Sunday 30 April 2017

নোবেল মেডেলের কথা

নোবেল পদকের নানা গল্প


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়





        তোমাদের মনে আছে নিশ্চয় ২০০৪ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পদক বিশ্বভারতী থেকে চুরি হয়ে গিয়েছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই বহু অনুসন্ধান করেও তার আর কোনো খোঁজ পায়নি। নোবেল কমিটি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই পদকটির একটি প্রতিরূপ পাঠিয়ে দিয়েছিল। সম্প্রতি সেই চুরির খবরটা  আর একবার সামনে এল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শান্তিনিকেতনে গিয়ে বলেছেন এবারে রাজ্য সরকার পদক উদ্ধারের চেষ্টা করতে চায়। অনেকেই অবশ্য এতদিন পরে সেই পদক আর ফিরে পাওয়া সম্ভব কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তবে আমাদের আজকের গল্প রবীন্দ্রনাথের সেই মেডেল নিয়ে নয়। অনেক সময়ই নানা কারণে নোবেল পদক সংবাদে এসেছে। সেই রকম কয়েকটা ঘটনা আজ তোমাদের বলব।
A black and white photo of a bearded man in his fifties sitting in a chair.
        
আলফ্রেড নোবেল
      তোমরা সকলেই জানো সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করেছিলেন। ডিনামাইট ও তাঁর অন্যান্য নানা আবিষ্কার থেকে তিনি বিপুল অর্থ উপার্জন করেছিলেন। সেই সম্পত্তি থেকে তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর মৃত্যুর পরে পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ও শান্তির ক্ষেত্রে মানবজাতির কল্যাণে যাঁরা সর্বোত্তম কাজ করেছেন, তাঁদের পুরস্কার দেওয়া হয়। ১৯০১ সাল থেকে নোবেল পুরস্কার দেয়া শুরু হয়েছে। ১৯৬৮ সাল থেকে সুইডিশ ব্যাঙ্ক অর্থনীতির ক্ষেত্রে নোবেল স্মৃতি পুরস্কার চালু করেছে। পুরস্কারপ্রাপকদের একটি শংসাপত্র অর্থাৎ সার্টিফিকেট, কিছু অর্থ ও একটি সোনার পদক দেওয়া হয়। সব পদকগুলির ওজন সমান নয়, গড় ওজন ১৭৫ গ্রামের কাছাকাছি ১৯৮০ সালের আগে ২৩ ক্যারাট সোনা দিয়ে পদকগুলি তৈরি করা হত। বর্তমানে ১৮ ক্যারাট সোনা দিয়ে পদক তৈরি করে তার উপর ২৪ ক্যারাট সোনার প্রলেপ দেওয়া হয়। পদকের এক পাশে থাকে আলফ্রেড নোবেলের প্রতিকৃতি।  অন্য পাশে বিভিন্ন বিষয়ের জন্য আলাদা আলাদা নকশা খোদাই করা থাকে। পদকের ধারে উৎকীর্ণ থাকে প্রাপকের নাম সারা পৃথিবীতে যত পদক দেওয়া হয়, তার মধ্যে সম্ভবত এটাই সবচেয়ে পরিচিত ও বিখ্যাত
        অর্থনীতির পুরস্কারের কথা ছেড়ে দিলাম, সেটা অনেক পরে শুরু হয়ে হয়েছে ১৯০২ সাল থেকে অন্য পদকগুলির একই নকশা অনুযায়ী বানানো হয়ে আসছে পুরস্কার তো ১৯০১ সাল থেকে দেওয়া হচ্ছে, তাহলে প্রথম বছর কী হয়েছিল? ১৯০১ সালে নোবেল পদকের নকশাই ঠিক হয়নি। সে বছর তাই নোবেল বিজয়ীদের একটা স্মারক পদক দেওয়া হয়েছিল। ১৯০২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রথম পদকটি ঢালাই করা হয়েছিল। তাই আসল পদক বিজেতাদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছিল ১৯০২ সালে প্রথম বছরের  বিজয়ীদের সেই তালিকায় ছিলেন এমিল ফন বেরিং (জার্মানি, চিকিৎসা), উইলহেল্ম রন্টজেন (জার্মানি, পদার্থবিদ্যা), জ্যাকোবাস হেনরিকাস ভ্যান টি হফ (হল্যান্ড, রসায়ন), সুলি প্রুধোম (ফ্রান্স, সাহিত্য) শান্তির নোবেল পুরস্কার ফরাসি অর্থনীতিবিদ ফ্রেডেরিক পাসি এবং রেড ক্রসের প্রতিষ্ঠাতা সুইজারল্যাণ্ডের হেনরি ডুন্যান্টের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।   
        ১৯০২ সালে পদার্থবিদ্যার নোবেল পুরস্কার পান একত্রে তিন ফরাসি বিজ্ঞানী -- আঁরি বেকেরেল এবং পিয়ের ও মেরি কুরি ১৯১১ সালে মেরি কুরি এককভাবে রসায়নে নোবেল জয় করেন। পিয়ের তার আগেই এক দুর্ঘটনাতে প্রাণ হারিয়েছেন। ১৯১৪ সালে জার্মানি ফ্রান্স আক্রমণ করলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়। ফরাসি সরকার দেশ রক্ষার জন্য নাগরিকদের কাছে সোনা রূপা দানের জন্য আবেদন করেন। মেরি তাঁর দুটি নোবেল পদক সরকারকে দান করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফরাসি জাতীয় ব্যাঙ্ক তা নিতে রাজি হয়নি। তিনি তাঁর পুরস্কারের অর্থ দিয়ে ওয়ার বণ্ড কেনেন। গবেষণা সম্পূর্ণ বন্ধ করে মেরি যুদ্ধের সময় আহত সৈনিকদের চিকিৎসাতে ব্রতী হয়েছিলেন।
        সব নোবেল বিজয়ীই যে মেরির মতো উদার ও মহৎ ছিলেন তা নয়। ইতালির নাট্যকার লুইগি পিরান্দেল্লো ১৯৩৪ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার পরের বছর ইতালি কোনো কারণ ছাড়াই আবিসিনিয়া (বর্তমানে ইথিওপিয়া) আক্রমণ করেছিল। মুসোলিনির এই ঘৃণ্য কাজের সমর্থনে পিরান্দেল্লো তাঁর পদক দান করেছিলেন যাতে সেটা গলিয়ে সোনাটা বিক্রি করে যুদ্ধের সাহায্যার্থে ব্যবহার করা যায়।  
        রবীন্দ্রনাথের পদক ছাড়াও আরও তিনটি নোবেল পদক চুরি হয়েছিল, তবে তাদের মধ্যে দুটি উদ্ধার হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলে থেকে ২০০৭ সালে আর্নেস্ট লরেন্সের পদক চুরি হয়ে যায়। লরেন্স সাইক্লোট্রন যন্ত্র তৈরি করা জন্য ১৯৩৯ সালে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরে জানা যায় এক ছাত্র মজা করার জন্য চুরিটা করেছিল। ১৯৮৫ সালে ইন্টারন্যাশনাল  ফিজিসিয়ানস ফর দি প্রিভেনশন অফ নিউক্লিয়ার ওয়ার, এই সংস্থাকে শান্তির নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়েছিল। সেই পদক ২০০৬ সালে চুরি হয়েছিল, তবে কয়েক মাসের মধ্যেই ঘটনাচক্রে তা উদ্ধার হয়। রবীন্দ্রনাথের পদক ছাড়াও আরো একটি মেডেল চুরির পরে আর উদ্ধার করা যায়নি। ব্রিটিশ লেবার পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আর্থার হেন্ডারসন ১৯৩৪ সালে শান্তির নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ২০১৩ সালে নিউকাসলের মেয়রের অফিস থেকে তা চুরি হয়েছে তার আর সন্ধান মেলেনি
        নোবেল পদক নিজের আলমারিতে সাজিয়ে রাখতে গেলে যে মানবজাতির কল্যাণে কাজ করতেই হবেই, সে কথা আর সত্যি নয়। টাকার জোর থাকলে পদক কিনতেও পাওয়া যায়। এখনো পর্যন্ত উনিশটি নোবেল পদক বিক্রি হয়েছে বলে জানা গেছে অধিকাংশ সময়েই পরিবার বা উত্তরাধিকারীদের পক্ষ থেকে পদকগুলো নিলামে তোলা হয়েছে সব সময় যে তার ক্রেতা পাওয়া যায়, তাও নয়। মার্কিন সাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনার ১৯৪৯ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। পদার্থের দশা পরিবর্তনের উপর গবেষণার স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৮২ সালে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন কেনেথ উইলসন। পদক দুটি গত দুবছরে নিলামে উঠলেও সর্বনিম্ন দাম দিয়ে কেনার মতো লোক পাওয়া যায়নি তবে এ ঘটনাগুলি ব্যতিক্রম, অধিকাংশ সময়েই নোবেল পদক নিলামে ভালো দামে বিক্রি হয়ে যায়   
Carl Van Vechten - William Faulkner.jpg
উইলিয়াম ফকনার

        যে সব বিজয়ীর মেডেল তাঁদের মৃত্যুর পরে বিক্রি হয়েছে তাঁদের মধ্যে আছেন শান্তির জন্য পুরস্কার জয়ী উইলিয়াম ক্রেমার (১৯০৩) এবং অ্যারিস্টাইড ব্রায়ান্ড (১৯২৬)। তাঁদের পদকগুলির দাম সেরকম বেশি ওঠেনি। কিন্তু গত দু তিন বছরের মধ্যে বেশ কয়েকটি পদক নিলামে উঠেছে এবং ভালো দামে বিকিয়েছে ডি এন এর গঠন আবিষ্কারের জন্য ১৯৬২ সালে চিকিৎসাতে যুগ্ম ভাবে পুরস্কার পেয়েছিলেন ফ্রান্সিস ক্রিক ও জেমস ওয়াটসন। ২০১৩ সালে নিলামে ক্রিকের পদকের দাম ওঠে বাইশ লক্ষ ডলার নিঊট্রন আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৫ সালে জেমস চ্যাডউইক পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পেয়েছিলেন। ২০১৪ সালে নিলামে সেই পদক  বিক্রি হয়েছে প্রায় তিন লাখ তিরিশ হাজার ডলারে আর্জেন্টিনার প্রথম নোবেল বিজেতা কার্লোস লামাসের (শান্তি, ১৯৩৬) নোবেল পদক ২০১৪ সালে এক বন্ধকি দোকানে খুঁজে পাওয়ার পরে এগার লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়।  আর্জেন্টিনা সরকার তা আবার কিনে দেশে ফেরত আনার চেষ্টা করছে।
        ২০১৫ সালে বেশ কয়েকটি নোবেল পদক হাত বদল হয়। ১৯৭১ সালে অর্থনীতির নোবেল পুরষ্কার জয়ী সাইমন কুজনেৎসের পদক বিক্রি হয় তিন লক্ষ নব্বই হাজার ডলারে ১৯৬৩ সালে চিকিৎসার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন অ্যালান হজকিন। তাঁর মেয়ে প্রায় আট লক্ষ ডলারের বিনিময়ে সেই পদকটি বিক্রি করেছেন। বেলজিয়ামের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অগুস্ত বিয়ারনের্ট (১৯০৯) শান্তির জন্য কাজের  স্বীকৃতিস্বরূপ পুরস্কার পেয়েছিলেন। সেই পদক বিক্রি হয়েছে ছলক্ষ ছেষট্টি হাজার ডলারে ১৯৩৪ সালে জর্জ মিনোট রক্তাল্পতা রোগের উপর গবেষণার জন্য চিকিৎসাশাস্ত্রে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছিলেন। তাঁর পদকটি পাঁচলক্ষ পঁয়তাল্লিশ হাজার ডলারে গত বছর নিলামে বিক্রি হয়েছে। 
        সব সময়েই যে প্রাপকের মৃত্যুর পরে নোবেল পদক বিক্রি হয়েছে, তা নয় বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ডেনমার্কের নিলস বোর পরমাণুর উপর গবেষণার জন্য ১৯২২ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। ১৯৪০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ফিনল্যাণ্ডের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধ শেষের পর ফিনল্যাণ্ডের ত্রাণকার্যের সহায়তার জন্য বোর ১৯৪০ সালের ১২ই মার্চ তাঁর পদকটি নিলামে তোলেন। অজ্ঞাত পরিচয় এক ক্রেতা সেটিকে কিনে পরে আবার ডেনমার্কের এক মিউজিয়ামে  দান করে দেন। আরও দুটি নোবেল পদকের সঙ্গে বোরের নাম জড়িত, সে গল্প তোমাদের পরে বলছি। ১৯৮৮ সালে মিউয়ন নিউট্রিনো  মৌলিক কণা আবিষ্কারের জন্য পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরষ্কারের অংশ পেয়েছিলেন লিওন লেডারম্যান। পরীক্ষাগারে হিগস বোসন খোঁজা বিষয়ে ১৯৯৩ সালে লেখা তাঁর বই দি গড পার্টিকলবিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। বর্তমানে তিনি স্মৃতিভ্রংশ রোগের শিকার। চুরানব্বই বছর বয়সী এই বিজ্ঞানীর চিকিৎসার খরচের জন্য তাঁর স্ত্রী গতবছর নোবেল পদক নিলামে তুলেছিলেন। সাড়ে সাত লক্ষ ডলারের বেশি দাম ওঠে পদকটির।  
        ক্রিকের সঙ্গে ডি এন এর গঠন আবিষ্কারের জন্য নোবেল ভাগ করে নিয়েছিলেন জেমস ওয়াটসন বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য তিনি বিশেষ পরিচিত তিনি ২০১৪ সালে তাঁর পদকটিকে নিলামে তোলেন।  রাশিয়ান ধনকুবের আলিশার উসমানভ একচল্লিশ লক্ষ ডলারে পদকটি কিনে আবার ওয়াটসনকেই ফিরত দিয়ে দেন। ওয়াটসন এই অর্থ গবেষণার কাজে ব্যায় করবেন। এটাই এখনও পর্যন্ত এটাই নোবেল পদকের বিক্রি থেকে পাওয়া অর্থের রেকর্ড। রসায়নে ১৯৯৩ সালে পুরষ্কার জয়ী ক্যারি মুলিসের পদক এ বছর ছলক্ষ পঁয়ষট্টি হাজার ডলারে বিক্রি হয়েছে। ১৯২২ সালে আইসোটোপ আবিষ্কার এবং প্রথম মাস স্পেক্ট্রোগ্রাফ তৈরির জন্য রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন ফ্রান্সিস অ্যাসটন। তাঁর পদকটি এবছর নিলামে উঠেছে।  
        নোবেল পদক কী কখনো লুকিয়ে রাখতে হয়েছে? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুটি পদককে ঘিরে যে ঘটনা ঘটেছিল, তা অনেক রোমাঞ্চ কাহিনিকেও হার মানাবে। তোমরা হয়তো জানো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে হিটলারের শাসনাধীন ফ্যাসিস্ট জার্মানিতে ইহুদিদের উপর এবং হিটলারের বিরোধী সমস্ত মানুষের উপর চরম নির্যাতন নেমে এসেছিল। আইনস্টাইন সহ অনেক বিজ্ঞানী প্রাণ বাঁচাতে দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এক্স রে বিষয়ে গবেষণার জন্য ম্যাক্স ফন লউ ১৯১৪ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন হিটলারের বিরোধী বহু ইহুদি বিজ্ঞানীকে দেশ ছাড়তে তিনি গোপনে সাহায্য করেছিলেন প্রকাশ্যে হিটলারের বিরোধিতার জন্যও তিনি যে কোনো সময় নাৎসিদের আক্রমণের মুখোমুখি হতে পারতেন।  সে কারণে তিনি তাঁর নোবেল পদকটি বাঁচানোর জন্য গোপনে জার্মানির বাইরে ডেনমার্কে নিলস বোরের কাছে পাঠিয়ে দেন। নিলস বোর তরুণ ইউরোপীয় বিজ্ঞানীদের অভিভাবকের মতো ছিলেন দেশছাড়া জার্মান ইহুদি বিজ্ঞানীদের তিনি নানা ভাবে সাহায্য করছিলেন। বোরের কাছে তখন আরও একটি নোবেল পদক ছিল। ১৯২৫ সালে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার ভাগ করে নিয়েছিলেন জেমস ফ্রাঙ্ক ও লুডভিগ হার্জ। ফ্রাঙ্ক নিজে ছিলেন ইহুদি, অন্যান্য ইহুদি বিজ্ঞানীদের তিনি দেশ ছাড়তে সাহায্য করেছিলেন তার উপর তিনি প্রকাশ্যে হিটলারের বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। তাই হিটলারের শাসনাধীন জার্মানিতে তাঁর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছিল ১৯৩৩ সালে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়। সে সময় সোনা জার্মানি থেকে বিদেশে নিয়ে যাওয়া ছিল বেয়াইনি, ধরা পড়লে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত। তাই ফ্রাঙ্ক নিজের সঙ্গে মেডেলটি নিয়ে যাওয়ার সাহস পাননি। সেটিও গোপনে বোরের কাছে পৌঁছয়।  
        জার্মানির পোল্যাণ্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর। এক মাসের মধ্যেই পোল্যাণ্ড আত্মসমর্পণ করেছিল। এই যুদ্ধে ফ্রান্স ও ইংল্যাণ্ড    জার্মানির বিরোধিতা করেছিল। ডেনমার্ক ও নরওয়ে যুদ্ধে কোনো পক্ষেই যোগদান করেনি। কিন্তু ১৯৪০ সালের ৯ই এপ্রিল জার্মানি বিনা প্ররোচনায় এই দুটি ছোট্ট দেশকে আক্রমণ করে। জার্মানির সামরিক শক্তির বিরোধিতা করার কোনো ক্ষমতাই ডেনমার্কের ছিল না। মাত্র ছ ঘন্টার মধ্যেই রাজধানী কোপেনহেগেন সমেত গোটা দেশ জার্মান সৈন্যদের অধীনে চলে যায়। 

Photograph showing the head and shoulders of a man in a suit and tie
     George de Hevesy.jpg

নিলস বোর                     জর্জ ডে হেভেসি

     জার্মানরা এত দ্রুত দেশ দখল করে নেওয়াতে নিলস বোর সাংঘাতিক বিপদের মুখোমুখি হলেন। তিনি যে শুধু ইহুদি বিজ্ঞানীদের সাহায্য করছিলেন তা নয়, নিজে খ্রিস্টান হলেও তাঁর মা ছিলেন ইহুদি। তাই হিটলারের শাসনাধীনে তিনি যে কোনো সময় গ্রেফতার হতে পারেন। এর উপর  অফিসে তাঁর টেবিলে পড়ে রইয়েছে ফন লউ ও ফ্রাঙ্কের নাম খোদাই করা দুটি নোবেল পদক। এত দ্রুত যে জার্মান সৈন্য কোপেনহেগেন দখল করে নিতে পারবে, তা কারোরই ধারণা ছিল না, তাই আগে থেকে পদকগুলি লুকানোর কথা বোর ভাবেননি।  জার্মানি থেকে বেআইনি পথে ছাড়া এই দুই পদক তাঁর কাছে এসে পৌঁছোতে পারে না।  ফ্রাঙ্ক না হয় হিটলারের নাগালের বাইরে আমেরিকাতে, কিন্তু পদক সমেত ধরা পড়লে বোর এবং ফন লউয়ের কারাবাস নিশ্চিত -- এমনকি মৃত্যুদণ্ডও হতে পারে। বোরের ইন্সটিটিউট জার্মানরা খানাতল্লাস করবেই, তার আগে যেমন করে হোক পদকদুটি লুকোতে হবে। কিন্তু কিভাবে?
        বোরের পরীক্ষাগারে কাজ করছিলেন হাঙ্গারির রসায়ন বিজ্ঞানী জর্জ ডে হেভেসি। তিনিও ছিলেন ইহুদি। ১৯৪৩ সালে তিনি নোবেল পুরষ্কার পাবেন।  কী করা যায় তা নিয়ে বোর পরামর্শ করেন ডে হেভেসির সঙ্গে ডে হেভেসি প্রথমে মাটির তলায় পুঁতে রাখার কথা বলেন। বোরের সেটাকে খুব নিরাপদ মনে হয়নি তাঁর পরীক্ষাগার তো সার্চ হবেই। কাছাকাছি কোথাও নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ির চিহ্ণ পেলে সহজেই বোঝা যাবে মাটির তলায় কিছু লুকিয়ে রাখা হয়েছে। অন্য কোনো উপায় ভেবে বার করতে হবে।
        রসায়নবিদ ডে হেভেসি এবার রসায়নের কোনো পদ্ধতির কথা ভাবতে বসেন। সোনা সহজে রাসয়ানিক বিক্রিয়াতে অংশ নেয় না। সাধারণ অ্যাসিডেও সোনাকে গলানো যায় না। একমাত্র তিন ভাগ হাইড্রোক্লোরিক ও এক ভাগ নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরি অ্যাকোয়া রিজিয়া বা অম্লরাজ সোনাকে দ্রবীভূত করতে সক্ষম। ডে হেভেসি অ্যাকোয়া রিজিয়ার মধ্যে পদকদুটিকে ফেলে দিলেন। উদ্বেগ কমছে না, সোনা গলতে অনেক সময় নেবে -- কিন্তু যে কোনো সময়েই জার্মান হানাদাররা ইন্সটিউটে ঢুকে পড়বে। ডে হেভেসির চোখের সামনেই স্বচ্ছ দ্রবণ অবশেষে উজ্জ্বল কমলা রঙে রূপান্তরিত হয়ে গেল। তিনি বিকারটাকে পরীক্ষাগারের তাকে তুলে রাখলেন।
        জার্মানরা বোরের ইন্সটিউটে ঢুকেছিল, কিন্তু ভেঙেচুরে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কিছু পায়নি। ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে খবর আসে ডেনমার্কের ইহুদিদের ১লা অক্টোবর গ্রেফতার করে জার্মানিতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে। ঐ ক্যাম্পগুলোতে ষাট লক্ষ ইহুদিকে খুন করা হয়েছিল। সে কথা তখনও সবাই জানত না, কিন্তু নামটাই ভয় ধরানোর পক্ষে যথেষ্ট ছিল। যে কোনো সময় নিলস বোর গ্রেফতার হতে পারেন, কারণ তাঁর মা ইহুদি। ড্যানিশ বিদ্রোহীদের সহায়তায় বোর সুইডেনে পালিয়ে যান। প্রায় একই সময়ে ডে হেভেসিও গোপনে ডেনমার্ক ছাড়েন। ডেনমার্কের বিদ্রোহী এবং অন্যান্য সাধারণ মানুষের সহায়তায় সে দেশের সাড়ে সাত হাজার ইহুদিদের প্রায় সবাই তিন দিনের মধ্যে সুইডেনে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কমলা রঙের দ্রবণসহ বিকারটা ইনস্টিটিউটের তাকেই তোলা থাকে। ১৯৪৫ সালে মিত্রশক্তির সহায়তায় ডেনমার্ক মুক্ত হয়। যুদ্ধে জার্মানির পরাজয়ের পর ডে হেভেসি কোপেনহেগেনে ফিরে যান। দেখেন সেই বিকার সে রকমভাবেই তাকে বসানো আছে। ডে হেভেসি এবার সেই দ্রবণ থেকে পদকের সোনাটাকে বার করে আনেন। সেই ধাতু থেকে নোবেল কমিটি আবার দুটি পদক তৈরি করে। ১৯৫২ সালে ফন লউ এবং ফ্রাঙ্ককে সেই পদকদুটি দেওয়া হয়।
        নোবেল পদক নিয়ে কিছু গল্প তোমাদের বললাম। আজ পর্যন্ত ঠিক নশো নোবেল পদক দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে অল্প কয়েকটি মাত্র এভাবে সংবাদ শিরোনামে এসেছে। তবে শেষ পর্যন্ত পদক নয়, পুরষ্কারের অর্থও নয়, পুরষ্কার বিজয়ী বিশ্বজোড়া যে সম্মান পান সেটাই সবসেরা পুরষ্কার। রবীন্দ্রনাথের পদক চুরি গেলে তাঁর মর্যাদার বিন্দুমাত্র হানি হয় না। তিনি আমাদের হৃদয়ে যে আসনে বসে আছেন, সেখান থেকে তাঁকে সরাবে এমন সাধ্য কার?

(প্রকাশিতঃ
 পথের সুজন, নভেম্বর ২০১৬, পরিমার্জিত)
পুনশ্চঃ সবার উপরের ছবিটা আমার নিজের তোলা, কিন্তু এটা আসল নোবেল পদক নয়। নোবেলজয়ী ইচ্ছা করলে পদকের তিনটে গিলটি করা ব্রোঞ্জের তৈরি প্রতিরূপ  পেতে পারেন। হিগ্‌স বোসন আবিষ্কারের জন্য ২০১৩ সালে পিটার হিগ্‌স পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, একটা প্রতিরূপ তিনি এডিনবারের জাতীয় সংগ্রহশালাকে দান করেছিলেন। সেটা দেখার ও ছবি তোলার সুযোগ আমার হয়েছিল। 

ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন



ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোনঃ সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


আজ থেকে কুড়ি বছর আগেও সকলের পকেটে মোবাইল ফোন ছিল না। ইন্টারনেট কথাটাও ছিল অপরিচিত। যারা জ্ঞান হওয়া থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের এই দুই আবিষ্কারকে দেখছে, তাদের পক্ষে সে সময়কে কল্পনা করাও শক্ত। কয়েকদিন আগে একটি অল্পবয়সী ছেলে তার বাবাকে জিজ্ঞাসা করছিল মোবাইল ফোন আসার আগে সময় রাস্তায় বেরিয়ে কেমন করে যোগাযোগ রাখতে হত। এক কথায় এর উত্তর, যোগাযোগ রাখা যেত না। এমনকি আজকে আমরা যাকে ল্যাণ্ডলাইন বলি, ১৮৭৬ সালে আবিষ্কৃত সেই টেলিফোন, তাও তখন ভারতের ঘরে ঘরে ছিল দুর্লভ। গত দুই দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে বিপ্লব ঘটেছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। 


মোবাইল ফোন পৃথিবীটাকে অনেক ছোটো করে দিয়েছে। ইন্টারনেটের সঙ্গে জুড়ে সে মুহূর্তের মধ্যে আমাদের হাতে নানা দরকারি তথ্য তুলে দিয়েছে। জীবনকে করে দিয়েছে অনেক সহজ। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রায় কোনো আবিষ্কারই অবিমিশ্র ভালো নয়, তার প্রয়োগের পদ্ধতির উপর নির্ভর করে সে আমাদের উপকার করবে না অপকার। মোবাইল ফোনও তার বাইরে নয় – আমাদের জীবনে তার ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। এই নিবন্ধে আমরা তার কয়েকটা দিক দেখব। শুরুতেই একটা কথা বলে রাখা ভালো – বর্তমান লেখক শারীরবিদ্যা বা মনস্তত্ত্ব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নন। অন্য যে কোনো সচেতন সাধারণ মানুষের মতো এ বিষয়ে আগ্রহ থেকেই এই লেখা। তবে এ কথা নিশ্চিত যে মোবাইল ফোনের ক্ষতিকর দিক এবং তা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায়, এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পক্ষে দুই দশক সময়টা খুব বেশি নয়। তাই শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। 


প্রথমেই দেখা যাক মোবাইল ফোন আমাদের কোনো শারীরিক ক্ষতি করে কিনা। মাঝে মাঝে আমরা খবরে দেখেছি মোবাইল ফোন ক্যান্সার বা হার্ট অ্যাটাকের মতো প্রাণঘাতী রোগকে ত্বরান্বিত করে। এর পিছনে কতটা সত্যতা আছে? মোবাইল ফোনে ব্যবহার হয় রেডিওতরঙ্গ। ওয়ার্ন্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার ২০১১ সালের বলেছে রেডিওতরঙ্গ থেকে ক্যান্সার হতেও পারে (Group 2B: Possibly carcinogenic to humans)। তবে তাতে সাংঘাতিক ভয় পাওয়ার কিছু আছে বলে মনে হয় না। এই তালিকাতে আরও অনেক জিনিসের নাম পাওয়া যায় যেগুলো আমরা সবাই ব্যবহার করি। কফির নাম এ বছরের গোড়া পর্যন্ত এই তালিকায় ছিল। এখনো আচার, ঘৃতকুমারী পাতার রস বা নারকেল তেল দিয়ে তৈরি কিছু সাবান বা শ্যাম্পুকে সেখানে পাওয়া যাবে। কাজেই শুধুমাত্র তালিকা টু বিতে নাম আছে এখানেই না ছেড়ে দিয়ে এ বিষয়ে আরও একটু অনুসন্ধান করা যাক।


আমরা সবাই জানি গামা রশ্মি বা এক্স রশ্মি জীবদেহে ক্যান্সার ঘটাতে সক্ষম। গামা রে, এক্স রে, মাইক্রোওয়েভ বা রেডিওতরঙ্গ, এরা সবাই তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ। (আলোও তাই।) প্রশ্ন আসে তাহলে কী মোবাইল ফোন বা মাইক্রোওয়েভ থেকে ক্যান্সার হতে পারে। মনে রাখতে হবে গামা বা এক্স রশ্মির শক্তি অনেক বেশি, তাই তারা জীবকোশের মধ্যে আয়নন ঘটাতে পারে। এই আয়নন ক্রোমোজোমের পরিবর্তন ঘটিয়ে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। মাইক্রোওয়েভ বা রেডিও ওয়েভ, এদের শক্তি অনেক কম, তাই কোষের মধ্যে আয়ননের ক্ষমতা এদের নেই। তাই অন্তত এই কারণে মোবাইল ফোন থেকে ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। পৃথিবীব্যাপী বেশ কয়েকটি সমীক্ষা চালিয়েও মোবাইল ফোন ও ক্যান্সারের মধ্যে নিশ্চিত কোনো যোগসূত্র পাওয়া যায়নি। হৃৎপিণ্ড, মানবদেহে গ্লুকোজ বিপাক বা মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালনের উপরে মোবাইল ফোনের প্রভাব বিষয়েও অনেক সমীক্ষা হয়েছে, কিন্তু খুব নিশ্চিত ভাবে বিশেষ কিছু পাওয়া যায়নি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে, এ ধরণের সমীক্ষা দীর্ঘদিন ধরে অনেক মানুষের উপর চালাতে হয় —তবেই কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। তাই স্থির সিদ্ধান্ত করার আগে আমাদের এখনো অপেক্ষা করতে হবে। 


তবে মোবাইল ফোন শরীরের অন্য রকমের ক্ষতি যে করে সে বিষয়ে অনেক বিশেষজ্ঞই নিশ্চিত। বিশেষ করে এখানে দৃষ্টিশক্তির কথা বলতেই হবে। ফোনের উজ্জ্বল নীলচে সাদা আলো চোখের পক্ষে ক্ষতিকারক। মনে রাখবেন বিবর্তনের ফলে আমাদের চোখ সূর্যের হলদেটে সাদা আলোতে অভ্যস্ত – বর্ণালীর অন্যান্য অংশ দেখতে আমাদের চোখকে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়। ফোনের ছোটো ছোটো লেখা বা ছবি দেখতেও চোখের উপর চাপ পড়ে। তার থেকে মাইওপিয়া বা দৃষ্টিক্ষীণতা হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে শুধুমাত্র ফোনের উপর দোষ দিলে সম্ভবত আমরা একদেশদর্শিতার স্বাক্ষর রাখব। কম্পিউটার, ফ্ল্যাট স্ক্রিন টিভি – এ ধরণের অনেক আধুনিক যন্ত্র আমাদের দৃষ্টি শক্তির উপর এই রকম প্রভাব ফেলে। তেমনি সারাক্ষণ কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শোনা যে কানের ক্ষতি করে, তাতেও সন্দেহ নেই। 


শারীরবৃত্তীয় প্রভাবের কথা ছাড়াও মোবাইল ফোন, আরও বিশেষ করে বললে স্মার্ট ফোন, আমাদের জীবনকে নানা ভাবে প্রভাবিত করে। বর্তমানে পৃথিবীর মানুষের এক চতুর্থাংশ এই ফোন ব্যবহার করে এবং এই সংখ্যাটা খুব তাড়াতাড়ি বাড়ছে। আমাদের সামাজিক রীতিনীতি, আমাদের ব্যবহারকে স্মার্ট ফোন অনেকভাবে যে পালটে দিয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। আমরা এখন অনেকভাবেই এই ফোনের উপর নির্ভরশীল। তাই সে বিষয়েও নজর দেওয়া প্রয়োজন। এদের অনেকগুলোই অবশ্য কম্পিউটার বা ল্যাপটপের জন্যেও সত্যি, কিন্তু এই যন্ত্রগুলো কখনোই স্মার্ট ফোনের মতো সহজে সর্বত্র ব্যবহার যোগ্য নয়। তাই আমাদের আলোচনার সিংহভাগ অধিকার করে থাকবে স্মার্ট ফোন।


ইন্টারনেটে বা খবরের কাগজে খুঁজলেই স্মার্ট ফোনের নানা রকম কুপ্রভাব সম্পর্কে খবর পাওয়া যাবে। আশেপাশের লোকের থেকেও আরও নানা কথা শোনা যায়। তার মধ্যে কয়েকটা আমার কাছে অন্তত খুব হাস্যকর মনে হয়েছে। যেমন সেদিন ইন্টারনেটে পড়লাম গুগল ম্যাপ এবং মোবাইল ফোনে জিপিএস-এর কল্যাণে মানুষ ম্যাপ দেখতে ভুলে যাচ্ছে। বুঝতেই পারছেন এখানে মূলত পশ্চিমের উন্নত দেশ – যেখানে গাড়ি চালানো খুব স্বাভাবিক একটা স্কিল -- সেখানকার কথাই বলা হয়েছে। লেখকের মনে হয়েছে শেখা জিনিস ভুলে যাওয়া এবং তা নিয়ে চিন্তা না করাটা খুব ভালো কথা নয়। বাক্যটা ছিল ‘There is nothing that can define being dumber better than losing a skill, and not caring about it, don’t you think?’


আমার কিন্তু মনে হয় অনেক স্কিল বা দক্ষতা সমাজের, এবং আরও বিশেষভাবে বললে প্রযুক্তির, বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অনাবশ্যক হয়ে পড়ে। মানচিত্র দেখতে শেখাকে এমন কোনো আবশ্যিক প্রয়োজন বলে মেন নেয়া আমার কাছে শক্ত। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ গাড়ি চালাতে জানেন না এবং মানচিত্র দেখতে তাঁদের কালেভদ্রে প্রয়োজন হয়। তবে মানচিত্র দেখতে পারাটা অপ্রয়োজনীয় হতে পারে, কিন্তু সব সমস্যাকে এরকম হালকা ভাবে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আমরা আর কোন কোন দক্ষতা হারাচ্ছি দেখা যাক।


আমাদের দেশে ইংরাজি ভাষা শেখার একটা সমস্যা অধুনা দেখা দিয়েছে। এস এম এসের মাধ্যমে বার্তা বিনিময়ে জন্য, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম, অনেক সাধারণ কথাকে সংক্ষিপ্ত করে নিয়েছে। lol বা bbl আমরা অনেকেই মেসেজে দেখেছি। ইন্টারনেটে এক তালিকায় দেখলাম দুহাজার পাঁচশ এ রকম শর্ট কোড বা সংক্ষিপ্ত রূপ রয়েছে। প্রতিদিন এই সংখ্যাটা বাড়ছে। সংখ্যাটা মোটেই ছোটো নয়, এক হিসাবে দেখা যায় যে পরিভাষা বা টেকনিকাল শব্দ বাদ দিলে প্রতিদিন ইংরাজি ভাষায় যত শব্দ কাজে লাগে, তার নব্বই শতাংশই মাত্র তিন হাজার শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কে জানে, আড়াই হাজার শর্ট কোড হয়তো ভবিষ্যতে এক নতুন ভাষা তৈরির দিকে এগোচ্ছে। তা এগোক, কিন্তু এই মুহূর্তে এই সংক্ষিপ্ত রূপের ব্যবহার এবং বানান ঠিক করার সফটওয়্যারের সুবিধার জন্য কোনো শব্দের বানান মনে রাখার কোনো প্রয়োজন হচ্ছে না। আমাদের ছেলেমেয়েরা বানান শিখছে না বলে শিক্ষকরা হা হুতাশ করছেন। 


একটু গভীর চিন্তা করলে দেখব একই সমস্যা আরও বহু নানা ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বিশেষ করে ইন্টারনেটের কল্যাণে নানা তথ্য, কখনো ঠিক কখনো ভুল, খুব সহজে পেয়ে যাচ্ছি। আমাদের ছোটবেলার পড়ায় বহু তথ্য মাথায় রাখতে হত। এখন প্রশ্নের উত্তর, রচনা, হোমওয়ার্ক, এমনকি স্কুলের প্রজেক্টও একটু খোঁজ করলে নেট থেকে পাওয়া যায়। স্মার্ট ফোনের সুবাদে সবই এখন সহজলভ্য। তার ফলে ছাত্রছাত্রীদের অনেক কিছুই নিজেদের আর করতে হচ্ছে না। 


শিক্ষার ক্ষেত্রে এই সমস্যা নিশ্চয় খুব গভীর। কিন্তু এর সমাধান কী? আমরা চাইলেই তো আর ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাবে না। কোন স্কিলটা আমাদের দরকারি আর কোন দক্ষতা আজকের দিনে সম্পূর্ণ অনাবশ্যক – সে কথা কেমন করে ঠিক করা যাবে তা আমি অন্তত জানি না। একসময় নামতা শেখাটা খুব দরকারি ছিল, ছোটোখাটো যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ মুখে মুখেই করে নেওয়া যেত। গত বইমেলাতে দুশ পঞ্চাশ টাকা দামের বইতে দশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্টের পর বিল কত হয় তার জন্য কোনো একটি দোকানে দোকানদারকে ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে দেখেছি। নামতা ভুলে গেছেন বলে বিক্রেতার কোনো সমস্যা যদি না হয়, তা হলে নামতা মুখস্থ করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কথা বলতে বানান জানার প্রয়োজন হয়না। ফোন বা কম্পিউটারে টাইপ করার সময়ও তাই, কারণ সফটওয়্যার ভুল বানান সংশোধন করে দেয়। হাতে লেখার সময়ই সমস্যাটা দেখা দিচ্ছে। আজকের দুনিয়ায় বানান মনে রাখার প্রয়োজনীয়তা নামতা মুখস্থ করারই মতো, নাকি তার দরকার অনেক বেশি, এ প্রশ্নের উত্তর আমার অজানা। 


ইন্টারনেট থেকে উত্তর টোকা, অর্থপুস্তক অর্থাৎ নোটবই থেকে উত্তর টোকা বা গৃহশিক্ষকের বলে দেয়া উত্তর টোকা – এই তিনের মধ্যে পার্থক্য আছে কি? আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মুখস্থ বিদ্যার গুরুত্বটা অনেকটাই বেশি, নিজে ভাবনা চিন্তার সুযোগ সেখানে কম। স্কুলে যে ভাবে করানো হয়েছে সে পদ্ধতিতে করা হয়নি বলে সঠিক অঙ্ক কেটে দেওয়া হয়েছে – এ ঘটনার মুখোমুখি হয়তো অনেকেই হয়েছেন। এই যুগে দাঁড়িয়ে সম্ভবত ভেবে দেখার সময় এসেছে এই শিক্ষা ব্যবস্থা আরও কতদিন আমরা অপরিবর্তিত রাখব। ইতিহাস মানে রাজাদের বংশ তালিকা, জ্যামিতি মানে উপপাদ্য মুখস্থ, বিজ্ঞান মানে সূত্র ও সংজ্ঞাগুলোকে দাঁড়ি কমা ফুলস্টপ সমেত খাতায় উগড়ে দেওয়া – মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে এই শিক্ষা পদ্ধতির প্রাসঙ্গিকতা বিচার করা দরকার। ইন্টারনেট আমাদের অনেক কিছু শেখাতে পারে, প্রয়োজন তার সঠিক ব্যবহার।


স্মার্ট ফোন আমাদের বিনোদনের সংজ্ঞাকে পালটে দিয়েছে। চলচ্চিত্র যেদিন হল থেকে টেলিভিশনের মাধ্যমে আমাদের ঘরে পা রেখেছিল, সেদিন যে পরিবর্তন হয়েছিল, তার থেকেও এই পরিবর্তন আরও ব্যাপক, তার তাৎপর্য আরও গভীর। খুব সহজেই, প্রায় বিনা ব্যায়ে সিনেমা, গান ইত্যাদি স্মার্ট ফোনে পৌঁছে যাচ্ছে, বন্ধুদের মধ্যে শেয়ার হয়ে যাচ্ছে। পথে ঘাটে মোবাইল ফোনে গেম খেলা নিশ্চয় সকলেরই নজরে এসেছে। ফেসবুক, টুইটারের মতো সোশাল মিডিয়ার কথা আগে চিন্তা করাই যেত না, এখন তা অনায়াসলভ্য। এর ভালো দিকগুলোকে নিশ্চয় অস্বীকার করা যাবে না। সম্প্রতি কাশ্মীরে আন্দোলনরত জনগণের উপর কেন্দ্রীয় সরকার যে আক্রমণ নামিয়ে এনেছে, শুধুমাত্র মূল ধারার সংবাদমাধ্যমের উপর নির্ভর করে থাকলে সে খবর আমাদের কাছে পৌঁছত কিনা সন্দেহ। বিশেষ করে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রতিবাদের রূপকে পালটে দিয়েছে সোশাল মিডিয়া। কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত এই মাধ্যমের বিপদগুলিকেও অস্বীকার করা যায় না। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেত্রে পড়াশোনাতে অমনোযোগের কথা প্রায়ই শোনা যায়। বিশেষ করে বয়ঃসন্ধির সময় এই সহজলভ্য বিনোদন, যা অনেক সময় অবাঞ্ছনীয় রূপও নিয়ে থাকে, তার প্রভাব খুব গভীর হতে পারে। 


এই সমস্যাটাও নতুন নয়। টেলিভিশন চালু হওয়ার সময় আমরা কিশোর মনের উপর তার প্রভাব নিয়ে চিন্তা করেছি। ভিডিও গেম আসক্তি নিয়ে এক সময় প্রচুর লেখালেখি হয়েছে। পুরানো অভ্যাসকে ভেঙে ফেলা অনেক নতুন প্রযুক্তিরই একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সেই সময় যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, তার প্রভাব পড়ে সমাজজীবনে। আজ আমরা সেই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। 


তবে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত সমাজে অল্প বয়সীদের মধ্যে এই মুহূর্তে সমস্যাটা যে আগের থেকে অনেক বেশি ব্যাপক তাতে কোনো সন্দেহ নেই। যৌথ পরিবার ভেঙে গিয়ে নিউক্লিয় পরিবার সৃষ্টির ফলে বাড়ছে একাকীত্ব। শহরে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলোর সুযোগ ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে। আমাদের জীবনের অপূর্ণ আশা পূরণের জন্য সাফল্যের ইঁদুর দৌড়ে আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্মের পর থেকেই ঠেলে দিচ্ছি। তাদের বোঝাচ্ছি যে তোমার নিজের সাফল্যকে পাখির চোখ করে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তার জন্য তোমার বন্ধুবান্ধবী, আত্মীয় স্বজন, পরিচিত, কারোর কথা ভাবার প্রয়োজন নেই। নয়া উদার নীতির যুগে সাফল্যই একমাত্র মাপকাঠি, নৈতিকতা আদৌ বিচার্য নয়। যেখানে বাবা মায়েরাই তাঁদের সন্তানদের সমাজবিচ্ছিন্ন করে রাখতে চান, সেখানে একাকীত্বের সঙ্কট গভীর হতে বাধ্য। যৌথ জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে অল্প বয়স্করা সহজলভ্য বিনোদনের কোনো বিকল্প হাতে পায় না। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলা দরকার। সমাজবিচ্ছিন্নতা শুধুমাত্র অল্পবয়সীদের সমস্যা নয়, অনেক বয়স্ক ব্যক্তিও এর শিকার হয়ে এই ধরণের বিনোদনকে বেছে নিয়েছেন।


এই সমস্যার কোনো চটজলদি সমাধান বর্তমান লেখকের অজ্ঞাত। আমরা হয়তো কাউকে ক্ষতিকর দিকগুলো বোঝাতে পারি, কিন্তু তার সামনে কোনো বিকল্প না তুলে ধরলে সে কাজটা অধিকাংশ সময়েই অরণ্যে রোদনে পর্যবসিত হতে বাধ্য। বিকল্প সৃষ্টির পথ দীর্ঘ এবং আয়াসসাধ্য। কিন্তু সেই দিকেই এগোনো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় আছে কী?


মনে হতেই পারে যে স্মার্ট ফোন ইত্যাদি যখন এতই সমস্যার, তখন সেটা থেকে দূরে সরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ। কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা সঠিক পথ হতে পারে, কিন্তু গোটা সমাজের ক্ষেত্রে এই সমাধান অচল। নতুন প্রযুক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। নানা দেশে নানা সময় সে চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু কখনোই তাতে দীর্গমেয়াদি সাফল্য আসেনি। নব আবিষ্কৃত প্রযুক্তিকে হৃদয়ঙ্গম করে, তাকে সঠিক ভাবে ব্যবহার করা ছাড়া কোনো বিকল্প হতে পারে না। 



প্রকাশিতঃ নিশিত সাহিত্যপত্র উৎসব ২০১৬
       
       
       
    

       
       


        

অসৌর গ্রহ

ঘরের কাছের প্রতিবেশী প্রক্সিমা বি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


গত ২৪শে আগস্ট, ২০১৬ ইউরোপিয়ান সাদার্ন অবজার্ভেটরি ঘোষণা করেছে আমাদের সবচেয়ে কাছের যে তারকা প্রক্সিমা সেন্টরি (বা সেন্টরাই, যেমন খুশি উচ্চারণ বেছে নিন), তার চারপাশে একটা গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেছে। গ্রহটার নাম দেওয়া হয়েছে প্রক্সিমা বি। বিভিন্ন কারণে এই আবিষ্কারের খবরটা কিছুটা আলোড়ন তুলেছে, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় জায়গা করে নিয়েছে। এটা শুধু যে সৌরজগতের বাইরে আমাদের সবচেয়ে কাছের গ্রহ তা নয়, এর তাপমাত্রাও সম্ভবত এমন যে এর পৃষ্ঠে জল তরল অবস্থায় থাকার সম্ভাবনা আছে। পৃথিবী ছাড়া সৌর জগতের অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান আমরা পাইনি। তাই তরল জল থাকার সম্ভাবনা শুনলে আমদের আগ্রহ জাগে কারণ তার মানে এই গ্রহে হয়তো প্রাণ সৃষ্টির অনুকূল পরিস্থিতি থাকতে পারে। 

মাত্র কুড়ি বছরের মধ্যে সৌরজগতের বাইরে গ্রহ, সংক্ষেপে বহির্গ্রহ, সম্পর্কে আমাদের ধারণা পুরোপুরি পালটে গেছে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, তখনও পর্যন্ত সৌরজগতের বাইরে কোনো গ্রহের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তত্ত্ব আর কল্পবিজ্ঞানের মধ্যেই তারা সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৯২ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম ঘোষণা করেন যে পাওয়া গেছে, সূর্য ছাড়া অন্য কোনো নক্ষত্রের চারপাশে আবর্তনরত গ্রহের সন্ধান পাওয়া গেছে। অবশ্য তার চার বছর আগে অন্য এক তারকাতে গ্রহ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল বলে সন্দেহ করা হচ্ছিল, তবে নিশ্চিত হয়ে বিজ্ঞানীরা বলতে পারেননি। সেই নিশ্চিত হতে লেগে গিয়েছিল প্রায় পনের বছর – ততদিনে আরও অনেক বহির্গ্রহ খুঁজে পাওয়া গেছে। 

বহির্গ্রহের সন্ধান কেমন করে পাওয়া যায়? সূর্য ছাড়া বাকি সব নক্ষত্রই আমাদের থেকে এত দূরে যে তাদের কাছে কোনো গ্রহ আছে কিনা বোঝা সহজ নয়। গ্রহদের নিজের আলো নেই, নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্যের পাশে তাদের দেখা যায় না; ঠিক যেমন দিনের বেলা সূর্যের আলোতে আমরা চাঁদতারকাদের দেখতে পাই না। সেজন্য অন্য কয়েকটা পদ্ধতি কাজে লাগাতে হয়। তারকার বেগের পরিবর্তন মাপা তার মধ্যে একটা। তারকা যেমন মাধ্যাকর্ষণের সাহায্যে গ্রহকে টানে, গ্রহও তেমনি তারকাকে আকর্ষণ করে। গ্রহের ভর কম বলে তার চলাফেরা দেখা সহজ। কিন্তু গ্রহের আকর্ষণের জন্য নক্ষত্রও নড়াচড়া করে। সূর্যের ক্ষেত্রেও এটা হয়, তবে গ্রহদের ভর কম বলে সূর্যের এই বেগটাও কম। সূর্যের টানে পৃথিবী আবর্তন করছে, তার আবর্তন বেগ হল সেকেণ্ডে তিরিশ কিলোমিটার। পৃথিবী সূর্যের থেকে তিনশো তিরিশ লক্ষ গুণ হালকা, তাই পৃথিবীর টানে সূর্য প্রতি সেকেণ্ডে নয় সেন্টিমিটার সরে যায়। বোঝা যাচ্ছে নিশ্চয় যে কোটি কোটি কিলোমিটার দূর থেকে তারকাদের এই নড়াচড়া মাপা বেশ শক্ত। কেমন করে তারকার বেগ মাপা হবে?

তারকার বেগ আমরা তারকার বর্ণালী থেকে ডপলার ক্রিয়ার সাহায্যে মাপতে পারি। ডপলার ক্রিয়া কী? রেলস্টেশনে দাঁড়িয়ে আছেন, দূর থেকে একটা মেল ট্রেন হুইসল দিতে দিতে আসছে। যখন আপনার দিকে আসছে তখন, তার স্বরগ্রাম বেশি। যখন আপনার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, স্বরগ্রাম কমে যায়। ট্রেনের বেগের উপর স্বরগ্রামের ওঠাপড়া নির্ভর করে। ঠিক তেমনি আলোর কম্পাঙ্কের পরিবর্তন মেপে আলোক উৎস আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে না কাছে আসছে, তার বেগ কত, এ সমস্ত মাপা যায়। এই লিঙ্কে ডপলার ক্রিয়া থেকে কেমন করে তারাদের বেগ মাপা যায় ভিডিও সমেত পাওয়া যাবে।

তবে গ্রহ আবিষ্কারের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরও জটিল। আমাদের ছায়াপথে কোনো তারকাই স্থির নয়, প্রায় সমস্ত তারকাই আমাদের থেকে হয় দূরে সরে যাচ্ছে নয়তো কাছে আসছে। গ্রহ থাকলে তার প্রভাবে এই দূরে সরে যাওয়া বা কাছে আসার বেগটা সময়ের সঙ্গে পালটে যায়। এই বেগ পরিবর্তন থেকে গ্রহটার ভর, তারকার পাশে এক বার ঘুরতে তার কত সময় লাগে, কেন্দ্রের নক্ষত্রটার থেকে তার দূরত্ব কত – এ সমস্ত খবর পাওয়া যায়। 


Radial velocity curve of Gliese 86
প্রদক্ষিণরত গ্রহের জন্য গ্লিসে 86 নক্ষত্রের বেগের পরিবর্তন (চিত্রঃ ESO)

আমাদের সৌরজগৎ থেকে কোনো তারকা যত দূরে থাকে, সাধারণত আমাদের সাপেক্ষে তার বেগ তত বেশি হয়। ফলে গ্রহের টানে তার বেগের পরিবর্তন মাপা শক্ত হয়ে পড়ে। আবার গ্রহটা যত ভারি হয় বা নক্ষত্রের যত কাছে থাকে, নক্ষত্রের উপর তার আকর্ষণ বল তত বেশি। নক্ষত্রের আলোর ডপলার অপসরণ মাপা তত সোজা। তাই প্রথম প্রথম আমরা আমাদের কাছাকাছি তারকাতে খুব ভারি গ্রহগুলোকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম। আমাদের মাপার পদ্ধতি যত উন্নত হয়েছে, তত আমরা আরও বেশি করে গ্রহ খুঁজে পেয়েছি।

আরও একটা পদ্ধতিতে অনেকগুলো বহির্গ্রহের সন্ধান মিলেছে। নক্ষত্র আর আমাদের পৃথিবীর মাঝে একটা সরলরেখা কল্পনা করুন। ঐ নক্ষত্রের কোনো গ্রহ থাকলে, এবং যদি সে ওই সরলরেখাটাকে ছেদ করে, তাহলে গ্রহণের মতো একটা পরিস্থিতি হবে। সেক্ষেত্রে তারকা থেকে আসা আলোর পরিমাণ কমে যাবে। এঁর থকে আমরা যে শুধু গ্রহের অস্তিত্ব বুঝতে পারি তা নয়, তার বছরের দৈর্ঘ্য এবং সেটা কত বড় তাও বুঝতে পারি। 


Light Curve of a Planet Transiting Its Star
গ্রহের জন্য তারার ঔজ্জ্বল্যের  হ্রাসবৃদ্ধি (চিত্রঃ NASA Ames)

এই দুটি পদ্ধতিই সবচেয়ে বেশি বহির্গ্রহ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। এ বছর আগস্ট মাস পর্যন্ত প্রথম পদ্ধতিতে ৬৮৮-টা এবং দ্বিতীয় পদ্ধতিতে ২৬৭৮-টা বহির্গ্রহ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরও কয়েকটি পদ্ধতি আছে তবে সেগুলো প্রয়োগের সুযোগ এখনো পর্যন্ত আরও কম। সব মিলিয়ে ২০১৬ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত আবিষ্কৃত বহির্গ্রহের মোট সংখ্যা ৩৫১৮। এই হিসাবটা exoplanet.eu ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া। NASA-র বহির্গ্রহের তালিকায় ৩৩৭৫-টা নাম আছে। প্রথম বহির্গ্রহ আবিষ্কারের পঁচিশ বছরের মধ্যে আমরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি সন্দেহ নেই। 

গ্রহ থাকলেই তাতে প্রাণ থাকবে এমন কথা বলা যায় না। আগেই বলেছি সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও প্রাণের সন্ধান এখনো মেলেনি। তাই পৃথিবীর বাইরে প্রাণ, বিশেষ করে উন্নত জীব থাকতে পারে কিনা, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞ্ররা একমত নন। তবে যে কোনো গ্রহে প্রাণ থাকার জন্য একটা শর্ত যে পূরণ করতে হবে সে কথা প্রায় সকলেই বলেন। সেখানে তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকতে হবে যাতে সেখানে জল তরল অবস্থায় পাওয়া যাবে। তাপমাত্রা কম হলে জল জমে বরফ হয়ে যাবে, আর বেশি হলে জল বাষ্পে পরিণত হবে। এই দুই পরিস্থিতিতেই প্রাণ সৃষ্টির কোনো উপায় আমরা কল্পনা করতে পারি না, কারণ আমাদের জানা সমস্ত জৈবরাসয়ানিক বিক্রিয়াই জলীয় মাধ্যমে ঘটে। এই অঞ্চলকে বলে নক্ষত্রজগতের হ্যাবিটেবল জোন অর্থাৎ বাসযোগ্য অঞ্চল। যদি এককোশী জীবের থেকে জটিল কোনো জীব জন্ম হতে হয়, তাহলে বহির্গ্রহটাকে হতে হবে পৃথিবী, শুক্র, মঙ্গল বা বুধের মতন পাথুরে। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস বা নেপচুনের মতো গ্যাস দানব গ্রহে উন্নত জীব সৃষ্টি শক্ত। 

The habitable zone (artist's impression)
আমাদের সৌরজগতের বাসযোগ্য অঞ্চল (চিত্রঃ ESO/M. Kornmesser)

এই দুই শর্তে দেখা যাবে আমাদের খুঁজে পাওয়া অধিকাংশ বহির্গ্রহেই উন্নত প্রাণ সৃষ্টির জন্য অনুকূল পরিবেশ নেই। তার কারণ এখনো পর্যন্ত আমরা সাধারণত নক্ষত্রের কাছের বড় গ্রহগুলোকে বেশি সংখ্যায় খুঁজে পেয়েছি। এর মানে এই নয় যে অধিকাংশ গ্রহই বড় এবং নক্ষত্রের কাছাকাছি থাকে। এ ধরনের গ্রহগুলোকে খুঁজে পাওয়া সহজ বলে আমরা এদের কথাই বেশি জানি। তাই নতুন গ্রহ প্রক্সিমা সেন্টরি বি-র আবিষ্কার বিজ্ঞানী মহলে আগ্রহের সঞ্চার করেছে। দেখা যাক এর সম্পর্কে আমরা কী জানি।

প্রথমেই ধরা যাক এই গ্রহটা যে তারকাকে ঘিরে আবর্তন করছে তার কথা। প্রক্সিমা সেন্টরি হল আমাদের সবচেয়ে কাছের তারকা, আমাদের থেকে মাত্র ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। আলফা সেন্টরি নক্ষত্রমণ্ডলীতে তিনটি নক্ষত্র আছে, তাদের মধ্যে একটি প্রক্সিমা। তবে প্রক্সিমা আলফা সেন্টরির স্থায়ী সদস্য না অতিথি তা আমরা এখনো জানি না। এর ভর সুর্যের ভরের মাত্র তের শতাংশ, পরিভাষায় এটি একটি লাল বামন নক্ষত্র। লাল বামনদের ভর সূর্যের ভরের মোটামুটি নয় থেকে পঞ্চাশ শতাংশের মধ্যে হয়, তার মানে এই নক্ষত্রকূলের মধ্যেও প্রক্সিমার ভর কম। আর একটু কম হলেই এ আর কোনোদিনই তারকা হয়ে জন্মাতে পারত না। লাল বামন নক্ষত্ররা খুব অনুজ্জ্বল হয়, প্রক্সিমার ঔজ্জ্বল্য সূর্যের দুই শতাংশেরও কম। আমাদের সবচেয়ে কাছের তারকা হওয়া সত্বেও এত মিটমিটে বলে আমরা খালি চোখে প্রক্সিমাকে দেখতে পাই না। নক্ষত্রটা আবিষ্কার হয় একশ বছর আগে ১৯১৫ সালে দূরবিনের সাহায্যে। আমরা জেনেছি যে তার ব্যাসার্ধ হল এক লক্ষ কিলোমিটার। তুলনা করলে আমাদের সূর্যের ব্যাসার্ধ সাত লক্ষ কিলোমিটার। 

Artist's impression of the planet orbiting Proxima Centauri
শিল্পীর চোখে প্রক্সিমা বি, প্রক্সিমা সেন্টরি এবং যুগ্ম তারা আলফা সেন্টরি এবি (চিত্রঃ ESO/M. Kornmesser)

প্রক্সিমার ভর কম বলে তার কাছের গ্রহের টান তাকে সহজেই বিচলিত করতে পারে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন তার বেগ যে ভাবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পালটাচ্ছে তা ব্যাখ্যা করতে গেলে ধরে নিতে হবে তার চারপাশে একটা গ্রহ আছে। গ্রহটা তাকে ১১.২ দিনে একবার প্রদক্ষিণ করছে। নতুন গ্রহটার জন্য নক্ষত্রটা সেকেণ্ডে দুই মিটারের কাছাকাছি সরে যায়। তারকার ভর আমরা আগেই বার করেছিলাম, তাই গ্রহদের গতবিধি সংক্রান্ত কেপলারের সূত্র ব্যবহার করে দেখা গেল তারকা থেকে গ্রহটার দূরত্ব হল মাত্র সাড়ে বাহাত্তর লক্ষ কিলোমিটার। আমাদের সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ সূর্যের থেকে প্রায় পাঁচ কোটি আশি লক্ষ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গ্রহটার ভরের পাল্লাটাও জানা গেল। দেখা গেল তার ভর কম হলে পৃথিবীর থেকে সামান্য অর্থাৎ ১.৩ গুণ বেশি। অবশ্য পৃথিবীর তিন গুণ ভারি হওয়াও বিচিত্র নয়। 

The motion of Proxima Centauri in 2016, revealing the fingerprints of a planet
প্রক্সিমা সেন্টরির বেগের পরিবর্তন। এর থেকেই প্রক্সিমা বি গ্রহের অস্তিত্ব জানা গেছে। (চিত্রঃ ESO/G. Anglada-Escudé)

প্রক্সিমা বি কেন্দ্রের তারকার খুব কাছে অবস্থান করছে। আমাদের সূর্যের ক্ষেত্রে এত কাছে কোনো গ্রহ যদি থাকত, তা সূর্যের তাপে পুড়ে ঝামা হয়ে যেত। তবে সূর্যের অত কাছে কোনো গ্রহ থাকা এমনিই সম্ভব নয়, তা সূর্যের টানে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। ঠিক যে কারণে গ্রহরাজ বৃহস্পতির আকর্ষণের জন্য গ্রহাণুপুঞ্জের সদস্যরা সবাই মিলে গ্রহ তৈরি করতে পারেনি। প্রক্সিমা সেন্টরির ভর কম, তাই তার আকর্ষণ বলও কম। তাই নতুন আবিষ্কৃত গ্রহটা তার এত কাছে থাকতে পেরেছে, টুকরো হয়ে যায়নি। 

প্রক্সিমা সেন্টরি লাল বামন নক্ষত্র, আগেই দেখেছি যে তার থেকে যে শক্তি বেরোয় তা আমাদের সূর্যের দুই শতাংশেরও কম। তাই প্রক্সিমা বি-র তাপমাত্রা অনেক কম হওয়া উচিত। নক্ষত্রের খুব কাছের গ্রহে তাপমাত্রা এত বেশি হয় যে জল বাষ্প হয়ে যায়। আবার গ্রহ অনেক দূরে থাকলে জল ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যাবে। মাঝের যে অংশটায় জল তরল অবস্থায় থাকা সম্ভব, তাকে বলে নক্ষত্রজগতের বাসযোগ্য অঞ্চল (Habitable zone)। আমাদের সৌরজগতের বাসযোগ্য অঞ্চল কতটা তা নিয়ে মতভেদ আছে, তবে পৃথিবী যে তার মধ্যে পড়বে, তা আমরা বুঝতেই পারছি। প্রক্সিমা সেন্টরির থেকে যে পরিমাণ শক্তি বেরোয়, তার থেকে দেখা যায় যে প্রক্সিমা বি গ্রহটাও বাসযোগ্য অঞ্চলের মধ্যে পড়বে, অর্থাৎ সেখানে জল তরল অবস্থায় থাকতে পারবে। বিজ্ঞানীরা তাই সেখানে প্রাণের সম্ভাবনা নিয়ে কিছুটা আশাবাদী।

তবে বাসযোগ্য অঞ্চলে থাকলেই সেখানে জল থাকবে এমন কোনো কথা নেই। অনেক হিসাবেই শুক্র বা মঙ্গলকেও সৌরজগতের বাসযোগ্য অঞ্চলের মধ্যে ধরা হয়েছে। মঙ্গলে তরল জল এক সময় ছিল কিনা তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো একমত নন। কিন্তু এখন যে নেই তা আমরা সবাই জানি। শুক্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। সেখানে জল তরল অবস্থায় থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এমনকি আমাদের ঘরের কাছে চাঁদেও জল তরল অবস্থায় থাকতে পারে না। চাঁদ বা মঙ্গলের ক্ষেত্রে বায়ুর চাপ কম বলে জল তরল অবস্থায় পাওয়া যায় না, কম চাপে তা ফুটে বাষ্প হয়ে যাবে। এই দুই জায়গায় একমাত্র বরফ অবস্থায় জল পাওয়া যেতে পারে। শুক্রের বায়ুমণ্ডল মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে তৈরি এবং ভীষণ পুরু। সেখানে গ্রিনহাউস এফেক্টের মাধ্যমে বায়ুমণ্ডল তাপ ধরে রাখে। তাই শুক্রের তাপমাত্রা এত বেশি যে জল তরল বা কঠিন কোনো ভাবেই থাকতে পারে না। 

যে গ্রহের ভর যত কম, তার বায়ুমণ্ডলকে আকর্ষণ বলের মাধ্যমে ধরে রাখার ক্ষমতা তত কম। তাই মঙ্গলের বায়ুচাপ খুব কম, চাঁদে তো বায়ুমণ্ডলই নেই। প্রক্সিমা বি-র যা ভর, তাতে মনে হয় সেখানে হয়তো বায়ুর চাপ কম হবে না তাই মঙ্গল বা চাঁদের মতো অবস্থা হয়তো সেখানে হবে না। (তবে বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে শেষ কথা এখনো বলতে পারছেন না, সে কথায় পরে আসছি।) শুক্রে গ্রিনহাউস এফেক্ট কেন এত বেশি তা নিয়ে এখনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যায়নি। তাই আমরা বলতে পারব না শুক্রের মতো পরিস্থিতি প্রক্সিমা বি-তে আছে কিনা, তার জন্য গ্রহটার বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বহির্গ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপাদান কেমন করে জানা যায়? প্রত্যেক মৌল এবং যৌগ বিভিন্ন নির্দিষ্ট কম্পাঙ্কের আলো শোষণ করে। যদি গ্রহটা তারকা আর আমাদের মাঝের সরলরেখাটাকে ছেদ করে, তাহলে তারকার থেকে আমাদের কাছে যে আলো আসছে তা ঐ গ্রহের বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে আসবে। সেই সময় বায়ুমণ্ডলে যে গ্যাস থাকে সে কিছু কিছু কম্পাঙ্কের আলো শোষণ করে, সুতরাং সেই কম্পাঙ্কের আলো আমাদের কাছে কম আসবে। তাই তারকার আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করে আমরা তখন বলতে পারব বায়ুমণ্ডলে কী কী গ্যাস কত পরিমাণে আছে। আমরা এখনো জানি না প্রক্সিমা বি ঠিক ঐ সরলরেখাটাকে ছেদ করবে কিনা। 

তবে প্রক্সিমা বি-তে প্রাণ সৃষ্টির পথে অন্য সমস্যা আছে। প্রথমত অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে লাল বামন নক্ষত্রেরা সব সময় একই রকম ভাবে আলো দেয় না। আমাদের সূর্যে যেমন সৌর কলঙ্ক আছে, ঠিক তেমনি লাল বামন তারকাতেও কলঙ্ক আছে। কিন্তু এই ধরণের তারকাতে কখনো কখনো কলঙ্কের পরিমাণ এত বেশি হয় যে তারকার প্রায় অর্ধেকটা ঢেকে যায়। সে সময় তাহলে গ্রহের তাপমাত্রা খুব কমে যাবে। অন্যদিকে আমরা জানি অন্য অনেক লাল বামনের মতো প্রক্সিমা বি পরিবর্তনশীল (variable) নক্ষত্র, তার ঔজ্জ্বল্য কখনো কখনো খুব বেড়ে যায়। তার ফলে গ্রহের তাপমাত্রা হঠাৎ খুব বেড়ে যেতে পারে। তাপমাত্রার এই রকম বাড়াকমা প্রাণ সৃষ্টির অনুকূল নয়। আরও একটা সমস্যা আছে। প্রক্সিমার ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধির কারণ নাক্ষত্র প্রজ্বাল (flare)। প্রক্সিমা সেন্টরির প্রজ্বালের মাত্রা এখন মাঝারি মাপের হলেও জন্মের সময় তা ছিল আরও অনেক বেশি। অনেক সময়ই প্রজ্বালের সঙ্গে বিশাল সংখ্যায় ইলেকট্রন, প্রোটন ইত্যাদি বেরিয়ে আসে। কোনো গ্রহ যদি কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের খুব কাছে থাকে, এই কণাগুলো তার বায়ুমণ্ডলে গিয়ে ধাক্কা মারবে এবং তাকে ঠেলে মহাকাশে পাঠিয়ে দেবে। প্রক্সিমা বি-র ক্ষেত্রে এই রকম হয়ে থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে হয়তো তার আদৌ বায়ুমণ্ডলই নেই। এখানে লাল বামন তারার প্রজ্জ্বাল সম্পর্কে আরো খবর ও ভিডিও দেখা যাবে।

একমাত্র গ্রহটার চৌম্বক ক্ষেত্র শক্তিশালী হলে তা ইলেকট্রন প্রোটনের মতো আধানিত (charged) কণাদের অন্য পথে নিয়ে যেতে পারে। পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র এই কাজটাই করে। তাহলে গ্রহটার বায়ুমণ্ডল টিকেও যেতে পারে। কিন্তু প্রক্সিমা বি-র চৌম্বক ক্ষেত্র খুব শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা কম। গ্রহের চৌম্বক ক্ষেত্র থাকে কেন? পৃথিবীর কেন্দ্রটা মূলত গলিত লোহা ও নিকেল দিয়ে তৈরি। সেই কেন্দ্র দিনে একবার আবর্তন করে চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। তারকা ও গ্রহ যদি খুব কাছে থাকে, তাহলে গ্রহ একটা পাশই তারকার দিকে ফিরিয়ে রাখবে, ঠিক যেমন চাঁদের একটা মুখই সবসময় পৃথিবীর দিকে ফেরানো থাকে। প্রক্সিমার খুব কাছে গ্রহটা থাকার ফলে তার কেন্দ্রে গলিত পাথরে যে জোয়ার ভাঁটা হয়, তা নিশ্চয় খুব শক্তিশালী। আগেই বলেছি আমাদের সূর্যের ক্ষেত্রে সেটা এতই শক্তিশালী হত যে গ্রহটা টুকরো টুকরো হয়ে যেত। প্রক্সিমা বি-র ক্ষেত্রে তা হবে না, কিন্তু গলিত পাথরের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে গ্রহের আবর্তন বেগ কমে গেছে। তার ফলে গ্রহটা নক্ষত্রের চারদিকে আবর্তন করতে যতটা সময় নেয়, নিজের চারপাশে একবার ঘুরতেও একই সময় নিচ্ছে। এ রকম ক্ষেত্রে গ্রহের কেন্দ্রের গলিত লোহার পক্ষেও নাক্ষত্র প্রজ্বাল থেকে বাঁচানোর মতো খুব শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা শক্ত। তাই প্রক্সিমা বি-র বায়ুমণ্ডল আদৌ আছে কিনা সন্দেহ। তার উপর গ্রহটার এক দিক সব সময় কেন্দ্রের তারকার দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকে আর অন্য দিকটা সব সময় অন্ধকারে থাকে। তার মানে এক দিকে প্রচণ্ড গরম, অন্য দিকে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। এই পরিস্থিতিও প্রাণ সৃষ্টির পক্ষে খুব অনুকূল নয়।

Artist’s impression shows a view of the surface of the planet Proxima b orbiting the red dwarf star Proxima Centauri
শিল্পীর চোখে প্রক্সিমা বি। প্রক্সিমা সেন্টরি ও যুগ্ম তারা নক্ষত্র আলফা সেন্টরি এবি-কে দেখা যাচ্ছে। (চিত্রঃ  ESO/M. Kornmesser)

তবে অন্য ধরণের পরিস্থিতিও সম্ভব যেখানে গ্রহে বায়ুমণ্ডল ও জল দুইই থাকতে পারে। তার জন্য গ্রহটার ভর, কক্ষপথ ইত্যাদি আরও অনেক নির্ভুলভাবে জানা প্রয়োজন। একদিকে সবসময় দিন, অন্যদিকে সবসময় রাত হলেও তাপমাত্রা খুব চরম নাও হতে পারে, কারণ বায়ুস্রোত ও সমুদ্রস্রোত হয়তো উষ্ণ থেকে শীতল অঞ্চলে তাপ বয়ে নিয়ে যেতে পারে।

অন্য এক কারণে প্রক্সিমা বি-তে জল থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আমাদের জানা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রায় নিরানব্বই শতাংশ দুটি মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি -- হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। অথচ আমাদের পৃথিবীর মতো পাথুরে গ্রহে এই দুটি মৌলিক পদার্থের পরিমাণ এক শতাংশেরও কম। বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের মতো গ্যাস দানব গ্রহগুলো মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। আসলে সূর্যের জন্মের সময় তার কাছে তাপমাত্রা ছিল অনেক বেশি। তাই শুধুমাত্র লোহা, নিকেল, সিলিকন, অ্যালুমিনিয়াম ইত্যাদি ধাতু (মূলত অক্সাইড যৌগ রূপে) কঠিন অবস্থায় ছিল। জল, হাইড্রোজেন, হিলিয়াম সহ অধিকাংশ পদার্থই গ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। গ্যাসের উপর উচ্চ তাপমাত্রা এবং সৌর ঝড় (solar wind)-এর প্রভাব এত বেশি যে মাধ্যাকর্ষণ বল গ্যাস অণুদের এক জায়গায় আনতে পারেনি। কঠিন পদার্থদের এই সমস্যা নেই, তাই পারষ্পরিক মাধ্যাকর্ষণের টানে কঠিন পদার্থরা সবাই মিলে গ্রহ সৃষ্টি করতে পারে। সে কারণে একমাত্র কঠিন পাথুরে গ্রহই তারকার কাছাকাছি তৈরি হওয়া সম্ভব। নক্ষত্রের থেকে দূরে তাপমাত্রা ও সৌর ঝড়ের প্রভাব কম, সেখানে গ্যাস অণুরা নিজেদের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে এক জায়গায় এসে গ্রহ সৃষ্টি করে। হাইড্রোজেন হিলিয়ামের পরিমাণ অনেক বেশি, তাই এই গ্রহরা অনেক বড়ো, এদেরই আমরা গ্যাস দানব বলি। পৃথিবী সৃষ্টির সময় তার মধ্যে জল ছিল না। সৌরজগতের বাইরের দিকে অনেক ধূমকেতু আছে, যারা মূলত বরফ ও পাথর দিয়ে তৈরি। সৌরজগত সৃষ্টির প্রথম যুগে তাদের অনেকে এসে ভেতরের গ্রহগুলোতে আছড়ে পড়েছিল। তারাই জল বয়ে এনেছিল পৃথিবীতে। 

এই ছবি ঠিক হলে গ্যাস দানব গ্রহরা কখনোই কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের কাছে তৈরি হতে পারে না। অথচ আমাদের আবিষ্কৃত অধিকাংশ বহির্গ্রহই গ্যাস দানব এবং তারা কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের খুব কাছে আছে। তার কারণ অবশ্যই এই ধরণের গ্রহগুলোকে আমরা সহজে খুঁজে পাই, কম ভরের গ্রহদের সন্ধান মেলা শক্ত। কিন্তু নক্ষত্রের এত কাছে গ্যাস দানবরা এল কোথা থেকে? বিজ্ঞানীরা মনে করছেন সম্ভবত কোনো কারণে গ্রহেরা অনেক সময় তাদের কক্ষপথ পরিবর্তন করে, যদিও সেটা কী তা নিয়ে আমরা নিশ্চিত নই। তাঁরা মনে করছেন যে গ্যাস দানবরা সবসময়েই দূরেই তৈরি হয়, কিন্তু পরে সেগুলো হয়তো কখনো কখনো কেন্দ্রীয় নক্ষত্রের কাছাকাছি চলে আসে। এমন যদি প্রক্সিমা বি-র ক্ষেত্রে হয়ে থাকে? জন্মের সময় সে হয়তো নক্ষত্র থেকে দূরে ছিল, তাই বায়ু এবং জলকে সে ধরে রাখতে পেরেছিল। পরে সে কোনো ভাবে নক্ষত্রটার কাছে সরে এসেছে। এমন হলে সেখানে প্রাণের অনুকূল পরিস্থিতি থাকা সম্ভব। 

প্রক্সিমা বি-র ক্ষেত্রে এই কল্পনাটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আমাদের তত্ত্ব অনুসারে লাল বামন নক্ষত্রের খুব কাছে প্রক্সিমা বি-র মতো বড়ো গ্রহ তৈরি হওয়া শক্ত, কারণ নক্ষত্রের অত কাছে গ্রহ সৃষ্টির মতো উপাদান খুব কম থাকার কথা। তাই বিজ্ঞানীরা মনে করছেন হয়তো গ্রহটা আরও অনেক দূরে তৈরি হয়েছিল। তবে লাল বামন নক্ষত্রের ক্ষেত্রে একটা সুবিধা আছে। আমাদের সূর্য পাঁচশো কোটি বছর আগে জন্ম নিয়েছিল, আরও মোটামুটি পাঁচশো কোটি বছর সে এইভাবেই আলো দেবে। তারপর সে মৃত্যূর দিকে এগিয়ে যাবে। প্রক্সিমা সেন্টরাই কিন্তু বাঁচবে আরও অনেক বেশি – দশ লক্ষ কোটি বছর! তাই সেখানে কোনো ভাবে প্রাণ সৃষ্টি হলে তা বহু গুণ সময় টিকে থাকার সুযোগ পাবে। আমাদের কাছের তারকাদের মধ্যে লাল বামন নক্ষত্রের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি - প্রায় সত্তর শতাংশ তারকাই লাল বামন। (গোটা ছায়াপথের হিসাব আমরা জানি না কারণ লাল বামন তারকারা অনুজ্জ্বল বলে আমাদের থেকে দূরের লাল বামনদের আমরা খুঁজে পাই না।) তাই প্রক্সিমা বি আবিষ্কার এক ধাক্কায় আমাদের প্রতিবেশী গ্রহের সম্ভাব্য সংখ্যাকে অনেকটা বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রক্সিমা বি-তে জল আছে কি নেই, সে বিষয়ে এত রকমের সন্দেহের অবসান এত দূর থেকে হওয়া কি সম্ভব? বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি জানলে অবশ্য কিছুটা আলো দেখা যেতে পারে। তবে সবচেয়ে ভালো হবে যদি আমরা সেখানে কোনো মহাকাশযান (অবশ্যই রোবট, মানুষ পাঠানো এখনো শুধুই কল্পনা) পাঠাতে পারি যে আমাদের সেখান থেকে খবর দিতে পারবে। আমরা যে রকেট ব্যবহার করি, তা দিয়ে হবে না -- আমাদের সবচেয়ে দ্রুতগামী রকেটও বহু হাজার বছর সময় নেবে। কিন্তু আরো কিছু নতুন প্রযুক্তির কথা উঠে আসছে যার সাহায্যে খুব ছোটো একটা যান হয়তো পঁচিশ থেকে তিরিশ বছর যাত্রা করে প্রক্সিমার কাছাকাছি পৌঁছোতে পারবে। এই নতুন প্রযুক্তিগুলো শুধুমাত্র মহাকাশ যাত্রা নয়, আমাদের পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের কাজে লাগতে পারে। সে নিয়ে আলোচনার সময় আজ আর নেই। তবে যদি এরকম কোনো অভিযান সত্যিই পাঠানো যায়, তা আমাদের সৌরজগত কেমন ভাবে তৈরি হয়েছিল, পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টি হল কেমন করে, এরকম নানা সমস্যা সমাধানে সাহায্য করবে সন্দেহ নেই।



(প্রকাশিতঃ যুবশক্তি শারদ সংখ্যা ২০১৬/১৪২৩, পরিমার্জিত)

সংযোজনঃ মূল লেখাতে লিখেছিলাম যে প্রক্সিমা সেন্টরির প্রজ্বালের মাত্রা এখন মাঝারি মাপের। কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেছে আসলে এই সময়েও প্রজ্বালের মাত্রা খুব বেশি। ২৪শে মার্চ ২০১৭ তারিখে একটা প্রজ্বাল দেখা যায় যা সুর্য থেকে যে প্রজ্জ্বাল বেরোয়, তার চেয়ে দশ গুণ বেশি শক্তিশালী। দশ সেকেন্ডের জন্য প্রক্সিমা সেন্টরির ঔজ্জ্বল্য হাজারগুণ বেড়ে গিয়েছিল।নিয়মিত এই মাত্রার প্রজ্বাল সামলে প্রক্সিমা বিতে বায়ুমন্ডল থাকা সম্ভব নয়। তাই নিকটতম অসৌর গ্রহে প্রাণ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।