Thursday 14 September 2017

আইনস্টাইন ও বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ



আলবার্ট আইনস্টাইন ও বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       রাষ্ট্রসংঘের পক্ষ থেকে ২০০৫ সালকে আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা বর্ষ হিসাবে পালন করা হয়েছে। একশো বছর আগে ১৯০৫ সালে বিশ্ববরেণ্য পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন পাঁচটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। শুধু পদার্থবিদ্যা নয়, প্রকৃতি সম্পর্কে আমাদের বহুদিনের ধ্যানধারণার যে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল এই পাঁচটি প্রকাশনা, তার সঙ্গে তুলনীয় ঘটনা মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল।
যুবক আইনস্টাইন


       কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বা আবিষ্কার চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বজগতের তত্ত্ব বা ডারউইনের বিবর্তনবাদ পূর্ববর্তী বহু সুপ্রতিষ্ঠিত ধারণার অবসান ঘটিয়েছিল। ঠিক তেমনি ১৯০৫ সালে আইনস্টাইনের গবেষণা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল মানুষের বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে, দর্শনে এবং সর্বোপরি প্রকৃতি সম্বন্ধে আমাদের ধ্যানধারণায় অর্থাৎ সংক্ষেপে বিশ্ববীক্ষাতে।
       বিংশ শতাব্দীকে বলা হয় পদার্থবিজ্ঞানের শতক। এই শতাব্দীতে পদার্থবিদ্যার বিভিন্ন দিকের যে অসাধারণ উন্নতি হয়েছে তার এক বড় অংশে আইনস্টাইনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তার সেই অবদানের পরিমাপকে কোনো একটি প্রবন্ধের ক্ষুদ্র পরিসরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। এমনকি আইনস্টাইনের কেবল ১৯০৫ সালের গবেষণা পত্রগুলির বিষয়েও বিস্তারিত আলোচনাও এখানে সম্ভব নয়। সে বছর আইনস্টাইনের কাজের মধ্যে আছে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ (Special theory of relativity) যা দেশকাল (Space-time) সম্পর্কে আমাদের বহু ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। আবার সেই বছরই তিনি আলোকতড়িৎ বিক্রিয়া (Photoelectric effect) ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আলোকের প্রকৃতি সম্বন্ধে তার গবেষণা প্রকাশ করেন যা কণা-তরঙ্গ দ্বৈতবাদের (Wave-particle duality) এক মূল স্তম্ভ। এছাড়া একই বছরেই তার প্রকাশিত গবেষণার মধ্যে আছে ব্রাউনিয় গতি (Brownian motion) সম্পর্কিত একটি প্রবন্ধ। এখন আমরা তাঁর এই কাজটিকে আণবিক তত্ত্বের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণগুলির মধ্যে একটি বলে গণ্য করি। এদের মধ্যে যে কোনো একটি গবেষণা বিজ্ঞানের ইতিহাসে তীর নাম চিরদিনের জন্য স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখত। এছাড়াও পরবর্তীকালে আইনস্টাইন আরও বহু গবেষণা করেছেন যাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে গেলেও এই প্রবন্ধ অতি দীর্ঘ হয়ে পড়বে। আইনস্টাইনের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজগুলির একটি হল সাধারণ আপেক্ষিকতা যা দীর্ঘ দশ বছরব্যাপী তাঁর প্রায় একক চেষ্টাতে পূর্ণতা লাভ করে। এছাড়াও কঠিন পদার্থের পদার্থবিদ্যা বা লেজারের তত্ত্বে আইনস্টাইনের মৌলিক এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। বর্তমান নিবন্ধে আমরা অতি সংক্ষিপ্তভাবে বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব বিষয়ে আইনস্টাইনের গবেষণা নিয়ে আলোচনা করব।

       বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা করতে গেলে প্রথমেই মনে আসে তড়িৎচৌম্বকীয় ক্ষেত্রের কথা। আমরা যদি বিংশ শতাব্দীর প্রথম বছরগুলোতে ফিরে যাই তাহলে দেখব বহু বৈজ্ঞানিকের চিন্তাভাবনা ও পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে তড়িৎ ও চুম্বকের নিয়মগুলি তখন সুপ্রতিষ্ঠিত। এই সমস্ত বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ফরাসী বিজ্ঞানী শার্ল কুলম্ব, আঁদ্রে মারি আ্যাম্পিয়ার, এবং ব্রিটেনে মাইকেল ফ্যারাডে। অপর এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল এই সমস্ত পরীক্ষালব্ধ নিয়ম থেকে তাঁর বিখ্যাত তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন। আলো যে আসলে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ তাও তখন তাঁর গবেষণা থেকে বিজ্ঞানীদের জানা। অন্য যে তত্ত্ব বিজ্ঞানীদের কাছে প্রায় স্বতঃসিদ্ধ হিসাবে পরিগণিত ছিল তা হল গতিবিদ্যা সংক্রান্ত নিউটনের তত্ত্ব। আইজ্যাক নিউটন সপ্তদশ শতকে গতিবিদ্যার যে নিয়মগুলি আবিষ্কার করেছিলেন, তাদের সন্দেহ করার কথা অধিকাংশ বিজ্ঞানী ভাবতেই পারতেন না।
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল


       কিন্তু নিউটনের গতিবিদ্যা এবং ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র তত্ত্বের মধ্যে একটা মৌলিক বিরোধ ছিল। ধরা যাক দুটি ট্রেন একই দিকে পাশাপাশি যাচ্ছে। স্টেশনে দাঁড়িয়ে স্টেশন মাস্টার তাদের গতিবেগ মাপলেন ঘণ্টায় যথাক্রমে নব্বই কিলোমিটার ও ষাট কিলোমিটার। দ্বিতীয় গাড়িটি থেকে কোনো ব্যক্তি যদি প্রথম গাড়িটির গতিবেগ মাপেন, তিনি দেখবেন সেটি তার সাপেক্ষে ঘণ্টায় তিরিশ কিলোমিটার বেগে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই। নিউটনের গতিবিদ্যাও এই একই উত্তর দেবে। কিন্তু এবারে একটা অন্য উদাহরণ নেওয়া যাক। আলোর গতিবেগ, আমরা জানি, সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব অনুযায়ী শূন্য মাধ্যমে আলোর গতিবেগ সর্বদাই অপরিবর্তনীয়। কিন্তু প্রশ্ন ওঠে বেগ কার সাপেক্ষে অপরিবর্তনীয়? ধরা যাক দ্বিতীয় ট্রেন ও একটি আলোকরশ্মি একই দিকে যাচ্ছে। আমাদের সাধারণ বুদ্ধি বলে যে এবার স্টেশন মাস্টার এবং ওই দ্বিতীয় গাড়িটির দর্শক আলোকরশ্মির বেগ মাপলে দেখবেন তাঁরা আলাদা আলাদা মান পাচ্ছেন। তা হলে অপরিবর্তনীয়তার কথা আসছে কোথা থেকে? তখনো পর্যন্ত জানা ছিল যে তরঙ্গমাত্রেরই যাওয়ার জন্য কোনো এক মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। যেমন আমরা জানি শব্দ বায়ুশূন্য স্থানে যেতে পারে না। বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন মহাশূন্যে আলো চলাচলের জন্য এরকমই এক মাধ্যম আছে যার নাম তাঁরা দেন ইথার। ধারণা করা হয়েছিল যে একমাত্র এই ইথারের সাপেক্ষেই আলোর গতিবেগ অপরিবর্তনীয়, অর্থাৎ ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব এ মাধ্যমেই পুরোপুরি খাটে। আলোর বেগ খুব বেশি বলে দু'টি ভিন্ন গতির দর্শকের সাপেক্ষে তার পরিবর্তন হয় কিনা, তা মাপা সম্ভব ছিল না বহুদিন। অবশেষে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির উন্নতির পর ঊনবিংশ শতকের একেবারে শেষে এই ধরণের পরীক্ষা করা সম্ভব হল। করলেন দুই বিজ্ঞানী আলবার্ট মাইকেলসন ও এডওয়ার্ড মর্লে। আশ্চর্যের সঙ্গে দেখা গেল যে শূন্যস্থানে আলোর বেগের মান দর্শকের গতি নিরপেক্ষ অর্থাৎ অপরিবর্তনীয়। আগের উদাহরণে যদি স্টেশন মাস্টার ও দ্বিতীয় গাড়ির যাত্রী আলোকরশ্মির বেগ মাপেন, তারা একই মান পাবেন।
আলবার্ট মাইকেলসন
এডওয়ার্ড মর্লে


       নিউটন ও ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের এই বিরোধে দ্বিতীয়টির পক্ষে পরীক্ষাগত প্রমাণ সত্ত্বেও অধিকাংশ বিজ্ঞানী নিউটনিয় গতিবিদ্যাকে অপরিবর্তিত রাখার চেষ্টা করছিলেন। তাঁরা ইথারের নানা অদ্ভুত ধর্ম কল্পনা করতে লাগলেন যাতে প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই পরীক্ষার ব্যাখ্যা সম্ভব হয়। এখানেই আইনস্টাইনের আবির্ভাব। আমরা প্রায় সবাই জানি যে তিনি তখন সুইজারল্যান্ডের বার্নে পেটেন্ট অফিসে কেরানি। সেখান থেকেই পদার্থবিদ্যার গবেষণা পত্রিকা 'অ্যানালেন ডার ফিজিক'-এ ১৯০৫ সালের তীর পূর্বোল্লিখিত পাঁচটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে দুটি ছিল বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব সংক্রান্ত গবেষণা।
       কী বলেছিলেন আইনস্টাইন? তিনি মনে করেছিলেন যে ম্যাক্সওয়েলই সঠিক, পরিবর্তন করতে হবে নিউটনের তত্ত্বের। তিনি প্রথমেই ধরে নেন যে শূন্য মাধ্যমে আলোকের বেগ দর্শকের গতির অবস্থা নিরপেক্ষ। এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। যদিও আইনস্টাইন আলোর বেগের বিষয়ে পূর্বোল্লিখিত পরীক্ষা সম্পর্কে জানতেন, তার তত্ত্বে তিনি কিন্তু বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের প্রতিসাম্য (symmetry) ধর্মের উপর। এছাড়াও তিনি বলেন যে পদার্থবিদ্যার সূত্রগুলি সমস্ত জড়ত্বীয় নির্দেশতন্ত্রে অপরিবর্তনীয়। (জড়ত্বীয় নির্দেশতন্ত্র কাকে বলে পরে আলোচিত হয়েছে।) আইনস্টাইন আলোর বেগসংক্রান্ত তার এই অনুমান থেকে দেখালেন যে স্থান বা দেশ (space) ও কাল বা সময় (time) আর পরস্পর নিরপেক্ষ নয়। এর আগে পর্যন্ত সকলের ধারণা ছিল যে সময়ের গতি সব ক্ষেত্রেই সমান। আইনস্টাইনের তত্ত্ব দেখাল যে সময়ের বেগ পর্যবেক্ষকের গতির অবস্থার উপর নির্ভর করে। বেশি বেগে গতিশীল ব্যক্তির জন্য সময়ের প্রবাহ ধীরগামী হবে।      
       এই বিষয়টা আরও একটু গভীর ভাবে বোঝা দরকার। ধরা যাক আগের উদাহরণে স্টেশন মাস্টার ও ট্রেনের যাত্রী, দুজনের হাতেই ঘড়ি আছে যেগুলি সঠিক সময় দেয়। ট্রেনের গতিবেগ যদি খুব বেশি হয়, তবে অদ্ভুত সমস্ত ব্যাপার দেখা যাবে। স্টেশন মাস্টার দেখবেন যাত্রীর ঘড়ি ধীরে অর্থাৎ “স্লো” চলছে। কারণ যাত্রী স্টেশন মাস্টারের সাপেক্ষে দ্রুত বেগে চলনশীল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, যাত্রীও দেখবেন স্টেশন মাস্টারের ঘড়ি “স্লো” চলছে, কারণ স্টেশন মাস্টারও তো তাঁর সাপেক্ষে একই বেগে গতিশীল। শুনতে অদ্ভুত লাগলেও পরীক্ষাগারে সময়ের বেগের এই পরিবর্তন প্রমাণ হয়েছে। ট্রেনকে আমরা আলোর কাছাকাছি বেগে চালাতে এখনো পারিনি। কিন্তু অনেক কণা আছে যাদের ক্ষেত্রে অতি দ্রুত বেগ পাওয়া সম্ভব হয়েছে। এদের অনেকেরই স্থির অবস্থায় আয়ু খুব কম। কিন্তু পরীক্ষাগারে দেখা গেছে যে চলনশীল অবস্থায় তাদের জীবনকাল আইনস্টাইনের সমীকরণ অনুযায়ী বেড়ে যায়। তবে এর থেকে কিন্তু দীর্ঘকাল জীবন ভোগ করার কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার সম্ভব নয়। কণাটির নিজের কাছে সে একই সময় বাঁচছে। ধরা যাক পরীক্ষাগারে বিজ্ঞানীর হিসাবে কণাটির ঘড়ি দশগুণ “স্লো? যাচ্ছে। তার মানে কণাটির কাছে যা এক সেকেন্ড সময়, এ বিজ্ঞানীর কাছে তা দশ সেকেন্ড সময়। সেজন্য পর্যবেক্ষকের হিসাবে কণার জীবনকাল দশ গুণ বাড়লেও কণার নিজের হিসাবে তার আয়ু একই থাকে।
       বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হল স্থান ও কালকে সমতুল্য ভূমিতে স্থাপন। তাই শুধু সময় নয়, পরিবর্তন হয় দৈর্ঘ্যের। ধরা যাক আগের উদাহরণে স্টেশন ও ট্রেন যখন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, তখন মেপে দেখা গেল তারা দুজনেই পঞ্চাশ মিটার লম্বা। কিন্তু ট্রেন চলতে শুরু করলে অবস্থাটা পাল্টে যাবে। স্টেশন মাস্টার এখন ট্রেনের দৈর্ঘ্য মাপলে দেখবেন তা পঞ্চাশ মিটারের থেকে কম। আবার ট্রেনের যাত্রী স্টেশন কত লম্বা মাপলে দেখবেন যে তাও ঠিক একই পরিমাণ কমে গেছে। কিন্তু স্টেশন মাস্টারের কাছে স্টেশনের এবং যাত্রীর কাছে ট্রেনের দৈর্ঘ্য অপরিবর্তিত থাকবে। যাত্রী যে ট্রেনের দৈর্ঘ্য মেপে দেখলেন পাল্টায়নি, স্টেশন মাস্টারের তাতে কী মনে হবে? তিনি দেখবেন যে শুধু যে ট্রেন ছোটো হয়েছে তা নয়, যাত্রীর স্কেলও গতিশীল, তাই তাও সেই একই অনুপাতে ছোটো হয়ে গেছে। তাই ট্রেনের দৈর্ঘ্যে যাত্রী কোনো পরিবর্তন দেখছেন না। আরও একটা কথা মনে রাখতে হবে। গতিশীল বন্তর দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হবে শুধুমাত্র বেগের দিক বরাবর। তাই ট্রেনের উচ্চতা বা প্রস্থ পাল্টাবে না।
       একটা প্রশ্ন মনে হওয়া স্বাভাবিক -- চলমান অবস্থায় স্থান বা কাল মাপার এই পরিবর্তনকে দর্শকরা কীভাবে দেখবেন? এখানে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের আরও এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিক মনে রাখতে হয়, তা হল সমাপতনের পর্যবেক্ষকনির্ভরতা। সমাপতন বলতে আমরা বুঝি দুটি ঘটনা একই সময়ে ঘটা। আইনস্টাইন দেখালেন যে যদি কোনো পর্যবেক্ষকের কাছে দুটি ঘটনা দু'টি ভিন্ন স্থানে একই সময় ঘটে; তবে তার সাপেক্ষে গতিশীল অপর কোনো পর্যবেক্ষকের কাছে সে দুটি সমাপতিত নয়, একটি আগে ও অপরটি পরে ঘটবে। কোনটি আগে কোনটি পরে হবে, তা পর্যবেক্ষকের গতির উপর নির্ভর করে। এবার দৈর্ঘ্যের পরিবর্তনের বিষয়টা দেখা যাক। চলমান ট্রেনের দৈর্ঘ্য মাপতে গেলে একই সময়ে ট্রেনের দুই প্রান্তের অবস্থান মাপতে হবে_ স্টেশন মাস্টার নিশ্চয় তাই করবেন। তাঁর কাছে দুই প্রান্তের অবস্থান মাপাটা সমাপতিত। কিন্তু ট্রেনের যাত্রীর কাছে এই দুটি ঘটনা একই সঙ্গে ঘটেনি। তিনি যেহেতু স্টেশন সাপেক্ষে গতিশীল, তাই তিনি দেখবেন দুটি প্রান্তের অবস্থান একই সময় মাপা হল না, স্টেশন মাস্টার ট্রেনের সামনের প্রান্তের অবস্থান আগে মাপলেন, আর পিছনের প্রান্তের অবস্থান মাপলেন পরে। আর সে জন্যই ট্রেনের দৈর্ঘ্য তাঁর কাছে কমে যাচ্ছে। ঠিক তেমনি সময়ের প্রবাহ মাপার জন্য গাড়িতে একটা ঘড়ি রাখতে হবে। ট্রেনের সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িটিও চলমান। রেললাইনের দু'টি স্থানে দুটি ঘড়ি রাখতে হবে যেগুলি স্টেশন মাস্টার মিলিয়ে রেখেছেন। এই দুটি ঘড়ির পাশ দিয়ে যখন ট্রেনের ঘড়িটি যাবে, তিনি সময় মিলিয়ে দেখবেন। কিন্তু এখানেও সমাপতনের প্রশ্ন, তাই যাত্রীর মনে হবে যে লাইনের ধারের ঘড়িগুলি আসলে মেলানো নেই। একারণেই সময়ের প্রবাহের হার স্টেশন মাস্টারের কাছে পাল্টে যাচ্ছে।
       এখন নিশ্চয় বোঝার অসুবিধা নেই যে দূরত্ব বা সময়ের মাপ পর্যবেক্ষকের গতির উপর নির্ভর করে। পর্যবেক্ষক যদি বস্তুর বা ঘড়ির সাপেক্ষে স্থির থাকেন, তাহলে তিনি যা মান পাবেন, গতিশীল হলে তা পাল্টে যাবে। অর্থাৎ যাত্রী বা স্টেশন মাস্টার দুজনের মাপই ঠিক, শুধু তাঁরা গতির বিভিন্ন অবস্থায় আছেন। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় যার সাপেক্ষে আমরা অবস্থান বেগ সময় ইত্যাদি মাপি, তাকে বলা হয় নির্দেশতন্ত্র। যাত্রী ও স্টেশনমাস্টারের নির্দেশতন্ত্রদুটি পরম্পরের সাপেক্ষে গতিশীল। এখানে অবশ্য বলে রাখা দরকার যে নির্দেশতন্ত্রদুটির মধ্যে যে কোনো রকম গতির জন্য বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ খাটে না। নিউটনের প্রথম সূত্র হল বস্তুর উপর বলপ্রয়োগ না করলে তার গতির অবস্থার পরিবর্তন হয় না। যে ধরণের নির্দেশতন্ত্রে এই সূত্র সত্য তাদের বলা হয় জড়ত্বীয় নির্দেশতন্ত্র এবং একমাত্র তাদের ক্ষেত্রেই বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ খাটে। সেজন্য আগের উদাহরণে ট্রেন যদি সমবেগে সরলরেখায় গতিশীল না হয়, তাহলে স্থানকালের পরিবর্তন অবশ্যই হবে, কিন্তু তা বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
       বিশেষ আপেক্ষিকতার আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক এখানে আলোচনা করা দরকার। গতির সঙ্গে সঙ্গে যে সময় ও দূরত্বের পরিবর্তন হয়, তা আইনস্টাইনই প্রথম বলেছেন, তা নয়। বস্তুতপক্ষে এই সংক্রান্ত সমীকরণগুলি ডাচ পদার্থবিজ্ঞানী হেনড্রিক লরেঞ্জের আবিষ্কার, তাই আমরা এদের লরেঞ্জ রূপান্তর সমীকরণ বলি। তাহলে আইনস্টাইনকেই কেন আমরা বিশেষ আপেক্ষিকতার স্রষ্টা বলে মানি? আসলে সমীকরণগুলি আগে থেকে জানা থাকলেও সেগুলির মর্ম বুঝতে বিজ্ঞানীরা অক্ষম ছিলেন। তাঁরা ইথারের বিভিন্ন ধর্ম কল্পনা করে সমীকরণগুলি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছিলেন। আইনস্টাইন কেবল আলোর গতি সংক্রান্ত থেকে অনুমান থেকে দেখান যে এটা আসলে ইথার নয়, দেশকালেরই ধর্ম। আইনস্টাইনের তত্ত্বে ইথারের কোনো প্রয়োজন নেই। আধুনিক কালে প্রায় কোনো বিজ্ঞানীই আর ইথার নিয়ে মাথা ঘামান না।
       পাঠকের মনে হতেই পারে যে এই সময় বা দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন আগে কারো খেয়ালে আসেনি কেন? কেনই বা আমরা এই ধরণের অদ্ভুত ঘটনা আমাদের জীবনে দেখতে পাই না? আমরা কেউই তো চলমান ট্রেনকে ছোটো হয়ে যেতে দেখিনি। তার কারণ হল আলোর গতিবেগ এত বেশি যে আমরা সাধারণত দৈনন্দিন জীবনে যে ধরণের বেগের সম্মুখীন হই তাদের জন্য এই পরিবর্তনের পরিমাণ খুবই সামান্য। সহজ করে বোঝানোর জন্য আমরা ট্রেনের উদাহরণ নিয়েছি। ট্রেনের গতিবেগ ধরেছি ঘণ্টায় ষাট কিলোমিটার। এর জন্য দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হবে একটা পরমাণুর ব্যাসের থেকেও অনেক কম। অন্যভাবে বললে সময়ের পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ট্রেনযাত্রী ও স্টেশন মাস্টারের ঘড়িতে এক সেকেন্ড তফাৎ হওয়ার জন্য যাত্রা দু’কোটি বছরেরও বেশি ধরে চলতে হবে। সহজেই বোঝা যাচ্ছে আমরা রোজকার জীবনে কেন আপেক্ষিকতার প্রভাব দেখতে পাই না। উচ্চ বেগের ক্ষেত্রে কিন্তু পরিবর্তনের হার অনেক বেশি। সেকেন্ডে ৪২০০০ কিলোমিটার বেগে গেলে সময় বা দৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হবে এক শতাংশ। গতিবেগ যদি আলোর বেগের নিরানব্বই শতাংশ হয়, তবে চলমান ঘড়ির এক সেকেন্ড হবে স্থির ঘড়ির সাত সেকেন্ডের বেশি। ইলেকট্রন প্রোটন জাতীয় মৌল কণার ক্ষেত্রে এখন এধরণের বেগ সহজেই পাওয়া সম্ভব। সেখানে আপেক্ষিকতাবাদের ভবিষ্যৎবাণী মিলিয়ে দেখা হয়েছে এবং পরীক্ষার ফলের সঙ্গে তা সম্পূর্ণ মিলে গেছে।
       দূরত্ব বা সময়ের পরিবর্তন যখন হয়, তখন বেগেরও নিশ্চয় পরিবর্তন হবে। বোঝাই যায় বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্বে আলোর বেগের একটা বিশেষ স্থান আছে। সাধারণভাবে বলা যায় আলোর বেগ হল সর্বোচ্চসীমা যাকে অতিক্রম করা বস্তুর পক্ষে সম্ভব নয়। একটা সহজ উদাহরণ নেয়া যাক। ধরা যাক একটা গাড়ি রাস্তার সাপেক্ষে ঘণ্টায় একশ কিলোমিটার বেগে যাচ্ছে। গাড়ি থেকে সামনের দিকে যদি ঘণ্টায় একশ কিলোমিটার বেগে কোনো বল ছোঁড়া হয়, তাহলে নিউটনের সূত্র অনুযায়ী রাস্তার সাপেক্ষে বলটির বেগ হবে ঘণ্টায় দুশ কিলোমিটার। আপেক্ষিকতাবাদের উত্তরও ঘণ্টায় দুশ কিলোমিটারের এত কাছে যে তফাত করা সম্ভব নয়। কিন্তু যদি গাড়ির গতিবেগ রাস্তার সাপেক্ষে সেকেন্ডে দু লক্ষ কিলোমিটার এবং বলের বেগ গাড়ির সাপেক্ষে সেকেন্ডে দু লক্ষ কিলোমিটার হয়, সেক্ষেত্রে কী হবে? নিউটনের সূত্র মানলে রাস্তার সাপেক্ষে বলের বেগ হবে সেকেন্ডে চার লক্ষ কিলোমিটার অর্থাৎ আলোর বেগের থেকে বেশি। আপেক্ষিকতা অনুযায়ী এ বেগ হবে প্রায় দু লক্ষ সাতাত্তর হাজার কিলোমিটার। আগেই বলেছি আলোর বেগ সেকেন্ডে তিন লক্ষ কিলোমিটার। এভাবে দেখানো যায় যে কোনো অবস্থাতেই বস্তুর বেগ আলোর থেকে বেশি হতে পারে না। পরীক্ষা করে দেখা গেছে এই ধরণের উচ্চবেগের জন্য বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদই সঠিক উত্তর দেয়। (গাড়ি এবং বলের জন্য এই বেগের প্রশ্ন ওঠে না কিন্তু মৌল কণার ক্ষেত্রে এধরণের বেগ পরীক্ষাগারে পাওয়া সম্ভব।)
       সবশেষে বলতে হয় ভর ও শক্তির সমতুল্যতার কথা। আইনস্টাইন দেখান যে বস্তুর ভর কোনো অপরিবর্তনীয় রাশি নয়, বস্তুর বেগ বাড়লে তার ভরের পরিমাণও বাড়ে। কোনো সাধারণ বন্তকে যদি আলোর বেগে চলতে হয়, তাহলে তার জন্য বস্তুটিকে অসীম পরিমাণ শক্তি দিতে হবে। আইনস্টাইনের নাম শুনলেই সবার মনে আসে E=mc2 সূত্রের কথা। এখানে m হল বস্তুর ভর, E হল তার সমতুল্য শক্তি ও c হল আলোর বেগ। এই সূত্রটিও আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্বে ভরের পরিবর্তন থেকেই নির্ণয় করেন। এখন আমরা ইলেকট্রন, প্রোটন বা অন্যান্য মৌলিক কণার ভর প্রায়শই শক্তির এককে বলে বা লিখে থাকি।
       বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ আজ আর নিছক এক তত্ত্ব নয়, পদার্থবিজ্ঞানের যে কোনো প্রকল্পের অন্যতম কষ্টিপাথর। যে কোনো নতুন চিন্তা, নতুন প্রকল্প বা নতুন কল্পনা যদি বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ সম্মত হয়, তবেই তাকে পূর্ণাঙ্গ তত্ত্বের মর্যাদা দেওয়া যেতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের সঙ্গে না মিললেই তত্ত্বটি ভুল, কিন্তু এটা স্বতঃসিদ্ধ যে সেক্ষেত্রে সেই তত্ত্বের আরও উন্নতি করার সুযোগ আছে।
       ভর ও শক্তির সমতুল্যতা সংক্রান্ত সূত্রটি পদার্থবিজ্ঞানের এক বহু প্রাচীন সমস্যার সমাধান করল। সূর্য বা অন্য তারাদের শক্তির উৎস নিয়ে বিজ্ঞানীরা বহু দিন চিন্তিত ছিলেন। সূর্য যে হারে শক্তি বিকিরণ করে, কোনো ভাবেই তা ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। সূর্য যদি একটা কয়লার বল হত, তাহলে বর্তমান হারে তা মাত্র কয়েক হাজার বছর শক্তি দিতে সক্ষম হত। অন্য অনেক প্রকল্প করেও সূর্যের জীবনকাল কয়েক কোটি বছরের বেশি কল্পনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু ভূতত্ববিদরা প্রমাণ করেছিলেন যে পৃথিবীর বয়সই অন্তত চারশো কোটি বছর। সূর্যের বয়স কী ভাবে পৃথিবীর থেকে কম হবে? ভর ও শক্তির সমতুল্যতা থেকে সমস্যার সমাধান পাওয়া গেল। পারমাণবিক সংযোজন (nuclear fusion) বিক্রিয়াতে প্রতি মুহূর্তে সূর্যে বিপুল পরিমাণ ভর আলো, তাপ ও অন্যান্য শক্তি হিসাবে সুক্ত হচ্ছে। তাই সূর্যের বয়স চার থেকে পাঁচশ কোটি বছর হলেও অসুবিধা নেই _ আরও কয়েকশ কোটি বছর সূর্য বর্তমান হারে শক্তি দিতে সক্ষম। আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই সূত্রটিকেই ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি হয়েছিল পরমাণু বোমা যা জাপানে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ব্যবহার হয়। শুধু যুদ্ধ নয়, শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যেও একে প্রয়োগ করা গেছে। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও এই সূত্র কাজে লাগে।
       ১৯০৫ সালের পর আইনস্টাইন পদার্থবিজ্ঞানের অন্য অনেক বিষয়ে গবেষণা করেন। কিন্তু যে গবেষণার জন্য তিনি সাধারণ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে পরিচিত হন, তা হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ আগেই বলেছি বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্বে আমরা ধরে নিই যে নির্দেশতন্ত্রটি জড়ত্বীয়। সাধারণ আপেক্ষিকতাতত্ত্বে এই বাধা নেই। তাই ত্বরণ-সম্পন্ন অর্থাৎ পরিবর্তনশীল গতি এবং মাধ্যাকর্ষণ একসঙ্গে স্থান পেয়েছে এই তত্ত্বে। সাধারণ আপেক্ষিকতা আসলে হল মাধ্যাকর্ষণের ক্ষেত্রতত্ত্ব (Field theory)| পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যামিতির মিলনে জন্ম এই তত্ত্বের। আবার এখান থেকেই আইনস্টাইন শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানের আর এক নতুন শাখার যার প্রয়াস হল গোটা বিশ্ববহ্মাণ্ডকে ব্যাখ্যা করার। এই নতুন বিজ্ঞান cosmology বলে পরিচিত।
       সাধারণ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব কিন্তু চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের (Classical physics) অংশ। আলোক তড়িৎ বিক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাহায্য নেন। কোয়ান্টাম তত্ত্বের তখন শৈশব। এর অগ্রগতিতে আইনস্টাইনের অবদান বা পরবর্তীকালে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে উত্তরণের পর এই তত্ত্ব সম্বন্ধে তার বিরোধিতা বিষয়ে কিছু বলতে গেলে বর্তমান নিবন্ধ অতি দীর্ঘ হয়ে যাবে। শুধু একটা বিষয়ের উল্লেখ না করলে বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্বের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মিলনে জন্ম নেয় কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব যা প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য পদার্থবিজ্ঞানীর হাতে সবচেয়ে বড় অন্ত্র।
       শেষ জীবনে আইনস্টাইন তিরিশ বছরেরও বেশি ব্যয় করেছিলেন একীকৃত ক্ষেত্রতত্ত্ব (Unified field theory) বিষয়ে গবেষণায়। তাঁর স্বপ্ন ছিল এমন একটি প্রকল্পের যেখানে স্থান পাবে একই সঙ্গে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ও তড়িৎচৌম্বক তত্ত্ব। সমকালীন বিজ্ঞানীরা এবিষয়ে বিশেষ উৎসাহী ছিলেন না। কিন্তু গত কয়েক দশকে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। আমরা এখন জানি যে একীকৃত ক্ষেত্র তত্ত্বে স্থান দিতে হবে আরও দুটি বল, সবল ও দুর্বল বলকে (Strong and weak force)| এ দুটি বিষয়ে আইনস্টাইনের সরাসরি কোনো অবদান নেই। কিন্তু একক চেষ্টাতে তিনি বিজ্ঞানের যে শাখার গোড়াপত্তন করেছিলেন, তা আজ পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার অন্যতম প্রধান ক্ষেত্র। এর থেকেই আইনস্টাইনের অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। এই গবেষণার জন্য প্রয়োজন সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মিলন। বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এই বিষয়েই কাজ করেন। আধুনিক String theory-ও এই গবেষণারই অংশ।
       এ পর্যন্ত পড়ে হয়তো কারো মনে হয়েছে যে বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্ব কেবল উচ্চতর তাত্ত্বিক বিজ্ঞানে কাজে লাগে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তার কোনো প্রয়োগ নেই। এবার তাই এই তত্ত্বের দুটি ব্যবহারের কথা বলি। আধুনিক কালে পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থান নির্ণয়ের জন্য জি. পি. এস. বা Global Positioing System ব্যবহার করা হয়। এই ব্যবস্থায় মহাকাশে স্থাপিত কৃত্রিম উপগ্রহের সঙ্গে রেডিয়ো তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ করে পৃথিবীতে কোনো জি. পি. এস. রিসিভারের অবস্থান পাঁচ থেকে দশ মিটারের মধ্যে নির্ণয় করা সম্ভব। রেডিয়ো তরঙ্গও তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, তার বেগও আলোর বেগের সমান। তাই দশ মিটারের মধ্যে অবস্থান নির্ণয় করতে হলে উপগ্রহের ঘড়ি থেকে অত্যন্ত সঠিক সময় পাওয়া প্রয়োজন -- সহজেই বোঝা যায় ঘড়িটি স্লো বা ফাস্ট হতে পারে খুব বেশি হলে এক সেকেন্ডের দশ কোটি ভাগের তিন ভাগ। উপগ্রহগুলি মহাকাশে পৃথিবীর চার দিকে ঘুরছে। তাদের বেগের জন্য তাদের ঘড়িতে সময়ের প্রবাহ ধীরগামী। আবার মহাকাশে পৃথিবীর অভিকর্ষ কম, সে জন্য তাদের ঘড়ির সময় সাধারণ আপেক্ষিকতা অনুসারে পরিবর্তিত হয়। (এ বিষয়ে বর্তমান নিবন্ধে আলোচনা করা হয়নি।) এদের জন্য ঘড়িতে সময়ের পরিবর্তন হতে পারে দিনে এক সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগের চার ভাগ। এজন্য উপগ্রহের ঘড়িতে বিশেষ ও সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ, দুয়েরই প্রভাব হিসাব করতে হয়। প্লেনে, এমনকি বহু আধুনিক গাড়িতে জি. পি. এস. ব্যবহার করা হয়। আবার আমাদের ঘরে আগে যে টেলিভিশন ব্যবহার করা হযত, সেখানে অতি উচ্চবেগের ইলেকট্রন এসে টিভির পর্দাতে পড়ত। ইলেকট্রনের বেগ বেশি বলে তাদের ভরেরও বৃদ্ধি হয়। টেলিভিশন সেট বানানোর সময় ভরের এই পরিবর্তনকে হিসাব করে ডিজাইন করতে হয়।

পরিশিষ্ট

উৎসাহী ছাত্রদের যদি জন্য বিশেষ আপেক্ষিকতাতত্ত্বের কয়েকটি ফল অঙ্কের আকারে প্রকাশ করা হল। যদি কোন দণ্ডের দৈর্ঘ্য স্থির অবস্থায় L0 হয় এবং কোনো দর্শকের সাপেক্ষে দৈর্ঘ্য বরাবর যদি সেটি v বেগে যায়, তবে দর্শকের কাছে দণ্ডটির দৈর্ঘ্য হবে 

 এখানে c হল শূন্যস্থানে আলোর বেগ। তেমনি দর্শকের সাপেক্ষে v বেগে চলমান ঘড়িতে যখন t0  সময় অতিক্রান্ত, দর্শকের ঘড়িতে তখন 
সময় চলে গেছে। এই দুটি ফল থেকে দেখানো যায় যে একটি গাড়ি যদি রাস্তার সাপেক্ষে কোনো দিকে u1 বেগে যায় এবং গাড়ির গতির দিকে যদি u2 বেগে বল ছোঁড়া হয়, তবে রাস্তার সাপেক্ষে বলের বেগ হল 

সবশেষে, যদি কোনো বস্তুর ভর স্থির অবস্থায় m0 হয় পর্যবেক্ষকের সাপেক্ষে v  বেগে চললে পর্যবেক্ষক সেটির ভর মাপলে পাবেন 
 এই সমীকরণগুলিকে ব্যবহার করে নিবন্ধে যে দৈর্ঘ্য সংকোচন, ঘড়ির স্লো হওয়া বা দুটি বেগের যোগফলের কথা বলা হয়েছে, তা নির্ণয় করা সম্ভব। এছাড়া বেগের যোগের নিয়ম থেকে দেখানো যায় যে আলোর বেগ বা তার চেয়ে কম দুটি বেগের যোগফল কখনো আলোর বেগের থেকে বেশি হবে না।
প্রকাশ: পর্ষদ বার্তা এপ্রিল ২০০৬, পরিমার্জিত






পুনশ্চ-১ঃ বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ অনেক জায়গায় অ্যানিমেশনের সাহায্যে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যেমন এই ওয়েবসাইটটা

পুনশ্চ-২ঃ সহজ কথায় আপেক্ষিকতা (বা কোয়ান্টম মেকানিক্স) জানতে গেলে জর্জ গ্যামোর মিস্টার টমকিন্সের (Mr Tompkins in Wonderland) তুলনীয় কিছু আমার জানা নেই।


পুনশ্চ-৩ঃ এখানে সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে বিশেষ আলোচনা নেই। এই ব্লগে এই লেখাটায় সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ নিয়ে লিখেছিলাম।






Wednesday 13 September 2017

গ্রন্থবীক্ষণঃ হিন্দুগণিত ও ভাস্করাচার্য






২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে খবর পেলাম বাখশালি পুঁথির বয়স কার্বন ডেটিং করে নির্ণয় করা হয়েছে। পুঁথির সবচেয়ে পুরোনো পাতা খ্রিস্টিয় তৃতীয় বা চতুর্থ শতাব্দিতে লেখা হয়েছিল। ভারতে স্থান রক্ষক হিসাবে শূন্যের ব্যবহারের এটাই সবচেয়ে পুরানো দৃষ্টান্ত। তবে মূল লেখাতেও বলেছি, স্থান রক্ষক হিসাবে শূন্যের ব্যবহার সব প্রাচীন সভ্যতাই করত। ভারতের কৃতিত্ব শূন্যকে সংখ্যা হিসাবে চিহ্নিত করা -- সেটা অনেক পরের ঘটনা।উল্লেখযোগ্য বাখশালি পুঁথিতে শূন্য বোঝাতে বিন্দু ব্যবহার করা হয়েছিল, সেটাই বর্তমান '0'-তে রূপান্তরিত হয়েছে।

Friday 8 September 2017

ধূমকেতুর সওয়ার



ধূমকেতুর সওয়ার

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      জুলে ভের্নের গল্প ‘হেক্টর সারভাডাক’-এ গ্যালিয়া ধূমকেতু পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে একটা টুকরোকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তার সঙ্গে ছিল কয়েকজন মানুষ। দু বছর পরে আবার সে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে গিয়েছিল, তখন সেই মানুষেরা একটা বেলুনে চড়ে পৃথিবীতে ফিরে আসেন। সত্যি সত্যি ধূমকেতুর পিঠে চড়ার সুযোগ এখনো কোনো মানুষের হয়নি, কিন্তু মানুষের তৈরি যন্ত্রের হয়েছে। ২০১৪ সালের ১২ নভেম্বর ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির জার্মান মহাকাশযান রসেটার অবতরণযান ফাইলি এক নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছিল। তার পিছনে অবশ্য ছিল দুই দশকের প্রস্তুতি।
      বিজ্ঞানীরা ১৯৯৩ সালেই রসেটা অভিযানের প্রস্তাব করেছিলেন, লক্ষ্য কোনো ধূমকেতুর বুকে অবতরণ। এর জন্য প্রথমে বেছে নেওয়া হয়েছিলো ধূমকেতু ৪৬পি/উইরটানেন। এগারো বছর পরে ২০০৪ সালের দোসরা মার্চ ফরাসি গায়না থেকে এরিয়েন রকেটে সওয়ার হয়ে রসেটা যাত্রা শুরু করে। এর মধ্যে এক রকেট দুর্ঘটনার জন্য মিশন এক বছর পিছিয়ে যায়। ধূমকেতুরা মাধ্যাকর্ষণের সূত্র মেনে তাদের নিজেদের কক্ষপথে চলাফেরা করে, তারা আমাদের রকেটের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে না। তাই রসেটার লক্ষ্যও পাল্টাতে হয়, তার নতুন গন্তব্য হয় ১৯৬৯ সালে আবিষ্কৃত ধূমকেতু ৬৭পি/চুরাইমভ-গেরাসিমেঙ্কো। এত বড়ো নাম হওয়ার কারণ হল ধূমকেতুদের নাম দেওয়া হয় তাদের আবিষ্কর্তাদের নামে। সাড়ে ছয় বছরে ৬৭পি সূর্যকে একবার প্ৰদক্ষিণ করে। দশ বছর যাত্রার পর ২০১৪ সালের আগস্ট মাসে রসেটা ৬৭পি ধূমকেতুর চারপাশে কক্ষপথে স্থাপিত হয়। অবশেষে নভেম্বর মাসের ১২ তারিখে অভিযান সফল হয় ফাইলি ধূমকেতুর বুকে নামতে সক্ষম হয়।



রসেটার তোলা ৬৭পি ধূমকেতুর ছবি (Photo ESA/Rosetta/NAVCAM)

      এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে রসেটা তিনবার পৃথিবী ও একবার মঙ্গলের পাশ দিয়ে গেছে প্ৰতিবার সে অভিকর্ষকে ব্যবহার করে তার গতি বাড়িয়েছে। দুটি গ্রহাণু স্টেইন্স ও লুটেশিয়ার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে তাদের ছবি পাঠিয়েছে। স্টেইন্স একেবারেই ছোটো, মাত্র পাঁচ কিলোমিটার চওড়া। লুটেশিয়া অবশ্য বেশ বড়, ১৩০ কিলোমিটার। রসেটার ছবি থেকে বোঝা গেছে যে লুটেশিয়াতে ধাতুর পরিমাণ কম, সেখানে যে সমস্ত যৌগ আছে, তারা জল শোষণ করেছে। অর্থাৎ সেই গ্রহাণুতেও একসময় জল তরল অবস্থায় ছিল। লুটেশিয়াতে সৌরজগৎ সৃষ্টির সময়ের নানা সংঘর্ষের চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেছে। তার চারবছর পরে রসেটা ধূমকেতুতে পৌঁছায়, ফাইলির অবতরণের সময়েও সমস্যা হয়েছিল, সে সমস্যাও কাটিয়ে ওঠা গেল। এত দীর্ঘ সময়ের মিশনের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
      ধূমকেতু সম্পর্কে মানুষের কৌতূহল নতুন কিছু নয়। এক সময় প্রায় সব দেশেই তাকে অমঙ্গলের চিহ্ন হিসেবে দেখা হয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মেও ধূমকেতুর একটা ভূমিকা আছে। গ্রিক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আরিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে সূর্য চন্দ্র গ্রহ তারা সমন্বিত আকাশ হল দিব্যলোক বা স্বর্গ। তার কোনো পরিবর্তন হয় না। আমাদের এই পৃথিবী তার সমস্ত ক্লেদ নিয়ে পরিবর্তনশীল। ইউরোপে মধ্যযুগে আরিস্টটলের দর্শন ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু ধূমকেতুরা তো মাঝে মাঝে আসে তাহলে দিব্যলোক অপরিবর্তনীয় কেমন করে? আরিস্টটল বললেন, ধূমকেতুরা চাঁদের নিচে বায়ুমণ্ডলের মধ্যে থাকে। চাঁদের ওপার থেকে দিব্যলোকের সূচনা। কিন্তু ১৫৭৭ সালে এক মহা ধূমকেতু আকাশে দেখা দেয়। টাইকো ব্রাহের মতো কয়েকজন জ্যোতির্বিদ তার দূরত্ব মেপে দেখালেন যে তা চাঁদের থেকে অনেক দূরে আছে। তাই ক্ৰমে ক্ৰমে অপরিবর্তনীয় দিব্যলোকের ধারণা পরিত্যক্ত হল। আরিস্টটলের ভাববাদী মত অনুসরণের ফলে মধ্য যুগে ইউরোপে বিজ্ঞান যে কানাগলিতে ঢুকে পড়েছিলো, তার থেকে মুক্তির এটা ছিল একটা বড়ো ধাপ।
      ইতিহাসে সবচেয়ে বিখ্যাত ধূমকেতু হল হ্যালির ধূমকেতু। নিউটনের বন্ধু এডমন্ড হ্যালি নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র ধরে হিসাব কষে দেখিয়েছিলেন যে মোটামুটি ৭৬ বছর পর পর একটি বিশেষ ধূমকেতু ফিরে আসে। তাঁর হিসাব মেনে ধূমকেতুটি যখন আবার আকাশে দেখা দিলো, তখন হ্যালি আর বেঁচে নেই। শেষবার হ্যালির ধূমকেতু এসেছিলো ১৯৮৬ সালে, কলকাতা থেকে আমরা অনেকে তাকে দেখেছিলাম। দুটি মহাকাশযান, জিয়োত্তো ও ভেগা তাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছিলো।
      ধূমকেতু সম্পর্কে আজও আমাদের এত কৌতূহল কেন? পৃথিবীতে প্ৰাণের পিছনে ধূমকেতুর সম্ভবত বিরাট অবদান আছে। সৃষ্টির সময় পৃথিবী ছিল অত্যন্ত গরম। ঐ তাপমাত্রায় জল হাইড্রোজেন অক্সিজেনে ভেঙে যায়। হাইড্রোজেন হালকা গ্যাস, তা পৃথিবী ছেড়ে মহাকাশে মিলিয়ে যাবে। তাই সে সময় পৃথিবীতে জল থাকা সম্ভব নয়। তাহলে জল এলো কোথা থেকে? সৌরজগত এখন যেমন শান্ত, চিরকাল সেই রকম ছিল না। সৌরজগতের বাইরে অংশে প্লুটোর থেকেও অনেক দূরে আছে পাথর আর বরফ দিয়ে তৈরি ছোটো ছোটো অণু গ্রহ। তারা তৈরি করেছে এক গোলকাকার মেঘ। তার বাইরের ও ভিতরের অংশের নাম হল উর্ট মেঘ ও হিল মেঘ। বৃহস্পতির মতো দানব গ্রহদের আকর্ষণের ফলে সেই অণু গ্রহদের কয়েকটা মাঝে মাঝে সৌরজগতের দিকে রওনা দেয়। সৃষ্টি হয় ধূমকেতু। সৌরজগত যখন সৃষ্টি হয়েছিলো, তখন ধাক্কাধাক্কি হতো অনেক বেশি। তাই ধূমকেতুরাও সংখ্যায় ছিল অনেক। প্রায়শই ঐ রকম ধূমকেতু এসে পৃথিবীতে পড়তো। সেই জল থেকেই মহাসাগরের জন্ম। অবশ্য অনেক বিজ্ঞানী এই তত্ত্বের সঙ্গে সহমত নন। তাঁদের যুক্তি আলোচনা করা এখানে সম্ভব নয়। ধূমকেতু কী দিয়ে তৈরি তা ঠিকঠাক ভাবে জানতে পারলে আমরা হয়তো একসময় এই বিতর্কের সমাধান করতে পারবো। জলের বিষয়ে রসেটা কী জানিয়েছে, সে কথায় আমরা পরে আসছি।


শিল্পীর চোখে রসেটা থেকে ফাইলির ধূমকেতুতে অবতরণ (ESA)

      ধূমকেতু যখন সূর্যের কাছে আসে, তখন উত্তাপে তার থেকে জলীয় বাষ্প ও অন্যান্য নানা গ্যাস বেরিয়ে আসে। সৌর বিকিরণ ও সৌর বায়ুর প্রভাবে তা থেকে জন্ম নেয় ধূমকেতুর সবচেয়ে দর্শনীয় অংশ, তার পুচ্ছ বা লেজ। হ্যালির ধূমকেতুর ঐ উদ্বায়ী পদার্থের বর্ণালী বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে, পাওয়া গেছে জল, কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাই অক্সাইড এবং অ্যামোনিয়া। এছাড়াও কিছু জৈব যৌগের থাকার সম্ভাবনে দেখা যাচ্ছিল। প্ৰাণ সৃষ্টির সঙ্গে জৈব যৌগের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক আছে। একটা তত্ত্ব তো এমন কথাও বলে যে প্রাণের এক মূল অঙ্গ অ্যামিনো অ্যাসিডও হয়তো ধূমকেতুর মধ্যে তৈরি হয়েছিলো। অ্যামিনো অ্যাসিড দিয়েই তৈরি হয় প্রোটিন, যা ছাড়া প্ৰাণের অস্তিত্ব হয়তো সম্ভব নয়। প্ৰাণ সৃষ্টিতে ধূমকেতুর ভূমিকা জানতে চাইলেও তাই তার রাসায়নিক বিশ্লেষণ করতে হবে।
      বুঝতেই পারছ, রসেটার এই অভিযানের গুরুত্ব ছিল অনেক। সচেতনভাবেই বিজ্ঞানীরা তার নামটা বেছে নিয়েছেন। দুশো বছর আগে মিশরে যে রসেটা পাথর পাওয়া গিয়েছিলো তাতে প্ৰাচীন মিশরিয় লিপি ও প্রাচীন গ্রিক লিপিতে ফারাও পঞ্চম টলেমির আদেশ লিপিবদ্ধ ছিল। প্ৰাচীন গ্রিক লিপি প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানতেন, তার থেকেই প্রাচীন মিশরের লিপির পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়েছিলো। প্রাচীন মিশর সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের সমস্ত জ্ঞানের সূত্র তাই রসেটা পাথর। নতুন এই রসেটা কি প্রাচীন পৃথিবী তথা সৌরজগত সম্পর্কে আমাদের অনেক অজানা কথা শেখাবে? বিজ্ঞানীরা আশায় ছিলেন। একটা মজার কথা বলি, জুলে ভের্নের গল্পে ধূমকেতু যে মানুষগুলোকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে ছিলেন একজন ফরাসি জ্যোতির্বিদ। তাঁর নাম ছিল রসেট। জানি না মিশনের নামকরণের সময় সেই কথা কারো মনে ছিল কিনা।
      ফাইলির অবতরণের পরে ২০১৬ সালের ৩০শে সেপ্টেম্বর রসেটা ৬৭পি ধূমকেতুর বুকে নিয়ন্ত্রিত ভাবে ঝাঁপ দেয়। তার ঠিক আগে ধূমকেতুর খুব কাছ থেকে গ্যাস, ধুলো ও প্লাজমা সম্পর্কে নানা তথ্য পাঠায় সে। ঝাঁপ দেওয়ার জন্য বিজ্ঞানীরা একটা গহ্বরকে বেছে নিয়েছিলেন, কারণ ধূমকেতুর ভিতরের গঠনের সেই গহ্বরের থেকে পাওয়া যেতে পারে। সাড়ে বারো বছরের যাত্রার এইভাবেই শেষ হল। এই সময়ে রসেটা আটশো কোটি কিলোমিটার পথ পেরিয়েছে, সূর্যকে ছবার প্রদক্ষিণ করেছে। যাত্রার শেষ হলেও তার থেকে পাওয়া সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করতে আরো বহু বছর চলে যাবে। রসেটা মিশনের বিশদ বিবরণ ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির http://www.esa.int/Our_Activities/Space_Science/Rosetta এই ওয়েবসাইটে পাওয়া যাবে।
      এখনো পর্যন্ত রসেটা মিশন থেকে যা নতুন তথ্য পাওয়া গেছে সংক্ষেপে তার কয়েকটা আলোচনা করা যাক। ধূমকেতুতে পাওয়া গেছে আণবিক নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন। জলে ডয়টেরিয়াম ও সাধারণ হাইড্রোজেনের অনুপাত মেপে দেখা গেছে যে তা পৃথিবীর জলে যে অনুপাত আমরা পাই, তার থেকে তিনগুন বেশি। ভারি হাইড্রোজেন বা ডয়টেরিয়াম হল হাইড্রোজেনের আইসোটোপ। সাধারণ হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে একটা প্রোটন, ডয়টেরিয়ামের নিউক্লিয়াসে আছে একটা প্রোটন ও একটা নিউট্রন। উর্ট মেঘে যে ধূমকেতুদের জন্ম, তাদের ডয়টেরিয়ামের অনুপাত পৃথিবীর অনুপাতের বেশি। এই থেকে বোঝা গেছে যে এই ৬৭পি ধূমকেতু বহু প্রাচীন, সৌরজগত সৃষ্টির সময় সূর্য থেকে বহুদূরে এর জন্ম হয়েছিল। পৃথিবীতে জলের উৎস ধূমকেতু, এই কথাই আমরা আমরা ক্লাসে পড়তাম। কিন্তু ৬৭পির জলে ডয়টেরিয়াম ও সাধারণ হাইড্রোজেনের অনুপাত আমাদের সেই জ্ঞানকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। অতি সম্প্রতি জানা গেছে যে এক বিশেষ ধরনের ধূমকেতু, যাদের নাম দেয়া হয়েছে অতি-সক্রিয় ধূমকেতু, তাদের ক্ষেত্রে হাইড্রোজেন ও ডয়টেরিয়ামের অনুপাত পৃথিবীরই মতো। রসেটার যে প্রথম লক্ষ্য ছিল, সেই ৪৬পি/উইরটানেন ধূমকেতুর জলের ডয়টেরিয়ামের পরিমাণ ২০১৯ সালে মাপা সম্ভব হয়েছে। দেখা গেছে যে তা একেবারেই পৃথিবীর মাপের কাছাকাছি। তার জন্য অবশ্য ধূমকেতুতে যাওয়ার দরকার হয়নি, পৃথিবীতে বসেই ধূমকেতুর জলের বর্ণালীকে বিশ্লেষণ করে খবর বার করেছেন বিজ্ঞানীরা।
     ৬৭পি ধূমকেতুর থেকে ধূলিকণা বেরিয়ে আসে, তা রসেটার ডিটেক্টরে ধরা পড়েছিল। এই রকম ধূলিকণাই সৌরজগত সৃষ্টির সময় গ্রহ তৈরির সূচনা করেছিল। কিন্তু কেমন করে এগুলো ধূমকেতু থেকে বেরিয়ে আসছে, তা আমরা এখনো বুঝতে পারিনি। তবে এটা বোঝা যাচ্ছে যে রসেটা ভূতাত্ত্বিক ভাবে মৃত নয়, সেখানে নানা প্রক্রিয়া চলছে, যা এতদিন ছিল আমাদের ধারণার বাইরে।
      ফাইলির গ্যাস বিশ্লেষণ যন্ত্রগুলি আমাদের আরো জানিয়েছে যে ধূমকেতুর মধ্যে আছে বেশ কয়েকটি জৈব যৌগ। বিশেষ করে বলতে হবে ফর্মালডিহাইডের কথা। এই যৌগগুলির কয়েকটি প্রোটিন, সুগার এবং ডিএনএ অণু তৈরিতে কাজে লাগে। প্রাণের মূলে আছে এই অণুগুলি। মনে রাখতে হবে যে ৬৭পির জন্ম হয়েছিল সৌরজগত সৃষ্টির সময়। তাহলে কি প্রাণের সৃষ্টিতে সেই প্রথম যুগেরও ভূমিকা আছে? আমাদের সৌরজগতের বাইরে প্রাণ সৃষ্টির সম্ভাবনা তাহলে কি বেড়ে গেলো? এই সমস্ত নানা প্রশ্ন এখন বিজ্ঞানীদের ভাবাচ্ছে।
ছবিগুলি ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত (CC BY-SA IGO 3.0)

মূল লেখা : সৃষ্টির একুশ শতক, ডিসেম্বর ২০১৪, পরিবর্ধিত