Thursday 19 April 2018

বিদায় স্টিফেন হকিং

বিদায় স্টিফেন হকিং 

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


প্রয়াত হলেন এ যুগের সবচেয়ে পরিচিত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং (৮ জানুয়ারি ১৯৪২ – মার্চ ১৪, ২০১৮)। যৌবনেই তিনি আক্রান্ত হয়েছিলেন মোটর নিউরন রোগে যার সংক্ষিপ্ত নাম এ এল এস। ফলে জীবনের অধিকাংশ সময়ই তিনি ছিলেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত, চলাফেরা বা সাধারণভাবে কথা বলতে অক্ষম। এই পরিস্থিতিতে অন্য যে কেউ হাল ছেড়ে দিত। কিন্তু হকিং সাধারণ ছিলেন না। সমস্ত প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি বিজ্ঞান জগতে নিজের স্বাক্ষর রেখেছেন।  বিজ্ঞানী মহলে তাঁর খ্যাতি অনেক দিন, কিন্তু তাঁর বই ‘এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইমঃ ফ্রম দি বিগ ব্যাং টু ব্ল্যাক হোলস’ তাঁকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিশেষ জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল। এই বইটিতে তিনি অসাধারণ নৈপুণ্যের সঙ্গে মহাবিশ্ব সম্পর্কে তাঁর ও অন্যান্য বিজ্ঞানীদের গবেষণার কথা তুলে ধরেছিলেন। হকিঙের গবেষণার বিষয়বস্তু মোটেই সহজ নয়। এই জটিল বিষয়ে লেখা বইয়ের  আড়াই কোটি  কপি বিক্রি এবং চল্লিশটি ভাষায় অনুবাদ – এই সংক্ষিপ্ত তথ্য থেকে বিজ্ঞান লেখক হকিঙের কৃতিত্বের একটা আন্দাজ আমরা পেতে পারি। এই নিবন্ধে আমরা খুব সংক্ষেপে হকিঙের প্রধান গবেষণাগুলির দিকে চোখ রাখব এবং গবেষণার বাইরেও তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে দু’চার কথা শুনব।
স্টিফেন হকিঙের জন্ম ১৯৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে।  বাবা ফ্রাঙ্ক ছিলেন জীববিদ্যার গবেষক, ট্রপিকাল রোগ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ।  মা ইসোবেল ছিলেন মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী, একসময় ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলান। হকিঙের জীবনদর্শনের উপর তাঁর প্রভাব খুব স্পষ্ট। লন্ডন এবং পরে সেন্ট অ্যালবানসে বড় হয়ে ওঠেন হকিং, পড়াশোনা করেন সেন্ট অ্যালবানস স্কুলে। তারপরে বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হন অক্সফোর্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজে। সেখানকার শিক্ষকরা মনে করতেন হকিং যথেষ্ট প্রতিভাধর, কিন্তু সেই অনুপাতে পরিশ্রমী নন।
অক্সফোর্ড থেকে প্রকৃতিবিজ্ঞানে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণার জন্য ১৯৬২ সালে তিনি এলেন কেমব্রিজের ট্রিনিটি হল। তাঁর ইচ্ছা ছিল বিখ্যাত বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েলের কাছে গবেষণা করবেন, কিন্তু হয়েলের কাছে তখন কোনো শূন্যস্থান ছিলনা। তাঁর ডক্টরেটের গাইড হলেন ডেনিস স্কিয়ামা। হকিং যে বিষয়ে কাজ করতেন, তা হল সাধারণ আপেক্ষিকতা এবং ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্ব (Cosmology)। স্কিয়ামার নাম হকিং আগে শোনেন নি, কিন্তু এই ঘটনা তাঁর কাছে শাপে বর হয়েছিল, কারণ স্কিয়ামা ছিলেন আধুনিক কসমোলজির স্রষ্টাদের মধ্যে অন্যতম। 
কৈশোরে ঘোড়ায়-চড়া ও নৌকা-চালানো জাতীয় খেলাধুলাতে হকিঙের বিশেষ উৎসাহ ছিল। সে সবেরই সমাপ্তি ঘটল ১৯৬৪ সাল নাগাদ, যখন হকিং-এর মোটর নিউরন সমস্যা, এ এল এস রোগ ধরা পড়ল -- প্রায় সম্পূর্ণ পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় বাকি জীবনটা কাটাতে হয় তাঁকে। সেই সময় চিকিৎসকরাও দু’তিন বছরের বেশি আয়ুর আশ্বাস তাঁকে দিতে পারেন নি। প্রথমে মানসিক অবসাদের শিকার হলেও তিনি তা কাটিয়ে ওঠেন এবং ১৯৬৬ সালে তাঁর কৃষ্ণ গহ্বর (Black Hole) বিষয়ে তাঁর ডক্টরেটের থিসিস জমা দেন। ১৯৮৫ সালে নিউমোনিয়ার সময় তাঁর স্বরযন্ত্র অপারেশন করে বাদ দিতে হয়। তারপর থেকে তিনি কথা বলার জন্য কম্পিউটার চালিত সিনথেসাইজার ব্যবহার করতেন।

 
 অপর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী রজার পেনরোজের কৃষ্ণ গহ্বর সংক্রান্ত উপপাদ্যটিকে হকিং তাঁর থিসিসে   সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডের উপর প্রয়োগ করেছিলেন। আমরা জানতাম যে চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান অনুসারে কৃষ্ণ গহ্বর হল এমন শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রের উৎস যাকে অগ্রাহ্য করে কোনো কিছুই গহ্বর থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর বিখ্যাত সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্বের (General Theory of Relativity) পূর্ণ রূপ উপস্থাপন করেন। এ হল আসলে মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব, আইনস্টাইন দেখালেন মাধ্যাকর্ষণ আসলে কোনো বল নয়। বস্তুর ভরের জন্য সে তার চারপাশের স্থানকালকে বাঁকিয়ে দেয়, ফলে তার কাছে এসে সরলরেখাও বেঁকে যায়। যেমন সূর্য তার পাশের স্থানকাল ক্ষেত্রকে এমনভাবে বিকৃত করেছে যে পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা সবাই নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের কথা স্কুলে পড়েছি। আইনস্টাইন দেখালেন যে খুব শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্রে নিউটনের তত্ত্ব পুরোপুরি খাটবে না। ১৯৩৯ সালে জে  রবার্ট ওপেনহাইমার এবং হার্টল্যান্ড স্নাইডার সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব ব্যবহার করে কৃষ্ণ গহ্বরের কথা প্রথম বলছিলেন। একটা কথা বলে রাখা ভালো, নিউটনের তত্ত্ব থেকেও কৃষ্ণ গহ্বরের ধারণা পাওয়া যায়, তবে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ যে ধরনের কৃষ্ণ গহ্বরের কথা বলে তা অনেকাংশেই আলাদা।
কৃষ্ণ গহ্বরের সৃষ্টি বিভিন্ন ভাবে হতে পারে। যেমন কোনো বিরাট তারকা যখন তার জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে, তখন সে নিজের মাধ্যাকর্ষণের জন্য সংকুচিত হয়। আগেই বলেছি যে তারকার ভর তার চারপাশের স্থানকাল ক্ষেত্রকে বাঁকিয়ে দেয়। ওপেনহাইমাররা দেখালেন বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে এই তারকার ভর যদি খুব বেশি থাকে, তাহলে সংকোচনের মাত্রা এতটাই হয় যে তার ঘনত্ব এবং স্থানকালের বক্রতা অসীমে পৌঁছে যায়। একে বলে সিঙ্গুলারিটি বা ব্যতিক্রমী বিন্দু। তার চারদিকে তৈরি হয় এক ঘটনা সীমান্ত (Event Horizon) যার মধ্যে থাকলে কোনো বস্তু, এমনকি আলোর পক্ষেও মাধ্যাকর্ষণকে অস্বীকার করে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
হকিং যখন কেমব্রিজে গবেষণা করছেন, সেই সময় ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞানী রয় কার সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সমীকরণ থেকে নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণায়মান কৃষ্ণ গহ্বরের সমীকরণ সমাধান করেন। তার পরেই বিজ্ঞানী রজার পেনরোজ এক উপপাদ্যে দেখালেন যে কোনো বিশেষ পরিস্থিতি নয়, কোনো তারকার ভর যদি বেশি থাকে, এবং তা যদি নিজের চারদিকে আবর্তন না করে, তাহলে তার অন্তিম পরিণতি অবশ্য কৃষ্ণ গহ্বর। হকিংও এই ধরনের কৃষ্ণ গহ্বর ও সিঙ্গুলারিটি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। স্কিয়ামার উদ্যোগে পেনরোজের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়।
পেনরোজের উপপাদ্যটি ব্যবহার হচ্ছিল বিশাল তারকার মৃত্যুকালীন পরিস্থিতি ব্যাখ্যাতে, হকিং সম্পূর্ণ এক নতুন ক্ষেত্রে সেটিকে প্রয়োগ করলেন। আমরা জানি যে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জন্ম হয়েছিল এক মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে যার নাম দেওয়া হয়েছে বিগ ব্যাং। মহাবিশ্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। তার অর্থ অতীতে মহাবিশ্ব ছিল আরও ক্ষুদ্র এবং তার ঘনত্ব ছিল আরো বেশি। মহাবিশ্বের জন্মমুহূর্ত তাহলে কেমন ছিল?  হকিং দেখালেন সেই মুহূর্তে মহাবিশ্বের ঘনত্ব ছিল অসীম। এমন নয় যে হকিংই এই কথা প্রথম বলেছিলেন, কিন্তু তখনো পর্যন্ত ধারণা ছিল যে খুব নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতেই আদি ঘনত্ব অসীম হওয়া সম্ভব, কিন্তু সাধারণভাবে হয়তো সে কথা সত্যি নয়। আমাদের বিশ্বের ক্ষেত্রে আদি ঘনত্ব হয়তো অসীম ছিলনা। পেনরোজের উপপাদ্য প্রয়োগ করে হকিং দেখালেন বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্র নয়, মহাবিশ্বের প্রায় সমস্ত মডেলের ক্ষেত্রেই আদিতে ছিল সেই সিঙ্গুলারিটি।
এর পরে হকিং রজার পেনরোজের সঙ্গেই কাজ শুরু করেছিলেন। তাঁদের যৌথ গবেষণার ফল হিসাবে আমরা আরো কয়েকটি উপপাদ্য পেয়েছি যাদের একসঙ্গে পোশাকি নাম হকিং পেনরোজ সিঙ্গুলারিটি উপপাদ্যসমূহ। এই গবেষণায় কাজে লেগেছিল একটি বিশেষ সমীকরণ যার সঙ্গে আমাদের দেশের এক বিজ্ঞানীর নাম জড়িত। সাধারণ আপেক্ষিকতা বা জেনারেল রিলেটিভিটি বিষয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক অমল রায়চৌধুরির আবিষ্কৃত রায়চৌধুরি সমীকরণ ব্যবহার করেছিলেন হকিং ও পেনরোজ। কোন কোন ক্ষেত্রে তারকারা শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণ গহ্বরে পরিণত হবে, হকিংরা তা নির্ধারণ করলেন। ব্র্যান্ডন কার্টারের সঙ্গে মিলে হকিং আরো দেখান যে নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণায়মান কোনো কৃষ্ণ গহ্বরের চরিত্র ব্যাখ্যা করার জন্য মাত্র দুটি জিনিস জানা দরকার তা হল তার ভর ও ঘূর্ণন বেগ। এই দুটি মানের সাহায্যেই আমরা কৃষ্ণ গহ্বরের বাইরের কোনো পর্যবেক্ষক গহ্বর সম্পর্কে কী দেখতে পাবে তা বলে দিতে পারি। যদি দুটি বস্তুর ভর ও ঘূর্ণন বেগ সমান হয়, সংকোচনের ফলে তাদের থেকে যে দুটি কৃষ্ণ গহ্বর পাওয়া যাবে, গহ্বরের বাইরের পর্যবেক্ষকের কাছে তাদের সমস্ত চরিত্র একেবারে একই রকম হবে। কেরের সমীকরণ থেকে তাদের সমস্ত ধর্ম নির্ণয় করা যাবে। একে বলে ‘No hair theorem’। তারকা বা অন্য কোনো ভারি বস্তু, যা থেকেই কৃষ্ণ গহ্বর তৈরি হোক না কেন, সেই বস্তু সম্পর্কে গহ্বর সৃষ্টি হওয়ার আগের অন্য কোনো তথ্য ঘটনা সীমান্তের বাইরে পাওয়া যাবে না। 
হকিং, কার্টার এবং জেমস বার্ডিন তিনজনে মিলে এর পর কৃষ্ণগহ্বর সম্পর্কে একটা সম্পূর্ণ অন্য দিক তুলে ধরেন। সে কথায় যাওয়ার আগে তাপগতিবিদ্যা সম্পর্কে দু একটা কথা মনে রাখা দরকার। এনট্রপি বলে একটি রাশি আছে যাকে আমরা বলি বিশৃঙ্খলার মাপ। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র অনুসারে যে কোনো প্রক্রিয়ায় এই এনট্রপি সবসময়েই বৃদ্ধি পায়। তেমনি যে কোনো বস্তুর একটা তাপমাত্রা থাকে। কৃষ্ণ গহ্বরের ক্ষেত্রে এই এনট্রপি বা তাপমাত্রা কেমন করে পাওয়া যাবে? হকিংরা দেখালেন কৃষ্ণ গহ্বরের ঘটনা সীমান্তের ক্ষেত্রফল হল তার এনট্রপির পরিমাপ। তেমনি ঘটনা সীমান্তে অভিকর্ষজ ত্বরণ হল তার তাপমাত্রার মাপক। একইভাবে আমরা সহজেই বুঝতেই পারি পারি কৃষ্ণ গহ্বরের ভর হল তার মোট শক্তির পরিমাপ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিজ্ঞানী জ্যাকব বেকেনস্টাইনও এ বিষয়ে গবেষণাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
এর পরেই আসে হকিং-এর সবচেয়ে বিখ্যাত আবিষ্কার কৃষ্ণগহ্বর থেকে নির্গত বিকিরণ যা হকিং বিকিরণ নামে পরিচিত। আগেই বলেছি যে চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুসারে কৃষ্ণ গহ্বর বা ব্ল্যাক হোল থেকে কখনোই কোনো কিছু বেরিয়ে আসে না। অথচ হকিংরা দেখিয়েছেন যে কোনো কৃষ্ণ গহ্বরের একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা আছে এবং তাপমাত্রা থাকার অর্থ হল তাপগতিবিদ্যা অনুসারে তার থেকে বিকিরণ নির্গত হবে।  এই দুই বিপরীতকে মেলাব কেমন করে?
হকিং এখানে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার শরণাপন্ন হলেন। গত শতাব্দীর ঠিক সূচনাতে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্ম দিয়েছিলেম ম্যাক্স প্লাঙ্ক। আইনস্টাইন, নিলস বোর, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ, এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার, পল ডিরাক, রিচার্ড ফেইনম্যান সহ আরো অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর গবেষণার ফলে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে যে কণাসমূহের গতির সঠিক ব্যাখ্যা একমাত্র কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রয়োগের মাধ্যমে সম্ভব। তেমনি আমরা এও জানি যে সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বিবর্তন ব্যাখ্যার চাবিকাঠি। কিন্তু আজ পর্যন্ত এই দুই তত্ত্বকে মেলানো সম্ভব হয়নি। হকিঙের গবেষণাকে এই মেলানোর বিষয়ে প্রথম ধাপ বলা যেতে পারে। আরো সঠিক ভাবে বললে হকিং দেখিয়েছিলেন এই দুই তত্ত্বকে মেলাতে গেলে বিজ্ঞানের আরো এক মৌলিক তত্ত্বকে হিসাবে আনতেই হবে তা হল তাপগতিবিদ্যা। এ বিষয়ে হকিঙের কৃতিত্ব অনন্য। সংক্ষেপে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাক।
আমরা জানি যে কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র অত্যন্ত শক্তিশালী। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সবচেয়ে উন্নত রূপ হল কোয়ান্টাম ক্ষেত্র তত্ত্ব। এই তত্ত্ব অনুযায়ী এ ধরণের শক্তিশালী ক্ষেত্র শূন্যস্থানেও কণা ও তার প্রতিকণা সৃষ্টি করবে। ইলেকট্রন-পজিট্রন এধরনের কণা প্রতিকণার উদাহরণ। হকিং বললেন যে ঘটনা সীমান্তের ঠিক বাইরে যে কণা-প্রতিকণা যুগ্ম তৈরি হবে, তার মধ্যে একটি কৃষ্ণ গহ্বরের মাধ্যাকর্ষণ ক্ষেত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। অপরটি কৃষ্ণ গহ্বরে প্রবেশ করবে। এর ফলে কৃষ্ণ গহ্বরের ভর সামান্য কমে যাবে, কারণ বেরিয়ে যাওয়া কণাটির জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি কৃষ্ণ গহ্বরের ভর থেকেই পাওয়া যাবে। দূরের পর্যবেক্ষকের কাছে মনে হবে যেন কৃষ্ণ গহ্বর থেকে কণাটি বেরিয়ে এল। কৃষ্ণ গহ্বরের তাপমাত্রা নির্ধারণ হকিংরা আগেই নির্ধারণ করেছিলেন, তাই তাপগতিবিদ্যা অনুযায়ী তা থেকে বেরোনো বিকিরণের চরিত্র কেমন হওয়া উচিত তা আমরা জানি। হকিং দেখালেন তাঁর প্রস্তাবিত বিকিরণ একই চরিত্রের হবে।
হকিঙের তত্ত্ব থেকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে কৃষ্ণ গহ্বরের ভর কমে আসবে, তারা তাহলে চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু তারকার মৃত্যুর সময় সৃষ্ট গহ্বর বা ছায়াপথসমূহের কেন্দ্রে যে অতিকায় কৃষ্ণগহ্বর আছে, তাদের তাপমাত্রা খুবই কম, তাই তাদের থেকে নির্গত বিকিরণের পরিমাণও খুব কম। তাই তারা তাদের চারিদিক থেকে যে পরিমাণ ভর নিজের ভিতরে টেনে নেয়, তার পরিমাণ এই বিকিরণের থেকে বেশি। তাই তাদের ভর বৃদ্ধি পাচ্ছে, কমছে না। কিন্তু মহাবিশ্ব সৃষ্টির সময় এক ধরনের খুব কম ভরের কৃষ্ণ গহ্বর সৃষ্টি হওয়ার কথা, তাদের তাপমাত্রা অনেক বেশি। তাই তাদের ক্ষেত্রে হকিং বিকিরণের পরিমাণ অনেক বেশি এবং ভর কমতে কমতে তারা একসময় ধ্বংস হয়ে যাবে। এই ধরনের কৃষ্ণ গহ্বর খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন, হয়তো হকিং বিকিরণই তাদের দেখার একমাত্র পথ। তাই এখনো পর্যন্ত হকিং বিকিরণ  সনাক্ত করা সম্ভব হয় নি। মৃত্যু পর্যন্ত হকিঙের এই আক্ষেপ ছিল।
এই লেখাতে হকিং-এর বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে আর বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না। বিগ ব্যাং সিঙ্গুলারিটি বিষয়ে গবেষণার জন্য তিনি এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন। আমরা দেখেছি কৃষ্ণ গহ্বরের ভিতরে কি আছে তা বাইরে থেকে জানা সম্ভব নয়। তাহলে কোনো কণা যদি কৃষ্ণ গহ্বরের ভিতর পড়ে যায়, তার সম্পর্কে সমস্ত তথ্য কি মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যায়? পদার্থবিদ্যার অন্য ক্ষেত্রে কিন্তু এই তথ্য কখনোই হারায় না। এই আপাত বৈপরীত্যকে বলে হকিং কূট (Hawking paradox)। হকিং প্রাথমিক ভাবে মনে করতেন যে কৃষ্ণ গহ্বরে পড়ে যাওয়া কণা সম্পর্কে সমস্ত তথ্য হারিয়েই যায়, পরে তিনি মত পরিবর্তন করেন। বিজ্ঞানী জন প্রেস্কিলের সঙ্গে এই নিয়ে বাজি ধরার গল্প হয়তো অনেকেরই জানা। পরবর্তীকালে তিনি কৃষ্ণ গহ্বর সম্পর্কে আরো অনেক মত দিয়েছিলেন, তবে তা এখনো বিতর্কিত। ছোটদের জন্য লেখা জয়ঢাক ওয়েবজিনের বিশেষ সংখ্যায় এই প্রবন্ধে বিজ্ঞান বিষয়ে আরো একটু বিশদ আলোচনা আছে।
বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একটা কথা মনে রাখতেই হবে, নতুন আবিষ্কার সবসময়েই পুরানো জ্ঞানকে অতিক্রম করবে এবং ক্ষেত্রবিশেষে অস্বীকার করবে। এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রকেই আমরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিপ্লব বলি। হকিং-এর গবেষণা বিজ্ঞানে আমাদের প্রচলিত অনেক ধ্যানধারণাকে অস্বীকার করে, তাই তাকে আমরা বিপ্লব বলে চিহ্নিত করতেই পারি। তাঁর গবেষণার গুরুত্ব সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী মহলের কাছেই খুব বেশি। তাই সারা জীবনে অনেক পুরষ্কার ও সম্মান পেয়েছেন হকিং। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটির এডিংটন মেডেল (১৯৭৫), ডিরাক মেডেল (১৯৮৭), ইজরায়েলের উলফ পুরষ্কার (১৯৮৮), রয়াল সোসাইটির কপলি মেডেল (২০০৬), মার্কিন রাষ্ট্রপতির মেডেল অফ ফ্রিডম (২০০৯), মৌলিক বিজ্ঞানে ব্রেকথ্রু পুরষ্কার (২০১২), ইত্যাদি।
আমরা সবাই জানি যে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণে তিনি উৎসাহী ছিলেন।  কিন্তু সাধারণের জন্য লিখতে গিয়ে তিনি বিজ্ঞানের তথ্য বিষয়ে কোনো সমঝোতা করেন নি। ব্রিফ হিস্টোরি ছাড়াও আরো দুটি বই, ‘দি গ্র্যান্ড ডিজাইন’ এবং ‘এ ব্রিফার হিস্টোরি অফ টাইম’, বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ে তিনি উৎসাহী ছিলেন, পদার্থবিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রের ইতিহাসের ক্ষেত্রে তাঁর সম্পাদিত বই যথাক্রমে ‘অন দি শোল্ডারস অফ জায়ান্টস’ এবং ‘গড ক্রিয়েটেড দি ইন্টিজার্স’ পড়ে আমরা অনেকেই এই দুই বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছি।
শারীরিক এত প্রতিবন্ধকতা শুধু বিজ্ঞান নয়, হকিঙের জীবনতৃষ্ণাকে কমাতে পারে নি। হকিং কয়েকটি বিখ্যাত টেলিভিশন সিরিয়ালে অংশ নিয়েছেন। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তিনি  ভারশূন্য অবস্থা কেমন হয় তা অনুভব করার জন্য  স্পেস শাটলে উড়েছিলেন। সাবমেরিনে করে সমুদ্রের তলায় নেমেছিলেন। বহু দেশে তিনি বিজ্ঞান সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়েছেন। ভারতেও এসেছেন দু’বার। এমন কি অ্যান্টার্কটিকা ও ইস্টার দ্বীপের মতো দুর্গম জায়গায় গিয়েছেন। দু’বার বিয়ে করেছিলেন। পুত্র ও কন্যার সংখ্যা তিন। কন্যা লুসির সঙ্গে ছোটদের জন্য তিনি পাঁচটি  কল্পবিজ্ঞান উপন্যাসও লিখেছিলেন। সেগুলি সাধারণ কল্পবিজ্ঞানের থেকে অনেক আলাদা, হকিঙের গবেষণার বিষয়কে ব্যবহার করে গল্পগুলি রচনা করা হয়েছে।
হকিং বিজ্ঞানী, কিন্তু অনেক বিজ্ঞানীর মতো গজদন্ত মিনারে বসে থাকার পাত্র তিনি ছিলেন না। আন্তর্জাতিক ও জাতীয় নানা বিষয়ে তাঁর স্পষ্ট মত ছিল এবং তা তিনি প্রকাশও করতেন। মার্কিন-ব্রিটিশ শক্তি ২০০৩ সালের ইরাক আক্রমণ করেছিল। ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক যুদ্ধ বিরোধী সমাবেশে অংশ নিয়ে তিনি একে অপরাধ বলে চিহ্নিত করেন এবং বলেছিলেন এই যুদ্ধ মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন এবং সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ উন্নত দেশগুলির অনীহার তিনি কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প যখন নিজের দেশকে জলবায়ু সংক্রান্ত প্যারি চুক্তি থেকে সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তখন হকিং বলেছিলেন, ‘"Donald Trump ... may just have taken the most serious, and wrong, decision on climate change this world has seen." ২০১৩ সালে প্যালেস্টাইনের বুদ্ধিজীবীদের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি ইজরায়েলের রাষ্ট্রপতির ডাকা এক বিজ্ঞান সম্মেলন বয়কট করেন।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়ার তিনি বিরোধী ছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল এতে বিজ্ঞান গবেষণাতে অর্থসাহায্যের ক্ষেত্রে খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। হকিং ব্রিটেনে পরমাণু অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ব্রিটেনে চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে সরকারি সাহায্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে হকিং মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে একমাত্র সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থা থাকার জন্যই তাঁর পক্ষে দীর্ঘ জীবন লাভ ও গবেষণা করা সম্ভব হয়েছে। তিনি ব্রিটেনে লেবার পার্টির সমর্থক ছিলেন, তবে সেই দলের বর্তমান নেতা জেরেমি করবিনকে তিনি পছন্দ করতেন না। ১৯৯০-য় তাঁকে ‘নাইটহুড’-এ ভূষিত করার প্রস্তাব উঠলেও, গবেষণার খাতে সরকারী বরাদ্দের অপ্রতুলতার বিরুদ্ধে হকিং নাকচ করে দেন সেই সম্ভাবনা।
ধর্মের অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার তিনি সোচ্চারে বিরোধিতা করেছিলেন। খ্রিস্টধর্মের ডারউইনবাদের বিরোধিতার তিনি কঠোর সমালোচক। বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সমর্থক হকিং-এর কাছে পোপের সামনেই তাঁর বিরোধিতা করা হয়তো খুব সাধারণ ব্যাপার, কিন্তু আমাদের কাছে তাঁর এই সাহস শ্রদ্ধা আকর্ষণ না করে পারে না। তাঁর কাছে সৃষ্টিতে ঈশ্বরের কোনো ভূমিকা ছিল না, বিজ্ঞানই সৃষ্টিকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম।  তিনি বলেছিলেন যে ধর্ম আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করে, বিজ্ঞান নির্ভর করে যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের উপর, তাই বিজ্ঞান কার্যকরী এবং তার জয় সুনিশ্চিত। ধর্মে তাঁর এই অবিশ্বাস তাঁর প্রথম বিবাহের ক্ষেত্রে বিচ্ছেদের একটা কারণ বলে অনেকেই মনে করেন।
হকিং, মৃত্যুর পরে আত্মা বা চৈতন্যের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না। তাঁর মতো বিজ্ঞানীর মৃত্যু হয় না, তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর গবেষণায়, তাঁর ছাত্রদের মধ্যে, সাধারণ মানুষের জন্য বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর লেখায়। ‘গড ক্রিয়েটেড দি ইন্টিজার্স’ বইটির ভূমিকা হকিং এই ভাবে শেষ করেছিলেন, ‘The wonders of the ancient world were physical, like the pyramids in Egypt. … the greatest wonder of the modern world is our own understanding.’  আমাদের সেই বোধের বিকাশে হকিঙের ভূমিকাও অনস্বীকার্য। 

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, এপ্রিল ২০১৮ (পরিমার্জিত)

জয়ঢাক ওয়েবজিনের স্টিফেন হকিং ক্রোড়পত্রে হকিঙের গবেষণা সম্পর্কে এই লেখাটা লিখেছিলাম, পরে ওই ক্রোড়পত্রটি বই হিসাবে প্রকাশিত হয়েছে।
কৃষ্ণগহ্বর, ব্যতিক্রমী বিন্দু ও স্টিফেন হকিং

Friday 6 April 2018

বিজ্ঞানী মেরি কুরি


দেড়শ বছরে মেরি কুরি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      যে মানুষটি প্রথম দুবার নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন এবছর তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমরা সবাই তাঁর নাম জানি। মাদাম মেরি কুরির জন্ম হয় পোল্যান্ডে ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর। জন্মের সময় তাঁর নাম ছিল মারিয়া স্ক্লোদোভস্কা। ১৯০৩ সালে পদার্থবিদ্যা এবং ১৯১১ সালে রসায়নে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। অথচ তাঁর দেশ পোল্যান্ড সেই সময় ছিল রাশিয়ার জারের অধীনে, সেখানে উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল খুবই কম। তার উপর ছিল দারিদ্র। স্কুলের শিক্ষা শেষ করার পর আট বছর তিনি পড়াশোনা ছেড়ে গভর্নেসের চাকরি করে দিদির প্যারিতে ডাক্তারি পড়াতে সাহায্য করেন। তারপর ১৮৯১ সালে প্যারি বিশ্ববিদ্যালয় সরবোনে পদার্থবিদ্যাতে এম এস সি পড়ার জন্য ভর্তি হন। পরের বছর একই সঙ্গে অঙ্ক নিয়ে পড়াও শুরু করেন। পরীক্ষাতে ১৮৯৩ সালে পদার্থবিদ্যাতে প্রথম ও ১৮৯৪ সালে অঙ্কে দ্বিতীয় হয়ে উত্তীর্ণ হলেন।
      ইচ্ছা গবেষণা করার, কিন্তু সুযোগ কোথায়? ইতিমধ্যে আলাপ হয়েছে এক পদার্থবিজ্ঞানী পিয়ের কুরির সঙ্গে। তিনি প্যারির মিউনিসিপ্যাল স্কুলে পড়ান, যদিও ইতিমধ্যে পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর ইউরোপে পরিচিতি হয়েছে। তিনি মেরিকে তাঁর ছোট্টো  গবেষণাগারের একদিকে কাজ করার সুযোগ দিলেন। এক বছর পরে ১৮৯৫ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন তাঁরা। মেরির উৎসাহে পিয়ের থিসিস জমা দিয়ে ডক্টরেট পেলেন।
      কোন বিষয়ে কাজ শুরু করেছিলেন মেরি? ১৮৯০-এর দশক ছিল পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞানে উথালপাথালের যুগ। পদার্থবিদ্যার সে সময় পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান অনেক পরীক্ষার ফল ব্যাখ্যা করতে পারছিল না। ১৮৯৫ সালে রন্টজেন আবিষ্কার করলেন এক্স-রে বা রঞ্জন রশ্মি, পরের বছর বেকারেল তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি আবিষ্কার করলেন। ১৮৯৭ সালে টমসন ঘোষণা করলেন পরমাণু অবিভাজ্য নয়, তার মধ্যে থাকে ঋণাত্মক কণা ইলেকট্রন।  
      বিশেষ করে রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি ও ইলেকট্রনের ব্যাখ্যা চিরায়ত পদার্থবিদ্যাতে পাওয়া সম্ভব ছিল না। তেজষ্ক্রিয়তার কথায় আমরা পরে আসব। টমসন যখন পরমাণু ভেঙ্গে ইলেকট্রন পাবার কথা বলছেন, তখন অধিকাংশ বিজ্ঞানী পরমাণুর অস্তিত্বেই বিশ্বাস করতেন না।  সে সময় বিজ্ঞানের দর্শনে সবচেয়ে প্রভাবশালী নাম আর্নেস্ট মাখ – তাঁর যুক্তিমূলক দৃষ্টবাদ (Logical Positivism) দর্শনে যা অনুভব করা যায় না, সেই পরমাণুর কোনো জায়গা ছিল না। টমসনের কথা তাই অধিকাংশ বয়স্ক বিজ্ঞানীর কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। যাঁরা পরমাণুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন, তাঁদের কাছেও পরমাণু ছিল অবিভাজ্য কণা।
      রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটির কথায় আসি --- আবিষ্কারের গল্প অনেকেরই জানা। এক্স-রে নিয়ে কাজ করার সময় আঁরি বেকারেল খানিকটা আকস্মিক ভাবেই আবিষ্কার করেন যে ইউরেনিয়াম থেকে সারাক্ষণ বিকিরণ নির্গত হয়। বেকারেল দেখালেন যে এই বিকিরণ এক্স-রে হওয়া সম্ভব নয়। এক্স-রে তড়িৎ-নিরপেক্ষ। (আজ আমরা জানি যে এক্স-রে আসলে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ অর্থাৎ আলোক।) কিন্তু ইউরেনিয়াম থেকে নির্গত বিকিরণ ধনাত্মক, ঋণাত্মক ও তড়িৎ-নিরপেক্ষ, তিন রকমই হয়। বেকারেল অনুমান করেছিলেন যে তেজস্ক্রিয়তা মৌলিক পদার্থের ধর্ম। সে সময় এই বিকিরণের নাম ছিল বেকারেল রশ্মি। কিন্তু এই রশ্মির উৎস কী, অবিরাম এই বিকিরণ শক্তির নিত্যতা সূত্র মেনে চলে কিনা, এ কি শুধু ইউরেনিয়ামের ধর্ম নাকি অন্য মৌলিক পদার্থেও একে পাওয়া যাবে – এ ধরনের নানা প্রশ্নের উত্তর তখন অজানা।
      এক্স-রে ও বেকারেল রে, এই দুয়ের মধ্যে সে সময় অধিকাংশ বিজ্ঞানী প্রথমটিকে গবেষণার জন্য বেছে নিয়েছিলেন। মেরি ও পিয়ের ঠিক করলেন মেরি দ্বিতীয়টি নিয়ে কাজ করবেন। এই কাজে তাঁর সাহায্যে এসেছিল পিয়ের ও তাঁর দাদা জ্যাকসের আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রোমিটার যন্ত্র। রেডিয়োঅ্যাক্টিভিটি শব্দটি মেরিরই তৈরি। মেরি দেখলেন যে শুধু ইউরেনিয়ামই নয়, থোরিয়ামও আরো এক তেজস্ক্রিয় মৌলিক পদার্থ।  ইউরেনিয়াম বা থোরিয়াম কঠিন অবস্থায় থাকুক বা অন্য মৌলের সঙ্গে যৌগ রূপে দ্রবণে, ধাতুর বাঁট হিসাবে বা গুঁড়ো অবস্থায়, তাপমাত্রা যেমনই হোক না কেন, তাদের তেজস্ক্রিয়তার কোনো পরিবর্তন হয় না। এভাবেই তিনি প্রমাণ করলেন বেকারেল ঠিকই বলেছেন, তেজস্ক্রিয়তা মৌলিক পদার্থেরই ধর্ম।
      মেরি বেকারেলের থেকে এক ধাপ এগিয়ে গেলেন, বললেন যে তেজস্ক্রিয়তা মৌলের পরমাণুর থেকে আসে। এখন আমরা জানি যে পরমাণুর নিউক্লিয়াস হল তেজস্ক্রিয়তার উৎস, কিন্তু তখনো নিউক্লিয়াস আবিষ্কার হয়নি কথাটা বলা তখন খুব সহজ ছিল না। মেরি যে শুধু পরমাণুর অস্তিত্বের কথা বলছেন তা  নয়, বলছেন তার ভিতর থেকে বিকিরণ বেরোয়। অর্থাৎ পরমাণুর গঠন তাহলে মোটেই সরল নয়। টমসনের পরমানুর মডেল থেকে কিছুতেই তেজস্ক্রিয়তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। এর পর দীর্ঘ দিন বিজ্ঞানীরা পরমাণুর গঠন নিয়ে গবেষণা করবেন।
      মেরির অগ্রগতিতে উৎসাহী হয়ে কিছুদিন পরেই পিয়ের তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। ইউরেনিয়ামের আকরিক পিচব্লেন্ড থেকে মেরিরা ইউরেনিয়াম নিষ্কাশন করেন। অবাক হয়ে তাঁরা দেখলেন যে ইউরেনিয়াম বার করে নেওয়ার পরে যে অংশ পড়ে থাকে, তার তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা বেড়ে গেছে। এই ঘটনার একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, পিচব্লেন্ডের মধ্যে আরো অন্যান্য অজানা মৌলিক পদার্থ আছে যার তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক বেশি। নতুন মৌল খোঁজার জন্য তাঁদের রাসয়ানিক বিশ্লেষণের নতুন পদ্ধতি  আবিষ্কার করতে হয়েছিল। প্রথমে যে নতুন মৌলিক পদার্থের চিহ্ণ মেরি ও পিয়ের খুঁজে পেলেন, তাঁর পরাধীন জন্মভূমির স্মরণে মেরি তার নাম দিলেন পোলোনিয়াম। কিন্তু পোলোনিয়াম দিয়েও পিচব্লেন্ডের তেজস্ক্রিয়তার পুরোপরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। মেরিরা দেখলেন আরো একটি মৌল পিচব্লেন্ডের মধ্যে আছে। তাঁরা এর নাম ঠিক করলেন রেডিয়াম। যেখানে একটা মৌল আবিষ্কারই যে কোনো বিজ্ঞানীর কাছে স্বপ্ন, মেরিরা সেই কাজে সফল হয়েছেন দুবার। দীর্ঘ দিন চেষ্টা করে কুরিরা রেডিয়াম নিষ্কাশনে সফল হলেন। প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন এক টন পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পাওয়া যাবে দশ কিলোগ্রাম। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল একশো মিলিগ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড।
      মেরি ও পিয়ের তাঁদের কোনো গবেষণার পেটেন্ট নেন নি। তাই তাঁদের গবেষণাকে ভিত্তি করে শিল্প  গড়ে উঠলেও তাঁদের আর্থিক স্বচ্ছলতা আসেনি। তাঁদের আবিষ্কৃত বিশ্লেষণ পদ্ধতি রসায়ন শিল্পে কাজে লেগেছিলপিয়ের দেখিয়েছিলে রেডিয়াম থেকে বেরোনো বিকিরণ জীব কোষ ধ্বংস করতে পারে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্যানসারের চিকিৎসাতে রেডিয়াম ব্যবহার শুরু হয়। ১৯০৩ সালে মেরি ডক্টরেট উপাধি পেলেন। সেই বছরই তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার ভাগ করে দেওয়া হয় বেকারেল, পিয়ের ও মেরির মধ্যে। নোবেল কমিটি প্রথমে মেরির নাম বিবেচনা করেনি। পিয়ের তাঁদের লেখেন যে মেরিও তাঁদের কাজে সমান অংশীদার। আগেই রেডিয়ামের ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য মেরির নাম নোবেল পুরষ্কারের জন্য প্রস্তাবিত হয়েছিল। সেই প্রস্তাবকে ধরে মেরির নাম তালিকায় ঢোকানো হয়নোবেল পাওয়ার পর পিয়ের অবশেষে সরবোনে অধ্যাপকের চাকরি পান।
      কিন্তু মেরির জীবনে সংগ্রাম কখনো থেমে থাকেনি। নোবেল পুরষ্কারের পরেও তাঁর যোগ্য সম্মান তিনি পাননি। ১৯০৬ সালে এক দুর্ঘটনায় পিয়েরের মৃত্যু হয়, সরবোনে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন মেরি। ১৯০৩ সালের নোবেল পুরষ্কারে পোলোনিয়াম বা রেডিয়ামের নাম ছিল না। কমিটির রসায়ন বিজ্ঞানীরা এই দুই মৌল আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরষ্কারের কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু তাঁরা আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। সেই সময় এলো ১৯১১ সালে, দুই মৌল আবিষ্কার ও তাদের বিষয়ে গবেষণার জন্য রসায়নে এককভাবে নোবেল জিতলেন মেরি। পিয়েরের নাম তালিকায় ছিল না কারণ নোবেলের জন্য মৃতদের নাম বিবেচনা করা হয় না।
      মেরি কুরির মৃত্যু হয় ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই। মেরি ও পিয়েরের গবেষণার ফলে পরমাণুর গঠন বিষয়ে কৌতূহল জাগে। নতুন নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার হয়। রেডিয়োকেমিস্ট্রি ও ক্যানসারে রেডিয়োথেরাপির তাঁরাই পথিকৃৎ। তাঁদের মেয়ে আইরিন ও জামাই ফ্রেডরিক জোলিও কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৫ সালে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেনআধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাসে মাদাম কুরির অবদান ভোলার নয়।


প্রকাশ ঃ নিশিত শারদীয় ২০১৭