Tuesday 25 September 2018

কৃষ্ণ পদার্থ ও কৃষ্ণ শক্তি


কৃষ্ণ পদার্থ ও কৃষ্ণ শক্তি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

        দুটো কথা তোমরা হয়তো অনেকেই শুনেছ, ডার্ক ম্যাটার এবং ডার্ক এনার্জি। বাংলায় এই ডার্ক শব্দের কেউ অনুবাদ করেছেন অন্ধকার, কেউ বা করেছেন কৃষ্ণ। এই লেখাটায় আমরা দ্বিতীয় বিকল্পটা বেছে নিলাম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে কৃষ্ণ পদার্থ এবং কৃষ্ণ শক্তির কথা বারবার আসে। এদের সম্পর্কে আমরা কী জানি?
        এই প্রশ্নটার উত্তরে যদি কেউ বলে কিছুই জানি না, তাহলে সে খুব ভুল করবে না। ঠিকঠাক বললে আমরা কৃষ্ণ পদার্থ সম্পর্কে খুব সামান্যই জানি, আর কৃষ্ণ শক্তি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান তার চেয়েও কম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে বুঝতে গেলে আমরা এমন কয়েকটা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি যার ব্যাখ্যা আমাদের এখনো পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান দিয়ে করতে পারছি না। তাই বিজ্ঞানীরা এই দুটো নতুন প্রস্তাব করেছেন। এই লেখায় আমরা দেখব সেই সমস্যাগুলো কী কী, কেমন করেই বা এই নতুন প্রস্তাবরা তাদের সমাধান করছে।
        কৃষ্ণ পদার্থ বা কৃষ্ণ শক্তির চরিত্র কী হতে পারে আর কী হতে পারে না? একটা কথা বলে রাখি, কৃষ্ণ পদার্থই বলি বা কৃষ্ণ শক্তি, আমাদের জানা পদার্থ বা শক্তির মতো নয়। প্রথমে বলি কৃষ্ণ পদার্থের কথা। আমাদের জানা সমস্ত বস্তু পরমাণু দিয়ে তৈরি। সেই পরমাণুর মধ্যে আছে প্রোটন-নিউট্রন দিয়ে তৈরি নিউক্লিয়াস, এবং নিউক্লিয়াসের বাইরে আছে ইলেকট্রন। প্রোটন-নিউট্রন আবার কোয়ার্ক কণা দিয়ে তৈরি, তবে সে খবরটা এই লেখায় আমাদের দরকার হবে না। ইলেকট্রনের চার্জ অর্থাৎ তড়িতাধান ঋণাত্মক। প্রোটনের তড়িতাধান ধনাত্মক, নিউট্রন তড়িৎ-নিরপেক্ষ। প্রোটন ও ইলেকট্রনের আধান বিপরীত বলে তারা একে অপরকে আকর্ষণ করে, সেজন্য পরমাণু সুস্থির অর্থাৎ ভেঙে যায় না। দুটি তড়িতাহিত কণার মধ্যে যে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বল কাজ করে তাকে বলে তড়িৎচৌম্বক বল।
        হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস হল শুধু একটা প্রোটন। বাকি সমস্ত নিউক্লিয়াসের মধ্যে আছে একাধিক প্রোটন যাদের সবার আধান ধনাত্মক, তারা একে অপরকে তড়িৎচৌম্বক বলের জন্য বিকর্ষণ করে। নিউট্রনের আধান নেই। তাহলে নিউক্লিয়াস সুস্থিত হল কেমন করে, প্রোটন-প্রোটন বিকর্ষণের জন্য তার তো ভেঙে পড়া উচিত। আসলে প্রোটন-প্রোটন, প্রোটন-নিউট্রন বা নিউট্রন-নিউট্রনের মধ্যে আরো একটা বল কাজ করে, তার নাম স্ট্রং ফোর্স। বাংলায় বলা যায় সবল বল বা পীন বল।  নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে পীন বল বেশ শক্তিশালী, দুটো প্রোটনের মধ্যের তড়িৎচৌম্বক বিকর্ষণ বলের থেকে পীন বলের আকর্ষণ একশোগুণের থেকেও বেশী জোরদার। এই পীন বল কিন্তু ইলেকট্রনের উপর কাজ করে না। এত শক্তিশালী বল, কিন্তু আমরা তা সাধারণভাবে টের পাই না কেন? কারণ এই বলের পাল্লা খুব কম। এক মিটারের দশ কোটি কোটি ভাগের এক ভাগকে বলে এক ফেমটোমিটার। প্রোটন নিউট্রনের মতো কণাদের যদি একজন আরেকজনের থেকে দূরত্ব যদি মোটামুটি দুই ফেমটোমিটারের বেশি হয়, তাহলে তাদের মধ্যে পীন বল কাজ করে না। তড়িৎচৌম্বক বলের পাল্লা কিন্তু অসীম, একটা প্রোটন যদি এখানে আর অন্যটা অ্যান্ড্রোমিডা ছায়াপথে থাকে, তাহলেও তাদের মধ্যে তড়িৎচৌম্বক বল শূন্য হয়ে যায় না।
        প্রোটন-নিউট্রন-ইলেকট্রনের মধ্যে আর একটা বল কাজ করে, তার নাম ক্ষীণ বল বা দুর্বল বল। কতটা দুর্বল? মোটামুটি বলা যায় এই বল তড়িৎচৌম্বক বলের থেকে এক কোটি কোটি ভাগের থেকেও কম শক্তিশালী। এর পাল্লা সবল বলের থেকেও কম। তাহলে এই বলকে আমরা খুঁজে পেলাম কোথায়? নিউক্লিয়াসের বিটা তেজস্ক্রিয়ার জন্য দায়ী এই বল। বিটা তেজস্ক্রিয়ার সময় কয়েক ধরনের ঘটনা ঘটে। যেমন ধরো নিউট্রন থেকে তৈরি হতে পারে প্রোটন, ইলেকট্রন আর তাদের সঙ্গে নিউট্রিনো নামের নতুন এক কণা। এই নিউট্রিনোর তড়িতাধান নেই, ভরও প্রায় নেই বললেই চলে। নিউট্রিনোর উপর ক্ষীণ বল কাজ করে, কিন্তু পীন বল বা তড়িৎচৌম্বক বল করে না। প্রতি সেকেন্ডে তোমার শরীরের মধ্যে দিয়ে কোটি কোটি নিউট্রিনো চলে যাচ্ছে, তুমি টেরও পাচ্ছ না।
        আরো একটা বল আছে যার পাল্লা অসীম, তা হল মাধ্যাকর্ষণ বল। মহাবিশ্বের যে কোনো দুটি ভরের মধ্যে তা কাজ করে, এবং তার জন্য দুটো ভর সবসময়েই একে অন্যকে আকর্ষণ করে, বিকর্ষণ নয়। পৃথিবী আর সূর্য যে একে অন্যকে টানে, তার পিছনে আছে মাধ্যাকর্ষণ। মাধ্যাকর্ষণ বল বাকি বলগুলোর থেকে অনেক বেশি দুর্বল। দুটো প্রোটনের মধ্যে যে তড়িৎচৌম্বক বল কাজ করে, তা তাদের মধ্যের মাধ্যাকর্ষণ বলের থেকে কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি কোটি গুণ শক্তিশালী। অন্য ভাবে বললে তড়িৎচৌম্বক বলের পরিমাপকে যদি মাধ্যাকর্ষণ বলের মান দিয়ে ভাগ দিই, তাহলে যে সংখ্যাটা পাব, তা লিখতে গেলে প্রথমে একটা চার লিখে তার পিছনে বিয়াল্লিশটা শূন্য বসাতে হবে।       
        এত দুর্বল হলে কি হবে,  আমাদের সৌরজগৎ যে এতদিন ধরে টিকে আছে, এক ছায়াপথ যে অন্য ছায়াপথকে আকর্ষণ করছে, তার পিছনে আছে মাধ্যাকর্ষণ। ক্ষীণ বা পীন বলের পাল্লা খুব কম। তড়িৎচৌম্বক বলের পাল্লা মাধ্যাকর্ষণেরই মতো, তা অনেক বেশি শক্তিশালীও বটে। কিন্তু সব বস্তুর মধ্যে  ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই রকম আধানই থাকে। তাদের মধ্যে আকর্ষণ ও বিকর্ষণ কাটাকুটি হয়ে যায়, বিশেষ কিছু পড়ে থাকে না। মাধ্যাকর্ষণ বল শুধুই আকর্ষণ করে, তাই নক্ষত্র গ্রহ উপগ্রহরা মাধ্যাকর্ষণ বল মেনেই চলাফেরা করে। আমাদের চেনা বস্তুদের উপরে এই চাররকম বলই কাজ করে।
        প্রোটন-নিউট্রন (বা কোয়ার্ক), ইলেকট্রন, নিউট্রিনো ছাড়া আরো কিছু বস্তুকণার কথা আমরা বলতে পারি, তবে তারা সবাই অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। তাদের কথা এই আলোচনায় আসবে না। চার রকম যে বলের কথা বললাম, তাদের প্রত্যেকের জন্য একটা কণা থাকার কথা। তারা ঠিক বস্তুকণা নয়, আমরা বলব বলকণা। যেমন তড়িৎচৌম্বক বলের বলকণা হল ফোটন। তবে মাধ্যাকর্ষণের জন্য যে বলকণার প্রস্তাব করা হয়েছে, সেই গ্রাভিটনকে খুঁজে পাওয়ার আশা আমরা অদূর ভবিষ্যতে করি না। আর একটা কথা বলে আমরা আলোচনার এই অংশ শেষ করব। তোমরা আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের নাম শুনেছ। এই তত্ত্ব হল আসলে মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব, যদিও আইনস্টাইনের তত্ত্বে মাধ্যাকর্ষণ ঠিক বল নয়।
        মাধ্যাকর্ষণ হল প্রথম বল যার সম্পর্কে আমরা একটা সূত্র খাড়া করতে পেরেছিলাম। গ্রহ উপগ্রহের গতিবিধি মানুষ বহু হাজার বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করছে। সপ্তদশ শতকের গোড়াতে জোহানেস কেপলার সেই সমস্ত তথ্যকে সূর্যকেন্দ্রিক জগতের সাপেক্ষে ব্যাখ্যা করেন। তার থেকেই আইজ্যাক নিউটন তাঁর বিখ্যাত সার্বজনীন মাধ্যাকর্ষণের সূত্র তৈরি করেছিলেন। আমরা সবাই ক্লাসে সেই কথা পড়েছি।
        তাহলে নিউটনের আপেলের গল্পটা গেল কোথায়? তোমরা হয়তো খবরের কাগজে পড়েছ, নিউটনের আগে অমুক লোক মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কার করেছিলেন। এ সবই হল ঐ আপেলের গল্পটা ভালো করে না জানার লক্ষণ। আপেল পড়তে দেখে নিউটন এ কথা ভাবেননি পৃথিবী আপেলকে আকর্ষণ করে। পৃথিবী যে আপেল বা কমলালেবুকে টানে তা বোঝার জন্য সর্বকালের সেরা প্রতিভা নিউটনকে দরকার পড়ে না। একটা জল ভর্তি বালতি একতলা থেকে দোতলাতে নিয়ে যাওয়ার সময় সবাই পৃথিবীর আকর্ষণ টের পায়। নিউটন বুঝেছিলেন যে পৃথিবীর আর আপেলের মধ্যে যে বল কাজ করে, পৃথিবী আর চাঁদের মধ্যে সেই একই বল কাজ করে। শুধু তাই নয়, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণাই অন্য বস্তুকণাকে আকর্ষণ করে। সেই আকর্ষণ বল হল কণাদুটির ভরের গুণফলের সমানুপাতিক ও দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। এটাই মাধ্যাকর্ষণের সূত্র, আর এই কথাগুলো নিউটনের আগে কেউ বলে নি।  
        নিউটনের সূত্র থেকে আমরা সৌরজগতে গ্রহদের গতিবিধি থেকে শুরু করে আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গাতে তারাদের চলাফেরা ব্যাখ্যা করতে পারি। আকর্ষণ বল দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতে পাল্টায়, অর্থাৎ সূর্য থেকে পৃথিবী এখন যত দূরে, যদি তার তিনগুণ দূরত্বে থাকত, তাহলে সূর্যের আকর্ষণ বল ন’গুণ কমে যেত। তাই পৃথিবীর আবর্তন বেগ হল সেকেন্ডে তিরিশ কিলোমিটার আর প্লুটো, যে অনেক দূরে আছে তার আবর্তন বেগ হল সেকেন্ডে পাঁচ কিলোমিটারেরও কম। প্লুটো যদি সেকেন্ডে তিরিশ কিলোমিটার দৌড়ত, তাহলে সে আর সৌরজগতে বাঁধা পড়ে থাকত না।
        আমাদের ছায়াপথের নাম আকাশগঙ্গা, তার চেহারাটা স্পাইরাল বা সর্পিল। ছায়াপথের বাইরে গিয়ে ছবি তোলা সম্ভব নয়। তবে মহাবিশ্বে আরো অনেক এইরকম সর্পিল ছায়াপথ আছে, যেমন আমাদের সবচেয়ে কাছের বড় ছায়াপথ অ্যান্ড্রোমিডা সর্পিল। সঙ্গের ফটোটা সেই রকমই এক ছায়াপথের। আকাশগঙ্গার এক প্রান্ত থেকে বিপরীত প্রান্তের দূরত্ব মোটামুটি এক লক্ষ আলোকবর্ষ। সূর্য আছে ছায়াপথের কেন্দ্র থেকে সাতাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে দেখলেন যে নিউটনের সূত্র মানলে সাতাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরের কক্ষপথে বেগ যা হওয়া উচিত, সূর্যের বেগ তার থেকে অনেক বেশি। তাহলে জন্ম থেকে সাড়ে চারশো কোটি বছর ধরে সূর্য এই ছায়াপথে বাঁধা রয়েছে কেমন করে?

হাবল স্পেস টেলিস্কোপে তোলা সর্পিল ছায়াপথের আলোকচিত্র (সৌজন্য NASA)

        এর দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে, হয় নিউটনের সূত্র এত বেশি দূরত্বের ক্ষেত্রে ঠিকঠাক খাটে না, নয়তো আমরা ছায়াপথের ভর ঠিক মতো জানি না। প্রথমটা মেনে নেওয়া একটু শক্ত, তার যথেষ্ট কারণ আছে -- কিন্তু সেগুলো সহজে বোঝানো যাবে না। তবু কেউ কেউ সেই নিয়ে চিন্তা করছেন। দ্বিতীয় বিকল্পটাই অধিকাংশ বিজ্ঞানী বিশ্বাস করেন। ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে নেয়া যাক। সূর্যের ভর যদি দ্বিগুণ হত, তাহলে তার আকর্ষণ বলও দ্বিগুণ হতো, কারণ আকর্ষণ বল ভরের সমানুপাতে পাল্টায়। তাহলে পৃথিবীর বেগ আরো বেশি হওয়া প্রয়োজন হত, তা না হলে পৃথিবী সূর্যে আছড়ে পড়ত। ঠিক সেই রকমই ছায়াপথের ভর  যদি বেশি হয় তাহলে সূর্য ছায়াপথে বাঁধা পড়ে থাকবে। ছায়াপথের ভর তাহলে কেমন করে বার করব? দাঁড়িপাল্লাতে তো আর ছায়াপথকে চাপানো যাবে না।
        কক্ষপথের থাকার জন্য সূর্যের প্রয়োজনীয় বেগ কষার সময় আমরা ছায়াপথে নক্ষত্র, মহাজাগতিক মেঘ, কৃষ্ণ গহ্বর, মৃত নক্ষত্র বা অন্যান্য ভারি বস্তু কত আছে তার একটা হিসেব করে তার থেকে ভরটা বার করেছিলাম। এটাকে বলা যাক ভরের প্রথম মাপ। বিভিন্ন ছায়াপথের ভর  ও ঘূর্ণন মেপে তাদের ভরের ক্ষেত্রে এই সমস্যার প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেরা রুবিন।  
        ভর নির্ণয়ের অন্য একটা উপায় আছে, তার জন্য মাধ্যাকর্ষণের সূত্র লাগবে।  দুটো ছায়াপথ নিজেদের মধ্যে আকর্ষণের জন্য কেমন ভাবে চলাফেরা করে, নিউটনের সূত্র ব্যবহার করে তার থেকে ছায়াপথ দুটোর ভর বার করা যায়। আমাদের সূর্যের ভর আমরা সেইভাবেই মেপেছিলাম। আবার আমরা জানি আইনস্টাইন বলেছিলেন যে ভারি বস্তুর আকর্ষণে আলোও তার পথ থেকে বেঁকে যায়। তার মানে ভর লেন্সের মতো কাজ করে। সঙ্গের ফটোটাতে সে রেখাগুলো দেখছ, সেগুলোর উৎস ঐ মাধ্যাকর্ষণ-জাত লেন্স। মাঝখানে দুটো যে বড় আলো দেখা যাচ্ছে, তারা হল একটা ছায়াপথগুচ্ছ। কোনো উৎস থেকে আলো আসছিল, আমাদের কাছে আসার সময় ঐ ছায়াপথগুচ্ছের টানে বেঁকে গিয়ে ওইরকম রেখার মতো দেখতে হয়েছে। যে ছায়াপথগুচ্ছ আলোকে বাঁকিয়েছে, তার ভর এর থেকে নির্ণয় করা যায়। নিউটন বা আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্ব থেকে ভরের যে মান পাই তাকে বলি দ্বিতীয় মাপ।  হিসাব করে দেখা গেল প্রথম মাপের থেকে দ্বিতীয় মাপটা প্রায় ছ’গুণ বড়। দ্বিতীয় মাপের ছ’ভাগের এক ভাগ নক্ষত্র ইত্যাদি আমাদের জানা নানা বস্তুর ভর, বাকি পাঁচ ভাগ পদার্থ তাহলে কী?
হাবল টেলিস্কোপে ধরা দিল মাধ্যাকর্ষণ-জাত লেন্স (সৌজন্য NASA)


       
এর সহজ উত্তর হচ্ছে আমরা জানি না। এই পদার্থ কী নয় তা আমরা বলতে পারি, বিজ্ঞানে অবশ্য সেটাও খুব কম কথা নয়। নিউটনের সূত্র থেকে এই পদার্থকে পাওয়া যাচ্ছে, তার মানে মাধ্যাকর্ষণ বল এর উপর কাজ করে। কিন্তু মাধ্যাকর্ষণ বল এতই দুর্বল যে আমাদের ল্যাবরেটরিতে তাকে ব্যবহার করে কৃষ্ণ পদার্থকে খুঁজে পাওয়ার আশা সুদূরপরাহত। ক্ষীণ বল কৃষ্ণ পদার্থের উপর কাজ করে কিনা সে ব্যাপারে আমাদের কোনো ধারণা নেই, তবে বিজ্ঞানীরা সেটা দেখার চেষ্টা করছেন। চোখে দেখা যাচ্ছে না, তার মানে আলোর সঙ্গে তার কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হয় না। আলো আসলে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, তার সঙ্গে ক্রিয়া করে না মানে এ নিশ্চয় তড়িৎ-নিরপেক্ষ। আলোর সঙ্গে ক্রিয়া করে না বলে আমরা তার নাম দিয়েছি কৃষ্ণ পদার্থ।
        পীন বল যে কৃষ্ণ পদার্থের উপর কাজ করে না, সেটা বোঝা আরো একটু শক্ত, তবু সেই চেষ্টা করা যাক। আমরা জানি আজ থেকে তেরোশো আশি কোটি বছর আগে এক প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ বিগ ব্যাঙের মাধ্যমে ব্রহ্মাণ্ডের জন্ম। সেই সময় প্রোটন কণারা মিলে নানা রকম বিক্রিয়ার মাধ্যমে হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াস তৈরি করেছিল। হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসে আছে দুটো করে প্রোটন ও নিউট্রন। ব্রহ্মাণ্ডের হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের অনুপাত আমরা মেপেছি, তার থেকে সেই সময় পীন বলের সঙ্গে ক্রিয়া করে এমন পদার্থের পরিমাণ বার করা সম্ভব হয়েছে। সেটা প্রথম মাপের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। পীন বল তাহলে কৃষ্ণ পদার্থের উপর কাজ করা না।
        এমন একটা কণার কথা আমরা জানি যার উপরে পীন বল বা তড়িৎচৌম্বক বল কাজ করা না, তা হল নিউট্রিনো। তাই একসময় অনেকে ভেবেছিলেন কৃষ্ণ পদার্থ হয়তো নিউট্রিনো।  নিউট্রিনোর সংখ্যাও অনেক, ব্রহ্মাণ্ডে প্রোটন নিউট্রন ইলেকট্রনের মোট সংখ্যার থেকে নিউট্রিনোর সংখ্যা প্রায় একশো কোটি গুণ বেশি। অনেকদিন পর্যন্ত নিউট্রিনোর ভর মাপা যাচ্ছিল না। সম্প্রতি সেই সম্পর্কে আমাদের কিছুটা ধারণা হয়েছে, তার থেকে দেখা যাচ্ছে নিউট্রিনো দিয়ে কৃষ্ণ পদার্থকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। নিউট্রিনো যে কৃষ্ণ পদার্থ হতে পারে না, তার অন্য কারণও আছে, তবে সে আলোচনায় যাচ্ছি না।
        বিজ্ঞানীরা নানা রকম ভাবছেন, কোনো সমাধানে এখনো পৌঁছানো যায় নি। তবে কৃষ্ণ পদার্থের ধারণা যদি ঠিক হয়, তাহলে আমাদের ছায়াপথকে দেখতে হয়তো সঙ্গের ফটোটার মতো, আলোকোজ্জ্বল অংশটা তার খুব ছোট্ট একটা ভাগ।
ছায়াপথের দৃশ্যমান অংশ ও কৃষ্ণ পদার্থ

       এবার আসি কৃষ্ণ শক্তির কথায়। বিগ ব্যাঙের কথা আগেই বলেছি। সেই জন্মমুহূর্ত থেকে মহাবিশ্ব প্রসারিত হয়ে চলছে। ভবিষ্যতে কী ঘটবে। দু ধরনের ঘটনার কথা ভাবতে পারি। একটা পাথর নিয়ে উপরদিকে ছুঁড়লাম, পাথরটার বেগ মাধ্যাকর্ষণের টানে ক্রমশ কমবে, একসময় থেমে যাবে তারপর ফিরে আসবে। আরো জোরে ছুঁড়লাম, আবার বেগ কমবে, থামবে, ফিরে আসবে। যদি মুক্তিবেগ নিয়ে ছুঁড়তে পারতাম, তাহলে থামত না বা ফিরেও আসত না, কিন্তু বেগ কমতেই থাকত। মহাবিশ্বের সমস্ত কণা একে অপরকে মাধ্যাকর্ষণের বাঁধনে বেঁধে রেখেছে। সেই আদি বিস্ফোরণের পরে তাহলে ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষেত্রে দুটো ঘটনা ঘটতে পারে। গোড়ায় যদি সে যথেষ্ট বেগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে থাকে, তাহলে সে চিরকালই প্রসারিত হবে।  অথবা যদি সূচনাতে যথেষ্ট বেগ না থাকে তাহলে ব্রহ্মাণ্ড একসময় থেমে আবার সংকুচিত হতে শুরু করবে।  কিন্তু দু ক্ষেত্রেই প্রথমে যে প্রসারণ বেগ ছিল তা ক্রমশ কমবে।
        বিজ্ঞানীরা দেখার চেষ্টা করছিলেন এই দুটো বিকল্পের মধ্যে কোনটা আমাদের ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষেত্রে খাটবে। ছায়াপথরা এখন কত বেগে একে অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে তা মাপাটা শক্ত নয়। কিন্তু সুদূর অতীতে কী ঘটেছিল তা মাপতে গেলে তো টাইম মেশিন লাগবে। এক রকম টাইম মেশিন আমাদের আছে, তাতে অতীতে যাওয়া যায় না, কিন্তু অতীতের ঘটনা দেখা যায়। তার নাম দূরবিন। আমাদের থেকে পাঁচশো কোটি আলোকবর্ষ দূরে যে ছায়াপথ আছে, তার থেকে আলো যাত্রা শুরু করেছিল পাঁচশো কোটি বছর অতীতে। সেই আলোকে আজ বিশ্লেষণ করে আমরা পাঁচশো কোটি বছর আগে ছায়াপথদের বেগ নির্ণয় করতে পারি। এভাবেই আমরা শত শত কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ বেগ বার করেছি।
        ১৯৯৮ সাল নাগাদ দুই দল বিজ্ঞানী আলাদা আলাদা ভাবে অতীতে বিভিন্ন সময়ে ব্রহ্মাণ্ডের প্রসারণ বেগ মাপছিলেন। কেমন ভাবে এই বেগ মাপা যায় সে আলোচনা এখানে করছি না। তাঁরা দেখলেন যে ব্রহ্মাণ্ডের বেগ প্রথম প্রথম কমছিল বটে, কিন্তু গত ছ’শো কোটি বছর ধরে এই প্রসারণ বেগ বাড়ছে। এ এক অদ্ভুত ঘটনা। পাথরটাকে উপরে ছুঁড়ে দিলে যদি তার বেগ ক্রমশ বাড়তে থাকে তাহলে আমাদের ধরে নিতে হবে তার উপরে মাধ্যাকর্ষণ ছাড়াও অন্য কিছু কাজ করছে। এই অন্য কিছু কী হতে পারে আমরা জানি না, এরই নাম আমরা দিয়েছি কৃষ্ণ শক্তি। কৃষ্ণ শক্তির পক্ষে আরো কিছু যুক্তি আছে, সেগুলো আমরা আর এখানে আলোচনা করছি না। ২০১৩ সালে প্লাঙ্ক উপগ্রহের মাপ থেকে বলা যায় এই সময়ে মহাবিশ্বের মোট শক্তির ৫% হল প্রোটন নিউট্রন ইলেকট্রন ইত্যাদি দিয়ে তৈরি সাধারণ বস্তু, ২৭% হল কৃষ্ণ পদার্থ এবং ৬৮% হল কৃষ্ণ শক্তি। সত্যি আমরা যে বিশ্বে বাস করছি তার কতটুকুই আমরা জানি!
        কৃষ্ণ শক্তি সম্পর্কে আমরা বিশেষ কিছু জানি না, তবে বিভিন্ন যুগে এর পরিমাণ মাপা সম্ভব হয়েছে। দেখা যাচ্ছে মহাবিশ্বের বিভিন্ন যুগে এর ঘনত্বের কোনো পরিবর্তন হয় নি। সাধারণ বস্তু ও কৃষ্ণ পদার্থের  ঘনত্ব মহাবিশ্বের আয়তনের ব্যস্তানুপাতে পরিবর্তিত হয়। তার কারণ বোঝা খুব সোজা, একটা বাক্সের মধ্যে কয়েকটা কণা রাখলাম। তাহলে প্রতি কণার সংখ্যাকে বাক্সের আয়তন দিয়ে ভাগ দিলে কণার ঘনত্ব বার করে নিতে পারব। এবার যদি বাক্সটার আয়তন দ্বিগুণ করে দিই, তাহলে ঘনত্ব অর্ধেক হয়ে যাবে। কৃষ্ণ শক্তির ঘনত্ব পরিবর্তন হয় না কারণ এ হল মহাবিশ্বের কাঠামোরি অঙ্গ। মহাবিশ্বের আয়তনকে ঘনত্ব দিয়ে গুণ করে মোট কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ পাওয়া যাবে। আমাদের মহাবিশ্ব যত প্রসারিত হচ্ছে, তত তার আয়তন বাড়ছে,সেই সঙ্গে বাড়ছে কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ। অতীতে কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ ছিল কম, তাই মহাবিশ্বের প্রসারণ বেগ ক্রমশ কমছিল। কৃষ্ণ শক্তির পরিমাণ বেড়ে বেড়ে একটা নির্দিষ্ট মানে পৌঁছানোর পরে সেটাই মহাবিশ্বের প্রসারণকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। সেই সময় থেকে মহাবিশ্বের প্রসারণ বেগ বাড়তে শুরু করেছে।
        কৃষ্ণ শক্তির কথা শেষ করার আগে একটা পুরানো কথায় ফিরে যাই। আজ থেকে একশো বছর আগে আইনস্টাইন তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। তাকে তিনি মহাবিশ্বের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে গিয়ে দেখলেন যে তাঁর সমীকরণ অনুযায়ী মহাবিশ্বের স্থির থাকা সম্ভব নয়, তা হয় প্রসারিত হবে না হয় সংকুচিত হবে। কিন্তু সেই সময় সকলের ধারণা ছিল আমাদের ব্রহ্মাণ্ড স্থির, তাই আইনস্টাইন তাঁর সমীকরণে একটা নতুন পদ যোগ করেছিলেন। তার নাম দিয়েছিলেন মহাজাগতিক পদ। পরে যখন হাবল দেখান যে মহাবিশ্ব সত্যি সত্যিই প্রসারিত হচ্ছে, আইনস্টাইন ঐ পদটিকে বলেছিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। এখন যখন জানা গেছে মহাবিশ্বের প্রসারণ বেগ বাড়ছে, তখন আইনস্টাইনের সেই ভুলের আবার প্রয়োজন পড়েছে। আমাদের সবচেয়ে সফল তত্ত্ব হল কোয়ান্টম ক্ষেত্রতত্ত্ব, তা অনুযায়ী শূন্যস্থানেরও শক্তি আছে, তার থেকে মহাজাগতিক পদের মান নির্ণয় করা হয়েছে। কিন্তু সেই মানটা মেপে আমরা পাচ্ছি তার থেকে অনেক বেশি, একের পিঠে একশো কুড়িটা শূন্য দিলে যে সংখ্যাটা পাওয়া যায় তত গুণ বেশী!
        কৃষ্ণ পদার্থ আর কৃষ্ণ শক্তির এই গল্প শেষ করার সময় এসেছে। ঠিক যে সময় আমরা ভেবেছিলাম আমরা মহাবিশ্বকে মোটামুটি বুঝতে পেরেছি, তখনই আমাদের সমস্ত ধ্যানধারণাকে ওলটপালট করে দিয়েছে এই নতুন আবিষ্কার। কিছু বিজ্ঞানী অবশ্য মনে করেন যে কৃষ্ণ পদার্থ বা কৃষ্ণ শক্তির আসলে অস্তিত্ব নেই। আমাদের উচিত মাধ্যাকর্ষণের তত্ত্বে পরিবর্তন আনা। সুদূর অতীতে মহাবিশ্বের প্রসারণ বেগ মাপার পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। তবে সামনের কয়েক বছর পদার্থবিজ্ঞানের জগতে অনেক বড় পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে কৃষ্ণ পদার্থ ও কৃষ্ণ শক্তি সংক্রান্ত গবেষণা। তোমরা যারা এই লেখা পড়লে, তারা কেউ কেউ নিশ্চয় সেই পরিবর্তন আনতে সাহায্য করবে।

(প্রকাশঃ কিচিরমিচির   জুলাই-আগস্ট ২০১৮)
        

Friday 21 September 2018

শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ সামির আমিন


সামির আমিন (৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ - ১২ আগস্ট, ২০১৮)

          চলে গেলেন ইউরোসেন্ট্রিজম অর্থাৎ ইউরোকেন্দ্রিকতা শব্দের নির্মাতা সামির আমিন। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ সামির আমিন ছিলেন আধুনিক মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের মধ্যে অন্যতম। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে মার্কসীয় তত্ত্বের প্রয়োগে তাঁর স্থান প্রথম সারিতে
        সামির আমিনের জন্ম মিশরে। তাঁর বাবা ছিলেন মিশরীয়, মা ফরাসি – দুজনেই ছিলেন ডাক্তার। তাঁর ছোটবেলার পড়াশোনা মিশরের পোর্ট সইদে। ১৯৪৭ সালে তিনি পড়াশোনার জন্য ফ্রান্সে যান। প্যারিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং পরিসংখ্যানবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করে ১৯৫৭ সালে পিএইচডি করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল অনুন্নয়নের উৎস, তাঁর পরবর্তী বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অ্যাকুমুলেশন অন এ ওয়ার্ল্ড স্কেল’-এ তিনি এ বিষয়ে তাঁর ধারণাকে আরো বিকশিত করেছিলেন।
        তাঁর নিজের কথাতেই, ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার জন্য পড়াশোনাতে ব্যাঘাত ঘটেছিল। তখনই ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে অচিরেই তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল তিনি মিশরে ফিরে পরিকল্পনা বিষয়ক সরকারি দপ্তরে কাজ করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দুল নাসেরের দেশের মধ্যে কমিউনিস্ট বিরোধিতার জন্য তিন বছরের মধ্যেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ ছিলেন সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র মালিতে পরিকল্পনা বিষয়ে উপদেষ্টা, তারপর ১৯৬৩ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত  সেনেগালের ডাকারে রাষ্ট্রসংঘের  আফ্রিকান ইন্সটিটিউট অফ ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং-এ কাজ করেছেন, তার মধ্যে শেষ দশ বছর ছিলেন ইন্সটিটিউটের ডাইরেক্টরএকই সঙ্গে প্যারি ও ডাকারে অধ্যাপনা করেছেন১৯৮০ সালে থার্ড ওয়ার্ল্ড ফোরামের আফ্রিকা দপ্তরের ডাইরেক্টর হন। তাঁর উৎসাহেই প্রতিষ্ঠিত হয় আফ্রিকার অগ্রগণ্য সমাজ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল ফর দি ডেভেলপমেন্ট অফ সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ ইন আফ্রিকা।
        প্যান-আফ্রিকানিজম বা সার্বিক-আফ্রিকানবাদের প্রতি তাঁর পক্ষপাত তাঁর জীবন থেকেই স্পষ্ট, কিন্তু তাঁর কাছে আফ্রিকান সংস্কৃতির কোনো অভিন্ন সাধারণ রূপ ছিল না।  তাঁর প্যান-আফ্রিকানিজম ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও তার মুৎসুদ্দিদের বিরুদ্ধে আফ্রিকার অত্যাচারিত জনগণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। আমিন বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃত মার্কসবাদী মাত্রেই কেবলমাত্র বুদ্ধিজীবী নয়, একই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মী ভবিষ্যৎ কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা ছিল। সমাজতন্ত্রই ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য  এবং তিনি জানতেন যে তার জন্য প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পরাজয়। সেই উদ্দেশ্যে আন্দোলন সংগঠন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ।
        আমিন বিশ্বাস করতেন যে মার্কসবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ও সামাজিক-ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাকে  পৃথক করার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি সঠিক নয়। তাঁর মতে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়মগুলি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অধীনসে জন্য সাম্রাজ্যবাদের উত্থানকে নিছক ধনতন্ত্রের নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তিনি মনে করতেন যে মূল ধারার অর্থনীতির লক্ষ্য হল ধনতান্ত্রিক শোষণকে বৈধতা দানের প্রয়াস। অর্থনীতিকে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান হিসাবে প্রকাশের যে কোনো প্রচেষ্টা তাঁর কাছে ছিল হাস্যকর উল্লেখ করতে হয় তাঁর ডিপেন্ডেন্সি বা নির্ভরতা তত্ত্ব বিষয়ে তাঁর কাজ। উন্নত ও অনুন্নত দুনিয়ার মধ্যে অসম বিনিময় কেমনভাবে অনুন্নত দুনিয়াকে শোষণ করেছে এবং বিশ্ব ধনতন্ত্র একচেটিয়া অধিকারের মাধ্যমে সেই অসাম্যকে পুষ্ট করছে, তা তিনি ‘অ্যাকুমুলেশন অন এ ওয়ার্ল্ড স্কেল’, ‘ইউরোসেন্ট্রিজম’, ‘ইমপিরিয়ালিজন এন্ড আনইকোয়াল ডেভেলপমেন্ট’ এবং ‘ক্যাপিটালিজম ইন দি এজ অফ গ্লোবালাইজেশন’ এই সমস্ত বইতে আলোচনা করেছেন। অসম বিনিময়ের তত্ত্ব আলোচনাতে তিনি দেখিয়েছিলেন যে উন্নত দেশের সাধারণ শ্রমের মূল্য অনুন্নত দেশের থেকে বেশি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনুন্নত দেশের শ্রমিককে এই শোষণ সাম্রাজ্যবাদের এক মূল স্তম্ভ।  এই সমস্ত কারণেই তাঁকে দক্ষিণের অর্থাৎ অনুন্নত দেশের অর্থনীতিবিদ বলা হত।
ইউরোসেন্ট্রিজম আধুনিক সমাজবিদ্যার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। সমাজ বিবর্তনকে কেমন ভাবে সচেতন বা অচেতন ভাবে পশ্চিমী দুনিয়াকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়, তা প্রতিষ্ঠা করেছে। ধনতান্ত্রিক শোষণের ইতিহাসকে লুকিয়ে রেখে অনুন্নয়নের দায় অনুন্নত দেশের উপরে চাপিয়ে দেওয়াকে প্রকাশ্যে এনেছে ইউরোসেন্ট্রিজম তত্ত্ব।
        এই একচেটিয়া ধনতন্ত্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি এনেছেন ‘ডিলিঙ্কিং’ অর্থাৎ বিযুক্তির ধারণা। তাঁর মতে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের অন্ধ অনুকরণ শেষ পর্যন্ত নয়া উপনিবেশবাদকেই শক্তিশালী করে। তাই  শুধু যে উন্নত দেশ কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা প্রয়োজন তা নয়,  অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গঠন করে যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, তাকেও অস্বীকার করতে হবে। একমাত্র সাহসী ও ব্যাপক গণভিত্তিসম্পন্ন সরকারের পক্ষেই এই নীতি গ্রহণ করা সম্ভব। এছাড়াও প্রয়োজন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে সংহতি। সে কারণেই তিনি বহুকেন্দ্রিক বিশ্বের সমর্থক ছিলেন। তিনি এও আশা রাখতেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের শ্রমিকশ্রেণি ধনতন্ত্রেরই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে।
        তা বলে তিনি বহুকেন্দ্রিকতা যে সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী এমন কোনো সরল ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না। সেই কারণেই তিনি ধর্মীয় মৌলবাদের বিরোধিতা করেছিলেন। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের তিনি তীব্র বিরোধী ছিলেন। তার কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে তারা শেষ পর্যন্ত নয়া উদারনীতিবাদের নীতিগুলিই প্রয়োগ করবে। মোরসির মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত সরকারের বিরোধিতা এবং সেই সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পক্ষে আমিনের সমর্থন তাঁর অনেক সমর্থককেও  বিচলিত করেছিল। কিন্তু আমিন ছিলেন নিজের বিশ্বাসে অবিচল। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর মত প্রকাশে কুণ্ঠা বোধ করেন নি।
 গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, সেপ্টেম্বর ২০১৮