Friday 30 November 2018

মেঘনাদ সাহাঃ এক সমাজ সচেতন বিজ্ঞানী



মেঘনাদ সাহাঃ এক সমাজ সচেতন বিজ্ঞানী

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       সাধারণভাবে কোনো বিজ্ঞানীর নাম শুনলেই আমাদের অনেকে মনে আসে এমন একজন মানুষের কথা যিনি হয় ল্যাবরেটরিতে গবেষণাতে ব্যস্ত নয়তো অঙ্ক কষে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের চেষ্টায় ব্রতী। বাইরের সমাজ সম্পর্কে তাঁর ধারণা নেই, উৎসাহও নেই। এর সেরা উদাহরণ হিসাবে প্রায়ই শোনা যায়  আলবার্ট আইনস্টাইনের নাম প্রায় কোনো বিজ্ঞানীর ক্ষেত্রেই এটা সত্যি নয়, আইনস্টাইনের জন্য তো নয়ই। বিজ্ঞানীরা অধিকাংশ সময়েই সমাজ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। তবু তাঁদের মধ্যেও এক এক জন বিজ্ঞানী আছেন যাঁদের সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা আলাদা করে বলতেই হয়। আমাদের দেশে এই রকম দুজন বিজ্ঞানীর নাম আমরা সবাই জানি, প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও মেঘনাদ সাহা। মেঘনাদ সাহার জন্মের একশো পঁচিশ বছর উপলক্ষে তাঁর জীবনের এই দিক নিয়ে এই লেখায় সংক্ষেপে আলোচনার চেষ্টা করব।



       মেঘনাদ সাহার বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই প্রবন্ধে বিশেষ নেই, সংক্ষেপে কয়েকটা কথা বলা যাক। মেঘনাদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বিখ্যাত সাহা আয়নন সমীকরণ। সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্রের মধ্যে যে মৌলিক পদার্থ থাকে, প্রচণ্ড তাপমাত্রায় তাদের পরমাণুরা ইলেকট্রন হারিয়ে আয়নিত হয়ে যায়। এই আয়ননের পরিমাণ কেমনভাবে নক্ষত্রের তাপমাত্রা ও গ্যাসের চাপের উপর নির্ভর করে, তা অঙ্ক কষে বার করেছিলেন মেঘনাদ।  তাঁর গবেষণা থেকেই আমরা নক্ষত্রের ভিতরে চাপ, তাপমাত্রা ইত্যাদি ভৌত অবস্থা জানতে পারি। সাহা আয়নন সমীকরণের সাফল্য অনেক। এখানে তাদের মধ্যে শুধু একটা বলাই যথেষ্ট, এর থেকেই জানা গেছে যে সূর্য ও অন্য নক্ষত্ররা যে পদার্থ দিয়ে তৈরি, তার নিরানব্বই শতাংশই দুটো মৌল -- হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। অর্থাৎ মহাবিশ্ব কোন কোন মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি, তা সাহা সমীকরণ থেকেই বোঝা গিয়েছিল, যদিও সুযোগের অভাবে সেই কাজটা মেঘনাদ করে উঠতে পারেন নি। সিসিলিয়া পেইন নামের এক বিজ্ঞানী সাহা সমীকরণ ব্যবহার করে এই কাজটা করেছিলেন। আজও নক্ষত্রদের সম্পর্কে তত্ত্বীয় গবেষণা করতে গেলে অনেক জায়গায় সাহা সমীকরণ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এ ছাড়াও নক্ষত্রের ক্ষেত্রে বিকিরণের চাপ সম্পর্কে তিনি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছিলেন যা পরে বিজ্ঞানের এক নতুন শাখার জন্ম দেয়। তাই এ কথা সম্পূর্ণ সত্য যে তাঁর গবেষণা অ্যাস্ট্রোফিজিক্স অর্থাৎ জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। এর বাইরেও নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা, রেডিও জ্যোতির্বিদ্যা, রেডিও তরঙ্গের প্রসারণ ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর মৌলিক কাজ আছে।  নোবেল পুরস্কারের জন্য তাঁর নাম বেশ কয়েকবার মনোনীত হয়েছিল, কিন্তু ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত কোনো জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীই নোবেলের যোগ্য বলে বিবেচিত হননি। বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠান তৈরি  ও পরিচালনাতেও তাঁর দক্ষতা অনস্বীকার্য। এমন একজন বিজ্ঞানী, সারা পৃথিবীতে যাঁর খ্যাতি, তিনি ইচ্ছা করলেই সারাজীবন শুধু গবেষণাতেই মন দিতে পারতেন, তাঁর সতীর্থরা কেউ কেউ তা করেছিলেন। মেঘনাদ কিন্তু ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখেন নি।
       মেঘনাদের জন্ম হয়েছিল ঢাকার কাছে শেওড়াতলি গ্রামে ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবরগ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি পাস করার পরে দূরের অন্য এক গ্রামের স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে সারা পূর্ববঙ্গের মধ্যে প্রথম। এরপর বাংলার রাজধানী কলকাতা, প্রেসিডেন্সি কলেজসেখানে সহপাঠী পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। তাঁরা দুজনেরই বিষয় ছিল গণিত। বিএসসি ও এমএসসিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলেন মেঘনাদ, প্রথম সত্যেন্দ্রনাথ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন শুরু হয়েছে পদার্থবিদ্যা বিভাগ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আদেশে সেখানে পড়ানো ও গবেষণা শুরু করেন দুই বন্ধু। তার চার বছরের মধ্যেই মেঘনাদ আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত সমীকরণ, তখন তাঁর বয়স মাত্র ছাব্বিশ বছর। চোদ্দ বছর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন, তারপর আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। সেখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, যা এখন তাঁর নামে নামাঙ্কিত।
       এই কয়েক লাইনের জীবন আলেখ্যের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক হার না মানা চরিত্র, দুঃখকষ্টের আগুনে তৈরি হওয়া ইস্পাত। জাতপাতের হিসাবে তাঁরা ছিলেন বৈশ্য সাহা, অর্থাৎ তথাকথিত নিচু জাতের। মেঘনাদের বাবা জগন্নাথের ছিল একটা ছোটো মুদির দোকান। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার,  ছেলেকে প্রাইমারির পরে পড়ানোর ক্ষমতা জগন্নাথের ছিল না, গ্রামে তার কোনো সুযোগও ছিলও না। দূরের গ্রামে এক ডাক্তারের বাড়িতে মেঘনাদ পড়াশোনার জন্য থাকতেন, বিনিময়ে তাদের বাড়ির কিছু কাজ করতে হত। ভালো রেজাল্ট করার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে ঢাকার স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু ছোটলাট যেদিন স্কুলে আসবেন সেদিন খালি পায়ে আসার জন্য তাঁকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। মেঘনাদ বলার সুযোগও পাননি যে কোনোদিনই তিনি স্কুলে জুতো পরে আসেন না, কারণ তা কেনার ক্ষমতা তাঁর নেই। অন্য একটি স্কুলে তাঁর জায়গা হয়। তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফিয়ের জন্য তাঁর মা ভুবনেশ্বরীকে হাতের বালা বিক্রি করতে হয়েছিল। হিন্দু হস্টেলে সকলের সঙ্গে বসে খাওয়ার অনুমতি ছিল না, স্কুলে ও কলেজে সরস্বতী পুজোর মণ্ডপ থেকে তাঁকে বার করে দেওয়া হয়েছিল। বিদেশের তুলনায় ভারতে গবেষণার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত।  তার উপর আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সি ভি রমনের সঙ্গে তাঁর কোনোদিনই সম্পর্ক ভালো ছিল না, তাই পরীক্ষাগার ব্যবহারের সুযোগ কলকাতায় বিশেষ পান নি। এলাহাবাদেও গবেষণার পরিকাঠামো ছিল খুবই অনুন্নত। এই সমস্ত অসুবিধার মধ্যেই মেঘনাদ সর্বোচ্চ মানের কাজ করে গেছেন। কিন্তু বিজ্ঞানচর্চাই তাঁর জীবনের সব নয় নিজে ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র ও অবজ্ঞার মধ্যে মানুষ হয়েছিলেন বলেই হয়তো তিনি সারা জীবনই দেশের ও দেশের মানুষের কথা ভেবেছেন।  
       জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েছিলেন মেঘনাদ। কখনো ভোলেন নি যে নিচু জাতে জন্ম বলে হিন্দু হস্টেলে তাঁর সকলের সঙ্গে খাওয়ার অধিকার ছিল না। তাই বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের কাছে দাবি তুলেছিলেন যে সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সমস্ত হস্টেলে যে কোনো রকম জাতপাত ভিত্তিক থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা তুলে দিতে হবে। নিজের গ্রামে পড়ার সুযোগ হয়নিযখন সামর্থ্য হয়েছে, সেখানে নিজের মায়ের নামে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেননিজের বাড়িতে দুঃস্থ ছাত্রদের রেখে পড়াশোনা করিয়েছেন। নিজে বিদেশে গবেষণার সুযোগ বিশেষ পাননি, তাঁর ছাত্রদের জন্য সে ব্যবস্থা করেছেন। নিজে যে সমস্ত সুযোগ পাননি, অন্যরা তার থেকে যেন বঞ্চিত না হয় সেজন্য তাঁর যথাসাধ্য চেষ্টা ছিল। 
       নিজের ছাত্র, আত্মীয়,‌ কাছের মানুষদের উন্নতির চেষ্টার মধ্যেই মেঘনাদের প্রয়াস সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁর প্রসারিত দৃষ্টির ভিতরে ছিল দেশের ভবিষ্যৎ। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, সেই সময় আমাদের দেশ বিদেশী শাসনের অধীন। মেঘনাদের মতো কোনো প্রকৃত দেশপ্রেমিক সে কথা ভুলে যেতে পারেন না। ছাত্রজীবন থেকেই বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। পুলিস সে কথা জানত বলে সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বসার অনুমতি তিনি পাননি। বাঘা যতীনই তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নিয়ে বিজ্ঞান চর্চার মাধ্যমে দেশের মুখ উজ্জ্বল করতে। তিনি যখন ১৯২১ সালে জার্মানিতে গিয়েছিলেন, প্রবাসী বিপ্লবীদের সঙ্গে, বিশেষ করে কমিউনিস্ট নেতা মানবেন্দ্রনাথ রায়ের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়েছিলসেই বছরই মানবেন্দ্রনাথের প্রতিনিধি নলিনী গুপ্ত ভারতে এসেছিলেন, মেঘনাদের মাধ্যমেই যুগান্তর দলের বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয় এ সমস্ত সংবাদ ব্রিটিশের পুলিসের অজানা ছিল না। এই সব কারণে তাঁর ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হওয়া কয়েক বছর পিছিয়ে গিয়েছিল। এই সমস্ত হলো মেঘনাদের সরাসরি স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের উদাহরণ। মেঘনাদ কলকাতা ছাড়ার পরে সম্ভবত বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সরাসরি সংগ্রামে অংশগ্রহণ ছাড়াও মেঘনাদের মতো মানুষের পক্ষে দেশের সেবা করা সম্ভব। তিনি নিজেও মনে করেছিলেন যে একজন বিজ্ঞানী হিসাবে দেশকে, আরো ভালোভাবে বললে, দেশের মানুষকে সেবার করার অন্য রাস্তাই তাঁর কাছে শ্রেয়। সেই কথায় আমরা আসব, তবে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রতি তাঁর সহানুভূতি সারাজীবনই ছিল। এলাহাবাদে তাঁর ছাত্র বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরি বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁকে বোঝালেন পড়াশোনা করাটা কতটা জরুরি, তারপর পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে নিজের বাড়িতেই লুকিয়ে রেখেছিলেন।
       মেঘনাদের দেশের কাজে হাতেখড়ি কলেজ জীবনে। তিনি ছিলেন গণিতের ছাত্র, তবে যে শিক্ষক কলেজে তাঁকে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছিলেন, তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র। কলেজে পড়ার সময় দামোদরে বন্যা হয়েছিল, প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর ছাত্রদের নিয়ে বন্যাত্রাণে গিয়েছিলেন। মেঘনাদ স্বচক্ষে দেখেছিলেন বন্যার ভয়াল রূপ। এই ঘটনার দশ বছর পরে উত্তরবঙ্গে ভয়ঙ্কর বন্যার সময় প্রফুল্লচন্দ্রকে সভাপতি করে ত্রাণ সংগ্রহের জন্য কমিটি তৈরি হয় তাঁরই চেষ্টায়, তিনি নিজেই হয়েছিলেন সম্পাদক। এই সময়েই তরুণ সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হয়, সুভাষ ত্রাণ নিয়ে উত্তরবঙ্গে গিয়েছিলেন। ১৯২২ সালের সেই বন্যার কারণ আলোচনা করে তিনি দেখিয়েছিলেন যে রেলপথ নির্মাণের জন্য জলের স্বাভাবিক গতিপথ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, তার ফলেই বন্যা প্রলয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। মেঘনাদ সাহা লিখলেন, ‘রাজশাহীতে রেলপথের সুবিধার জন্য চাষিকে বলি দেওয়া হল।’ ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ পত্রিকার কথা পরে আসবে, তাতে বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে বন্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব বিষয়ে তিনি লিখেছিলেন। মেঘনাদের লেখালেখির  ফলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে থেকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠে আসে এবং শেষপর্যন্ত ১৯৪৩ সালে সরকার দামোদরের বন্যা বিষয়ে এক কমিটি তৈরি করেন, মেঘনাদ হয়েছিলেন তার সদস্য। এই কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে দামোদর ভ্যালি প্রকল্প রূপায়িত হয়েছিল। দুর্ভাগ্যবশত মেঘনাদের অনেকগুলি সুপারিশ শেষপর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি, তার ফল আমরা আজ পর্যন্ত ভোগ করছি।
       মেঘনাদের নিজের কথায়, ১৯৩০-এর দশকে তিনি বিজ্ঞানের গজদন্ত মিনার থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। বিজ্ঞানীদের সংগঠিত করার কাজ এই সময়ই শুরু করেছিলেনপ্রথমেই এলাহাবাদে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সায়েন্স অ্যাকাডেমি। তাকে সর্বভারতীয় রূপ দিতে গিয়ে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল, তার উত্তরাধিকার আমরা আজও বয়ে নিয়ে চলেছি একই দেশে এলাহাবাদ, দিল্লি ও বাঙ্গালোরে তিনটি আলাদা আলাদা সায়েন্স অ্যাকাডেমির মাধ্যমে। কলকাতায় দুটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি ও ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন। বিখ্যাত বিজ্ঞানী জন ডেসমন্ড বার্নাল ও জোসেফ নিডহ্যামের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে তৈরি করেছিলেন বিজ্ঞানকর্মীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অফ সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স। বিজ্ঞানীদের এই সমস্ত সংগঠনের কথা আলোচনার সুযোগ এই প্রবন্ধে নেই। সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশন থেকে শুরু করা ‘সায়েন্স এন্ড কালচার’ পত্রিকার নাম আলাদা করে করতে হয়, যার কথা এই লেখায় আগে এসেছে। মেঘনাদের লক্ষ্য ছিল বিজ্ঞান সম্পর্কিত খবর এবং দেশের ভবিষ্যৎ কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে ভারতীয় বিজ্ঞানীদের মতামত প্রচার করা আজ পর্যন্ত নিয়মিত তা প্রকাশিত হয়ে চলছে।
উনিশশো তিরিশের দশকটা দেশের ইতিহাসেও খুব গুরুত্বপূর্ণ। গান্ধীজী ও কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশ উত্তাল। ব্রিটিশ শাসকরা ভারতকে স্বাধীনতা দিতে কোনোমতেই রাজি নয়। তবে মেঘনাদ সহ কোনো কোনো বিজ্ঞানীর মনে হচ্ছিল যে স্বাধীনতা শুধু সময়ের অপেক্ষা, কিন্তু স্বাধীন ভারত বিকাশের কোন পথ বেছে নেবে তা সেই মুহূর্তেই স্থির করাটা খুব জরুরি। ঠিক করার সময় এসেছে দেশের কোটি কোটি নিরন্ন মানুষের মঙ্গল কেমনভাবে হবে। মেঘনাদ সেই মানুষদের মধ্যে থেকেই উঠে এসেছেন।
দেশের ভবিষ্যৎ বিকাশ বিষয়ে কংগ্রেসের মূল ধারার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মেঘনাদের তীব্র আপত্তি ছিল। গান্ধীজীর অনুসরণ করে কংগ্রেস মনে করত চরকা ও কুটিরশিল্পই দেশের সামনে একমাত্র পথ। মেঘনাদের মত সম্পূর্ণ আলাদা। তরুণ রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার চোখ-ধাঁধানো সাফল্য অন্যান্য পিছিয়ে পড়া দেশকে এগোনোর পথের দিশা দেখাচ্ছে। সেই পথ হল শিল্পায়নের পথ, বিজ্ঞানকে যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পরিকল্পনা মাফিক ব্যাপক অংশের জনগণের উন্নয়নের পথ। তাঁর আদর্শ শিক্ষক প্রফুল্লচন্দ্র তাঁকে বলেছিলেন যে একটা দেশ কত এগিয়ে, তা তার সালফিউরিক অ্যাসিড ও ইস্পাত তৈরির পরিমাণ থেকে বোঝা যায়। প্রফুল্লচন্দ্র নিজে রসায়ন শিল্পের জন্য বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। অথচ মেঘনাদ দেখছেন যে যুক্তপ্রদেশের কংগ্রেসি মন্ত্রীসভার শিল্পমন্ত্রী কৈলাসনাথ কাটজু একটা দেশলাই বানানোর কারখানার উদ্বোধন করে দেশ শিল্পের পথে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। মেঘনাদ উপলব্ধি  করেছিলেন যে কংগ্রেসকে বোঝাতে হবে দেশের বিশাল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির জন্য অবশ্য প্রয়োজন হল ভারি শিল্প।  ১৯৩৮ সালে দেখা করলেন নবনির্বাচিত কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে। সুভাষচন্দ্র জানতেন দেশের উন্নতি বিষয়ে মেঘনাদের মত, ১৯২২ সালে বঙ্গীয় যুবক সম্মেলনে সুভাষই তাঁকে সভাপতি হতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সেখানে ভাষণে মেঘনাদ একই কথা বলেছিলেন।
       ‘সায়েন্স এন্ড কালচার পত্রিকায়’ নিবন্ধের পর নিবন্ধ লিখে পরিকল্পনার গুরুত্ব বোঝাতে লাগলেন মেঘনাদ। তাঁরই পরামর্শে সুভাষচন্দ্র তৈরি করলেন জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি। সভাপতি হওয়ার জন্য জহরলাল নেহরুকে অনুরোধ করলেন মেঘনাদ। জহরলাল রাজি হলেও সাহার সন্দেহ গেল না, গান্ধীজীকে কতটা অগ্রাহ্য করতে পারবেন তিনি? তাই এমন একজনের শরণাপন্ন হলেন যাঁর কথা গান্ধী বা নেহরু কেউই উড়িয়ে দিতে পারবেন না। জার্মানিতে তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সতের বছর পরে সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করার সময় হল। রবীন্দ্রনাথও দেশের উন্নয়ন বিষয়ে তাঁর মত শুনে মুগ্ধ হলেন, জহরলালকে চিঠি দিলেন।
       এইসময় আরো একটা ঘটনা ঘটল যা আজকের দিনে হয়তো আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। শান্তিনিকেতনে বক্তৃতাতে তিনি বলেছিলেন, ‘যে সব প্রাচীন আদর্শ বিজ্ঞাননির্ভর নয়, তাদের অবলম্বন করে আমরা দিনের পর দিন পিছিয়ে যাচ্ছি সেই বক্তব্য ছাপা হওয়া মাত্র হিন্দু ধর্মের ধ্বজাধারীদের আক্রমণের মুখে পড়লেন, তাঁরা মেঘনাদকে বললেন বেদের মধ্যেই সমস্ত আধুনিক বিজ্ঞানকে পাওয়া যাবে। খরশান ব্যঙ্গে উত্তর এলো, ‘কোনও লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল আমি কি বৈজ্ঞানিক কাজ করিয়াছি জানিবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। আমি প্রথম জীবনের উৎসাহভরে তাঁহাকে আমার তদানীন্তন গবেষণা সম্বন্ধে সবিশেষ বর্ণনা দেই। তিনি দুই-এক মিনিট পর পরই বলিয়া উঠিতে লাগিলেন, ‘এ আর নূতন কি হইল, এ সমস্তই ব্যাদে আছে’ ... বলিলাম, ‘মহাশয় এসব তত্ত্ব বেদের কোন অংশে আছে...’ তিনি বলিলেন, ‘আমি ত কখনও ‘ব্যাদ’ পড়ি নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস, তোমরা নূতন বিজ্ঞানে যাহা করিয়াছ বলিয়া দাবি কর সমস্তই ‘ব্যাদে’ আছে।’ সঙ্গে ছিল প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা। ভুল মানুষকে আক্রমণের লক্ষ্য বেছে নিয়েছেন বুঝে চুপ করে গেলেন প্রাচীনপন্থীরা। আজ যখন প্রাচীন শাস্ত্রে আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত অগ্রগতিকে খুঁজে পাওয়ার কথা সরকারের সর্বোচ্চ স্তর থেকে বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছে, মেঘনাদ সাহার মতো মানুষকে আমাদের বড়ো দরকার।
       জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির কাজ খুব এগোয়নি, কারণ নেহরু কিছুদিনের মধ্যেই কারাবন্দী হলেন। পরের বছর সুভাষচন্দ্র গান্ধীজীর মত অগ্রাহ্য করে আবার সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন ও নির্বাচিত হলেন। কিন্তু গান্ধীজীর বিরোধিতা করে বেশিদিন তিনি সভাপতি পদে থাকতে পারলেন না, পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। মেঘনাদের কলেজের বন্ধু রসায়নবিদ জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ এবং ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বেশ্বরাইয়া ছাড়া অল্প কয়েকজন বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদই পরাধীন ভারতে এই কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলেন। তবে দেশের উন্নতিতে কমিটির প্রভাব নিঃসন্দেহে সুদূরপ্রসারী, কারণ এরই উত্তরসূরি স্বাধীন ভারতের প্ল্যানিং কমিশন। মেঘনাদের চিন্তা থেকেই উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রধানমন্ত্রী জহরলাল এই কমিশনকে তৈরি করেন, যদিও মেঘনাদের সেখনে বিশেষ স্থান হয়নি। নানা সীমাবদ্ধতা থাকলেও স্বাধীনতার পর দেশের অগ্রগতিতে প্ল্যানিং কমিশনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার অবশ্য এর অবলুপ্তি ঘটিয়েছে।
দেশের বিজ্ঞানীদের স্বাধীনতা আন্দোলনের থেকে গা-বাঁচানোর সুবিধাবাদী মনোভাব মেঘনাদ পরিকল্পনা কমিটির বাইরেও দেখবেন। কলকাতায় ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের অধিবেশনে সভাপতি হয়েছিলেন নেহরু। তিনি জেলে বন্দী ছিলেন, মেঘনাদের পরামর্শে তাঁর ছবি চেয়ারে রেখে সভা চালানো হয়েছিল। কিন্তু দেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানীদের কেউই প্রায় সেই অধিবেশনে আসেন নি। পরে নেহরুর সঙ্গে যখন তাঁর মতবিরোধ তীব্র, তখন তিনি নেহরুকে সেই কথা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তাতে অবশ্য কোনো ফল হয়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই ভারতীয় শিল্পের উপর ব্রিটেনের নির্ভরতা বাড়তে থাকে। শিল্পে বিজ্ঞান গবেষণার প্রয়োগের জন্য তৈরি হয়েছিল বোর্ড অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ যা পরে কাউন্সিলে পরিবর্তিত হয়। মেঘনাদ প্রথম থেকেই সদস্য, অধিকর্তা তাঁর এক পুরানো বন্ধু রসায়নবিদ শান্তিস্বরূপ ভাটনগর। কিন্তু ভাটনগরের লক্ষ্য কয়েকটা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, তাদের মধ্যেই গবেষণা সীমাবদ্ধ থাকবে। নেহরু ও কংগ্রেসও তাঁরই মতের সমর্থক। মেঘনাদ এই কেন্দ্রীকরণের তীব্র বিরোধিতা করলেন, তাঁর বক্তব্য বিশ্ববিদ্যালয়দের বঞ্চিত করে এই রকম গবেষণার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ফলপ্রসূ হবে না। একবার কমিটি থেকে পদত্যাগও করলেন। কিন্তু স্বাধীন ভারতেও সরকারের নীতি পাল্টালো না, অথচ সারা পৃথিবীর সমস্ত উন্নত দেশে গবেষণা হয় মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ মেঘনাদের মতকে অগ্রাহ্য করার দাম আমাদের দিতে হচ্ছে বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়ে। বিরোধের ক্ষেত্র এই একটা ছিল নাভাটনগর তৈল অনুসন্ধান পুরোপুরি বিদেশী কোম্পানির হাতে তুলে দিচ্ছেন, মেঘনাদের বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ দেশের হাতে থাকা প্রয়োজন। মেঘনাদ চিরকালই দেশে স্বাধীন গবেষণার পক্ষপাতী। সংঘাত অনিবার্য। ভাটনগর ক্ষমতাশালীদের কাছের লোক, সাহার বক্তব্য তাই নীতি পরিবর্তন করতে পারে না।
       অন্যদিকে পরমাণু শক্তি গবেষণার জন্য ১৯৪৫ সালে তৈরি হয়েছিল অ্যাটমিক এনার্জি রিসার্চ কমিটি। কোনোদিন নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে গবেষণা না করলেও নেহরুর সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে সভাপতি হয়েছেন হোমি জাহাঙ্গির ভাবা। মেঘনাদই ভারতে প্রথম পরমাণু শক্তির গুরুত্ব সম্পর্কে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। তিনি নিজে দীর্ঘদিন এ বিষয়ে গবেষণা করেছেন, ভারতে প্রথম সে বিষয়ে পড়াশোনা ও গবেষণা শুরু হয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরই তত্ত্বাবধানে, সেখানে তিনি তৈরি করছেন ভারতের প্রথম সাইক্লোট্রন যন্ত্র। তিনি হয়েছেন কমিটির সাধারণ সদস্য। ভাবাও ভাটনগরের মতোই গবেষণার কেন্দ্রীকরণের পক্ষে, তিনি চাইছেন পরমাণু শক্তি বিষয়ে সমস্ত গবেষণা বম্বেকে কেন্দ্র করে হোক। কলকাতার ভাগ্যে কিছুই জুটছে না। ভাবার লক্ষ্য এখনই পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন, মেঘনাদ জানেন যে নিজেদের গবেষণার উপর দাঁড়িয়ে পরমাণু শক্তির ব্যবহার করতে ভারতের কয়েক দশক লাগবে। বিদেশ থেকে সহায়তা পেতে গেলে তাদের শর্ত মতো চলতে হবে। তাই তিনি ধীরে ধীরে ভারতীয় বিজ্ঞানী-প্রযুক্তিবিদদের উপর নির্ভর করে এগোনোর পক্ষপাতী।  মেঘনাদ পরমাণু গবেষণাতে অনাবশ্যক গোপনীয়তার ঘেরাটোপের বিরোধী, অথচ জাতীয় নিরাপত্তার অজুহাতে পরমাণু গবেষণা সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে। ভাবার কার্যকলাপে বিরক্ত মেঘনাদ নেহরুর কাছে নালিশ করেছেন, কোনো ফল হয়নি। একসময় বিরক্ত হয়ে  ছাত্রকে চিঠিতে লিখেই ফেললেন, ‘পণ্ডিতজীকে ক্ষমতালোভীরা ঘিরে রেখে ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে’ ১৯৪৮ সালে যখন পরমাণু শক্তি আয়োগ তৈরি হয়, মেঘনাদ তার সদস্য হতে অস্বীকার করলেন। সদস্য হয়ে লাভ কী, তাঁর মতামতের কোনো দামই দেওয়া হচ্ছে না।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু দেশের উন্নতির জন্য বিজ্ঞান গবেষণার গুরুত্ব নিয়ে মেঘনাদ কোনো কথা বলার জায়গা পাচ্ছেন না। তাহলে কি হেরে গেলেন মেঘনাদ? পালিয়ে যাওয়া তাঁর ধাতে নেই। প্রথম লোকসভা নির্বাচনে উত্তর কলকাতা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন মেঘনাদ। গান্ধীজীর চরকা ও কুটির শিল্পনীতির বিরোধিতা করে তাকে বিজ্ঞানবিরোধী ও পশ্চাৎমুখী বলেছেন, কংগ্রেসের টিকিট তাঁর পাওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। বামপন্থীদের সমর্থনে নির্দল হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কংগ্রেসের প্রার্থীকে হারিয়ে জয়ী হলেন মেঘনাদ। লোকসভাতে মেঘনাদ বিজ্ঞান গবেষণা শিক্ষা, নদী পরিকল্পনা, শিল্পায়ন, উদ্বাস্তু পুনর্বাসন, পরমাণু শক্তি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বক্তব্য রেখেছেনসংসদে নেহরুর সঙ্গে একাধিকবার তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিলেন মেঘনাদ। একসময়ে নেহরুর ব্যক্তিগত আক্রমণের উত্তরে মেঘনাদ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ‘আমি হয়তো বিজ্ঞানে সামান্যই কাজ করেছি, কিন্তু তবু আমার নাম শতাব্দীর পর শতাব্দী লোক মনে রাখবে এখানকার অনেক রাজনীতিক কয়েক বছরের মধ্যেই বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবেন’ সংসদের বাইরে বিজ্ঞান ছাড়াও মেঘনাদ সাহার বিভিন্ন ভূমিকা আছে। দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে তিনি সংসদের বাইরে ও ভিতরে বারবার সরব হয়েছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝেছিলেন যে নির্দলীয় সদস্যদের কথার কোনো গুরুত্ব নেই নির্দল হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও সংসদের খাতায় তাঁর নামের পাশে লেখা আছে ইউনিয়ন অফ সোশ্যালিস্টস এন্ড প্রগ্রেসিভস, দল বিচারে তিনি আরএসপির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সংসদ সদস্য হিসাবে পাঁচ বছর পূর্ণ করার আগেই আকস্মিক হৃদরোগে দিল্লিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
মেঘনাদের কাছে বিজ্ঞান শুধু নিছক জ্ঞানচর্চার বিষয় ছিল না, তা ছিল সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার। দেশের সমসাময়িক অন্য প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানীর থেকে তিনি এই ক্ষেত্রে পৃথক। রমনের মতো সমাজের উঁচু অংশের প্রতিনিধিত্ব তিনি করেন নি, ভাবার মতো সোনার চামচ মুখে নিয়েও তাঁর জন্ম নয়। তাঁর মতো সমাজের নিচু স্তর থেকে উঠে এসে দেশের বিজ্ঞানীমহলে শীর্ষস্থান অধিকার কেউ করেন নি। দারিদ্র্যকে তিনি ভিতর থেকে দেখেছিলেন, অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলেন সমাজে তথাকথিত নিচু জাতের সমস্যা। মেঘনাদের বিজ্ঞানচর্চার আলোচনা এই নিবন্ধে বিশেষ করা হল নাসেখানেও বিদেশি বিজ্ঞানীদের মুরুব্বিয়ানা তাঁকে আহত করেছিল। একজন বিদেশি বিজ্ঞান ঐতিহাসিক একবার লিখেছেন সাহা সমীকরণ ইংল্যান্ডে বসে মেঘনাদ আবিষ্কার করেছিলেন, মেঘনাদ তা জানা মাত্র তীব্র প্রতিবাদ জানান। মেঘনাদের কাছে বিজ্ঞানচর্চার অন্য একটা  উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয়রা যে বিদেশি বিজ্ঞানীদের থেকে কোনো অংশে ন্যূন নয়, তা প্রতিষ্ঠা করা, অর্থাৎ তা দেশপ্রেমেরই একটা প্রকাশ। দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাঁর জীবনের চালিকাশক্তি। পরাধীন দেশে প্রথমে বিপ্লবী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। যখন দেশের স্বাধীনতা কাছে এলো, তখন দেশের ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে সামিল হতে চেয়েছিলেন। আবার যখন বুঝলেন স্বাধীন দেশের সরকার দেশগঠনে বিজ্ঞানকে তার প্রাপ্য গুরুত্ব দিছে না, তখনই তাঁর নিজের মতকে প্রকাশ করার উপযুক্ত জায়গা হিসাবে তিনি বেছে নিলেন সংসদকে। সমাজ পরিবর্তনের তাগিদ মেঘনাদ সাহাকে পরীক্ষাগারের নিশ্চিন্ত জীবন থেকে বার করে এনেছিল। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য যে আমরা তাঁর সেই জীবনব্যাপী সংগ্রামের যথাযথ মূল্য দিতে পারিনি।

প্রকাশঃ সমন্বয় উৎসব ২০১৮

Monday 19 November 2018

শতবর্ষ পরে সাহা সমীকরণ




শতবর্ষ পরে সাহা সমীকরণ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      আজ থেকে একশো বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে  বসে তরুণ গবেষক মেঘনাদ সাহা মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলেন নক্ষত্রলোক তথা মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনের চাবিকাঠি। অধিকাংশ যুগান্তকারী আবিষ্কারের মতোই সাহার গবেষণার সম্পূর্ণ তাৎপর্য বুঝতে বিজ্ঞানীদের অনেক সময় লেগেছে, এমন কি স্বয়ং আবিষ্কর্তাও তা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারেন নি। মেঘনাদের ক্ষেত্রে অবশ্য তার মূল কারণ বিজ্ঞানের কেন্দ্র অর্থাৎ ইউরোপ-আমেরিকা থেকে তাঁর দূরত্ব। সে দূরত্ব শুধুমাত্র ভৌগোলিক নয়, পরাধীন দেশের বিজ্ঞানীদের প্রতি তাচ্ছিল্য ও ঔদাসীন্য যে মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করেছিল সে বিষয়ে মেঘনাদ যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। সে সমস্ত পৃথক আলোচনার বিষয়, আমরা এই নিবন্ধে শুধুমাত্র সাহা সমীকরণের উৎস ও বিশেষ করে জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাতে তার তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করব।



      আমরা সবাই বর্ণালী কথাটা শুনেছি। বর্ণালীতে আলো বিভিন্ন রঙে ভেঙে যায়। বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। সূর্যের বা অন্যান্য নক্ষত্রের আলোর বর্ণালীতে আমরা উজ্জ্বল পশ্চাৎপটের ওপর কালো কালো দাগ দেখতে পাই। এই ধরনের বর্ণালীকে বলে শোষণ বর্ণালী। এর উৎস কী?  বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ বিভিন্ন রঙের আলো শোষণ করে। সূর্যের কেন্দ্রের অঞ্চল (যেখানে নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়াতে তাপ উৎপন্ন হয় বলে আমরা এখন জানি) প্রচণ্ড উত্তপ্ত, সেখান থেকে আলো বেরোয়। সূর্যের একদম বাইরের স্তর আলোকমণ্ডল (photosphere) ও বর্ণমণ্ডল (chromosphere) যে সমস্ত মৌল আছে, তারা তাদের চরিত্র অনুযায়ী কোনো কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে, ফলে সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় অপেক্ষাকৃত অনেক কম পরিমাণে। বর্ণালীতে সেই সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গায় কালো দাগগুলো দেখতে পাওয়া যায়। তাই সূর্যের বা অন্য নক্ষত্রের শোষণ বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কোন কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গায় কালো দাগ অর্থাৎ অন্ধকার, তা দেখে কোন কোন মৌলের পরমাণু সেখানে আছে তা বলা সম্ভব।
      বর্ণালীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকরা নক্ষত্রদের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন। তাদের নাম দেওয়া হয় O, B, A, F, G, K এবং M রঙের দিক থেকে বললে O শ্রেণির তারা নীল, তার পর রঙ ক্রমশ লালের দিকে যায়। M তারা লাল। কিন্তু এই শ্রেণি বিভাগের সঙ্গে তারকাদের গঠন বা ভৌত প্রকৃতির সম্পর্ক কী সে বিষয়ে কোনো ধারণা আমাদের ছিল না। অবশেষে ভিনের সূত্র ব্যবহার করে তারার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে তারাদের উপরিতলের তাপমাত্রা সম্ভব হয়। তখন বোঝা গেল যে O তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশী। তারপর তাপমাত্রা কমতে থাকে। M তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। গত শতাব্দীর একদম শুরুতে বর্ণালীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে জার্মানিতে এজনার হার্জস্প্রুং ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি নরিস রাসেল তারাদের ঔজ্জ্বল্য ও তাদের বাইরের পিঠের তাপমাত্রার মধ্যে একটা সম্পর্ক খুঁজে পান।
      তারাদের শ্রেণি অর্থাৎ তাপমাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন মৌলের শোষণ বর্ণালীর চরিত্রের পরিবর্তন হয়বিভিন্ন মৌল বা আয়নের তীব্রতার হ্রাস বৃদ্ধি ও হার্ভার্ড শ্রেণি বা তাপমাত্রার সম্পর্ক আমরা দেখতে পাচ্ছিলামযেমন O শ্রেণির তারাদের বর্ণালিতে হিলিয়ামের শোষণ রেখা খুব শক্তিশালী। অন্যদিকে K বা M তারাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাতুর রেখা খুবই তীব্র। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে আয়নের কথা। নিস্তড়িৎ পরমাণু থেকে নক্ষত্রের অভ্যন্তরের উচ্চ তাপমাত্রায় ইলেকট্রন বেরিয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে পরমাণুটি আয়নে পরিণত হবে। এই ধরনের আয়নদের রেখাও বর্ণালীতে পাওয়া যাচ্ছিল। কোনো ভাবেই নক্ষত্রদের তাপমাত্রার সঙ্গে তার বর্ণালীর সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছিল না। মেঘনাদ সাহা এই নিয়ে চিন্তা করছিলেন। অন্য একটা সমস্যা তাঁকে ভাবিয়েছিল। সূর্যের সবচেয়ে বাইরের অংশ হল বর্ণমণ্ডল, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়নের রেখা দেখতে পাওয়া যায়। অথচ তার ভিতরের অংশ হল আলোকমণ্ডল, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়ন নয়, নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর রেখা দেখা যায়। এর কারণ কী হতে পারে?  
      ১৯১৯ সাল। মেঘনাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ক্লাসে তাপগতিতত্ত্ব পড়াচ্ছিলেন। রাসয়ানিক বিক্রিয়ার বিষয় পড়াতে গিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জার্মান বিজ্ঞানী এগার্টের একটি প্রবন্ধ। এগার্ট নক্ষত্রের ভিতরে উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণু ও আয়নের ভেঙে যাওয়াকে তাপগতিতত্ত্বে রাসয়ানিক বিক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। মেঘনাদ দেখলেন যে এগার্টের পদ্ধতিতে কয়েক বছর আগে আবিষ্কৃত নিলস বোরের পরমাণুর মডেল ব্যবহার করা প্রয়োজন। ১৯২০ সালে philosophical Magazine – এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধ সাহা যে সমীকরণ দেন, তা পরবর্তী কালে সাহা আয়নের সমীকরণ (Saha Ionization Equation) হিসেবে পরিচিত হয়েছে সাহা ধরে নেন সূর্যের মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রার জন্য পরমাণুরা আয়ন ও ইলেকট্রনে ভেঙে যায় এবং একই সঙ্গে আয়ন ও ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে পরমাণু গঠন করে এই দুই বিক্রিয়া তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকে সাহার গবেষণার বৈশিষ্ট্য হল যে চিরায়ত তাপগতিবিদ্যা ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে টেনে দেখান পরমাণুর আয়নন বিভব (ionization potential) এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় কোনো পরমাণুকে আয়ন ইলেকট্রনে ভাঙতে গেলে যে পরিমাণ শক্তি দিতে হয়, তাকে বলে আয়নন বিভব
      সাহার সমীকরণের রূপটি হল
log x2P/(1-x2) = -u/4.571T +2.5 logT - 6.5
এখানে P হল প্রমাণ বায়ুমণ্ডলের চাপের মাপে নক্ষত্রের ভিতর গ্যাসের চাপ, x হল গ্যাসের আয়ননের মাত্রা, u ক্যালরিতে আয়নন বিভব এবং T কেলভিন স্কেলে গ্যাসের তাপমাত্রা  জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেল পরে দেখালেন যে P হল মুক্ত ইলেকট্রন গ্যাসের চাপ সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে এই চারটি ভৌত রাশি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত এদের মধ্যে কিছু জানা থাকলে বাকিগুলি নির্ণয় করা সম্ভব
      সমীকরণ থেকে সাহা দেখাতে পারলেন যে সূর্যের বর্ণমণ্ডলে তাপমাত্রা, চাপ ও অন্যান্য ভৌত অবস্থা এমন যে সেখানে সমস্ত ক্যালসিয়াম পরমাণু একটি করে ইলেকট্রন ছেড়ে আয়নিত হয়ে যায় আবার কেন্দ্রের আরো কাছের আলোকমণ্ডলে তাপমাত্রা বেশী বটে, কিন্তু চাপও অনেক বেশী তাই সেখানে ক্যালসিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রন ছাড়ার সম্ভাবনা কম ফলে আলোকমণ্ডলের বর্ণালীতে নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর এবং বর্ণমণ্ডলে আয়নের চিহ্ন দেখার সম্ভাবনা বেশি
      সাহার গবেষণা আরো এক সমস্যার সমাধান করলো সূর্যে রুবিডিয়াম, সিজিয়াম ইত্যাদি ধাতুর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সাহা বললেন এদের আয়নন বিভব কম, তাই এরা সহজে আয়নিত হয়ে যায় কোন মৌলের আয়ন যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে তা ঐ মৌলের পরমাণুর থেকে আলাদা আয়নিত হয়নি এমন অবস্থায় ঐ মৌলের পরমাণুর চিহ্ন পেতে হলে অপেক্ষাকৃত শীতল অঞ্চলে দেখতে হবে সৌর কলঙ্কের তাপমাত্রা কম, তাই সেখান থেকে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে রুবিডিয়ামের চিহ্ন পাওয়া যাবে অচিরেই দেখা গেল সাহার কথা ঠিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেল সৌরকলঙ্কের বর্ণালীতে রুবিডিয়ামকে খুঁজে পেলেন
      সাহা এই সময় অপর একটি গবেষণা পত্র প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন এর অল্প পরেই তিনি ইংল্যান্ডে আলফ্রেড ফাউলারের ল্যাবরেটরিতে যান ফাউলারের পরামর্শে তিনি গবেষণাপত্রটি নতুন করে লেখেন বিদেশের পরীক্ষাগারে কাজ করার সুবাদে সাম্প্রতিকতম তথ্য ব্যবহারের সুযোগ তিনি পান তার ফলে মূল তত্ত্বটি অপরিবর্তিত থাকলেও প্রবন্ধটির মানের অনেক উন্নতি ঘটে এটিও তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে অন্যতম
      এই প্রবন্ধে সাহা বিভিন্ন তারার বর্ণালীর এক সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা বহু তারার বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তারাদের রঙের সঙ্গে তাপমাত্রার একটা সম্পর্ক ছিল বলে বোঝা যাচ্ছিল যেমন নীল তারারা বেশী উত্তপ্ত, লাল তারাদের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম কিন্তু তার সঙ্গে তারাদের মধ্যে ভিন্ন মৌলের পরমাণুর শোষণ বর্ণালীর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সাহা দেখান যে তাঁর সমীকরণ সহজেই তারার তাপমাত্রার সঙ্গে শোষণ বর্ণালীর সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে পারে যেমন অতি উত্তপ্ত তারাতে সমস্ত হাইড্রোজেন আয়নিত হয়ে যায়, ফলে হাইড্রোজেনের শোষণ তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ঐ তারাদের বর্ণালীতে থাকে না আমরা জানি যে ধাতুর আয়নন বিভবের মান কম, সুতরাং অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রাতেই ধাতু আয়নিত হয়ে যায় কোনো সাধারণ পরমাণু এবং তার আয়নের শোষণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য কিন্তু এক নয় যদি তারার তাপমাত্রা এতই কম হয় যে কোনো ধাতুর পরমাণু আয়নিত না হয়ে অস্তিত্ব বজায় থাকতে পারে, একমাত্র তখনই এই তারার বর্ণালীতে ধাতুর পরমাণুর শোষণের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় এভাবে সাহার কাজের ফলে এক দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হয়ে যায় আগে মনে করা হত যে বিভিন্ন তারার উপাদান হয়তো আলাদা এখন বোঝা গেল যে তা নয়, তারাদের বর্ণালীর পার্থক্য হয় মূলত তাদের তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য
      সাহা সমীকরণ আমাদের নক্ষত্রের ভিতরে বিভিন্ন অংশে চাপ ও তাপ নির্ণয় করার সুযোগ করে দিল। শুধু তাই নয়, এই সমীকরণ থেকেই আমরা নক্ষত্ররা কী কী মৌলিক পদার্থও দিয়ে তৈরি তা বার করতে পারি। আমরা দেখেছি যে সমীকরণ থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে সমস্ত নক্ষত্রের উপাদানই এক। কোন মৌল কত পরিমাণে আছে, তা জানার জন্য এর আগে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। যেমন এক পদ্ধতিতে ধরা হয়েছিল যে মৌলের শোষণ রেখার তীব্রতা যত বেশি, তার পরিমাণও তত বেশি হেনরি নরিস রাসেল দেখলেন যে পৃথিবীর উপরিভাগে ভূত্বকে যে ছটি মৌল সবচেয়ে বেশি আছে, সৌর বর্ণালীতে তাদের তীব্রতার মান খুব বেশি তাই একটা ধারণা জন্মেছিল যে সূর্য ও পৃথিবী আসলে একই উপাদান দিয়ে তৈরি রাসেলেরও আগে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনরি রোল্যান্ড বলেছিলেন যে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি সূর্যের মতো হত, তাহলে তার বর্ণালীও সূর্যের মতোই হত
      আমরা দেখে নিই এই ছটি মৌল কী কী ভূত্বকে অক্সিজেন আছে ৪৬.১ শতাংশ, সিলিকন আছে ২৮.২ শতাংশ, অ্যালুমিনিয়াম ৮.২ শতাংশ, লোহা ৫.৬ শতাংশ, ক্যালসিয়াম ৪.১ শতাংশ ও সোডিয়াম আছে ২.৪ শতাংশ। সূর্যের বর্ণালী বিশ্লেষণ করে যে ঠিক এই সংখ্যাগুলোই পাওয়া যাচ্ছিল তা নয়, কিন্তু তাদের মধ্যে মিল ছিল। সাহার সমীকরণ কিন্তু অন্য কথা বলছিল, আর সে কথা বুঝতে পেরেছিলেন এক তরুণী বিজ্ঞানী সিসিলিয়া পেইন।
      সাহার সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছিল যে নক্ষত্রের ভিতর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। অথচ পৃথিবীতে হাইড্রোজেনের পরিমাণ খুব কম, হিলিয়াম নেই বললেই চলে। মেঘনাদ সমেত প্রায় কোনো বিজ্ঞানীই তাই বিশ্বাস করতে পারেন নি, ভেবেছিলেন যে কোনো কারণে হয়তো এই দুটি গ্যাসের জন্য সাহা সমীকরণ কাজ করে না। সিসিলিয়া পেইন ছিলে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের ছাত্রী, তিনি হেনরি রাসেলের সঙ্গেও কাজ করছিলেন। তিনিই প্রথম জোর দিয়ে বলেন যে সাহা সমীকরণ ঠিক, সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের মূল উপাদান হল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। এ ব্যাপারে তিনি এডিংটন ও রাসেল দুজনের সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পেইনই ঠিক, সূর্যের মোট ভরের আটানব্বই শতাংশই হল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। শুধু সূর্য কেন, আধুনিক কালে আমরা জানি যে মহাবিশ্বের মধ্যে সাধারণ যে সমস্ত পদার্থ আছে, তারও প্রায় ৭৪ শতাংশ হল হাইড্রোজেন ও প্রায় ২৪ শতাংশ হিলিয়াম। বাকি সমস্ত মৌলের পরিমাণ মাত্র দুই শতাংশ
      হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরিমাপের গুরুত্ব জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে খুব বেশি। প্রথমত সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের অভ্যন্তরে  নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়ায় চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস মিলে তৈরি করে একটি হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসএই প্রক্রিয়ায় যে শক্তি উৎপন্ন হয় তাই হল নক্ষত্র থেকে যে তাপ বা আলো বেরোয় তার উৎস। নক্ষত্রের মূল উপাদান যে হাইড্রোজেন তা না জানলে আমরা কোনোদিনই নক্ষত্রদের শক্তি আসে কোথা থেকে তা বুঝতে পারতাম না। তেমনি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময় হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হয়েছিল। সেই সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব আমরা বিশ্বে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অনুপাত থেকে বুঝতে পারি। এ সবই অবশ্য সাহার গবেষণার অনেক পরের ঘটনা।
      তাই সাহার এই গবেষণা তাই জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে যুগান্তর ঘটিয়েছিল বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না দেড় দশক পরে ১৯৩৬ সালে Oxford University Press থেকে প্রকাশিত Theoretical Astrophysics গ্রন্থে লেখক রোসল্যান্ড লিখছেন, ‘…. It was the Indian Physicist Meghnad Saha who (1920) first attempted to develop a consistent theory of the spectral sequence of the stars from the point of view of atomic theory. …..From that time dates the hope that a thorough analysis of stellar spectra will afford complete information about the state of the stellar atmospheres, not only as regards the chemical composition, but also as regards the temperature and various deviations from a state of thermal equilibrium, the density distribution of the various elements, the value of gravity in the atmosphere and its state of motion. The impetus given to Astrophysics by Saha’s work can scarcely be overestimated, as nearly all later progress in this field has been influenced by it and much of the subsequent work has the character of refinements of Saha’s ideas.’ সংক্ষেপে বলা যায় যে সাহার গবেষণাই তাদের অভ্যন্তরের ভৌত অবস্থা সম্পর্কে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়ার পথ খুলে দেয় এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাকে এক পরিমাণগত বিজ্ঞানে পরিণত করে বিখ্যাত আর্থার এডিংটনের মতে গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেরা দশটি আবিষ্কারের অন্যতম হল সাহা আয়নন সমীকরণ
      একশ বছর পরেও সাহা সমীকরণ কোথায় কোথায় আমাদের প্রয়োজন, সে বিষয়ে দু একটা কথা বলে শেষ করা যাক নক্ষত্রের মডেল করতে সাহা সমীকরণ দরকার হয় কারণ সেখানে আয়ন ও ইলেকট্রনের সংখ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সাহার সমীকরণ পরমাণুর আয়নন ছাড়া অন্য কাজেও লাগে যেমন কোনো কোনো বিক্রিয়াতে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন বা নিউট্রন যুক্ত হতে পারে, আবার একই সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রায় প্রোটন বা নিউট্রন নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়েও যেতে পারে নিউক্লিয়াসে প্রোটন বা নিউট্রনের একটা বন্ধনী শক্তি আছে যা পরমাণুর আয়নন বিভবের সঙ্গে তুলনীয় এই দুই বিপরীত প্রক্রিয়া যদি তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকে তাহলে সাহা সমীকরণ ব্যবহার করা হয় এ ধরণের বিক্রিয়া ঘটে মহাকাশে এক্স রে বার্স্টার বা সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় বিশেষ করে সুপারনোভা বিস্ফোরণ লোহার থেকে ভারি মৌল সৃষ্টির অন্যতম উৎস বলে আমরা মনে করি।
      বিগ ব্যাঙের পরে মহাবিশ্বের বিবর্তন বুঝতে বিভিন্ন স্তরে সাহা সমীকরণ প্রয়োগ করতে হয়। যেমন আদিতে তাপমাত্রা ও ঘনত্ব ছিল খুব বেশি, তখন নিউট্রিনো ও ইলেকট্রনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিউট্রন ও প্রোটন পরস্পরের মধ্যে পরিবর্তিত হচ্ছিলমহাবিশ্ব যত প্রসারিত হচ্ছিল, তত শীতল হচ্ছিল। তাপমাত্রা একটু কমলে প্রোটন ও নিউট্রন মিলে তৈরি করে ভারি হাইড্রোজেনের পরমাণু। এই দুই ঘটনাকেই আমরা আয়ননের অনুরূপ ভাবতে পারি। আবার বিগ ব্যাঙের পরে দীর্ঘ সময় তাপমাত্রা ছিল পরমাণুর অস্তিত্বের পক্ষে বেশি। একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করে। উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণু আবার ভেঙেও যেতে পারে।  ফলে এই সময়েও হাইড্রোজেন পরমাণু এবং প্রোটন-ইলেকট্রন তাপীয় সাম্যাবস্থায় ছিল। তাই সাহা সমীকরণ এখানেও প্রযোজ্য। 
      মেঘনাদ সাহা তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ আবিষ্কার করেছিলেন কলকাতাতে বসে, সে বিষয় গবেষণাপত্রগুলিও তিনি ভারত থেকেই প্রকাশের জন্য প্রথম পাঠান। কিন্তু সেগুলি যখন প্রকাশিত হয়, তখন সাহা ফাউলারের গবেষণাগারে কাজ করেছিলেনতাই বহুদিন পাশ্চাত্যে ধারণা ছিল যে সাহা ফাউলারের অধীনে কাজ করেই তাঁর তাপ আয়নন সমীকরণ আবিষ্কার করেন সাহার কাজের মূল অংশ কিন্তু কলকাতায় বসে করা, পরে ফাউলারের গবেষণাগার থেকে অনেক নতুন তথ্য পাওয়ার ফলে তিনি তাঁর সমীকরণের পক্ষে আরো বেশি প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন অনেক অসুবিধার মধ্যে প্রায় কোনো পরিকাঠামো ছাড়াই তিনি সর্বোচ্চ মানের গবেষণা করেছেন শুধুমাত্র নক্ষত্র নয়, মহাবিশ্বের বিবর্তনের ইতিহাস জানতে প্রয়োজন সাহা সমীকরণ। আবিষ্কারের একশো বছর পরেও তা সমান প্রাসঙ্গিক।

প্রকাশঃ মুক্তমন পত্রিকা, সেপ্টেম্বর ২০১৮, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা
     




       
     

Wednesday 7 November 2018

কলকাতায় সি ভি রামন


লকাতায় সি ভি রামন


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

        সন্ধ্যাবেলা বৌবাজার স্ট্রিট আর কলেজ স্ট্রিট জংশনে ট্রাম থেকে নেমে এলেন এক দীর্ঘদেহী দক্ষিণ ভারতীয় তরুণসকালে তিনি অফিস যাওয়ার সময় ট্রাম থেকে দেখেছিলেন একটা প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। অল্পদিন তিনি কলকাতায় এসেছেন, তাঁর স্কট লেনের ভাড়াবাড়ির থেকে বেশি দূরে নয় জায়গাটা। ২১০ নম্বর বৌবাজার (বর্তমানে বিপিন বিহারী গাঙ্গুলী) স্ট্রিটের বাড়িটার দরজা তাঁর জন্য খুলে দিলেন আশুবাবু, আশুতোষ দে। তাঁকে নিয়ে গেলেন অমৃতলাল সরকারের কাছে। আগন্তুক কোনো রকম ভূমিকা না করেই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাইরে লেখা আছে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সকিন্তু ভিতরে তো কাউকে কাজ করতে দেখলাম না। এখানে কী হয়?’
        সালটা ছিল ১৯০৭। এভাবেই চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের যোগাযোগের সূচনা, যে যোগাযোগ বজায় থাকবে সাতাশ বছর। ১৮৭৬ সালে অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। ভারতীয়দের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার উদ্দেশ্য নিয়ে শুরু হলেও অর্থাভাবে সে কাজ বিশেষ এগোয়নি। শুধুমাত্র বিজ্ঞান বিষয়ক কিছু বক্তৃতার মধ্যে তা সীমাবদ্ধ ছিল। সেই হতাশা নিয়েই মহেন্দ্রলাল মারা যান ১৯০৪ সালেতার তিন বছর পরে তাঁর ছেলে অমৃতলাল রামনকে অ্যাসোসিয়েশনের ল্যাবরেটরি ব্যবহারের সাদর অনুমতি দিলেন। আরো একুশ বছর পরে রামন মহেন্দ্রলালের স্বপ্নকে পূরণ করবেন। কলকাতা বাসের এই সময়টাকে রামন মনে করতেন তাঁর জীবনের স্বর্ণযুগ।
        রমানাথন চন্দ্রশেখরন আয়ার ও পার্বতী আম্মালের দ্বিতীয় পুত্র চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন বা সি ভি রামনের জন্ম ১৮৮৮ সালের ৭ নভেম্বর। ১৮৯২ সালে চন্দ্রশেখরন বিশাখাপত্তনমে এক কলেজে বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করেন। সেখানেই রামনের শিক্ষাজীবনের শুরু। মাত্র এগারো বছর বয়সে ম্যাট্রিক পাস করলেন রামন। বাবার কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। মাদ্রাজে সে সময় বিজ্ঞানেও বি এ ডিগ্রিই দেওয়া হত। রামন ছিলেন কলেজের সর্বকালের কনিষ্ঠতম ছাত্র। ১৯০৪ সালে বিএ এবং ১৯০৭ সালে পদার্থবিজ্ঞানে এমএ, দুটি পরীক্ষাতেই প্রথম। ইতিমধ্যে রামন ছাপিয়ে ফেলেছেন তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র। আলোকবিজ্ঞানের উপরে তাঁর সেই কাজ প্রকাশিত হল লন্ডনের ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিনে, রামনের বয়স তখনো আঠারো হয়নি। পরীক্ষা দিলেন সরকারের ফিনান্সিয়াল সিভিল সার্ভিসে। এবারেও প্রথম। এই সময়েই রামনের বিয়েদক্ষিণভারতীয় ব্রাহ্মণ সামাজিক রীতি নানাভাবে ভেঙেছিলেন রামন। নিজে পছন্দ করেছিলেন তাঁর স্ত্রী লোকসুন্দরী আম্মালকে। ব্রাহ্মণ হলেও লোকসুন্দরীরা ছিলেন অন্য গোষ্ঠীরসর্বোপরি কোনো রকম পণ নিতে অস্বীকার করেছিলেন রামন।
        ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে রামনের প্রথম চাকরিস্থল হল ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা কয়েক বছর পরেই কলকাতা থেকে রাজধানী দিল্লীতে স্থানান্তরিত হবে সেই সময় রামন যদি কাজ শুরু করতেন, তাহলে তাঁর প্রথম পোস্টিং কলকাতাতে হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল ভারতে আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মস্থান কলকাতা; রামনের সঙ্গে সেই শহরের যোগাযোগ রামন এবং ভারতের বিজ্ঞান দুপক্ষেরই প্রয়োজন ছিল
        গবেষণা শুরু করলেন রামন সোমবার থেকে শনিবার প্রতিদিন নিয়ম করে সকাল সাড়ে পাঁচটায় তিনি অ্যাসোসিয়েশনে যেতেন পৌনে দশটায় বাড়ি ফিরতেন, কোনোরকমে চান খাওয়া সেরে ট্যাক্সি ধরে অফিস অফিস থেকে পাঁচটায় বেরিয়ে সোজা অ্যাসোসিয়েশন রাত সাড়ে নটা থেকে দশটায় বাড়ি রবিবার সারা দিন অ্যাসোসিয়েশন গবেষণার সঙ্গী সহকারী শুধুমাত্র আশুবাবু। গবেষণা শুরু করেছিলেন স্বনবিদ্যা বা শব্দবিজ্ঞান বিষয়ে রামনের পরিবারে সঙ্গীতের চল ছিল, তাঁর বাবা বেহালা বাজাতেন ভারতীয় বাদ্যযন্ত্রের উপর রামন অত্যন্ত মৌলিক কাজ করেছিলেন। রামনের উৎসাহে এমনকি কোনোদিন কলেজের চৌকাঠ না পেরোনো আশুবাবুও একা গবেষণাপত্র ছাপিয়েছিলেন ব্রিটেনের প্রসিডিংস অফ দি রয়্যাল সোসাইটিতে।
২১০ বৌবাজার স্ট্রিটের সেই বাড়ি

দেখতে দেখতে চলে গেল প্রায় সাত বছর। ইতিমধ্যে অল্পদিনের জন্য রেঙ্গুন ও নাগপুরে বদলি হয়েছিলেন, গবেষণাতে অসুবিধা হয়েছিল। তবে সেই বদলি নিতান্তই অল্পদিনের জন্য, আবার কলকাতাতে ফিরে এসেছেন। ইতিমধ্যে রামনের জীবনে আর এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এলো। সেই কথা আলোচনার আগে কলকাতায় উচ্চশিক্ষার সেযুগের পরিস্থিতি জেনে নেওয়া জরুরি।
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন ১৯০৬ সালে, তারপরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আটটি বিষয়ে এম এ পড়ানো শুরু করেছেন। এর আগে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হত না, শুধুমাত্র ডিগ্রি দেওয়া হত। কলকাতায় সে সময় এমএসসি পড়ানো হত শুধু প্রেসিডেন্সি কলেজে, ১৮৮৪ সালে তা শুরু হয়েছিল  আশুতোষের ইচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান পড়ানো গবেষণা শুরু করবেন কিন্তু বিদেশী সরকার তাঁকে এর জন্য কোনো সাহায্য করতে রাজি নয় ভারতীয়দের বিজ্ঞান শিখিয়ে বিদেশী তাদের লাভ কী?  শুধু বিজ্ঞান নয়, যে সব শিক্ষা শাসিতদের প্রশ্ন করতে শেখায়, ভাবতে শেখায় -- তা বিদেশী শাসনের পক্ষে বিপজ্জনক
 বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় ইংরাজদের স্কুলকলেজের বাইরে জাতীয় শিক্ষার জন্য অনেকেই সাহায্য করছিলেন, আশুতোষ তাঁদের কাছে গেলেনব্যারিস্টার স্যার তারকনাথ পালিত প্রায় সমস্ত সম্পত্তি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করলেন। এর পরিমাণ হল সাড়ে চোদ্দ লক্ষ টাকা ও বালিগঞ্জে তাঁর নিজের বাড়ি  অন্য এক ব্যারিস্টার, স্যার রাসবিহারী ঘোষ, দুবারে মোট সাড়ে একুশ লক্ষ টাকা দান করেছিলেন।  সেদিনের এক টাকা আজকের প্রায় পাঁচশো টাকার সমান। অর্থাৎ দুজনে মিলে আজকের হিসাবে একশো পঁচাত্তর কোটি টাকার বেশি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করেছিলেন। সেই দানেই শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান কলেজ প্রথমেই যে টি বিভাগ প্রতিষ্ঠা হল, তার মধ্যে ছিল পদার্থবিজ্ঞান। রাজাবাজারে পালিতের বাগানবাড়িতে তৈরি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজ। ঠিকানা ৯২ আপার সার্কুলার (বর্তমানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র) রোড। ২৭ মার্চ ১৯১৪ তার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন আশুতোষ। ১৯১৬ সালের ১ জুলাই পদার্থবিদ্যা বিভাগে পঠনপাঠন শুরু হয়।

আপার সার্কুলার রোডে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজ

 পালিত ও ঘোষের শর্ত ছিল তাঁদের দানের টাকায় কয়েকটি অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করতে হবে সেই মতো অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিদ্যা বিভাগে পালিত অধ্যাপক এবং ঘোষ অধ্যাপক পদ সৃষ্টি হয়। তাঁদের দানের শর্ত অনুযায়ী এই পদের অধ্যাপকদের ভারতীয় হতেই হবে। মাত্র কয়েক বছর আগে স্বামী বিবেকানন্দের প্রেরণায় জামসেদজী টাটার উৎসাহে বাঙ্গালোরে তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স। কিন্তু প্রথম দিকে সেখানে ইংল্যান্ড থেকে আসা দ্বিতীয় শ্রেণির বিজ্ঞানীরাই মূলত চাকরি পেয়েছিল, তার ফলে সেখানে গবেষণার মান ছিল খুবই নিচু। ভারতীয় অধ্যাপকরা যাতে বিশ্বমানের গবেষণা করতে পারেন, সে জন্য চাকরি পাওয়ার পরে প্রয়োজনে বিদেশের কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দু’বছর গবেষণা করার কথা দানের শর্তে ছিল। তাঁরা সেজন্য সবেতন ছুটি পেতেন। এছাড়া বিভিন্ন বিভাগে কয়েকটি গবেষক বা রিসার্চ ফেলোর পদ চালু করা হয়।
১৯১৪ সালের ২৪শে জানুয়ারি পালিত গভর্নিং বডির সভাতে পদার্থবিজ্ঞানে সি ভি রামন এবং রসায়নে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রকে পালিত অধ্যাপকের পদে নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সভাতে সদস্য ছিলেন উপাচার্য স্যার আশুতোষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পি ব্রুল, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, ডাক্তার নীলরতন সরকার, রেভারেন্ড জে ওয়াট, বিচারপতি বি কে মল্লিক এবং লর্ড সত্যপ্রসন্ন সিনহা। সেই দিনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এক সভায় এই নিয়োগে সম্মতি দেয়। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি সেনেটে কয়েকজন ইউরোপীয় সদস্য নিয়োগের পদ্ধতি নিয়ে আপত্তি তোলেন। ফলে ভোটাভুটি হয়, ভোটে আশুতোষের প্রস্তাব জেতে। আশুতোষের ইচ্ছা ছিল জগদীশচন্দ্রকে পদার্থবিজ্ঞানে অধ্যাপক পদে নিয়োগ করা, কিন্তু তিনি রাজি হননি।
একা একা আংশিক সময়ে খুব সামান্য পরিকাঠামোর মধ্যে গবেষণা করেও রামন যথেষ্ট পরিচিতি লাভ করেছিলেন, না হলে আশুতোষের চোখ তাঁর উপরে পড়ত না। তখনই রামন মোট বাইশটা গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছেন, যার মধ্যে ষোলটা বিদেশের সেরা জার্নালগুলিতে। ঠিক আগের বছর মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে গবেষণার জন্য বিশেষ পুরস্কার দিয়েছে। আশুতোষ অবশ্য অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, আগে তিনি গণিত বিষয়ে বেশ কয়েকবার সেখানে বক্তৃতা দিয়েছেন। সেই সূত্রেই রামনের নাম তাঁর কাছে অপরিচিত ছিল না। সেনেটে তাঁর নিয়োগের পক্ষে জোর সওয়াল করেছিলেন আশুতোষ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মহেন্দ্রনাথ রায়।
রামন যে চাকরি করতেন, তাঁর মাইনে বেড়ে দাঁড়াত মাসে দুহাজার টাকা পালিত অধ্যাপকের পদে পাবেন আটশো টাকা, বাড়িভাড়া বাবদ আরো দুশো টাকা শুধু তাই নয়, মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই রামনের সাফল্যে সবাই নিশ্চিত ছিলেন যে এক সময় তিনি ফিনান্সিয়াল সার্ভিসে শীর্ষস্থানে উঠবেন এবং ভাইসরয়ের কাউন্সিলের সদস্য হবেন। কোনো ভারতীয়ের পক্ষে সরকারি স্তরে তা ছিল সর্বোচ্চ সম্মান। রামন অধ্যাপক পদে যোগ দেওয়ার ব্যাপারে সামান্যও দ্বিধা করেননি, শুধু বলেছিলেন যে দেশের বাইরে দু’বছর গবেষণার শর্ত তুলে না নিলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগ দিতে পারবেন না। তাছাড়া তিনি জানতে চেয়েছিলেন যে পড়ানো তাঁর পক্ষে বাধ্যতামূলক কিনাবিশ্ববিদ্যালয় জানায় যে তাঁর জন্য বিদেশে গবেষণা বা ক্লাস নেওয়া বাধ্যতামূলক নয়। সরকারি চাকরি ছেড়ে আসার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতি লেগেছিল, তা পাওয়ার পরে ১৯১৭ সালের ২ জুলাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। চিঠিতে যাই লিখুন, রামন প্রথম থেকেই ইলেকট্রন তত্ত্বের উপর ক্লাস নিয়েছিলেন। তবে সবসময়ই তাঁর গবেষণার প্রধান জায়গা ছিল অ্যাসোসিয়েশন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পরে রামন পুরোপুরি গবেষণাতে মন দিতে পারলেন। অবশ্য ভারতবর্ষের নানা জায়গায় পড়ানো, বিদেশে কনফারেন্সে যোগদান ও ল্যাবরেটরি পরিদর্শন, বিভিন্ন সরকারি কমিটিতে অংশগ্রহণ ছাড়াও বিভাগীয় প্রধান হিসাবে তাঁকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হত। ১৯৩৩ সালের ১ এপ্রিল রামন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যান। তিনি বাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের ডাইরেক্টর হিসাবে যোগ দেন। মাঝের ষোল বছর তিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রামনের জীবন একেবারে মসৃণ ছিল তা নয়। অর্থবরাদ্দের সীমাবদ্ধতার জন্য সকল অধ্যাপকের গবেষণাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। সে সময় পদার্থবিদ্যা বিভাগে একই সঙ্গে তিন নক্ষত্র বিরাজ করতেন। রামন বিভাগে যোগদান করার আগে থেকেই সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা দুজনেই ছিলেন পালিত অধ্যাপকের সহকারী। তবে তাঁরা কখনোই রামনের সঙ্গে কোনো গবেষণা করেন নি, রামনও কোনোদিন তাঁদের এই নিয়ে কিছু বলেন নি। সত্যেন্দ্রনাথ ১৯২১ সালে ঢাকা চলে যান, তিনি যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন তার অনেক আগেই রামন কলকাতা ছেড়েছেন। রামনের সঙ্গে সত্যেন্দ্রনাথের বিশেষ কোনো মনোমালিন্য ছিল না। বয়সে তরুণ হলেও মেঘনাদ তাঁর সাহা সমীকরণের জন্য রামনের আগেই বিশ্বখ্যাতি লাভ করেন। ১৯২১ সালে তিনি পদার্থবিদ্যা বিভাগে খয়রা অধ্যাপক পদে যোগ দেন। বিশেষ করে গবেষণার সুযোগসুবিধা নিয়ে তাঁর সঙ্গে রামনের বারবার বিরোধ বেঁধেছিল। সেই বিবাদে আশুতোষকে বা তৎকালীন উপাচার্যকে মধ্যস্থতা করতে হয়েছিল। তামিল ব্রাহ্মণ রামনের হিমালয়প্রমাণ অহং এবং সমাজের নিচুস্তর থেকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় উঠে আসা মেঘনাদের স্বাভিমানকে মেলানোর কোনো জায়গা খুঁজে পাওয়া সহজ ছিল না। শেষ পর্যন্ত গবেষণার সুযোগের অভাবে মেঘনাদ ১৯২৩ সালে কলকাতা ছেড়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। রামন কলকাতা ছাড়ার কয়েক বছর পরে তিনি ফিরে আসেন।
রামন প্রধানত আলো ও শব্দ বিষয়ে গবেষণা করতেন। সারা দেশ থেকে তাঁর কাছে বহু ছাত্র গবেষণার জন্য আসত। তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিশিরকুমার মিত্র, বিধুভূষণ রায়, ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ,‌ ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুকুমারচন্দ্র সরকার তাঁর অন্য ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন কে আর রমানাথন, কে এস কৃষ্ণন, এল এ রামদাস প্রমুখ। রমানাথন আমেদাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রথম অধিকর্তা হয়েছিলেন। কৃষ্ণন হয়েছিলেন দিল্লীর ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির প্রথম অধিকর্তা বেশ কয়েকবার ইউরোপ ও আমেরিকাতে যান রামন, রামন এফেক্ট আবিষ্কারের আগেই তিনি সেখানকার বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ সমাদর লাভ করেছিলেন। বিদেশ থেকে বিজ্ঞানীরা ভারতে এলে তাঁর সঙ্গে অবশ্যই দেখা করতেন।
বিজ্ঞান কলেজে রক্ষিত রামনের পিয়ানো

রামনের গবেষণার পরিচয় দেয়া এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, আমরা শুধু রামন এফেক্ট বা রামন ক্রিয়া আবিষ্কারের ইতিহাসের কথা সংক্ষেপে দেখব। কাল্টিভেশনের ল্যাবরেটরিতে তিনি তাঁর নামাঙ্কিত এফেক্টকে চিহ্নিত করেছিলেন। এ কাজে তাঁকে সহায়তা করেছিলেন কে এস কৃষ্ণন। ১৯২১ সালে প্রথমবার ইউরোপ যাত্রা করেন রামন। ফেরার সময় জাহাজ থেকে সমুদ্রের জল দেখে তাঁর মনে প্রশ্ন জাগে সমুদ্র নীল কেন? আকাশের রঙ কেন নীল তার কারণ বায়ুমণ্ডল কর্তৃক আলোর বিচ্ছুরণ  দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলেন লর্ড র‍্যালে। তিনি বলেছিলেন যে সমুদ্রের রঙ আসলে আকাশের রঙের প্রতিফলন। নানাভাবে রামন নিশ্চিত হলেন তা নয়তিনি দেখালেন যে সমুদ্রের জল নিজেই আলোকে বিচ্ছুরণ করে বলেই সমুদ্রের জলের রঙ নীল। এর পর থেকে তিনি আলোর বিচ্ছুরণ নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েন।
দু বছর পরে রামন ও তাঁর ছাত্র রমানাথন জল ও অ্যালকোহল কর্তৃক আলোর বিচ্ছুরণ সংক্রান্ত পরীক্ষানিরীক্ষার সময় এক নতুন রঙের আলোর খুব ক্ষীণ চিহ্ন দেখতে পান। এর উৎস তাঁরা বুঝতে পারেন নি, ভেবেছিলেন যে তাঁদের ব্যবহৃত স্যাম্পল হয়তো যথেষ্ট বিশুদ্ধ নয়প্রসঙ্গত বলে রাখি যে আলো হল তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ, বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। ১৯২৫ সালে কৃষ্ণনও একই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন। ১৯২৭ সালে অপর এক ছাত্র ভেঙ্কটেশ্বরন দেখেন যে গ্লিসারিন কর্তৃক বিচ্ছুরিত সূর্যের আলোর রঙ হওয়া উচিত ছিল নীল, কিন্তু তা হয়েছে সবুজ। রামন বুঝতে পারেন যে তিনি এক বিরাট আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি এসে গেছেন। কৃষ্ণনকে তিনি পরীক্ষা শুরু করতে নির্দেশ দেন। সেটা ছিল ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। ২৮ ফেব্রুয়ারি বোঝা গেল যে বিচ্ছুরিত আলোতে এক নতুন রঙের আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। আবিষ্কৃত হল রামন এফেক্ট। পাঁচ বছর আগে অস্ট্রিয়ান বিজ্ঞানী অ্যাডলফ স্মেকাল তাত্ত্বিকভাবে এই নতুন রঙের আলোর কথা ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। কোয়ান্টম তত্ত্ব থেকে রামন এফেক্টকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু সেই সময় এই ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করা মোটেই সহজ ছিল না। রামন এফেক্ট এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আবিষ্কারের দু বছরের মধ্যেই তার উপর দুশোর বেশি গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছিল।
রামন ও রামন এফেক্ট আবিষ্কারে ব্যবহৃত বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র

রামন প্রথম থেকেই তাঁর আবিষ্কারের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি পরের দিনই অর্থাৎ ২৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতার স্টেটসম্যান খবরের কাগজে এই আবিষ্কারের খবর প্রকাশের ব্যবস্থা করেন ৮ মার্চ রামন নেচার পত্রিকায় তাঁর আবিষ্কারের বিষয়ে এককভাবে গবেষণা পত্র পাঠান। ৩১ মার্চ তা প্রকাশিত হয়। তিনি বিদেশী বিজ্ঞানীদের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ করেছিলেন। সুইডেনের নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী মানে সিগবান এবং জার্মান বিজ্ঞানী আর্নল্ড সমারফেল্ড তাঁর গবেষণার প্রশংসা করে চিঠি দিয়েছিলেন। রামনের এই দ্রুততার প্রয়োজন ছিল, কারণ মে মাসেই দুই সোভিয়েত বিজ্ঞানী মেন্ডেলশাম ও ল্যান্ডসবার্গ এই বিষয়ে তাদের গবেষণা প্রকাশ করেন। তাঁরা এমনকি রামনের আগেই এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাতে অবশ্য রামনের কৃতিত্ব বিন্দুমাত্র খাটো হয় না। রামন তাঁদের গবেষণার বিষয় জানতেন না। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা যদি তাঁদের কাজের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকতেন ও তাঁদের পরীক্ষার ফল বিষয়ে নিশ্চিত হতেন, তাহলে তাঁরা নিশ্চয় আরো আগেই গবেষণাপত্র প্রকাশ করতেন। রামনকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করার সময় নোবেল কমিটি এই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন, কাজেই রামনই যে পুরস্কারের যোগ্য প্রাপক তা নিয়ে সন্দেহ নেই।
২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ স্টেটসম্যান পত্রিকাতে প্রকাশিত সংবাদ

রামন এফেক্ট ব্যবহার করলে বিশ্লেষণের সময় নমুনার কোনো ক্ষতি হয় না। তাই রাসয়ানিক বা গঠন বিশ্লেষণের সময় রামন এফেক্টের কার্যকারিতা দিন দিন বেড়েই চলেছে।  লেজার আবিষ্কারের পরে লেজার রামন বিশ্লেষণ আরো নানা জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে।  রসায়ন শিল্পে, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে, ভূতত্ত্বে, ঔষধ শিল্পে। জীববিদ্যা, ইলেকট্রনিক্স – কত জায়গায় যে রামন এফেক্ট কাজে লাগছে তা লিখে শেষ করা যাবে না।
১৯৩০ সালে রামন নোবেল পুরস্কার পান, এশিয়ার প্রথম বিজ্ঞানী যিনি এই সম্মান লাভ করেছিলেন। পুরস্কারের প্রস্তাবক ছিলেন দশজন বিজ্ঞানীতাঁদের মধ্যে ছিলে ছ’জন নোবেলজয়ী -- নিলস বোর, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড, লুই দ ব্রয়লি, জোহানেস স্টার্ক, চার্লস উইলসন ও জাঁ পেরিন। রামন নোবেল পুরস্কার নিতে রওনা হন ১৯৩০ সালের ২১শে নভেম্বর, সেদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করেছিল 
২১০ নম্বর বৌবাজার স্ট্রিটের বাড়িটা আর নেই, সেখানে তৈরি হয়েছে গোয়েঙ্কা কলেজ। কাল্টিভেশন স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেছে যাদবপুরে। তা এখন কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। বাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের অধিকর্তা হওয়ার ডাক পেয়ে রামন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়  ছেড়েছিলেন নিজের ইচ্ছায়, কিন্তু অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিচ্ছেদ খুব সুখের হয়নি। সেই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে এই লেখা অনেক দীর্ঘ হয়ে পড়বে। শুধুমাত্র এটুকু বলাই যথেষ্ট যে সেই ইতিহাস রামন বা কলকাতার শিক্ষামহলের তৎকালীন নেতৃত্ব, কারোর পক্ষেই গৌরবের নয়।  আরো ছত্রিশ বছর বাঁচলেও একবার কলকাতা ছাড়ার পরে রামন আর কোনোদিন কলকাতায় পদার্পণ করেননি।
        
প্রকাশঃ সাংস্কৃতিক চিন্তাভাবনা পত্রিকার শারদীয় সংখ্যা, ১৪২৫, পরিমার্জিত