Saturday 22 June 2019

বিজ্ঞান গবেষণা ও মেঘনাদ সাহা


বিজ্ঞান গবেষণা মেঘনাদ সাহা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       পদার্থবিদ্যার ইতিহাস বহু প্রাচীন হলেও ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশক থেকে শুরু পরের তিন দশকে বিজ্ঞানের এই শাখায় যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছিল, তার তুলনা বিজ্ঞানের ইতিহাসে পাওয়া যাবে না। পারে। টমসনের ইলেকট্রন আবিষ্কার দেখিয়েছিল পরমাণুর যে শুধু অস্তিত্ব আছে তা নয়, তাকে ভাঙাও যায়। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা ও সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের বহুদিনের ধ্যানধারণার মূলে কুঠারাঘাত করে। আইনস্টাইনের এই তত্ত্ব দুটির তাৎপর্য গভীর হলেও তাদের আমরা ক্লাসিকাল বা চিরায়ত পদার্থবিদ্যার আওতাতেই ফেলব। বিজ্ঞানে আরো সুদূর প্রসারী পরিবর্তন এনে দেবে কোয়ান্টাম তত্ত্ব। প্লাঙ্ক, আইনস্টাইন ও বোরের এই সংক্রান্ত গবেষণা থেকে দেখা যায় যে পদার্থের মতো শক্তিরও একটা ক্ষুদ্রতম একক থাকতে পারে। অবশেষে কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এই অধ্যায়ের যবনিকাপাত ঘটবে। বিজ্ঞানের এই বিপ্লব মূলত ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল। বিশেষ করে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীন ভারতবর্ষে সেই বিপ্লবের কোনো ঢেউ এসে পড়েনি। ভারতের প্রথম আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানী আচার্য জগদীশচন্দ্র মূলত ঊনবিংশ শতাব্দীর পদার্থবিজ্ঞানকেই নির্ভর করে গবেষণা করেছিলেন। সি ভি রমনের গবেষণাতেও সরাসরি এই নতুন পদার্থবিজ্ঞানের কোনো ছাপ পড়েনি।
       ১৮৯৭ সালের ইলেকট্রন আবিষ্কারকে পদার্থবিদ্যার নতুন যুগের সূচনা বলে অনেকে মনে করেন। আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশিত হয় ১৯০৫ সালে, সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯১৫ সালে। প্লাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রকাশকাল ১৯০০ সাল। ১৯০৫ সালে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আইনস্টাইনের আলোর কণার কল্পনা করেন। ১৯১১ সালে নিলস বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম মডেল প্রস্তাব করেন। কোয়ান্টাম তত্ত্বের চার মূল স্তম্ভের মধ্যে পড়বে এই তিনটি কাজ। ১৯১৬ সালে দুই তরুণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়ানো ও গবেষণা শুরু করবেন। তাঁরা হলেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। নব আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম তত্ত্বকে অবলম্বন করে কয়েক বছরের মধ্যে দুজনই বিজ্ঞানের জগতে নিজেদের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রাখবেন। সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণা পৃথক প্রবন্ধের বিষয়বস্তু, এই নিবন্ধে আমরা মেঘনাদ সাহার গবেষণার দিকে দৃষ্টি রাখব।
       মেঘনাদের সারা জীবনটাই এক সংগ্রামের ইতিহাস। তাঁর জন্ম হয়েছিল ঢাকার কাছে শেওড়াতলি গ্রামে ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবরহিন্দুসমাজে জাতপাতের হিসাবে তাঁরা ছিলেন তথাকথিত নিচু জাতের। মেঘনাদের বাবা জগন্নাথের ছিল একটা ছোটো মুদির দোকান। অত্যন্ত দরিদ্র পরিবার,  ছেলেকে প্রাইমারি স্কুলের পরে পড়ানোর ক্ষমতা জগন্নাথের ছিল না, গ্রামে তার কোনো সুযোগও ছিলও না। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি পাস করার পরে দূরের গ্রামে এক ডাক্তারের বাড়িতে মেঘনাদ পড়াশোনার জন্য থাকতেন, বিনিময়ে তাদের বাড়ির গরু দেখাশোনার কাজ করতে হত। ভালো রেজাল্ট করার জন্য স্কলারশিপ নিয়ে ঢাকার স্কুলে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু ছোটলাট যেদিন স্কুলে আসবেন সেদিন খালি পায়ে আসার জন্য তাঁকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। নেই। অন্য একটি স্কুলে তাঁর জায়গা হয় তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফিয়ের জন্য তাঁর মা ভুবনেশ্বরীকে হাতের বালা বিক্রি করতে হয়েছিল। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েটে সারা পূর্ববঙ্গের মধ্যে প্রথম হয়েছিলেন। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেনসেখানে সহপাঠী পেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। তাঁরা দুজনেরই বিষয় ছিল গণিত। বিএসসি ও এমএসসিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলেন মেঘনাদ, প্রথম সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯১৬ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয় পদার্থবিদ্যাতে বিভাগ, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আদেশে সেখানে পড়ানো ও গবেষণা শুরু করেন দুই বন্ধু স্বল্পকাল বিদেশে কাটানোর পরে ১৯২৩ সালে কলকাতা ছাড়েন মেঘনাদ। পনের বছর এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন, আবার ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ১৯৫৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।


       মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ দুজনেই গণিতের ছাত্র, ক্লাসঘরে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষার সুযোগ তাঁদের হয়নি। পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণার নাগাল পাওয়ার জন্য তাঁদের জার্মান ভাষাটাও আয়ত্ত করতে হয়েছিল। জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা বিষয়ে অ্যাগনেস ক্লার্কের লেখা ইংরাজি বইগুলি মেঘনাদ পড়েছিলেন, আমরা দেখব সেগুলি তাঁর গবেষণার দিক বেছে নিতে সাহায্য করেছিল। কাজ শুরুর চার বছরের মধ্যেই মেঘনাদ আবিষ্কার করেছিলেন তাঁর সেই বিখ্যাত সমীকরণ, তখন তাঁর বয়স মাত্র ছাব্বিশ বছর।  মনে রাখতে হবে, বিদেশের তুলনায় ভারতে গবেষণার সুযোগ ছিল খুবই সীমিত। তার উপর আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান সি ভি রমনের সঙ্গে তাঁর কোনোদিনই সম্পর্ক ভালো ছিল না, তাই পরীক্ষাগার ব্যবহারের সুযোগ কলকাতায় মেঘনাদ বিশেষ পান নি। এলাহাবাদেও গবেষণার পরিকাঠামো ছিল খুবই অনুন্নত। এই সমস্ত অসুবিধার মধ্যেই মেঘনাদ সর্বোচ্চ মানের কাজ করে গেছেন।
       মেঘনাদ সাহা সারা জীবনে নানা বিষয়ে গবেষণা করেছিলেন। সমস্ত কাজ আমাদের এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আসার সুযোগ নেই। কালানুক্রম অনুসরণ করার পরিবর্তে আমরা তাঁর বিজ্ঞান গবেষণাকে আমরা কয়েকটা বিশেষ ক্ষেত্রে ভেঙে আলোচনা করব তাঁর কাজ কেমনভাবে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছে, সে দিকেও আমরা চোখ রাখব। গবেষণা শুরু করার সময় তাঁকে দেখিয়ে দেওয়ার বা সাহায্য করার কেউ ছিল না। সেই সময় নানা দিকে নানা রকম চেষ্টা তিনি করছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ একসঙ্গে গ্যাসের অবস্থা বিষয়ে একটি নতুন সমীকরণ তৈরি করেছিলেন। মেঘনাদের প্রথম গবেষণা পত্র প্রকাশিত হয়েছিল ইংল্যান্ডের ফিলজফিকাল ম্যাগাজিনে ১৯১৭ সালে; বিষয় ছিল তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্রের স্ট্রেস বা পীড়ন। একই বছরে তিনি ফেব্রি-পেরো ইন্টারফেরোমিটার নিয়েও গবেষণা পত্র ছাপিয়েছিলেন। আমরা দেখব যে এই দুই আপাতবিচ্ছিন্ন বিষয়ে মেঘনাদের গবেষণা আসলে একই সূত্রে গাঁথা। পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর প্রধান গবেষণার ক্ষেত্র ছিল জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা (Astrophysics), নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা (Nuclear Physics), ও বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশবিজ্ঞান (Atmoshpheric and Space Physics)বিভিন্ন সময়ে নানারকম গবেষণা এই তিনটে ক্ষেত্রেই তিনি করেছিলেন, তাদের মধ্যে প্রধান কয়েকটার আলোচনাই এই প্রবন্ধে সম্ভব।

নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান

       প্রথমেই আমরা মেঘনাদ সাহার নিউক্লিয় বিজ্ঞানে গবেষণার কথা আলোচনা করি। মেঘনাদের সময় নিউক্লিয় বিজ্ঞানের অবস্থা সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক। 1911 সালে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড দেখান যে পরমাণুর কেন্দ্রে আছে অতি ক্ষুদ্র নিউক্লিয়াস না কেন্দ্রীণপরমাণুর ব্যাস হল এক মিটারের হাজার কোটি ভাগের এক ভাগের মতো, অর্থাৎ 10-10 মিটার। নিউক্লিয়াস আবার তার দশ হাজার ভাগের এক ভাগ 10-14 মিটারেরও কমতার চারপাশে রয়েছে ঋণাত্মক আধানের ইলেকট্রন। এই ক্ষুদ্র কেন্দ্রীণের মধ্যেই আছে পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর এবং সমস্ত ধনাত্মক আধান। 1917 সালে রাদারফোর্ড ও তাঁর ছাত্র মার্সডেন দেখান যে নিউক্লিয়াসের মধ্যে আছে প্রোটন কণা যার আধানের মান হল ইলেকট্রনের মানের সমান কিন্তু ধনাত্মক। আমরা এই মানকে বলি e.
       পরমাণুর নিউক্লিয়াসের ভর মেপে দেখা গেল যে প্রোটন ছাড়াও অন্য কিছু নিউক্লিয়াসে আছে। ধরা যাক সাধারণ অক্সিজেনের নিউক্লিয়াসের কথা। তার ভর ষোলটা প্রোটনের ভরের কাছাকাছি কিন্তু আধান হল 8e। প্রথমে অনুমান করা হয়েছিল যে অক্সিজেনের নিউক্লিয়াসের মধ্যে ষোলটা প্রোটন আর আটটা ইলেকট্রন আছে। ইলেকট্রনের আধান যেহেতু প্রোটনের আধানের বিপরীত, তাই অক্সিজেন নিউক্লিয়াসের মোট আধান মিলে যাবে। ইলেকট্রনের ভর প্রোটনের ভরের তুলনায় অনেক কম, তাই তার ভরটা মাপের হিসাবেই আসছে না। কিন্তু অচিরেই বোঝা গেল যে কেন্দ্রীণের মধ্যে ইলেকট্রন থাকা সম্ভব নয়। রাদারফোর্ড অনুমান করেছিলেন প্রোটনের সমান ভরের কিন্তু আধানশূন্য এক নতুন কণা নিউক্লিয়াসে আছে, তার নাম দিয়েছিলেন নিউট্রন। অক্সিজেনের নিউক্লিয়াসে থাকে আটটা করে প্রোটন ও নিউট্রন। তাঁর ছাত্র চ্যাডউইক 1932  সালে নিউট্রন কণার অস্তিত্ব পরীক্ষাগারে আবিষ্কার করেন।
       রাদারফোর্ডই দেখিয়েছিলেন যে অনেক তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে বিটা রশ্মি  বেরোয়। বিটা রশ্মি হল ইলেকট্রন। তিনি আরো দেখান যে আলফা ও বিটা তেজস্ক্রিয়াতে এক পরমাণু অন্য পরমাণুতে পরিবর্তিত হয়ে যায়।  কিন্তু নিউক্লিয়াসে যদি ইলেকট্রন না থাকে, তাহলে তা আসে কোথা থেকে? অপর এক সমস্যা হল যে বিটা ক্ষয়ে নির্গত ইলেকট্রনদের সবার গতিশক্তি সমান নয়। কোনো ভাবেই এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। বিজ্ঞানী নিলস বোর তো এক সময় বলেই ফেললেন যে বিটা ক্ষয় শক্তির সংরক্ষণ সূত্র, বা আরো বিশেষ ভাবে বললে ভর–শক্তির সংরক্ষণ সূত্র মেনে চলে না।
       ১৯৩৩ সালে মেঘনাদ ও তাঁর ছাত্র ও পরবর্তীকালে বিখ্যাত বিজ্ঞানী দৌলত সিং কোঠারি বিটা ক্ষয়ের এক নতুন তত্ত্ব দেন। তাঁরা বললেন যে প্রোটন কোনো মৌলিক কণা নয়, তাকে ভাঙ্গলে পাওয়া যায় নিউট্রন ও পজিট্রন। প্রসঙ্গত বলে রাখি পজিট্রন হল ইলেকট্রনের বিপরীত কণা বা অ্যান্টিপার্টিকল। বিজ্ঞানী পল ডিরাক তাত্ত্বিকভাবে পজিট্রনের কথা বলেছিলেন, তাকে পরীক্ষামূলকভাবে খুঁজে পান কার্ল অ্যান্ডারসন। নিউক্লিয়াসের মধ্যে আলফা কণার চলাফেরার জন্য গামা রশ্মির ফোটন কণা তৈরি হয়, তার থেকে সৃষ্টি হয় ইলেকট্রন ও পজিট্রন। পজিট্রন ও নিউট্রন মিলে তৈরি করে প্রোটন, ইলেকট্রন বিটা কণা রূপে নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসে। এই ছিল সাহা–কোঠারির বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব।
দৌলত সিং কোঠারি


       এই তত্ত্বের আয়ু বেশিদিন ছিলনা। ১৯৩০ সালেই উলফগ্যাং পাউলি বলেছিলেন যে নিউট্রন ভেঙে তৈরি হয় প্রোটন, ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো নামের তড়িৎআধানহীন অতি ক্ষুদ্র ভরের এক কণা। এই নতুন কণাটা কিছুটা শক্তি নিয়ে চলে যায়, সেটা পরীক্ষাগারে ধরা পরে না বলে ভর-শক্তির সংরক্ষণ সূত্র মিলছে না। তবে মনে রাখতে হবে যে পাউলি এই প্রস্তাব কোনো গবেষণা পত্রিকাতে প্রকাশ করেননি, ইউরোপের এক কনফারেন্সে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের সঙ্গে ইউরোপের বিজ্ঞানীমহলের যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ, এলাহাবাদ আবার কলকাতার তুলনায় আরো দূরবর্তী। মেঘনাদরা এলাহাবাদে বসে সম্ভবত পাউলির সেই চিঠির খবর পাননি। নিউট্রিনোকে হিসাবে রেখে বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব প্রকাশ করেন এনরিকো ফার্মি ১৯৩৪ সালে, নিউট্রিনো প্রথম আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়ে ১৯৫৬ সালে। কাজেই সাহারা যখন গবেষণা করছিলেন, তখনও বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি।
       এই গবেষণার কয়েকটা দিক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমত সাহা ও কোঠারি এমন সমস্যাতে হাত দিয়েছিলেন যা বিজ্ঞানে একেবারে প্রথম সারিতে ছিল।  সাধারণ গবেষণাতে তাঁরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। দ্বিতীয়ত তাঁরা বললেন প্রোটন মৌলিক কণা নয়, তাকেও ভাঙা সম্ভব। সম্ভবত তাঁরাই এই কথা প্রথম বলেছিলেন। তিন দশক পরে বোঝা যাবে প্রোটন ও নিউট্রন আসলে মৌলিক কণা নয়, তারা তিনটি করে কোয়ার্ক কণা দিয়ে তৈরি। তার সঙ্গে অবশ্য মেঘনাদদের তত্ত্বের কোনো সম্পর্ক নেই।
       সাহা সেই সময় নিউট্রন বিষয়ে আর এক নতুন তত্ত্ব দিয়েছিলেন।  বলেছিলেন যে নিউট্রন হল আসলে দুটি বিপরীত চৌম্বক একমেরু কণার সমষ্টি। আমাদের জানা সমস্ত চুম্বকের উত্তর ও দক্ষিণ দুটি মেরু থাকে। তড়িতাধান কিন্তু ধনাত্মক ও ঋণাত্মক দুই রকমই হতে পারে। চৌম্বক একমেরু কণা কেন পাওয়া যয় না তার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা নেই, আজও তার খোঁজ চলছে। এই কণার সন্ধান পাওয়া গেলে বিজ্ঞানের একটা বড়ো সমস্যার সমাধান হয়। পল ডিরাক দেখিয়েছিলেন যে চৌম্বক একমেরু কণার অস্তিত্ব থাকলে দেখানো যায় যে তড়িতাধান কেন কখনো e-এর ভগ্নাংশ হয় না, অর্থাৎ আমরা এমন কোনো কণা পাই না যার আধান e/2 বা 1.8e এমন হতে পারে। (এখন আমরা জানি যে কোয়ার্কের আধানের মান  e/3 বা 2e/3 হতে পারে, তবে তাতে ডিরাকের যুক্তির কোনো ক্ষতি হয় না।) সাহা বললেন যে নিউট্রন হল একটি চৌম্বক উত্তরমেরু ও একটি চৌম্বক দক্ষিণমেরু কণার সমষ্টি।
       এই তত্ত্ব সেই সময় খুব একটা দাগ কাটেনি। কিন্তু কয়েকটি কারণে সাহার এই তত্ত্ব খুব উল্লেখযোগ্য। প্রথমত সাহা ধরেছিলেন যে একমেরু কণার ভর নিউট্রনের থেকে বেশি। আধুনিক কালেও আমরা এই কথাই মেনে নিই, যদিও চৌম্বক একমেরু কণা থাকলে তা হবে সাহার অনুমানের থেকে অনেকগুণ বেশি ভারী। দ্বিতীয়ত, অনেক পরে এই ধরনের তত্ত্বের সাহায্যে পদার্থের গঠন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হয়েছিল। নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী আবদুস সালামের কথায়, “Saha also suggested that the neutron might consist of bound pole pairs. This anticipated in some ways another idea which has been used by Schwinger, Barut and others to suggest that the basic entities of which all matter may be composed of, may be monopoles carrying electric charge (dyons)
       মেঘনাদ, তাঁর ছেলে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী অজিত কুমার সাহা এবং পরবর্তীকালে অপর এক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী সমরেন্দ্রনাথ ঘোষাল নিউক্লিয়াসের ভর নির্ণয়ের একটি সূত্র তৈরি করেছিলেন। এই ধরনের সূত্র প্রথম দিয়েছিলেন হান্স বেথে ও কার্ল ওয়াইজ্যাকার। সাহারা এই সূত্রে একটি নতুন পদ যোগ করেছিলেন। এই পদটি নিউক্লিয়াসে স্পিন বা কৌণিক ভরবেগের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে আমরা ভর নির্ণয়ের সূত্রে ওই বিশেষ পদটি ব্যবহার না করে কাছাকাছি একটি পদ প্রয়োগ করি যা প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা জোড় না বিজোড় তার উপর নির্ভর করে। ঘোষাল পরে স্মৃতিচারণ করেছেন যে বিশ্বযুদ্ধের সময় গবেষণা পত্রিকা ও বিজ্ঞানের খবর আস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাতে তাঁদের বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল।

বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশবিজ্ঞান

       মেঘনাদের গবেষণার দ্বিতীয় অংশ হিসাবে আমরা বায়ুমণ্ডল ও মহাকাশবিজ্ঞান বিষয়ে তাঁর কাজ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।  এই বিষয়ে কাজ তিনি শুরু করেছিলেন ১৯৩৪ সালে এলাহাবাদে। কলকাতাতে ফিরেও তিনি সেই কাজ চালু রেখেছিলেন। তাঁর তাপ-আয়নন তত্ত্বের কথা আমরা পরে আলোচনা করব। বায়ুমণ্ডল সংক্রান্ত তাঁর গবেষণার অনেকটাই বায়ুমণ্ডলের উপরের অংশে অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে আয়নীভবনের সঙ্গে যুক্ত। তিনি বলেছিলেন যে সৌরপদার্থবিজ্ঞান, ওজোনমণ্ডল ও বায়ুমণ্ডলের পদার্থবিজ্ঞান, এদের একসঙ্গে করে গবেষণা করতে হবে। ওজোন স্তর তৈরি ও নাইট্রোজেনের অক্সাইড বা কার্বন ডাই অক্সাইড ইত্যাদি দ্বারা তার ধ্বংস হওয়ার বিষয়ে তিনি কাজ করেছিলেন। এর জন্য তিনি বায়ুমণ্ডলে যে সমস্ত গ্যাস পাওয়া যায়, পরীক্ষাগারে তাদের উপর অতিবেগুলি রশ্মির প্রভাব পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন।  আয়নমণ্ডলের মধ্যে দিয়ে রেডিওতরঙ্গ চলাচল বিষয়ে তাঁর গবেষণা যোগাযোগ ব্যবস্থাতে বিশেষ কাজে লেগেছে।
       বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরে রেডিও-তরঙ্গের প্রসার বিষয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন এডওয়ার্ড অ্যাপলটন, তিনি সাহার কাজের গুণগ্রাহী ছিলেন। তিনি এক চিঠিতে মেঘনাদকে লিখেছিলেন, “I am glad to see that you and your pupils are tackling magnetoionic problems in a rigorous manner, and I gratly admire your mathematical skill. My original formulation of the theory was very crude and needs the hand of a real mathematician to put things right.”
       এই প্রসঙ্গে তাঁর একটা প্রস্তাবের কথা আলাদা করে বলতে হয়। ১৯৩৭ সালে মেঘনাদ সাহা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মানমন্দিরে কিছুদিনের জন্য গিয়েছিলেন। সেই সময় এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছিলেন যে সূর্য বা অন্যান্য নক্ষত্র থেকে যে অতিবেগুনি রশ্মি বেরোয়, তা বায়ুমণ্ডলের শোষণের জন্য মাটিতে পৌঁছায় না। এজন্য তিনি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের বাইরে অন্তত ৪০ কিলোমিটার উপর থেকে সূর্য পর্যবেক্ষণের আহ্বান জানান। পরবর্তীকালে বেলুন বা কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে মহাকাশ পর্যবেক্ষণ মহাবিশ্ব সম্পর্কে আমাদের ধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এই ভাবে পর্যবেক্ষণের প্রস্তাব প্রথম করেছিলেন মেঘনাদ সাহা।

জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা

       জ্যোতির্পদার্থবিদ্যা নিয়ে তিনি প্রথম থেকেই উৎসাহী ছিলেন।  এই বিষয়ে গবেষণাই তাঁকে বিশ্বখ্যাতি এনে দিয়েছিল। তাঁর প্রথম গবেষণা পত্র তড়িৎচৌম্বক পীড়নের উপরে আলোচনাক্রমে তিনি বিকিরণের চাপের প্রসঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। দ্বিতীয় গবেষণা পত্রে ফেব্রি-পেরো ইন্টারফেরোমিটার প্রসঙ্গে আলোচনাতে তিনি সূর্য ও অন্য নক্ষত্রের বর্ণালী পর্যবেক্ষণের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন। এই ক্ষেত্রটিতে আমরা তাঁর দুটি গবেষণা নিয়ে আলোচনা করব।
       প্রথমে আমরা বিকিরণের বা আলোর চাপ বিষয়ে তাঁর তাঁর অপেক্ষাকৃত স্বল্পজ্ঞাত গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা করব। কাজটি স্বল্পজ্ঞাত হলেও তার গুরুত্ব কিন্তু কম নয়। এই বিষয়ে তাঁর যথেষ্ট আগ্রহ প্রথম থেকেই ছিল, ১৯১৭ সালে তড়িৎচৌম্বক পীড়নের উপরে গবেষণাতে বিকিরণের চাপ নিয়ে আলোচনার পরের বছরেই তিনি পরীক্ষাগারে বিকিরণের চাপ মাপার এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন।    
       সৌরবিজ্ঞানে একটি সমস্যা বিজ্ঞানীদের ভাবিয়েছিল। সূর্যের উপরিতলে বর্ণমণ্ডল (Chromosphere) ও কিরীট (Corona) বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। কিন্তু তাপগতিবিদ্যাতে  মাধ্যাকর্ষণের সূত্র প্রয়োগ করে এই বিস্তারের ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না।, কারণ সূর্যের ভিতরের অংশে আকর্ষণ বাইরের অংশকে বেঁধে রাখতে চায়। সূর্যের উপরে সৌর প্রজ্জ্বাল (Solar prominence) দেখা যায়, সময়ে সময়ে তা বিপুল বেগে সূর্য থেকে দূরে সরে যায়। বিকিরণের চাপের কথা বিজ্ঞানীরা বাতিল করে দিয়েছিলেন কারণ চিরায়ত পদার্থবিদ্যা অনুযায়ী পরমাণুর ব্যাস আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের থেকে অনেক কম, তাই তার চাপ পরমাণুর উপর বিশেষ প্রভাব ফেলার কথা নয়। হয়তো অ্যাগনেস ক্লার্কের বই থেকে মেঘনাদ এই সমস্যার কথা জেনেছিলেন। ক্লার্ক লিখেছিলেন যে সৌর কিরীট, সৌর প্রজ্জ্বাল, ধূমকেতুর পুচ্ছ ইত্যাদির বিস্তার ও বেগ এবং  ক্যালসিয়ামের মতো ভারি পরমাণুর অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এক বিকর্ষণ বলের কথা কল্পনা করেন। কেউ কেউ আবার মনে করেছিলেন যে হয়তো উচ্চ তাপমাত্রায় মাধ্যাকর্ষণ বল হ্রাস পায়।
       সাহা দেখালেন যে নবীন কোয়ান্টাম তত্ত্ব থেকে বিকিরণের চাপের সম্পূর্ণ নতুন মাপ পাওয়া যায়। তা থেকেই সৌর কিরীট, প্রজ্জ্বাল ইত্যাদির ব্যাখ্যা করা যায়। (ক্যালসিয়ামের কথা পরে আবার আসবে।) ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ও বিশেষ করে আইনস্টাইনের গবেষণা থেকে বোঝা গেছে যে আলো বা তড়িৎচৌম্বক বিকিরণ হল ফোটন কণার সমষ্টি। এই ফোটন কণার শক্তি ও ভরবেগ দুইই আছে। কোনো অণু বা পরমাণু যখন ফোটন কণাকে শোষণ করে, তখন ভরবেগের সংরক্ষণ সূত্র অনুযায়ী ফোটনের ভরবেগ তার মধ্যে স্থানান্তরিত হয়। ফোটন সূর্যের কেন্দ্র থেকে আসছে, ফলে তার ভরবেগ সাধারণভাবে বাইরের দিকে। তাই ফোটন কণার শোষণের ফলে অণু বা পরমাণুর উপরে একটা চাপ সৃষ্টি হয় যা মাধ্যাকর্ষণের বিপরীত দিকে কাজ করে। এই চাপের জন্যই বর্ণমণ্ডল এত বিস্তৃত। সাহা এখানে এক বিশেষ পরিস্থিতিতে পরমাণু কর্তৃক শোষণের মাত্রা বৃদ্ধির কথা কল্পনা করেছিলেন যার থেকে প্রজ্জ্বালের বিপুল গতিবেগের তিনি ব্যাখ্যা দিতে চেষ্টা করেছিলেন।
       ১৯১৯ সালে সাহার এ বিষয়ে প্রথম প্রবন্ধটি অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত হয়। এর পরে তিনি আরো দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ তিনি ছাপার জন্য পাঠিয়েছিলেন কিন্তু প্রবন্ধের দৈর্ঘ্যের জন্য পত্রিকা কর্তৃপক্ষ অর্থ দাবি করে। সাহার সামর্থ্য ছিল না, বিশ্ববিদ্যালয়েরও এর জন্য  কোনো তহবিল ছিল না। পরে তিনি কলকাতা  বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালে এই প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই তা তেমন প্রচার পায় নি। অক্সফোর্ডের বিজ্ঞানী এডওয়ার্ড মিলনে এই গবেষণাটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেন। তাঁর লেখাতেই তিনি সাহার কাছে ঋণ স্বীকার করেছিলেন, ‘These paragraphs develop ideas originally put forward by Saha.’। পরিশেষে বলতে হয় যে প্রজ্জ্বালের বিষয়ে সাহার ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ছিল না। তার জন্য প্রয়োজন হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন শাখার চৌম্বক-প্রবাহী-গতিবিজ্ঞান (Magnetohydrodynamixs), যার জন্ম অনেক পরে।
       সূর্যের বিকিরণ সম্পর্কে মেঘনাদ সাহার অপর একটি চিন্তা পরবর্তীকালে অন্যত্র কাজে এসেছে। হাইড্রোজেন পরমাণুর ক্ষেত্রে 21 সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রেডিওবিকিরণ এক বিশেষ স্থান অধিকার করে। ১৯৪৬ সালে মেঘনাদ সূর্য বা অন্য নক্ষত্র থেকে এই বিকিরণের উপরে কথা বলেছিলেন। ততদিনে তাঁর তাপ আয়নন সমীকরণ থেকেই জানা গেছে যে নক্ষত্ররা আসলে মূলত হাইড্রোজেন দিয়ে তৈরি। এখন আমরা জানি যে নক্ষত্র থেকে এই বিকিরণের মাত্রা খুব বেশি নয়, কিন্তু মহাবিশ্বে বিরাট বিরাট হাইড্রোজেনের মেঘ আছে যার সম্পর্কে খবর এই বিকিরণের মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব। তবে সাহা জানতেন না, তাঁর এই লেখার কয়েক মাস আগে এ বিষয়ে আর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে সেটি তাঁর চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। আরো পাঁচ বছর পরে মহাকাশ থেকে আসা 21 সেন্টিমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রেডিওবিকিরণ আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়ে।
       যে কাজের জন্য তিনি তরুণ বয়সে বিশ্বখ্যাতি লাভ করেছিলেন তা হল তাঁর তাপ আয়নন সমীকরণ এই গবেষণার গুরুত্ব বুঝতে গেলে সেই মুহূর্তে বিজ্ঞানের এই শাখায় কী পরিস্থিতি ছিল তা বোঝা জরুরি। আমরা জানি বর্ণালীতে আলো বিভিন্ন রঙে ভেঙে যায়। বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। সূর্যের বা অন্যান্য নক্ষত্রের আলোর বর্ণালীতে আমরা উজ্জ্বল পশ্চাৎপটের ওপর কালো কালো দাগ দেখতে পাই। এই ধরনের বর্ণালীকে বলে শোষণ বর্ণালী। এর উৎস কী?  বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ বিভিন্ন রঙের আলো শোষণ করে। সূর্যের কেন্দ্রের অঞ্চল (যেখানে নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়াতে তাপ উৎপন্ন হয় বলে আমরা এখন জানি) প্রচণ্ড উত্তপ্ত, সেখান থেকে আলো বেরোয়। সূর্যের একদম বাইরের স্তর আলোকমণ্ডল (photosphere) ও বর্ণমণ্ডল অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা, সেখানে যে সমস্ত মৌল আছে, তারা তাদের চরিত্র অনুযায়ী কোনো কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে। সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় অপেক্ষাকৃত অনেক কম পরিমাণে। বর্ণালীতে সেই সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গায় কালো দাগ দেখতে পাওয়া যায়। তাই সূর্যের বা অন্য নক্ষত্রের শোষণ বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কোন কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গায় কালো দাগ অর্থাৎ অন্ধকার, তা দেখে কোন কোন মৌলের পরমাণু সেখানে আছে তা বলা সম্ভব।
       বর্ণালীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকরা নক্ষত্রদের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন। তাদের নাম দেওয়া হয় O, B, A, F, G, K এবং M রঙের দিক থেকে বললে O শ্রেণির তারা নীল, তার পর রঙ ক্রমশ লালের দিকে যায়। M তারা লাল। কিন্তু এই শ্রেণি বিভাগের সঙ্গে তারকাদের গঠন বা ভৌত প্রকৃতির সম্পর্ক কী সে বিষয়ে কোনো ধারণা করা যাচ্ছিল না। অবশেষে তারার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে তাপগতিতত্ত্ব থেকে তারাদের উপরিতলের তাপমাত্রা সম্ভব হয়। তখন বোঝা গেল যে O তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশী। তারপর তাপমাত্রা কমতে থাকে। M তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। গত শতাব্দীর একদম শুরুতে বর্ণালীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে জার্মানিতে এজনার হার্জস্প্রুং ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি নরিস রাসেল তারাদের ঔজ্জ্বল্য ও তাদের বাইরের পিঠের তাপমাত্রার মধ্যে একটা সম্পর্ক খুঁজে পান।
       তারাদের শ্রেণি অর্থাৎ তাপমাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন মৌলের শোষণ বর্ণালীর চরিত্রের পরিবর্তন হয়বিভিন্ন মৌল বা আয়নের তীব্রতার হ্রাস বৃদ্ধি ও হার্ভার্ড শ্রেণি বা তাপমাত্রার সম্পর্ক আমরা দেখতে পাচ্ছিলামযেমন O শ্রেণির তারাদের বর্ণালিতে হিলিয়ামের শোষণ রেখা খুব শক্তিশালী। অন্যদিকে K বা M তারাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাতুর রেখা খুবই তীব্র। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে আয়নের কথা। নিস্তড়িৎ পরমাণু থেকে নক্ষত্রের অভ্যন্তরের উচ্চ তাপমাত্রায় ইলেকট্রন বেরিয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে পরমাণুটি আয়নে পরিণত হবে। এই ধরনের আয়নদের রেখাও বর্ণালীতে পাওয়া যাচ্ছিল। কোনো ভাবেই নক্ষত্রদের তাপমাত্রার সঙ্গে তার বর্ণালীর সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছিল না। মেঘনাদ সাহা এই নিয়ে চিন্তা করছিলেন। অন্য একটা সমস্যা তাঁকে ভাবিয়েছিল। সূর্যের সবচেয়ে বাইরের অংশ হল বর্ণমণ্ডল, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়নের রেখা দেখতে পাওয়া যায়। অথচ তার ভিতরের অংশ হল আলোকমণ্ডল, যা অপেক্ষাকৃত উষ্ণ, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়ন নয়, নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর রেখা দেখা যায়। বেশি তাপমাত্রায় আয়নন বেশি হওয়ার কথা, তার বিপরীত ঘটনার কারণ কী হতে পারে?
       ১৯১৯ সাল। মেঘনাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ক্লাসে তাপগতিতত্ত্ব পড়াচ্ছিলেন। রাসয়ানিক বিক্রিয়া পড়াতে গিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জার্মান বিজ্ঞানী এগার্টের একটি প্রবন্ধ। এগার্ট নক্ষত্রের ভিতরে উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণু ও আয়নের ভেঙে যাওয়াকে তাপগতিতত্ত্বে রাসয়ানিক বিক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। নবীন কোয়ান্টাম তত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞান আবার মেঘনাদকে তাঁর সাহায্য করল। তিনি দেখলেন যে এগার্টের পদ্ধতিতে নিলস বোরের পরমাণুর মডেল ব্যবহার করা প্রয়োজন। বোর দেখিয়েছিলেন যে পরমাণুতে ইলেকট্রনরা কতকগুলি নির্দিষ্ট শক্তিস্তরে অবস্থান করে। কোনো পরমাণুকে আয়ন ইলেকট্রনে ভাঙতে গেলে যে পরিমাণ শক্তি দিতে হয়, তাকে বলে আয়নন বিভব এই শক্তি নিয়ে পরমাণুর ইলেকট্রন পরমাণু থেকে বেরিয়ে যায়।
       ১৯২০ সালে Philosophical Magazine – এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধ সাহা যে সমীকরণ দেন, তা পরবর্তী কালে সাহা আয়নন সমীকরণ (Saha Ionization Equation) হিসেবে পরিচিত হয়েছে সাহা ধরে নেন সূর্যের মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রার জন্য পরমাণুরা আয়ন ও ইলেকট্রনে ভেঙে যায় এবং একই সঙ্গে আয়ন ও ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে পরমাণু গঠন করে এই দুই বিক্রিয়া তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকে সাহার গবেষণার বৈশিষ্ট্য হল যে চিরায়ত তাপগতিবিদ্যা ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে টেনে দেখান পরমাণুর আয়নন বিভব (ionization potential) এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় 
       সাহার সমীকরণের রূপটি হল

       এখানে P হল প্রমাণ বায়ুমণ্ডলের চাপের মাপে নক্ষত্রের ভিতর গ্যাসের চাপ, x হল গ্যাসের আয়ননের মাত্রা, u ক্যালরিতে আয়নন বিভব এবং T কেলভিন স্কেলে গ্যাসের তাপমাত্রা জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেল পরে দেখালেন যে P হল মুক্ত ইলেকট্রন গ্যাসের চাপ সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে এই চারটি ভৌত রাশি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত এদের মধ্যে কয়েকটি জানা থাকলে বাকিগুলি সম্পর্কে জানা বা অনুমান করা সম্ভব    সমীকরণ থেকে সাহা দেখালেন যে সূর্যের বর্ণমণ্ডলে তাপমাত্রা, চাপ ও অন্যান্য ভৌত অবস্থা এমন যে সেখানে সমস্ত ক্যালসিয়াম পরমাণু একটি করে ইলেকট্রন ছেড়ে আয়নিত হয়ে যায় আবার কেন্দ্রের আরো কাছের আলোকমণ্ডলের তাপমাত্রা বেশী বটে, কিন্তু চাপও অনেক বেশী তাই সেখানে ক্যালসিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রন ছাড়ার সম্ভাবনা কম ফলে আলোকমণ্ডলের বর্ণালীতে নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর এবং বর্ণমণ্ডলে আয়নের চিহ্ন দেখার সম্ভাবনা বেশি সূর্যের বাইরের দিকের প্রজ্জ্বাল ইত্যাদি অংশে ক্যালসিয়ামের রেখা দেখা যাওয়ার অর্থ এই নয় যে সেখানে ক্যালসিয়াম অন্য পরমাণুর থেকে অনেক বেশি আছে, সূর্যের ওই অঞ্চলের ভৌত পরিবেশের কারণেই ক্যালসিয়ামের রেখা বেশি উজ্জ্বল।
       সাহার গবেষণা আরো এক সমস্যার সমাধান করলো সূর্যে রুবিডিয়াম, সিজিয়াম ইত্যাদি ধাতুর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সাহা বললেন এদের আয়নন বিভব কম, তাই এরা সহজে আয়নিত হয়ে যায় কোন মৌলের আয়ন যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে তা ঐ মৌলের পরমাণুর থেকে আলাদা আয়নিত হয়নি এমন অবস্থায় ঐ মৌলের পরমাণুর চিহ্ন পেতে হলে অপেক্ষাকৃত শীতল অঞ্চলে দেখতে হবে সৌর কলঙ্কের তাপমাত্রা কম, তাই সেখান থেকে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে রুবিডিয়ামের চিহ্ন পাওয়া যাবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল সাহার কথা ঠিক, হেনরি নরিস রাসেল সৌরকলঙ্কের বর্ণালীতে রুবিডিয়ামকে খুঁজে পেলেন
       সাহা এই সময় অপর একটি গবেষণা পত্র প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন এর অল্প পরেই তিনি ইংল্যান্ডে আলফ্রেড ফাউলারের ল্যাবরেটরিতে যান ফাউলারের পরামর্শে তিনি গবেষণা পত্রটি নতুন করে লেখেন বিদেশের পরীক্ষাগারে কাজ করার সুবাদে সাম্প্রতিকতম তথ্য ব্যবহারের সুযোগ তিনি পান তার ফলে মূল তত্ত্বটি অপরিবর্তিত থাকলেও প্রবন্ধটির মানের অনেক উন্নতি ঘটে এটিও তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে অন্যতম
       এই প্রবন্ধে সাহা বিভিন্ন তারার বর্ণালীর এক সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা বহু তারার বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তারাদের রঙের সঙ্গে তাপমাত্রার একটা সম্পর্ক ছিল বলে বোঝা যাচ্ছিল যেমন নীল তারারা বেশী উত্তপ্ত, লাল তারাদের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম কিন্তু তার সঙ্গে তারাদের মধ্যে ভিন্ন মৌলের পরমাণুর শোষণ বর্ণালীর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সাহা দেখান যে তাঁর সমীকরণ সহজেই তারার তাপমাত্রার সঙ্গে শোষণ বর্ণালীর সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে পারে যেমন অতি উত্তপ্ত তারাতে সমস্ত হাইড্রোজেন আয়নিত হয়ে যায়, ফলে হাইড্রোজেনের শোষণ তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ঐ তারাদের বর্ণালীতে থাকে না আমরা জানি যে ধাতুর আয়নন বিভবের মান কম, সুতরাং অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রাতেই ধাতু আয়নিত হয়ে যায় কোনো সাধারণ পরমাণু এবং তার আয়নের শোষণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য কিন্তু এক নয় যদি তারার তাপমাত্রা এতই কম হয় যে কোনো ধাতুর পরমাণু আয়নিত না হয়ে অস্তিত্ব বজায় থাকতে পারে, একমাত্র তখনই এই তারার বর্ণালীতে ধাতুর পরমাণুর শোষণের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় এভাবে সাহার কাজের ফলে এক দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হয়ে যায় আগে মনে করা হত যে বিভিন্ন তারার উপাদান হয়তো আলাদা এখন বোঝা গেল যে তা নয়, তারাদের বর্ণালীর পার্থক্য হয় মূলত তাদের তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য
       সাহা সমীকরণ আমাদের নক্ষত্রের ভিতরে বিভিন্ন অংশে চাপ ও তাপ নির্ণয় করার সুযোগ করে দিল। শুধু তাই নয়, এই সমীকরণ থেকেই আমরা নক্ষত্ররা কী কী মৌলিক পদার্থও দিয়ে তৈরি তা বার করতে পারি। আমরা দেখেছি যে সমীকরণ থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে সমস্ত নক্ষত্রের উপাদানই এক। কোন মৌল কত পরিমাণে আছে, তা জানার জন্য এর আগে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। যেমন এক পদ্ধতিতে ধরা হয়েছিল যে মৌলের শোষণ রেখার তীব্রতা যত বেশি, তার পরিমাণও তত বেশি হেনরি নরিস রাসেল দেখলেন যে পৃথিবীর উপরিভাগে ভূত্বকে যে ছটি মৌল সবচেয়ে বেশি আছে, সৌর বর্ণালীতে তাদের তীব্রতার মান খুব বেশি তাই একটা ধারণা জন্মেছিল যে সূর্য ও পৃথিবী আসলে একই উপাদান দিয়ে তৈরি রাসেলেরও আগে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনরি রোল্যান্ড বলেছিলেন যে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি সূর্যের মতো হত, তাহলে তার বর্ণালীও সূর্যের মতোই হত
       ভূত্বকের প্রধান ছটি মৌল কী কী? ভূত্বকে অক্সিজেন আছে ৪৬.১ শতাংশ, সিলিকন ২৮.২ শতাংশ, অ্যালুমিনিয়াম ৮.২ শতাংশ, লোহা ৫.৬ শতাংশ, ক্যালসিয়াম ৪.১ শতাংশ ও সোডিয়াম আছে ২.৪ শতাংশ। সূর্যের বর্ণালী বিশ্লেষণ করে যে ঠিক এই সংখ্যাগুলোই পাওয়া যাচ্ছিল তা নয়, কিন্তু তাদের মধ্যে মিল ছিল।
       সাহার সমীকরণ কিন্তু তারাদের উপাদান সম্পর্কে অন্য কথা বলছিল, আর সে কথা বুঝতে পেরেছিলেন এক তরুণী বিজ্ঞানী সিসিলিয়া পেইন। সাহার সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছিল যে নক্ষত্রের ভিতর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। অথচ পৃথিবীতে হাইড্রোজেনের পরিমাণ খুব কম, হিলিয়াম নেই বললেই চলে। মেঘনাদ সমেত প্রায় কোনো বিজ্ঞানীই তাই বিশ্বাস করতে পারেন নি, ভেবেছিলেন যে কোনো কারণে হয়তো এই দুটি গ্যাসের জন্য সাহা সমীকরণ কাজ করে না। সিসিলিয়া পেইন ছিলে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের ছাত্রী, তিনি হেনরি রাসেলের সঙ্গেও কাজ করছিলেন। তিনিই প্রথম জোর দিয়ে বলেন যে সাহা সমীকরণ ঠিক, সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের মূল উপাদান হল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। এ ব্যাপারে তিনি এডিংটন ও রাসেল দুজনের সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পেইনই ঠিক, সূর্যের মোট ভরের আটানব্বই শতাংশই হল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। শুধু সূর্য কেন, আধুনিক কালে আমরা জানি যে মহাবিশ্বের মধ্যে সাধারণ যে সমস্ত পদার্থ আছে, তারও প্রায় ৭৪ শতাংশ হল হাইড্রোজেন ও প্রায় ২৪ শতাংশ হিলিয়াম। বাকি সমস্ত মৌল মিলিয়ে মাত্র দুই শতাংশ
       হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরিমাপের গুরুত্ব জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে খুব বেশি। প্রথমত সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের অভ্যন্তরে  নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়ায় চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস মিলে তৈরি করে একটি হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসএই প্রক্রিয়ায় যে শক্তি উৎপন্ন হয় তাই হল নক্ষত্র থেকে যে তাপ বা আলো বেরোয় তার উৎস। নক্ষত্রের মূল উপাদান যে হাইড্রোজেন তা না জানলে আমরা কোনোদিনই নক্ষত্রদের শক্তি আসে কোথা থেকে তা বুঝতে পারতাম না। তেমনি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময় হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হয়েছিল। সেই সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব আমরা বিশ্বে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অনুপাত থেকে বুঝতে পারি। এ সবই সাহার গবেষণার অনেক পরের ঘটনা।    
       তাই সাহার এই গবেষণা তাই জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে যুগান্তর ঘটিয়েছিল বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না দেড় দশক পরে ১৯৩৬ সালে Oxford University Press থেকে প্রকাশিত Theoretical Astrophysics গ্রন্থে লেখক রোসল্যান্ড লিখছেন, ‘…. It was the Indian Physicist Meghnad Saha who (1920) first attempted to develop a consistent theory of the spectral sequence of the stars from the point of view of atomic theory. …..From that time dates the hope that a thorough analysis of stellar spectra will afford complete information about the state of the stellar atmospheres, not only as regards the chemical composition, but also as regards the temperature and various deviations from a state of thermal equilibrium, the density distribution of the various elements, the value of gravity in the atmosphere and its state of motion. The impetus given to Astrophysics by Saha’s work can scarcely be overestimated, as nearly all later progress in this field has been influenced by it and much of the subsequent work has the character of refinements of Saha’s ideas.’ সংক্ষেপে বলা যায় যে সাহার গবেষণাই তাদের অভ্যন্তরের ভৌত অবস্থা সম্পর্কে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়ার পথ খুলে দেয় এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাকে এক পরিমাণগত বিজ্ঞানে পরিণত করে বিখ্যাত জ্যোতির্পদার্থবিদ আর্থার এডিংটনের মতে গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেরা দশটি আবিষ্কারের অন্যতম হল সাহা আয়নন সমীকরণ
       একশ বছর পরেও সাহা সমীকরণ কোথায় কোথায় আমাদের প্রয়োজন, সে বিষয়ে দু একটা কথা বলে শেষ করা যাক নক্ষত্রের মডেল করতে সাহা সমীকরণ দরকার হয় কারণ সেখানে আয়ন ও ইলেকট্রনের সংখ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সাহার সমীকরণ পরমাণুর আয়নন ছাড়া অন্য কাজেও লাগে যেমন কোনো কোনো বিক্রিয়াতে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন বা নিউট্রন যুক্ত হতে পারে, আবার একই সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রায় প্রোটন বা নিউট্রন নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়েও যেতে পারে নিউক্লিয়াসে প্রোটন বা নিউট্রনের একটা বন্ধনী শক্তি আছে যা পরমাণুর আয়নন বিভবের সঙ্গে তুলনীয় এই দুই বিপরীত প্রক্রিয়া যদি তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকে তাহলে সাহা সমীকরণ ব্যবহার করা হয় এ ধরণের বিক্রিয়া ঘটে মহাকাশে এক্স রে বার্স্টার বা সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় বিশেষ করে সুপারনোভা বিস্ফোরণ লোহার থেকে ভারি মৌল সৃষ্টির অন্যতম উৎস বলে আমরা মনে করি।
       বিগ ব্যাঙের পরে মহাবিশ্বের বিবর্তন বুঝতে বিভিন্ন স্তরে সাহা সমীকরণ প্রয়োগ করতে হয়। যেমন আদিতে তাপমাত্রা ও ঘনত্ব ছিল খুব বেশি, তখন নিউট্রিনো ও ইলেকট্রনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিউট্রন ও প্রোটন পরস্পরের মধ্যে পরিবর্তিত হচ্ছিলমহাবিশ্ব যত প্রসারিত হচ্ছিল, তত শীতল হচ্ছিল। তাপমাত্রা একটু কমলে প্রোটন ও নিউট্রন মিলে তৈরি করে ভারি হাইড্রোজেনের পরমাণু। এই দুই ঘটনাকেই আমরা আয়ননের অনুরূপ ভাবতে পারি। আবার বিগ ব্যাঙের পরে দীর্ঘ সময় তাপমাত্রা ছিল পরমাণুর অস্তিত্বের পক্ষে বেশি। একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করে। উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণু আবার ভেঙেও যেতে পারে।  ফলে এই সময়েও হাইড্রোজেন পরমাণু এবং প্রোটন-ইলেকট্রন তাপীয় সাম্যাবস্থায় ছিল।  সাহা সমীকরণ এখানেও প্রযোজ্য। 
গবেষণার পরিকাঠামো নির্মাণ
সাহার বিজ্ঞান গবেষণার কথা বলতে গেলে গবেষণার পরিকাঠামো তৈরির জন্য তাঁর প্রয়াসের কথা বলা প্রয়োজন। এলাহাবাদে তিনি পরমাণুর আয়ন বিভব মাপার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সেরকম সাফল্য আসে নি। কলকাতায় একটা ক্লাউড চেম্বার বানিয়েছিলেন মহাজাগতিক রশ্মি পর্যবেক্ষণের জন্য, কিন্তু অর্থাভাবে তা বন্ধ হয়ে যায় কিন্তু তাঁর সবচেয়ে বড়ো অবদান হল নিউক্লিয় গবেষণার পরিকাঠামো নির্মাণ। পরমাণু শক্তি যখন ভবিষ্যতের স্বপ্ন, মেঘনাদ সাহা কিন্তু তখনই নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানের সম্ভাবনার কথা বুঝতে পেরেছিলেন। ১৯৪১ সালে মেঘনাদ সায়েন্স এন্ড কালচার পত্রিকায় লিখেছিলেন, ‘নিউক্লিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া থেকে বিস্ফোরণ ঘটানোর পদ্ধতি আবিষ্কার হতেই পারে ভাবলে বিস্ময় লাগে যে ইউরেনিয়ামের একটা ছোট্ট ট্যাবলেট একটা বিরাট রণতরীকে ডুবিয়ে দিতে পারবে’ আমরা জানি প্রথম পরমাণু বোমা এর চার বছর পরের ঘটনা
১৯৩৯ সালে নিউক্লিয় শৃঙ্খল বিক্রিয়া আবিষ্কারের ঘোষণার পরে সে বিষয়ে আলোচনা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অসাধারণ প্রজ্ঞার অধিকারী মেঘনাদ বুঝতে পেরেছিলেন যে বিশ্বযুদ্ধের সময় এই নীরবতার অর্থ হল সামরিক গোপনীয়তার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়েছে পরমাণু গবেষণাকলকাতাতে শুরু করলেন নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানের পাঠক্রম। কিন্তু সে কাজে প্রধান অন্তরায় হল যন্ত্রপাতির অভাব। পদার্থবিজ্ঞানের মূল কথা হল পরীক্ষানিরীক্ষা, কিন্তু যন্ত্র না থাকলে তা সম্ভব নয়। নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম যেটা দরকার তা হল কণাত্বরক বা অ্যাক্সিলারেটর। দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে বিক্রিয়া ঘটানো শক্ত কারণ নিউক্লিয়াসের আধান ধনাত্মক, তাই এক নিউক্লিয়াস অন্য নিউক্লিয়াসকে বিকর্ষণ করে। সেই বিকর্ষণকে অগ্রাহ্য করে বিক্রিয়া তখনই হতে পারে যখন সংঘর্ষরত দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে অন্তত একটার গতিশক্তি খুব বেশি। নিউক্লিয়াসের গতিশক্তি বাড়াতে পারে কণাত্বরক। মেঘনাদ বুঝলেন নিউক্লিয় বিজ্ঞানে গবেষণার চাবিকাঠি হল কণাত্বরক।
       সেই সময় সবচেয়ে আধুনিক কণাত্বরক হল সাইক্লোট্রন। সাইক্লোট্রন যন্ত্রে একটা কণাকে প্রায় বৃত্তাকার পথে বারবার ঘোরানো হয় এবং অল্প অল্প করে তার শক্তি বাড়ানো হয়। সাইক্লোট্রনের আবিষ্কর্তা আর্নেস্ট লরেন্স, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন। লরেন্স মেঘনাদের পূর্বপরিচিত, মেঘনাদ ১৯৩৭ সালে তাঁর অতিথি হিসাবে গিয়ে লরেন্সের সাইক্লোট্রন দেখেছেন। মেঘনাদ তাঁর ছাত্র বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরীকে ১৯৩৮ সালে বার্কলেতে পাঠালেনসেখানে গবেষণা করে ডক্টরেট করে ১৯৪১ সালে দেশে ফিরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন বাসন্তীদুলাল
       ইতিমধ্যে সাহা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা সাইক্লোট্রনের জন্য কিছু অর্থ সংগ্রহ করেছেন, মূল লক্ষ্য চিকিৎসাতে নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রয়োগনেহরুর চেষ্টায় টাটারা তাঁকে ষাট হাজার টাকা দেন অনেক টালবাহানার পরে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সেই টাকা নিতে রাজি হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ও সমপরিমাণ টাকা দেলরেন্স ও ডোনাল্ড কুকসের তত্ত্বাবধানে আমেরিকান রোলিং মিলস কোম্পানি সাইক্লোট্রনের পরিকল্পনা ও মূল যন্ত্রাংশগুলি তৈরি করে। যন্ত্রাংশের দাম অবশ্য অনেক বেশি, কিছু কিছু বার্কলে থেকে উপহার হিসাবে পাওয়া গিয়েছিল। মেঘনাদ বাসন্তীদুলালকে সাইক্লোট্রন অফিসার পদে নিয়োগ করে যন্ত্রাংশ কলকাতায় পাঠানোর ভার দিয়েছিলেনবাসন্তীদুলাল সেই দায়িত্ব পালন করেছেন। সেটা মোটেই সহজ কাজ ছিলনা। সাইক্লোট্রনে যে তড়িৎচুম্বক লাগে তারই ওজন ছিল পঞ্চাশ টন। দেশে ফেরার আগে সমস্ত যন্ত্রপাতি পাঠানোর ব্যবস্থা করেন বাসন্তীদুলাল।
বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরী


       ১৯৪২ সালে সাইক্লোট্রনের জন্য আলাদা করে বাড়ি তৈরি করতে হয়। সাইক্লোট্রনের বিপুল পরিমাণ যন্ত্রাংশ একসঙ্গে আসা সম্ভব নয়। ১৯৪১ সালের শেষে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণ করে, আমেরিকাও বিশ্বযুদ্ধে যোগ দেয়ফলে জাহাজ চলাচলে সমস্যা দেখা হয়। বাকি সব কিছু এলেও ভ্যাকুয়াম পাম্পগুলি যে মালবাহী জাহাজে আসছিল তা সিঙ্গাপুরের কাছে জাপানি আক্রমণে ডুবে যায়। শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের নেতৃত্বাধীন বোর্ড অফ সায়েন্টিফিক রিসার্চ সাইক্লোট্রন তৈরির জন্য দেড় লক্ষ টাকা মঞ্জুর করলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপে অত সূক্ষ্ম পাম্প তৈরির সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়। ফলে সাইক্লোট্রনের কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কাজ শুরু করার জন্য বাসন্তীদুলালকে আবার বার্কলেতে ফিরে যেতে হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। মেঘনাদের জীবদ্দশায় সাইক্লোট্রন পুরোপুরি চালু হয়নি।
       সেই যুগের পরিস্থিতির কথা চিন্তা করলে আমরা হয়তো সাহাদের সামনে সমস্যার গভীরতাটা বুঝতে পারব। সাইক্লোট্রন এমন যন্ত্র নয় যে কিনে এনে বসিয়ে দেওয়া যাবে। বিভিন্ন অংশ বিদেশ থেকে নিয়ে এলেও তাদের একসঙ্গে করে বসানোর কাজটা মোটেই সহজ নয়, সে সময় ভারতে কোনো  বিশেষজ্ঞ থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ইঞ্জিনিয়ারিঙের সমস্যা সমাধান করতে হত পদার্থবিজ্ঞানীদের। যুদ্ধের জন্য অনেক জিনিস দেশে অমিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়ার্কশপ এই ধরনের কাজের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নেই। মেঘনাদের সঙ্গে নেহরুর সম্পর্ক ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। ১৯৪০ ও ১৯৫০-এর দশকে দেশের বিজ্ঞান গবেষণার অনুদানকে নিয়ন্ত্রণ করতেন শান্তিস্বরূপ ভাটনগর ও হোমি জাহাঙ্গির ভাবা  ভাবার সঙ্গে মেঘনাদের সম্পর্ক কোনোদিনই ভালো নয়, ভাটনগরের সঙ্গেও তাঁর পুরানো বন্ধুত্ব নানা কারণে ভেঙে গিয়েছিলফলে কলকাতার ইনস্টিটিউটের জন্য অর্থ বরাদ্দও নিতান্ত অপ্রতুল। বিজ্ঞানীর সংখ্যাও কম, যৌথ ভাবে কাজ করার অভ্যাস তখনো দেশে গড়ে ওঠেনি। প্রথম যুগে মূলত তরুণ ছাত্ররাই কাজ সমাধা করেছিল। মেশিন দেখাশোনার জন্য ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ ১৯৫০-এর দশকের শেষ দিকের আগে সম্ভব হয়নি।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের পালিত ল্যাবরেটরির মধ্যেই মেঘনাদ তৈরি করেছিলেন ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স দেশভাগের সময়েও বিড়লা, লাহা ও অন্যান্য স্থানীয় শিল্পপতিদের থেকে ছ’লাখের বেশি টাকা জোগাড় করেছিলেন। ইনস্টিটিউট পরিচালনা করতে গিয়ে স্বাধিকারপ্রসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন ও কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে তাঁর নিয়মিত বিরোধ বেঁধেছে শ্যামাপ্রসাদের মধ্যস্থতায় একটা সমাধান পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৪৮ সালে  ইনস্টিটিউটের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেন শ্যামাপ্রসাদ। তিন বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়, কেন্দ্রীয় সরকার ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ইনস্টিটিউট পরিচালনা নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হল। মেঘনাদের মৃত্যুর পরে এর নাম হয়েছে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স
১৯৪৪ সাল থেকে মেঘনাদ ছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের সচিব।  ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত  সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন ১৯৫৩ সাল থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন অ্যাসোসিয়েশনের পূর্ণ সময়ের অধিকর্তা। তাঁর উৎসাহেই কাল্টিভেশনের নতুন ক্যাম্পাস তৈরি হয় যাদবপুরে।
আরো নানা দিকে হাত লাগিয়েছিলেন মেঘনাদ। ১৯৩৪ সালে মেঘনাদ তৈরি করেছিলেন দেশের পদার্থবিজ্ঞানীদের সংগঠন ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি। মেঘনাদ এলাহাবাদে বসে প্রথমে ইউনাইটেড প্রভিন্স অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স তৈরি করেছিলেন। তাঁরই উৎসাহে ১৯৩৪ সালে এই অ্যাকাডেমি থেকেই সারা দেশের বিজ্ঞানীদের জন্য একটা জাতীয় অ্যাকাডেমির গোড়াপত্তন হয়। নানা সমস্যার পরে  শেষ পর্যন্ত সমঝোতার সূত্র হিসাবে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৪৫ সালে মস্কোতে এবং ১৯৪৬ সালে লন্ডনে বিজ্ঞানে নিযুক্ত কর্মীদের সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়েছিলেন মেঘনাদ সেখানে দেখা হয় এ বিষয়ে পথিকৃৎ বিখ্যাত বিজ্ঞানী জন ডেসমন্ড বার্নাল ও জোসেফ নিডহ্যামের সঙ্গে। মেঘনাদের উৎসাহেই নেহরুকে সভাপতি করে তৈরি হল ভারতের অ্যাসোসিয়েশন ফর সায়েন্টিফিক ওয়ার্কার্স
       গবেষণার বাইরে একজন বিজ্ঞানীর সাফল্যের অপর এক মাপকাঠি হল তাঁর ছাত্রদের তিনি কেমন তৈরি করেছেন তার বিচার। মেঘনাদের কাছে গবেষণা করে অনেক ছাত্র সাফল্য পেয়েছেন এবং দেশের বিজ্ঞান প্রশাসনে শীর্ষস্থানগুলি অধিকার করেছেনপ্রতাপ কিশোর কিচলু দিল্লীর ন্যাশনাল ফিজিক্যাল ল্যাবরেটরির অধিকর্তা হয়েছিলেন। দৌলত সিং কোঠারি হয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনের সভাপতি। রমেশচন্দ্র মজুমদার দীর্ঘদিন দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগের প্রধান হিসাবে কাজ করেছেন। আত্মা রাম হয়েছিলেন কলকাতার সেন্ট্রাল গ্লাস এন্ড সেরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর ও পরে কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চের ডিরেক্টর জেনারেল। বিশ্বম্ভর নাথ শ্রীবাস্তব বেশ কিছুদিন ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের অধিকর্তার কাজ চালাবেন। বাসন্তীদুলাল নাগ চৌধুরি হবেন সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অধিকর্তা, পরে বিভিন্ন সময়ে প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য, ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অরগানাইজেশনের ডিরেক্টর জেনারেল ও জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তাই সেই বিচারে মেঘনাদ অবশ্যই সফল।  
        গবেষণা জীবনের শুরুতেই অসাধারণ সাফল্য পেয়েছিলেন মেঘনাদ, কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন যে  তিনি পরবর্তীকালে তাঁর নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি। নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞানী এস পি পাণ্ড্য অনুযোগের সুরে বলেছেন, ‘Why did he not pursue nuclear theory – which would have been so much easier? There were so many new developments – Yukawa’s theory of nuclear forces, Bohr’s work on nuclear reactions, beginings of a shell model etc. Somehow he remained aloof from all these developments. ” অপর কোনো বিজ্ঞানীও মনে করেন মেঘনাদ কোয়ান্টাম তত্ত্বকে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্মের পরে সেই বিষয়ে গবেষণারও কোনো চেষ্টা করেন নি। এর সম্ভাব্য কারণ জানতে গেলে মেঘনাদের জীবনের অন্যান্য দিকে চোখ রাখতে হবে। পরবর্তীকালে মেঘনাদ গবেষণার সময়ে ভাগ বসাত তাঁর অন্যান্য দায়িত্ব। গবেষণার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নিয়মিত ক্লাসে পড়িয়েছেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও দেশ গঠনের কাজে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন, বন্যাত্রাণে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন, একাধিক বিজ্ঞান সংগঠন তৈরি করেছেন, বিজ্ঞান ও সমাজ বিষয়ক পত্রিকা চালিয়েছেন, একই সঙ্গে দুটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ও ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স পরিচালনা করেছেন, আন্তর্জাতিক মানের পাঠ্যপুস্তক লিখেছেন এবং লোকসভা নির্বাচনে জিতে সাংসদ হিসাবে কাজ করেছেন। তাঁর সেই সমস্ত ভূমিকা বিষয়ে আলোচনা অন্য প্রবন্ধে পাওয়া যাবে।  বিদেশী ঐতিহাসিক রবার্ট অ্যান্ডারসন মেঘনাদ সাহার জীবনের শেষ দুই দশক সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে  লিখেছেন, “Given his active political correspondence, travel, and search for funds for his instution, you may rightly wonder whether Saha actually got any scientific work done. Remarkably he did …”
       যে সামাজিক অবস্থানে মেঘনাদের জন্ম, দেশের যে পরিস্থিতিতে তিনি গবেষণা করেছেন, যে সমস্ত বাধার পাহাড় তাঁকে ডিঙোতে হয়েছে – তাদের দীর্ঘ আলোচনা এই প্রবন্ধে করা সম্ভব হল না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানে মেঘনাদ সাহার সুউচ্চ সাফল্য আমাদের বিস্মিত করে। অনেকক্ষেত্রেই তিনি নতুন চিন্তা করেছিলেন কিন্তু সুযোগের অভাবে তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি; পরবর্তীকালে অন্য বিজ্ঞানীরা সেই সমস্ত চিন্তাকে বিকশিত করেছেন। মেঘনাদ সাহার গবেষণার প্রভাব সুদূরপ্রসারী, তাঁর কাজ ভবিষ্যতের বহু গবেষণাতে সাহায্য করেছে। একশো বছর অতিক্রম করেও তাই তাঁর গবেষণা প্রাসঙ্গিক।
 (বাঁদিক থেকে) বসেঃ মেঘনাদ, জগদীশচন্দ্র, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ; দাঁড়িয়েঃ স্নেহময় দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রমোহন বসু, নিখিলরঞ্জন সেন, জ্জানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও নগেন্দ্রচন্দ্র নাগ (১৯৩০ সালে তোলা ছবি)


      বিজ্ঞানের গণ্ডির বাইরে মেঘনাদ সাহার গবেষণার কথা ব্লগের এই লেখাটাতে পাওয়া যাবে। সাহা সমীকরণ নিয়ে আরো আলোচনা এই লেখাটাতে আছে।

      


Sunday 16 June 2019

শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ মারে গেল-ম্যান


প্রয়াত হলেন কোয়ার্কের আবিষ্কর্তা মারে গেল-ম্যান


মারে গেল-ম্যান (১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ -২৪ মে, ২০১৯)[By I, Joi, CC BY 2.5]

        প্রয়াত হলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী মারে গেল-ম্যান। সাধারণ মানুষের মধ্যে তিনি হয়তো খুব পরিচিত ছিলেন না, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় অর্ধের সেরা পদার্থবিজ্ঞানীদের কোনো তালিকা থেকেই তাঁর নাম বাদ যাবে না। বিজ্ঞানের ইতিহাসে কণাদ বা ডেমোক্রিটাস যে পরমাণুবাদের সূচনা করেছিলেন, তার সর্বশেষ ও সর্বোচ্চ রূপ হল মৌলিক কণার কোয়ার্ক মডেল সেই তত্ত্বে যাঁর সবচেয়ে বেশি অবদান তিনি মারে গেল-ম্যান।
        গেল-ম্যানের জন্ম ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে। তাঁর পরিবার পূর্ব ইউরোপ থেকে আমেরিকাতে এসেছিলমহামন্দার সময় তাঁরা তীব্র আর্থিক দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যানতবে গেল-ম্যান শিশু বয়স থেকেই ছিলেন প্রতিভাবান, তিনি ছাত্রবৃত্তির সুযোগে পড়াশোনা চালাতে পেরেছিলেন। ১৯৪৮ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে স্নাতক হবার পরে তিনি মাত্র বাইশ বছর বয়সে ১৯৫১ সালে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে ডক্টরেট করেন, সুপারভাইসর ছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ভিক্টর ভাইসকফ। তাঁর প্রতিভার দিকে দৃষ্টি পড়েছিল বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমারের। তিনি গেল-ম্যানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান চর্চার সবথেকে বিখ্যাত কেন্দ্র প্রিন্সটনের ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভ্যান্সড সায়েন্সে আমন্ত্রণ জানান। ১৯৫৪ সালে গেল-ম্যান শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। সেখানে তিনি বিখ্যাত বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মির সঙ্গে কাজ করেছিলেন। ১৯৫৫ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে।
        উনিশশো চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে পরীক্ষামূলক কণাপদার্থবিজ্ঞানের দ্রুত অগ্রগতি ঘটেছিল। মহাজাগতিক রশ্মির মধ্যে অনেক নতুন ক্ষণস্থায়ী কণার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল। এই কণাদের নানা ধর্ম বিজ্ঞানীদের সমস্যায়  ফেলেছিল। কিছু কণা ছিল যাদের জীবনকাল এক সেকেন্ডের এক হাজার কোটি ভাগের এক ভাগ। শুনতে খুব কম মনে হলেও বিজ্ঞানীদের কাছে তা ছিল অপ্রত্যাশিত রকম বেশি, তত্ত্ব অনুযায়ী এই সমস্ত কণার আয়ু হওয়া উচিত ছিল এক সেকেন্ডের একশো কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগের কাছাকাছিএর কারণ হিসাবে গেল-ম্যান ১৯৫৩ সালে এই দীর্ঘস্থায়ী কণাদের জন্য স্ট্রেঞ্জনেস নামের এক নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যার প্রস্তাব করেনমোট চার রকম বল আছে, স্ট্রং ফোর্স বা পীন বল, তড়িৎচৌম্বক বল, উইক ফোর্স বা ক্ষীণ বল এবং মাধ্যাকর্ষণ। এদের মধ্যে চতুর্থটি খুবই দুর্বল, তাকে হিসাবে আনার প্রয়োজন নেই। গেল-ম্যান বলেন কোনো স্ট্রেঞ্জ কণা যখন ভেঙে যায়, তখন তার স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যার পরিবর্তন ঘটে। পীন বল বা তড়িৎচৌম্বক বল স্ট্রেঞ্জনেস সংখ্যার পরিবর্তন ঘটাতে পারে না, তা পারে একমাত্র ক্ষীণ বল।  নামেই বোঝা যাচ্ছে এই বলের শক্তি খুব কম, সেজন্য কণার ভেঙে পড়ার হারও অনেক কম, তার স্থায়িত্বকাল বেশিগেল-ম্যান তাঁর তত্ত্ব থেকে নতুন কিছু কণার কথা বলেন, অচিরেই তাদের খুঁজে পাওয়া যায়।
        ১৯৫৮ সালে অপর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী রিচার্ড ফেইনম্যনের সঙ্গে তিনি ক্ষীণ বলের এক তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন। একই সময় ই সি জি সুদর্শন ও  রবার্ট মার্শাক অনুরূপ তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন। তাঁদের তত্ত্ব ক্ষীণ বলের সম্পর্কে সাম্প্রতিকতম আবিষ্কারকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়।
        দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের দুই দশকে অনেক নতুন নতুন কণাত্বরক তৈরি হয়েছিল যেখানে ইলেকট্রন প্রোটন জাতীয় কণাদের উচ্চ শক্তিতে সংঘর্ষ ঘটানো হচ্ছিল। তার ফলে সৃষ্টি হচ্ছিল আরো অনেক নতুন কণাএত রকমের কণা আবিষ্কারের পরে তাদের শ্রেণিবিভাগের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। একই সঙ্গে মনে হচ্ছিল যে এই সমস্ত কণা, সবাই মৌলিক হতে পারে না। গেল-ম্যান এই নিয়ে চিন্তা করছিলেনএই কণাদের দুভাগে ভাগ করা যায়। যে সমস্ত কণা পীন বলের বিক্রিয়াতে অংশ নেয় তাদের বলে হ্যাড্রন, যারা নেয় না, তাদের বলে লেপ্টন। যেমন প্রোটন, নিউট্রন হল হ্যাড্রন, ইলেকট্রন হল লেপ্টন। ১৯৬১ সালে গেল-ম্যান হ্যাড্রনদের শ্রেণিবিভাগের এক নতুন পদ্ধতি খুঁজে পান। এর ব্যাখ্যা জটিল গণিত ছাড়া সম্ভব নয়। সহজ কথায় বললে, সবচেয়ে হালকা হ্যাড্রনদের আটটিকে এক দলে ফেলা যায়। বৌদ্ধধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গের কথা মনে রেখে গেল-ম্যান একে বলেন এইটফোল্ড ওয়ে। এর ফলে পরবর্তীকালে বৌদ্ধ ধর্ম ও  কণাপদার্থবিদ্যার সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা শুরু হলে তিনি তাঁর খেয়ালের জন্য অনুতাপ করেছিলেন।
        এইটফোল্ড ওয়ে নজরকাড়া সাফল্য পায়। তার কারণ হিসাবে গেল-ম্যান ১৯৬৪ সালে বললেন প্রোটন নিউট্রন আসলে মৌলিক কণিকা নয়, তারা প্রত্যেকে তিনটি করে কোয়ার্ক কণা দিয়ে তৈরি। কোয়ার্ক শব্দটা তিনি পেয়েছিলেন জেমস জয়েসের ‘ফিনেগান্স ওয়েক’ উপন্যাসে। তাঁর তত্ত্বে আপ, ডাউন ও স্ট্রেঞ্জ তিনরকমের কোয়ার্ক ছিল এখন অবশ্য আমরা জানি মোট ছ’রকমের কোয়ার্ক আছে। তাঁর এই মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি ১৯৬৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি কোয়ার্কদের কালার বলে আরও এক ধর্মের কথা বলেনরঙ বলতে আমরা যা বুঝি তার সঙ্গে কালারের কোনো সম্পর্ক নেই। পীন বলের তত্ত্বের মূল স্তম্ভ এই কালার।
        পরবর্তীকালে গেল-ম্যান জটিল সিস্টেম বা তন্ত্রের বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহী হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর বই, ‘দি কোয়ার্ক এন্ড দি জাগুয়ার’ এ বিষয়ে তাঁর চিন্তাভাবনার পরিচয় বহন করে। পরিবেশ আন্দোলনে অবদানের জন্য তিনি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে কণাপদার্থবিদ্যার সবচেয়ে গৌরবময় যুগের এক মহীরুহের পতন ঘটল।
                                                                        গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক জুন ২০১৯