Sunday 29 September 2019

পর্যায়সারণির দেড়শ বছর




পর্যায়সারণির দেড়শ বছর

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       যারা স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়, তার নিশ্চয় পর্যায়সারণির কথা জানো। কেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির দেওয়ালে টাঙানোও হয়তো অনেকে দেখেছ। সেই পর্যায়সারণির বয়স হল দেড়শ বছর। রুশ বিজ্ঞানী দমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ মৌলিক পদার্থগুলিকে একটা সারণি বা টেবিলের মতো করে সাজান। এরই নাম পর্যায় সারণি বা পিরিয়ডিক টেবিল। ১৮৬৯ সালের ১৮ মার্চ মেন্দেলিয়েভ রাশিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির সভায় তাঁর গবেষণার কথা প্রকাশ করেছিলেন। পর্যায়সারণি এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার যে রাষ্ট্রসংঘ ২০১৯ সালকে আন্তর্জাতিক পর্যায়সারণি বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছে। কিন্তু এক দিনে এই আবিষ্কার হয়নি। আজ আমরা এই পর্যায় সারণি ধাপে ধাপে কেমন করে তৈরি হল, সেই গল্প শুনব।

       মৌলিক পদার্থ কাকে বলে সকলেরই জানাসহজ কথায়, যে পদার্থকে ভাঙতে ভাঙতে একই রকম পরমাণু পাওয়া যায়, তাকে বলে মৌলিক পদার্থ বা মৌল। যেমন লোহার মধ্যে লোহা ছাড়া অন্য কোন পরমাণু পাওয়া যাবে না। কিন্তু জল ভেঙে দুই রকম মৌল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন পাওয়া যায়, তাই জল মৌল নয়, যৌগ। এ কথাটা এখন আমরা জানি বটে, কিন্তু প্রাচীনকালে বিষয়টা বোঝা মোটেই সহজ ছিল নাযৌগিক পদার্থ ভেঙে মৌল বার করার মতো বিজ্ঞান রপ্ত করতে মানুষের সময় লেগেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মানুষ বিশ্বাস করত যে চারদিকে যে কোটি কোটি নানা বস্তু দেখা যায়, তারা মাত্র কয়েকটা মৌলিক পদার্থ দিয়ে তৈরি। আমাদের দেশে মনে করা হত মৌলিক পদার্থের সংখ্যা পাঁচ – ক্ষিতি অর্থাৎ পৃথিবী বা কঠিন পদার্থ, অপ অর্থাৎ জল বা তরল, মরুৎ অর্থাৎ বায়ু, তেজ অর্থাৎ আগুন বা শক্তি এবং ব্যোম অর্থাৎ শূন্য। এদের বলা হত পঞ্চভূত। সব প্রাচীন সভ্যতাই এই রকম কয়েকটা মৌলের কল্পনা করেছিল। প্রাচীন গ্রিকরাও প্রথমে চারটে, পরে পাঁচটা মৌলিক পদার্থের কথা বলেছিল। চীনদেশের কল্পনায় পাঁচটা মৌলিক পদার্থ ছিল মাটি, ধাতু, কাঠ, জল ও আগুন। সবাই পাঁচটা মৌলের কথাই বলেছিল,  তাই মনে করা হয় যে প্রাচীন সভ্যতাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল।

 




পঞ্চভূত: প্রাচীন ভারতবর্ষ, গ্রিস ও চীনে

       এগুলো যে সত্যি সত্যি মৌলিক পদার্থ  নয় -- কোনো কোনোটা আদৌ পদার্থই নয় -- তা বুঝতে সময় লেগেছিল। সোনা, রুপো, তামা, টিন, কার্বন, গন্ধক, পারদ, সিসা, লোহা, অ্যান্টিমনি, দস্তা, আর্সেনিক এই বারোটা মৌলের আবিষ্কার হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে এগুলো হয় প্রকৃতিতে মৌলিক পদার্থের রূপে পাওয়া যায়, নয়তো এদের আকরিক থেকে আলাদা করা বেশ সহজ। যেমন, সোনা প্রকৃতিতে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। আকরিক থেকে তামা নিষ্কাশন খুব শক্ত নয়। আবার লোহাকে আকরিক থেকে পৃথক করা বেশ শক্ত, কিন্তু মানুষ প্রথম যে লোহা ব্যবহার করে, তা এসেছিল উল্কাপিণ্ড থেকে। সে যুগে এদের কোনোটাকেই অবশ্য মৌলিক পদার্থ বলে মনে করা হত না।

       প্রথম মৌলগুলো কে বা কারা আবিষ্কার করেছিল জানা সম্ভব নয়। মধ্যযুগে অ্যালকেমিস্টরা সস্তার ধাতুকে সোনাতে পরিবর্তন করার নানা চেষ্টা করত, তার থেকেই রসায়ন শাস্ত্র বা কেমিস্ট্রির জন্ম অ্যালকেমিস্টদের মধ্যেই আমরা মৌলিক পদার্থের প্রথম আবিষ্কারকের নাম খুঁজে পাই; ১৬০৯ সালে হেন্নিগ ব্র্যান্ড ফসফরাস আবিষ্কার করেছিলেন। ১৬৬১ সালে রবার্ট বয়েল প্রথম মৌলিক পদার্থের আধুনিক সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। তখন অবশ্য পরমাণুর কথা আসতে পারে না, বয়েল বলেছিলেন যে পদার্থকে কখনোই  ভেঙে অন্য পদার্থ পাওয়া যাবে না, তাই মৌল।

       চলে আসি অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে। রসায়নের জনক ফরাসি বিজ্ঞানী আঁতোয়া ল্যাভসিয়ের ১৭৮৯ সালে মৌলিক পদার্থের প্রথম তালিকা তৈরি করেছিলেন, তাতে ছিল তেত্রিশটি নামএদের মধ্যে সবাইকে অবশ্য আজ মৌল বা এমনকি পদার্থ বলাও যাবে না; তেইশটি পদার্থ ছিল মৌলিক। তাহলেও বোঝা যাচ্ছে যে ফসফরাস আবিষ্কারের পরের একশো আশি বছরে আরো দশটা নতুন মৌল আবিষ্কার হয়ে গেছে। ফরাসি বিপ্লবের সময় ল্যাভসিয়েরকে গিলোটিনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।

       আধুনিক পরমাণুবাদের জনক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী জন ডালটন ১৮০৩ সালে হাইড্রোজেন অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ও গন্ধক -- পাঁচটি মৌলিক পদার্থের এক তালিকা তৈরি করেছিলেন। ১৮০৮ সালে তিনি এই তালিকাতে আরো পনেরটি নাম সংযোজন করেন। ১৮২৭ সালে তাঁর তালিকাতে মৌলের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬সঙ্গের ছবিতে সেই ৩৬টি মৌলিক পদার্থের নাম দেওয়া আছে।  দেখতে পাচ্ছ যে এই তালিকাতে সবগুলোই সত্যিকারের মৌলিক পদার্থ। ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, সোডিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, বেরিয়াম, স্ট্রনসিয়াম ও বোরন – এই সমস্ত মৌলিক পদার্থকে তাদের যৌগ থেকে পৃথক করেছিলেন ব্রিটিশ রসায়নবিদ হামফ্রে ডেভি মাত্র দু বছরে ১৮০৭ ও ১৮০৮ সালেডালটনের তালিকাতে অবশ্য বোরনের নাম নেই  

      


ডালটনের ৩৬টি মৌলিক পদার্থ ও তাদের চিহ্ন

       ছবিতে দেখতে পাচ্ছ ডালটন মৌলিক পদার্থদের জন্য আলাদা আলাদা চিহ্ন ব্যবহার করতেন। সেই চিহ্নগুলো জনপ্রিয় হয়নি, কারণ সেগুলোকে  মনে রাখাটা মোটেই সহজ ছিল না। এখন আমরা যে এক বা দুই অক্ষর ব্যবহার করে মৌলিক পদার্থ এবং তাদের পাশাপাশি লিখে যৌগিক পদার্থ বোঝাই, তা শুরু করেছিলেন সুইডিশ বিজ্ঞানী জোয়ানস জ্যাকব বার্জেলিয়াস। যেমন ধরো অক্সিজেন আর ক্যালসিয়ামের চিহ্ন হল যথাক্রমে O Ca তাহলে পোড়া চুন বা ক্যালসিয়াম অক্সাইডের সঙ্কেত হল CaO ঠিক তেমনি হাইড্রোজেনের চিহ্ন H বলে জলের সঙ্কেত হল H2OH-এর পরে 2 দিয়ে বোঝানো হয়েছে জলের অণুতে হাইড্রোজেনের দুটো পরমাণু আছে। O-এর পরে কোনো সংখ্যা না লেখার অর্থ জলের অণুতে অক্সিজেনের পরমাণু আছে একটা।  সিলিকন, সেলেনিয়াম, সেরিয়াম – এই তিনটি নতুন মৌল আবিষ্কারের সঙ্গেও বার্জেলিয়াসের নাম যুক্ত আছে।




জন ডালটন (উপরে) ও জ্যাকব বার্জেলিয়াস

       ১৮৩০ সালে নাগাদ মৌলের সংখ্যা পঞ্চাশ পেরিয়ে গেল। এবার চেষ্টা শুরু হল তাদের শ্রেণিবিন্যাসের। ধরো  বাঘ, সিংহ, চিতা, বিড়াল, তাদের মধ্যে অনেক মিল আছে, তাই তাদের জীববিজ্ঞানে একই গোত্রে ফেলা হয়।  সেই রকম একই ধরণের মৌলদের নিয়ে পরিবার তৈরির চেষ্টা শুরু হল।

       এ ব্যাপারে মৌলদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে ধর্মের কথা বলতে হয় তা হল পারমাণবিক গুরুত্বহাইড্রোজেন পরমাণুর থেকে কোনো মৌলের পরমাণু যত গুন ভারি, তাকে বলে ঐ মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব। যেমন একটা অক্সিজেনের পরমাণু একটা হাইড্রোজেন পরমাণুর থেকে মোটামুটি ষোল গুন ভারি, তাই অক্সিজেনের পারমাণবিক ভর ১৬১৮০৩ সাল থেকেই মৌলদের পারমাণবিক গুরুত্ব নির্ণয় করা শুরু হয়ে গিয়েছিল, এ কাজেও ডালটন ও বার্জেলিয়াসের বিশেষ ভূমিকা ছিল

       মৌলের শ্রেণিবিন্যাসের প্রথম উদাহরণ হল ১৮২৯ সালে প্রকাশিত জার্মান বিজ্ঞানী জোহান ডোবারেইনারের ট্রায়াড বা ত্রয়ীর সূত্র একটা উদাহরণ দেখা যাক। তিনটি মৌল লিথিয়াম, সোডিয়াম ও পটাশিয়াম; এদের পারমাণবিক গুরুত্ব যথাক্রমে ৬., ২৩ ও ৩৯.ডোবারেইনার দেখলেন যে সোডিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব লিথিয়াম ও পটাশিয়ামের গুরুত্বের গড়ের সমান। আবার তিনটে মৌলই ক্ষার (alkaline) ধাতু, অর্থাৎ তারা জলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে হাইড্রোজেন তৈরি করে। পটাশিয়ামের বিক্রিয়ার হার সবচেয়ে বেশি, সোডিয়ামের তার থেকে কম, আর লিথিয়ামের সব চেয়ে কম। এই তিনটি মৌলকে তিনি বললেন ট্রায়াড বা ত্রয়ী। এই রকম আরো ট্রায়াড খুঁজে পাওয়া গেল, যেমন গন্ধক-সেলেনিয়াম-টেলুরিয়াম, হ্যালোজেন গ্যাসত্রয়ী ক্লোরিন-ব্রোমিন-আয়োডিন; মৃৎক্ষার (alkaline-earth) ধাতুত্রয়ী ক্যালসিয়াম-স্ট্রনশিয়াম-বেরিয়ামসবার ক্ষেত্রে যে মাঝের মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব  বাকি দুটোর গুরুত্বের গড়ের একদম সমান  তা নয়, কিন্তু তার কাছাকাছি।

       ট্রায়াডের সূত্র নিয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ শুরু করলেন, দেখলেন যে একই ধরনের ধর্ম অনেক সময় তিনটের বেশি মৌলিক পদার্থের মধ্যেও পাওয়া যায়। হ্যালোজেন গ্যাসের দলে সবচেয়ে হালকা মৌল ফ্লুরিনের সন্ধান পাওয়া গেল, গন্ধকের আগে নাম ঢুকল অক্সিজেনের। নাইট্রোজেন, ফসফরাস, আর্সেনিক, অ্যান্টিমনি, বিসমাথ নিয়ে নতুন পরিবার তৈরি হল। কিন্তু সে যুগে অনেক মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব নির্ণয়ে ভুল ছিল, তাই এ বিষয়ে গবেষণা খুব একটা এগোল না।




জোহান ডোবারেইনার (উপরে) ও জন নিউল্যান্ডস

       ১৮৬৩ সালে ব্রিটিশ রসায়নবিদ জন নিউল্যান্ডস তখনকার জানা ৫৬টি মৌলকে এগারটা শ্রেণিতে ভাগ করেন। তিনি এটাও দেখান যে পারমাণবিক গুরুত্ব অনুযায়ী সাজালে প্রতি অষ্টম মৌলের ধর্ম একই রকম। যেমন ক্ষার ধাতু লিথিয়াম দুই নম্বর, সোডিয়াম নয় নম্বর, পটাশিয়াম ষোল নম্বর। আবার হ্যালোজেনদের মধ্যে ফ্লুরিন সাত নম্বর, ক্লোরিন চোদ্দ নম্বর। কিন্তু  এই নিয়মটা ক্যালসিয়ামের পরে আর খাটে না। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন অক্টেভ বা অষ্টকের সূত্র। কিন্তু বিজ্ঞানী মহলে তাঁর আবিষ্কারকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় নি।  

       অনেকেই এই সময়ে মৌলিক পদার্থদের শ্রেণি বিন্যাসের চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হলেন মেন্দেলিয়েভ। মেন্দেলিয়েভের জন্ম ১৮৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার সাইবেরিয়াতে। তাঁরা সম্ভবত সতের ভাইবোন ছিলেন, তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ। তাঁর বাবা ইভান ছিলেন শিক্ষক, কিন্তু মেন্দেলিভের জন্মের পরেই তিনি অন্ধ হয়ে যান, ফলে চাকরিটি চলে যায়। কয়েক বছর পরে তিনি মারা যান। মা মারিয়া তাঁদের পারিবারিক একটা কাচের কারখানা নতুন করে খোলেন, কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই সেটি আগুনে ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁদের আর্থিক দুরবস্থা চরমে পৌঁছায়।

দমিত্রি বেশ মেধাবী ছাত্র ছিলেন, তাই তাঁর যখন পনের বছর বয়স, তখন মারিয়া নিয়ে যান বাইশশো কিলোমিটার দূরে মস্কোতে সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য, সঙ্গে ছিলেন দমিত্রির ঠিক উপরের দিদি এলিজাবেথ। সে যুগে সাইবেরিয়া থেকে মস্কোতে যাওয়া মোটেই সহজ ছিল না, স্লেজ, ঘোড়ার গাড়ি, কখনো বা হেঁটে, সেই যাত্রা নিঃসন্দেহে তিন থেকে চার সপ্তাহ লেগেছিল। কিন্তু মস্কো তাঁদের হতাশ করে, অধ্যাপকরা সাইবেরিয়ার কোনো ছাত্রকে ভর্তি নিতে রাজি হননি। সেখানে সুযোগ না পেয়ে তাঁরা যান সাতশো কিলোমিটার দুরে সেন্ট পিটার্সবার্গে। সেখানে ইভানের এক পূর্বপরিচিতের সাহায্যে মেন পেডাগজিকাল ইন্সটিটিউটের ভর্তির পরীক্ষাতে বসার সুযোগ পান দমিত্রি, এবং পাস করে ভর্তি হন। সাফল্যের সঙ্গে সেখানকার পড়াশোনা শেষ করলেন মেন্দেলিয়েভ, কিন্তু একই সঙ্গে যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। ইতিমধ্যেই একই রোগে তাঁর মা ও দিদি মারা যান। স্বাস্থ্যের কারণে কৃষ্ণ সাগরের তীরে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে এক স্কুলে চাকরি নেন মেন্দেলিয়েভ। এক সপ্তাহের মধ্যেই রাশিয়া ও ব্রিটেনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়, এবং ব্রিটিশ সৈন্যরা ক্রিমিয়ার সমুদ্রতীর দখল করে। মেন্দেলিয়েভ বাধ্য হয়ে আরো উত্তরদিকে ক্রিমিয়ার রাজধানী ওডেসার এক স্কুলে যোগ দেন। অবশেষে সুস্থ হয়ে তিনি আবার সেন্ট পিটার্সবুর্গে ফিরে আসেন ও গবেষণা শুরু করেন। ১৮৬৪ সালে সেন্ট পিটার্সবুর্গ টেকনোলজিক্যাল ইন্সটিটিউট এবং পরের বছর সেন্ট পিটার্সবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। তাঁর নেতৃত্বে সেন্ট পিটার্সবুর্গ রসায়ন গবেষণাতে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছিল। ১৯০৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।

পর্যায়সারণি তৈরির জন্য মেন্দেলিয়াভের নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৮৬৯ সালে মেন্দেলিয়েভ তখনো পর্যন্ত জানা ষাটটি মৌলকে পারমাণবিক গুরুত্ব এবং রাসয়ানিক ধর্ম অনুসারে একটা সারণি বা টেবিলের আকার সাজান। নিচের টেবিলটা হুবহু মেন্দেলিয়েভের ১৮৬৯ সালের সারণির সংগে মিলবে না, কিন্তু আমাদের সুবিধার জন্য এটা নিয়েই আলোচনা করা যাক।

        


মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণি

       উপরে RH, RH2 এই সমস্ত দিয়ে বোঝানো হয়েছে মৌলটি (R) হাইড্রোজেনের সঙ্গে মিলে হাইড্রাইড যৌগ গঠন করলে তার সঙ্কেত কী হবে তেমনি RO, RO2 এ সমস্ত দেখাচ্ছে মৌলের অক্সাইডের সঙ্কেত কী। যেমন লিথিয়াম (Li) হাইড্রোজেনের সঙ্গে মিলে যে যৌগ বানাবে, তার সঙ্কেত LiH, আবার লিথিয়াম অক্সাইডের সঙ্কেত হল LiO2 একটি কলম বা স্তম্ভের সমস্ত মৌল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সঙ্গে একইরকম ভাবে যৌগ গঠন করবে যেমন ক্ষারধাতুরা সবাই আছে IA স্তম্ভে, তাদের হাইড্রাইড অণুতে আছে একটা ধাতুর পরমাণু, আর একটা হাইড্রোজেন পরমাণু  আবার তাদের অক্সাইডে একটা অক্সিজেন পরমাণুর সংগে দুটো ধাতুর পরমাণু যুক্ত হয় আমাদের চেনা মৃৎক্ষার ধাতুরা আছে IIA স্তম্ভে, হ্যালোজেন গ্যাসেরা  VIIA স্তম্ভে পর্যায় শব্দের একটা মানে হল পালা করে ঘুরে আসা এইভাবে রাসয়ানিক ধর্ম ঘুরে ঘুরে আসে বলে এর নাম পিরিয়ডিক টেবিল বা পর্যায় সারণি শুধু এই কাজ করলেই মেন্দেলিয়েভের নাম বিখ্যাত হয়ে থাকত, কিন্তু পর্যায় সারণি তৈরিতে তিনি আরো অনেক প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন।  তার কয়েকটা উদাহরণ দেখা যাক।

       বিজ্ঞানীরা তখন ভেবেছিলেন বেরিলিয়াম (Be) ধাতুর  অক্সাইডের সঙ্কেত হল Be2O3, সেই অনুযায়ী তার পারমাণবিক গুরুত্ব হয় ১৪। মেন্দেলিয়েভ দেখলেন যে বেরিলিয়ামের অন্যান্য রাসয়ানিক ধর্মের সঙ্গে বরঞ্চ মৃৎক্ষার ধাতুদের মিল আছে। মৃৎক্ষার ধাতুর অক্সাইডে একটা ধাতুর পরমাণু আর একটা অক্সিজেনের পরমাণু থাকে, যেমন CaO তাই তিনি বেরিলিয়াম অক্সাইডের সঙ্কেত লিখলেন BeOএর থেকে তার পারমাণবিক গুরুত্ব কমে তা বোরনের (B) আগে গিয়ে ক্ষারধাতু ম্যাগনেসিয়ামের (Mg)  ঠিক উপরে বসল। আবার টেলুরিয়ামের (Te) পারমাণবিক গুরুত্ব আয়োডিনের (I) থেকে বেশি হওয়া সত্ত্বেও তিনি রাসয়ানিক ধর্ম বিচার করে টেলুরিয়ামকে আগে রেখেছিলেন। ঠিক তেমনি কোবাল্ট(Co) ও নিকেলের(Ni) জায়গাও তিনি উলটে দিয়েছিলেনপরে দেখা গেছে মেন্দেলিয়েভ সব কটি ক্ষেত্রেই ঠিক কাজ করেছিলেন। সেই কথায় আমরা এই লেখার শেষে আসব।

       তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলে যে মেন্দেলিয়েভ তাঁর সারণিতে কয়েকটা শূন্যস্থান রেখেছিলেন, বলেছিলেন যে সেখানে এমন মৌলরা বসবে যাদের তখনো আবিষ্কার হয়নিঅ্যালুমিনিয়ামের (Al) নিচের শূন্যস্থানের মৌলের তিনি নাম দেন এক-অ্যালুমিনিয়াম, সিলিকনের(Si) নিচে বসালেন এক-সিলিকনকে। এই ‘এক’ শব্দটা মেন্দেলিয়েভ নিয়েছিলেন সংস্কৃত ভাষা থেকে। তিনি বলেছিলেন যে এই মৌলগুলো এখনো আবিষ্কার হয় নি, কিন্তু পর্যায় সারণি থেকে তিনি তাদের ধর্ম সম্পর্কে নানা ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। এখন আমরা এক-অ্যালুমিনিয়ামকে গ্যালিয়াম (Ga) আর এক-সিলিকনকে জার্মেনিয়াম (Ge) নামে চিনি। কী রকম ধর্ম মেন্দেলিয়েভ বলেছিলেন, আর কী পরে পাওয়া গেল তার কয়েকটা উদাহরণ নিচের সারণিতে দেওয়া হয়েছে। দেখা যাবে মেন্দেলিয়েভের হিসাব আসল মাপের খুব কাছাকাছি।

 

এক-অ্যালুমিনিয়াম

গ্যালিয়াম

এক-সিলিকন

জার্মেনিয়াম

পারমাণবিক গুরুত্ব

৬৮

৬৯.৭

৭২

৭২.৬

মৌলের ঘনত্ব (গ্রাম/ঘনসেমি)

৬.০

৫.৯

৫.৫

৫.৩

অক্সাইডের ঘনত্ব

(গ্রাম/ঘনসেমি)

৫.৫

৫.৯

৪.৭

৪.৭

অজানা মৌল সম্পর্কে মেন্দেলিয়েভের অনুমান ও তাদের আবিষ্কারের পরের মাপ

       এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে। গ্যালিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী পল এমিল লেকক।  মেন্দেলিয়েভ তাঁকে লেখেন যে এই মৌলটিই তাঁর এক-অ্যালুমিনিয়াম। লেকক মনে করেছিলেন যে মেন্দেলিয়েভ তাঁর কৃতিত্বে ভাগ বসাতে চাইছেন, তিনি বলেন যে এক-অ্যালুমিনিয়াম আর গ্যালিয়ামের ধর্মে অনেক পার্থক্য আছে। পরে দেখা যায় মেন্দেলিয়েভই ঠিক। এই বিতর্কের ফলে পর্যায়সারণির কথা বিজ্ঞানী মহলে ছড়িয়ে পড়ে।

       মেন্দেলিয়েভ অবশ্য সমস্ত কথা ঠিক বলেন নি। যেমন, মেন্দেলিয়েভ বিভিন্ন সময়ে মোট আঠারটা নতুন মৌলের কথা বলেছিলেন, যার মধ্যে ন’টার অস্তিত্ব আছে। তবে সে আলোচনায় আর যাচ্ছি না। একই সময়ে জার্মান বিজ্ঞানী জুলিয়াস লোথার মেয়ার প্রায় একই রকম এক পর্যায়সারণি তৈরি করেছিলেন, তিনি অবশ্য কোন নতুন মৌলের কথা বলেন নি। মেয়ার কাজটা করেছিলেন ১৮৬৮ সালে, কিন্তু তাঁর প্রকাশক পাণ্ডুলিপি হারিয়ে ফেলায় বই ছাপতে দেরি হয়ে যায় দু’বছর। মেন্দেলিয়েভও অবশ্য ১৮৬৮ সালে থেকেই পর্যায় সারণি বানানো শুরু করেছিলেন। কে আগে কাজটা করেছিলেন তা নিয়ে দুজনের মধ্যে বেশ বিতর্ক হয়েছিল।




দমিত্রি মেন্দেলিয়েভ (উপরে) ও জুলিয়াস লোথার মেয়ার

       মেন্দেলিয়েভের জীবৎকালেই পর্যায় সারণীর একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়েছিল। সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের মৌল খুঁজে পাওয়ার পরে পর্যায় সারণিতে তাদের জন্য একটা নতুন স্তম্ভ তৈরি করতে হয়। তারা হল নিষ্ক্রিয় গ্যাস। প্রথম যে নিষ্ক্রিয় গ্যাস খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, তা হল হিলিয়াম। পৃথিবীতে নয়, তার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল সূর্যে। সেই আবিষ্কারের সঙ্গে আমাদের দেশের একটা সম্পর্ক আছে, সেই গল্প তোমরা এখানে পড়তে পার। হিলিয়াম পৃথিবীতে আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম র‍্যামজে। শুধু হিলিয়াম নয়, নিয়ন, আর্গন, ক্রিপটন, জেনন ও রেডন -- সব কটি নিষ্ক্রিয় গ্যাসের আবিষ্কারের সঙ্গেই র‍্যামজের নাম যুক্ত। ১৯০৪ সালে র‍্যামজেকে এই জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। বর্তমান আরো অনেক মৌল কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করা হয়েছে, এখন আমাদের জানা মৌলের সংখ্যা ১১৮। এই সব নতুন মৌলরা তেজস্ক্রিয়, এদের আয়ু খুব কম। এই সব মৌলদের নিয়ে বড়দের জন্য একটা লেখা লিখেছিলাম, ইচ্ছা করলে এখানে পড়ে দেখতে পার। একেবারে আধুনিক পর্যায়সারণির একটা ছবি নিচে দেওয়া হল। দেখতে পাচ্ছ মেন্দেলিয়েভের পর্যায়সারণির থেকে এ অনেকটাই আলাদা। আলাদা হলেও সাজানোর মূল নীতিটা একই আছে, তবে আধুনিক সারণির বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে এই লেখাটা অনেক বড় হয় যাবে।



আধুনিক পর্যায় সারণী

       পর্যায় সারণি নিয়ে একটা সমালোচনা অনেক দিন ছিল। ধরা যাক ক্যালসিয়াম আর ঠিক তার পরের মৌল স্ক্যান্ডিয়ামের(Sc) কথা। প্রথমটার পারমাণবিক গুরুত্ব হল প্রায় ৪০ আর দ্বিতীয়টার প্রায় ৪৫। যদি ৪২ বা ৪৩ গুরুত্বের কোনো মৌল আবিষ্কার হয়, তাহলে পর্যায় সারণিতে তাকে জায়গা দেব কেমন করে? মেন্দেলিয়েভের পক্ষে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না।

       আধুনিক পর্যায় সারণিটাকে দেখ প্রতিটি মৌলের পাশে একটা সংখ্যা আছে, যা হাইড্রোজেনকে ১ ধরে শুরু করে পর্যায় সারণিতে সেটি কত নম্বর মৌল তা বোঝাচ্ছে। এই সংখ্যাকে বলে পরমাণু ক্রমাঙ্ক। ১৯০৭ সালে মেন্দেলিয়েভ মারা গিয়েছিলেন। তার দু’বছর পরে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন। ১৯১৩ সালে তরুণ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি মোসলে মৌলিক পদার্থের এক্স-রশ্মি বর্ণালী থেকে দেখান যে কোনো মৌলে থেকে বেরোনো একটা নির্দিষ্ট ধরনের এক্স রশ্মির কম্পাঙ্ক ঐ মৌলের পরমাণু ক্রমাঙ্কের বর্গের সমানুপাতী। দু বছর পরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মাত্র আঠাশ বছর বয়সে নিহত হয়েছিলেন মোসলে।




উইলিয়াম র‍্যামজে (উপরে) ও হেনরি মোসলে

       খুব তাড়াতাড়ি বোঝা গেল যে পরমাণু ক্রমাঙ্ক আসলে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যার সমান। তাহলে আধুনিক পর্যায়সারণি থেকে দেখা যাচ্ছে প্রোটনের সংখ্যা ক্যালসিয়ামের নিউক্লিয়াসে হল ২০ আর স্ক্যান্ডিয়ামের ক্ষেত্রে ২১। প্রোটনকে টুকরো করা যায় না, তাই এই দুই মৌলের মধ্যে অন্য কোনো মৌল থাকতে পারে নাশুধু তাই নয়, আগেই বলেছি মেন্দেলিয়েভ কোবাল্ট-নিকেল এবং টেলুরিয়াম-আয়োডিনের এই মৌলদের নিজেদের মধ্যে জায়গা পালটেছিলেন, তিনি ভেবেছিলেন যে হয়তো ওদের পারমাণবিক গুরুত্ব ভুল মাপা হয়েছে। আসলে নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা ধরে হিসাব করলে মেন্দেলিয়েভের সাজানোটাই পাওয়া যায়। যেমন টেলুরিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব আয়োডিনের থেকে বেশি হলেও পরমাণু ক্রমাঙ্কের বিচারে সে আগে বসবে।

       পারমাণবিক গুরুত্ব তাহলে কী? পরমাণুর নিউক্লিয়াসে মোট কতগুলো প্রোটন আর নিউট্রন আছে, তা হল তার ভর সংখ্যা। কোন মৌলের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা পালটায় না, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা এদিক ওদিক হতে পারে। কাজেই তাদের ভর সংখ্যা আলাদা আলাদা। এই ধরনের পরমাণুদের বলে মৌলের আইসোটোপ। কোনো মৌলের পারমাণবিক গুরুত্ব মাপলে আমরা পাই তার আইসোটোপদের ভর সংখ্যার গড়।

       মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণির গুরুত্ব সব রসায়নবিদ স্বীকার করে নিয়েছিলেন। কিন্তু কেন মৌলগুলো পর্যায়সারণিতে এই ভাবেই সাজানো থাকে, তা বুঝতে সময় লেগেছে আরো অনেক দিন। শেষ পর্যন্ত কোয়ান্টাম বলবিদ্যা এর সমাধানের পথ দেখিয়েছে। কিন্তু সে আলোচনা অনেক জটিল ও দীর্ঘ, আজ আর সেখানে আমরা যাব না। ১৮৮২ সালে মেন্দেলিয়েভ ও লোথার মেয়ার একসঙ্গে ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটির হামফ্রে ডেভি পদক পেয়েছিলেন। চাঁদের বুকে একটি গহ্বরের নাম দেয়া হয়েছে মেন্দেলিয়েভ। র‍্যামজে নোবেল পেলেন, কিন্তু মেন্দেলিয়েভের নাম দুবার নোবেল পুরস্কারের জন্য ওঠা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত দেওয়া হল না কেন -- সে পৃথক আলোচনার বিষয়। কিন্তু নোবেল পুরস্কারের থেকেও বড় সম্মান মেন্দেলিয়েভ পেয়েছেন। আধুনিক সারণিতে দেখ ১০১ নম্বর মৌলের চিহ্ন হল Mdওই মৌলের নাম মেন্দেলেভিয়াম।

       



এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছে একপর্ণিকা পত্রিকার জুলাই ২০১৯ সংখ্যায়। কিছুটা পরিবর্তন করে ব্লগে দিলাম। 

Sunday 1 September 2019

বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাহিত্য ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীঃ


বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাহিত্য ও রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীঃ 

শতবর্ষ পরে ফিরে দেখা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      পাঠ্য বইয়ের বাইরে সাধারণ মানুষের জন্য বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান রচনার ইতিহাস আধুনিক বাংলাভাষার প্রায় সমসাময়িক। বিদ্যাসাগরকে আধুনিক বাংলা গদ্যের জনক বলে চিহ্নিত করা হয়। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে কৌতূহলী ছিলেন, সংস্কৃত কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার জন্য তাঁর প্রয়াসের ইতিহাস অনেকেরই জানা। তাঁর সমবয়সী ও ঘনিষ্ঠ অক্ষয়কুমার দত্ত সাধারণের জন্য বাংলাতে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার পথিকৃৎ। তাঁর  সেই সব রচনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে মাইলফলক। এর পরে যাঁদের নাম করতে হয়, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র, ভূদেব মুখোপাধ্যায় ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এঁদের সকলের সম্মিলিত চেষ্টাতেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাহিত্য তার প্রাথমিক রূপ লাভ করে।
      তবে এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলা ভাষার প্রথম যুগে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার অধিকাংশই ছিল বিদেশী লেখার অনুবাদ ও সংকলন। অক্ষয়কুমার বা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথাগত বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ ছিল সীমিত। অক্ষয়কুমার নিজের উদ্যোগে বিজ্ঞান শিখেছিলেন, মেডিক্যাল কলেজে ক্লাস করেছিলেন। রাজেন্দ্রলালও সেই কলেজের ছাত্র ছিলেন কিছুদিন। সে যুগে কলকাতায় একমাত্র মেডিক্যাল কলেজেই বিজ্ঞান শিক্ষার পাঠক্রম চালু ছিল। হাতে কলমে বিজ্ঞান চর্চার অভ্যাস অক্ষয়কুমারের ছিল। আধুনিক যুগের প্রথম বাঙালী বিজ্ঞানী রাধানাথও বিজ্ঞান শিখেছিলেন পাঠক্রমের বাইরে নিজের উৎসাহে। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে প্রেসিডেন্সি কলেজে বিজ্ঞান পড়েছেন। পরে দীর্ঘদিন রিপন কলেজে অধ্যাপনা করেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাদানের সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত ছিলেনহয়তো সেই অভিজ্ঞতার সুবাদেই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান সাহিত্য তাঁর হাত ধরে সাবালকত্ব লাভ করে। রামেন্দ্রসুন্দরের লেখা কখনো যদি না পড়েও থাকি, তাহলেও আমরা যারা বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়ি বা লিখি, সবাই রামেন্দ্রসুন্দরের কাছে ঋণী।


      রামেন্দ্রসুন্দরের জন্মস্থান হল মুর্শিদাবাদের কান্দির কাছে জেমো। তাঁর পিতৃপুরুষ ছিলেন কনৌজের বাসিন্দা। যুদ্ধবিশারদ ব্রাহ্মণ হিসাবে তাঁরা আকবরের সেনাপতি মানসিংহের সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছিলেন। রামেন্দ্রসুন্দরের জন্ম ১৮৬৪ সালের ২০ আগস্ট। পড়াশোনায় চিরকালই ভালো ছিলেন, জীবনে মাত্র দুবার কোনো পরীক্ষায় প্রথম হতে পারেননি তিনি। বিএ পরীক্ষাতে তাঁর রসায়নের খাতা সম্বন্ধে বিখ্যাত অধ্যাপক পেডলার বলেছিলেন তাঁর জীবনের দেখা শ্রেষ্ঠ খাতা। পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন একসঙ্গে নিয়ে ১৮৮৭ সালে এমএ পাস করার পরে পেডলারের উৎসাহেই প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তির জন্য পরীক্ষা দেন এবং সফল হয়ে আট হাজার টাকা বৃত্তি পেয়েছিলেন।
      নানা জায়গা থেকে তাঁর কাছে চাকরির প্রস্তাব এসেছিল। একই সঙ্গে বাঙ্গালোরের কলেজের অধ্যক্ষ ও সেখানকার মানমন্দিরের তত্ত্বাবধায়কের পদ গ্রহণের জন্য পেডলার তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি বাঙালী সংস্কৃতির পীঠস্থান কলকাতা ছাড়তে তিনি রাজি ছিলেন না। জীবনে তিনি তিনবার বাংলার বাইরে পা দিয়েছিলেন। ১৮৯২ সালে রিপন কলেজ (বর্তমানে সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) তাঁকে বিজ্ঞানের অধ্যাপক পদে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, এবার রামেন্দ্রসুন্দর রাজি হলেন। বিজ্ঞান শিক্ষাকে বইয়ের পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে জীবন্ত করে তুলেছিলেন তিনি, এ বিষয়ে তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কলেজ তাঁর জীবনের এতখানি স্থান অধিকার করেছিল যে এমনকি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনার জন্য আশুতোষের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ১৯০৩  থেকে ১৯১৯ সালের ৬ জুন তারিখে মৃত্যু পর্যন্ত তিনি ছিলেন রিপন কলেজের অধ্যক্ষ।
      রামেন্দ্রসুন্দরের লেখা স্কুল পাঠ্য বই বিষয়ে আলোচনা এই নিবন্ধে নেই। তিনি বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা করেন নি, কাজেই তাঁর প্রায় সমসাময়িক জগদীশচন্দ্রের মতো সে বিষয়ে লেখালেখির কথাও ওঠে না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁর বিজ্ঞান প্রবন্ধ রচনার উদ্দেশ্য সঠিক ভাবেই চিহ্নিত করেছেন। “(রামেন্দ্রসুন্দরের লেখা) পড়ে বিজ্ঞান শেখা যায় না, দেখা যায়। কারণ, রামেন্দ্রসুন্দর তো বিজ্ঞান শেখাতে চাননি, দেখাতে চেয়েছেন। ... সাহিত্যিক যেমন জীবন থেকে রস সংগ্রহ করেন, রামেন্দ্রসুন্দর তেমনি রস আহরণ করেছেন বিজ্ঞান থেকে।” (বিজ্ঞান সাহিত্যে রামেন্দ্রসুন্দর, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, অগাস্ট ১৯৬৪) রামেন্দ্রসুন্দরের নিজের কথায়, “মাদক দ্রব্যের একটা সাধারণ লক্ষণ এই যে, অপরকে না বিলাইলে আনন্দের পূর্ণতা হয় না। বিজ্ঞানামোদীও অপরকে আপনার আনন্দের ভাগ দিতে চান”। (জগদানন্দ রায়ের ‘প্রকৃতি পরিচয়” বইয়ের ভূমিকা) রামেন্দ্রসুন্দরের বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম বই ‘প্রকৃতি’-র সূচনাতে তিনি লিখেছিলেন, “পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের আয়াসলব্ধ বৈজ্ঞানিক সত্যগুলি মানবজাতির সাধারণ সম্পত্তি”, সেই সম্পত্তি তিনি সব বাঙালীর মধ্যে বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। একই সঙ্গে তিনি লিখেছিলেন, “বাঙ্গালা ভাষায় সাধারণ পাঠকের নিকট বিজ্ঞান প্রচার বোধহয় অসাধ্যসাধনের চেষ্টা; সিদ্ধিলাভের ভরসা করিনা।” তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরে বাংলার বিজ্ঞান সাহিত্যে তাঁর অবদানকে আমরা ফিরে দেখব।
      রামেন্দ্রসুন্দরের ধ্যানজ্ঞান ছিল মাতৃভাষা, তিনি ক্লাসে বাংলায় পড়ানো শুরু করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “অধ্যাপকের আসনে বসিয়া বাঙ্গালা ভাষায় অধ্যাপনা যদি আপনারা অপরাধ বলিয়া গণ্য করেন, তাহা হইলে আমার মত অপরাধী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঙ্ঘমধ্যে খুঁজিয়া মিলিবে না।” একাধিকবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতাদানের প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, কারণ নিয়মানুসারে সেই বক্তৃতা দিতে হবে ইংরাজিতে। শেষ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে বাংলাতে বক্তৃতা দেওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠার অল্পদিনে পরেই তিনি তার সভ্য হয়েছিলেন। একবছরের মধ্যেই তিনি হয়েছিলেন পরিষদের অন্যতম সম্পাদক। আমৃত্যু তিনি পরিষদের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন। বাংলায় বৈজ্ঞানিক বক্তৃতা, বৈজ্ঞানিক পরিভাষা তৈরি – এ সমস্ত বিষয়ে ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। বাংলায় বিজ্ঞান চর্চার যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল, তার ভগীরথ ছিলেন রামেন্দ্রসুন্দর। 
      রামেন্দ্রসুন্দরের পাণ্ডিত্য ছিল বিশাল মাপের, বিজ্ঞানের বাইরে সাহিত্য ও দর্শনের জগতে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। আমরা এই প্রবন্ধে শুধুমাত্র তাঁর বিজ্ঞান সংক্রান্ত লেখার আলোচনার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখব। তবে এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলা প্রয়োজন। অনেকেই রামেন্দ্রসুন্দরের বিজ্ঞান ও দর্শনের মেলবন্ধনের প্রয়াসের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেও কারো কারো মতে দার্শনিক রামেন্দ্রসুন্দর শেষ পর্যন্ত তাঁর বিজ্ঞানীসুলভ মনোভাব বজায় রাখতে পারেননি, আশ্রয় নিয়েছিলেন যুক্তিনিরপেক্ষ বৈদিক  অদ্বৈতবাদের কাছে। অমলকুমার মুখোপাধ্যায়েয় কথায়, “আজীবন যুক্তিবাদী রামেন্দ্রসুন্দরের এ-এক বিস্ময়কর পশ্চাদপসরণ। ... যুক্তিনিরপেক্ষ বিশ্বাসের কাছে স্পষ্টতই পরাভূত হয়েছে তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা।” ( দার্শনিক রামেন্দ্রসুন্দর, চতুরঙ্গ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯) সত্যেন্দ্রনাথ বসুর কথায়, “(শাস্ত্র গ্রন্থের অনুবাদ) করতে গিয়ে সাফাই গাইবার প্রবৃত্তিটি বোধ হয় বেদপন্থী ত্রিবেদী সন্তানের মধ্যে প্রবেশ করলো। ... রামেন্দ্রসুন্দরের সমাজরক্ষণশীলতা শেষ অবধি পুরাতনী মনোভাবে পরিণত হয়েছে। ... বর্তমান বিজ্ঞানের আবশ্যিকতা রামেন্দ্রসুন্দর স্বীকার করিতেন না। ... মাঝে মাঝে মনে হয় ত্রিবেদী মশায়ের মতো তত্ত্বজিজ্ঞাসু শিক্ষক যদি রিপন কলেজের মত স্থানে না কাটিয়ে এমন কোনো স্থানে অধ্যাপনা করতেন – দেশের নবীন মনের সঙ্গে যেখানে সাক্ষাৎ হওয়া সম্ভব ছিল, তাহলে এই সাময়িক একদেশদর্শী তর্করাশির পরিবর্তে হয়তো চিরস্থায়ী মৌলিক অবদান আমরা তাঁর কাছ থেকে পেতে পারতাম। ... খুব কম প্রবন্ধ পড়ি যাতে তাঁর গভীর সংস্কারমুক্ত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মৌলিক চিন্তার সাক্ষ্য দেয়।” (আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর, জ্ঞান ও বিজ্ঞান, অগাস্ট ১৯৬৪)।  তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা বর্তমান নিবন্ধের সীমার বাইরে।
      তাহলে বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যে রামেন্দ্রসুন্দরের অবদান কী? আবার সত্যেন্দ্রনাথের কথায় ফিরে আসি। “বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি বঙ্গমাতাকে যে সুন্দর উপহার দিয়েছেন – স্বচ্ছ গতিশীল ভাষা যা বিজ্ঞানের দুর্জ্ঞেয় রাজত্ব থেকে অবলীলাক্রমে ঘরের কোণে পরিচিত বস্তুর বর্ণনায় চলে আসতে পারে, তার জন্যেই দেশ তাঁর কাছে চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবে।” তাঁর অনায়াসপাঠ্য প্রবন্ধ শিক্ষিত বাঙালীর সামনে বিজ্ঞানের স্বাদ এনে দিয়েছিল। কয়েকটা উদাহরণ থেকেই তা স্পষ্ট হবে।
      সহজ কথায় বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা কাকে বলে বোঝাতে বসেছেন রামেন্দ্রসুন্দর। “জলের ভিতর hydrogen oxygen আছে, তা না জানা সত্ত্বেও পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের জীবনযাত্রা এতকাল চলিয়াছে ও চলিতেছে। ... বৈজ্ঞানিক কিন্তু আপনার laboratory-ঘরে তাড়িত-প্রবাহ দ্বারা বিশ্লিষ্ট করিয়া, পথিকদিগকে ডাকিয়া আনিয়া দেখান ... জল হইতে hydrogen oxygen বাহির করিতে হইলে হাত, পা, দাঁত নখ প্রভৃতি কর্মেন্দ্রিয়ে কুলায় না; তাহার জন্য বিশিষ্ট রকমের হাতিয়ার বা tool তৈরি করিতে হয়, যন্ত্র-তন্ত্র, তোড়জোড় আবশ্যক হয়। ... এইরূপ যন্ত্র-তন্ত্র, তোড়জোড় সাহায্যে যে observation, তাহার নাম experiment বা পরীক্ষা।” (বাঙ্ময় জগৎ, বিচিত্র জগৎ) 
      তরলের ধর্ম সম্পর্কে লিখছেন, “তরল পদার্থের হাতের কাছে উদাহরণ জল। কঠিনের সঙ্গে ইহার প্রভেদ কী? প্রভেদ অনেক। জল গড়াইয়া যায়, জলে স্রোত হয়: জল ফোঁটা ফোঁটা পড়ে; জলে অক্লেশে হাত ডুবাও। জল সেখান হইতে সরিয়া যাইবে, আবার হাত তোল, জল দ্বিধা না করিয়া স্বস্থানে আসিয়া স্থান পূরণ করিবে; ... জল যে এইরূপ অবাধে সরিয়া নড়িয়া বহিয়া যায়, ইহাই জলের তারল্য।” (তরল পদার্থ, জগৎ-কথা) সাধুভাষা সত্ত্বেও এ যেন আধুনিক লেখকের লেখা।
      এই প্রসঙ্গে তুলনা করুন পরমাণু সম্পর্কে অক্ষয়কুমার ও রামেন্দ্রসুন্দরের লেখার। অক্ষয়কুমার লিখছেন, “স্বর্ণ, রৌপ্য, লৌহ, প্রস্তর, জল, অস্থি, মাংস, শিরা, রক্ত আদি যত জড় বস্তু আছে, সমুদায়ই অত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরমাণুর সমষ্টি। এই যে সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্রাদি বিশিষ্ট আশ্চর্য জগৎ, ইহা কেবল পরমাণুপুঞ্জ মাত্র।” (পদার্থবিদ্যা) পক্ষান্তরে রামেন্দ্রসুন্দরের ভাষায়, “কয়লা কতিপয় কয়লাখণ্ডের সমষ্টি, ... সেই খণ্ডগুলিকে কাটিয়া ভাঙ্গিয়া গুঁড়া করিয়া কোনরূপে ক্ষুদ্রতর ভগ্নাংশে পরিণত করা চলে না। ... মূল পদার্থের এই সকল সূক্ষ্মতম খণ্ডের নাম দেওয়া হইয়াছে পরমাণু।” (রাসয়ানিক সম্মিলন, জগৎ-কথা) স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে  রামেন্দ্রসুন্দরের রচনায় ভাষা অনেক বহমান; অবশ্য তার পিছনে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা গদ্যের পরিবর্তনের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না।
      রামেন্দ্রসুন্দর উদাহরণ ব্যবহার করতেন সাধারণ জীবন থেকে। প্রাচীন কালের ভূকেন্দ্রিক সৌরজগতের মডেলের একটা প্রধান অঙ্গ ছিল এপিসাইকল। রামেন্দ্রসুন্দর বুধগ্রহের এপিসাইকল বোঝাতে গিয়ে লিখেছেন, “একখানা বড়ো চাকা পৃথিবীকে কেন্দ্রে রাখিয়া তিন-শ পঁয়ষট্টি দিনে ঘুরিতেছে, ও আর একখানা ছোট চাকা সেই বড় চাকারই পরিধিস্থিত একটি বিন্দুকে কেন্দ্রগত করিয়া স্বতন্ত্র ভাবে আটাশি দিনে অপেক্ষাকৃত দ্রুতবেগে ঘুরিতেছে।”(প্রাচীন জ্যোতিষ, প্রকৃতি)। লামার্কের বিবর্তন তত্ত্ব সম্পর্কে লিখছেন, “হাতুড়ি পিটিয়া কামারের ও লাঙ্গল ধরিয়া চাষার হাতের পেশীগুলা মোটা ও শক্ত হয়, এবং কামারের ছেলে ও চাষার ছেলে এই পেশীর সবলতা উত্তরাধিকারসূত্রেই প্রাপ্ত হয়, সর্বসাধারণের সংস্কার এইরূপ।” (মৃত্যু, প্রকৃতি)
      বিজ্ঞানকে সাধারণের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য রামেন্দ্রসুন্দর বিজ্ঞানের ইতিহাসকে নানা সময়ে কাজে লাগিয়েছেন। সৌরজগতের ইতিহাস, বিবর্তনতত্ত্ব বা জ্যোতির্বিদ্যার আলোচনা প্রসঙ্গে বিজ্ঞানের ধারণা কেমনভাবে পরিবর্তন হয়েছে, সে কথা ঘুরে ফিরে এসেছে। পাশাপাশি বলতে হবে তাঁর রসবোধের কথা। ষোড়শ শতাব্দীতে বিশপ জেমস আশার ঠিক করেছিলেন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে ৪০০৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ২২ অক্টোবর। রামেন্দ্রসুন্দর লিখছেন, ‘এরূপ প্রাজ্ঞের অস্তিত্বও বিরল নহে, যাঁহারা কররেখা বা ললাটরেখামাত্র দেখিয়া নষ্টকোষ্ঠী উদ্ধার করিয়া জন্মকালের রাশি নক্ষত্র নির্দেশ করিয়া থাকেন। বোধ হয় এই পদ্ধতিরই কোনরূপ বিচারের দ্বারা এককালে স্থির হইয়াছিল বসুন্ধরার বয়ঃক্রম ছয় হাজার বৎসরমাত্র। আমরা এই সকল কোষ্ঠী-উদ্ধারকের ক্ষমতার প্রশংসা করি; কিন্তু তাঁহাদের অবলম্বিত বিচারপ্রণালীর মাহাত্ম্য আমাদের মস্তিষ্কে আসেনা।” (পৃথিবীর বয়স, প্রকৃতি) বিজ্ঞান রচনার শুষ্কতা দূর করে তাঁর লেখাকে সর্বজনগ্রাহ্য করেছে তাঁর রচনাশৈলীর এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য।
      উপরের একটি উদ্ধৃতিতে দেখলাম বর্ণীকরণ ছাড়াই সরাসরি ইংরাজি শব্দের ব্যবহার করেছেন রামেন্দ্রসুন্দর-- এ বাপারে তাঁর মত কী? এই লেখার সময় তিনি অসুস্থ ছিলেন, অনেক প্রবন্ধ তিনি মুখে মুখে বলেছে। অন্য একটি বই, ‘বিচিত্র-প্রসঙ্গ’, তার ভূমিকাতে রামেন্দ্রসুন্দর লিখেছেন, “অনেক ইংরাজি শব্দ কথার মুখে ব্যবহার করিতে হইয়াছে। ... তাহার কতক রাখিয়া গিয়াছেন। ইহা রুচিবিরুদ্ধ।” ‘বিচিত্র জগৎ’ বইটি তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত। হয়তো সুযোগ থাকলে তিনি পরিবর্তন করতেন।  
      বৈজ্ঞানিক পরিভাষা নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেছেন রামেন্দ্রসুন্দর। তাঁর মত, “প্রত্যেকটি শব্দ একটি নির্দিষ্ট অর্থে ব্যবহার করিবে; সেই শব্দটি আর দ্বিতীয় অর্থে প্রয়োগ করিবে না, এবং সেই অর্থে দ্বিতীয় শব্দের প্রয়োগ করিবে না।” (বৈজ্ঞানিক পরিভাষা, শব্দ-কথা) তাঁর নির্দিষ্ট মত আছে এ বিষয়ে, যা তিনি জোরের সঙ্গে প্রকাশ করছেন। “একটি ধাতুর নাম Ruthenium; ইংরেজের ছেলেই বল আর বাঙ্গালীর ছেলেই বল, যে রসায়ন-শাস্ত্র অধ্যয়ন করে নাই, এই শব্দের উচ্চারণে তাহার মনে কোন ভাবের উদয় হয় না... সুতরাং উহা যখন ইংরেজীতে চলিবে তখন বাঙ্গালায় চলিবে না কেন? ... উহাকে অক্ষরান্তরিত করিলেই যথেষ্ট।” (রাসয়ানিক পরিভাষা, শব্দ-কথা) কিন্তু Oxidation, Distillation জাতীয় প্রক্রিয়া বা Element, Compound ইত্যাদি জাতিবাচক বা শ্রেণীবাচক শব্দ, “ইহাদেরও অনুবাদ আবশ্যক; হরপ বদলাইলে চলিবে না।” সংস্কৃত ভাষাতে অগাধ জ্ঞানের অধিকারী হয়েও সেই ভাষা অবলম্বনে পরিভাষা সৃষ্টির চেষ্টাকে তিনি বাহাদুরী আখ্যা দিয়েছেন, তার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেননি। “Oxygen Nitrogenএর অনুবাদে অম্লজান ও যবক্ষারজান, এই দুই নামের কল্পনা কেন হইয়াছিল বলিতে পারিনা। ঐরূপ অনুবাদের কোন বিশেষ উপযোগিতা ছিল না।” শেষে লিখছেন, “আমাদের দেশে এ পর্যন্ত পরিভাষা সঙ্কলনের যে কিঞ্চিৎ চেষ্টা হইয়াছে, তাহাতে নামের সার্থকতা রক্ষার জন্য একটা উৎকট প্রয়াস দেখা যায়। ... পারিভাষিক নামের সার্থকতা থাকিবার কোন প্রয়োজন নাই, এই কথাটি সর্বদা মনে রাখা আবশ্যক।” এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, “পারিভাষিক শব্দগুলি ইংরাজি রাখিয়াই এবং সাংকেতিক চিহ্নগুলি ইংরাজি রাখিয়াই আর সমস্ত কথা বাংলায় প্রকাশ করা যাইতে পারে।” শব্দ-কথা বইয়ের মধ্যে স্থান পেয়েছে শারীরবিজ্ঞান, রসায়ন ও বৈদ্যক পরিভাষা বিষয়ে আলাদা আলাদা প্রবন্ধ। ভূগোলের পরিভাষা নিয়েও তিনি কলম ধরেছিলেন। পরিভাষা বিষয়ে তাঁর প্রয়াস বাংলা বিজ্ঞান সাহিত্যের শ্রেষ্ঠতম অবদান। বিজ্ঞান বিষয়ে রচনা স্বাভাবিকভাবেই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রয়োজনীয়তা হারায়, কিন্তু রামেন্দ্রসুন্দরের নির্মিত বৈজ্ঞানিক পরিভাষা ও আরো বিশেষ করে বললে তার নিয়মাবলী বাংলা ভাষার স্থায়ী সম্পদ।
      এখানে একটা কথা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না-- রামেন্দ্রসুন্দরের বিজ্ঞান অন‍্য প্রবন্ধেও স্থান করে নিয়েছে। বিদ্যাসাগরের জীবন সম্পর্কে তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি স্মরণ করা যাক, “অণুবীক্ষণ নামে একরকম যন্ত্র আছে, তাহাতে ছোট জিনিসকে বড় করিয়া দেখায়, বড় জিনিসকে ছোট দেখাইবার নিমিত্ত উপায় পদার্থ বিদ্যাশাস্ত্রে নির্দিষ্ট থাকলে ওই উদ্দেশ্যে কোন যন্ত্র আমাদের মধ্যে সর্বদা ব্যবহৃত হয়না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের জীবন চরিত বড় জিনিসকে ছোট দেখাইবার জন্য নিমিত্ত যন্ত্রস্বরূপ।” (ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, চরিত কথা)
       বিজ্ঞান বিষয়ে লেখার এক আবশ্যিক শর্ত হল বিজ্ঞান জগতের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, রামেন্দ্রসুন্দর তা রেখেছিলেন। দুই একটা উদাহরণ থেকে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। ‘প্রকৃতি’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৯৬ সালে। লেখাগুলি দশ বছর ধরে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৯০৯ সালে। বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই জানেন যে এই মধ্যবর্তীকালীন সময় বিজ্ঞানের জগতে বিপ্লবের যুগ। রামেন্দ্রসুন্দর সে বিষয়ে সচেতন ছিলেন। লেখক দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছেন যে এই ক’বছরে বিজ্ঞানের জগতে অনেক পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও বইটির সম্পূর্ণ সংস্কারের সুযোগ হয়নি। তাঁর ইচ্ছা ছিল আমূল সংস্কারের, সে সুযোগ আর আসেনি। তবু দ্বিতীয় সংস্করণে দেখি প্রয়োজনে পাদটীকা যোগ করে লেখক স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। ‘আকাশ-তরঙ্গ’ প্রবন্ধে আলোচনা করেছেন তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ প্রসঙ্গে, সেখানে এসেছে ইথার মাধ্যমের কথা। দ্বিতীয় সংস্করণে শেষে যোগ করেছেন, ‘মনে রাখিতে হইবে, এই প্রবন্ধটি ষোল বৎসর পূর্বে লিখিত, উহা এখন পুরাতন ইতিহাস।” কেন তা ‘পুরাতন ইতিহাস’ সে কথা পাদটীকার ক্ষুদ্র পরিসরে রামেন্দ্রসুন্দর লেখার সুযোগ পাননি, বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রেই আজ তা জানেন। ইতিমধ্যে ১৯০৫ সালে আইনস্টাইন বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব প্রকাশ করেছেন, ইথার মাধ্যমের ধারণার স্থান হয়েছে বিজ্ঞানের আস্তাকুঁড়ে। 
      লর্ড কেলভিন পৃথিবীর বয়স নির্ণয় করতে গিয়ে বলেছিলেন যে পৃথিবী ক্রমাগত ঠাণ্ডা হচ্ছে, তার এখন যা তাপমাত্রা, তাতে কিছুতেই তার বয়স দশ কোটি বছরের বেশি হবে না। অথচ ভূবিদ্যা ও বিবর্তনের হিসাবে পৃথিবীর বয়স অনেক গুন বেশি। এই সমস্যাটি নিয়ে ‘প্রকৃতি’র পরের প্রবন্ধ ‘পৃথিবীর বয়স’ লেখা হয়েছিল ১৮৯৫ সালে, তেজস্ক্রিয়া আবিষ্কারের আগে। ভূকেন্দ্রের উত্তাপের এক প্রধান উৎস তেজস্ক্রিয়া। তাই দ্বিতীয় সংস্করণে পাদটীকা, ‘অধুনা রেডিয়াম নামক অদ্ভুত ধাতুর আবিষ্কারের ফলে লর্ড কেল্‌বিনের হিসাব উলট-পালট হইয়া গিয়াছে।”
      বাংলা ভাষায় সাধারণের মধ্যে বিজ্ঞান প্রসারের সেই ‘অসাধ্যসাধন’ তিনি শেষ পর্যন্ত করেছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে তাঁর বিজ্ঞানবিষয়ে রচনার সামান্যই পরিচয় দেওয়া সম্ভব হল। তাঁর লেখার তালিকা থেকে আমরা দেখতে পাই বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে রামেন্দ্রসুন্দরের কৌতূহল ছিল। এই প্রবন্ধের অনেক তথ্য ও মতামত নিচের উৎসগুলি থেকে নেওয়া হয়েছে। উৎসাহী পাঠকপাঠিকাদের সেগুলি পড়তে অনুরোধ করি।
১। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সব্যসাচী রায়চৌধুরী
বাংলার নবজাগরণে বিজ্ঞান চেতনা, অসীমকুমার মুখোপাধ্যায়
৩। বিজ্ঞানভিত্তিক রচনায় রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায় (বাঙালির বিজ্ঞানচর্চাঃ প্রাক্‌স্বাধীনতা পর্ব, সম্পাদক ধনঞ্জয় ঘোষাল)
৫। বাঙালির বিজ্ঞানভাবনা ও সাধনা, অরূপরতন ভট্টাচার্য
বঙ্গে বিজ্ঞানঃ উন্মেষপর্ব, আশীষ লাহিড়ী
রামেন্দ্রসুন্দরের লেখার উদ্ধৃতিগুলি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রকাশিত রামেন্দ্রসুন্দর রচনাবলী থেকে নেওয়া।  বানানের ক্ষেত্রে আধুনিক রূপ ব্যবহার করা হয়েছে। উদ্ধৃতির ক্ষেত্রে বন্ধনীর মধ্যে প্রবন্ধ ও বইয়ের নাম দেওয়া হয়েছে।

প্রকাশঃ বিজ্ঞানভাষ, আগস্ট ২০১৯