Saturday 26 October 2019

মৌলিক পদার্থ ও মহিলা বিজ্ঞানী


মৌলিক পদার্থ ও মহিলা বিজ্ঞানী

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      ঠিক একশো পঞ্চাশ বছর আগে 1869 সালের 18 মার্চ রুশ বিজ্ঞানী দমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ রাশিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির সভায় মৌলিক পদার্থগুলিকে একটা সারণি বা টেবিলের মতো করে সাজানোর কথা বলেছিলেন। তাকেই আমরা আজ পর্যায়সারণি বা পিরিয়ডিক টেবিল বলে চিনি। এ এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার যে রাষ্ট্রসংঘ 2019 সালকে আন্তর্জাতিক পর্যায়সারণি বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছে। ১৮৬৯ সালে ষাটটি মৌলের অস্তিত্বের কথা জানা ছিল। পর্যায়সারণিতে অনেক শূন্য স্থান ছিল যা পরে নতুম মৌল আবিষ্কারের মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে। তাছাড়াও পর্যায়সারণির আরো সম্প্রসারণ ঘটেছে।  দেড়শো বছর পরে মৌলের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে  দাঁড়িয়েছে একশো আঠারোতে। এদের মধ্যে অনেকগুলি তেজস্ক্রিয়। ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা হল 92। ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি মৌলগুলি সবই ক্ষণস্থায়ী,  তাদের প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না -- পরীক্ষাগারে তৈরি করতে হয়েছে। সেগুলির সবই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের আবিষ্কার; একজন বা দুজন নন, সাধারণভাবে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী দলবদ্ধভাবে সেই গবেষণাতে অংশ নিয়েছিলেন।
      সোনা, রুপো, তামা, টিন, কার্বন, গন্ধক, পারদ, সিসা, লোহা, অ্যান্টিমনি, দস্তা, আর্সেনিক -- এই বারোটি মৌলের আবিষ্কার হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে এগুলো হয় প্রকৃতিতে মৌলিক পদার্থের রূপে পাওয়া যায়, নয়তো এদের আকরিক থেকে আলাদা করা বেশ সহজ ছিল। এদের আবিষ্কারকদের নাম জানার কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাসে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত বাকি মৌলদের নামের পাশে তাদের আবিষ্কারকদের নাম পাওয়া যাবে। আধুনিক বিজ্ঞানের জগতে মহিলাদের পদার্পণ খুব সাম্প্রতিক ঘটনা, তাই সেই তালিকাতে মহিলা বিজ্ঞানীর সংখ্যা কম। তবু এদের মধ্যে অন্তত ছ’টি ক্ষেত্রে কোনো না কোনো মহিলা বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে আছে। এই প্রবন্ধে আমরা খুব সংক্ষেপে সেই সমস্ত আবিষ্কারের  দিকে দৃষ্টি রাখব।
      প্রথমেই আসে মাদাম মেরি কুরির নাম। স্বামী পিয়ের কুরির সঙ্গে মিলে তিনি দুটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড  অবশ্য আরো একটি মৌল আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, সে কথায় আমরা পরে আসব। বেকারেল তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পরে পরেই মেরি সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। অন্য সবাই যখন বিকিরণ দেখার জন্য ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করছিলেন, মেরি কাজে লাগালেন পিয়ের ও তাঁর দাদা জ্যাকসের আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রোমিটার যন্ত্র। ইলেক্ট্রোমিটার তেজস্ক্রিয়তার জন্য বাতাসের যে আয়নন হয়, তার পরিমাণ মাপতে পারে। তার ফলে মেরি তেজস্ক্রিয়তার যে পরিমাপ বার করছিলেন, তা অন্যদের থেকে অনেক ভালো।
      মেরির অগ্রগতিতে উৎসাহী হয়ে কিছুদিন পরেই পিয়ের তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। ইউরেনিয়ামের  দুই আকরিক হল পিচব্লেন্ড ও চালকোলাইট, মেরিরা তাদের থেকে ইউরেনিয়াম বার করছিলেন। তাঁরা দেখলেন ইউরেনিয়ামের আকরিকের তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা ইউরেনিয়ামের থেকে বেশী। এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, আকরিকের মধ্যে এক বা একাধিক অজানা মৌলিক পদার্থ আছে যাদের তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক বেশি। মেরিরা সেই মৌলিক পদার্থগুলি আবিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেন। পিচব্লেন্ড হল মূলত ইউরেনিয়ামের অক্সাইড, কিন্তু তার মধ্যে প্রায় তিরিশ রকম মৌলিক পদার্থ থাকে, তাদের একে একে পৃথক করতে হত। নতুন মৌলের রাসয়ানিক ধর্ম সম্পর্কে তাঁদের কিছুই জানা ছিল না, তাই তাকে  খোঁজার জন্য তাঁদের রাসয়ানিক বিশ্লেষণের নতুন পদ্ধতি  আবিষ্কার করতে হয়েছিল। 1898 সালের জুলাই মাসে তাঁরা একটা নতুন মৌলিক পদার্থের চিহ্ন খুঁজে পেলেন। পিচব্লেন্ডের মধ্যে থাকে বিসমাথ। নতুন মৌলটার রাসয়ানিক ধর্ম বিসমাথের খুব কাছাকাছি, তাই পিচব্লেন্ড থেকে বিসমাথ যখন রাসয়ানিক পদ্ধতিতে আলাদা করলেন কুরিরা, তখন নতুন মৌলটাও তার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল। পরাধীন জন্মভূমি পোল্যান্ডের স্মরণে মেরি তার নাম দিলেন পোলোনিয়াম (Po)। পোলোনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা হল 84

মেরি কুরি

      কিন্তু পোলোনিয়াম দিয়েও পিচব্লেন্ডের তেজস্ক্রিয়তার পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। মেরিরা বুঝতে পারলেন আরো একটি মৌল পিচব্লেন্ডের মধ্যে আছে, সেটা শেষ পর্যন্ত অন্য এক মৌলিক পদার্থ বেরিয়ামের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল। বিকিরণ বা রেডিয়েশনের অনুসারে তাঁরা এর নাম ঠিক করলেন রেডিয়াম (Ra)। সেটা ছিল 1898 সালের ডিসেম্বর মাস। যেখানে একটা মৌল আবিষ্কারই যে কোনো বিজ্ঞানীর কাছে স্বপ্ন, মেরিরা সেই কাজে সফল হয়েছেন দুবার। দীর্ঘ তিন বছর চেষ্টা করে কুরিরা 1902 সালের এপ্রিল মাসে রেডিয়ামকে বেরিয়াম থেকে আলাদা করতে সফল হলেন। কাজ শুরুর সময় কুরিরা ভেবেছিলেন এক টন পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পাওয়া যাবে দশ কিলোগ্রাম। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল একশো মিলিগ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড।  তার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কুরিরা বুঝেছিলেন যে তাঁরা রেডিয়ামকে বেরিয়ামের থেকে আলাদা করতে পেরেছেন। এ কাজে তাঁদের সাহায্য করেছিলেন দুই বিজ্ঞানী গুস্তাভ বেমন্ট ও ইউজিন ডেমার্কে। কুরিরা রেডিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব বা ভরসংখ্যা নির্ধারণ করলেন 225। পরে জানা গিয়েছিল রেডিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা অর্থাৎ তার নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা হল 88। পোলোনিয়ামকে কুরিরা কখনোই বিসমাথ থেকে আলাদা করতে সক্ষম হন নি। তার কারণ তখন বোঝা যায়নি। তাঁদের আবিষ্কৃত পোলোনিয়ামের আইসোটোপের অর্ধায়ুকাল হল 138 দিন, রাসয়ানিক পদ্ধতিতে এত সময় লাগত যে পোলোনিয়াম পরমাণুর ক্ষয় হয়ে যেত।
      আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও তাঁর সহযোগী ফ্রেডরিক সডি প্রথম বলেছিলেন তেজস্ক্রিয়াতে এক পরমাণু অন্য পরমাণুতে পাল্টে যাচ্ছে। সেই প্রকল্পের সূচনাতে ছিল রাদারফোর্ড ও তাঁর এক ছাত্রীর পরীক্ষা। হ্যারিয়েট ব্রুক্‌সের নাম আজ বিশেষ কেউ জানে না, তিনি কানাডার প্রথম মহিলা নিউক্লিয় বিজ্ঞানী। শুধু কানাডা নয়, গোটা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ মিলিয়েই তাঁর এই সম্মান প্রাপ্য। 1898 সালে বিজ্ঞান ও অঙ্ক নিয়ে কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক হয়েছিলেন হ্যারিয়েট ব্রুক্‌স। সে সময় রাদারফোর্ড কেমব্রিজ থেকে ম্যাকগিলে যোগ দিয়েছেন, তিনি সহকারী হিসাবে বেছে নেন হ্যারিয়েটকে। মাঝে কিছুদিন কেমব্রিজে ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা জে জে টমসনের সঙ্গে কাজ করার পরে হ্যারিয়েট আবার কানাডা ফিরে যান।
      রাদারফোর্ডও তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি ও রবার্ট আওয়েন্স দেখলেন যে থোরিয়াম থেকে কিছু একটা নিঃসরণ হচ্ছে, যা তেজস্ক্রিয়তাতে যে আলফা বা বিটা কণা বেরোয়, তার থেকে আলাদা। বায়ুর প্রবাহ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁরা তার নামও দিয়েছিলেন থোরন। কুরিরা এই নিঃসরণের কথা আগেই বলেছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন যে রেডিয়াম তার কাছাকাছি বায়ুকে তেজস্ক্রিয় করে দেয়, কিন্তু তা নিয়ে তাঁরা আর এগোননি। আমরা এখন জানি আলফা কণা হল হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস যার ভরসংখ্যা হল চার। বিটা কণা হল ইলেকট্রন, তার ভরসংখ্যা শূন্য। মনে করা হচ্ছিল এ হয়তো থোরিয়ামেরই অন্য কোন ভৌত রূপ। রাদারফোর্ড ও হ্যারিয়েট ব্রুক্‌স দেখালেন যে এই নতুন নিঃসরণ হল একটা তেজস্ক্রিয় গ্যাস যার ভরসংখ‍্যা থোরিয়ামের থেকে অনেক কম। সেই প্রথম কোনো তেজস্ক্রিয় গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেল। রাদারফোর্ড ও ব্রুক্‌স রেডিয়াম থেকেও এই গ্যাস নির্গত হওয়ার চিহ্ন খুঁজে পান।  কয়েক বছর পরে ব্রুক্‌স এর অর্ধায়ুকালও মাপেন, যার থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যায় এটি একটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল। রেডিয়াম থেকে নির্গত এই গ্যাসের নাম দেওয়া হল রেডন (Rn)। এর পারমাণবিক সংখ্যা হল 86। এর থেকেই রাদারফোর্ড এবং সডি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে তেজস্ক্রিয়াতে এক মৌল অন্য মৌলে পরিবর্তিত হচ্ছে।

হ্যারিয়েট ব্রুক্‌স

      তবে রেডন আবিষ্কারের ইতিহাস সরলরেখা নয়। রাদারফোর্ডই প্রথম রেডনকে নতুন মৌল বলেছিলে, আজকাল অনেক জায়গায় তাঁকে রেডনের আবিষ্কর্তার সম্মান দেওয়া হয়। রাদারফোর্ড কিন্তু কুরিদের রেডন আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, তার কারণ তাঁরাই প্রথম রেডিয়াম থেকে এই নিঃসরণ দেখেছিলেন। অপরদিকে মাদাম কুরি রাদারফোর্ডের মতের বিরোধিতা করেছিলেন। রাদারফোর্ড ও সডি নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখান যে রেডন সত্যিই গ্যাস, তার রাসয়ানিক ধর্ম নিষ্ক্রিয় গ্যাসের অনুরূপ। মাদাম কুরি তখন তা মেনে নেন। আমরা এখন জানি ব্রুক্‌স রেডনের ভরসংখ্যা ঠিকঠাক মাপতে পারেন নি। তার ভরসংখ্যা আসলে থোরিয়ামের থেকে সামান্যই কম। তাই যে পরীক্ষা থেকে রেডনকে মৌল বলে অনুমান করা গিয়েছিল, তা ছিল ভুল। অবশ্য রেডনের অর্ধায়ুকালও ব্রুক্‌স মেপেছিলেন, তার থেকে বোঝা গিয়েছিল যে সেটি একটি নতুন মৌল। রাদারফোর্ড নিজে সবসময়েই রেডন বিষয়ে গবেষণা প্রসঙ্গে ব্রুক্‌সের কথা বলেছেন। রাদারফোর্ড ও ব্রুকস প্রথমে রেডন বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র ছাপান। পরে রাদারফোর্ড একাই এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন, তার ভিতরেও তিনি ব্রুক্‌সের অবদানের কথা লিখেছিলেন।  কিন্তু সে কথা বিশেষ প্রচার পায়নি, ফলে হ্যারিয়েট ব্রুক্‌স অপরিচিতই রয়ে গিয়েছেন। তিনি অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেছিলেন কিন্তু কৃতিত্ব পান নি। রেডনের আবিষ্কারে পিয়ের ও মেরি কুরি, রাদারফোর্ড, আওয়েন্স, ব্রুক্‌স এবং সডি – সকলেরই অবদান আছে।
      অবদান যাঁর বিশেষ নেই তাঁর নামই কিন্তু রসায়নের প্রামাণিক বইতে সাধারণত রেডনের আবিষ্কর্তা হিসাবে থাকে -- তিনি জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিয়েডরিশ আর্ন্‌স্ট ডর্ন। ডর্ন শুধুমাত্র রাদারফোর্ডরা থোরিয়ামে যে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন, তা রেডিয়ামের উপরে করেছিলেন। কুরিরা রেডিয়ামে এই ধরনের কাজ আগেই করেছিলেন। ডর্ন কোনো নতুন মৌলের কথা বলেনও নি। তাঁর গবেষণাপত্রটি একটি অপেক্ষাকৃত অপরিচিত গবেষণাপত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল, ফলে সেটি বিশেষ কেউ পড়ার সুযোগ পান নি। পরের এক সুপরিচিত প্রবন্ধে নতুন মৌলের প্রস্তাবকের কথা লিখতে গিয়ে ভুলক্রমে রাদারফোর্ডদের পরিবর্তে ডর্নের গবেষণাপত্রটিকে উল্লেখ করা হয়েছিল। ডর্নের মূল লেখাটি না পাওয়ায় পরবর্তীকালে প্রায় সবাই ওই প্রবন্ধটি অনুসরণ করে ডর্নকেই রেডন আবিষ্কারের সম্মান দিয়েছেন। হিসাব করে দেখা গেছে ইন্টারনেটে নব্বই শতাংশ জায়গায় ডর্নকেই রেডনের আবিষ্কর্তা বলা হয়েছে।     
      আমাদের আলোচনার চতুর্থ মৌলটির নাম হল প্রোট্যাক্টিনিয়াম (Pa)। এটিও তেজস্ক্রিয়। 1913 সালে জার্মানির কার্লসরুহেতে পোলিশ বিজ্ঞানী কাসিমির ফাইয়ান্স ও জার্মান বিজ্ঞানী অসওয়াল্ড গোয়েরিং ইউরেনিয়ামের  ক্ষয় হয়ে যে সমস্ত নতুন মৌল তৈরি হয়, তার মধ্যে প্রোট্যাক্টিনিয়ামের সন্ধান পান, তখনো অবশ্য এই নাম দেওয়া হয়নি।। তাঁদের আবিষ্কৃত মৌলটির ভরসংখ্যা ছিল 234, এর অর্ধায়ু কাল এক মিনিটের সামান্য বেশি। এত ক্ষণস্থায়ী মৌল নিয়ে গবেষণা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। লাতিন ভাষায় ব্রেভিস অর্থে স্বল্পস্থায়ী, তার থেকে তাঁরা এর নাম দিয়েছিলেন ব্রেভিয়াম। কিন্তু এ আদৌ মৌল কিনা তা পরীক্ষা না করে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
      সেই কাজটাই করেন পাঁচ বছর পরে জার্মানির বার্লিনে অটো হান ও লিজা মাইটনার। নিউক্লিয় বিভাজন বা ফিশন বিক্রিয়া বিষয়ে তাঁদের গবেষণার কথা সকলের জানা। হিটলারের ইহুদিবিদ্বেষের কারণে মাইটনারকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, ফলে নোবেল পুরস্কার থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। এ বিষয়ে অটো হানের ভূমিকাও ভালো ছিল না, কিন্তু সে পরবর্তীকালের কথা। মাইটনার ছিলেন আর এক জন মহিলা বিজ্ঞানী যিনি নিউক্লিয় বিজ্ঞানের প্রথম যুগে গবেষণা শুরু করেছিলেন।

লিজা মাইটনার

      হান ও মাইটনার পিচব্লেন্ডচূর্ণে উত্তপ্ত ঘন নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে রেডিয়াম ও অন্যান্য জানা তেজস্ক্রিয় পদার্থকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। পড়ে থাকা অধঃক্ষেপ থেকে যে আলফা বিকিরণ বেরিয়েছিল, তার ভেদনক্ষমতা মেপে তাঁরা নিশ্চিত হন যে এক নতুন মৌলের সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন। এটা ছিল প্রোট্যাক্টিনিয়ামের অন্য আইসোটোপ যার ভরসংখ্যা 231। এর অর্ধায়ুকাল হল প্রায় তেত্রিশ হাজার বছর, ফলে মৌলের রাসয়ানিক ধর্ম নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল। দেখা গেল তা ট্যান্টালাম মৌলের অনুরূপ। নতুন মৌলটি আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে অ্যাক্টিনিয়াম মৌল তৈরি করে বলে তার নাম হল প্রোট্যাক্টিনিয়াম। ফাইয়ান্সও এই নামকরণে সায় দেন। প্রায় একই সময়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে সডি ও তাঁর সহযোগী জন ক্র্যানস্টন প্রোট্যাক্টিনিয়ামের  চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন। পর্যায়সারণিতে পারমাণবিক সংখ্যা 91-এর ঘরটা শূন্য ছিল। মেন্দেলিয়েভ বলেছিলেন ওইখানে যে মৌল বরবে তার ধর্ম হতে হবে ট্যান্টালাম মৌলের খুব কাছাকাছি,  প্রোট্যাক্টিনিয়ামই সেই শূন্যস্থান পূরণ করল।
      এর পরে যে মৌলিক পদার্থের কথা আসবে, তা তেজস্ক্রিয় নয়। তার আগে বলতে হয় মোসলের সূত্রের কথা। কোনো মৌলিক পদার্থকে যথেষ্ট উত্তেজিত করলে তার থেকে এক্স রশ্মি নির্গত হয়। 1913-14 সালে ব্রিটেনে হেনরি মোসলে দেখান যে সেই এক্স রশ্মির কম্পাঙ্কের বর্গমূল হল মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যার সমানুপাতী। এর ফলে মৌল চেনার কাজ খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। পর্যায়সারণিতে 75 পারমাণবিক সংখ্যার ঘরটা শূন্য ছিল, মেন্দেলিয়েভ বলেছিলেন তার ধর্ম হবে ম্যাঙ্গানিজের মতো। 1925 সালে বার্লিনে ওয়াল্টার নড্যাক, ইডা টাকে ও অটো বার্গ প্লাটিনামের আকরিক ও কলম্বাইট নামের এক খনিজের মধ্যে মৌলটিকে আবিষ্কার করেছিলেন। রাইন নদীর নামে তাঁরা তার নাম দিয়েছিলেন রেনিয়াম (Re)। নড্যাক ও টাকে কলম্বাইট থেকে চেনা মৌলগুলি রাসয়ানিকভাবে সরিয়ে দিয়ে রেনিয়ামের ঘনত্বকে এক লক্ষ গুণ পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হন। বার্গ এক্স রশ্মির বর্ণালীতে মোসলের সূত্র প্রয়োগ করে রেনিয়ামের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিলেন। ইডা নুরেমবার্গে জার্মান রসায়ন ক্লাবের সামনে এই মৌল আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন, সেই প্রথম কোনো মহিলা সেই ক্লাবে বক্তৃতা দেন। পরবর্তীকালে ইডা ও ওয়াল্টার বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ইডা অবশ্য গবেষণা বন্ধ করেননি। তিন বছর পরিশ্রম করে নড্যাক দম্পতি বিশুদ্ধ রেনিয়াম ধাতুকেও পৃথক করতে সক্ষম হন। একই সঙ্গে তাঁরা 43 পারমাণবিক সংখ্যার মৌলটি আবিষ্কারের ঘোষণা করেছিলেন। পর্যায়সারণিতে এর জায়গা ঠিক ম্যাঙ্গানিজ ও রেনিয়ামের মাঝখানে, এর রাসয়ানিক ধর্মও হওয়া উচিত তাদেরই মতো। তবে নড্যাকদের দাবী সঠিক ছিল না, কারণ ঐ মৌলটি আসলে তেজস্ক্রিয়, পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে তাকে পাওয়া যায় না।
      একমাত্র যে মৌলটি কোনো মহিলা বিজ্ঞানী একক ভাবে আবিষ্কার করেছেন, তা হল ফ্রান্সিয়াম (Fr)। 1930-এর দশকের শেষদিকে ইউরেনিয়ামের থেকে হালকা মৌলদের মধ্যে দুটি মাত্র অনাবিষ্কৃত ছিল, যাদের পারমাণবিক সংখ্যা 43 ও 87। তাই তাদের খোঁজার নানা চেষ্টা চলছিল। অনেকেই দাবী করেছিলেন যে তাঁরা সফল হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের দাবী প্রমাণ হয়নি। মাদাম কুরির এক সময়কার ছাত্রী মার্গারিট পেরেই প্যারির কুরি ইনস্টিটিউটে প্রথম 87 পারমাণবিক সংখ্যার মৌলটির সন্ধান পান। তিনি অ্যাক্টিনিয়াম-227 আইসোটোপ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। অ্যাক্টিনিয়াম বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে থোরিয়াম-227 আইসটোপে পরিবর্তিত হয়ে যায়, এই কথাই জানা ছিল। পেরেই দেখালেন যে মাত্র এক শতাংশ ক্ষেত্রে অ্যাক্টিনিয়াম-227 ফ্রান্সিয়াম-223 আইসটোপে রূপান্তরিত হয়। এর অর্ধায়ু কাল বাইশ মিনিট, তারপর বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে এর থেকে রেডিয়াম-223 সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে থোরিয়াম-227 আবার আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে রেডিয়াম-223 সৃষ্টি করে। দেখা যাচ্ছে দুই ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত অ্যাক্টিনিয়াম-227 থেকে রেডিয়াম-223 পাওয়া যাচ্ছে। এসের মধ্যে ফ্রান্সিয়ামের পথ ধরছে মাত্র এক শতাংশ অ্যাক্টিনিয়াম নিউক্লিয়াস, তাই ফ্রান্সিয়াম অন্যদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। পেরেই নিজের জন্মভূমির নামে মৌলটির নাম দেন। ফ্রান্সিয়ামই প্রাকৃতিক পদার্থের মধ্যে আবিষ্কৃত শেষ মৌল।
মার্গারিট পেরেই
      আমরা যে সময়ের কথা বলছি সে যুগে মহিলা বিজ্ঞানীদের কাজ করার পরিসর ছিল যথেষ্ট কম। মেরি কুরি দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন ব্যক্তিগত প্রয়াসে, এমনকি নোবেল পুরস্কারও তাঁর জন্য অধ্যাপনার সুযোগ এনে দিতে পারেনি। দুর্ঘটনাতে পিয়েরের মৃত্যুর পরেই একমাত্র তাঁর জায়গায় মেরিকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়া হয়। হ্যারিয়েট ব্রুক্‌সের সামনে কোনো সুযোগই আসেনি, বিয়ের পরে তিনি সমস্ত গবেষণা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। বার্লিনের কেমিস্ট্রি ইনস্টিটিউটের প্রধান মাইটনারকে প্রবেশাধিকার দিতে রাজি ছিলেন না, কারণ মেয়েদের লম্বা চুলে আগুন ধরে যেতে পারে। ইডাই প্রথম নিউক্লিয় বিভাজন বিক্রিয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রায় সারাজীবন চাকরি পাননি, স্বামীর গবেষণাগারে অতিথি হিসাবে কাজ করেছিলেন -- তাই অন্যান্য বিজ্ঞানীরা তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দেননি। এত সমস্যার মধ্যে কাজ করেই এই মহিলারা তাঁদের নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন।

প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান, শারদীয় ২০১৯, পরিমার্জিত


Monday 21 October 2019

পুনরাগমনায় চ


এই গল্পটা প্রকাশ পেয়েছে কল্পবিশ্ব ওয়েব পত্রিকার পূজাবার্ষিকী ১৪২৬ সংখ্যায়। এই লিংকে পত্রিকাতে গল্পটা পাওয়া যাবে। 

Wednesday 9 October 2019

বিক্রম সরাভাই ও ভারতের প্রথম পরমাণু পরীক্ষা


বিক্রম সরাভাই ভারতের প্রথম পরমাণু পরীক্ষা: 
এক বিস্মৃত-প্রায় ইতিহাস

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      এই বছর আমরা বিক্রম সরাভাইয়ের জন্মশতবার্ষিকী পালন করছি। ১৯১৯ সালের ১২ আগস্ট তাঁর জন্ম। আমরা সবাই চন্দ্রযান-২ অভিযানের কথা শুনেছি। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা বা ইসরোর পাঠানো চন্দ্রযান থেকে চাঁদের বুকে যে ল্যান্ডার নামবে, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার জনকের নামে তার নাম দেওয়া হয়েছে বিক্রম। এই লেখাতে কিন্তু আমরা মহাকাশ গবেষণাতে তাঁর অবদান নিয়ে আলোচনা করব না। ভাবার মৃত্যুর পরে ভারতের অ্যাটমিক এনার্জি বা পরমাণু শক্তি কমিশনের দায়িত্ব নিয়েছিলেন বিক্রম সরাভাই। ১৯৭১ সালের শেষে আকস্মিক মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন।তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পরে ভারত প্রথম নিউক্লিয় বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। সেই বিষয়ে তাঁর ভূমিকা কী ছিল? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক ভারতীয় বিজ্ঞানীর কথায়, “Sarabhai died when only 52, removing one of the obstacles to India’s ill-calculated and premature nuclear explosion of 1974.এই উক্তিতে কি বিক্রমের পরমাণু বিস্ফোরণের বিরোধিতাকে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে? তাঁর জন্মশতবর্ষে এই লেখাতে আমরা সেই ইতিহাসকে সংক্ষেপে ফিরে দেখব।
      বিক্রম সরাভাইয়ের জীবন অনেকটা গল্পের মতো। সরাভাইরা ছিলেন আমেদাবাদের সবচেয়ে ধনী ও সুপরিচিত পরিবারদের মধ্যে অন্যতম। বিক্রম কেমব্রিজে পড়তে গিয়েছিলেন, সঙ্গে ছিল এক সুপারিশ পত্র। “It is with great pleasure that I rcommend the application of admission of Mr. Vikram Sarabhai to the authorities of the Cambridge University. He is a young man with a keen interest in Science… I know him personally… He comes of a wealthy and cultured family…” নিজের হাতে এই সুপারিশপত্রটি লিখে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি আমেদাবাদে সরাভাই পরিবারের বাড়িতে বাস করেছেন, শিলঙেও একমাস ছিলেন তাঁদের অতিথি। ১৯২০ সালের সরাভাই পরিবারের সঙ্গে তোলা এক আলোকচিত্রে দেখা যায় কবির পায়ের কাছে বসে ছোট্ট বিক্রম। শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, মহাত্মা গান্ধী, সি ভি রমন, মতিলাল ও জহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, জগদীশচন্দ্র, রাধাকৃষ্ণণ, মহম্মদ আলি জিন্না, আবুল কালাম আজাদ, পৃথ্বীরাজ কাপুর – সরাভাই পরিবারের আতিথ্য স্বীকার করেছেন অনেকেই।
      বিক্রমের বাবা অম্বালালের কাপড়ের মিলগুলি ছিল আমেদাবাদের সর্বোৎকৃষ্ট। কিন্তু শুধুমাত্র সম্পত্তি দিয়ে তাঁদের পরিবারকে বোঝা সম্ভব নয়। মহাত্মা গান্ধী যখন আমেদাবাদে প্রথম আশ্রম স্থাপন করেছিলেন, তখন অম্বালালের দানের ফলেই তা সম্ভব হয়েছিল। বিক্রমের পিসি অনসূয়া আমেদাবাদে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁর কাছে মিলের শ্রমিকদের দুর্দশার কথা শুনে গান্ধীজী আমেদাবাদে বস্ত্রশিল্পে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন এবং প্রথম অনশন সত্যাগ্রহ করেছিলেন। একাধিকবার মিলের শ্রমিকদের নেত্রী অনসূয়া ও মিলের মালিক অম্বালাল পরস্পর বিরোধী শিবিরের নেতৃত্ব দিয়েছেন। গান্ধীজীর ডাকে স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খেটেছেন বিক্রমের মা সরলা ও দিদি মৃদুলা।
      বিক্রম ভারতের সমস্ত বিজ্ঞানীদের থেকে আলাদা পথ অনুসরণ করেছেন। বিজ্ঞানের পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসাতেও তিনি মন দিয়েছিলেন। তাদের পরিবারের সরাভাই কেমিক্যালস কোম্পানি তাঁর ভাগে পড়েছিল, তিনি সেই ছোট্ট প্রতিষ্ঠানকে ভারতের অন্যতম বৃহৎ ওষুধ কোম্পানিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। তাঁদের পরিবারের অন্যান্য অনেক শিল্পোদ্যোগেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁর স্ত্রী বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী মৃণালিনী সরাভাই, কন্যা আর এক বিখ্যাত অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী মল্লিকা। আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সায়গল ছিলেন মৃণালিনীর দিদি। সরাভাইরা ছিলেন জৈন। বিক্রমের সঙ্গে বিয়ের পরে মৃণালিনী যখন নৃত্য অনুষ্ঠানে অংশ নিতে শুরু করেন, তখন আমেদাবাদের রক্ষণশীল জৈন সমাজ থেকে প্রতিবাদ এসেছিল। বিক্রম তাতে কান তো দেননি বটেই, নিজেই দেশে বিদেশে মৃণালিনীর অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিলেন, এমনকি সমস্ত ব্যস্ততা সত্ত্বেও সময় পেলে একদিনের জন্য হলেও বিদেশে মৃণালিনীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে উড়ে যেতেন তিনি।

বিক্রম ও মৃণালিনী
      বিক্রম সরাভাইয়ের বিজ্ঞান গবেষণার পরিচয় দেওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে তিনি গবেষণা শুরু করেছিলেন মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে। ঐ বিষয়ে তিনি ছিলেন পৃথিবীর প্রথম সারির বিশেষজ্ঞদের অন্যতম। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে বাবার কথা মেনে বিক্রম কেমব্রিজ থেকে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ভারতে গবেষণা চালানোর অনুমতি দিয়েছিল, শর্ত ছিল তাঁকে গবেষণা করতে হবে সি ভি রমনের অধীনে। রমন তখন বাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে কর্মরত, সরাভাই পরিবার ছিল তাঁর পূর্বপরিচিত। রমন অবশ্য মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন না। ১৯৪০ সালে নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী রবার্ট মিলিকান বাঙ্গালোরে এসেছিলেন। তিনি তখন মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে পৃথিবীর সব থেকে বিখ্যাত বিজ্ঞানী, তাঁর প্রভাব বিক্রমের গবেষণায় পড়েছিল। রমনের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ পরবর্তীকালেও বজায় ছিল; রমন যখন বাঙ্গালোরে নিজের গবেষণা প্রতিষ্ঠান শুরু করেন, তখন বিক্রমের উদ্যোগেই আমেদাবাদের শিল্পপতিদের থেকে বেশ কিছু অর্থসাহাযা তিনি পেয়েছিলেন। মহাজাগতিক রশ্মি থেকেই বিক্রমের মহাকাশ বিষয়ে গবেষণাতে আগ্রহ জাগে।
      বাঙ্গালোরেই বিক্রম ও মৃণালিনীর আলাপ হয়েছিল। আরো একজনের সঙ্গে এখানেই বিক্রমের বন্ধুত্ব হয়, যাঁর কথা আমাদের লেখাতে আবার আসবে।  হোমি জাহাঙ্গির ভাবা তখন বিজ্ঞান জগতে অতি পরিচিত নাম। ভাবা গবেষণা করতেন কেমব্রিজে, ছুটি কাটাতে দেশে ফিরে তিনি বিশ্বযুদ্ধের জন্য আটকে পড়েছিলেন। তিনিও তখন বাঙ্গালোরে ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে। ভাবা মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে উল্লেখযোগ্য তাত্ত্বিক কাজ করেছিলেন। ভাবার সঙ্গে বিক্রমের অনেক মিল ছিল। ভাবা ছিলেন ভারতের প্রথম শিল্পোদ্যোগী পরিবার টাটাদের আত্মীয়। উল্লেখযোগ্য হল যে ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল টাটাদের অর্থানুকূল্যে। দুজনেই শিল্পকলা বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন, জীবনকে উপভোগ করতে ভালোবাসতেন। তাই সহজেই তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়েছিল, ভাবার মৃত্যু পর্যন্ত তা অটুট ছিল।
      একটা কথা বলতেই হবে, জীবনের প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই বিক্রমের সময়জ্ঞান ছিল অসাধারণ। মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন ১৯৪০ সালে। তার দশ বছরের মধ্যেই পদার্থবিদ্যাতে যত নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গবেষণার ভূমিকা আছে। তিনি যখন উপগ্রহের সাহায্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা বা আবহাওয়া বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কথা বলেছেন, তখন অনেকেই ভারতের মতো গরীব দেশের পক্ষে তা কল্পনাবিলাস বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতার সময় ভারতের মতো গরিব দেশ যে মহাকাশ গবেষণার স্বপ্ন দেখছিল, তার পিছনে ছিলেন একজন ব্যক্তি, বিক্রম সরাভাই। বিক্রমের অধীনে কাজ করেছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম, তিনি মহাকাশ বিষয়ে বিক্রমের চিন্তাভাবনাকে রোমান্টিক আখ্যা দিয়েছিলেন, কিন্তু তাকে কখনোই আকাশকুসুম মনে করেননি। বিক্রমের নিজের কথাতে, “There are some who question the relevance of space activities in a developing nation. To us, there is no ambiguity of purpose. We do not have the fantasy of competing with the economically advanced nations in the exploration of the moon or the planets or manned space-flight. … if we are to play a meaningful role nationally, and in the community of nations, we must be second to none in the application of advanced technologies to the real problems of man and society.” সমাজ ও জাতির স্বার্থই গবেষণার চালিকাশক্তি হওয়া উচিত, বিক্রম সারা জীবন এই নীতি মেনে চলেছেন।
      ভারতের মহাকাশ প্রযুক্তি যে আজ গোটা বিশ্বের নজর কেড়ে নিয়েছে, তার পিছনে আছে সরাভাইয়ের উদ্যোগ। বিদেশের সাহায্য নিলেও দেশীয় প্রযুক্তি বিকাশে তাঁর সবসময় দৃষ্টি ছিল। ১৯৬৭ সালে মার্কিনীরা এক বছরের জন্য ভারতকে তাদের এক উপগ্রহ ব্যবহারের অনুমতি দেয়। তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ভারতের মাটিতে একটা স্টেশন বানাতে হবে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে এই কাজটা কানাডাকে দেওয়া হবে। বিক্রম সরাসরি তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রী আই কে গুজরালকে প্রশ্ন করেন, ভারতীয়রা ভারতেই পরীক্ষা করা সুযোগ না পেলে কোথায় পাবে? তাঁর চেষ্টাতেই সরকার মত পরিবর্তন করে। ভারতের রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র শ্রীহরিকোটা তৈরি করতে মার্কিনীরা পঞ্চাশ কোটি টাকা চেয়েছিল, বিক্রমের উদ্যোগে শেষ পর্যন্ত ভারতীয়রাই কাজটা সম্পূর্ণ করছিল, খরচ হয় মাত্র আট কোটি টাকা।
      বিক্রম বিশ্বাস করতেন বিজ্ঞান গবেষণা মানুষের কল্যাণের জন্য, তাই হয়তো নিজেকে বিজ্ঞানের সীমার মধ্যে  আবদ্ধ রাখেননি। তাঁর চেষ্টাতেই ভারতের প্রথম ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট বা আইআইএম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আমেদাবাদে, ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন তার অবৈতনিক অধিকর্তা। আমেদাবাদের অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের কথা বলতেই হয়, তা হল আমেদাবাদ টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিস রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন। মিলমালিকদের অর্থে শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান কিভাবে বস্ত্র শিল্পে বিজ্ঞানের প্রয়োগ ঘটানো সম্ভব তা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছে। ভারতে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান এর আগে তৈরি হয়নি। এটি সৃষ্টির পিছনেও বিক্রম সরাভাইয়ের উদ্যোগ ছিল, তিনি ছিলেন এরও প্রথম অবৈতনিক অধিকর্তা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত তিনি এই দায়িত্ব সামলেছেন। তিনি ও মৃণালিনী মিলে তৈরি করেছিলেন দর্পণা অ্যাকাডেমি অফ পারফর্মিং আর্টস।  
      প্রতিষ্ঠান নির্মাণ ও একসঙ্গে অনেকগুলি দায়িত্ব সফলভাবে বহন করার এক অনন্যসাধারণ ক্ষমতা ছিল বিক্রম সরাভাইয়ের। ১৯৪৭ সালে আমেদাবাদে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতে তিনি তৈরি করেছিলেন ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি বা পিআরএল। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭১ তিনি ছিলেন এর অধিকর্তা, তার আগেও অবশ্য তিনিই ছিলন এর মূল চালক। একই সময়ে তিনি পিআরএল, আইআইএম, নিজের কোম্পানি সামলেছেন। আবার এরই মধ্যে ১৯৬২ সালে তাঁরই উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ যা ১৯৬৯ সালে ইসরোতে রূপান্তরিত হয়েছিল। দুটিরই প্রধান ছিলেন তিনি, প্রথমে থুম্বা ও পরে শ্রীহরিকোটাকে রকেট উৎক্ষেপণ কেন্দ্র হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন বিক্রম। এমনকি একবার গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদেও তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন, কিন্তু রাজনীতির জগতের কলাকৌশলে তাঁর পরাজয় ঘটে।
      বিক্রমের এই সংক্ষিপ্ত পরিচয় থেকে বোঝা সম্ভব কেন বিমান দুর্ঘটনাতে ভাবার মৃত্যুর পরে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে তাঁর নাম এসেছিল। তারও আগে কাউন্সিল ফর সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ বা সিএসআইআরের প্রথম অধিকর্তা শান্তিস্বরূপ ভাটনগরের মৃত্যুর পর বিক্রমের নাম উঠেছিল, তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছত্রিশ বছর। ভাবার ইচ্ছা ছিল তাঁর পরে বিক্রমই পরমাণু শক্তি কমিশনে তাঁর জায়গা নেবেন। সেজন্য ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ভাবা তাঁকে পরমাণু শক্তি কমিশনের সদস্য করেন। সরাভাইয়ের ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ ছিল ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জির অধীনে।
      ১৯৬৬ সালের ১১ জানুয়ারি ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর তাসখন্দে আকস্মিক মৃত্যু হয়। ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন ২৪ জানুয়ারি। সেই দিনই বিমান দুর্ঘটনাতে ভাবার মৃত্যু হয়। নতুন প্রধানমন্ত্রী তখন রাজনীতিতে খুব একটা প্রভাবশালী ছিলেন না, কংগ্রেস দলের অভ্যন্তরে বিবদমান দুই পক্ষ প্রধানমন্ত্রী পদে কোনো নামে সম্মত হতে পারেননি, তখন তাঁরা ইন্দিরাকে বেছে নিয়েছিলেন। কংগ্রেসের প্রবীণ নেতৃত্বের  বিশ্বাস ছিল যে ইন্দিরাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব সহজ হবে।
      ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পরমাণু শক্তি কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রথমে যোগাযোগ করা হয় পরবর্তীকালের নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী সুব্রহ্মনিয়ান চন্দ্রশেখরের সঙ্গে, কিন্তু তিনি উৎসাহী ছিলেন না। তাছাড়া সরকারের উঁচু মহলে জানা ছিল না যে তিনি মার্কিন নাগরিক। পরমাণু গবেষণার মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে তাঁকে নিয়োগ করতে গেলে আপত্তি আসা স্বাভাবিক। এর পরেই আসে বিক্রমের নাম। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালনাতে তাঁর সাফল্যের কথা তখন সরকারি মহলে সুবিদিত। পারিবারিক সূত্রে রাজনৈতিক মহলে তাঁর যোগাযোগ ছিল এমনকি ভাবার থেকেও বেশি। শিল্পপতিদের থেকেও তাঁর নাম নিয়ে কোনো আপত্তি আসার কথা নয়, তাঁরা জানতেন বিক্রম তাঁদেরই একজন। দেশে পরমাণু গবেষণাতে তখন অর্থবরাদ্দের পরিমাণ ক্রমশ বাড়ছে, ভারতীয় বৃহৎ শিল্প মহল সেদিকে নজর রেখেছিল। শুধু তাই নয়, শিল্পপতিরা জানতেন দেশে সফলভাবে পরমাণু শক্তি সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প রূপায়িত করতে পারলে বিদেশেও অনুরূপ কাজের বরাত পাওয়া সম্ভব। মনে রাখতে হবে ১৯৬০-এর দশকে পরমাণু শক্তি বিষয়ে আগ্রহ সারা পৃথিবীতে শীর্ষে পৌঁছেছিল, তখনও পরমাণু বিদ্যুৎ আজকের মতো ব্রাত্য হয়ে যায়নি।তাঁদের আশাও সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল; টাটারা বা লারসেন এন্ড টুব্রো পরমাণু শক্তি বিভাগের থেকে বড় প্রকল্পের বরাত পায়। পরমাণু শক্তি সংস্থাও ভারতে তৈরি প্রযুক্তি ভারতীয় শিল্পের কাছে হস্তান্তর করতে চাইছিল। বিক্রম সরাভাই সরকার ও শিল্পপতি উভয়পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিলেন।
      বিক্রমের নাম বেছে নেওয়াতে নতুন প্রধানমন্ত্রীরও স্বার্থ ছিল। আমেদাবাদে সরাভাই পরিবারের আতিথ্যগ্রহণের সুবাদে ইন্দিরা বিক্রমকে আগে থেকেই বিশেষ করে চিনতেন। বিক্রম তাঁর প্রায় সমবয়সী, হয়তো তরুণ কাউকে নিয়োগ করে বয়স্ক কংগ্রেসি নেতৃত্বকে অগ্রাহ্য করার কথা তিনি ভেবেছিলেন। কংগ্রেসের মধ্যে তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন মোরারজি দেশাই। গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে মোরারজি বিক্রমের বিরোধিতা করেছেন, সেই কথাও হয়তো প্রধানমন্ত্রীর মাথায় ছিল।তিনি কংগ্রেসের প্রবীণ নেতৃত্বের থেকে শিল্পপতিদের নিজের দিকে আনতে চাইছিলেন, বিক্রমকে নিয়োগ করা তার একটা ধাপ। বিক্রমের পরিবার থেকে আপত্তি ছিল, কারণ সরকারি নিয়মে তাঁর পক্ষে আর পারিবারিক ব্যাবসাতে যুক্ত থাকা সম্ভব ছিল না।  মৃণালিনীও আপত্তি জানিয়েছিলেন, একসঙ্গে এত দায়িত্ব নেওয়া তাঁর শরীরের পক্ষে ভালো হবে না। সেই কথাই সত্যি হয়েছিল। তবে বিক্রম দেশের কাজে নিজেকে নিয়োগ করতে চেয়েছিলেন, তাই সব আপত্তি অগ্রাহ্য করে মাত্র এক টাকা বেতনে তিনি তাঁর পদে যোগ দেন।
      ভাবা একই সঙ্গে অনেকগুলি পদে ছিলেন। সেগুলি তিনজনের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। বিক্রম হলেন পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান, ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জি বা ডিএইর সচিব এবং ইলেকট্রনিক্স কমিটির চেয়ারম্যান। এম জি কে মেনন হলেন মুম্বাইয়ের টাটা ইন্সটিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চের অধিকর্তা। হোমি সেঠনা বিশ্বাস করতেন ভাবার জায়গাটা তাঁরই পাওয়া উচিত, তাঁকে ট্রম্বের পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র অর্থাৎ বর্তমানের ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের অধিকর্তা করা হয়। তিনি অবশ্য খুশী হননি, বিক্রমের অধীনে তাঁকে কাজ করতে হচ্ছিল। সেঠনা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার, তাঁকে অধিকর্তা করা নিয়ে বিজ্ঞানীমহলেও অসন্তোষ ছিল। পরবর্তীকালে বার বার তিনি বিক্রমের বিরোধিতা করেছেন। বিক্রম ধৈর্য ধরে তাঁকে সহ্য করেছেন। বিক্রম সবাইকে নিয়ে চলাতে বিশ্বাস করতেন, তাঁর পারিবারিক জীবনেও তিনি তার প্রমাণ রেখেছেন। তাই অধস্তন হলেও তিনি কখনোই সেঠনার উপরে জোর করে নিজের মতামত চাপিয়ে দেননি। টি এন শেষন সেই সময়ে  ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জির সেক্রেটারিয়েটে কর্মরত ছিলেন, তিনি বেশ কয়েকবার এই ধরনের মোকাবিলার সাক্ষী।
      ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের ইতিহাস শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার আগেই। সেই সময় ভাবা ও মেঘনাদ সাহার মধ্যে বিরোধের ইতিহাস হয়তো অনেকেরই জানা। সাহা ধীরে ধীরে এগোনোর পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর মতে প্রথমেই পরমাণু বিদ্যুতের কথা না ভেবে ভারতবর্ষের উচিত চিকিৎসা বিজ্ঞানে নিউক্লিয় প্রযুক্তির ব্যবহার। ভাবা অপরপক্ষে সরাসরি দেশীয় প্রযুক্তিতে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলেছিলেন। নেহরু ভাবার পক্ষ নিয়েছিলেন, ভারতের পরমাণু গবেষণা নীতি প্রণয়নে সাহার কোনো ভূমিকা ছিল না। সেখানে ভাবাই সর্বেসর্বা। শুধু পরমাণু গবেষণা নয়, দেশের বিজ্ঞান জগতে ভাবার প্রভাব খুবই সুস্পষ্ট। নেহরু বিজ্ঞান গবেষণাগারগুলিকে আধুনিক ভারতের মন্দির বলেছিলেন, এই কথার মধ্যে ভাবার সঙ্গে তাঁর চিন্তার মিল খুঁজে পাওয়া যায়। আমাদের বিজ্ঞানীদের বড় করে ভাবতে শিখিয়েছিলেন ভাবা। এমনকি ভারতের অন্যতম ধনী পরিবার থেকে আসা বিক্রম সরাভাইয়ের ক্ষেত্রেও কথাটা সত্যি। থুম্বাতে অফিস তৈরির সময় বিক্রম সরাভাই দুশো জন কর্মচারীর কথা ভেবেছিলেন, ভাবা বলেন যে অন্তত চারশো লোকের জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিস করতে হবে। প্রসঙ্গত বলা যায়, বিক্রম পিআরএলে অধিকর্তার অফিসেও এসির ব্যবস্থা করেন নি।
      কিন্তু মূলত তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ভাবা স্পষ্টতই পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের সম্ভাব্য অসুবিধাগুলিকে কমিয়ে দেখেছিলেন। ১৯৬৫ সালের মধ্যে এক হাজার মেগাওয়াট লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হলেও সেই সময়সীমার মধ্যে কোনো পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনই সম্ভব  হয়নি। দেশীয় প্রযুক্তির বিকাশ তখন বহুদূর। পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচকেও অনেক কমিয়ে ধরা হয়েছিল। ফলে ডিএইর মূল লক্ষ্য নিয়েই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। কিন্তু নতুন পদে যোগ দেওয়ার সময় প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে বিক্রম সরাভাইকে একটাই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছিল, পরমাণু বোমার কী হল?
      পরমাণু শক্তি কমিশনের ঘোষিত লক্ষ্য ছিল নিউক্লিয় শক্তির শান্তিপূর্ণ প্রয়োগ। কিন্তু ধীরে ধীরে ভারতের নিরাপত্তা ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা বাড়ছিল। পরমাণু রিঅ্যাক্টরে বিদ্যুৎ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে প্লুটোনিয়াম বা এনরিচড ইউরেনিয়াম পাওয়া সম্ভব যা হল পরমাণু বিস্ফোরণের প্রধান কাঁচামাল। নেহরু কিন্তু প্রথম থেকেই ভারতের পরমাণু নীতিকে বিদেশ নীতির অঙ্গ হিসাবে ব্যবহার করেছেন। ভারতের ঘোষিত নীতি ছিল সমস্ত দেশই সমান, তাই পরমাণু শক্তিধর দেশগুলি তাদের অস্ত্র ধ্বংস না করলে ভারত শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরমাণু বিস্ফোরণের অধিকার বজায় রাখবে, ননপ্রলিফারেশন ট্রিটি বা এনপিটিতে স্বাক্ষর করবে না। বিস্ফোরণ ঘটালে এই নৈতিক অবস্থান দুর্বল হতে বাধ্য। ১৯৬২ সালে চীন ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পরেই চীন খুব অল্প দিনের মধ্যে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটাবে, এই কথা জানিয়ে ভাবা নেহরুর থেকে বিস্ফোরণ ঘটানোর অনুমতি চান। নেহরু পত্রপাঠ তাঁকে না বলে দেন। 
প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, শান্তিপূর্ণ বিস্ফোরণের জন্য নিশ্চয় পরমাণু বোমার প্রয়োজন, কিন্তু অস্ত্র থেকে তার উদ্দেশ্য আলাদা। সেই সময় খনি বা পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরির কাজে পরমাণু বিস্ফোরণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বিভিন্ন দেশের মধ্যে আলোচনা চলছিল। এমনকি দুই সুপার পাওয়ার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এনপিটিতে সইয়ের পরিবর্তে বিভিন্ন দেশকে সেই রকম বিস্ফোরক দেওয়ার বিষয়েও উৎসাহী ছিল। অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের জন্য শুধু বোমা নয়, আরো অনেক কিছু প্রয়োজন। বিক্রম তাঁর প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে সেই কথাই বলবেন -- সে প্রসঙ্গে আমরা পরে আসছি।
বিস্ফোরণের জন্য নেহরুর মৃত্যুর পর থেকে পরমাণু নীতিতে বিজ্ঞানীদের প্রভাব বাড়ছিল, তাঁরা বিস্ফোরণের বিষয়ে উৎসাহী ছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল প্রাযুক্তিক ও সামরিক ক্ষমতা প্রদর্শন। ইট্টি আব্রাহাম তাঁর ‘দি মেকিং অফ দি ইন্ডিয়ান অ্যাটমিক বম্ব’ বইতে বলেছেন পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিলম্বের ফলে বিজ্ঞানীদের উপরেও চাপ বাড়ছিল, তাঁরা তখন সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে পরমাণু গবেষণার প্রয়োজনীয়তার উপরে জোর দিতে থাকেন। নেহরুর মৃত্যুর কয়েকমাস পরে ভাবা আকাশবাণীতে এক বক্তৃতার সময় পরমাণু অস্ত্র বিষয়ে আলোচনা করেন। তাঁর মতে পরমাণু অস্ত্রে খরচ সমমানের সাধারণ অস্ত্রের থেকে অনেক কম পড়বে। এক মাস পরেই অবশ্য প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বলেন যে পরমাণু অস্ত্র বানানোর খরচ ভাবা যা বলেছিলেন তার থেকে অনেক গুণ বেশি। কিন্তু বিজ্ঞানীদের দিক থেকে চাপ বজায় ছিল। বিজ্ঞানী রাজা রামান্নার কথা থেকে জানা যায় যে পরমাণু শক্তি কমিশনে কখনো পরমাণু বিস্ফোরণের নৈতিকতা নিয়ে আলোচনা হয়নি। বিস্ফোরণের পিছনে বিজ্ঞানীদের সমর্থনকে এভাবেই ব্যাখ্যা করেছেন রামান্না, “For us it was a matter of prestige that would justify our ancient past... Also, as Indian scientists we were keen to show our Western counterparts, who thought little of us thise days, that we too could do it.”
বিজ্ঞানীদের সমর্থনে এ কথা বলতেই হয় যে ভাবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি মেনেই শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে বিস্ফোরণ ঘটাতে তাঁদের সহযোগিতা চেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি প্রত্যাখ্যাত হন। তার পরেই বিজ্ঞানীরা শাস্ত্রীর উপরে চাপ আরো বাড়ান। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৫ সালে কচ্ছের রনে পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘর্ষের পরে শাস্ত্রী ভাবাকে ‘শান্তিপূর্ণ’ পরমাণু বিস্ফোরণ বিষয়ে তাত্ত্বিক কাজের অনুমতি দিয়েছিলেন, শর্ত ছিল তাঁর অনুমতি ছাড়া হাতে কলমে কোনোরকম কাজ শুরু করা যাবে না। ভাবা রাজা রামান্নার নেতৃত্বে এক গ্রুপ গঠন করেন সেই উদ্দেশ্যে। এর অল্পদিন পরেই দুর্ঘটনাতে তাঁর মৃত্যু হয়।
      স্বাভাবিক ভাবেই জনমানসে বিদ্যুতের থেকে পরমাণু বোমা বিষয়ে আগ্রহ অনেক বেশি। সাংবাদিক সম্মেলনে পরমাণু শক্তি কমিশনের নতুন চেয়ারম্যান বিক্রম সরাভাই ব্যাখ্যা করে বলে যে তাঁর কাছে পরমাণু বোমার প্রোটোটাইপ কাগুজে বাঘের থেকে বেশি কিছু নয়। পরমাণু বোমা ফাটিয়েই প্রতিরক্ষা সম্ভব নয়, তার জনয় প্রয়োজন মিসাইল ও রাডার প্রযুক্তি এবং ইলেকট্রনিক্স ও অন্যান্য সংযুক্ত শিল্পের উন্নতি সাধন। দেশের ভিতর থেকেও নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে, তার জন্য প্রয়োজন জনগণের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।
      দেশে মহাকাশ গবেষণা শুরু করেছিলেন সরাভাই, তাই জুনিয়ররা সব বিষয়ে তাঁর মত শুনতে ও মেনে চলতে অভ্যস্ত ছিল। কিন্তু পরমাণু শক্তি কমিশনের কথা আলাদা। সেখানে বিস্ফোরণের সমর্থকরা ধরে নিয়েছিলেন যে বিক্রম তাঁদের বিরোধী। বিক্রম এর আগে বিখ্যাত নিরস্ত্রীকরণ সংক্রান্ত পাগওয়াশ সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। তাই তাঁদের সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়েছিল। সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে বিজ্ঞানীদের থেকে পরমাণু বোমা সংক্রান্ত সিদ্ধান্তকে বিক্রম রাজনৈতিকদের হাতে তুলে দিতে চাইছিলেন। তাঁরই কথার প্রতিধ্বনি করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লোকসভাতে বলেন, পরমাণু অস্ত্র কখনোই সাধারণ অস্ত্র ও সামরিক প্রস্তুতির বিকল্প হতে পারে না। বরঞ্চ তার অর্থনৈতিক দায় আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে বিপন্ন করতে পারে। কিন্তু দুজনের এই মতৈক্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। রাজ চেঙ্গাপ্পা তাঁর ‘ওয়েপনস অফ পিস’ বইতে অনুমান করেছেন যে পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীরা সরাভাইকে এড়িয়ে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী চিরকালই নিজের ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থে তাঁর অধস্তনদের একজনকে অন্যজনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতেন। বিক্রমের প্রতি সহানুভূতি সত্ত্বেও এই সুযোগ তিনি ছেড়ে দেননি।
পরমাণু বিদ্যুতের বিষয়ে বিক্রম বেশ কিছু নতুন পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। সংক্ষেপে বলা যায় পরমাণু বিদ্যুতের ব্যবহার করে গ্রামীণ জনগণের উন্নতি ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। তবে অনেক নিরপেক্ষ সমালোচকের মতে সেগুলি ছিল উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা। ডিএইর ভিতরে সরাভাইয়ের এই পরিকল্পনার রূপায়ণের পদ্ধতি নিয়েও আপত্তি ছিল, তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছিল এবং সরকারের অভ্যন্তরে সরাভাইয়ের অবস্থানকে দুর্বল করেছিল। তবে এ নিয়ে আলোচনা এই লেখার পরিধির বাইরে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি এল কে ঝা ও বিক্রম এক নতুন পথ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন যে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলি যৌথ ভাবে নিউক্লিয় অস্ত্র প্রয়োগের বিষয়ে চুক্তিভঙ্গকারীকে শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা করুক। বিনিময়ে ভারত এনপিটিতে স্বাক্ষর করবে। তবে ঝা ও সরাভাইয়ের এই প্রস্তাব পরমাণু শক্তি কমিশনের বিজ্ঞানীদের মনঃপূত ছিল না, কারণ এতে ভারত পরমাণু পরীক্ষার সুযোগ হারাবে। কিছুদিন আগে লালবাহাদুর শাস্ত্রী এই ধরনের এক প্রস্তাব দিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও নতুন প্রধানমন্ত্রী এক কথায় এই প্রস্তাব উড়িয়ে দেননি, বোঝা যায় সেই মুহূর্তে তিনি বিক্রমের উপর যথেষ্টই নির্ভরশীল ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর চিঠি নিয়ে বিক্রম মস্কো ওয়াশিংটন, লন্ডন ও প্যারিসে গিয়েছিলেন। ফ্রান্স ও ব্রিটেন তাঁর প্রস্তাবের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্মতি বিক্রম পাননি। ১৯৬৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ঘোষণা করেন ভারত এনপিটিতে স্বাক্ষর করবে না।
বিক্রম কিন্তু সরাসরি বিস্ফোরণের বিরোধিতা করেন নি। এ কথা নিশ্চিত যে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের একদল বিজ্ঞানী পরমাণু অস্ত্র বিষয়ে কাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে রামান্না রাজগোপাল চিদাম্বরমকে বোমার ডিজাইনের উপর কাজ করার নির্দেশ দেন। চিদাম্বরম ও পদ্মনাভ আয়েঙ্গার ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের অধিকর্তা বাসন্তীদুলাল নাগচৌধুরির সঙ্গে মিলে এ বিষয়ে কাজের জন্য একটি দল তৈরি করেন। বিক্রম এ কথা জানতেন না, তা হতে পারে না। কিন্তু কখনোই তাদের বারণ করেন নি।  কিছুদিন পরে রামান্না এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্টও সরাভাইয়ের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ১৯৬৮ সালে আয়েঙ্গার রাশিয়াতে এক পরমাণু রিঅ্যাক্টর দেখে মনে করেছিলেন যে কারো সন্দেহ না উদ্রেক করে পরমাণু বিস্ফোরণের প্রযুক্তির  সম্পর্কে গবেষণতে তা সাহায্য করবে। তাঁর কথাতে বিক্রম সেই ধরনের রিঅ্যাক্টরের ডিজাইন বিষয়ে কাজের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন। আয়েঙ্গার বুঝতে পারেন যে বিক্রম এ বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের পক্ষেই। ১৯৭০ সালে বিক্রম ঘোষণা করেন যে ভারত পরমাণু অস্ত্র চায় না, কিন্তু শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে বিস্ফোরণ ঘটানোর অধিকার ছেড়ে দেবে না। তার কদিন পরে তিনি যে দশ বছরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন, তাতে শান্তিপূর্ণ বিস্ফোরণ বা পরমাণু অস্ত্র সংক্রান্ত কোনো কথা ছিল না। সেখানে পরমাণু বিদ্যুৎ তৈরির  লক্ষ্যমাত্রাকে কমিয়ে অনেকটা বাস্তবোচিত করা হয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা দেখেন যে এই বাস্তবোচিত পরিকল্পনা রূপায়িত হলে ভারতের হাতে যে পরিমাণ প্লুটোনিয়াম আসবে, তার সামরিক গুরুত্ব যথেষ্ট। সেঠনা মনে করেন যে আন্তর্জাতিক মহলে তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরে বিক্রম তাঁর অস্ত্রবিরোধী অবস্থান থেকে সরে আসেন।
      বিক্রমের ব্যক্তিগত মত যাই হোক, রাজনীতিই শেষ পর্যন্ত ভারতের পরমাণু নীতি নিয়ন্ত্রণ করেছিল। ১৯৬৬ সালে যে দাবীই উঠুক না কেন, ভারতের পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটানোর ক্ষমতা ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটছিল। ১৯৭০ সালে বিক্রম এক সাক্ষাকারে বলেন যে আঠারো মাসের মধ্যে ভারত মাটির তলায় বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম, তার সেই অধিকারও আছে। বোঝাই যায় যে সরকার তার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে, তা না হলে বিক্রম এই কথা বলতেন না। সেই বছরই সরকার জানতে চায় পরমাণু বিস্ফোরণের জন্য কত অর্থ প্রয়োজন। বিক্রম যাঁকে হিসাব করার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেই শেষগিরি মনে করেন বিক্রম ব্যক্তিগতভাবে বিস্ফোরণ ঘটানোর পক্ষে ছিলে না, তিনি আশা করেছিলেন শান্তিপূর্ণ বিস্ফোরণের খরচও অনেক বেশি প্রমাণ হবে। এক বছর পরে জমা পড়া রিপোর্ট তাঁর সেই আশাতে জল ঢেলে দেয়। দেশের মধ্যেও পরমাণু পরীক্ষার জন্য দাবি উঠতে থাকে। প্রাক্তন সেনা প্রধান কারিয়াপ্পার মতো কয়েকজনের বিরোধিতা সত্ত্বেও সরকারও সেই পথে পা বাড়ায়।
      ইতিমধ্যে ইন্দিরা গান্ধী প্রবীণ কংগ্রেসিদের হটিয়ে দিয়ে দলের মধ্যে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তাঁর নেতৃত্বে কংগ্রেস বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে। ইন্দিরা ভারতকে সামরিক দিক থেকে শক্তিধর রাষ্ট্রের দলভুক্ত হওয়ার জন্য যা প্রয়োজন, তা করতে দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। এই সময়েই ভারতের মিসাইল তৈরির প্রকল্পের শুরু হয়। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের সমস্যা ভারতের সামনে আসে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ আসন্ন হয়ে পড়ে। সেই সম্ভাবনাও নিশ্চয় ইন্দিরা গান্ধীর মনে প্রভাব ফেলেছিল। সরকারি ভাবে  সিদ্ধান্ত না হলেও তিনি নিজের মনে পরমাণু পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন। বিক্রম কখনোই প্রকাশ্যে সরকারী নীতির বিরোধিতা করেন নি। কিন্তু ইন্দিরা নিশ্চিত হতে পারছিলেন না যে সরকার পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নিলেও বিক্রম সেই অবস্থানে দৃঢ় থাকবেন। পরামর্শদাতাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রধানমন্ত্রী স্থির করেন যে পরমাণু শক্তি ও মহাকাশ গবেষণাকে দুটি পৃথক বিভাগ করা হবে। একজনের পক্ষে দুটিই সামলানো সম্ভব হবে না, তাই বিক্রম নেবেন দ্বিতীয়টির দায়িত্ব। সেঠনা হবেন পরমাণু শক্তি কমিশনের   চেয়ারম্যান। এমনকি যদি নিজেকে অপমানিত মনে করে বিক্রম সমস্ত পদই ছেড়ে দেন, তাহলে মহাকাশ বিভাগের দায়িত্ব কাকে দেওয়া হবে, তা নিয়েও সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে।
      প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিক্রমের এই নিয়ে কোনো কথা হয়েছিল কিনা তার কোনো লিখিত প্রমাণ নেই। টি এন শেষন সহ অন্য অনেকেই অবশ্য নিশ্চিত যে ইন্দিরা বিক্রমকে জানিয়েছিলেন এবং বিক্রম তাতে ভেঙে পড়েছিলেন। বিক্রম নিশ্চয় বুঝতে পেরেছিলেন যে প্রধানমন্ত্রীর বিশ্বাস তিনি হারিয়েছেন। বাইরের লোক ধরতে না পারলেও তাঁর ঘনিষ্ঠদের কাছে তাঁর আচরণের পরিবর্তন লুকানো ছিল না। মৃণালিনী বলেছেন যে সেই সময় বিক্রম ব্যক্তিগত জীবনে ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে গেছেন। অমানুষিক পরিশ্রম করতেন বিক্রম, সম্ভবত সেই কারণেই তাঁর শরীরও ভেঙে পড়ছিল। ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন, এভাবে চললে আপনি মারা যাবেন।  যাই হোক না কেন, বিক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে সরকারি স্তরে কোনো সিদ্ধান্তের আগেই ১৯৭১ সালের ২৯ ডিসেম্বর রাত্রিবেলা ঘুমের মধ্যে বিক্রমের মৃত্যু হয়।
      পরমাণু বিস্ফোরণ নিয়ে বিক্রম কিছুটা দোদুল্যমান অবস্থান নিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। ইন্সটিটিউট অফ ডিফেন্স স্টাডিজের অধিকর্তা কে সুব্রহ্মনিয়মের এক প্রশ্নের উত্তরে সরাভাই বলেন, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে থেকে এই সুযোগ কেড়ে নেওয়ার আমি কে? আমি শুধু এ কথা বলতে পারি যে এই মুহূর্তে আমি পরমাণু বোমার বিরোধী। এই উক্তিটার মধ্যেই সম্ভবত তাঁর অবস্থানকে বোঝা যায়। মানবতাবাদী হিসাবে তিনি পরমাণু অস্ত্রের বিরোধী হলেও বিজ্ঞানী হিসাবে প্রযুক্তিকে তিনি অগ্রাহ্য করতে পারেননি আবার তিনি নিজেই পরমাণু বিস্ফোরণ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত থেকে বিজ্ঞানীদের সরিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন, তাই সরকার যখন পরমাণু পরীক্ষার পথ ধরবে স্থির করে, তখন তাঁর পক্ষে বিরোধিতা করার সুযোগ ছিল না। মনে পড়ে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে পরমাণু বোমা তৈরির সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীদের একটা অংশ জাপানে বোমা ফেলার বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু মার্কিন সরকারের নীতিতে তা কোনো প্রভাব ফেলেনি।
      এ কথাও সত্যি যে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদনের নানা পরিকল্পনা অতিরিক্ত খরচসাপেক্ষ হলেও সরকারি অনুমোদন যে খুব সহজেই পেত, তার কারণ তাদের সঙ্গে পরমাণু বিস্ফোরক তৈরির প্রয়োজনীয় কাঁচামাল পাওয়া যাবে। বিক্রম নিশ্চয় তা জানতেন।  ১৯৬৮ সাল থেকে বিক্রমের বিভিন্ন বিবৃতি, ভাষণ ও লেখা থেকে বোঝা যায় তিনি পরমাণু অস্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির অর্জনের বিরোধী ছিলেন না, ছিলেন পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার বিরোধী। তাঁর কাছে পরমাণু বোমা চিরকালই কাগুজে বাঘ রয়ে গিয়েছিল, অন্যান্য বিষয়ে প্রযুক্তির উন্নতি ছাড়াই তা দেশের নিরাপত্তাতে কোনো সাহায্য করতে পারে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। অপর একটা সমস্যা তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে ভাবিয়েছিল। বিস্ফোরণ মানেই বিদেশ থেকে উন্নত প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা নেমে আসবে। তাহলে তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় মহাকাশ গবেষণার কী হবে? শুধুমাত্র দেশীয় প্রযুক্তির সাহায্যে চালানোর মতো সাবালকত্ব অর্জনের তখনো বহু পথ বাকি। ১৯৭৪ সালের ১৮ মে পোখরানে বিস্ফোরণের পরে বিক্রমের অনেক আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র
Vikram Sarabhai: A Life, Amrita Shah
Nucleus and Nation, Robert Anderson    

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, শারদীয় ২০১৯    

Sunday 6 October 2019

সাহা সমীকরণঃ শতবর্ষ


সাহা সমীকরণঃ শতবর্ষ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      আমরা সবাই মেঘনাদ সাহার নাম জানি, এও জানি যে তিনি যে তাপ-আয়নন সমীকরণ আবিষ্কার করেছিলেন তা এখন তাঁর নামে পরিচিত। সাহা সমীকরণ হল জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার এক মূল স্তম্ভ। শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারের বৈশিষ্ট্য হল যে বিশেষ ক্ষেত্রের জন্য সে প্রতিষ্ঠিত তাকেও ছাড়িয়ে যাবে। সাহা সমীকরণের জন্যও একথা সত্য। আজ থেকে একশো বছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে গবেষণারত তরুণ মেঘনাদ সাহা তাঁর সমীকরণটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

      মেঘনাদ সাহার জীবন পাঠকের অজানা নয়। ঢাকার কাছে শেওড়াতলি গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর তাঁর জন্ম। শুধুমাত্র নিজের জেদের জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ম্যাট্রিক ও ইন্টারমিডিয়েট দুটি পরীক্ষাতেই তৃতীয় হয়েছিলেন, সারা পূর্ববঙ্গের মধ্যে প্রথম। এরপর গণিত নিয়ে পড়ার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হলেন, সহপাঠী পেলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে বিএসসি ও এমএসসিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দ্বিতীয় হয়েছিলেন মেঘনাদ, প্রথম সত্যেন্দ্রনাথ। এমএসসি পাস করার পরে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় দুই বন্ধুকে মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত বিজ্ঞান কলেজে পড়ানোর নির্দেশ দেন, কিছুদিন গণিত বিভাগে কাটিয়ে তাঁরা পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে পড়ানো ও গবেষণা শুরু করেন। তার চার বছরের মধ্যে মেঘনাদ আবিষ্কার করেন তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ যা নক্ষত্রদের অভ্যন্তরকে বোঝার চাবিকাঠি আমাদের হাতে তুলে দেয়। অল্প দিন বিদেশের গবেষণাগারে কাটিয়ে ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯২৩ সালে তিনি এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। চোদ্দ বছর পরে আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ফিরে আসেন। সেখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যা এখন তাঁর নামাঙ্কিত। ১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর জীবনাবসান হয়।
মেঘনাদ ও সত্যেন্দ্রনাথ দুজনেই নামে ছিলেন সি ভি রমনের সহকারী, কিন্তু তাঁরা স্বাধীন ভাবেই কাজ করতেন। রমনও তাঁদের সেই নিয়ে কখনো কিছু বলেন নি। গবেষণার ক্ষেত্রে সাধারণত একজন গাইড থাকেন যিনি দিকনির্দেশ করে দেন। সেইরকম কেউ ছিলেন না,  মেঘনাদ তাই বিকিরণ,  স্থিতিস্থাপকতা, ইলেকট্রন তত্ত্ব এরকম নানা বিষয়ে গবেষণা করছেন  সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে একসঙ্গে গ্যাসের আণবিক গতি তত্ত্ব নিয়েও একটা গবেষণা করেছিলেন।  বিকিরণ ও তার চাপ সংক্রান্ত থিসিস জমা দিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি ডিগ্রি পান। মেঘনাদই বিজ্ঞান কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগের শিক্ষকদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট।
১৯১৯ সালে ক্লাসে তাপগততত্ত্বে রাসয়ানিক বিক্রিয়া পড়ানোর সময় জার্মান বিজ্ঞানী এগার্টের একটি গবেষণাপত্র তাঁর নজরে আসে। এগার্ট নক্ষত্রের ভিতরে উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণু ও আয়নের ভেঙে যাওয়াকে তাপগতিতত্ত্বে রাসয়ানিক বিক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। মেঘনাদ দেখলেন যে এগার্টের পদ্ধতিতে কয়েক বছর আগে আবিষ্কৃত নিলস বোরের পরমাণুর মডেল ব্যবহার করা প্রয়োজন। বোরের মডেলে পরমাণুর অভ্যন্তরে ইলেকট্রনগুলি কয়েকটি শক্তিস্তরে থাকতে পারে।

একটি চিঠি। প্রেরক হেনরি নরিস রাসেল, প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। প্রাপক মেঘনাদ সাহা।
      “সৌর কলঙ্কের বর্ণালী বিশ্লেষণ করে ক্ষার ধাতুর অস্তিত্ব নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎবাণী পুরোপুরি মিলে গেছে। সূর্যে রুবিডিয়ামের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আমরা আপনার অন্যান্য সিদ্ধান্তগুলোও পরীক্ষা করে দেখছি
আর্থার এডিংটন ছাত্রী সিসিলিয়া পেইনের উচ্ছ্বাস দেখে মনে মনে হাসলেন। ‘নক্ষত্রে হাইড্রোজেনের পরিমাণ বেশি বলতে তুমি নিশ্চয় নক্ষত্রের বাইরের তলে বলতে চাইছ, ভিতরে নয়
      বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টের কথার প্রতিবাদ করতে পেইনের গলা একটুও কাঁপল না। ‘না, আমি তারাদের অভ্যন্তরের কথাই বলছি। আপনিও রাসেলের মতো একই ভুল করছেন। আপনি যদি মাউন্ট উইলসনের দূরবীন থেকে তারাদের বর্ণালীর যা হিসাব পাওয়া গেছে, তা সাহার সমীকরণে বসান, একটাই সিদ্ধান্ত হয়। নক্ষত্রদের ভরের নিরানব্বই শতাংশই হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম ঠিক আছে, আপনারা দুজনেই যখন বলছেন, আমি আমার থিসিসে হাইড্রোজেন আর হিলিয়ামের মাপটার উপর জোর দেব না। কিন্তু, দেখে নেবেন, আমি ঠিকই বলছি। সাহার সমীকরণ থেকে আমরা নক্ষত্ররা কী দিয়ে তৈরি, তা জানতে পারছি
      ‘তাই যদি হয়, তাহলে সাহা সমীকরণ হবে দূরবিন আবিষ্কারের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানে সেরা দশ আবিষ্কারের একটা’ এডিংটন নিজের মনেই ভাবলেন।

      আমরা সবাই বর্ণালী কথাটা শুনেছি। বর্ণালীতে আলো বিভিন্ন রঙে ভেঙে যায়। বিভিন্ন রঙের আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য আলাদা আলাদা। সূর্যের বা অন্যান্য নক্ষত্রের আলোর বর্ণালীতে আমরা উজ্জ্বল পশ্চাৎপটের ওপর কালো কালো দাগ দেখতে পাই। এই ধরনের বর্ণালীকে বলে শোষণ বর্ণালী। এর উৎস কী?  বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ বিভিন্ন রঙের আলো শোষণ করে। সূর্যের কেন্দ্রের অঞ্চল (যেখানে নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়াতে তাপ উৎপন্ন হয় বলে আমরা এখন জানি) প্রচণ্ড উত্তপ্ত, সেখান থেকে আলো বেরোয়। সূর্যের একদম বাইরের স্তর আলোকমণ্ডল (photosphere) ও বর্ণমণ্ডল (chromosphere) যে সমস্ত মৌল আছে, তারা তাদের চরিত্র অনুযায়ী কোনো কোনো তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে, ফলে সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আমাদের কাছে এসে পৌঁছায় অপেক্ষাকৃত অনেক কম পরিমাণে। বর্ণালীতে সেই সমস্ত তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গায় কালো দাগগুলো দেখতে পাওয়া যায়। তাই সূর্যের বা অন্য নক্ষত্রের শোষণ বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কোন কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের জায়গায় কালো দাগ অর্থাৎ অন্ধকার, তা দেখে কোন কোন মৌলের পরমাণু সেখানে আছে তা বলা সম্ভব।
      বর্ণালীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষকরা নক্ষত্রদের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করেছিলেন। তাদের নাম দেওয়া হয় O, B, A, F, G, K এবং M রঙের দিক থেকে বললে O শ্রেণির তারা নীল, তার পর রঙ ক্রমশ লালের দিকে যায়। M তারা লাল। কিন্তু এই শ্রেণি বিভাগের সঙ্গে তারকাদের গঠন বা ভৌত প্রকৃতির সম্পর্ক কী সে বিষয়ে কোনো ধারণা আমাদের ছিল না। অবশেষে ভিনের সূত্র ব্যবহার করে তারার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে তারাদের উপরিতলের তাপমাত্রা সম্ভব হয়। তখন বোঝা গেল যে O তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশী। তারপর তাপমাত্রা কমতে থাকে। M তারাদের তাপমাত্রা সবচেয়ে কম। গত শতাব্দীর একদম শুরুতে বর্ণালীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে জার্মানিতে এজনার হার্জস্প্রুং ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হেনরি নরিস রাসেল তারাদের ঔজ্জ্বল্য ও তাদের বাইরের পিঠের তাপমাত্রার মধ্যে একটা সম্পর্ক খুঁজে পান।
      তারাদের শ্রেণি অর্থাৎ তাপমাত্রার সঙ্গে বিভিন্ন মৌলের শোষণ বর্ণালীর চরিত্রের পরিবর্তন হয়বিভিন্ন মৌল বা আয়নের তীব্রতার হ্রাস বৃদ্ধি ও হার্ভার্ড শ্রেণি বা তাপমাত্রার সম্পর্ক আমরা দেখতে পাচ্ছিলামযেমন O শ্রেণির তারাদের বর্ণালিতে হিলিয়ামের শোষণ রেখা খুব শক্তিশালী। অন্যদিকে K বা M তারাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধাতুর রেখা খুবই তীব্র। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে আয়নের কথা। নিস্তড়িৎ পরমাণু থেকে নক্ষত্রের অভ্যন্তরের উচ্চ তাপমাত্রায় ইলেকট্রন বেরিয়ে যেতে পারে, সেক্ষেত্রে পরমাণুটি আয়নে পরিণত হবে। এই ধরনের আয়নদের রেখাও বর্ণালীতে পাওয়া যাচ্ছিল। কোনো ভাবেই নক্ষত্রদের তাপমাত্রার সঙ্গে তার বর্ণালীর সম্পর্ক বোঝা যাচ্ছিল না। মেঘনাদ সাহা এই নিয়ে চিন্তা করছিলেন। অন্য একটা সমস্যা তাঁকে ভাবিয়েছিল। সূর্যের সবচেয়ে বাইরের অংশ হল বর্ণমণ্ডল, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়নের রেখা দেখতে পাওয়া যায়। অথচ তার ভিতরের অংশ হল আলোকমণ্ডল, সেখানে ক্যালসিয়াম আয়ন নয়, নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর রেখা দেখা যায়। এর কারণ কী হতে পারে? 
      ১৯১৯ সাল। মেঘনাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ক্লাসে তাপগতিতত্ত্ব পড়াচ্ছিলেন। রাসয়ানিক বিক্রিয়ার বিষয় পড়াতে গিয়ে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করে জার্মান বিজ্ঞানী এগার্টের একটি প্রবন্ধ। ১৯২০ সালে philosophical Magazine – এ প্রকাশিত এক প্রবন্ধ সাহা যে সমীকরণ দেন, তা পরবর্তী কালে সাহা আয়নের সমীকরণ (Saha Ionization Equation) হিসেবে পরিচিত হয়েছে সাহা ধরে নেন সূর্যের মধ্যে উচ্চ তাপমাত্রার জন্য পরমাণুরা আয়ন ও ইলেকট্রনে ভেঙে যায় এবং একই সঙ্গে আয়ন ও ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে পরমাণু গঠন করে এই দুই বিক্রিয়া তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকে সাহার গবেষণার বৈশিষ্ট্য হল যে চিরায়ত তাপগতিবিদ্যা ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের মধ্যে সংযোগ ঘটিয়ে টেনে দেখান পরমাণুর আয়নন বিভব (ionization potential) এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় কোনো পরমাণুকে আয়ন ইলেকট্রনে ভাঙতে গেলে যে পরিমাণ শক্তি দিতে হয়, তাকে বলে আয়নন বিভব
      সাহার সমীকরণের রূপটি হল


log x2P/(1-x2) = -u/4.571T +2.5 logT 6.5

এখানেহল প্রমাণ বায়ুমণ্ডলের চাপের মাপে নক্ষত্রের ভিতর গ্যাসের চাপx হল গ্যাসের আয়ননের মাত্রা, u ক্যালরিতে আয়নন বিভব এবং কেলভিন স্কেলে গ্যাসের তাপমাত্রা  জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেল পরে দেখালেন যে P হল মুক্ত ইলেকট্রন গ্যাসের চাপ সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছে এই চারটি ভৌত রাশি অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত এদের মধ্যে কিছু জানা থাকলে বাকিগুলি নির্ণয় করা সম্ভব
      সমীকরণ থেকে সাহা দেখাতে পারলেন যে সূর্যের বর্ণমণ্ডলে তাপমাত্রা, চাপ ও অন্যান্য ভৌত অবস্থা এমন যে সেখানে সমস্ত ক্যালসিয়াম পরমাণু একটি করে ইলেকট্রন ছেড়ে আয়নিত হয়ে যায় আবার কেন্দ্রের আরো কাছের আলোকমণ্ডলে তাপমাত্রা বেশী বটে, কিন্তু চাপও অনেক বেশী তাই সেখানে ক্যালসিয়াম পরমাণুর ইলেকট্রন ছাড়ার সম্ভাবনা কম ফলে আলোকমণ্ডলের বর্ণালীতে নিস্তড়িৎ ক্যালসিয়াম পরমাণুর এবং বর্ণমণ্ডলে আয়নের চিহ্ন দেখার সম্ভাবনা বেশি
      সাহার গবেষণা আরো এক সমস্যার সমাধান করলো সূর্যে রুবিডিয়াম, সিজিয়াম ইত্যাদি ধাতুর চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সাহা বললেন এদের আয়নন বিভব কম, তাই এরা সহজে আয়নিত হয়ে যায় কোন মৌলের আয়ন যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে তা ঐ মৌলের পরমাণুর থেকে আলাদা আয়নিত হয়নি এমন অবস্থায় ঐ মৌলের পরমাণুর চিহ্ন পেতে হলে অপেক্ষাকৃত শীতল অঞ্চলে দেখতে হবে সৌর কলঙ্কের তাপমাত্রা কম, তাই সেখান থেকে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করলে রুবিডিয়ামের চিহ্ন পাওয়া যাবে অচিরেই দেখা গেল সাহার কথা ঠিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেনরি নরিস রাসেল সৌরকলঙ্কের বর্ণালীতে রুবিডিয়ামকে খুঁজে পেলেন
      সাহা এই সময় অপর একটি গবেষণা পত্র প্রকাশের জন্য পাঠিয়েছিলেন এর অল্প পরেই তিনি ইংল্যান্ডে আলফ্রেড ফাউলারের ল্যাবরেটরিতে যান ফাউলারের পরামর্শে তিনি গবেষণাপত্রটি নতুন করে লেখেন বিদেশের পরীক্ষাগারে কাজ করার সুবাদে সাম্প্রতিকতম তথ্য ব্যবহারের সুযোগ তিনি পান তার ফলে মূল তত্ত্বটি অপরিবর্তিত থাকলেও প্রবন্ধটির মানের অনেক উন্নতি ঘটে এটিও তাঁর শ্রেষ্ঠ কাজের মধ্যে অন্যতম
      এই প্রবন্ধে সাহা বিভিন্ন তারার বর্ণালীর এক সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা বহু তারার বর্ণালী পর্যবেক্ষণ করেছিলেন তারাদের রঙের সঙ্গে তাপমাত্রার একটা সম্পর্ক ছিল বলে বোঝা যাচ্ছিল যেমন নীল তারারা বেশী উত্তপ্ত, লাল তারাদের তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম কিন্তু তার সঙ্গে তারাদের মধ্যে ভিন্ন মৌলের পরমাণুর শোষণ বর্ণালীর সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সাহা দেখান যে তাঁর সমীকরণ সহজেই তারার তাপমাত্রার সঙ্গে শোষণ বর্ণালীর সম্পর্কের ব্যাখ্যা দিতে পারে যেমন অতি উত্তপ্ত তারাতে সমস্ত হাইড্রোজেন আয়নিত হয়ে যায়, ফলে হাইড্রোজেনের শোষণ তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ঐ তারাদের বর্ণালীতে থাকে না আমরা জানি যে ধাতুর আয়নন বিভবের মান কম, সুতরাং অপেক্ষাকৃত কম তাপমাত্রাতেই ধাতু আয়নিত হয়ে যায় কোনো সাধারণ পরমাণু এবং তার আয়নের শোষণ তরঙ্গদৈর্ঘ্য কিন্তু এক নয় যদি তারার তাপমাত্রা এতই কম হয় যে কোনো ধাতুর পরমাণু আয়নিত না হয়ে অস্তিত্ব বজায় থাকতে পারে, একমাত্র তখনই এই তারার বর্ণালীতে ধাতুর পরমাণুর শোষণের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় এভাবে সাহার কাজের ফলে এক দীর্ঘদিনের সমস্যার সমাধান হয়ে যায় আগে মনে করা হত যে বিভিন্ন তারার উপাদান হয়তো আলাদা এখন বোঝা গেল যে তা নয়, তারাদের বর্ণালীর পার্থক্য হয় মূলত তাদের তাপমাত্রার পার্থক্যের জন্য
      সাহা সমীকরণ আমাদের নক্ষত্রের ভিতরে বিভিন্ন অংশে চাপ ও তাপ নির্ণয় করার সুযোগ করে দিল। শুধু তাই নয়, এই সমীকরণ থেকেই আমরা নক্ষত্ররা কী কী মৌলিক পদার্থও দিয়ে তৈরি তা বার করতে পারি। আমরা দেখেছি যে সমীকরণ থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে সমস্ত নক্ষত্রের উপাদানই এক। কোন মৌল কত পরিমাণে আছে, তা জানার জন্য এর আগে বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। যেমন এক পদ্ধতিতে ধরা হয়েছিল যে মৌলের শোষণ রেখার তীব্রতা যত বেশি, তার পরিমাণও তত বেশি হেনরি নরিস রাসেল দেখলেন যে পৃথিবীর উপরিভাগে ভূত্বকে যে ছটি মৌল সবচেয়ে বেশি আছে, সৌর বর্ণালীতে তাদের তীব্রতার মান খুব বেশি তাই একটা ধারণা জন্মেছিল যে সূর্য ও পৃথিবী আসলে একই উপাদান দিয়ে তৈরি রাসেলেরও আগে জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে হেনরি রোল্যান্ড বলেছিলেন যে পৃথিবীর তাপমাত্রা যদি সূর্যের মতো হত, তাহলে তার বর্ণালীও সূর্যের মতোই হত
      আমরা দেখে নিই এই ছটি মৌল কী কী ভূত্বকে অক্সিজেন আছে ৪৬.১ শতাংশ, সিলিকন আছে ২৮.২ শতাংশ, অ্যালুমিনিয়াম ৮.২ শতাংশ, লোহা ৫.৬ শতাংশ, ক্যালসিয়াম ৪.১ শতাংশ ও সোডিয়াম আছে ২.৪ শতাংশ। সূর্যের বর্ণালী বিশ্লেষণ করে যে ঠিক এই সংখ্যাগুলোই পাওয়া যাচ্ছিল তা নয়, কিন্তু তাদের মধ্যে মিল ছিল। সাহার সমীকরণ কিন্তু অন্য কথা বলছিল, আর সে কথা বুঝতে পেরেছিলেন এক তরুণী বিজ্ঞানী সিসিলিয়া পেইন।
      সাহার সমীকরণ থেকে দেখা যাচ্ছিল যে নক্ষত্রের ভিতর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আছে হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। অথচ পৃথিবীতে হাইড্রোজেনের পরিমাণ খুব কম, হিলিয়াম নেই বললেই চলে। মেঘনাদ সমেত প্রায় কোনো বিজ্ঞানীই তাই বিশ্বাস করতে পারেন নি, ভেবেছিলেন যে কোনো কারণে হয়তো এই দুটি গ্যাসের জন্য সাহা সমীকরণ কাজ করে না। সিসিলিয়া পেইন ছিলে বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের ছাত্রী, তিনি হেনরি রাসেলের সঙ্গেও কাজ করছিলেন। তিনিই প্রথম জোর দিয়ে বলেন যে সাহা সমীকরণ ঠিক, সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের মূল উপাদান হল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। এ ব্যাপারে তিনি এডিংটন ও রাসেল দুজনের সঙ্গেই দ্বিমত পোষণ করেন। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল পেইনই ঠিক, সূর্যের মোট ভরের আটানব্বই শতাংশই হল হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম। শুধু সূর্য কেন, আধুনিক কালে আমরা জানি যে মহাবিশ্বের মধ্যে সাধারণ যে সমস্ত পদার্থ আছে, তারও প্রায় ৭৪ শতাংশ হল হাইড্রোজেন ও প্রায় ২৪ শতাংশ হিলিয়াম। বাকি সমস্ত মৌলের পরিমাণ মাত্র দুই শতাংশ
      হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরিমাপের গুরুত্ব জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানে খুব বেশি। প্রথমত সূর্য সহ অধিকাংশ নক্ষত্রের অভ্যন্তরে  নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়ায় চারটি হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াস মিলে তৈরি করে একটি হিলিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসএই প্রক্রিয়ায় যে শক্তি উৎপন্ন হয় তাই হল নক্ষত্র থেকে যে তাপ বা আলো বেরোয় তার উৎস। নক্ষত্রের মূল উপাদান যে হাইড্রোজেন তা না জানলে আমরা কোনোদিনই নক্ষত্রদের শক্তি আসে কোথা থেকে তা বুঝতে পারতাম না। তেমনি বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের সময় হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি হয়েছিল। সেই সময় মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব আমরা বিশ্বে হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের অনুপাত থেকে বুঝতে পারি। এ সবই অবশ্য সাহার গবেষণার অনেক পরের ঘটনা।
      তাই সাহার এই গবেষণা তাই জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে যুগান্তর ঘটিয়েছিল বললে মোটেই বাড়িয়ে বলা হবে না দেড় দশক পরে ১৯৩৬ সালে Oxford University Press থেকে প্রকাশিত Theoretical Astrophysics গ্রন্থে লেখক রোসল্যান্ড লিখছেন, ‘…. It was the Indian Physicist Meghnad Saha who (1920) first attempted to develop a consistent theory of the spectral sequence of the stars from the point of view of atomic theory. …..From that time dates the hope that a thorough analysis of stellar spectra will afford complete information about the state of the stellar atmospheres, not only as regards the chemical composition, but also as regards the temperature and various deviations from a state of thermal equilibrium, the density distribution of the various elements, the value of gravity in the atmosphere and its state of motion. The impetus given to Astrophysics by Saha’s work can scarcely be overestimated, as nearly all later progress in this field has been influenced by it and much of the subsequent work has the character of refinements of Saha’s ideas.’ সংক্ষেপে বলা যায় যে সাহার গবেষণাই তাদের অভ্যন্তরের ভৌত অবস্থা সম্পর্কে অনেক সঠিক তথ্য পাওয়ার পথ খুলে দেয় এবং জ্যোতির্পদার্থবিদ্যাকে এক পরিমাণগত বিজ্ঞানে পরিণত করে বিখ্যাত আর্থার এডিংটনের মতে গ্যালিলিওর টেলিস্কোপ আবিষ্কারের পরে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেরা দশটি আবিষ্কারের অন্যতম হল সাহা আয়নন সমীকরণ
      একশ বছর পরেও সাহা সমীকরণ কোথায় কোথায় আমাদের প্রয়োজন, সে বিষয়ে দু একটা কথা বলে শেষ করা যাক নক্ষত্রের মডেল করতে সাহা সমীকরণ দরকার হয় কারণ সেখানে আয়ন ও ইলেকট্রনের সংখ্যা একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সাহার সমীকরণ পরমাণুর আয়নন ছাড়া অন্য কাজেও লাগে যেমন কোনো কোনো বিক্রিয়াতে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন বা নিউট্রন যুক্ত হতে পারে, আবার একই সঙ্গে উচ্চ তাপমাত্রায় প্রোটন বা নিউট্রন নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়েও যেতে পারে নিউক্লিয়াসে প্রোটন বা নিউট্রনের একটা বন্ধনী শক্তি আছে যা পরমাণুর আয়নন বিভবের সঙ্গে তুলনীয় এই দুই বিপরীত প্রক্রিয়া যদি তাপীয় সাম্যাবস্থায় থাকে তাহলে সাহা সমীকরণ ব্যবহার করা হয় এ ধরণের বিক্রিয়া ঘটে মহাকাশে এক্স রে বার্স্টার বা সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় বিশেষ করে সুপারনোভা বিস্ফোরণ লোহার থেকে ভারি মৌল সৃষ্টির অন্যতম উৎস বলে আমরা মনে করি।
      বিগ ব্যাঙের পরে মহাবিশ্বের বিবর্তন বুঝতে বিভিন্ন স্তরে সাহা সমীকরণ প্রয়োগ করতে হয়। যেমন আদিতে তাপমাত্রা ও ঘনত্ব ছিল খুব বেশি, তখন নিউট্রিনো ও ইলেকট্রনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে নিউট্রন ও প্রোটন পরস্পরের মধ্যে পরিবর্তিত হচ্ছিলমহাবিশ্ব যত প্রসারিত হচ্ছিল, তত শীতল হচ্ছিল। তাপমাত্রা একটু কমলে প্রোটন ও নিউট্রন মিলে তৈরি করে ভারি হাইড্রোজেনের পরমাণু। এই দুই ঘটনাকেই আমরা আয়ননের অনুরূপ ভাবতে পারি। আবার বিগ ব্যাঙের পরে দীর্ঘ সময় তাপমাত্রা ছিল পরমাণুর অস্তিত্বের পক্ষে বেশি। একটি প্রোটন ও একটি ইলেকট্রন যুক্ত হয়ে হাইড্রোজেন পরমাণু তৈরি করে। উচ্চ তাপমাত্রায় পরমাণু আবার ভেঙেও যেতে পারে।  ফলে এই সময়েও হাইড্রোজেন পরমাণু এবং প্রোটন-ইলেকট্রন তাপীয় সাম্যাবস্থায় ছিল। তাই সাহা সমীকরণ এখানেও প্রযোজ্য। 
      মেঘনাদ সাহা তাঁর বিখ্যাত সমীকরণ আবিষ্কার করেছিলেন কলকাতাতে বসে, সে বিষয় গবেষণাপত্রগুলিও তিনি ভারত থেকেই প্রকাশের জন্য প্রথম পাঠান। কিন্তু সেগুলি যখন প্রকাশিত হয়, তখন সাহা ফাউলারের গবেষণাগারে কাজ করেছিলেনতাই বহুদিন পাশ্চাত্যে ধারণা ছিল যে সাহা ফাউলারের অধীনে কাজ করেই তাঁর তাপ আয়নন সমীকরণ আবিষ্কার করেন সাহার কাজের মূল অংশ কিন্তু কলকাতায় বসে করা, পরে ফাউলারের গবেষণাগার থেকে অনেক নতুন তথ্য পাওয়ার ফলে তিনি তাঁর সমীকরণের পক্ষে আরো বেশি প্রমাণ সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন অনেক অসুবিধার মধ্যে প্রায় কোনো পরিকাঠামো ছাড়াই তিনি সর্বোচ্চ মানের গবেষণা করেছেন শুধুমাত্র নক্ষত্র নয়, মহাবিশ্বের বিবর্তনের ইতিহাস জানতে প্রয়োজন সাহা সমীকরণ। আবিষ্কারের একশো বছর পরেও তা সমান প্রাসঙ্গিক।

প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, শারদ সংকলন ২০১৯