Saturday 30 November 2019

চন্দ্রযান -২ঃ সাফল্য ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে বিজ্ঞান গবেষণা




চন্দ্রযান -২ঃ সাফল্য ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে বিজ্ঞান গবেষণা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       এই পত্রিকার আগস্ট সংখ্যায় চন্দ্রযান-২ এর উৎক্ষেপণের খবর দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন যে বিক্রম ল্যান্ডারকে সফ্‌ট ল্যান্ডিং (পুরানো এক লেখায় পড়েছিলাম পালকের মতো অবতরণ) শেষ পর্যন্ত করানো সম্ভব হয়নি।সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে পূর্বনির্ধারিত সূচী অনুযায়ী বিক্রমকে চন্দ্রযান থেকে বিচ্ছিন্ন করাতে বিজ্ঞানীরা সফল হয়েছিলেন, কিন্তু সে যখন চন্দ্রপৃষ্ঠের দু’কিলোমিটার উপরে তখন রকেটের নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দেয়। তিনশো তিরিশ মিটার উচ্চতায় বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই সময় তার নামার বেগ ছিল সেকেন্ডে ৫৮ মিটার, যা নিরাপদ মাত্রার উপরে। বিক্রম সম্ভবত চন্দ্রপৃষ্ঠে ৫০ মিটার প্রতি সেকেন্ড বেগ নিয়ে নেমেছিল, যা অনেকটাই বেশি। এই হার্ড ল্যান্ডিঙের পর বিক্রমের চিহ্ন অবলোহিত ক্যামেরাতেখুঁজে পাওয়া গেলেও তার সঙ্গে আর যোগাযোগ স্থাপন করা যায় নি। মূল চন্দ্রযান অবশ্য চাঁদের চারপাশে আবর্তন করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে।
       এই অভিযানকে নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে উৎক্ষেপণের দিন ছিল ১৪ জুলাই, কিছু ত্রুটি ধরা পড়ার জন্য তা শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে করা হয় ২২ জুলাই। উৎক্ষেপণ আটদিন পিছিয়ে গেলেও অবতরণের দিন পালটানো হয় নি। সমালোচনা হয়েছে যে নতুন কেন্দ্রীয় সরকারের একশোতম দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যেই অবতরণের দিন অপরিবর্তিত রাখার জন্য সরকারের থেকে হয়তো চাপ এসেছিল। ভারত এই প্রথম সফ্‌ট ল্যান্ডিঙের চেষ্টা করেছিল। এর আগে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন চাঁদের বুকে মহাকাশযান নামাতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র কয়েকমাস আগে ইজরায়েলের অবতরণ যান চাঁদে নামার সময় দুর্ঘটনাতে পড়েছিল। বিষয়টা মোটেই সহজ নয়, নানা সমস্যা আছে। যেমন চাঁদের খুব কাছে যখন ব্রেক করার জন্য ল্যান্ডিং রকেট চালানো হবে, তখন চাঁদের থেকে ক্ষুদ্র ধূলিকণা ছিটকে এসে রকেটের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, সেই কথা মাথায় রেখে রকেট ডিজাইন করতে হয়। এ ধরনের নানা সমস্যার জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই কাজে এলো না। ভন্দ্রযান-২ অবশ্য কক্ষপথ থেকে ভচাঁদ সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানের কাজ করে চলেছে, তার সময়কাল বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
       এই অভিযান নিয়ে এক অদ্ভুত উন্মাদনা দেশে সৃষ্টি করা হয়েছিল, যা অনেক বিজ্ঞানীই পছন্দ করেননি। রেটিং বানানোর জন্য গণমাধ্যম এ ধরনের কাজ করেই থাকে, কিন্তু এবারে সরকারি স্তরেও তাতে মদত ছিল।  অবতরণের লাইভ টেলিকাস্ট খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু সেই সময় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়।অবতরণের ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য আগে থেকে বাছাই করে কিছু ছাত্রছাত্রীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অনেকেই ঐতিহাসিক ঘটনা চোখে দেখবেন বলে টেলিভিশনের সামনে রাত জেগে বসেছিলেন।এই সমস্ত ঘটনা বিজ্ঞানীদের উপরে চাপ সৃষ্টি করে।
       চন্দ্রযান-১ বা মঙ্গলযানের সাফল্য যেমন এসেছে, তেমনি কোনো কোনো অভিযানে ব্যর্থতা আসবে সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের ভারতীয়দের একটা সমস্যা হল যে আমরা সাদা এবং কালোর বাইরে যে ধূসর এলাকা রয়েছে, তা সাধারণত মনে রাখতে পারি না। বিরাট কোহলি দুই তিন ইনিংসে রান না পেলেই তার সমালোচনাতে মুখর হই। এক্ষেত্রেও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সমালোচনা হয়েছিল, কিন্তু মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন তার থেকে বেশি এসেছে। সেই কথাটা ভালো, কিন্তু সম্ভবত অবিমিশ্র ভালো নয়। সংস্থার প্রধান সাংবাদিক সম্মেলনে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন অভিযান ৯৫ শতাংশ সফল। পরে ৯৮ শতাংশ সাফল্যের কথাও শোনা গেছে। এ ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনে বাধ্য হওয়াটা নিজেদেরভুলত্রুটি খুঁজে বার করাতে বাধা সৃষ্টি করে।
       বিজ্ঞান এগোয় সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার মধ্যে  দিয়ে।  কিন্তু সমালোচনা ঐ বিশেষ ক্ষেত্রের  বিশেষজ্ঞদের থেকে আসতে হবে। স্টুডিওতে বসে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞও তা নিয়ে মতামত দেবেন, বিজ্ঞান গবেষণা ঠিক ততটা সহজ নয়। বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও স্বাভাবিক, শুধু তাই নয় ব্যর্থতার ভূমিকাও ভবিষ্যতের সাফল্যের পিছনে কম নয়। Failures are the pillars of success, এই প্রাচীন প্রবাদটা বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রে যতটা প্রযোজ্য, অন্য কোনো ক্ষেত্রে তত নয়। মনে রাখতে হবে যে কোনো কিছু প্রথমবারের জন্য করতে গেলে পা রাখতে হবে এমন এলাকায় যেখানে আগে কারোর পদচিহ্ন পড়েনি। ভুল পথে যাওয়াটা সেখানে স্বাভাবিক, তার মধ্যে দিয়েই এগোতে হবে। তা না হলে বুঝতে হবে যে নতুন কিছু নয়, পুরোনো পথেই চলেছে বিজ্ঞান। কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালের সঙ্গে যদি চন্দ্রযানের অবতরণকে একই আসনে বসানো হয়, তাতে বিজ্ঞানীদের উপরে চাপ আসতে বাধ্য। বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের শরীরি ভাষা সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিল। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থারঅতীত ইতিহাস দেখায় যে ভবিষ্যতে সাফল্য আসবেই,  প্রয়োজন সরকার ও দেশবাসীর সমর্থন।  একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভের জন্য  বিজ্ঞান গবেষণাকে ব্যবহার শেষ পর্যন্ত সুফল নাও দিতে পারে।
নাসার ক্যামেরাতে তোলা বিক্রমের অবতরণস্থলের চিত্র 



চাঁদের কথা


চাঁদের কথা
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       আকাশে সূর্যের পরেই সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হল চাঁদ, তাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল চিরদিনেরচাঁদকে নিয়ে দেশবিদেশের পু্রাণে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। মহাভারতের গল্পে কুরুপাণ্ডবদের সবার চন্দ্রবংশে জন্ম, অর্থাৎ তারা চাঁদের বংশধর। অন্য এক গল্পে আবার চাঁদের জন্ম হয়েছিল সমুদ্রমন্থনে, শিব তাকে নিজের জটায় বসিয়ে নিয়েছিলেন। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল এরোনটিক্স এন্ড স্পেস অ্যাশমিনিস্ট্রেশন বা নাসার মহাকাশযান অ্যাপোলো-১১-এর মহাকাশচারীরা চাঁদে পা দিয়েছিলেন। গ্রহ-উপগ্রহ মিলিয়ে পৃথিবীর বাইরে একমাত্র যেখানে মানুষের পা পড়েছে তা হল চাঁদ।

চাঁদের বুকে নিল আর্মস্ট্রং (চিত্রঃ নাসা)
       আমাদের সৌরজগতে চাঁদ সবচেয়ে বড় উপগ্রহ নয়। গ্রহরাজ বৃহস্পতির উপগ্রহ গ্যানিমিড, আইয়ো ও ক্যালিস্টো বা শনির উপগ্রহ টাইটান চাঁদের থেকে আয়তনে বড়। কিন্তু এক দিক থেকে চাঁদ সৌরজগতে প্রথম স্থান দখল করে আছে। চাঁদ আয়তনে পৃথিবীর পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ। এটা অন্য যে কোন গ্রহ-উপগ্রহ জোড়ার থেকে বেশি। এর পরেই আছে নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটন, সে হল নেপচুনের ছ’হাজার ভাগের একভাগেরও কম। প্লুটোর উপগ্রহ চ্যারন অবশ্য এই হিসেবে অনেক বড় কিন্তু প্লুটোকে এখন আর গ্রহ বলা হয় না, কাজেই চ্যারনকে হিসাবের মধ্যে রাখা যায় না। চাঁদ আয়তনে প্লুটোর তিনগুণের থেকেও বেশি বড়। চাঁদের আকর্ষণ তার বায়ুমণ্ডলকে ধরে রাখতে পারে নি, তাই চাঁদ বায়ুশূন্য।
       প্রাচীন কাল থেকেই জানা ছিল চাঁদের আলো নেই, সূর্যের আলো প্রতিফলন করেই তার আলো। কারণটা খুব সোজা, চাঁদের কলা। চাঁদের যদি আলো থাকত, তাহলে সবসময়ই তাকে গোল দেখতাম, সূর্যকে যেমন দেখি। সূর্যের আলো চাঁদের অর্ধেকটাকে আলোকিত করে, বলা যাক সেই অংশে চাঁদের দিন। আমরা যখন চাঁদের দিকে তাকাই, তখন শুধু আলোকিত অংশটা দেখতে পাই। যতটা আলোকিত অংশ আমাদের দিকে মুখ করে আছে সেই অনুযায়ী চাঁদ আমাদের কাছে কখনো একফালি, কখনো অর্ধেক, পূর্ণিমাতে পূর্ণচন্দ্র।  অমাবস্যাতে তাকে দেখা যায় না, তখন আলোকিত অংশটা আমাদের পৃথিবীর উল্টোদিকে। একেই বলে চাঁদের কলা। সঙ্গের ছবিটাতে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। পৃথিবীর পাশের ছোট বৃত্তটা হল চাঁদের কক্ষপথ, সেখানেও বিভিন্ন অবস্থানে চাঁদের কোন অংশ আলোকিত তা দেখা যাচ্ছে। আর বড় বড় বৃত্ত দিয়ে বোঝানো হয়েছে পৃথিবী থেকে চাঁদকে কেমন দেখতে লাগে

চাঁদের কলা
       চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ কেন হয় আমরা জানি। পৃথিবীর ছায়া যখন চাঁদের উপর পড়ে তখন চন্দ্রগ্রহণ, উপরের ছবিটা থেকে বোঝা যাচ্ছে সেটা পূর্ণিমার দিনই সম্ভব। ঠিক তেমনি অমাবস্যার সময় পৃথিবী আর সূর্যের ঠিক মাঝখানে যদি চাঁদ এসে পড়ে, তখন সূর্যগ্রহণ হয়। মানুষের বিজ্ঞানের ইতিহাসে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের আলাদা গুরুত্ব আছে । প্রাচীন যুগের বিজ্ঞানীরা যখন বুঝলেন যে চন্দ্রগ্রহণের কারণ পৃথিবীর ছায়া, তখন চাঁদের বুকে সেই ছায়ার আকার দেখে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পৃথিবী গোলউপরের ছবিটা থেকে মনে হতে পারে তাহলে প্রতি অমাবস্যা পূর্ণিমাতে গ্রহণ হয় না কেন? আসলে চাঁদ যে তলে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে আর পৃথিবী যে তলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, সে দুটো নিজেদের মধ্যে পাঁচ ডিগ্রি কোণ করে আছে। নিচের ছবিটাতে দেখতে পাচ্ছ যে সব অমাবস্যাতে চাঁদের ছায়া পৃথিবীতে পড়বে না, আবার সব পূর্ণিমাতে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়বে না

বিভিন্ন পূর্ণিমা ও অমাবস্যাতে চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্যের অবস্থান
       চাঁদের ব্যাসার্ধ হল মোটামুটি ১৭৪০ কিলোমিটার। পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের কক্ষপথটা ঠিক বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার। সবচেয়ে কাছে যখন তখন পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্ব মোটামুটি ৩,৬৪,০০০ কিলোমিটার, আবার সবচেয়ে বেশি দূরত্ব হল ৪,০৫,০০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। যখন খুব কাছে আসে, তখনকার পূর্ণিমাকে বলে সুপারমুন। চাঁদের গড় দূরত্বটা এমন যে পৃথিবী থেকে দেখলে সূর্য আর চাঁদ প্রায় একই কোণ করে থাকে। সেজন্য চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিয়ে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘটাতে পারে। সূর্যের প্রচণ্ড ঔজ্জ্বল্যের জন্য তার দিকে তাকানো শক্ত, জ্যোতির্বিদদের যন্ত্রপাতিও আকাশে সূর্যের কাছাকাছি কম উজ্জ্বল জিনিস দেখতে পায় নাতাই সূর্যগ্রহণের সময়টাকে বিজ্ঞানীরা নানা ভাবে কাজে লাগান, তার দুটো তোমাদের বলি। সূর্য থেকে বাইরের দিকে উত্তপ্ত গ্যাস থামের আকার নিয়ে বেরিয়ে আসে, একে বলে সৌরশিখা  (solar prominence)এমনি সময় একে পর্যবেক্ষণ করা শক্ত। ১৮৬৮ সালের ৮ আগস্ট ভারত থেকে এক সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। সেই সময় এক ইংরেজ ও এক ফরাসি বিজ্ঞানী সূর্যের বাইরের সৌরশিখা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, তার থেকে শেষ পর্যন্ত এক নতুন মৌলের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই মৌল হল প্রথম আবিষ্কৃত নিষ্ক্রিয় গ্যাস হিলিয়াম, তা পরে পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আবার ১৯১৯ সালের ২৯ মে সূর্যগ্রহণের সময় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন সূর্যের পাশ দিয়ে আসা নক্ষত্রের আলো সূর্যের জন্য কতটা বেঁকে যায় তা মেপেছিলেন। তার থেকেই বোঝা যায় যে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব মাধ্যাকর্ষণ ব্যাখ্যা করতে নিউটনের তত্ত্বের থেকে বেশি সফল। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যাতেও চাঁদ কাজে লেগেছে, কিন্তু সে কথা আজ থাক
       তোমরা সত্যজিৎ রায়ের গল্প ‘কম্পু’ নিশ্চয় পড়েছ। সেখানে প্রফেসর শঙ্কুকে একজন জাপানি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গ্রহণের সময় চাঁদ যে সূর্যকে একদম ঠিকঠাক ঢেকে দিতে পারে, তার কারণ বিজ্ঞান বলতে পারবে? আগেই আমরা দেখলাম পৃথিবী থেকে চাঁদ আর সূর্যের কৌণিক মাপ প্রায় সমান। শঙ্কু উত্তর দিতে পারেনি নি। একশো কোটি বছর আগে বা পরে হলে সন্ন্যাসী কিন্তু এই প্রশ্নটা করতেন না। কেন জানো? আসলে চাঁদ পৃথিবীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই একশো কোটি বছর আগে চাঁদের কৌণিক মাপ আরো বেশি ছিল, পৃথিবী থেকে তাকে সূর্যের থেকে অনেক বেশি বড়ো লাগত। সহজেই তা সূর্যকে ঢেকে দিতে পারত। আবার একশ কোটি বছর পরে চাঁদের কৌণিক মাপ এত ছোট হয়ে যাবে যে সে সূর্যকে আর পুরোপুরি ঢাকতে পারবে না। এ জন্যও দায়ী চাঁদ, কিন্তু সে কথায় যাওয়ার আগে চাঁদের টানে কেমন করে জোয়ার ভাঁটা হয়, তা বুঝে নেয়া যাক। অনেক জায়গায় লেখা থাকে চাঁদের টানে পৃথিবীর জলরাশি ফুলে ওঠে, তাই জোয়ার হয়। আবার সেই জোয়ারের জন্য জল অন্য জায়গা থেকে চলে আসে, সেখানে তখন জল কমে গিয়ে ভাঁটা হয়। পৃথিবীর যে দিকটা  চাঁদের দিকে, সেদিকে জোয়ার কেন হয় বোঝা গেল, কিন্তু পরিষ্কারভাবে বোঝা গেলনা যে যেদিকটা চাঁদের উল্টোদিকে, সেখানেও জোয়ার হয় কেন।
       তোমরা জানো নিউটনের সূত্র অনুযায়ী পৃথিবী চাঁদকে যে বলে আকর্ষণ করে, চাঁদও পৃথিবীকে সমান বলে আকর্ষণ করে। তাহলে চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, পৃথিবী চাঁদের চারদিকে নয় কেন? কারণ পৃথিবী চাঁদের থেকে আশি গুণেরও বেশি ভারী, তাই একই বল দুজনের উপরে কাজ করলেও চাঁদের গতিকে সে আশি গুণ বেশি পরিবর্তন করে। বিজ্ঞানের ভাষায় চাঁদের ত্বরণ আশি গুণ বেশি। খুব ঠিকঠাক বললে চাঁদ ও পৃথিবীর একটা ভরকেন্দ্র আছে, দুজনেই তার চারদিকে পাক খায়। কিন্তু ভরকেন্দ্রটা হল পৃথিবীর মধ্যে, তাই পৃথিবীর আবর্তন সহজে বোঝা যায় না। সঙ্গের ছবিটা দেখ। এখানে CM (Centre of Mass) বিন্দুটা হল ভরকেন্দ্র, চাঁদ আর পৃথিবী দুজনেই ঐ ভরকেন্দ্রকে ঘিরে পাক খাচ্ছে।
পৃথিবী ও চাঁদের আবর্তন
       সে না হয় হল, কিন্তু তার সঙ্গে জোয়ার ভাঁটার সম্পর্ক কি? একটা কথা মনে রেখ, এই আকর্ষণ বলের জন্য চাঁদ পৃথিবীর দিকে সরে সরে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি পৃথিবী চাঁদের দিকে সরে যাচ্ছে। তাহলে একজন অন্যজনের উপর পড়ে যাচ্ছে না কেন? কারণ তাদের আর একটা গতি আছে। চাঁদ আর পৃথিবীর কেন্দ্র দুটোকে জুড়ে একটা সরলরেখা কল্পনা কর, আকর্ষণ বল ঐ রেখা বরাবর কাজ করে।  চাঁদ ও পৃথিবী ঐ রেখা বরাবর পরস্পরের দিকে সরে যায়। কিন্তু অন্য গতিটা ঠিক ওই রেখার সঙ্গে লম্বভাবে কাজ করে। এই দুই গতির মোট ফলটা হয় যে দুজনেই তাদের সাধারণ ভরকেন্দ্রের চারদিকে ঘুরতে থাকে।
       পৃথিবী চাঁদের দিকে সরে যাচ্ছে বললাম বটে, কিন্তু এখানে একটা কথা বলা হয়নি। আমরা জানি দুটো বস্তুর মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ বল দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতে পাল্টায়। সহজ কথায় দূরে গেলে আকর্ষণ বল কমে যায়। তাহলে পৃথিবীর উপর চাঁদের আকর্ষণ বল সব জায়গায় নিশ্চয় সমান নয়। যেদিকটা চাঁদের বেশি কাছে তার উপর আকর্ষণ বেশি, পৃথিবীর কেন্দ্রের উপর তার থেকে কম, আবার যেদিকটা চাঁদের থেকে দূরে তার উপর আকর্ষণ আরো কম। কিন্তু পৃথিবী মাটি পাথর মিলিয়ে একটা কঠিন বস্তু, তাই তার কেন্দ্র যতটা সরবে, দুপাশের মহাদেশ ও সমুদ্রের তলাটাও প্রায় ততখানি সরবে। অন্যদিকে মহাসমুদ্রের জল তরল, তা পৃথিবীর কেন্দ্রের সঙ্গে অত শক্তভাবে বাঁধা নেই। তাই চাঁদের দিকের জল সেদিকের সমুদ্রের তল বা মহাদেশের থেকে বেশি সরে যায়, ফলে সমুদ্রতল ফুলে ওঠে। এবার ভাব বিপরীত দিকের কথা। সেখানে চাঁদের আকর্ষণ কম, তাই মহাসমুদ্রের জল কম সরবে। কিন্তু সমুদ্রের তলা ও মহাদেশ চাঁদের দিকে বেশি সরবে, কারণ তা পৃথিবীর কেন্দ্রের সঙ্গে শক্তভাবে যুক্ত। ফলে আমরা দেখব সেখানেও জল ফুলে উঠছেএই হল চাঁদের উল্টো দিকের জোয়ারের কারণ। পাশের  ছবিটা দেখ, এখানে পৃথিবীর কঠিন অংশ আর সমুদ্রের জল কতটা করে সরবে দেখানো হয়েছে। তীর চিহ্নটা যত বড়, সরণ তত বেশি। দেখতে পাচ্ছ, সমুদ্রের জল কেমন করে ফুলে উঠছে। বোঝার সুবিধার জন্য অনেক বাড়িয়ে দেখিয়েছি।
চাঁদের টানে জোয়ার ভাঁটা
       এবার আসা যাক চাঁদ কেন পৃথিবীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেই কথায়। পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য আস্তে আস্তে বাড়ছে, তার জন্যও দায়ী চাঁদের টানে জোয়ার ভাঁটাপৃথিবী নিজের চারদিকে তেইশ ঘণ্টা ছাপ্পান্ন মিনিটে একবার পাক খায়, একে বলে নাক্ষত্র দিনচাঁদ পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় সাতাশ দিন সাত ঘণ্টার মতো। এটা কিন্তু দুটো পূর্ণিমা বা দুটো অমাবস্যার মধ্যের পার্থক্য নয়, সেটা সাড়ে উনত্রিশ দিন। এ হল চাঁদের নাক্ষত্র মাসদেখা যাচ্ছে চাঁদ অনেক আস্তে ঘোরে, জলরাশি এগিয়ে যেতে চায়, চাঁদ তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে। এই টেনে ধরার ফলে পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণন বেগ কমে যাচ্ছে আর দিন লম্বা হচ্ছেযেমন একশো কোটি বছর আগে পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য ছিল আঠারো ঘণ্টার মতো। কুড়ি কোটি বছরে পরে তা বেড়ে হবে পঁচিশ ঘণ্টা।
       যারা উঁচু ক্লাসে পড়, তারা জানো ঘূর্ণনের জন্য কৌণিক ভরবেগ বলে একটা রাশি আছে। নিউটনের সূত্রে ভরবেগের কথা আছে, ভরকে বেগ দিয়ে গুণ করলে তাকে পাওয়া যায়। বাইরে থেকে বল না দিলে ভরবেগের মান পাল্টায় না। কৌণিক ভরবেগ অনেকটা ওই ভরবেগেরই মতো, খালি সরলরেখায় গতির জন্য নয়, বৃত্তাকার পথে গতির জন্য তাকে আমরা ব্যবহার করি। বাইরে থেকে তাকে জোর করে না পালটালে তার মানও একই থাকে। যেমন, চাঁদের ভরবেগকে তার কক্ষপথের ব্যাসার্ধ দিয়ে গুণ করলে তার আবর্তনের কৌণিক ভরবেগ পাওয়া যায়। এখানে তিনটি কৌণিক ভরবেগ আছে, পৃথিবীর নিজের চারদিকে ঘূর্ণনের জন্য, চাঁদের নিজের চারদিকে ঘূর্ণনের জন্য এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের জন্য। পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ কমে যাচ্ছে অর্থাৎ তার কৌণিক ভরবেগ কমে যাচ্ছে। মোট কৌণিক ভরবেগের মান পালটায় না, সুতরাং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের  জন্য যে কৌণিক ভরবেগ আছে, তার মান বেড়ে যাচ্ছে। চাঁদের আবর্তনের জন্য কৌণিক ভরবেগ চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্বের বর্গের অনুপাতে বাড়ে। তাই কৌণিক ভরবেগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ পৃথিবীর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।
চাঁদের আকাশে পৃথিবী (চিত্রঃ নাসা)
       তোমরা হয়তো বলবে, তৃতীয়টা অর্থাৎ চাঁদের কৌণিক ভরবেগটা বাড়ছে না কেন? বাড়ছে না কারণ চাঁদের কৌণিক ভরবেগ বাড়ার সুযোগ নেই। চাঁদের একটা পাশই আমরা দেখতে পাই, অন্যদিকটা আমাদের দিকে কখনোই আসে না। আবার পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদকে আকাশে পূর্বদিকে উঠতে ও পশ্চিমদিকে ডুবতে দেখি, কিন্তু চাঁদের আকাশে পৃথিবী এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। কেন জানো? চাঁদ পৃথিবীকে আবর্তন করতে যতটা সময় নেয়, নিজের চারদিকে পাক খেতেও ঠিক একই সময় নেয়। ভাবো তো পৃথিবীর জোয়ার ভাঁটার কথা। পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ কমতে কমতে চাঁদের আবর্তনকালের সঙ্গে সমান হয়ে যাবে, তখন আর ওই ফুলে ওঠা অংশ চাঁদের সাপেক্ষে এগিয়ে যাবে না। এর পর আর পৃথিবীর বেগের পরিবর্তন হবে না। চাঁদ পৃথিবীর থেকে অনেক ছোট, তাই পৃথিবীর টানে চাঁদের ক্ষেত্রে সেটা আগে ঘটেছে। সে জন্যই চাঁদের নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণন কাল আর পৃথিবীর চারদিকে আবর্তন কাল সমান। তার আর পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়।  সৌরজগতের প্রায় সমস্ত বড় উপগ্রহই এইরকম ভাবে গ্রহের দিকে একটা মুখ ফিরিয়ে রাখে। প্লুটো আর চ্যারনের ভর অনেক কাছাকাছি, তাই চ্যারন যেমন প্লুটোর দিকে একটা মুখ ফিরিয়ে থাকে, প্লুটোও তাই। সেজন্য চ্যারনের আকাশে প্লুটো যেমন দাঁড়িয়ে থাকে, প্লুটোর আকাশেও চ্যারন তেমনি স্থির। পাঁচ হাজার কোটি বছর পরে পৃথিবী আর চাঁদেরও ওই অবস্থা হওয়ার কথা, অবশ্য যদি অতদিন তাদের অস্তিত্ব আদৌ থাকে।
       প্রশ্ন করতেই পারো, চাঁদে তো সমুদ্র নেই, তাহলে জোয়ার ভাঁটার কথা কেন? পৃথিবীর কেন্দ্রে যে তরল ম্যাগমা আছে, তারও জোয়ার ভাঁটা হয়। চাঁদের কেন্দ্রও একসময় তরল ছিল, তার জোয়ার ভাঁটা হত। তার জন্য চাঁদের ঘূর্ণন ক্রমশ কমেছে। এখনো পৃথিবীর টানে চাঁদের দুই প্রান্ত ফুলে ওঠে, যদিও তার পরিমাণ কম। এই ফুলে ওঠাটাও আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জায়গা পরিবর্তন করে, তার ফলে একই ধরনের ফল হয়। 
       চাঁদ না থাকলে কী হত? জ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসা করলে সে তোমার জীবনকে চন্দ্র কেমনভাবে প্রভাবিত করে তা বোঝাতে শুরু করবে। তার বাজে কথা শোনার দরকার নেই, কিন্তু চাঁদ কি পৃথিবীতে জীবনকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে? আমরা জানি পৃথিবী কক্ষপথের সঙ্গে সাড়ে তেইশ ডিগ্রি কোণ করে আছে, সেজন্য ঋতু পরিবর্তন হয়। এই কোণটা কয়েক হাজার বছরে এক ডিগ্রি মতো বাড়ে কমে। অঙ্ক কষে দেখা যায় চাঁদ না থাকলে এই বাড়া কমাটা অনেক বেশি হতো, কোণটা বেড়ে পঁচাশি ডিগ্রি পর্যন্ত হতো। সূর্য তাহলে কখনো মেরুর প্রায় উপরে, আবার লক্ষ বছর পরে হয়তো নিরক্ষরেখার উপরে লম্বভাবে কিরণ দিতলক্ষ বছর বেশি মনে হয়ে পারে, কিন্তু জীবের বিবর্তনের পক্ষে তা সামান্য সময়। পৃথিবীর জীবজগত হয়তো সম্পূর্ণ অন্যরকম হতো
       চাঁদের জন্ম কিভাবে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। অ্যাপোলো অভিযানগুলো প্রায় চারশো কিলোগ্রাম চাঁদের পাথর পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে। সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানও অল্প পাথর এনেছে। তাছাড়া কিছু কিছু উল্কাপাথর পাওয়া গেছে যারা চাঁদ থেকে এসেছে। এই সব পাথর থেকে দেখা গেছে চাঁদের বয়স মোটামুটি সাড়ে চারশো কোটি বছর। পৃথিবী তার থেকে সামান্য বড়। কিভাবে এই বয়স বার করা হয়েছে সে কথা বলতে গেলে এই লেখা আর শেষ হবে না, পরে কোনোদিন সেই আলোচনা করা যাবে। চাঁদের জন্ম সম্পর্কে মোটামুটি চার রকম মত আছে। একটা একটা করে সেগুলো দেখা যাক। তার সঙ্গে তাদের সমস্যাগুলোও জেনে রাখি।
       একটা মত হল পৃথিবী আর চাঁদ একই সঙ্গে জন্মেছে। তা হলে চাঁদের জন্ম সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের সৌরজগতের জন্ম কেমনভাবে হল জানতে হবে। ছায়াপথে অনেক মহাজাগতিক মেঘ আছে, তাদের ভর সূর্যের অনেক গুণ। তাদের থেকেই আমাদের সৌরজগতের জন্ম বলে সবাই মেনে নিয়েছেন। খুব সহজ কথায় বললে একটা বড় মহাজাগতিক মেঘ নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে ছোট ছোট হতে হতে সৌরজগতের জন্ম দিয়েছে। কেন্দ্রটা হয়েছে সূর্য, আর তার বাইরের দিকের টুকরোগুলো হয়েছে গ্রহ। পৃথিবী আর চাঁদ একই সঙ্গে জন্ম নিয়েছে ঐ মহাজাগতিক মেঘের সংকোচনের ফলে। কিন্তু এই মত পৃথিবী ও চাঁদের উপাদানের পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে পারে না। পৃথিবীর মোট ভরের তিরিশ শতাংশ হল লোহা, চাঁদের ক্ষেত্রে সেটা দশ শতাংশের কমদুটো কাছাকাছি মেঘের টুকরোর মধ্যে এত তফাত কেন হবে?
       দ্বিতীয় মত হল যে চাঁদ ছিল আদি-পৃথিবীর মধ্যে। সে অনেক জোরে ঘুরত, তার ফলে দু টুকরো হয়ে চাঁদ ও এখনকার পৃথিবীর জন্ম। কিন্তু টুকরো হতে গেল ঘূর্ণন বেগ খুব বেশি হতে হবে, তার মানে মোট কৌণিক ভরবেগও হবে বেশি। পৃথিবী ও চাঁদের ঘূর্ণন ও আবর্তন মিলিয়ে এখন যে মোট কৌণিক ভরবেগ, তা খুবই কম, তার পক্ষে আদি-পৃথিবীকে টুকরো করা সম্ভব নয়। মনে রেখো কৌণিক ভরবেগ বাইরে থেকে জোর না দিলে পরিবর্তন হয় না।
       তৃতীয় মতটা হল চাঁদ আগে ছিল একটা ছোট গ্রহ, পৃথিবীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পৃথিবীর অভিকর্ষে বাঁধা পড়ে গেছে। এই মতের দুটো সমস্যা আছে। কোনো মৌলের পরমাণুর বিভিন্ন ভর হয়, তাদের বলে আইসোটোপ। চাঁদের পাথরের আইসোটোপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তা সৌরজগতের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মেলে না, কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে একদম মিলে যায়। কাজেই চাঁদ ও পৃথিবী আলাদা জায়গায় তৈরি হওয়ার কথা ভাবা শক্ত। দ্বিতীয়ত তাহলে চাঁদের কক্ষপথ এত বৃত্তাকার না হয়ে অনেক লম্বাটে হত।
       যে মতটা এখন সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞানী সমর্থন করেন, তা হল মহাসংঘাত (Giant impact) প্রকল্প। এতে মনে করা হয় সৌরজগৎ সৃষ্টির পরে পরে মঙ্গলের মতো বড় একটা গ্রহ আদি-পৃথিবীকে ধাক্কা মেরেছিল, তার ফলে অনেক ছোট ছোট টুকরো ছিটকে বেরিয়ে যায়, সেগুলো জমাট বেঁধে চাঁদের জন্ম। পৃথিবীর বাইরের দিকের অংশে লোহার পরিমাণ কম, কেন্দ্রে বেশি; কেন্দ্র থেকে বেশি অংশ বেরোয়নি বলে চাঁদে লোহার পরিমাণ কম। চাঁদ ও পৃথিবীর পাথরের আইসোটোপ একরকম কেন, তা ব্যাখ্যার জন্য এই তত্ত্বকে অনেকটা পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখনও কিছু সমস্যা আছে, তবু মনে হচ্ছে যে এই তত্ত্বই শেষ পর্যন্ত চাঁদের জন্মকে বোঝাতে পারবে।
       আমাদের সভ্যতায় চাঁদের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে, কারণ প্রথম ক্যালেন্ডার বানাতে চাঁদ সাহায্য করেছিল। দিনের হিসাব রাখা সোজা, সূর্য উঠলেই নতুন দিন, কিন্তু প্রাচীনকালে মাস বা বছর হিসাব করা সহজ ছিল না। এক বছরে মোটামুটি বারোটা পূর্ণিমা-অমাবস্যা হয়। সে জন্য প্রাচীনকালে সব সভ্যতাই বছরে বারো মাস ধরে হিসেব করত। তিথি নক্ষত্রের হিসাব হয় চাঁদের কলাকে ধরে, যেমন সরস্বতী পুজো হয় মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে। হিজরি মাস শুরু হয় শুক্লা প্রতিপদ মানে অমাবস্যার পরের দিন থেকেহিজরি বছর হল চান্দ্র বছর, এক বছরে ঠিক বারোটা অমাবস্যা বারোটা পূর্ণিমাই থাকে। এক হিজরি বছরে তাই ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন। প্রাচীন জ্যোতির্বিদরা সৌর জগতের মডেল বানানোর সময় পূর্ণিমা অমাবস্যা ও গ্রহণের দিন, রাতের আকাশে চাঁদের অবস্থান, এ সমস্ত বার করার চেষ্টা করতেন। তবে তাঁদের মডেলের কেন্দ্রে সূর্য ছিল না, ছিল পৃথিবী, তাই সেগুলো অনাবশ্যক জটিল হয়ে পড়েছিল। আকাশে চাঁদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ কোথায় আছে বার করা হত। এই সব নিয়ে পরে কোনোদিন আলোচনা করা যাবে।
        অনেক পুরানো কথা হল, এবার একটু ভবিষ্যতের কথা বলি। চাঁদে মানুষ নেমেছে পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, আমরা কবে চাঁদে থাকতে পারব? কেমন করে চাঁদে বাস করা সম্ভব অল্প কথায় দেখা যাক। প্রথমত, চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, তাই মহাজাগতিক রশ্মি আর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে আটকানোর কেউ নেই চাঁদের দিন আর রাত দুটোই পৃথিবীর প্রায় পনের দিনের । বায়ুমণ্ডল না থাকার ফলে দিনের তাপমাত্রা উঠে যায় ১১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে আর রাতের তাপমাত্রা নেমে যায় -১৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেছায়াতে আর রোদে তাপমাত্রার পার্থক্যও হয় বিরাট। এ সবের থেকে বাঁচতে হলে বাস করতে হবে মাটির তলায়। চাঁদে অনেক বিরাট বিরাট লাভা নল আছে, তাদের সিল করে বায়ু ধরে রেখে তার ভিতরেই থাকা যায়শক্তির অভাব হবে না। অভিকর্ষ পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ, তাই সহজেই বিশাল বিশাল সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব। তার জন্য দরকারি সিলিকন চাঁদেই পাওয়া যাবে। ভারতবর্ষের চন্দ্রযান মিশন চাঁদে জল খুঁজে পেয়েছে। জলের তড়িদবিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাওয়া যাবে। এমনকি কৃত্রিম আলো ব্যবহার করে গাছদের সালোক সংশ্লেষ করানো সম্ভব। আর অনেকরকম পরিকল্পনা করা যায়।
       আমাদের পৃথিবীতে অনেক সমস্যা, এত খরচ করে চাঁদে মানুষের বাসস্থান বানিয়ে লাভ কী? কয়েকটা লাভের কথা বলি। চাঁদের বিপরীত দিকে যদি দূরবিন বা রেডিও টেলিস্কোপ বসাতে পারি, তাহলে তা পৃথিবীর যে কোনো টেলিস্কোপের থেকে শক্তিশালী হবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অনেক তরঙ্গকে শোষণ করে নেয়, বায়ুতে প্রতিসরণের জন্য অসুবিধা হয়। তাছাড়া শহরের আলো, মোবাইল টিভি রেডিওর সিগন্যাল এগুলো না আটকাতে পারলে টেলিস্কোপের পক্ষে কাজ করা শক্ত। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, উল্টো দিকে পৃথিবী থেকে কোনো সিগন্যাল পৌঁছবে না। অভিকর্ষ কম বলে অনেক বড় টেলিস্কোপ  বানানো যাবে। চাঁদের বায়ুচাপ প্রায় শূন্য, পৃথিবীতে আমরা অনেক খরচ করে ঐরকম অত্যুচ্চ ভ্যাকুয়াম বা বায়ুশূন্য স্থান  বানাতে পারি। ইলেকট্রনিক্স শিল্পের মতো যে সমস্ত শিল্পে ভ্যাকুয়াম লাগে, সেগুলো সহজে চাঁদে স্থাপন করা সম্ভব। তোমরা সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডারের কথা জানো। ওইরকম কণাত্বরক বা অ্যাকসিলারেটর চাঁদে বানানো খুব সহজ, বায়ুশূন্য স্থান আলাদা করে বানাতে হবে না, সুপারকন্ডাক্টর তারকে ঠাণ্ডা করার ঝামেলা অনেক কম। তবে যে কারণে ভবিষ্যতে চাঁদে বসবাসের খরচা উঠে যেতে পারে তা হল হিলিয়ামের এক আইসোটোপ হিলিয়াম-৩ যা পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। সূর্যে নিউক্লিয় সংযোজন বা ফিউশন প্রক্রিয়াতে শক্তি তৈরি হয়। আমরা হাইড্রোজেন বোমাতে সেই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়েছি, কিন্তু এখনো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে উঠতে পারিনি। তা করতে পারলে অনেক সুবিধা হবে, গ্রিন হাউস গ্যাসের ব্যাপার নেই, তেজষ্ক্রিয়তার ভয় নেই। ফ্রান্সে এক আন্তর্জাতিক প্রয়াসে ফিউশন রিঅ্যাক্টর বানানো হচ্ছে, আমাদের দেশও তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। পৃথিবীতে হিলিয়াম-৩ পাওয়া গেলে রিঅ্যাক্টর বানানো অনেক সহজ হতোসূর্য থেকে হিলিয়াম-৩ সৌর বায়ুর সঙ্গে বেরিয়ে আসে, কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তাকে আটকে দেয়। চাঁদের মাটিতে কোটি কোটি বছর ধরে হিলিয়াম-৩ জমা পড়েছে, তাকে তুলে পৃথিবীতে পাঠাতে পারলে খরচ উঠে আসতে পারে। মানুষ শেষ চাঁদে নেমেছিল ১৯৭২ সালে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা আবার ২০২৪ সালে চাঁদে মানুষ পাঠাতে এবং ২০২৮ সাল থেকে চাঁদে স্থায়ী বেস বানাতে চাইছে। চীন চাঁদের হিলিয়াম-৩ উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে। জাপান ২০৩০ সাল থেকে স্থায়ী ভাবে চাঁদে অভিযাত্রীদল রাখার ব্যাপারে চিন্তা করছে। আমরা আশায় থাকি।  

প্রকাশিতঃ কিচির মিচির শারদীয় সংখ্যা ২০১৯ ঃ সম্পাদিত