Friday 6 March 2020

মৌলের সৃষ্টি ও আর-প্রসেস


মৌলের সৃষ্টি ও আর-প্রসেস

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      আমরা জানি যে প্রাকৃতিক ভাবে মোটামুটি বিরানব্বইটা মৌল পাওয়া যায়, যদিও তাদের কয়েকটা ক্ষণস্থায়ী এদের সৃষ্টি হল কিভাবে? মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণা হল পরমাণু। পরমাণুর কেন্দ্ৰে আছে নিউক্লিয়াস আর চারদিকে আছে ঋণাত্মক আধানযুক্ত ইলেকট্রন। নিউক্লিয়াসের মধ্যে আছে প্রোটন ও নিউট্রন। নিউট্রনের তড়িৎ আধান নেই। প্রোটন ধনাত্মক আধানসম্পন্ন -- তার আধান ইলেকট্রনের আধানের সমান, কিন্তু বিপরীত। পরমাণু নিস্তড়িৎ, তার কেন্দ্রে যতগুলো প্রোটন আছে, বাইরেও আছে ঠিক ততগুলোই ইলেকট্রন বিভিন্ন মৌলিক পদার্থের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা আলাদা আলাদা। মৌলিক পদার্থের ধর্ম নির্ধারণ করে তার মধ্যের ইলেকট্রনেরা, তাই তার সৃষ্টির রহস্য খুঁজতে গেলে তার নিউক্লিয়াস কেমনভাবে তৈরি হল, তা জানতে হবে কয়েকটা পদ্ধতিতে এই মৌলরা তৈরি হয়েছে। আমরা এই লেখায় সেই সবগুলির উল্লেখ করে তাদের মধ্যে একটার দিকে চোখ রাখব।
      মহাবিশ্বে সবচেয়ে সরল পরমাণু হল সাধারণ হাইড্রোজেন তার কেন্দ্ৰে আছে একটা প্রোটন। সবচেয়ে ভারি চিরস্থায়ী পরমাণু হল সিসা সিসার পরমাণুর নিউক্লিয়াসে আছে বিরাশিটা প্রোটন। নিউট্রনের সংখ্যার কিছুটা হেরফের হতে পারে, তাতে পরমাণুর রাসায়নিক ধর্মের পরিবর্তন হয় না। একটা মৌলের সমস্ত নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা সমান। যে সমস্ত পরমাণুর প্রোটন সংখ্যা সমান কিন্তু নিউট্রন সংখ্যা আলাদা আলাদা হয়, তাদের বলে মৌলের আইসোটোপ  
ছায়াপথে কয়েকটি মৌলিক পদার্থের পরিমাণ
মৌলিক পদার্থ
প্রোটন সংখ্যা
শতাংশে পরিমাণ
মৌলিক পদার্থ
প্রোটন সংখ্যা
শতাংশে পরিমাণ
হাইড্রোজেন
1
73.9
লোহা
26
0.11
হিলিয়াম
2
24.0
নিকেল
28
0.006
কার্বন
6
0.46
জার্মেনিয়াম
32
2X 10-5
অক্সিজেন
8
1.04
ক্রিপ্টন
36
4X 10-6
নিয়ন
10
0.13
টিন
50
4X 10-7
সিলিকন
14
0.06
সিসা
82
10-6
গন্ধক
16
0.04
ইউরেনিয়াম
92
2X 10-8
     
      আমাদের ছায়াপথে সবচেয়ে বেশী পরিমাণে আছে হাইড্রোজেন, তারপরেই হিলিয়াম। বাকি মৌলিক পদার্থের পরিমাণ অত্যন্ত কম। প্রথম সারণিতে কয়েকটা মৌলিক পদার্থ কি পরিমাণে পাওয়া যায় তার শতাংশে হিসেব দেওয়া হল এই ছোটো তালিকা থেকেই দেখা যাচ্ছে যে ছায়াপথের চারভাগের প্রায় তিন ভাগই হাইড্রোজেন আর এক ভাগ হল হিলিয়াম। আমাদের ছায়াপথের হিসাবকে আমরা মোটামুটি মহাবিশ্বের হিসাব ধরে নিতে পারি। ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে তিন ধরনের সংখ্যা আছে সারণীতে হাইড্রোজেনকে আমরা হিসাব থেকে বাদ দিতে পারি, কারণ সেই হল অন্য সমস্ত মৌল তৈরির জন্য দরকারি কাঁচামাল। হাইড্রোজেন হিলিয়াম মিলিয়েই আমাদের জানা পদার্থের প্রায় 98 শতাংশ। এর পর লোহা পর্যন্ত মৌলগুলো পাওয়া যায় হিলিয়ামের থেকে অনেক কম। লোহার চেয়েও ভারি যে মৌলগুলো, তাদের পরিমাণ আরো অনেক কম। যেমন ইউরেনিয়ামের পরিমাণ মোট পদার্থের 2X10-8 শতাংশ, অর্থাৎ এক শতাংশের দশ কোটি ভাগের দু ভাগ। আসলে তিন ধরনের পদ্ধতিতে এই মৌলগুলো তৈরি হয়েছেতাই এই তিন ধরনের পরিমাণ পাওয়া যায়। খুব সংক্ষেপে এই পদ্ধতিগুলো আলোচনা করা যাক।
      মোটামুটি তেরোশো আশি কোটি বছর আগে বিগ ব্যাং বা মহা বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের জন্ম হয়। সৃষ্টির সেই আদি মুহূর্তের পরে মহাবিশ্ব ছিল অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তার তাপমাত্রাও ছিল খুব বেশি। প্রোটন বা নিউট্রন কোয়ার্ক কণা দিয়ে তৈরি। সৃষ্টির আদিতে তাপমাত্রা এতো বেশি ছিল যে কোয়ার্ক কণাগুলো প্রোটন বা নিউট্রনের মধ্যে আবদ্ধ ছিল নাকিন্তু মহাবিশ্ব যত প্রসারিত হয়, তত ঠাণ্ডা হতে থাকে। এক সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ 10-5 সেকেন্ড পর বিশ্বের তাপমাত্রা যখন কমে হয় এক লক্ষ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড; তখন আলাদা করে প্রোটন নিউট্রনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব
      সাধারণ অবস্থায় নিউট্রন চিরস্থায়ী কণা নয়, তার অর্ধায়ু কাল দশ মিনিটের কাছাকাছি। তার অর্থ, যদি শুরুতে এক হাজার নিউট্রন থাকে, তাহলে দশ মিনিট পরে থাকবে পাঁচশো নিউট্রন, তারও দশ মিনিট পরে আড়াইশো নিউট্রন – এভাবে নিউট্রনের সংখ্যা কমতে কমতে যাবে। নিউট্রন ভেঙে তৈরি হয় প্রোটন, ইলেকট্রন অ্যান্টিনিউট্রিনো। নিউট্রনরা ভাঙতে শুরু করে, কিন্তু সব নিউট্রন ভেঙে যাওয়ার আগেই পরের ধাপ শুরু হয়ে যায়দু মিনিট পরে বিশ্বের তাপমাত্রা কমে হল একশো কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। প্রোটন ও নিউট্রন মিলে তৈরি করেছিল ভারি হাইড্রোজেন বা ডয়টেরিয়ামের নিউক্লিয়াস। এর পর ডয়টেরিয়াম, মুক্ত প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে নানা বিক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি হল হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস যার মধ্যে আছে দুটো প্রোটন এবং দুটো নিউট্রন। কুড়ি মিনিটের মধ্যে সমস্ত নিউট্রন হিলিয়ামের মধ্যে বাঁধা পড়ে গিয়েছিল মুক্ত নিউট্রন ক্ষণস্থায়ী হলেও নিউক্লিয়াসের মধ্যে নিউট্রন সহজে ভেঙে যায় না। অনেক নিউক্লিয়াসের মধ্যে তারা কখনোই ভেঙে পড়ে নাহিলিয়াম বা ডয়টেরিয়ামের ক্ষেত্রেও এই ব্যাপারটা খাটে। তাহলে যদি কোনো মুক্ত নিউট্রন থেকেও থাকে, আধঘণ্টার মধ্যেই তা ভেঙে প্রোটন তৈরি করবে। মহাবিশ্বের প্রায় সমস্ত নিউট্রনই এখন হিলিয়ামের মধ্যে। খুব একটা সহজ অঙ্ক কষে দেখানো যায় যে মহাবিশ্বের প্রায় 75 শতাংশ হবে হাইড্রোজেন আর 25 শতাংশ হবে হিলিয়াম এর সঙ্গে খুব সামান্য লিথিয়ামও তৈরি হয়েছিল।
      হিলিয়াম, প্রোটন নিউট্রন পরস্পরের মধ্যে বিক্রিয়া করে আরো ভারি মৌলগুলো তৈরি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ এদের মধ্যে বিক্রিয়ার মাধ্যমে যে সমস্ত নিউক্লিয়াস তৈরি হয়ে, তারা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী, তৈরি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তারা ভেঙে পড়ে। তাই মহা বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পরে নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি বন্ধ হয়ে গেলো।
      নিউক্লিয়াস ইলেকট্রন মিলে পরমাণু তৈরি হয়। কিন্তু পরমাণুর মধ্যে ইলেকট্রনরা যে খুব শক্ত করে নিউক্লিয়াসের সঙ্গে বাঁধা থাকে তা নয়। তাই যতক্ষণ পর্যন্ত না তাপমাত্রা অনেকটা কমছে, ততক্ষণ পরমাণু তৈরি সম্ভব নয়তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা নিউক্লিয়াস ইলেকট্রনে ভেঙে যাবে। প্রায় চার লক্ষ বছর পরে তাপমাত্রা এতটা কমে গেলো যে স্থায়ীভাবে পরমাণু তৈরি হওয়া সম্ভব হল আরো পরে দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু মিলে তৈরি করলো হাইড্রোজেনের অণু এর পর কয়েক কোটি বছরের মধ্যে হাইড্রোজেন হিলিয়াম অণু-পরমাণুরা তাদের নিজেদের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে বিরাট বিরাট মহাজাগতিক মেঘ তৈরি করে এই মেঘ  নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে ছোটো হতে থাকে। একই সঙ্গে তার তাপমাত্রা পৌঁছে যায় কয়েক লক্ষ ডিগ্রি সেন্টিগ্ৰেডে এই মেঘ থেকেই নক্ষত্রদের জন্ম
      সাধারণভাবে দুটো প্রোটন পরস্পরের কাছে আসতে পারে নাতাদের ধনাত্মক আধানের জন্য তারা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। কিন্তু যদি তাদের গতিশক্তি খুব বেড়ে যায়, তাহলে তারা হয়তো বিকর্ষণ বল সত্ত্বেও টানেলিং নামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে মিলতে পারে। আমরা চার রকম বলের কথা পড়েছি। নিউট্রন বা প্রোটনরা যখন খুব কাছাকাছি আসে, তখন দু রকম বল, পীন (Strong) বল ও ক্ষীণ (Weak) বল তাদের মধ্যে কাজ করে। তাই একমাত্র উচ্চ তাপমাত্রায় প্রোটন থেকে কয়েক ধাপে নতুন ভারি নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়া সম্ভব। হাইড্রোজেনের মেঘের তাপমাত্রা যখন কয়েক লক্ষ ডিগ্রি হয়ে যায়, তখন প্রোটনগুলো পরস্পরের কাছে আসতে পারে। কয়েকটা বিক্রিয়ার মাধ্যমে তারা হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি করে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর চারটে প্রোটনের ভরের থেকে কিছুটা কম। এই ভরটা শক্তি হিসেবে বেরিয়ে আসে এবং মেঘটাকে গরম রেখে দেয় যাতে করে বিক্রিয়াটা চলতেই থাকে। এই ভাবেই নক্ষত্রের জন্ম হয়। আমাদের সূর্যে ঠিক এই বিক্রিয়াই চলছে। সূর্য বা তার মতো ভারি নক্ষত্রে বিক্রিয়াটা চলে খুব ধীর গতিতে। তাই সূর্য অন্তত সাড়ে চারশো কোটি বছর ধরে আলো দিচ্ছে এবং আরো সাড়ে চারশো কোটি বছর পরে তার কেন্দ্রের হাইড্রোজেন শেষ হবে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত ভারি নক্ষত্রে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরিটা হয় অন্য বিক্রিয়াতে যা অনেক দ্রুত তাই কোনো কোনো নক্ষত্র এমনকি এক কোটি বছরেরও অনেক কম সময়ে তার কেন্দ্রের জ্বালানি ফুরিয়ে ফেলে।
      মহাজাগতিক মেঘ নিজের আকর্ষণে ছোটো হয়ে নক্ষত্রের জন্ম দেয়। একবার নক্ষত্রের কেন্দ্রে সংযোজন বিক্রিয়া শুরু হলে সংকোচন বন্ধ হয়ে যায়এই বিক্রিয়াতে তৈরি শক্তি নক্ষত্রের তাপমাত্রা বাড়ায়, ফলে গ্যাস দিয়ে সে তৈরি তার চাপ বাড়ে। গ্যাসের এই চাপ এবং নক্ষত্র যে আলো বিকিরণ করে তার চাপ, এই দুই চাপ মাধ্যাকর্ষণের বিপক্ষে কাজ করে বলে নক্ষত্র আর ছোটো হতে পারে না। কিন্তু যেই নক্ষত্রের কেন্দ্রের আশেপাশের অঞ্চলে হাইড্রোজেন পুরোপুরি হিলিয়ামে পরিবর্তিত হয়ে যায়, তখন জ্বালানি শেষ হয় বলে নিউক্লিয় বিক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। তার ফলে চাপ যায় কমে। তখন নক্ষত্র নিজের মাধ্যাকর্ষণের প্রভাবে আবার সংকুচিত হতে শুরু করে। ঠিক আগের মতোই, সংকোচনের ফলে তাপমাত্রা আরো বেড়ে যায় কেন্দ্রের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব তখন এত বেড়ে যায় যে তিনটি হিলিয়াম নিউক্লিয়াস মিলে তৈরি হয় একটা কার্বন নিউক্লিয়াস। কার্বনের নিউক্লিয়াসের মধ্যে আছে ছটা করে প্রোটন নিউট্রন কার্বন নিউক্লিয়াসের ভর তিনটে হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের ভর অপেক্ষা কম। এই অতিরিক্ত ভরটা শক্তি হিসেবে বেড়িয়ে আসে। নক্ষত্র আবার নতুন করে জ্বলতে শুরু করে
      কেন্দ্রের হিলিয়ামও এক দিন শেষ হয়ে যায়। আবার নক্ষত্রের কেন্দ্র সংকুচিত হয় ও তার তাপমাত্রা বাড়ে। তাপমাত্রা এতই বেড়ে যায় যে এবার দুটো কার্বন নিউক্লিয়াস পরস্পরের কাছে এসে বিক্রিয়া করে তৈরি করে নিয়ন বা তার চেয়েও ভারি নিউক্লিয়াস। এভাবে পর পর কার্বন, নিয়ন, অক্সিজেন সিলিকন জ্বালানির কাজ করে। শেষ পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া শেষ হয় গিয়ে লোহা ও নিকেলে লোহা, নিকেল বা তার চেয়ে ভারি কোনো নিউক্লিয়াসের সঙ্গে অন্য কোনো নিউক্লিয়াস বিক্রিয়া করলে তাতে কোনো শক্তি পাওয়া যায় না। দুটো নিউক্লিয়াস যুক্ত হয়ে যখন কোনো ভারি নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি করছে, তখন কিছুটা অতিরিক্ত ভর শক্তি হিসেবে বেরিয়ে আসে এই শক্তিটাই নক্ষত্র কে গরম রাখে যাতে করে বিক্রিয়াটা বন্ধ হয়ে যায় না, চলতেই থাকে। লোহা-নিকেলের ক্ষেত্রে এই শক্তিটা পাওয়া তো যায় না, উল্টে আরো কিছু শক্তি দিতে হয়। তার মানে নক্ষত্র ঠাণ্ডা হতে শুরু করে। তাই বিক্রিয়াটা বন্ধ হয়ে যায় নক্ষত্রের কেন্দ্রের বিক্রিয়া শেষ পর্যন্ত লোহা ও নিকেলে শেষ হয়
      সব নক্ষত্ৰ যে এই ধাপগুলোর মধ্যে দিয়ে যেতে পারে তা নয়একমাত্র খুব ভারি নক্ষত্রেরাই লোহা তৈরি করতে সক্ষম হয়। সূর্য যেমন কখনোই কার্বন জ্বালানোর স্তরে পৌঁছবে না। দ্বিতীয়ত, পরের স্তরগুলো অনেক কম সময় স্থায়ী। যেমন সূর্যের চেয়ে পঁচিশ গুণ ভরের কোনো নক্ষত্র হাইড্রোজেন জ্বালানোর স্তরে থাকে পঞ্চাশ লক্ষ বছর, কিন্তু সিলিকন শেষ করতে সময় নেয় এক দিনেরও কম তাহলে লোহার চেয়ে ভারি মৌলগুলো এলো কোথা থেকে? প্রথম সারণীর দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায় যে লোহার চেয়ে ভারি মৌলরা অন্য কোনো ধরনের পদ্ধতিতে তৈরি হয়। কী সেই পদ্ধতি?
      নিউট্রনের কোনো তড়িৎ আধান নেই, তাই নিউক্লিয়াস তাকে বিকর্ষণ করে না। তাই তা সহজেই নিউক্লিয়াসের ভিতরে ঢুকতে পারে। নিউট্রন ক্ষণস্থায়ী বলে তাকে মুক্ত অবস্থায় আমাদের চারপাশে পাওয়া যায় না, কিন্তু নক্ষত্রের জীবনের শেষদিকে কার্বন, নিয়ন, অক্সিজেন ইত্যাদির যে সমস্ত সংযোজন বিক্রিয়ার কথা বলেছি, তাদের মাধ্যমে নিউট্রন তৈরি হয়।  সাধারণ লোহাতে যে আইসোটোপ সবচেয়ে বেশি থাকে তা হল লোহা-56। এতে আছে 26টা প্রোটন আর 30টা নিউট্রন। ধরা যাক একটা নিউট্রন এই আইসোটোপে ঢুকল। এর ফলে লোহার যে আইসোটোপ তৈরি হল, তা হল লোহা-57। এরপর হল লোহা-58, তারপরে লোহা-59। এই শেষ আইসোটোপটা কিন্তু চিরস্থায়ী নয়বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে লোহার নিউক্লিয়াসের একটা নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হয়। অর্থাৎ প্রোটনের সংখ্যা এক বেড়ে গেলো, তৈরি হল নতুন মৌল কোবাল্ট-59। আবার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, আরো নতুন নতুন মৌল সৃষ্টি হয়। অবশ্য লোহা-59 এর ক্ষয়ের আগে যদি পরের নিউট্রনটা আসে, তাহলে লোহা-60 তৈরি হতে পারে, কিন্তু তারও বিটা ক্ষয় হয়ে কোবাল্ট-60 ও অবশেষে নিকেল-60 বা নিকেল-61 হওয়া অবশ্যম্ভাবী। নিচের ছবিতে লোহার থেকে কোন পথে নতুন মৌল তৈরি হয়, তার কিছুটা দেখানো হয়েছে। নিউট্রন গ্রহণ করলে মৌলের প্রোটন সংখ্যা পাল্টায় না, কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা এক বাড়ে – অনুভূমিক তীরচিহ্নগুলি দিয়ে সেই বিক্রিয়া দেখানো হয়েছে। বিটা ক্ষয়ে নিউটনের সংখ্যা এক কমে ও প্রোটনের সংখ্যা এক বাড়ে। কোণাকুণি তীরচিহ্নগুলি তাই ইঙ্গিত করছে। সাদা বাক্সগুলো হল অস্থায়ী মৌল, তাদের বিটা ক্ষয় হয়। ছাই রঙা বস্তুগুলো স্থায়ী মৌল। এই পদ্ধতির নাম ধীর পদ্ধতি বা স্লো প্রসেস, সংক্ষেপে এস-প্রসেস। ধীর কারণ এখানে নিউট্রন বিক্রিয়া ঘটে বিটা ক্ষয়ের থেকে ধীরে। এভাবে সিসা পর্যন্ত সমস্ত মৌল অনেকটা পরিমাণে তৈরি হয়েছে।

      নক্ষত্রের মৃত্যুর সময় এক বিস্ফোরণ ঘটে যাকে বলে নোভা বা সুপারনোভা। নতুন তৈরি সমস্ত মৌল তখন মহাকাশে ছড়িয়ে পড়ে সেই মৌলরা আবার মহাজাগতিক মেঘে বাঁধা পড়ে, তার সংকোচনের ফলে যখন গ্রহ নক্ষত্র সৃষ্টি হয়, সেখানে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়, যেমন আমাদের চারিপাশে তাদের দেখতে পাই। কিন্তু এই পদ্ধতিতে সমস্ত মৌল তৈরির ব্যাখ্যা করা যায় না। যেমন সিসার চেয়ে ভারি মৌল এভাবে তৈরি সম্ভব নয়। নিউক্লিয়াসের প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যাকে বলে ভর সংখ্যা। নিউট্রন গ্রহণ করলে ভর সংখ্যা এক বাড়ে। বিটা ক্ষয়ে নিউট্রন প্রোটনে পরিবর্তিত হয়, তাই ভর সংখ্যার পরিবর্তন হয় না। সিসার থেকে ভারি মৌলদের ক্ষয় বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে নয়, মূলত আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে হয়। এস-প্রসেসে কোনো নিউক্লিয়াস গড়ে মোটামুটি দশ বছরে একটা নিউট্রন গ্রহণ করে। আলফা ক্ষয়ের সময় নিউক্লিয়াস থেকে আলফা কণা বেরিয়ে আসে। আলফা কণার মধ্যে থাকে দুটো প্রোটন ও দুটো নিউট্রন। অর্থাৎ আলফা ক্ষয়ে ভর সংখ্যা চার কমে যায়। সাধারণ ভাবে আলফা ক্ষয় হয় অনেক তাড়াতাড়ি, কয়েক মিনিট থেকে কয়েক দিনের মধ্যে আলফা ক্ষয় ঘটে। সুতরাং পরের নিউট্রনের সঙ্গে নিউক্লিয়াসের সাক্ষাৎ হওয়ার আগেই আলফা ক্ষয় হয়ে যায়। তাই একবার আলফা ক্ষয় শুরু হলে নিউক্লিয়াসের ভর আর বাড়ে না।
      একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে। সিসার সবচেয়ে ভারি স্থায়ী আইসোটোপের ভর হল 208। এর মধ্যে আছে 82টা প্রোটন ও 126টা নিউট্রন। একে লেখা যায় সিসা-208। প্রকৃতিতে তার থেকে ভারি আইসোটোপ পাওয়া যায় তবে তারা ক্ষণস্থায়ী। এই আইসোটোপের নিউক্লিয়াস একটা নিউট্রন গ্রহণ করে, তৈরি হয় সিসার নতুন আইসোটোপ যার ভর সংখ্যা 209। এর অর্ধায়ুকাল হল তিন ঘণ্টার একটু বেশি। চার অর্ধায়ুকালের মধ্যে মৌলের 98 শতাংশের বেশি মৌলের ক্ষয় হয়ে যাবে। অর্থাৎ বারো ঘণ্টার মধ্যে প্রায় সব নিউক্লিয়াসই সিসা-209 থেকে বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে বিসমাথ-209 তে পরিবর্তিত হবে। এর পর সে আরো একটা নিউট্রন নিয়ে বিসমাথ-210-এ পালটে যাবে।  বিসমাথ-210 অন্য এক ভাবে হতে পারে। সিসা-209-এর  বিটা ক্ষয়ের আগে যদি কোনো নিউট্রন আসে, তাহলে তৈরি হবে সিসা-210। সে আবার বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে বিসমাথ-210 তৈরি করবে। বিসমাথ-210 এর অর্ধায়ুকাল পাঁচ দিন, সে বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে তৈরি করবে পোলোনিয়াম-210। তার অর্ধায়ুকাল হল 138 দিন, তারপর তার থেকে আলফা কণা বেরিয়ে তৈরি হয় সিসা-206। তাহলে দেখা যাছে 208 ভর সংখ্যাকে অতিক্রম করা যাচ্ছে না। নিচের ছবিটাতে সিসা-208-এর কাছে এস-প্রসেস কোন পথে ঘটে দেখানো হয়েছে। বিচ্ছিন্ন রেখা দিয়ে আলফা ক্ষয় দিয়ে বোঝানো হয়েছে। বোঝার জন্য বিষয়টাকে সরল করে দেখানো হয়েছে, কিন্তু এস-প্রসেসে সর্বোচ্চ ভর সংখ্যার বিষয়ে এই সিদ্ধান্তটা তাতে পালটাবে না।

      অথচ প্রকৃতিতে সিসা-208-এর থেকে আরো ভারি মৌলের আইসোটোপ পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক ইউরেনিয়ামের ভর সংখ্যা হল 238, থোরিয়ামের 232। প্রকৃতিতে রেডিয়াম পোলোনিয়াম রেডন ইত্যাদি মৌলও পাওয়া যায়, যাদের ভর সংখ্যা 208-এর থেকে বেশি। তাদের অর্ধায়ুকাল পৃথিবীর বয়সের এক ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র, তাহলে তাদের পৃথিবীতে এখনো পাওয়া যায় কেন? কারণ এরা পৃথিবীর জন্ম থেকে নেই,  ইউরেনিয়াম ও থোরিয়ামের ক্ষয় থেকে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে। ইউরেনিয়াম ও থোরিয়াম তেজস্ক্রিয় হলেও এদের অর্ধায়ুকাল পৃথিবীর জীবনকালের থেকেও অনেক বেশি, তাই তাদের অস্তিত্ব পৃথিবীতে এখনও আছে। কিন্তু ইউরেনিয়াম বা থোরিয়াম তৈরি হল কেমন করে? তাদের ভর সংখ্যা তো 208-এর থেকে অনেক বেশি। এস-প্রসেস দিয়ে তা সম্ভব নয়। অন্য কিছু কিছু মৌলের পরিমাপও এস-প্রসেসের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না।
      এখনো পর্যন্ত অন্য যে উপায়ের কথা ভাবা সম্ভব হয়েছে, তা হল দ্রুত পদ্ধতি অর্থাৎ র‍্যাপিড প্রসেস বা আর-প্রসেস। এস-প্রসেসের সংগে এর পার্থক্যটা কোথায়? এস প্রসেসে পরে কয়েক বছরে একবার নিউক্লিয়াসের সঙ্গে নিউট্রনের বিক্রিয়া ঘটে।  তাই তার পরে বিটা বা আলফা ক্ষয়ের যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। কিন্তু যদি নিউট্রনের সংখ্যা অনেক বেশি হয়, তাহলে ক্ষয়ের আগেই পরের নিউট্রনের সঙ্গে বিক্রিয়া করা সম্ভব। সিসা-208 থেকে শুরু করে যদি এক সেকেন্ডের মধ্যে বেশ কিছু নিউট্রন পরপর নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করে তাহলে বিটা বা আলফা ক্ষয়ের আগেই ভর সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। এরপর বিটা বা আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে ভর কমলেও তার পক্ষে ভারি মৌল তৈরি করা সম্ভব হতে পারে।
      বিষয়টা আরো একটু জটিল, তবু বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করা যাকএই আর-প্রসেস হয় উচ্চ তাপমাত্রায়, সেখানে মেঘনাদ সাহার আবিষ্কৃত আয়নন সমীকরণ প্রয়োগ করে যে কোনো নিউক্লিয়াস সর্বোচ্চ কতগুলো নিউট্রন ধারণ করতে পারে তা জানা যাওয়ার কথা। সেই সংখ্যাটা আবার প্রোটনের সংখ্যার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। অর্থাৎ সিসার নিউক্লিয়াসে যতগুলো নিউট্রন থাকা সম্ভব, বিসমাথের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা তার থেকে বেশি। অবশ্য বাস্তবে সর্বোচ্চ নিউট্রনের সংখ্যা সঠিকভাবে এখনো আমরা খুব কম জায়গায় জানতে পেরেছি। এই সমস্ত নিউক্লিয়াস, যাদের নিউট্রনের সংখ্যা অনেক বেশি, তাদের প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না, সৃষ্টির কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের সবার ক্ষয় হয়ে যায়। পরীক্ষাগারেও তাদের সৃষ্টি করা এখনো আমাদের সামর্থ্যের বাইরে। সাহা সমীকরণে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ লাগে, তা হল নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের বন্ধনীশক্তি, কিন্তু নিউক্লিয়াস তৈরি করতে না পারলে তা মাপা সম্ভব নয়। তাত্ত্বিকভাবে তার মান বার করা ছাড়া আমাদের উপায় নেই, কিন্তু নিউক্লিয় বিজ্ঞানের তত্ত্ব থেকে সঠিকভাবে এই মান নির্ণয় করা এখনো সম্ভব হয়নি।
      তবে সর্বোচ্চ নিউট্রনের সংখ্যাটা জানা না থাকলেও বিষয়টা বুঝতে অসুবিধা হবে না। ধরা যাক সিসার নিউক্লিয়াস যখন সেই সর্বোচ্চ সংখ্যক নিউট্রনে পৌঁছে গেছে, তখন তার পক্ষে আর নিউট্রন গ্রহণ সম্ভব নয়। সিসার নিউক্লিয়াসটিকে এবার বিটা ক্ষয়ের জন্য অপেক্ষা করতেই হবে। অন্য নিউট্রন এলেও তার পক্ষে তাকে গ্রহণ সম্ভব নয়। বিটা ক্ষয়ের সময় একটা নিউট্রন প্রোটনে রূপান্তরিত হল, অর্থাৎ প্রোটনের সংখ্যা এক বাড়ল ও নিউট্রনের সংখ্যা এক কমল। এবার কিন্তু বিসমাথের এই নিউক্লিয়াস আরো কয়েকটি নিউট্রন নিতে পারবে যতক্ষণ না সে তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। এরপর সে বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে পোলোনিয়ামে পরিবর্তিত হবে। পোলোনিয়ামের সর্বোচ্চ নিউট্রন ধারণ ক্ষমতা আরো বেশি, তাই তার পক্ষে আরো নিউট্রনের সঙ্গে বিক্রিয়া করা সম্ভব। পড়তে যত সময় লাগছে, আসল বিক্রিয়াতে সময় নেবে তার থেকে অনেক কম। নিউক্লিয়াসরা এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে যতটা সম্ভব নিউট্রন গ্রহণ করে। তারপরের বিটা ক্ষয়ও ঘটে যায় এক সেকেন্ডের অতি ক্ষুদ্র ভগ্নাংশের মধ্যে। আমরা যে নিউক্লিয়াস তৈরি করতে পারি না, কেমন করে জানলাম তার বিটা ক্ষয় হতে কত সময় লাগবে? নিউট্রনের সংখ্যা স্বাভাবিকের থেকে যত বাড়বে, বিটা ক্ষয়ের অর্ধায়ুকালও তত কমবে। এর থেকেই অনুমান করা যায় যে যে নিউক্লিয়াস নিউট্রন গ্রহণের চরম সীমায় পৌঁছে গেছে, তার বিটা ক্ষয় অতি দ্রুত হয়ে যাবে।
      আর-প্রসেস কোথায় ঘটতে পারে সেটা জানতে গেলে বোঝা দরকার সেই স্থানে বা পরিবেশ কেমন হওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, সেখানে নিউট্রনের সংখ্যা খুব বেশি হতে হবে। এস-প্রসেস সেখানে ঘটে সেখানে নিউট্রন থাকে এক ঘন সেন্টিমিটারে মোটামুটি 108 থেকে 1010 অর্থাৎ এক ঘন সেন্টিমিটারে দশ কোটি থেকে হাজার কোটি পর্যন্ত। শুনতে বেশি মনে হলেও এই সংখ্যাটা খুব কম, আমাদের বায়ুতে এক ঘন সেন্টিমিটারে 5 1021 সংখ্যক বিভিন্ন গ্যাসের পরমাণু থাকে। নক্ষত্রের মধ্যে যেখানে এস-প্রসেস ঘটে, সেখানে এক ঘন সেন্টিমিটারে লোহা বা তার থেকে ভারি মৌলের পরমাণুর সংখ্যা 1019 –এর কাছাকাছি ধরে নেওয়া যেতে পারে। একটা সহজ হিসাব করা যাক, ধরে নিলাম নিউট্রনের ঘনত্ব মাঝামাঝি অর্থাৎ  109 হলে দশ বছরে গড়ে একটা নিউট্রন বিক্রিয়া ঘটে। আর-প্রসেসে ধরে নিলাম গড়ে এক সেকেন্ডের একশোভাগের এক ভাগে অর্থাৎ দশ মিলি-সেকেন্ডে বা 10-2 সেকেন্ডে একটা বিক্রিয়া ঘটতে হবে। দশ বছরে মোটামুটি 3X 108 সেকেন্ড আছে। তাহলে আর-প্রসেসে নিউট্রনের ঘনত্ব হতে হবে এস-প্রসেসে নিউট্রনের ঘনত্বের থেকে 3X 108 /10-2 = 3X1010 গুণ বেশি। অর্থাৎ নিউট্রনের ঘনত্ব মোটামুটি 3X 1019 -এর বেশি হওয়া প্রয়োজন। এই পরিমাণ মুক্ত নিউট্রন একসঙ্গে কোথায় পাওয়া যেতে পারে? মনে রাখতে হবে নিউট্রন চিরস্থায়ী কণা নয়, আর-প্রসেসের সময় তাকে কোনোভাবে তৈরি হতে হবে।
      এর সঙ্গে আরো একটা বিষয় আছে, তা হল আর-প্রসেস কতক্ষণ চলবে? বেশিক্ষণ চললে সব নিউক্লিয়াসই নিউট্রন নিয়ে সিসার থেকে ভারি মৌলে রূপান্তরিত হয়ে যাবে। তা যখন হয় না, তখন আর-প্রসেস নিশ্চয় খুব স্বল্পস্থায়ী। হিসাব বলছে যে আর-প্রসেস মাত্র দু’তিন সেকেন্ড চলে, তারপরে বন্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ আমাদের এমন জায়গা খুঁজতে হবে যেখানে খুব অল্প সময়ের জন্য অনেক মুক্ত নিউট্রন পাওয়া যায়।  
      আমাদের জ্ঞানের মধ্যে মহাবিশ্বে যে দুভাবে এক সঙ্গে অল্প সময়ের জন্য অনেক নিউট্রন পাওয়া যেতে পারে, তারা হল নিউট্রন তারকার সংযুক্তি এবং সুপারনোভা বিস্ফোরণ। এই দুই ঘটনার সময় বিপুল সংখ্যায় নিউট্রন তৈরি হয়, তারা লোহা জাতীয় ভারি মৌলের নিউক্লিয়াসে ঢুকে, এবং তারপর বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে আরো ভারি মৌল তৈরি করতে পারে। এই পদ্ধতিতেও লোহা থেকে সিসা পর্যন্ত মৌল তৈরি হয়। সিসার চেয়ে ভারি মৌলগুলো এভাবেই সৃষ্টি হয়েছে তবে এই দুই পদ্ধতি নিয়েই বিজ্ঞানীরা এখনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি।          
      প্রাথমিকভাবে আমরা সুপারনোভা বিস্ফোরণেই আর-প্রসেস হয় বলে ভেবেছিলাম। সুপারনোভা বিস্ফোরণে তারকার কেন্দ্র নিউট্রন তারকাতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। নিউট্রন তারকা হল সূর্যের থেকে কয়েকগুণ ভারী তারকার জীবনের শেষ পর্যায় ভারী তারকার কেন্দ্রে সংযোজন বিক্রিয়া যখন বন্ধ হয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের বা বিকিরণের চাপ প্রায় লুপ্ত হয়ে গেল। বিপুল ভরের জন্য নক্ষত্রের বাইরের অংশের উপর মাধ্যাকর্ষণের টান খুব বেশি, তীব্র বেগে তা কেন্দ্রের উপর এসে পড়ে। কেন্দ্রের ঘনত্ব অনেক কোটি গুণ বেড়ে যায়। ওই ঘনত্বে ইলেকট্রন নিউক্লিয়াসের মধ্যে ঢুকে প্রোটনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে নিউট্রন তৈরি করে। একই সঙ্গে তৈরি হয় ইলেকট্রন প্রতি নিউট্রিনো (νe) এই বিক্রিয়াটাকে লিখতে পারি,
p+e-n+νe

এভাবে কেন্দ্রটা শুধুমাত্র নিউট্রন দিয়ে তৈরি পদার্থে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এর ঘনত্ব এতই বেশি যে এক ঘন সেন্টিমিটার এ ধরনের পদার্থের ভর হয় প্রায় একশো কোটি টনপাউলির বর্জন নীতি মেনে অপজাত নিউট্রনের চাপ মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে কাজ করে সংকোচনকে বন্ধ করে।
      এখানেই শেষ নয়। একটা স্প্রিংকে খুব জোরে চাপ দিলে সে রিবাউন্ড বা প্রতিক্ষেপ করে। নক্ষত্রের কেন্দ্রও ঠিক তেমনি তার উপরে এসে পড়া বাইরের অংশকে মহাকাশে তীব্র বেগে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। এই ঘটনাকে আমরা বলি সুপারনোভা বা অতিনোভা বিস্ফোরণ। এই তীব্র বিস্ফোরণে কিছুদিনের জন্য তারকার ঔজ্জ্বল্য এতটাই বেড়ে যায় যে গোটা গ্যালাক্সির সব তারকার মোট ঔজ্জ্বল্যকে ছাপিয়ে যায়। তবে সুপারনোভাতে নির্গত শক্তির পরিমাণ আসলে আরো অনেক বেশি, মোট শক্তির দশ হাজার ভাগের মাত্র একভাগকে আমরা আলো হিসাবে দেখতে পাই। কেন্দ্রে পড়ে থাকে নিউট্রন দিয়ে তৈরি একটা গোলক যার ব্যাস হয় দশ কিলোমিটারের কাছাকাছি আর ভর হয় সূর্যের দু’গুণের মতো। এই হল নিউট্রন তারকা। সুপারনোভা বিস্ফোরণের তীব্রতা এতই বেশি যে আমাদের থেকে কয়েক হাজার আলোকবর্ষ দূরে হলেও তাকে দিনের আলোতে দেখা যেতে পারে সে জন্যই মনে হয় যেন এক নতুন তারকা জন্ম নিয়েছে এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, এটা এক বিশেষ শ্রেণির সুপারনোভার কথা আলোচনা করলাম। অন্য ধরনের সুপারনোভাও আছে।

      সৃষ্টির আদিতে মহাবিস্ফোরণে নিউক্লিয়াস সৃষ্টির কথা প্রথম বলেছিলনে র‍্যালফ আলফার ও জর্জ গ্যামো। তারকাদের অভ্যন্তরে মৌলিক পদার্থ সৃষ্টির বিষয়ে এখনো পর্যন্ত যা আলোচনা হয়েছে, তার কাঠামো নির্মাণের কৃতিত্ব চারজন বিজ্ঞানীর -- ফ্রেড হয়েল, উইলিয়াম ফাউলার, মার্গারেট বারবিজ ও জিওফ্রে বারবিজ। 1950 ও 1960-এর দশকে এই তত্ত্ব প্রকাশের পর থেকে আমাদের ধারণা ছিল যে সুপারনোভার কেন্দ্রে নিউট্রন তারকা সৃষ্টির সময় প্রচুর নিউট্রন পাওয়া যাবে, তারাই আর-প্রসেস বিক্রিয়াতে সাহায্য করে। কিন্তু গত শতাব্দীর শেষ দিকে বোঝা গেল যে নিউট্রন তারকার উপরিতলে নিউট্রন বিক্রিয়াতে নিশ্চয় আর-প্রসেসের মাধ্যমে নতুন মৌল সৃষ্টি হয়, কিন্তু নিউট্রন তারকার প্রবল মাধ্যাকর্ষণ অগ্রাহ্য করে তাদের পক্ষে বাইরে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। অথচ তারা যদি নিউট্রন তারকার মধ্যে বাঁধা পড়ে থাকে, তাহলে আমাদের পৃথিবীতে এলো কোথা থেকে? এর জন্য অন্য এক পদ্ধতির প্রস্তাব হয়েছে। সুপারনোভা বিস্ফোরণের সময় সবচেয়ে বেশি শক্তি নিউট্রিনো-প্রতিনিউট্রিনো রূপে বেরিয়ে আসে। তারা তারকার বাইরের দিকে যায় এবং সেই অংশকে উত্তপ্ত করে। নক্ষত্রে একদম বাইরের অংশের হাইড্রোজেন প্রচুর পরিমাণে থেকে যায়, কারণ সেই অংশে কখনোই সংযোজন বিক্রিয়া ঘটে নি। ইলেকট্রন নিউট্রিনোরা বাইরের স্তরের এই হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস অর্থাৎ প্রোটনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিউট্রন সৃষ্টি করে,
p+νen+e+
সেই নিউট্রনরা আর-প্রসেস মৌলের জন্ম দেয়। সুপারনোভা বিস্ফোরণ এই নতুন মৌলদের মহাকাশে ছুঁড়ে ফেলে। সুপারনোভার অবশেষে এই ধরনের মৌলের সন্ধান বর্ণালী বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে।
      এই মডেলে এখনো বেশ কিছু সমস্যা আছে, তবে সেগুলো খুব সহজবোধ্য নয়। নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যার জায়গাটা মোটামুটি বোঝা গেছে, কিন্তু সুপারনোভা বিস্ফোরণের মডেলে এখনো অনেক ঘাটতি আছে। তার একটা কারণ সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে কদাচিৎ, ফলে পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্যের পরিমাণ কম। আমাদের ছায়াপথে শেষ সুপারনোভা বিস্ফোরণ পৃথিবী থেকে দেখা গিয়েছিল 1604 সালে। পৃথিবীর খুব কাছে সুপারনোভা বিস্ফোরণ কখনো হয়নি, সেই রকম সম্ভাবনাও এখন নেই। সেটা অবশ্য এক দিক থেকে ভালো, কারণ আমাদের কয়েক আলোকবর্ষের মধ্যে যদি সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয় তাহলে পৃথিবী থেকে বায়ুমণ্ডল ও জীবজগৎ এক মুহূর্তে মুছে যাবে। আধুনিক কালে আমাদের সবচেয়ে কাছে সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটেছে আমাদের ছায়াপথের বাইরের ছোট গ্যালাক্সি লার্জ ম্যাজেলানিক ক্লাউডে। সেটা আমাদের থেকে একলক্ষ তেষট্টি হাজার আলোকবর্ষ দূরে।
      গত দুই দশক ধরে আর-প্রসেসের জন্য অপর এক মহাজাগতিক ঘটনার প্রস্তাব এসেছিল, যদিও সেই বিশেষ ঘটনা তখনো পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েনি। তা হল দুই নিউট্রন তারকার অথবা নিউট্রন তারকা ও  কৃষ্ণ গহ্বরের সংযুক্তি। নিউট্রন তারকার ভিতরটা নিউট্রন দিয়ে তৈরি হলেও একেবারে বাইরের দিকে কিছু মৌল থাকে। এই মৌলরা আর-প্রসেসের বীজ বা সিড হিসাবে কাজ করে। নিউট্রন তারকার একটা নির্দিষ্ট সর্বোচ্চ ভর আছে। দুই নিউট্রন তারকার সংযুক্তির সময়, কৃষ্ণ গহ্বর ও নিউট্রন তারকার সংযুক্তির সময় তো বটেই,  মোট ভরটা সেই সীমা পেরিয়ে যায়। মডেল দেখায় যে তখন এক প্রলয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটে যাতে প্রচুর পরিমাণ আর-প্রসেস মৌল তৈরি হয় ও বাইরে বেরিয়ে আসে।
      2017 সালে লাইগো প্রথম দুটি নিউট্রন তারকার সংযুক্তির কথা জানায়। লাইগো পুরো কথাটা হল লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরি যন্ত্রটা দেখতে ইংরেজি L-অক্ষরের মত, এক একটা বাহু চার কিলোমিটার করে লম্বা। লাইগো মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ধাক্কাতে কোনো বস্তুর আকারের যে সামান্য পার্থক্য হয়, তাকে মাপার চেষ্টা করে। পার্থক্যের পরিমাণ খুবই কম, একটা দণ্ডের দৈর্ঘ্য পালটাবে এক কোটি কোটি কোটি ভাগের এক ভাগেরও কম। আমেরিকার হ্যানফোর্ড আর লিভিংস্টনে দুটো এইরকম যন্ত্র বসানো আছে। দুই বাহু বরাবর দুটো লেজার রশ্মি পাঠিয়ে আবার তাদের প্রতিফলিত করে ফিরিয়ে এনে মিলিয়ে দিলে তার থেকে বাহু দুটোর দৈর্ঘ্য সমান কিনা নিখুঁতভাবে মাপা যায়।  বাহু দুটোর ওপর মহাকর্ষীয় তরঙ্গ এসে পড়লে তাদের দৈর্ঘ্য খুব সামান্য পালটাবে কিন্তু লম্বভাবে থাকার ফলে দুটো বাহুর পাল্টানোর পরিমাণটা আলাদা আলাদা হবেএই পার্থক্যটাকে খুব নিখুঁতভাবে লেজার রশ্মি দিয়ে মাপা সম্ভবআমাদের থেকে তেরো কোটি আলোকবর্ষ দূরে দুটি নিউট্রন তারকার সংঘর্ষে যে মহাকর্ষীয় ঢেউ উঠেছিল তা লাইগোতে ধরা পড়েছিল। সংঘর্ষের সময় বাইরে যে পদার্থ বেরিয়ে এসেছে তার বর্ণালী বিশ্লেষণ থেকে সেখানে আর-প্রসেস মৌলের সন্ধান পাওয়া গেছে। নিউট্রন তারকার সংযুক্তির সম্ভবত আরো দু’বার লাইগোতে ধরা পড়েছে।  লাইগো মাত্র পাঁচ বছর কাজ করছে। নিউট্রন তারকার সংযুক্তি নিশ্চয় বিরল ঘটনা, কত বিরল তা বুঝতে প্রয়োজন আরো দীর্ঘকাল পর্যবেক্ষণ। নিউট্রন তারার সংযুক্তি দিয়ে ছায়াপথে ভারি মৌলের পরিমাণ ব্যাখ্যা করা যায় কিনা তারপরেই বলা সম্ভব।
      ভারি মৌল সৃষ্টির সম্পর্কে গত পঞ্চাশ বছরে অনেকটা পথ অগ্রসর হওয়া গেছে, কিন্তু অনেকটা পথ এখনো বাকি আছে। এর জন্য প্রয়োজন হয়েছে নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণগত জ্যোতির্বিদ্যার মিলিত প্রয়াস। নিউট্রন তারকার সংযুক্তি ধরা পড়ল মহাকর্ষ তরঙ্গের গ্রাহকযন্ত্রে। সেখানে সৃষ্ট মৌলের সন্ধান দিল সাধারণ দূরবিনের সাহায্যে বর্ণালী বিশ্লেষণ। জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বানিয়েছিল নিউট্রন তারার সংযুক্তির মডেল, নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যার প্রয়োজন হয়েছিল নিউট্রন ও নিউক্লিয়াসের বিক্রিয়া ও নিউক্লিয়াসের বিটা ক্ষয়ের ব্যাখ্যা করতে। তবে এখনো অনেক পথ বাকি, দেখা যাক আর কোন বিস্ময় আমাদের জন্য ভবিষ্যতে অপেক্ষা করছে।
     
 প্রকাশঃ আত্মবিকাশ, জুন ২০১৯