Wednesday 29 April 2020

মারিয়েটা ব্লাউঃ বিস্মৃতপ্রায় বিজ্ঞানী


 
মারিয়েটা ব্লাউঃ বিস্মৃতপ্রায় বিজ্ঞানী

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

মৌলিক কণা সৃষ্টি ও তার ধর্ম নিরূপণ পদার্থবিজ্ঞানের একটা মূল লক্ষ্য। আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণ অনুযায়ী সংঘর্ষরত কণাগুলোর গতিশক্তি (E) বেশী হয়, তাহলে তারা অনেক নতুন কণা তৈরির ভর (m) যোগান দিতে পারবে। কিন্তু প্রথম যুগের কণাত্বরক দিয়ে কণাদের গতিশক্তি খুব একটা বাড়ানো যেত না। তাই অজানা মৌলিক কণার উৎস ছিল মহাজাগতিক রশ্মি। মহাবিশ্বে নানা ঘটনায় অনেক মৌলিক কণা তৈরি হয় এবং চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই নতুন মৌলিক কণাগুলো প্রায় সবই খুব ক্ষণস্থায়ী, তাদের খুঁজে পাওয়ার উপায় কী? বিজ্ঞানীরা ক্লাউড চেম্বার বা মেঘকক্ষ ব্যবহার করছিলেন, কিন্তু তার একটা সমস্যা ছিল যে সেটা খুব অল্প সময় চালু থাকে, তারপর তাকে কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিতে হয়। যে সময় যন্ত্রটা চালু নেই, সেই সময় নতুন কণা এলে আমরা তাদের খুঁজে পাব না।  বিজ্ঞানীরা তাই পর্যবেক্ষণের অন্য পদ্ধতি খুঁজছিলেন।  ভারতে বিভা চৌধুরী ও তাঁর শিক্ষক দেবেন্দ্রমোহন বসু ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করে নতুন এক কণা আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, এই ব্লগের অন্য লেখাতে সেই গল্প শোনা যাবে। নিউক্লিয় বিজ্ঞানে কাজ করার সময় ফটোগ্রাফিক প্লেটের বিকাশ ঘটাবেন এক মহিলা বিজ্ঞানী, কিন্তু দুঃখের বিষয় হল বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর বিশেষ উল্লেখ পাওয়া যায় না। এই প্রবন্ধে আমরা  সেই বিস্মৃতপ্রায় মারিয়েটা ব্লাউয়ের কথা শুনব।
মারিয়েটা ব্লাউয়ের জন্ম ১৮৯৪ সালের ২৯ এপ্রিল অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার এক উচ্চশিক্ষিত ও সংস্কৃতিমনস্ক ইহুদি পরিবারে। তাঁর বাবা মার্কাস ব্লাউ ছিলেন আইনজীবী, মায়ের নাম ফ্লোরেন্টাইন। মারিয়েটা ছিলেন তাঁদের তৃতীয় সন্তান ও একমাত্র কন্যা। মার্কাস ছিলেন সঙ্গীতের সমঝদার, ভিয়েনার সংস্কৃতিজগতের এক উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। সঙ্গীতের স্বরলিপি ছাপার জন্য তাঁদের পারিবারিক কোম্পানি ইউরোপের সর্বত্র পরিচিত ছিল। বাবার থেকে ব্লাউ পেয়েছিলেন জীবনব্যাপী সঙ্গীতপ্রীতি। স্কুল থেকেই গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান ছিল তাঁর পছন্দের বিষয়। মেয়েদের জন্য অস্ট্রিয়াতে উচ্চ শিক্ষার দরজা  ব্লাউয়ের জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই, তাই তাঁর পূর্বসূরি লিজে মাইটনারের মতো অন্তত তাঁর শিক্ষাতে ছেদ ঘটেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য যে মাটুরা পরীক্ষাতে পাস করতে হত তাতে খুবই সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হলেন মারিয়েটা। ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে ভর্তি হলেন ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাফল্যের সঙ্গে পড়াশোনা করে ১৯১৯ সালে ব্লাউ পিএইচডি ডিগ্রি পেয়েছিলেন। তাঁর গবেষণার সুপারভাইসর ছিলেন ফ্রাঞ্জ এক্সনার এবং পরীক্ষক ছিলেন স্টেফান মেয়ার। মহিলাদের বিজ্ঞান গবেষণাতে স্থান দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের দুজনেরই উৎসাহ ছিল। ব্লাউয়ের গবেষণার বিষয় ছিল পদার্থ কর্তৃক গামা রশ্মির শোষণ।
দু’বছর ব্লাউ বার্লিনের এক এক্স-রশ্মি টিউব বানানোর কারখানায় কাজ করার পর ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি ছাত্রদের এক্স-রশ্মি ছবি তোলার কায়দা শেখানোর চাকরি পান। এই সময়ে ফটোগ্রাফিক ইমালশন বা অবদ্রবের উপর সাধারণ আলো ও এক্স-রশ্মির প্রভাব নিয়ে দুটি গবেষণাপত্র ছাপান। নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা থেকে অনেক দূরে মনে হলেও এই দুই চাকরিই তাঁর কাজে লেগেছিল। দুই জায়গাতেই তিনি ফটোগ্রাফিক প্লেটের উপরে বিকিরণের ক্রিয়া নিয়ে কাজ করছিলেন। আমরা দেখব যে ভবিষ্যতে তাঁর গবেষণা সেই পথেই যাবে।

মারিয়েটা ব্লাউ (By Source, Fair use, https://en.wikipedia.org/w/index.php?curid=31802482)
এখন ডিজিটাল ক্যামেরার যুগ, ফটোগ্রাফির প্লেট হয়তো অনেকেই দেখেনি। একটা পাতলা কাঁচের প্লেটের উপরে রুপোর যৌগ সিলভার আয়োডাইডের (বা ব্রোমাইডের) ইমালশন বা অবদ্রব লাগানো থাকে। আলো এসে পড়লে সিলভার আয়োডাইড সিলভার অর্থাৎ  রুপো এবং আয়োডিনে ভেঙে যায়। রুপো প্লেটের গায়ে এঁটে যায়। আলোর পরিবর্তে যদি কোনো কণা প্লেটের মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলে সেও সিলভার আয়োডাইডকে ভাঙতে ভাঙতে যাবে, ফলে প্লেটের গায়ে বিন্দু বিন্দু রুপো জমা পড়বে। এই বিন্দুগুলো দেখে বোঝা যায় যে কণা কোন পথ দিয়ে গেছে। এখানে সবচেয়ে বড়ো সুবিধা হল যে ফটোগ্রাফিক প্লেটকে যতক্ষণ খুশি রেখে দেয়া যায়, সারাক্ষণই সে সক্রিয় থাকবে। কোনো কণা  যদি তার মধ্যে দিয়ে যায়, তাহলে সে পথের একটা চিহ্ন রেখে দেবে প্লেটের জায়গায় ফিল্মও ব্যবহার করা যায়। এখন অবশ্য আমরা প্লেট বলতে ফিল্মই বুঝি।
মায়ের অসুস্থতার জন্য ব্লাউ ফ্রাঙ্কফুর্টের চাকরি ছেড়ে ১৯২৩ সালে ভিয়েনা ফিরে ইন্সটিটিউট ফর রেডিয়াম রিসার্চে যোগ দেন, অবশ্য সেই কাজ ছিল অবৈতনিক। ভিয়েনার এই ইন্সটিটিউট মহিলাদের বিজ্ঞান গবেষণাতে উৎসাহ দিত, এর জন্য বিশেষ করে ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা ফ্রাঞ্জ এক্সনার ও বিশেষ করে তাঁর উত্তরসূরি স্টেফান মেয়ারের নাম উল্লেখ করতে হয়। আমরা দেখেছি যে ব্লাউয়ের পিএইচডির পিছনে এঁদের দুজনের ভূমিকা ছিল। এই ইন্সটিটিউটে ১৯২০ থেকে ১৯৩৪ পর্যন্ত সময়ে মোট বত্রিশ জন মহিলা এবং পঁয়ষট্টি জন পুরুষ বিজ্ঞানী গবেষণা করেন। বিজ্ঞানীদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ছিলেন মহিলা, এর পিছনে ছিলেন মেয়ার। শুধু  বিজ্ঞানীর সংখ্যা নয়, গবেষণাপত্রের সংখ্যাতেও একই অনুপাত লক্ষ্য করা যায়। এই সময়কালে তাঁদের মধ্যে আটজন পুরুষ ও চারজন মহিলা দশের বেশি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। দুজন পুরুষ ছাড়া বাকি দশজনেরই প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সংখ্যা বারো থেকে পনেরোর মধ্যে। সেই চারজন মহিলা হলেন মারিয়েটা ব্লাউ, এলিজাবেথ রোনা, এলিজাবেথা কারা-মিহাইলোভা এবং বার্টা কার্লিক।
১৯২৩ থেকে ১৯৩৮ ব্লাউ ভিয়েনার ইন্সটিটিউটে কাটান। ১৯২৫ সালে তিনি ফটোগ্রাফিক ফিল্মের মধ্যে দিয়া প্রোটন বা আলফা কণা গেলে তার চিহ্ন কেমন হবে সেই বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। তার পিছনেও এক কাহিনি আছে। ভিয়েনার দুই বিজ্ঞানী হান্স পেটারসন ও গেরহার্ড কির্শ এবং ব্রিটেনের বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও জেমস চ্যাডউইকের মধ্যে এক বিতর্ক শুরু হয়েছিল। বিতর্কের কেন্দ্রে ছিল বিকিরণের মধ্যে আলফা কণা বা উচ্চশক্তির প্রোটনের সংখ্যা গোনার পদ্ধতি। জিঙ্ক সালফাইড বা ওই ধরনের অনেক পদার্থ আছে যার উপর তেজস্ক্রিয় বিকিরণ পড়লে একটা আলোর ঝলক দেখা যায়। এই ঘটনাকে বলে  প্রতিপ্রভা। ভিয়েনাতে বিজ্ঞানীরা এই আলোর ঝলক গুনে কণার সংখ্যা গুনছিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই দীর্ঘকাল কাজ করতে হলে গণকের ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকত। রাদারফোর্ড গোনার জন্য তাঁর ছাত্র হান্স গাইগারের উদ্ভাবিত কাউন্টার ব্যবহার করছিলেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের বিস্তারিত আলোচনাতে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, শুধু একথা বলা যায় যে রাদারফোর্ডরা সেই বিতর্কে জিতেছিলেন। এই বিতর্ক চলাকালীনই পেটারসন তরুণী ব্লাউকে অবদ্রব ব্যবহার করে বিকিরণ গোনা সম্ভব কিনা তা দেখার  দায়িত্ব দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পেটারসন এই বিষয়ে আর উৎসাহ দেখাননি; কিন্তু ব্লাউ এই গবেষণাকে আরও এগিয়ে নিয়ে যান।
বিকিরণ যে ইমালশনের মধ্যে ছাপ রেখে যায়, সে কথা অনেক আগে থেকেই জানা ছিল। তেজস্ক্রিয় বিকিরণ আবিষ্কারই হয়েছিল ফটোগ্রাফিক ফিল্মে, সেই গল্প আমরা সবাই জানি। এক্স-রশ্মিতে ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার ছিল খুবই সাধারণ পদ্ধতি, কিন্তু আলফা বা  উচ্চশক্তির প্রোটনের জন্য তার ব্যবহারে  বেশ কিছু সমস্যা ছিল। ব্লাউ ইমালশনের উন্নতির জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে যান। ১৯২৭ সালে তিনি দেখালেন যে তাঁর তৈরি করা ইমালশন ব্যবহার করে প্রোটনের সংখ্যা গোনা সম্ভব। ব্রিটিশ কোম্পানি ইলফোর্ড ব্লাউয়ের পরামর্শে ক্রমান্বয়ে ইমালশন ও ফিল্মকে কণা দেখার উপযোগী করে তোলে। ব্লাউ দেখালেন যে তাঁর পদ্ধতিতে আলফা ও প্রোটনকে সহজেই আলাদা করে চেনা যায়।
 ১৯৩২ থেকে ১৯৩৮ ব্লাউ ও তাঁর সহযোগী ও একদা ছাত্রী অপর এক মহিলা বিজ্ঞানী হার্থা ওয়ামবাখার এই নিয়ে আরও কাজ করেছিলেন, সে জন্য তাঁরা যৌথভাবে বিজ্ঞানে অস্ট্রিয়ার সবচেয়ে সম্মানের সূচক লিবেন পুরস্কার পেয়েছিলেন। মূলত তাঁদের দুজনের চেষ্টাতেই নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যাতে ইমালশনের ব্যবহার চালু হয়। মহাজাগতিক রশ্মি দেখার জন্য ১৯৩৭ সালে ব্লাউ ও ওয়ামবাখার পরপর ফটোগ্রাফিক প্লেট সাজিয়ে এক পাহাড়ের চূড়ায় রাখলেন। চারমাস পরে তাঁরা যখন প্লেটগুলো পরীক্ষা শুরু করলেন, তখন উচ্চ শক্তি প্রোটনের পথরেখা দেখতে পেলেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা তাঁরা দেখতে পেলেন কতকগুলো তারার মতো চিহ্ন, যেখানে একটা কেন্দ্রীয় বিন্দু থেকে কয়েকটা রেখা নানা দিকে বেরিয়ে গেছে। এদের আমরা এখন স্টার বলি। এরা এলো কোথা থেকে?  ব্লাউ ও ওয়ামবাখার ‘নেচার’ পত্রিকাতে এক গবেষণা পত্র লিখে দেখালেন যে মহাজাগতিক রশ্মি উচ্চশক্তির কণারা ইমালশনের নিউক্লিয়াসকে ধাক্কা মেরে ভেঙে ফেলেছে। নিউক্লিয় বিক্রিয়া দেখার নতুন এক পদ্ধতি আবিষ্কার হল।
সারা পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় পদার্থবিদরা নড়েচড়ে বসলেন। ব্লাউয়ের সহকর্মী বার্টা কার্লিক  সালের শেষে হান্স পেটারসনকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘I don’t know … if you realize of what first rate importance the phenomenon [disintegration stars] is for the present state of the whole field of nuclear physics. The theoreticians are quite excited about it, Heisenberg takes personally the most vivid interest in it and is in continual correspondence with Blau and Wambacher… Sir Raman was quite wild about it and took plates to India.’ কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম আবিষ্কারক ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ছিলেন সেই সময়ের শীর্ষস্থানীয় পদার্থবিদদের একজন। হাইজেনবার্গ ও সি ভি রমন, দুই নোবেলজয়ীর গবেষণা্র ক্ষেত্র আলাদা, কিন্তু দুজনেই ব্লাউদের কাজের বিষয়ে উৎসাহী হয়েছিলেন। ১৯৩৮ সালের ভারতের কংগ্রেসে এসেছিলেন দুই বিদেশি বিজ্ঞানী জিওফ্রে টেলর ও ভবিষ্যতের নোবেলজয়ী ওয়াল্টার বোথে তাঁর ব্লাউদের পদ্ধতিতে কেমন করে মহাজাগতিক রশ্মি ধরা যায় তা আলোচনা করেছিলেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞানী দেবেন্দ্রমোহন বসু। তিনি কলকাতায় ফিরে এই বিষয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি ও তাঁর ছাত্রী বিভা চৌধুরী কেমন করে এক বিরাট আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি এসে পৌঁছেছিলেন, সে কথা এই ব্লগের অন্য লেখাতে আছে।
এত গুরুত্বপূর্ণ কাজের পরেও ইন্সটিটিউটে ব্লাউয়ের বেতনের চাকরি জুটছিল না -- কারণ তিনি প্রথমত ইহুদি, দ্বিতীয়ত মহিলা। জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্লাউ ইন্সটিটিউটের কাজের থেকে সময় বার করে বাইরে পড়াতেন, বিভিন্ন রিসার্চ ইন্সটিটিউটে অল্প সময়ের জন্য কাটাতেন, ফটোগ্রাফিক ফিল্ম বানানোর কোম্পানিদের পরামর্শ দিতেন। ইউরোপে ইহুদিবিদ্বেষ নতুন ছিল না, কিন্তু জার্মানিতে হিটলারের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে তা চারদিকে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। অস্ট্রিয়াতে নাৎসি পার্টি ছিল নিষিদ্ধ, কিন্তু গোপনে গোপনে অনেকেই তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের বিজ্ঞানীদের অনেকেই নাৎসি মনোভাবাপন্ন ছিলেন, তাঁরা এই সময়েই ইহুদি ব্লাউয়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ওয়ামবাখারও।
ওয়ামবাখার ১৯৩৪ সালে নাৎসি পার্টির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। ইন্সটিটিউটের তিন নাৎসি সমর্থক বিজ্ঞানী হঠাৎ করে বলতে শুরু করলেন যে ব্লাউ ওয়ামবাখারকে কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত করছেন। তাঁদের মধ্যে একজনের সঙ্গে ওয়ামবাখারের অবৈধ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু সেটা মূল কারণ নয়, ব্লাউয়ের বিরুদ্ধে এই আক্রমণের প্রধান কারণ ছিল তিনি ইহুদি। তাঁরা দাবি করেন যে গবেষণাপত্রে প্রথম ফটোগ্রাফিক প্লেটে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার কথা লেখা হবে, তার লেখকের তালিকাতে ওয়ামবাখারের নাম ব্লাউয়ের আগে বসাতে হবে। ব্লাউ যে ওয়ামবাখারের অনেক আগে থেকে এ বিষয়ে গবেষণা করছেন, তাঁর পরামর্শেই যে ইমালশন ও ফটোগ্রাফিক প্লেটের উন্নতি ঘটেছে, ওয়ামবাখার যে ব্লাউয়ের কাছেই কাজ শিখেছেন, সে সবের কোনো দাম নেই। অন্য সহকর্মীরা জানতেন ব্লাউ কখনোই অন্য কাউকে তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করেননি। স্বভাবগতভাবে চুপচাপ হলেও চাপের কাছে মাথা নোয়ান নি ব্লাউ।
কিন্তু ইন্সটিটিউটের পরিবেশ ব্লাউয়ের পক্ষে অসহ্য হয়ে উঠেছিল। জার্মানির অস্ট্রিয়া দখল তখন সময়ের অপেক্ষা। তাই কিছুদিনের মানসিক শান্তির জন্য ব্লাউ নরওয়ের অধ্যাপিকা এলেন গ্লেডিচের আমন্ত্রণে অসলো রওনা হলেন। যেদিন তিনি অস্ট্রিয়া ছাড়েন, ঘটনাচক্রে সেদিনই অস্ট্রিয়া ও জার্মানি এক হয়ে যায়। ইহুদি ব্লাউয়ের আর দেশে ফেরার কোনো সুযোগই ছিল না। ডাইরেক্টর মেয়ার সহ এগারো জন বিজ্ঞানীর চাকরি যায়। ওয়ামবাখার কিছুদিন পরে একা একটা গবেষণাপত্র লেখেন। তাতে যে কাজের কথা লিখেছিলেন সেটা যে ব্লাউ ও তিনি দুজনে মিলেই করেছেন সে কথা তিনি গোপন করেন। ব্লাউয়ের আগের অবদানকে তিনি খুবই তুচ্ছ করে দেখান। ইমালশনের মধ্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া প্রসঙ্গে এক নাৎসি বিজ্ঞানীর মন্তব্যের কথা বলেন যিনি কোনোদিন ইমালশন নিয়ে কাজও করেননি। সব  থেকে বড় কথা হল ইমালশনের মধ্যে মহাজাগতিক রশ্মি যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া ঘটবে, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠে না, কিন্তু ব্লাউয়ের চেষ্টাতে ইমালশনের উন্নতির ফলেই তা দেখা সম্ভব হয়েছিল। আরও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হল বারো বছর পরে নোবেল কমিটি ব্লাউয়ের অবদান আলোচনার সময় ওয়ামবাখারের সেই লেখাকে বিবেচনায় এনেছিলেন। তাই বিজ্ঞানের সব সেরা সম্মান তাঁর অধরা থেকে যায়। সেই কথায় আমরা পরে আসব।
ইউরোপ থেকে ব্লাউ চলে যান মেক্সিকো। আইনস্টাইনের ছিলেন ব্লাউয়ের গুণগ্রাহী। তাঁর চেষ্টাতে মেক্সিকো টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে একটা চাকরি পান ব্লাউ। তাঁকে সেখানে গবেষণার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আইনস্টাইন মেক্সিকো সরকারের কাছে একাধিকবার চিঠি লিখেছিলেন। “I am taking the liberty of drawing your attention to a case close to my heart. …I know Miss Blau as a very capable experimental physicist who could render valuable service to your country. She is an experimental investigator in the field of radio-activity and cosmic rays.” মেক্সিকোর শিক্ষামন্ত্রীকে এই চিঠি লিখেছিলেন আইনস্টাইন। কিন্তু মেক্সিকোতে গবেষণার কোনো সুযোগই ছিল না। ১৯৪৪ সালে নিউইয়র্কে ইন্টারন্যাশনাল রেয়ার মেটালস রিফাইনারি কোম্পানিতে একটা চাকরি পেলেন, আবারও আইনস্টাইনের উদ্যোগে। এখানে সন্তুষ্ট না হয়ে দু’বার চাকরি পাল্টান। ১৯৪৮ সালে আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ শুরু করার পরে তিনি নিজের পছন্দের গবেষণাতে ফিরতে পারলেন। আমেরিকাতে ব্রুকহাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি ও ফ্লোরিডা ইউনিভার্সিটিতে কিছুদিন চাকরি করেছিলেন ব্লাউ।
রিফাইনারি কোম্পানিতে চাকরির সময় ব্লাউ ভিয়েনাতে তাঁর সহকর্মী বার্টা কার্লিকের এক গবেষণাকে কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমরা দেখেছি প্রতিপ্রভ পদার্থতে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ পড়লে আলোর ঝলক দেয়। কার্লিক বিকিরণের সংখ্যা গোনার জন্য ফটোসেল ব্যবহার করছিলেন, কিন্তু সেই পদ্ধতি খুব একটা কাজ করত না। ব্লাউ ও তাঁর সহযোগী ফটোসেলের জায়গায় ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব বলে একটি যন্ত্র ব্যবহার শুরু করেছিলেন। যদিও এই বিষয়ে তিনি অল্পদিনই কাজ করেছিলেন, কিন্তু পৃথিবীতে তাঁরাই প্রথম এই বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। পদার্থবিদ্যাতে ফটোগ্রাফিক প্লেটের ব্যবহার এখন হয় না বললেই চলে,  বিকিরণ গোনার জন্য আমরা ইলেকট্রনিক্সের সাহায্য নিই।  প্রতিপ্রভ পদার্থ ও ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব ইলেকট্রনিক্সেরই অঙ্গ, আজও শিল্প ও আধুনিক গবেষণাতে বহু জায়গায় তাদের ব্যবহার চলে। কিন্তু কোম্পানির চাপে এই গবেষণা আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় নি। পরে ব্লাউ আবার ইমালশন ব্যবহারে ফিরে যান। ব্রুকহাভেনে নতুন তৈরি কণাত্বরকে থেকে যে মেসন পাওয়া যাচ্ছিল, ব্লাউ দেখান যে ইমালশনের মধ্যে নিউক্লিয়াসের সঙ্গে সংঘর্ষে সে আরও নতুন মেসন কণা তৈরি করে।
কিন্তু আমেরিকাতে ধীরে ধীরে গবেষণার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিলেন ব্লাউ। নিজের পছন্দের মতো যন্ত্রপাতি পাচ্ছিলেন না। আবারও আইনস্টাইন তাঁর জন্য চিঠি লিখেছিলেন। ব্রুকহাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির ডাইরেক্টর স্যামুয়েল গোউডস্মিটকে এক চিঠিতে তিনি লেখেন ‘It is well known that Marietta Blau has shown really original achievements. However, it would be very unfortunate if such a personality would be condemned to inactivity due to the shortage of scientific tools. . . Of course, Marietta Blau does not know about this letter.’ গোউডস্মিটের উত্তর থেকে ব্লাউয়ের পরিস্থিতিটা আমরা বুঝতে পারি। ‘Physics has changed so drastically from the days of simple experimentation that group work has become an unfortunate necessity. Miss Blau's temperament is not adapted to the type of regimentation which occurs nowadays when only intense cooperations make it possible to obtain meager results from a tremendously expensive piece of apparatus.’ একা একা অল্প খরচে নিজে বানানো যন্ত্রপাতি দিয়ে গবেষণা করার দিন শেষ, সময় এসেছে দল বেঁধে গবেষণার। ব্লাউ এই নতুন জগতের সঙ্গে মানাতে পারছিলেন না। এমনকি ফটোগ্রাফিক প্লেটে কণার চিহ্ন পরীক্ষা করার জন্য একদল কর্মী থাকলেও ভিয়েনার দিনগুলির মতো সেই কাজটা তিনি নিজেই করতেন।
শেষপর্যন্ত সমসাময়িক বিজ্ঞান থেকে বিচ্ছিন্ন ব্লাউ ১৯৬০ সালে অবসর নিয়ে ভিয়েনা ফিরে যান। তাঁর স্বাস্থ্য ও আর্থিক অবস্থা সেই সময় খুবই খারাপ ছিল, চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। অস্ট্রিয়াতে ফিরে আসার অন্যতম কারণ ছিল যে অবসরের পরে তাঁর আয় ছিল মাত্র দু’শো ডলার, তাতে আমেরিকাতে থাকা ও চিকিৎসার খরচ চালানো সম্ভব ছিল না। আরও কয়েকবছর তিনি ভিয়েনার রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি শ্রয়ডিঙ্গার পুরস্কারও পেয়েছিলেন।
কিন্তু যুদ্ধের পরে তাঁর পুরানো ইন্সটিটিউটের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ভালো হয়নি। কারণ ভিয়েনাতে ইহুদি বিদ্বেষ তখনও বেশ ব্যাপকভাবেই ছিল। জার্মানির অধীনে থাকার সময় ইন্সটিটিউটের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ নথি থেকে ব্লাউয়ের নাম হয় বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল, অথবা তাঁর গবেষণাকে তুচ্ছ করে দেখানো হয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধের পরেও অবস্থার পরিবর্তন হয়নি। নাৎসি সমর্থক বিজ্ঞানীরা তখনো ইন্সটিটিউটে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। ১৯৫০ সালে ওয়ামবাখারের ক্যান্সারে মৃত্যু হয়। তাঁর স্মৃতিচারণের সময় তাঁকেই ইমালশনের মধ্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার একমাত্র আবিষ্কারক বলা হয়। যাঁরা নাৎসিদের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত ছিলেন না বা তাদের তীব্র বিরোধী ছিলেন, তাঁরাও যুদ্ধ পরবর্তীকালে নাৎসি সমর্থক বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পথে না গিয়ে সহাবস্থানের পথে বেছে নিয়েছিলেন। যাঁরা পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন, দেশে ফেরার পরেও তাঁরা বাইরের লোকই রয়ে গিয়েছিলেন। নাৎসি শাসনাধীন বহু প্রতিষ্ঠানেই এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। অস্ট্রিয়া সরকারও ব্লাউকে আর্থিক সাহায্যের বা তাঁর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো চেষ্টা করেন নি। ব্লাউয়ের বন্ধু ও সহকর্মী বার্টা কার্লিক ছিলেন নাৎসি বিরোধী, তিনি ব্লাউয়ের সঙ্গে যুদ্ধের সময় যোগাযোগ রেখেছিলেন, একাধিক ইহুদি বিজ্ঞানীকে পালাতে সাহায্যও করেছিলেন। তিনি যখন ব্লাউ আর ওয়ামবাখারের কৃতিত্বকে তুলনীয় বললেন, ব্লাউ আর সহ্য করতে পারেন নি।  ১৯৬৪ সালের পরে তিনি আর ইন্সটিটিউটে পা রাখেননি। ২৭ জানুয়ারি ১৯৭০ ফুসফুসের ক্যানসারে তাঁর মৃত্যু হয়। তখন তিনি সত্যিই বিস্মৃত, তাঁর মৃত্যুর পরে এমনকি রেডিয়াম ইন্সটিটিউটেও কোনো শোকসভা হয়নি।
দেশ ছাড়ার পরে ব্লাউয়ের গবেষণাতে ছেদ পড়েছিল। মেক্সিকোতে গবেষণার কোনো সুযোগই ছিলনা। ব্লাউ অস্ট্রিয়া ছাড়ার পর ওয়ামবাখার কাজ নিয়ে বিশেষ এগোতে পারেননি। ১৯৩৮ সাল নাগাদ ব্রিটিশ বিজ্ঞানী সিসিল পাওয়েল ব্লাউয়ের গবেষণা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে  সালে এই বিষয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য তাঁর গবেষণাতে ছেদ পড়েছিল, তখন ভালো ফটোগ্রাফিক প্লেট যুদ্ধের প্রয়োজন ছাড়া পাওয়া যেত না। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে কোডাক ও ইলফোর্ড কোম্পানি থেকে আবার ভালো প্লেট গবেষণার জন্য পাওয়া যায়, তাদের মানও ইতিমধ্যে অনেক উন্নত হয়েছে। পাওয়ে সরাসরি কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে প্লেটের আর উন্নতি ঘটান। পাওয়েল ও তাঁর সহযোগীরা ব্রিটেনের ব্রিস্টলে সেই উন্নত প্লেট নিয়ে কাজ শুরু করে পরপর অনেক নতুন কণা খুঁজে পেলেন। ১৯৫০ সালে পাওয়েল পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান। ফটোগ্রাফিক প্লেটের সাহায্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া বিষয়ে গবেষণার পদ্ধতির উন্নতি ঘটানো ও তার সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের মেসন আবিষ্কারে জন্য তাঁকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
পাওয়েলকে নোবেল দেওয়া উচিত হয়নি, একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। মহাজাগতিক রশ্মি ধরার জন্য ফটোগ্রাফিক প্লেটের অনেক উন্নতি তাঁর ল্যাবরেটরি থেকে হয়েছিল। ভারতে বিভা চৌধুরী ও দেবেন্দ্রমোহন বসু পাই মেসন আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন বটে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে সেটা বলতে পারেননি। তাঁদের নাম নোবেলের জন্য কেউ মনোনীত করেনি। পাওয়েল নিশ্চিত ভাবে পাই মেসনকে সনাক্ত করেছিলেন। কিন্তু ব্লাউয়ের কৃতিত্বকে অস্বীকার করার সুযোগ নেই।  ১৯৪১ সালে রিভিউজ অফ মডার্ন ফিজিক্সে একটি লেখাতে ইমালশন নিয়ে সেই সময় পর্যন্ত গবেষণার আলোচনাতে ব্লাউয়ের নামের উল্লেখ আছে উনিশ বার, অন্য যে কারো থেকে বেশি। ব্লাউ ও ওয়ামবাখারের নাম নোবেলের জন্য মনোনীত করেছিলেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যার দুই আবিষ্কারকের একজন, বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার। ওয়ামবাখারের মনোনয়ন নিয়ে প্রশ্ন থাকেই, কারণ ব্লাউ নিঃসন্দেহে ছিলেন নেত্রী। ব্লাউয়ের পরে ওয়ামবাখার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও একা বিশেষ কিছুই করতে পারেননি। এত সত্ত্বেও ব্লাউয়ের নাম নোবেল কমিটি ভুলে গেল কেমন করে?   
১৯৫০ সালে নোবেল কমিটি তার সদস্য অ্যাক্সেল লিন্‌ধকে ব্লাউদের বিষয়ে রিপোর্ট তৈরির দায়িত্ব দেয়। তিনি ইলফোর্ড কোম্পানির ইমালশন উন্নতিতে ব্লাউয়ের অবদানের কথা উল্লেখ করলেন না। আশ্চর্য এই যে লিন্‌ধ তার আগের বছরই সিসিল পাওয়েলের জন্যও রিপোর্ট লিখেছিলেন, এবং সেখানে ইমালশনের উন্নতিতে ব্লাউ ও ওয়ামবাখারের অবদানের কথা ছিল। ওয়ামবাখারের যে প্রবন্ধের কথা আগে বলেছি, তার উল্লেখ করে লিন্‌ধ ইমালশনের মধ্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া দেখার বিষয়ে ব্লাউয়ের কৃতিত্বকে আদৌ গুরুত্ব দেননি। পাওয়েলকে পুরস্কার দেওয়ার আগে বক্তৃতাতে লিন্‌ধ ইমালশনের মধ্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তা কে প্রথম দেখেছিলেন তার উল্লেখ করেননি। পাওয়েল তাঁর নোবেল বক্তৃতাতে ১৯৪৫  সালের আগের কোনো গবেষণার উল্লেখ করেননি। নোবেল কমিটি বাস্তব পরিস্থিতিকেও অবহেলা করেছিল। লিন্‌ধ রিপোর্টে লিখেছিলেন যে ১৯৩৮ সালের পর ওয়ামবাখার গবেষণাপত্র ছাপালেও ব্লাউ ছাপাননি। এই ব্লগের অন্য লেখাতে নিউক্লিয় ফিশন আবিষ্কারের ক্ষেত্রে মাইটনারের ভূমিকা আছে, তাঁর জন্য নোবেল পুরস্কারের আলোচনার সময়ও একবার একই রকম মন্তব্য এসেছিল -- নিউক্লিয় বিভাজন আবিষ্কারের পরে দুই বছর তিনি কোনো গবেষণা করেননি। দুজনকেই কোন পরিস্থিতিতে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, তা বিবেচনার প্রয়োজন ছিল। আরও দু’বার ব্লাউয়ের নাম প্রস্তাবিত হয়েছিল, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মাইটনারকে নানা ভাবে পদার্থবিজ্ঞানী মহল মনে রেখেছে,  ব্লাউয়ের ক্ষেত্রে আমরা সেই সান্ত্বনাটুকুও পাই না। আরও দুঃখজনক এই বিস্মৃতির পিছনে যুদ্ধোত্তর পর্বের বিজ্ঞানীদের দায়িত্বও কম নয়। 
ব্লাউকে বিস্মৃতির পিছনে আরও কয়েকটা কারণ মনে রাখতে হয়। প্রথমত, কণাত্বরক বা পার্টিকল অ্যাকসিলারেটরের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ফটোগ্রাফিক প্লেটের গুরুত্ব কমতে থাকে। মহাজাগতিক রশ্মি বিজ্ঞানীর ইচ্ছামতো আসবে না, অনেকদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করলে হয়তো দু’একটা সংঘর্ষ বা নতুন কণা দেখা সম্ভব। কণাত্বরকের পরীক্ষার সময় নিজের ইচ্ছামতো বেছে নেওয়া যায়, পরীক্ষাতে প্রতি সেকেন্ডে হাজার হাজার এইরকম ঘটনা পাওয়া যায়, তার জন্য দরকার হয়েছিল আধুনিক ইলেকট্রনিক্স। ব্লাউ সেই বিষয়ে কাজ শুরু করেছিলেন বটে, কিন্তু ইলেকট্রনিক্সের অতি দ্রুত বিকাশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। উনিশশো পঞ্চাশের দশক থেকেই নিউক্লিয় বা কণা পদার্থবিদ্যাতে ফটোগ্রাফিক প্লেটের ব্যবহার কমতে শুরু করে। আমরা এও দেখেছি যে দলবদ্ধভাবে গবেষণার সঙ্গেও তিনি মানিয়ে নিতে পারেননি। দ্বিতীয়ত, ব্লাউ অনেক দিন ইন্ডাস্ট্রি বা শিল্পে চাকরি করেছেন, সারা কর্মজীবনই শিল্পের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে গবেষণা করেছেন। বর্তমানে আমরা বিজ্ঞান ও শিল্পের যোগস্থাপনের উপরে জোর দিয়ে থাকি। কিন্তু উনিশশো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরস্কারের দিকে তাকালে দেখতে পাব সেই সময়ে সাধারণভাবে সেই সমস্ত গবেষণাই স্বীকৃতি পেয়েছে যা মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচন করেছে, কিন্তু যা ঠিক ‘কেজো’ নয়, যার সঙ্গে দৈনন্দিন জীবনের যোগাযোগ কম। তাই এত সাফল্য সত্ত্বেও মারিয়েটা ব্লাউ আজ এক বিস্মৃত নাম।

প্রকাশঃ তরী পত্রিকা ১৪২৭


Thursday 23 April 2020

মহাকাশের মাপনি


মহাকাশের মাপনি


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       আকাশের গ্রহনক্ষত্র নিয়ে মানুষের আগ্রহ চিরদিনের, তাই জ্যোতির্বিদ্যাকে বলা হয় প্রথম সচেতন বিজ্ঞান। ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা তৈরির প্রয়োজন হয়েছিল কৃষিকাজের জন্য, যুদ্ধযাত্রার জন্য; হয়তো তারও আগে মানুষকে শিকারের মরশুমের কথা ভাবতে হয়েছিল। আকাশের চাঁদ, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র – এরা ক্যালেন্ডার তৈরিতে সাহায্য করত, তাই প্রথম যুগেই তাদের গতিবিধি সম্পর্কে জানার প্রয়োজন হয়েছিল। এদের মধ্যে চাঁদ ও সূর্য দৃশ্যতই অন্যদের থেকে আলাদা। গ্রহদের চেনাও সহজ ছিল, কারণ আমাদের চোখে তাদের নক্ষত্রদের থেকে বড় দেখায়, তাদের আলো স্থির, নিয়মিত লক্ষ্য রাখলে দেখা যায় যে তাদের আপেক্ষিক অবস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে যায়। প্রাচীন যুগের জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাস খুবই চিত্তাকর্ষক, কিন্তু আমাদের আজকের আলোচনার বিষয় আলাদা।
       প্রাচীন যুগে জ্যোতিষ আর জ্যোতির্বিদ্যাকে আলাদা করার উপায় ছিল না। শুধুমাত্র আকাশের জ্যোতিষ্কদের গতিবিধি নয়, তাদের গঠন, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি নিয়ে যে বিজ্ঞানে চর্চা হয়, তাকে আমরা জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞান বা অ্যাস্ট্রোফিজিক্স বলি। আধুনিক কালে অ্যাস্ট্রোকেমিস্ট্রি বা অ্যাস্ট্রোবায়োলজিও গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান হিসাবে জায়গা করে নিচ্ছে। পরীক্ষানিরীক্ষার উপরে জোর দেওয়া হল আধুনিক বিজ্ঞানের একটা বড় বৈশিষ্ট্য। জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে বিজ্ঞানের অধিকাংশ শাখার পার্থক্য এই যে গ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সি সহ মহাবিশ্বের এক অতি ক্ষুদ্র অংশকে আমরা আমাদের ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার সুযোগ পাই। অপর এক সমস্যা হল যে গ্রহ নক্ষত্রদেরও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তন হয়, কিন্তু কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া তা এতই ধীর গতিতে যে তা একজন মানুষের জীবনকাল, এমনকি আমাদের সভ্যতার বয়সের থেকেও অনেক বড়। সূর্য অন্তত চারশো পঞ্চাশ কোটি বছর ধরে আলো দিচ্ছে, প্রায় একই সময় এইভাবেই বিকিরণ করবে। আমাদের সভ্যতার বয়স তার তুলনায় কতটুকু? তাই আমাদের পর্যবেক্ষণে তাদের বিবর্তন ধরা পড়ে না। নক্ষত্রদের মধ্যে কী বিক্রিয়া চলছে, তার গঠন কিরকম, কেমন করে তারা তৈরি হল, কীভাবে তাদের মৃত্যু ঘটে -- এসব জানতে তাই আমাদের প্রয়োজন জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বের। তত্ত্ব নির্মাণের জন্য প্রয়োজন তথ্যের;  নক্ষত্রদের ভর কত, কী দিয়ে তারা তৈরি, কত দূরে তারা আছে, তাদের তাপমাত্রা কত – এ সমস্ত নানা খবর জানতে হবে। কিন্তু কেমন করে? স্কেল, থার্মোমিটার, ওজনযন্ত্র তো এক্ষেত্রে অচল - তাহলে কোন মাপনি আমরা ব্যবহার করব? কেমন করে এই সমস্ত তথ্য আমরা জোগাড় করতে পারি – তাই নিয়েই এই প্রবন্ধ।
       একটা কথা মনে রাখা দরকার। যে কোনো রকমের মাপে কিছু না কিছু ত্রুটি থেকে যাবে।  পদার্থবিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে যেরকম নিখুঁত ভাবে মাপা সম্ভব, দূরত্বের কারণে জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে প্রায়শই তা আমাদের ক্ষমতার বাইরে। ইলেকট্রনের ভরের মাপে ত্রুটির পরিমাণ ভরের 10-8 অর্থাৎ দশ কোটি ভাগের এক ভাগের বেশি নয়। কিন্তু আমরা লুব্ধক নক্ষত্রের ভরের মাপে এক শতাংশ ভুল আমরা মেনে নেব, এমনকি ঘরের কাছের নক্ষত্র সূর্যের ভরেও এক লক্ষ ভাগের তিন ভাগ পর্যন্ত ত্রুটি নিয়ে আমরা চিন্তিত হই না।
       মাপের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে দূরত্বের কথা। জ্যোতিষ্কে গিয়ে দূরত্ব মাপার প্রশ্ন ওঠে না। সামনে যে কলমটা রাখা আছে, তা হাত বাড়িয়ে নেওয়াটা খুব সহজ, আমার মস্তিষ্ক হাতকে নির্দেশ দেয় কোথায় যেতে হবে। কিন্তু ফিতে দিয়ে না মেপে মস্তিষ্ক কলমের দূরত্বটা মাপে কেমন করে? কোনো বস্তুর দিকে তাকালে আমাদের দুই চোখ ঠিক একই রকম প্রতিবিম্ব আমাদের রেটিনাতে গঠন করা না, কারণ তারা আলাদা কোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করছে। আমাদের মস্তিষ্ক সেই দুটি ছবিকে বিশ্লেষণ করে তার থেকে দূরত্ব বার করে এক চোখ বন্ধ করে কলমটা হাতে নেওয়ার চেষ্টা করলেই বিষয়টা বোঝা যাবে। কিন্তু বস্তুটা যত দূরে যাবে, দুই চোখের প্রতিবিম্ব তত একইরকম হবে, তখন দূরত্ব মাপার সমস্যা বাড়বে। অনেক দূরের বস্তুর এভাবে মাপাই সম্ভব নয়। দুরের পাহাড়ের দূরত্ব যদি চোখের আন্দাজে না মাপতে পারি, তাহলে গ্রহ নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপব কেমন করে?

       আমাদের দুটো চোখের মধ্যের ফাঁক কয়েক সেন্টিমিটার, এটা যদি অনেকটা বাড়াতে পারতাম তাহলে দু’চোখের প্রতিবিম্ব অনেকটা আলাদা হত। সেক্ষেত্রে আমরা আরো বেশি দূরের বস্তুর দূরত্ব মাপতে পারতাম। সেটা বাড়াব কেমন করে? উপরের বাঁদিকের ছবিটা দেখুন। এখানে 1 2 ছয় মাস আগে পরে পৃথিবীর অবস্থান। এই দুই অবস্থানে দূরবিন হল দুই চোখ যাদের মধ্যে তফাৎটা তাহলে পৃথিবীর কক্ষপথের ব্যাস অর্থাৎ তিরিশ কোটি কিলোমিটার। অপেক্ষাকৃত কাছে যে নক্ষত্র আছে, দূরের নক্ষত্রদের সাপেক্ষে 1 2  বিন্দু থেকে তার অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। দূরের নক্ষত্ররা এতই দূরে আছে যে ওই দুই বিন্দু থেকে দেখলেও তাদের অবস্থান পাল্টায় না; এই কথাটায় আবার আসব। বোঝার সুবিধার জন্য ছবিতে নক্ষত্রটাকে খুব কাছে দেখানো হয়েছে। তাহলে ছ’মাস আগে পরে নক্ষত্রটার অবস্থান নির্ণয় করে p কোণের মান নির্ণয় সম্ভব। এই কোণটাকে বলে লম্বন (parallax)। এখানে d হল পৃথিবী ও সূর্যের গড় দূরত্ব, একে বলে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিট, সংক্ষেপে এইউ(AU) অর্থাৎ 1 এইউ = 15 কোটি কিলোমিটার।  এখন রাডার ব্যবহার করে এই  মানটা খুব নিখুঁত ভাবে মাপা সম্ভব হয়েছে, তবে তারও আগে এই লম্বন পদ্ধতি ব্যবহার করেই আমরা পৃথিবী সূর্যের গড় দূরত্ব মেপেছিলাম। সৌরজগৎ থেকে নক্ষত্রটার দূরত্বকে D দিয়ে বোঝানো হয়েছে।
       ডানদিকের ছবির সূর্য, পৃথিবী ও নক্ষত্র দিয়ে গঠিত সমকোণী ত্রিভুজটা বাঁদিকে আলাদা করে দেখানো হয়েছেকোণ p খুব ছোটো হলে, আমরা জানি 
p=d/D  অর্থাৎ D=d/p
এই সমীকরণে লম্বন p-এর মান রেডিয়ানে দেওয়া আছেসাধারণত লম্বনের মান সেকেন্ডে মাপা হয়। ষাট মিনিটে এক ডিগ্রি, ষাট সেকেন্ডে এক মিনিট, অর্থাৎ এক সেকেন্ড হল এক ডিগ্রির 3600 ভাগের এক ভাগ। এক রেডিয়ান মোটামুটি 57.3 ডিগ্রি, অর্থাৎ এক সেকেন্ড = এক রেডিয়ান/206280 আগেই দেখেছি d হল পনের কোটি কিলোমিটার =1.5X108  কিলোমিটার। তাই কোনো নক্ষত্রের লম্বন যদি এক সেকেন্ড হয়, তাহলে তার দূরত্ব হবে
D=1.5X108 কিলোমিটার/(1/206280)=3.086X1013  কিলোমিটার=3.26 আলোকবর্ষ
এই 3.26 আলোকবর্ষকে বলে 1 পারসেক। পারসেক হল জ্যোতির্বিদ্যাতে দূরত্ব মাপার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একক। সৌরজগত থেকে ঐ দূরত্বের মধ্যে কোনো নক্ষত্র নেই। যদি লম্বনের মান 0.1 সেকেন্ড হয়, দূরত্ব হবে 32.6 আলোকবর্ষ বা 10 পারসেক। আমাদের নিকটতম নক্ষত্র প্রক্সিমা সেন্টাউরির লম্বন 0.768, অর্থাৎ তার দূরত্ব হল 1/0.768 পারসেক = 1.3 পারসেক বা 4.2 আলোকবর্ষ। । লুব্ধকের লম্বন হল 0.385 সেকেন্ড, তার থেকে বুঝতে পারিও তার দূরত্ব হল 2.6 পারসেক। এভাবেই নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপা শুরু হয়েছিল। এখানেই দেখা যাচ্ছে যে D যদি খুব বড় হয়, তাহলে p-এর মান খুব কমে যাবে। সেজন্যই ছ’মাস আগে পরে পর্যবেক্ষণ করলেও খুব দূরের নক্ষত্রদের অবস্থান পাল্টায় না।
       এভাবে কত দূর পর্যন্ত মাপতে পারি? আমরা দূরবিনে কত ছোট কোণ মাপতে পারি তার একটা সীমা আছে, সেটা 10-5 সেকেন্ডের কাছাকাছি বলে ধরে নিতে পারি। কিন্তু সেই সীমাতে পৌঁছানোর অনেক আগেই সমস্যা আসে। আমরা দেখেছি যে নক্ষত্রদের আলো ঝিকমিক করে। বায়ুপ্রবাহ ইত্যাদি কারণে বায়ুমণ্ডলের প্রতিসরাঙ্ক সবসময় পরিবর্তিত হচ্ছে, ফলে নক্ষত্র থেকে আসা আলোর গতিপথও পাল্টে যাচ্ছে। তাই নক্ষত্রের প্রতিবিম্ব স্থান পরিবর্তন করে, আমাদের মনে হয় সে ঝিকমিক করছে। প্রতিবিম্ব যেহেতু এক জায়গায় থাকে না, লম্বনের মানও পালটে পালটে যায়। তাই 10-2 সেকেন্ডের থেকে  লম্বন কম হলে পৃথিবীতে বসে তা ঠিকঠাক মাপা সম্ভব নয়। লম্বন 10-2  অর্থ দূরত্ব একশো পারসেক, তাহলে যে সমস্ত নক্ষত্র তার থেকে দূরে আছে, তাদের দূরত্ব মাপব কেমন করে?   
       বায়ুমণ্ডলের বাইরে থেকে যদি লম্বন মাপা হয়, তাহলে এই সমস্যা থাকে না। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির হিপ্পারকস উপগ্রহ 1989 থেকে 1993 পর্যন্ত মহাকাশে অবস্থান করে লম্বন পদ্ধতিতে নক্ষত্রদের দূরত্ব মেপেছে। হিপ্পারকস 10-3 পর্যন্ত লম্বন মাপতে পারত।  এক লক্ষেরও বেশি নক্ষত্রের দূরত্ব এভাবে মাপা গেছে। ওই এজেন্সিরই গাইয়া উপগ্রহ 2013 থেকে কাজ করছে। গাইয়া  2.4X10-5 পর্যন্ত লম্বন মাপতে পারে, তাই তার দূরত্ব মাপার পাল্লা হল চল্লিশ হাজার পারসেক বা একলক্ষ তিরিশ হাজার আলোকবর্ষ। আমাদের ছায়াপথ মোটামুটি এক লক্ষ আলোকবর্ষ চওড়া, তাই ছায়াপথের শেষ সীমা পর্যন্ত নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপা গাইয়ার পক্ষে সম্ভব। একশো কোটি নক্ষত্রের দূরত্ব মাপার কাজ করে চলেছে গাইয়া, শেষ হতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে। ছায়াপথে নক্ষত্রের সংখ্যা অবশ্য তার কয়েকশো গুণ, একটা ন্যূনতম ঔজ্জ্বল্য না থাকলে লম্বন মাপা সম্ভব নয়।
       কিন্তু এতো গেল ছায়াপথের কথা। মহাবিশ্বে হাজার হাজার কোটি গ্যালাক্সি আছে, তাদের দূরত্ব অনেক বেশি। আমাদের সবচেয়ে কাছের যে পূর্ণাঙ্গ গ্যালাক্সি আছে, সেই অ্যান্ড্রোমিডা যে আমাদের থেকে প্রায় পঁচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে আছে, তা মাপলাম কেমন করে? লম্বন পদ্ধতি সেখানে অচল।
       ধরা যাক কোনো একটা আলোর উৎস আছে যার থেকে প্রতি সেকেন্ডে কত শক্তি বেরোচ্ছে আমরা জানি। একটা 10 ওয়াটের বাল্ব এক মিটার দূর থেকে যত উজ্জ্বল দেখাবে, দু মিটার দূর থেকে তার ঔজ্জ্বল্য হবে তার ঠিক চার ভাগের এক ভাগ। মহাকাশে যদি কোনো এরকম কিছু পাওয়া যায়, তাহলে তার পৃথিবীতে প্রতি সেকেন্ডে কত শক্তি আসছে তা মেপে আমরা তার দূরত্ব নির্ণয় করতে পারি। ধরা যাক তার থেকে প্রতি সেকেন্ডে E পরিমাণ শক্তি নির্গত হচ্ছে। উৎসের থেকে D দূরত্বে যদি প্রতি একক ক্ষেত্রফলের মধ্যে দিয়ে লম্বভাবে  I পরিমাণ শক্তি যায়, তাহলে
I=E/4πD

পৃথিবীতে বসে I মাপা খুব সহজ, তাই E জানা থাকলে দূরত্ব D পাওয়া যাবেএকে বলে স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডল পদ্ধতি। আমরা দুটো স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডলের কথা আলোচনা করব।
       প্রথমটা হলে সেফিড ভেরিয়েবল বা পরিবর্তনশীল নক্ষত্র। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে এদের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে কমে। এবার নিচের ছবিটার দিকে তাকান। এখানে সেফিড ভেরিয়েবলের ঔজ্জ্বল্যের সঙ্গে তার পর্যায়কাল, অর্থাৎ তার একবার বাড়তে কমতে করতে সময় লাগবে তা দেখানো হয়েছে। ওই সরলরেখা দুটো দু ধরনের সেফিডের ঔজ্জ্বল্য আর পর্যায়কালের মধ্যে সম্পর্ক দেখাচ্ছে। এখানে একটা কথা বলে রাখি, জ্যোতির্বিদ্যাতে দুইরকম ঔজ্জ্বল্যের কথা আছে। আপাত ঔজ্জ্বল্য হল পৃথিবী থেকে আমরা জ্যোতিষ্কটাকে কতটা উজ্জ্বল দেখি, নিরপেক্ষ ঔজ্জ্বল্য জ্যোতিষ্কটা আসলে কতটা উজ্জ্বল তা বোঝায়-- সে কথা এই লেখার পরিশিষ্টে পাওয়া যাবে। এই লেখাতে আমরা ঔজ্জ্বল্য বলতে সবসময় দ্বিতীয়টা বুঝব। ঔজ্জ্বল্য ঋণাত্মক দেখে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, ঐতিহাসিক কারণে জ্যোতিষ্কদের ঔজ্জ্বল্যের মাপটা এমনই হয়ে গেছে যে যত উজ্জ্বল, তার ঔজ্জ্বল্যের মাপ তত কম। দু ধরনের সেফিডের মধ্যে তফাত করাও শক্ত নয়, প্রথম শ্রেণির সেফিডদের বর্ণালীতে ধাতুর রেখা দেখা যায়, দ্বিতীয় শ্রেণির সেফিডে তারা অনুপস্থিত। (জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে হাইড্রোজেন আর হিলিয়াম ছাড়া সবই ধাতু, এমনকি নাইট্রোজেন অক্সিজেন কার্বন -- এরা সবাই ধাতু!) পর্যায়কাল বার করা খুব সোজা, একবার ঔজ্জ্বল্যটা মেপে নিলাম, তারপর আবার বেড়ে কমে যখন আগের জায়গায় ফিরে এলো, মাঝের সময়টাই পর্যায়কাল। সেফিডের ঔজ্জ্বল্য ও পর্যায়কালের মধ্যে সম্পর্কটা নির্ণয় করেছিলেন মহিলা বিজ্ঞানী হেনরিয়েটা লেভিট। লেভিট ও তাঁর মতো অনেক মহিলাই উনিশ শতকের শেষে ও বিশ শতকের শুরুতে হার্ভার্ড মানমন্দিরে কাজ করতেন। তাঁদের বলা হত হার্ভার্ড কম্পিউটার্স – এখানে কম্পিউটার অর্থে গণক। সমকাল তাঁদের বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকার করতে কুণ্ঠা বোধ করলেও জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে তাঁদের অবদান এখন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা হয়। ব্লগের এই লেখাতে তাঁদের কথা পড়া যাবে।
       দেখা যাচ্ছে যে সেফিডের পর্যায়কাল জানা থাকলে তার ঔজ্জ্বল্য মাপা সম্ভব, অর্থাৎ আমরা উপরের সমীকরণে E জেনে গেছি। তাহলে পৃথিবীতে আমাদের টেলিস্কোপে প্রতি সেকেন্ডে তার থেকে কত শক্তি এসে পড়ছে মেপে তার দূরত্ব মাপা সম্ভব। আমাদের থেকে অন্য গ্যালাক্সিদের দূরত্ব বিশাল, গ্যালাক্সির সাইজ তার কাছে খুবই কম। তাই সেই গ্যালাক্সির সেফিডের দূরত্বকেই আমরা গ্যালাক্সির গুরুত্ব ধরে নিতে পারি। এভাবেই অ্যান্ড্রোমিডার মতো আমাদের কাছাকাছি গ্যালাক্সিদের দূরত্ব মাপা হয়েছে।  
       অপেক্ষাকৃত দূরের গ্যালাক্সিদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি চলবে না, কারণ সেখানে একটা নক্ষত্রকে আলাদা করে আমরা দেখতে পাই না। তাই সেফিড চেনা সম্ভব নয়। তাদের ক্ষেত্রে যে স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডল আমরা ব্যবহার করি, তা হল এক বিশেষ ধরনের বিস্ফোরণ যাদের বলে ওয়ান এ সুপারনোভা। আমরা জানি সুপারনোভা বিস্ফোরণে এতই শক্তি বেরোয় যে গোটা একটা গ্যালাক্সির থেকেও সুপারনোভাকে সাময়িকভাবে উজ্জ্বল দেখায়, পরে তা আস্তে আস্তে কমে যায়। ওয়ান এ সুপারনোভা কেমনভাবে হয় তার আলোচনায় যাচ্ছি না, কিন্তু সমস্ত ওয়ান এ সুপারনোভার সর্বোচ্চ ঔজ্জ্বল্যের মান সমান। তাই সেফিডের মতো একই সমীকরণ ব্যবহার করে সুপারনোভার দূরত্ব বার করা সম্ভব। এখানে একটা সুবিধা হল যে সুপারনোভা যে কোনো সাধারণ নক্ষত্রের থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল, তাই বহু দূরের গ্যালাক্সিতে বিস্ফোরণ হলেও তার দূরত্ব মাপা সম্ভব। কিন্তু অসুবিধা হল যে ওয়ান এ সুপারনোভা বিস্ফোরণ একটা গ্যালাক্সিতে একশো বছরে গড়ে একটাও ঘটে না। তাই অধিকাংশ গ্যালাক্সির দূরত্ব এভাবে মাপা সম্ভব নয়।
       সব থেকে দূরের গ্যালাক্সিদের দূরত্ব মাপার জন্য এক সম্পূর্ণ অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। তার জন্য আমাদের গ্যালাক্সির বেগটা জানতে হয়। ডপলার ক্রিয়ার সাহায্যে আমাদের সাপেক্ষে কোনো নক্ষত্র বা গ্যালাক্সির বেগ মাপা যায়। ডপলার ক্রিয়া কী? স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি, সামনে দিয়ে একটা এক্সপ্রেস ট্রেন হুইসল দিতে দিতে চলে যাচ্ছে। যখন সে আমার দিকে আসছে, তখন তার হুইসলের স্বরগ্রাম অর্থাৎ কম্পাঙ্ক বেশি মনে হচ্ছে। যখন আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, হুইসলের কম্পাঙ্ক কমে যাচ্ছে। একে বলে ডপলার ক্রিয়া। আলোর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। যে জ্যোতিষ্ক আমাদের দিকে আসছে, তার থেকে নির্গত আলোর কম্পাঙ্ক বেড়ে যায়, যে আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তার কম্পাঙ্ক কমে যায়। এই কম্পাঙ্ক বাড়া কমা থেকে উৎসের বেগ নির্ণয় করা যায়।
       আমরা জানি প্রায় তেরোশো কোটি বছর আগে বিগ ব্যাঙ বিস্ফোরণে মহাবিশ্বের জন্ম, তার পর থেকে তা প্রসারিত হচ্ছে। ফলে গ্যালাক্সিরা সাধারণভাবে এক অন্যের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।  প্রায় সব গ্যালাক্সি যেহেতু আমাদের থেকে দূরে চলে যাচ্ছে, তাই তাদের আলোর কম্পাঙ্ক কমে যায়। একে বলে মহাজাগতিক লোহিতাপসরণ (Cosmological red shift)। দূরের গ্যালাক্সিদের বেগ আলোর বেগের কাছাকাছি পৌঁছে যায়, তাই সেখানে বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের জন্য কম্পাঙ্কের পরিবর্তন ও বেগের মধ্যের সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। বিজ্ঞানী এডউইন হাবল দেখিয়েছিলেন যে দূরের গ্যালাক্সিদের বেগ v এবং দূরত্ব D-এর মধ্যে একটা খুব সহজ সম্পর্ক আছে। সেটা হল
v=Hd
H-কে বলা হয় হাবলের ধ্রুবক। এর মান হল 67.4 কিলোমিটার/সেকেন্ড/মেগাপারসেক। মেগাপারসেক মানে দশ লক্ষ পারসেক। অর্থাৎ আমাদের থেকে একহাজার মেগাপারসেক দূরে যে গ্যালাক্সি আছে, সে আমাদের থেকে এক সেকেন্ডে মোটামুটি 67400 কিলোমিটার দূরে সরে যাচ্ছে।
এই মানটা পেলাম কেমন করে? সেফিড তারা বা সুপারনোভা থেকে যেসব গ্যালাক্সির দূরত্ব মাপা গেছে, তাদের D জানি। ডপলার ক্রিয়া থেকে তাদের v-এর মান মাপলাম। এই দুটো মাপ থেকে H-এর মান  সহজেই বার করে নেওয়া সম্ভব। এবার যে গ্যালাক্সির দূরত্ব জানি না, ডপলার ক্রিয়া থেকে তার বেগ বার করে উপরের সম্পর্কটা ব্যবহার করে দূরত্ব নির্ণয় করা খুব সহজ। এভাবে এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে দূরের যে জ্যোতিষ্কের খোঁজ আমরা পেয়েছি তা হল এক 1339 কোটি আলোকবর্ষ দূরের এক গ্যালাক্সি GN-z11। দূরত্ব নির্ণয় করার আরো কিছু পদ্ধতি আছে, তবে আমরা যেগুলো আলোচনা করলাম সেগুলিই বেশি ব্যবহার করা হয়।
       1998 সালে সুপারনোভার সাহায্যে দূরের গ্যালাক্সিদের দূরত্ব মাপার সঙ্গে সঙ্গে ডপলার ক্রিয়া ব্যবহার করে তাদের বেগ মাপতে গিয়ে এক অভাবনীয় ঘটনা ধরা পড়ে। দেখা যায় গ্যালাক্সিদের এক অন্যের থেকে দূরে সরে যাওয়ার বেগ আগের থেকে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে। গ্যালাক্সিরা একে অপরের সঙ্গে মাধ্যাকর্ষণের মাধ্যমে ক্রিয়া করে, কিন্তু মাধ্যাকর্ষণের থেকে কিছুতেই এই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করা যায় না। একটা ঢিল উপরদিকে ছুঁড়লাম, তার বেগ মাধ্যাকর্ষণের টানে ক্রমশ কমবে, একসময় থেমে যাবে তারপর ফিরে আসবে। আরো জোরে ছুঁড়লাম, আবার বেগ কমবে, থামবে, ফিরে আসবে। যদি মুক্তিবেগ নিয়ে ছুঁড়তে পারতাম, তাহলে থামত না বা ফিরেও আসত না, কিন্তু বেগ কমতেই থাকত। তাহলে গ্যালাক্সিদের বেগ ক্রমশ বাড়ছে কেন?  এর পিছনের কারণের একটা নাম দেওয়া হয়েছে, কৃষ্ণ শক্তি বা ডার্ক এনার্জি। আরো একটা কথা একটু পরে আসবে, কৃষ্ণ পদার্থ বা ডার্ক ম্যাটার। কিন্তু এরা যে কী সে প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি না। কৃষ্ণ শক্তি ও কৃষ্ণ পদার্থ  বিষয়ে এইখানে পড়তে পারেন।
       বেগ মাপার প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলে রাখি। সৌরজগতের বাইরে গ্রহ খুঁজে পাওয়ার একটা উপায় হল তারকার বেগ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কেমন পালটায় তা দেখা। গ্রহ থাকলে তার মাধ্যাকর্ষণের জন্য নক্ষত্রের বেগের পরিবর্তন হবে। নিচের ছবিতে প্রক্সিমা বি গ্রহের জন্য প্রক্সিমা সেন্টরাই নক্ষত্রের বেগ কেমন পালটায় তা দেখা যাচ্ছে। আরো জানতে হলে এই লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন। 
       এরপর আসা যাক তারকাদের ভর নির্ণয়ের কথায়। যে নক্ষত্রের কাছাকাছি অন্য কোনো জ্যোতিষ্ক নেই, সরাসরি তার ভর মাপার কোনো পদ্ধতি আমাদের জানা নেই। কিন্তু মহাবিশ্বে অধিকাংশ নক্ষত্রই যুগ্ম (biary) হিসাবে অবস্থান করে। গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত কেপলারের সূত্র যুগ্ম নক্ষত্রের জন্য ব্যবহার করে তাদের ভর বার করা সম্ভব। নিচের ছবিটা দেখুন। এখানে দুটি তারা তাদের সাধারণ ভরকেন্দ্রের চারপাশে বৃত্তাকার কক্ষপথে ঘুরছে। দুটো তারার কক্ষপথের ব্যাসার্ধ যথাক্রমে R1 R2 এবং ভর যথাক্রমে M1 M2
       ভরকেন্দ্রের সমীকরণ থেকে পাওয়া যায়
R1M1=R2M2

নক্ষত্র দুটি যদি একে অন্যের চারদিকে
T সময় নিয়ে পাক খায়, তাহলে কেপলারের সূত্র থেকে দেখানো যায়
M1+M2=4π2(R1+R2 )3/T2G
G হল নিউটনের মহাকর্ষীয় ধ্রুবক। এখানে দুটো সমীকরণ আছে, তাদের থেকে দুটি অজ্ঞাত রাশি M1 M2 –র মান সহজেই বার করা যায়। আমাদের সূর্যের তুলনায় পৃথিবীর ভর এতই কম যে উপরের সমীকরণে তাকে আমরা শূন্য ধরে নিতে পারি। পৃথিবীর ক্ষেত্রে R1+R2 = পনের কোটি কিলোমিটার, T হল এক বছর। সমীকরণে মহাকর্ষীয় ধ্রুবকের মান বসিয়ে সূর্যের ভর পাই 1.99X1030 কিলোগ্রাম নক্ষত্রের ভর সাধারণত সূর্যের ভরের  M-এর এককে প্রকাশ করা হয়। আমরা যে লুব্ধক নক্ষত্রকে দেখি, তা আসলে এক যুগ্ম নক্ষত্র যারা 50.1 বছরে একবার একে অপরকে প্রদক্ষিণ করে। এদের জন্য R1 R2  হল 13.2 এইউ ও 6.6 এইউ। যুগ্ম নক্ষত্রের মধ্যে একটা হল শ্বেত বামন নক্ষত্র সিরিয়াস বি যার ঔজ্জ্বল্য খুব কম। উপরের সমীকরণ থেকে আমরা দুটি তারকারই ভর নির্ণয় করতে পারি। সিরিয়াস বি-র ভর সূর্যের ভরের প্রায় সমান। অন্য নক্ষত্রটা হল সিরিয়াস এ, তার ভর 2M  অর্থাৎ সূর্যের ভরের দ্বিগুণ -- সেটাকেই আমরা খালি চোখে দেখতে পাই।
       একটা কথা মনে রাখতে হবে, R1 R2-র মান জানতে গেলে কিন্তু আমাদের থেকে ঐ যুগ্ম তারার দূরত্ব জানা প্রয়োজন। কারণ দূরবিনে আমরা দুটো তারাকে যখন আলাদা করে দেখি, আমরা আসলে তাদের থেকে আসা আলো কতটা কোণ করে আসছে মাপতে পারি। সেই কোণকে আমাদের থেকে তাদের দূরত্ব D দিয়ে গুণ করে r1 r2-র মান বার করা সম্ভব। নিচের ছবিটাতে হয়তো বিষয়টা পরিষ্কার হবে। দূরবিন দিয়ে θ1 ও θ2 মাপা যাবে। তার থেকেR1=Dθএবং  R2=Dθ2বার করা যাবে
       সরাসরি নক্ষত্রের ভর মাপার অন্য কোনো পদ্ধতি জানা নেই। যদি জ্যোতিষ্ক দুটিকে দূরবিনে আলাদা না দেখা যায়, তাহলে এই পদ্ধতি অচল, কারণ সেক্ষেত্রে R1 R2 নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে একেবারে জানা না গেলেও কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব। সেই আলোচনায় আর যাচ্ছি না। গ্যালাক্সিদের নিজেদের মধ্যে মাধ্যাকর্ষণের টানে চলাফেরা বা কোনো গ্যালাক্সির টানে আলো কতটা বেঁকে যায় তার থেকে সেই গ্যালাক্সির ভর অনুমান করা যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের সাহায্য লাগবে। দেখা গেছে গ্যালাক্সিদের ভরের অধিকাংশটাই এমন পদার্থ যা আলোর সঙ্গে ক্রিয়া করে না, তাই বিজ্ঞানীরা কোনো নতুন ধরনের পদার্থের কথা চিন্তা করছেন। তার নাম দেওয়া হয়েছে কৃষ্ণ পদার্থ বা ডার্ক ম্যাটার, যদিও আগেই বলেছি সেটা যে আসলে কী তা আমরা জানি না।
       দূরের নক্ষত্রদের উপরিতলের তাপমাত্রা মাপার বিষয়টা অপেক্ষাকৃত সোজা। তারকাদের আমরা মোটামুটি ব্ল্যাক বডি বা কৃষ্ণ বস্তু হিসাবে ধরে নিতে পারি। তার পক্ষে যুক্তিও আছে, তবে তা আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে। উত্তপ্ত কৃষ্ণ বস্তু থেকে আলো বা আরো সঠিক ভাবে বললে তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ নির্গত হয়। সেই তরঙ্গের বর্ণালীর তীব্রতা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের সঙ্গে সঙ্গে পালটে যায়। যে তরঙ্গদৈর্ঘ্যে বর্ণালীর তীব্রতা সব থেকে বেশি তাকে যদি λmax বলি, তাহলে ঐ তারার উপরিতলের গড় তাপমাত্রা কৃষ্ণ বস্তুর জন্য ভীনের সূত্র থেকে নির্ণয় করা যায়
T=b/λmax
যেখানে b হল ধ্রুবক এখানে T তাপমাত্রার কেলভিন স্কেলে পাওয়া যাবে। যেমন সূর্যের বর্ণালী থেকে পাওয়া  যায় যে λmax হল 500 ন্যানোমিটারের কাছাকাছি তার থেকে জানা যায় সূর্যের উপরিতলের গড় তাপমাত্রা হল 5800 কেলভিনের মতো। সিরিয়াস এ ও বি-র উপরিতলের গড় তাপমাত্রা হল যথাক্রমে সাড়ে দশ হাজার ও পঁচিশ হাজার কেলভিনের কেলভিনের কাছাকাছি। তবে কেন্দ্রের তাপমাত্রা অনেক বেশি, তাকে সরাসরি মাপা যায় না। নক্ষত্রের বাইরে অংশের তাপমাত্রা মাপার আরো একটা পদ্ধতি আছে, মেঘনাদ সাহার আবিষ্কৃত সাহা আয়নন সমীকরণ থেকে তাপমাত্রা নির্ভুল্ভাবে মাপা সম্ভব। কিন্তু সেই আলোচনা অপেক্ষাকৃত জটিল, তাই তার মধ্যে আমরা আজ যাচ্ছি না। আগ্রহী পাঠক এই লেখাটি পড়ে দেখতে পারেন। 
       নক্ষত্ররা কত বড়? সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব জানি। সূর্য আমাদের চোখে 0.53 ডিগ্রি অর্থাৎ 0.0092 রেডিয়ান কোণ করে সেটাও জানি। এই দুটো সংখ্যাকে গুণ করলে সূর্যের ব্যাস পেয়ে যাই প্রায় চোদ্দ লক্ষ কিলোমিটার। কিন্তু আমাদের দূরবিনে সূর্য ছাড়া সব নক্ষত্রকেই বিন্দুর মতো দেখায়, তাই তাদের ব্যাস সরাসরি নির্ণয় করা সহজ নয়। খুব কম সংখ্যক নক্ষত্রের ব্যাস আমরা মাপতে পেরেছি, এখানে সেই আলোচনা সম্ভব নয় তবে একটা পরোক্ষ উপায় আছে। আমরা উপরিতলের গড় তাপমাত্রা কেমন ভাবে মাপা যায় তা দেখলাম। তাপগতিবিদ্যার স্টেফান-বোলজ্‌ম্যান সূত্র অনুযায়ী কৃষ্ণ বস্তুর উপরের প্রতি একক ক্ষেত্রফল থেকে প্রতি সেকেন্ডে σT4  পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়। এখানে σ হল স্টেফানের ধ্রুবক। যদি ধরে নিই যে জ্যোতিষ্কটি R ব্যাসার্ধের একটি গোলক, তাহলে তার মোট পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল হল 4πR2, সুতরাং তার থেকে প্মোরতি সেকেন্ডে শক্তি বেরোয় E=4πRσT4  আগেই দেখেছি যে জ্যোতিষ্কটি যদি D দূরত্বে থাকে, তাহলে আমাদের দূরবিনে প্রতি একক ক্ষেত্রফলে যে শক্তি এসে পড়ে তার পরিমাণ E/4πD2=R2σT4/D2সুতরাং I, D ও T জানা থাকলে ব্যাসার্ধ R-এর মান জানা যাবে। যেমন সিরিয়াস এ-র ব্যাসার্ধ হল 11.9 লক্ষ কিলোমিটার। সিরিয়াস বি-এর ব্যাসার্ধ হল 5840 কিলোমিটার, পৃথিবীর থেকেও কম। ব্যাসার্ধ জানতে পারলে আয়তন জানা সহজ। ভরও যদি জানা থাকে, তাকে আয়তন দিয়ে ভাগ দিলে গড় ঘনত্ব পেয়ে যাব। সিরিয়াস এ-র গড় ঘনত্ব হল 0.57 গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার, জলের প্রায় অর্ধেক। সূর্যের ঘনত্ব হল 1.41 গ্রাম/ঘন সেন্টিমিটার। সিরিয়াস বি-এর ঘনত্ব হল 2.38 টন/ঘন সেন্টিমিটার, তার এক চামচ পদার্থের ওজন হবে এক টনের বেশি। শ্বেত বামন নক্ষত্রের তাপমাত্রা ও বিপুল ঘনত্ব থেকে নক্ষত্রের জীবন ইতিহাস সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পেরেছি, কিন্তু সে আলাদা আলোচনার বিষয়।
       সবশেষে আসি নক্ষত্ররা কী দিয়ে তৈরি। বিজ্ঞানী গুস্তাফ কিরশফ দেখিয়েছিলেন যে নিরবচ্ছিন্ন আলোকে যদি কোনো মৌলিক পদার্থের গ্যাস বা বাষ্পের মধ্যে দিয়ে পাঠানো হয়, তাহলে সেই মৌল কয়েকটা নির্দিষ্ট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো শোষণ করে। এই তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো প্রত্যেক মৌলিক পদার্থের জন্য আলাদা। তাহলে সেই তরঙ্গদৈর্ঘ্যগুলো জানতে পারলে আমরা মৌলিক পদার্থটাকে চিনতে পারব। বিজ্ঞানী জোসেফ ফন ফ্রনহফার সূর্য থেকে আসা আলোর বর্ণালী বিশ্লেষণ করেছিলেন তিনি দেখেছিলেন উজ্জ্বল পটির উপরে অনেকগুলো কালো রেখা দেখা যায় কিরশফ ও রবার্ট বুনসেন বললেন সূর্যের ভিতরটা সাংঘাতিক গরম, বাইরেটা অপেক্ষাকৃত ঠাণ্ডা ভিতর থেকে যে আলো আসছে, বাইরের গ্যাস সেই আলো শোষণ করছে। তাহলে ফ্রনহফার বর্ণালীতে কালো কালো রেখাগুলো নিশ্চয় আলোটা কোন কোন মৌলিক পদার্থের মধ্যে দিয়ে আসছে তা দেখাচ্ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু রেখার উৎস পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের সূর্যালোক শোষণ সেই অংশ বাদ দিলে যা পড়ে থাকবে তা নিশ্চয় সূর্যের বাইরের অংশে কোন কোন মৌল আছে তা দেখাচ্ছে। এভাবে সূর্যে লোহা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, নিকেল, তামা, বেরিয়াম, সোডিয়াম ইত্যাদি আছে, তা দেখা যায়। অবশ্য আমরা এখন জানি সূর্য বা অন্য নক্ষত্র মূলত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে তৈরি। সৌর বর্ণালী থেকে সেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে প্রয়োজন হয়েছিল মেঘনাদ সাহা আবিষ্কৃত আয়নন সমীকরণের, কিন্তু আগেই বলেছি সে কথাও আমাদের আজকের আলোচনার বাইরে।
       মহাকাশের মাপনিদের কথা এখানেই শেষ করা যাক। আলোচনার সুবিধার জন্য  যতটা সরল করে লেখা হয়েছে, বিষয়টা সবসময় ততটা সরল নয়। যেমন তারারা সাধারণত বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার পথে একে অপরকে প্রদক্ষিণ করে। সেক্ষেত্রেও কেপলারের সূত্র প্রয়োগ করা যায়, তবে সেটা এত সহজে লেখা যায় না। আমরা দেখলাম বিজ্ঞানের যে সমস্ত সূত্র আমাদের জানা, পৃথিবীতেই পরীক্ষা করে যাদের আবিষ্কার করা হয়েছে -- তাদের ব্যবহার করে জ্যোতিষ্কদের সম্পর্কে নানা খবর জোগাড় করা হয়েছে।  এই সমস্ত খবর থেকে আমরা জ্যোতির্পদার্থবিদ্যার তত্ত্ব নির্মাণ করেছি, মহাবিশ্বকে বুঝতে শিখেছি। এখানে একটা কথা খুব গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র সূত্র জানলেই তো হবে না, পর্যবেক্ষণের জন্য যন্ত্রপাতির উন্নতিও করতে হয়েছে। সেই কথা এই নিবন্ধের বাইরে রয়ে গেল, কিন্তু তাছাড়া কোনোভাবেই আমরা মহাকাশের জ্যোতিষ্কদের সম্পর্কে এত খবর সংগ্রহ করতে পারতাম না।

পরিশিষ্ট
আপাত ও প্রকৃত ঔজ্জ্বল্য
       গ্রহ তারা নক্ষত্রদের ঔজ্জ্বল্য মাপার জন্য আমরা যে স্কেল ব্যবহার করি তা শুরু করেছিলেন প্রাচীন যুগের গ্রিক বিজ্ঞানী হিপ্পারকাস। সে দূরবিন আবিষ্কারের অনেক আগের কথা। তিনি চাঁদ ও সূর্যের বাইরে আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের ঔজ্জ্বল্যের মান ধরেছিলেন 1, এবং সবচেয়ে অনুজ্জ্বল তারকার মান ধরেছিলেন 6। 1856 সালে নর্মান রবার্ট পগসন মাপটা একটু পরিবর্তন করেন। তিনি বললেন 1 মাপের উজ্জ্বল তারকা 2 মাপের উজ্জ্বল তারকার থেকে 2.512 গুণ বেশি শক্তি আমাদের কাছে পাঠায়, সে আবার 3 মাপের তারকার থেকে 2.512 গুণ বেশি শক্তি পাঠায়। এভাবে দেখলে 1 মাপের উজ্জ্বল তারকা 6 মাপের তারকার থেকে একশো গুণ বেশি শক্তি পাঠায়। এই 2.512 সংখ্যাটাকে বলা হয় পগসনের অনুপাত। যে জ্যোতিষ্ক যত উজ্জ্বল, পগসন স্কেলে তার মান তত কম। এই মাপে সূর্যের ঔজ্জ্বল্য হল -26.74। অভিজিৎ বা ভেগা নক্ষত্রের মান শূন্য ধরে হিসাবটা করা হত, এখন অবশ্য কৃত্রিম মান ব্যবহার করা হয়।
       এই ঔজ্জ্বল্যের মাপে কিন্তু পৃথিবী থেকে দূরত্বের হিসাব রাখা হয় না। তাই লুব্ধক আসলে সূর্যের থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল হলেও তার ঔজ্জ্বল্যের মান হয় -1.2। একে তাই বলা হয় আপাত ঔজ্জ্বল্য (Apparent magnitude)। এছাড়া আরো একটা মাপ আছে, নিরপেক্ষ ঔজ্জ্বল্য (Absolute magnitude)। জ্যোতিষ্কটা যদি ঠিক দশ পারসেক দূরে থাকে তাহলে তার আপাত ঔজ্জ্বল্য যত হত, তাকেই বলা হয় তার  নিরপেক্ষ ঔজ্জ্বল্য। নিরপেক্ষ ঔজ্জ্বল্য থেকে বোঝা সম্ভব কোন জ্যোতিষ্ক বেশি শক্তি বিকিরণ করছে। এর মান নির্ণয় করতে গেলে জ্যোতিষ্কটার দূরত্ব জানা প্রয়োজন। সূর্যের নিরপেক্ষ ঔজ্জ্বল্য হল 4.83