Friday 30 October 2020

বেকনপন্থী অক্ষয়কুমার: দ্বিশতবর্ষে ফিরে দেখা


বেকনপন্থী অক্ষয়কুমার: দ্বিশতবর্ষে ফিরে দেখা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ তাঁহাদের আবশ্যক হইয়াছিল।

       ইংরেজ দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকনের (১৫৬১-১৬২৬) চিন্তাধারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জন্ম দিয়েছিল। তাঁকে দর্শনে এম্পিরিসিজম বা অভিজ্ঞতাবাদের জনক বলা হয়। অভিজ্ঞতাবাদ অনুযায়ী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে জ্ঞানলাভ সম্ভব, এবং জ্ঞানের একমাত্র বা প্রাথমিক উৎস হল অভিজ্ঞতা। বেকন মনে করতেন যে প্রকৃতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণ ও আরোহী যুক্তির প্রয়োগই হল বিজ্ঞানের নিয়ম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র পথ। এর সঙ্গে তিনি জোর দিয়েছিলেন পরীক্ষা করে সেই সিদ্ধান্তের সত্যতা যাচাইয়ের উপর। বিজ্ঞানীকে সবসময়েই নিজের সিদ্ধান্ত সম্পর্কেও সন্দিহান থাকতে হবে। অভিজ্ঞতাবাদ ও আরোহী যুক্তির সম্মিলনই ইউরোপে মধ্যযুগীয় খ্রিস্টান ধ্যানধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের নবজন্ম ঘটিয়েছিল। বেকনের মতে বিজ্ঞানের লক্ষ্য হল মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি। আমাদের দেশে বেকনের প্রথম অনুসারী রামমোহন রায়, পাশ্চাত্য শিক্ষার সমর্থনে ১৮২৩ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে লেখা রামমোহনের সেই বিখ্যাত চিঠিতে তিনি বারবার বেকনের মতকেই নিজের সমর্থনে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু তিনি বেকনের পাশাপাশি বেদান্তের চর্চাও চেয়েছিলেন, স্পষ্টতই তা স্ববিরোধী। বেদান্তের ‘ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা’, এই উক্তির সঙ্গে অভিজ্ঞতাবাদকে মেলানো সম্ভব নয়। আধুনিক বিজ্ঞানের ভগীরথ বেকনের আমাদের দেশে প্রথম সার্থক শিষ্য তাহলে কে?
       এই বছর আমরা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পালন করছি। সমাজ সংস্কার, নারী শিক্ষার প্রসার, আধুনিক শিক্ষাচিন্তা – নানা দিক দিয়ে বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তাঁর সমবয়সী ও ঘনিষ্ঠ একজনের কথা আমরা প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। এ বছর তাঁরও জন্মের দ্বিশতবর্ষ পূর্ণ হচ্ছে, তিনি অক্ষয়কুমার দত্ত। বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান রচনাতে তিনি পথিকৃৎ, সেই কথা যদিও বা মনে রেখে থাকি, আমরা ভুলতে বসেছি তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা ও দর্শনচিন্তার কথা। এই দুই ক্ষেত্রে অক্ষয়কুমারের দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দিয়েছিল বেকনের দর্শন। বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমার দু’জনেই বেকনের অভিজ্ঞতাবাদের অনুসারী ছিলেন। বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে তা জানতে পারি বারাণসীর সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ব্যালান্টাইনের নির্ধারিত সংস্কৃত কলেজের পাঠক্রম বিষয়ে তাঁর চিঠি ও রিপোর্টে, কিন্তু সেই সময় তা প্রকাশ্যে আসে নি।  বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে তাঁর মত আলোচনাতে উৎসাহী ছিলেন না, তাঁর সেই সময়ও ছিল না। যিনি প্রথম আমাদের দেশে অভিজ্ঞতাবাদকে আত্মস্থ করে তার ধ্বজা প্রকাশ্যে তুলে ধরেছিলেন তিনি অক্ষয়কুমার দত্ত।


       খুব সংক্ষেপে অক্ষয়কুমারের জীবন সম্পর্কে জেনে নিই। তাঁর জন্ম ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই বর্ধমানের চুপীগ্রামে। বাবার নাম পীতাম্বর দত্ত, মা দয়াময়ী। একসময়ে অবস্থাপন্ন হলেও অক্ষয়কুমারের জন্মের সময় তাঁদের পারিবারিক অবস্থা ভালো ছিল না। ন’বছর বয়সে তাঁর জাঠতুতো দাদা হরমোহন দত্ত তাঁকে খিদিরপুরে নিজের কাছে এনে রাখেন। কিন্তু আগে বাবা বা পরে দাদা কেউই অক্ষয়কুমারের পড়াশোনা নিয়ে খুব একটা চিন্তা করতেন না। তাঁদের অবহেলাতে ছ’টা বছর নষ্ট হওয়ার পরে কিশোর অক্ষয়কুমারের শিক্ষালাভের আগ্রহেই তাঁকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে ভর্তি করতে হয়। সেই সময় তিনি থাকতেন অন্য এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কাছে, তাঁর আর্থিক অবস্থা একেবারেই ভালো ছিল না। এক সময় স্কুলে মাইনে বাকি পড়েছিল, কিন্তু প্রধান শিক্ষক গৌরমোহন আঢ্য তাঁর অসাধারণ ছাত্রটিকে সেই কারণে স্কুল ছাড়তে দেন নি।
       কিন্তু পারিবারিক কারণে স্কুল ছাড়তেই হয়েছিল তাঁকে, ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে তিনি পড়তে পেরেছিলেন মাত্র আড়াই বছর। আগেই পনেরো বছর বয়সে বাবা মায়ের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছেন, স্ত্রীর নাম নিমাইমণি। তাঁর যখন উনিশ বছর বয়স, বাবা মারা গেলেন। মা তাঁকে পড়া ছেড়ে অর্থ উপার্জন শুরু করতে বাধ্য করেন। অঙ্ক ও ইংরাজি শিখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন।পাশাপাশি স্কুল ছাড়লেও নিজে পড়াশোনা চালিয়ে যান। এমন কি মেডিক্যাল কলেজেও ক্লাস করেছিলেন। শিখেছিলেন সংস্কৃত, ফারসি, ইংরাজি, লাতিন, গ্রিক, হিব্রু, ফরাসি ও জার্মান ভাষা।
       তাঁর লেখালেখি শুরু হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকাতে। তাঁর রচনা তাঁকে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নজরে এনেছিল। দেবেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা চালু করেছিলেন, অক্ষয়কুমার নিযুক্ত হলেন সম্পাদক। দুজনের এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থায়ী হয়নি, সেই প্রসঙ্গে পরে আসব। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার সময় তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের, তিনি তাঁকে নর্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে নিয়োগ করেন। অক্ষয়কুমার অনিচ্ছার সঙ্গে সেই চাকরি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। অনিচ্ছার কারণ, পড়াশোনাতে ব্যাঘাত ঘটবে। খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিন বছর পরে তিনি সেই কাজ ছাড়তে বাধ্য হন। বিদ্যাসাগর তাঁর জন্য মাসিক পঁচিশ টাকার বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। অবশ্য তার কিছুদিন পরেই তিনি সেই বৃত্তি প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর লেখা বইয়ের বিক্রি থেকে যে টাকা তিনি সেই সময় আয় করতে শুরু করেছিলেন, তাতে তিনি কলকাতা ও তার আশেপাশে একাধিক বাড়ি কিনতে সক্ষম হয়েছিলেন। বালিতে নিজের বাড়িতে একটা ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা ও ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন, বাড়ির বাইরে স্থাপন করেছিলেন বোটানিক্যাল গার্ডেন। প্রচণ্ড শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও লেখালেখি ও গবেষণা চালিয়ে গিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। শেষ পর্যন্ত  ২৮ মে ১৮৮৬ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
       বাংলা ভাষার বিজ্ঞান সাহিত্যের সূচনা করেছিলেন অক্ষয়কুমার। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে আছে ‘ভূগোল’ (প্রকাশকাল ১৮৪১), ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ (প্রথম ভাগ, ১৮৫১; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৩) ‘চারুপাঠ’ (প্রথম ভাগ ১৮৫৩; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৪; তৃতীয় ভাগ ১৮৫৯),‘পদার্থবিদ্যা’ (১৮৫৬), ধর্মনীতি (১৮৫৬), ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (প্রথম ভাগ ১৮৭০; দ্বিতীয় ভাগ ১৮৮৩) প্রভৃতি। প্রথম দিকের বইগুলি মূলত অনুবাদ ও সংকলন। অনুবাদ বলে তাদের তুচ্ছ করার কোনো কারণ নেই, বিজ্ঞানের সিঁড়িতে পা রাখার ক্ষেত্রে অনুবাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মধ্য যুগে আরব সভ্যতাতে বিজ্ঞানের চোখ-ধাঁধানো বিকাশের সূচনা হয়েছিল গ্রিক ও সংস্কৃত থেকে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা অনুবাদের মাধ্যমে। পরবর্তীকালে আবার আরবি থেকে লাতিন ভাষায় অনুবাদ ইউরোপের বিজ্ঞানে জোয়ার আনে।  অক্ষয়কুমারের অনুবাদ কিন্তু শুধুমাত্র ভাষান্তর নয়, তাতে যথেষ্ট মৌলিক চিন্তাভাবনার ছাপ আছে। বাংলাতে বিজ্ঞান রচনার জন্য একই সঙ্গে তাঁকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল পরিভাষার। এক কথায় বলতে গেলে বাংলাতে বিজ্ঞান লেখার গদ্যরীতিই তাঁকে গড়ে নিতে হয়েছিল।  
       একটি প্রবন্ধে অক্ষয়কুমারের কর্মজীবনের সমস্ত দিকের প্রতি সুবিচার করা অসম্ভব। আগেই বলেছি, বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে অক্ষয়কুমারের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। যখন ভারতীয়রা বিদেশী শাসনের গুণগানে ব্যস্ত সেই সময় তিনি সরাসরি বিদেশী শাসনকে দেশবাসীর দুরবস্থার কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। নীলকরদের অত্যাচার ও চিরস্থায়ী ব্যবস্থাতে সৃষ্ট জমিদারদের প্রজাশোষণ সম্পর্কে সমালোচনা করতে তিনি পরাঙ্মুখ ছিলেন না। শেষ বিষয়টি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ কারণ জমিদার দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের বিবাদে সরাসরি না এলেও নিশ্চয় তার ছায়া পড়েছিল। ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ রচনা করতে গিয়ে তিনি তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে জাতিপ্রথা মানেন নি। পঞ্জিকাতে যে সময়কে অশুভ বলা হত, কুসংস্কার বিরোধী অক্ষয়কুমার সেই সময়কেই যাত্রা শুরুর জন্য বেছে নিতেন। কোনো পুজোর দিনে অন্যরা যখন স্নানের উদ্দেশ্যে গঙ্গার দিকে চলেছে, তখন গঙ্গানদীর পাশে বাড়ি থাকা সত্ত্বেও অক্ষয়কুমার সবাইকে দেখিয়ে পুকুরে চান করতেন। অক্ষয়কুমারের বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহের বিরোধিতা, বিধবা বিবাহের প্রতি সমর্থন তাঁকে সেই যুগে সংস্কার আন্দোলনের সামনের সারিতে স্থান করে দেয়। বিবাহিত জীবনে স্বামী ও স্ত্রীর সমানাধিকারের প্রতি তাঁর সমর্থন এক স্কুলের ছাত্রদের মধ্যে এমনই সমর্থন পেয়েছিল যে অভিভাবকরা স্কুলটাই পুড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এই ক্ষুদ্র লেখাতে আমরা শুধু অক্ষয়কুমারের বেকন অনুরাগের প্রতিই দৃষ্টি রাখব।
       অক্ষয়কুমারকে আকর্ষণ করেছিল বিজ্ঞান, তা পড়তে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় বেকনের অভিজ্ঞতাবাদের সঙ্গে। অভিজ্ঞতাবাদই সেই যুগে সবচেয়ে আধুনিক ও সার্থক বিজ্ঞানদর্শন। প্রথম জীবনে স্কটল্যান্ডের চিন্তাবিদ জর্জ কুম্বের মতের দ্বারা অক্ষয়কুমার প্রথম দিকে বিশেষ প্রভাবিত ছিলেন, তাঁর ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ হল কুম্বের ‘Constitution of Man in Relation to External Objects’ বইটির ভাবানুবাদ। ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশের পরে পরেই তিনি তা পড়েছিলেন। হয়তো অক্ষয়কুমারই আমাদের দেশে প্রথম ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বৈপ্লবিক তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিলেন। ডারউইন ছিলেন স্বঘোষিত ভাবেই বেকনের অনুগামী। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ ও তার থেকে সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ আধুনিক পাঠককেও চমকে দেয়।  ডারউইনের মত প্রচারে জীববিদ টমাস হাক্সলির অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল বেকনের আরোহী যুক্তিবাদকে আরও শাণিত করেছিলেন। আইজ্যাক নিউটনের চিন্তাধারার উপর বেকনের প্রভাব স্পষ্ট। নিউটনের একটি বিখ্যাত উক্তি, “Hypothesis non fingo”, আমি কোনো রকম পূর্বানুমান করি না। আগে থেকে কোনো ধারণা না করে পরীক্ষার মাধ্যমে যা পাওয়া যায়, তাই মেনে নেওয়ার এই চিন্তা বেকন দর্শনেরই অনুরূপ। রামমোহন যে বিখ্যাত চিঠিতে সুস্পষ্টভাবে বেকনের দর্শনকেই ব্রিটেন তথা ইউরোপের উন্নতির কারণ হিসাবে বর্ণনা করেছেন, তা অক্ষয়কুমার তাঁর বইতে উদ্ধৃত করেছিলেন। নিজের বাড়িতে রামমোহন, নিউটন, ডারউইন, টমাস হাক্সলি  ও জন স্টুয়ার্ট মিলের ছবি টানিয়ে অক্ষয়কুমার তাকে দেবালয় আখ্যা দিয়েছিলেন। লক্ষণীয় যে এই পাঁচজনই বেকনের দর্শনের অনুসারী। বেকনই হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর আরাধ্য। অনেকের মতে জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি হয়ে পড়েছিলেন অজ্ঞেয়বাদী, তিনি মনে করতেন ঈশ্বর থাকা বা না থাকার কোনো প্রমাণ নেই, যুক্তি দিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যাবে না। এই কথা নিয়ে এই লেখাতে পরে বিস্তারিত আলোচনা করব।
       অক্ষয়কুমারের প্রার্থনা-ইকুয়েশন একসময় কলকাতায় ঝড় তুলেছিল। হিন্দু হস্টেলের একদল ছাত্র একবার তাঁকে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনার উপযোগিতা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তিনি জিজ্ঞাসা করেন, কৃষক পরিশ্রমের মাধ্যমে কী পায়? উত্তর আসে শস্য। পরের প্রশ্ন হল পরিশ্রমের সঙ্গে প্রার্থনা যদি করে, তাহলে কী পাবে। আবারও উত্তর এলো শস্য। সুতরাং অক্ষয়কুমার বীজগণিতের সমীকরণ লিখলেন:
পরিশ্রম = শস্য
পরিশ্রম + প্রার্থনা = শস্য
অতএব, প্রার্থনা = ০
বেকনীয় অভিজ্ঞতাবাদের ছাপ এখানে স্পষ্ট। আধুনিক যুগের দৃষ্টিতে এই যুক্তির মধ্যে যে ফাঁকি ধরা পড়বে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু উনিশ শতকের মধ্যখানে দাঁড়িয়ে এই যুক্তিবিন্যাস কলকাতার শিক্ষিত মহলে আলোড়ন তুলেছিল। অক্ষয়কুমার কিন্তু তাতে খুশি হননি, বলেছিলেন, “বিশুদ্ধবুদ্ধি বিজ্ঞানবিৎ লোকের পক্ষে যাহা অতি বোধ-সুলভ, তাহা এদেশীয় লোকদের নূতন বোধ হইল এটি বড় দুঃখের বিষয়।” অর্থাৎ বিজ্ঞান দর্শনের প্রাথমিক পাঠই ভারতবর্ষে প্রসারিত হয়নি।
       দেবেন্দ্রনাথের স্থাপিত তত্ত্ববোধিনী সভার সঙ্গে অব্রাহ্মরাও যুক্ত হয়েছিলেন, বিদ্যাসাগরের নাম তাঁদের মধ্যে স্মরণীয়। অক্ষয়কুমার কিন্তু ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন, দেবেন্দ্রনাথ সহ প্রথম একুশ জন ব্রাহ্মের মধ্যে তিনিও একজন। সাধারণে চলিত হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতাতে তিনি আগেই বিশ্বাস হারিয়েছিলেন, কারণ বিশ্বইতিহাস পাঠ তাঁকে দেখিয়েছিল যে গ্রিক বা রোমান সভ্যতার যুগে ইউরোপের প্রচলিত ধর্মের দেবদেবীদের স্থান রয়েছে শুধু বইয়ের পাতায়। ব্রাহ্মধর্মের একেশ্বরবাদ তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল।
       ব্রাহ্মধর্মের দর্শন নির্ধারণে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। হিন্দুধর্মের বিশ্বাস বেদ অপৌরুষেয় অর্থাৎ মানুষের সৃষ্টি নয়, ঈশ্বরপ্রণীত; তাই তা অভ্রান্ত। প্রথম প্রথম দেবেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য  ব্রাহ্মরাও তাই বিশ্বাস করতেন। অক্ষয়কুমার বেদ ও বেদান্তের অভ্রান্ততা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। ধর্মগ্রন্থ যে যুক্তিনিরপেক্ষ বিশ্বাসের কথা বলে, তাঁর বেকনীয় দর্শনের সঙ্গে তা একেবারেই মেলে না। তাঁর যুক্তির যথার্থতা মেনে দেবেন্দ্রনাথ বেদবেদান্তের অভ্রান্ততার ধারণা পরিত্যাগ করেন। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সাধে কি আর তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘বেকন পড়িয়া করে বেদের সিদ্ধান্ত’? অনেক পরে ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইতে অক্ষয়কুমার লিখেছেন, ‘বেদের যে অংশ যে ব্যক্তির কৃত স্পষ্টই লিখিত আছে, এবং তন্মধ্যে নানা স্থানে ও নানা কালে বিদ্যমান লোকসমূহের ভক্তি শ্রদ্ধা, রাগ দ্বেষ, কাম ক্রোধ, বিপদ আপদ, যুদ্ধ বিবাদ, ব্যসন বাণিজ্য ইত্যাদি অশেষ প্রকার ব্যাপারের বিবিধ বৃত্তান্ত বিনিবেশিত রহিয়াছে, তথাপি জৈমিনি মহাশয়ের মত-প্রভাবে তাহা অপৌরুষেয়, ... এইরূপ অঙ্গীকার করিতে হইবে।
       অক্ষয়কুমার কালক্রমে বুঝেছিলেন যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ধর্মের সত্যাসত্য নির্ণয় বাঙালি ভদ্রলোকের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য হবে না। নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে তা আরও পরিষ্কার হয়। ভবানীপুর  ব্রাহ্মসমাজের এক বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, ‘ভাস্কর ও আর্য্যভট্ট এবং নিউটন্‌ ও লাপ্লাস্‌ যে কিছু যথার্থ বিষয় উদ্‌ভাবন করিয়াছেন, তাহাও আমাদের শাস্ত্র। গৌতম ও কণাদ এবং বেকন ও কোন্ত্‌ যে-কোন প্রকৃত তত্ত্ব প্রচার করিয়াছেন, তাহাও আমাদের শাস্ত্র।‘ লাপ্লাস ও কোঁত ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন না, খোদ সম্পাদকের বক্তৃতাটি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে ছাপার সময় সেই দুটি নাম তাঁর অজ্ঞাতসারেই বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। অক্ষয়কুমারের পত্রিকা সম্পাদনা সম্পর্কে দেবেন্দ্রনাথ বিরক্ত হয়ে লিখেছিলেন ‘‘কতগুলান নাস্তিক গ্রন্থাধ্যক্ষ হইয়াছে, ইহাদিগকে এ পদ হইতে বহিষ্কৃত না করিয়া দিলে ব্রাহ্ম ধর্ম প্রচারের সুবিধা নাই।’ এই ‘নাস্তিক’-রা স্পষ্টতই ছিলেন অক্ষয়কুমার ও বিদ্যাসাগর। ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ পড়ে দেবেন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি কোথায়, আর তিনি কোথায়। আমি খুঁজিতেছি ঈশ্বরের সঙ্গে আমার কী সম্বন্ধ; আর তিনি খুঁজিতেছেন, বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির কী সম্বন্ধ; আকাশ পাতাল প্রভেদ।’ এই প্রভেদের জন্য অক্ষয়কুমারকে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়েছিল।
       আধুনিক মনে প্রশ্ন জাগে, ধর্মের সত্যতা বিচারে বৈজ্ঞানিক যুক্তির প্রয়োগ কি সম্ভব? অক্ষয়কুমারের অবস্থান সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়েছে। বেদবেদান্তের অভ্রান্ততা বিষয়ে তাঁর মত আগেই আলোচনা করেছি। এও দেখেছি যে প্রার্থনার সাহায্যে কোনো বাস্তব ফল পাওয়া যায় বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার পাতাতে তিনি যে বিজ্ঞানের প্রবন্ধ লিখতে শুরু করেছিলেন, তার মূল লক্ষ্য ছিল প্রকৃতির নিয়ম জানা। প্রকৃতি নিয়ম মেনে চলে, এবং সেই নিয়ম একজন নিয়মস্রষ্টা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ, অক্ষয়কুমারের এই অবস্থানকে বলা যায় ডীইস্‌ম। জর্জ কুম্বও ছিলেন ডীইস্ট।  ডীইস্টরা ধর্মগ্রন্থের আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করেন না, তাঁরা যুক্তি ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জগৎস্রষ্টা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে চান। তাই অক্ষয়কুমারের শাস্ত্রকারদের মধ্যে আর্যভট্ট, নিউটন, লাপ্লাসদের স্থান পাওয়া মোটেই আকস্মিক নয়। যুক্তি ও পর্যবেক্ষণ – বেকনীয়  দর্শনের এই দুই মূল স্তম্ভের সঙ্গে ডীইস্‌মের উপর উপর মিল খুঁজে পেয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। কিন্তু সম্ভবত তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
       এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে হয় একটি বিখ্যাত উক্তি, ‘ডীইস্ট হল সেই যে নাস্তিক হয়ে ওঠার আগেই মারা গেছে। অক্ষয়কুমার নাস্তিক না হলেও সম্ভবত অজ্ঞেয়বাদী হওয়া পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। ডারউইনের আগে বিশ্বাসীরা ঈশ্বরের সমর্থনে যে যুক্তি দেখাতেন, তাকে বলা যায় Intelligent design-এর যুক্তি। সেই অনুসারে প্রতিটি জীব তার পরিবেশের সঙ্গে এমন ভাবে খাপ খেয়ে যায় যে কোনো বুদ্ধিমান স্রষ্টা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এর সঙ্গে ডীইস্‌মের মিল খুব স্পষ্ট। অক্ষয়কুমারও লিখেছেন, ‘জীবের শরীর অতি আশ্চর্য্য শিল্প-কার্য্য। তাহার প্রত্যেক অঙ্গ পরাৎপর পরম শিল্পকরের নিরুপম নৈপুণ্য-পক্ষে নিরন্তর সাক্ষ্যদান করিতেছে।  ডারউইনের বিবর্তনতত্ত্ব সেই যুক্তিকে নস্যাৎ করে দেয়। বিবর্তনতত্ত্বের পাঠ অক্ষয়কুমারকেও নিঃসন্দেহে প্রভাবিত করেছিল। অক্ষয়কুমার আগে লিখেছিলেন, ‘যে পক্ষী যেরূপ দ্রব্য আহার করে জগদীশ্বর তাহার চঞ্চু তদুপযোগী করিয়া দিয়াছেন।‘ ফিঞ্চ পাখির ঠোঁট সম্পর্কে ডারউইনের বিখ্যাত আলোচনা পড়ে অক্ষয়কুমার নিশ্চয় বুঝেছিলেন যে তাঁর যুক্তি ঘোড়ার আগে গাড়িকে জুড়ছে, প্রকৃতপক্ষে পাখির খাদ্যাভ্যাসই তার চঞ্চুর গঠন নির্ধারণ করেছে। সুগভীর ঈশ্বরবিশ্বাসী ডারউইন তাঁর নিজের তত্ত্বের যুক্তি মেনে অজ্ঞেয়বাদের পথ ধরেছিলেন। অক্ষয়কুমার শেষ জীবনে নিজেকে আস্তিক বেকনের সঙ্গে সঙ্গে নাস্তিক অগুস্ত কোঁতেরও অনুগামী বলে ঘোষণা করেছিলেন। তবে এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে শেষ বয়সে অক্ষয়কুমারর অজ্ঞেয়বাদী হয়ে গিয়েছিলেন, সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সবাই একমত নন। অক্ষয়কুমার নিজে সে বিষয়ে তাঁর জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ রায়ের প্রশ্নের সরাসরি কোনো উত্তর দেননি।  
       অক্ষয়কুমারের অক্ষয় কীর্তি ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। এই বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেওয়াও সীমিত পরিসরের মধ্যে সম্ভব নয়। এটি তাঁর পুরোপুরি মৌলিক রচনা। ভারতের দুই খণ্ডে বিভক্ত বইয়ের দুটি দীর্ঘ উপক্রমণিকা আছে, যেখানে তিনি বেকনের পদ্ধতির প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন যে ভারতীয় ষড়দর্শনের অনেকাংশই নিরীশ্বরবাদী। কেন আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম ভারতে হল না তিনি আলোচনা করেছেন। দীর্ঘ আলোচনা না করে বেকনের নামোল্লেখ আছে এমন কয়েকটি অংশ উদ্ধৃত করি।
       সাংখ্য দর্শন আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, ‘সাঙ্খ্য-শাস্ত্রের কোন কোন অংশে সমধিক বুদ্ধির প্রাখর্য্য প্রদর্শিত হইয়াছে তাহার সন্দেহ নাই। কিন্তু এ অংশটি নিতান্ত মনঃকম্পিত এখন একথা বলা বাহুল্য। যে সময়ে, ভূমণ্ডলে বিজ্ঞান-রাজ্যের পথ-প্রদর্শক বেকন্‌ ও কোন্তের জন্ম হয় নাই, সে সময়ে আর অধিক প্রত্যাশা করাই বা কেন?’ অর্থাৎ তিনি পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা ছাড়া শুধুমাত্র চিন্তার মাধ্যমে সত্যে পৌঁছানোর সম্ভাবনাকে অস্বীকার করছেন।
       কণাদ প্রবর্তিত বৈশেষিক দর্শনে পরমাণুর কথা আছে। সে সম্পর্কে সমধিক শ্রদ্ধা সত্ত্বেও তাঁর আক্ষেপ, ‘... সূত্রপাতেই অবশেষ হইল। অঙ্কুর রোপিত হইল, কিন্তু বর্ধিত, পুষ্পিত ও ফলিত হইল না। উহা সংস্কৃত, পরিবর্দ্ধিত ও বহুলীকৃত করিয়া ফল-পুষ্প-শোভায় সুশোভিত করা ভারতভূমির ভাগ্যে ঘটিল না। কালক্রমে সে সৌভাগ্য বেকন্‌, কোন্ত্‌ ও হম্বোল্‌টের জন্মভূমিতে গিয়া প্রকাশিত ও প্রাদুর্ভূত হইয়া উঠিল। তথাপি আমাদের সুশ্রুত, চরক, আর্য্যভট্টাদির পদ-কমলে বার বার নমস্কার!’
       পরে তিনি লিখেছেন, ‘... দার্শনিক গ্রন্থকারের অনেকেই সতেজ বুদ্ধির সুপুষ্ট বীজ লইয়া জন্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন। যদি তত্ত্বানুসন্ধানের প্রকৃত পথাবলম্বন পূর্ব্বক বিশুদ্ধ বিজ্ঞান-মার্গে বিচরণ করিতে পারিতেন, তবে বহুকাল পূর্বে ভারত-ভূমিও ইয়ুরোপ-ভূমির ন্যায় এ অংশে ভূ-স্বর্গ-পদে অধিরূঢ় হইতেন তাহার সন্দেহ নাই। তাঁহারা বিশ্বের যথার্থ প্রকৃতি ও সেই প্রকৃতি-সিদ্ধ নিয়মাবলী নির্দ্ধারণ পূর্ব্বক কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য-নিরূপণের নিশ্চিত উপায় চেষ্টা না করিয়া কেবল আপনাদের  অনুধ্যান-বলে দুই একটি প্রকৃত মতের সহিত অনেকগুলি মনঃকল্পিত মত উদ্ভাবন করিয়া গিয়াছেন। তাঁহাদের একটি পথ প্রদর্শকের অভাব ছিল। একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ – একটি বেকন্‌ তাঁহাদের আবশ্যক হইয়াছিল।  স্পষ্টতই অক্ষয়কুমার অভিমত প্রকাশ করছেন যে প্রকৃত বিজ্ঞান দর্শনের অভাবেই ভারতে বিজ্ঞানের বিকাশ হতে পারেনি।
       অপ্রাসঙ্গিক হলেও অক্ষয়কুমারের একটি উদ্ধৃতি তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। বেকনের প্রয়োজনের কথা বলে তিনি লিখছেন যে সুসজ্জিত সৈন্যদলও দক্ষ সেনাপতির অভাবে ব্যর্থ হয়। ‘একটি রণজিৎ - একটি বোনাপার্ত্‌ – একটি ওয়াশিংটন্‌ আবশ্যক। যে তিনজন সেনাপতির নাম করেছেন, একজনও ইংরেজ ছিলেন না; নেপোলিয়ন ও ওয়াশিংটন তো ব্রিটেনের বিরুদ্ধেই লড়াই করেছেন। 
       প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের মধ্যে নিরীশ্বরবাদের প্রভাবের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন অক্ষয় কুমার। তিনি কৌতুকের সঙ্গে লক্ষ্য করেছেন যে ঈশ্বরকে অস্বীকার করলেও বেদের অভ্রান্ততাকে বিষয়ে অধিকাংশ দর্শন একমত। বেদের অভ্রান্ততা বিষয়ে তাঁর মত আমরা আগে দেখেছি। নিরীশ্বরবাদী সাংখ্য দর্শনের প্রবর্তক কপিল সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘চিরকাল হিন্দু-সমাজে বেদের কি অতুল প্রভাব ও দুর্জ্জয় পরাক্রমই চলিয়া আসিয়াছে। কপিল ঈশ্বরের  অস্তিত্ব অক্লেশে অস্বীকার করিলেন, কিন্তু বেদের মহিমা অগ্রাহ্য করিতে পারিলেন না। তিনিও বেদার্থ প্রামাণিক বলিয়া অঙ্গীকার করিয়াছেন। পরবর্তীকালে টীকাকাররা বৈশেষিক দর্শনে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সাক্ষ্য খোঁজার চেষ্টা করেছেন, সে বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘কণাদ ঋষির সেইরূপ বিশ্বাস থাকিলে, সূত্রের মধ্যে ঈশ্বর-প্রসঙ্গ সুস্পষ্ট না লিখিয়া তাহার অন্তর্গত শব্দ-বিশেষের অভ্যন্তর-গুহায় তাহা প্রচ্ছন্ন রাখা কি কোনরূপে সম্ভব হয়?’ সবশেষে তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘প্রথমে কিছু ছিল না, কেবল একমাত্র অদ্বিতীয় পরমেশ্বরই বিদ্যমান ছিলেন, তিনিই পশ্চাৎ সমুদয় জগৎ সৃজন করেন, যাঁহারা কেবল ইহাকেই আস্তিকতাবাদ বলিয়া স্বীকার করিয়াছেন, তাঁহাদের মতে প্রায় সমুদয় ষড়্‌দর্শনকে নাস্তিকতা-প্রতিপাদক বলিয়া উল্লেখ করিতে হয়।
        বেকনের দর্শন বিষয়ে পরবর্তীকালে নানা সমালোচনা হয়েছে, তার অধিকাংশই অবশ্য অক্ষয়কুমারের অনেক পরে। সেই সমালোচনা ঠিক না ভুল তা নিয়েও বিতর্ক আছে। এই লেখাতে তার মধ্যে যাওয়ার অবকাশ নেই। বিদ্যাসাগর জেনারেল কমিটি অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশনের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘সাংখ্য ও বেদান্ত যে ভ্রান্তদর্শন, সে সম্বন্ধে এখন আর বিশেষ মতভেদ নেই। তবে ভ্রান্ত হলেও এই দুই দর্শনের প্রতি হিন্দুদের গভীর শ্রদ্ধা আছে। সংস্কৃতে যখন এইগুলি পড়াতেই হবে তখন তার প্রতিষেধক হিসেবে ছাত্রদের ভাল ভাল ইংরেজি দর্শনশাস্ত্রের বই পড়ানো দরকার। (অনুবাদ সূত্র, বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ) এর বেশি লেখার তিনি প্রয়োজন বোধ করেন নি। অক্ষয়কুমার কোথায় ভারতীয় দর্শন কানাগলিতে ঢুকে পড়েছে বা উদ্দেশ্যহীন তর্কে সময় নষ্ট করেছে তার বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এবং এই কাজে তাঁর সহায় হয়েছেন বেকন।
       আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞানদর্শনের প্রয়োজনীয়তা প্রথম উপলব্ধি করেছিলেন অক্ষয়কুমার, তাঁকেই আমরা ভুলতে বসেছিলাম। আশার কথা দ্বিশতবর্ষে অক্ষয়কুমারকে নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ প্রকাশিত ‘দ্বিশতজন্মবর্ষে অক্ষয় কুমার দত্ত’ বইটিতে কয়েকটি ছোট কিন্তু তথ্যবহুল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। কোরক পত্রিকার বইমেলা ২০২০ সংখ্যাটিতে তাঁর জীবন ও কর্ম বিষয়ে অনেকগুলি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে।  
তথ্যসূত্র
১। আশীষ লাহিড়ী, অক্ষয়কুমার দত্ত: আঁধার রাতে একলা পথিক, দ্বিতীয় সংস্করণ, দেজ পাবলিশিং
২। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, কামারের এক ঘা, দ্বিতীয় সংস্করণ, পাভলভ ইন্সটিটিউট
৩। বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান
       অক্ষয়কুমারের লেখার উদ্ধৃতিগুলিতে বানান অপরিবর্তিত রাখা হল।

প্রকাশঃ নিশিত সাহিত্যপত্র, উৎসব সংখ্যা, অক্টোবর ২০২০
      
        
      
      

Tuesday 27 October 2020

বিকিরণরোধী গোময়, রাসেলের টিপট এবং কাণ্ডজ্ঞান

বিকিরণরোধী গোময়, রাসেলের টিপট এবং কাণ্ডজ্ঞান

 গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

 

খবরে দেখলাম যে গোবর দিয়ে তৈরি চিপ মোবাইল ফোনের বিকিরণ কমিয়ে দেবে বলে দাবি উঠেছে। ফেসবুক টুইটার হোয়াটসঅ্যাপের যুগে সামাজিক মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই এরকম অদ্ভুত দাবি শোনা যায়, তাই খুব একটা পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনে করিনি। কিন্তু বারবার খবরটা নজরে আসতে কৌতূহল হল; দেখলাম কথাটা বলেছেন রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগের প্রধান। অগত্যা আবার ইন্টারনেটের শরণাপন্ন হতে হল। জানতে পারলাম এই আয়োগ হল এক কেন্দ্রীয় সরকারী প্রতিষ্ঠান, তার কাজ হল দেশের গবাদি পশুর উন্নতি। আয়োগের প্রধান নিজে গোবরের এই ক্ষমতা দেখেছেন বলে দাবি করেছেন। তাঁর সেই পর্যবেক্ষণ কোন গবেষণা পত্রিকাতে বেরিয়েছে অথবা গোবরের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য তা বিকিরণ রোধ করে সে বিষয়ে কোনো কথা চোখে পড়ল না।

কিছুদিন আগে কোনো একটি বিখ্যাত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষস্থানীয় কর্তাব্যক্তি অম্লানবদনে প্রাচীন ভারতে বিমান নির্মাণ আবিষ্কার হয়েছিল বলে দাবি করলেন। ইংরাজরা সেই তত্ত্ব চুরি করেছিল। কিন্তু নিজেরা এরোপ্লেন বানালে ধরা পড়ে যাবে; তাই তারা আমেরিকানদের কাছে সেই কৌশল পাচার করে দেয়। তার থেকেই রাইট ভাইয়েরা প্লেন বানায়। তাঁর এই রোমহর্ষক গল্প শোনার পরে আমার বক্তৃতাতে আমি বিনম্রভাবে প্রতিবাদ করেছিলাম। এর পরে জনৈক শ্রোতা আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কিছু একটা নিশ্চয় ছিল, তা না হলে পুরাণ মহাকাব্যে এই কথা এলো কোথা থেকে? আমাদের অনুসন্ধান করে দেখা উচিত।’ প্রশ্নকর্তা একটি বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক। মনে পড়লো আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে গণেশের ঘাড়ের উপরে হাতির মাথা যখন লাগানো হয়েছিল বলে পুরাণে আছে, কেউ তো ছিল যে এই প্লাস্টিক সার্জারিটা করেছিল।

খবরে পড়লাম ঐ আয়োগের প্রধান আরো বলেছেন যে সেই সব বিষয় নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, যাকে এতদিন গল্প মনে করা হত। প্রথমে শুনতে খারাপ লাগে না কথাটা, গবেষণা বা অনুসন্ধান করা তো ভালোই। একটু তলিয়ে দেখলে কিন্তু বিষয়টা অত সরল লাগবে না। বিজ্ঞানে ব্যবহৃত শব্দগুলি প্রতিদিনের ভাষা থেকেই নেওয়া, তার ফলে এই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি। সাধারণ ভাষাতে আমরা অনেক সময় বলেই থাকি, ‘এটা তোমার থিওরি,’ অর্থাৎ তোমার বিশ্বাস, কিন্তু তা সত্যি নাও হতে পারে। বিজ্ঞানে ব্যাপারটা অনেকটা আলাদা। ধরুন ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বের কথা। প্রথম যখন ডারউইন ও ওয়ালেস বিবর্তনের কথা বলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার নাম দেয়া হয়েছিল তত্ত্ব বা থিওরি। তারপরে গত দেড় শতাব্দীতে তার পক্ষে এত প্রমাণ জড়ো হয়েছে যে কোনো বিজ্ঞানীর আর তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও তার নামটা থিওরিই রয়ে গেছে, যেমন আইস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদের পক্ষে অসংখ্য প্রমাণ সত্ত্বেও তাকে আমরা থিওরিই বলে থাকি। তার মানে এই নয় যে এই সব তত্ত্বে কখনো কোনো সামান্য পরিবর্তন হবে না, কিন্তু মোটের উপর কাঠামো যে এক থাকবে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। কিন্তু যে কোনো বিশ্বাসই বিজ্ঞানের থিওরি নয়, তাকে প্রমাণ করে দেখার দায়িত্বও বিজ্ঞানের নয়।

বিজ্ঞান কি পাল্টায় না? আজ যা গল্প, কাল তা সত্যি প্রমাণিত হতেও তো পারে। একথা ঠিক বিজ্ঞানের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল যে সে শেষ কথা বলতে পারে না। প্রতিনিয়ত নতুন উদ্ভাবন নতুন পর্যবেক্ষণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হচ্ছে, বিজ্ঞান নিজেকে পরিবর্তন করছে। এই আত্মসংশোধন ও আত্মোন্নতি একান্তভাবেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অঙ্গ। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আজ যা জানি তা কাল ভুল প্রমাণিত হবে। একেবারে যে তা হয় না এমন নয়, কিন্তু সেই উদাহরণ খুবই কম; এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তা আরও দ্রুত কমে আসছে। কিন্তু যাঁরা বিজ্ঞানের প্রকৃতি বোঝেননি, তাঁদের অনেকের মধ্যে এক অদ্ভুত যুক্তি শোনা যায়। ‘মানুষের জীবনে গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব অবশ্যই পড়ে, আজ বিজ্ঞান সেটা ধরতে পারেনি তো কী হয়েছে, ভবিষ্যতেও পারবে না এরকম কথা কি বলা যায়? তোমরা প্রমাণ করে দেখাও যে আমি যা বলছি তা ভুল।’ এই ধরনের কথা শোনার দুর্ভাগ্য আমাদের অনেকের হয়েছে। বক্তাকে বোঝানো কঠিন যে কোনো কিছুর বিরুদ্ধ প্রমাণ নেই মানেই তা সত্যি হয়ে যায় না। তর্কশাস্ত্রে এই ধরনের কুযুক্তিকে বলে argumentum ad ignorantiam

এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে পড়ে গেল। বাইবেলে লেখা আছে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশাল অংশের মানুষ বিবর্তন তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। (অবশ্য কারোর বিশ্বাস অবিশ্বাসের উপর বৈজ্ঞানিক সত্য নির্ভর করে না।) তাঁদের অনেকেই বলেন বিবর্তন হল একটা থিওরি, আসলে সেটা সত্যি কিনা বিজ্ঞান এখনো নিশ্চিতভাবে বলতে পারে না। খোলা মনে বিচার করতে হবে। এই খোলা মনে বিচার করার কথাটা বহু দিন ধরে শুনে আসছি। অনেক বছর আগে কলকাতার এক বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান একটি বক্তৃতা আয়োজন করেছিল। বিষয় ছিল ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন। ঈশ্বর প্রাণ বা মানুষের সৃষ্টি করেছেন, এই ধারণার পোশাকি নাম ছিল ক্রিয়েশনিজম। এখন সেটা বিজ্ঞানী মহলে উপহাসের পাত্র, তাই তার নতুন নাম হয়েছে ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন। সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক বিষয়ে বক্তৃতা কেন? উত্তর এলো, সব কিছু খোলা মনে বিচার করতে হবে, বিজ্ঞান তাই বলে। গোময়ের ক্ষেত্রে বা প্রাচীন যুগের বিমানের ক্ষেত্রেও সেই কথা কি প্রযোজ্য নয়?

বিজ্ঞান কি সত্যিই সেই কথা বলে? থালা বাজানো বা বিদ্যুতের আলো নিভিয়ে প্রদীপ জ্বালানোর কথা বলার সময় প্রধানমন্ত্রী বলেননি যে তাতে করোনা ভাইরাস নির্মূল হবে, কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে সেই কথার ব্যাপক প্রচার হয়েছে। খোলা মনে তার বিচার করতে হবে কি? গুজরাটের গরুর দুধে সোনা পাওয়ার কথা পরীক্ষা করে দেখতে হবে কি? খোলা মনে বিচার করলে শুধু আমাদের জীবনে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রভাব, ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন বা গোময়ের বিকিরণরোধী ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব কেন? বিষাক্ত সাপে কামড়ালে ওঝা বাঁচাতে পারবে কিনা খোলা মনে বিচার করব। মাঝেমাঝে শোনা যায় অমুক জায়গায় এক বৃদ্ধাকে ডাইনি সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তাহলে খোলা মনে বিচার করা উচিত মৃতা সত্যি সত্যিই ডাইনি ছিল কিনা। কথাটা প্রমাণ করার দায়িত্ব কার?

বিজ্ঞানী দার্শনিক এবং সাহিত্যে নোবেলজয়ী বার্ট্রান্ড রাসেল বিজ্ঞানে প্রমাণের দায়িত্ব কার তা একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়েছিলেন। তিনি প্রস্তাব দিলেন যে পৃথিবী আর মঙ্গলের মধ্যের কোনো এক কক্ষপথে একটা টিপট সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। রাসেলকে ভুল প্রমাণ করার জন্য কি আমরা মহাকাশযান পাঠিয়ে তন্নতন্ন করে সেই চায়ের পাত্রটা খুঁজব? পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যের ফাঁকা জায়গায় সাতাশ লক্ষ কোটি পৃথিবীকে ধরানো যায়। এই সব জায়গা আমরা খুঁজে দেখব, নাকি রাসেলকেই বলব আপনি প্রমাণ করুন। করোনা ভাইরাসের সামনে থালা বাজিয়ে দেখব তা ধ্বংস হয় কিনা, নাকি যিনি বলছেন তাঁকে বলব আপনি দেখান? ভাবিজির পাঁপড় খেয়ে ডাক্তাররা পিপিই না পরে করোনা রোগীর চিকিৎসা করতে যাবেন, নাকি যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সেই কথা বলেছিলেন তাঁকে বলবেন যে আপনি প্রমাণ দিন?

বিজ্ঞান ভুল সংশোধনের মধ্যে দিয়ে এগোয়। তা বলে আমার বা আপনার বিশ্বাস সম্পর্কে বিজ্ঞানের কথা আজ না মিললেও কাল বা পরশু কিংবা কয়েকশো বছর পরে তা মিলে যাবে, এ যুক্তি চলে না। কোনো সন্দেহ নেই যে বিজ্ঞানের মূল কথা হল সংশয় এবং তা দূর করার জন্য পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষা নিরীক্ষা। কিন্তু তার আগে কিঞ্চিৎ কাণ্ডজ্ঞানেরও প্রয়োজন হয়। ধরা যাক কোনো সুপ্রভাতে মানুষের মাথার জায়গায় হাতির মাথা বসানো সম্ভব হল। (দয়া করে এখানেই পড়া বন্ধ করবেন না, এটা একটা অসম্ভব উদাহরণ মাত্র।) হাতির মস্তিষ্ক যুক্ত এই নতুন ‘হাঁসজারু’ কি মানুষের মতো চিন্তা করবে? হাতির স্বরযন্ত্রে মানুষের মতো কথা বলা সম্ভব? এরোপ্লেন আবিষ্কার হয়ে গেছে, কিন্তু মাটিতে ঘোড়ায় টানা রথের থেকে উন্নত কোনো যান পাওয়া যাচ্ছে না এও কি মানতে হবে? গরুর পেটের ভিতরে নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলারেটর বা রিঅ্যাক্টর নেই; সে যে পরমাণু বাইরে থেকে খাদ্য পানীয় বা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে নেয়, দুধের মধ্যে তার বাইরে কোনো পরমাণু থাকা সম্ভব নয়। তাহলে গরুর দুধের মধ্যে সোনা রুপো প্লাটিনাম খুঁজতে যাব কেন? কোন ধরনের পদার্থ বিকিরণ রোধ করে আমরা জানি; গোবরে তার চিহ্নমাত্র নেই, তাহলে হঠাৎ করে গোবরকে নিয়েই বা পড়ব কেন? গোবরের এই অসাধারণ ক্ষমতা কোথা থেকে এলো যে বিষয়ে কোনো কথা তো শুনলাম না। যুক্তির তোয়াক্কা না করলে অসংখ্য প্রকল্প দেওয়া যায়, কাণ্ডজ্ঞান প্রয়োগ না করে সেগুলো সবই পরীক্ষা করে দেখতে হবে? তাহলে তো অন্য সমস্ত গবেষণা বন্ধ করে দিয়ে হয়।

রাষ্ট্রীয় কামধেনু আয়োগের প্রধান নাকি একথাও বলেছেন আমরা আমাদের বিজ্ঞানকে ভুলতে বসেছি। আমাদের দেশের প্রাচীন বিজ্ঞানের ঠিক কোন পুঁথিতে গোময়ের মাধ্যমে রেডিওবিকিরণ আটকানোর কথা আছে জানি না; এই ধরনের অবাস্তব দাবি আমাদের প্রাচীন সাহিত্য সংস্কৃতির উত্তরাধিকারেরই অপমান করে। আগে যে শিক্ষকের কথা বলেছিলাম, তাঁকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমাদের কল্পনাকে এত সংকুচিত ভাবছেন কেন? আজকের কল্পবিজ্ঞান লেখকদের বই দুহাজার বছর পরে পড়লে তখনকার পাঠক কি বলবেন একবিংশ শতাব্দীতে মানুষ মুহূর্তের মধ্যে এক গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিতে যাওয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছিল? রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে।’ আমরা কি খুঁজতে বসব যে চোখ থেকে আলো বেরোয় কিনা; নাকি সেটা বৈজ্ঞানিক সত্য নয় বলে তাঁর সেই লেখাকে বাতিল করে দেব? পুরাণ মহাকাব্য ধর্মগ্রন্থ আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ, তাদেরকে সেই ভাবেই পড়া উচিত। সেখানে বিজ্ঞান খুঁজতে যাওয়া অর্থহীন।

পিপলস রিপোর্টার ওয়েব পত্রিকাতে প্রকাশিত



Monday 19 October 2020

Monday 12 October 2020

ইউরেনিয়ার অভিশাপ

 ইউরেনিয়ার অভিশাপ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 


 সম্পাদক লেখা দিতে বলেছেন
, বিষয় ‘বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ’।

এই শিরোনামে রচনা প্রথম কবে লিখতে হয়েছিল খেয়াল নেই, তবে যতদূর মনে আছে তখন হাফপ্যান্ট পরে স্কুলে যেতাম। বিভিন্ন ক্লাসে পরীক্ষাতে সম্ভবত একাধিকবার লিখতে হয়েছিল। তারপর একসময় স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে গেলাম, কোনো রচনা লেখার আর প্রয়োজন হয়নি। কাজেই বেচারি ইউরেনিয়া নিঃশ্বাস ছেড়ে বেঁচেছিলেন। তখন কি আর তিনি ভেবেছিলেন যে বিচারকের হাতুড়ি নিয়ে ‘আবার সে আসিবে ফিরিয়া’?

ইউরেনিয়া কে? প্রাচীন গ্রিকরা সমস্ত সাহিত্য শিল্পকলা ইত্যাদির প্রেরণাদাত্রী হিসাবে মোট নয়জন মিউজ বা দেবীকে খুঁজে পেয়েছিলেন। তাঁরা সবাই দেবরাজ জিউস ও স্মৃতিশক্তির দেবী নিমোজিনির সন্তান। অবশ্য তারও আগে তাঁদের আকাশের দেবতা ইউরেনাস ও পৃথিবীর দেবী গাইয়ার সন্তান মনে করা হত। তাহলে তাঁরা সম্পর্কে হবেন জিউসের পিসি এবং নিমোজিনির বোন। খুবই জটিল সম্পর্ক! যাকগে, মোদ্দা কথা হল ইউরেনিয়া হলেন জ্যোতির্বিদ্যার মিউজ।

প্রাচীন ভারত বিদ্যার সমস্ত দায়িত্ব দেবী সরস্বতীর হাতে তুলে দিয়েছিল, কিন্তু মিউজদের সঙ্গে আধুনিক যুগের বিশেষজ্ঞদের মিল পাওয়া যাবে। শুধু কবিতার জন্যই চারজন আলাদা আলাদা মিউজ ছিলেন। মহাকাব্য লেখাতে যিনি প্রেরণা দিতেন, গীতিকবিতা তাঁর ডিপার্টমেন্ট ছিল না, আবার প্রেমের কবিতার দায়িত্ব নিয়েছিলেন অন্য একজন। নাটকের ক্ষেত্রে ট্রাজেডি আর কমেডি আলাদা আলাদা জায়গা থেকে অনুপ্রেরণা পেত। মিউজদের তালিকায় বিজ্ঞানের একটা শাখারই নাম ছিল, তা হল জ্যোতির্বিদ্যা। ইউরেনিয়ার হাতে থাকত গ্লোব আর কম্পাস। কম্পাস মানে দিকনির্দেশক চুম্বক নয়। প্রাচীন গ্রিকরা সেটা আবিষ্কার করে উঠতে পারেনি, সেটা করেছিল চিনারা। এটা হল কাঁটা কম্পাস, সেটা ছোটবেলায় আমার জ্যামিতি বাক্সে থাকত।

কেউ প্রশ্ন করতেই পারেন শুধু জ্যোতির্বিদ্যার দেবীকেই সব বিজ্ঞানের দায়িত্ব দিলাম কেন? তার কারণ আর কিছু নয়, সায়েন্স শব্দটা প্রাচীন হলেও আমরা যে অর্থে এটাকে ব্যবহার করি তা নিতান্তই আধুনিক, অষ্টাদশ শতকের আগে এই মানেটা চলত না। আর জ্যোতির্বিদ্যা শুধু প্রথম আধুনিক অর্থে বিজ্ঞান নয়, বহুদিন পর্যন্ত ছিল একমাত্র বিজ্ঞান। গ্রহ নক্ষত্রের নিয়ম মাফিক চলাফেরা, তাদের পরিবর্তনহীনতা মানুষকে একটু মানসিক স্বস্তি দিত। সমস্ত প্রাচীন সভ্যতাই তাই আকাশে স্বর্গকে খুঁজে পেয়েছিল, মৃত্যুর পরে মানুষের সেখানেই স্থান হত।

মজাটা হল ইউরেনিয়াও পরবর্তীকালে কবিতার দায়িত্ব পেয়েছিলেন, তখন অবশ্য গ্রিক সভ্যতা অস্তাচলে। মধ্যযুগে ইউরোপে বিজ্ঞান গবেষণা শুধুমাত্র প্রাচীন পণ্ডিতদের পুঁথি পড়ে তাদের টীকা ভাষ্য রচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। ইউরেনিয়া মনে হয় বেকার হয়ে পড়েছিলেন, তাই খ্রিস্টধর্মের তত্ত্ব নিয়ে কবিতার প্রেরণা জোগানোর কাজটা তখন তাঁর ঘাড়ে পড়েছিল। এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের লেখালেখি পড়ে মনে হয় দায়িত্বটা বেশ কঠিন ছিল, ভদ্রমহিলা ঠিক পেরে ওঠেন নি।

এই দেখুন। লিখতে বসেছিলাম বিজ্ঞান অভিশাপ না আশীর্বাদ, চলে গেলাম ইউরেনিয়ার গল্পে। আচ্ছা বলুন তো, ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসের ছ’তারিখের আগে কোনো দেশে কোনো স্কুলের ছাত্রকে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ বিষয়ে রচনা লিখতে হত কি? বিজ্ঞান আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দেবে জেনে আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে বসেছিলাম; ইউরেনিয়া সমেত সব মিউজকে ছুটি দিয়ে দিয়েছিলাম। তারপর তো শুধু অ্যাটম বোম নয়, এলো রেডিয়েশন বা পেস্টিসাইড পয়জনিং, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, এরকম কত কী! ছোটবেলায় এসব যদি জানা থাকত!

অভিশাপ আর আশীর্বাদের মধ্যে তফাত করাটা সবসময় সহজ নয়। রচনাতে লিখতাম প্রয়োগ কিভাবে করা হবে তার উপর নির্ভর করছে বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ -- নিউক্লিয়ার বোমা খারাপ, কিন্তু রেডিওথেরাপি, এমআরআই ভালো। এবার ইতিহাস বই খুলুন, দেখবেন চাষবাস শুরুর আগে মানুষ ছিল যাযাবর, কুড়িয়ে বাড়িয়ে আর শিকার করে যা জুটত, তাই খেত। কৃষিকাজ আবিষ্কার হল মানুষের ইতিহাসে দ্বিতীয় বিপ্লব, এর ফলে গ্রাম ও নগর তৈরি সম্ভব হয়েছে, সভ্যতার অগ্রগতি হয়েছে। তাহলে কৃষি আবিষ্কার নিশ্চয় বিজ্ঞানের আশীর্বাদ। জানেন কি চাষবাস শুরু করার আগে মানুষের গড় আয়ু ছিল তেত্রিশ বছর। বারো হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যে কৃষি আবিষ্কার হয়, তার পরে সেই গড়টা কমে দাঁড়িয়েছিল পঁচিশ বছর? যাযাবররা মাটির সঙ্গে বাঁধা থাকত না, এক জায়গায় খাবার শেষ হয়ে গেলে অন্য জায়গায় চলে যেত, তাদের স্বাস্থ্য ছিল অনেক ভালো, দুর্ভিক্ষ বা মহামারী কাকে বলে জানত না। তাহলে মানুষ কৃষি বেছে নিয়েছিল কেন? খুব সহজ, সংখ্যাধিক্য। এমনি এমনি তো প্রাচীন মিশরের দেবী হেকেট একই সঙ্গে নীল নদে বন্যা, কৃষি এবং প্রজননশক্তির দায়িত্ব পাননি? যাযাবর মানুষের থেকে এক জায়গায় থিতু মানুষের সন্তানসংখ্যা সব সময়েই বেশি হবে। তাই ডারউইনের সূত্র মেনে কৃষিকাজই প্রজাতির বিকাশের পক্ষে যোগ্যতর। মানুষের গড় আয়ু বেড়ে আবার তেত্রিশ বছর ছুঁল সবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। তাহলে কৃষি আবিষ্কার কি বারো হাজার বছরব্যাপী অভিশাপ?

পুরানো কথা অনেক হল, এবার সামনের দিকে তাকানো যাক। এই করোনার যুগে একটা কথা খুব শোনা যাচ্ছে। এআই অর্থাৎ আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স। আপনি যখন গুগলকে কোনো কিছু খুঁজতে বলেন, কর্টানা অ্যালেক্সা বা সিরিকে নিজের রুটিন ঠিক করার দায়িত্ব দেন, ওলা বা উবের জাতীয় অ্যাপক্যাবের শরণাপন্ন হন, তখন আপনি এআই-এর সাহায্য চাইছেন। এআই–এর একটা বড় সুবিধা হল খুব দ্রুত বিপুল পরিমাণ তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা -- করোনার ওষুধ বা ভ্যাকসিনের জন্য অনেক বিজ্ঞানী তাই তার উপর নির্ভর করছেন। গুগল সার্চে ঠাণ্ডা লাগা, মাথা ধরা, জ্বর ইত্যাদি কতবার খোঁজা হয়েছে, তা বিশ্লেষণ করে গুগল ফ্লু ট্রেন্ডস অ্যালগরিদম ব্রিটেনের জাতীয় হেলথ সার্ভিসের দশদিন আগে ফ্লু এপিডেমিক পর্যায়ে চলে যাচ্ছে কিনা বলতে পারে, স্বাস্থ্য দপ্তর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে। পাশাপাশি আপনার ই-মেল, মেসেজ, গত কদিনে কোন শব্দটা বেশি খুঁজেছেন, কোন ধরনের খবর পড়েছেন, এসব দেখে আপনি কোন জিনিসটা কিনতে পারেন থেকে শুরু করে সরকারবিরোধী বিক্ষোভে অংশ নেবেন কিনা সবই অনুমান করতে পারে এআই। অরওয়েলের নাইন্টিন এইটিফোর যদি বাস্তবে নেমে আসে? গল্পকথা নয়, ব্রেক্সিটের গণভোট বা গত মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে এআই-এর সাহায্যে ফেসবুক প্রোফাইল বিশ্লেষণ করে আলাদা আলাদা ব্যক্তির জন্য আলাদা আলাদা পদ্ধতিতে প্রচার চালানো হয়েছিল। আবার বলি, স্কুলের রচনাতে লিখতাম এ হল বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ। কিন্তু ঠিক কোনখানে দাঁড়িটা টানব? আগে অটোমেশনের জন্য চাকরি যাওয়ার কথা শুনলে বলতাম অন্তত বুদ্ধির কাজ তো যন্ত্র করতে পারবে না। এখন? ডাক্তার উকিল শিক্ষক, এমনকি লেখক সঙ্গীতকার সবাই যদি সমাজে অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে?

কিছু শিশু জন্মগত শারীরিক ত্রুটি নিয়ে জন্মায়, তাদের এবং তাদের বাবা মা পরিবারের অবস্থাটা আমরা কিছুটা অনুমান করতে পারি। বিজ্ঞান আমাদের মুক্তির উপায় দেখাচ্ছে -- জিন টেলরিং। অনেক সময়েই এই ত্রুটিগুলো জেনেটিক, সংশ্লিষ্ট জিনটা পাল্টে দাও। মানুষ ছাড়া অন্য প্রাণীতে হয়েছে, মানুষের ক্ষেত্রেও দু’বছর আগে চিনে এক বিজ্ঞানী সে কাজ করেছিলেন। নিশ্চয় আমরা চাইব জন্মগত ত্রুটি দূর করতে, কিন্তু ঠিক কোথায় থামব? সন্তানের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়াতে চাওয়াটা কি অন্যায়? তার রক্তে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ বাড়ানো? পেশীর শক্তি বৃদ্ধি, হাড় মজবুত করা? দৃষ্টিশক্তি বাড়ানো? বুদ্ধিবৃত্তি? এই সুপারম্যান বা সুপারওম্যানদের সন্তানরাও তাদের ক্ষমতা নিয়ে জন্মাবে। শাসকরা চিরকালই শাসিতদের থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখতে চেয়েছে, কিন্তু বাস্তবে দু’দলের জিনে কোনো পার্থক্য ছিল না। এখন? বিজ্ঞান তাহলে কি কিছু লোকের জন্য আশীর্বাদ আর বাকিদের জন্য অভিশাপ?

শেষ করতে হবে, সুতরাং এখানেই থামা যাক। সত্যি সত্যি কি আর ইউরেনিয়া বলে কেউ আছেন যিনি আমার রচনাটা পড়বেন? হাসালেন, এখন কেউ আর ইউরেনিয়াকে বিশ্বাস করে নাকি? কিন্তু দুহাজার বছর আগে তো করত; সুতরাং সমাজবিদ্যার আধুনিকতম এক তত্ত্ব অনুযায়ী সে যুগে তাঁর অস্তিত্ব ছিল। ভাগ্যিস আমি দু’হাজার বছর আগে লেখাটা লিখতে বসিনি; এইরকম উদ্দেশ্যহীন লেখা পড়লে তিনি নির্ঘাত আমাকে অভিশাপ দিতেন।

 

প্রকাশিত হয়েছিল খোয়াবনামা খবরে, তার লিঙ্ক এইখানে রইল।

    

Sunday 11 October 2020

পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল, ২০২০

গুরুচন্ডা৯ ওয়েব পোর্টালে প্রকাশিত হয়েছে  এই লেখাটা। 

প্রকাশিতঃ  অক্টোবর ১১, ২০২০

Tuesday 6 October 2020

গ্রহ চুরির গল্প

গ্রহ চুরির গল্প

 

টাকা গয়না জমি বাড়ি এমনকি পুকুর চুরি পর্যন্ত শুনেছি, কিন্তু গ্রহ চুরি! সে আবার কী? গ্রহ তো পকেটে বা থলিতে পুরে নিয়ে আসা যায় না, ব্যাঙ্কের ভল্টে বা মাটির নিচে পুঁতে রাখাও সম্ভব নয়। কিন্তু সত্যিই গ্রহ চুরির গল্প বেরিয়েছিল যে সে জায়গায় নয়, সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকার 2004 সালের ডিসেম্বর সংখ্যায়, শিরোনাম ছিল ‘‘The Case of the Pilfered Planet’, অর্থাৎ গ্রহ চুরির মামলা। সেই মামলার কথা জানতে গেলে আমাদের কিছুটা বিজ্ঞান আর কিছুটা ইতিহাস শুনতে হবে।

আমাদের সৌরজগতে আটটা গ্রহ আছে। অবশ্য আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখন গ্রহের সংখ্যা ছিল নয়, পরে প্লুটোকে বামন গ্রহ বলে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটাতে আমরা বাস করি। খালি চোখে দেখা যায় বুধ, শুক্র, মঙ্গল বৃহস্পতি আর শনি, এই পাঁচটা গ্রহকে; মানুষ যেদিন থেকে আকাশের জ্যোতিষ্কদের চিনতে শিখেছে, প্রায় সেই সময় থেকেই এদের কথা জেনেছে। প্রাচীনকালে অবশ্য সূর্য ও চাঁদকেও গ্রহ ধরা হত, তার সঙ্গে আমাদের দেশে রাহু ও কেতু বলে দুটো গ্রহের কথা ধরে নবগ্রহের কথা চালু ছিল।

আমাদের সৌরজগতে ইউরেনাস ও নেপচুন এই দুটো, প্লুটোকে ধরলে তিনটে, গ্রহ দূরবিন দিয়ে আবিষ্কার হয়েছে। ইউরেনাস অবশ্য খুব অনুকূল পরিস্থিতিতে খালি চোখে দেখা যায়। যেমন প্রাচীন গ্রীক বিজ্ঞানী হিপ্পার্কাস 128 খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেখেছিলেন, কিন্তু গ্রহ বলে চিনতে পারেননি। অন্য নক্ষত্রজগতে অবশ্য কয়েক হাজার গ্রহ গত পঁচিশ বছরে আবিষ্কার হয়েছে, সেই আলোচনা এই বইয়ে পরে পাওয়া যাবে। এখানে আমরা নেপচুন আবিষ্কারের কথা শুনব, তবে তার ভূমিকা হিসাবে ইউরেনাসের কথাও আসবে। সেই ইতিহাসের মধ্যেই গ্রহ চুরির মামলা লুকিয়ে আছে।

গ্রহ কাকে বলে আমরা সবাই জানি। সহজ কথায় নক্ষত্রের চারদিকে ঘোরে, নিজের অভিকর্ষের প্রভাবে গোলকাকার হয়ে গেছে এবং তার রাস্তা থেকে ছোটখাটো পাথরের টুকরোটাকরা সব পরিষ্কার করে দিয়েছে, এমন বস্তুদের বলে গ্রহ। এ কথাও অবশ্য মনে রাখতে হবে যে গ্রহের ভিতরে নিউক্লিয় বিক্রিয়া হয় না। অনেক সময় দুই বা তারও বেশি তারকা একে অন্যকে প্রদক্ষিণ করে, তাদের আমরা নিশ্চয় গ্রহ বলব না।

দূরবিন দিয়ে তো লক্ষ লক্ষ জ্যোতিষ্ক দেখা যায়। তার মধ্যে কোনটা গ্রহ আর কোনটা গ্রহ নয় বুঝব কেমন করে? ছোটবেলায় পড়েছি গ্রহের আলো স্থির, তারার আলো মিটমিট করে। কিন্তু সেটা কাছের গ্রহদের জন্য সঠিক। তারারা আমাদের চোখে বিন্দুর মতো দেখতে, তাই বাতাসের প্রতিসরণের জন্য মনে হয় মিটমিট করছে। কিন্তু প্রথম যুগের দূরবিনে ইউরেনাস বা নেপচুনকেও বিন্দুর মতোই দেখাত, তখনকার জ্যোতির্বিদদের পক্ষে কোনোভাবেই শুধু কেমন দেখতে লাগছে তা দিয়ে গ্রহ নক্ষত্রের মধ্যে তফাত করা সম্ভব ছিল না। তাঁদের তাই অন্য রাস্তা বেছে নিতে হয়েছিল।

আকাশের তারারা অনেক দূরে আছে, তাই তাদের স্থির মনে হয়। অবশ্য পৃথিবীও স্থির নয়, সে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে; কিন্তু তার জন্য তারকাদের অবস্থানে খুব কম পার্থক্য হয়। সেই পার্থক্যও মাপা গেছে, তার থেকে আমরা আমাদের কাছের তারকাদের দূরত্ব নির্ণয় করি। এই বইয়ের পরের একটা লেখাতে সেই পদ্ধতির কথা বলা আছে। তারকাদের জন্য এই পার্থক্যটা প্রথম যুগে দেখা সম্ভব ছিল না। আমাদের সৌরজগতের গ্রহরা যেহেতু সূর্যের চারদিকে ঘুরছে, তাই আকাশে তাদের স্থান পরিবর্তন হয়। সেই দেখে গ্রহ আর নক্ষত্রের মধ্যে তফাত করা সম্ভব।

একটা উদাহরণ দেখা যাক। উইলিয়াম হার্শেল দূরবিনে দেখে 1781 সালের মার্চ মাসে ইউরেনাস আবিষ্কার করেন। কেমন করে তিনি বুঝলেন যে সেটা গ্রহ তা পরের পাতার ছবি থেকে বোঝা যাবে। মার্চ মাসের 13 থেকে 18 তারিখ প্রত্যেকদিন তিনি আকাশের একটা বিশেষ অঞ্চল দেখছিলেন এবং বিভিন্ন জ্যোতিষ্কের অবস্থান নোট করছিলেন। তাঁর দূরবিনে সেই জায়গাতে বিভিন্ন জ্যোতিষ্ককে কেমন দেখা যাচ্ছিল তা ছবিতে দেওয়া আছে। খুব ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে এর মধ্যে মাত্র একটা আলোকবিন্দুই জায়গা পাল্টেছে। যেমন A, B, C এগুলোর আপেক্ষিক অবস্থান স্থির, সুতরাং এগুলো নক্ষত্র। এদের সাপেক্ষে D চিহ্নিত আলোকবিন্দুটি স্থান পরিবর্তন করছে। সুতরাং D হল নতুন গ্রহ, এটাই ইউরেনাস। D একটা চাকতির মতো দেখাচ্ছে, সেটা গ্রহ হওয়ারই কথা। 


হার্শেল দূরবিন দিয়ে ইউরেনাসকে যেমন দেখেছিলেন


যত সহজে বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টা তত সহজ ছিল না ছবিতে রাতের আকাশে ফটো তুললে কেমন হতো সেটা দেখানো হয়েছে, 1781 সালে ফটোগ্রাফির কথা কল্পনাতেও ছিল না। হার্শেল প্রথমে ভেবেছিলেন এটা একটা ধূমকেতু। ইউরেনাস নামটাও হার্শেলের দেওয়া নয়, তিনি ইংল্যান্ডের তখনকার রাজা পঞ্চম জর্জের নামে গ্রহটার নাম দিয়েছিলেন। সে নাম অবশ্য বিশেষ কেউ মানেননি। ইউরোপে প্রচলিত গ্রহদের নামগুলো ছিল গ্রিক বা রোমান দেবতাদের নামে, সেই অনুযায়ী গ্রিক পুরাণের আকাশের দেবতার নামে গ্রহটার নাম দেওয়া হল ইউরেনাস।

হার্শেলকে গ্রহ আবিষ্কারের জন্য বছরের পর বছর আকাশ পর্যবেক্ষণ করতে হয়েছিল। মনে রাখতে হবে শনির পরে যে আরও গ্রহ থাকতে পারে, সেটাই অনেকে বিশ্বাস করতে পারতেন না। নেপচুনও আবিষ্কার হয়েছিল দূরবিন দিয়ে দেখে, কিন্তু মাত্র একরাতের মধ্যে। তার কারণ আকাশের কোথায় সেটা পাওয়া যাবে তা বিজ্ঞানীরা আগেই অঙ্ক কষে বার করেছিলেন। এর পিছনে একটা বড় গল্প আছে যেটা আবিষ্কারের দেড়শো বছর পরে অমাপ্তিতে পৌঁছেছে। আজ আমরা সেটাই শুনব।

লে ভেরিয়ের  
অ্যাডামস

ইউরেনাস আবিষ্কার হল বটে, কিন্তু নিউটনের মাধ্যাকর্ষণের সূত্র থেকে তার চলাফেরার হিসেব মেলানো যাচ্ছিল না। নিউটনের সূত্রটা শুনতে সোজা, দুটো বস্তু থাকলে তাদের কক্ষপথ বার করাও খুবই সহজ। কিন্তু দুইয়ের বেশি বস্তু থাকলে অঙ্কটা প্রচণ্ড শক্ত। এই হিসাবটা আমরা এখনো কম্পিউটার ছাড়া খুব নিখুঁতভাবে করতে পারি না। 1845 সালে কম্পিউটারের প্রশ্নই আসে না। এ  ক্ষেত্রে সূর্য, বৃহস্পতি, শনি ইউরেনাস, সবাইকে একসঙ্গে ধরে অঙ্কটা কষতে হয়েছিল। তাতেও যখন মিলছিল না, তখন দুই বিজ্ঞানী জন অ্যাডামস বা তাঁর পরে উরবাইন লে ভেরিয়ের আরও একটা অজানা গ্রহকে হিসেবে এনে অঙ্কটা মেলানোর চেষ্টা করেন। তার থেকে তাঁরা দুজনে আলাদা আলাদা ভাবে নতুন গ্রহটার ভর কক্ষপথ ইত্যাদি বার করেছিলেন, বলেছিলেন আকাশের কোথায় এই নতুন গ্রহটাকে পাওয়া যাবে। উরবাইন লে ভেরিয়ের ছিলেন ফরাসি, জন অ্যাডামস ব্রিটিশ। তাঁরা কেউই নিজেরা আকাশ পর্যবেক্ষণ করতেন না, কাজেই তাঁরা অন্যদের সাহায্য চেয়েছিলেন।

 

গ্যালে
ডি অ্যারেস্ট

 লে ভেরিয়ের নিজের দেশের জ্যোতির্বিদদের অনুরোধ করলেন কিন্তু তাঁরা কেউ পাত্তা দেন নি। তিনি তখন নানা দেশের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কাছে চিঠি লিখে আকাশে তাঁর নির্দেশিত জায়গা পর্যবেক্ষণ করার অনুরোধ জানান। তাঁর কথার গুরুত্ব দিয়েছিলেন জার্মানির বার্লিন মানমন্দিরের বিজ্ঞানী জোহান গ্যালে। তিনি আর তাঁর এক অল্পবয়সী সহযোগী হাইনরিখ ডিঅ্যারেস্ট চিঠির কথা মতো আকাশের ঠিক জায়গায় দূরবিন তাক করেন। সেই দিনটা ছিল 1846 সালের 23 সেপ্টেম্বর। ডিঅ্যারেস্টের হঠাৎ মনে পড়ল রাতের আকাশে ঠিক ওই জায়গার তারাদের অবস্থানের একটা পুরানো ছবি বার্লিন মানমন্দিরে আছে। দুজনে মিলে সেই ছবিটার সঙ্গে সেদিন রাতের তারাগুলোর অবস্থান একটা একটা করে মেলাচ্ছিলেন, হঠাৎ ডিঅ্যারেস্ট বললেন, ‘ম্যাপে এই তারাটা নেই!’ আধঘণ্টাতেই একটা গ্রহ আবিষ্কার হয়ে গেল। পরের দিন দেখা গেল সেটা সত্যিই একটু জায়গা পাল্টেছে। গ্যালে সঙ্গে সঙ্গে লে ভেরিয়েরকে লিখে পাঠালেন যে তাঁর গণনা অনুযায়ী গ্রহটা পাওয়া গেছে। রোমানদের সমুদ্রের দেবতার নামে তার নাম দেওয়া হয় নেপচুন।

এবার আসি অ্যাডামসের কথায়। নেপচুন আবিষ্কারের ঘোষণার পরে রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনোমার অর্থাৎ ব্রিটেনের গ্রিনউইচ মানমন্দিরের প্রধান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জর্জ এয়ারি বলেন যে জন অ্যাডামস বলে একজন তাঁকে আগেই বলেছিলেন ঠিক কোথায় নতুন গ্রহটাকে পাওয়া যাবে। নেপচুন আবিষ্কারের পরে তাঁর কাগজটা খুলে তিনি দেখেছেন যে অ্যাডামসও আকাশের প্রায় একই জায়গার কথা লিখেছিলেন। তাই নেপচুন আবিষ্কারের সমান গৌরব অ্যাডামসেরও প্রাপ্য। ফ্রান্স আর ব্রিটেনের বিজ্ঞানীরা কিছুদিন এই নিয়ে তর্কাতর্কি করেন, শেষে সবাই মেনে নিয়েছিলেন যে সেই দুজনেই আবিষ্কারের সমান ভাগীদার।

নেপচুন আবিষ্কারের যে গল্পটা চালু আছে, তার এই জায়গাটা বেশ ইন্টারেস্টিং। 1845 সালের অক্টোবর মাসে বিকেল সাড়ে তিনটের সময় লণ্ডনে এয়ারির বাড়িতে একজন দেখা করতে এসেছিলেন। আগেও তিনি দুবার এসেছিলেন, কিন্তু কোনোবারই এয়ারি বাড়ি ছিলেন না। এয়ারি পরিবার তখন রাতের খাবার খেতে বসেছিলেন। এয়ারির নির্দেশ ছিল কোনো কারণেই যেন ডিনারের সময় তাঁদের বিরক্ত করা না হয়। তাই বাড়ির খানসামা তাঁকে ফিরিয়ে দেয়। আগন্তুক তখন একটা কাগজে কিছু লিখে এয়ারির জন্য রেখে যান। দুপুর সাড়ে তিনটের সময় রাতের খাবার! এয়ারি একটু অদ্ভুত মানুষ ছিলেন সন্দেহ নেই। তবে সন্ধে হলেই জ্যোতির্বিদরা আকাশ পর্যবেক্ষণে লেগে যান, তাই তাঁদের অফিসের সময় অন্যদের সঙ্গে মেলে না। সেই আগন্তুকই ছিলেন জন অ্যাডামস।

অ্যাডামস ওই অঙ্কটা কষেছিলেন 1845 সালের সেপ্টেম্বর মাসে, দূরবিন দিয়ে কোথায় দেখলে গ্রহটাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, সেই কথা তিনি এয়ারিকে লিখে দিয়েছিলেন। সে যা হোক, প্রচলিত গল্প হল এয়ারি অ্যাডামসকে পাত্তা দেননি। প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানী তরুণের কথা শোনেননি বলেই নেপচুন আবিষ্কারের গৌরব ইংরেজদের হাত থেকে ফসকে যায়। পরবর্তীকালে অনেকেই এর জন্য এয়ারিকে প্রচুর গালমন্দ করেছেন। বিখ্যাত বিজ্ঞান লেখক আইজ্যাক আসিমভের মতে এয়ারি ছিলেন অহংকারী সংকীর্ণমনা ও হিংসুটে, তিনি গ্রিনউইচ মানমন্দিরটাকে নিজের জমিদারির মতো চালাতেন, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে তিনি এতটাই ব্যস্ত থাকতেন যে একটা গ্রহ আবিষ্কারের গুরুত্বও তিনি বুঝতে পারেন নি। এই সমালোচনা এয়ারির প্রাপ্য নয়, কিন্তু অন্য একটা অত্যন্ত অন্যায় কাজ তিনি করেছিলেন। সেই কথায় আমরা পরে আসব।

এই গল্পটা চালু বটে, কিন্তু আসলে সত্যি নয়। নেপচুন আবিষ্কারের পরে পরেই এয়ারি পুরো বিষয়টা লিখেছিলেন, অ্যাডামস তার কোনো প্রতিবাদ করেননি। আমরা এয়ারির বিবরণী থেকে ঘটনাপরম্পরা জেনে নিই। এয়ারি অ্যাডামসের কথা খুব ভালোই জানতেন, কারণ অ্যাডামস গবেষণা করতেন কেমব্রিজে। কেমব্রিজ মানমন্দিরের বিজ্ঞানী জেমস চ্যালিস এয়ারিকে চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে অ্যাডামস এই বিষয়ে কাজ করছেন, চ্যালিস মারফত এয়ারি অ্যাডামসকে ইউরেনাসের কক্ষপথ সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণও পাঠিয়েছিলেন।

ডিনারের সময় এয়ারির বাড়িতে অ্যাডামসের আসার গল্পটাও ঠিক নয়। চ্যালিস এয়ারিকে জানিয়েছিলেন অ্যাডামস তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। অ্যাডামস সেপ্টেম্বর মাসের শেষে এয়ারির বাড়ি গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তখন ফ্রান্সে। তিনি ফিরে চ্যালিসকে চিঠি লিখে জানান যে অ্যাডামসের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি, অ্যাডামস যেন চিঠিতে বিষয়টা ব্যাখ্যা করেন। অ্যাডামস তারপর গিয়েছিলেন গ্রিনউইচ মানমন্দিরে এয়ারির অফিসে, সেটা সে বছর অক্টোবর মাসের শেষের দিক। এয়ারি সেদিনও ছিলেন না, অ্যাডামস তখন তাঁর হিসেবের কাগজটা রেখে আসেন। তাতে লেখা ছিল যে ইউরেনাসের কক্ষপথ যে হিসেবের সঙ্গে মিলছে না, তার জন্য দায়ী এক অনাবিষ্কৃত গ্রহ। আকাশের কোথায় সেই গ্রহটাকে খুঁজতে হবে, সেটাও তিনি লিখে দিয়েছিলেন। গল্পে যেমন শোনা যায়, এয়ারি কাগজটাকে মোটেই তেমন উপেক্ষা করেন নি। তিনি তার পরেই কয়েকটা ব্যাখ্যা জানতে চেয়ে অ্যাডামসকে চিঠি লিখেছিলেন, কিন্তু অ্যাডামস উত্তর দেননি।

আমাদের কাহিনি এবার পৌঁছবে ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে ফ্রান্সে। 1845 সালের 10 নভেম্বর প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে লে ভেরিয়ের দেখান ইউরেনাসের কক্ষপথ হিসাবের সঙ্গে মিলছে না। পরের বছর 1 জুন এক লেখাতে হিসাব না মেলার কারণ হিসাবে এক নতুন গ্রহের প্রস্তাব করেন তিনি। এয়ারি এই লেখাটা পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই কিছু ব্যাখ্যা চেয়ে লে ভেরিয়েরকে চিঠি পাঠান। তাঁর উত্তর আসার আগেই এক মিটিঙে এয়ারি, চালিস ও জন হার্শেলের দেখা হয়। জন হার্শেল হলেন উইলিয়াম হার্শেলের ছেলে এবং সে যুগের বিখ্যাত বিজ্ঞানী। সেই সময় তাঁরা এই নতুন গ্রহ দেখার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন, অ্যাডামসের কথাও ওঠে। ইতিমধ্যে লে ভেরিয়েরের ব্যাখ্যা এয়ারির কাছে এসে পৌঁছায়। এর পরই এয়ারি চালিসকে চিঠি লিখে নতুন গ্রহ খোঁজার উপর জোর দেন।

চ্যালিস সেই কাজ শুরু করেন 1846 সালের 29 জুলাই। ইতিমধ্যে অ্যাডামস আবার নতুন করে গণনা করেন এবং সেপ্টেম্বরের গোড়াতে এয়ারিকে সেটা পাঠান। লে ভেরিয়েরও 31 আগস্ট আবার গণনা করেন। এয়ারি দেখেন যে দু’য়ের মধ্যে অনেকটাই মিল আছে। চ্যালিস সেই অনুযায়ী খোঁজা শুরু করেন, কিন্তু বিশেষ এগোতে পারেন নি। তার কারণ হল নেপচুন আকাশে খুব ধীরে সরে। তার বছর হল আমাদের 165 বছরের সমান। তার মানে আকাশে 165 বছরে নেপচুন ঘোরে 360 ডিগ্রি, এক মাসে 0.18 ডিগ্রি। তুলনার জন্য বলা যায় চাঁদ আমাদের চোখে 0.5 ডিগ্রি কোণ উৎপন্ন করে, অর্থাৎ তিন মাসে নেপচুন আকাশে দূরের নক্ষত্রদের সাপেক্ষে চাঁদের ব্যাসের পরিমাণ সরবে। তাই বেশ কিছুদিন পর্যবেক্ষণ না করলে কখনোই নিশ্চিত হওয়া যায় না যে আলোকবিন্দুটা সরেছে কিনা। সেই সময় চ্যালিস পাননি। কারণ লে ভেরিয়েরের অনুরোধ বার্লিনের মানমন্দিরে পৌঁছোয় সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহে, আর 23 তারিখ রাতেই গ্যালে ও ডিঅ্যারেস্ট গ্রহটা আবিষ্কার করেন। পরে বোঝা গেছে চালিস 4 আগস্ট গ্রহটাকে দেখতেও পেয়েছিলেন, কিন্তু আকাশের ভালো ম্যাপ না থাকার ফলে চিনতে পারেননি।

এর পরে এয়ারি আর অন্য সব ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা অনেক লেখালেখি করে প্রমাণ করেন যে অ্যাডামস লে ভেরিয়েরের আগেই অঙ্কটা কষেছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে তাঁর গবেষণার কথাটা জনসমক্ষে আসে নি। তাই লে ভেরিয়েরের থেকে তাঁর কৃতিত্ব কোনো অংশে কম নয়। আমি উপরের আলোচনাতে এয়ারির সেই বিবরণের সাহায্য নিয়েছি। লে ভেরিয়ের মোটেই এতে খুশি হন নি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এয়ারির বিবরণ মেনে নিয়ে অ্যাডামস ও লে ভেরিয়ের দুজনকেই সমান কৃতিত্ব দেওয়া হয়। আমরা দেখলাম যে এয়ারিকে তাহলে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না, তিনি অ্যাডামসের কাজকে যথেষ্টই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। নেহাতই ঘটনাচক্রে ইংল্যান্ডে নেপচুন আবিষ্কার হয়নি; জার্মানদের কাছে কিছুদিন আগের আকাশের মানচিত্র ছিল, চালিসের কাছে ছিল না। সুতরাং ব্রিটিশ আর ফরাসি বিজ্ঞানীদের কৃতিত্ব সমান।

এত বিস্তারিত আলোচনার কি দরকার ছিল? ছিল, তার কারণ এই গল্পটাও পুরোপুরি সত্যি নয়, তবে সেটা বোঝা গেছে অনেক পরে। 1960 সাল পর্যন্ত রয়্যাল গ্রিনউইচ অবজারভেটরি নেপচুন আবিষ্কার সংক্রান্ত কাগজপত্র কাউকে দেখতে দেয়নি। তার পরে ফাইলটা হারিয়েই যায়। ফাইলটা শেষ নিয়েছিলেন রয়্যাল অ্যাস্ট্রোনোমারের সহকারী ওলিন এগেন, তিনি 1960 সাল নাগাদ এয়ারি ও চালিসের জীবনী লিখছিলেন। এগেনকে জিজ্ঞাসা করলেই বলতেন যে ফাইল তিনি ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন। এগেন তার পর ইংল্যান্ড ছাড়েন, অস্ট্রেলিয়া ও সবশেষে চিলির মানমন্দিরে কাজ করছিলেন। 1998 সালে তিনি মারা যান। তারপর অর্থাৎ নেপচুন আবিষ্কার হওয়ার দেড়শো বছর পরে তাঁর কাগজপত্রের মধ্যে গ্রিনউইচ মানমন্দিরের সেই ফাইলটা পাওয়া যায়। সমস্ত কাগজপত্র আবার কেমব্রিজে ফেরত আসে।



বার্লিন মানমন্দিরের আকাশের ম্যাপ

 

খুঁজে পাওয়া সেই কাগজপত্রই আমাদের নেপচুন আবিষ্কারের কাহিনিকে নতুন করে লিখতে বাধ্য করেছে। সঙ্গের ছবিটা বার্লিন মানমন্দিরের সেই আকাশের ম্যাপ, যার উপর গ্যালে ভেরিয়েরের ভবিষ্যৎবাণী ও নেপচুনের প্রকৃত অবস্থান এঁকে দিয়েছিলেন। অ্যাডামসের প্রথম হিসাবটা একই ছবিতে দেখানো হয়েছে মনে রাখতে হবে গ্যালে অ্যাডামসের কথা জানতেন না। দেখতে পাচ্ছি অ্যাডাম প্রথমে যে হিসেব দিয়েছিলেন সেটা নেপচুনের প্রকৃত অবস্থানের বেশ কাছাকাছি, কিন্তু ভেরিয়েরের হিসাবটা অবশ্যই আরও নিখুঁত। কিন্তু এও জানা গেছে যে অ্যাডামস পরবর্তীকালে যে হিসাব দিয়েছিলেন, সেটা অনেক বেশি ভুল ছিল। এয়ারি সেই কথাটা এড়িয়ে গেছেন। শুধু তাই নয়, অ্যাডামস প্রথম যে হিসাবটা দিয়েছিলেন, সেটা কেমন করে পেয়েছিলেন তা লেখার প্রয়োজন বোধ করেন নি – শুধু কতগুলো সংখ্যার উপর নির্ভর করে কোনো জ্যোতির্বিদই কাজ শুরু করতে রাজি হতেন না। এয়ারি যখন গণনার ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন, তখন অ্যাডামস কোনো উত্তর দেননি। লে ভেরিয়েরের গণনা এতই বিশ্বাসযোগ্য ছিল যে সেটা জার্মানি ও ইংল্যান্ড দুই দেশের জ্যোতির্বিদদের প্রভাবিত করেছিল। অ্যাডামস যে একই কাজ করেছেন, সে কথা এয়ারি লে ভেরিয়েরকে কখনো লেখেন নি – কাজেই তিনি আদৌ অ্যাডামসের কথায় বিশ্বাস করেছিলেন কিনা সে প্রশ্ন থেকে যায়। বাস্তবটা হল ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা নিজেদের দেশের লোকের কৃতিত্বকে অনেক বড় করে দেখিয়েছিলেন - তার জন্য সুবিধামতো কিছু তথ্য বেছেছিলেন ও কিছু বাদ দিয়েছিলেন। অর্থাৎ চালিস ও বিশেষত এয়ারি মোটেই অ্যাডামসকে অবজ্ঞা করেন নি, বরঞ্চ তাঁর যা স্বীকৃতি পাওনা তার থেকে অনেক বেশি পাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। সায়েন্টিফিক আমেরিকান পত্রিকার সেই প্রবন্ধের উপশিরোনাম ছিল ‘Did the British Steal Neptune?’ তাই এই প্রবন্ধে গ্রহ চুরি কথাটা বোধহয় খুব ভুল নয়। গ্রহটাকে চুরি না করলেও তার আবিষ্কারের কৃতিত্বটা চুরি নিশ্চয় হয়েছিল, এবং করেছিলেন ব্রিটেনের কয়েকজন বিজ্ঞানী।

এখানেই একটা কথা বলে রাখা ভালো। অ্যাডামস তো বটেই, এমনকি লে ভেরিয়েরও নেপচু্নের কক্ষপথ বা ভর যা বার করেছিলেন, তার সঙ্গে প্রকৃত মানের অনেকটাই পার্থক্য আছে। 1846 সালে কক্ষপথের ফারাকটা কমই ছিল, কিন্তু যদি জ্যোতির্বিদরা সেই সময়ে পর্যবেক্ষণ না করে কয়েক বছর দেরি করতেন, তাহলে তাঁরা হিসাবের সঙ্গে অনেকটাই তফাত পেতেন। সেটার কারণ অবশ্য পুরোটাই অঙ্কের ভুল নয়। ইউরেনাসের কক্ষপথ সম্পর্কে আমাদের পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু ত্রুটি ছিল, তার জন্যও অঙ্কে ভুল রয়ে গিয়েছিল।

 

আমরা কি চালিসকে নেপচুন প্রথম চোখে দেখার কৃতিত্বটা দেব? সেটা ঠিক নয়, কারণ আগেও নিশ্চয় কেউ কেউ নেপচুনকে দেখেছিলেন, কিন্তু গ্রহ বলে চেনাটাই হল আসল। নেপচুনকে প্রথম কে দেখেছিলেন, সে বিষয়ে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত – তিনি গ্যালিলিও। তিনি এমনকি সেই জ্যোতিষ্কটা যে আকাশে জায়গা পরিবর্তন করে, সেটাও বুঝতে পেরেছিলেন। আমরা জানি গ্যালিলিও বৃহস্পতির চারটে উপগ্রহ আবিষ্কার করেছিলেন। সেই প্রথম পৃথিবী ছাড়া অন্য কোনো গ্রহের উপগ্রহের খবর আমরা জানতে পেরেছিলাম। গ্যালিলিও মনে করলেন বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে যদি উপগ্রহ ঘোরে, তাহলে বাইবেলে যে বলা আছে পৃথিবী ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে, কথাটা ভুল। ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে গ্যালিলিওর বিরোধের সেই ইতিহাস সকলের জানা, কিন্তু আজ আমরা তা নিয়ে কথা বলতে বসিনি।

 

 

উপরের ছবিদুটো গ্যালিলিওর নোট থেকে নেওয়া। ছবিতেই লেখা আছে প্রথম ছবিটা ডিসেম্বর 27, 1612 আর দ্বিতীয় ছবিটা হল পরের বছর জানুয়ারি মাসের 29 তারিখের।এই নোটদুটো গ্যালিলিওর বৃহস্পতি পর্যবক্ষণের। ছবিদুটোর মাঝখানে বড় গোলটা হল বৃহস্পতি, ছোট ছোট গোল দিয়ে গ্যালিলিও উপগ্রহগুলোর অবস্থান দেখিয়েছেন। ছবিতে বাঁদিকে ভাঙ্গা রেখা দিয়ে যে তারকাচিহ্নটি যুক্ত, এখন আমরা জানি যে সেটাই ছিল নেপচুন। গ্যালিলিও প্রথমে ওটাকে সাধারণ তারকাই ভেবেছিলেন নিশ্চয়, কিন্তু পরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে সেই জ্যোতিষ্কটা যে একমাসের মধ্যে জায়গা পাল্টেছে সেটা গ্যালিলিও বুঝতে পেরেছিলেন। কেন তিনি তা প্রকাশ করেননি, তা অনুমানের বিষয়। এমন হতেই পারে যে সৌরজগতে যে আরও কোনো অজানা গ্রহ থাকতে পারে, সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত হতে পারেন নি। মনে রাখতে হবে হার্শেল আরো সত্তর বছর পরে ইউরেনাস আবিষ্কার করেছিলেন। এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে গ্যালিলিওর আগে কেউ নেপচুন দেখতে পাননি -- কারণ খালি চোখে তা সম্ভব নয় গ্যালিলিওই প্রথম দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, এবং সেই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দূরবিনটি ছিল গ্যালিলিওর কাছে, তিনি নিজের হাতে সেটা বানিয়েছিলেন।

  নেপচুনের কক্ষপথ নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র দিয়ে পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না, সেজন্য বিজ্ঞানীরা নতুন গ্রহ খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছিলেন। 1905 সাল থেকে খোঁজ চলছিল। অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লাওয়েল মানমন্দিরে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্লাইড টমবাউ 1930 সালে প্লুটোকে আবিষ্কার করেন। তার অবস্থান অঙ্কের সঙ্গে মোটামুটি মিলেও গিয়েছিল। কিন্তু আমরা এখন জানি প্লুটোর ভর খুবই কম, তাই নেপচুনের কক্ষপথ পরিবর্তনে তার ভূমিকা সামান্যইতখনকার গ্রহ পর্যবেক্ষণে প্রচুর ভুল ছিল। তাই অঙ্কের সঙ্গে প্লুটো অবস্থান মিলে যাওয়া একেবারেই সমাপতন অর্থাৎ অ্যাক্সিডেন্ট।

 এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছিল চার পর্বে বিবিধ ডট ইন অনলাইন ওয়েব ম্যাগাজিন কাম পোর্টালে। পর্বগুলোর লিঙ্ক , ,