Wednesday 2 December 2020

দারুচিনির দ্বীপ পর্ব ৫- হিক্কাদুয়া, গ্যালে ও কলম্বো



 

দারুচিনির দ্বীপ

পর্ব ৫- হিক্কাদুয়া, গ্যালে ও কলম্বো

                                 শম্পা গাঙ্গুলী

প্রথম পর্বঃ সিগিরিয়া

দ্বিতীয় পর্বঃ পোলোন্নারুয়া ও মিনেরিয়া

তৃতীয় পর্বঃ অনুরাধাপুরা ও ডাম্বুলা

দারুচিনির দ্বীপ পর্ব ৪- ক্যান্ডি ও নুয়ারা এলিয়া

   সারাদিন ঘোরার ধকলে ক্লান্ত হয়ে যখন হিক্কাদুয়া পৌঁছালাম, সন্ধে নেমে গেছে। হোটেল ওসেন ভিউ কটেজ। দেখে সবাই ভীষণ খুশি। এত সস্তায় এত ভাল হোটেল পাওয়ার পুরো ক্রেডিট অনির্বাণের। বিশাল বড় হোটেল, সঙ্গে সুইমিং পুল, আবার হোটেলের নিজস্ব সমুদ্রসৈকতও আছে। চারপাশ প্রচুর গাছপালা দিয়ে সুন্দর করে সাজানো। এর সঙ্গে ফ্রিতে উপরি পাওনা নিরিবিলি পরিবেশ। অত বড় হোটেলটায়, আমরা ছাড়া প্রথম দিন অন্তত আর কোনো পর্যটক চোখে পড়েনি। পরের দুদিন দু’একজন বিদেশীকে দেখেছি। অফ সিজন বলেই এটা সম্ভব ছিল। শ্রীলঙ্কাতে পর্যটনের সিজন নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি। ব্যালকনি থেকে কয়েক হাত দুরে রাতের সমুদ্র তীরে নারকেল গাছের সারি; অন্ধকার কালো জলে সাদা ফেনা সৈকতে আছড়ে পড়তে দেখে  আর সমুদ্র গর্জন শুনে মনে হচ্ছিল, নিচের সুইমিং পুলের পাশ দিয়ে নুড়ি বিছানো পথ ধরে তক্ষুণি চলে যাই মিশমিশে কালো সমুদ্রের কাছে। কিন্তু রাতের খাওয়া তখনও বাকি। খাবার হোটেলগুলো বেশি রাত পর্যন্ত খোলাও থাকবে না। অগত্যা খেয়ে বিশ্রাম।



দু’রাত এখানেই থাকব। ফলে অখণ্ড অবসর। দূরে কোথাও যাওয়া নেই বলে ড্রাইভার তার বন্ধুর বাড়ি যাবে বলে ছুটি চাইল। আমরাও টানা পাঁচদিন গাড়িতে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। পরের দিনটা নিজেদের মত ভাগ হয়ে ঘুরে বেড়াব ঠিক করলাম। খালি দুপুরের আর রাতের খাওয়া সবাই একসঙ্গে খাব
আমার আর গৌতমের সকালে হাঁটা অভ্যাস। ভোরবেলা জনমানবহীন ঐ সমুদ্রপাড়ে তাই পরের দিনের প্রথম সূর্যটাকে কেবল আমরাই বুঝি দেখলাম। ছোটো কাঁকড়া দলে দলে দূষণহীন নির্জন পাড়ের বালুতটে অসংখ্য আঁকিবুকি কেটে চলেছে বিরামহীন ভাবে। খানিক পরে অভিজিত এলো। সারা ট্রিপে অভিজিত ছিল হিসাব রক্ষক। প্রতিটা পাই পয়সার হিসাব খুব ভালোভাবে সামলেছে। হাবারানাতে সন্ধ্যেগুলোতে গানের আসরে ওর গান শুনেছিলাম। বেশ ভাল গায়।
হোটেলের ব্যালকনি থেকে ভারত মহাসাগর, হিক্কাদুয়া
ব্রেকফাস্ট সেরে অন্যদের ঘরে গিয়ে জানলাম, অন্যরা কেউই সমুদ্রে নামতে রাজি নয়। ঝুলন তো এখানে এসে অখণ্ড অবসর পেয়ে নিজেদের জামাকাপড় কেচে সারা ঘর দড়ি টাঙিয়ে মেলেও ফেলেছে ততক্ষণে তাই আমরা দুজনই গেলাম সমুদ্রে। বেশ ঢেউ তবে পুরীর সমুদ্রের মত অত বড় নয় এদিক ওদিক বড় বড় প্রবাল। খুব সাবধানে ঢেউ সামলাতে হচ্ছিল। তার মধ্যে তখন জোয়ারের সময় বলে হয়ত, পায়ের তলার স্রোতে ভীষণ সমুদ্রমুখী টান। জলের তলার বালি অজান্তেই আমাদের ক্রমেই দূরের সমুদ্রের অভিমুখে নিয়ে যেতে চাইছে কিন্তু অবাক লাগছিল সকাল দশটাতেও আমাদের আশপাশে একটাও স্নানার্থী না দেখতে পেয়ে। হিক্কাদুয়াতে তো শুনেছিলাম, স্কুবা-ডাইভিং, সার্ফিং, ওয়াটার স্কিইং সব হয়। যদিও সেগুলো টুরিষ্ট সিজনে। যাহোক, স্নান করতে করতে আমরা তট থেকে বেশ অনেকটা দূরে চলে গিয়েছি। দেখি আমাদের দলের অন্যরা সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে আমাদের পাড়ে চলে আসতে বলছে। ফিরে এসে শুনলাম, হোটেলের লোক আমাদের সমুদ্রে নামতে নিষেধ করেছে। কয়েক মাস আগে ওই জায়গাটেতেই নাকি চার জন রাশিয়ান জলে ডুবে মারা গেছে। এখানকার সমুদ্রে খুব চোরা স্রোত। বুঝলাম এখানকার তটভূমি অর্থাৎ মহীসোপানটা বেশি চওড়া নয়। ঐ জন্য অত বড় বড় ঢেউও নেই। পুরীর সমুদ্রে মৃদু ঢালের মহীসোপান বহুদূর পর্যন্ত আছে বলে জলের সঙ্গে ক্রমাগত সমুদ্র-তটের ঘর্ষণের পরিমাণও অনেক গুণ বেশি হয়। তাই ঢেউগুলোর উচ্চতাও অত বেশি। এখানে অল্প চওড়া মহীসোপানের পরই, খাড়াই মহীঢাল। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, এটা বঙ্গোপসাগর নয়, ভারত মহাসাগর। বুঝলাম বেশ ভুল করেছি জলে নেমে।  
কিন্তু জল থেকে উঠে আর এক বিপত্তি। জলে নেমে ভুলে গিয়েছিলাম, আমি লাম্বার-স্পন্ডিলোসিসের রুগি। শক্তিশালী ঢেউয়ের ধাক্কায় প্রচণ্ড কোমরের যন্ত্রণা শুরু হল। ঐ নিয়েই খেতে গেলাম সমুদ্রের বিচের ওপর অভিনব এক রেস্তরা টপ সিক্রেটে রেস্তরাটা নেট থেকে খুঁজে বার করেছিল অনির্বাণ।  অনেক কিছু  খাওয়া হয়েছিল সেদিন। হাঙর, অক্টোপাস, স্যামন, স্কুইড, নানা ধরনের স্যালাড আর পানীয়। গৌতম তো একাই প্লেটে প্রায় গোটা আষ্টেক অক্টোপাস নিয়ে মহাভোজ সারল। সেগুলো অবশ্য সাইজে ছোটো ছিল। 

    খাওয়া  সেরে অন্যরা গেল কেনাকাটা করতে, আর আমার যন্ত্রণার জন্য আমরা দুজন হোটেলে ফিরলাম। শুনলাম ওখানকার সমুদ্রের পাড়ের সূর্যাস্ত নাকি দেখার মত ওটা যেন মিস না করি।  অন্যরা সব একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর থেকে সারা দুপুর ধরে মোটামুটি সস্তায় অনেক কেনাকাটা করল। কাবেরীর দেওয়া ওষুধ দারুণ কাজ হল বিকেলে খানিক সুস্থ হয়ে আমরাও সেখানে গিয়ে, মশলা, চা আরও কিছু কেনাকাটা সারলাম। তবে কাঠের জিনিসের এখানেও খুব দাম।
ভারত মহাসাগরে সেদিনের সূর্যটা সবে ডুবেছে
কেনাকাটা সেরে সমুদ্রের ধারে যখন গেলাম তখন সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার আকাশের ফিকে লাল রং গোধুলিকে মাতাল করে রেখেছে। ঝোড়ো হাওয়া কালো কালো নারকেল গাছের মাথার ওপর দাপাদাপি করে চলেছে। আর তীরের দিকে আসা মাছ ধরার কালো ডিঙি নৌকোগুলোর কালো ছায়া মনটাকে বিষাদ করে তুলল। আমরা দুজন বহুক্ষণ একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনে হল,
হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি

সেদিন সন্ধ্যায় হোটেলের সুইমিং পুলের ধারে আরাম কেদারায় বসে আমি, ঝুলন আর কাবেরী অনেকক্ষণ গল্প করলাম। পরের দিন সকাল বেলা রওনা দিতে হবে। সেদিন গ্যালে দুর্গ ছুঁয়ে কলম্বো শহর দেখে এয়ারপোর্ট ঢুকব। সারাদিনে অনেকটা গাড়ির জার্নি।
হিক্কাদুয়া থেকে পরদিন সকালে বেরিয়ে আমরা গ্যালে দুর্গ দেখতে গেলাম। শ্রীলঙ্কার আরও দক্ষিণ- পশ্চিম উপকূলে এটি বানিয়েছিল পর্তুগিজরা ১৫৮৮ সালে। পরে সপ্তদশ শতকে সেটার সম্প্রসারণ ঘটায় ডাচ বণিকরা। টলেমির ম্যাপ অনুযায়ী প্রাচীনকালে (১২৫-১৫০ খ্রিস্টাব্দ) শ্রীলঙ্কা এই বন্দরের মাধ্যমে গ্রীস, রোম, আরব ও চিন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করত। এটি তখন একটি ব্যস্ত বন্দর ছিল। বিখ্যাত পর্যটক ইবন বতুতা তাঁর পৃথিবী পরিক্রমণ কালে এই বন্দর ছুঁয়ে যান। এর অনেক পরে রাজা ধর্মচক্রবাহুর সঙ্গে বন্ধুত্বের জোরে পর্তুগিজরা এখানে একটি দুর্গ গড়ার অনুমতি পায়। পরে তা দখল করে ডাচরা এবং দুর্গটির সম্প্রসারণ করে ব্রিটিশ শাসন কালে ডাচরা এখান থেকে বিতাড়িত হয়। দুর্গ এলাকাটা বিশাল বড়। প্রাচীনত্বের ছোঁয়া বজায় রেখেই এটি রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে দারুন ভাবে। গ্যালে দুর্গে ঢুকেই প্রথমে পড়ল মেরিটাইম মিউজিয়াম।  সেখানে শ্রীলঙ্কার প্রাচীন কালের নৌপরিবহনের ইতিহাস ও নানান সামুদ্রিক সম্পদ মডেল ও ছবির মাধ্যমে দেখানো হয়েছে। এছাড়াও পর্তুগিজ চার্চ, লাইট হাউস, ওয়াচ টাওয়ার তো দেখলামই প্রাচীন সময় থেকেই বহু জাতি ও ধর্মের মানুষের বসতি এই শহরটাকে দিয়েছে একটা রঙিন ইতিহাস। বেশ কিছু ডাচ অধিবাসীর বংশপরম্পরায় এখানে এখনো বসবাস। কেউ কেউ অনেক সম্পত্তির অধিকারী। ইউনেস্কো যথার্থই  ঐতিহ্যবাহী এই দুর্গ-শহরকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করেছে। গ্যালে দুর্গের ভিতরে কিন্তু লোক বাস করে, আদালত ও অফিস সবই আছে।  
গ্যালে দুর্গের ভিতরে
  দুর্গের প্রাচীরের ওপর দিয়ে হেঁটে একেবারে সবচেয়ে উঁচু প্রান্তে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। প্রথমে মনে হল বোধহয় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেছে বা কেউ আত্মহত্যা করেছে। তারপরেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। শ্রীলঙ্কার কোনো সিনেমার শুটিং হচ্ছে। কুচকুচে কালো ঝাঁকড়া চুলের মাঝারি উচ্চতার খালি গায়ের একটা লোক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে। রুপোলি মাকড়ি পরা পেশীবহুল কালো পায়ের একটাতে মোটা দড়ি বাধা। মাথায় ফেট্টি, তাতে ক্যামেরা লাগানো। তাতেও আমরা বুঝিনি সে কী করতে চলেছে। তারপর জানলাম সে নাকি ঐ দুর্গ প্রাচীরের সবচেয়ে উঁচু অংশ থেকে অনেক নীচের গভীর ভারত মহাসাগরে লাফাবে! সিনেমার শুটিং করতে! লাফানোর জন্য যে জায়গাটা বেছেছে, সেখানে মাথা তুলে আছে একটা বড়সড় সূচাল প্রবাল খণ্ড। গভীর জলের মধ্যে দেওয়াল আর ঐ পাথরটার মধ্যে হয়ত বা ফুট দশেকের দূরত্ব। একটু এদিক ওদিক হলেই প্রবাল পাথরে লেগে মাথা ফেটে চৌচির। লাফানোর আগে আমরা সবাই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। সিনেমার লোকজন ছাড়াও অনেক মানুষ সেই ঝাঁপানোটা ভিডিও রেকর্ডিং করে ধরে রাখার জন্য মোবাইল বা ক্যামেরা নিয়ে রেডি। ঘটনার ক্লাইম্যাক্সটা ঘটল নিরাপদেই এবং বেশ কয়েকবার। অর্থাৎ লোকটাকে একই দৃশ্যের শুটিং এর জন্য অন্তত বার তিনেক একই জায়গায় ঝাঁপ মারতে হল, যতক্ষণ না পরিচালকের মনোমত হচ্ছে। প্রতিবারই লোকটা কোনো বিপদ না ঘটিয়ে নির্ভুল ভাবে একই জায়গায় ঝাঁপ দিচ্ছিল আর অবলীলায় ডুব সাঁতার দিয়ে ভেসে উঠে আবার পাড়ে চলে আসছিল। লোকটা সিনেমার হিরো, নাকি ভিলেন, নাকি হিরোর ডামি জানি না; এই কাজের মূল্য হিসাবে কত টাকা পাবে তাও জানি না; কিন্তু লোকটা যে অসীম সাহসী এটা বুঝলাম।




        তক্ষণ ধরে শুটিং দেখতে গিয়ে, প্রচুর হাওয়া থাকা সত্ত্বেও তাপে ঝলসে গিয়েছিলাম সবাই। নিচে একটা আইসক্রিমওয়ালাকে দেখে আমার ফাইন শোধ করার কথা মনে পড়ল। সবাইকে আইসক্রিম  খাওয়ালাম। সত্যি কথা বলতে সারা ট্রিপে একদিনও কোথাও কোনো ফেরিওয়ালাকে ঠেলাগাড়ি করে কিছু বিক্রি করতে দেখিনি। বেকারত্ব কম বলেই বোধহয়। আর রাস্তায় রাস্তায় ফেরিওয়ালা নেই বলেই হয়ত দেশটা এত পরিচ্ছন্ন রাখা সম্ভব। তবে ওখানকার মানুষের সচেতনতার নমুনা সঙ্গে সঙ্গে পেলাম। আইসক্রিমওয়ালার সঙ্গেই ময়লা ফেলার একটা বিন ব্যাগ ছিল। আমরা সবাই খেয়ে ঐখানেই আমাদের আইস্ক্রিমের প্যাকেটগুলো ফেলছিলাম। প্রচণ্ড হাওয়ার জন্য গৌতমের প্যাকেটটা ফেলার সময়ে হাত থেকে ফসকে উড়ে গিয়ে পরিষ্কার রাস্তায় বেশ কিছুটা দূরে গিয়ে পড়ল। আমরা কিছু করার আগেই সবাইকে অবাক করে দিয়ে আইসক্রিমওয়ালা ছুটে গিয়ে প্যাকেটটা কুড়িয়ে এনে বিন ব্যাগে ভরল। জানিনা, ঐ লোকটার বিদ্যালয়ের পাঠলাভ কতদূর অবধি, কিন্তু দেশটাকে পরিচ্ছন্ন রাখার সচেতনতার পাঠ তার নিঃসন্দেহে সম্পূর্ণ হয়েছে শৈশবেই, এটা বুঝলাম। নাহলে এই দৃষ্টান্ত সে রাখতে পারত না। সে আরও বলল যে ওটা রাস্তায় পড়ে আছে কারোর নজরে পড়লে তার সাংঘাতিক জরিমানা হবে। ভাবুন তো একবার, রাষ্ট্রের নজরও কতখানি?
     ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায় ভারত-শ্রীলঙ্কা-অস্ট্রেলিয়া-আন্টার্কটিকা সবই বহু কোটি বছর আগে গণ্ডোয়ানা নামে একটা বিশাল ভূখণ্ডের অংশ ছিল। ভূ-অভ্যন্তরের উত্তপ্ত ম্যাগমার পরিচলন স্রোত এই ভূখণ্ডকে টুকরো টুকরো করে নানান দিকে সরিয়ে দিয়েছে। তেমনি শ্রীলঙ্কাকেও বিচ্ছিন্ন করেছে ভারত থেকে। শ্রীলঙ্কার দশ ভাগের নয় ভাগ প্রাচীন প্রিক্যাম্ব্রিয়ান যুগের রূপান্তরিত শিলা দিয়ে তৈরি। মধ্যভাগের পার্বত্য ভূভাগ সবচেয়ে উঁচু। এই উঁচু ভূপ্রকৃতি দেশের উত্তর-পূর্ব থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে।  কেবলমাত্র দেশের উত্তর-পশ্চিম উপকূল অংশ মূলত পাললিক শিলা দিয়ে তৈরি। ভারতের তামিলনাডুর দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে পাম্বাম দ্বীপ থেকে শ্রীলঙ্কার  উত্তরে জাফনার উত্তর-পশ্চিম উপকূলে মান্নার দ্বীপের মাঝে সমুদ্রে তিরিশ কিলোমিটার দূরত্ব। সেখানে ডুবন্ত চুনাপাথরের আর প্রবালের পাহাড় আছে পরপর বলয়ের মতো। ওখানকার জলের গভীরতাও মাত্র এক থেকে দশ মিটার। প্রাচীন কালে দুদেশের বিচ্ছিন্নকারী সমুদ্রটার নাম ছিল সেতুসমুদ্র এবং ওই সমুদ্রের ওপর দিয়ে সত্যি যোগাযোগ যে ছিল তার প্রমাণ  মেলে অনেক। মার্কোপোলো এটার নাম দিয়েছিলেন সেতুবন্ধ। ঐতিহাসিক ইবনবতুতার লেখাতেও এই পথের কথা পাওয়া গেছে। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত ভারত শ্রীলঙ্কার মাঝের এই পথ দিয়ে মানুষ পায়ে হেঁটে যাতায়াত করত। ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্রের জলতল উঠে আসায় এটি ডুবে যায়। আবার ব্রিটিশ একজন কার্টোগ্রাফার ১৮০৪ সালে  একটি ম্যাপ তৈরি করেন যেখানে এটাকে বলেছিলেন অ্যাডামস ব্রিজ। তাঁর তথ্যসূত্র ছিল প্রাচীন ইহুদি পুঁথি। সেখানে বলা হয়েছে আদম স্বর্গ থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রথম শ্রীলঙ্কার এক পাহাড়ের ওপর পড়েন। সেখানে তিনি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে একহাজার বছর একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেজন্য শ্রীলঙ্কার সেই পাহাড়টার চূড়ার নাম হয় অ্যাডামস পিক। সেই চূড়ায় একটা গর্ত ও বিশাল বড় আকারের মানুষের পায়ের মতো একটা ছাপ আছে। কথিত আছে অ্যাডাম এর পর এই সেতুর ওপর দিয়ে হেঁটে ভারতে আসেন। সেজন্য এটার নাম অ্যাডাম সেতু। এর উৎপত্তিগত বৈশিষ্ট নিয়ে প্রধানত দুধরনের মতবাদ আছে। একদল বলে সামুদ্রিক ঢেউয়ের সঞ্চয়ের ফলে এটা তৈরি হয়েছে। অন্যদল বলে, না এটা আসলে ভারত ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে শ্রীলঙ্কা সৃষ্টির সময়ে তৈরি হয়েছে। উৎপত্তি যে ভাবেই হোক না কেন ইসরোর স্যাটেলাইট চিত্র থেকে জানা যায় এখানে পরপর প্রাচীরের আকারে জলের তলায় চুনাপাথর ও বালির স্তরের ওপর প্রবাল জমে প্রায় ১০৩ টা ছোটো এই ডুবোপাহাড় পরপর রয়েছে, যা বড় কোনো জাহাজ এপথ দিয়ে যেতে বাধার সৃষ্টি করে। এই ডুবোপাহাড়ের সারিগুলির প্রবালের রেডিওকার্বন ডেটিং করে জানা যায় যে এগুলি প্রায় এক লক্ষ পঁচিশ হাজার থেকে সাড়ে তিনহাজার বছর পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল।
স্বাধীনতা সৌধ, কলম্বো
যাত্রার শেষ ধাপ কলম্বো, কিন্তু সেখানে বিশেষ কিছু দেখার সময় আমাদের নেই। পুরনো পার্লামেন্ট ভবন দেখলাম। স্বাধীনতা সৌধ দেখলাম, তার সামনের ইন্ডিপেন্ডেন্স পার্কে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলাম। প্রাচীন কাল থেকেই কলম্বো বন্দরের মাধ্যমে এদেশের বাণিজ্য চলত দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে। স্বাভাবিক পোতাশ্রয় যুক্ত শ্রীলঙ্কার দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের এই  বন্দরটি পঞ্চম থেকে অষ্টম শতক পর্যন্ত রেশম-পথের অন্তর্গত ছিল। সিল্ক-রুট বা রেশম পথ হল প্রাচীন কালের পূর্ব-পশ্চিমের একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পথ যা পূর্বে কোরিয়া জাপান চিন থেকে শুরু করে পশ্চিমের ভূমধ্যসাগরপারের দেশগুলো পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বাণিজ্যিক লেনদেনের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানও ঘটত। চিনের রেশমই এই বাণিজ্যের প্রধান সামগ্রী ছিল, তাই এই বাণিজ্য পথের নামও হয়েছিল রেশম পথ। পূর্বের চিন দেশে ও পাশ্চাত্যের গ্রীক, রোম, আরব ও মিশরে রপ্তানি হত প্রাচ্যের নানান মশলা যেমন দারুচিনি, গোলমরিচ, সুগন্ধি দ্রব্য, মূল্যবান পাথর, চা, হাতির দাঁতের সামগ্রী ইত্যাদি। পশ্চিমী দেশগুলো থেকে আসত উন্নত মানের তুলা, আধুনিক প্রযুক্তির সামগ্রী। তাই বহুদিন ধরে বাণিজ্য চলেছে এই বন্দরের মাধ্যমে যা নিয়ন্ত্রণ করেছে কলম্বো তথা সমগ্র দেশটার অর্থনীতিকে।
তবে দেশটার অর্থনীতি জোর ধাক্কা খেয়েছিল তামিল ও সিংহলীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের সময়। এলটিটিই জঙ্গিরা (যাদের অন্য নাম তামিল টাইগার) দেশে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দ্বীপের উত্তর ও পূর্বাংশে তামিল ইলম নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিল। দীর্ঘ ছাব্বিশ বছর সামরিক অভিযান চালানোর পরে ২০০৯ সালের মে মাসে সরকার ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে এলটিটিই সংগঠনকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। এই যুদ্ধে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টের সম্মুখীন হতে হয় দু পক্ষের সাধারণ মানুষকে। কোনো কোনো পরিসংখ্যান বলে প্রায় এক লক্ষ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান এই যুদ্ধে। সাংঘাতিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশের অর্থনীতি। বিদেশী পর্যটক আসা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন অবশ্য পরিস্থিতি ক্রমে স্বাভাবিক হচ্ছে।


আধুনিক কলম্বো
কলম্বো ছেড়ে আমাদের যাত্রা শেষ হল বন্দরনায়েক বিমান বন্দরে। এই কদিনের আমাদের সবসময়ের সঙ্গী ড্রাইভার পালিথাকে বিদায় জানালাম। নিজের দেশের শিল্পকলা, অর্থনীতি ও রাজনীতি সম্পর্কে বেশ ওয়াকিবহাল ভদ্রলোক। নিজের দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ মনুষ্য-সম্পদ নিয়েও গর্বের শেষ নেই লোকটার। ভারত ও ভারতীয়দের সাথে তুলনা করে বারবার ভদ্রলোক সেটাই প্রমাণ করতে চাইছিলেন।      
    এয়ারপোর্টে দেখা হয়ে গেল আমার আগের স্কুলের এক সহকর্মী মৈত্রেয়ীর সঙ্গে। পরিবারসহ তারাও শ্রীলঙ্কা ভ্রমণে এসেছিল। অনেকদিন পর দেখা হতে বেশ ভালো লাগল, কিছুক্ষণ গল্প করলাম। মাত্র চারদিনের জন্য এলেও তারা কিনেছে অনেক কিছু। আমি কী নিয়ে এলাম শ্রীলঙ্কা থেকে? আমি তো সঙ্গে করে ওই দেশ থেকে মূল্যবান কিছুই প্রায় আনিনি, কিন্তু স্মৃতির ঝোলাটা যতটা পেরেছি ভরে এনেছি। তার আকর থেকে আপনাদের কিছু দিলাম।

(সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার ১৪২৪ সালের উৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত)