Friday 28 May 2021

সত্যেন্দ্রনাথের ছোটবেলা

সত্যেন্দ্রনাথের ছোটবেলা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

 

‘একশোর মধ্যে একশো দশ!’ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন হিন্দু স্কুলের অন্য শিক্ষকরা। উপেন্দ্রনাথের হলটা কী? উপেন্দ্রনাথ বক্সি কলকাতার সবচেয়ে নামকরা অঙ্কের মাস্টারমশাই, তিনি টেস্ট পরীক্ষায় কাউকে একশো দশ দিয়েছেন? ছাত্রটি কে?

       ‘সত্যেন। প্রশ্নপত্রে যতগুলো অঙ্ক ছিল, সবগুলো করে দিয়েছে। জ্যামিতির এক্সট্রাগুলো আবার দু’তিন রকম উপায়ে সলভ করেছে। ওকে একশো দিলে জাস্টিস হত না। দেখবেন একদিন ও লাপ্লাস বা কশির মতো নাম করবে। ও আমার থেকে যত শিখেছে, আমি ওর থেকে তার চেয়ে কম শিখিনি।’ উপেন্দ্রনাথ বললেন। পিয়ের লাপ্লাস বা অগুস্তো লুই কশি সর্বকালের সেরা গণিতজ্ঞদের মধ্যে পড়েন, তাঁদের সঙ্গে তুলনা!

       ‘ও, তাই বলুন। সত্যেন তো শুধু অঙ্ক নয়, সব বিষয়েই দারুণ। এইটুকু বয়সে টেনিসনের কবিতা জানে, রবীন্দ্রনাথের কবিতা বলতে পারে, আবার কালিদাসের মেঘদূত একেবারে কণ্ঠস্থ। ওর স্মৃতিশক্তির কোনো তুলনা নেই।’ বললেন বাংলার শিক্ষক শরৎচন্দ্র শাস্ত্রী।

সে যুগের হিন্দু স্কুল

       সত্যেন কে তোমাদের নিশ্চয় বলে দিতে হবে না। ছোট্ট সত্যেন বড় হয়ে হবেন পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। আজ তাঁর ছোটবেলার আর ছাত্রজীবনের কিছু গল্প তোমাদের শোনাব।




সত্যেন্দ্রনাথের জন্মস্থান 

       হিন্দু স্কুলের কথা দিয়ে শুরু করেছি, কিন্তু সেখানে অল্পদিনই পড়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি ছিল নদীয়ার বড়জাগুলিয়া গ্রামে, তবে তাঁর জন্ম কলকাতার গোয়াবাগানে ২২ নম্বর ঈশ্বর মিল লেনের বাড়িতে। বাবা সুরেন্দ্রনাথ ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়েতে আসাম ও উত্তরবঙ্গে হিসাবরক্ষকের চাকরি করতেন। সত্যেন্দ্রনাথের জন্মের পরে ঈশ্বর মিল লেনে বেশিদিন ছিলেন না বসু পরিবার। ভাড়াটেদের সঙ্গে গণ্ডগোল হওয়াতে তাঁরা চলে যান কলকাতারই জোড়াবাগানের এক ভাড়া বাড়িতে। সত্যেন্দ্রনাথ প্রথমে পড়া শুরু করেন সেই বাড়ির কাছে নর্মাল স্কুলে। সেই স্কুলের ছাত্র আর এক জন বিখ্যাত মানুষের নাম জানো তো? রবীন্দ্রনাথ বছর দুয়েক ঐ স্কুলে প

ড়েছিলেন।  সত্যেন্দ্রনাথরা আবার যখন ঈশ্বর মিল লেনের বাড়িতে ফিরে আসে, তখন তিনি ভর্তি হলেন কাছের নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে।

        ‘হ্যাঁরে, বইয়ের পাতাগুলো ছিঁড়ে ফেললি যে!’ মা ব্যস্ত হয়ে বললেন।

       ‘পড়া তো হয়ে গেছে তো, বুঝে গেছি তো।’

       মা বড় বড় চোখ করে ছেলের দিকে তাকালেন। অসাধারণ স্মৃতিধর সত্যেন, একবার যা পড়েন, আর ভোলেন না। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে কাগজ ফেলে দেওয়ার এই অভ্যাস ছেলের সারা জীবন বজায় ছিল। সত্যেন্দ্রনাথ তাঁর যুগান্তকারী গবেষণাটা আইনস্টাইনকে পাঠিয়েছিলেন, তার কপি রাখার প্রয়োজন মনে করেননি। আইনস্টাইন সেটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে ছাপিয়েছিলেন, এই সময় কিছুটা পালটে দিয়েছিলেন।  আসলটিতে কি ছিল জানার উপায় নেই। আইনস্টাইনকে পাঠানো আরো একটি গবেষণাপত্রের কোনো হদিস নেই। অনেক বছর পরে আইনস্টাইনের জন্য লিখলেন একটি দীর্ঘ  প্রবন্ধ। এমন সময় এলো আইনস্টাইনের মৃত্যুসংবাদ, শোকে সেটা ছিঁড়ে ফেলে দিলেন।

       তবে ভালো ছেলে বললে যে রকম পড়ার বই মুখে করা ছেলের কথা মনে আসে, সত্যেন মোটেই সেরকম নন। বাইরের বইতে বেশি আগ্রহ, গল্প উপন্যাস কাব্য ইতিহাস – সবেতেই তাঁর উৎসাহ। ফরাসি ভাষা শিখছেন। খেলাধুলোও করেন -- ক্যারাম, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, এ সব খেলেন বাঁহাতে; কিন্তু লেখার বেলায় ডানহাতি। তবে খেলাধুলোতে উৎসাহ আস্তে আস্তে কমে আসে, কারণ ছোটবেলা থেকেই চোখে উঠেছে হাই পাওয়ারের চশমা। অবশ্য তাই নিয়েই পরে কলেজে ফুটবল খেলা শুরু করেছিলেন। খেলতেন গোলরক্ষক, কিন্তু সে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। গান, ছবি আঁকা – কোন বিষয়ে তাঁর আগ্রহ নেই?

       ‘বুঝলে, বোদে তো এবার ফার্স্ট ক্লাসে উঠবে। ভাবছি ওকে হিন্দু স্কুলে দেব। কলকাতার সবচেয়ে ভালো ছেলেরা ঐ স্কুলে পড়ে। এখানে ও ঠিক কম্পিটিশন পাচ্ছে না।’

       মা আমোদিনী একমত, ‘ঠিক, পড়তে আমার ছেলেটা বড্ড ভালোবাসে। মনে আছে, ছোটবেলায়  দুষ্টুমি করলেই  তুমি ওরা হাতে চক ধরিয়ে মেঝেতে অঙ্ক কষতে দিতে। ব্যাস, সব দুষ্টুমি নিমেষে উধাও।’

       তাই হল। প্রধান শিক্ষক রসময় মিত্র পরীক্ষা করে সত্যেনকে ভর্তি করে নিলেন, এখন আমরা যাকে বলি ক্লাস টেন সেই ক্লাসে। ১৯০৮ সালে তাঁর স্কুলের শেষ পরীক্ষা এনট্রান্স দেওয়ার কথা। কিন্তু পরীক্ষার দুদিন আগে চিকেন পক্স হওয়ার ফলে তাঁর সে বছর আর পরীক্ষায় বসা হয়নি।

       পরের বছর অঙ্কে যে একশো পাবেন সে নিয়ে সত্যেন্দ্রনাথ বা তাঁর মাস্টারমশাই কারোর কোনো সন্দেহ নেই। পরীক্ষার খাতা জমা দিয়ে ছাত্র এলেন স্কুলে, উপেন্দ্রনাথ প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে মুখে মুখে অঙ্কগুলো কষে উত্তর মেলাতে শুরু করলেন।  হঠাৎ দেখা গেল একটা অঙ্কে সত্যেন্দ্রনাথ একশো সতেরকে মৌলিক সংখ্যা ধরেছেন। উপেন্দ্রনাথ হতাশ গলায় বললেন, ‘ন তেরয় একশ সতের হয় তো?’ ছাত্র শিক্ষক দুজনের মুখেই অন্ধকার নেমে এলো। অঙ্কে সেবার একশো পাননি, তবে পরীক্ষায় হলেন পঞ্চম। ওই একবারই সত্যেন্দ্রনাথ পরীক্ষাতে প্রথম হননি।

       বাবা বলেছিলেন, ‘ইতিহাস ভূগোলে এত নম্বর পেয়েছিস, তুই আর্টস নিয়ে পড়।’

       ‘না বাবা, আমি ইন্টারমিডিয়েটে সায়েন্স পড়ব। অঙ্কে একশো পাইনি তো কী হয়েছে, অঙ্ক আমার ভালো লাগে। গত এক বছরে ইন্টারমিডিয়েটের অঙ্ক অনেকটা এগিয়ে রেখেছি।’ বসন্তের জন্য যে এক বছর বসেছিলেন, সেই সময়টাকে নষ্ট করেননি সত্যেন্দ্রনাথ। পঞ্চাশ বছর পরে এক ছাত্র লন্ডন থেকে ফিরে এসে তাঁর ছেলের কাছে গবেষণা করছেন শুনে সুরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘সারা পৃথিবী ঘুরে তুমি অঙ্ক শেখানোর আর কাউকে খুঁজে পেলে না, শেষে বোদের কাছে এলে?’

       কোথায় পড়বেন তা নিয়ে কোনো আলোচনার দরকার হয়নি। হিন্দু স্কুল থেকে রাস্তা পেরিয়েই প্রেসিডেন্সি কলেজ তখন এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সেখানে পড়াচ্ছেন প্রফুল্লচন্দ্র, জগদীশচন্দ্রের মতো শিক্ষকেরা। দুই বছরের ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্সে ভর্তি হলেন সত্যেন্দ্রনাথ, এখন আমরা তাকে হায়ার সেকেন্ডারি বলি। গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়নের বাইরে চতুর্থ বিষয় বেছেছেন ফিজিওলজি।

       আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র ক্লাসে ঢুকলেন, বেয়ারা সীতারাম একটা টুল নিয়ে এসে টেবিলের পাশে রাখল। ছেলেরা ভাবছে কী ব্যাপার। ‘সত্যেন, উঠে আয়। আজ থেকে আমার ক্লাসে তুই এখানে বসবি।’ সত্যেন্দ্রনাথ মোটেই খুব বাধ্য ছাত্র ছিলেন না, নানা প্রশ্ন করে শিক্ষকদের ব্যতিব্যস্ত করে তুলতেন। প্রফুল্লচন্দ্রের মনে হয়েছে আশপাশের ছেলেদের মনোযোগে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন সত্যেন্দ্রনাথ, তাঁকে সামলানোর এই কায়দা তিনি বার করেছেন। সত্যেন্দ্রনাথের সুবিধাই হল, চোখ খারাপ বলে গ্যালারি থেকে বোর্ড দেখতে অসুবিধা হচ্ছিল।

       কলেজের ইন্টারমিডিয়েট টেস্টে ইংরাজিতে একশোতে ষাট পেয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ।  অধ্যাপক হিউ মেলভিল পার্সিভাল খাতা দেখেছেন, আরও দশ যোগ করে নাম্বার করলেন সত্তর, খাতায় লিখে দিলেন, ‘This boy has originality’। ভারত থেকে চলে যাওয়ার সময় তিনি সত্যেনকে ডেকে পাঠিয়ে আশীর্বাদ করলেন। ছাত্র চলে গেলে সহকর্মী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষকে বলেছিলেন, ‘আপনারা ছেলেটার দিকে খেয়াল রাখবেন। ওর চোখ দু’টো বলছে ও ভবিষ্যতের দিকপাল।’

       ১৯১১ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাতে আর ভুল হল না, সবার উপরে নাম সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ফোর্থ সাবজেক্ট ফিজিওলজিতে পেয়েছেন একশোয় একশো। এবার গণিতে অনার্স পড়ার পালা। ঢাকা থেকে এসে প্রেসিডেন্সির গণিত বিভাগে ভর্তি হলেন মেঘনাদ সাহা, তিনি হয়েছিলেন তৃতীয়।

       ১৯১৩ সালে বিএসসি পরীক্ষা। অনার্সের প্রথম দিন ভালো ভাবেই কেটে গেল। সেকেন্ড পেপার পরীক্ষার দিন বিকালে হেদুয়ার পুকুরের ধারে বন্ধুরা সত্যেনের জন্য অপেক্ষা করছেন। সন্ধে হয়ে গেছে,  গ্যাসের আলো জ্বলে গেছে, তাহলে কি সত্যেন সোজা বাড়ি চলে গেল? এমন সময় সত্যেন্দ্রনাথ এলে, বিধ্বস্ত চেহারা। করুণ গলায় বললেন, ‘আমি সব কটা অঙ্ক কষতে পারিনি। এই প্রথম পরীক্ষার হল থেকে অঙ্ক ছেড়ে বেরিয়ে এসেছি।’ পরে জানা গেল কেমব্রিজের প্রথম ভারতীয় সিনিয়র র‍্যাংলার রঘুনাথ পরাঞ্জপে প্রশ্নপত্র তৈরি করেছেন। এমন শক্ত প্রশ্ন করেছেন যে সত্যেন্দ্রনাথও আটাত্তর নম্বরের বেশি উত্তর করতে পারেননি।

       যা করেছিলেন, তাই যথেষ্ট। রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল সবার উপরে সত্যেন্দ্রনাথের নাম। দ্বিতীয় মেঘনাদ। দু’জনেই মিশ্র গণিত নিয়ে এমএসসি পড়া শুরু করলেন।

প্রেসিডেন্সি কলেজ

       তখন কলকাতাতে এমএসসি পড়ানো হত শুধুই প্রেসিডেন্সি কলেজে। কাজেই কলেজ পালটালো না। কাদের কাছে অঙ্ক শিখেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বা মেঘনাদের মতো ভবিষ্যতের নক্ষত্ররা? প্রফেসর দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক ১৯১৯ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিভাগের সভাপতি হয়েছিলেন। আরেক অধ্যাপক কাথবার্ট কালিস ছিলেন ক্যালকাটা ম্যাথামেটিক্যাল সোসাইটির সহ-সভাপতি, পরে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছিলেন।

       ‘স্যার, এই অঙ্কটা আটকে গেছে,’ ছাত্র বলল।

       আমার এখন সময় নেই। শনিবার সত্যেনকে বলিস’। বললেন শ্যামাদাস মুখোপাধ্যায়, প্রেসিডেন্সির আর এক বিখ্যাত অধ্যাপক। মিহিজামে তাঁর একটি বাড়ি ছিল, দীর্ঘ ছুটির সময় সেখানে তিনি ছাত্রদের নিয়ে যেতেন তাদের অঙ্ক আটকে গেলে কখনো কখনো বলতেন শনিবার সত্যেন্দ্রনাথ এসে সমাধান করে দেবেন। অনেক শনিবার সেখানে যেতেন সত্যেন্দ্রনাথ, সেকালের রেওয়াজমতো হাতে থাকত একটা ছড়ি। নদীর ধারে ঘুরতে ঘুরতে বালির উপরে ছড়ি দিয়ে অঙ্কগুলো কষে দিতেন তিনি।

        কলেজের জীবন শেষ হয়ে আসে। ১৯১৫ সালে এমএসসি পরীক্ষা হয়ে গেছে। বন্ধু নীরেন্দ্রনাথ রায় প্রেসিডেন্সি কলেজের কমন রুমে বসে আছেন, হঠাৎ দেখেন সত্যেন। ‘কী ব্যাপার দাদা? তুমি এখানে কী কাজে?’

       ‘রেজাল্ট বেরিয়েছে। ইউনিভার্সিটি অফিস থেকে মার্কশীট নিয়ে আসি।’

       সেই মার্কশীট এলো। আটটি পেপারের একটিতে পুরো নম্বর,  দুটিতে আটানব্বই, সবচেয়ে কম নম্বর হল চুরাশি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এমন নম্বর ওঠেনি। দ্বিতীয় হয়েছেন আবারও মেঘনাদ। 

এই ছবি ১৯৩০ সালে তোলা। বসে বাঁদিকে থেকে মেঘনাদ সাহা, জগদীশচন্দ্র বসু ও জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ। দাঁড়িয়ে, বাঁদিক থেকে স্নেহময় দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ, দেবেন্দ্রমোহন বসু, নিখিলরঞ্জন সেন, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ও নগেন্দ্রচন্দ্র নাগ। জগদীশচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে সত্যেন্দ্রনাথের শিক্ষক, দেবেন্দ্রমোহন বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী, নগেন্দ্রচন্দ্র নাগ বসু বিজ্ঞান মন্দিরের সহকারী অধিকর্তা। বাকিরা সবাই সত্যেন্দ্রনাথের প্রেসিডেন্সি কলেজের সহপাঠী।  

       ভালো ছেলে বলে পরিচিত হতে পারেন, কিন্তু তা বলে মুখ বুজে অন্যায় মেনে নেন না সত্যেন। ‘বন্ধুগণ, আপনারা শুনেছেন ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর হ্যারিসন সেকেন্ড ইয়ারের এক ছাত্রকে ক্লাসের মধ্যে বাঁদর বলেছেন। আমরা কিছুতেই এই অপমান মেনে নেব না। প্রফেসর হ্যারিসনকে ক্ষমা চাইতে হবে।’ সত্যেন্দ্রনাথ ছাত্রদের জমায়েতে বক্তৃতা দিচ্ছেন। কলেজ উত্তাল, সত্যেন্দ্রনাথের মতো ছেলেকে নেতা পেয়ে ছাত্ররাও সাহসী। সারা দিন প্রতিবাদের পরে হ্যারিসন ক্ষমা চাইলেন। সেবারের মতো সমস্যা মিটে গেল। কিন্তু প্রিন্সিপাল হেনরি জেমস সাহেব এই ধরনের বিক্ষোভ যাতে আর না ঘটে তার জন্য কয়েকটি নিয়ম চালু করেছিলেন। সেটা ছিল ১৯১৪ সাল। দু’বছর পরে সেই সমস্ত নিয়মের বেড়াজালে পড়ে ছাত্রদের বিক্ষোভ বোমার মতো ফেটে পড়েছিল। সেই গল্প তোমরা অনেকে জানো। প্রফেসর ওটেন ক্লাসে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে  জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য করেছিলেন। প্রতিবাদের অন্য পথ না পেয়ে কয়েকজন ছাত্র তাঁকে আক্রমণ করেছিল। ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, কিন্তু তিনি আক্রমণকারীদের নাম বলতে অস্বীকার করেছিলেন। তাঁকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল।

       বালক সত্যেনের মনে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন প্রভাব ফেলেছিল।  রাখীবন্ধনের গান গেয়ে রাস্তায় ঘুরে বেরিয়েছেন, সাহেব দেখলে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে বন্দেমাতরম আওয়াজ তুলেছেন। কলেজে পড়ার সময় সত্যেন্দ্রনাথ মানিকতলাতে শ্রমজীবীদের জন্য এক অবৈতনিক নাইট স্কুলে পড়াতেন। স্কুলটি চালাত মূলত বিপ্লবীরা। অরবিন্দের ভাই বারিদবরণ ঘোষের সঙ্গে স্কুলের যোগ ছিল। স্কুলের প্রধান ছিলেন সত্যেনদের প্রফেসর দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক। এছাড়া অনুশীলন সমিতি গোয়াবাগানে বয়েজ ওন বলে এক লাইব্রেরি শুরু করেছিলো, সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম থেকেই তার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছিল।

অনেক বছর পরে তাঁকে এক ছাত্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার সমসাময়িক এই সব শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেকেই যে পরবর্তী জীবনে দিকপাল বিজ্ঞানী হয়েছেন, বিজ্ঞানের আকাশে একসঙ্গে এতগুলি জ্যোতিষ্কের আবির্ভাব আমাদের দেশের ইতিহাসে আর নেই বলেই চলে। আপনাদের কৃতিত্বের পিছনে অনুপ্রেরণা কী ছিল?’

       ‘দ্যাখ, আমাদের মনে হত সাহেবরা যা পারে, আমরা তা পারবো না কেন? বিজ্ঞানে আমরা যে সাহেবদের চেয়ে কম নই, তা দেখিয়ে দিতে হবে।’

সত্যিই দেখিয়ে দিয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ, কিন্তু সে গল্প অন্যদিন হবে। শুধু মনে রেখো, দেশকে ভালোবাসার অনেক পথ আছে। সত্যেন মেঘনাদরা বেছে নিয়েছিলেন বিজ্ঞান গবেষণার পথ।

 

প্রকাশঃ খুশির হাওয়া, প্রথম নববর্ষ সংখ্যা ১৪২৮ (২০২১)

 

যারা আরো বেশি জানতে চাও, তাদের জন্য এই লিঙ্কগুলোঃ

কলকাতাতে ছাত্র-গবেষক সত্যেন্দ্রনাথঃ কিছু প্রাসঙ্গিক কথা 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজ, সূচনা পর্ব  

স্বর্ণযুগের কাহিনিঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগ   

দুই বন্ধুর গল্পঃ সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ  

আলোর দিশারীঃ সত্যেন্দ্রনাথ  


এখানে একটা ইউটিউব ভিডিওতে আছে সত্যেন্দ্রনাথকে নিয়ে আলোচনা। আছেন তাঁর ছাত্র পার্থ ঘোষ। 

আলোচনাতে সত্যেন্দ্রনাথ  


Sunday 16 May 2021

ভ্যাক্সিনমঙ্গল

 

ভ্যাক্সিনমঙ্গল

কোভ্যাক্সিন প্রাপক ছাড়িল নিশ্বাস,

'কোভিশিল্ডের পরে আমার বিশ্বাস।'

কোভিশিল্ড গ্রাহক বলে, 'কিছু জানিনে,

আমার ভরসা ছিল কোভ্যাক্সিনে।'

হেনকালে কোথা হতে রাশিয়ার টিকা

বাজার উজল করে দিল সে যে দেখা

টিকা যারা নিয়েছিল মে মাসের আগে,

স্পুটনিক দেখে তারা গজরায় রাগে।

সেকরার ঠুকঠাক ভ্যাক্সিন যত,

মার্কেটে নাহি কেহ জনসন মতো

এক ডোজে করোনারে করে কুপোকাত,

J & J সে কি করে বাজিমাত?

ধরাধাম মাঝে টিকা আছে কত শত,

গ্যাপ পাল্টায়ে না কোভিশিল্ড মতো

এই শুনি ফোর উইক্স, এই শুনি ছয়,

আট বারো ষোল কুড়ি যা খুশি তা হয়

মার্কিন মডার্না কি ফাইজার টিকা

বাঙালির কপালে নাই তারা লিখা

ভ্যাক্সিনমঙ্গল কথা অমৃতের পারা,

ফেসবুকে অকবি সে লিখে চলে ছড়া।


Sunday 9 May 2021

গ্রন্থবীক্ষণঃ অক্ষয়কুমার দত্ত: বিজ্ঞান ভাবনার পথিকৃৎ’

 

    বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ইতিহাসে যে নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকা উচিত ছিল, দুঃখের কথা আমরা তাঁকে ভুলতে বসেছি। ২০২০ সালে অক্ষয়কুমার দত্তের  জন্মের দুশো বছর পূর্ণ হল, হয়তো অতিমারী না থাকলে তাঁর অবদান নিয়ে এই উপলক্ষে আরও আলোচনা হত। তাঁকে নিয়ে লেখা সাম্প্রতিক বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আশীষ লাহিড়ীর ‘অক্ষয়কুমার দত্ত আঁধার রাতের একলা পথিক’ এবং মুহম্মদ সাইফুল ইসলামের ‘অক্ষয়কুমার দত্ত ও উনিশ শতকের বাঙলা’। গত বছর কোরক সাহিত্য পত্রিকা অক্ষয়কুমারকে নিয়ে একটি সংখ্যা এবং জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকা বিদ্যাসাগর ও অক্ষয়কুমারকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সেই তালিকাতে আর এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন ডা. শঙ্করকুমার নাথের বই ‘অক্ষয়কুমার দত্ত: বিজ্ঞান ভাবনার পথিকৃৎ’।

       আলোচ্য বইটির নাম খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান রচনাতে অক্ষয়কুমার নিঃসন্দেহে পথিকৃৎ, আগে দু একটি বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশিত হলেও ধারাবাহিকতা ও মানের দিকে থেকে তাদের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের লেখার তুলনাই চলে না। কিন্তু শুধুমাত্র সে কথা বললে উহ্য থেকে যায় তাঁর বিজ্ঞানমনস্কতা ও দর্শনচিন্তার কথা। বন্ধু ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনার আশ্চর্য মিল। বিদ্যাসাগর এ বিষয়ে তাঁর মত আলোচনাতে খুব একটা উৎসাহী ছিলেন না, তাঁর সেই সময়ও ছিল না। বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা এবং বাংলাদেশে বিজ্ঞানের দর্শন প্রচারকে ব্রত হিসাবে নিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার।

       বইটির পিছনে পরিশ্রম ও গবেষণার ছাপ সুস্পষ্ট। সমকালের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বিশ্লেষণ না করলে অক্ষয়কুমারের সম্যক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়; আবার পরবর্তীকালকে তিনি কেমনভাবে প্রভাবিত করেছেন, তা জানাটাও জরুরি। স্বল্পায়ু বিদ্যাদর্শন পত্রিকার প্রকাশ থেকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনা হয়ে ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ রচনা পর্যন্ত অক্ষয়কুমারের বিজ্ঞানভাবনা এক জায়গায় থেমে থাকেনি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিকশিত হয়েছে। অক্ষয়কুমারের মূল রচনা, সমসাময়িক পত্রপত্রিকাতে তাঁর সম্পর্কে আলোচনা, সমকালের জীবনীকার ও পরবর্তীকালের গবেষকদের রচনা থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর অবদানকে বিশ্লেষণ করেছেন লেখক। এসেছে বিদেশী বই আত্মস্থ করে দেশের মানুষের উপযোগী করে লেখার কথা, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে বিরোধের প্রসঙ্গ এবং জীবনের শেষ ক’বছর প্রচণ্ড অসুস্থতার মধ্যেও বিজ্ঞানচর্চার কথা। পুরানো সংবাদপত্র ও বইয়ের পৃষ্ঠার ছবিগুলিও আগ্রহ জাগায়।

       বর্তমানের অপবিজ্ঞান, কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে অক্ষয়কুমারের জীবন আলোকবর্তিকা হতে পারে। সেই সম্পর্কে প্রথম পাঠের অত্যন্ত উপযোগী এই বই।

 

                                                              গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

(প্রকাশঃ গণশক্তি, ৮ মে ২০২১)