Wednesday 15 September 2021

শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ স্টিভেন ভাইনবার্গ

শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ স্টিভেন ভাইনবার্গ

( ৩ মে, ১৯৩৩ - ২৩ জুলাই, ২০২১)


আমরা যখন কলেজের ছাত্র ছিলাম, তখন যে ক'জন পদার্থবিজ্ঞানী আমাদের কাছে আইডল ছিলেন, কালের নিয়মে তাঁরা অনেকেই প্রয়াত হয়েছেন। একে একে চলে গেছেন রিচার্ড ফেইনম্যান, আবদুস সালাম, হান্স বেথে, স্টিফেন হকিং, মারে গেলম্যান, এরকম আরো অনেকে। ২৩ জুলাই ২০২১ তারিখে সেই তালিকায় সর্বশেষ নাম যোগ হল স্টিভেন ভাইনবার্গের।

ভাইনবার্গ, সালাম ও শেলডন গ্ল্যাশো ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। ভাইনবার্গ আমাদের কালের পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে একেবারে প্রথম সারিতে জায়গা করে নেবেন। শুনেছি একসময় কোনো গবেষণাপত্রে কৃতজ্ঞতা স্বীকার অংশে সেই বিষয়ে ভাইনবার্গের সঙ্গে আলোচনা হয়েছিল বললেই তা ছিল অবিলম্বে প্রকাশের চাবিকাঠি। শেষে এমন হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে ভাইনবার্গকে বলতে হয়েছিল যে সেই কথা লেখার আগে যেন তাঁর থেকে অনুমতি নেওয়া হয়। পাশাপাশি বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের ক্ষেত্রে তাঁর ‘দি ফার্স্ট থ্রি মিনিট্‌স’ বইটির তুলনা চলতে পারে শুধুমাত্র স্টিফেন হকিঙের 'এ ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইম’-এর। সেই বই জীবনের ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশ করে দিয়েছিল এমন বিজ্ঞানীর সংখ্যা কম নয়।

পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসকে আমরা এক অর্থে ইউনিফিকেশনের অর্থাৎ একীকরণের ইতিহাস বলতে পারি। নিউটন দেখিয়েছিলেন যে পৃথিবীর টানে কোনো বস্তুর পতন এবং গ্রহনক্ষত্রের চলাফেরা আসলে একই মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রকাশ। মাইকেল ফ্যারাডে ও সমসাময়িক আরো অনেকের গবেষণা থেকে প্রমাণ হয় যে তড়িৎ ও চুম্বক আসলে একই বল তড়িৎচৌম্বক বলের দুই রূপ। জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল দেখালেন আলোও এক প্রকার তড়িৎচৌম্বক তরঙ্গ অর্থাৎ আলোকবিজ্ঞান এবং তড়িৎচৌম্বক বিদ্যা আলাদা কিছু নয়। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দুই দশকে আইনস্টাইন তাঁর দুই আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্যে দ্বিতীয়টি অর্থাৎ সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব হল মাধ্যাকর্ষণেরই উন্নততর রূপ। সেই সময় আমরা দুটি মৌলিক বলের কথা জানতাম, মাধ্যাকর্ষণ ও তড়িৎচৌম্বক বল। জীবনের শেষ চার দশক আইনস্টাইন এই দুটিকে একীকরণের চেষ্টা করে গিয়েছিলেন।

শুরু থেকেই ব্যার্থতাই ছিল আইনস্টাইনের সেই চেষ্টার ভবিতব্য। তার কারণ এই নয় যে সেই দুটি বলের একীকরণ সম্ভব নয়; তা সম্ভব কিনা আমরা আজও জানি না। কিন্তু আসলে মৌলিক বলের সংখ্যা দুই নয়। আমরা এখন আরো দুটি মৌলিক বলের কথা জনেছি, স্ট্রং ফোর্স বা পীন বল এবং উইক ফোর্স বা ক্ষীণ বল। নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন নিউট্রনরা যে বলে বাধা থাকে, তা হল পীন বল। অন্যদিকে বিটা তেজস্ক্রিয়া বা কোনো কোনো মৌলিক কণার ক্ষয়ের জন্য দায়ী হল ক্ষীণ বল। গত ছয় দশকে এই দুটি এবং তড়িৎচৌম্বক বলকে একীকরণের কাজে কিছু দূর এগোনো গেছে।

১৮৭৯ সালে ম্যাক্সওয়েল প্রয়াত হয়েছিলেন, তার ঠিক একশ বছর পরে বিংশ শতাব্দীর প্রথম সার্থক একীকরণের স্বীকৃতি হিসাবে ভাইনবার্গদের নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল। ভাইনবার্গের বৈজ্ঞানিক কর্মকাণ্ড নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা এই লেখার পরিসরে সম্ভব নয়। সংক্ষেপে বলা যায় যে তাঁর এবং গ্ল্যাশো ও সালামের গবেষণা থেকে বোঝা যায় যে ক্ষীণ বল ও তড়িৎচৌম্বক বল হল একই বলের প্রকাশ। এই অনুমান করাটাও মোটেই সহজ ছিল না, কারণ নামেই প্রকাশ ক্ষীণ বল হল অত্যন্ত ক্ষীণ, তড়িৎচৌম্বক বলের থেকে তা কোটি কোটি গুণ দুর্বল। বিশেষ করে ভাইনবার্গ দেখিয়েছিলেন যে ব্রোকেন সিমেট্রি বা ভগ্ন প্রতিসাম্য এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়।

প্রতিসাম্য আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়, যদিও তা বুঝতে আমাদের সময় লেগেছে। নিউটনের বলবিদ্যার সূত্র গ্যালিলিও বর্ণিত প্রতিসাম্য মেনে চলে। ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ কিন্তু নিউটনের সূত্রের সঙ্গে মেলে না। সেই সমীকরণ যে প্রতিসাম্য মেনে চলে তা হল লরেঞ্জ প্রতিসাম্য, বিজ্ঞানী হেনড্রিক লরেঞ্জের নামানুসারে তার নাম। বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদে আইনস্টাইন দেখান যে নিউটনের বলবিদ্যার সূত্রগুলি সম্পূর্ণ সঠিক নয়, কারণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সঙ্গে খাপ খায় প্রকৃতপক্ষে লরেঞ্জের প্রতিসাম্য। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকে এমি নোয়েথার প্রতিসাম্য সম্পর্কে এক গুরুত্বপূর্ণ উপপাদ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। একটা খুব সাধারণ উদাহরণ নেয়া যাক। বিজ্ঞানের সূত্র পরীক্ষাটা কোথায় করা হচ্ছে তার উপর নির্ভর করে না, একে বলে সরণের প্রতিসাম্য। নোয়েথারের উপপাদ্য প্রয়োগ করে দেখানো যায় যে কোনো সিস্টেম বা তন্ত্রে এই প্রতিসাম্য থাকলে তার ভরবেগের মোট পরিমাণ ধ্রুবক। তার পর থেকেই বিজ্ঞানীরা প্রতিসাম্যের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন। কণা পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রতিসাম্যের গুরুত্ব বিরাট। ভাইনবার্গ কিন্তু একটু অন্য পথ নিয়েছিলেন। তিনি দেখালেন যে তড়িৎচৌম্বক বল ও ক্ষীণ বল আসলে একই বল, কিন্তু তাদের মধ্যে এক প্রতিসাম্য ভগ্ন হওয়ার ফলে তারা পৃথক বল হিসাবে আমাদের কাছে প্রকাশিত হয়। ভাইনবার্গদের তত্ত্ব থেকে তিনটি নতুন বোসন কণার কথা আসে। ১৯৮৩ সালে সার্নের কণাত্বরকের সাহায্যে সেগুলিকে খুঁজে পাওয়া যায়, সেজন্য তার পরের বছর কার্লো রুবিয়া এবং সাইমন ভ্যান ডার মির পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।

ভাইনবার্গ সারা জীবনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করেছিলেন, তা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। তাঁর জন্ম ১৯৩৩ সালের ৩ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। তাঁর বাবা ও মা ছিলেন ইহুদি, ইউরোপ থেকে আমেরিকাতে তাঁরা চলে এসেছিলেন। পড়াশোনা নিউইয়র্কের ব্রন্‌ক্স হাই স্কুল ফর সায়েন্সে, সেখানে তাঁর এক ক্লাসের বন্ধু ছিলেন শেলডন গ্ল্যাশো। তাঁরা স্কুলের কল্পবিজ্ঞান ক্লাবের সদস্য ছিলেন, আবার স্কুল ছাড়ার তিন দশক পরে নোবেল পুরস্কার নিতেও একসঙ্গেই গিয়েছিলেন। কোনো হাই স্কুলের ক্ষেত্রে একই ক্লাসে দুই নোবেলজয়ীর উদাহরণ আর নেই, যদিও গ্ল্যাশোর স্মৃতিচারণে সেখানকার বিজ্ঞান শিক্ষা সম্পর্কে খুব একটা প্রশংসা শোনা যায় না। এরপর ভাইনবার্গ কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। একবছর ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে কাটানোর পর তিনি আবার দেশে ফিরে যান। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যাম ট্রিম্যানের সঙ্গে গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট করেছিলেন।

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে কিছুদিন গবেষণা করার পর তিনি বার্কলেতে চাকরি পেয়েছিলেন। এরপর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি, সংক্ষেপে এমআইটি। ১৯৮২ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাস অ্যাট অস্টিনে যোগ দেন, বাকি জীবন তিনি এখানেই কাটিয়েছিলেন।

সাধারণত খুব কম সংখ্যক শীর্ষস্থানীয় বিজ্ঞানীই তাঁদের গবেষণা সাধারণ মানুষের জন্য লেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ভাইনবার্গ সেখানে পৃথক। তাঁর ‘দি ফার্স্ট থ্রি মিনিট্‌স’ এর কথা আগে বলেছি, এই বইতে তিনি বিগ ব্যাং-ও তার পরে মৌলিক পদার্থের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। ‘ড্রিমস অফ এ ফাইনাল থিওরি’-তে স্ট্রিং থিওরি নিয়ে আলোচনা খুঁজে পাওয়া যাবে; স্ট্রিং থিওরি চারটি মৌলিক বলকে একীকরণের চেষ্টা করে চলেছে।

শুধু আধুনিক বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাস নিয়েও ভাইনবার্গ আগ্রহী; সেই বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত বই ‘টু আন্ডারস্ট্যান্ড দি ওয়ার্ল্ড’। কখনো কৌতুক, কখনও বিদ্রুপ মেশানো ভাইনবার্গের লেখার ভঙ্গিটি ভারী চমৎকার। এই বই অবশ্য ঐতিহাসিকদের খুব একটা পছন্দ হয় নি। সোজা কথা বলতে অভ্যস্ত ভাইনবার্গ এই বইতে নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। প্লেটো তাঁর কাছে silly, অ্যারিস্টটল tedious; আধুনিক বিজ্ঞানের বিপ্লবের সঙ্গে যে দুই দার্শনিকদের নাম প্রথমেই আসে,সেই ফ্রান্সিস বেকন ও রেনে দেকার্তে তাঁর কাছে most overrated। প্রাচীন অন্ধকার যুগ থেকে আধুনিক আলোকময় যুগের দিকে প্রগতির সরলরৈখিক ইতিহাসকে বলা হয় হুইগ (Whig), কথাটা এক্ষেত্রে খুব সম্মানের নয়। আধুনিক ঐতিহাসিকরা কোনো যুগের ইতিহাসকে দেখতে চান সেই যুগের নিরিখে, আজকের বিচারে নয়। স্বাভাবিক ভাবেই হুইগ ইতিহাস তাঁদের পছন্দ নয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসের ক্ষেত্রে নিজেকে হুইগপন্থী ঘোষণা করতে ভাইনবার্গের কিন্তু কোনো দ্বিধা নেই। তার কারণ তিনি বিশ্বস করেন যে বিজ্ঞানে একটা value judgement বা মূল্য বিচার সম্ভব। সেই তত্ত্বই বেশি সঠিক যা প্রকৃতির বর্ণনা বা ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে বেশি সফল।

ভাইনবার্গ ছিলেন নাস্তিক, আরো সঠিকভাবে বললে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের তীব্র বিরোধী। তাঁর এক বিখ্যাত উক্তি, 'ধর্ম ছাড়াই ভালো মানুষরা ভালো এবং খারাপ মানুষরা খারাপ কাজ করে। কিন্তু ভালো মানুষদের দিয়ে খারাপ কাজ করাতে ধর্মকে প্রয়োজন।” তিনি দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করতেন যে অবিজ্ঞান এবং ধর্মের বিজ্ঞান বিরোধিতা প্রতিহত করতে বিজ্ঞানীদের আরো সক্রিয় হতে হবে। ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে গঠনমূলক আলোচনার জন্য আয়োজিত এক সম্মেলনে মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন এই দুয়ের মধ্যে আলোচনা হোক, কিন্তু গঠনমূলক আলোচনা সম্ভব নয়। তাঁর প্রয়াণে পদার্থবিজ্ঞানের এক যুগের অবসান ঘটল।


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

 

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, আগস্ট ২০২১ 

গুরুচণ্ডা৯-তে প্রকাশিত এই লেখাটাতে ভাইনবার্গের একটি বই "To Explain the World" নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।