Sunday 24 October 2021

 

বিষম চিন্তা

সুকুমার রায়

মাথায় কত প্রশ্ন আসে, দিচ্ছে না কেউ জবাব তার-

সবাই বলে, মিথ্যে বাজে বকিস নে আর খবরদার!

অমন ধারা ধমক দিলে কেমন করে শিখব সব?

বলবে সবাই মুখ্য ছেলে, বলবে আমায় “গো গর্দভ!”

কেউ কি জানে দিনের বেলায় কোথায় পালায় ঘুমের ঘোর?

বর্ষা হলেই ব্যাঙের গলায় কোথেকে হয় এমন জোর?

গাধার কেন শিং থাকে না, হাতির কেন পালক নেই?

গরম তোলে ফোড়ন দিলে লাফায় কেন তাধেই-ধেই?

সোডার বোতল খুললে কেন ফঁসফঁসিয়ে রাগ করে?

কেমন করে রাখবে টিকি মাথায় যাদের টাক পড়ে?

ভুত যদি না থাকবে তবে কোত্থেকে হয় ভূতের ভয়?

মাথায় যাদের গোল বেধেছে তাদের কেন “পাগোল” কয়?

কতই ভাবি এসব কথা, জবাব দেবার মানুষ কই?

বয়স হলে কেতাব খুলে জানতে পাব সমস্তই।

 

 

চিন্তামুক্তি

ছোট্টবেলার প্রশ্ন যত ছিল মাথার মধ্যে মোর,

কেতাবে নয়, গুগল করে পেয়েছি তার সদুত্তর।

দিনের বেলা ঘুমের ঘোর ঠাঁই করে নেয় দপ্তরে,

বড়বাবুর টেবিলে আর অফিসারের চেম্বারে।

বর্ষাকালে ব্যাঙগিন্নি বাড়িয়ে যে দেয় গলার জোর,

কারণ সুপুত্রটি তখন হয়েছে এক মস্ত চোর।

গাধা নিজেই ভাঙল শিং নিতে বাছুর ছদ্মবেশ,

গরু বলে ডাকলে তাকে থাকে না তার খুশির শেষ।

ডেন্টিস্টের ভিজিট দিয়ে হয় যখনি খালি ট্যাঁক,

পালক বেচে কেনে হাতি টুথপেস্টের ট্রিপল প্যাক।

গরম তেলে পড়লে ফোড়ন নাচে কেন তাধেই-ধেই ,

গ্রীষ্মকালে খালি পায়ে উঠলে ছাদে টের পাবেই।

খুললে ছিপি সোডার বোতল একটু না হোক ফঁসফঁসায়,

কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে দিলে রাগ করা কি দোষের হয়?

টাক পড়ছে মাথায় না হয় টিকি নিয়ে চিন্তা কি,

পরচুলার দোকানেতেই মিলছে এখন পরটিকি।

ভূতপেত্নি নেই বলে কি থাকবে নাকো ভূতের ভয়?

হোমিওপ্যাথির ওষুধ তবে কেমন করে রোগ সারায়?

চৌকোনো বা তিনকোণা কি মাথার মাপ কভুও হয়?

গোল মাথাতো সবারই, তাই মাথার গোলে পাগোল কয়।

যার যেমনই প্রশ্ন আছে গুগল জানে জবাব তার,

এমন দিন কি কল্পনাতেও দেখেছিলেন সুকুমার?

                             গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 



Friday 8 October 2021

 


আমেরিকা আবিষ্কার ও জ্ঞানচর্চার শৃঙ্খলমুক্তি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


    আমাদের গল্পের প্রত্থমে আছেন তিনজন, যাঁদের মধ্যে দুজন হলেন গ্রিক দার্শনিক। প্রথমজন পশ্চিমী দর্শনের জন্মদাতা সক্রেটিস। দ্বিতীয়জন অ্যাারিস্টটল; মধ্যযুগে আরব ও ইউরোপের দার্শনিক বলতে অ্যারিস্টটলকেই বোঝানো হত। অ্যারিস্টটল প্লেটোর অ্যাকাডেমিতে শিক্ষালাভ করেছিলেন, প্লেটো সক্রেটিসের সাক্ষাৎ শিষ্য। হেমলক পানে সক্রেটিসের মৃত্যুর ইতিহাস আমরা সবাই জানি, তার পনের বছর পরে অ্যারিস্টটলের জন্ম। আজও সর্বকালের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতদের মধ্যে আমরা এই দু'জনকে রাখি। তৃতীয় জন পৃথিবীর নিঃসন্দেহে সব থেকে বিখ্যাত নাবিক, ক্রিস্টোফার কলম্বাস। তাঁর জন্ম অ্যারিস্টটলের মৃত্যুর প্রায় উনিশশো বছর পরে জেনোয়াতে, এখন তা ইতালির অন্তর্গত। কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলেন আমরা জানি, এও জানি যে তিনি কোনো নতুন মহাদেশ আবিষ্কারের জন্য যাত্রা করেননি। (অবশ্য আবিষ্কার বলতে এখানে প্রাচীন ও মধ্যযুগের ইউরোপের দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়েছে, মানুষ আমেরিকা ভূখণ্ডে পা দিয়েছে তার হাজার হাজার বছর আগে।) কলম্বাসের লক্ষ্য ছিল ইউরোপ থেকে পূর্ব দিকে না গিয়ে পশ্চিমদিকে যাত্রা করে এশিয়া মহাদেশে পোঁছানো। তিনি নিজের চেষ্টাতে পড়াশোনা শিখেছিলেন; জ্যোতির্বিদ্যা ভূগোল ইত্যাদি বিষয়ে তাঁর প্রচুর আগ্রহ ছিল। কিন্তু তাঁকে পণ্ডিতদের মধ্যে কেউ ধরবেন না। বস্তুত পক্ষে তাঁর পড়াশোনাতে অনেক ফাঁক থেকে যাওয়াটাই তাঁর পক্ষে শাপে বর হয়েছিল, কারণ ইউরোপ থেকে চিনের পূর্ব প্রান্তের দূরত্ব তিনি অনেক কম ধরেছিলেন। প্রকৃত দূরত্ব জানলে তিনি হয়তো যাত্রার সাহসই করতেন না, কারণ ষোড়শ শতাব্দীর নৌচালনবিদ্যার পক্ষে তা কোনোভাবেই অতিক্রম করা সম্ভব হত না। দুই মহাপণ্ডিতের সঙ্গে তাঁর কথা আসার কারণ কী?


 

ক্রিস্টোফার কলম্বাস

     কারণ হল আমরা সাধারণত সপ্তদশ শতাব্দীকে বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের সূচনাকাল বলে ধরে থাকি; সেই বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করেছিল কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার। সক্রেটিস ও অ্যারিস্টটলের দার্শনিক কীর্তি নিঃসন্দেহে মহান, কিন্তু তা আধুনিক বিজ্ঞানের উপযোগী ছিল না। এই প্রসঙ্গে সক্রেটিসের জীবনের এক বিখ্যাত কাহিনি স্মরণ করি। সক্রেটিস বিশ্বাস করতেন যে কাউকে কিছু শেখানো যায় না, সমস্ত জ্ঞানই প্রকৃতপক্ষে স্মৃতিলব্ধ, অর্থাৎ ভিতর থেকে আসে। তাঁর বন্ধু মেনো তাঁকে তা প্রমাণ করতে বলেন। সক্রেটিস এক অশিক্ষিত ক্রীতদাস বালককে ডেকে তাকে দিয়ে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জ্যামিতির একটি সমস্যার সমাধান করান। সক্রেটিস দাবী করেছিলেন যে এর থেকে বোঝা যায় যে ক্রীতদাসটির আগে থেকেই এই প্রশ্নের উত্তর জানত, তিনি এই উদাহরণকে আত্মার অমরত্ব এবং পুনর্জন্মের স্বপক্ষে ব্যবহার করেছিলেন। সক্রেটিস প্রতিষ্ঠিত ধারণাসমূহকে প্রশ্ন করার জন্য বিখ্যাত ছিলেন, কিন্তু এই ক্ষেত্রে অন্তত তাঁর প্রশ্নকে আজকের আদালতের ভাষায় বলব লিডিং কোশ্চেন অর্থাৎ উত্তর ধরিয়ে দেওয়া প্রশ্ন। কথোপকথনটি পড়লে দেখা যায় সক্রেটিস কেমনভাবে বালকটিকে সঠিক উত্তরের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।

সক্রেটিস

অ্যাারিস্টটল
    পুনর্জন্ম বা আত্মা বিষয়ে সক্রেটিসের চিন্তার আলোচনা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সক্রেটিসের আলোচিত পূর্বলব্ধ জ্ঞানকে আমরা অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞানে অন্য রূপে দেখতে পাই। অ্যারিস্টটল ছিলেন অসাধারণ ধীসম্পন্ন ব্যক্তি, পৃথিবীর ইতিহাস তাঁর তুলনা খুবই কম। দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, রাজনীতি, তর্কশাস্ত্র, নাট্যশাস্ত্র, জ্ঞানতত্ত্ব থেকে শুরু করে জীবনবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান ইত্যাদিতে তিনি যে অবদান রেখেছিলেন তা প্রায় দু’হাজার বছর ইউরোপের সভ্যতার দিক নির্দেশ করেছিল। অ্যরিস্টটলের দর্শন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা বর্তমান লেখকের ক্ষমতাতীত, এই লেখাতে আমরা শুধু বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তার প্রভাবের কথায় আসব। অ্যারিস্টটলের এক বিখ্যাত যুক্তিজালের কথা স্মরণ করি।

          মানুষ মরণশীল। 

    সক্রেটিস মানুষ। 

    অতএব সক্রেটিস মরণশীল।

    সাধারণ প্রতিজ্ঞা বা অনুমান (মানুষ মরণশীল) থেকে বিশেষ সিদ্ধান্তে (সক্রেটিস মরণশীল) আসার এই পদ্ধতিকে বলে অবরোহী যুক্তি। এই বিশেষ উদাহরণটি ঠিক হতে পারে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানে এই যুক্তিজাল অচল। অবরোহী যুক্তির মূল সমস্যা হল তার মূলের প্রতিজ্ঞা বা অনুমানগুলি অনেক অনেক সময়েই সক্রেটিসের পূর্বলব্ধ জ্ঞানের অনুরূপ। আধুনিক বিজ্ঞানে তার জায়গা নিয়েছে আরোহী যুক্তি যেখানে বিশেষ অভিজ্ঞতা অর্থাৎ পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে সাধারণ সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। অন্তর থেকে আসা পূর্বলব্ধ জ্ঞানের সেখানে স্থান নেই।

    কিন্তু মধ্যযুগে অ্যারিস্টটলের প্রভাব এমনই সর্বব্যাপী হয়েছিল যে পণ্ডিতরা নিজের চোখকে অ্যারিস্টটলের থেকে কম বিশ্বাস করতেন। গ্যালিলিও এক অ্যারিস্টটলপন্থী দার্শনিকের কথা বলেছেন। যত্ন করে শবব্যবচ্ছেদ করে তাঁকে দেখানো হল যে সমস্ত স্নায়ু গিয়ে মস্তিষ্কে শেষ হয়েছে। তিনি বললেন যে যদি অ্যারিস্টটল যদি না বলতেন যে স্নায়ুর উৎস হল হৃৎপিণ্ড, তাহলে তিনি নিশ্চয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতেন। পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে গালিলিওর অ্যারিস্টটলপন্থী সহকর্মীরা দূরবিনের সাক্ষ্য হয় অগ্রাহ্য করেন, নয়তো তার ভিতর দিয়ে তাকাতেই অস্বীকার করেন – কারণ ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে যা বলার অ্যারিস্টটল তো আগেই বলে দিয়ে গেছেন।

    মধ্যযুগে নতুন কোনো জ্ঞানের সম্ভাবনাকেই অস্বীকার করা হচ্ছিল। সমস্ত জ্ঞানই প্রাচীন পণ্ডিতদের লেখাতে পাওয়া যাবে, পণ্ডিতদের কাজ শুধু সেই লেখার ভাষ্য রচনা ও তার থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞানটিকে খুঁজে বার করা। পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষানিরীক্ষার কোনো স্থানই ছিল না। এমনকি ইউরোপের বিখ্যাত নবজাগরণের সূচনাপর্বেও কিন্তু প্রাচীন গ্রিক বিজ্ঞান ও দর্শনের প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। পুরাতনের প্রতি আনুগত্য এমনই দৃঢ় ছিল যে এমন কি কলম্বাস নিজে কখনো তিনি যে নতুন মহাদেশ আবিষ্কার করেছিলেন তা বিশ্বাস করেন নি।

    অ্যারিস্টটল কিন্তু বিশেষ করে জীবনবিজ্ঞানে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। ডিমের মধ্যে মুরগির বিকাশ দেখার জন্য একদিন অন্তর ডিম ভেঙে ভ্রূণ দেখার তাঁর পরীক্ষা খুবই বিখ্যাত। তিনিই প্রথম দেখেছিলেন ডলফিনরা স্তন্যপায়ী। অ্যারিস্টটলই প্রথম জীবজগৎকে শ্রেণিবিভক্ত করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু অ্যারিস্টটলের পদার্থবিজ্ঞান ছিল তাঁর অবরোহী দর্শনের অঙ্গ, সেখানে পরীক্ষানিরীক্ষা ছিল গৌণ।

    গ্রিক সভ্যতার পতনের পরে ইউরোপ অ্যারিস্টটলকে ভুলে গিয়েছিল, তাঁকে পুনরাবিষ্কার করে আরবরা। আরব পণ্ডিতদের মারফত যখন ইউরোপ অ্যারিস্টটলের সঙ্গে পরিচিত হয়, তখন কিন্তু আর কোনো রকম পরীক্ষানিরীক্ষার স্থানই সেখানে পাওয়া গেল না। ইবন রশিদ, ইউরোপে যিনি আভেরস বলে পরিচিত ছিলেন, তিনি ইসলাম ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের মধ্যে সাযুজ্য ঘটান। আভেরসের মাধ্যমে অ্যারিস্টটলের সঙ্গে পরিচিত হন সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস; ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের অপ্রতিহত প্রতাপের যুগে বাইবেল ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের মিলন তিনি ঘটিয়েছিলেন। সে কাজে যথেষ্ট পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়েছিল। যেমন অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়নি, তা চিরকাল একই রকমভাবে আছে। তিনি কোনো বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। বাইবেলের ঈশ্বর, সৃষ্টিতত্ত্ব বা আদম ইভের গল্পের সঙ্গে তাকে মেলাতে গিয়ে টমাস অ্যাকুইনাস যে যুক্তিবিন্যাস করেছিলেন, তা সম্ভবত আধুনিক মনের কাছ গ্রহণীয় হত না। এই বৈপরীত্য থেকে বেরোনোর একমাত্র উপায় ছিল তাকে বিনা বিচারে গলাধঃকরণ করা, গোঁড়া খ্রিস্টধর্ম তাই যুক্তিহীন বিশ্বাসের পথই বেছে নিয়েছিল। এমনকি আরব পণ্ডিতরাও কখনো কখনো অ্যারিস্টটলের মতের বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু মধ্যযুগে ইউরোপে অ্যারিস্টটলের লেখা ও তার ভাষ্যের বাইরে নতুন কোনো জ্ঞানের সম্ভাবনাই অস্বীকার করা হল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, আরিস্টটল বলেছিলেন বিষুবরেখার কাছাকাছি এত গরম যে সেখানে কোনো প্রাণ থাকাই সম্ভব নয়। সুতরাং সেখানে প্রাণ আছে কিনা দেখার জন্য কোনো অভিযান পাঠানোর কল্পনাই ইউরোপে বহুদিন করা হয়নি। আরও একটা সহজ উদাহরণ নেওয়া যাক। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন যে দুটি বস্তুর মধ্যে যে বস্তুটির ভর অন্যটির দ্বিগুণ, সে দ্বিগুণ তাড়াতাড়ি পড়বে। পরীক্ষা করে দেখলেই বোঝা যাবে এই কথাটা ভুল। অ্যারিস্টটলের পরে দু'হাজার বছরে কেউ এই পরীক্ষা করেন নি তা নয়, কিন্তু তা যখনই অ্যারিস্টটলের সঙ্গে মেলেনি তখনই কেন পরীক্ষার ফল ভুল ও অ্যারিস্টটল ঠিক, তার পক্ষে পণ্ডিতরা নানা রকম যুক্তি বিস্তার করেছিলেন।

কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল জাগিয়েছিল তা নয়, পণ্ডিতদেরও ভাবিয়ে তুলেছিল, কারণ কোনো প্রাচীন গ্রন্থেই এই নতুন মহাদেশের কথা পাওয়া গেল না। অন্য পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষানিরীক্ষার ফল প্রাচীন দর্শনের অনুসারী না হলে তার অনেক রকম ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব, কিন্তু একটা গোটা মহাদেশের অস্তিত্বকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। কাজেই প্রাচীন গ্রন্থ সমস্ত জ্ঞানের আকর, এই ধারণার মূলে কুঠারাঘাত পড়েছিল। ফলে ষোড়শ শতক থেকেই অ্যারিস্টটলের দর্শনের প্রতি প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। আস্তে আস্তে পরীক্ষানিরীক্ষা করাও শুরু হয়। তাই পরবর্তীকালে গ্যালিলিও ও অন্য বিজ্ঞানীদের কাজটা সহজ হয়ে গিয়েছিল। গ্যালিলিওকে যে সে যুগে জ্যোতির্বিদ্যার কলম্বাস বলা হত, তা বিনা কারণে নয়।

এই সব পুরানো কথা নিয়ে আজ আলোচনার কি দরকার আছে? আছে, কারণ আমাদের দেশে আবার সেই যুগকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে যখন প্রাচীন গ্রন্থের মধ্যে সমস্ত জ্ঞানকে খুঁজে পাওয়া যেত। মেঘনাদ সাহার এক সুপরিচিত গল্পের কথা স্মরণ করিয়ে দিই। এক ব্যক্তি সাহাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কী বৈজ্ঞানিক কাজ করেছেন। মেঘনাদ যাই বলেন, তিনি কেবল যে ‘সবই ব্যাদে আছে।’ বেদের কোথায় আছে, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন যে বেদ তাঁর পড়া হয়নি বটে, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস সবই সেখানে পাওয়া যাবে। প্রাচীন শাস্ত্র থেকে যাঁরা আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব খুঁজে বার করেন, তাঁদের সম্পর্কে মেঘনাদের বিদ্রূপ আজ প্রবাদে পরিণত।

মেঘনাদের এই লেখার পর আশি বছর কেটে গেছে। প্রাচীন ভারতের অনেক ঐতিহ্যের কথা ইদানিং শোনা যায় যা আগে কেউ কখনো শোনেন নি। তার মধ্যে পড়বে এক প্রাচীন গ্রন্থ বৈমানিক শাস্ত্র যেখানে নাকি উড়োজাহাজের বিবরণ আছে। সেই নিয়ে অনেক আলোচনা বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া যাবে, আজ অন্য এক ‘নব আবিষ্কার’-এর কথায় আসি, তা হল বৈদিক গণিত। ইন্টারনেটে খুঁজলেই এখন ছাত্রছাত্রীদের বৈদিক গণিত শিক্ষাদান থেকে শুরু করে কম্পিউটার প্রোগ্রাম পর্যন্ত অসংখ্য সূত্র পাওয়া যাবে। এর মূল শুরু হয়েছিল একটি বিশেষ গ্রন্থ থেকে। ১৯৬৫ সালে Vedic Mathematics নামে পুরির গোবর্ধন মঠের শঙ্করাচার্য জগদ্‌গুরু স্বামী শ্রী ভারতী কৃষ্ণতীর্থজী লিখিত একটি বই প্রকাশিত হয়। বইটিতে ষোলটি সূত্র আছে যা কৃষ্ণতীর্থজীর কথানুসারে অথর্ব বেদ থেকে প্রাপ্ত। বইটি তাঁর মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হলেও এ বিষয়ে তিনি বহুদিন ধরেই প্রচার চালিয়েছিলেন।

সমস্যা হল যে কৃষ্ণতীর্থজীর আগে কেউ অথর্ব বেদে এই সূত্রসমূহের সন্ধান পান নি। বই প্রকাশের সময়েই গ্রন্থের সম্পাদক ভি এস আগরওয়ালা ভূমিকাতে লিখেছিলেন যে এই কাজটিকে অথর্ববেদের নতুন পরিশিষ্ট বলে ধরতে হবে। কৃষ্ণতীর্থজীর শিষ্যা মঞ্জুলা ত্রিবেদী লিখেছিলেন যে তাঁর গুরু গবেষণা ও তপস্যার মাধ্যমে অথর্ববেদ থেকে এই সমস্ত সূত্র পেয়েছেন।

অথর্ব বেদে সেই সমস্ত সূত্রের সন্ধান পাওয়া গেলেও তা কৃষ্ণতীর্থজীর ব্যাখ্যা বহন করে কিনা তা তর্ক সাপেক্ষ হত। যেমন একটি সূত্র আছে 'একাধিকেন পূর্ব্বেন', লেখা আছে এই সূত্র প্রয়োগ করে সহজেই বর্গ নির্ণয় করা এবং সামান্য ভগ্নাংশকে দশমিক ভগ্নাংশে পরিণত করা যায়। যে দীর্ঘ আলোচনা ও উদাহরণ সূত্রের ব্যাখ্যাতে দেওয়া হয়েছে, যদি ধরেও নিই ঐ দুটি শব্দ থেকে তা পাওয়া সম্ভব, (যা আমার কাছে একেবারেই স্পষ্ট নয়) পাঠকরা কি অনুমান করতে পারছেন যে ঐ সূত্র প্রয়োগ করতে গেলে বর্গ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে এককের ঘরে ৫ থাকতেই হবে? অথবা ঐ দুটি শব্দ থেকে কি বোঝা যাচ্ছে যে দশমিক ভগ্নাংশে রূপান্তরের ক্ষেত্রে সামান্য ভগ্নাংশের হর সংখ্যার একক স্থানে ৯ থাকতেই হবে? তার থেকেও বড় কথা, যে পদ্ধতি ১৫-র বর্গ নির্ণয়ের জন্য যে পদ্ধতি চলবে কিন্তু ১৪ বা ১৬-র ক্ষেত্রে খাটবে না, তা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাতে কাজে লাগতে পারে, কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের শেখানো সম্ভবত খুব বুদ্ধির কাজ নয়। আর দশমিক ভগ্নাংশের কথা প্রাচীন ভারতীয় গণিতে কোথাও পাওয়া যায় না; আর্যভট্ট, ব্রহ্মগুপ্ত ও ভাস্করাচার্যরা ভগ্নাংশ নিয়েই কাজ করেছিলেন।

সূত্রগুলি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার প্রয়োজন এখানে নেই, এই লেখার শেষে দু’জন গণিতজ্ঞ ও গণিতের ঐতিহাসিকের প্রবন্ধের নাম ও লিংক দেওয়া হল, আগ্রহী পাঠক সেগুলি পড়ে নিতে পারেন। সাধারণভাবে বলা যায় যে তাঁরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে কৃষ্ণতীর্থজীর সময় স্কুলে যে ধরনের পাটিগণিত ও বীজগণিত পড়ানো হত, বৈদিক গণিত বইটিও সেই মানের। ক্যালকুলাস সহ নানা আধুনিক গণিত তার মধ্যে পাওয়া যাবে বলে যে দাবি শোনা যায় তার কোন ভিত্তি নেই। ভাষাও নিতান্তই আধুনিক, বৈদিক নয়।

নামের আগে বৈদিক শব্দটি আছে বলে এই বইটি এখন বেশ বিখ্যাত হয়ে পড়ছে। যাঁরা এর মাহাত্ম্য প্রচার করছেন, তাঁদের অনেকেই হয়তো মেঘনাদের গল্পের মতোই বইটি পড়েও দেখেন নি। বেদে থাকুক বা না থাকুক, বৈদিক গণিত যথেষ্ট সরকারি পৃষ্ঠপোষণাও পাচ্ছে, কোনো কোনো রাজ্যে বিদ্যালয়ের পাঠক্রমেও ঢুকে পড়েছে। প্রসঙ্গত বলি, রাইট ভ্রাতৃদ্বয় তাঁদের উড়োজাহাজের ডিজাইন বৈমানিক শাস্ত্র থেকে পেয়েছেন এমন বক্তৃতা শোনার সুযোগও আমার হয়েছে। এর পরের ধাপ হল নতুন জ্ঞানের সম্ভাবনা অস্বীকার, কারণ যা জানার সবই প্রাচীনকালে জানা হয়ে গেছে। সেই চিন্তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বিভিন্ন গবেষণাখাতে ব্যয়ের পরিমাণ ক্রমশই কমছে। আমরা কি আবার কলম্বাস-পূর্ব যুগে ফিরে যাচ্ছি? জ্ঞানচর্চা কি আবার শৃঙ্খলিত হওয়ার পথে?

বৈদিক গণিত নিয়ে আলোচনা এই প্রবন্ধগুলিতে পাওয়া যাবে

Myths and reality : On ‘Vedic Mathematics’, S.G. Dani, https://www.tifr.res.in/~vahia/dani-vmsm.pdf

A critical study of ‘Vedic Mathematics’, C Chandra Hari, https://insa.nic.in/writereaddata/UpLoadedFiles/IJHS/Vol34_1_1_KCHari.pdf

 

প্রকাশঃ নিশিত  অক্টোবর ২০২১