Saturday 8 January 2022

অ্যারিস্টটল, গ্যালিলিও ও আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা

 

অ্যারিস্টটল, গ্যালিলিও ও আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 


 


আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম ইউরোপে। সভ্যতার সূচনা হয়েছিল ব্যাবিলন, মিশর, ভারত ও চিনে। মানুষের ইতিহাসে তাদের অবদান কম নয়, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানের কার্যপ্রণালী বা পদ্ধতি আবিষ্কারে তাদের ভূমিকা পরোক্ষ। আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনার সরলরৈখিক ইতিহাস লিখতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রাচীন গ্রিসে, যদিও সেখানে মিশর সভ্যতার অবদান ভুললে চলবে না। আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রিক সভ্যতা পারসিক, মিশরিয় এবং ভারতীয় সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছিল। দান প্রতিদানের মধ্যে দিয়ে সমস্ত সভ্যতাই পরিপুষ্ট হয়েছিল। আলেকজান্ডারের শিক্ষক ছিলেন সে সময়ের সব থেকে বিখ্যাত দার্শনিক ও বিজ্ঞানী অ্যাারিস্টটল (৩৮৪-৩২২ খ্রিপূ); তাঁর মৃত্যুর পরে গ্রিসের মূল ভূখণ্ডে জ্ঞানচর্চাতে ছেদ পড়েছিল।

তবে গ্রিক সভ্যতার সূর্য তখনই অস্তমিত হয়নি; মিশরে আলেজান্ডারের স্থাপিত নগরী আলেকজান্দ্রিয়া আরো বহু শতাব্দী জ্ঞানের আলোকবর্তিকা জ্বালিয়ে রেখেছিল। ক্রমান্বয়ে রোম ও বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলেও আলেকজান্দ্রিয়ার জ্ঞানচর্চা বন্ধ পড়েনি। ৬৪১ সালে আলেকজান্দ্রিয়া দখলের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর বিজ্ঞানে ইসলামিক যুগের সূচনা হয়। আরব খলিফারা জ্ঞান ও বিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ইউরোপে খ্রিস্টধর্মের প্রসার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে যুক্ত নয় এমন সমস্ত জ্ঞানচর্চার উপর আক্রমণ নেমে এসেছিল। অনেক পণ্ডিত গ্রিস থেকে পালিয়ে ইসলামিক প্রভাবিত সিরিয়াতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গ্রিক ও ভারতীয় বিজ্ঞানের গ্রন্থের আরবি ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল এই সময়। আরব সাম্রাজ্য পূর্বে ভারত থেকে উত্তর আফ্রিকা এবং ইউরোপের স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। আরব ও ইউরোপীয় শক্তির মধ্যে যুদ্ধের পাশাপাশি জ্ঞানের বিনিময়ও ঘটেছিল। বহু গ্রিক মূল বই হারিয়ে গেলো আরবি থেকে তা ইউরোপের শিক্ষিত সমাজের ভাষা লাতিনে অনূদিত হয়। পরবর্তীকালে আবার খ্রিস্টান শক্তি স্পেন অধিকার করে। স্পেনের কর্ডোবা ইত্যাদি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে ইউরোপ গ্রিক জ্ঞানের সন্ধান পায়। এভাবেই বিজ্ঞানও ইউরোপে শিল্প সংস্কৃতির নবজাগরণের অংশীদার হয়ে পড়ে। অবশেষে গ্যালিলিওর হাত ধরে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা হয়।

মধ্যযুগের বিজ্ঞানে অ্যারিস্টটলের প্রভাব ছিল সব থেকে বেশি। আরব বিদ্বানরা আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগারে অ্যাারিস্টটলের লেখার সংস্পর্শে আসার পরে তাঁকে সমস্ত জ্ঞানের আধার বলে মেনে নিয়েছিলেন, ইউরোপ যখন আবার আরবি অনুবাদের মাধ্যমে তাঁর লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়, তখনও তাঁর সেই সম্মান বজায় ছিল। গোটা মধ্যযুগে এককথায় ফিলজফার বা দার্শনিক বললে একজনকেই বোঝাত, তিনি অ্যারিস্টটল। তিনি ছিলেন অসাধারণ ধীসম্পন্ন ব্যক্তি, পৃথিবীর ইতিহাস তাঁর তুলনা খুবই কম। দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র, রাজনীতি, তর্কশাস্ত্র, নাট্যশাস্ত্র, জ্ঞানতত্ত্ব থেকে শুরু করে জীবনবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান ইত্যাদিতে তিনি যে অবদান রেখেছিলেন তা প্রায় দু’হাজার বছর ইউরোপের সভ্যতার দিকনির্দেশ করেছিল। তাঁর প্রভাব এমনই সর্বব্যপী হয়েছিল যে পণ্ডিতরা নিজের চোখকে অ্যারিস্টটলের থেকে কম বিশ্বাস করতেন। গ্যালিলিও এক অ্যারিস্টটলপন্থী দার্শনিকের কথা বলেছেন। যত্ন করে শবব্যবচ্ছেদ করে তাঁকে দেখানো হল যে সমস্ত স্নায়ু গিয়ে মস্তিষ্কে শেষ হয়েছে। তিনি বললেন যে যদি অ্যারিস্টটল যদি না বলতেন যে স্নায়ুর উৎস হল হৃৎপিণ্ড, তাহলে তিনি নিশ্চয় নিজের চোখকে বিশ্বাস করতেন। পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে গালিলিওর অ্যারিস্টটলপন্থী সহকর্মীরা দূরবিনের সাক্ষ্য হয় অগ্রাহ্য করেন, নয়তো তার ভিতর দিয়ে তাকাতেই অস্বীকার করতেন– কারণ ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে যা বলার অ্যারিস্টটল তো আগেই বলে দিয়ে গেছেন। মধ্যযুগে অ্যারিস্টটলের প্রতি এই অন্ধ বিশ্বাস বিজ্ঞানের অগ্রগতির সহায়ক হয়নি।

আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে অ্যারিস্টটলের দর্শনের বিরোধের আলোচনার জন্য আধুনিক বিজ্ঞান বলতে এই লেখাতে কী বোঝানো হয়েছে তার ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। বিশেষ করে বিংশ শতাব্দীতে দার্শনিক ও ঐতিহাসিকদের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানের চরিত্র নিয়ে যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল তা এখনো চলছে। তবে আমাদের সুবিধার জন্য আমরা একটা সহজ সংজ্ঞা ধরে নিতে পারি। হাতেকলমে গবেষণা করা বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের সংজ্ঞা নিয়ে একমত না হলেও মোটামুটি এটা মেনে চলেন। পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষানিরীক্ষা ও তার থেকে সাধারণীকৃত তত্ত্বে উত্তরণ, এই হলো আধুনিক বিজ্ঞানের চরিত্র। তার সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে কোনো তত্ত্ব সবসময়েই প্রমাণসাপেক্ষ, পরীক্ষানিরীক্ষাতে ব্যর্থ হলে তা বাতিল হয়ে যাবে বা তাকে সংশোধন করতে হবে। যে তত্ত্বকে পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করা যায় না, তা যতই গাণিতিকভাবে সফল বা আপাতগ্রাহ্য হোক, তাকে বিজ্ঞান বলা যায় না। আরো একটা বিষয়ের উপর আধুনিক বিজ্ঞান জোর দেয়, তা হল পরিমাপ। প্রাচীন পৃথিবীতে বিজ্ঞান নিশ্চয় ছিল, কিন্তু তা আধুনিক বিজ্ঞানের থেকে অনেকটাই আলাদা। একমাত্র জ্যোতির্বিদ্যা ছাড়া প্রাচীন বিজ্ঞানে পরিমাপের স্থান ছিল নগণ্য। আমরা আমরা বলতে পারি বিজ্ঞানের দর্শন হল অভিজ্ঞতাবাদী দর্শন (empiricism) যে বলে যে সমস্ত জ্ঞানের উৎস হল অভিজ্ঞতা; বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতার অর্থ হল পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ।

আধুনিক বিজ্ঞানে কারণ কাকে বলে? আমরা সাধারণভাবে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে কোনো ঘটনার কারণ হিসাবে কয়েকটি মূল সূত্রের দিকে নির্দেশ করি। অনেকে অবশ্য বলেন এটা কারণ ব্যাখ্যা নয়, বর্ণনা করা হল, সেই বিতর্কে আমরা যাচ্ছি না। একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। আপেল কেন মাটির দিকে পড়ে, তার উত্তর হল পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ। রাজশেখর বসু এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন যে অক্সিজেনে অভাবের কারণকে অ্যানক্সিয়া বলা অর্থহীন, কারণ সেটা শব্দার্থ মাত্র। তাহলে পৃথিবীর আকর্ষণে বা টানে আপেল পড়ছে বললে কি নতুন কথা বলা হল? নিউটন শুধু আপেল বা কমলালেবুর মাটিতে পড়া নয়, আরো অনেক প্রাকৃতিক ঘটনাকে মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করেছিলেন, তাই আমরা মাধ্যাকর্ষণকে আপেলের মাটিতে পড়ার কারণ বলি। কিন্তু প্রশ্ন এখানেই শেষ হয় না, তারপর জিজ্ঞাসা করা যায় মাধ্যাকর্ষণ বলের অস্তিত্বের কারণ কী; কেন আপেল আর পৃথিবী পরস্পরকে টানে? নিউটনের তত্ত্বে এর উত্তর মেলে না। আইনস্টাইন বিংশ শতাব্দীতে বললেন যে কোনো ভরের প্রভাবে চারদিকের স্থানকাল বিকৃত হয়, তা আকর্ষণ হিসাবে আমাদের কাছে প্রতিভাত হয়। একে যদি মাধ্যাকর্ষণের কারণ বলি, তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে ভর কেন তার চারপাশের স্থানকালকে বিকৃত করে। এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই, সম্ভবত এই প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না। সম্ভবত বলছি, কারণ আইনস্টাইনের আগে আমরা মাধ্যাকর্ষণের পিছনের কারণ সম্পর্কে কিছু বলতে পারতাম না, এখন পারি। হয়তো আরো উন্নত কোনো তত্ত্ব ভর কেন স্থান-কালকে বিকৃত করে সেই প্রশ্নেরও উত্তর দেবে।

অ্যাারিস্টলের দর্শন অনুযায়ী যে কোনো ঘটনার চারটি কারণ আছে, উপাদানগত (material), আনুষ্ঠানিক (formal). দক্ষ (efficient) ও চূড়ান্ত বা পরম (final)। ধরা যাক কেউ একটি কাঠের টেবিল বানাবে, তাহলে কাঠ হল উপাদানগত কারণ, আনুষ্ঠানিক কারণ হলে টেবিলের যে চেহারা আমার মনে আছে, দক্ষ কারণ হল করাত, হাতুড়ি, ইত্যাদি যন্ত্র, এবং টেবিল বানানোর ইচ্ছা হল চূড়ান্ত কারণ।

অ্যারিস্টটলের কারণকে আমরা বৈজ্ঞানিক কারণ বলব না, কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত তা মানুষ বা অন্য জীবের কাজের উপর প্রয়োগ করা হয়, এ নিয়ে বিতর্ক তেমন নেই। কিন্তু অ্যারিস্টটলের যুক্তি অনুযায়ী পাথর পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে যায়, তার চূড়ান্ত কারণ হল সেটাই তার প্রকৃত স্থান। তেমনি ধোঁয়া উপর দিকে ওঠে, কারণ সে উপরে উঠতে চায়। জলের স্থান উপরদিকেও হতে পারে, নিচের দিকেও হতে পারে, কারণ জল হিসাবে সে নিচের দিকে বয়ে যায়, কিন্তু বাষ্প হিসাবে উপরে এই ওঠে। এই ব্যাখ্যা দিয়ে আর যাই হোক, আধুনিক বিজ্ঞান সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। সব কিছুরই কারণ আছে, আজ আমরা এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হব নিশ্চয়, কিন্তু অ্যারিস্টটলের চূড়ান্ত কারণকে উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য বললে সঠিক হয়, পাথর পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে যায় কারণ সেটাই তার লক্ষ্য। তাই সঠিক অর্থে অ্যারিস্টটলের দর্শন হল উদ্দেশ্যবাদ (teleology)। কোন জিনিসের প্রকৃত স্থান কোথায় আগে থেকেই নির্দিষ্ট, সেখানে যাওয়াটাই তাহলে তার গতির উদ্দেশ্য।

অ্যারিস্টটলের বিজ্ঞান মোটামুটি গুণগত (subjective), পরিমাণগত (objective) নয়। আধুনিক বিজ্ঞানে আমরা শুধুমাত্র গুণগত ব্যাখ্যাতে সন্তুষ্ট থাকি না। আপেল মাটির দিকে পড়ছে বলাই যথেষ্ট নয়, কত বেগ নিয়ে পড়ছে, সেই বেগের পরিবর্তনের হার কত, মাটিতে পড়তে কত সময় লাগবে - পতনশীল বস্তুর পরীক্ষা করতে গেলে এইগুলি মাপার কথাই প্রথম আমাদের মনে আসবে। এই বিশেষ ক্ষেত্রে অবশ্য অ্যারিস্টটল পরিমাণগত বর্ণনা দিয়েছিলেন; বলেছিলেন দুটি বস্তুর মধ্যে যে বস্তুটির ভর অন্যটির দ্বিগুণ, সে দ্বিগুণ তাড়াতাড়ি পড়বে। পরীক্ষা করে দেখলেই বোঝা যেত এই কথাটা ভুল। পরিমাণগত বিচার অ্যারিস্টটলের দর্শনে অত্যন্ত গৌণ, তার কারণ হল যে তা দাঁড়িয়ে আছে অবরোহী (deductive) যুক্তির উপর। অ্যারিস্টটল লিখেছেন,

মানুষ মরণশীল।

সক্রেটিস মানুষ।

অতএব সক্রেটিস মরণশীল।

সাধারণ প্রতিজ্ঞা বা অনুমান (মানুষ মরণশীল) থেকে বিশেষ সিদ্ধান্তে (সক্রেটিস মরণশীল) আসার এই পদ্ধতিকে বলে অবরোহী যুক্তি। এই বিশেষ উদাহরণটি ঠিক হতে পারে, কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞানে এই যুক্তিজাল অচল। তার জায়গা নিয়েছে আরোহী (inductive) যুক্তি যেখানে বিশেষ থেকে সাধারণে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হয়। পাথর নিচের দিকে পড়ে, জল নিচের দিকে পড়ে, আপেল নিচের দিকে পড়ে, সুতরাং সাধারণ সিদ্ধান্ত হল যে সবই নিচের দিকে পড়ে। তাহলে ধোঁয়া বা জল ফুটে তৈরি হওয়া বাষ্প যে উপরে ওঠে, তার পিছনে কি অন্য কোনো কারণ আছে? যদি না পাওয়া যায়, তাহলে আগের সাধারণ সিদ্ধান্তটা ভুল ধরে নিতে হবে। এমন উদাহরণ বিজ্ঞানে প্রচুর আছে। গোটা ঊনবিংশ শতক বিজ্ঞানীরা নানা রকম রাসায়নিক পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখেছিলেন এক মৌলিক পদার্থকে অন্য মৌলিক পদার্থে পরিবর্তন করা যায় না, তাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল সাধারণ অনুমান। কিন্তু তেজস্ক্রিয়া আবিষ্কারের পর যখন দেখা গেল এক পরমাণু অন্য পরমাণুতে পরিবর্তিত হচ্ছে তখন সেই ধারণা পরিত্যক্ত হল। অবরোহী যুক্তিতে সেই সুযোগ নেই, পরীক্ষানিরীক্ষার স্থান সেখানে গৌণ।

অ্যারিস্টটল নিজে কিন্তু বিশেষ করে জীবনবিজ্ঞানে অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। ডিমের মধ্যে মুরগির বিকাশ দেখার জন্য একদিন অন্তর ডিম ভেঙে ভ্রূণ দেখার তাঁর পরীক্ষা খুবই বিখ্যাত। তিনিই প্রথম দেখেছিলেন ডলফিনরা স্তন্যপায়ী। অ্যারিস্টটলই প্রথম জীবজগৎকে শ্রেণিবিভক্ত করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু অ্যারিস্টটলের পদার্থবিজ্ঞান ছিল তাঁর অবরোহী উদ্দেশ্যবাদী দর্শনের অঙ্গ, সেখানে পরীক্ষানিরীক্ষার কথা বিশেষ আলোচনা হয়নি।

আরব পণ্ডিতদের মারফত যখন ইউরোপ অ্যারিস্টটলের দর্শনের সঙ্গে আবার পরিচিত হয়, তখন কিন্তু আর কোনো রকম পরীক্ষানিরীক্ষার স্থানই সেখানে পাওয়া গেল না। ইবন রশিদ ইউরোপে আভেরস বলে পরিচিত ছিলেন, তিনি ইসলাম ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের মধ্যে সাযুজ্য ঘটান। আভেরসের মাধ্যমে অ্যারিস্টটলের সঙ্গে পরিচিত হন সেন্ট টমাস অ্যাকুইনাস, খ্রিস্টধর্মের অপ্রতিহত প্রতাপের যুগে বাইবেল ও অ্যারিস্টটলের দর্শনের মিলন তিনি ঘটিয়েছিলেন। সে কাজে যথেষ্ট পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়েছিল। যেমন, অ্যারিস্টটল বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়নি, তা চিরকাল একই রকমভাবে আছে। তিনি কোনো বুদ্ধিমান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব বা আদম ইভের গল্পের সঙ্গে তাকে মেলাতে গিয়ে টমাস অ্যাকুইনাস যে যুক্তিবিন্যাস করেছিলেন, তা সম্ভবত আধুনিক যুক্তিবাদী মনের কাছ গ্রহণীয় হত না। এই বৈপরীত্য থেকে বেরোনোর একমাত্র উপায় ছিল বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর, এই আপ্তবাক্যকে শিরোধার্য করা। গোঁড়া খ্রিস্টধর্ম তাই যুক্তিহীন বিশ্বাসের পথই বেছে নিয়েছিল। আরব পণ্ডিতরাও কখনো কখনো অ্যারিস্টটলের মতের বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু মধ্যযুগে ইউরোপে অ্যারিস্টটলের লেখা ও তার ভাষ্যের বাইরে নতুন কোনো জ্ঞানের সম্ভাবনাই অস্বীকার করা হল। আরিস্টটল বলেছিলেন বিষুবরেখার কাছাকাছি এত গরম যে সেখানে কোনো প্রাণ থাকাই সম্ভব নয়। সুতরাং সেখানে প্রাণ আছে কিনা দেখার জন্য কোনো অভিযান পাঠানোর কল্পনাই ইউরোপে বহুদিন করা হয়নি। অ্যারিস্টটল যে প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের কথা বলেছিলেন, তা সম্পূর্ণ পরিত্যক্ত হল।

প্রাচীন জ্ঞানের প্রতি এই নিঃশর্ত আনুগত্যের উপর প্রথম ধাক্কা কিন্তু বিজ্ঞানের থেকে আসেনি। বিজ্ঞানে স্বল্পশিক্ষিত একজন অভিযাত্রী এশিয়ার সন্ধানে আটলান্টিক মহাসাগর পার হতে গিয়ে নতুন এক মহাদেশ আবিষ্কার করে ফেললেন। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার শুধু সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতূহল জাগিয়েছিল তা নয়, পণ্ডিতদেরও ভাবিয়ে তুলেছিল, কারণ কোনো প্রাচীন গ্রন্থেই এই নতুন মহাদেশের কথা পাওয়া গেল না। অন্য পরীক্ষানিরীক্ষার ফল প্রাচীন দর্শনের অনুসারী না হলেও তার অনেক রকম ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব, কিন্তু একটা গোটা মহাদেশের অস্তিত্বকে উড়িয়ে দেওয়া সহজ নয়। ফলে ষোড়শ শতক থেকেই অ্যারিস্টটলের দর্শনের প্রতি প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। আস্তে আস্তে পরীক্ষানিরীক্ষা করাও শুরু হয়। দার্শনিক ফ্রান্সিস বেকন (১৫৬১-১৬২৬) প্রথম পরীক্ষানিরীক্ষা ও আরোহী যুক্তির মাধ্যমে বিজ্ঞানের দর্শনের কথা বলেছিলেন। বেকনের প্রায় সমসাময়িক যে বিজ্ঞানী হাতেকলমে পরীক্ষানিরীক্ষা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে আরিস্টটলের বিরোধিতা করে আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা করেছিলেন, তিনি ইতালির বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি (১৫৬৪-১৬৪২)। তাঁর ও অ্যারিস্টটলের বিরোধের জায়গাগুলি দেখে নেওয়া যাক।

আমাদের অভিজ্ঞতাতে যে কোনো বস্তুকে যদি ঠেলি, সে চলতে শুরু করবে কিন্তু এক সময় থেমে যাবে। অ্যারিস্টটল তার থেকে সিদ্ধান্ত করলেন যে সাধারণ বস্তুদের স্থায়ী ধর্ম হল স্থিতাবস্থা। বলপ্রয়োগ করলে তাদের গতি সৃষ্টি করা যায় বটে, কিন্তু বল সরিয়ে নিলেই তারা আবার স্থিতাবস্থায় ফিরে আসে। এই বল শব্দটা কিন্তু পদার্থবিদ্যাতে আধুনিক যে অর্থে আমরা প্রয়োগ করি সেই অর্থে প্রযুক্ত নয়, অ্যারিস্টটল কখনোই বলের সংজ্ঞা দেননি। আমরা বর্তমানে যে ভাবে বলের সংজ্ঞা দিই ও পরিমাপ করি, তা নিউটনের অবদান। সাধারণ বস্তু কাদের বলা হয়? অ্যারিস্টটলের মতে যে সমস্ত বস্তু চারটি মৌলিক উপাদান, মাটি (earth), জল (water), বায়ু (air) এবং আগুন (fire) দ্বারা তৈরি, তারাই সাধারণ বস্তু। পৃথিবী স্থির এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত। পৃথিবী স্থির, কারণ তার মূল উপাদান হল ঐ চারটি উপাদানের মধ্যে একটি, অর্থাৎ মাটি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত কেমন করে জানলাম? কারণ একটা পাথর হাত থেকে ছেড়ে দিলে সে পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে যেতে চায়। পাথরের মূল উপাদান মাটি, অর্থাৎ মাটি সবসময় কেন্দ্রের দিকে যেতে চায়। তাহলে পৃথিবী নিশ্চয় ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে আছে, তা নাহলে সে সেইদিকে পড়ে যেত। তাহলে আকাশের গ্রহ নক্ষত্ররা চিরকাল চলমান কেন? কারণ তাদের উপাদান হল ইথার, তার উপর পৃথিবীর বস্তুদের নিয়ম খাটে না।

অ্যারিস্টটলের প্রায় সমসাময়িক গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টার্কাস বলেছিলেন পৃথিবী চলমান, সূর্য স্থির। এ ছিল পৃথিবীর বার্ষিক গতি, আহ্নিক গতির কথাও কেউ কেউ বলেছিলেন। কিন্তু এ সমস্ত ছিল নেহাতই একটা মতবাদ, তাদের স্বপক্ষে সে যুগে কোনো প্রমাণ পাওয়া সম্ভব হয়নি। অ্যারিস্টটলপন্থীদের জবাব ছিল যে একটা পাথর নিয়ে নিচে ফেলা হল। পাথরের স্বাভাবিক অবস্থা যেহেতু স্থির। তাই পৃথিবী চলমান হলে হাত থেকে ছাড়া মাত্র পাথরটা পিছিয়ে পড়বে, পৃথিবী তাকে ফেলে এগিয়ে যাবে। আমরা দেখছি যে এই সমস্ত সিদ্ধান্তের মূলে আছে দুটি প্রতিজ্ঞা, বস্তুর স্বাভাবিক অবস্থা হল স্থিতাবস্থা, এবং মাটি পৃথিবীর বা ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রের দিকে যেতে যায়। এই দুটি প্রতিজ্ঞাই কিন্তু অ্যারিস্টটল সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে অনুমান করেছেন, বাকি সমস্ত তার থেকে অবরোহী যুক্তির মাধ্যমে এসেছে।

নিকোলাস কোপার্নিকাস ১৫৪৩ সালে প্রস্তাব করেন যে সূর্য ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থান করে, বাকি সমস্ত গ্রহ তাকে ঘিরে আবর্তন করছে। কিন্তু পণ্ডিতদের কাছে তা বিশেষ গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এ কথা সত্য যে কোপার্নিকাসের মতের পক্ষে বিশেষ প্রমাণ ছিল না। সে সময় ব্রহ্মাণ্ডের যে মডেল অনুসরণ করা হত, তা গ্রিক বিজ্ঞানী ক্লডিয়াস টলেমির সৃষ্ট। টলেমির মডেল ছিল বেশ জটিল পৃথিবী ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে অবস্থিত, তাকে ঘিরে অন্য সব নক্ষত্ররা পাক খাচ্ছে, কিন্তু তাদের পথ ছিল অনাবশ্যক জটিল। কোপার্নিকাসের মডেল তার থেকে খুব একটা সরল ছিল না। অন্যদিকে দুটি প্রশ্নের জবাব সেই মডেলে ছিল না। প্রথমটির মুখোমুখি আমরা আগে হয়েছি, পাথর হাত থেকে ফেললে অ্যারিস্টটলের গতিবিদ্যা অনুযায়ী তার পিছিয়ে যাওয়ার কথা। প্রায় একই রকম একটা আপত্তি এসেছিল। চাঁদ যে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে তা নিয়ে সন্দেহ ছিল না, পৃথিবী চলমান হলে চাঁদ তার সঙ্গে থাকছে কেমন করে?

দ্বিতীয় আপত্তিটি একটু অন্য রকম। ধরা যাক ট্রেনে যেতে যেতে আমরা দূরে পাহাড়ে আর সামনে দুটি গাছ দেখলাম। ট্রেন যেহেতু চলমান, তাই কয়েক সেকেন্ড পরে আমরা দেখব পাহাড়ের সাপেক্ষে গাছদুটোর অবস্থান পাল্টে গেছে। পৃথিবী যদি চলমান হয়, তাহলে ছ'মাস আগে পরে সে নিশ্চয় অনেকটা পথ গেছে; অথচ দূরের তারাগুলোর পারস্পরিক অবস্থানে কোনো পার্থক্য দেখা যায় না।

গ্যালিলিও কোপার্নিকাসের মতেই বিশ্বাস করতেন; বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলারকে ১৫৯৭ সালে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন লোকের ঠাট্টার ভয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোপার্নিকাসের মত সমর্থন করতে পারছেন না। সেই সুযোগ এলো ১৬০৯ সালে। গ্যালিলিও শুনলেন যে দুটি লেন্সের সাহায্যে এমন যন্ত্র বানানো যাচ্ছে, যা দিয়ে দূরের জিনিসকে কাছে দেখা যাচ্ছে। পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক গ্যালিলিও এই খবর থেকেই এক দূরবিন বানিয়ে ফেললেন। তা দিয়ে আকাশের দিকে তাকানোর সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন জগৎ যেন তাঁর সামনে খুলে গেলো।

চাঁদের দিকে তাকিয়ে গ্যালিলিও দেখতে পেলেন পাহাড় আর গহ্বর। দেখলেন চাঁদের বুকে পড়েছে পৃথিবী থেকে প্রতিফলিত হওয়া সূর্যের আলো। শুক্র গ্রহের দিকে তাকালেন। আমরা পূর্ণিমা ছাড়া অন্যসময় চাঁদকে পুরোপুরি দেখতে পাইনা, শুধু যে অংশে সূর্যের আলো পড়ে সেটুকু দেখি। একে বলে চাঁদের কলা। গ্যালিলিও অবাক হয়ে দেখলেন শুক্রগ্রহেরও কলা আছে। সূর্যের দিকে দূরবিন ঘুরিয়ে চোখে পড়ল কালো কালো দাগ যাদের আমরা এখন বলি সৌরকলঙ্ক। আকাশগঙ্গা তাঁর কাছে আসল রূপে ধরা দিল, দেখলেন যে সাদা ঐ পথ আসলে অগুন্তি তারার সমষ্টি। গ্যালিলিওর জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের উপহার নিয়ে এল বৃহস্পতি গ্ৰহ। দেখলেন তার চারদিকে চারটি চাঁদ যারা বৃহস্পতিকে প্ৰদক্ষিণ করছে।

       গ্যালিলিও কোপার্নিকাসপন্থীদের পক্ষ থেকে অনেক প্রশ্নের জবাব নিয়ে এলেন। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন যে পৃথিবী অন্য গ্রহদের থেকে আলাদা, কারণ তাদের আলো আছে, পৃথিবীর নেই। অন্য গ্রহনক্ষত্ররা ইথার দিয়ে তৈরি, পৃথিবী তা নয়। গ্যালিলিও দেখলেন পৃথিবীও নিশ্চয় আলো দেয়, যা চাঁদের উপর পড়ে। কিন্তু আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি পৃথিবীর আলো নেই। গ্যালিলিও বুঝলেন কোনো গ্রহেরই নিজের আলো নেই, সূর্যের আলো যেখানে পড়ে না সেই জায়গা অন্ধকার থাকে। তাই তো আমরা শুক্রের চাঁদের মতো কলা দেখতে পাই। পৃথিবী ও অন্য গ্রহদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, সূর্যের আলোর প্রতিফলনেই তাদের সকলের ঔজ্জ্বল্য। তিনি দেখান যে শুক্রের কলার যে বাড়া কমা দেখা যায়, তা টলেমির সৌরজগতের মডেল ব্যাখ্যা করতে পারে না। তিনি দেখালেন যে পৃথিবীকে চলমান ধরে নিলেই এক মাত্র সহজে বৃহস্পতির চাঁদদের গ্রহণের সময় বার করা যায়।

       অ্যারিস্টটলের মত খণ্ডন করতে গিয়ে গ্যালিলিও বলবিদ্যার জগতে যুগান্তর নিয়ে আসেন। অ্যারিস্টটলপন্থীদের তিনি উত্তর দিলেন বৃহস্পতি যদি চারটি চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে, তাহলে পৃথিবী কেন একটি চাঁদকে নিয়ে চলবে না? তিনি উদাহরণ দিলেন যে চলমান জাহাজের মাস্তুল থেকে কোনো বস্তুকে নিচে ফেললে তা মাস্তুলের গোড়াতেই পড়ে, জাহাজের গতির জন্য পিছন দিকে চলে যায় না। তেমনি পৃথিবীতে পতনশীল বস্তু সোজা নিচের দিকেই পড়ে, পিছিয়ে যায় না। পরীক্ষার মাধ্যমে সবাইকে তিনি দেখিয়ে দিলেন, তিনিই ঠিক বলছেন।

       গ্যালিলিওর দূরবিন চিন্তার জগতে বিপ্লব এনে দিল। যদি বৃহস্পতির চারদিকে প্ৰদক্ষিণ করতে পারে কোনো চাঁদ, তাহলে পৃথিবীই কেন্দ্রে আর সমস্ত কিছুই পৃথিবীকে প্ৰদক্ষিণ করে, একথা আর বলা যাবে না। দূরবিন দিয়ে আকাশের দিকে তাকানোর পরে তাঁর মনে হলো যে কোপার্নিকাসের মতের পক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখন তাঁর নাগালের মধ্যে। সবাইকে তা জানানোর জন্য তাই ১৬১০ সালে বেরোল তাঁর বই, 'Siderus Nuncius', 'তারকাজগতের দূত'। বই ছাপার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচুর বিক্রি হতে লাগল। চারদিকে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল, আর সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছে গেল বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ডের এই নতুন চিত্র।

       শুধু কোপার্নিকাসকে সমর্থন করেই থামলেন না গ্যালিলিও। অ্যারিস্টটলের গতিবিদ্যার মূলের উপর আঘাত করে তিনি দেখালেন যে বস্তুর গতিতে স্থিতাবস্থার আলাদা করে কোনো গুরুত্ব নেই। অসাধারণ কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি দেখালেন যে ঘর্ষণ বা অন্য কোনো বল না থাকলে সচল বস্তু চিরকাল সচল থাকবে। পরে আমরা দেখব যে নিউটনের গতিবিদ্যার প্রথম সূত্রের খুব কাছে গেলেও তার সঙ্গে গ্যালিলিওর সিদ্ধান্তের কিছু তফাত আছে। ১৬৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গতিবিদ্যা সংক্রান্ত নতুন বই "ডায়ালগস কনসার্নিং টু সায়েন্সেস”

গতিবিদ্যার চর্চা করতে গিয়ে পদার্থবিজ্ঞানের গণিতায়ন করেছিলেন গ্যালিলিও। তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘গণিতের বর্ণমালাতে ঈশ্বর ব্রহ্মাণ্ড রচনা করেছেন’। তিনি পতনশীল বস্তুর সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন, দেখিয়েছিলেন যে কোনো বস্তুকে যদি সোজা উপরদিকে না ছুঁড়ে অন্য কোনো কোণে ছোড়া হয় তাহলে তার গতিপথ হল একটি অধিবৃত্ত (parabola) এজন্য তিনি যে কোনো গতিকে দুটি অংশে ভাগ করেছিলেন, একটি হল পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে গতি, অন্যটি পৃথিবী বরাবর অনুভূমিক গতি। এই ধরনের বস্তুকে বলে প্রাস বা প্রজেক্টাইল (Projectile)

আকাশের গ্রহ তারার মধ্যে তাহলে আলাদা করে কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। একই নিয়মে সমস্ত কিছু চালিত হয়। গ্রহ নক্ষত্রদের আর স্বর্গের অংশ বলা যাচ্ছে না। তারা নিখুঁত নয় – গ্যালিলিও দূরবিন দিয়ে চাঁদের পাহাড় আর গহ্বর, সূর্যের কলঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছেন। তাহলে আর স্বর্গ এই মাটির পৃথিবীর থেকে আলাদা কোথায়? অ্যারিস্টটলের দর্শনের একটা অংশ খ্রিস্টান দার্শনিকদের খুব পছন্দ হয়েছিল। আকাশে যা দেখা যাচ্ছে, তা হল স্বর্গের অংশ। সেই কারণেই তারা ত্রুটিহীন, নিখুঁত। তার কোনো পরিবর্তন হবে না, কারণ তার কোনো উন্নতি করা সম্ভব নয়। সেজন্য নক্ষত্রের জন্ম মৃত্যু হয় না। গ্ৰহ নক্ষত্ররা চিরকাল চলমান, কারণ তারা পৃথিবীর নিয়ম নীতির ঊর্ধ্বে। গ্যালিলিও আগেই দেখিয়েছিলেন যে আকাশের নক্ষত্ররা চিরকাল একই রকম থাকে না। ১৬০৪ সালে এক নতুন তারা আকাশে দেখা যায়। আজ আমরা জানি, যে তা ছিল এক তারকার মৃত্যু বা নোভা বিস্ফোরণের চিহ্ন। অ্যরিস্টটলপন্থীরা বললেন যে নতুন তারাটা নিশ্চয় পৃথিবীর খুব কাছে, কারণ তাদের মতে স্বর্গের তো কোনো পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। গ্যালিলিও দূরত্ব হিসেব করে বললেন সেটি গ্রহদের থেকে অনেক দূরে আছে, তাকে কোনোভাবেই আমাদের সৌরজগতের অংশ হিসেবে ভাবা যাবে না। তাই স্বৰ্গও অপরিবর্তনীয় বা চিরস্থায়ী নয়।

গ্যালিলিও শুধুমাত্র আকাশের জ্যোতিষ্কদের উপর গবেষণাতেই সন্তুষ্ট রইলেন না। পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে বিভিন্ন পার্থিব ঘটনার সম্পর্কে অনুসন্ধান করলেন গ্যালিলিও। এও আর এক নতুন চিন্তাধারা। পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়েই বিশ্বজগত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে হবে, প্রাচীন দর্শনের বই পড়ে তা সম্ভব নয় – গ্যালিলিওর এই মত মধ্যযুগের দর্শনের একেবারে মূলেই কুঠারাঘাত করল। পনশী বস্তুর ক্ষেত্রে অ্যারিস্টটলের বিরোধিতা করলেন গ্যালিলিও, বললেন যে বাতাসের ঘর্ষণকে উপেক্ষা করলে দুটি বস্তুই একই সঙ্গে নীচে পড়বে। তাঁর আগে যে এ বিষয়ে অ্যারিস্টটলের মতের সমালোচনা কেউ করেন নি তা নয়, কিন্তু গ্যালিলিও প্রথম প্রকাশ্যে পরীক্ষাটা করেও দেখালেন। সবাই নিশ্চয় পিসার হেলানো মিনারের উপর থেকে দুটি বল ফেলে করা তাঁর পরীক্ষার গল্প শুনেছেন। যদিও সত্যিই গ্যালিলিও ঐ মিনারেই পরীক্ষাটা করেছিলেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে, তবে আমরা জানি যে তিনি বিভিন্ন টাওয়ারের উপর থেকে দুরকম ভরের বল ফেলে তাঁর ছাত্রদের দেখাতেন।

       পতনশীল বস্তুর গতি সংক্রান্ত মাপজোক করা সে সময় নির্ভুল ভাবে সরাসরি করা ছিল কঠিন, তাই গ্যালিলিওকে পরোক্ষ পদ্ধতির সাহায্য নিতে হয়েছিল। তিনি একটি মসৃণ নততলে একটি বল গড়িয়ে পরীক্ষা করেন। তখন গতিবিদ্যার শৈশব অবস্থা, তাই গ্যালিলিওর পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি যে তাঁর পরীক্ষাতে বলের ঘূর্ণনের হিসাব ধরতে হবে। তাই গ্যালিলিওর মাপে অনেক ভুল ছিল, কিন্তু তার জন্য তাঁর কৃতিত্বকে বিন্দুমাত্র ছোটো করা যাবে না। প্রকল্প বা হাইপোথিসিস উত্থাপন ও পরীক্ষার মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই করার যে পদ্ধতি গ্যালিলিও শুরু করেছিলেন, তা আধুনিক বিজ্ঞানের এক মূল স্তম্ভ। গ্যালিলিওর মতে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছুই স্বীকার করা যাবে না। তাঁর সময়ের দর্শনের পণ্ডিতরা দূরবিন দিয়ে তাকাতেই রাজি হলেন না। কারণ তাঁরা তো চিন্তাভাবনা করেই ব্ৰহ্মাণ্ডটা কেমন তা জেনে গেছেন, সেখানে প্রত্যক্ষ প্রমাণের কোনো প্রয়োজন নেই। পক্ষান্তরে পতনশীল বস্তুর গতি সম্পর্কে গ্যালিলিওর নিজের প্রথমে যে মত ছিল, পরীক্ষার ফল দেখে তার পরিবর্তন করতে হয়। অর্থাৎ চিন্তা করে বিশ্ব সম্পর্কে জানা যাবে না, বাস্তবে যেটা দেখা যাচ্ছে সেটাকেই ঠিক বলে মেনে নিতে হবে। তাই তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান সম্ভবত আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন। তিনি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য পরীক্ষার উপর জোর দেন। আগের প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানী পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেও তা অধিকাংশ সময় ছিল দেখানোর জন্য, কোনো কিছু মাপার জন্য নয়।

পক্ষান্তরে আগেই বলেছি আধুনিক বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও নিখুঁত পরিমাপের উপর। গ্যালিলিওই বিশেষ করে পরিমাপগত পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন। বস্তুর গতি বর্ণনা করতে গিয়ে অ্যারিস্টটলপন্থীরা তার নিজস্ব প্রকৃতির কথা বলতেন, গ্যালিলিও তার জায়গায় যে ধর্ম দেখা যায়, মাপা যায়, তার উপর জোর দিলেন। সরল দোলকের দোলনকাল মেপে সময় নির্ণয় শুরু করেছিলেন গ্যালিলিও। ঠিক তেমনি, চাঁদে পাহাড় দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার উচ্চতা মাপার কাজটাও তিনি করেন। আকাশে নতুন তারা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার দূরত্ব মাপার চেষ্টা করেন। দুটি বস্তু একসঙ্গে ফেললে মাটিতে পড়ার সময় তাদের মধ্যে কতখানি ব্যবধান থাকবে সেটা নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। তিনিই প্ৰথম বলেন যে বাতাসের বাধার জন্যই যে তারা একসঙ্গে পড়তে পারছে না। সৌর কলঙ্ক পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে সূর্যের নিজের চারপাশে ঘুরতে কতো সময় লাগে সেটা বার করেন। দূরত্ব মেপে দেখান যে সৌরকলঙ্করা সূর্যেরই অংশ। তিনিই প্ৰথম আলোর বেগ মাপার চেষ্টা করেন যদিও একাজে তিনি সফল হননি। প্ৰথম থার্মোমিটারও তিনি তৈরি করেন। তাঁর পরামর্শেই তাঁর ছাত্র টরিশেলি বায়ুচাপ মাপার যন্ত্র ব্যারোমিটার তৈরি করেন।

আমরা দেখেছি যে কোপার্নিকাসের বিপক্ষে এক বড়ো যুক্তি ছিল যে চলমান পৃথিবী থেকে তারাদের অবস্থানের পরিবর্তন দেখা উচিত ছিল, কিন্তু কোনোভাবেই তা দেখা যাচ্ছে না। আকাশগঙ্গা যখন গ্যালিলিওর দুরবিনে অসংখ্য তারার সমষ্টি হিসাবে দেখা দিল, তখন তিনি বুঝেছিলেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আয়তন বিশাল। নক্ষত্ররা এত দূরে আছে যে আমাদের চোখে তাদের অবস্থানের পরিবর্তন দেখা যাবে না। গ্যালিলিও নিজেও বহু চেষ্টা করেছিলেন সেই পরিবর্তন দেখতে, কিন্তু আমাদের যন্ত্রপাতির সেই সুবেদিতা আসতে সময় লাগবে আরও দুশো বছর। এত দূর থেকে দেখা যাচ্ছে; সুতরাং নক্ষত্রদের আয়তনও নিঃসন্দেহে বিরাট, এক একটা সূর্যের সমান।

আধুনিক বিজ্ঞানের ভিত্তি রচনা করেছিলেন গ্যালিলিও। তাঁর মতামত সে যুগের সমাজপতিদের পছন্দ হয়নি, ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক তাঁর বিচার ও শাস্তির কথা সকলেরই জানা। কিন্তু চার্চ যা চেয়েছিল, ফল হয়েছিল তার বিপরীত। গ্যালিলিওর মতো বিজ্ঞানীকে শাস্তি দেওয়াটা অন্য বিজ্ঞানীদের ধর্ম সম্পর্কে বিরূপ করে তুলেছিল, ধর্ম ও বিজ্ঞানের বিচ্ছেদের সেই ছিল সূচনা। 

 

তথ্যসূত্রঃ

সুশান্ত মজুমদার, ভূপতি চক্রবর্তী, প্রসাদরঞ্জন রায় (সম্পাদিত), আধুনিক বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশ 
David Wootton, The Invention of Science : A New History of Scientific Revolution
David Wooton, Galileo: Watcher of the Science (এই বইটি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম গুরুচণ্ডা৯-তে

George Gamow, The Great Physicists from Galileo to Einstein
I. Bernard Cohen, The Birth of a New Physics
Ray Spangenburg and Diane Kit Moser: The Birth of Science
Stephen Hawking (Edited), On the Shoulders of Giants: The Great Works of Physics and Astronomy

 (প্রকাশ পরম্পরা পত্রিকা, উৎসব ১৪২৮ সংখ্যা)

Monday 3 January 2022

চেনা অচেনা সুভাষ কুণ্ডু

চেনা অচেনা সুভাষ কুণ্ডু

 

আমরা যখন ছাত্র ছিলাম, সেই উনিশশো আশির দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান অনার্সের তালিকার উপর দিকে কলকাতার কলেজগুলোর একচেটিয়া প্রাধান্য থাকত। তখন মুর্শিদাবাদ, নদীয়া, দুই চব্বিশ পরগণা, কলকাতা, হাওড়া এবং হুগলির কিছু অংশের কলেজগুলি ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে। এখন অনেকগুলি জেলার কলেজই অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও কলকাতার কলেজদের সেই প্রাধান্য আর নেই। এর কৃতিত্ব নিশ্চয় সেই সব কলেজের শিক্ষকদের যাঁরা বিশ্বাস করতেন, এবং তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে  এই বিশ্বাসটা ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন যে ভালো পড়াশোনা সমস্ত জায়গাতেই সম্ভব, তার জন্য কলকাতাতে দৌড়ানোর দরকার নেই। আর একজনের নাম জানতাম ছিলেন যিনি ঘটনাচক্রে কলেজে পড়াতেন না, কিন্তু এক বিরাট অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের একই রকম বা আরো বেশি উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। তিনি সুভাষ কুন্ডু।

সুভাষবাবুর নাম অনেকদিন আগে থেকে জানি বটে, কিন্তু নামটা তেমন কেউ বলত না। সুভাষবাবু প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি করেছিলেন, তখন সেই কলেজ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত। ঘটনাচক্রে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে আমি পড়াই। বসিরহাট বা তার কাছাকাছি কলেজগুলো কয়েক বছর আগে পর্যন্ত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেই ছিল, ফলে সেখান থেকে অনেক ছাত্র আমাদের বিভাগে পড়তে আসত। তাদের কেউ যখন স্যারের কথা বলত, বুঝে নিতে হত সুভাষ কুন্ডুর কথা বলছে। তাই একদা ছাত্র পরে সহকর্মী অরিত্র ব্যানার্জি যখন সুভাষ বাবুর ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্সের এক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানালো, সম্মতি দিতে বিশেষ ভাবতে হয়নি। সেই প্রথম তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার সুযোগ হয়েছিল, তখন জানি না যে সেই হবে শেষ দেখা।

আগে থেকেই তাঁর সম্পর্কে আরো অনেক কথা শুনেছি। বসিরহাট কলেজে শিক্ষকতা, নকশাল আমলে তাঁর বন্দিত্বের কথা, পুলিশের নৃশংস অত্যাচারে শরীর ভেঙে পড়ার কথা। জেল থেকে বেরিয়ে বসিরহাট স্কুলে চাকরি, স্কুলের বাইরে বিনা মাইনেতে ছাত্রদের শেখানো, তাঁর অসাধারণ পড়ানোর কথা, তারপর ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স তৈরি করার কথা। সুভাষ কুন্ডু আর ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স মনে হত প্রায় সমার্থক। কখনো কখনো ভেবেছি, আজকের দিনে এ আবার হয় নাকি? একজন মানুষ দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, নিজের পয়সা খরচ করে ছাত্রদের পড়িয়ে যাচ্ছেন?

আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। ছাত্ররা গুরুগৃহে প্রতিপালিত হত। সেই খরচ জোগাত রাজা বা স্থানীয় জমিদার। কয়েকশো বছর আগের কথা বলি কেন? আমার একাধিক শিক্ষকের কাছে শুনেছি যে তাঁরা স্কুলের কোনো শিক্ষকের বাড়িতে থেকেই পড়াশোনা করেছেন, এবং সমস্ত খরচ সেই শিক্ষকই বহন করেছেন। তাহলে কেন আজকের দিনে এ ধরনের ঘটনা অসম্ভব মনে হল? মনে হল কারণ ভেবেছিলাম যে সেই সমস্ত উদাহরণ এখন অচল, কারণ আমাদের জীবনের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। সেই পরিবর্তন ভালো না খারাপ তার বিচারে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আশপাশে যা দেখছি তার বাইরেও আরো কিছু থাকা এ যুগেও সম্ভব, যুগের হুজুকই শেষ কথা বলে না, সুভাষবাবুর মতো মানুষরা সেটাই আমাদের দেখিয়ে দিয়ে যান।

দীর্ঘদিন পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষকতা করার সুবাদে একটা কথা আমার প্রায়শই মনে হয়। আমাদের দেশে পদার্থবিজ্ঞানকে প্রায় গণিতের মতো সম্পূর্ণ থিয়োরেটিকাল বা তাত্ত্বিক বিষয় বলে দেখার একটা প্রবণতা আছে। এর জন্য অনেকটা দায়ী সম্ভবত আমাদের প্রাচীন জাতিভেদ প্রথা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র দেখিয়েছিলেন যে যে দিন থেকে সমাজের তথাকথিত উঁচু তলার লোকরা হাতে কলমে কাজ করাকে তাচ্ছিল্য করতে লাগল, সেই দিন থেকেই আমাদের দেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতি রুদ্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে পশ্চিমবঙ্গে এই ঝোঁকটা আরো বেশি। হয়তো তার কারণ আমরা ছাত্রছাত্রীদের শেখাই যে আমাদের বাংলাতেই জন্মেছিলেন মেঘনাদ সাহা বা সত্যেন্দ্রনাথ বসু, বা স্বাধীনতা পরবর্তীকালে অমলকুমার রায়চৌধুরির মতো বিজ্ঞানীরা যাঁরা তত্ত্বীয় বিজ্ঞানের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। কিন্তু এই কলকাতাতেই সি ভি রমন, মেঘনাদ বা সত্যেন্দ্রনাথ যে ল্যাবরেটরি তৈরির জন্য প্রাণপাত করেছেন সে ইতিহাস আমরা ছাত্রদের কাছে নিয়ে যাই না। যে কারণেই হোক, হাতে কলমে বিজ্ঞান শেখার প্রতি আমাদের অনীহা প্রবল। অথচ পদার্থবিজ্ঞান তো বটেই, আধুনিক বিজ্ঞান বলতে আমরা যে বিষয়টাকে বুঝি সেটা কিন্তু পরীক্ষামূলক বিদ্যা। পরীক্ষানিরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে তা গড়ে উঠেছে। তত্ত্বের গুরুত্ব তাতে কম নয়, কিন্তু শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা বিবর্জিত যুক্তির উপর নির্ভর করে বিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করার অ্যারিস্টটলিয় আদর্শকে আমারা অনেকদিন ত্যাগ করেছি।

সুভাষবাবুও নিশ্চয় পড়াতে গিয়ে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের এই মনোভাব অনুভব করেছিলেন। তাই ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স একটা ফ্রি কোচিং সেন্টার হয় নি, হয়েছিল সত্যিকারের বিজ্ঞান শেখার জায়গা যেখানে ছেলেমেয়েদের থিওরির পাশাপাশি প্র্যাকটিকাল হাতে ধরে শেখাতেন সুভাষবাবু। ফিজিক্সের ল্যাবরেটরি তৈরির খরচ অনেকটাই বেশি, এমনকি সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত কলেজগুলোতেও অনেক সময় প্রয়োজনীয় সমস্ত যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব হয় না। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টাতে এবং নিজের খরচে ইন্সটিটিউটের বাড়ি তৈরি করে সেখানে যে অত্যন্ত উন্নত মানের ল্যাবরেটরি তৈরি করেছিলেন সুভাষবাবু, কলকাতার অনেক কলেজেও সেই ধরনের ল্যাবরেটরি নেই।

সেদিন ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স-এর অনুষ্ঠানে আলাপ হল। প্রতিষ্ঠান ঘিরে ছাত্রছাত্রীদের আগ্রহ চোখে পড়ার মতো। একটা বড় হলঘর পুরোপুরি পরিপূর্ণ। তারা মূলত স্কুল পড়ুয়া, মোটেই সুভাষ বাবুর ছাত্র নয়। এত ছাত্রছাত্রী এসেছে একটি প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে, যার কেন্দ্রে রয়েছেন একজন মানুষ। ছোটখাটো চেহারার মানুষটির সঙ্গে বিশেষ কথা বলার সুযোগ হল না। তিনিও ব্যাস্ত, সবাই ব্যাস্ত। কয়েকদিন আগে বন্ধু অরিত্র আমার লেখা মেঘনাদ সাহার একটা ছোট্ট জীবনী ওনাকে দিয়েছিল, ওনার পছন্দ হয়েছিল সেই কথা ব্যাস্ততার মধ্যেও জানালেন। শুনেছিলাম অসুস্থ, আদৌ আসতে পারবেন কিনা সন্দেহ ছিল। তবু এসেছিলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্সের অনুষ্ঠানে। তাই জীবনে অন্তত একবার সেই মানুষটিকে দেখার সুযোগ পেলাম যিনি জীবৎকালেই কিংবদন্তীতে পরিণত হয়েছিলেন।

সুভাষ বাবুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর অনেক ছাত্রই আমার বন্ধু বা বিশেষ পরিচিত। তাঁদের মধ্যে যাঁরা আমাকে অন্তত একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। একজন শিক্ষকের সাফল্যের বিচার দুই মাপকাঠিতেই হয়, প্রথমত কত সংখ্যায় সফল ছাত্রছাত্রী তিনি তৈরি করতে পেরেছেন, এবং দ্বিতীয়ত কতজনকে তিনি নিজের আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন। দুটি ক্ষেত্রেই সুভাষবাবুর সাফল্য বিস্ময়কর। প্রায় সর্বত্রই কোনো নতুন উদ্যোগের পিছনে থাকেন এক বা খুব অল্প কয়েকজন ব্যক্তি। আমাদের দেশের দুর্ভাগ্য হল সেই এক বা একাধিক ব্যক্তি না থাকলে উদ্যোগটি সাধারণত মুখ থুবড়ে পড়ে। স্যারের ছাত্রছাত্রীরা অনেকদিন আগে থেকেই স্যারের পাশে ছিলেন। আমার বিশ্বাস ইন্সটিটিউট অফ ফিজিক্স-কে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

        গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

 

(শ্রদ্ধেয় সুভাষচন্দ্র কুণ্ডুর স্মৃতিতে প্রকাশিত 'স্মৃতির কণায় ঊর্মিমালায়' বইতে সংকলিত। বইটির সম্পাদনা করেছেন চন্দ্রা মিত্র, শুভঙ্কর ঘোষ, নীরজ নাথ, অরিত্র ব্যানার্জী, রথীন রায়, জয়দীপ মিত্র ও ব্যাসদেব গায়েন।)