Friday 13 May 2022

পিশাচের নখ

 

পিশাচের নখর

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


সকালে রাজা বিক্রমাদিত্য উজ্জয়িনীর রাজসভাতে বসে কালিদাসের কাব্য পাঠ শুনছেন। এমন সময় সভার প্রবেশপথে খুব তর্কবিতর্কের শব্দ পাওয়া গেল। মহারাজ বিরক্ত হয়ে উচ্চকণ্ঠে বললেন, 'দ্বারী, কি হয়েছে?’

মহারাজ, এক ভিল্ল আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়। আমি বলেছি মহারাজ এখন ব্যস্ত, কিন্তু সে কিছুতেই শুনতে রাজি নয়।'

'ঠিক আছে, ওকে আসতে দাও।'

একটি বয়স্ক মহিলা এসে দাঁড়াল। বলল, 'আমার ছেলেকে ছেড়ে দে, ও কিছু করেনি।'

ভিল্লদের সমাজে সবাই সমান। তাই তুমি আপনি এসব শব্দের ব্যবহার নেই। বিক্রমাদিত্য জানতেন, তাই তিনি কিছু মনে করেন নি। তিনি বললেন, 'কে তোমার ছেলে? কী করেছে সে?’

'আমার ছেলে শম্ভকে কোটাল ধরে নিয়ে গেছে। বলছে ও নাকি কাকে মেরেছে। আমি জানি ও কোনো মানুষের গায়ে হাত দেবে না। তুই কোটালকে বল ওকে ছেড়ে দিতে।'

'ঠিক আছে, অপেক্ষা করো। আমি কোটালকে ডেকে পাঠাচ্ছি।

বেশ কিছুক্ষণ পরে শহরের কোটাল এসে অভিবাদন করে দাঁড়ালেন।

বিক্রমাদিত্য জিজ্ঞাসা করলেন, 'কোট্টপাল, এই ভিল্ল রমণী বলছে ওর পুত্রকে তুমি বিনা দোষে বন্দি করেছ।’

কোটাল বললেন, 'মহারাজ, কাল রাত্রে নগরের এক পান্থশালাতে এক অদ্ভুত হত্যাকাণ্ড হয়েছে। সাক্ষীও একজন আছে, সে বলছে এ এক পিশাচের কীর্তি। মহারাজ, এক ভিল্ল সেই সময় পান্থশালার বাইরের গাছের তলায় ছিল। কে না জানে যে ভিল্লরা সবাই পিশাচসিদ্ধ হয়? তাই আমি তাকে বন্দী করেছি। আমি নিশ্চিত যে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সে দোষ স্বীকার করবে।'

শম্ভর মা কেঁদে উঠে বলল, 'রাজা, আমি জানি কোটাল কেমন করে জিজ্ঞেস করে। আমার শম্ভ বড় নরম, চাবুকের ঘা সহ্য করতে পারবে না। তুই ওকে ছেড়ে দে।'

বিক্রমাদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। কালিদাস বললেন, 'মহারাজ, অনুমতি দিলে আমি একবার অনুসন্ধান করে দেখতে পারি।'

কালিদাসের বুদ্ধির উপর গভীর আস্থা ছিল বিক্রমাদিত্যের। তিনি বললেন, ‘আপনি! যান। তবে সাবধান। প্রেত পিশাচ ডাকিনী এদের এড়িয়ে চলবেন।' বিক্রমাদিত্যের কথাতে কৌতুকের আভাস পেয়ে কালিদাস মুহূর্তের জন্য তাঁর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর অভিবাদন করে সভা ত্যাগ করলেন, সঙ্গে কোটাল ও সেই ভিল্ল। কালিদাস মহিলাকে বললেন, 'আমি কোটালের সঙ্গে যাচ্ছি। তুমি বাড়ি যাও। যদি শম্ভ নির্দোষ হয় নিশ্চয় দেবাদিদেব মহাদেবের আশীর্বাদে সে মুক্তি পাবে।' কোটাল কোনো কথা বলল না, তবে তার মুখের ভাবেই সুস্পষ্ট সে কালিদাসের সঙ্গে একমত নয়।

কোটালকে একা পেয়ে কালিদাস জিজ্ঞাসা করলেন, 'সুমলয়, তুমি কি করে নিশ্চিত হয়েছ যে এই হত্যা পিশাচের কাজ?’

'কালিদাস, আমি জানি তুমি পিশাচে বিশ্বাস করো না। কিন্তু সাক্ষী আছে যে ওই পিশাচকে দেখেছে।'

কালিদাস বললেন, 'পিশাচের কথা যদি মেনেও নিই, তাহলেও ওই ভিল্লকেই কেন বন্দী করেছ?’

'পিশাচ কেন হঠাৎ করে কোনো মানুষকে আক্রমণ করবে? ঘটনাস্থলের কাছে একমাত্র ঐ শম্ভই ছিল। আর জানোই তো বনচারী জাতি ভিল্ল কিরাত শবররা রাক্ষস পিশাচ এদের পূজা করে। অন্য আর কে পিশাচকে ডেকে আনবে?

কালিদাস বললেন 'তোমার ঐ যে সাক্ষী পিশাচকে দেখেছে বলেছে, সেই হয়তো আসল আততায়ী।'

'দেখো কালিদাস, আমার কাজ আমি জানি। তাকেই আমি প্রথম সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু তন্নতন্ন করে খুঁজেও আমি তার নিকটে কোনো অস্ত্র পাইনি।'

কালিদাস বললেন, 'আমি তোমার সাক্ষীর সঙ্গে কথা বলতে চাই। শম্ভর সঙ্গেও কথা বলব।'

'সম্রাটের অনুমতি পেয়েছ, তোমার যথা ইচ্ছা তুমি করো। কিন্তু দেখবে আমি সঠিক দোষীকেই বন্দি করেছি। বিকর্ণকে সেই পান্থশালাতেই প্রহরাধীন রেখেছি। শম্ভ কারাগারে আছে। শবদেহের কিন্তু সৎকার হয়ে গেছে। অপঘাতে মৃত্যু, তাই অধিক সময় রাখতে সাহস হয়নি।'

'গতস্য শোচনা নাস্তি, যা হয়ে গেছে তা নিয়ে আর ভেবে কী হবে? যা সম্ভব তাই নিয়েই কাজ করতে হবে। শবদেহ তুমি পরীক্ষা করেছিলে?’

নিশ্চয়। বুকের কাছে এক গভীর ক্ষত, পিশাচের নখের চিহ্ন। তাছাড়া সারা দেহে আরো কয়েক স্থানে নখরাঘাত ছিল।'

'নখ না সূক্ষ্ম ছুরিকা?’

'পার্থক্য করতে পারব না, তবে চাক্ষুষ দেখেছে যে সাক্ষী, সে নখের কথাই বলেছে।'

কারাগারই কাছে, সেখানেই প্রথম গেলেন কালিদাস। কোটালের ঘরে দুজনে বসলেন, তারপর প্রহরীকে দিয়ে শম্ভকে ডেকে আনা হল।

'এ তো নেহাতই বালক,' কালিদাস সবিস্ময়ে বললেন। সত্যিই তাই, শম্ভের বয়স বেশি নয় গোঁফের রেখা ফুটেছে মাত্র। হাতদুটো দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। খুবই ভয় পেয়ে গেছে, তা চোখমুখের চেহারাতেই স্পষ্ট।

'বালক তো কী হয়েছে? ভিল্লরা জন্ম থেকেই পিশাচসিদ্ধ হয়।' কোটাল বলল।

'তা হলে তো একে বন্দিশালাতে রাখা খুব বিপজ্জনক। দরজা কি পিশাচকে আটকাতে পারবে?’ কালিদাস নির্বিকার গলায় বললেন। তারপর নরম গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, 'তোমার নাম শম্ভ?’

'হ্যাঁ।'

উজ্জয়িনীর মাঘমাসের মেলা বিখ্যাত, দূর দূর থেকে মানুষ সেখানে ক্রয়বিক্রয়ের জন্য আসে। এক মাস ব্যাপী মেলা গতকাল শেষ হল। শম্ভ এসেছিল শিকার করা হরিণের চামড়া বিক্রি করতে।

'শম্ভ, অত রাতে তুমি পান্থশালার বাইরে কি করছিলে?’

শম্ভ বলল, 'কাল সন্ধে হয়ে গিয়েছিল। অত রাতে জঙ্গলে যাব না। সকাল হলে চলে যাব। তাই গাছের তলায় রাত কাটাচ্ছিলাম।'

কালিদাস জিজ্ঞাসা করলেন না যে শম্ভ কেন পান্থশালায় আশ্রয় নেয়নি। ভিল্লরা চতুর্বর্ণের মধ্যে পড়ে না, তারা অচ্ছুৎ। কোনো বাড়িতে ওদের ঢুকতে দেওয়া হয় না।

শম্ভ বলে চলে, ‘এমন সময় পান্থশালার বাইরের এক ঘর থেকে খুব জোর চিৎকার ভেসে আসে। আমি ছুটে যেতে গিয়েও সামলে নিই, আমি তো ঘরে ঢুকতে পারব না। তারপর অনেক লোক এসে সেই ঘরের সামনে জড়ো হয়, দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে ভিতরে ঢোকে। অনেকক্ষণ চেঁচামেচি চলে। একটু শান্ত হলে আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ আমাকে লাথি মেরে তুলে এই প্রহরীরা জিজ্ঞাসা করে আমি কে। আমি যেই বলেছি আমি ভিল্ল শম্ভ, সঙ্গে সঙ্গে একজন বলল, "এই নিশ্চয় পিশাচ ডেকে এনেছে।" তারপর আমাকে এখানে এনে বেঁধে রেখেছে। আমার জিনিসপত্র সব নিয়ে নিয়েছে। আমি এত বলছি যে পিশাচকে কেমন করে ডাকতে হয় আমি জানি না, কেউ আমাকে বিশ্বাস করছে না।'

কালিদাস কোটালের দিকে তাকালেন। কোটাল বললেন, 'ওর সমস্ত সামগ্রী নিরাপদে রাখা আছে।'

কালিদাস উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, 'আমরা পান্থশালাতে যাব। শম্ভও আমাদের সঙ্গে চলুক।' কোটাল প্রহরীকে ইঙ্গিত করলেন, সে শম্ভর হাতে বাঁধা দড়ির অন্য প্রান্ত নিজের হাতে নিল। কালিদাস বললেন, 'শম্ভের বাঁধন খুলে দাও, ও পলায়ন করবে না। করলে যাবেই বা কোথায়? এই নগরীতে ওকে কে আশ্রয় দেবে? প্রহরী সঙ্গে চলুক।’

সবাই পায়ে হেঁটে পান্থশালাতে উপস্থিত হলেন। মাঘ মাস, তাই সূর্য মাথার উপরে উঠলেও রোদের তাত নেই। এই পান্থশালা উজ্জয়িনীর বাসিন্দাদের খুবই প্রিয় জায়গা। অন্যদিনে এখানে জায়গা পাওয়াই শক্ত। অথচ আজ তা প্রায় নির্জন। দরজার বাইরে এক প্রহরী বসে ছিল, কোটালকে দেখে উঠে দাঁড়াল। কোটাল বললেন, 'বিকর্ণ কোথায়?’

'ভিতরে। ও চলে যেতে চাইছিল, আমি বলেছি আপনার অনুমতি ছাড়া এই ওকে যেতে দেওয়া যাবে না।'

'ঠিক আছে। আমরা ভিতরে যাচ্ছি। তুমি এখানেই থাকো। এই ভিল্লকে এখানেই রেখে গেলাম।' কোটাল বললেন।

পান্থশালার অধিকারী সৌগন্ধ তাঁদের দেখে দৌড়ে এলেন। কালিদাসকে উজ্জয়িনীতে কে না চেনে, তাছাড়া তিনি আগে বেশ কয়েকবার এই পান্থশালাতে এসেছেন। কোটালের সঙ্গে তাঁকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, 'রাজকবি, আপনি?’

'মহারাজ পাঠিয়েছেন এই হত্যার ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে।'

'কবি, এ পিশাচের কাণ্ড। ভয়ে সব নাগরিক আমার পান্থশালা এড়িয়ে যাচ্ছে। যজ্ঞ করে এই স্থানকে পিশাচমুক্ত করতে হবে বলে পুরোহিত বিধান দিয়েছেন, তার ব্যয় অনেক।'

'কাল রাত্রে কী হয়েছিল?’

'একমাস পূর্বে দুই জন এসে একটি ঘর নেয়। আগেও তারা কয়েকবার এখানে রাত্রিবাস করেছে। দুজনেই বণিক, অন্য নগর থেকে মেলায় এসেছিল। একজনের নাম বিকর্ণ, অন্যজনের নাম চণ্ড। প্রতিদিন সকালে তারা মেলায় যায়, সন্ধ্যাতে ফিরে আসে। গতকাল ফেরার পর দুজনেই ক্লান্ত ছিল, তাই তারা স্নানাগার ব্যবহার করতে চায়। পান্থশালার পশ্চাতে এক পুষ্করিণী আছে, সাধারণত সবাই তা ব্যবহার করে। কিন্তু গতকাল বিকর্ণ বলে যে এই শীতে গরম জলই তাদের পছন্দ। আগেও তারা কয়েকদিন স্নানাগারটি ব্যবহার করেছে। সেটি বিশেষ করে চণ্ডের খুবই প্রিয় ছিল। স্নানকক্ষ পান্থশালার বাইরে, কিঙ্কর সেখানে জল গরম করার জন্য আগুন জ্বেলে দিয়ে চলে আসে। কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ এক প্রচণ্ড ভয়ার্ত চিৎকার স্নানকক্ষের দিকে থেকে আসে। সচকিত হয়ে আমি এক মশাল জ্বালিয়ে সেখানে ছুটে যাই, আরো অনেকেই আমার সঙ্গে ছিল। কিন্তু স্নানাগারের দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। ভিতর থেকে তখনো গোঙানির শব্দ ভেসে আসছিল। আমরা দুএকজন দরজাতে ধাক্কা দিতে থাকি, শেষে স্থির হয় দরজা ভেঙে ফেলতে হবে। কিন্তু হঠাৎই দরজা নিজে থেকেই খুলে যায়। দেখি সারা কক্ষ কটুগন্ধ ধোঁয়াতে পরিপূর্ণ। আমাদের সকলের শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। একটু অপেক্ষা করার পর কক্ষে প্রবেশ সম্ভব হয়। তখন দেখি চণ্ড ও বিকর্ণ দুইজনেই পড়ে আছে। রক্তে চারদিক ভেসে যাচ্ছে। দুজনকে ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে আসি। চণ্ড তখন মৃত। আমাদের আশঙ্কা ছিল বিকর্ণও তাই, কিন্তু দেখলাম সে অচৈতন্য। আমি তখন কোটালকে খবর দিই, বৈদ্যকেও ডেকে পাঠাই।

'বৈদ্য এসে চিকিৎসা করলে বিকর্ণের জ্ঞান ফিরে আসে। প্রথমে সে ভয়ে কথা বলতে পারছিল না। কিছুক্ষণ পরে বলল ...’

কালিদাস হাত তুলে বললেন, 'আমি বিকর্ণের কাছেই সে কথা শুনে নেব। ওর সঙ্গে এখন কথা বলা সম্ভব?’

'নিশ্চয়। ও এখন সুস্থ। তবে প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে, উজ্জয়িনী ছেড়ে চলে যেতে চাইছে।'

'তাহলে ওকে একটু ডাকুন। আমরা ওর সঙ্গে একান্তে কথা বলতে চাই। '

সৌগন্ধ বেরিয়ে গিয়ে বিকর্ণকে পাঠিয়ে দিলেন। কোটাল তাকে বললেন, 'বসুন। আপনাকে ইনি কয়েকটি প্রশ্ন করবেন কালকের ঘটনা নিয়ে।'

'আমার যা বলার তো আমি বলেছি। আমাকে উজ্জয়িনী ত্যাগের অনুমতি দিন। আমি আর এক রাত্রিও এখানে থাকতে চাই না, পিশাচ যদি ফিরে আসে? এমনিও আমি ও চণ্ড আজ বিকালে একদল বণিকের সঙ্গে ফিরে যাব স্থির করেছিলাম।'

বণিকরা এক নগর থেকে অন্য নগরে দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে। পথের অনেক জায়গাতেই জঙ্গল, হিংস্র পশু ও দস্যুর ভয় আছে।

কালিদাস বললেন, 'আপনার গৃহ কোথায়?’

'আপনি কে? আপনার প্রশ্নের উত্তর কেন দেব?’

কোটাল বললেন, 'ইনি মহাকবি কালিদাস। মহারাজ বিক্রমাদিত্য অনুসন্ধানের জন্য এঁকে পাঠিয়েছেন।'

'মহাকবি? আমি তো একজন মহাকবিরই নাম জানি। তিনি বাল্মীকি।'

কালিদাস বললেন, 'আপনি সঠিকই বলেছেন। মহাকবি একজনই, যদিও বেদব্যাসকেও হয়তো আমরা সেই সম্মান দিতে পারি।'

'তা মহাকবির এই বিষয়ে আগ্রহের কারণ কী? নতুন কোনো মহাকাব্য রচনা করবেন?

বিকর্ণের কথাতে বিচলিত হলেন না কালিদাস। বললেন, 'কবির নয়, মহারাজের প্রতিনিধির প্রশ্নের উত্তর দিন।'

মহারাজের নাম শুনে বিকর্ণ একটু নিরস্ত হল। 'আমি মাহিষ্মতীর অধিবাসী।' মাহিষ্মতী উজ্জয়িনীর থেকে তেরো যোজন দূরের এক নগর।

'চণ্ড কি আপনার পূর্বপরিচিত?’

'চণ্ড ও আমি একত্রে বাণিজ্য করে থাকি। আমরা নানা শৌখিন দ্রব্য এক শহর থেকে অন্য শহরে ক্রয় বিক্রয় করে থাকি। মাঘী মেলাতে এসেছিলাম। উজ্জয়িনী ত্যাগের পূর্বেই এই ঘটনা। জানি না চণ্ডের স্ত্রীপুত্রকে কী উত্তর দেব।'

'এবার বাণিজ্য কেমন হয়েছে?’

'সত্য বলতে আশানুরূপ নয়। এই মেলার জন্য চণ্ডই সমস্ত সামগ্রী সংগ্রহ করেছিল, তার কোনোটির জন্যই বিশেষ মূল্য পাওয়া যায় নি। এবারের যাত্রা একেবারেই বৃথা বললেই হয়।'

'আপনারা কোথায় বিপণি সাজিয়েছিলেন?’

'মহাকাল মন্দিরের কাছে শিপ্রা যেখানে উত্তরদিকে বাঁক নিয়েছে, সেইখানে।'

'কাল কী ঘটেছিল?

'কাল সারা দিনের পরে আমরা ভীষণ ক্লান্ত ছিলাম। চণ্ড আসার সময় বলেছিল যে উষ্ণ জলে স্নান করলে শরীর সুস্থ হবে, আমিও সম্মত হই। অবশ্য তার জন্য সৌগন্ধকে দুটি তাম্রমুদ্রা দিতে হল। যা হোক, আমরা যখন স্নান করছিলাম, হঠাৎ এক পূতিগন্ধময় ধূমে ঘর ভর্তি হয়ে যায়। কিছু বোঝার আগেই সেই ধোঁয়া থেকে বেরিয়ে আসে এক পিশাচ। সে আমাদের আক্রমণ করে। সামনে ছিল চণ্ড, প্রথমে তাকে আঁচড় দেয়, তারপর তাকে পুতুলের মতো তুলে ধরে উন্মত্ত পিশাচ দীর্ঘ নখ দিয়ে তার হৃৎপিণ্ডকে বিদ্ধ করে। আমি স্নানকক্ষের দরজা খোলার চেষ্টা করছিলাম, কিন্তু নিশ্চয় ইন্দ্রজাল প্রয়োগে তা রুদ্ধ করে রেখেছিল। চণ্ডের মৃতদেহ ফেলে রেখে পিশাচ আমাকে আক্রমণ করে। পালাতে গিয়ে আমার ঊরুতে তার নখের আঁচড় লাগে। যখন আমি জীবনের আশা ত্যাগ করেছি, ঠিক সেই সময় দরজাতে কেউ আঘাত করে। পিশাচ তখন অদৃশ্য হয়ে যায়। আমি অচৈতন্য হয়ে পড়েছিলাম, আমার আর কিছুই মনে নেই।'

বিকর্ণ তার ঊরুতে পিশাচের নখের চিহ্ন দেখায়। তিনটি সমান্তরাল আঁচড়, দীর্ঘ তবে গভীর নয়।

'ঠিক আছে, কিন্তু আপনি এখনি পান্থশালা ত্যাগ করবেন না,' কালিদাস বললেন।

বিকর্ণ আর থাকতে রাজি নয়, কিন্তু কোটালও তাঁকে এখনি ছাড়বেন না। কিছুক্ষণ তর্কাতর্কির পরে বিকর্ণ চলে গেল। কালিদাস বললেন, 'সুমলয়, বিকর্ণই যে হত্যা করেনি, তা তুমি জানলে কেমন করে? হয়তো ও অভিনয় করেছিল। অপর কেউ তো স্নানকক্ষে ছিল না, ও যা বলছে তা সত্য না হতেই পারে। গায়ের আঁচড় হয়তো আমদের বিপথে চালিত করার জন্য নিজেই করেছে।'

কোটাল বললেন, 'দেখো কালিদাস, আমি প্রথমেই সেই কথা ভেবেছিলাম। তাই চণ্ডের শব পরীক্ষা করি। তার বুকের যে গভীর ক্ষত, তা যদি পিশাচের না হয়, তাহলে তা তো কোনো অস্ত্রের হবে। বিকর্ণের নিকট কোনো অস্ত্র ছিল না। আমার প্রহরীরা আতঙ্কে স্নানকক্ষে প্রবেশ করতে চায় নি। তাই আমি নিজে সেই ঘর পরীক্ষা করেছি। সেই ঘরে কোনো অস্ত্র পাওয়া যায়নি। স্নানকক্ষের আশপাশও উত্তমরূপে দেখেছি।'

'আমি নিজে একবার দেখব। কিন্তু শম্ভকে বন্দি করেছ কেন?’

'পিশাচ আবাহন কেউ একজন তো করেছে। এই সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। অবিলম্বে কোনো ব্যবস্থা না নিলে নগরে আতঙ্কের সৃষ্টি হবে। অধিবাসীরা যখন জানতে পারবে যে মূল অপরাধীকে বন্দি করা হয়েছে তাহলে তারা আশ্বস্ত হবে।'

'তার জন্য ঐ বালককে শাস্তি দেবে, হত্যা করবে?’

'সামান্য এক ভিল্ল বালক, তার জীবন মৃত্যুতে কী আসে যায়?’

কালিদাস আগেই শম্ভকে দোষী সাব্যাস্ত করার উদ্দেশ্য অনুমান করেছিলেন। শুধু সুমলয় নয়, উজ্জয়িনীর অধিকাংশ নাগরিকই ভিল্ল জাতি সম্পর্কে একই মত পোষণ করে। কালিদাসের অনুমান মহারাজ বিক্রমাদিত্য সেই দলে পড়েন না, কিন্তু জনমতের কাছে তিনিও নিরুপায়। চতুর্বর্ণ প্রথার বাইরে যাওয়ার ক্ষমতা তাঁরও নেই।

'বিকর্ণ বা চণ্ডের কাছে অর্থ কী পরিমাণ আছে?’ তিনি সুমলয়কে জিজ্ঞাসা করলেন।

'বিকর্ণ ঠিকই বলেছে, মাসকালব্যপী মেলার অন্তে তাদের দু'জনের কাছে মুদ্রার পরিমাণ সামান্যই।'

কালিদাস স্নানকক্ষে ঢুকলেন। ঘরটি বেশ বড়। একপার্শ্বে আগুন জ্বেলে জল গরম করার বন্দোবস্ত আছে। অন্যপাশে একটি জলপূর্ণ গভীর পরিখা। স্বচ্ছ জল, তলদেশ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। চতুর্দিকে রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে আছে। কক্ষের একটিই দরজা, জানালা নেই। প্রচণ্ড শীতেও ভিতরের হাওয়া গরম রাখার জন্যই এই ব্যবস্থা। বেশিক্ষণ দেরি করলেন না; সুমলয় নিজের কাজে খুবই দক্ষ, ছুরিকার মতো অস্ত্র তার চোখ এড়িয়ে যাবে না।

বেরিয়ে এসে কালিদাস শম্ভকে জিজ্ঞাসা করলেন সে রাত্রে কোথায় ছিল। শম্ভের ইঙ্গিত অনুসরণ করে কালিদাস দেখলেন যে সেই গাছতলা থেকে স্নানকক্ষের দরজা স্পষ্ট দেখা যায়।

'কাল আর্তনাদের পরে কাউকে ঐ কক্ষ থেকে পলায়ন করতে দেখেছিলে?’ তিনি অম্ভকে প্রশ্ন করলেন।

'না, আমি নজর রেখেছিলাম। দরজা বন্ধ ছিল, অন্যরা আসার পরেই দরজা খোলে।'

পান্থশালা থেকে বিদায় নিয়ে কালিদাস অন্যমনস্কভাবে ইতস্তত পায়চারি করছিলেন। কবিকে এমন দেখতে অভ্যস্ত উজ্জয়িনীর নাগরিকরা। দূর থেকেই তারা অভিবাদন করছিল, কালিদাস কাউকেই উত্তর দিচ্ছিলেন না, তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন। শম্ভকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হল প্রকৃত আততায়ীকে চিহ্নিত করা। তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস যে বিকর্ণই এই হত্যা করেছে। কটুগন্ধ ধোঁয়া সৃষ্টি কঠিন নয়, নানা রকমের ওষুধ বা শুষ্ক লতাপাতাচূর্ণ দিয়ে তা সম্ভব। দরজা খুলে দিয়ে দূরে গিয়ে অজ্ঞানের অভিনয় করাও সহজ; যারা প্রথমে প্রবেশ করেছে, ধোঁয়ার জন্য তাদের দৃষ্টি বিগ্নিত হয়েছিল। কিন্তু অস্ত্রটির সন্ধান না পেলে কোনোভাবেই তা প্রমাণ করা যাবে না। ছুরিকাটিকে কোথায় লুকাল বিকর্ণ?

সচকিত হয়ে কালিদাস দেখলেন শিপ্রা নদীতীরে মেলাস্থলে পোঁছেছেন তিনি। কিছু দোকান শূন্য, কিন্তু অনেকেই তখনো তাদের সামগ্রী পেটিকাবদ্ধ করছে। তিনি একজনকে জিজ্ঞাসা করে বিকর্ণদের বিপণির সন্ধান পেলেন। সেটি শূন্য, তবে পাশের একটি দোকানি তখনো ছিল।

কালিদাস জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এটি কি চণ্ড ও বিকর্ণের বিপণি?’

'হ্যাঁ। শুনেছি চণ্ডকে কাল এক পিশাচ হত্যা করেছে। ওরা যে সমস্ত সামগ্রী বিক্রয় করত, তাতে আশ্চর্য নয়।'

কেন, কী বিক্রয় করত?’

'বিদেশি দ্রব্য, নানা স্থান থেকে সংগ্রহ করত। কোনোটির মধ্যে হয়তো কোনো পিশাচ আবদ্ধ ছিল, সে প্রতিহিংসা নিয়েছে। তবে ওরা যে মূল্যে বিক্রয় করত, তার জন্য সম্ভবত এই ধরনের ঝুঁকি নিতে হত।'

'অধিক মূল্য, তাহলে কি ক্রেতা পায়নি?’

'কী যে বলেন? ইদানিং প্রাচীন চিরাচরিতের প্রতি কারো আগ্রহ নেই, উজ্জয়িনীর নাগরিকরা বিদেশি সামগ্রী ক্রয়ের জন্য আকুল। দেশীয় দ্রব্যের প্রতি কারো আকর্ষণ নেই। আমার অর্ধেক পসরা অবিক্রীত, কিন্তু বিকর্ণদের বিপণি মেলা শেষের পূর্বেই শূন্য হয়ে পড়েছিল।' দোকানি দুঃখের সঙ্গে বলে।

কালিদাস মাথা নাড়লেন। তাঁর অনুমান সত্য, বিকর্ণরা ভালোই লাভ করেছিল। কিন্তু সেই মুদ্রা রাখল কোথায়? হঠাৎ একটা কথা মনে হল তাঁর। তিনি শুনেছেন যে বণিকেরা পথিমধ্যে দস্যুর হাত থেকে অর্থ রক্ষার জন্য এক কৌশল অবলম্বন করে। তারা স্থানীয় কোনো কুসীদজীবীর কাছে অর্থ জমা রেখে একটি প্রমাণপত্র সংগ্রহ করে। অন্য নগরীতে বা অন্য রাজ্যে সেই কুসীদজীবীর প্রতিনিধি সেই পত্র দেখে অর্থ প্রত্যর্পণ করে, এর জন্য সামান্য কিছু দক্ষিণা দিতে হয়। রাজকোষাধ্যক্ষ বলছিলেন যে এভাবে বণিকরা কর ফাঁকিও দিচ্ছে। বিকর্ণ ও চণ্ড কি সেই পদ্ধতিই অবলম্বন করেছিল? সুমলয়কে জিজ্ঞাসা করতে হবে বিকর্ণের কাগজপত্রের মধ্যে সেই রকম কোনো পত্র আছে কিনা।

কিন্তু সব থেকে বড় কথা হল, অস্ত্রটা কোথায়? বিকর্ণ বলতেই পারে যে কর এড়ানোর জন্য সে আয়ের পরিমাণ প্রকাশ করেনি, কিন্তু হত্যার প্রমাণ কোথায়?

অদূরে একটি বিরাট শিবিকার দিকে তাঁর দৃষ্টি আকৃষ্ট হল। 'ওটি কার?’

'বহুদূর দেশ থেকে এসেছে। আপনি যদি এই কয়দিন ওই বিদেশির সামগ্রী ক্রয়ের জন্য মানুষের উৎসাহ দেখতেন, বুঝতে পারতেন। আমাদের পিতা পিতামহের কালে এমন কথা কেউ চিন্তাও করতে পারত না।' দোকানি সম্ভবত সেই সুদূর অতীতের কথা চিন্তা করেই ক্ষোভে মাথা নাড়ল।

কৌতূহলী কালিদাস সেই শিবিরের দিকে গেলেন। দরজাতে একজন প্রহরী ছিল, সে কালিদাসের পথ আটকাতে যাচ্ছিল, কিন্তু ভিতর থেকে এক শ্বেতকায় বিদেশি বেরিয়ে এসে তাকে ইঙ্গিত করে সরিয়ে দিলেন। বললেন, 'মহাকবি, আপনাকে নিকটে পেয়ে আমি ধন্য। সুদূর রোম পর্যন্ত আপনার খ্যাতি ছড়িয়েছে। আশা ছিল উজ্জয়িনীতে আপনার সাক্ষাৎ পাব, তা পূর্ণ হল। অরেলিয়াসের শিবিরে আপনাকে স্বাগত জানাই কবিবর।'

কথায় একটু টান থাকলেও অরেলিয়াস নামের সেই বিদেশীর ব্যাকরণে কোনো ভুল নেই। কালিদাসের কৌতূহল বেড়ে গেল। 'আপনি কি রোম নগরের অধিবাসী?’ রোম অনেকের কাছেই এক অর্ধকাল্পনিক শহর। প্রাচীন যবন সভ্যতার স্থান নিয়েছে এই নগরী।

'হ্যাঁ। তবে কবি, আমি সেই নগরী ছেড়েছি প্রায় এক বৎসর হয়ে গেল। আমি পূর্বেও কয়েকবার ভারত ভূখণ্ডে এসেছি, দীর্ঘদিন থেকেছি। আসুন, আপনাকে আমার পণ্য সামগ্রী কিছু দেখাই।'

কত দেশ থেকে কত রকমের সামগ্রী। অধিকাংশ স্থানের নামই কালিদাস শোনেন নি। একটি পুঁথি কালিদাসের দৃষ্টি আকর্ষণ করল। ভাষাটা অবশ্য তাঁর জানা নেই, কিন্তু চিত্র থেকে পরিষ্কার যে সেটি সূর্য চন্দ্র গ্রহাদির পরিক্রমণের উপরে লিখিত। অরেলিয়াস বললেন সেটি টলেমি নামক এক জ্যোতিষীর লেখা, সমগ্র রোম সাম্রাজ্য নাকি এই পঞ্জিকাই অনুসরণ করে। কালিদাসের সে বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান নেই, তবে জ্যোতিষবিদ্যার পণ্ডিত মাত্রেই রোমকপঞ্জিকার ব্যবহারে অভ্যস্ত। বরাহমিহির প্রায়শ বিক্রমাদিত্যের সভাতে বলেন যে সূর্যসিদ্ধান্ত ও রোমকসিদ্ধান্ত প্রায় সমতুল্য। অরেলিয়াস হাসতে হাসতে অন্য এক পুঁথি দেখালেন। বললেন, 'প্রাচীন গ্রিক জ্যোতিষীরা মহান, কিন্তু কখনো কখনো তাঁরা উদ্ভট ধারণা পোষণ করতেন। এই দেখুন, এই গ্রন্থে বলেছে সূর্য স্থির, পৃথিবী চলমান।'

'গ্রিক কারা?’ কালিদাসও হাসতে হাসতে জানতে চান।

'সংস্কৃত ভাষাতে তাদের বলে যবন।'

কালিদাস শেষ পর্যন্ত বিদায় চাইলেন। অরেলিয়াস বললেন, 'আপনাকে একটি সামগ্রী দেখাতে ইচ্ছা করি।' একটি জলভর্তি পাত্র নিয়ে কালিদাসকে বললেন, 'এর ভিতরে যে ক্ষুদ্র মূর্তিটি আছে, সেটি আপনাকে দিতে চাই।'

কালিদাস উঁকি মেরে দেখলেন পাত্রটিতে জল ছাড়া আর কিছুই নেই। জিজ্ঞাসা করলেন, 'আপনি কি আমার সঙ্গে কৌতুক করছেন?’

অরেলিয়াস হেসে বললেন, 'আপনার দৃষ্টি বিভ্রম ঘটছে। পাত্রের অভ্যন্তরে হাত দিন।'

কালিদাস তাই করলেন। হাতে কিছু ঠেকল। তুলে আনলেন জল থেকে। দেখলেন একটি কাচনির্মিত মৎস্যমূর্তি। কালিদাস অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। কাচের সামগ্রী উজ্জয়িনীতে মোটেই দুর্লভ নয়, কিন্তু তা রঙীন বা ঘোলাটে। এমন স্বচ্ছ কাচ তিনি কখনো দেখেন নি। হাতে ধরে আছেন, কিন্তু চোখ যেন তাকে অনুসরণ করতে পারছে না। বিস্ময়ে উচ্চারণ করলেন, 'অপূর্ব। এর মূল্য কত?’

অরেলিয়াস এক পা পিছিয়ে গেলেন। বললেন, ‘মহাকবি আমার তুচ্ছ উপহার স্বীকার করুন। আপনার গৃহে এটি থাকলে কখনো কখনো এই রোমককে আপনার মনে পড়বে।'

'ধন্যবাদ। এর মূল্য আমার কাছে অনেক। কিন্তু এই ভঙ্গুর বস্তুটিকে তো খুব সাবধানে রাখতে হবে।'

অরেলিয়াস হেসে বললেন, 'না কবি, এর ধর্ম এমন যে এই কাচ বেশ কঠিন, সহজে ভাঙে না। কিন্তু এ প্রায় জলের মতোই স্বচ্ছ। এটিও আলেকজান্দ্রিয়াতেই তৈরি, কিন্তু এই কাচ নির্মাণের রহস্য অতি গুপ্ত, আমারও অজ্ঞাত। এই আশ্চর্য দেখার জন্য অনেক ধনাঢ্য নাগরিক এই কাচের সামগ্রী কিনেছেন।'

কালিদাস চমকে উঠলেন, তারপরে অরেলিয়াসকে প্রশ্ন করলেন, 'আপনি কি উজ্জয়িনীতে এই সামগ্রী অনেক বিক্রয় করেছেন?’

'সে কটি এনেছিলাম সবগুলিই বিক্রীত, কেবল এই ক্ষুদ্র মৎস্যটি অবশিষ্ট ছিল। আমি এই উজ্জয়িনীর ক্রেতাদের উপরেই ভরসা করেছিলাম, ভারতের অন্য কোন নগরের নাগরিকরা এই সব দুর্মূল্য বস্তু কিনতে সক্ষম হবে? '

'ক্রেতাদের সবাইকে স্মরণ করতে পারবেন?’

'কবি, আপনি আমাকে কৌতূহলী করে তুলছেন। মাসাধিক কাল এই মেলা চলছে, সকল ক্রেতাকে মনে আনতে পারব না। কিন্তু কেন?’

'দেখলে মনে পড়বে?’

'সম্ভবত।'

'ধন্যবাদ। আমাকে যেতে হবে। আপনাকে অনুরোধ, আজ উজ্জয়িনী ত্যাগ করবেন না।'

'কৌতূহল বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ নগর ত্যাগ এমনিই আমার পক্ষে সম্ভব নয়।'

কালিদাস কোটালের কার্যশালার উদ্দেশে চললেন। সৌভাগ্যক্রমে তিনি সেখানে ছিলেন। 'সুমলয়, আততায়ীর অস্ত্র আমি খুঁজে পেয়েছি।’

'কোথায়?’

'পান্থশালায় এসো আমার সঙ্গে।'

দুজনে দ্রুতপদে পান্থশালায় পৌঁছালেন। মাঘ মাসের বেলা দীর্ঘস্থায়ী হয় না, সন্ধ্যা নামছে। মহাকাল মন্দিরে আরতি শুরু হয়েছে। কালিদাস বাইরের প্রহরীকে বললেন, 'সৌগন্ধকে বলো অবিলম্বে একটি মশাল ও একটি বস্ত্র দিতে।'

মশাল নিয়ে পান্থশালার অধিকারী নিজেই উপস্থিত। 'কী হয়েছে কবিবর?’

কালিদাস শুধু সংক্ষেপে বললেন, 'আমার সঙ্গে আসুন।'

স্নানাগারে পৌঁছে কালিদাস প্রথমে বস্ত্রটি পরে নিজের পরিধেয় খুলে রাখলেন। বললেন, 'মশালটি তুলে ধরুন।' তারপর বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে শীতল জলে ভরা পরিখাতে নেমে পড়লেন। পরিখার জল কালিদাসের কণ্ঠ পর্যন্ত উঠেছে। সকলের বিমূঢ় দৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি জলের মধ্যে এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলেন। তারপর হঠাৎ ডুব দিয়ে বিজয়গর্বে কিছু তুলে আনলেন। উপরে উঠে এসে দ্রুত অঙ্গ শুষ্ক করে নিজের বস্ত্র পরে নিলেন। 'এই নাও আততায়ীর অস্ত্র, পিশাচের নখ। আমরা ধাতুনির্মিত ছুরিকার সন্ধান করছিলাম, তাই আমাদের চক্ষুর সম্মুখের বস্তুই দেখতে পাইনি।'

মশালের আলোতে কালিদাসের হাতে ঝলমল করছে একটি স্বচ্ছ ছুরিকা। কাচ নির্মিত, দৈর্ঘ্য বিঘৎ পরিমাণ, তার অগ্রভাগটি সূচের মতো সূক্ষ্ম। কালিদাস সাবধান করে দিলেন, 'অগ্রভাগ কিন্তু অতি শাণিত।'

সুমলয় সাবধানে সুদৃশ্য ছুরিকাটি হাতে নিলেন। 'অসাধারণ, কালিদাস, অসাধারণ। কিন্তু এটি যে বিকর্ণেরই তা কী করে প্রমাণ হবে?'

'রোমক বণিক অরেলিয়াসকে এই ছুরিকা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করো সে বিকর্ণকে এটি বিক্রয় করেছে কিনা। বিকর্ণ ও চণ্ড এবারে মেলাতে অনেক লাভ করেছিল, তার অংশ থেকে চণ্ডকে বঞ্চিত করার জন্য বিকর্ণ এই হত্যা করেছে। অরেলিয়াস এই কাচ নির্মিত বস্তু বিক্রয়ের সময় সবাইকে দেখাচ্ছিল যে জলের মধ্যে তা প্রায় অদৃশ্য হয়ে যায়, তাই দেখে তার মস্তিষ্কে হত্যার পরিকল্পনা আসে; ভেবেছিল ছুরিকাটি পরিখার তলদেশে থাকলে তার সন্ধান কেউ পাবে না, কখনোই তার দোষ প্রমাণ করা যাবে না।'

'কিন্তু এটি তো কাচ নির্মিত, নিজের বিরুদ্ধে এমন প্রমাণটিকে ভেঙে ফেলেনি কেন?’

'কাচ নির্মিত হলেও এ ক্ষণভঙ্গুর নয়। একাধিক খণ্ড হলেও তাদের থেকে পূর্বের আকার অনুমান করা কঠিন হবে না। তা ছাড়া বণিক মানুষ, সহজে দুর্মূল্য বস্তুকে নষ্ট করতে চায়নি। সম্ভবত ভেবেছিল পিশাচের ভয়ে কেউ স্নানকক্ষে আসবে না, পরে কোনো অবসরে সে এটি উদ্ধার করে নেবে। কিন্তু প্রহরীর চোখ এড়িয়ে তা করতে সক্ষম হয়নি। আমি নিশ্চিত যে তুমি ওর কাগজপত্রের মধ্যে সন্ধান করলে কোনো কুসীদজীবীর কাছে অর্থ জমা রাখার প্রমাণপত্র পাবে। শম্ভকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থাও করো।'

তারপর নিজের মনেই বললেন, 'সুমলয় তুমি বলেছিলে আমি পিশাচে বিশ্বাস করি না। করি, খুব দৃঢ়ভাবেই করি। অর্থলোভ, হিংসা, পরপীড়ন এই সমস্তই তো পিশাচ। কিন্তু তারা বাইরে নয়, মানুষের মনের অভ্যন্তরে বাস করে।

 

প্রকাশঃ এ যুগের কিশোর বিজ্ঞানী শারদ 1428