Wednesday, 26 February 2025

অনুবাদে প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চা

 

 অনুবাদে প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


বিশ্ব সাহিত্যের রসাস্বাদনে অনুবাদের গুরুত্ব অপরিসীম তা নিয়ে সন্দেহ নেই। পৃথিবীর হাজার হাজার ভাষাতে যে সাহিত্য রচনা হয়ে চলেছে, অনুবাদের মাধ্যমেই তা আমাদের সকলের নাগালে আসে। উপন্যাস, ছোট গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ -- সাহিত্যের সমস্ত শাখাপ্রশাখার অনুবাদেরই চাহিদা আছে। হয়তো তাদের সম্পূর্ণ রস অনুবাদে ধরা পড়ে না, কিন্তু যা পাই তাতে অন্তত কিছুটা মনের আশা মেটে।

সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক ভাষা থেকে অনুবাদ অন্য ভাষাতে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে এমন ঘটনা নিশ্চয় বিরল নয়, কিন্তু তা সাধারণভাবে এক ভৌগোলিক অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু বিশ্বের বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাসে অনুবাদের এক বিশেষ ভূমিকা আছে। এই লেখাতে আমরা মূলত ভারতের প্রাচীন বিজ্ঞান কেমনভাবে অনুবাদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানচর্চাকে প্রভাবিত করেছিল তার সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব।

কেন এই বিশেষ বিষয়টিকেই বেছে নিয়েছি, তা বলার হয়তো একটা প্রয়োজন আছে। ইদানিং দেখছি বৈমানিক সূত্র বা বৈদিক গণিতের নাম করে একান্তই আধুনিক বইকে প্রাচীন ঋষিদের লিখিত বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের শীর্ষমহল থেকে প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞান সম্পর্কে নানা উদ্ভট দাবি শোনা যাচ্ছে; উড়োজাহাজ থেকে টেলিভিশন, মাধ্যাকর্ষণ থেকে বিবর্তনতত্ত্ব, ক্লোনিং থেকে সূর্যকেন্দ্রিক জগৎ -- এ সমস্তই নাকি প্রাচীন ভারতীয়দের জানা ছিল। দুঃখের হলেও বলতে হয় যে ইতিহাসকে অস্বীকার করে নিজের কল্পনাকে তার জায়গায় স্থান দেওয়ার এই প্রয়াসে স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যোগ দিয়েছেন অনেক বুদ্ধিজীবীও। অনুবাদের মাধ্যমেই ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চা বিদেশিদের কাছে পৌঁছেছিল। সত্যিই কোন কোন ভারতীয় চিন্তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে ছাপ ফেলেছিল, এই সংক্ষিপ্ত লেখাতে আমরা তার কিছু পরিচয় পাব। একটা কথা বলে রাখি – মহাকাব্য বা পুরাণের মধ্যে বিজ্ঞানকে খুঁজতে চাওয়ার মতো আধুনিক আহাম্মকি প্রাচীন বিজ্ঞানীরা করেননি; যে সমস্ত বইয়ের অনুবাদের কথা বলা হবে, সেগুলি প্রকৃতই বিজ্ঞানের বই। এই লেখাতে আমরা ভারতীয় বইয়ের অনুবাদের আলোচনা করছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রাচীনকালেও জ্ঞান চর্চা কখনো একমুখী ছিল না, অন্য সভ্যতাদের দানেও পরিপুষ্ট হয়েছিল প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা। একটা উদাহরণ দিই, আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ের সময় ভারত ও গ্রিক জ্ঞানচর্চার মধ্যে যোগাযোগ হয়েছিল; তার প্রমাণ রোমক সিদ্ধান্ত বা পৌলিশ সিদ্ধান্তের মতো সংস্কৃত জ্যোতিষগ্রন্থ যারা আসলে অনুবাদ।

প্রাচীন যুগ ও মধ্য যুগের বিজ্ঞানের মধ্যে যোগস্থাপন করেছিল অনুবাদ। প্রাচীন যুগ বলতে এখানে আমরা মূলত গ্রিস ও ভারতীয় বিজ্ঞানের কথা বলছি। ব্যাবিলন ও মিশরের বিজ্ঞান গ্রিক ও পরবর্তীকালে রোমান জ্ঞানচর্চাতে স্থান করে নিয়েছিল, সচেতনভাবে সরাসরি অনুবাদ তাদের হয়নি। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে ইউরোপের মূল ভূখণ্ডে গ্রিক সভ্যতার পতনের পরে বিজ্ঞানের চর্চা স্তিমিত হয়ে আসে। তার স্থান নিয়েছিল রোমান সভ্যতা যা মৌলিক বিজ্ঞানের চর্চাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। আলেকজান্ডারের স্থাপিত মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া নগরী আরো কয়েক শতাব্দী গ্রিক সভ্যতার আলো জ্বালিয়ে রেখেছিল, কিন্তু পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যেই তা নির্বাপিত হয়। একই রকম ভাবে ভারতবর্ষেও অষ্টম শতাব্দীতে শঙ্করাচার্যের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পুনরুত্থান ও কঠোর জাতপাত ব্যবস্থার পুনঃপ্রচলনের ফলে বিজ্ঞানচর্চা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এই বন্ধ্যা অবস্থা বিজ্ঞানচর্চাকে থেকে মধ্যযুগে উদ্ধার করেছিল আরব সভ্যতা। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের পরের কয়েক শতাব্দীতে ভারত থেকে শুরু করে উত্তর আফ্রিকা এবং পূর্ব ও দক্ষিণ ইউরোপ -- এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আরব সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিশেষ করে আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনকালে বিপুল উদ্যমে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা শুরু হয়, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, শারীরবিদ্যা, ভূগোল -- নতুন নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিজ্ঞানের নানা দিকে জোয়ার এসেছিল। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আরবদের মধ্যে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার বিশেষ ঐতিহ্য ছিল না। বিজ্ঞানচর্চা শূন্য থেকে শুরু করা যায় না, তার এক ভিত্তি লাগে। সেই ভিত্তি স্থাপন করেছিল অনুবাদ।

একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন; আমরা আরব সাম্রাজ্য বলতে যে বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কথা বলেছি, তার অনেকটাই বর্তমান আরব ভূখণ্ডের বাইরে। তেমনি প্রথমদিকের অনুবাদকদের অনেকেই মুসলমান ছিলেন না, ছিলেন খ্রিস্টান, ইহুদি বা হিন্দু।

প্রশ্ন আসে, হঠাৎ আব্বাসীয় খলিফাদের রাজত্বকালেই অনুবাদের সূচনা হল কেন? এ নিয়ে পণ্ডিতরা একমত নন। কথিত আছে খলিফা আল-মামুন (শাসনকাল ৮১৩-৮৩৩ সাল) একরাতে অ্যারিস্টটলকে স্বপ্নে দেখেছিলেন, তার পরে তিনি অ্যারিস্টটলের সমস্ত লেখা অনুবাদের নির্দেশ দেন। কিন্তু অনুবাদের সূচনা হয়েছিল তার অনেক আগে, আল-মামুনের ঠাকুর্দা আল-মনসুরের (শাসনকাল ৭৫৪-৭৭৫) সময়েই তা বিপুল এক প্রবাহের সৃষ্টি করেছিল। আল-মামুনকে স্বপ্ন দেখতে হলেও তো অ্যারিস্টটলের নাম জানতে হবে। তাই গল্প হিসাবে ভালো হলেও এর কোন ঐতিহাসিক মূল্য নেই।

উমাইয়া খলিফাদের সরিয়ে আব্বাসীয় বংশের শাসন শুরু হয় ৭৫০ সালে। তাদের প্রথমে রাজধানী ছিল বর্তমান ইরানের কুফাতে, ৭৬২ সালে তা বাগদাদে স্থানান্তরিত হয়। আব্বাসীয় খলিফাদের আগে অনুবাদ নিশ্চয় হত, তবে তা আরবি ভাষায় নয়। সাসানীয় শাসনে সংস্কৃত থেকে পারস্য, অর্থাৎ বর্তমান ইরানের, পাহলভি (মধ্যযুগের ফার্সি) ভাষাতে, এবং বাইজান্টাইন বা উমাইয়াদ শাসনে গ্রিক থেকে সিরিয়াক ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল জ্যোতির্বিদ্যা বা চিকিৎসা বিষয়ক অনেক বই। আব্বাসীয় খলিফাদের শাসনে আসতে সাহায্য করেছিল বিভিন্ন পারসিক গোষ্ঠী, ফলে তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা আব্বাসীয়রা করেছিলেন। সাম্রাজ্যের সরকারি ভাষা ছিল আরবি, তাই পাহলভি থেকে আরবিতে বিভিন্ন বইয়ের অনুবাদে সরকারিভাবেই পৃষ্ঠপোষণা করা হয়েছিল। সেই সময়েই গ্রিক ও ভারতীয় বইগুলির আরবিতে অনুবাদ শুরু হয়।

একই সঙ্গে এক নতুন প্রযুক্তি আরবদের হাতে আসে, তা হল কাগজ তৈরি। চিন অনেকদিন আগেই কাগজ উদ্ভাবন করেছিল। ৭৫১ সালে প্রথম আব্বাসীয় খলিফা আল-সাফার (শাসনকাল ৭৫০-৭৫৪ সাল) সৈন্যদল আধুনিক কিরগিজিস্থানে চিনা সেনাকে পরাজিত করে। যুদ্ধবন্দীদের মধ্যে কাগজ বানাতে দক্ষ কিছু সৈন্য ছিল, তাদের সাহায্যে সমরখন্দে তৈরি হয় আরব দুনিয়ার প্রথম কাগজ কল। একই সঙ্গে আঠা, রঙ, কালি ইত্যদিরও অনেক উন্নতি ঘটে, ফলে বই অনেক সহজলভ্য হয়।

অষ্টম শতাব্দীতে অনুবাদের কাজে যে জোয়ার এসেছিলে, তাতে ভাঁটা পড়ে দুই শতাব্দী পরে। তার কারণ আরব বিজ্ঞান তখন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, প্রাচীন গ্রিক বা ভারতীয় বিজ্ঞানকে অনেক ক্ষেত্রেই তা অতিক্রম করে গেছে। এর ফলে মৌলিক গবেষণার উপর জোর পড়ে, এবং অনুবাদের প্রয়োজন ফুরায়। ইসলামি সভ্যতা যখন বন্ধ্যা যুগে প্রবেশ করে, তখন আবার আরবি ভাষাতে লেখা জ্ঞানবিজ্ঞানের বই লাতিনে অনুবাদ হয়। প্রাচীন গ্রিক লেখাও আরবের মাধ্যমেই ইউরোপের পণ্ডিতদের কাছে পৌঁছায়; সে সময় ইউরোপে প্রাচীন গ্রিক পড়ে উদ্ধার করার মতো কেউ ছিল না। অনেক গ্রিক বইয়ের মূল পাঠও হারিয়ে গিয়েছিল, পরেও তাদের আর পাওয়া যায়নি। সংস্কৃত বইয়ের ক্ষেত্রেও এই ঘটনা ঘটেছে। স্পেনের টলেডো শহর ছিল আরব জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যতম কেন্দ্র, সেটি খ্রিস্টানদের দখলে আসার পরে আরবি গ্রন্থদের লাতিন অনুবাদে জোয়ার আসে। এভাবেই আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা হয়েছিল, কিন্তু সে আলোচনা এই লেখার পরিধির বাইরে। শুধু একটা উদাহরণ দিই, সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বের প্রস্তাব করা কোপার্নিকাসের যে বিখ্যাত বই আধুনিক বিজ্ঞানের সূচনা করেছিল বলে মনে করা হয়, সেই ডে রিভলিউশনিবাস অরবিটাম সেলেস্টিয়াম বইতে আরবি পণ্ডিত আল-বাত্তানির উল্লেখ আছে তেইশ বার।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনুবাদ যথাসম্ভব মূলানুগ হওয়া প্রয়োজন। পারস্যের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার কেন্দ্র ছিল গন্ডিশাপুর (বা জন্ডিশাপুর), আরবি পণ্ডিতরা সেখান থেকেই অনুবাদ গ্রন্থগুলি পেয়েছিলেন। আরবি অনুবাদকরা যখন দেখলেন যে পাহলভি বা সিরিয়াক ভাষার বইগুলি আসলে মূল সংস্কৃত বা গ্রিক থেকে অনুবাদ, তখন তাঁরা সেগুলিকে সরাসরি অনুবাদের দিকে মন দিলেন। খলিফা হারুন আল-রশিদ (শাসনকাল ৭৮৬-৮০৯) এই কাজে বিশেষ উৎসাহ দিতেন। বিশেষ করে গ্রিক গ্রন্থের প্রথম অনুবাদকরা প্রায় সবাই ছিলেন ইহুদি বা খ্রিস্টান। অন্যদিকে সরাসরি সংস্কৃত অনুবাদ অনেক সময়েই ভারতীয় পণ্ডিতদের দিয়েই করানো হয়েছিল বা তাঁদের সাহায্য নেওয়া হয়েছিল।

জ্যোতিষ বিষয়ক বইগুলি প্রথমেই আরবিতে অনুবাদ হয়েছিল। সেই সময় পারসিকরা ছিলেন জরথুস্ত্রের অনুসারী, তাঁরা তখনো ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করেননি। জ্যোতিষ ছিল তাঁদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আরবরা জ্যোতিষ পছন্দ করত না, কারণ তা ইসলাম বিরোধী। খলিফা আল-মনসুর জ্যোতিষে বিশ্বাস করতেন; কেউ কেউ অবশ্য মনে করেন তিনি পারসিক উচ্চ শ্রেণিকে আরো কাছে আনার জন্য জ্যোতিষের পৃষ্ঠপোষণা করেছিলেন। খলিফার দরবারে জ্যোতিষী নিয়োগ হয়েছিল, তারা কোষ্ঠী বিচার করত। আল-মনসুর বাগদাদে নতুন রাজধানী তৈরি শুরু করার জন্য তিনজন জ্যোতিষীর থেকে শুভ মুহূর্ত জেনে নিয়েছিলেন। জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান তখনো হাত ধরাধরি করে চলত, এই তিনজন জ্যোতিষীর একজন, আল-ফাজারি (৭৪৬-৮০৬), আরব দুনিয়ার প্রথম অ্যাস্ট্রোলেব বানিয়েছিলেন। জ্যোতিষের প্রতি আকর্ষণ থেকে শুধু পাহলভি নয়, সরাসরি সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করাও শুরু হয়েছিল। কেউ কেউ মনে করেন যে আল-ফাজারিই ব্রহ্মগুপ্তের (আনুমানিক ৫৯৮-৬৬৮) লেখা ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত প্রথম আরবিতে অনুবাদ করেছিলেন। সম্ভবত বইটির পাহলভি রূপান্তর থেকেই আরবিতে অনুবাদ হয়। আরবি ভাষায় এর নাম ছিল সিন্দহিন্দ, এবং টলেমির আলমাজেস্ট এবং ইউক্লিডের এলিমেন্টস-এর মতোই ছিল আরব বিজ্ঞান চর্চাতে এর প্রভাব। এক কাহিনিতে আছে একদল ভারতীয় জ্ঞানী ব্যক্তি কঙ্ক নামের এক চিকিৎসকের নেতৃত্বে খলিফা আল- মনসুরের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তাঁদেরই মারফত ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্ত খলিফার দরবারে পৌঁছেছিল এবং কঙ্ক সেটিকে পাহলভিতে অনুবাদ করেন। তবে বিখ্যাত পণ্ডিত আল-বিরুনি (৯৭৩-১০৪৮) সহ পরের যুগের অনেকেই এই কাহিনির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। জ্যোতির্বিদ্যার আরো বহু বই সংস্কৃত থেকে আরবিতে অনুবাদ হয়েছিল। আল-মনসুরের রাজত্বকালেই ব্রহ্মগুপ্তের বই খণ্ডখাদ্যক অনুবাদ করেন ইয়াকুব বিন তারিক, তার নাম হয় আল-আরকন্দ। আল-বিরুনি ভারতে এসেছিলেন, তিনি মূলতানে পণ্ডিত দুর্লভের থেকে জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বই করণ তিলক সংগ্রহ করে অনুবাদ করেন, নাম দেন ঘুররত আল-জিজাত।

জ্যোতির্বিদ্যার সঙ্গেই ভারতীয় গণিত আরবে প্রবেশ করেছিল। ত্রিকোণমিতিতে সুপরিচিত সাইন অপেক্ষক (Sine function)-এর নাম এলো কোথা থেকে? আর্যভাটের বিখ্যাত বই আর্যভাটিয় আরবি ভাষায় অনুবাদ হয়েছিল, সেখান থেকেই সাইন অপেক্ষক আরবি গণিতে প্রবেশ করে। সংস্কৃতে শব্দটি ছিল জ্যা-অর্ধ, সংক্ষিপ্ত আকারে তাকে বলা হত জিভা। আরবিতে '' উচ্চারণ নেই, ফলে তা হয়ে দাঁড়ায় জিবা। এর পরে লেখার সময় স্বরবর্ণ না লিখে তাকে সংক্ষেপে দুটি ব্যঞ্জনবর্ণের সাহায্যে লেখা হল, যাকে রোমান অক্ষরে লিখলে হয় jb। লাতিনে অনুবাদের সময় ভুল করে তাকে পড়া হয় jayb (জেব), যার অর্থ পকেট। পকেটকে লাতিনে বলে sinus, যার থেকে শেষ পর্যন্ত sine শব্দটির আবির্ভাব।

বিশেষ করে বলতে হয় ভারতীয় সংখ্যাপাতনের পদ্ধতির কথা, দশটি চিহ্ন ব্যবহার করে যে কোনো সংখ্যা লেখার বর্তমান পদ্ধতিটি ভারতীয়দেরই উদ্ভাবন, যদিও অনুরূপ পদ্ধতি আগে অন্যত্র ব্যবহার হয়েছিল বলে জানা গেছে। মূলত সিন্দহিন্দ ও আল-আরকন্দের থেকেই আরবে এই পদ্ধতির ব্যবহার শুরু হয়। আরবি পণ্ডিতদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত গণিতজ্ঞ আধুনিক বীজগণিতের অন্যতম স্রষ্টা আল-খোয়ারিজমি (আনুমানিক ৭৮০-৮৫০); তাঁর লেখার অনুবাদের মাধ্যমে সংখ্যাপাতনের এই পদ্ধতি ইউরোপে পৌঁছায় এবং আরবি পদ্ধতি নামে পরিচিত হয়। আরবি বইতে অবশ্য সব সময়েই একে ভারতীয় পদ্ধতি বলা হয়েছে, যেমন আল-কিন্দির সংখ্যাপাতন সংক্রান্ত বইয়ের নাম ছিল কিতাব ফি ইস্তিমাল আল-আদাদ আল-হিন্দি। আল-খোয়ারিজমির এই সংক্রান্ত বইয়ের নাম ছিল সম্ভবত কিতাব আল-আদাদ আল-হিন্দি যার লাতিন অনুবাদের নাম অ্যালগরদমি দে নুমেরো ইন্ডোরাম। বিখ্যাত গণিতবিদ লাপ্লাসের বইতেও একে ভারতীয়দেরই উদ্ভাবন বলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি যে সংখ্যাপাতনে শূন্যের ব্যবহার ভারতীয়রা ব্যাপকভাবে শুরু করলেও অনেক আধুনিক ঐতিহাসিক চিনে এর প্রথম ব্যবহারের ছাপ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছেন। আবার দশমিক পদ্ধতি যে বহু দেশেই স্বাধীনভাবে ব্যবহার শুরু হয়েছিল তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য মীরা নন্দার Science in Saffron বইটি দ্রষ্টব্য। তবে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে ব্যবহৃত সংখ্যাপাতন পদ্ধতি যে আরবের মাধ্যমে ভারত থেকেই ইউরোপে গিয়েছিল তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

অপর যে বিজ্ঞানের অনুবাদ বিশেষ করে আরবি বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছিল, তা হল চিকিৎসাবিজ্ঞান; আরো নির্দিষ্ট করে বললে চরক ও সুশ্রুত সংহিতা। এদের মধ্যে প্রথমটিতে ঔষধ ও দ্বিতীয়টিতে অস্ত্রোপচার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কাছে। চরক বা সুশ্রুতের নামে প্রচারিত হলেও এগুলি সম্ভবত বিভিন্ন সময়ে অনেকের অবদানে রচিত হয়েছিল। গ্রিক চিকিৎসা বিজ্ঞান মূলত গ্যালেনের গবেষণার উপরে নির্মিত; দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দেখিয়েছেন যে ভারতীয় সংহিতা দুটি গ্যালেনের থেকে অনেকদিকেই উৎকৃষ্টতর ছিল। অবশ্য তিনি এও দেখিয়েছেন যে পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্যধর্ম কেমনভাবে ভাববাদ ও জাতপাত ব্যবস্থাকে এই দুইয়ের উপরে চাপিয়ে তাদের বিজ্ঞানচিন্তাকে পিছনে ঠেলে দিয়েছিল; তবে সে ইতিহাস আমাদের আলোচনার বাইরে।

সুশ্রুত সংহিতার অনুবাদ করেছিলেন মাণিক্য (বা মানক) নামের এক ভারতীয় চিকিৎসক, কথিত আছে হারুন আল-রশিদের চিকিৎসার জন্য তাঁকে বাগদাদে আমন্ত্রণ করা হয়েছিল। কিতাব-উল-সুস্রুদ নামে এই অনুবাদটি পরিচিত। তিনি ভারতীয় ওষুধের বিষয়ে একটি বইয়েরও অনুবাদ করেন। মাণিক্য হয়তো চরক সংহিতাও পারসিক ভাষায় অনুবাদ করছিলেন। পারসিক থেকে সেটিকে আরবিতে অনুবাদ করেন আবদুল্লা বিন আলি আল-দানদানি। ভাগবত রচিত অষ্টাঙ্গহৃদয় বইটিকে অনুবাদ করেন বাগদাদ হাসপাতালের প্রধান ইবন দাহান। তাঁর আসল নাম ধনপতি, ভারত থেকে তাঁকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আরো অনেকগুলি চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত সংস্কৃত গ্রন্থ বিভিন্ন সময় আরবিতে অনুবাদ হয়েছিল। আরবিতে ব্যবহৃত বেশ কিছু ওষুধ বা চিকিৎসা বিষয়ক শব্দের উৎস সংস্কৃত ভাষা, যেমন স্যান্ডাল (চন্দন), কফুর (কর্পূর) ইত্যাদি। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বইগুলি কেমনভাবে আরবি বিজ্ঞানকে প্রভাবিত করেছিল, তার বিস্তারিত আলোচনা এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে সম্ভব নয়। মধ্যযুগের বিখ্যাত চিকিৎসক আল-রাজি (আনুমানিক ৮৬৫-৯২৫), আধুনিক চিকিৎসাবিদ্যার জনক বলে পরিচিত ইবন সিনা বা আভিসেন্না (৯৮০-১০৩৭), প্রমুখ তাঁদের বইতে আয়ুর্বেদ বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। আল-তাবারি (৮৩৯-৯২৩) তাঁর ফিরদৌস আল-হিকমা বইতে ভারতীয় ও গ্রিক চিকিৎসাবিদ্যা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন।

এই পরিমাণে না হলেও কিছু ভারতীয় বইয়ের অনুবাদ চিনা ভাষায় হয়েছিল। মূলত বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থের অনুবাদ হলেও বিজ্ঞানের বইও বাদ যায়নি। তার ইতিহাসও সুপ্রাচীন। সম্ভবত খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দীতে মাতঙ্গীসূত্র চিনা ভাষায় অনুবাদ করেন চু লু-ইয়েন ও চি-চিয়েন, সেই গ্রন্থে জ্যোতির্বিদ্যার পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ ছিল। তবে শুধু অনুবাদ নয় , সেখানে তাঁরা নিজেদের কিছু পর্যবেক্ষণও লিপিবদ্ধ করেছিলেন। মহারত্নকূটসূত্রে বড় বড় সংখ্যা লেখার পদ্ধতি বর্ণনা করা ছিল। ইয়ুহে-ফো-সোউ-না (উপশূন্য) নামের এক ভিক্ষু ষষ্ঠ শতাব্দীতে সেটির অনুবাদ করে নাম দেন তা পাও চি চিং। সপ্তম শতকে লেখা চিনের ইতিহাসে বেশ কিছু বইয়ের নাম পাওয়া যায় যাদের শুরু হয়েছিল পো-লো-মেন এই শব্দ দিয়ে। পো-লো-মেন অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, সে যুগে চিনে ভারতীয় বইকে এই নামেই ডাকা হত। পো-লো-মেন থিয়েন ওয়েন চিং অর্থাৎ ব্রাহ্মণ জ্যোতির্বিদ্যা, পো-লো-মেন সুয়ান ফা বা ব্রাহ্মণ গণিত, পো-লো-মেন ইন ইয়াং সিয়ান লি বা ব্রাহ্মণ পঞ্জিকা, পো-লো-মেন ইয়াওফ্যাং বা ব্রাহ্মণ জ্যোতির্বিদ্যা, এমন নানা বইয়ের নাম পাওয়া গেলেও তারা কোন বইয়ের চিনা ভাষায় অনুবাদ, অনুবাদক কে ইত্যাদি জানার কোনো উপায় নেই।

আরব বলতে যেমন আমরা আধুনিক ভূগোলের বাইরের এক বিশাল ভূখণ্ডকে বুঝিয়েছি, তেমনি প্রাচীন ভারত বলতেও এখানে ভারত পাকিস্তান আফগানিস্থান উজবেকিস্থান তাজিকিস্থান সহ এক বিরাট অঞ্চলের কথাই বলছি। যেমন পু খেং বা অমোঘবজ্রের জন্ম হয় বর্তমান উজবেকিস্থানের সমরখন্দে, তিনি সপ্তম শতাব্দীতে বৌদ্ধ জ্যোতিষ থেকে অনুবাদ করে যে বই লেখেন তার নাম ছিল সি চিয়াও চিং। শুধু যে চিনা পণ্ডিতরা বই অনুবাদ করেছিলেন তা নয়, ভারত থেকে পণ্ডিতরা গিয়ে চিনের সম্রাটদের অধীনে বংশপরম্পরায় কাজ করেছেন। এরকম তিনটি বংশের কথা জানা আছে, তারা হল কুমার, কাশ্যপ ও গৌতম। বিশেষ করে গৌতম বংশ দীর্ঘদিন প্রধান জ্যোতির্বিদের পদ নিজেদের দখলে রেখেছিল। মৌলিক কাজের পাশাপাশি এই সমস্ত বংশের মানুষরা সংস্কৃত থেকে মূল পুঁথি অনুবাদ করে সেগুলি নিজেদের বইতে রেখে দিতেন। যেমন চুথান সি তা (গৌতম সিদ্ধার্থ) অষ্টম শতকের প্রথমভাগে নবগ্রহ পঞ্জিকা অনুবাদ করে চিনের জ্যোতির্বিদ্যার বিশ্বকোষে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। প্রাচীন চিনের জ্যোতির্বিদ্যার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানের সব থেকে বড় উৎস হল সেই গৌতম সিদ্ধার্থের সংকলিত বিশ্বকোষ।

আরবির ও চিনের অনুবাদের ইতিহাসের এক মৌলিক পার্থক্য আছে; চিনে পরবর্তীকালে জ্যোতির্বিদ্যা বা গণিতে এদের কোনো ছাপ পড়েনি। উদাহরণ স্বরূপ গৌতম সিদ্ধার্থের বইতে একটি ত্রিকোণমিতির টেবিল ছিল যেটি স্পষ্টতই সংস্কৃত উৎস থেকে নেওয়া, এবং সেটিই চিনে ত্রিকোণমিতির প্রথম নিদর্শন। অথচ এর পরের আড়াইশো বছরে চিনে ত্রিকোণমিতি ব্যবহারের কোনো নিদর্শন নেই। এই পার্থক্যের কারণ কী হতে পারে? একটা কারণ সম্ভবত এই যে আরব সভ্যতার উষালগ্নে জ্ঞানবিজ্ঞানচর্চার বিশেষ কোনো পরম্পরা ছিল না। ফলে গ্রিক, রোমান, চিনা বা ভারতীয় উৎস থেকে পাওয়া জ্ঞানকে আত্মীকৃত করতে তার কোনো অসুবিধা হয়নি। হয়তো চিনের সভ্যতার দীর্ঘ ইতিহাস বাইরে থেকে আসা জ্ঞানকে নিজের করে নিতে বাধা দিয়েছিল।

এই প্রসঙ্গে অন্য একটি কথাও মনে হয়। আরবি ভাষাতে অনুবাদের সূত্রেই পরের যুগের পণ্ডিতরা প্রাচীন যুগকে ছাড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। হাজার বছর ব্যাপী অন্ধকার যুগের পরে আমাদের দেশে আধুনিক বিজ্ঞান এসেছিল ইউরোপিয় ঔপনিবেশিকদের হাত ধরে, কিন্তু শিক্ষার বাহন ছিল বিদেশি ভাষা। ভারতীয় ভাষাতে আধুনিক বিজ্ঞানের বই অনুবাদের প্রয়াস বিশেষ হয়নি, এখন যে সেদিকে বিশেষ জোর পড়েছে তা নয়। এই কারণেই হয়তো আমাদের দেশে বিজ্ঞান সংস্কৃতির শিকড় খুব গভীরে যায় নি; বিদেশি ভাষাতে লেখা বিজ্ঞান সাধারণ মানুষের কাছে অবোধ্যই থেকে গেছে। মাতৃভাষাতে বিজ্ঞানশিক্ষার পক্ষে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি।

এই লেখাতে যেসব বইয়ের সাহায্য নেওয়া হয়েছেঃ

Abdul Ali, Indian origins of Arab-islamic Scientific and Literary Heritage (Prints Publication, 2022)

অমর্ত্য সেন, তর্কপ্রিয় ভারতীয় (আনন্দ, ২০০৭)

Debiprasad Chattopadhyay, History of Science and Society in Ancient India (K P Bagchi and Co, 1977)

Jim Al-Khalili, Pathfinders: The Golden Age of Arabic Science (Allan lane, 2010)

Joseph Needham, Science and Civilization in China, Vol. 2 (Cambridge University Press, 1956)

 

অন্য লেখা পত্রিকা কলকাতা বইমেলা ২০২৫




Friday, 21 February 2025

ভারতে বিজ্ঞানঃ বস্তুবাদী দর্শন বনাম ভাববাদী আগ্রাসন

 

ভারতে বিজ্ঞানঃ বস্তুবাদী দর্শন বনাম ভাববাদী আগ্রাসন


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


বিজ্ঞানের মূলে আছে বস্তুবাদ। সেই মতবাদ বিশ্বাস করে বস্তুই সব কিছুর মূল; নানা বস্তু ও তাদের মধ্যে পারস্পরিক ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া থেকেই সমস্ত ঘটনার ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। অবশ্য খুব সহজে এ ধারণাতে পৌঁছানো যায়নি। বস্তুবাদকে প্রথম থেকেই সংগ্রাম করতে হয়েছে ভাববাদের বিরুদ্ধে। ভাববাদের মূল কথা হল যে চেতনাই প্রথম, বস্তুর উদ্ভব তার থেকে। সমস্ত ধর্মের মূলে আছে ভাববাদ, যেখানে এক বা একাধিক দেবদেবীর কল্পনা করা হয়েছে। বিজ্ঞানে ভাববাদ ও বস্তুবাদের সেই সংগ্রাম এখনো চলছে। এই লেখাতে আমরা আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকেই ভাববাদ কেমনভাবে বিজ্ঞানের দর্শনের উপর আগ্রাসন চালিয়েছে, তার ইতিহাস সংক্ষেপে ফিরে দেখব।

প্রাচীন যুগের বিজ্ঞানের কথা আলোচনার সময় একটা কথা মনে রাখতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞানের মূলে আছে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা। তার থেকে যে জ্ঞান লাভ করা যায়, তার থেকে আরোহী দর্শনের যুক্তিজাল প্রয়োগ করে আমরা সাধারণ সত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করি। পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষাতে ভুল বা সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে, তাই বিজ্ঞান সাধারণ সত্যকেও পরিবর্তন করতে সবসময়েই প্রস্তুত থাকে। আধুনিক বিজ্ঞান পরীক্ষানিরীক্ষার উপর যে গুরুত্ব দেয়, কোনো প্রাচীন সভ্যতাই তা দেয়নি। বিজ্ঞানের তখন শৈশব অবস্থা, তার পক্ষে অধিকাংশ প্রাকৃতিক ঘটনার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব ছিল না। কাজেই প্রাচীন যুগের বিজ্ঞান মূলগতভাবে আমরা এখন বিজ্ঞান বলতে যা বুঝি তার থেকে পৃথক। কিন্তু প্রাচীন যুগের বিজ্ঞানের সুচনাতেও ছিল বস্তুবাদ, তাকে ছাড়া প্রকৃত বিজ্ঞানের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। অপরদিকে চেতনা বা চিন্তাই যেহেতু ভাববাদে প্রথম, তার মূলগত দর্শন তাই অবরোহী। অর্থাৎ সেখানে সিদ্ধান্ত আসে আগে, তার থেকে পর্যবেক্ষণ বা পরীক্ষার ব্যাখ্যা হাজির করা হয়।

আমাদের দেশে কণাদ ছিলেন পরমাণুবাদের উদ্গাতা। পরমাণুবাদের মুল কথা হল আমরা যা কিছু দেখতে পাই সব কিছুর মূলেই আছে পরমাণু। বিভিন্ন রকম পরমাণু নানা ভাবে পরষ্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে জগতের সমস্ত কিছু গটয়হন করেছে। পরমাণুদের বাস্তব অস্তিত্ব আছে, তাদের সৃষ্টি বা ধ্বংস করা যায় না। প্রাচীন যুগের পরমাণুবাদের সঙ্গে আধুনিক পরমাণুবাদের বিশেষ মিল নেই, কিন্তু দুটি মতই বলে বস্তুর সমস্ত ধর্ম তার ভিতরের পরমাণুদের থেকেই আসে, তার সঙ্গে ঈশ্বর বা চেতনার কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ তারা নিখাদ বস্তুবাদী।

কণাদের পরে বৌদ্ধ ও জৈন দার্শনিকরা পরমাণুবাদের চর্চা করেছিলেন। এই দুই দর্শনে ঈশ্বর বা ভগবানের বিশেষ স্থান নেই, তাই প্রথমে অন্তত পরমাণুবাদের সঙ্গে তাদের মূলগত কোনো বিরোধ হয়নি। নবম শতাব্দীর সূচনাতে শঙ্করাচার্য যখন বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মের পুনরুত্থানের নেতৃত্ব দেন, তখন তিনি পরমাণুবাদের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। শঙ্করাচার্যের মায়াবাদ বলে যে ব্রহ্ম সত্য জগৎ মিথ্যা। স্পষ্টতই তা ভাববাদী, কারণ সেখানে একমাত্র চেতনাকেই বাস্তব বলে স্বীকার করা হয়েছে। পরমাণুর সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, তাকে মায়াবাদের সঙ্গে মেলানো সম্ভব নয়। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত বই A History of Hindu Chemistry-তে লিখেছেন, “The Vedanta philosophy, as modified and expanded by Sankara, which teaches the unreality of the material world is also to a large extent responsible for bringing the study of physical science into disrepute. Sankara is unsparing in his stricture on Kananda and his system.” আমাদের দেশে প্রাচীন কালে বিজ্ঞানের অগ্রগতি বন্ধ হওয়ার পিছনে জাতিভেদ প্রথার পাশাপাশি এই ভাববাদী প্রতিক্রিয়াকে একটা বড় কারণ বলেই প্রফুল্লচন্দ্র সিদ্ধান্ত করেছেন। বৌদ্ধ দর্শনেও একই ঘটনা ঘটেছিল। দ্বিতীয় শতাব্দীতে বিখ্যাত বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন যে শূন্যবাদ প্রচার করেন তা অনুযায়ী জগৎ অবর্ণনীয়। স্বাভাবিক ভাবেই যাকে বর্ণনা করা যায় না, তার উপাদান বা গঠন নিয়ে চর্চাও অর্থহীন। বিপরীতে বিজ্ঞানের একটা মূল লক্ষ্য হল বস্তুজগতের সম্পর্কে জ্ঞানলাভ। একই সঙ্গে শঙ্করাচার্য বা নাগার্জুনের দর্শন কার্য-কারণ সম্পর্ককে অস্বীকার করে। বিজ্ঞানের একটা মূল কথা হল যে কোনো কার্যের পিছনেই একটা কারণ আছে, এবং সেই কারণ অবশ্যই আমাদের বাস্তব জগতের মধ্যেই অবস্থান করে। এখানে কোন রকম দৈব বা ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই।

প্রাচীন ভারতে যে বিজ্ঞান কিছুটা বস্তুবাদকে আশ্রয় করে বিকশিত হয়েছিল তা হল আয়ুর্বেদ অর্থাৎ চিকিৎসাশাস্ত্র। চরক বা সুশ্রুত সংহিতার তুলনীয় কিছু কোনো প্রাচীন সভ্যতাতে পাওয়া যাবে না। চিকিৎসাশাস্ত্র স্বাভাবিক ভাবেই বস্তুবাদী, কারণ তা রোগের কারণ নির্ণয় করে তাকে উপশমের চেষ্টা করে। সেখানে দৈবের কোনো স্থান নেই। দুই সংহিতাতেই তাই প্রত্যক্ষ অর্থাৎ পর্যবেক্ষণের উপরে জোর দেওয়া হয়েছে, তাকে সব রকম সাক্ষ্যের উপরে বসানো হয়েছে। দেবদেবী বা পরলোকের অস্তিত্বের কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই, প্রত্যক্ষ প্রমাণের উপর নির্ভর করতে শুরু করলে তাঁদের থেকে মানুষের বিশ্বাস টলে যাবে। ধর্মশাস্ত্রে তাই ঠিক উল্টো কথা পাওয়া যায়। বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে, 'পরোক্ষ-প্রিয়াঃ ইব হি দেবাঃ, প্রত্যক্ষ-দ্বিষঃ।’ দেবতারা পরোক্ষ প্রিয়, প্রত্যক্ষের প্রতি তাঁদের বিদ্বেষ।

প্রত্যক্ষ প্রমাণের অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে এসেছে বস্তুবাদ। সুশ্রুত সংহিতাতে বলা হয়েছে, 'ভূতেভ্যঃ হি পরং যস্মৎ নাস্তি চিন্তা চিকিৎসিতে', অর্থাৎ ভূতবাদ বাদ দিয়ে চিকিৎসা সম্ভব নয়। এখানে ভূত অর্থ পঞ্চভূত, যা বস্তুকেই সূচনা করে। দেহের চিকিৎসা করতে হবে, সে জন্য দেহ কী থেকে উৎপন্ন জানতে হবে। চরক সংহিতাতে বলা হয়েছে, 'দেহঃ হি আহার সম্ভবঃ', আহার থেকেই দেহের উৎপত্তি। চরক সংহিতাতে হাজারের বেশী গাছগাছড়া এবং দেড়শোর বেশী জন্তুজানোয়ারের কথা আছে। ফলমূল শিকড়বাকড় থেকে শুরু করে জন্তুজানোয়ারের রক্তমাংস থেকে মূত্র পর্যন্ত কীভাবে ব্যবহার করতে হবে তার আলোচনা করা আছে। প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের এ এক অসাধারণ সংকলন। প্রাচীন ভারতে চিকিৎসাবিদ্যা কোন স্তরে পৌঁছেছিল এ থেকে অনুমান করা যায়।

বস্তুবাদের প্রতি এই আনুগত্য সমাজপতিদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রাচীন ভারতের ধর্মের একটা মূল কথা ছিল যে জাগতিক সমস্ত দুঃখের কারণ হল পূর্বজন্মের কর্ম। যাগযজ্ঞের মাধ্যমে কর্মফল থেকে নিস্তার পাওয়া যেতে পারে। চিকিৎসক যদি রোগজ্বালার উপশম ঘটাতে সক্ষম হন, তাহলে যাগযজ্ঞ বা পূজাআচ্চার উপর মানুষের বিশ্বাস টলে যেতে পারে। সেই কারণে ঋক্‌বেদে চিকিৎসক উচ্চ আসনে থাকলেও যজুর্বেদ বা মনুসংহিতাতে তাকে নামানো হয়েছে চণ্ডালের স্তরে। তাকে সামাজিকভাবে বর্জন করার কথা বলা হয়েছে।

চরক ও সুশ্রুত দুই সংহিতাতেই তাই অনেক পরস্পরবিরোধী কথা পাওয়া যায় যেগুলি স্পষ্টতই পরে ঢোকানো হয়েছে। চরক সংহিতাতে প্রয়োজনে রোগীকে গোমাংস খাওয়ানোর বিধান দেওয়া হয়েছে। এবং সেখানেই বহু জায়গায় গোব্রাহ্মণের জয়গান গাওয়া হয়েছে। বারবার সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবে মোক্ষ বা মুক্তির কথা এসেছে। চরক সংহিতাতে কোথাও বলা আছে যে রোগের নিরাময় চারটি স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে থাকে -- রোগী, চিকিৎসক, পরিচর্যাকারী এবং ঔষধপথ্য। আবার অন্যত্র বলা হয়েছে ব্রাহ্মণের স্থান চিকিৎসকের উপরে, সে ব্রাহ্মণের কথামতো চলতে বাধ্য। স্পষ্টতই ভাববাদের আগ্রাসনের সামনে পড়ে সমাজপতিদের সন্তুষ্ট করে চিকিৎসাশাস্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যই এই সমস্ত কথা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিদ্যার ক্ষেত্রে প্রায় একই ধরনের নানা উদাহরণ পাওয়া যায়। চাঁদ ও পৃথিবীর ছায়াই যে সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণের সঠিক কারণ তা আমাদের দেশে প্রথম বলেছিলেন আর্যভাট। কিন্তু পরবর্তীকালে বরাহমিহির, লল্ল, ব্রহ্মগুপ্তের মতো জ্যোতির্বিদরা তাঁর বিরোধিতা করেন। বিশেষ করে কৌতূহল জাগায় ব্রহ্মগুপ্তের আচরণ। ব্রহ্মস্ফুটসিদ্ধান্তে তিনি ঘোষণা করেন বেদে আছে বা মনু বলেছেন রাহুগ্রাসই গ্রহণের জন্য দায়ী, সেটাই সত্য। আর্যভাটের ধারণা সত্য হলে ব্রাহ্মণরা গ্রহণের সময় যে সমস্ত আচরণ পালন করে, তা অর্থহীন হয়ে পড়বে। কিন্তু সেই একই বইতে কিছু পরে ব্রহ্মগুপ্ত চন্দ্রগ্রহণের সময় পৃথিবীর ছায়ার মাপ বার করেছেন বা সূর্যগ্রহণের সময় চাঁদের ব্যাস মাপার চেষ্টা করেছেন। ভাববাদের আগ্রাসনের মুখে পড়ে বস্তুবাদী ব্যাখ্যাকে বাঁচাতে ব্রহ্মগুপ্তকেও ছলনার আশ্রয় নিতে হল।

ভাববাদ ও বস্তুবাদের এই বিরোধ আজও চলে আসছে। প্রফুল্লচন্দ্রের মৃত্যুর পরে তাঁর A History of Hindu Chemistry-র নতুন সংস্করণের সম্পাদনা করেন তাঁর অন্যতম প্রিয় ছাত্র প্রিয়দারঞ্জন রায়। সেখানে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞানে অধোগতিতে শঙ্করাচার্যের বেদান্তের ভূমিকা সম্পর্কে প্রফুল্লচন্দ্রের মন্তব্যগুলি কোনো মন্তব্য না করেই বর্জন করেন। প্রফুল্লচন্দ্রের বইতে দুটি অধ্যায় লিখেছিলেন বিখ্যাত দার্শনিক ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। চরকসংহিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন যে প্রাচীন দার্শনিকরা শুধুমাত্র চিন্তা করেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পৌঁছেছিলেন, চিকিৎসকরা সেই পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তিনি লিখলেন, '... the various Pramana-s, proofs, i.e. source of valid knowledge, in Hindu Logic, ... are only operations subsidiary to the ascertainment of Truth'। অবরোহী দর্শনের প্রভাব এখানে স্পষ্ট। ব্রজেন্দ্রনাথের মতো দার্শনিকও এই ভাববাদী প্রবণতা থেকে মুক্ত হতে পারেননি!

অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগে আমরা ভাববাদী আগ্রাসনকে নানা রূপে দেখতে পাই। সরকারি উচ্চমহল থেকে বিজ্ঞানের কথা প্রচার করা হচ্ছে, কিন্তু বিজ্ঞানের মূল দর্শন বস্তুবাদকেই অস্বীকার করা হচ্ছে। ইন্টারনেট, স্টেম সেল চিকিৎসা বা এরোপ্লেনের মতো আধুনিক উদ্ভাবন ও আবিষ্কারকে পুরাণ ও ধর্মগ্রন্থের মধ্যে খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আগ্রহ সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে। একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে এগুলি ভাববাদী আগ্রাসনের উদাহরণ। ধরা যাক বৈমানিক শাস্ত্রের কথা। দাবি করা হয় যে প্রাচীন মুনিঋষিরা শুধুমাত্র চিন্তা করেই বিমান নির্মাণের প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছিলেন। যে কোনো প্রযুক্তির পিছনে থাকে পরীক্ষানিরীক্ষা, ভুল করা ও তাকে সংশোধন করা, ইত্যাদি; হাতে কলমে কাজ ছাড়া যা সম্ভব নয়। বস্তুত ভাষাতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে বোঝা যায় বইটি নিতান্তই অর্বাচীন, সহজ কথায় জাল। তার কোনো পুরানো পুঁথি কোথাও পাওয়া যায়নি।

ভাববাদ আমাদের বিজ্ঞানীদের একটা বড় অংশকে আজও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী পুষ্প মিত্র ভার্গব ও ঐতিহাসিক আবদুর রহমান ১৯৬৪ সালে স্থাপন করেছিলেন সোসাইটি ফর সায়েন্টিফিক টেম্পার। সদস্য হয়েছিলেন বিদেশের অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী, যাঁদের মধ্যে নোবেলজয়ী ফ্রান্সিস ক্রিকের নাম উল্লেখযোগ্য। সংস্থার সদস্যপদ লাভের জন্য একটি বিবৃতিতে সই করতে হত। বিবৃতিটির অনুবাদ করলে হয়, 'আমি বিশ্বাস করি যে একমাত্র মানুষের প্রচেষ্টাটার মাধ্যমেই জ্ঞান অর্জন সম্ভব, কোনো দৈবানুগ্রহে নয়। আধিদৈবিক শক্তির কাছে প্রার্থনা না করে মানুষের বৌদ্ধিক ও নৈতিক শক্তির সাহায্যেই সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।' তাঁরা দেশের বহু বিজ্ঞানীর কাছে সেই বিবৃতিটি স্বাক্ষরের জন্য পাঠিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো সাড়া পাননি বললেই চলে।

আধুনিক যুগেও ভাববাদের কাছে এই আত্মসমর্পণের কারণ কী? আমাদের দেশে বিজ্ঞানর্চার একটা মূল সমস্যা হল আমাদের সমাজে কোনো বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়নি। আমাদের নবজাগরণ আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্যের ভালোমন্দ বিচার না করেই তার সঙ্গে সমঝোতা করেছিল। প্রাচীন সমাজের পশ্চাদমুখী ধ্যানধারণা এবং তার উপর চাপিয়ে দেওয়া উপনিবেশিক চিন্তাধারা দেশে বিজ্ঞানমনস্কতার প্রসারে বাধা দিয়েছে। ফলে অনেক বিজ্ঞানীই প্রকৃত অর্থে বিজ্ঞানমনস্ক নন। তাই মহাকাশযান উৎক্ষেপণের আগে তাঁরা মন্দিরে পুজো দিতে যান, থিসিস জমা দেওয়ার আগে গঙ্গাস্নান করেন। পাঠক্রমে ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেমের নাম করে গাল্পগল্প ও কল্পনাকে জায়গা করে দেওয়ার বিপক্ষে বিশেষ প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় না।

সম্পূর্ণ ভাববাদী অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বও কখনো কখনো প্রাতিষ্ঠানিক সমর্থন লাভ করে। ডারউইন-ওয়ালেসের বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধিতাতে ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন নামের ভাববাদী তত্ত্বকে খাড়া করা হয়েছে; কলকাতার এক বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এই বিষয়ে এক বক্তৃতা পর্যন্ত আয়োজন করা হয়েছিল। অনেক সময়েই এই ধরনের সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক মতকেও প্রচারের ব্যবস্থা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই করা হয়, যুক্তি দেখানো হয় যে খোলা মনে সমস্ত কিছু বিচার করা প্রয়োজন। এই যুক্তি প্রসঙ্গে বলতে হয় যে একটা ন্যূনতম মাপকাঠিকে না পূরণ করতে পারলে কোনো মতকে বিজ্ঞানে প্রবেশাধিকার দেওয়া উচিত নয়। তা না হলে পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্ব বা ডাইনি প্রথাকেও আমাদের খোলা মনে বিচার করতে হবে। এই ধরনের ছিদ্র দিয়েই পশ্চাৎমুখী ভাববাদ মূলধারার বিজ্ঞানে প্রবেশ করে।

ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনকে ভাববাদী বলছি কেন? ডারউইন-ওয়ালেস প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের যে তত্ত্বের প্রস্তাব করেছিলেন, আজ প্রায় পৌনে দু'শো বছর পরে তা দৃঢ় ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। জীববিদ্যার বহু ক্ষেত্রকে একমাত্র সেই তত্ত্বের মাধ্যমেই ব্যাখ্যা করা সম্ভব। বিবর্তন সম্পূর্ণ এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল (random), তার কোনো উদ্দেশ্য নেই। প্রথম সরল প্রাণ থেকে বর্তমানের জীবজগতের সৃষ্টির পিছনে কোনো চিন্তা কাজ করে না। সেই কারণে বিবর্তন তত্ত্ব সম্পূর্ণ বস্তুবাদী, এবং স্বাভাবিকভাবেই ভাববাদীদের চক্ষুশূল। প্রথম যুগে বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধিতা করেছিল বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব। তার পরাজয়ের পরে তাকে ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনের নতুন মোড়কে হাজির করা হয়েছে। এই তত্ত্বে বলা হয় যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ও জীবগগতের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করতে গেলে ধরে নিতে হবে যে আদিতে কোনো এক চিন্তা কাজ করেছিল। সহজ কথায় জটিল ডিজাইন থাকলে ধরে নিতে হবে যে তার পিছনে এক ডিজাইনার আছে, এভাবেই ঈশ্বর সম্পর্কিত চিন্তাকে আধুনিক বিজ্ঞানের দর্শনে ঢোকানোর চেষ্টা চলছে। প্রাচীন সৃষ্টিতত্ত্বের মতোই ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন তত্ত্বের স্বপক্ষেও কোনো প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, তবু বিংশ শতাব্দীর শেষ থেকে একে বিবর্তনবাদের বিপক্ষে দাঁড় করানো হয়েছে। এর পিছনে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্ষণশীল খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান ডিসকভারি ইনস্টিটিউট। কোনো প্রতিষ্ঠিত জীববিজ্ঞানী ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনকে সমর্থন করেন না, কিন্তু ডিসকভারি ইনস্টিটিউটের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার জন্য এই মতকে প্রায়ই খবরের শিরোনামে দেখা যায়।

আমাদের দেশেও বিবর্তন তত্ত্বকে ভাববাদী আগ্রাসনের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। এই ক্ষেত্রে আক্রমণের দুটি রূপ আছে। একটি হল সরাসরি অস্বীকার, যেমন কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দপ্তরের মন্ত্রী সরাসরি বলেন বিবর্তন তত্ত্ব মিথ্যা, কারণ কেউ এক জীবকে অন্য জীবে বিবর্তিত হতে দেখেনি। বিবর্তন তত্ত্ব সম্পর্কে সামান্য পড়াশোনা করলেই জানা যায় যে সাধারণভাবে বিবর্তন অত্যন্ত ধীর প্রক্রিয়া, কাজেই তাকে মন্ত্রীমশায় যা দেখতে চেয়েছিলেন, সেই বানরকে মানুষে হতে দেখার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু অতি সরল জীবের ক্ষেত্রে বিবর্তন সহজেই দেখা যায়। মন্ত্রীমশায় কি ড্রাগরেজিস্ট্যান্ট ব্যাকটেরিয়ার কথা শোনেন নি? তাকে তিনি কেমনভাবে ব্যাখ্যা করবেন?

দ্বিতীয় একটি আক্রমণ ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনেরই অন্য রূপ। মাঝেমাঝেই শোনা যায় আমাদের প্রাচীন ভারতীয় পুরাণের দশাবতার তত্ত্ব অর্থাৎ মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন ইত্যাদি হল প্রাচীন ভারতীয়দের যে বিবর্তন তত্ত্ব জানা ছিল তার প্রমাণ। এখানেও সেই একই কথা বলতে হয়। পুরাণ অনুযায়ী বিষ্ণু এই সমস্ত রূপ পরিগ্রহণ করেছিলেন। বাস্তবে জলচর থেকে উভচর, তার থেকে স্থলচর প্রাণী কোনো দেবতার ইচ্ছায় হয়নি; হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে, যার উল্লেখ ছাড়া বিবর্তন তত্ত্ব অর্থহীন।

এই লেখাতে অন্য দেশে বা সমাজে বিজ্ঞানের উপর ভাববাদের আগ্রাসনের কথা আসেনি, কিন্তু তার অনেক উদাহরণ আমরা সবাই জানি। গ্যালিলিওকে বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তাঁর সমসাময়িক বিজ্ঞানী রেনে দেকার্তে ধর্ম ও বিজ্ঞানের জগৎকে আলাদা করে বিজ্ঞানকে ভাববাদী আক্রমণ থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন। সেই যুগে তিনি সফল হয়েছিলেন, কিন্তু তার ফলেই ভবিষ্যতে বিজ্ঞানদর্শনের উপর ভাববাদী আক্রমণের পথ খোলা থেকে গেছে। সবসময় তাকে চেনা সহজ নয়। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে মার্কসবাদকে সঠিকভাবেই বস্তুবাদ বলা হত। অথচ তার বিকৃত ব্যাখ্যাকে যেভাবে জেনেটিক্স বা কসমোলজির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করা হয়েছিল, তা ভাববাদী আগ্রাসনেরই অন্য রূপ। সূচনাকাল থেকেই বিজ্ঞানকে ভাববাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হয়েছে। সেই সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি।

 

প্রকাশঃ পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা কমিটির পত্রিকা শতমুখীতে প্রকাশিত। (নভেম্বর ২০২৪ সংখ্যা)।