ইউরেনিয়ামোত্তর মৌলের সন্ধানে
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
আশি বছর আগে 1938 সালে নিউট্রন বিক্রিয়ার মাধ্যমে
নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার এবং ধীরগতির নিউট্রনের সাহায্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া
আবিষ্কারের স্বীকৃতিতে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ইতালির
বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মিকে। এক্ষেত্রে আংশিকভাবে হলেও ভুল হয়েছিল, ফের্মি কোনো নতুন
তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করেননি। নোবেল কমিটি ভেবেছিলেন যে ফের্মি ইউরেনিয়ামোত্তর অর্থাৎ ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি মৌলিক
পদার্থ পরীক্ষাগারে তৈরি করেছেন। এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আমরা দেখব ভুল কেন হয়েছিল।
নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যাতে ভারি মৌলিক পদার্থ তৈরি ও তার ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা এখন
এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – সেদিকেও আমরা দৃষ্টি রাখব।
1932 সালে জেমস
চ্যাডউইক দেখিয়েছিলেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন নামের এক তড়িতাধানহীন কণা আছে। 1934
সালে ফের্মি নিউক্লিয়াসকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে কী বিক্রিয়া হয় তা দেখছিলেন। তিনি
দেখেছেন যে নিউট্রনের গতিশক্তি কম থাকলে বিক্রিয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।
ফের্মি ঠিক করলেন প্রকৃতিতে সবচেয়ে ভারি যে মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়, সেই
ইউরেনিয়ামের সঙ্গে নিউট্রনের বিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবেন।
ফের্মির
উদ্দেশ্য কী ছিল? 1934 সালে আইরিন কুরি ও ফ্রেডরিক জোলিও কুরি অ্যালুমিনিয়ামের
নিউক্লিয়াসকে আলফা কণা দিয়ে আঘাত করেন। আলফা কণারা হল হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস। তাঁদের পরীক্ষাকে সংক্ষেপে লেখা যায়
2713Al+42He→3015P+10n; 3015P→3014Si+e++n
(AZX দিয়ে দেখানো হয় X মৌলের নিউক্লিয়াস যার মধ্যে প্রোটনের সংখ্যা Z এবং ভরসংখ্যা অর্থাৎ প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা A।) সংঘর্ষে একটা নিউট্রন (10n) বেরিয়ে গিয়ে তৈরি হয় ফসফরাসের এক
তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ 3015P। মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপের
নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা সমান কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা আলাদা। যেমন ফসফরাসের প্রাকৃতিক আইসোটোপ 3115P-এ নিউট্রনের সংখ্যা 16। কুরি দম্পতি ফসফরাসের যে
আইসোটোপ তৈরি করেছিলেন তার নিউক্লিয়াসে ছিল 15টি নিউট্রন। এটি পজিট্রন বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে সিলিকনের নিউক্লিয়াসে পরিবর্তিত হয়, সঙ্গে
নির্গত হয় পজিট্রন (e+) ও নিউট্রিনো (n)। কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়ার আবিষ্কারের জন্য তাঁরা 1935 সালে রসায়নে নোবেল পান।
নিউক্লিয়াসে
থাকে ধনাত্মক আধানের প্রোটন ও আধানহীন নিউট্রন। তাই নিউক্লিয়াসের মোট আধান
ধনাত্মক। ধনাত্মক আলফা কণা ও নিউক্লিয়াস পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, সেজন্য তাদের মধ্যে
বিক্রিয়া হওয়া শক্ত। আলফা কণার যথেষ্ট শক্তি না থাকলে তা নিউক্লিয়াসের কুলম্ব বলকে
অতিক্রম করতে পারে না। নিউট্রন আধানহীন,
তাই নিউক্লিয়াস তাকে বিকর্ষণ করে না। তারা সহজেই নিউক্লিয়াসের মধ্যে ঢুকে বিক্রিয়া
করতে পারে।
ফের্মি মনে করেছিলেন
যে নিউট্রন ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসে ঢুকে ইউরেনিয়ামের নতুন আইসোটোপ তৈরি করবে। এই আইসোটোপে
নিউট্রনের সংখ্যা ইউরেনিয়ামের স্বাভাবিক আইসটোপের থেকে বেশি, তাই ইলেকট্রন বিটা তেজস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটা
নিউট্রন ভেঙে একটা প্রোটন, একটা ইলেকট্রন (e-) ও একটা অ্যান্টিনিউট্রিনো (n) তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। তা হলে নিউক্লিয়াসের প্রোটনের সংখ্যা
92 থেকে বেড়ে হবে 93, অর্থাৎ ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি এমন এক
নতুন মৌল তৈরি হবে যাকে প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না।
তিনি ভেবেছিলেন তিনি নিচের
বিক্রিয়াগুলো করতে সফল হয়েছেন।
23892U+10n→23992U→23993Ao+e-+n; 23993Ao→23994Hs+e-+n
সত্যিই দুই নতুন মৌল, ফের্মির দেওয়া নামানুসারে যাদের সঙ্কেত Aoএবং Hs, তারা তৈরি হল কিনা জানতে ফের্মি রসায়নের সাহায্য নিলেন। ইউরেনিয়ামের রাসয়ানিক ধর্ম জানা। কোনো মৌলিক পদার্থের সমস্ত
আইসোটোপের রাসয়ানিক ধর্ম এক। তাই নিউট্রন দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত ইউরেনিয়ামের মধ্যে এমন
কোনো নতুন কোনো রাসয়ানিক ধর্ম দেখা যায় যা ইউরেনিয়ামের নয়, তাহলে বুঝতে হবে নতুন
মৌলিক পদার্থ তৈরি হয়েছে। অবশ্য নতুন মৌলটা ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি নাও হতে পারে। নিউট্রন ইউরেনিয়াম পরমাণুর
সঙ্গে সংঘর্ষ করে তার থেকে প্রোটন একটা আলফা কণাও বের করে দিতে পারে। প্রথম
ক্ষেত্রে মৌলটার প্রোটন সংখ্যা হবে 91 এবং দ্বিতীয়
ক্ষেত্রে 90, যথাক্রমে প্রোঅ্যাক্টিনিয়াম ও থোরিয়াম মৌলের নিউক্লিয়াস। ফের্মি শুধু এই দুই
মৌল নয়, যার প্রোটন সংখ্যা 82, সেই সিসা পর্যন্ত সমস্ত মৌলিক পদার্থের
রাসয়ানিক ধর্মের জন্য পরীক্ষা করলেন। যখন প্রোটন সংখ্যা 82 থেকে 92 এমন কোনো মৌলের সঙ্গে নতুন তৈরি মৌলিক পদার্থের রাসয়ানিক
ধর্ম মিলল না, ফের্মি নিশ্চিত হলেন যে তিনি ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি দুটি নতুন মৌলিক পদার্থ বানাতে সক্ষম হয়েছেন। নেচার পত্রিকায় তিনি প্রবন্ধ লিখলেন, ‘Possible
Production of Elements of Atomic Number Higher than 92’।
এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী
গবেষণা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্যারিসে কুরিদের এবং বার্লিনে অটো হান ও লিজে
মাইটনারের নাম উল্লেখযোগ্য। বার্লিনের বিজ্ঞানীরা ফের্মির সিদ্ধান্তকে সমর্থন
করলেন, কিন্তু কুরিরা সন্দিহান ছিলেন। রেনিয়াম মৌলের অন্যতম আবিষ্কর্তা জার্মান মহিলা
বিজ্ঞানী ইডা নড্যাক বললেন যে রসায়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ফল থেকে নতুন মৌলের
অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। তিনিই প্রথম বলেছিলেন যে হয়তো নিউক্লিয়াস ছোটো ছোটো
টুকরোতে ভেঙে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকেই আমরা এখন বলি নিউক্লিয় বিভাজন বা ফিসন।
এনরিকো ফের্মি (1901-1954)
কুরিরা ইউরেনিয়াম ও ধীরগতির নিউট্রনের
বিক্রিয়া বিষয়ে তাঁদের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করলেও ফের্মি তাকে আমল দেননি। ধীর গতির
নিউট্রনের শক্তি এক ইলেকট্রন ভোল্টেরও কম। ফের্মি বিশ্বাসই করতে পারেননি যে দশ
লক্ষ ইলেকট্রন ভোল্টের থেকেও অনেক বেশি শক্তির আলফা কণা বা প্রোটন নিউক্লিয়াসকে
ভাঙতে পারছে না, কিন্তু ধীরগতির নিউট্রন নিউক্লিয়াসকে টুকরো করে দেবে। অবশেষে 1938 সালে অটো হান ও
ফ্রাঞ্জ স্ট্রাসম্যান ইউরেনিয়াম ও নিউট্রনের বিক্রিয়ায় বেরিয়াম খুঁজে পেলেন।
বেরিয়ামের প্রোটন সংখ্যা 56। এর অর্থ হল ইউরেনিয়ামের
নিউক্লিয়াস নিউট্রনের ধাক্কায় দু’টুকরো হয়ে যাচ্ছে। একটা টুকরো যদি বেরিয়াম হয়,
অন্যটা হবে ক্রিপটন যার প্রোটন সংখ্যা 36। কেমন করে তা হল তার ব্যাখ্যা দিলেন মাইটনার। তিনি অবশ্য তখন
নাৎসিদের ইহুদিবিদ্বেষের থেকে রক্ষা পেতে জার্মানি ছেড়ে গোপনে পালিয়ে গেছেন। অটো
হান শেষ পর্যন্ত নিউক্লিয় বিভাজন আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পাবেন। তবে
অনেকেরই মতে মাইটনারের কৃতিত্ব হানের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না। জার্মানি থেকে
পালাতে না হলে হানের সঙ্গে তাঁর নামও গবেষণাপত্রে থাকত। মাইটনার ও নিউক্লিয় বিভাজন সম্পর্কে আরো বেশি কথা এই লেখায় পাওয়া যাবে।
ফের্মি যখন
নোবেল পুরষ্কার আনতে যান, তখনই তিনি জানতেন নতুন মৌলিক পদার্থ বিষয়ে তাঁর
সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি পরে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন যে নোবেল
কমিটি ভুল করেছে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন পুরস্কারটা তাঁর প্রাপ্য ছিল। সেকথা
অবশ্য ঠিক। ফের্মি সম্ভবত শেষ পদার্থবিজ্ঞানী যিনি তত্ত্বীয় ও পরীক্ষামূলক দুই
ক্ষেত্রেই অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। 1938 সালের আগেই ধীরগতির নিউট্রনের সাহায্যে
নিউক্লিয় বিক্রিয়া ছাড়াও তিনি বিটা তেজস্ক্রিয়ার তত্ত্ব দিয়েছেন। ইংরেজ বিজ্ঞানী পল ডিরাকের সঙ্গে মিলে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রিনোরা কোন
পরিসংখ্যান মেনে চলে তা আবিষ্কার করেছেন। তাঁদের সম্মানে আমরা একে বলি ফের্মি
ডিরাক সংখ্যায়ন। যে কণারা এই সংখ্যায়ন মেনে চলে তাদের বলে ফের্মিয়ন। মহাবিশ্বের
সমস্ত মৌলিক কণা হয় ফের্মিয়ন না হয় বোসন।
ফের্মির
অবশ্য পুরস্কার নিতে স্টকহোল্মে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক
মুসোলিনি হিটলারের কথামতো ইহুদিবিরোধী আইন চালু করেছিলেন। ফের্মির স্ত্রী লরা
ছিলেন ইহুদি। নোবেল পুরস্কার নেওয়ার জন্য ফের্মিকে পরিবার সহ দেশ ছাড়ার অনুমতি
দেওয়া হয়। পুরস্কার নেওয়ার পরে ফের্মি পরিবারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান।
ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস বিভাজনের সময় কয়েকটা নিউট্রন
বেরোয় যা অন্য ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে ভেঙে ফেলতে পারে। একে বলে শৃঙ্খল বিক্রিয়া।
এই বিক্রিয়াকে ব্যবহার করে ফের্মি নিজেই প্রথম নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টর তৈরি করেন
আমেরিকাতে। নিউক্লিয় বোমাতেও এই শৃঙ্খল বিক্রিয়া ব্যবহৃত হয়, প্রথম
বোমা তৈরির মানহাটান প্রকল্পে ফের্মির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
ইউরেনিয়ামের
থেকে ভারি মৌল প্রথম তৈরি হয়েছিল কিন্তু ফের্মির পদ্ধতিতেই। আমেরিকার বার্কলে
ল্যাবরেটরিতে এডুইন ম্যাকমিলান ও ফিলিপ আবেলসন 1940 সালে 23992U-এর বিটা ক্ষয় থেকে 93 প্রোটন সংখ্যা
বিশিষ্ট মৌলটিকে পৃথক করতে সক্ষম হন। ইউরেনিয়াম ও ইউরেনাস গ্রহের নামের উৎস এক,
গ্রিক দেবতা ইউরেনাস। ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি বলে তাঁরা গ্রহের তালিকার সঙ্গে
মিলিয়ে এর নাম দেন নেপচুনিয়াম (Np)। ফের্মি এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন কিন্তু তিনি নেপচুনিয়াম খুঁজে পাননি,
বেরিয়ামকেই নেপচুনিয়াম বলে ভুল করেছিলেন। বার্কলেতেই এক বছর পরে গ্লেন সিবর্গ ও তাঁর সহকর্মীরা নিচের
বিক্রিয়াতে তৈরি করেন পরের মৌলটি, প্লুটোনিয়াম (Pu)।
23892U+21H→23993Np+210n; 23893Np →23894Pu+e-+n
ভারি হাইড্রোজেনের আইসোটোপ
ডয়টেরন (21H) ও 23892U-এর সংঘর্ষে দুটি
নিউট্রন মুক্ত হয় ও 23993Np তৈরি হয় যা পরে বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে 23894Pu-তে রূপান্তরিত হয়। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়। এতদিন ইউরেনিয়ামের সঙ্গে একমাত্র নিউট্রনের বিক্রিয়াই করা সম্ভব হচ্ছিল।
তার কারণ তখনো পর্যন্ত পরীক্ষাগারে আলফা কণা বা প্রোটনের শক্তি বেশি বাড়ানো সম্ভব
হয় নি। ইউরেনিয়ামের মতো ভারি নিউক্লিয়াসের বিকর্ষণ অগ্রাহ্য করে এই কম শক্তির ধনাত্মক
আধান সম্পন্ন কণাদের পক্ষে নিউক্লিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে বিক্রিয়া করা সম্ভব নয়।
কিন্তু 1930-এর দশকের শেষ দিকে কণাত্বরকের অনেক উন্নতি ঘটেছিল। বিশেষ করে বলতে হয় বার্কলে ল্যাবরেটরির কথা
যেখানে আর্নেস্ট লরেন্স প্রথম সাইক্লোট্রন বানিয়েছিলেন। 1939 সালে তিনি এর জন্য নোবেল পুরস্কার পান। সাইক্লোটন ব্যবহার করে সিবর্গরা ডয়টেরন
নিউক্লিয়াসদের গতিশক্তি বাড়িয়ে করেছিলেন 16 মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট, ফলে তারা সহজেই 23892U-এর বিকর্ষণকে অগ্রাহ্য করতে পারে। 1951 সালে সিবর্গ ও ম্যাকমিলান ইউরেনিয়ামোত্তর মৌল
বিষয়ে তাঁদের গবেষণার জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান।
গ্লেন সিবর্গ (1912-1999)
কণা ত্বরকের যত উন্নতি ঘটল, ততই আরো ভারি মৌলিক পদার্থের আইসোটোপ
তৈরি করা সম্ভব হল। মনে রাখতে হবে যে এই সমস্ত মৌলের সকলেরই একাধিক আইসোটোপ আছে,
সাধারণত তাদের তৈরি করতে আলাদা আলাদা বিক্রিয়া প্রয়োজন। শুধু প্রোটন, ডয়টেরন বা আলফা কণা নয়, এখন সিসা বা
ইউরেনিয়ামের মতো ভারি নিউক্লিয়াসকেও এতটা গতিশক্তি দেওয়া সম্ভব হয়েছে যে নিউক্লিয়াসদের
বিকর্ষণ অগ্রাহ্য করে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটানো খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
কিন্তু অতিরিক্ত গতিশক্তির একটা সমস্যা আছে। উচ্চ গতিশক্তির দুই
নিউক্লিয়াসের সংঘর্ষে যে নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি হয়, তার নিজের শক্তি খুব বেশি থাকে।
ফলে সেই নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভাজন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আমরা দেখার আগেই তা দু’টুকরো হয়ে দুটো হালকা
নিউক্লিয়াস তৈরি করবে। বিজ্ঞানীরা মনে করলেন যদি প্রথমেই বেশি বন্ধনশক্তির
নিউক্লিয়াস নিয়ে শুরু করা যায়, তাহলে নতুন নিউক্লিয়াসের বন্ধনশক্তিও বেশি হবে। ক্যালসিয়ামের
আইসোটোপ 4820Ca-র বন্ধনশক্তি বেশি, তাকে ব্যবহার করে সুফল মিলেছে। এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ভারি পরমাণু এভাবেই
বানানো সম্ভব হয়েছে।
24998Cf+4820Ca→294118Og+310n
এখানে 4820Ca-এর সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে
পরীক্ষাগারে তৈরি ইউরেনিয়ামোত্তর মৌল 24998Cf-কে। ক্যালিফোর্নিয়ামের আইসোটোপ 24998Cf-এর অর্ধায়ু সাড়ে তিনশো বছর, তাই তার ব্যবহার সম্ভব হয়েছে। এই মৌলটির নাম দেওয়া হয়েছে
রাশিয়ান বিজ্ঞানী ইউরি ওগানেসিয়ানের নামে, যিনি শুধু এই পরমাণু নয়, আরো অনেকগুলি অতি-ভারি
পরমাণু তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দুজন মাত্র বিজ্ঞানীর জীবনকালে তাঁদের নামে মৌলের
নাম দেওয়া হয়েছে, সিবর্গ ও ওগানেসিয়ান।
জন্মভূমি আর্মেনিয়ার ডাকটিকিটে ইউরি ওগানেসিয়ান
ও সবচেয়ে ভারি আইসটোপের ক্ষয় শৃঙ্খল
শুধু মৌল তৈরি হয়েছে বললেই তো
হবে না, তা প্রমাণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই সমস্ত মৌলই তেজস্ক্রিয়, তাদের জীবন
কাল অনেক সময়ই খুব কম।
তার মধ্যেই তাদেরকে খুঁজে বার করতে হবে। আরো একটা সমস্যা আছে। সাধারণ পদার্থের রাসয়ানিক
ধর্ম পরীক্ষা করার সময় তার বহু সংখ্যক পরমাণু বিজ্ঞানীর কাছে থাকে। এক গ্রাম
হাইড্রোজেন গ্যাসে পরমাণুর সংখ্যা অর্থাৎ প্রায় ছ’শো কোটি কোটি কোটি। নতুন মৌলের
পরমাণুর সংখ্যা অনেক কম, হয়তো কয়েকশো বা তারও কম। এই অল্পসংখ্যক পরমাণুকে খুঁজে
বার করে তার রাসয়ানিক ধর্ম আবিষ্কারের জন্য রসায়নের এক বিশেষ শাখার সৃষ্টি করতে
হল।
প্রোটনের সংখ্যা যখন 103 পেরোল তখন রাসয়ানিক পদ্ধতিও আর পেরে উঠলো না। তার
কারণ এই সব নতুন মৌলের পরমাণুর সৃষ্টির হার এতই কম যে এক সপ্তাহ বা এক মাস পরীক্ষা
করে হয়তো একটা নতুন ভারি পরমাণু তৈরি সম্ভব। তাছাড়া তাদের জীবন কাল কমতে কমতে এক
সেকেন্ডেরও কম হয়ে যায়। সেই পরমাণুকে নিয়ে এসে রাসয়ানিক পরীক্ষা করা আমাদের সাধ্যাতীত।
এই মৌলগুলিকে বলা হয় অতি-ভারি (Super-Heavy Elements সংক্ষেপে
SHE)।
বিজ্ঞানীরা এই ধরনের নিউক্লিয়াসকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার জন্য
একটা পদ্ধতি বার করেছেন। খুব সংক্ষেপে একটা উদাহরণ দেখা যাক। সিসা-বিসমাথের থেকে ভারি মৌলরা সবাই তেজস্ক্রিয়, তারা অধিকাংশ
সময়ে আলফা কণা ত্যাগ করে। এর ফলে নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা দুই করে
কমে যায়। এভাবে একের পর এক আলফা কণা ত্যাগ করে তারা আরো সুস্থিতির দিকে যায়, একে
বলে আলফা শৃঙ্খল। ইউরেনিয়াম ও তার আশপাশের মৌলের আইসোটোপদের শৃঙ্খলের জন্য আলফা
কণার শক্তি আমরা খুব ভালোভাবে জানি। ধরা যাক 23492U-এর কথা। এই নিউক্লিয়াস থেকে পরপর পাঁচটি আলফা কণা বেরোয় ও নিউক্লিয়াস শেষ
পর্যন্ত 21482Pb-এ পরিবর্তিত হয়। (এছাড়া বিটা ক্ষয়ও হতে পারে
তবে তা আমাদের বিবেচ্য নয়।) এখন যদি কোনো নতুন তৈরি ভারি নিউক্লিয়াস থেকে পরপর
বারোটা আলফা কণা বেরোয় যার শেষ পাঁচটার শক্তি 23492U-এর সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি 23492U-এর সঙ্গে সাতটা কণা আলফা কণা যোগ করে আদি নিউক্লিয়াসটা
পাওয়া যায়, অর্থাৎ নিউক্লিয়াসে প্রোটন সংখ্যা 92+2X7=106 এবং ভরসংখ্যা 234+(2+2)X7=262. এই মৌলটিই সিবর্গিয়াম, আইসোটোপের সঙ্কেত 262106Sg এবং এভাবেই একে চিহ্নিত করা সম্ভব। অর্থাৎ
আলফা ক্ষয়ের শৃঙ্খলে যদি আমাদের চেনা কোনো নিউক্লিয়াস পাওয়া যায়, তার থেকে আদি
নিউক্লিয়াসটা জানা সম্ভব। তবে একাধিকবার এমন হয়েছে যে শৃঙ্খলের এক বা একাধিক আলফা
কণা বিজ্ঞানীদের চোখ এড়িয়ে গেছে, ফলে
পরমাণুটিকে চিহ্নিত করতে ভুল হয়েছে, পরে
সেই ভুল ধরা পড়েছে। সে জন্য দ্বিতীয় কোনো পরীক্ষা প্রথমটির ফলকে সমর্থন করলে তবেই তা
মেনে নেওয়া হয়।
পৃথিবীর মাত্র কয়েকটা গবেষণাগারেই অতি-ভারি পরমাণু তৈরি করা সম্ভব
-- রাশিয়ার দুবনাতে জয়েন্ট ইন্সটিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, জার্মানির
ডার্মস্টাডে জিএসআই গবেষণাকেন্দ্র, জাপানের টোকিয়োর কাছে রিকেন গবেষণাগার এবং
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি। প্রশ্ন ওঠে অতি-ভারি মৌল তৈরি করে লাভ কী? নিউক্লিয়াসের মধ্যে
প্রোটন-নিউট্রনদের মধ্যে বল সম্পর্কে জানতে গেলে অতি-ভারি মৌলগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিককালে মনে করা
হচ্ছে যে মহাবিশ্বে মৌলিক পদার্থ সৃষ্টির সম্পর্কে জানতে গেলে ইউরেনিয়ামোত্তর মৌল বিষয়ে
জানা জরুরি। যদিও এখনো এই গবেষণা মৌলিক বিজ্ঞানেরই
অঙ্গ, ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি মৌলিক গবেষণা শেষ পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রেই নতুন
প্রযুক্তির জন্ম দেয়। ভারি মৌলের খোঁজ যেমন নিউক্লিয় শক্তির দরজা খুলে দিয়েছিল। পরমাণুর
সর্বোচ্চ ভর কত হতে পারে, বিজ্ঞানীরা এখন সে গবেষণাতে রত। দেখা যাক আমাদের সামনে
নতুন কোনো দিগন্ত তা উন্মোচন করতে পারে কিনা।
(প্রকাশ, জ্ঞান ও বিজ্ঞান শারদীয় ২০১৮, সামান্য পরিবর্তিত)