Friday 26 October 2018

ইউরেনিয়ামোত্তর মৌলের সন্ধানে


ইউরেনিয়ামোত্তর মৌলের সন্ধানে

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       আশি বছর আগে 1938 সালে নিউট্রন বিক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার এবং ধীরগতির নিউট্রনের সাহায্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া আবিষ্কারের স্বীকৃতিতে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ইতালির বিজ্ঞানী এনরিকো ফের্মিকে। এক্ষেত্রে আংশিকভাবে হলেও ভুল হয়েছিল, ফের্মি কোনো নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার করেননি। নোবেল কমিটি ভেবেছিলেন যে ফের্মি ইউরেনিয়ামোত্তর অর্থাৎ ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি মৌলিক পদার্থ পরীক্ষাগারে তৈরি করেছেন। এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে আমরা দেখব ভুল কেন হয়েছিল। নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যাতে ভারি মৌলিক পদার্থ তৈরি ও তার ধর্ম সম্পর্কে গবেষণা এখন এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – সেদিকেও আমরা দৃষ্টি রাখব।
       1932 সালে জেমস চ্যাডউইক দেখিয়েছিলেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে নিউট্রন নামের এক তড়িতাধানহীন কণা আছে। 1934 সালে ফের্মি নিউক্লিয়াসকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করে কী বিক্রিয়া হয় তা দেখছিলেন। তিনি দেখেছেন যে নিউট্রনের গতিশক্তি কম থাকলে বিক্রিয়ার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়। ফের্মি ঠিক করলেন প্রকৃতিতে সবচেয়ে ভারি যে মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়, সেই ইউরেনিয়ামের সঙ্গে নিউট্রনের বিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবেন।
       ফের্মির উদ্দেশ্য কী ছিল? 1934 সালে আইরিন কুরি ও ফ্রেডরিক জোলিও কুরি অ্যালুমিনিয়ামের নিউক্লিয়াসকে আলফা কণা দিয়ে আঘাত করেন। আলফা কণারা হল হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসতাঁদের পরীক্ষাকে সংক্ষেপে লেখা যায়
2713Al+42He3015P+10n;                 3015P3014Si+e++n
(AZX দিয়ে দেখানো হয় X মৌলের নিউক্লিয়াস যার মধ্যে প্রোটনের সংখ্যা Z এবং ভরসংখ্যা অর্থাৎ প্রোটন ও নিউট্রনের মোট সংখ্যা A) সংঘর্ষে একটা নিউট্রন (10n) বেরিয়ে গিয়ে তৈরি হয়  ফসফরাসের এক তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ 3015P মৌলের বিভিন্ন আইসোটোপের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা সমান কিন্তু নিউট্রনের সংখ্যা আলাদাযেমন ফসফরাসের প্রাকৃতিক আইসোটোপ 3115P-এ নিউট্রনের সংখ্যা 16কুরি দম্পতি ফসফরাসের যে আইসোটোপ তৈরি করেছিলেন তার নিউক্লিয়াসে ছিল 15টি নিউট্রনএটি পজিট্রন বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে সিলিকনের নিউক্লিয়াসে পরিবর্তিত হয়, সঙ্গে নির্গত হয় পজিট্রন (e+) ও নিউট্রিনো (n)কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়ার আবিষ্কারের জন্য তাঁরা 1935 সালে রসায়নে নোবেল পান।
       নিউক্লিয়াসে থাকে ধনাত্মক আধানের প্রোটন ও আধানহীন নিউট্রন। তাই নিউক্লিয়াসের মোট আধান ধনাত্মক। ধনাত্মক আলফা কণা ও নিউক্লিয়াস পরস্পরকে বিকর্ষণ করে, সেজন্য তাদের মধ্যে বিক্রিয়া হওয়া শক্ত। আলফা কণার যথেষ্ট শক্তি না থাকলে তা নিউক্লিয়াসের কুলম্ব বলকে অতিক্রম করতে পারে না।  নিউট্রন আধানহীন, তাই নিউক্লিয়াস তাকে বিকর্ষণ করে না। তারা সহজেই নিউক্লিয়াসের মধ্যে ঢুকে বিক্রিয়া করতে পারে।
       ফের্মি মনে করেছিলেন যে নিউট্রন ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াসে ঢুকে ইউরেনিয়ামের নতুন আইসোটোপ তৈরি করবে। এই আইসোটোপে নিউট্রনের সংখ্যা ইউরেনিয়ামের স্বাভাবিক আইসটোপের থেকে বেশি, তাই  ইলেকট্রন বিটা তেজস্ক্রিয়ার মাধ্যমে একটা নিউট্রন ভেঙে একটা প্রোটন, একটা ইলেকট্রন (e-) ও একটা অ্যান্টিনিউট্রিনো (nতৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে তা হলে নিউক্লিয়াসের প্রোটনের সংখ্যা 92 থেকে বেড়ে হবে 93, অর্থাৎ ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি এমন এক নতুন মৌল তৈরি হবে যাকে প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না।  তিনি ভেবেছিলেন তিনি নিচের বিক্রিয়াগুলো করতে সফল হয়েছেন।
23892U+10n23992U23993Ao+e-+n;      23993Ao23994Hs+e-+n
       সত্যিই দুই নতুন মৌল, ফের্মির দেওয়া নামানুসারে যাদের সঙ্কেত Aoএবং Hs, তারা তৈরি হল কিনা জানতে ফের্মি রসায়নের সাহায্য নিলেনইউরেনিয়ামের রাসয়ানিক ধর্ম জানা। কোনো মৌলিক পদার্থের সমস্ত আইসোটোপের রাসয়ানিক ধর্ম এক। তাই নিউট্রন দ্বারা আঘাতপ্রাপ্ত ইউরেনিয়ামের মধ্যে এমন কোনো নতুন কোনো রাসয়ানিক ধর্ম দেখা যায় যা ইউরেনিয়ামের নয়, তাহলে বুঝতে হবে নতুন মৌলিক পদার্থ তৈরি হয়েছেঅবশ্য নতুন মৌলটা ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি নাও হতে পারে। নিউট্রন ইউরেনিয়াম পরমাণুর সঙ্গে সংঘর্ষ করে তার থেকে প্রোটন একটা আলফা কণাও বের করে দিতে পারে। প্রথম ক্ষেত্রে মৌলটার প্রোটন সংখ্যা হবে 91 এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে 90, যথাক্রমে প্রোঅ্যাক্টিনিয়াম ও থোরিয়াম মৌলের নিউক্লিয়াসফের্মি শুধু এই দুই মৌল নয়, যার প্রোটন সংখ্যা 82, সেই সিসা পর্যন্ত সমস্ত মৌলিক পদার্থের রাসয়ানিক ধর্মের জন্য পরীক্ষা করলেন। যখন প্রোটন সংখ্যা 82 থেকে 92 এমন কোনো মৌলের সঙ্গে নতুন তৈরি মৌলিক পদার্থের রাসয়ানিক ধর্ম মিলল না, ফের্মি নিশ্চিত হলেন যে তিনি ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি দুটি নতুন মৌলিক পদার্থ বানাতে সক্ষম হয়েছেন। নেচার পত্রিকায় তিনি প্রবন্ধ লিখলেন, ‘Possible Production of Elements of Atomic Number Higher than 92’  
       এই বিশেষ ক্ষেত্রটিতে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানী গবেষণা করছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্যারিসে কুরিদের এবং বার্লিনে অটো হান ও লিজে মাইটনারের নাম উল্লেখযোগ্য। বার্লিনের বিজ্ঞানীরা ফের্মির সিদ্ধান্তকে সমর্থন করলেন, কিন্তু কুরিরা সন্দিহান ছিলেন। রেনিয়াম মৌলের অন্যতম আবিষ্কর্তা জার্মান মহিলা বিজ্ঞানী ইডা নড্যাক বললেন যে রসায়নের ক্ষেত্রে নেতিবাচক ফল থেকে নতুন মৌলের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। তিনিই প্রথম বলেছিলেন যে হয়তো নিউক্লিয়াস ছোটো ছোটো টুকরোতে ভেঙে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়াকেই আমরা এখন বলি নিউক্লিয় বিভাজন বা ফিসন

এনরিকো ফের্মি (1901-1954)

       কুরিরা ইউরেনিয়াম ও ধীরগতির নিউট্রনের বিক্রিয়া বিষয়ে তাঁদের পরীক্ষার ফল প্রকাশ করলেও ফের্মি তাকে আমল দেননি। ধীর গতির নিউট্রনের শক্তি এক ইলেকট্রন ভোল্টেরও কম। ফের্মি বিশ্বাসই করতে পারেননি যে দশ লক্ষ ইলেকট্রন ভোল্টের থেকেও অনেক বেশি শক্তির আলফা কণা বা প্রোটন নিউক্লিয়াসকে ভাঙতে পারছে না, কিন্তু ধীরগতির নিউট্রন নিউক্লিয়াসকে টুকরো করে দেবে।  অবশেষে 1938 সালে অটো হান ও ফ্রাঞ্জ স্ট্রাসম্যান ইউরেনিয়াম ও নিউট্রনের বিক্রিয়ায় বেরিয়াম খুঁজে পেলেন। বেরিয়ামের প্রোটন সংখ্যা 56 এর অর্থ হল ইউরেনিয়ামের নিউক্লিয়াস নিউট্রনের ধাক্কায় দু’টুকরো হয়ে যাচ্ছে। একটা টুকরো যদি বেরিয়াম হয়, অন্যটা হবে ক্রিপটন যার প্রোটন সংখ্যা 36কেমন করে তা হল তার ব্যাখ্যা দিলেন মাইটনার। তিনি অবশ্য তখন নাৎসিদের ইহুদিবিদ্বেষের থেকে রক্ষা পেতে জার্মানি ছেড়ে গোপনে পালিয়ে গেছেন। অটো হান শেষ পর্যন্ত নিউক্লিয় বিভাজন আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পাবেন। তবে অনেকেরই মতে মাইটনারের কৃতিত্ব হানের থেকে কোনো অংশে কম ছিল না। জার্মানি থেকে পালাতে না হলে হানের সঙ্গে তাঁর নামও গবেষণাপত্রে থাকত। মাইটনার ও নিউক্লিয় বিভাজন সম্পর্কে আরো বেশি কথা এই লেখায় পাওয়া যাবে। 
       ফের্মি যখন নোবেল পুরষ্কার আনতে যান, তখনই তিনি জানতেন নতুন মৌলিক পদার্থ বিষয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্দেহ আছেতিনি পরে প্রকাশ্যে স্বীকার করেছিলেন যে নোবেল কমিটি ভুল করেছে, কিন্তু তিনি বিশ্বাস করতেন পুরস্কারটা তাঁর প্রাপ্য ছিল। সেকথা অবশ্য ঠিক। ফের্মি সম্ভবত শেষ পদার্থবিজ্ঞানী যিনি তত্ত্বীয় ও পরীক্ষামূলক দুই ক্ষেত্রেই অসাধারণ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। 1938 সালের আগেই ধীরগতির নিউট্রনের সাহায্যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া ছাড়াও তিনি বিটা তেজস্ক্রিয়ার তত্ত্ব দিয়েছেনইংরেজ বিজ্ঞানী পল ডিরাকের সঙ্গে মিলে ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রিনোরা কোন পরিসংখ্যান মেনে চলে তা আবিষ্কার করেছেন। তাঁদের সম্মানে আমরা একে বলি ফের্মি ডিরাক সংখ্যায়ন। যে কণারা এই সংখ্যায়ন মেনে চলে তাদের বলে ফের্মিয়ন। মহাবিশ্বের সমস্ত মৌলিক কণা হয় ফের্মিয়ন না হয় বোসন।
       ফের্মির অবশ্য পুরস্কার নিতে স্টকহোল্‌মে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসক মুসোলিনি হিটলারের কথামতো ইহুদিবিরোধী আইন চালু করেছিলেন। ফের্মির স্ত্রী লরা ছিলেন ইহুদি। নোবেল পুরস্কার নেওয়ার জন্য ফের্মিকে পরিবার সহ দেশ ছাড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। পুরস্কার নেওয়ার রে ফের্মি পরিবারসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে যান। ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস বিভাজনের সময় কয়েকটা নিউট্রন বেরোয় যা অন্য ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে ভেঙে ফেলতে পারে। একে বলে শৃঙ্খল বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়াকে ব্যবহার করে ফের্মি নিজেই প্রথম নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টর তৈরি করেন আমেরিকাতে নিউক্লিয় বোমাতেও এই শৃঙ্খল বিক্রিয়া ব্যবহৃত হয়, প্রথম বোমা তৈরির মানহাটান প্রকল্পে ফের্মির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। 
       ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি মৌল প্রথম তৈরি হয়েছিল কিন্তু ফের্মির পদ্ধতিতেই। আমেরিকার বার্কলে ল্যাবরেটরিতে এডুইন ম্যাকমিলান ও ফিলিপ আবেলসন 1940 সালে 23992U-এর বিটা ক্ষয় থেকে  93 প্রোটন সংখ্যা বিশিষ্ট মৌলটিকে পৃথক করতে সক্ষম হন। ইউরেনিয়াম ও ইউরেনাস গ্রহের নামের উৎস এক, গ্রিক দেবতা ইউরেনাস। ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি বলে তাঁরা গ্রহের তালিকার সঙ্গে মিলিয়ে এর নাম দেন নেপচুনিয়াম (Np)ফের্মি এই একই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন কিন্তু তিনি নেপচুনিয়াম খুঁজে পাননি, বেরিয়ামকেই নেপচুনিয়াম বলে ভুল করেছিলেন। বার্কলেতেই ক বছর পরে গ্লেন সিবর্গ ও তাঁর সহকর্মীরা নিচের বিক্রিয়াতে তৈরি করেন পরের মৌলটি, প্লুটোনিয়াম (Pu)
23892U+21H23993Np+210n; 23893Np 23894Pu+e-+n
ভারি হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ডয়টেরন (21H)  23892U-এর সংঘর্ষে দুটি নিউট্রন মুক্ত হয় ও 23993Np তৈরি হয় যা পরে বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে 23894Pu-তে রূপান্তরিত হয়। এখানে একটা বিষয় লক্ষণীয়এতদিন ইউরেনিয়ামের সঙ্গে একমাত্র নিউট্রনের বিক্রিয়াই করা সম্ভব হচ্ছিল। তার কারণ তখনো পর্যন্ত পরীক্ষাগারে আলফা কণা বা প্রোটনের শক্তি বেশি বাড়ানো সম্ভব হয় নি। ইউরেনিয়ামের মতো ভারি নিউক্লিয়াসের বিকর্ষণ অগ্রাহ্য করে এই কম শক্তির ধনাত্মক আধান সম্পন্ন কণাদের পক্ষে নিউক্লিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছে বিক্রিয়া করা সম্ভব নয়। কিন্তু 1930-এর দশকের শেষ দিকে কণাত্বরকের অনেক উন্নতি ঘটেছিল। বিশেষ করে বলতে হয় বার্কলে ল্যাবরেটরির কথা যেখানে আর্নেস্ট লরেন্স প্রথম সাইক্লোট্রন বানিয়েছিলেন। 1939 সালে তিনি এর জন্য নোবেল পুরস্কার পান। সাইক্লোটন ব্যবহার করে সিবর্গরা ডয়টেরন নিউক্লিয়াসদের গতিশক্তি বাড়িয়ে করেছিলেন 16 মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট, ফলে তারা সহজেই 23892U-এর বিকর্ষণকে অগ্রাহ্য করতে পারে। 1951 সালে সিবর্গ ও ম্যাকমিলান ইউরেনিয়ামোত্তর মৌল বিষয়ে তাঁদের গবেষণার জন্য রসায়নে নোবেল পুরস্কার পান।

 গ্লেন সিবর্গ (1912-1999)

       কণা ত্বরকের যত উন্নতি ঘটল, ততই আরো ভারি মৌলিক পদার্থের আইসোটোপ তৈরি করা সম্ভব হল। মনে রাখতে হবে যে এই সমস্ত মৌলের সকলেরই একাধিক আইসোটোপ আছে, সাধারণত তাদের তৈরি করতে আলাদা আলাদা বিক্রিয়া প্রয়োজনশুধু প্রোটন, ডয়টেরন বা আলফা কণা নয়, এখন সিসা বা ইউরেনিয়ামের মতো ভারি নিউক্লিয়াসকেও এতটা গতিশক্তি দেওয়া সম্ভব হয়েছে যে নিউক্লিয়াসদের বিকর্ষণ অগ্রাহ্য করে  তাদের মধ্যে  সংঘর্ষ ঘটানো খুব স্বাভাবিক ঘটনা।
       কিন্তু অতিরিক্ত গতিশক্তির একটা সমস্যা আছে। উচ্চ গতিশক্তির দুই নিউক্লিয়াসের সংঘর্ষে যে নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি হয়, তার নিজের শক্তি খুব বেশি থাকে। ফলে সেই নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভাজন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। আরা দেখার আগেই তা দু’টুকরো হয়ে দুটো হালকা নিউক্লিয়াস তৈরি করবে। বিজ্ঞানীরা মনে করলেন যদি প্রথমেই বেশি বন্ধনশক্তির নিউক্লিয়াস নিয়ে শুরু করা যায়, তাহলে নতুন নিউক্লিয়াসের বন্ধনশক্তিও বেশি হবে। ক্যালসিয়ামের আইসোটোপ 4820Ca-র বন্ধনশক্তি বেশি, তাকে ব্যবহার করে সুফল মিলেছে। এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে ভারি পরমাণু এভাবেই বানানো সম্ভব হয়েছে।
24998Cf+4820Ca294118Og+310n
       এখানে 4820Ca-এর সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে পরীক্ষাগারে তৈরি ইউরেনিয়ামোত্তর মৌল 24998Cf-কে। ক্যালিফোর্নিয়ামের আইসোটোপ 24998Cf-এর অর্ধায়ু সাড়ে তিনশো বছর, তাই তার ব্যবহার  সম্ভব হয়েছে। এই মৌলটির নাম দেওয়া হয়েছে রাশিয়ান বিজ্ঞানী ইউরি ওগানেসিয়ানের নামে, যিনি শুধু এই পরমাণু নয়, আরো অনেকগুলি অতি-ভারি পরমাণু তৈরিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দুজন মাত্র বিজ্ঞানীর জীবনকালে তাঁদের নামে মৌলের নাম দেওয়া হয়েছে, সিবর্গ ও ওগানেসিয়ান।

জন্মভূমি আর্মেনিয়ার ডাকটিকিটে ইউরি ওগানেসিয়ান  
ও সবচেয়ে ভারি আইসটোপের ক্ষয় শৃঙ্খল

       শুধু মৌল তৈরি হয়েছে বললেই তো হবে না, তা প্রমাণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে এই সমস্ত মৌলই তেজস্ক্রিয়, তাদের জীবন কাল অনেক সময়ই খুব কম তার মধ্যেই তাদেরকে খুঁজে বার করতে হবে। আরো একটা সমস্যা আছে। সাধারণ পদার্থের রাসয়ানিক ধর্ম পরীক্ষা করার সময় তার বহু সংখ্যক পরমাণু বিজ্ঞানীর কাছে থাকে। এক গ্রাম হাইড্রোজেন গ্যাসে পরমাণুর সংখ্যা অর্থাৎ প্রায় ছ’শো কোটি কোটি কোটি। নতুন মৌলের পরমাণুর সংখ্যা অনেক কম, হয়তো কয়েকশো বা তারও কম। এই অল্পসংখ্যক পরমাণুকে খুঁজে বার করে তার রাসয়ানিক ধর্ম আবিষ্কারের জন্য রসায়নের এক বিশেষ শাখার সৃষ্টি করতে হল।
       প্রোটনের সংখ্যা  যখন 103 পেরোল তখন রাসয়ানিক পদ্ধতিও আর পেরে উঠলো না। তার কারণ এই সব নতুন মৌলের পরমাণুর সৃষ্টির হার এতই কম যে এক সপ্তাহ বা এক মাস পরীক্ষা করে হয়তো একটা নতুন ভারি পরমাণু তৈরি সম্ভব। তাছাড়া তাদের জীবন কাল কমতে কমতে এক সেকেন্ডেরও কম হয়ে যায়। সেই পরমাণুকে নিয়ে এসে রাসয়ানিক পরীক্ষা করা আমাদের সাধ্যাতীত। এই মৌলগুলিকে বলা হয় অতি-ভারি (Super-Heavy Elements সংক্ষেপে SHE)
       বিজ্ঞানীরা এই ধরনের নিউক্লিয়াসকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার জন্য একটা পদ্ধতি বার করেছেন। খুব সংক্ষেপে একটা উদাহরণ দেখা যাক। সিসা-বিসমাথের থেকে ভারি মৌলরা সবাই তেজস্ক্রিয়, তারা অধিকাংশ সময়ে আলফা কণা ত্যাগ করে। এর ফলে নিউক্লিয়াসে প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা দুই করে কমে যায়। এভাবে একের পর এক আলফা কণা ত্যাগ করে তারা আরো সুস্থিতির দিকে যায়, একে বলে আলফা শৃঙ্খল। ইউরেনিয়াম ও তার আশপাশের মৌলের আইসোটোপদের শৃঙ্খলের জন্য আলফা কণার শক্তি আমরা খুব ভালোভাবে জানি। ধরা যাক 23492U-এর কথা। এই নিউক্লিয়াস থেকে পরপর পাঁচটি আলফা কণা বেরোয় ও নিউক্লিয়াস শেষ পর্যন্ত 21482Pb-এ পরিবর্তিত হয়। (এছাড়া বিটা ক্ষয়ও হতে পারে তবে তা আমাদের বিবেচ্য নয়।) এখন যদি কোনো নতুন তৈরি ভারি নিউক্লিয়াস থেকে পরপর বারোটা আলফা কণা বেরোয় যার শেষ পাঁচটার শক্তি 23492U-এর সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি 23492U-এর সঙ্গে সাতটা কণা আলফা কণা যোগ করে আদি নিউক্লিয়াসটা পাওয়া যায়, অর্থাৎ নিউক্লিয়াসে প্রোটন সংখ্যা 92+2X7=106 এবং ভরসংখ্যা 234+(2+2)X7=262. এই মৌলটিই সিবর্গিয়াম, আইসোটোপের সঙ্কেত 262106Sg এবং এভাবেই একে চিহ্নিত করা সম্ভব। অর্থাৎ আলফা ক্ষয়ের শৃঙ্খলে যদি আমাদের চেনা কোনো নিউক্লিয়াস পাওয়া যায়, তার থেকে আদি নিউক্লিয়াসটা জানা সম্ভব। তবে একাধিকবার এমন হয়েছে যে শৃঙ্খলের এক বা একাধিক আলফা কণা বিজ্ঞানীদের চোখ এড়িয়ে গেছে, ফলে পরমাণুটিকে চিহ্নিত করতে ভুল হয়েছে, পরে সেই ভুল ধরা পড়েছে। সে জন্য দ্বিতীয় কোনো পরীক্ষা প্রথমটির ফলকে সমর্থন করলে তবেই তা মেনে নেওয়া হয়।
       পৃথিবীর মাত্র কয়েকটা গবেষণাগারেই অতি-ভারি পরমাণু তৈরি করা সম্ভব -- রাশিয়ার দুবনাতে জয়েন্ট ইন্সটিটিউট ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ, জার্মানির ডার্মস্টাডে জিএসআই গবেষণাকেন্দ্র, জাপানের টোকিয়োর কাছে রিকেন গবেষণাগার এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স বার্কলে ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি প্রশ্ন ওঠে অতি-ভারি মৌল তৈরি করে লাভ কী? নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন-নিউট্রনদের মধ্যে বল সম্পর্কে জানতে গেলে অতি-ভারি মৌলগুলি খুব গুরুত্বপূর্ণসাম্প্রতিককালে মনে করা হচ্ছে যে মহাবিশ্বে মৌলিক পদার্থ সৃষ্টির সম্পর্কে জানতে গেলে ইউরেনিয়ামোত্তর মৌল বিষয়ে জানা জরুরি। যদিও এখনো এই  গবেষণা মৌলিক বিজ্ঞানেরই অঙ্গ, ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি মৌলিক গবেষণা শেষ পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রেই নতুন প্রযুক্তির জন্ম দেয়। ভারি মৌলের খোঁজ যেমন নিউক্লিয় শক্তির দরজা খুলে দিয়েছিল। পরমাণুর সর্বোচ্চ ভর কত হতে পারে, বিজ্ঞানীরা এখন সে গবেষণাতে রত। দেখা যাক আমাদের সামনে নতুন কোনো দিগন্ত তা উন্মোচন করতে পারে কিনা।

(প্রকাশ, জ্ঞান ও বিজ্ঞান শারদীয় ২০১৮, সামান্য পরিবর্তিত)








Sunday 21 October 2018

উর্সুলা লেগুইনের সাহিত্য




উর্সুলা লেগুইনের সাহিত্যঃ প্রকৃত নামের ইন্দ্রজাল  

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

‘... do you know, by your own experience, what patriotism is?’
‘No’, I said,  ... ‘If by patriotism you don´t mean the love of one`s homeland, for that I do know.’
‘No, I don’t mean love, when I say patriotism. I mean fear. The fear of the other. And its expressions are political, not poetical: hate, rivalry, aggression. It grows in us
, that fear.’
                              (The Left Hand of Darkness)

      হ্যারি পটারকে নিয়ে উন্মাদনা যখন চরমে, তখন আমার এক সহকর্মী আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গল্পগুলোর মধ্যে কী আছে আমি উত্তর দিয়েছিলাম, ‘উর্সুলা লেগুইন যদি পি জি উডহাউসের ভাষায় ইংল্যান্ডের পাবলিক স্কুলের কাহিনি লিখতে বসতেন, তাহলে হ্যারি পটারের মতো গল্প পাওয়া যেত’ আবার ২০১৭ সালের নোবেল জয়ী সাহিত্যিক কাজিও ইশিগুরোর ‘দি বারিড জায়ান্ট’ পড়তে বসে মনে পড়ে গেছে লেগুইনের আর্থসি সিরিজের কথা। সেখানে পেয়েছি একই রকম মিতকথন, একই রকম সাদায় কালোতে মেশানো চরিত্রলেখার এই বিশেষ গুণ লেগুইনের সাহিত্যকে অন্য মাত্রা দিয়েছে।
      ইশিগুরোকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ‘দি বারিড জায়ান্ট’-কে তিনি কি কল্পকাহিনি মনে করেন। তাঁর উত্তর ছিল, এইসব ভাগ, জঁর বা তকমা প্রকাশকদের সৃষ্টি, তাঁদের প্রচারের পক্ষে সুবিধাজনক। লেখককে কোনো বিশেষ তকমাতে আটকে রাখা যায় না। লেগুইনের সঙ্গে এই কথা নিয়ে তাঁর প্রকাশ্য বিতর্কও হয়েছিল। লেগুইনের মনে হয়েছিল ইশিগুরো কল্পকাহিনির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন। শেষ বিচারে সম্ভবত দুজনে খুব আলাদা কথা বলেন নি -- লেগুইনও মেনে নিয়েছিলেন যে ইশিগুরো কল্পকাহিনিকে মূলধারা থেকে আলাদা করতে চান নি।
উর্সুলা কে লেগুইন (আলোকচিত্র ঃ Gorthian,  CC BY-SA 3.0)
      উর্সুলা কে লেগুইন (২১ অক্টোবর ১৯২৯ -- ২২ জানুয়ারি ২০১৮) ব্যক্তিগতভাবে কল্পকাহিনি অর্থাৎ ফ্যান্টাসি কিংবা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যিক হিসাবে পরিচিত হতে পছন্দ করতেন না মেইনস্ট্রিম বা মূলধারা তাঁর লেখায় সেই তকমা লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল। বরঞ্চ তিনিই মূলধারাকে পালটে দিয়েছিলেন, বাধ্য করেছিলেন তাঁকে স্বীকার করতে আজও কল্পবিজ্ঞান বা কল্পকাহিনি অনেকের কাছেই মূলধারার সাহিত্য হিসাবে গণ্য হয় না। তাঁদের প্রতি অনুরোধ, ২০০৭ সালের নোবেলজয়ী লেখিকা ডরিস লেসিঙের বই ‘শিকাস্টা’-র ভূমিকাটা পড়ে দেখুন।  লেসিঙের ‘ক্যানোপাস ইন আর্গসঃ আর্কাইভস’ সিরিজের পাঁচটি বই কাঠামোর দিক থেকে নিখাদ কল্পবিজ্ঞান, তার প্রথম বই ‘শিকাস্টা’ উপন্যাসটির ভূমিকায় ১৯৭৮ সালে  তিনি লিখেছিলেন যে বর্তমানে কল্পবিজ্ঞান হল সাহিত্যের সবচেয়ে উদ্ভাবনী ধারা। আমাদের চারদিকের জগতটা প্রতিদিন আরো উদ্ভট, আরো অবিশ্বাস্য হচ্ছে, তার ফলে ঔপন্যাসিকরাও বাস্তবতার বেড়া ভেঙে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন। ওলাফ স্টেপলডনের ‘লাস্ট এন্ড ফার্স্ট মেন’ এবং তথাকথিত “সিরিয়াস” উপন্যাসকে আলাদা আলাদা তাকে সাজানোর মনোভঙ্গিটা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন লেসিঙ   
      লেসিঙের কথার সূত্র ধরেই বলি, লেগুইনের কল্পবিজ্ঞান বা কল্পকাহিনি হল জীবনকে অন্যভাবে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রয়াস। আধুনিক কল্পবিজ্ঞানের জগতটাকে পালটে দিয়েছিলেন লেগুইন। নারীবাদের উচ্চকিত ঘোষণা না থাকলেও নারীবাদী কল্পবিজ্ঞানের তিনি প্রথম স্রষ্টা। অনেক সমালোচকেরই মতে লেগুইনের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘দি লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস’ (প্রকাশকাল ১৯৬৯) উপন্যাসের গেথেন গ্রহের মানুষরা উভলিঙ্গ, কিন্তু আমরা যে অর্থে সাধারণত শব্দটা ব্যবহার করি সেই অর্থে নয়। গেথেনের মানুষরা আমাদেরই বংশধর, কিন্তু তাদের লিঙ্গ সাধারণভাবে নির্দিষ্ট নয়। একমাত্র ঋতুকালেই তাদের মধ্যে মিলন সম্ভব এবং সেই সময় পরিস্থিতির, বিশেষ করে সঙ্গীর চরিত্রের উপর, নির্ভর করে কোনো বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে পুরুষ বা নারী রূপের প্রকাশ ঘটে। যাদের লিঙ্গ পরিবর্তন হয় না, সেরকম মানুষকে সেখানে পার্ভার্ট বা বিকৃতকাম মনে করা হয়।     
      লেগুইন গেথেন নয়, আসলে আমাদেরই সমাজব্যবস্থার উপর নারী-পুরুষের দৈহিক পার্থক্যের প্রভাব দেখতে চাইছেনপৃথিবী থেকে একজন সাধারণ অর্থে পুরুষ, জেনলি আই, সেই গ্রহে দূত হয়ে এসেছেপ্রতি মুহূর্তে তার সঙ্গে গেথেনের অধিবাসীদের ভুল বোঝাবুঝি হয়। নারী-পুরুষে বিভক্ত যে সমাজে আই-এর জন্ম, সে তার ধ্যান-চিন্তা-ধারণাকে গড়ে তুলেছে, এবং তার সঙ্গে গেথেনের সমাজের মৌলিক পার্থক্য আছে। অপরাধ গেথেনে হয়, কিন্তু দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ হয় না। একই ব্যক্তি একই সঙ্গে কোনো সন্তানের বাবা, আবার অন্য কোনো সন্তানের মা -- তার ফলে আমাদের চেনা পরিবারের ছক সেখানে অচল। লেগুইন নারী-পুরুষের মধ্যে স্বীকৃত সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসেছেন, আমাদের সমাজের উপর পিতৃতান্ত্রিকতার প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন
      এই গ্রহেরই পটভূমিকায় অন্য একটি গল্প ‘উইন্টার্স কিং’ (প্রকাশকাল ১৯৬৯) যখন ‘দি উইন্ডস টুয়েলভ কোয়ার্টার্স’ বইতে সংকলিত হয়েছিল, লেগুইন গল্পটিকে সামান্য পালটে দিয়েছিলেননতুন রূপে গল্পটিতে রাজা বা King-এর জন্য She সর্বনামের ব্যবহার চমকে দেয়, বারবার ফিরে পড়তে হয়। অন্যান্য কল্পবিজ্ঞান অ্যালিয়েন খুঁজতে ভিনগ্রহে যায়, লেগুইনের অ্যালিয়েনরা অন্য গ্রহে থাকলেও তারা আমাদের মতোই মানুষ – কিন্তু তাদের আর আমাদের মধ্যে উঠেছে দুর্লংঘ্য দেওয়াল। সেই দেওয়াল তৈরি করেছে আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ, যা আমাদের চিন্তাভাবনাকে একটা লক্ষ্মণরেখার মধ্যে বেঁধে রাখতে চায়। লেসিঙের মতোই তিনি নতুন জগত নির্মাণ করছেন, আমাদের বহুদিনের সযত্ন লালিত ধ্যানধারণা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, আমাদের বাধ্য করছেন চেনা গণ্ডির বাইরে বেরোতে। এই প্রবন্ধের শুরুর উদ্ধৃতিটি ‘দি লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস’ থেকে নেয়া, তা আমাদের বর্তমান সমাজের ক্ষেত্রে কতটা প্রযোজ্য তা ব্যাখ্যা করে বলার বোধহয় অপেক্ষা রাখে না।
      লেগুইন তাঁর লেখাতে রূপক আরোপ করতে চাইতেন না, তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন যে তিনি শুধু একটা গল্প বলতে চান। কিন্তু ‘দি লেদ অফ হেভেন’-এর (প্রকাশকাল ১৯৭১) কোনো পাঠক যদি আমার মতো  গল্পের ভিতরে গভীর কোনো অর্থ খুঁজে পায় তাহলে তাকে বোধহয় দোষ দেয়া যাবে না। গল্পের ২০০২ সালের পৃথিবী বিশ্বউষ্ণায়নের শিকার। মধ্য প্রাচ্যে যুদ্ধ চলছে, আমেরিকাতেও জীবনযাত্রার মান ক্রমশই নামছে। জর্জ অর নামের এক ড্রাফটসম্যান গল্পের মুখ্য ভূমিকায়, সে যা স্বপ্ন দেখে তা বাস্তবে পরিণত হয়। অন্য সকলের কাছেই সেই নতুন বাস্তবটা চিরকালের জন্য সত্য, তাদের স্মৃতিতে অতীতটাও নতুন বাস্তবের অনুসারে পালটে যায়। শুধু অরের স্মৃতিতে পুরানো অতীতের ছবি ধরা থাকে। বাঁধা গতের বাইরে চিন্তা করার জন্য সমাজ জর্জ অরের উপর মনোরোগীর তকমা লাগিয়ে দেয় হেবার নামের এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ তার এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করে পৃথিবীর মঙ্গল করতে চায়, কিন্তু অরের কল্পনার নতুন বিশ্ব প্রতিটি পরিবর্তনের পরে খারাপ থেকে আরো খারাপের দিকে যায়। হেবারের উপচিকীর্ষা ক্রমশ ক্ষমতালোভে পর্যবসিত হয়। হেবারের চরিত্রের মাধ্যমে ইউটিলিটারিয়ানিজম বা হিতবাদের কঠোর সমালোচনা করেছেন লেগুইন।
      সমালোচকদের মতে জর্জ অরের নাম দেওয়ার সময় লেগুইন হয়তো জর্জ অরওয়েলের কথা ভাবছিলেন। হতে পারে, কারণ ‘নাইনটিন এইটি ফোর’-এর লেখকের মতোই লেগুইনও সমাজকে নানা দিক থেকে দেখতে চেয়েছিলেন। তাঁর আর একটি বিখ্যাত উপন্যাস ‘দি ডিসপজেসডঃ অ্যান অ্যাম্বিগুয়াস ইউটোপিয়া’ (প্রকাশকাল ১৯৭৪)। এই উপন্যাসে তিনি পুঁজিবাদ, পিতৃতন্ত্র, সমাজবাদ, নৈরাজ্যবাদ নানা ধরণের সমাজব্যবস্থাকে পাশাপাশি রেখেছেন। লেগুইনের গল্পের  ইউটোপিয়া কিন্তু কল্পনার স্বর্গ নয়, অ্যাম্বিগুয়াস অর্থাৎ সন্দেহাকীর্ণ বা দ্ব্যর্থকগল্পের মূল চরিত্র শেভেক এক পদার্থবিজ্ঞানী, সে সময়ের চরিত্র নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেছে, দেখিয়েছে সময় যে সবসময় সরল ভাবে এগোয় বলে আমরা মনে করি তা আসলে ভুল। শেভেকের আবিষ্কারের মতোই উপন্যাসও সময়ের সঙ্গে রৈখিকভাবে এগোয়নি। গল্প কখনো ভবিষ্যৎ থেকে অতীতে ফিরে গেছে, কখনো বা এক সমাজ থেকে অন্য সমাজে ঝাঁপ দিয়েছে। লেগুইন কখনো পাঠককে নিশ্চিন্তে থাকতে দেবেন না, প্রতি মুহূর্তে তাঁর মনোযোগ দাবি করেন।
      কল্পবিজ্ঞান থেকে এবার আসি লেগুইনের কল্পকাহিনিতে। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত ‘দি ওয়ার্ড অফ আনবাইন্ডিং’ গল্পটি যে জগতের ইঙ্গিত দিয়েছিল, সেই জগতেই লেগুইন রচনা করেছেন পাঁচটি উপন্যাস ও আরো কয়েকটি গল্প। এগুলি একত্রে ‘আর্থসি’ নামে পরিচিত। আর্থসির জগত হল এক দ্বীপমালা ও সমুদ্রের বিশ্ব। সেখানে সমাজে জাদুবিদ্যা এক প্রধান স্থান অধিকার করে আছে -- কিন্তু তা সংযত, নমিত, নিজেকে সে জাহির করে না। জেড নামের এক কিশোর জাদুবিদ্যার এক অসাধারণ প্রতিভা, কিন্তু কৈশোরের অপরিণামদর্শিতাতেই সে ভুলক্রমে এক ছায়াজীবকে সৃষ্টি করে, যে জেডকে ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কেমনভাবে জেড সেই ছায়াজীবের মুখোমুখি হল, তাই নিয়েই প্রথম উপন্যাস ‘এ উইজার্ড অফ আর্থসি’-র (প্রকাশকাল ১৯৬৮) কাহিনি। এই উপন্যাস মূলত জেডের বয়ঃপ্রাপ্তির কাহিনি -- কৈশোরের বলগাহীন প্রতিভা অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সংযমের শাসনে বাঁধা পড়ে। উপন্যাসের সমাপ্তি আমাকে বিস্মিত করেছিল, বাধ্য করেছিল পুরো উপন্যাস আবার ঘুরে পড়তে। দেখেছিলাম লেগুইন বারে বারে উপন্যাসের সমাপ্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন, কিন্তু  লেখনীর মুনশিয়ানা এমনই যে একমাত্র দ্বিতীয়বার পাঠেই তারা আমার চোখে ধরা পড়েছিল।
      সর্বকালের সেরা কল্পকাহিনিকারদের মধ্যে লেগুইন অবশ্যই জায়গা করে নেবেনআমার বিচারে টলকিয়েনের ‘দি লর্ড অফ দি রিংস’ আর লেগুইনের ‘আর্থসি’ সিরিজের উপন্যাসগুলি একই স্থান অধিকার করে নেবে। এই সিরিজের প্রথম তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হয় চার বছরের মধ্যে, সেগুলি প্রথমে কিশোরসাহিত্য হিসাবেই পরিচিত হয়েছিল এবং যথেষ্ট খ্যাতি কুড়িয়েছিল কিন্তু লেগুইন তাতে খুশি হননি, তার সঙ্গত কারণও ছিল ‘দি লর্ড অফ দি রিংস’-এর মতোই দশ বছরের শিশু থেকে শুরু করে প্রাপ্তবয়স্ক, সকলের কাছেই এই উপন্যাসগুলির আবেদন অসাধারণ গল্প বলার নৈপুণ্যে এবং কল্পনার শক্তিতে  উপন্যাসগুলি যেমন পাঠককে ধরে রাখে, তেমনি তার অন্তর্নিহিত অর্থ আমাদের জীবন এবং, আরো বিশেষ করে বললে, মৃত্যুর মুখোমুখি হতে শেখায় মার্গারেট অ্যাটউডের মতো সাহিত্যিকও আর্থসি-র গল্পগুলির আবেদনকে সার্বজনীন বলেই মনে করেছেন, সেগুলো পরবর্তীকালে বয়স্কদের মধ্যেও বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
লেখা শুরুর সময় বলেছিলাম হ্যারি পটারের গল্পের কথা  আর্থসি-তেই প্রথম খুঁজে পাই জাদুবিদ্যা শেখার স্কুলের কথা প্রতিভাধর জেড সেই স্কুলে গিয়ে এক শত্রু তৈরি করবে যে তারই সঙ্গে এক অচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধা সে প্রথম সাক্ষাতেই জেডকে আক্রমণ করে তার দেহে আঘাতের চিহ্ন এঁকে দেবে তাকে রক্ষা করতে গিয়ে প্রাণ দেবে তার এক প্রিয়জন। যখনই ছায়াজীব জেডের কাছাকাছি আসে, তখনই সেই পুরানো ক্ষতচিহ্ন তাকে যন্ত্রণা দেয় গল্পটা চেনা লাগছে কি? এই প্রবন্ধ লিখতে বসে দেখলাম অনেকেই জে কে রাউলিঙের উপর লেগুইনের প্রভাবের কথা বলেছেন তবে দুজনের লেখাতে তফাতও কম নয়। রাউলিঙের লেখা উচ্চকিত, লে গুইনের ভাষা তুলনায় মৃদু রাউলিঙের জাদুকরদের জগত আমাদের বিশ্বের সঙ্গে সমান্তরালে অবস্থান করে। তারা আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে, কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের জীবনের অঙ্গ নয়। তাদের জাদু অধিকাংশ সময়েই চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। লেগুইনের আর্থসিতে জাদুকররা সমাজের স্বাভাবিক অংশ, আলাদা করে সম্ভ্রমের পাত্র নয় চাষী, কামার বা জেলের মতো জাদুকরদেরও উপার্জন করে খেতে হয়।
আমার ব্যক্তিগত মত আর্থসি সিরিজের প্রথম উপন্যাসই গল্প হিসাবে সবচেয়ে সুখপাঠ্য কিন্তু পরের উপন্যাসগুলিতে লেগুইন মানবপ্রবৃত্তির আরো গভীরে প্রবেশ করেছেন, তাকে বিশ্লেষণ করেছেন একটা বিশেষ উদাহরণ দেখা যাক প্রথম দিকের গল্পে নারী চরিত্রগুলি তেমন রূপ পায়নি ‘দি লেফট হ্যান্ড অফ ডার্কনেস’-এর স্রষ্টার কাছে যে ধরনের নারীকে আমরা আশা করি, চরিত্রগুলি তার কাছাকাছিও পৌঁছায়নি দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দি টম্বস অফ আটুয়ান’-এর (প্রকাশকাল ১৯৭১) কথক টেনার নারী, উপন্যাসে সে এক মুখ্য ভূমিকা অধিকার করেছে কিন্তু গল্পে সে পশ্চাৎপট ছাড়া কিছু নয় জেডই গল্পের নায়ক, পাদপ্রদীপের সমস্ত আলোই পড়েছে তার উপরে 
      তৃতীয় উপন্যাস ‘দি ফার্দেস্ট শোর’-এর (প্রকাশকাল ১৯৭২) সমাপ্তিতে জেড তার সমস্ত জাদুক্ষমতা হারিয়ে সাধারণ মানুষে পরিণত হয়েছিল আঠারো বছর পরে লেগুইন যখন আবার আর্থসিতে ফিরে গেলেন, তখন পেলাম এক অন্য ধারার গল্প পশ্চাৎপট একই, কিন্তু সমাজকে আমরা দেখলাম অন্য চোখে। টেনারের নারীত্বকে স্বীকার করে জেডের যেন নবজন্ম হল চতুর্থ উপন্যাস ‘টেহানু’-তে (প্রকাশকাল ১৯৯০) জাদুকরশ্রেষ্ঠ জেড নয়, আমরা খুঁজে পেলাম মানুষ জেডকে লেগুইন দেখালেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সীমাবদ্ধতা, লিখলেন নারীদের প্রাপ্য স্থান ও অধিকার থেকে বঞ্চনার কাহিনি আর্থ সির জাদুবিশ্ব নিশ্চয় পৃথিবী নয়, তার সমাজও প্রথম দর্শনে আমাদের সমাজের থেকে আলাদা কিন্তু লেগুইনের লেখনীর গুণে তারা এক জায়গায় এসে মেলে
তাঁর লেখা থেকে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে ট্রু নেম অর্থাৎ প্রকৃত বা জন্মগত নামের ধারণা। অনেক প্রাচীন সমাজ বিশ্বাস করত যে প্রত্যেক জিনিসের বা প্রাণীর এক জন্মগত নাম আছে। সেই নামের মধ্যে তার সমস্ত চারিত্রবৈশিষ্ট্য পাওয়া যাবে, তাই তা জানতে পারলে সেই বস্তু বা প্রাণীকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়‘দি রুল অফ নেমস’ (প্রকাশকাল ১৯৬৪) গল্প থেকে শুরু করে আর্থসি-র প্রত্যেকটি গল্পে এই ধারণার অসাধারণ ব্যবহার করেছেন লেগুইন। ‘এ উইজার্ড অফ আর্থসি’ উপন্যাসে ছায়াজীবের প্রকৃত নাম আবিষ্কারের মধ্যে দিয়েই জেডের মুক্তি ঘটে।
সারা জীবন নানা সম্মান পেয়েছেন উর্সুলা লেগুইন কল্পবিজ্ঞান ও কল্পকাহিনির জন্য যে কটি পুরষ্কার দেওয়া হয়, তাদের সবগুলির তালিকাতেই তাঁর নাম পাওয়া যাবে, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশ কয়েকবার তাঁর গল্পে একাকার হয়ে গেছে নৃতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব, পরিবেশবিজ্ঞানতাই লেগুইনের লেখার ড্রাগনরা কিন্তু শুধু গল্পের মধ্যে বাস করে না। তাঁর এক সতর্ক বার্তা দিয়েই লেখা শেষ করি।
People who deny the existence of dragons are often eaten by dragons. From within.

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, উৎসব সংখ্যা ২০১৮