Monday 21 February 2022

বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদঃ পঁচাত্তর বছরের পথ চলা

 

বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদঃ পঁচাত্তর বছরের পথ চলা


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

দেশের স্বাধীনতার ঠিক পরেই অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উৎসাহেই বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চার জন্য যে প্রতিষ্ঠান যাত্রা শুরু করেছিল, সেই বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ পঁচাত্তর বছরে পা দিল। মাতৃভাষাতে বিজ্ঞান চর্চা বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথের আগ্রহের কথা সুপরিচিত। স্বাধীনতার পরেই তিনি লিখেছিলেন, "এই স্বাধীনতার সুফল যেন শুধু অল্পসংখ্যক ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিতের আয়ত্তের মধ্যে না থাকে, সেগুলি যেন দেশের সকল লোকের কাছে পৌঁছে যায়।" নিঃসন্দেহে স্বাধীনতার সুফলের মধ্যে বিজ্ঞানপ্রযুক্তি তাঁর চিন্তার মধ্যে ছিল, এবং দেশের সকল লোকের কাছে পৌঁছানোর বাহন যে মাতৃভাষা তা নিয়েও তাঁর সন্দেহ ছিল না। এই প্রবন্ধে আমরা কেন মাতৃভাষাতে বিজ্ঞান চর্চা জরুরি সেই আলোচনাতে যাব না, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের সংক্ষিপ্ত ইতিহাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকব। সত্যেন্দ্রনাথ বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান লেখা শুরু করেছিলেন পরিচয় পত্রিকাতে, ১৯৩১ সালে প্রকাশিত সেই প্রবন্ধের নাম 'বিজ্ঞানের সংকট।' তিনি ১৯২১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। স্বাধীনতার আগে অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জায়গাতে যে সাম্প্রদায়িক অশান্তি সৃষ্টি হয়েছিল, তা দেশভাগের দু'বছর আগেই সত্যেন্দ্রনাথকে ঢাকা ছাড়তে বাধ্য করে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপকপদে যোগ দেন। ঢাকাতেই ১৯৪১ সালে তাঁর চেষ্টাতে 'বিজ্ঞান-পরিচয়' নামে একটি দ্বিমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি ঢাকা ছাড়ার পরে সেটি চালু রাখা সম্ভব হয়নি। 

স্বাধীনতা লাভের প্রাক্কালেই কলকাতার বিজ্ঞানীমহলে মাতৃভাষার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানপ্রচার ও প্রসারের জন্য আলোচনা শুরু হয়েছিল, সত্যেন্দ্রনাথ ছিলেন সেই আলোচনার কেন্দ্রে। এ বিষয়ে আমাদের দেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের উৎসাহ ছিল; জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাদ সাহা, প্রফুল্লচন্দ্র রায় সহ অনেকেই সেই কাজে হাত লাগিয়েছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১৮ অক্টোবর সত্যেন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণাতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের  রসায়নের অধ্যাপক সুবোধনাথ বাগচির উদ্যোগে রাজাবাজারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে এক সভা অনুষ্ঠির হয়েছিল। সভাতে সভাপতিত্ব করেন রসায়নের অধ্যাপক সর্বাণীসহায় গুহ সরকার। সভাতে মোট চব্বিশজন উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সুপরিচিত সাহিত্যিক পরিমল গোস্বামী ছাড়া সকলেই ছিলেন বিজ্ঞান জগতের সঙ্গে যুক্ত। এই সভাতেই সিদ্ধান্ত হয় যে ১৯৪৮ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হবে। এই কাজের জন্য একটি পরিচালক মণ্ডলী তৈরি হয়, তার সভাপতি হন সত্যেন্দ্রনাথ ও কর্মসচিব সুবোধনাথ। এর পর পরিচালকমণ্ডলী পরিষদ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গেই একই দিনে থেকে 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়। পত্রিকার সম্পাদক হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের অধ্যাপক প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র।

পরিষদের কাজের জন্য সকলের সহায়তা চেয়ে একটি আবেদনপত্র প্রচারিত হয়েছিল। সেই আবেদনে এবং 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতে কর্মসচিব সুবোধনাথের একটি লেখাতে পরিষদের পাঁচটি উদ্দেশ্য লেখা হয়েছিল। সংক্ষেপে বলা যায়, () জনগণের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী গঠন, () স্কুল-কলেজের পাঠ্যবস্তুকে সহজভাষায় চিত্তাকর্ষক কিন্তু যথাযথরূপে প্রকাশ, () স্কুল-কলেজের জন্য পাঠ্যপুস্তক ও অন্যান্য ধরনের বিজ্ঞানের বই প্রকাশ, () সাহিত্য, বিশেষ করে শিশুসাহিত্যে বিজ্ঞানের প্রবেশ ঘটানো, এবং () বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শনী ও বক্তৃতা এবং বাৎসরিক সম্মেলন আয়োজন। 

১৯৪৮ সালের ২৫ জানুয়ারি রামমোহন লাইব্রেরি হলে প্রায় চারশোজনের উপস্থিতিতে পরিষদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সভার সভাপতিত্ব করেন সাহিত্যিক রাজশেখর বসু যিনি পরশুরাম ছদ্মনামে বিখ্যাত। প্রধান অতিথি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। বক্তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কর্মসচিব সুবোধনাথ বাগচি, হেমেন্দ্রপ্রসাদ ঘোষ, অতুলচন্দ্র গুপ্ত, সজনিকান্ত দাশ ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

পরিষদের প্রথম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিজ্ঞান কলেজে ফলিত রসায়ন বিভাগের বক্তৃতা কক্ষে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮। সভাতে সভাপতিত্ব করেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু। পরিচালকমণ্ডলী এক গঠনতন্ত্র তৈরি করেছিলেন, সেটি সাময়িক ভাবে গৃহীত হয়। এক মন্ত্রণাপরিষদ তৈরি হয়, তার সদস্য ছিলেন একশো একান্ন জন। মন্ত্রণা পরিষদে রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান, রাশিবিজ্ঞান, প্রাণিবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদির পাশাপাশি ছিল সাহিত্যবিজ্ঞানের জন্য জায়গা ছিল; সেখানকার সদস্যদের মধ্যে বিনয়কুমার সরকার, রাজশেখর বসু, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, গোপাল হালদার প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। পশ্চিম বাংলার বাইরে দিল্লি, এলাহাবাদ, রাঁচি, ঢাকা ইত্যাদি জায়গা থেকেও মন্ত্রণা পরিষদের সদস্য নেওয়া হয়েছিল। সেই বছর ১৮ই মার্চ মন্ত্রণাপরিষদের সভাতে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তা দেবেন্দ্রমোহন বসুকে সভানায়ক ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক দুঃখহরণ চক্রবর্তী সচিব নির্বাচিত করা হয়। ১৯৪৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বার্ষিক সাধারণ অধিবেশনে গঠনতন্ত্র চূড়ান্তরূপে গৃহীত হয়, এর পর মন্ত্রণা পরিষদের জায়গা নেয় সারস্বত সংঘ। প্রথমদিকে প্রতিবছরই কার্যকরী সমিতির নির্বাচন হত। ১৯৮৩ সাল থেকে কার্যকরী সমিতির সময়কাল বাড়িয়ে তিন বছর করা হয়, সেই নিয়মই এখনো চলছে। ১৯৭৪ সালে সত্যেন্দ্রনাথের প্রয়াণ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন পরিষদের সভাপতি। বর্তমানে পরিষদের আজীবন ও বাৎসরিক, এই দুই রকমের সভ্যপদ আছে।  

বসু বিজ্ঞান মন্দির কর্তৃপক্ষ একটি ঘর পরিষদকে ব্যবহারের জন্য দিয়েছিলেন। প্রথম যুগে পরিষদের কার্যকলাপ মূলত সেই ঘর ও বিজ্ঞান কলেজে সত্যেন্দ্রনাথের অফিস থেকেই পরিচালিত হত। পরিষদের নিজস্ব বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয় ১৯৬০-এর দশকে। ১৯৬০ সালে গোয়াবাগানে কলকাতা ইম্প্রুভমেন্ট ট্রস্টের কাছে একটি জমি কেনা হয়েছিল, ১৯৬৪ সালে থেকে সেখানে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৬৪ সালের ১ জানুয়ারি পরিষদ ভবনের ভিত্তিপ্রস্ত্র স্থাপন করেন তখনকার মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লকুমার সেন। বাড়ি তৈরির টাকা সাধারণ মানুষ ও সরকারের কাছ থেকে দান হিসাবে পাওয়া গিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে পরিষদ নতুন বাড়ি থেকে কাজ শুরু করে। প্রথমে কেবল বেসমেন্ট ও একতলা থাকলেও পরে অর্থ জোগাড় হলে ভবনের আরো দুটি তলা নির্মাণ সম্ভব হয়েছে।  

পরিষদ প্রথম থেকেই বিজ্ঞান বিষয়ক বই প্রকাশে জোর দিয়েছিল। কার্যকরী সমিতির সিদ্ধান্ত অনুসারে লোকবিজ্ঞান গ্রন্থমালা নামে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বই প্রকাশ করা হয়েছিল। প্রথম বইটি লেখেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য; 'তড়িতের অভ্যুত্থান' নামের এই বই পরিষদের প্রথম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদ্‌যাপনের অনুষ্ঠানে (ফেব্রুয়ারি ২, ১৯৪৯) প্রকাশিত হয়েছিল। এই গ্রন্থমালাতে বেশ কিছু সুপরিচিত বিজ্ঞানী বিভিন্ন সময়ে লিখেছেন। এছাড়া বিজ্ঞানপ্রবেশ নাম দিয়ে পরিষদ বিজ্ঞানের গোড়া থেকে শুরু করার জন্য বই প্রকাশ করবে স্থির করেছিল। প্রথম দুই বছরে চারটি বই প্রকাশিত হয়েছিল, পদার্থবিদ্যার গোড়ার কথা নিয়ে চারটিই বইয়েরই লেখক ছিলেন চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। এই গ্রন্থমালা দুটির কয়েকটি বইয়ের একাধিক সংস্করণ হয়েছিল। পরিষদ একটি বিজ্ঞান বিষয়ক এনসাইক্লোপেডিয়া বা বিজ্ঞানকোষ প্রণয়নের পরিকল্পনা নিয়েছিল, কিন্তু সরকারি সাহায্য না পাওয়াতে তা পরিত্যক্ত হয়।

বর্তমানে আগের মতো কোনো গ্রন্থমালা প্রকাশিত না হলেও পরিষদ নিয়মিত বই প্রকাশের চেষ্টা করে চলেছে। বইগুলি লিখেছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান লেখকরা। বিজ্ঞানীদের জীবন, কর্মকাণ্ড ও এবং বিজ্ঞানের নানা দিক সেখানে উঠে আসে। এর মধ্যে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর পরিবারের আর্থিক সহায়তায় প্রকাশিত জনবোধ্য পুস্তকগুলির আলাদা করে উল্লেখ করতে হয়। পরিষদ প্রকাশিত অসীমকুমার মুখোপাধ্যায়ের লেখা 'বাংলার নবজাগরণে বিজ্ঞান চেতনা' বইটি রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছে। বর্তমানে পরিষদের বইগুলি আন্তর্জালে বিপণনের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ই-বই প্রকাশের দিকে নজর দেওয়া হয়েছে।

তিনটি বইয়ের কথা বিশেষ করে বলতে হয়। ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল "সত্যেন্দ্রনাথ বসুঃ রচনা সংকলন"। ১৯৯৩ সালে সত্যেন্দ্রনাথের জন্ম শতবর্ষে এই বইটির একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সম্প্রতি পরিষদের পঁচাত্তরতম বর্ষে একটি পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সত্যেন্দ্রনাথের ছাত্রী পূর্ণিমা সিংহ তাঁর শিক্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়ে তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন, 'আমার কথা' নামের সেই বইটি আবার সম্প্রতি পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস নিয়ে অধ্যাপক জয়ন্ত বসু লিখেছিলেন 'বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদঃ পঞ্চাশ বছর পরিক্রমা'।

 পরিষদ প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে কয়েকটি ছিল পাঠ্যপুস্তক। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের অনুরোধে পর্ষদ ১৯৫১ সালে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণির জন্য প্রাথমিক বিজ্ঞান (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগ) তিনটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছিল। দ্বিতীয়টির লেখক ছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য, অন্য দুটির চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য। ১৯৫৯ সালে পরিষদ মাধ্যমিক স্তরের বিজ্ঞানের কয়েকটি পাঠ্যপুস্তক প্রকাশ করেছিল। মাধ্যমিক পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও জীববিদ্যার বই তিনটির লেখক ছিলেন তিন সুপরিচিত বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, যথাক্রমে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, অসীমা চট্টোপাধ্যায় ও রুদ্রেন্দ্রকুমার পাল। ১৯৬৮ সালে ম্যাকমিলান কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে চারটি বিজ্ঞানের পাঠ্যপুস্তক প্রকাশিত হয়েছিল এবং সেগুলি যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল। এই বইগুলি কোনো একক লেখক নয়, বেশ কয়েকজন মিলে লিখিত ও সম্পাদিত। তবে পরে নানা কারণে পরিষদ পাঠ্যপুস্তকের প্রকাশ বা লেখা থেকে সরে আসে।

পরিষদের প্রকাশিত 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকা বাংলাতে বিজ্ঞান লেখার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। পত্রিকাতে প্রথম বছর লেখকদের জন্য যে নিবেদন রাখা হয়েছিল, তা থেকে এখনো আমরা বিজ্ঞান লেখা কেমন হওয়া উচিত সে সম্পর্কে পরামর্শ পেতে পারি। সংক্ষেপে বলা যায়, () লেখা এমন বিষয়ে হওয়া উচিত যা মানুষকে আকৃষ্ট করে; () ভাষা হতে হবে সহজ-সরল; () লেখা অনাবশ্যক দীর্ঘ না করে পত্রিকার চার-পাঁচ পাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখাই ভালো; () উপযুক্ত পরিভাষা না থাকলে বিদেশি শব্দকে বাংলা হরফে লেখাই বাঞ্ছনীয়।

প্রফুল্লচন্দ্র মিত্রের সম্পাদনাতে পত্রিকা প্রকাশ শুরু হয়েছিল, ১৯৪৯ সাল থেকে গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্যও প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র যুগ্মভাবে সম্পাদনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন। দ্বিতীয়জন সময়ের অভাবে অব্যাহতি নিলে ১৯৫০ সাল থেকে সম্পাদকের পূর্ণ দায়িত্ব নিয়েছিলেন গোপালচন্দ্র ভট্টাচার্য। ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে তিনি হন পত্রিকার প্রধান উপদেষ্টা, কার্যকরী সম্পাদক ছিলেন তখনকার কর্মসচিব রতনমোহন খাঁ। আর কখনোই এত দীর্ঘকাল সম্পাদক কেউ থাকেননি, অনেক সময় সম্পাদকের পরিবর্তে সম্পাদনা-সচিব দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বর্তমানে সম্পাদনা-সচিবের নেতৃত্বে এক সম্পাদকমণ্ডলী পত্রিকা প্রকাশের কাজ করে।  পত্রিকার প্রথম বছর থেকেই ছোটদের পাতা ও পরে কিশোরবিজ্ঞানীর দপ্তর নামে ছোটদের জন্য লেখা প্রকাশিত হয়। প্রথমদিকে সেগুলির অধিকাংশেরই লেখক ছিলেন গোপালচন্দ্র। বিশেষ করে 'করে দেখ' শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলি বিজ্ঞানের পরীক্ষানিরীক্ষা ও মডেল তৈরিতে উৎসাহ দিয়েছিল। এই লেখাগুলি পরে একত্রিত করে পরিষদ থেকে দুই খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। অনেক তরুণ লেখক 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকাতে লিখে পরিচিতি পেয়েছেন। একসময় ছোটবড় অনেক বইয়ের দোকানে জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকা পাওয়া যেত, প্রচারসংখ্যাও ছিল অনেক বেশি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে অনেক কিশোর এই পত্রিকা পড়ে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ছাপা বই ও পত্রিকার প্রতি পাঠকের আগ্রহ কিছুটা কমেছে। সম্প্রতি খড়গপুরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির উদ্যোগে ন্যাশনাল ডিজিটাল লাইব্রেরি আর্কাইভে 'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকার পুরানো সংখ্যাগুলি রক্ষিত হয়েছে। 

প্রতিষ্ঠার প্রথম বছরেই অক্টোবর মাসে পত্রিকাতে সত্যেন্দ্রনাথের স্বাক্ষরিত এক আবেদন প্রচার হয়েছিল। সত্যেন্দ্রনাথ লেখেন যে পরিষদের উদ্দেশ্য নানারকম হলেও অর্থাভাবে পরিষদ এখনো পর্যন্ত পত্রিকা প্রকাশ ছাড়া অন্য কোন কাজে হাত দিতে পারেনি। তাই বিশেষ করে বক্তৃতা, চলচ্চিত্র প্রদর্শন ইত্যাদির জন্য আশু প্রয়োজন কুড়িহাজার টাকা, সাধারণ মানুষের কাছে তাই মুক্তহস্তে সাহায্যের আবেদন তিনি রাখেন। তার উত্তরে প্রায় ৭২০০ টাকা সংগৃহীত হয়েছিল। পরিষদ বর্তমানে বেশ কয়েকটি বার্ষিক ও দ্বিবার্ষিক বক্তৃতা আয়োজন করে ও মূলত বিজ্ঞান প্রসার ও বিজ্ঞান চর্চার জন্য কিছু পুরস্কার দেয়। বক্তৃতাগুলির মধ্যে সবথেকে প্রাচীন হল রাজশেখর বসু স্মৃতি বক্তৃতা।সত্যেন্দ্রনাথের জন্মের ১২৫ বছর উপলক্ষে পরিষদ সারা বাংলার অনেকগুলি স্কুল ও কলেজে বক্তৃতার আয়োজন করেছিল, অনেক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও অধ্যাপক তাতে অংশ নিয়েছিলেন। এছাড়া বিজ্ঞান সমাজ শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে পরিষদ বেশ কয়েকটি আলোচনাচক্র আয়োজন করেছে। পরিষদ ছাত্রদের মধ্যে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে বক্তৃতা ক্যুইজ মডেল স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিযোগিতা আয়োজন করে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু মৌল বিজ্ঞান কেন্দ্র বিভিন্ন সময়ে পরিষদকে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন, সাধারমণ মানুষও সাহায্যের হার বাড়িয়ে দিয়েছেন।

পরিষদ একটি সত্যেন্দ্রনাথ বসু স্মৃতি সংগ্রহশালা তৈরি করেছে, এখানে আছে সত্যেন্দ্রনাথের ব্যবহৃত পোশাক ও অন্যান্য সামগ্রী, তাঁর লেখা কয়েকটি চিঠির অনুলিপি, সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টের আলোকচিত্র। বাংলাদেশ সরকারের থেকে প্রাপ্ত “মৈত্রী যুদ্ধ সম্মাননা" (মরণোত্তর) পুরস্কারের স্মারক সত্যেন্দ্রনাথের পরিবার পরিষদকে প্রদান করেছে। পরিষদের একটি গ্রন্থাগার আছে, যেখানে বেশ কিছু পত্রপত্রিকা নিয়মিত রক্ষিত হয়। প্রথম দশকগুলিতে বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র এখানে পড়াশোনা করত। কিন্তু বর্তমানে অন্য সব গ্রন্থাগারের মতোই এখানেও পাঠকের সংখ্যা ক্রমশই কমছে। এখন বাংলাতে বিজ্ঞান প্রসারের ইতিহাস বিষয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা ছাড়া গ্রন্থাগার ব্যবহারকারীর সংখ্যা নেই বললেই চলে।

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের মতো সংগঠন ভারতবর্ষে বিশেষ নেই। একাদিক্রমে পঁচাত্তর বছর ধরে বিজ্ঞানের পত্রিকা ও বই প্রকাশ খুব সহজ কাজ নয়। বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান পত্রিকার সংখ্যা এখনও খুবই স্বল্প, তবে বিজ্ঞান বিষয়ক বই অনেক বেরোয়; স্বাধীনতার পরে বাংলা ভাষাতে বিজ্ঞান চর্চা ও প্রসার যা হয়েছে, তার পিছনে পরিষদ প্রকাশিত বই ও পত্রিকার একটা বড় ভূমিকা আছে।

তথ্যসূত্রঃ

বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদঃ পঞ্চাশ বছর পরিক্রমা, জয়ন্ত বসু, বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ

বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণঃ বিজ্ঞান মনস্কতা, সত্যেন্দ্রনাথ ও বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, তপন সাহা (তপনমোহন চক্রবর্তী সম্পাদিত 'আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুঃ জীবন ও কৃতি' গ্রন্থে সংকলিত)

'জ্ঞান ও বিজ্ঞান' পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা

 

প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, জানুয়ারি ২০২২  



Saturday 19 February 2022

ভুতেদের থেকে সাবধান

শুনো না অপপ্রচার,
ভূতপেত্নিরা মানুষ পেলেই
মটকে দেয় না ঘাড়।
                                        তা বলে ভেবো না যেন
                                        অশরীরীদের হেলাফেলা করে
                                        পার পাবে কক্ষনো।
বাজে যবে রাত আটটা
পেত্নী রানিকে সেলাম না দিলে
খেতে হয় রামগাঁট্টা।
                                        আছে সে কন্ধকাটা,
                                        হাসো যদি দেখে মাথা ছাড়া টুপি
                                        মেরে যাবে ঠিক চাঁটা।
কোরো নাকো যেন ভুল,
নিশির গানকে সাবাসি না দিলে
ছিঁড়ে নিতে পারে চুল।                                   
                                        থেকো খুব সাবধান,
                                        ব্রহ্মদত্যি প্রণাম না পেলে
                                        মুলে দেয় দুই কান।
হয়ো নাকো অজ্ঞান
শাঁকচুন্নির হাসি শুনে কভু,
চিমটিতে যাবে প্রাণ।
 
                                        মামদো ভূতের দাড়ি
                                        ভুল করে কভু ছিঁড়ে দাও যদি
                                        পিঠে পড়বেই বাড়ি।
বলে রাখি আগভাগ,
পান থেকে চুণ খসলে পরেই
ভূতেদের জাগে রাগ।
                                        অশরীরীদের গুণ
                                        নাই গাও যদি, মুখেতে তেনারা
                                        দেবেন কালি ও চুণ।
 
(প্রকাশ একপর্ণিকা শারদীয় সংখ্যা  ১৪২৮)