Tuesday 26 February 2019

সূর্যের জীবনকথা


সূর্যের জীবনকথা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


     
     আমাদের পৃথিবীর আকাশে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জ্যোতিষ্ক নিঃসন্দেহে সূর্য। সম্ভবত সমস্ত প্রাচীন সমাজই সূর্যকে দেবতারূপে কল্পনা করেছে। তার আলোকে ব্যবহার করে সবুজ উদ্ভিদ খাবার তৈরি করে, সেই খাবারই সমস্ত জীবজগতকে বাঁচিয়ে রেখেছে। নিউক্লিয় শক্তি আবিষ্কারের আগে আমাদের সমস্ত রকম শক্তির উৎস ছিল সূর্য। সূর্য আমাদের জীবনকে অন্য ভাবেও নিয়ন্ত্রণ করে, কারণ আমরা সময়ের হিসাব করি দিন-রাত্রি মাস বছরের হিসাবে যা পৃথিবী ও সূর্যের আপেক্ষিক গতির উপরে নির্ভর করে। এই লেখাতে আমরা সূর্যের জন্ম বর্তমান অবস্থা নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব।  সূর্যের গঠন সম্পর্কে কোনো কথা এই লেখাতে নেই, আমরা শুধু তার কেন্দ্রে শক্তি উৎপাদনের দিকে নজর রাখব।
      সূর্য একটা মাঝারি মাপের তারা।  তার জন্ম হল কেমন করে? তার জন্মের সময় মানুষের থাকার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মহাকাশে যে হাজার হাজার কোটি নক্ষত্র আছে তাদের পর্যবেক্ষণ করে তারাদের সৃষ্টি ও জীবনকথা সম্পর্কে আমাদের মোটামুটি একটা ধারণা হয়েছে। সেই জ্ঞানের সাহায্যে আমরা সূর্যের জন্ম ও শৈশব সম্পর্কে অনুমান করতে পারি। 
      আমাদের আলোচনাতে কৃষ্ণ বস্তু বা কৃষ্ণ শক্তির কোনো ভূমিকা নেই। তাদের কথা বাদ দিলে আমরা জানি যে আমাদের ছায়াপথ আকাশগঙ্গার মোট ভরের আটানব্বই শতাংশ হল দুটো মৌল, হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম। সূর্যের ভরেরও আটানব্বই শতাংশ এই দুটি মৌল। অবশিষ্ট দুই শতাংশ যে ভারি মৌল আছে, বর্তমান দশা পর্যন্ত সূর্যের মধ্যে সেগুলি তৈরি হওয়া সম্ভব নয় আমরা জানি এই সমস্ত মৌল নানাভাবে বিভিন্ন তারকার জীবনের শেষভাগে সৃষ্টি হয়। আমরা এও জানি যে আদি যুগের তারকাদের মধ্যে হাইড্রোজেন এবং হিলিয়াম ছাড়া অন্য মৌলিক পদার্থ ছিল না। তার অর্থ সূর্য মহাবিশ্বের প্রথম যুগের তারকা নয়, অন্য তারকার মৃতদেহের অবশেষ তার মধ্যে আছে। পৃথিবীর, এমন কি আমাদের দেহেরও প্রায় সমস্ত পরমাণুর উৎস সেই মৃত তারকার দেহাবশেষ -- আমরা সবাই আক্ষরিক অর্থে নক্ষত্রের সন্তান। আমাদের সূর্যের বয়স হল চারশো ষাট কোটি বছরের মতো। পক্ষান্তরে মহাবিশ্বের বয়স তেরোশো আশি কোটি বছর।
      আমাদের ছায়াপথে অনেক বিশাল বিশাল মহাজাগতিক মেঘ আছে, যাদের অধিকাংশই হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম, এই দুটো মৌলিক পদার্থ দিয়েই তৈরি। এই সব মেঘ আণবিক মেঘ (molecular cloud) নামেও পরিচিত। এক একটা মেঘ হয়তো কয়েকশো পারসেক চওড়া এবং তাদের ভর হয়তো আমাদের সূর্যের ভরের কয়েকশো গুণ থেকে কয়েক হাজার গুণ ভর বেশি হলেও বিশাল আয়তনের জন্য এদের ঘনত্ব খুব কম, এক ঘন সেন্টিমিটারে কয়েকশো অণু পাওয়া যাবে। তুলনায় আমাদের বাতাসে এক ঘন সেন্টিমিটারে অণুর সংখ্যা 3X1019 অর্থাৎ তিন লক্ষ কোটি কোটির কাছাকাছি। (এখানে বলে রাখি পারসেক হল জ্যোতির্বিদ্যাতে নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত একক। এক পারসেক (pc) হল 3.26 আলোকবর্ষের সমান এবং এর মাপ হল 3.1X1016 মিটার। সূর্যের ভর M=2X1030 কিলোগ্রাম।) মহাবিশ্বের তাপমাত্রা খুব কম, তাই এই মেঘদের তাপমাত্রা সাধারণত হয় 10 থেকে 100 কেলভিনের মধ্যে। (কেলভিন হল তাপমাত্রার পরম একক যা শুরু হয় -273.15o ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে।)
      এই বিশাল মেঘ নিজেরই অভিকর্ষের টানে নিজেই সংকুচিত হতে চায়। তাকে বাধা দেয় মেঘের গ্যাসের চাপ যা অভিকর্ষের বিপরীতে কাজ করে। গ্যাসের চাপ (P) কেলভিন স্কেলে তার তাপমাত্রা (T)গ্যাসের কণার ঘনত্ব (r) এই দুইয়ের উপর নির্ভর করে। আদর্শ গ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা জানি P=rkT এখানে k হল বোলজম্যানের ধ্রুবক। মহাজাগতিক মেঘের গ্যাসকে আমরা আদর্শ গ্যাস হিসাবে কল্পনা করতেই পারি। মেঘের ভিতরে তাপমাত্রা ও ঘনত্ব এই দুটি রাশিই ক্ষুদ্র, তাই গ্যাসের চাপও খুবই কম। অভিকর্ষজ বল যদি চাপের থেকে উদ্ভূত বলের থেকে বেশি হয়, সে ক্ষেত্রে মেঘ সংকুচিত হতে শুরু করতে পারে। এই ঘটনা প্রথম বলেছিলেন বিজ্ঞানী জেমস জিনস, তাই তাঁর নামানুসারে এই সীমাকে আমরা জিনস সীমা বলি। যেমন নির্দিষ্ট আয়তনের ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় মেঘের সংকোচন শুরুর জন্য মেঘের যে ন্যূনতম ভর হওয়া প্রয়োজন, তাকে বলে জিনস ভর। বাস্তবে অবশ্য এই সঙ্কোচনের বিষয়টা আরো অনেক জটিল, তবে সেই বিস্তারিত আলোচনাতে আমরা যাব না।
      একটা বলকে উপর থেকে ফেলে দিলে সে যত নিচে নামে, তার বেগ তত বাড়ে, কারণ স্থিতিশক্তি গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ঠিক তেমনি মেঘের গ্যাস অণুগুলি যত কেন্দ্রের দিকে যায় তাদের বেগ তত বাড়ে। আমরা জানি যে গ্যাসের তাপমাত্রা হল তার অণুগুলির বেগের প্রকাশ। এর অর্থ, মেঘ যত সংকুচিত হবে, তত তার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া উচিত। তাপমাত্রা বাড়লে গ্যাসের চাপ বাড়বে, তার জন্য সংকোচন বাধা পাবে। তবে কিছুটা তাপ মেঘ থেকে অবলোহিত বিকিরণ আকারে বেরিয়ে যায় কারণ যে কোনো বস্তু সবসময়ই তাপ বিকিরণ করে। সংকোচনের ফলে মেঘের তাপমাত্রা বাড়ে, কিন্তু তার আশপাশের তাপমাত্রা কমই থাকবে -- তাই মেঘ যে পরিমাণ তাপ তার পরিবেশের থেকে পাবে, তার থেকে বেশি পরিমাণ তাপ ছেড়ে দেবে। সেই কারণে রুদ্ধতাপ (adiabatc) পরিবর্তনে তাপমাত্রা যে হারে বৃদ্ধি পাওয়ার কথা, মেঘের তাপমাত্রা তার থেকে অনেক কম হারে বাড়ে।
      কিন্তু এই পরিস্থিতি চিরকাল চলতে পারে না। মেঘের ঘনত্ব বেড়ে গেলে তার স্বচ্ছতা কমে যায়, তখন কেন্দ্রের তাপ বাইরে না বেরোতে পেরে মেঘের মধ্যেই আটকে পড়ে। অন্যভাবে বললে, গ্যাসের অণুর ঘনত্ব বাড়লে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে অবলোহিত রশ্মির ফোটনগুলি বাইরের দিকে যেতে বাধা পায়। ফলে মেঘের তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। মনে রাখতে হবে এই সময় স্বাভাবিক ভাবেই মেঘের কেন্দ্রের তাপমাত্রার বাইরের অংশের থেকে বেশি হয়। এই সময় দুটি ঘটনা ঘটে যা কিছুটা তাপকে গতিশক্তি থেকে অন্য শক্তিতে রূপান্তরিত করে। তাপমাত্রা যখন নয় হাজার কেলভিনের কাছাকাছি পৌঁছোয় তখন হাইড্রোজেন অণু দুটি পরমাণুতে ভেঙে যায়। হিলিয়ামের অণুতে একটাই পরমাণু থাকে, তাই তার ভাঙার প্রশ্ন ওঠে না। আবার তিরিশ হাজার কেলভিনের কাছাকাছি তাপমাত্রায় হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের পরমাণুরা ইলেকট্রন ছেড়ে আয়নে পরিণত হয়। এই দুটি ঘটনাই তাপ শোষণ করে, সেই তাপ গ্যাসের চাপ বাড়াতে সরাসরি কাজে লাগে না। তবে তাপমাত্রার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের চাপও বৃদ্ধি পায়, তাই অভিকর্ষ জনিত সঙ্কোচন খুব শ্লথ হয়ে যায়। বোঝা যাচ্ছে যে নক্ষত্রের কেন্দ্রে উচ্চ তাপমাত্রায় তড়িৎআধানহীন পরমাণুর অস্তিত্ব থাকতে পারে না, তা আয়ন ও ইলেকট্রনে ভেঙে যায়
      আর একটা ঘটনা এই সংকোচনের সময় ঘটে যা নক্ষত্র সৃষ্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দেখেছি যে মহাজাগতিক মেঘের ভর সূর্যের কয়েকশো থেকে কয়েক হাজার গুণ, কিন্তু কোনো নক্ষত্রই ঐরকম ভারি নয়। বাস্তবে একটা মহাজাগতিক মেঘ থেকে অনেকগুলো তারার জন্ম হতে পারে। মেঘ যত সংকুচিত হতে থাকে, তত তার ঘনত্ব বাড়ে। ঘনত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জিনস ভরের মান কমতে থাকে। ফলে একটা সময় সেই মান এত কমে যায় যে মেঘের একটা অংশের ভর তার থেকে বেশি হয়ে যায়। তখন ওই টুকরোটা সম্পূর্ণ মেঘের কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত না হয়ে ঐ খণ্ডিত অংশের কেন্দ্রের দিকে পতিত হয়। এভাবে মেঘের নানা টুকরো আলাদা আলাদা ভাবে নিজের নিজের কেন্দ্রের দিকে সংকুচিত হয়ে শেষ পর্যন্ত একের বেশি তারার জন্ম দেয়। যে টুকরোটা শেষ পর্যন্ত একটা নক্ষত্রের জন্ম দেয় তাকে আমরা বলি আদি-তারা (protostar)
      সৌর জগতের সমান ভরের একটা মেঘ যখন হাইড্রোজেনকে আয়নিত করার অবস্থায় পৌঁছায়, তখন তার ব্যাসার্ধ মোটামুটি সাত কোটি কিলোমিটার, অর্থাৎ সূর্যের ব্যাসার্ধের একশো গুণের কাছাকাছি। এই সময় আদি-তারাটির সংকোচন শ্লথ হয়ে যায়। কেন্দ্রের তাপমাত্রা অবশ্য একই সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকে কারণ কেন্দ্রের ঘনত্ব বেশি, তাই সেখান থেকে বিকিরণ বাইরে আসতে বাধা পায়। যে আদি-তারা থেকে আমাদের সূর্যের জন্ম তা এভাবে ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়েছে, সময় লেগেছে আনুমানিক দশ লক্ষ থেকে এক কোটি বছর। একসময় আদি-তারার কেন্দ্রের তাপমাত্রা এতটাই বৃদ্ধি পায় যে কেন্দ্রে নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া শুরু হয়। উচ্চ তাপমাত্রা ছাড়া সংযোজন বিক্রিয়া কেন সম্ভব নয় সে বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করব। আদি-তারার কেন্দ্রে নিউক্লিয় বিক্রিয়া শুরু হলে এবার তাকে আমরা সাধারণ অর্থে তারা বলতে পারি।
      একটা বিষয় সহজেই বোঝা যায়, তারার কেন্দ্রে অভিকর্ষজ সঙ্কোচনের বাইরে একটা নতুন তাপের উৎসের জন্ম হলনিউক্লিয় বিক্রিয়ার ফলে প্রচুর তাপ তৈরি হয় যা নক্ষত্রকে আরো উত্তপ্ত করে তোলে। আমাদের সূর্যের মতো নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে গ্যাসের চাপ তখন এত বেড়ে যায় যে গ্যাসের সংকোচন বন্ধ হয়ে এক সাম্যাবস্থায় পৌছায়। আমাদের সূর্যের কেন্দ্রের ঘনত্ব প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে 150 গ্রাম। সূর্যের থেকে নেকগুণ ভারি নক্ষত্ররা যখন এই সাম্যাবস্থায় পৌঁছায়, তখন তাদের তাপমাত্রা আরো অনেক বেশি হয়। কোনো উৎস থেকে বিকিরণের চাপ (Prad) উৎসের কেলভিন স্কেলে তাপমাত্রার চতুর্থ ঘাতের সমানুপাতে বৃদ্ধি পায় (PradµT4), অর্থাৎ তাপমাত্রা দুগুণ বাড়লে বিকিরণের চাপের পরিমাণ বাড়বে ষোল গুণ। সে জন্য এই সমস্ত নক্ষত্রদের ক্ষেত্রে সাম্যাবস্থাতে গ্যাসের চাপের সঙ্গে বিকিরণের বহির্মুখী চাপকেও হিসাবে রাখতে হবে।
      সূর্যের সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সৌরজগত সৃষ্টি হয়েছিল। মহাজাগতিক মেঘের কেন্দ্র সূর্যের জন্ম দিয়েছিল। বাইরের অংশ থেকে গ্রহদের জন্ম হয় নানা জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেগুলো সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নআমাদের সৌরজগতের বাইরে অন্যান্য নক্ষত্রের গ্রহ আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে আমরা বুঝতে পারছি যে আমাদের ধারণার অনেক পরিবর্তন দরকার। সেই দীর্ঘ আলোচনা আমরা এই লেখায় আনবো না।
      সূর্যের ভিতরে কী বিক্রিয়া ঘটে সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে একটু ইতিহাস আলোচনা করে নেওয়া যাক। নিউক্লিয় শক্তি যে তারাদের ক্তির উৎস, এ কথা প্রথম বলেছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন। ১৯২০ সালে তিনি বলেছিলেন যে অপেক্ষাকৃত হালকা নিউক্লিয়াসরা মিলে ভারি নিউক্লিয়াস তৈরি করে এবং একই সঙ্গে কিছুটা ভর শক্তি হিসাবে মুক্ত হয়। এটাই নক্ষত্রদের শক্তির উৎস। জেমস জিনস তাঁর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। জিনস বলেন যে নক্ষত্রদের অভ্যন্তরে নিউক্লিয় বিক্রিয়া সম্ভব নয়, কারণ সেখানে যথেষ্ট তাপমাত্রা নেই।
      কথাটা শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও জিনস সেই যুগের বিচারে ভুল বলেননি। নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়ার জন্য উচ্চ তাপমাত্রার প্রয়োজন কেন? মনে রাখতে হবে গ্যাসের তাপমাত্রা হল তার অণুদের গতিশক্তির প্রকাশ। নিউক্লিয় বলের পাল্লা খুব কম, দুই ফেমটোমিটারের কাছাকাছি। (এক ফেমটোমিটার = 10-15মিটার)  তাই দুই নিউক্লিয়াসকে খুব কাছাকাছি না আনলে তাদের মধ্যে সংযোজন বিক্রিয়া সম্ভব নয়। কিন্তু নিউক্লিয়াসের চার্জ বা আধান ধনাত্মক, তারা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে। সেই বিকর্ষণকে অতিক্রম করে দুই নিউক্লিয়াস পরস্পরের কাছে আসতে তখনই পারে যদি তাদের আপেক্ষিক বেগ বা গতিশক্তি খুব বেশি হয়।  ল্যাবরেটরিতে নিউক্লিয় বিক্রিয়া করার জন্য আমরা অ্যাকসিলারেটর বা কণাত্বরক ব্যবহার করে নিউক্লিয়াসদের গতিশক্তি বাড়াই।  গ্যাসের ক্ষেত্রে অধিক গতিশক্তির অর্থ অধিক তাপমাত্রা, তাই নক্ষত্রের অভ্যন্তরে সংযোজন বিক্রিয়া একমাত্র উচ্চ তাপমাত্রাতেই হতে পারে। কিন্তু জিনস দেখালেন যে সেই তাপমাত্রাও সংযোজন বিক্রিয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয়।  যেমন সূর্যের কেন্দ্রে আছে আয়নিত হাইড্রোজেন অর্থাৎ প্রোটন। দুটো প্রোটনকে যদি দুই ফেমটোমিটার দূরত্বের মধ্যে আসতে হয়, তাহলে প্রোটনের গতিশক্তি 1 মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট অর্থাৎ দশ লক্ষ ইলেকট্রন ভোল্টের বেশি  হওয়া প্রয়োজন। (1 ইলেকট্রন ভোল্ট = 1.6X10-19 জুল)। সূর্যের কেন্দ্রে তাপমাত্রা হল দেড় কোটি ডিগ্রি কেলভিন, এই তাপমাত্রায় প্রোটনদের গড় শক্তি হল মাত্র 1 কিলো ইলেকট্রন ভোল্ট অর্থাৎ হাজার ইলেকট্রন ভোল্টের কাছাকাছি। তাই জিনস বলেছিলেন যে সূর্যের কেন্দ্রে দুটো প্রোটনের পক্ষে বিক্রিয়া করা সম্ভব নয়।
      এডিংটন অবশ্য জিনসের আপত্তিতে বিচলিত হননি। তাঁর বিখ্যাত বই The Internal Constitution of Stars’-এ তিনি বলেছিলেন, ‘We do not argue with the critic who urges that the stars are not hot enough for this process; we tell him to go and find a hotter place.’ এডিংটন এই কথা লিখেছিলেন ১৯২৬ সালে, তার দু বছরের মধ্যেই নব আবিষ্কৃত কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দেখিয়ে দেয় যে জিনসের আপত্তিকে কেমন করে এড়ানো যায়।

      এড়ানো কথাটা আমি সচেতন ভাবে ব্যবহার করেছি। সঙ্গের ছবির দিকে দেখা যাক। এখানে অনুভূমিক অক্ষ বরাবর দুটি প্রোটনের মধ্যে দূরত্ব (R) এবং উল্লম্ব অক্ষ বরাবর তাদের মধ্যে বলের জন্য স্থিতিশক্তির পরিমাপ (Veff) দেখানো হয়েছে। রেখাটা দুইটি প্রোটনের মোট স্থিতিশক্তিকে সূচিত করছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে স্থিতিশক্তির মান, বিকর্ষণ বলের জন্য ধনাত্মক ও আকর্ষণ বলের জন্য ঋণাত্মক হয়। দেখা যাচ্ছে যে দুই প্রোটনের মধ্যে দূরত্ব দুই ফেমটোমিটারের কম হলে তারা নিউক্লিয় বলের মারফত পরস্পরকে আকর্ষণ করবে। তখন নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়া সম্ভব। কিন্তু দুই ফেমটোমিটার দূরত্বে আসতে হলে তার গতিশক্তি সর্বোচ্চ স্থিতিশক্তি অর্থাৎ রেখাটার সর্বাধিক উচ্চতার থেকে বেশি হতে হবে। দুটি ধনাত্মক আধানের মধ্যে বিকর্ষণ বল কুলম্বের সূত্র মেনে চলে, তাই এই ধরনের বাধাকে বলে কুলম্ব ব্যারিয়ার। বিজ্ঞানের ভাষায় একটা তুলনা দিয়ে দেখানো যাক। ধরা যাক একটা উঁচু দেয়াল আছে। আমি একটা বল যদি দেয়ালের উল্টোদিকে পাঠাতে চাই, তাহলে দেয়ালের থেকেও বেশি উঁচুতে ছুঁড়তে হবে। আমার যদি সেই শক্তি না থাকে, তাহলে বলকে আমি দেয়ালের উল্টোদিকে পাঠাতে পারব না। জিনসের আপত্তি এইখানে।
      কোয়ান্টাম বলবিদ্যা দেখাল যে গতিশক্তি সর্বোচ্চ স্থিতিশক্তির থেকে বেশি না হলেও দুটো প্রোটনের পক্ষে কাছাকাছি আসা সম্ভব। এই ঘটনাকে বলে টানেলিং। এ যেন বলটা বারবার দেয়ালে ছুঁড়ছি, হঠাৎ করে একবার দেয়াল না টপকে এবং ফুটো না করে হঠাৎ দেয়ালের ওপাশে চলে গেল। আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার বাইরের এই ধরনের ঘটনার কথা শুনতে খুব অদ্ভুত লাগলেও নানা রকম ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিতে টানেলিংকে নিয়মিত কাজে লাগানো হয়। টানেলিঙের বিশদ অঙ্কে আমরা যাব না, তবে সেই অঙ্ক দেখায় যে সেই সম্ভাবনা খুবই কম। সূর্যের তাপমাত্রায় সেই সম্ভাব্যতার মান মাত্র 10-10 অন্যভাবে বললে, যদি সূর্যের ভিতরে এক হাজার কোটি বার এক জোড়া প্রোটন পরস্পরের কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে, তাহলে একবার মাত্র সফল হবে আমাদের পৃথিবীর কোনো পরীক্ষাগারে দুই নিউক্লিয়াসের মধ্যে টানেলিঙের মাধ্যমে এই ধরনের বিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করা কঠিন, তার জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয় দুটি প্রোটনের ক্ষেত্রে বিক্রিয়া দেখা আরো শক্ত, সে কথা পরে আলোচনা করব কিন্তু সূর্যের হাইড্রোজেনের পরিমাণ বিশাল, তাই ঐ রকম ক্ষুদ্র সম্ভাবনা সত্ত্বেও টানেলিং প্রক্রিয়াতেই এক সেকেন্ডে সূর্যের মধ্যে 3.8X1026 জুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্র থেকে আমরা বুঝতে পারি যে সূর্যের কেন্দ্রে প্রতি সেকেন্ডে চল্লিশ লক্ষ টনের বেশি ভর শক্তি হিসাবে মুক্ত হচ্ছে। আমাদের বিচারে বিপুল হলেও সূর্যের ভরের তুলনায় তা নগণ্য, তাই সূর্য শত শত কোটি বছর ধরে এইভাবে আলো দিয়েছে ও আরো দেবে।
      এবার আমরা সূর্যের কেন্দ্রে কী কী বিক্রিয়া ঘটে তা আলোচনা করতে পারি। যে বিক্রিয়াগুলি পরপর ঘটে তাদের একসঙ্গে বলা হয় বিক্রিয়া শৃঙ্খল (Chain reaction)সূর্যে একাধিক এইরকম বিক্রিয়া শৃঙ্খল ঘটে আমরা তাদের মধ্যে শুধুমাত্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, অর্থাৎ প্রথম প্রোটন-প্রোটন শৃঙ্খল (ppI chain)   নিয়ে আলোচনা করব, অন্যগুলি আমাদের আলোচনার বাইরে থাকবে।
      শুধু প্রথম নয়, যে কোনো প্রোটন-প্রোটন শৃঙ্খলই শুরু হয় প্রোটনের সংযোজন বিক্রিয়াতে -- প্রথমে দুটি প্রোটন বা সাধারণ হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস (11H) মিলিত হয়ে তৈরি করে হাইড্রোজেনের আইসোটোপ ভারি হাইড্রোজেন বা ডয়টেরিয়ামের নিউক্লিয়াস (12H ) – এর  মধ্যে থাকে একটা প্রোটন ও একটা নিউট্রন। (X মৌলের কোনো আইসোটোপকে ZAX, এভাবে লেখা হয়এখানে Z হল পরমাণু ক্রমাঙ্ক, যা ওই পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যার সঙ্গে সমা্‌ এবং A হল ভরসংখ্যা নিউক্লিয়াসে নিউট্রনের সংখ্যা হল A-Z) তার সঙ্গে তৈরি হয় পজিট্রন (e+) ও ইলেকট্রন নিউট্রিনো (νe)সমীকরণের আকারে লিখতে পারি
11H + 11H 12H + e+ + νe
আমরা দেখছি যে সমীকরণের দুপাশে আধান সমান, কারণ প্রোটন ও পজিট্রনের আধান সমান। নিউট্রন ও নিউট্রিনো আধানশূন্য কণা। এই বিক্রিয়ার হার খুব কম। প্রথমত দুটো প্রোটনের মধ্যে বিক্রিয়ার জন্য তাদের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা কম, উপরন্তু তারা কাছাকাছি এলেই যে সংযোজন বিক্রিয়া হবে তা নয়। আমরা জানি যে চাররকমের বল আছে - স্ট্রং ফোর্স বা পীন বল, তড়িৎচৌম্বক বল, উইক বা ক্ষীণ বল ও মাধ্যাকর্ষণ। নিউক্লিয় বল হল পীন বলের উদাহরণ। উপরের বিক্রিয়াটি কিন্তু পীন বল নয়, উইক ফোর্স বা ক্ষীণ বলের মাধ্যমে ঘটে। নামেই বোঝা যাচ্ছে যে বলটি দুর্বল, তাই দুটি প্রোটনের মধ্যে এই বিক্রিয়াটির হার খুবই কম। এতই কম যে সূর্যের কেন্দ্রে একটি প্রোটনের গড় আয়ু হাজার কোটি বছরের কাছাকাছি। সেই জন্যই সূর্য সাড়ে চারশো কোটি বছরের বেশি সময় ধরে আলো দিচ্ছে এবং আরো চারশো আশি কোটি বছর ধরে দিতে থাকবে।
      পরের বিক্রিয়াগুলি পীন বলের মাধ্যমে ঘটে, তাই তাদের হার অনেক দ্রুত। ডয়টেরিয়ামের নিউক্লিয়াস তৈরি হওয়ার এক সেকেন্ডের মধ্যেই সে অন্য প্রোটনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে।
      11H + 12H 23He
এই বিক্রিয়াতে তৈরি হয় হিলিয়ামের আইসোটোপ 23He, একই সঙ্গে গামা রশ্মি ও 23He-এর গতিশক্তি রূপে শক্তি বেরিয়ে আসে। এর পরের ধাপে দুটি     23He মিলে তৈরি করে হিলিয়ামের সবচেয়ে সুস্থিত আইসোটোপ 24He
23He + 23He 24He + 211H
এই বিক্রিয়াতেও গতিশক্তি মুক্ত হয়। এই বিক্রিয়ার সময়কাল তিন লক্ষ বছর।
      পরের বিক্রিয়াগুলো যতই দ্রুত হোক না কেন, প্রথম বিক্রিয়ার মাধ্যমে ডয়টেরিয়ামের নিউক্লিয়াস তৈরি না হলে সেগুলো ঘটার উপায় নেই। তাই প্রোটন-প্রোটন শৃঙ্খলের সময়কাল প্রথম বিক্রিয়ার সময়কালের সমান, অর্থাৎ হাজার কোটি বছর। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে প্রথম দুটি বিক্রিয়া একবার করে ঘটলে একটি 23He তৈরি হয়। তৃতীয়টিতে দুটি 23He শ নেয়, তাই সেটি একবার ঘটার জন্য প্রথম বিক্রিয়াদ্বয় দুবার করে হওয়া প্রয়োজন।সব মিলিয়ে সূর্যের কেন্দ্রে যে পদ্ধতিতে শক্তি উৎপাদন হয় তাকে আমরা লিখতে পারি,
411H 24He + 2e+ + 2νe
অর্থাৎ চারটি প্রোটন বা সাধারণ হাইড্রোজেনের নিউক্লিয়াস মিলে একটি হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস, দুটি পজিট্রন ও দুটি নিউট্রিনো তৈরি করে। নিউট্রিনোর ভর খুব কম, এতই কম যে তা এখনো মাপা সম্ভব হয়নি। আমাদের হিসাবের জন্য তাকে শূন্য ধরে নিতে পারি। বিক্রিয়ার ডানদিকের মোট ভর বাঁদিকের চারটে প্রোটনের ভর অপেক্ষা কম, এই ভরের পার্থক্যই শক্তিরূপে মুক্ত হয়। পজিট্রন তৈরি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে একটা ইলেকট্রনের সঙ্গে মিলে ধ্বংস হয়ে যায়, দুই কণার মোট ভর গামা রশ্মিতে পরিবর্তিত হয়। এভাবে মোট শক্তি মুক্ত হয় 26.73 মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট। নিউট্রিনোরা বিশেষ বিক্রিয়া করে না, তাই সূর্য তাদের ধরে রাখতে পারে না। দুটি নিউট্রিনো মিলে গড়ে 0.52 মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি নিয়ে বেরিয়ে চলে যায়। হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে রূপান্তরের সময় প্রতিটি বিক্রিয়াতে যে অবশিষ্ট 26.21 মিলিয়ন ইলেকট্রন ভোল্ট শক্তি পাওয়া যায়, তাই হল সূর্যের শক্তির উৎস।
      সূর্যের অভ্যন্তরে নিউক্লিয় বিক্রিয়া কিন্তু হিলিয়াম তৈরির পরে আর এগোতে পারে না। হিলিয়াম ও প্রোটন মিলে কোনো নতুন মৌলের নিউক্লিয়াস তৈরি হয় না কারণ সেই রকম কোনো নিউক্লিয়াসের অস্তিত্বই থাকা সম্ভব নয়  হিলিয়ামের নিউক্লিয়াসদের মধ্যে বিক্রিয়ার জন্য যে তাপমাত্রা ও ঘনত্ব লাগে, তা সূর্যের কেন্দ্রে এখন নেই। তাই 24He হল প্রোটন-প্রোটন শৃঙ্খলের অন্তিম পরিণতি। এই বিক্রিয়া শৃঙ্খল সূর্যের অভ্যন্তরে নিরন্তর হয়ে চলেছে এবং হাইড্রোজেন হিলিয়ামে পরিবর্তিত হচ্ছে। সূর্য যে মেঘ থেকে জন্ম নিয়েছিল, তার ভরের 71% ছিল হাইড্রোজেন এবং 27% ছিল হিলিয়াম। এখন  সূর্যের কেন্দ্রের অংশে হিলিয়ামের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে 64% এবং হাইড্রোজেনের পরিমাণ কমে হয়েছে 34%
      এভাবে চলতে চলতে চারশো আশি কোটি বছর পরে সূর্যের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন শেষ হয়ে যাবে। যে সব তারকা তাদের কেন্দ্রে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি করে, তাদের বলে মূল অনুক্রমের তারকা। হাইড্রোজেন শেষ হলে সূর্য মূল অনুক্রম ত্যাগ করবে। তখন অতি দ্রুত অর্থাৎ ষাট কোটি বছরেরও কম সময়ে সে নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাবে। হিলিয়াম নিউক্লিয়াসের বিক্রিয়ার মাধ্যমে কেন্দ্রে তৈরি হবে কার্বন ও অক্সিজেন। একই সঙ্গে তার বাইরের অংশ বিরাট বড় হয়ে বুধ, শুক্র এবং সম্ভবত পৃথিবীকেও গ্রাস করে নেবে। তারকার এই অবস্থাকে বলে লাল দানব (Red giant)সূর্যের শেষ পরিণতি শ্বেত বামন নক্ষত্রসূর্যের থেকে অনেক বেশি তারকাদের পরিণতি আবার ভিন্ন। তারকাদের অন্তিমকালের বিভিন্ন ধাপগুলি খুবই আকর্ষণীয়, কিন্তু তাদের নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এই লেখা অতি দীর্ঘ হয়ে যাবে। 
      আমরা যে আলোচনা করলাম তা সাধারণ ভাবে সঠিক হলেও এখনো পর্যন্ত সূর্য সম্পর্কে আমরা সমস্ত কিছু যে বুঝতে পেরেছি তা নয়। তাই সূর্য আজও বিজ্ঞানীদের গবেষণার বস্তু। সূর্যের থেকে ভারি তারাদের সম্বন্ধে কয়েকটা কথা সংক্ষেপে বলে আমাদের আলোচনা শেষ করা যাক। প্রথম শৃঙ্খল ছাড়াও আরো দুটি প্রোটন প্রোটন শৃঙ্খল আছে যারা এই আলোচনায় এলো না। নক্ষত্রের কেন্দ্রের তাপমাত্রা এক কোটি আশি লক্ষ কেলভিন পেরিয়ে গেলে সেই দুটিই শক্তি উৎপাদনের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়।আগেই বলেছি সূর্যের কেন্দ্রের তাপমাত্রা দেড় কোটি কেলভিন, তাই প্রথম শৃঙ্খলটিই সূর্যের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অপেক্ষাকৃত ভারি তারাদের কেন্দ্রের তাপমাত্রা বেশি হয়। মূল অনুক্রমের তারারা সবাই যে প্রোটন প্রোটন শৃঙ্খলের সাহায্যেই হিলিয়াম সৃষ্টি করে তা নয়। সূর্যের থেকে অপেক্ষাকৃত ভারি তারাদের মধ্যে কার্বন-নাইট্রোজেন-অক্সিজেন চক্র বা সিএনও চক্র হাইড্রোজেনকে হিলিয়ামে পরিবর্তিত করে। এই চক্রে কার্বন ইত্যাদি মৌলগুলি অনুঘটকের কাজ করে অর্থাৎ তারা বিক্রিয়াতে অংশ নিলেও শেষপর্যন্ত তাদের কোনো পরিবর্তন হয় না। এই চক্র প্রোটন প্রোটন শৃঙ্খলের থেকে অনেক দ্রুত কাজ করে। তাই যে সমস্ত নক্ষত্রের ভিতরে এই চক্র চলে তারা অনেক বেশি উজ্জ্বল, আবার তাদের আয়ুও অনেক কম। যেমন সূর্যের থেকে পঁচিশ গুণ ভরের কোনো তারা মাত্র ষাট লক্ষ বছর মূল অনুক্রম পর্যায়ে থাকে -- পক্ষান্তরে আমাদের সূর্য সেই পর্যায়ে কাটাবে প্রায় হাজার কোটি বছর। আমাদের সূর্যের ভিতরে সিএনও চক্র হয় না, কারণ তার জন্য কেন্দ্রের তাপমাত্রা অন্তত দু কোটি কেলভিন হওয়া প্রয়োজন। মূল অনুক্রম থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরে নক্ষত্রদের ভিতরে আরো নানা বিক্রিয়ার মাধ্যমে হিলিয়ামের থেকে ভারি মৌল তৈরি হতে পারে, কিন্তু তা পৃথক নিবন্ধের বিষয়।


প্রকাশ ঃ আকাশগঙ্গা ত্রৈমাসিক বিজ্ঞান পত্রিকা জানুয়ারি ২০১৯