Thursday 7 March 2019

দুই বন্ধুর গল্প


দুই বন্ধুর গল্প

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       দুই বন্ধু। একশো পঁচিশ বছর আগে তাঁদের দুজনের জন্ম, বয়সের তফাত তিন মাসেরও কম। দুজনের জন্মস্থানের মধ্যে দূরত্ব তিনশো কিলোমিটার। কিন্তু তার থেকে বড় কথা তাঁরা জন্মসূত্রে সমাজের এমন দুই স্তরের বাসিন্দা, ইতিহাসের সেই মুহূর্তে যাদের মধ্যে দূরত্বকে কিলোমিটারে প্রকাশ করতে পারলে তার মাপ হতো আরো অনেক বেশি। তাঁদের চরিত্রেও অনেক মিল, আবার অমিলও যথেষ্ট। তাঁদের দুজনের জীবন এক অদ্ভুত গ্রন্থিতে বাঁধা। সেই বন্ধন কখনো দৃঢ় হয়েছে, কখনো হয়েছে শিথিলএকজনের নাম মেঘনাদ সাহা, অন্যজন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।

       মেঘনাদের জন্ম হয়েছিল ১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর ঢাকার কাছে শেওড়াতলি গ্রামে, সত্যেনের তার পরের বছর ১ জানুয়ারি কলকাতার গোয়াবাগানে। জাতের বিচারে মেঘনাদ ছিলেন বৈশ্য সাহা, বাঙালী হিন্দু সমাজে তখন যাদের স্থান ছিল অত্যন্ত নিচু। একাধিকবার তাঁকে শিক্ষাঙ্গনের সরস্বতী পূজার মণ্ডপ থেকে বার করে দেওয়া হয়। কলেজের হস্টেলে অন্য ছাত্রদের সঙ্গে বসে খাওয়ার অধিকার তাঁর ছিল না। সত্যেন্দ্রনাথের পরিবার কুলীন কায়স্থ -- তাঁকে কখনো এই পরিস্থিতির সামনে পড়তে হয়নি।
       শুধু জাতপাতের বিচারে নয়, আর্থিক অবস্থাতেও দুজনের অনেক অমিল। মেঘনাদের পরিবার ছিল হতদরিদ্র, বাবা জগন্নাথ ছেলের পড়া ছাড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কখনো অন্যের বাড়িতে থেকে, কখনো বা ছাত্রবৃত্তির উপর ভরসা করে পড়াশোনা চালিয়েছেন মেঘনাদ। মা শেষ সম্বল হাতের বালা বিক্রি করে ছেলের পরীক্ষার ফি ভরেছেন। সত্যেন্দ্রনাথের বাবা সুরেন্দ্রনাথ ছিলেন সরকারি চাকুরে, পাশাপাশি ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস বলে এক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাতাঁদের ধনী নিশ্চয় বলা যাবে না, কিন্তু সেকালের বিচারে বাঙালী সমাজে তাঁরা যথেষ্ট সচ্ছল
       সত্যেন্দ্রনাথ পড়েছিলেন কলকাতার তিনটি স্কুলে। নর্মাল স্কুল ছিল বাড়ির কাছে, বাসা পরিবর্তন করার পরে ভর্তি হলেন নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে। সবশেষে তাঁর বাবা তাঁকে হিন্দু স্কুলে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করেছিলেন যাতে তাঁর  প্রতিভা সঠিক দিশা পায়। মেঘনাদের পড়াশোনা শুরু পাঠশালায়, তারপর গ্রামে স্কুল না থাকায় দূরের শিমুলিয়া গ্রামে গিয়ে অন্যের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা। ছাত্রবৃত্তির টাকা সম্বল করে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, কিন্তু বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উত্তাল সময়ে বাংলার ছোটোলাটকে বিক্ষোভ দেখানোর অপরাধে সেখান থেকে বিতাড়ন। অগত্যা ভরসা ঢাকার কিশোরীলাল জুবিলি স্কুল। দশম শ্রেণির এন্ট্রান্স পরীক্ষায় সত্যেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন পঞ্চম, মেঘনাদ তৃতীয়। প্রথমজন ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে, দ্বিতীয়জন ঢাকা কলেজে। দু বছর পরে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় মেঘনাদ নিজের জায়গা ধরে রাখলেন, সত্যেন তাঁকে পেরিয়ে হলেন প্রথম।
       এত দিন কেউ কাউকে চিনতেন না, ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরেই দুজনের প্রথম সাক্ষাৎ১৯১১ সাল। প্রেসিডেন্সি কলেজ তখন গোটা এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে নামকরা কলেজ। সারা বাংলাদেশ এমনকি বাংলার বাইরে থেকেও ছেলেরা এসে সেই কলেজে ভর্তি হয়। মেঘনাদ এলেন ঢাকা থেকে। সত্যেন তো প্রেসিডেন্সিরই ছাত্র।  দুজনেই গণিতে অনার্স নিয়ে পড়লেনআলাপ ক্রমে বন্ধুত্বে রূপান্তরিত হলদু বছর পরে বিএসসি পাস করলেন দুজনে, ভর্তি হলে প্রেসিডেন্সির কলেজে এমএসসিতে। দুজনেরই বিষয় এক, মিশ্র গণিত। ১৯১৫ সালে এমএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন দুই বন্ধুবিএসসি এবং এমএসসি, দুই পরীক্ষার ফলই একপ্রথম সত্যেন্দ্রনাথ বসু, দ্বিতীয় মেঘনাদ সাহা।
       কেমন কেটেছে কলেজের চার বছর? দুজনেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের খুব প্রিয় ছাত্র, জগদীশচন্দ্রের কাছেও পড়েছেন। কলেজে দুজনের বন্ধুত্ব হয়েছে আরো কয়েকজনের সঙ্গে যাঁরা ভবিষ্যতে ভারতবর্ষের বিজ্ঞানের স্থপতি হিসাবে কাজ করবেন -- রসায়নে জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ ও জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, গণিতে নিখিলরঞ্জন সেন, পদার্থবিদ্যাতে স্নেহময় দত্ত। দুই বন্ধুই সপ্তাহের কয়েকটা সন্ধ্যাবেলা ছোটদের পড়ান। মেঘনাদ টিউশনি করেন নিজের খরচ চালাতে। গরীব ঘরের যে ছেলেরা পয়সার অভাবে পড়তে পারে না, নাইট স্কুলে তাদেরকে বিনা মাইনেতে পড়ান সত্যেন।
       এমএসসি পাস করলেন, এবার ইচ্ছা গবেষণা করবেন। কিছু স্থির করার আগেই দুজনকে ডাকলেন স্যার আশুতোষ। ১৯১৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদ থেকে সরে যাওয়ার ঠিক আগে বিজ্ঞান কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছিলেন তিনি সেখানে ১৯১৬ সাল থেকে চালু হবে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে এমএসসি পড়ানো ও গবেষণা।  উপাচার্য পদে না থাকলেও আশুতোষই বিজ্ঞান কলেজের  প্রাণ। রসায়ন বিভাগে আছেন দুই অধ্যাপক, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও প্রফুল্লচন্দ্র মিত্রপদার্থবিজ্ঞানে দুই অধ্যাপকের একজন সি ভি রমন কেন্দ্রীয় সরকারের চাকুরে, তখনো ছাড়পত্র পাননি। অন্যজন দেবেন্দ্রমোহন বসু উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানিতে গিয়েছিলে। বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়াতে আটকা পড়েছেন। ছাত্রদের পড়াবে কে?  দুই বন্ধুর সম্পর্কে তিনি খবর নিয়েছেন। গণিতের ছাত্র হলে কি হবে, তারা যে পদার্থবিদ্যা পড়াতে পারবে সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত।
       দুজনকে ডেকে পাঠালেন বাংলার বাঘ। সত্যেনকে দায়িত্ব দিলেন আপেক্ষিকতা পড়ানোর, মেঘনাদ পড়াবেন কোয়ান্টম তত্ত্ব। তাঁদের পদ হল পদার্থবিজ্ঞানে পালিত অধ্যাপকের সহকারী, যদিও পালিত অধ্যাপক পদে আরো এক বছরেরও বেশি পরে যোগ দেবেন রমননামে সহকারী হলেও অবশ্য দুই বন্ধু কোনোদিনই রমনের সঙ্গে কাজ করেন নি, চিরকালই গবেষণাতে তাঁরা স্বাধীন।
       দুই বন্ধুকে পড়াতে হবে এমন দুটি বিষয় যেগুলির তখন সবে সৃষ্টি হচ্ছে। কোয়ান্টম তত্ত্বের জন্ম হয়েছে ১৯০০ সালে, তা তখনো পরিবর্তনশীল। আপেক্ষিকতা বিষয়ে আইনস্টাইনের  দুটি তত্ত্ব আছে। প্রথমটি বিশেষ আপেক্ষিকতা যেটি ১৯০৫ সালেই পূর্ণাঙ্গ রূপ পেয়েছে। দ্বিতীয়টি হল সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ। এটি আইনস্টাইন প্রস্তাব করেছেন ১৯১৫ সালে। একশো বছর পরে আজও অবশ্য কোয়ান্টম ও আপেক্ষিকতা তত্ত্ব নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনিগণিতে এমএসসি পড়তে গিয়ে সত্যেন ও মেঘনাদ পদার্থবিদ্যার এই দুই নতুন তত্ত্বের সম্মুখীন হননি। তার থেকেও বড়ো সমস্যা হল বিষয়দুটি নতুন বলে কোনো পাঠ্যবই নেই। ছাত্রদের পড়াবেন কেমন করে? বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসে লেখা আছে শিক্ষকরা মূল গবেষণাপত্র থেকে পড়াবেন। কিন্তু সেখানেও সমস্যা। দুটি বিষয়েই অধিকাংশ গবেষণাপত্রগুলি জার্মান ভাষায় লেখা -- কারণ যাঁরা কাজগুলি করছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ বিজ্ঞানীই জার্মান। সে যুগে তাঁরা প্রবন্ধ লেখেন তাঁদের মাতৃভাষায়।
       মেঘনাদ জার্মান কিছুটা জানতেন, ইন্টারমিডিয়েটে পরেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ শিখেছিলেন ফরাসি, তাতে চলবে নাদুজনে মিলে ভর্তি হয়ে গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান শেখার ক্লাসে। সেখানে সহপাঠী পেলেন আর এক বিখ্যাত পণ্ডিতকে, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। জার্মান তাঁরা শিখলেন, কিন্তু ছাত্রদের কী হবে? তাদের সবার পক্ষে তো একটা নতুন ভাষা শেখা সম্ভব নয়।  ভেবেচিন্তে দুই বন্ধু সাহস করে চিঠি লিখলেন আইনস্টাইনকে, অনুমতি চাইলেন তাঁর আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত গবেষণাপত্রগুলি অনুবাদ করে ছাপার। অনুমতি দিলেন আইনস্টাইন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হল আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের মূল গবেষণাপত্রগুলির প্রথম ইংরাজি অনুবাদ। অনুবাদক মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। ভূমিকা লিখলেন তাঁদের থেকে এক বছরের সিনিয়র প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানের তরুণ শিক্ষক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ।
       দুজনেই হাতড়াচ্ছেন গবেষণার পথ। কখনো তাঁদের উৎসাহ এক জায়গায় এসে মেলে। গ্যাসের অবস্থার সমীকরণ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র লিখে ফেললেন দুই বন্ধু, সেটি সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম পেপার। কিন্তু সেই শেষ। আর কোনো গবেষণাপত্রের লেখক তালিকায় একই সঙ্গে দুই বন্ধুর উপস্থিতি পাওয়া যাবে না। 
       শুধু গবেষণা নয়, ভিন্ন পথে বয়ে চলল দুজনের জীবনধারা। থিসিস জমা দিলেন মেঘনাদ, পেলেন ডক্টরেট ডিগ্রি, ডিএসসি। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বসে আবিষ্কার করলেন তাঁর সেই বিখ্যাত তাপ আয়নন সমীকরণ। নক্ষত্রের অভ্যন্তরে উঁকি মারার সেই চাবিকাঠিকে সারা পৃথিবীর জোতির্পদার্থবিজ্ঞানী মহল সাদরে অভ্যর্থনা জানাল। সমীকরণ প্রকাশের আগেই অবশ্য মেঘনাদ পাড়ি দিয়েছেন ইংল্যান্ডে, সেখান থেকে জার্মানি। কিন্তু মন পড়ে রয়েছে দেশেআশুতোষেরও মনে আছে তাঁর কথা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পৃথিবীর বিজ্ঞানজগতে প্রথম তুলে ধরেছেন মেঘনাদতাই প্রথম সুযোগেই পদার্থবিদ্যা বিভাগে তৈরি করলেন এক নতুন পদ, খয়রা অধ্যাপক। মেঘনাদ এসে যোগ দিলেন সেই পদে। সেটা ১৯২১ সাল।
       সত্যেন কিন্তু ততদিনে কলকাতা ছেড়েছেনকলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদ তাঁর মেলেনি। আশুতোষের সঙ্গে তাঁর বনিবনা হচ্ছে না, একবার তো আশুতোষের করা প্রশ্নপত্রে একটা অঙ্কের ভুল নিয়ে দুজনের তুমুল তর্ক হয়ে গেল। দশ বছর আগে ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলেন মেঘনাদ, দশ বছর পরে  কলকাতা থেকে ঢাকা গেলেন তাঁর বন্ধু। ১৯২১ সালেই যোগ দিলেন নতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার রিডার পদে। আশুতোষ অবশ্য তখন বেশি বেতন দিয়ে কলকাতায় ধরে রাখতে চেয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথকে, রাজি হননি তিনি
       ঢাকা থেকে মেঘনাদকে চিঠিতে লিখলেন সত্যেন, ‘মাসখানেকের উপর তোমাদের দেশে এসেছি। এখানকার কাজ এখনও আরম্ভ হয়নি। তোমাদের ঢাকা কলেজে জিনিস অনেক ছিল, কিন্তু অযত্নে তাদের যে দুর্দশা হয়েছে তা বোধ হয় নিজেই জান।’
       দুজনের কর্মস্থান আবার এক হবে ১৯৪৫ সালে যখন সত্যেন্দ্রনাথ ঢাকা থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাবেন, হবেন খয়রা অধ্যাপককলকাতা ছেড়ে এসেছিলেন প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন এক অখ্যাত তরুণ, ফিরে যাবেন পঞ্চাশোর্ধ্ব এক বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী। মেঘনাদও মাঝে দেড় দশক এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটিয়ে ১৯৩৮ সালে পালিত অধ্যাপক হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার যোগ দিয়েছেন। দুই বন্ধুই ততদিনে অনেক পরিণত, বিশেষ করে মেঘনাদ তো নানা কাজে ভীষণ ব্যস্ত। দুজনের মধ্যে যোগাযোগের সূত্র ততদিনে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে     
        সত্যেন কলকাতা ছাড়ার পরে মেঘনাদ কলকাতায় বেশিদিন থাকতে পারেননি, রমনের সঙ্গে বিবাদের ফলে তিনি দু বছরের মধ্যেই চলে যান এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে এক ঝাঁক ছাত্র তৈরি করেছেন যাঁরা পরে দেশের নানা বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন। সত্যেন্দ্রনাথের ছাত্রের সংখ্যা কম, তাঁদের কারোরই বিজ্ঞান প্রশাসনে আগ্রহ ছিল না। মেঘনাদ নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যা বিষয়ে গবেষণার জন্য কলকাতাতে তৈরি করলেন ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। তার বাইরেও কলকাতারই ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ কাল্টিভেশন অফ সায়েন্সের অধিকর্তা হয়েছিলেন, একইসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানকে সাফল্যের সঙ্গে পরিচালনা করেছিলেন মেঘনাদ। সত্যেন্দ্রনাথ হয়েছিলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য, সে অভিজ্ঞতা তাঁর পক্ষে খুব সুখের হয়নি।  ১৯৫২ সালে মেঘনাদ সাহা বামপন্থীদের সমর্থিত নির্দল প্রার্থী হিসাবে কংগ্রেস প্রার্থীকে পরাজিত করে লোকসভায় নির্বাচিত হলেন, সেই বছরই রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু।
       বিজ্ঞান জগতের বাইরে তাঁদের দুজনেরই বিস্তার ছিল। সত্যেন্দ্রনাথের বহুমুখী প্রতিভা নানা পথ খুঁজে নিয়েছিল -- সঙ্গীতে, শিল্পকলায়, সাহিত্যে। সত্যেন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন গায়ক দিলীপকুমার রায় ও ধুর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কবি বিষ্ণু দে, শিল্পী যামিনী রায়। দুই বন্ধুরই স্বপ্ন ছিল দেশের সেবা, পথ ছিল আলাদা। সত্যেন বিশ্বাস করতেন দেশের উন্নতির জন্য মাতৃভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা জরুরি। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চার জন্য তৈরি করেছিলেন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। মেঘনাদ সাহার আগ্রহ ছিল দেশের উন্নতিতে সরাসরি বিজ্ঞানের প্রয়োগ, সেজন্য রাজনীতি জগতের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়ানোও তারই অঙ্গ। সুভাষচন্দ্র, নেহরু, শ্যামাপ্রসাদের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল। শিল্পায়ন, জাতীয় পরিকল্পনা, নদী পরিকল্পনা, ক্যালেন্ডার সংস্কার – নানা বিষয়ে স্বাধীনতার আগে ও পরে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন মেঘনাদ।    
       নানা দিক থেকে দুজনে ছিলেন বিপরীত চরিত্রের মানুষ। মেঘনাদ সাহার পিতৃদত্ত নাম ছিল মেঘনাথ, সামাজিক বৈষম্যের শিকার কিশোর নিজেই মধুসূদনের কাব্যের চিরন্তন প্রতিবাদী চরিত্রটি থেকে বেছে নিয়েছিল নিজের নাম। শৈশব-কৈশোর-যৌবনে নানা অবহেলা-বঞ্চনার শিকার মেঘনাদ সবসময়েই নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। নিজের খ্যাতি বিষয়ে সত্যেন্দ্রনাথের কোনো আগ্রহ নেই। আইনস্টাইন সত্যেন্দ্রনাথের সেই বিখ্যাত গবেষণাপত্রে অনুবাদের সময় নিজের বুদ্ধিমতো একটি সংশোধন করে মৌলিক কণার ঘূর্ণন প্রসঙ্গটি বাদ দিয়ে দেন। অল্প দিন পরেই দুই বিদেশি বিজ্ঞানী ঘূর্ণন সংক্রান্ত প্রকল্প স্বাধীনভাবে প্রস্তাব করবেন। তিনি যে এক মৌলিক আবিষ্কার থেকে বঞ্চিত হলেন, সত্যেনের তাতে তাপ উত্তাপ নেই। নানা কারণে তাঁর একসময়কার ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে মেঘনাদের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ অজাতশত্রু।
       ১৯৫৬ সালে সাহার মৃত্যু পর্যন্ত দুই বন্ধু এক বিভাগে কাজ করলেও কৈশোর-যৌবনের বন্ধুত্বের সেই উত্তাপ আর কখনো ফিরে আসে নি। তাঁদের ছাত্ররা ১৯৪৭ সালের এক ঘটনার কথা বলেছেন। একদিন দুপুরবেলা মেঘনাদ সাহা সত্যেন্দ্রনাথের ঘরে ঢুকলেন। দুজনের এক মিটিঙে উপস্থিত হওয়ার কথা। ঘরে তখন উপস্থিত এক বংশীবাদক। মেঘনাদ সত্যেন্দ্রনাথকে মিটিঙের কথা মনে করিয়ে দিলেন। সত্যেন উত্তর দিলেন। ‘বাজনা শুনবে? এই লোকটা বাঁশীতে বেহাগ বাজাবে।’ মেঘনাদ উত্তর না দিয়ে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।
       দীর্ঘ বিচ্ছেদের জন্য দুই বন্ধুর সম্পর্ক অপেক্ষাকৃত শীতল হয়ে পড়তেই পারে, কিন্তু সত্যেনের প্রতিভার উপর অগাধ আস্থা ছিল তাঁর বন্ধুর। ১৯৩৮ সালে ঢাকাতে এসেছিলেন মেঘনাদ সাহা। আয়নমণ্ডল থেকে বেতার তরঙ্গের প্রতিফলন বিষয়ে একটি কাজ করেছিলেন তিনি, সেই প্রসঙ্গে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন যে তিনি একটা জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। বন্ধুকে এ ব্যাপারে সাহায্য করার অনুরোধ জানান মেঘনাদ। বন্ধু তাঁকে নিরাশ করেননি – কয়েকদিন পরিশ্রমের পরেই সত্যেন্দ্রনাথ সমস্যাটির সমাধান করে ফেলেন।
        ১৯২৪ সালের মার্চ মাসে এলাহাবাদ থেকে ঢাকাতে পরীক্ষা নিতে এসেছেন মেঘনাদ। সত্যেন্দ্রনাথকে বললেন যে ঠিক আগের বছর বিকিরণ সংক্রান্ত ম্যাক্স প্লাঙ্কের সমীকরণ সম্পর্কিত সমস্যা নিয়ে দুটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে। একটির লেখক উলফগ্যাং পাউলি। অন্যটি লিখেছিলেন পল এহরেনফেস্ট ও আলবার্ট আইনস্টাইন। প্রবন্ধ দুটি তিনি বন্ধুর কাছে রেখে যান, বিশেষ করে পাউলির প্রবন্ধটিতে একটা বিশেষ সমীকরণের দিকে তিনি সত্যেনকে নজর দিতে বলেন। বন্ধুর উত্থাপিত সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই সত্যেন্দ্রনাথ এক নতুন সংখ্যায়নের প্রস্তাব করেছিলেন যাকে আমরা আজ বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন বলে চিনি। এর পরে আইনস্টাইনকে চিঠি লেখার গল্প আমাদের সকলেরই জানা। এই গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্বের বিজ্ঞানীমহলে বিখ্যাত হয়ে যান সত্যেন্দ্রনাথ। দুজনের বন্ধুত্বের স্মারক হয়ে থাকবে পদার্থবিজ্ঞানের নতুন শাখা কোয়ান্টম পরিসংখ্যানবিদ্যার জন্মের এই ইতিহাস।


এই লেখাটা প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালে আমার স্কুল নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়ের হীরক জয়ন্তী  স্মরণিকাতে।

মেঘনাদ সাহার বিজ্ঞান গবেষণা সম্পর্কে আলোচনা এই নিবন্ধে পাওয়া যাবে। বিজ্ঞানের জগতের বাইরে তাঁর পদচারণার কথা লিখেছিলাম কয়েকটি প্রবন্ধে, এটি তার মধ্যে একটি। ছাত্র সত্যেন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছু খবর এই লেখাটায় পাওয়া যাবে, স্বাভাবিকভাবেই কলেজে তাঁর সহপাঠী মেঘনাদের কথাও এসেছে। ছোটদের জন্য সত্যেন্দ্রনাথের প্রথম জীবন সম্পর্কে এই লেখাটা লিখেছিলাম।