Tuesday 6 February 2018

নামহীন লেখা (২)

     বরোদার মহারাজা সয়াজি রাও বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বিখ্যাত প্রাক্তনীদের মধ্যে একজন বেঙ্কটরমন রামকৃষ্ণন। তিনি ২০০৯ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি রয়াল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট। তাঁর আগে যাঁরা এই পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন তাঁদের মধ্যে আছেন আইজ্যাক নিউটন। এমন একজন বিজ্ঞানী তাঁর পুরানো বিশ্ববিদ্যালয়ের সামান্য নতুন বছরের ডায়েরি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেন? ২০১৭ সালের ডায়েরিতে আছে ভারতের বিজ্ঞানীদের কথা সেখানে আর্যভাট, জগদীশচন্দ্র, সি ভি রমন, রামানুজন ও বিক্রম সারাভাই যে জায়গা পেয়েছেন, এটাকে তাঁদের সৌভাগ্য বলে মানতেই হবে। কারণ নিউক্লিয় প্রযুক্তির সঙ্গে নিশ্চয় সামান্য রমন এফেক্টের তুলনা চলতে পারে না।  ইস্কুলে পড়ানো হয় যে পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেছিলেন রাদারফোর্ড। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা খুঁজে বার করেছেন যে তথ্যটা ভুল, আসলে নিউক্লিয়ার প্রযুক্তির জন্মদাতার নাম ঋষি কণাদ। ডায়েরিতে আছেন রকেট ও এরোপ্লেনের আবিষ্কর্তা ঋষি ভরদ্বাজ, কসমেটিক সার্জারির আবিষ্কর্তা সুশ্রুত, মহাবিশ্বতত্ত্বের জন্মদাতা কপিল মুনি বা নক্ষত্রবিজ্ঞানী গর্গ মুনি। এঁদের তুলনায় জগদীশচন্দ্ররা কোথায়? কোথা থেকে এই সমস্ত খবর পাওয়া গেল? রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের তাত্ত্বিক দীননাথ বাটরার বই থেকে। ভারতের প্রাচীন গৌরবকে সকলের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যই ডায়েরি।
        ভেঙ্কটরমন বলেছেন যে বিজ্ঞানে ভারতের সত্যিকারের অবদানের দিকে নজর না দিয়ে ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে বিজ্ঞান খূঁজে বার করাটা হতাশাজনক। যাঁরা এই কাজ করছে, তাঁরা ভাবছেন যে তাঁরা দেশপ্রেমিক, কিন্তু এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা দেশের দুর্নামই হচ্ছে। সেনেটে বিতর্কের সময় সেনেট সদস্য জিগর ইনামদার বলেন, ‘বিজেপির সসস্য ও আর এস এস কর্মী হিসাবে আমি গর্বিত যে আমরা ভারতের প্রকৃত ঐতিহ্যকে সামনে আনছি। কে প্রমাণ করতে পারবে যে মুনিঋষিরা এই সমস্ত আবিষ্কার করেন নি? আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে রামচন্দ্র পুষ্পক বিমানে ভ্রমণ করতেন। আমাদের সেটা শুধু প্রমাণ করতে হবে।’

        বিজ্ঞান গবেষণা সম্পর্কে সামান্য ধারণা যাদের নেই, তাদের হাতেই এখন দেশের বিজ্ঞান প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ!

Friday 2 February 2018

শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ আর্থার সি ক্লার্ক

শতবর্ষে আর্থার সি ক্লার্ক
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
      আর্থার সি ক্লার্কের নামের সঙ্গে কল্পবিজ্ঞান বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান সাহিত্যের পাঠকদের পরিচয় করানোর কোনো প্রয়োজন নেই। গত একশো বছরের সেরা তিনজন কল্পবিজ্ঞান লেখকের নাম বাছতে গেলে যে কোনো তালিকায় তাঁর নাম আসবেই। ক্লার্কের অন্য পরিচয়ও আছে। তাঁর এত কল্পনা পরবর্তীকালে বাস্তবায়িত হয়েছে যে তাঁকে অনেকেই মহাকাশ যুগের ভবিষ্যৎবক্তা বা প্রফেট বলেছেন।  ১৯৯৪ সালে তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়েছিল -- অবশ্য সাহিত্য নয়, শান্তির ক্ষেত্রে। আজকের দিনে পৃথিবীব্যাপী যোগাযোগ বিপ্লবের পিছনে আছে ভূসমলয় উপগ্রহ যারা পৃথিবীর আকাশে একই জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ক্লার্কের লেখা এক প্রবন্ধে এই বিষয়টা সকলের নজরে আসে, যদিও ধারণাটা তাঁর নিজস্ব আবিষ্কার নয়তাঁরই সম্মানে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন ভূসমলয় কক্ষপথের নাম দিয়েছে ক্লার্ক কক্ষপথ। যোগাযোগ ব্যবস্থার এই উন্নতি নানা দেশের মানুষকে আরো কাছাকাছি এনে বিশ্বে শান্তি আনতে সাহায্য করেছে, সে জন্যই তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য উঠেছিল।

      আর্থার চার্লস ক্লার্কের জন্ম ১৯১৭ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের সমারসেটে। ছোটবেলায় অর্থাভাবে পড়াশোনা বিশেষ এগোয়নি। ১৯৩৭ সালে অ্যামেচার সায়েন্স ফিকশন স্টোরিস নামের একটি ছোট পত্রিকায় তাঁর প্রথম গল্প ট্রাভেল বাই ওয়্যার (Travel by Wire!) ছাপা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রয়াল এয়ারফোর্সে রাডার সংক্রান্ত গবেষণাতে যুক্ত হয়েছিলেন, সেই নিয়ে লিখেছিলেন আত্মজীবনী ভিত্তিক উপন্যাস গ্লাইড পাথ (Glide Path) যুদ্ধের পরে কিংস কলেজ থেকে অঙ্ক ও পদার্থবিদ্যা নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।.১৯৫১ সালে প্রকাশিত হত প্রথম উপন্যাস প্রিলুড টু স্পেস (Prelude to Space) হয়েছিলেন ব্রিটিশ ইন্টারপ্ল্যানেটারি সোসাইটির সভাপতি। মহাকাশ নিশ্চয় তাঁর প্রথম প্রেম, কিন্তু সমুদ্রও খুব কাছাকাছি থাকবেসমুদ্রের তলায় স্কুবা ডাইভিং করে জীবজগত পর্যবেক্ষণ তাঁর এতই ভালো লেগেছিল যে বছরের সব সময় সেই সুযোগ পাওয়ার জন্য শ্রীলঙ্কাতে বসবাস শুরু করেন। সেই কথা লিখেছেন তাঁর দি ভিউ ফ্রম সেরেন্ডিপ (The View from Serendip) বইতে। সেখানেই ১৯শে মার্চ ২০০৮ তাঁর জীবনাবসান হয়বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্যও তিনি সারাজীবন প্রচুর কাজ করেছেন তবে এই লেখাতে আমরা মূলত তাঁর কল্পবিজ্ঞানের দিকেই চোখ রাখব। তাঁর উপন্যাসের সংখ্যা তিরিশের বেশি, গল্পের সংখ্যাও শতাধিক। তাদের মধ্যে মাত্র কয়েকটির কথাই এই লেখাতে আসবে। বেছে নেওয়ার পিছনে আমার ব্যক্তিগত পছন্দই কাজ করেছে, নিশ্চয় সবাই আমার সঙ্গে একমত হবেন না, তবে এগুলির মধ্যে ক্লার্কের লেখার মূল বৈশিষ্ট্যগুলি ফুটে উঠেছে বলেই আমার বিশ্বাস।
       ক্লার্কের নামের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় স্কুলে। জীবনে প্রথম যে ইংরাজি সায়েন্স ফিকশন গল্পসংগ্রহ পড়েছিলাম তাতে ছিল ক্লার্কের গল্প জুপিটার ফাইভ। শুধু নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র ব্যবহার করে একটা গল্পের ক্লাইম্যাক্স লেখা যায় সেটা না পড়লে বিশ্বাস হত না। কিন্তু তার থেকে অনেক বড়ো আকর্ষণ ছিল লেখকের কল্পনাশক্তি। জুপিটার ফাইভ বৃহস্পতির এক উপগ্রহ, ক্লার্ক তাকে বানিয়েছিলেন এক ইন্টারস্টেলার বা আন্তর্নক্ষত্র যান। তারপর থেকে সুযোগ পেলেই ক্লার্কের গল্প খুঁজতাম।
      কল্পবিজ্ঞানের সীমারেখা গত অর্ধ শতাব্দীতে অনেক দিকে প্রসারিত হয়েছে। সেই গল্পগুলো আমার নিজের পছন্দ যেখানে  যেখানে নতুন বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিকে গবেষণাগারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজে তার প্রভাব কী পড়তে পারে তা নিয়ে তার স্রষ্টা চিন্তা করেছেন। একটা সহজ উদাহরণ নিতেই পারি। বাংলা ভাষাতে সবচেয়ে জনপ্রিয় কল্পবিজ্ঞান চরিত্র নিশ্চয় প্রফেসর শঙ্কু। আমাদের ছোটোবেলাতে আমরা শঙ্কুর গল্পগুলো পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকতাম। এখনকার ছোটোরাও নিশ্চয় পড়ে কারণ সবচেয়ে বেশি বিক্রির তালিকায় এই বইগুলো সবসময়েই জায়গা করে নেয়। কিন্তু এগুলো আমার কাছে কল্পবিজ্ঞানের থেকে অ্যাডভেঞ্চারের পর্যায়ে পড়বে। গল্পগুলোর মধ্যে বিজ্ঞান খুবই কম -- শুধুমাত্র কয়েকটা নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ -- কিন্তু তার চেয়েও কম আছে সমাজে সেই বিজ্ঞানের প্রভাব। ধরুন শঙ্কুর মিরাকিউরলের মতো সর্বরোগহর বটিকা -- তা যদি কোনোদিন তৈরি হয় সমাজটা একেবারে পাল্টে যাবে। সত্যজিৎ রায় এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন বলেই বারবার লিখেছেন শঙ্কুর কোনো আবিষ্কার তাঁর গিরিডির গবেষণাগারের বাইরে বানানো সম্ভব নয়।  মূল ধারার কল্পবিজ্ঞান কিন্তু এভাবে সমাজকে এড়িয়ে যাবে না, বরঞ্চ এই আবিষ্কারের ফলে সমাজের কী পরিবর্তন হবে, তাকেই মুখ্য উপজীব্য করবে। বাংলা ভাষার আমার অন্যতম প্রিয় চরিত্র ঘনাদা। প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্পে বিজ্ঞানে তেমন কোনো বড় ত্রুটি নেই। সমাজে বিজ্ঞানের প্রভাবও এসেছে অনেক ভাবেই, তা সে কৃত্রিম ক্লোরোফিল তৈরিই হোক বা তেলের বিকল্প শক্তির উৎস সন্ধানই হোক। তবে সেখানেও অ্যাডভেঞ্চারই মুখ্য, বিজ্ঞান সেখানে গল্পের মুখ্য অংশ নয়, পটভূমি। বিজ্ঞানের গল্পকারদের দু’রকমের ঝোঁক সম্পর্কে সচেতন থাকতে হয়। অনেক সময় অতিরিক্ত তত্ত্ব গল্পের গতিতে বাধা হয় দাঁড়ায়। কখনো আবার বিজ্ঞান যেন শুধু নামেই আসে, অলৌকিক জাদুবিদ্যার সঙ্গে তার পার্থক্য করা শক্ত হয়ে পড়ে। ক্লার্কের লেখা এই দুই দোষ থেকে মুক্ত তো  বটেই – সমাজকেও তা কখনো এড়িয়ে যায়নি।
      ক্লার্কের কল্পবিজ্ঞানকে আমরা দু ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ভাগে থাকবে সেই সমস্ত গল্প যেখানে ব্যবহৃত বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আমাদের আয়ত্তের সামান্য বাইরে, কিন্তু কল্পনার অতীত নয়। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত ছোটোদের জন্য লেখা আয়ল্যান্ডস ইন দি স্কাই (Islands in the Sky) উপন্যাসের কথা ধরা যাক। স্পেস স্টেশনে প্রতিদিনের জীবন এক ছোটো ছেলের জবানিতে বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাস হিসাবে কখনোই এটা ক্লার্কের প্রথম শ্রেণির লেখা নয়, কিন্তু বিবরণ এতটাই বাস্তব যে পড়তে বসলে মনেই থাকে না স্পেস স্টেশন দূরের কথা, প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহও এই লেখা প্রকাশের ছ’বছর পরের ঘটনা।  মহাকাশে হাসপাতাল, চাঁদে ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক লঞ্চার -- এ সমস্ত আমরা এখনই বানাতে পারি, বাধা শুধু অর্থ। দি ডিপ রেঞ্জ, ডলফিন আয়ল্যান্ড বা দি ঘোস্ট ফ্রম দি গ্রিন ব্যাঙ্কস – এদের আমরা এই পর্যায়ে ফেলতে পারি।
      এই ধরনের উপন্যাসের মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় হল দি ফাউন্টেনস অফ প্যারাডাইস (The Fountains of Paradise). শ্রীলঙ্কার প্রাচীন ইতিহাস এবং মানুষের মহাকাশ জয়ের স্বপ্নকে অসাধারণ মুনশিয়ানাতে ক্লার্ক বেঁধেছেন এক সুরে। সাধারণভাবে ক্লার্কের লেখাতে আমাদের জানা বিজ্ঞানে কোনো ভুল পাওয়া যায় না। কিন্তু এই লেখাতে তিনি যেন নিজেকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন। স্পেস এলিভেটর তৈরি করে মহাকাশ জয়ের স্বপ্ন মানুষ অর্ধ শতাব্দীর থেকেও বেশি পুরানো। সেই এলিভেটরের এরকম বর্ণনা জনপ্রিয় বিজ্ঞানের প্রবন্ধেও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, কিন্তু গল্পের দুরন্ত গতিতে কোনো ছেদ পড়েনি। পঞ্চম শতাব্দীর রাজা কালিদাস পৃথিবীতে স্বর্গকে নামিয়ে আনতে চেয়েছিলেন, আর একবিংশ শতাব্দীতে ইঞ্জিনিয়ার মর্গান পৃথিবী থেকে স্বর্গে অর্থাৎ মহাকাশে যাওয়ার উপায় তৈরি করবেন। যুগের পরিবর্তন ঘটেছে, পাল্টে গেছে পাত্রপাত্রী। পরিবর্তন হয়নি রঙ্গমঞ্চের, থেকে গেছে মানুষের স্বর্গকে স্পর্শ করার দুঃসাহস। দোষে গুণে পিতৃহন্তা কালিদাস চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তাঁর লেখাতে দ্বীপরাষ্ট্রটির ইতিহাস ভূগোল সংস্কৃতির সঙ্গে এমনই নিবিড় পরিচয় ঘটেছিল যে আমরা যখন শ্রীলঙ্কা বেড়াতে গিয়েছিলাম, তখন সিগিরিয়া রক, ক্লার্ক যার নাম দিয়েছেন যক্ষগল, দেখানোর জন্য কোনো গাইডের দরকার হয়নি।
      ডলফিন আইল্যান্ড (Dolphin Island) একটি ছোট ছেলের জবানিতে লেখা। জাহাজে লুকিয়ে থাকা  বাড়ি-পালানো ছোটো ছেলের গল্প পশ্চিমী সাহিত্যে নতুন নয়। ছোট্ট জনি আশ্রয় পেয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার কাছের এক দ্বীপের ডলফিন গবেষণা কেন্দ্রে। স্কুবা ডাইভিংপ্রেমী ক্লার্ক সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ব্যারিয়ার রিফের বিচিত্র জীবজগতের ছবি এঁকেছেন। ডলফিন সুসি বা স্পুটনিকের কাহিনী এতই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছে যে বইটি পড়ার পরে আমার প্রথম কাজ হয়েছিল ডলফিনদের বুদ্ধিমত্তা বিষয়ে খবর নেওয়া। জেনেছি বিজ্ঞানীদের মধ্যে ডলফিনের বুদ্ধির পরিমাপ নিয়ে বিতর্ক আছেতা থাকুক, কিন্তু গল্পের রস তাতে বিন্দুমাত্র কমবে না। প্রজাতি হিসাবে মানুষ বড়ো একা, ভাব বিনিময়ের জন্য আমরা মহাকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। ক্লার্ক আমাদের বলছেন, ঘরের কাছেই আছে কথা বলার সঙ্গী, আমাদের শুধু তার ভাষাটা শিখতে হবে।
      দি ডিপ রেঞ্জ (The Deep Range) উপন্যাসও সমুদ্রের পটভূমিতে, সেখানে ক্লার্ক আমাদের নিয়ে গেছেন মহাসাগরের গভীরেসমুদ্রে প্ল্যাঙ্কটন চাষের মাধ্যমে পৃথিবীর খাদ্য সমস্যা সমাধান করা হয়েছে। এই উপন্যাসের একটি প্রধান চরিত্রের সঙ্গে আমাদের ফাউন্টেনস অফ প্যারাডাইসে দেখা হয়েছে, তিনি বৌদ্ধ ধর্মগুরু মহানায়ক থেরো। আগের গল্পে থেরো মর্গানের বিরোধিতা করে ব্যর্থ, এই উপন্যাসে তিনি তিমি শিকার নিষিদ্ধ করাতে সফল। কী শ্রদ্ধার সঙ্গে চরিত্রটিকে (নাকি চরিত্র দুটিকে?) সৃষ্টি করেছিলেন ক্লার্ক! অধিকাংশ কল্পবিজ্ঞানকারদের মতো তিনি ভবিষ্যৎ সমাজে ধর্ম ও বিজ্ঞানের সম্পর্ককে এড়িয়ে যাননি, যদিও ব্যক্তিগত ভাবে তিনি ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন না বা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। তবে আমার কাছে এই উপন্যাসের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ অন্য জায়গায়। প্রাচীন কাল থেকে সাগরযাত্রী নাবিকরা সমুদ্রসর্পের গল্প আমাদের শুনিয়েছে। টেনিসনের কবিতায় সমুদ্রের তলায় যে ক্রাকেন ঘুমিয়ে আছে, তার রহস্য উদ্ধারের চেষ্টা করেছিল আমাদের গল্পের মুখ্য চরিত্র ওয়াল্টার ফ্রাঙ্কলিন। শেষ মুহূর্তে সে চেষ্টা বিফল হয়, সমুদ্র তার রহস্যকে গোপনই রেখে দিল।
      গল্পের এই ভাগে যে বিস্ময় ও রহস্যের আবহ তৈরি হয়েছিল, তা আমার কাছে ক্লার্কের সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। ক্লার্কের সাহিত্যের দ্বিতীয় অংশ, যেখানে তিনি অতিদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সেখানে এই আবহ সৃষ্টিতে তিনি বহুবার সক্ষম হয়েছেন। নিউটনের তিনটি সূত্রের অনুকরণে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান প্রযুক্তি সম্পর্কে  ক্লার্ক তিনটি সূত্র দিয়েছিলেন, তার মধ্যে তৃতীয়টি সবচেয়ে বিখ্যাত -- পশ্চাৎপদ কোনো সভ্যতার কাছে অনেক এগিয়ে থাকা প্রযুক্তি আর জাদুবিদ্যাতে কোনো পার্থক্য থাকবে না। যেখানেই ক্লার্ক তাঁর নিজের তৃতীয় সূত্র মেনেছেন, মহান কল্পবিজ্ঞানের সৃষ্টি হয়েছে। মনে করুন মুঘল আমলের কোনো মানুষকে আপনি টেলিভিশন দেখাতে পারলেনতার কাছে আপনি হবেন মহান জাদুকর, না হলে একটা গোটা জগতকে ঐ বাক্সে আপনি ঢোকাবেন কেমন করে? প্রযুক্তির বিবর্তন হয় ডারউইন নয়, লামার্কের পথ ধরে – এক প্রজন্মের অভিজ্ঞতা পরের প্রজন্মকে সমৃদ্ধ করে। ঘোড়ার গাড়ি থেকে শুরু করে দু’শো বছরের মধ্যে  বিজ্ঞান-প্রযুক্তি যদি চাঁদে নামা রকেট তৈরি করতে পারে, তাহলে আমাদের থেকে হাজার বা লক্ষ বছর এগিয়ে থাকা সভ্যতা আমাদের অবোধ্য হওয়াটাই স্বাভাবিক।  
      ক্লার্কের      সবচেয়ে পরিচিত উপন্যাস নিশ্চয় ২০০১ঃ এ স্পেস ওডিসি (2001: A Space Odyssey)সেন্টিনেল নামে একটি ছোটো গল্প পরে উপন্যাসে রূপান্তরিত হয়েছিল। এর চলচ্চিত্র রূপায়ণ করেছিলেন স্ট্যানলি কুব্রিক, কল্পবিজ্ঞানভিত্তিক চলচ্চিত্রদের মধ্যে তা একেবারে প্রথম সারিতে জায়গা করে নেবে।  তার পরে আরো তিনটি উপন্যাসের মাধ্যমে গল্প শেষ হয়েছিল। মানুষের উপর নজর রাখছে কোনো এক উন্নত সভ্যতার যন্ত্র মনোলিথ। তার প্রযুক্তি আমাদের কল্পনাতীত, যন্ত্র হলেও তার রীতিমত ব্যক্তিত্ব আছে। কখনো সেই সভ্যতা মানুষের বিকাশে সাহায্য করছে, কখনো বা তাকে ধ্বংসে উদ্যত – কিন্তু কোনোটারই কারণ আমাদের বোধগম্য নয়। গল্পের অপর একটি চরিত্র মানুষেরই তৈরি কম্পিউটার হ্যাল। সে কখনো মহাকাশযানের অভিযাত্রীদের মেরে ফেলতে চায়, আবার কখনো সাহায্য করে। তার এই পরিবর্তনের কারণ আমরা বুঝতে পারি, কিন্তু ক্লার্কের সূত্র মেনেই মনোলিথের উদ্দেশ্য ও প্রযুক্তি আমাদের বুদ্ধির অতীত।
      রাঁদেভু উইথ রাম (Randezvous with Rama) আরো একটি প্রিয় উপন্যাস। সৌরজগতের বাইরে থেকে এক বিশাল মহাকাশযান এসেছিল, যার নাম আমরা দিয়েছিলাম রাম। মানুষের এক অভিযান রামের উপর অবতরণ করে। সেখানে রামের নির্মাতা রামানদের সঙ্গে মানুষের দেখা হয় না। কী উদ্দেশ্যে সে সৌরজগতে এসেছে, তার প্রযুক্তি, কোনো কিছুই প্রকাশ পায় না। আমাদের সভ্যতাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে রাম সৌরজগৎ ত্যাগ করে। এই গল্পটিও সহলেখক নাসার বিজ্ঞানী জেন্ট্রি লীর সঙ্গে মিলে লেখা পরের তিনটি উপন্যাসে অনুসৃত হয়েছে, কিন্তু তারা আমার মন ভরায় নি। পরের গল্পগুলিতে রাম সৃষ্টির উদ্দেশ্য বোঝা গেছে, এমনকি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তৈরির উদ্দেশ্যও আলোচিত হয়েছে। ক্লার্ক কি নিজের সূত্র ভুলে গিয়েছিলেন? প্রযুক্তি সভ্যতার তিনটি ধাপ আছে বলে মনে  করা হয়। প্রথম ধাপে সভ্যতা একটি গ্রহের, দ্বিতীয় ধাপে একটি সৌরজগতের এবং তৃতীয় ধাপে গোটা ছায়াপথের সমস্ত সম্পদকে ব্যবহার করবে। আমরা এখনো প্রথম ধাপে পৌঁছোইনি, আর রামানরা আছে অন্তত দ্বিতীয় ধাপে। হোমো ইরেকটাসের সঙ্গে আধুনিক মানুষের প্রযুক্তিগত যে পার্থক্য, আধুনিক মানুষ ও রামানদের পার্থক্য তার থেকে বেশি। রামের মতো মহাকাশযান তৈরির উদ্দেশ্য কি এত সহজে বোঝা যাবে?
      ছেড়ে দিন রাম সৃষ্টির উদ্দেশ্য। দু’শো বছর আগে যদি কেউ বলতেন সময়ের গতি যে মাপছে তার বেগের উপর নির্ভর করে, বা একটি কণা একই সময়ে দুটি ভিন্ন জায়গায় অবস্থান করে, কোনো বিজ্ঞানী সেকথা মেনে নিতেন? বিশেষ আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টম বলবিদ্যা আমাদের দেখিয়েছে এই দুটো কথাই সত্যি। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যাখ্যা করার জন্য এই দুই সত্যকে প্রয়োজন, আপনি অ্যারিস্টটলকে সে কথা বিশ্বাস করাতে পারতেন? এত সহজে আমরা ব্রহ্মাণ্ডের উদ্দেশ্যকে খুঁজে পাব? কোনো উদ্দেশ্য কি আদৌ আছে? নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনবার্গ লিখেছিলেন, The more the Universe seems comprehensible, the more it also seems pointless। বিশ্বকে আমরা সেদিন বুঝতে পারব যেদিন আমাদের বিজ্ঞান সমস্ত মূল তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলবে। ক্লার্ক কি মনে করছেন আমরা সেই স্তরে পৌঁছে গেছি? রাম সিরিজের প্রথম গল্পেই তো তিনি অক্লেশে নিউটনের তৃতীয় সূত্রকে অগ্রাহ্য করার কথা লিখেছিলেন। বিজ্ঞানে একাধিকবার এরকম হয়েছে যে আমরা ভেবেছি আমাদের জানার আর বিশেষ কিছু বাকি নেই, তারপরের ইতিহাস আমাদের ভুল দেখিয়ে দিয়েছে। মনে পড়ে ঊনবিংশ শতকের শেষের দিকে বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাঙ্কের এক অধ্যাপক তাঁকে বলেছিলেন যে পদার্থবিজ্ঞানে আর মৌলিক কিছু আবিষ্কারের সুযোগ নেই। প্লাঙ্কের গবেষণাই কোয়ান্টম তত্ত্বের জন্ম দিয়ে পদার্থবিদ্যার নতুন দিগন্ত খুলে দিল। ক্লার্ক কি তাঁর নিজের প্রথম সূত্রের শেষাংশ ভুলে গেছেন - যদি কোনো বয়স্ক বিশিষ্ট বিজ্ঞানী কোনো কিছুকে অসম্ভব বলেন, খুব সম্ভবত তিনি ভ্রান্ত?
      এই প্রসঙ্গে আরও একটি উপন্যাসের নাম করতেই হয়, চাইল্ডহুডস এন্ড (Childhood’s End)। এরও প্রথম অংশ একটি ছোটো গল্প হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল। পৃথিবী অধিকার করেছে অন্য সৌরজগতের প্রাণী ওভারলর্ডরা। একমাত্র কোনো অবিচার দেখলেই তারা মানুষের জীবনে হস্তক্ষেপ করে। কিন্তু তারা কেন দেখা দেয় না,  তাই নিয়ে কৌতূহল ও ক্ষোভ দুইই আছে। প্রথম অংশের শেষে আমরা জানলাম যে ইহুদি-খ্রিস্টান ধর্মের কল্পিত শয়তানের সঙ্গে ওভারলর্ডদের চেহারার এত মিল যে মানুষ তাদের সহজে মেনে নিতে পারত না –- তাই তারা নিজেদের দীর্ঘদিন লুকিয়ে রেখেছিল। তাদের সাহায্যে পৃথিবীতে এক স্বর্ণযুগ আসে। তাদের প্রযুক্তি আমাদের বিজ্ঞানের অগম্য, তারা এও বলে যে ব্রহ্মাণ্ডের উদ্দেশ্য চিরদিনই মানুষের চিন্তার বাইরে থাকবে। কেন ওভারলর্ডরা পৃথিবীতে এসেছে? অবশেষে জানা গেল যে মানুষ বিবর্তনের পরের ধাপ ওভারমাইন্ডে যাওয়ার জন্য তৈরি, সেখানে যাওয়ার পথ সুগম করতেই তাদের পাঠানো হয়েছে। ওভারমাইন্ড কিন্তু মানুষ কেন, এত উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন ওভারলর্ডদেরও বিশ্লেষণের অতীত। ওভারমাইন্ড বিস্ময়ের জন্ম দেয়, কিন্তু আমি তার সঙ্গে একাত্ম বোধ করতে পারিনা -- সে আমাদের সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন। এখানে ক্লার্ক প্রায় এক অতীন্দ্রিয় অনুভূতির কাছাকাছি নিয়ে গেছেন পাঠককে।
      ক্লার্ক ছিলেন সঠিক অর্থেই বিশ্বনাগরিক। শ্রীলঙ্কার কথা আগেই বলেছি। কয়েকটি ভারতীয় বংশোদ্ভূত চরিত্র তাঁর গল্পে এসেছে। ওডিসিতে আছেন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ ডক্টর চন্দ্র, হ্যাল যাঁর কাছে সন্তানতুল্য। দি হ্যামার অফ গডের মুল চরিত্র মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন রবার্ট সিং। এই গল্পেই যে গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষ হতে হতে পৃথিবী বেঁচে যায়, তার নাম দিয়েছেন ধ্বংসের দেবী কালীর নামে। তাঁর পছন্দের পরিবেশ মহাকাশ কোনো দেশের সীমাকে স্বীকার করে না, তাইতো তাঁর গল্পে বৃহস্পতির কোনো উপগ্রহে প্রথম পা রাখে চিনের অভিযাত্রীদল। শীতল যুদ্ধের পরিবেশেও তিনি সোভিয়েত মার্কিন যৌথ অভিযানের কথা লিখতে পারেন। তিনি সংস্কৃতির মিশ্রণে বিশ্বাসী ছিলেন -- তাঁর গল্পে শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ ধর্মগুরুর জন্ম হয় স্কটল্যান্ডে, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্ম মিলে সৃষ্টি হয় নতুন এক ধর্ম।  

      এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ তাঁর সাহিত্যের প্রতি কতটা সুবিচার করল, তা ঠিক করার ভার পাঠকের। জীবৎকালেই তিনি নাইটহুড সহ নানা সম্মান পেয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় আবিষ্কৃত এক ফসিল ডাইনোসরের নাম দেওয়া হয়েছে সেরেন্ডিপাসেরাটপস আর্থারসিক্লারকেই। মহাকাশে একটি গ্রহাণুর নামকরণ হয়েছে ক্লার্ক। দুর্ভাগ্যক্রমে এটির নাম্বার ৪৯২৩, কারণ তাঁর প্রাপ্য ২০০১ নম্বর গ্রহাণুটি জনৈক আলবার্ট আইনস্টাইন আগে থেকে দখল করে রেখেছেন। ক্লার্কের প্রায় সমস্ত লেখায় আছে মানবপ্রকৃতির জয়গান এবং মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অপরিমেয় আশাবাদ। সেখানে মানুষে মানুষে যে সংঘাত হয়েছে, তার পিছনে ব্যক্তিস্বার্থ নেই, তা অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রগতি ও স্থিতাবস্থার দ্বন্দ্ব। এমন প্রত্যেক ক্ষেত্রেই তিনি প্রগতির পক্ষে।

প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার জানুয়ারি ২০১৮, পরিমার্জিত