Tuesday 25 February 2020

নাৎসি জার্মানি ও উচ্চশিক্ষা


উচ্চশিক্ষার উপর আক্রমণ: ইতিহাস ফিরে দেখা
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       সাম্প্রতিককালে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হিংসার বিস্তার যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন নয় যে ছাত্র বা শিক্ষকদের উপর আক্রমণ নতুন ঘটনা; পশ্চিমবঙ্গে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে বহিরাগতদের আক্রমণের স্মৃতি এখনো মিলিয়ে যায়নি।  কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক ছাত্রদের হাতে একাধিকবার আক্রান্ত হয়েছেন।  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যেও এধরনের নিদর্শন পাওয়া যাবে। 
       কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির চরিত্র কিছুটা আলাদা। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং উত্তরপ্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিস ঢুকে ছাত্রদের উপর আক্রমণ করেছে। দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও শিক্ষকরা বহিরাগতদের সন্ত্রাসের শিকার -- কিন্তু তাতে পুলিসের এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদতের অভিযোগ উঠেছে। অন্য অনেক প্রতিষ্ঠানেও একই ধরনের ঘটনার খবর পাওয়া গেছে। তার থেকেও বড় কথা হল যে সরকারি স্তরে এ ধরনের ঘটনাতে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, এমনকি মৌখিক নিন্দাটুকুও করা হয়নি। বরঞ্চ যারা আক্রান্ত, তাদেরই দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা চলছে। পাশাপাশি সংবাদমাধ্যমে ও সোশ্যাল মিডিয়াতে চলেছে নানা রকমের ভিত্তিহীন প্রচার।
       জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট অধ্যাপিকা জয়তী বসু এক নিবন্ধে লিখেছেন যে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর এই আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আধুনিক যুগে শিক্ষার সঙ্গে  উদারবাদ ও সহিষ্ণুতা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, সে সমস্ত বর্তমান কেন্দ্রীয় রকারের পছন্দ নয়। নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী যে প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, তার সামনের সারিতে আছে ছাত্ররা। জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে ছাত্রদের এক শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পরে পুলিস অমানবিক আক্রমণ চালায়, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিও ভাঙচুর করে। তিনি বলেছেন উচ্চশিক্ষার উপর আক্রমণ অন্য ভাবেও শুরু য়েছে। ২০১৩-১৪ সালে উচ্চশিক্ষার বরাদ্দ ছিল মোট জাতীয় উৎপাদনের ০.৬ শতাংশ, সেটা যথেষ্টই কম ছিল। ২০১৮-১৯ বাজেটে তা  আরও কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ০.২ শতাংশ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মুখস্থবিদ্যা এবং প্রযুক্তির উপরে নয়, স্বাধীন চিন্তার উপর জোর দিয়ে অন্ধ আনুগত্যের পথে  বাধা সৃষ্টি করে। চিন, মিশর, হাঙ্গেরি বা তুর্কির মতো দেশে স্বৈরশাসকরা তাই একইভাবে উচ্চশিক্ষার উপরে আঘাত নামিয়ে আনছে। একই সঙ্গে আগে উচ্চশিক্ষার প্রাঙ্গণে সমাজের যে সমস্ত অংশের প্রবেশাধিকার সংকুচিত ছিল, যেমন নারী, তথাকথিত নিচু জাত এবং প্রান্তবাসী, তারা শিক্ষার সুযোগ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক ও আর্থিক বঞ্চনার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা তাদের নিজেদের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করার সুযোগ করে দিচ্ছে। বিতর্ক ও প্রশ্নকে জোর করে চাপা দেওয়া দীর্ঘমেয়াদে সমাজ ও দেশের পক্ষে ক্ষতিকর হয়।
       ভারতের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে হিংসা বিদেশেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বিশ্ববিখ্যাত গবেষণা পত্রিকা ‘নেচার’ ১৬ জানুয়ারি এক নিবন্ধে ভারত সরকারের কাছে শিক্ষাঙ্গনে হিংসা বন্ধের জন্য ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। নিবন্ধের সূচনাটুকু অনুবাদ করি। ‘গত কয়েক সপ্তাহ ধরে সারা পৃথিবী দেখেছে যে শিক্ষাবিদ ও ছাত্রসহ ভারতের নাগরিকরা পথে নেমেছে। বৈষম্যমূলক নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জানাতে ভারতের সংবিধানের মুখবন্ধ পাঠে সমবেত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।’ উপরের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনা উল্লেখ করে পত্রিকাটি লিখেছে যে আন্তর্জাতিক মহ এই নিয়ে উদ্বিগ্ন। প্রতিবাদীদের মধ্যে আছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত দুই নোবেল জয়ী অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভেঙ্কি রামকৃষ্ণন, তাঁরা দুজনেই নতুন নাগরিকত্ব আইনটিরও বিরোধী। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যসাধনের মূল স্তম্ভ, সরকারি নীতির প্রতিবাদ করা জনগণের অধিকার। ভারত ও সারা বিশ্বের শিক্ষাবিদরা সঙ্গত কারণেই শিক্ষাক্ষেত্রে বলপ্রয়োগের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর বিজ্ঞানবিষয়ক মুখ্য উপদেষ্টা বিজয়রাঘবন বলেছেন, শিক্ষাঙ্গন শিক্ষা, আলোচনা, ভিন্ন মতের মধ্যে বিতর্ক ও গবেষণার জায়গা, সেখানে হিংসার কোনো স্থান নেই।’ প্রশাসনকে সেই কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে পত্রিকা।
       বিশ্ববিদ্যালয় যে স্বাধিকার, স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের ও প্রশ্ন করার অধিকার ইত্যাদি নানা কথা বলবে শাসকদের পক্ষে তা অরুচিকর। কেন্দ্রীয় সরকারি হিসাবেই গত তিন বছর ধরে ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়দের মধ্যে জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম স্থান অধিকার করে আছে অথচ তার ছাত্র-শিক্ষক-গবেষকদের দেশ-বিরোধী প্রমাণ করার জন্য চেষ্টার অন্ত নেই। আমাদের রাজ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়েও আমাদের রাজ্যের শাসক দলের একই রকম মাথাব্যথা। অধ্যাপক সুকান্ত চৌধুরি এক বক্তৃতাতে বলেছিলেন, ‘কী রাজ্যে কী কেন্দ্রের এক্তিয়ারে যেগুলি সবচেয়ে সফল অগ্রণী প্রতিষ্ঠান, মূল্যায়ন তালিকায় যারা পুরোভাগে থাকে, তাদের প্রতিই কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে খড়গহস্ত। অন্য প্রতিষ্ঠানের হিংসা-তাণ্ডব-ভাঙচুর, দুর্নীতি-অনাচার, বিভ্রাট-অপশাসন সব কিছুর সঙ্গে তাঁদের দিব্যি সহাবস্থান, সেগুলি ছোট করে দেখাতে, তার হয়ে সাফাই গাইতে এমনকি অস্তিত্ব অস্বীকার করতে তাঁরা উন্মুখ।‘ আমাদের দেশে উচ্চশিক্ষার প্রসার সীমিত, তাই উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক ভাবেই বিশেষ সুবিধাভোগী ও সমাজ থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন। তাদের উপর আক্রমণ শাসক দলের কাছে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের একটা সহজ রাস্তা।
      এই প্রসঙ্গে স্মরণ করি যে নতুন নাগরিকত্ব বিরোধী বিলের প্রতিবাদে একদল বিজ্ঞানী একটি আবেদন স্বাক্ষর করেছিলেন। বর্তমান সরকারের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের যোগাযোগ বড়ই ক্ষীণ, কর্তাব্যক্তিরা ইতিহাস নয়, কল্পকথায় বিশ্বাসী এবং আধুনিক বিজ্ঞানকে ততদূরই বিশ্বাস করেন যতদূর প্রাচীন শাস্ত্রে পাওয়া যাবে বলে তাঁদের ধারণা। তাই বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদে তাঁরা কর্ণপাত করেন নি। খবরে প্রকাশ প্রতিবাদীদের মধ্যে যাঁরা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় কিনা তাই নিয়ে সরকার ভাবনা চিন্তা করছে। কোনো কোনো উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা যাবে না এমন বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে
      পাঠক মাত্রেই উপরে আলোচিত ঘটনাক্রম জানেন। উচ্চশিক্ষার উপর নিয়ন্ত্রণ জারির চেষ্টা  বিশ্বে আগেও হয়েছে। তার সবচেয়ে কুখ্যাত ঘটনা ও তার ফলাফলকে স্মরণ করার জন্য এই লেখা। ঘটনাস্থল ছিল জার্মানি, সময় নাৎসিদের শাসনকাল।
       শিক্ষাদানের পাশাপাশি স্বাধীন চিন্তার বিকাশে উৎসাহদানের জন্য জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে মধ্যযুগেও খুব শ্রদ্ধার চোখে দেখা হত। প্রায় দুই শতাব্দী আগে ১৮৩৭ সালে গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপককে সরকারের বিরোধিতা করার জন্য পদচ্যুত করা হয় -- এর ফলে সাধারণের মধ্যে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল যা সে যুগে এক বিরল ঘটনা। আধুনিক যুগে জার্মান শিক্ষাপদ্ধতি ৎকর্ষ বৃদ্ধির পক্ষে সহায়ক ছিল। নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয়েছিল ১৯০ সাল থেকে,  ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত বিজ্ঞান ও সাহিত্যে মোট ৪১ জন জার্মান সেই পুরস্কার লাভ করেন। জার্মান অধ্যাপকদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও সুযোগসুবিধা ছিল সারা পৃথিবীর শিক্ষাবিদদের ঈর্ষার বস্তু।
      জার্মানিতে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসে ১৯৩৩ সালে। নাৎসি মতবাদের এক মূল স্তম্ভ ছিল ইহুদি বিরোধিতা। নাৎসিরা ইহুদিদের নিচু শ্রেণির মানুষ মনে করত এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে পরাজয় ও তার পরের দুঃখকষ্টের জন্য তাদের দায়ী করেছিল। নাৎসিরা সরকারে আসার পরে তাদের উপর নিপীড়ন চরমে উঠেছিল, সে ইতিহাস সকলেই জানেন। একই সঙ্গে চিন্তার জগতে একাধিপত্য কায়েম করার জন্য শিক্ষা, বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষাকে নিজের কবলে আনার জন্য সচেষ্ট হয় নাৎসিরা। শিক্ষাবিদদের হিটলার বিশ্বাস করতেন না, তিনি চেয়েছিলেন নাৎসি মতবাদ বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে পড়াতে হবে এবং সমস্ত শিক্ষাতেই একটা নাৎসি ঝোঁক আনতে হবে।
      হিটলারের ক্ষমতায় আসার তিন মাসের মধ্যেই তাই নতুন সিভিল সার্ভিস আইন জারি করে প্রাথমিক স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, সব স্তরের শিক্ষককে তার আওতায় আনা হয়। ইহুদি এবং সরকারবিরোধীদের সরাসরি পদচ্যুত করা হয়। ঠাকুমা, ঠাকুরদা, দাদু বা দিদিমার মধ্যে একজন ইহুদি হলেই তাঁর চাকরি যায়। উদারবাদীরাও সরকার বিরোধী পরিচয়ে বরখাস্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের মধ্যে পনেরো শতাংশ এই আইনের আওতায় চাকরি হারান, তাঁদের এক তৃতীয়াংশ ছিলেন ইহুদি। বাকি দুই তৃতীয়াংশ তাঁদের রাজনৈতিক মতামতের জন্য বরখাস্ত হন।
      আমাদের দেশে ছাত্ররা ও জনসাধারণ মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টির চেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে দেশ শিক্ষাতে সেই সময় সারা পৃথিবীতে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিল, সেই জার্মানিতে এই ধরনের ঘটনার কী প্রতিবাদ হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে আশ্চর্য মনে হলেও বাস্তব এই যে বিশেষ কোনো প্রতিবাদ শিক্ষাবিদ বা ছাত্রমহল থেকে শোনা যায়নি।  কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলি শিক্ষাদানের পাশাপাশি উগ্র জাতীয়তাবাদের সূতিকাগার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি স্পষ্টতই ছিল আক্রমণকারী, অথচ ১৯১ সালে সাড়ে চারশোজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জার্মানির সামরিক অভিযানকে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বিরোধিতা করেছিলেন মাত্র তিনজন, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নাম আলবার্ট আইনস্টাইন। যুদ্ধে পরাজয়ের পরে জার্মানিতে প্রতিষ্ঠিত ভাইমার প্রজাতন্ত্র অনেক অধ্যাপকেরই অপছন্দ ছিল। আবারও আইনস্টাইন ছিলেন ব্যতিক্রম, তিনি প্রজাতান্ত্রিক সরকারের অঘোষিত মুখপত্রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। ছাত্রদের মধ্যেও নাৎসিদের প্রভাব ছিল খুবই বেশি, ছাত্রদের অধিকাংশ সংগঠন থেকে আগেই ইহুদিদের বিতাড়িত করা হয়েছিল। তাই ছাত্রদের থেকেও নতুন আইনের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ আসেনি।
      অধ্যাপকদের মনোবৃত্তি কিরকম হয়েছিল তার একটা উদাহরণ নেওয়া যাক। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক পিটার ড্রুকের ছিলেন অস্ট্রিয়ান, নতুন নীতি চালু হওয়ার সময় তিনি দেশে ফিরে যাবেন কিনা চিন্তা করছিলেন। ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয় ছিল জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে সবচেয়ে উদার, অধ্যাপকরা তাঁদের শিক্ষাদীক্ষা এবং গণতন্ত্রনিজেদের বিবেকের প্রতি আনুগত্য নিয়ে গর্ব বোধ করতেন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন নাৎসি কমিশার নিয়োগ করা হল, তাঁর হাতেই সমস্ত ক্ষমতা। কমিশার সমস্ত অধ্যাপকদের এক সভাতে ডেকে ঘোষণা করেন যে সমস্ত ইহুদি অধ্যাপকদের অবিলম্বে বরখাস্ত করা হচ্ছে। বিভাগীয় প্রধানদের অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করে কমিশার বলেন যে তাঁরা যে কোনো রকম বিরোধিতা করলে তাঁদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হবে। সভায় ছিলেন এক বিশিষ্ট শরীরতত্ত্ববিদ যিনি উদারনীতি ও স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর একনিষ্ঠ সমর্থনের জন্যও বিখ্যাত ছিলেন, ড্রুকের তাঁর নাম বলেন নি। কমিশারের বক্তৃতার শেষে সবাই যখন তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে, তিনি উঠে বললেন, ‘এ সব তো খুব ভালো কথা, কিন্তু শরীরতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণার জন্য কি বেশি টাকা পাওয়া যাবে?’ কয়েকজন অধ্যাপক ইহুদি সহকর্মীদের সঙ্গে সভা থেকে বেরিয়ে গেলেও বাকিরা কিন্তু তাঁদের থেকে দূরত্ব বজায় রাখেন। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে ড্রুকের আচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে জার্মানি ত্যাগ করেন।
       ছাত্ররাও পিছিয়ে ছিল না। তারা ঘোষণা করে যে জার্মান সাহিত্যকে অ-জার্মান প্রভাব থেকে মুক্ত করতে হবে। এক বিরাট বহ্ন্যুৎসবের আয়োজন করা হয় যেখানে আগুনে নিক্ষিপ্ত হয় সিগমুন্ড ফ্রয়েড, কার্ল মার্ক্স, বের্টোল্ট ব্রেখট, স্টিফেন জুইগ, আলবার্ট আইনস্টাইনের মতো ইহুদি দার্শনিক বিজ্ঞানী বা সাহিত্যিকদের বই।
      জার্মানির কথায় আবার ফিরে যাব, কিন্তু তার আগে আমাদের দেশের পরিস্থিতির সঙ্গে তুলনা করা যাক। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কিন্তু হচ্ছে না, সবাই এখনো পর্যন্ত সরকারি সিদ্ধান্তকে মু বুজে মেনে নিচ্ছে না, প্রতিবাদ বিভিন্ন মহল থেকে আসছে। এ থেকে বোঝা যায় যে উগ্র জাতীয়তাবাদ এখনো পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি। অবশ্যই তার একটা বড় কারণ গত নয় দশকে সারা পৃথিবীর পটপরিবর্তন। দক্ষিণপন্থী চিন্তাভাবনা নিঃসন্দেহে এই মুহূর্তে খুবই শক্তিশালী, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে তা সর্বগ্রাসী। বিশে করে শিক্ষাপ্রাঙ্গগুলি সারা পৃথিবীতেই এখনো উদারবাদের ঘাঁটি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে রিপাবলিকানরা বাকি সমস্ত প্রতিষ্ঠানে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হলেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে তাদের বিশেষ জায়গা নেই।  কিন্তু সাধান না হলে ভারতে ভবিষ্যতে যে জার্মানির মতো অবস্থা হবে না তা নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না।
      ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলের বিখ্যাত দার্শনিক ও শিক্ষাবিদ জুডিথ বাটলারের ২০১৮ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ ‘The Criminaliztion of Knowledge’ থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করি। ‘If and when the government or any other external power intervenes with political interests in the university to mandate or censor its curriculum, its direction, its standards, then the autonomous judgement of the faculty is undermined, and knowledge is restricted and distorted. The exercise of the freedom to think is punishable under such conditions. And when administrators ally with those external powers, they participate in the destruction of their own institutions.’ সরকার বা বাইরের শক্তি শিক্ষাঙ্গনে হস্তক্ষেপ আমাদের দেশে নতুন নয়। এ কথাও বলা বাহুল্য যে কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি সবসময়েই থাকবেন যাঁরা নিজেদের সুবিধার জন্য প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ বা সমাজের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে তৈরি থাকবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্বাধিকার হরণের সুযোগ নিয়ে তাঁদেরই সরকার প্রশাসনিক পদে দেখতে পছন্দ করবে। আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে আমরা বাটলারের কথার প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেখতে পাই। নাৎসি জার্মানিতেও এই ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু যে শিক্ষাবিদ আদর্শগতভাবে এই ধরনের হস্তক্ষেপকে সমর্থন করেন তিনি শুধু একটা প্রতিষ্ঠান নয়, গোটা ব্যবস্থাটার অনেক বেশি অনেক বেশি ক্ষতি করেন।
      নাৎসিদের বিরোধিতা করেছিলেন কয়েকজন সন্দেহ নেই। কয়েকজন ইহুদি বা উদারবাদী না হয়েও এই নতুন নীতির প্রতিবাদে পদত্যাগও করেছিলেন। কেউ কেউ আবার বরখাস্ত সহকর্মীদের সাহায্য করেছিলেন, কিন্তু গোপনে, কারণ তা অপরাধ হিসাবে গণ্য হত। যেমন এক অধ্যাপক পল কাহলে তাঁর এক ইহুদি বন্ধুকে সাহায্য করেছিলেন বলে তাঁকে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয় যে তিনি চাকরি ছেড়ে ব্রিটেনে চলে যান। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে বুদ্ধিজীবীরা শুধুমাত্র প্রতিবাদ করেন নি বা নীরবে পাশ কাটিয়ে গেছেন তা নয়, নাৎসি মতবাদের পক্ষে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক যুক্তি হাজির করেছিলেন।  ফ্রেইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত দার্শনিক মার্টিন হাইডেগার ছাত্র ও সহকর্মীদের বলেন যে নাৎসিদের সমর্থন করা উচিত কারণ জার্মানির আত্মার নিশ্বাস নেওয়ার জন্য তাজা বাতাসের প্রয়োজন। প্রশ্ন করা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা হল স্বার্থপরতা ও নেতিবাচক। অথচ সিভিল সার্ভিস আইনের পরে তাঁর সহকর্মী ধ্যাপকরা তাঁকেই ভোট দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাচিত করেন। হিটলার ক্ষমতায় আসার এক মাসের মধ্যে গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ইহুদি অধ্যাপককে বরখাস্ত করা হয়। পদার্থবিজ্ঞানে নোবেলজয়ী জেমস ফ্রাঙ্ক যখন তার প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন, তখন গটিনগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক অধ্যাপক চিঠি লিখে তাঁর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতের অভিযোগ আনেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে বলা হয়েছিল ইহুদি ধাপ্পাবাজি – এই কথাটা কিন্তু নাৎসি পার্টির নেতা বা সরকারের উচ্ছিষ্ট ভোগে উন্মুখ অপরিচিত অধ্যাপকদের থেকে আসেনি। যে দু’জন বিজ্ঞানী আপেক্ষিকতা তত্ত্বের উপর আক্রমণের নেতৃত্ব দেন, তাঁরা ভালোই জানতেন যে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পরীক্ষাতে প্রমাণিত। ফিলিপ লেনার্ড ও জোহানেস স্টার্ক যথাক্রমে ১৯০৫ এবং ১৯১৯ সালে পদার্থবিদ্যাতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু ইহুদি বিদ্বেষ তাঁদের চিন্তাশক্তিকে আচ্ছন্ন করেছিল।
      বিশ্ববিদ্যালয়গুলির পরিস্থিতি উত্তরোত্তর খারাপ হয়েছিল। হিটলার যখন ক্ষমতায় আসেন তখন জার্মানিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছি১,২৭,৮২০। ছ’বছরের মধ্যে ১৯৩৯ সালে তা অর্ধেকেরও বেশি কম দাঁড়ায় মাত্র ৮,৩২শুধুমাত্র ইহুদি ছাত্রদের বিতারণ দিয়ে এই ঘটনার ব্যাখ্যা করা যাবে না, কারণ তারা সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। নাৎসিরা উচ্চশিক্ষাকে পছন্দ করত না এবং সাধারণ ভাবে মৌলিক জ্ঞানার্জনের বিরোধী ছিল। উচ্চশিক্ষাতে সুযোগ পেতে গেলে পুরুষদের জন্য মিলিটারি সার্ভিস ও মহিলাদের জন্য লেবার সার্ভিস করা হয়েছিল বাধ্যতামূলক। এই সমস্ত কারণে ছাত্রসংখ্যা দ্রুত কমতে থাকে। নারীশিক্ষার অবস্থা আরও খারাপ হয়। আইন করে অধ্যাপক পদে মহিলাদের নিয়োগ বন্ধ করা হয়। মহিলা ডাক্তারদের চিকিৎসা করতে দেওয়া হত না। এই সব কারণে ছাত্রীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে হ্রাস পায়।
       নাৎসি শাসনকালে ইহুদি শিক্ষাবিদদের জার্মানি ত্যাগের ইতিহাস খুবই পরিচিত। যাঁরা তা সত্ত্বেও দেশে রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁদের শেষ পর্যন্ত স্থান হয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে  ষাট লক্ষ ইহুদিকে খুন করা হয়েছিল, বন্দী অধ্যাপকদের অধিকাংশই ছিলেন সেই তালিকায়। সবচেয়ে বিখ্যাত দেশত্যাগীদের মধ্যে রয়েছেন আইনস্টাইন। ছাত্রসংখ্যা হ্রাসের ফল কী হয়েছিল তা অনুমানের বিষয়, কিন্তু নাৎসি শাসনের ফলে বিজ্ঞানের ভরকেন্দ্র যে জার্মানি থেকে নতুন দুনিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্থানান্তরিত হয়েছিল সন্দেহ নেই। শুধুমাত্র পদার্থবিদ্যাতেই পাঁচজন দেশত্যাগী বিজ্ঞানী পরবর্তীকালে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। আরও তিনজন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীর জন্ম যুদ্ধপূর্ব জার্মানিতে, কিন্তু তাঁদের পরিবার দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছিল।
       বিজ্ঞানীদের দেশত্যাগের ফল বোঝার জন্য মার্কিন পরমাণু বোমা প্রকল্পের পিছনের ইতিহাসের দিকে চোখ রাখা যাক।পরমাণু বোমার পিছনে আছে নিউক্লিয় বিভাজন বিক্রিয়া। জার্মান অটো হান এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞানের ইতিহাস জানে যে তার পিছনে হানের দীর্ঘদিনের সহযোগী লিজে মাইটনারের ভূমিকা তাঁর থেকে কম নয়। বস্তুত পরীক্ষার ফল ব্যাখ্যার জন্য হানকে মাইটনারের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। মাইটনার কিন্তু তখন জার্মানি থেকে গোপনে পালিয়ে গেছেন। ফলে নিউক্লিয় বিভাজনের কথা গোপন রাখার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। বস্তুত এ বিষয়ে গবেষণাপত্র প্রকাশের আগেই ডেনমার্কের বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিল্‌স বোরের মারফত সেই খবর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে যায়। আইনস্টাইন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে এক চিঠিতে পরমাণু বোমা তৈরি সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছিলেন। এই চিঠি লিখতে তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন লিও জিলার্ড, ইউজিন উইগনার এবং এডওয়ার্ড টেলার। এঁরা সবাই জার্মান নন, কিন্তু তিনজনেই ইহুদি এবং প্রাণ বাঁচাতে নাৎসি অধিকৃত ইউরোপ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। জিলার্ড শৃঙ্খল বিক্রিয়ার আবিষ্কর্তা যা পরমাণু বোমা ও রিঅ্যাক্টরের প্রাণ স্বরূপ। টেলার এবং উইগনার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হাইড্রোজেন বোমা নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। পরমাণু বোমা প্রকল্পের প্রধানতম বিজ্ঞানীদের মধ্যে ছিলেন এনরিকো ফের্মি ও নিল্‌স বোর। ফের্মি ইতালিয়ান,  তাঁর দেশেও হিটলারের প্রভাবে মুসোলিনি ইহুদি বিরোধী আইন চালু করেন। বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ডেনমার্ক অধিকার করে নেওয়ার পরে সেখানে ইহুদিদের উপর আক্রমণ নেমে আসে। বোর বা ফের্মি ইহুদি ছিলেন না, কিন্তু তাঁদের স্ত্রীরা ছিলেন ইহুদি। স্ত্রীদের রক্ষা করতে তাঁদের দেশত্যাগ করতে হয়েছিল।
       হিটলারের জার্মানিতে শিক্ষাক্ষেত্রে ইহুদিদের উপর আক্রমণ দিয়ে যে ঘটনাক্রম শুরু হয়েছিল, দেশের প্রায় সার্বিক ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে তার পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পঁচাত্তর বছর পরেও জার্মানি বিজ্ঞান গবেষণাতে তার অতীত শীর্ষ অবস্থানের কাছাকাছি পৌঁছোতে পারেনি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করাটা জরুরি। জার্মানিতে প্রতিবাদের কণ্ঠ ধ্বনিত হয়নি, তাই নাৎসিরা ষাট লক্ষ ইহুদিকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে খুন করতে পেরেছিল। বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে প্রতিবাদ না করাটা অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানোর নামান্তর। লিজে মাইটনার অটো হানকে এক চিঠিতে লিখেছিলেন, “You all worked for Nazi Germany. And you tried to offer only a passive resistance. Certainly, to help buy off your conscience you helped a persecuted person here and there, but millions of innocent human beings were allowed to be murdered without any kind of protest being uttered. ...  you first betrayed your friends, then the men and women who worked with you in that you let them stake their lives on a criminal war – and finally that you betrayed Germany itself, because even when the war was already quite hopeless, you did not once arm yourselves against the senseless destruction of Germany.” উচ্চশিক্ষার উপর আক্রমণ এক বৃহৎ পরিকল্পনার অংশবিশেষ। নিরপেক্ষ থাকা বা নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ সেই পরিকল্পনা বানচাল করার পক্ষে যথেষ্ট নয়। ছাত্ররা ও আরও সঠিকভাবে বললে তরুণ সমাজ সেই কথা হৃদয় থেকে উপলব্ধি করেছে ও পথে নেমে প্রতিবাদ করছে। 

(প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, ফেব্রুয়ারি, ২০২০)