Friday 20 December 2019

‘এবং আইনস্টাইন’ – প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞানপ্রবন্ধের সংকলন


‘এবং আইনস্টাইন’ – প্রাসঙ্গিক বিজ্ঞানপ্রবন্ধের সংকলন

  গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       ‘এবং আইনস্টাইন’ অর্পণ পালের কয়েকটি বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধের সংকলন। নামটিতে অভিনবত্ব আছে, লেখক প্রথমেই বলেছেন ‘বইয়ের মূল ভরকেন্দ্র বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন।‘প্রথম পর্বের ছটি প্রবন্ধের সেটা সর্বাঙ্গীণ ভাবেই সত্যি। আইনস্টাইন সেখানে আছেন, এমনকি নাম উল্লেখ না থাকলেও আছেন। লেখক বলেননি, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের জন্যও ঠিক তেমনি এক ভরকেন্দ্র তিনি বেছে নিয়েছেন। সেখানে আছেন বিশ্বের সেরা বিজ্ঞানীদের প্রায় সব তালিকাতেই যিনি আইনস্টাইনকে সরিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে নিয়েছেন, সেই আইজ্যাক নিউটন।
       লেখক শুরুতে আইনস্টাইনের এক সংক্ষিপ্ত জীবনী যোগ করেছেন, ফলে পরের লেখাগুলি পড়তে সুবিধা হয়েছে। প্রথম প্রবন্ধে এসেছ ঠিক একশো বছর আগের এক পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের কথা। সেই সময় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটনের উদ্যোগে সূর্যের মাধ্যাকর্ষণে তারার আলো কতটা বেঁকে যায় তা মাপা হয়েছিল। এডিংটন ঘোষণা করেন যে আইনস্টাইনের চার বছর আগের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের অংকের সঙ্গে তা মিলে গেছে। বিশ্বযুদ্ধ ক্লান্ত মানুষের কাছে দুইবিরোধী শিবিরের দুই বিজ্ঞানীর এই যৌথ কৃতিত্ব অন্য এক বার্তা নিয়ে এসেছিল। এডিংটনের অনুসৃত পদ্ধতি নিয়ে সম্প্রতি প্রশ্ন উঠেছে। সাধারণ আপেক্ষিকতা আইনস্টাইনের অন্যান্য বিখ্যাত তত্ত্বের মতো একবারে পূর্ণতা পায়নি, দশ বছরের চেষ্টাতে আইনস্টাইন তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছেছিলেন। এই সমস্ত ইতিহাসও লেখাতে এসেছেএকশো বছর পরে জ্যোতির্বিদ্যা এমন স্তরে উঠেছে, যে কৃষ্ণগহ্বরের ছবি তোলা সম্ভব হয়েছে, সফল হয়েছে মহাকর্ষ তরঙ্গের সন্ধান। এ দুইই সেই সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের তত্ত্বের ভবিষ্যৎবাণী। তাই এই লেখাটি আজ খুবই প্রাসঙ্গিক।
       দ্বিতীয় নিবন্ধের বিষয় আইনস্টাইনের সমসাময়িক অপর এক জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রিৎজ হেবার। হেবার এক জটিল মানুষ। একদিকে তিনি বাতাসের নাইট্রোজেন থেকে অ্যামোনিয়া সংশ্লেষ পদ্ধতি আবিষ্কার করে সারের উৎপাদনে বিপ্লব এনেছেন, অন্যদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর তৈরি রাসয়ানিক অস্ত্র বহু সৈন্যের মৃত্যুর জন্য দায়ীসেই নিয়ে তাঁর স্ত্রীর ক্লারার সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ হয়েছিল, স্ত্রীর আত্মহত্যাও তাঁকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত করতে পারে নি। লেখক উদ্ধৃত করেছেন হেবারের মত, যুদ্ধের সময় বিজ্ঞানীর দায়িত্ব শুধুমাত্র দেশের প্রতি। এই আলোচনা আজ আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে আরো প্রাসঙ্গিক, কারণ প্রবন্ধটা পড়তে গিয়ে মনে পড়ে গেল যে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর পরেই জার্মান আগ্রাসনকে ধিক্কার জানিয়ে চারজন জার্মান অধ্যাপক এক বিবৃতি প্রকাশ করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন আইনস্টাইন। সেই বিবৃতি ছিল জার্মানির বেলজিয়াম আক্রমণকে সমর্থনে তিরানব্বই জন জার্মান অধ্যাপক পণ্ডিতের বিবৃতির প্রত্যুত্তর। তিরানব্বই জনের মধ্যে অনেকে পরে তাঁদের মত পরিবর্তন করেছিলেন, হেবার কিন্তু তাঁদের মধ্যে পড়বেন না। অথচ আইনস্টাইন ও হেবার দুজনে ছিলেন বন্ধু। ফ্যাসিবাদের কাছে শেষ পর্যন্ত উগ্র দেশপ্রেমও ইহুদি পরিচয়ের পাশে গৌণ হয়েছিল, এটাই হেবারের জীবনের ট্রাজেডি।
       তৃতীয় প্রবন্ধে এসেছেন ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক, কোয়ান্টাম তত্ত্বের জনক এবং আইনস্টাইনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুতিরানব্বই জনের বিবৃতির স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম, আবার এক বছরের মধ্যেই তিনি নিজের ভুল বুঝে প্রকাশ্যে জার্মানির সমালোচনা করেছিলেন। হিটলারের উত্থানের সঙ্গে অনেক জার্মান বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের তত্ত্বকে ইহুদি বিজ্ঞান বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন, প্ল্যাঙ্ক কিন্তু বিজ্ঞানের ব্যাপারে কোনোরকম আপোস করতে রাজি ছিলেন না। ইহুদি বিজ্ঞানীদের রক্ষা করার জন্য তিনি হিটলারের সঙ্গে দেখাও করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের সঙ্গে যে কোনো রকম সমঝোতা ব্যর্থ হতে বাধ্য। প্ল্যাঙ্কও তাই ফ্যাসিস্ট আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন।
       চতুর্থ প্রবন্ধটির বিষয় বর্তমান বহুচর্চিত, সত্যেন্দ্রনাথের আইনস্টাইনকে লেখা সেই বিখ্যাত চিঠি এবং সত্যেন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের সম্পর্ক। বিষয়টি পরিচিত হলেও প্রবন্ধের মধ্যে সংক্ষিপ্ত আকারে সত্যেন্দ্রনাথের  জীবন আলেখ্য ও আইনস্টাইনের সঙ্গে তাঁর মতবিনিময়কে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন লেখকপরের লেখাটিতে আছে ফ্যাসিবাদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য আইনস্টাইনের জার্মানি ত্যাগের কথা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাসের সময় তিনি কয়েকজন পরিচিত বিজ্ঞানীর অনুরোধে স্বাক্ষর করেছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টকে লেখা এক চিঠিতে, যেখানে হিটলারের হাতে নিউক্লিয়ার বোমার বিপদ সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছিল। এই ঘটনা প্রবাহের প্রথম পর্ব শেষ হয় হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে নিউক্লিয় বোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে। আইনস্টাইনের ভর ও শক্তির তুল্যতা সূত্র নিউক্লিয় বোমা তৈরিতে কোনো ব্যবহারিক কাজে লাগে নি, আইনস্টাইন বোমা তৈরির সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত ছিলেন না। কিন্তু যখন যুদ্ধের পরে জানা গেল যে জার্মানি সেই অস্ত্র তৈরির কাছাকাছিও পৌঁছোয় নি, তখন আইনস্টাইন সেই চিঠিতে স্বাক্ষরের সিদ্ধান্ত নিয়ে অনুশোচনা করেছেন। এই পর্বের শেষ প্রবন্ধটি আইনস্টাইনের নোবেল পুরস্কার নিয়ে, সে কথায় আমরা পরে আসব।
       দ্বিতীয় পর্বের প্রথম প্রবন্ধটির বিষয় নিউটনের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিনিউটন অ্যালকেমি ও বাইবেলের ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে অনেক কথা লিখেছিলেন। আধুনিক যুগে আমরা অ্যালকেমির পরশপাথর তৈরির চেষ্টাকে আমরা বিদ্রূপ করতে অভ্যস্ত, কিন্তু নিউটনের যুগে রসায়ন ও অ্যালকেমির মধ্যে সীমারেখা স্পষ্ট ছিল না। বিজ্ঞানের ঐতিহাসিকরা অনেকে মনে করেন যে সাদা আলো যে নানা রঙের আলোর সমাহার, সেই ধারণা নিউটন তাঁর অ্যালকেমি চর্চা থেকেই পেয়েছিলেন। প্রায় এক কোটি শব্দ সমন্বিত সেই পাণ্ডুলিপির ইতিহাসও যথেষ্ট চমকপ্রদ
       পরের লেখাতে আছেন জিওদার্নো ব্রুনো, আধুনিক বিজ্ঞানের প্রথম শহিদ। ক্যাথলিক চার্চের বিরাগভাজন হয়ে গ্যালিলিও নিজের মতকে ভুল বলতে বাধ্য হয়েছিলেন। কেপলার ছিলেন জার্মান, নিউটন ইংরেজ – দুজনেরই জন্ম প্রটেস্টান্ট দেশে। প্রটেস্টান্ট চার্চ ছিল অপেক্ষাকৃত সহনশীল, তাঁদের বিজ্ঞান গবেষণাতে তা কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। গ্যালিলিও ও ব্রুনোর সমসাময়িক কেপলার তাঁদের মতোই কোপার্নিকাসপন্থী ছিলেন নিউটন অবশ্য পরের যুগের মানুষ।  ব্রুনো দার্শনিক, বিজ্ঞানী নন।  গ্যালিলিও ভুল স্বীকার করে চরম শাস্তি এড়িয়েছিলেন। ব্রুনোর মত ছিল আরো বেশি বাইবেল বিরোধী। তিনি শুধু যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে বলেছিলেন তা নয়, তিনি বলেছিলেন যে  মহাকাশে আছে অসংখ্য গ্রহ, সেখানে থাকতে পারে মানুষের মতো আরো উন্নত জীব। ক্ষমা তিনি চাইবেন না, তাই তাঁকে পুড়ে মরতেই হল।
       এই পর্যায়ের তৃতীয় প্রবন্ধের বিষয় নিউটন ও রবার্ট হুকের সম্পর্ক। মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কারের ক্ষেত্রে হুক কৃতিত্ব দাবী করেছিলেন। এছাড়াও আরো নানা কারণে হুক ও নিউটনের মধ্যে বিবাদ বেঁধেছিল।  হুককে আমরা এতদিন দেখেছি নিউটনের চোখে, যিনি নিজের কৃতিত্বের কোনো ভাগীদারকে সহ্য করতে পারতেন না। ক্যালকুলাস আবিষ্কার নিয়ে লিবনিৎজের সঙ্গে তাঁর বিতণ্ডার ইতিহাস অনেকেরই জানা। আধুনিক যুগ হুকের পুনর্মূল্যায়ন করছে। সংকলনের শেষ লেখাতে এসেছেন নিউটনের গুণমুগ্ধ এক বিজ্ঞানী এডমন্ড  হ্যালির বহুমুখী কৃতিত্ব নিউটনের আলোতে ঢাকা পরে গেছে, আমরা শুধু মনে রেখেছি তাঁর নামাঙ্কিত ধূমকেতুটিকে। লেখক হ্যালিকে নতুন করে চিনিয়েছেন।
       পরিশেষে কয়েকটা ভিন্নমতও প্রকাশ করি। আইনস্টাইন যখন রবীন্দ্রনাথকে বোসের খবর জিজ্ঞাসা করেছিলেন, রবীন্দ্রনাথের মনে আড়াই দশকেরও বেশি সময় পদার্থবিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পর্কহীন জগদীশচন্দ্রের নাম আসেনিতিনি ভেবেছিলেন দেবেন্দ্রমোহন বোসের কথা, যিনি গোটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়টা জার্মানিতে কাটিয়েছেনডিরাক সত্যেন্দ্রনাথকে নোবেল পুরস্কার পাইয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, এই কাহিনিতে বিশ্বাস করা শক্তডিরাকের মনোবৃত্তি ছিল একেবারেই ভিন্নরকমতিনি যদি বিশ্বাস করতেন সত্যেন্দ্রনাথকে নোবেল দেওয়া উচিত, তাহলে মনোনয়নের জন্য তিনি অন্যের মতামতের অপেক্ষা করতেন না
       আইনস্টাইনের নোবেল পুরস্কার সংক্রান্ত প্রবন্ধে লেখক বলেছেন আপেক্ষিকতাবাদ কেনা দিয়ে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যাকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা যেনইচ্ছা না থাকলেও দিতে হয় তাই দেওয়াএকথার সঙ্গে একেবারেই একমত হওয়া গেল নাআপেক্ষিকতাবাদের জন্য আইনস্টাইন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিখ্যাত, কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটানোর ক্ষেত্রে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যা তাঁর অন্য কোনো কাজের থেকে কোনোমতেই পিছিয়ে থাকবে না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ব্যাখ্যা করার জন্য আমাদের অবশ্য প্রয়োজন কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতার জন্মের পিছনে আছে চারটি মৌলিক আবিষ্কার: প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আইনস্টাইনের আলোকতড়িৎ তত্ত্ব, নিলস বোরের পরমাণুর মডেল এবং সত্যেন্দ্রনাথ বোসের প্ল্যাঙ্কের সূত্রের ব্যাখ্যা। প্ল্যাঙ্ক সহ কোনো বিজ্ঞানীই সেই সময় কোয়ান্টাম তত্ত্বের গুরুত্ব বুঝতে পারেন নি। আইনস্টাইনই প্রথম তা উপলব্ধি করে তাকে আলোকতড়িৎ ক্রিয়ার ব্যাখ্যাতে ব্যবহার করেছিলেন। আইনস্টাইন নিজে অবশ্য কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে শেষ কথা মনে করতেন না, কিন্তু সে স্বতন্ত্র প্রশ্ন।
       প্রবন্ধগুলি সহজ ভাষায় লেখা, প্রায় সবকটিই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল। সংকলনের সময় বিষয় নির্বাচনে মুনশিয়ানা লক্ষণীয়, দুই শতাব্দীর দুই সেরা বিজ্ঞানীর যুগ তরুণ লেখকের কলমে উঠে এসেছে। পাঠক অনেক নতুন তথ্য খুঁজে পাবেন, আবার অনেক পুরানো কথাও নতুন আলোতে এসেছে। বইয়ের ছাপা সুন্দর, সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা বইটি প্রকাশ করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন
                                                            
এবং আইনস্টাইন
লেখক অর্পণ পাল
সৃষ্টিসুখ প্রকাশনা
মূল্য: ১৩৯ টাকা

(প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, নভেম্বর ২০১৯)

Saturday 30 November 2019

চন্দ্রযান -২ঃ সাফল্য ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে বিজ্ঞান গবেষণা




চন্দ্রযান -২ঃ সাফল্য ও ব্যর্থতাকে অতিক্রম করে বিজ্ঞান গবেষণা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       এই পত্রিকার আগস্ট সংখ্যায় চন্দ্রযান-২ এর উৎক্ষেপণের খবর দেওয়া হয়েছিল। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছেন যে বিক্রম ল্যান্ডারকে সফ্‌ট ল্যান্ডিং (পুরানো এক লেখায় পড়েছিলাম পালকের মতো অবতরণ) শেষ পর্যন্ত করানো সম্ভব হয়নি।সেপ্টেম্বর মাসের ৬ তারিখে পূর্বনির্ধারিত সূচী অনুযায়ী বিক্রমকে চন্দ্রযান থেকে বিচ্ছিন্ন করাতে বিজ্ঞানীরা সফল হয়েছিলেন, কিন্তু সে যখন চন্দ্রপৃষ্ঠের দু’কিলোমিটার উপরে তখন রকেটের নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা দেয়। তিনশো তিরিশ মিটার উচ্চতায় বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সেই সময় তার নামার বেগ ছিল সেকেন্ডে ৫৮ মিটার, যা নিরাপদ মাত্রার উপরে। বিক্রম সম্ভবত চন্দ্রপৃষ্ঠে ৫০ মিটার প্রতি সেকেন্ড বেগ নিয়ে নেমেছিল, যা অনেকটাই বেশি। এই হার্ড ল্যান্ডিঙের পর বিক্রমের চিহ্ন অবলোহিত ক্যামেরাতেখুঁজে পাওয়া গেলেও তার সঙ্গে আর যোগাযোগ স্থাপন করা যায় নি। মূল চন্দ্রযান অবশ্য চাঁদের চারপাশে আবর্তন করছে এবং তথ্য পাঠাচ্ছে।
       এই অভিযানকে নিয়ে নানা পরস্পরবিরোধী খবর পাওয়া যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে উৎক্ষেপণের দিন ছিল ১৪ জুলাই, কিছু ত্রুটি ধরা পড়ার জন্য তা শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে করা হয় ২২ জুলাই। উৎক্ষেপণ আটদিন পিছিয়ে গেলেও অবতরণের দিন পালটানো হয় নি। সমালোচনা হয়েছে যে নতুন কেন্দ্রীয় সরকারের একশোতম দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যেই অবতরণের দিন অপরিবর্তিত রাখার জন্য সরকারের থেকে হয়তো চাপ এসেছিল। ভারত এই প্রথম সফ্‌ট ল্যান্ডিঙের চেষ্টা করেছিল। এর আগে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন চাঁদের বুকে মহাকাশযান নামাতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র কয়েকমাস আগে ইজরায়েলের অবতরণ যান চাঁদে নামার সময় দুর্ঘটনাতে পড়েছিল। বিষয়টা মোটেই সহজ নয়, নানা সমস্যা আছে। যেমন চাঁদের খুব কাছে যখন ব্রেক করার জন্য ল্যান্ডিং রকেট চালানো হবে, তখন চাঁদের থেকে ক্ষুদ্র ধূলিকণা ছিটকে এসে রকেটের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে, সেই কথা মাথায় রেখে রকেট ডিজাইন করতে হয়। এ ধরনের নানা সমস্যার জন্য অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই কাজে এলো না। ভন্দ্রযান-২ অবশ্য কক্ষপথ থেকে ভচাঁদ সম্পর্কে তথ্য অনুসন্ধানের কাজ করে চলেছে, তার সময়কাল বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
       এই অভিযান নিয়ে এক অদ্ভুত উন্মাদনা দেশে সৃষ্টি করা হয়েছিল, যা অনেক বিজ্ঞানীই পছন্দ করেননি। রেটিং বানানোর জন্য গণমাধ্যম এ ধরনের কাজ করেই থাকে, কিন্তু এবারে সরকারি স্তরেও তাতে মদত ছিল।  অবতরণের লাইভ টেলিকাস্ট খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু সেই সময় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়।অবতরণের ঘটনার সাক্ষী হওয়ার জন্য আগে থেকে বাছাই করে কিছু ছাত্রছাত্রীকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। অনেকেই ঐতিহাসিক ঘটনা চোখে দেখবেন বলে টেলিভিশনের সামনে রাত জেগে বসেছিলেন।এই সমস্ত ঘটনা বিজ্ঞানীদের উপরে চাপ সৃষ্টি করে।
       চন্দ্রযান-১ বা মঙ্গলযানের সাফল্য যেমন এসেছে, তেমনি কোনো কোনো অভিযানে ব্যর্থতা আসবে সেটাই স্বাভাবিক। আমাদের ভারতীয়দের একটা সমস্যা হল যে আমরা সাদা এবং কালোর বাইরে যে ধূসর এলাকা রয়েছে, তা সাধারণত মনে রাখতে পারি না। বিরাট কোহলি দুই তিন ইনিংসে রান না পেলেই তার সমালোচনাতে মুখর হই। এক্ষেত্রেও ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার সমালোচনা হয়েছিল, কিন্তু মহাকাশ গবেষণা সংস্থার কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন তার থেকে বেশি এসেছে। সেই কথাটা ভালো, কিন্তু সম্ভবত অবিমিশ্র ভালো নয়। সংস্থার প্রধান সাংবাদিক সম্মেলনে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন অভিযান ৯৫ শতাংশ সফল। পরে ৯৮ শতাংশ সাফল্যের কথাও শোনা গেছে। এ ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনে বাধ্য হওয়াটা নিজেদেরভুলত্রুটি খুঁজে বার করাতে বাধা সৃষ্টি করে।
       বিজ্ঞান এগোয় সমালোচনা ও আত্মসমালোচনার মধ্যে  দিয়ে।  কিন্তু সমালোচনা ঐ বিশেষ ক্ষেত্রের  বিশেষজ্ঞদের থেকে আসতে হবে। স্টুডিওতে বসে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞও তা নিয়ে মতামত দেবেন, বিজ্ঞান গবেষণা ঠিক ততটা সহজ নয়। বিজ্ঞানপ্রযুক্তিতে সাফল্যের পাশাপাশি ব্যর্থতাও স্বাভাবিক, শুধু তাই নয় ব্যর্থতার ভূমিকাও ভবিষ্যতের সাফল্যের পিছনে কম নয়। Failures are the pillars of success, এই প্রাচীন প্রবাদটা বিজ্ঞান প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রে যতটা প্রযোজ্য, অন্য কোনো ক্ষেত্রে তত নয়। মনে রাখতে হবে যে কোনো কিছু প্রথমবারের জন্য করতে গেলে পা রাখতে হবে এমন এলাকায় যেখানে আগে কারোর পদচিহ্ন পড়েনি। ভুল পথে যাওয়াটা সেখানে স্বাভাবিক, তার মধ্যে দিয়েই এগোতে হবে। তা না হলে বুঝতে হবে যে নতুন কিছু নয়, পুরোনো পথেই চলেছে বিজ্ঞান। কিন্তু বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালের সঙ্গে যদি চন্দ্রযানের অবতরণকে একই আসনে বসানো হয়, তাতে বিজ্ঞানীদের উপরে চাপ আসতে বাধ্য। বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের শরীরি ভাষা সেই ইঙ্গিতই দিয়েছিল। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থারঅতীত ইতিহাস দেখায় যে ভবিষ্যতে সাফল্য আসবেই,  প্রয়োজন সরকার ও দেশবাসীর সমর্থন।  একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক লাভের জন্য  বিজ্ঞান গবেষণাকে ব্যবহার শেষ পর্যন্ত সুফল নাও দিতে পারে।
নাসার ক্যামেরাতে তোলা বিক্রমের অবতরণস্থলের চিত্র 



চাঁদের কথা


চাঁদের কথা
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       আকাশে সূর্যের পরেই সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হল চাঁদ, তাকে নিয়ে মানুষের কৌতূহল চিরদিনেরচাঁদকে নিয়ে দেশবিদেশের পু্রাণে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। মহাভারতের গল্পে কুরুপাণ্ডবদের সবার চন্দ্রবংশে জন্ম, অর্থাৎ তারা চাঁদের বংশধর। অন্য এক গল্পে আবার চাঁদের জন্ম হয়েছিল সমুদ্রমন্থনে, শিব তাকে নিজের জটায় বসিয়ে নিয়েছিলেন। পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল এরোনটিক্স এন্ড স্পেস অ্যাশমিনিস্ট্রেশন বা নাসার মহাকাশযান অ্যাপোলো-১১-এর মহাকাশচারীরা চাঁদে পা দিয়েছিলেন। গ্রহ-উপগ্রহ মিলিয়ে পৃথিবীর বাইরে একমাত্র যেখানে মানুষের পা পড়েছে তা হল চাঁদ।

চাঁদের বুকে নিল আর্মস্ট্রং (চিত্রঃ নাসা)
       আমাদের সৌরজগতে চাঁদ সবচেয়ে বড় উপগ্রহ নয়। গ্রহরাজ বৃহস্পতির উপগ্রহ গ্যানিমিড, আইয়ো ও ক্যালিস্টো বা শনির উপগ্রহ টাইটান চাঁদের থেকে আয়তনে বড়। কিন্তু এক দিক থেকে চাঁদ সৌরজগতে প্রথম স্থান দখল করে আছে। চাঁদ আয়তনে পৃথিবীর পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগ। এটা অন্য যে কোন গ্রহ-উপগ্রহ জোড়ার থেকে বেশি। এর পরেই আছে নেপচুনের উপগ্রহ ট্রাইটন, সে হল নেপচুনের ছ’হাজার ভাগের একভাগেরও কম। প্লুটোর উপগ্রহ চ্যারন অবশ্য এই হিসেবে অনেক বড় কিন্তু প্লুটোকে এখন আর গ্রহ বলা হয় না, কাজেই চ্যারনকে হিসাবের মধ্যে রাখা যায় না। চাঁদ আয়তনে প্লুটোর তিনগুণের থেকেও বেশি বড়। চাঁদের আকর্ষণ তার বায়ুমণ্ডলকে ধরে রাখতে পারে নি, তাই চাঁদ বায়ুশূন্য।
       প্রাচীন কাল থেকেই জানা ছিল চাঁদের আলো নেই, সূর্যের আলো প্রতিফলন করেই তার আলো। কারণটা খুব সোজা, চাঁদের কলা। চাঁদের যদি আলো থাকত, তাহলে সবসময়ই তাকে গোল দেখতাম, সূর্যকে যেমন দেখি। সূর্যের আলো চাঁদের অর্ধেকটাকে আলোকিত করে, বলা যাক সেই অংশে চাঁদের দিন। আমরা যখন চাঁদের দিকে তাকাই, তখন শুধু আলোকিত অংশটা দেখতে পাই। যতটা আলোকিত অংশ আমাদের দিকে মুখ করে আছে সেই অনুযায়ী চাঁদ আমাদের কাছে কখনো একফালি, কখনো অর্ধেক, পূর্ণিমাতে পূর্ণচন্দ্র।  অমাবস্যাতে তাকে দেখা যায় না, তখন আলোকিত অংশটা আমাদের পৃথিবীর উল্টোদিকে। একেই বলে চাঁদের কলা। সঙ্গের ছবিটাতে বিষয়টা আরো পরিষ্কার হবে। পৃথিবীর পাশের ছোট বৃত্তটা হল চাঁদের কক্ষপথ, সেখানেও বিভিন্ন অবস্থানে চাঁদের কোন অংশ আলোকিত তা দেখা যাচ্ছে। আর বড় বড় বৃত্ত দিয়ে বোঝানো হয়েছে পৃথিবী থেকে চাঁদকে কেমন দেখতে লাগে

চাঁদের কলা
       চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণ কেন হয় আমরা জানি। পৃথিবীর ছায়া যখন চাঁদের উপর পড়ে তখন চন্দ্রগ্রহণ, উপরের ছবিটা থেকে বোঝা যাচ্ছে সেটা পূর্ণিমার দিনই সম্ভব। ঠিক তেমনি অমাবস্যার সময় পৃথিবী আর সূর্যের ঠিক মাঝখানে যদি চাঁদ এসে পড়ে, তখন সূর্যগ্রহণ হয়। মানুষের বিজ্ঞানের ইতিহাসে চন্দ্রগ্রহণ ও সূর্যগ্রহণের আলাদা গুরুত্ব আছে । প্রাচীন যুগের বিজ্ঞানীরা যখন বুঝলেন যে চন্দ্রগ্রহণের কারণ পৃথিবীর ছায়া, তখন চাঁদের বুকে সেই ছায়ার আকার দেখে তাঁরা নিশ্চিত হয়েছিলেন যে পৃথিবী গোলউপরের ছবিটা থেকে মনে হতে পারে তাহলে প্রতি অমাবস্যা পূর্ণিমাতে গ্রহণ হয় না কেন? আসলে চাঁদ যে তলে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে আর পৃথিবী যে তলে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, সে দুটো নিজেদের মধ্যে পাঁচ ডিগ্রি কোণ করে আছে। নিচের ছবিটাতে দেখতে পাচ্ছ যে সব অমাবস্যাতে চাঁদের ছায়া পৃথিবীতে পড়বে না, আবার সব পূর্ণিমাতে পৃথিবীর ছায়া চাঁদের উপর পড়বে না

বিভিন্ন পূর্ণিমা ও অমাবস্যাতে চাঁদ, পৃথিবী ও সূর্যের অবস্থান
       চাঁদের ব্যাসার্ধ হল মোটামুটি ১৭৪০ কিলোমিটার। পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের কক্ষপথটা ঠিক বৃত্তাকার নয়, উপবৃত্তাকার। সবচেয়ে কাছে যখন তখন পৃথিবী ও চাঁদের দূরত্ব মোটামুটি ৩,৬৪,০০০ কিলোমিটার, আবার সবচেয়ে বেশি দূরত্ব হল ৪,০৫,০০০ কিলোমিটারের কাছাকাছি। যখন খুব কাছে আসে, তখনকার পূর্ণিমাকে বলে সুপারমুন। চাঁদের গড় দূরত্বটা এমন যে পৃথিবী থেকে দেখলে সূর্য আর চাঁদ প্রায় একই কোণ করে থাকে। সেজন্য চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে দিয়ে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ ঘটাতে পারে। সূর্যের প্রচণ্ড ঔজ্জ্বল্যের জন্য তার দিকে তাকানো শক্ত, জ্যোতির্বিদদের যন্ত্রপাতিও আকাশে সূর্যের কাছাকাছি কম উজ্জ্বল জিনিস দেখতে পায় নাতাই সূর্যগ্রহণের সময়টাকে বিজ্ঞানীরা নানা ভাবে কাজে লাগান, তার দুটো তোমাদের বলি। সূর্য থেকে বাইরের দিকে উত্তপ্ত গ্যাস থামের আকার নিয়ে বেরিয়ে আসে, একে বলে সৌরশিখা  (solar prominence)এমনি সময় একে পর্যবেক্ষণ করা শক্ত। ১৮৬৮ সালের ৮ আগস্ট ভারত থেকে এক সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। সেই সময় এক ইংরেজ ও এক ফরাসি বিজ্ঞানী সূর্যের বাইরের সৌরশিখা পর্যবেক্ষণ করেছিলেন, তার থেকে শেষ পর্যন্ত এক নতুন মৌলের সন্ধান পাওয়া যায়। সেই মৌল হল প্রথম আবিষ্কৃত নিষ্ক্রিয় গ্যাস হিলিয়াম, তা পরে পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। আবার ১৯১৯ সালের ২৯ মে সূর্যগ্রহণের সময় ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন সূর্যের পাশ দিয়ে আসা নক্ষত্রের আলো সূর্যের জন্য কতটা বেঁকে যায় তা মেপেছিলেন। তার থেকেই বোঝা যায় যে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব মাধ্যাকর্ষণ ব্যাখ্যা করতে নিউটনের তত্ত্বের থেকে বেশি সফল। আধুনিক জ্যোতির্বিদ্যাতেও চাঁদ কাজে লেগেছে, কিন্তু সে কথা আজ থাক
       তোমরা সত্যজিৎ রায়ের গল্প ‘কম্পু’ নিশ্চয় পড়েছ। সেখানে প্রফেসর শঙ্কুকে একজন জাপানি বৌদ্ধ সন্ন্যাসী জিজ্ঞাসা করেছিলেন, গ্রহণের সময় চাঁদ যে সূর্যকে একদম ঠিকঠাক ঢেকে দিতে পারে, তার কারণ বিজ্ঞান বলতে পারবে? আগেই আমরা দেখলাম পৃথিবী থেকে চাঁদ আর সূর্যের কৌণিক মাপ প্রায় সমান। শঙ্কু উত্তর দিতে পারেনি নি। একশো কোটি বছর আগে বা পরে হলে সন্ন্যাসী কিন্তু এই প্রশ্নটা করতেন না। কেন জানো? আসলে চাঁদ পৃথিবীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই একশো কোটি বছর আগে চাঁদের কৌণিক মাপ আরো বেশি ছিল, পৃথিবী থেকে তাকে সূর্যের থেকে অনেক বেশি বড়ো লাগত। সহজেই তা সূর্যকে ঢেকে দিতে পারত। আবার একশ কোটি বছর পরে চাঁদের কৌণিক মাপ এত ছোট হয়ে যাবে যে সে সূর্যকে আর পুরোপুরি ঢাকতে পারবে না। এ জন্যও দায়ী চাঁদ, কিন্তু সে কথায় যাওয়ার আগে চাঁদের টানে কেমন করে জোয়ার ভাঁটা হয়, তা বুঝে নেয়া যাক। অনেক জায়গায় লেখা থাকে চাঁদের টানে পৃথিবীর জলরাশি ফুলে ওঠে, তাই জোয়ার হয়। আবার সেই জোয়ারের জন্য জল অন্য জায়গা থেকে চলে আসে, সেখানে তখন জল কমে গিয়ে ভাঁটা হয়। পৃথিবীর যে দিকটা  চাঁদের দিকে, সেদিকে জোয়ার কেন হয় বোঝা গেল, কিন্তু পরিষ্কারভাবে বোঝা গেলনা যে যেদিকটা চাঁদের উল্টোদিকে, সেখানেও জোয়ার হয় কেন।
       তোমরা জানো নিউটনের সূত্র অনুযায়ী পৃথিবী চাঁদকে যে বলে আকর্ষণ করে, চাঁদও পৃথিবীকে সমান বলে আকর্ষণ করে। তাহলে চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, পৃথিবী চাঁদের চারদিকে নয় কেন? কারণ পৃথিবী চাঁদের থেকে আশি গুণেরও বেশি ভারী, তাই একই বল দুজনের উপরে কাজ করলেও চাঁদের গতিকে সে আশি গুণ বেশি পরিবর্তন করে। বিজ্ঞানের ভাষায় চাঁদের ত্বরণ আশি গুণ বেশি। খুব ঠিকঠাক বললে চাঁদ ও পৃথিবীর একটা ভরকেন্দ্র আছে, দুজনেই তার চারদিকে পাক খায়। কিন্তু ভরকেন্দ্রটা হল পৃথিবীর মধ্যে, তাই পৃথিবীর আবর্তন সহজে বোঝা যায় না। সঙ্গের ছবিটা দেখ। এখানে CM (Centre of Mass) বিন্দুটা হল ভরকেন্দ্র, চাঁদ আর পৃথিবী দুজনেই ঐ ভরকেন্দ্রকে ঘিরে পাক খাচ্ছে।
পৃথিবী ও চাঁদের আবর্তন
       সে না হয় হল, কিন্তু তার সঙ্গে জোয়ার ভাঁটার সম্পর্ক কি? একটা কথা মনে রেখ, এই আকর্ষণ বলের জন্য চাঁদ পৃথিবীর দিকে সরে সরে যাচ্ছে, ঠিক তেমনি পৃথিবী চাঁদের দিকে সরে যাচ্ছে। তাহলে একজন অন্যজনের উপর পড়ে যাচ্ছে না কেন? কারণ তাদের আর একটা গতি আছে। চাঁদ আর পৃথিবীর কেন্দ্র দুটোকে জুড়ে একটা সরলরেখা কল্পনা কর, আকর্ষণ বল ঐ রেখা বরাবর কাজ করে।  চাঁদ ও পৃথিবী ঐ রেখা বরাবর পরস্পরের দিকে সরে যায়। কিন্তু অন্য গতিটা ঠিক ওই রেখার সঙ্গে লম্বভাবে কাজ করে। এই দুই গতির মোট ফলটা হয় যে দুজনেই তাদের সাধারণ ভরকেন্দ্রের চারদিকে ঘুরতে থাকে।
       পৃথিবী চাঁদের দিকে সরে যাচ্ছে বললাম বটে, কিন্তু এখানে একটা কথা বলা হয়নি। আমরা জানি দুটো বস্তুর মধ্যে মাধ্যাকর্ষণ বল দূরত্বের বর্গের ব্যাস্তানুপাতে পাল্টায়। সহজ কথায় দূরে গেলে আকর্ষণ বল কমে যায়। তাহলে পৃথিবীর উপর চাঁদের আকর্ষণ বল সব জায়গায় নিশ্চয় সমান নয়। যেদিকটা চাঁদের বেশি কাছে তার উপর আকর্ষণ বেশি, পৃথিবীর কেন্দ্রের উপর তার থেকে কম, আবার যেদিকটা চাঁদের থেকে দূরে তার উপর আকর্ষণ আরো কম। কিন্তু পৃথিবী মাটি পাথর মিলিয়ে একটা কঠিন বস্তু, তাই তার কেন্দ্র যতটা সরবে, দুপাশের মহাদেশ ও সমুদ্রের তলাটাও প্রায় ততখানি সরবে। অন্যদিকে মহাসমুদ্রের জল তরল, তা পৃথিবীর কেন্দ্রের সঙ্গে অত শক্তভাবে বাঁধা নেই। তাই চাঁদের দিকের জল সেদিকের সমুদ্রের তল বা মহাদেশের থেকে বেশি সরে যায়, ফলে সমুদ্রতল ফুলে ওঠে। এবার ভাব বিপরীত দিকের কথা। সেখানে চাঁদের আকর্ষণ কম, তাই মহাসমুদ্রের জল কম সরবে। কিন্তু সমুদ্রের তলা ও মহাদেশ চাঁদের দিকে বেশি সরবে, কারণ তা পৃথিবীর কেন্দ্রের সঙ্গে শক্তভাবে যুক্ত। ফলে আমরা দেখব সেখানেও জল ফুলে উঠছেএই হল চাঁদের উল্টো দিকের জোয়ারের কারণ। পাশের  ছবিটা দেখ, এখানে পৃথিবীর কঠিন অংশ আর সমুদ্রের জল কতটা করে সরবে দেখানো হয়েছে। তীর চিহ্নটা যত বড়, সরণ তত বেশি। দেখতে পাচ্ছ, সমুদ্রের জল কেমন করে ফুলে উঠছে। বোঝার সুবিধার জন্য অনেক বাড়িয়ে দেখিয়েছি।
চাঁদের টানে জোয়ার ভাঁটা
       এবার আসা যাক চাঁদ কেন পৃথিবীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেই কথায়। পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য আস্তে আস্তে বাড়ছে, তার জন্যও দায়ী চাঁদের টানে জোয়ার ভাঁটাপৃথিবী নিজের চারদিকে তেইশ ঘণ্টা ছাপ্পান্ন মিনিটে একবার পাক খায়, একে বলে নাক্ষত্র দিনচাঁদ পৃথিবীর চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় সাতাশ দিন সাত ঘণ্টার মতো। এটা কিন্তু দুটো পূর্ণিমা বা দুটো অমাবস্যার মধ্যের পার্থক্য নয়, সেটা সাড়ে উনত্রিশ দিন। এ হল চাঁদের নাক্ষত্র মাসদেখা যাচ্ছে চাঁদ অনেক আস্তে ঘোরে, জলরাশি এগিয়ে যেতে চায়, চাঁদ তাকে পিছন থেকে টেনে ধরে। এই টেনে ধরার ফলে পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারপাশে ঘূর্ণন বেগ কমে যাচ্ছে আর দিন লম্বা হচ্ছেযেমন একশো কোটি বছর আগে পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য ছিল আঠারো ঘণ্টার মতো। কুড়ি কোটি বছরে পরে তা বেড়ে হবে পঁচিশ ঘণ্টা।
       যারা উঁচু ক্লাসে পড়, তারা জানো ঘূর্ণনের জন্য কৌণিক ভরবেগ বলে একটা রাশি আছে। নিউটনের সূত্রে ভরবেগের কথা আছে, ভরকে বেগ দিয়ে গুণ করলে তাকে পাওয়া যায়। বাইরে থেকে বল না দিলে ভরবেগের মান পাল্টায় না। কৌণিক ভরবেগ অনেকটা ওই ভরবেগেরই মতো, খালি সরলরেখায় গতির জন্য নয়, বৃত্তাকার পথে গতির জন্য তাকে আমরা ব্যবহার করি। বাইরে থেকে তাকে জোর করে না পালটালে তার মানও একই থাকে। যেমন, চাঁদের ভরবেগকে তার কক্ষপথের ব্যাসার্ধ দিয়ে গুণ করলে তার আবর্তনের কৌণিক ভরবেগ পাওয়া যায়। এখানে তিনটি কৌণিক ভরবেগ আছে, পৃথিবীর নিজের চারদিকে ঘূর্ণনের জন্য, চাঁদের নিজের চারদিকে ঘূর্ণনের জন্য এবং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের জন্য। পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ কমে যাচ্ছে অর্থাৎ তার কৌণিক ভরবেগ কমে যাচ্ছে। মোট কৌণিক ভরবেগের মান পালটায় না, সুতরাং পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের আবর্তনের  জন্য যে কৌণিক ভরবেগ আছে, তার মান বেড়ে যাচ্ছে। চাঁদের আবর্তনের জন্য কৌণিক ভরবেগ চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্বের বর্গের অনুপাতে বাড়ে। তাই কৌণিক ভরবেগ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চাঁদ পৃথিবীর থেকে দূরে চলে যাচ্ছে।
চাঁদের আকাশে পৃথিবী (চিত্রঃ নাসা)
       তোমরা হয়তো বলবে, তৃতীয়টা অর্থাৎ চাঁদের কৌণিক ভরবেগটা বাড়ছে না কেন? বাড়ছে না কারণ চাঁদের কৌণিক ভরবেগ বাড়ার সুযোগ নেই। চাঁদের একটা পাশই আমরা দেখতে পাই, অন্যদিকটা আমাদের দিকে কখনোই আসে না। আবার পৃথিবী থেকে আমরা চাঁদকে আকাশে পূর্বদিকে উঠতে ও পশ্চিমদিকে ডুবতে দেখি, কিন্তু চাঁদের আকাশে পৃথিবী এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকে। কেন জানো? চাঁদ পৃথিবীকে আবর্তন করতে যতটা সময় নেয়, নিজের চারদিকে পাক খেতেও ঠিক একই সময় নেয়। ভাবো তো পৃথিবীর জোয়ার ভাঁটার কথা। পৃথিবীর ঘূর্ণন বেগ কমতে কমতে চাঁদের আবর্তনকালের সঙ্গে সমান হয়ে যাবে, তখন আর ওই ফুলে ওঠা অংশ চাঁদের সাপেক্ষে এগিয়ে যাবে না। এর পর আর পৃথিবীর বেগের পরিবর্তন হবে না। চাঁদ পৃথিবীর থেকে অনেক ছোট, তাই পৃথিবীর টানে চাঁদের ক্ষেত্রে সেটা আগে ঘটেছে। সে জন্যই চাঁদের নিজের অক্ষের চারদিকে ঘূর্ণন কাল আর পৃথিবীর চারদিকে আবর্তন কাল সমান। তার আর পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়।  সৌরজগতের প্রায় সমস্ত বড় উপগ্রহই এইরকম ভাবে গ্রহের দিকে একটা মুখ ফিরিয়ে রাখে। প্লুটো আর চ্যারনের ভর অনেক কাছাকাছি, তাই চ্যারন যেমন প্লুটোর দিকে একটা মুখ ফিরিয়ে থাকে, প্লুটোও তাই। সেজন্য চ্যারনের আকাশে প্লুটো যেমন দাঁড়িয়ে থাকে, প্লুটোর আকাশেও চ্যারন তেমনি স্থির। পাঁচ হাজার কোটি বছর পরে পৃথিবী আর চাঁদেরও ওই অবস্থা হওয়ার কথা, অবশ্য যদি অতদিন তাদের অস্তিত্ব আদৌ থাকে।
       প্রশ্ন করতেই পারো, চাঁদে তো সমুদ্র নেই, তাহলে জোয়ার ভাঁটার কথা কেন? পৃথিবীর কেন্দ্রে যে তরল ম্যাগমা আছে, তারও জোয়ার ভাঁটা হয়। চাঁদের কেন্দ্রও একসময় তরল ছিল, তার জোয়ার ভাঁটা হত। তার জন্য চাঁদের ঘূর্ণন ক্রমশ কমেছে। এখনো পৃথিবীর টানে চাঁদের দুই প্রান্ত ফুলে ওঠে, যদিও তার পরিমাণ কম। এই ফুলে ওঠাটাও আবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জায়গা পরিবর্তন করে, তার ফলে একই ধরনের ফল হয়। 
       চাঁদ না থাকলে কী হত? জ্যোতিষীকে জিজ্ঞাসা করলে সে তোমার জীবনকে চন্দ্র কেমনভাবে প্রভাবিত করে তা বোঝাতে শুরু করবে। তার বাজে কথা শোনার দরকার নেই, কিন্তু চাঁদ কি পৃথিবীতে জীবনকে কোনোভাবে প্রভাবিত করেছে? আমরা জানি পৃথিবী কক্ষপথের সঙ্গে সাড়ে তেইশ ডিগ্রি কোণ করে আছে, সেজন্য ঋতু পরিবর্তন হয়। এই কোণটা কয়েক হাজার বছরে এক ডিগ্রি মতো বাড়ে কমে। অঙ্ক কষে দেখা যায় চাঁদ না থাকলে এই বাড়া কমাটা অনেক বেশি হতো, কোণটা বেড়ে পঁচাশি ডিগ্রি পর্যন্ত হতো। সূর্য তাহলে কখনো মেরুর প্রায় উপরে, আবার লক্ষ বছর পরে হয়তো নিরক্ষরেখার উপরে লম্বভাবে কিরণ দিতলক্ষ বছর বেশি মনে হয়ে পারে, কিন্তু জীবের বিবর্তনের পক্ষে তা সামান্য সময়। পৃথিবীর জীবজগত হয়তো সম্পূর্ণ অন্যরকম হতো
       চাঁদের জন্ম কিভাবে বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন। অ্যাপোলো অভিযানগুলো প্রায় চারশো কিলোগ্রাম চাঁদের পাথর পৃথিবীতে নিয়ে এসেছে। সোভিয়েত মহাকাশ অভিযানও অল্প পাথর এনেছে। তাছাড়া কিছু কিছু উল্কাপাথর পাওয়া গেছে যারা চাঁদ থেকে এসেছে। এই সব পাথর থেকে দেখা গেছে চাঁদের বয়স মোটামুটি সাড়ে চারশো কোটি বছর। পৃথিবী তার থেকে সামান্য বড়। কিভাবে এই বয়স বার করা হয়েছে সে কথা বলতে গেলে এই লেখা আর শেষ হবে না, পরে কোনোদিন সেই আলোচনা করা যাবে। চাঁদের জন্ম সম্পর্কে মোটামুটি চার রকম মত আছে। একটা একটা করে সেগুলো দেখা যাক। তার সঙ্গে তাদের সমস্যাগুলোও জেনে রাখি।
       একটা মত হল পৃথিবী আর চাঁদ একই সঙ্গে জন্মেছে। তা হলে চাঁদের জন্ম সম্পর্কে জানতে গেলে আমাদের সৌরজগতের জন্ম কেমনভাবে হল জানতে হবে। ছায়াপথে অনেক মহাজাগতিক মেঘ আছে, তাদের ভর সূর্যের অনেক গুণ। তাদের থেকেই আমাদের সৌরজগতের জন্ম বলে সবাই মেনে নিয়েছেন। খুব সহজ কথায় বললে একটা বড় মহাজাগতিক মেঘ নিজের মাধ্যাকর্ষণের টানে ছোট ছোট হতে হতে সৌরজগতের জন্ম দিয়েছে। কেন্দ্রটা হয়েছে সূর্য, আর তার বাইরের দিকের টুকরোগুলো হয়েছে গ্রহ। পৃথিবী আর চাঁদ একই সঙ্গে জন্ম নিয়েছে ঐ মহাজাগতিক মেঘের সংকোচনের ফলে। কিন্তু এই মত পৃথিবী ও চাঁদের উপাদানের পার্থক্য ব্যাখ্যা করতে পারে না। পৃথিবীর মোট ভরের তিরিশ শতাংশ হল লোহা, চাঁদের ক্ষেত্রে সেটা দশ শতাংশের কমদুটো কাছাকাছি মেঘের টুকরোর মধ্যে এত তফাত কেন হবে?
       দ্বিতীয় মত হল যে চাঁদ ছিল আদি-পৃথিবীর মধ্যে। সে অনেক জোরে ঘুরত, তার ফলে দু টুকরো হয়ে চাঁদ ও এখনকার পৃথিবীর জন্ম। কিন্তু টুকরো হতে গেল ঘূর্ণন বেগ খুব বেশি হতে হবে, তার মানে মোট কৌণিক ভরবেগও হবে বেশি। পৃথিবী ও চাঁদের ঘূর্ণন ও আবর্তন মিলিয়ে এখন যে মোট কৌণিক ভরবেগ, তা খুবই কম, তার পক্ষে আদি-পৃথিবীকে টুকরো করা সম্ভব নয়। মনে রেখো কৌণিক ভরবেগ বাইরে থেকে জোর না দিলে পরিবর্তন হয় না।
       তৃতীয় মতটা হল চাঁদ আগে ছিল একটা ছোট গ্রহ, পৃথিবীর পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় পৃথিবীর অভিকর্ষে বাঁধা পড়ে গেছে। এই মতের দুটো সমস্যা আছে। কোনো মৌলের পরমাণুর বিভিন্ন ভর হয়, তাদের বলে আইসোটোপ। চাঁদের পাথরের আইসোটোপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে তা সৌরজগতের অন্য সদস্যদের সঙ্গে মেলে না, কিন্তু পৃথিবীর সঙ্গে একদম মিলে যায়। কাজেই চাঁদ ও পৃথিবী আলাদা জায়গায় তৈরি হওয়ার কথা ভাবা শক্ত। দ্বিতীয়ত তাহলে চাঁদের কক্ষপথ এত বৃত্তাকার না হয়ে অনেক লম্বাটে হত।
       যে মতটা এখন সবচেয়ে বেশি বিজ্ঞানী সমর্থন করেন, তা হল মহাসংঘাত (Giant impact) প্রকল্প। এতে মনে করা হয় সৌরজগৎ সৃষ্টির পরে পরে মঙ্গলের মতো বড় একটা গ্রহ আদি-পৃথিবীকে ধাক্কা মেরেছিল, তার ফলে অনেক ছোট ছোট টুকরো ছিটকে বেরিয়ে যায়, সেগুলো জমাট বেঁধে চাঁদের জন্ম। পৃথিবীর বাইরের দিকের অংশে লোহার পরিমাণ কম, কেন্দ্রে বেশি; কেন্দ্র থেকে বেশি অংশ বেরোয়নি বলে চাঁদে লোহার পরিমাণ কম। চাঁদ ও পৃথিবীর পাথরের আইসোটোপ একরকম কেন, তা ব্যাখ্যার জন্য এই তত্ত্বকে অনেকটা পরিবর্তন করতে হয়েছে। এখনও কিছু সমস্যা আছে, তবু মনে হচ্ছে যে এই তত্ত্বই শেষ পর্যন্ত চাঁদের জন্মকে বোঝাতে পারবে।
       আমাদের সভ্যতায় চাঁদের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে, কারণ প্রথম ক্যালেন্ডার বানাতে চাঁদ সাহায্য করেছিল। দিনের হিসাব রাখা সোজা, সূর্য উঠলেই নতুন দিন, কিন্তু প্রাচীনকালে মাস বা বছর হিসাব করা সহজ ছিল না। এক বছরে মোটামুটি বারোটা পূর্ণিমা-অমাবস্যা হয়। সে জন্য প্রাচীনকালে সব সভ্যতাই বছরে বারো মাস ধরে হিসেব করত। তিথি নক্ষত্রের হিসাব হয় চাঁদের কলাকে ধরে, যেমন সরস্বতী পুজো হয় মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে। হিজরি মাস শুরু হয় শুক্লা প্রতিপদ মানে অমাবস্যার পরের দিন থেকেহিজরি বছর হল চান্দ্র বছর, এক বছরে ঠিক বারোটা অমাবস্যা বারোটা পূর্ণিমাই থাকে। এক হিজরি বছরে তাই ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিন। প্রাচীন জ্যোতির্বিদরা সৌর জগতের মডেল বানানোর সময় পূর্ণিমা অমাবস্যা ও গ্রহণের দিন, রাতের আকাশে চাঁদের অবস্থান, এ সমস্ত বার করার চেষ্টা করতেন। তবে তাঁদের মডেলের কেন্দ্রে সূর্য ছিল না, ছিল পৃথিবী, তাই সেগুলো অনাবশ্যক জটিল হয়ে পড়েছিল। আকাশে চাঁদের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ কোথায় আছে বার করা হত। এই সব নিয়ে পরে কোনোদিন আলোচনা করা যাবে।
        অনেক পুরানো কথা হল, এবার একটু ভবিষ্যতের কথা বলি। চাঁদে মানুষ নেমেছে পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, আমরা কবে চাঁদে থাকতে পারব? কেমন করে চাঁদে বাস করা সম্ভব অল্প কথায় দেখা যাক। প্রথমত, চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, তাই মহাজাগতিক রশ্মি আর সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে আটকানোর কেউ নেই চাঁদের দিন আর রাত দুটোই পৃথিবীর প্রায় পনের দিনের । বায়ুমণ্ডল না থাকার ফলে দিনের তাপমাত্রা উঠে যায় ১১০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে আর রাতের তাপমাত্রা নেমে যায় -১৭০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডেছায়াতে আর রোদে তাপমাত্রার পার্থক্যও হয় বিরাট। এ সবের থেকে বাঁচতে হলে বাস করতে হবে মাটির তলায়। চাঁদে অনেক বিরাট বিরাট লাভা নল আছে, তাদের সিল করে বায়ু ধরে রেখে তার ভিতরেই থাকা যায়শক্তির অভাব হবে না। অভিকর্ষ পৃথিবীর ছয় ভাগের এক ভাগ, তাই সহজেই বিশাল বিশাল সোলার প্যানেল বসানো সম্ভব। তার জন্য দরকারি সিলিকন চাঁদেই পাওয়া যাবে। ভারতবর্ষের চন্দ্রযান মিশন চাঁদে জল খুঁজে পেয়েছে। জলের তড়িদবিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পাওয়া যাবে। এমনকি কৃত্রিম আলো ব্যবহার করে গাছদের সালোক সংশ্লেষ করানো সম্ভব। আর অনেকরকম পরিকল্পনা করা যায়।
       আমাদের পৃথিবীতে অনেক সমস্যা, এত খরচ করে চাঁদে মানুষের বাসস্থান বানিয়ে লাভ কী? কয়েকটা লাভের কথা বলি। চাঁদের বিপরীত দিকে যদি দূরবিন বা রেডিও টেলিস্কোপ বসাতে পারি, তাহলে তা পৃথিবীর যে কোনো টেলিস্কোপের থেকে শক্তিশালী হবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অনেক তরঙ্গকে শোষণ করে নেয়, বায়ুতে প্রতিসরণের জন্য অসুবিধা হয়। তাছাড়া শহরের আলো, মোবাইল টিভি রেডিওর সিগন্যাল এগুলো না আটকাতে পারলে টেলিস্কোপের পক্ষে কাজ করা শক্ত। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, উল্টো দিকে পৃথিবী থেকে কোনো সিগন্যাল পৌঁছবে না। অভিকর্ষ কম বলে অনেক বড় টেলিস্কোপ  বানানো যাবে। চাঁদের বায়ুচাপ প্রায় শূন্য, পৃথিবীতে আমরা অনেক খরচ করে ঐরকম অত্যুচ্চ ভ্যাকুয়াম বা বায়ুশূন্য স্থান  বানাতে পারি। ইলেকট্রনিক্স শিল্পের মতো যে সমস্ত শিল্পে ভ্যাকুয়াম লাগে, সেগুলো সহজে চাঁদে স্থাপন করা সম্ভব। তোমরা সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডারের কথা জানো। ওইরকম কণাত্বরক বা অ্যাকসিলারেটর চাঁদে বানানো খুব সহজ, বায়ুশূন্য স্থান আলাদা করে বানাতে হবে না, সুপারকন্ডাক্টর তারকে ঠাণ্ডা করার ঝামেলা অনেক কম। তবে যে কারণে ভবিষ্যতে চাঁদে বসবাসের খরচা উঠে যেতে পারে তা হল হিলিয়ামের এক আইসোটোপ হিলিয়াম-৩ যা পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। সূর্যে নিউক্লিয় সংযোজন বা ফিউশন প্রক্রিয়াতে শক্তি তৈরি হয়। আমরা হাইড্রোজেন বোমাতে সেই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়েছি, কিন্তু এখনো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে উঠতে পারিনি। তা করতে পারলে অনেক সুবিধা হবে, গ্রিন হাউস গ্যাসের ব্যাপার নেই, তেজষ্ক্রিয়তার ভয় নেই। ফ্রান্সে এক আন্তর্জাতিক প্রয়াসে ফিউশন রিঅ্যাক্টর বানানো হচ্ছে, আমাদের দেশও তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। পৃথিবীতে হিলিয়াম-৩ পাওয়া গেলে রিঅ্যাক্টর বানানো অনেক সহজ হতোসূর্য থেকে হিলিয়াম-৩ সৌর বায়ুর সঙ্গে বেরিয়ে আসে, কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তাকে আটকে দেয়। চাঁদের মাটিতে কোটি কোটি বছর ধরে হিলিয়াম-৩ জমা পড়েছে, তাকে তুলে পৃথিবীতে পাঠাতে পারলে খরচ উঠে আসতে পারে। মানুষ শেষ চাঁদে নেমেছিল ১৯৭২ সালে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা আবার ২০২৪ সালে চাঁদে মানুষ পাঠাতে এবং ২০২৮ সাল থেকে চাঁদে স্থায়ী বেস বানাতে চাইছে। চীন চাঁদের হিলিয়াম-৩ উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে। জাপান ২০৩০ সাল থেকে স্থায়ী ভাবে চাঁদে অভিযাত্রীদল রাখার ব্যাপারে চিন্তা করছে। আমরা আশায় থাকি।  

প্রকাশিতঃ কিচির মিচির শারদীয় সংখ্যা ২০১৯ ঃ সম্পাদিত 

Saturday 26 October 2019

মৌলিক পদার্থ ও মহিলা বিজ্ঞানী


মৌলিক পদার্থ ও মহিলা বিজ্ঞানী

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

      ঠিক একশো পঞ্চাশ বছর আগে 1869 সালের 18 মার্চ রুশ বিজ্ঞানী দমিত্রি ইভানোভিচ মেন্দেলিয়েভ রাশিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির সভায় মৌলিক পদার্থগুলিকে একটা সারণি বা টেবিলের মতো করে সাজানোর কথা বলেছিলেন। তাকেই আমরা আজ পর্যায়সারণি বা পিরিয়ডিক টেবিল বলে চিনি। এ এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার যে রাষ্ট্রসংঘ 2019 সালকে আন্তর্জাতিক পর্যায়সারণি বর্ষ হিসাবে ঘোষণা করেছে। ১৮৬৯ সালে ষাটটি মৌলের অস্তিত্বের কথা জানা ছিল। পর্যায়সারণিতে অনেক শূন্য স্থান ছিল যা পরে নতুম মৌল আবিষ্কারের মাধ্যমে পূর্ণ হয়েছে। তাছাড়াও পর্যায়সারণির আরো সম্প্রসারণ ঘটেছে।  দেড়শো বছর পরে মৌলের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে  দাঁড়িয়েছে একশো আঠারোতে। এদের মধ্যে অনেকগুলি তেজস্ক্রিয়। ইউরেনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা হল 92। ইউরেনিয়ামের থেকে ভারি মৌলগুলি সবই ক্ষণস্থায়ী,  তাদের প্রকৃতিতে পাওয়া যায় না -- পরীক্ষাগারে তৈরি করতে হয়েছে। সেগুলির সবই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের আবিষ্কার; একজন বা দুজন নন, সাধারণভাবে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী দলবদ্ধভাবে সেই গবেষণাতে অংশ নিয়েছিলেন।
      সোনা, রুপো, তামা, টিন, কার্বন, গন্ধক, পারদ, সিসা, লোহা, অ্যান্টিমনি, দস্তা, আর্সেনিক -- এই বারোটি মৌলের আবিষ্কার হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে এগুলো হয় প্রকৃতিতে মৌলিক পদার্থের রূপে পাওয়া যায়, নয়তো এদের আকরিক থেকে আলাদা করা বেশ সহজ ছিল। এদের আবিষ্কারকদের নাম জানার কোনো সুযোগ নেই। ইতিহাসে ইউরেনিয়াম পর্যন্ত বাকি মৌলদের নামের পাশে তাদের আবিষ্কারকদের নাম পাওয়া যাবে। আধুনিক বিজ্ঞানের জগতে মহিলাদের পদার্পণ খুব সাম্প্রতিক ঘটনা, তাই সেই তালিকাতে মহিলা বিজ্ঞানীর সংখ্যা কম। তবু এদের মধ্যে অন্তত ছ’টি ক্ষেত্রে কোনো না কোনো মহিলা বিজ্ঞানীর নাম জড়িয়ে আছে। এই প্রবন্ধে আমরা খুব সংক্ষেপে সেই সমস্ত আবিষ্কারের  দিকে দৃষ্টি রাখব।
      প্রথমেই আসে মাদাম মেরি কুরির নাম। স্বামী পিয়ের কুরির সঙ্গে মিলে তিনি দুটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কার করেছিলেন। বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড  অবশ্য আরো একটি মৌল আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, সে কথায় আমরা পরে আসব। বেকারেল তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের পরে পরেই মেরি সে বিষয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। অন্য সবাই যখন বিকিরণ দেখার জন্য ফটোগ্রাফিক প্লেট ব্যবহার করছিলেন, মেরি কাজে লাগালেন পিয়ের ও তাঁর দাদা জ্যাকসের আবিষ্কৃত ইলেক্ট্রোমিটার যন্ত্র। ইলেক্ট্রোমিটার তেজস্ক্রিয়তার জন্য বাতাসের যে আয়নন হয়, তার পরিমাণ মাপতে পারে। তার ফলে মেরি তেজস্ক্রিয়তার যে পরিমাপ বার করছিলেন, তা অন্যদের থেকে অনেক ভালো।
      মেরির অগ্রগতিতে উৎসাহী হয়ে কিছুদিন পরেই পিয়ের তাঁর সঙ্গে কাজ শুরু করেন। ইউরেনিয়ামের  দুই আকরিক হল পিচব্লেন্ড ও চালকোলাইট, মেরিরা তাদের থেকে ইউরেনিয়াম বার করছিলেন। তাঁরা দেখলেন ইউরেনিয়ামের আকরিকের তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা ইউরেনিয়ামের থেকে বেশী। এর একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে, আকরিকের মধ্যে এক বা একাধিক অজানা মৌলিক পদার্থ আছে যাদের তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা ইউরেনিয়ামের থেকে অনেক বেশি। মেরিরা সেই মৌলিক পদার্থগুলি আবিষ্কার করার সিদ্ধান্ত নেন। পিচব্লেন্ড হল মূলত ইউরেনিয়ামের অক্সাইড, কিন্তু তার মধ্যে প্রায় তিরিশ রকম মৌলিক পদার্থ থাকে, তাদের একে একে পৃথক করতে হত। নতুন মৌলের রাসয়ানিক ধর্ম সম্পর্কে তাঁদের কিছুই জানা ছিল না, তাই তাকে  খোঁজার জন্য তাঁদের রাসয়ানিক বিশ্লেষণের নতুন পদ্ধতি  আবিষ্কার করতে হয়েছিল। 1898 সালের জুলাই মাসে তাঁরা একটা নতুন মৌলিক পদার্থের চিহ্ন খুঁজে পেলেন। পিচব্লেন্ডের মধ্যে থাকে বিসমাথ। নতুন মৌলটার রাসয়ানিক ধর্ম বিসমাথের খুব কাছাকাছি, তাই পিচব্লেন্ড থেকে বিসমাথ যখন রাসয়ানিক পদ্ধতিতে আলাদা করলেন কুরিরা, তখন নতুন মৌলটাও তার সঙ্গে বেরিয়ে এসেছিল। পরাধীন জন্মভূমি পোল্যান্ডের স্মরণে মেরি তার নাম দিলেন পোলোনিয়াম (Po)। পোলোনিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা হল 84

মেরি কুরি

      কিন্তু পোলোনিয়াম দিয়েও পিচব্লেন্ডের তেজস্ক্রিয়তার পুরোপুরি ব্যাখ্যা করা যাচ্ছিল না। মেরিরা বুঝতে পারলেন আরো একটি মৌল পিচব্লেন্ডের মধ্যে আছে, সেটা শেষ পর্যন্ত অন্য এক মৌলিক পদার্থ বেরিয়ামের সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল। বিকিরণ বা রেডিয়েশনের অনুসারে তাঁরা এর নাম ঠিক করলেন রেডিয়াম (Ra)। সেটা ছিল 1898 সালের ডিসেম্বর মাস। যেখানে একটা মৌল আবিষ্কারই যে কোনো বিজ্ঞানীর কাছে স্বপ্ন, মেরিরা সেই কাজে সফল হয়েছেন দুবার। দীর্ঘ তিন বছর চেষ্টা করে কুরিরা 1902 সালের এপ্রিল মাসে রেডিয়ামকে বেরিয়াম থেকে আলাদা করতে সফল হলেন। কাজ শুরুর সময় কুরিরা ভেবেছিলেন এক টন পিচব্লেন্ড থেকে রেডিয়াম পাওয়া যাবে দশ কিলোগ্রাম। শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল একশো মিলিগ্রাম রেডিয়াম ক্লোরাইড।  তার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে কুরিরা বুঝেছিলেন যে তাঁরা রেডিয়ামকে বেরিয়ামের থেকে আলাদা করতে পেরেছেন। এ কাজে তাঁদের সাহায্য করেছিলেন দুই বিজ্ঞানী গুস্তাভ বেমন্ট ও ইউজিন ডেমার্কে। কুরিরা রেডিয়ামের পারমাণবিক গুরুত্ব বা ভরসংখ্যা নির্ধারণ করলেন 225। পরে জানা গিয়েছিল রেডিয়ামের পারমাণবিক সংখ্যা অর্থাৎ তার নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা হল 88। পোলোনিয়ামকে কুরিরা কখনোই বিসমাথ থেকে আলাদা করতে সক্ষম হন নি। তার কারণ তখন বোঝা যায়নি। তাঁদের আবিষ্কৃত পোলোনিয়ামের আইসোটোপের অর্ধায়ুকাল হল 138 দিন, রাসয়ানিক পদ্ধতিতে এত সময় লাগত যে পোলোনিয়াম পরমাণুর ক্ষয় হয়ে যেত।
      আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও তাঁর সহযোগী ফ্রেডরিক সডি প্রথম বলেছিলেন তেজস্ক্রিয়াতে এক পরমাণু অন্য পরমাণুতে পাল্টে যাচ্ছে। সেই প্রকল্পের সূচনাতে ছিল রাদারফোর্ড ও তাঁর এক ছাত্রীর পরীক্ষা। হ্যারিয়েট ব্রুক্‌সের নাম আজ বিশেষ কেউ জানে না, তিনি কানাডার প্রথম মহিলা নিউক্লিয় বিজ্ঞানী। শুধু কানাডা নয়, গোটা উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশ মিলিয়েই তাঁর এই সম্মান প্রাপ্য। 1898 সালে বিজ্ঞান ও অঙ্ক নিয়ে কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে স্নাতক হয়েছিলেন হ্যারিয়েট ব্রুক্‌স। সে সময় রাদারফোর্ড কেমব্রিজ থেকে ম্যাকগিলে যোগ দিয়েছেন, তিনি সহকারী হিসাবে বেছে নেন হ্যারিয়েটকে। মাঝে কিছুদিন কেমব্রিজে ইলেকট্রনের আবিষ্কর্তা জে জে টমসনের সঙ্গে কাজ করার পরে হ্যারিয়েট আবার কানাডা ফিরে যান।
      রাদারফোর্ডও তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণা করছিলেন। তিনি ও রবার্ট আওয়েন্স দেখলেন যে থোরিয়াম থেকে কিছু একটা নিঃসরণ হচ্ছে, যা তেজস্ক্রিয়তাতে যে আলফা বা বিটা কণা বেরোয়, তার থেকে আলাদা। বায়ুর প্রবাহ তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাঁরা তার নামও দিয়েছিলেন থোরন। কুরিরা এই নিঃসরণের কথা আগেই বলেছিলেন। তাঁরা দেখেছিলেন যে রেডিয়াম তার কাছাকাছি বায়ুকে তেজস্ক্রিয় করে দেয়, কিন্তু তা নিয়ে তাঁরা আর এগোননি। আমরা এখন জানি আলফা কণা হল হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস যার ভরসংখ্যা হল চার। বিটা কণা হল ইলেকট্রন, তার ভরসংখ্যা শূন্য। মনে করা হচ্ছিল এ হয়তো থোরিয়ামেরই অন্য কোন ভৌত রূপ। রাদারফোর্ড ও হ্যারিয়েট ব্রুক্‌স দেখালেন যে এই নতুন নিঃসরণ হল একটা তেজস্ক্রিয় গ্যাস যার ভরসংখ‍্যা থোরিয়ামের থেকে অনেক কম। সেই প্রথম কোনো তেজস্ক্রিয় গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেল। রাদারফোর্ড ও ব্রুক্‌স রেডিয়াম থেকেও এই গ্যাস নির্গত হওয়ার চিহ্ন খুঁজে পান।  কয়েক বছর পরে ব্রুক্‌স এর অর্ধায়ুকালও মাপেন, যার থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যায় এটি একটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল। রেডিয়াম থেকে নির্গত এই গ্যাসের নাম দেওয়া হল রেডন (Rn)। এর পারমাণবিক সংখ্যা হল 86। এর থেকেই রাদারফোর্ড এবং সডি ইঙ্গিত পেয়েছিলেন যে তেজস্ক্রিয়াতে এক মৌল অন্য মৌলে পরিবর্তিত হচ্ছে।

হ্যারিয়েট ব্রুক্‌স

      তবে রেডন আবিষ্কারের ইতিহাস সরলরেখা নয়। রাদারফোর্ডই প্রথম রেডনকে নতুন মৌল বলেছিলে, আজকাল অনেক জায়গায় তাঁকে রেডনের আবিষ্কর্তার সম্মান দেওয়া হয়। রাদারফোর্ড কিন্তু কুরিদের রেডন আবিষ্কারের কৃতিত্ব দিয়েছিলেন, তার কারণ তাঁরাই প্রথম রেডিয়াম থেকে এই নিঃসরণ দেখেছিলেন। অপরদিকে মাদাম কুরি রাদারফোর্ডের মতের বিরোধিতা করেছিলেন। রাদারফোর্ড ও সডি নানা পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখান যে রেডন সত্যিই গ্যাস, তার রাসয়ানিক ধর্ম নিষ্ক্রিয় গ্যাসের অনুরূপ। মাদাম কুরি তখন তা মেনে নেন। আমরা এখন জানি ব্রুক্‌স রেডনের ভরসংখ্যা ঠিকঠাক মাপতে পারেন নি। তার ভরসংখ্যা আসলে থোরিয়ামের থেকে সামান্যই কম। তাই যে পরীক্ষা থেকে রেডনকে মৌল বলে অনুমান করা গিয়েছিল, তা ছিল ভুল। অবশ্য রেডনের অর্ধায়ুকালও ব্রুক্‌স মেপেছিলেন, তার থেকে বোঝা গিয়েছিল যে সেটি একটি নতুন মৌল। রাদারফোর্ড নিজে সবসময়েই রেডন বিষয়ে গবেষণা প্রসঙ্গে ব্রুক্‌সের কথা বলেছেন। রাদারফোর্ড ও ব্রুকস প্রথমে রেডন বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র ছাপান। পরে রাদারফোর্ড একাই এই বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র লিখেছিলেন, তার ভিতরেও তিনি ব্রুক্‌সের অবদানের কথা লিখেছিলেন।  কিন্তু সে কথা বিশেষ প্রচার পায়নি, ফলে হ্যারিয়েট ব্রুক্‌স অপরিচিতই রয়ে গিয়েছেন। তিনি অন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজও করেছিলেন কিন্তু কৃতিত্ব পান নি। রেডনের আবিষ্কারে পিয়ের ও মেরি কুরি, রাদারফোর্ড, আওয়েন্স, ব্রুক্‌স এবং সডি – সকলেরই অবদান আছে।
      অবদান যাঁর বিশেষ নেই তাঁর নামই কিন্তু রসায়নের প্রামাণিক বইতে সাধারণত রেডনের আবিষ্কর্তা হিসাবে থাকে -- তিনি জার্মান রসায়নবিদ ফ্রিয়েডরিশ আর্ন্‌স্ট ডর্ন। ডর্ন শুধুমাত্র রাদারফোর্ডরা থোরিয়ামে যে পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন, তা রেডিয়ামের উপরে করেছিলেন। কুরিরা রেডিয়ামে এই ধরনের কাজ আগেই করেছিলেন। ডর্ন কোনো নতুন মৌলের কথা বলেনও নি। তাঁর গবেষণাপত্রটি একটি অপেক্ষাকৃত অপরিচিত গবেষণাপত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল, ফলে সেটি বিশেষ কেউ পড়ার সুযোগ পান নি। পরের এক সুপরিচিত প্রবন্ধে নতুন মৌলের প্রস্তাবকের কথা লিখতে গিয়ে ভুলক্রমে রাদারফোর্ডদের পরিবর্তে ডর্নের গবেষণাপত্রটিকে উল্লেখ করা হয়েছিল। ডর্নের মূল লেখাটি না পাওয়ায় পরবর্তীকালে প্রায় সবাই ওই প্রবন্ধটি অনুসরণ করে ডর্নকেই রেডন আবিষ্কারের সম্মান দিয়েছেন। হিসাব করে দেখা গেছে ইন্টারনেটে নব্বই শতাংশ জায়গায় ডর্নকেই রেডনের আবিষ্কর্তা বলা হয়েছে।     
      আমাদের আলোচনার চতুর্থ মৌলটির নাম হল প্রোট্যাক্টিনিয়াম (Pa)। এটিও তেজস্ক্রিয়। 1913 সালে জার্মানির কার্লসরুহেতে পোলিশ বিজ্ঞানী কাসিমির ফাইয়ান্স ও জার্মান বিজ্ঞানী অসওয়াল্ড গোয়েরিং ইউরেনিয়ামের  ক্ষয় হয়ে যে সমস্ত নতুন মৌল তৈরি হয়, তার মধ্যে প্রোট্যাক্টিনিয়ামের সন্ধান পান, তখনো অবশ্য এই নাম দেওয়া হয়নি।। তাঁদের আবিষ্কৃত মৌলটির ভরসংখ্যা ছিল 234, এর অর্ধায়ু কাল এক মিনিটের সামান্য বেশি। এত ক্ষণস্থায়ী মৌল নিয়ে গবেষণা করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। লাতিন ভাষায় ব্রেভিস অর্থে স্বল্পস্থায়ী, তার থেকে তাঁরা এর নাম দিয়েছিলেন ব্রেভিয়াম। কিন্তু এ আদৌ মৌল কিনা তা পরীক্ষা না করে নিশ্চিত হওয়া যায় না।
      সেই কাজটাই করেন পাঁচ বছর পরে জার্মানির বার্লিনে অটো হান ও লিজা মাইটনার। নিউক্লিয় বিভাজন বা ফিশন বিক্রিয়া বিষয়ে তাঁদের গবেষণার কথা সকলের জানা। হিটলারের ইহুদিবিদ্বেষের কারণে মাইটনারকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, ফলে নোবেল পুরস্কার থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছিলেন। এ বিষয়ে অটো হানের ভূমিকাও ভালো ছিল না, কিন্তু সে পরবর্তীকালের কথা। মাইটনার ছিলেন আর এক জন মহিলা বিজ্ঞানী যিনি নিউক্লিয় বিজ্ঞানের প্রথম যুগে গবেষণা শুরু করেছিলেন।

লিজা মাইটনার

      হান ও মাইটনার পিচব্লেন্ডচূর্ণে উত্তপ্ত ঘন নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে রেডিয়াম ও অন্যান্য জানা তেজস্ক্রিয় পদার্থকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। পড়ে থাকা অধঃক্ষেপ থেকে যে আলফা বিকিরণ বেরিয়েছিল, তার ভেদনক্ষমতা মেপে তাঁরা নিশ্চিত হন যে এক নতুন মৌলের সন্ধান তাঁরা পেয়েছেন। এটা ছিল প্রোট্যাক্টিনিয়ামের অন্য আইসোটোপ যার ভরসংখ্যা 231। এর অর্ধায়ুকাল হল প্রায় তেত্রিশ হাজার বছর, ফলে মৌলের রাসয়ানিক ধর্ম নির্ধারণ করা সম্ভব হয়েছিল। দেখা গেল তা ট্যান্টালাম মৌলের অনুরূপ। নতুন মৌলটি আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে অ্যাক্টিনিয়াম মৌল তৈরি করে বলে তার নাম হল প্রোট্যাক্টিনিয়াম। ফাইয়ান্সও এই নামকরণে সায় দেন। প্রায় একই সময়ে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে সডি ও তাঁর সহযোগী জন ক্র্যানস্টন প্রোট্যাক্টিনিয়ামের  চিহ্ন খুঁজে পেয়েছিলেন। পর্যায়সারণিতে পারমাণবিক সংখ্যা 91-এর ঘরটা শূন্য ছিল। মেন্দেলিয়েভ বলেছিলেন ওইখানে যে মৌল বরবে তার ধর্ম হতে হবে ট্যান্টালাম মৌলের খুব কাছাকাছি,  প্রোট্যাক্টিনিয়ামই সেই শূন্যস্থান পূরণ করল।
      এর পরে যে মৌলিক পদার্থের কথা আসবে, তা তেজস্ক্রিয় নয়। তার আগে বলতে হয় মোসলের সূত্রের কথা। কোনো মৌলিক পদার্থকে যথেষ্ট উত্তেজিত করলে তার থেকে এক্স রশ্মি নির্গত হয়। 1913-14 সালে ব্রিটেনে হেনরি মোসলে দেখান যে সেই এক্স রশ্মির কম্পাঙ্কের বর্গমূল হল মৌলটির পারমাণবিক সংখ্যার সমানুপাতী। এর ফলে মৌল চেনার কাজ খুব সহজ হয়ে গিয়েছিল। পর্যায়সারণিতে 75 পারমাণবিক সংখ্যার ঘরটা শূন্য ছিল, মেন্দেলিয়েভ বলেছিলেন তার ধর্ম হবে ম্যাঙ্গানিজের মতো। 1925 সালে বার্লিনে ওয়াল্টার নড্যাক, ইডা টাকে ও অটো বার্গ প্লাটিনামের আকরিক ও কলম্বাইট নামের এক খনিজের মধ্যে মৌলটিকে আবিষ্কার করেছিলেন। রাইন নদীর নামে তাঁরা তার নাম দিয়েছিলেন রেনিয়াম (Re)। নড্যাক ও টাকে কলম্বাইট থেকে চেনা মৌলগুলি রাসয়ানিকভাবে সরিয়ে দিয়ে রেনিয়ামের ঘনত্বকে এক লক্ষ গুণ পর্যন্ত বাড়াতে সক্ষম হন। বার্গ এক্স রশ্মির বর্ণালীতে মোসলের সূত্র প্রয়োগ করে রেনিয়ামের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছিলেন। ইডা নুরেমবার্গে জার্মান রসায়ন ক্লাবের সামনে এই মৌল আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করেন, সেই প্রথম কোনো মহিলা সেই ক্লাবে বক্তৃতা দেন। পরবর্তীকালে ইডা ও ওয়াল্টার বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ইডা অবশ্য গবেষণা বন্ধ করেননি। তিন বছর পরিশ্রম করে নড্যাক দম্পতি বিশুদ্ধ রেনিয়াম ধাতুকেও পৃথক করতে সক্ষম হন। একই সঙ্গে তাঁরা 43 পারমাণবিক সংখ্যার মৌলটি আবিষ্কারের ঘোষণা করেছিলেন। পর্যায়সারণিতে এর জায়গা ঠিক ম্যাঙ্গানিজ ও রেনিয়ামের মাঝখানে, এর রাসয়ানিক ধর্মও হওয়া উচিত তাদেরই মতো। তবে নড্যাকদের দাবী সঠিক ছিল না, কারণ ঐ মৌলটি আসলে তেজস্ক্রিয়, পৃথিবীতে প্রাকৃতিকভাবে তাকে পাওয়া যায় না।
      একমাত্র যে মৌলটি কোনো মহিলা বিজ্ঞানী একক ভাবে আবিষ্কার করেছেন, তা হল ফ্রান্সিয়াম (Fr)। 1930-এর দশকের শেষদিকে ইউরেনিয়ামের থেকে হালকা মৌলদের মধ্যে দুটি মাত্র অনাবিষ্কৃত ছিল, যাদের পারমাণবিক সংখ্যা 43 ও 87। তাই তাদের খোঁজার নানা চেষ্টা চলছিল। অনেকেই দাবী করেছিলেন যে তাঁরা সফল হয়েছেন, কিন্তু তাঁদের দাবী প্রমাণ হয়নি। মাদাম কুরির এক সময়কার ছাত্রী মার্গারিট পেরেই প্যারির কুরি ইনস্টিটিউটে প্রথম 87 পারমাণবিক সংখ্যার মৌলটির সন্ধান পান। তিনি অ্যাক্টিনিয়াম-227 আইসোটোপ নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন। অ্যাক্টিনিয়াম বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে থোরিয়াম-227 আইসটোপে পরিবর্তিত হয়ে যায়, এই কথাই জানা ছিল। পেরেই দেখালেন যে মাত্র এক শতাংশ ক্ষেত্রে অ্যাক্টিনিয়াম-227 ফ্রান্সিয়াম-223 আইসটোপে রূপান্তরিত হয়। এর অর্ধায়ু কাল বাইশ মিনিট, তারপর বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে এর থেকে রেডিয়াম-223 সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে থোরিয়াম-227 আবার আলফা ক্ষয়ের মাধ্যমে রেডিয়াম-223 সৃষ্টি করে। দেখা যাচ্ছে দুই ক্ষেত্রেই শেষ পর্যন্ত অ্যাক্টিনিয়াম-227 থেকে রেডিয়াম-223 পাওয়া যাচ্ছে। এসের মধ্যে ফ্রান্সিয়ামের পথ ধরছে মাত্র এক শতাংশ অ্যাক্টিনিয়াম নিউক্লিয়াস, তাই ফ্রান্সিয়াম অন্যদের চোখ এড়িয়ে গিয়েছিল। পেরেই নিজের জন্মভূমির নামে মৌলটির নাম দেন। ফ্রান্সিয়ামই প্রাকৃতিক পদার্থের মধ্যে আবিষ্কৃত শেষ মৌল।
মার্গারিট পেরেই
      আমরা যে সময়ের কথা বলছি সে যুগে মহিলা বিজ্ঞানীদের কাজ করার পরিসর ছিল যথেষ্ট কম। মেরি কুরি দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন ব্যক্তিগত প্রয়াসে, এমনকি নোবেল পুরস্কারও তাঁর জন্য অধ্যাপনার সুযোগ এনে দিতে পারেনি। দুর্ঘটনাতে পিয়েরের মৃত্যুর পরেই একমাত্র তাঁর জায়গায় মেরিকে সরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি দেওয়া হয়। হ্যারিয়েট ব্রুক্‌সের সামনে কোনো সুযোগই আসেনি, বিয়ের পরে তিনি সমস্ত গবেষণা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হন। বার্লিনের কেমিস্ট্রি ইনস্টিটিউটের প্রধান মাইটনারকে প্রবেশাধিকার দিতে রাজি ছিলেন না, কারণ মেয়েদের লম্বা চুলে আগুন ধরে যেতে পারে। ইডাই প্রথম নিউক্লিয় বিভাজন বিক্রিয়ার সম্ভাবনার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রায় সারাজীবন চাকরি পাননি, স্বামীর গবেষণাগারে অতিথি হিসাবে কাজ করেছিলেন -- তাই অন্যান্য বিজ্ঞানীরা তাঁর মতামতকে গুরুত্ব দেননি। এত সমস্যার মধ্যে কাজ করেই এই মহিলারা তাঁদের নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রেখেছেন।

প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান, শারদীয় ২০১৯, পরিমার্জিত