Friday 13 July 2018

গ্রন্থবীক্ষণ- সৌরজগৎঃ সৃষ্টি ও নানা প্রসঙ্গ


গ্রন্থবীক্ষণ

সৌরজগৎঃ সৃষ্টি ও নানা প্রসঙ্গ

শিশিরকুমার ভট্টাচার্য
প্রকাশকঃ একুশ শতক
মূল্য ১২০ টাকা

       আমরা চারদিকে যা দেখতে পাই সে সব কেমন ভাবে  তৈরি হল, তা নিয়ে মানুষের জানার আগ্রহ চিরদিনের। সদ্য-প্রয়াত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিঙের ‘আ ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইম’ বইটির বিপুল জনপ্রিয়তা সেই আগ্রহেরই সাক্ষ্য দেয়। মহাবিশ্বের সৃষ্টি নিয়ে বেশ কিছু বই লেখা হয়েছে। আমরা যে সৌরজগতে বাস করি তা কেমন ভাবে তৈরি হল, সেই আলোচনা ইদানীংকালে চোখে পড়েনি শিশিরকুমার ভট্টাচার্যের প্রবন্ধ সংকলনটি এই বিষয়ে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বইটি মূলত বাংলাদেশী প্রকাশনা, ২০১৬ সালে একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছিল। একুশ শতক প্রকাশনা সংস্থা তার ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশ করেছেন বলে তাঁদের ধন্যবাদ জানাই।
       প্রথমেই একটা কথা বলে রাখা দরকার। এই ধরনের বিজ্ঞানের বই বাংলা ভাষায় খুব কম পড়েছি। প্রায়শই দেখা যায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখকরা ধরে নেন যে পাঠকরা বিজ্ঞানের তত্ত্ব এবং তথ্য বেশি জানতে উৎসাহী নন, তাই জনপ্রিয়তার অনুরোধে সে সমস্ত যথাসম্ভব কাটছাঁট করেই বইতে জায়গা দেন। এই বইটি কিন্তু সে দিক দিয়ে ব্যতিক্রম। যে পাঠক এই ধরনের বই কিনবেন, তিনি যথার্থই এ বিষয়ে জানতে আগ্রহী। তাঁর জন্য আধুনিক বিজ্ঞানকে যথাসাধ্য উপস্থাপন করেছেন লেখক, তাই তাঁকে অভিনন্দন  
       বইটিতে মোট আটটি প্রবন্ধ আছে। প্রথম প্রবন্ধ হল ‘সৌরজগতের সৃষ্টি তত্ত্ব’। জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে গত দুই দশকে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটেছে। তিরিশ বছর আগেও আমাদের সৌরজগতের বাইরে কোনো তারার গ্রহ আছে কিনা তা ছিল কল্পনার বিষয়। আজ কয়েক হাজার গ্রহের খবর আমরা জানি এবং প্রায় প্রতিদিনই সেই তালিকায় নতুন নাম যোগ হচ্ছে। তার ফলে আমাদের চিন্তাভাবনাও ক্রমশ বিবর্তিত হচ্ছে। তাই নতুন লেখার প্রয়োজন খুব বেশি। এই প্রবন্ধটা সেই চাহিদা পূরণ করবে। লেখক সৌরজগতের বিভিন্ন অংশের  বর্ণনা দিয়েছেন, তার পরে সৌর জগৎ সৃষ্টির তত্ত্বে প্রবেশ করেছেন। সেখানে আলোচনা করেছেন কিছুটা ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে, পুরানো মতামতগুলির তাদের ভুলভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা দেখিয়ে দিয়েছেন। আধুনিক মতবাদটি নিয়ে আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘতর, ঘূর্ণায়মান সংকোচন গ্যাসগোলক থেকে কিভাবে নক্ষত্র ও গ্রহের সৃষ্টি হতে পারে, তা নিয়ে সুন্দর আলোচনা করা হয়েছে। তবে কয়েকটি ছবির সাহায্য নিলে বিষয়টা বুঝতে আরো সুবিধা হত। প্রবন্ধে একটা সামান্য ভুল চোখে পড়ল, আধুনিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে বুধ সূর্যের দিকে একমুখী হয়ে ঘোরে না একই সঙ্গে কয়েকটা কথা বলতেই হয়। এই একটি প্রবন্ধে তথ্যের পরিমাণের সঙ্গে লেখার দৈর্ঘ্য সাযুজ্যপূর্ণ নয়। সৌরজগতের যে বর্ণনা আছে, তার জন্য পৃথক আর একটি প্রবন্ধ থাকলে বা প্রবন্ধটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে নিলে হয়তো পড়তে একটু সুবিধা হত। তাছাড়াও অনুচ্ছেদগুলি কখনো কখনো অতি দীর্ঘ হয়ে গেছে। আর একটা সামান্য কথা, লেখাতে দূরত্বের একক হিসেবে মাইল ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে মাইল বেশি ব্যবহার হয় কিনা জানি না,  ভারতীয় পাঠকরা, বিশেষ করে কিশোর ও তরুণরা, এতে অভ্যস্ত নয়। ভারতীয় সংস্করণ প্রকাশের সময় কিলোমিটার এককে পরিবর্তন করে নিলে ভালো হত। তেমনি জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক একক যে পৃথিবী ও সূর্যের গড় দূরত্ব, সে কথাটা চোখে পড়ল না। তবে এগুলি সামান্য বিষয়, সব মিলিয়ে প্রবন্ধটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক।
       দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘রাতের আকাশ অন্ধকার কেন’ অলবার্সের প্যারাডক্সের উপর লেখা। এই আপাত সহজ প্রশ্ন থেকে কেমন ভাবে সম্প্রসারণশীল ও নবীন বয়সী মহাবিশ্বের ধারণায় পৌঁছানো যায় তা পরপর যুক্তি দিয়ে এবং চিত্রে সাহায্যে বোঝানো হয়েছে। তবে চিত্রগুলি ছাপার সময়ে আরো যত্ন নেওয়া উচিত ছিল। যেমন লাল ও নীল সরণ সম্পর্কে সুন্দর ব্যাখ্যাটি সঙ্গের ছবিটি পরিষ্কার না হওয়াতে দুর্বোধ্য হয়ে গেছে।
       পরের চারটি প্রবন্ধ দৈর্ঘ্যে অপেক্ষাকৃত ছোট। ১৯৯৩ সালে বৃহস্পতির বুকে শুমেকার-লেভি-৯ ধূমকেতুর আছড়ে পরার কথা আমাদের অনেকেরই মনে আছে। সে সময় তা কিছুটা সাড়া জাগালেও এই ঘটনা থেকে বিজ্ঞানীরা কী জানতে পেরেছেন সে বিষয়ে বিশেষ আলোচনা হয়নি। সে দিক দিয়ে প্রবন্ধটি বেশ উল্লেখযোগ্য। পৃথিবীর সঙ্গে কোনো ধূমকেতুর সংঘর্ষ হলে তার পরিণতি কী হতে পারে তাও লেখাতে এসেছে।
       তার পরের লেখাটি গ্রহের মহাসংযোগ বিষয়ে। ২০০০ সালের ৫ মে বুধ থেকে শনি পর্যন্ত সমস্ত গ্রহ এক সরলরেখায় অবস্থান করেছিল, তার মধ্যে পৃথিবী সূর্যের একদিকে, বাকি পাঁচটি গ্রহ অন্যদিকে। লেখাটি সেই সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল।  এই মহাজাগতিক অবস্থানের জন্য পৃথিবীতে প্রলয় হবে বলে কেউ কেউ আশঙ্কা করেছিলেন, প্রবন্ধটিতে লেখক দেখিয়েছিলেন যে এর কোনো সম্ভাবনাই নেই।
       সৌরজগতে প্রাণের আবির্ভাব বিষয়ে লেখাটিতে ওপেরিন-হ্যালডেন তত্ত্বের আলোচনা করা হয়েছে। এই মতবাদ কেমন ভাবে পৃথিবীতে অজৈব পদার্থ থেকে জীবের উদ্ভব হতে পারে তা ব্যাখ্যা করে। অনেকে বলেন যে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণ এসেছিল উল্কাপাতের মাধ্যমে। সে কথার পক্ষে বিপক্ষে দুই রকম যুক্তিই আছে, কিন্তু তাহলে প্রাণের আবির্ভাব নিয়ে আলোচনা প্রায় অর্থহীন হয়ে পড়ে। মহাজগতে এত রকমের বিচিত্র পরিবেশ পাওয়া যায় , তার মধ্যে কোনটাতে প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল তা বলা সম্ভব নয়। পৃথিবীর বাইরে সৌরজগতের অন্যত্র উন্নত জীব নেই, এটা আমরা জানি। অণুজীব থাকার সম্ভাবনা কি আছে? প্রবন্ধটিতে সম্ভাব্য কয়েকটি গ্রহ উপগ্রহের কথা আছেলেখক মঙ্গল থেকে উৎক্ষিপ্ত শিলাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবয়বের কথা মনে করিয়েছেন যা ব্যাকটেরিয়ার অনুরূপ। তবে আজকাল আর সেই কথাটা বিশেষ শুনি না, বরঞ্চ গত বছর জুলাই মাসে কয়েকজন বিজ্ঞানী বলেছেন যে মঙ্গলের উপরিতল সম্ভবত অণুজীবদের টিকে থাকার অনুপযোগী। যতদিন না মানুষ মঙ্গলে যেতে পারছে, ততদিন এই তর্ক শেষ হওয়ার  নয়
       পরের প্রবন্ধটি একটা খুবই পরিচিত বিষয়ে, জ্যোতিষ শাস্ত্রের সঙ্গে বিজ্ঞানের বিরোধ। জ্যোতিষে যেহেতু গ্রহের প্রভাবের কথা আছে, সে কারণেই সম্ভবত লেখক এটিকে এই বইতে জায়গা দিয়েছেন। এই প্রবন্ধটিও অন্যগুলির মতোই সুলিখিত, তবে বিষয়টি বহুচর্চিত বলে আর আলাদা করে আলোচনার প্রয়োজন নেই। দুঃখের বিষয় এত লেখালেখির পরেও এই লোক-ঠকানো ব্যবসা উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে।
       কাল গণনা বিষয়ক প্রবন্ধটি মূলত ক্যালেন্ডার বা পঞ্জিকা বিষয়ে। মহাজাগতিক পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তনে থেকে কেমনভাবে বছর বা মাসের ধারণা আসে।  কিভাবে আমাদের দেশে ও পশ্চিমে যুগে যুগে পঞ্জিকার পরিবর্তন হয়েছে, তার কারণই বা কী, তা নিয়ে আলোচনা রয়েছে লেখাতে। বিশেষ করে বাংলা পঞ্জিকা কোথা থেকে এলো তা নিয়ে মতবিরোধ আছে। ভারতে পঞ্জিকা সংস্কারের জন্য মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। লেখক খেদ প্রকাশ করেছেন যে বাংলাদেশে অনুরূপ কাজে কোনো বিজ্ঞানীকে নেওয়া হয়নি। লেখক তাঁর দেশের জন্য স্বাধীনতার স্মারক হিসাবে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত পঞ্জিকার প্রস্তাব করেছেন। তিনি যে বিষয়টি নিয়ে গভীর ভাবে ভেবেছেন সন্দেহ নেই, কিন্তু আমাদের মতো দেশে এ ধরনের বিজ্ঞানসম্মত পঞ্জিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দেহ আছে। মেঘনাদ সাহা কমিটির তৈরি করা পঞ্জিকা সরকারি ভাবে মেনে নিলেও ভারতবর্ষের সমস্ত সরকারি কাজকর্মও সেই পুরানো পঞ্জিকা মেনেই চলছে।
       বইটি শুরু হয়েছিল সৌরজগতের সৃষ্টি নিয়ে, শেষ প্রবন্ধটি হল সৌরজগতের ভবিষ্যৎ। সূর্য যখন নিভে আসবে তার পরেও সৌরজগৎ থাকবে, অন্তত মঙ্গল থেকে শুরু করে তার বাইরের গ্রহদের অস্তিত্ব থাকবে। তার অনেক আগেই অবশ্য লাল দানবে পরিণত সূর্য পৃথিবী থেকে প্রাণের চিহ্ন মুছে দেবে। সুদূর ভবিষ্যতে অবশ্য সৌরজগতের অস্তিত্বই থাকবে না। লেখকের আশা সূর্য নিভে যাওয়ার আগে ভবিষ্যতের মানুষ অন্য নক্ষত্রে পাড়ি দেবে। এই আশাবাদ, মানুষের উপর এই আস্থাই নিঃসন্দেহে এই বই লেখার অনুপ্রেরণা।
        প্রবন্ধগুলি নানা বিষয়ে লেখা হলেও তাদের মধ্যে একটা যোগসূত্র আছে। সবগুলিই সুলিখিত এবং সাধারণভাবে বিষয়গুলিও কৌতূহল জাগায়।  বইটির ছাপা ভালো। দু একটি চোখের পক্ষে পীড়াদায়ক মুদ্রণ প্রমাদ, যেমন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্বে একটি শূন্য কম, এরকম থাকলেও সংখ্যায় কম। তবে ছবি মুদ্রণে আরো ভালো করার সুযোগ ছিল। বিজ্ঞানের বইতে চিত্র একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, শুধুমাত্র অলঙ্করণ নয়। এইটুকু বাদ দিলে প্রকাশনাটি প্রশংসনীয়।

                                                              গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, জুন ২০১৮