শেক্সপিয়র
থেকে বিটোভেনের দেশে
প্রথম পর্ব
শম্পা
গাঙ্গুলী
ভিসা অফিসে আমার আর
গৌতমের অ্যাপয়েন্টমেন্ট সকাল সাড়ে দশটায়। বজবজ স্টেশনে গিয়ে দিশেহারা অবস্থা।
ট্রেন বন্ধ, তার ছিঁড়েছে। তখন প্রায় নটা বাজে। রাস্তা লোকে লোকারণ্য। গাড়ি-ঘোড়া পাওয়া শক্ত, পেলেও ওঠা কঠিন।
অটোয় চেপে তখন আমরা একটা ট্যাক্সি পাওয়ার আশায় মরিয়া। বাটা থেকে জিঞ্জিরাবাজার পর্যন্ত ওভারব্রিজের কাজের জন্য তলার সড়ক পথের
চড়াই-উৎরাই, আধঘণ্টার পথ দেড় ঘণ্টায় অতিক্রম -- এসব আমাদের সে যুগের ঘোড়ায় টানা রথে চড়ার সুখ এনে দিল। সারথি অবশ্য আমাদের
আশ্বস্ত করল, একটা ট্যাক্সি ধরিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত তার রথ আমাদের গন্তব্যের দিকে
অবিচলভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
শুভদা আর অর্পিতাদি। ইংল্যান্ড সফরে আমাদের সঙ্গী। ওদের ভিসা অফিসে যাবার
সময়টা আরও ঘণ্টা দুয়েক পরে। ট্রেন বিভ্রাটের আগাম পূর্বাভাস ওদের খানিক সতর্ক
করলেও ভোগান্তি হল প্রায় একই। ইংল্যান্ড যাত্রার আগে ভিসা পাওয়া নিয়েও সকলকেই বেশ
ভুগতে হল। আমাদের চারজনের কাছেই ভিসা অফিস থেকে পরপর ই-মেল এলো, প্রায় কোনো কাগজই ইংল্যান্ডের
অফিসে পৌঁছায়নি। অগত্যা আবার সব ডকুমেন্ট স্ক্যান
করে ই-মেল কর। আমাদের বেড়ানোর নীল নক্সা অনেক দিন আগেই ছকা হয়ে গেছে। ইংল্যান্ডে লন্ডন
শহর ও স্ট্রাটফোর্ড-আপন-এভন ধরে চারদিন। তারপর যাব স্কটল্যান্ড। শুভায়ুর বাড়িতে। সেখানে তিন দিন তার আতিথেয়তায় না
থাকলে আমাদের বন্ধু ডাক্তারটি ভয়ানক চটবে। স্কটল্যান্ডের পরে প্যারি। সেখানে আরও
তিন দিন কাটিয়ে শুভদারা ফেরত আসবে। আমি আর গৌতম প্যারি থেকে যাব বেলজিয়ামের
রাজধানী ব্রাসেলস। পাপান, আমাদের ছেলে ওখানে আমাদের সাথে সফর সঙ্গী হবে। সেখানে
দুদিন ঘোরার পরে আমাদের পরবর্তী গন্তব্য জার্মানির বন শহর। পাপান ওখানেই থাকে, পাশের শহরে কোলন
বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় এম এস সি করছে। আরো দিন পাঁচেক কাটিয়ে তারপর কলকাতায়
ফেরা।
এবারের ইয়োরোপ ভ্রমণের জন্য আমি স্কুলের পুরো গরমের ছুটিটাই
রেখেছি। সেজন্য প্রস্তুতিও বিস্তর। কলকাতায় মে মাস আর ইংল্যান্ডের বা জার্মানির মে
মাস, তফাৎ অনেক। ওখানে ঐ সময় যখন তখন বৃষ্টির সম্ভাবনা। আর বৃষ্টি মানেই প্রচণ্ড
ঠাণ্ডা। তাই প্রত্যেকের উইন্ডচিটার আর ভাল মতো গরম পোশাক আবশ্যক। তাই যাওয়ার আগে
একসঙ্গে দফায় দফায় মিটিং, ইটিং আর মার্কেটিং। কিছু কিছু মিউজিয়ামের অগ্রিম টিকিট, হোটেল
বুকিং, একটা শহর থেকে অন্য শহরে যাবার ট্রেন বা বাসের টিকিট অগ্রিম কাটা। যাত্রার
দিন প্রায় এগিয়ে আসছে। ইংল্যান্ডের ভিসা না পেলে ফরাসি ভিসার জন্য আবেদন করাই যাবে
না। অথচ ইংল্যান্ডের ভিসার কোনো খবরই নেই। অনেকদিন আগে থেকেই শুভদা গৌতমকে বলে
রেখেছিল শেক্সপিয়রের জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ড-আপন-এভন জীবনে একবার উনি যদি না দেখেন
তাহলে ইংরাজির শিক্ষক হিসাবে নিজেকে ব্যর্থ মনে করবেন। শুভদার শেক্সপিয়রের প্রতি
এই গভীর শ্রদ্ধাই আমাদের ইংল্যান্ডে যাবার কথা ভাবিয়েছে। এদিকে প্লেনের আর মাত্র
দিন পনের বাকি। কোনো ভিসাই হয়নি জটিল ভিসা জটে। যাওয়া হচ্ছে না এমনটাই
মনে হল। শুভদা তো মুখ কালো করে লোকজনের সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিল। অবশেষে মেঘ
কাটল। আংশিক। ইংল্যান্ড-এর ভিসা যাও বা পাওয়া গেল যাবার মাত্র দশ দিন আগে, সমস্যা
হল ফ্রান্সের ভিসায়। শুভদার পাসপোর্টে কিছু গণ্ডগোল ছিল, সেটা আগেই ঠিক করে
নিয়েছিল। ব্রিটিশ কনসুলেট সেটা মেনে নিলেও ফরাসি
ভিসা অফিস তা মানল না। প্যারি ভ্রমণে আমরা একসঙ্গে থাকব
না, এটা ভেবেই খুব মন খারাপ হল। শুভদাও বেশ ভেঙে পড়ল। সান্ত্বনা একটাই। শেক্সপিয়রের
দেশে শুভদাদের সঙ্গে আমরা পাড়ি দিচ্ছি অবশেষে।
২১ মে, ২০১৭। মাঝরাতে বজবজ থেকে
রওনা। বড় একটা টাটা সুমো গাড়িতে আমরা মাত্র চারজন। বেড়িয়ে ফেরার প্রায় মাস চারেক
পর শুভদা বলেছিল, সেদিন গাড়িতে চড়ার পরে টানা একঘণ্টা আমরা নাকি কেউ কারোর সঙ্গে
একটাও কথা বলিনি। মনে হয় যাওয়াটা যে হচ্ছে সেটাই অবিশ্বাস্য ঠেকছিল। আমার অবশ্য
গলার একটা সমস্যার জন্য কথা বলা তখন বারণ ছিল, অন্যদের কথা বলতে পারব না। জেট
এয়ারওয়েজের প্লেন, ২২শে মে ভোর ৫টা ৩৫মিনিটে। কলকাতা থেকে মুম্বাই। সেখান থেকে
ব্রিটেনের প্লেন সকাল সাড়ে এগারোটায়। লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে নামলাম তখন ওখানকার সময় সন্ধে সাড়ে
সাতটা।
লন্ডন বেসিন ইংল্যান্ডের দক্ষিণ পূর্ব কোণে টেমস নদীর পাড়ে
মোহনার কাছে। স্কুলের পাঠ্য বইতে পড়েছি। সেখানে সত্যিই যাচ্ছি। পূর্ব-পশ্চিমে
লম্বাটে সরার মত আকৃতি । চক, নানা ধরণের বেলেপাথর, লন্ডন
ক্লে নামক কাদাপাথরে তৈরি হয়েছিল, সেই প্যালিওসিন-ইওসিন যুগে। চারপাশে ঘিরে আছে
স্বল্প উচ্চতার ভৃগু বা এস্কার্পমেন্ট, যেগুলো ঢালু হয়ে নেমে এসেছে বেসিনের দিকে।
টেমস নদী এই বেসিনের মাঝখান দিয়ে পশ্চিম থেকে পুবে বয়ে গেছে নর্থ সি-র দিকে।
ব্যস্ততা আর বসতির ঘনত্বের নিরিখে লন্ডনের কেন্দ্র থেকে পরপর
অনেকগুলি জোন গড়ে উঠেছে। এক থেকে ছ’নম্বর জোন পর্যন্ত বৃত্তাকার, জোন-১ হল একদম
কেন্দ্রে। পরের তিনটে জোন আর বৃত্ত নয়, উত্তরপশ্চিম কোণে ত্রিভুজ আকারে। হিথরো
এয়ারপোর্ট ছ’নম্বর জোনে, সেখান থেকে হিথরো
কানেক্ট ট্রেনে পিকাডেলি লাইন ধরে এক ঘণ্টা পরে প্যাডিংটন স্টেশনে নামলাম। গুগল
ম্যাপে জিপিএস-এ দেখাচ্ছে অ্যাপার্টমেন্ট স্টেশন থেকে হাঁটা পথ। ঘর বুকিং করেছিলেন হরজিৎ নামে একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের মেয়ে। ওনারা বহু বছর
ধরে ইংল্যান্ডে আছেন। হরজিতের কথায় পরে আসছি। যে ঠিকানা আমরা পেয়েছিলাম, সেটা ছিল অসম্পূর্ণ।
ফলে স্টেশন থেকে বেরিয়ে অ্যাপার্টমেন্ট খুঁজে পেতে আমাদের আরও এক ঘণ্টা লেগে গেল।
ভারি ভারি লাগেজ নিয়ে একেবারে নাজেহাল। অবশেষে বাড়ির
ম্যানেজারকে ফোনে পেয়ে আর এক বয়স্ক পথচারীর সহায়তায় গন্তব্যে পৌঁছলাম। অ্যাপার্টমেন্টটা
বিশাল, কিচেন সমেত মোট তিনটে বড় বড় ঘর। একটা কথা জানাই, একবেলাও অন্তত রান্না করে
খেতে পারলে বিদেশ ভ্রমণের খরচ অনেকটা কম হয়। এ অভিজ্ঞতা আমার আগে হয়েছে গৌতমের
সঙ্গে ঘুরে। তাই আমরা এই ট্রিপেও ঘর ভাড়া কিছু বেশি পড়লেও কিচেনেট সহ ঘর নিয়েছি সব
জায়গায়। ব্রেকফাস্ট আর ডিনার ঘরেই সারতাম। তাই সেদিন পৌঁছেই ডিনারের তোড়জোড় শুরু করলাম।
ব্যাগ হাতে গৌতম গেল বাজারে মানে কাছের সুপারমার্কেটে।
যাবার আগে নেট ঘেঁটে হোমওয়ার্ক আমি আর গৌতম ভালই করেছিলাম। পরদিন
সকালে গৌতম আর শুভদা প্যাডিংটন স্টেশন থেকে সারাদিন ঘোরার পাস কিনে আনল। দাম
ভালোই, এক একজনের জন্য সাড়ে বারো পাউন্ড। তাতে সারাদিন সুড়ঙ্গের টিউব (জোন-১ থেকে ৩ অবধি) বা শহরের মধ্যেকার যে কোনো
বাস সবই যতবার খুশি চড়া যাবে। এছাড়া এতে আছে টু ফর ওয়ান-এর সুবিধা। মানে অনেক
দ্রষ্টব্য স্থানে একজনের টিকিটে আরেকজনের ফ্রি।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবের দিকে রওনা দিলাম।
এই অ্যাবে হল ব্রিটেনের এক ঐতিহাসিক চার্চ যেখানে বহু বিশিষ্ট মানুষের সমাধি রয়েছে। হয়েছে অনেক রাজা ও রাণীর অভিষেক। কিন্তু হতাশ হলাম।
সেদিন ওটা বিশেষ কারণে বেলা আড়াইটেতে খুলবে। হাঁটতে হাঁটতে ওয়েস্টমিনিস্টার
রাজপ্রাসাদের উত্তর প্রান্তের বিখ্যাত বিগ বেনের কাছে গেলাম। বিশাল ঘড়িটা নয় কিন্তু, আসলে তার পেল্লাই সাইজের ঘণ্টাটার ডাক নাম বিগ বেন।
বিগ বেন |
পার্লামেন্ট ভবন চত্বরে একটা সুউচ্চ টাওয়ারের ওপরের দিকের
চারদিকের দেওয়ালে চারটে বিশাল বিশাল ঘড়ি যাদের বহু দূর থেকে দেখা যায়। পাশেই টেমস
নদী। (আমাদের কলকাতার লেকটাউনের মোড়েই একটা বিগ বেনের ছোটো রেপ্লিকা আছে না!) লন্ডনের প্রথম কমিশনার স্যার বেঞ্জামিন হল, তাঁর
নাম অনুসারে ঘণ্টাটার নামকরণ। উল্টোদিকের রাস্তা থেকে
এই ছিয়ানব্বই মিটার উচ্চতার ক্লক টাওয়ারটা ঘাড় উঁচু করে খানিক সময় ধরে দেখলাম। কলকাতার শহিদ মিনারের থেকে দ্বিগুণ উঁচু।
বিগ বেন দেখে আমরা এগোলাম সেই বিখ্যাত নদী টেমসের পাড়ে। পৃথিবীর
ব্যস্ততম নদী বন্দর। নর্থ সি-তে মেশার আগে নদীটা ফানেলের মতো ক্রমশ চওড়া
হয়ে শহরের দক্ষিণ পূর্বে বাঁক নিয়েছে। নদীর ওপারে লন্ডন আই দেখা যাচ্ছে। একশ পঁয়ত্রিশ
মিটার উঁচু গগনচুম্বী এই ইলেকট্রিক নাগরদোলায় চাপলে নাকি সারা লন্ডন শহর দৃশ্যপটে
আসে। কিন্তু আমাদের হাতে সময় কম, আর টিকিটও আগে কাটা হয়নি।
তাই নদীর দক্ষিণ পাড়ের লন্ডন আইকে ব্যাকগ্রাউণ্ডে রেখে উত্তর পার থেকে ছবি তোলা।
লন্ডন আইয়ের সামনে শুভদা- অর্পিতাদি |
ওয়েস্টমিনিস্টার ব্রিজে উঠে টেমসের বুকে ব্যস্ততা চোখে পড়ল। সামনে নদীর বুকে অসংখ্য জলযানের সমাগম। ব্রিজের একপাশে লন্ডন আই এর বিশাল উঁচু ঘূর্ণি চক্র, অন্যপাশে পার্লামেন্ট স্কোয়ারের অসংখ্য অফিস, আদালত, বিগ বেন ও অন্যান্য প্রাসাদ। শুভদা মনে করাল প্রায় দুশো বছর আগে এই ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ওয়ার্ডসওয়ার্থ “Composed Upon Westminister Bridge” কবিতাখানা লিখেছিলেন।
The City now doth, like
a garment, wear
The beauty of the
morning; silent, bare,
Ships, towers, domes,
theatres, and temple lie
Open unto the fields,
and to the sky
….. Ne’er saw I , never
felt, a calm so deep!
The river glideth at
his own sweet will:
ওয়েস্টেটমিনিস্টার ব্রিজ থেকে টেমস |
এখন সেই খোলা প্রান্তর, নিস্তব্ধতা, জনমানবশূন্য পরিবেশ নেই।
সকালের সূর্যের নরম আলোয় শহরটা আজও ঢেকে যায়---একই ভাবে। কিন্তু সেই প্রশান্তির আবরণে
গভীর অনুভূতিটুকু চারদিকের অস্থিরতায় খুঁজে পায় কি এযুগের কবি মন? আমরা যেদিন লন্ডনে
পৌঁছলাম, ২২ মে ২০১৭, সেদিনই তো ম্যানচেস্টারে এক আত্মঘাতী মানববোমা আরিয়ানা গ্র্যান্ডের
একটি মিউজিক কন্সার্টে তেইশটি তাজা প্রাণ কেড়ে নিলো। আরও আছে। বেড়িয়ে তখনও ফেরত
আসিনি। ছেলের সাথে বেলজিয়ামে ছিলাম। শুনলাম, লন্ডন ব্রিজে সন্ত্রাসবাদীর গাড়ি বেশ
কয়েকজন নিরীহকে চাপা দিয়েছে। এসব নিত্য ঘটনা আমাদের যেন গা সওয়া। উদগ্রীব শুধু
নিজের বা নিকটজনের প্রাণটুকু নিয়ে। এযুগের কবি মনেও এসবের ছায়া পড়ে বৈকি! তবে সেটা
প্রশান্তির নয়, অশান্তির।
বাকিংহাম প্রাসাদে যাব। পার্লামেন্ট স্কোয়ারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার
রাস্তাটা চমৎকার, সেন্ট জেমস পার্কের মধ্যে দিয়ে। প্রাসাদের সামনে সাতান্ন একর আয়তনের বড় পার্কটা
সুসজ্জিত। মাঝ বরাবর বিশাল দিঘি। রবিন,
ব্ল্যাক বার্ড, ওয়াটার ফাউল, পেলিক্যান পাখির দলের জলকেলি; তীরে এসে মাঝে মধ্যে
ভ্রমণ পিপাসুদের সাথে সেলফি তোলাতেও যেন আপত্তি নেই। পার্কটা ঘুরলাম আমরা দু-দলে
ভাগ হয়ে, জোড়ায় জোড়ায়। আমি আর গৌতম পুরো পার্কটা চক্কর
দিলাম। এক জায়গায় দেখি অজানা সৈনিকদের শহিদ বেদী। তার পিছনে বিশাল খোলা চত্বর হর্স
গার্ডস প্যারেড । সুসজ্জিত ঘোড়ার পিঠে ঝকমকে পোশাকে
সিপাহীর দল সেখানে কুচকাওয়াজ করছে। খুব ভিড়। দূর থেকেই দেখলাম।
সেন্ট জেমস পার্কের ভিতরে |
বাকিংহাম প্রাসাদে বিভিন্ন দিক দিয়ে ঢোকার জন্য মূল ফটকের আগে
সুন্দর সুন্দর সব সেরিমোনিয়াল গেট আছে। সাউথ অ্যান্ড ওয়েস্ট আফ্রিকা গেট, কানাডা গেট আর
অস্ট্রেলিয়া গেট। আমরা অস্ট্রেলিয়া গেট দিয়ে প্রাসাদ চৌহদ্দিতে ঢুকলাম। সামনেই মূল
প্রাসাদ। প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। লন্ডনের রাজা, রাণী ও তাঁদের
পরিবারের বর্তমান বাসস্থান। ‘কুইন্স গ্যালারী’ বাদে অন্যত্র সাধারণের প্রবেশ
নিষিদ্ধ। বাকিংহামের ডিউকের জন্য ১৭০৩ সালে এটি তৈরি হয়েছিল। এর ষাট বছর পর রাজা তৃতীয় জর্জ এই এস্টেটটি কিনে নেন ও তাঁর স্ত্রী শার্লটকে
নিয়ে থাকতে শুরু করেন। ১৮৩৭ সালে যখন রাণী ভিক্টোরিয়ার অভিষেক হয় তখন সাময়িক ভাবে
এই প্রাসাদের নামকরণ করা হয় ‘রাণীর বাড়ি’।
প্রতি সোম, বুধ, শুক্রবার এই প্রাসাদের সামনে সকাল সাড়ে এগারটায় গার্ড পরিবর্তন
দেখার জন্য বহু পর্যটকের সমাগম ঘটে। কিন্তু সেদিন মঙ্গলবার, তাই দেখা হল না। আগে ২০১৫
সালে ইতালিতে ভ্যাটিকানের সামনে বিখ্যাত সুইস সেনার ‘চেঞ্জ অফ গার্ড’ বর্ণাঢ্য
অনুষ্ঠান দেখেছিলাম।
বাকিংহাম প্যালেসের সামনে দর্শনার্থীদের ভিড় |
বেশ খানিকটা সময় বাকিংহাম প্যালেসের সামনে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল
চত্বরে কাটালাম। ১৮৩৭ থেকে ১৯০১ রাণী ভিক্টোরিয়ার রাজত্বের এই সময়কালকে ইংল্যান্ডের
স্বর্ণযুগ মনে করা হয়। তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পর ১৯১১ সালে বিরাশি ফুট উঁচু সাদা
মার্বেলের এই স্মৃতিস্তম্ভ প্রতিষ্ঠা করা হয়। বৃত্তাকার মনুমেন্টের অন্য দিকগুলোতে
ন্যায়, সত্য ও দানশীলতার প্রতীক রূপে দেবদূতদের মূর্তি খোদাই করা আছে। মনুমেন্টটির
চূড়ায় আছে জয়ের প্রতীক স্বরূপ সোনার গিল্টি করা ‘উইংড ভিকট্রি’। তাকে ঘিরে আছে সাহসিকতা ও দৃঢ়তার প্রতীক দুটি
মূর্তি। মহারাণীর সময়কালে সমুদ্রপথে বাণিজ্যে আর ঔপনিবেশিক রাজত্বে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের
বিস্তার ঘটেছিল সবচেয়ে বেশি। নৌশক্তি ছিল দেশের
প্রতিরক্ষার এক বিরাট সহায়। তাই সেই স্মৃতিতে আশপাশটা ভরিয়ে তুলেছে অসাধারণ কিছু মৎস্য-কন্যা
ও সামুদ্রিক প্রাণীর মূর্তি। নৌশক্তির চিহ্ন ধরা আছে জাহাজের সম্মুখভাগের প্রতিরূপ
খোদাই কাজে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কেন্দ্রের এই স্তম্ভের আশপাশে কিছু ব্রোঞ্জের
মূর্তি আছে, সেগুলো শান্তি, অগ্রগতি, কৃষি ও শিল্পের প্রতীক।
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল |
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখে আমরা যখন বেরিয়ে যাচ্ছি, তখন দেখি
প্রাসাদের সামনে দিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে এক সুসজ্জিত শোভাযাত্রা আসছে। রাজা রাণীর দেশে এসেছি বলে কথা! চট করে এমন
শোভাযাত্রা দেখার সৌভাগ্য হয় না। ‘চেঞ্জ অফ গার্ড’ দেখা না হলেও শোভাযাত্রাটা মন
ভরে দেখলাম। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কি!
বাকিংহাম প্যালেসের সামনে শোভাযাত্রা |
প্রাসাদের বিশাল চত্বর থেকে বেরিয়ে বাসে চেপে কেনসিংটন প্যালেস। সপ্তদশ
শতক থেকে ব্রিটিশ রাজপরিবারের আবাসস্থল। বিশাল কেনসিংটন বাগানের ভিতরে এই প্রাসাদ।
বর্তমানে এর অনেকটা অংশই খুলে দেওয়া হয়েছে সাধারণ দর্শকদের জন্য। সাজানো বাগানে
ছিল বিশাল বিশাল কাঠবিড়ালি, অত বড় কাঠবিড়ালি আগে কখনো দেখিনি। অর্পিতাদি ক্লান্ত
হয়ে বাগানের চেয়ারে গা এলিয়ে দিল। বাগানের শোভা আর কাঠবিড়ালি দেখে মন ভরাবে
সিদ্ধান্ত নিলো। প্রাসাদমুখো হল না। ইন্টারনেটে
পড়েছিলাম এখানে টু ফর ওয়ানের সুযোগ আছে, কিন্তু ওদের ছাপা লিস্টে নেই। সেই কথা বলাতে কিন্তু কাউন্টারের কর্মচারীরা ফোন করে
জেনে আমাদের সুবিধাটা পাইয়ে দিল। এক একটা টিকিটের দাম সতেরো পাউন্ড, অর্থাৎ হোমওয়ার্ক
করে যাওয়ার ফলটা আমরা হাতেনাতে পেয়েছিলাম। যদিও অর্পিতাদি বাইরেই রয়ে গেল। প্রাসাদে বিভিন্ন সময়কার রাজা রাণীর ব্যবহার্য পোশাক, অস্ত্র, আসবাব, বর্ম
ইত্যাদি রাখা আছে। বিশেষ করে রাণীদের ঘরগুলো দ্বিতীয় মেরী ও রাজাদের ঘরগুলো
দ্বিতীয় জর্জের আমলের মত করে সাজানো। নিচে প্রিন্সেস ডায়নার
ঘরে জাপানি দর্শকদের এত ভিড় যে আমরা ঢোকার সুযোগই পেলাম না।
কিংস গ্যালারি, কেনসিংটন প্যালেস |
বাইরের হোটেলে লাঞ্চ সেরে ডবলডেকার বাসে করে কলকাতাসম জ্যাম ঠেলে
ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যখন পৌঁছলাম তখন প্রায় দুপুর তিনটে। সামারে এই মিউজিয়াম সাড়ে
পাঁচটায় বন্ধ। টিকিট লাগে না, কিন্তু সিকিউরিটি চেকিংয়ের বিশাল লাইন। অত বড় মিউজিয়াম এত অল্প সময়ে দেখতে হলে কিছু ঘর বেছে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমরা আবার দুটো দলে ভাগ হয়ে নিজেদের পছন্দ মতো ঘরে
ঘুরতে লাগলাম। এত কিছু দেখেছি সব মনেও নেই, লেখাও সম্ভব নয়। কয়েকটার কথাই বলি।
রসেট্টা পাথর |
ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের মূর্তি |
প্রথমে গেলাম ইজিপ্ট ও ব্যাবিলন গ্যালারিতে। ঢুকেই চোখে পড়ল
ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের বিরাট আবক্ষ মূর্তি। কাছেই ছিল সেই বিখ্যাত রসেট্টা পাথর।
এর ওপর প্রাচীন গ্রিক ভাষা এবং প্রাচীন মিশরের দুটো ভাষাতে ১৯৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে
একটা আদেশনামা খোদাই করা হয়েছিল --- মিশরের মেমফিসের পুরোহিতরা ফারাও পঞ্চম
টলেমিকে দেবতা বলে ঘোষণা করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিক লিপি পণ্ডিতরা পড়তে পারতেন,
কিন্তু প্রাচীন মিশরীয় লিপি তাঁদের অজানা ছিল। এই পাথরে যেহেতু একই আদেশনামা দুটো ভাষায় লেখা ছিল, তাই গ্রিক লিপির মাধ্যমে তাঁরা
মিশরীয় চিত্রলিপিগুলি পড়তে শেখেন। মিশরের সর্বপ্রাচীন চিত্রলিপি বা হায়ারোগ্লিফের
এইভাবে আজকের যুগে পাঠোদ্ধার হয় এবং তার থেকে অন্যান্য প্রাচীন লিপিগুলো পড়া সম্ভব
হয়। রসেট্টা পাথরকে এজন্য প্রাচীন মিশর সভ্যতার চাবিকাঠি বলা হয়।
ফারাও দ্বিতীয় রামেসিসের মূর্তির সামনে লেখিকা |
চোখে পড়ল আসিরীয় সম্রাট দ্বিতীয় আসুরনাসিরপালের নিমরুদের
প্রাসাদের ডানাওয়ালা সিংহের মূর্তি। এরা নাকি সম্রাটকে দৈত্যদানবের হাত থেকে
বাঁচাত। ফারাও তৃতীয় আমেনহোটেপের দুটি মূর্তিই চোখ টেনে নেয়। এগিয়ে যেতে যেতে আমরা
প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সভ্যতায় ঢুকে পড়লাম। রয়েছে বিরাট একটা সমাধি মন্দির। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক সভ্যতার প্রাচীন এই
নমুনাটাকে তুরস্কে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। সেখান থেকে পুনরুদ্ধার করে পুরোপুরি নতুন
করে বসানো হয়েছে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে। গ্রিক-রোমান সভ্যতার
আরও অনেক মূর্তি ভারি সুন্দর। যেমন রয়েছে হারকিউলিস, হার্মেস, বা প্রেমের গ্রিক
দেবী আফ্রোদিতি --- যাঁর রোমান নাম ভেনাস আমাদের বেশি চেনা।
খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের গ্রিক সমাধি মন্দির |
ভেনাস মূর্তি |
গ্রিক, রোমান, মিশর, আসিরীয়, ব্যাবিলন সভ্যতার কথা আমরা তো জানি।
কিন্তু অবাক করে দেয় আফ্রিকা, আমেরিকা, জাপান, চীন, মেসোপটেমিয়া, ইজরায়েল তথা আরও
নানান দেশের নিদর্শনগুলির সংগ্রহ। মনে পড়ছে মধ্য-আমেরিকার আজটেক সভ্যতার দুমুখো সাপ। নিখুঁত
ভাবে তৈরি হয়েছে কাঠ, পাইন রজন আর নীলকান্ত মণি দিয়ে। অনুমান করা হয় এটি
পুনর্জন্মের প্রতীক।
মেরিন ক্রোনোমিটার |
অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগের নিদর্শনের মধ্যে দেখেছিলাম প্রথম যুগের মেরিন
ক্রোনোমিটার। সমুদ্রপথে দ্রাঘিমা নির্ণয় করতে অমূল্য ভূমিকা নিয়েছিল এই ঘড়ি। জাহাজ
চালনাতে যুগান্তর এনে তা ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের সহায়ক হয়ে উঠেছিল। দেখলাম
অ্যস্ট্রোলেব যন্ত্র যার সাহায্যে প্রাচীনকালে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করা
হত। ইশতারের মূর্তি গিলগামেশের গল্পটা মনে করাল। প্রাচীন
মেসোপটেমিয়ার মহাকাব্যের নায়ক গিলগামেশকে বিয়ে করতে চেয়েছিল দেবী ইশতার। রাজি না
হওয়ায় ইশতার তাকে নানাভাবে হত্যার চেষ্টা করে। কিন্তু গিলগামেশ সব চেষ্টাই ব্যর্থ
করে দেয়। খ্রিস্ট জন্মের দুহাজার বছর আগে রচিত এই গিলগামেশের মহাকাব্যকেই পৃথিবীর
প্রাচীনতম সাহিত্য ধরা হয়।
ইশতারের মূর্তি |
ইস্টার আইল্যান্ডের মূর্তি |
দক্ষিণ-পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে চিলির থেকে সাড়ে তিন হাজার
কিলোমিটার দূরে এক প্রত্যন্ত দ্বীপ ইস্টার আইল্যাণ্ড। এর দুহাজার কিলোমিটারের
মধ্যে কোনো মানুষ বাস করে না। অথচ এই দ্বীপে আছে কয়েকশো বিরাট বিরাট মূর্তি। ব্যাসল্ট পাথরের এই বিশালাকার মাথাগুলোর গড় উচ্চতা চার মিটার আর ওজন
চোদ্দ টন। এগুলো যারা বানিয়েছিল সেই উপজাতি আজ পৃথিবী থেকে লুপ্ত। কেনই বা
বানিয়েছিল, সেই রহস্যময় ইতিহাসটাও অজানা। মূর্তিগুলোর একটা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে
রাখা। আফ্রিকার নাইজেরিয়া থেকে পাওয়া ষোড়শ শতকের অলঙ্কৃত কাঠের ফলক, জাপানের
যোদ্ধা সামুরাইদের মূর্তি ও বর্ম, ভারতের দেবদেবী ও বুদ্ধের মূর্তি, মানুষ ও পশুর
অসংখ্য মমি -- কত আর লিখব? একটা বিখ্যাত দ্রষ্টব্যের কথা বলেই ব্রিটিশ মিউজিয়াম
থেকে বিদায় নেব। প্রাচীন একটা জাহাজ ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের কাছে সমুদ্রে ডুবে গিয়েছিল। ১৯৩৭ সালে সেটি উদ্ধার করা হয়। এত বছর পরেও তার থেকে
প্রায় অবিকৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে বহু স্বর্ণালঙ্কার, রৌপ্য পাত্র, মূল্যবান শিরস্ত্রাণ
ইত্যাদি।
ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে উদ্ধার হওয়া শিরস্ত্রাণ |
সন্ধেবেলায় ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে সবাই মিলে হাতে হাত লাগিয়ে গল্প
করতে করতে রান্না সারলাম। পরেরদিন সকালে পূর্ব পরিকল্পনা মাফিক আমরা যাব শুভদার
সেই বহু আকাঙ্ক্ষিত শেক্সপিয়রের জন্মভিটেতে। আমরা
যেদিন লন্ডন রওনা দিয়েছিলাম তার পরের দিন আমাদের বহুদিনের বন্ধু টুনুদি তার ছেলে চিরঞ্জিত
আর মেয়ে প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে নিজের ব্যবসার কাজে একসঙ্গে রথ দেখা ও কলা বেচা করতে লন্ডনে
গিয়েছিল। টুনুদির কলকাতায় হারমোনিয়াম, গিটার এই সমস্ত বাজনার দোকান। ব্যাবসার কাজে দেশের অনেক জায়গায় যাতায়াত। কিন্তু
এবার একেবারে লন্ডনে। ওরা ওখানে আতিথেয়তা পেয়েছিল হরজিৎ
শাহ নামে একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের বাড়িতে, লন্ডনের উপকণ্ঠে হেইস এন্ড হার্লিংটনে। তাঁরও ঐ একই ব্যবসা পৃথিবীব্যাপী, সেই সূত্রেই টুনুদির সঙ্গে আলাপ। আমাদের পরিকল্পনা শুনে আমরা কলকাতা ছাড়ার আগেই ভদ্রলোক প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে
টুনুদিরা, আমরা এবং ওনার পরিবারের সকলে মিলে একসঙ্গে শেক্সপিয়রের জন্মস্থানে যাওয়া
যেতে পারে। তার জন্য একটা পনেরো সিটারের গাড়ি
উনি ব্যবস্থা করে রাখবেন। আমরা তো আহ্লাদে আটখানা। বিদেশে গিয়ে একশো ষাট কিলোমিটার
দূরের অজানা জায়গায় সারাদিনের জন্য ঘোরার যাবতীয় ব্যবস্থা করা সহজ কথা নয়। উনি
সমস্ত ব্যবস্থা করেছেন।
সেদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে প্যাডিংটন স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে আমাদের
যেতে হল হেইস এন্ড হার্লিংটন স্টেশনে। সেখান থেকে উনি গাড়ি করে ওনার বাড়ি নিয়ে
গেলেন, যেখানে আগে থেকেই টুনুদিরা আছে। আমরা এগারো জনের একটা দল পিকনিক করার
মেজাজে হৈ হৈ করতে করতে শহর ছেড়ে পাড়ি দিলাম লন্ডনের উত্তর-পশ্চিমের কোলাহল বিহীন,
দূষণমুক্ত, প্রাকৃতিক মনোমুগ্ধকর শোভায় ভরা শেক্সপিয়রের দেশে।
এ্যানি হ্যাথওয়ের কুটিরের সামনে |
স্ট্রাটফোর্ড শহরের উপকণ্ঠে ছোট্ট নদী শটারির তীরে এ্যানি
হ্যাথওয়ের কুঁড়েঘর। বন্ধূর ভূপ্রকৃতির অরণ্যঘেরা উপত্যকায় নিবিড় প্রশান্তি নিয়ে
দাঁড়িয়ে আছে। শেক্সপিয়রের থেকে আট বছরের বড় ধনী কৃষকের মেয়ে এ্যানি হ্যাথওয়েকে
তিনি বিয়ে করেন ১৫৮২ সালে। তাঁদের বিবাহিত জীবনে তিনটি সন্তান ছিল। জায়গাটা ঘুরে
দেখার পর বাগানের মধ্যে গাড়িতে বসেই আমরা খাওয়া দাওয়া সারলাম। আমার খুব ইচ্ছে
করছিল বাগানের লনে বসে গাছের ছাওয়ায় যদি পিকনিক করা যেত; কিন্তু আশপাশের পরিবেশ
বিঘ্নিত হবে ভেবে মনের ইচ্ছা মনেই রাখলাম। হরজিতের স্ত্রী আর বৌদি মিলে আমাদের
খাবার-দাবার সকালে বাড়ির থেকে বানিয়েই এনেছিলেন।
শেক্সপিয়রের বাড়ির সামনে |
পরের গন্তব্য অ্যাভন নদীর তীরে স্ট্রাটফোর্ড, ১৫৬৪ সালে যেখানে
জন্মেছিলেন ইংরাজি তথা পৃথিবীর সর্বকালের দিকপাল সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্সপিয়র। ঊনবিংশ
শতকের গোড়ায় তাঁর বাড়িটি নষ্ট হতে চলেছিল ও বিক্রি হয়েই যাচ্ছিল। কিন্তু জাতীয় আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ প্রচেষ্টায় ১৮৬০ সালে বাড়িটি সঙ্গরক্ষণ করা সম্ভব হয়। তাতে চার্লস ডিকেন্সের ভূমিকা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি অন্যান্য সাহিত্যিকদের সঙ্গে নিয়ে ইংল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে অপেশাদার
নাটক মঞ্চস্থ করে প্রায় তিন হাজার পাউণ্ড সংগ্রহ করেন ও বাড়িটা বাঁচাতে সফল হন। এখনো ষোড়শ শতকের ইংল্যান্ডে উপকণ্ঠের একটা গ্রামের
মত করে সাজানো আছে পুরো পরিবেশটা। শেক্সপিয়রের ছেলেবেলা কেটেছিল যেখানে সেই কাঠের
বাড়িটা এখন ঐতিহ্যমণ্ডিত মিউজিয়াম। আমরা যার যার নিজের মতো করে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম।
শেক্সপিয়রের জন্মস্থানের ভিতরে |
ঘরগুলোর সমস্ত কিছু যেমন -- পালঙ্ক, বালিশ, কম্বল, জামাকাপড়,
আসবাব পত্র সেই সময়ের মতো করে সাজানো আছে। এমনকি ফায়ার প্লেসের পাশে রাখা ডাইনিং
টেবিলে ব্রেকফাস্টের খাবারদাবার আর পাত্র গুলো এমনভাবে রাখা, যেন মনে হবে এক্ষুণি
কেউ খেতে বসবে। শেক্সপিয়রের বাবার চামড়ার ব্যবসা ছিল। তখনকার দিনে ঘরোয়া পদ্ধতিতে
ভেড়া, কুকুর, ছাগল, হরিণের কাঁচা চামড়া ট্যান করা হত। তার যাবতীয় সরঞ্জাম আর ট্যান
করা চামড়া দেওয়ালে টাঙানো আছে। নরম মোমবাতির আলো, অখণ্ড নিস্তব্ধতার মাঝে কাঠের
মেঝেতে আমাদের পদশব্দ, প্রতিটি ঘরে সেই যুগের পোষাকে দাঁড়িয়ে থাকা ডেমন্সট্রেটরের
ভারি গলায় প্রেক্ষাপট বর্ণনা সত্যিই সেদিন আমাদের ষোড়শ শতকের ইংল্যান্ডের নিরিবিলি
শহরতলিতে নিয়ে গিয়েছিল। নীচে নেমে পেছনের বাগানে দেখি খোলা আকাশের নীচে সেজেগুজে
অল্পবয়সী কিছু ছেলে মেয়ে শেক্সপিয়রের কোনো নাটকের অংশ মঞ্চস্থ করছে। তাদের ঘিরে
উৎসাহী দর্শকের ভিড়। দর্শক যেমন ফরমায়েশ করছে তারা সঙ্গে সঙ্গে সেই নাটকের কোনো
সংলাপ অভিনয় করে দেখাচ্ছে। গৌতম অনুরোধ করল
‘জুলিয়াস সিজার’ নাটক থেকে কোনো অংশ অভিনয় করতে। মুহূর্তের মধ্যে এক সুবেশিনী নাটক
থেকে অ্যান্টনির বিখ্যাত সেই বক্তৃতা অসাধারণ অভিনয় করে দেখাল। মুগ্ধ হয়ে এরপর
‘রোমিও জুলিয়েট’ ফমায়েশ করে ফেললাম। তাতেও তৎক্ষণাৎ তাদের পারদর্শিতা অবাক করল।
বুঝলাম প্রতিদিন তারা দিনের অনেকটা সময় দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য শেক্সপিয়রের নাটক
অভিনয় করে। বাগানের এক কোণায় দেখি
রবীন্দ্রনাথের আবক্ষ মূর্তি। জানলাম ১৯৯৬ সালে সেটার আবরণ উন্মোচন করেছিলেন জ্যোতি
বসু। দুজন মহাকবি, সাহিত্যিক, নাট্যকার -- পৃথিবীর দুটি ভাষার দুই মহাসিন্ধুর যেন
মিলন ঘটেছে। শেক্সপিয়রের লেখনী রবীন্দ্রনাথকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
স্ট্রাটফোর্ডের রাস্তায় গৌতম- চারদিকে শুধুই শেক্সপিয়র |
শেক্সপিয়রের নতুন বাড়ির বাইরে, নানা মুহূর্তে |
কাছেই শেক্সপিয়রের নতুন বাড়ি। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এগারোজনের দল একজায়গায় জড়ো হলে,
তবে তো সেখানে যাওয়া! কিন্তু শুভদাকে তো
আমরা কেউ বহুক্ষণ দেখতেই পাচ্ছি না। ভাবলাম আত্মস্থ হয়ে কোথাও শেক্সপিয়রের চিন্তায়
নিমগ্ন হয়ে আছে হয়তো। তারপর দেখি আমাদের আগেই গেটের বাইরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বুদ্ধির গোড়ায় বুঝি ধোঁওয়া দেওয়ার প্রয়োজন পড়েছিল। ১৫৯৭ সালের মে মাসে পুরানো
বাড়ির খুব কাছেই অনেকটা এলাকা নিয়ে নতুন বাড়িটি কিনেছিলেন শেক্সপিয়র। সে বাড়ির বাগানটাও দেখার মতো করে সাজানো। নতুন
বাড়িটাকেও মিউজিয়াম বানানো হয়েছে। বাইরের উঠোনে টাইলস বসানো হয়েছে কবির রচিত এক
একটি সনেটের প্রথম পংক্তি খোদাই করে। বাগানের গাছগুলোকে ছাঁটা হয়েছে তাঁর নাটকের
এক একটা চরিত্র কল্পনা করে। ভাবুন তো একবার! কি অসাধারণ চিন্তা! আমরা অনেকক্ষণ ঐ
বাগানে সময় কাটিয়েছিলাম। শেক্সপিয়রের বড় মেয়ে সুসানার বাড়িও দেখলাম। সেখান থেকে
খুব কাছেই আমি, গৌতম আর শুভদা গেলাম ঐতিহাসিক ট্রিনিটি চার্চে, যেখানে শেক্সপিয়রের
সমাধি আছে। সেই পবিত্র চার্চের একটা অংশে শেক্সপিয়র, তাঁর স্ত্রী অ্যানা হ্যাথওয়ে,
বড় মেয়ে সুসানা ও তাঁর স্বামী জন হলের সমাধি আছে। শেক্সপিয়রের মৃত্যুর পর তাঁর
সমস্ত সম্পত্তি তাঁর বড় মেয়ে সুসানা পেয়েছিল। কোনো খোদাই লিপি বা কারুকার্য নেই শেক্সপিয়রের সমাধিতে। এত অনাড়ম্বর সমাধি
দেখে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগছিল, এত বড় মানুষটার সমাধি এত সাদামাটা হওয়ার কারণ কী?
মহাকবির নিরাড়ম্বর সমাধি |
বিকেলে চারপাশের প্রকৃতির নীরবতার
মাঝে গাড়ি করে সবাই মিলে গল্প করতে করতে ফেরার পালা। ফিরলাম সেই হরজিতের বাসায়,
যার আতিথেয়তায় টুনুদিরা ছিল। এই হরজিৎ শাহ ভদ্রলোকটির জীবন বেশ অন্যরকম। উনি পাঞ্জাবের
কোনো একটি কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেন খুব ভাল ভাবে। কিন্তু ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ার হবার জন্য নয়। ওনাদের পরিবারের কাপড়ের ব্যবসা ছিল। সেই সূত্রে উনি ইংল্যাণ্ডে আসেন। সেখানে ওনার বাবার
ইংল্যন্ডবাসী এক বন্ধুর মেয়ে জ্যাসমিতকে বিয়ে করে বাদ্যযন্ত্রের ব্যবসা শুরু করেন।
ওনার দোকানে একদিন গিল্ডহল বিশ্ববিদ্যালয়ের
একজন সঙ্গীতের প্রফেসর কোনো একটি বাদ্যযন্ত্র কিনতে আসেন। বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র
বিষয়ে হরজিতের জ্ঞান আর আগ্রহ দেখে উনি হরজিৎকে উৎসাহিত করেন এতটাই যে বাদ্যযন্ত্র
নিয়ে পড়াশুনা ও পরবর্তীকালে ছয় বছর গবেষণায় লিপ্ত রাখে হরজিৎকে। ওনার গবেষণার বিষয়
ছিল ভারতীয় ঘরানার বাদ্যযন্ত্রের ওপর আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব। ভারতের বাদ্যযন্ত্রের ঐতিহ্যশালী ভাবধারা অটুট রেখে
তাতে পশ্চিমী দুনিয়ার প্রযুক্তির প্রয়োগ। পাশ্চাত্যের নানা আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের
মাঝে ভারতের বাদ্যযন্ত্রগুলো একসময়ে অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিল- ডিজাইনে, প্রযুক্তিতে,
চাহিদায়। উপযুক্ত পারিশ্রমিকের অভাবে ভারতের অনেক পারদর্শী কারিগর তাদের এই ধুঁকতে
থাকা বংশগত পেশা থেকে সরে যায় বা চরম দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটায়। এযুগের মেশিন
দুনিয়াতেও ভারতের সুদক্ষ কারিগরদের খুঁজে বার করে তাঁদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিয়ে
তাঁর গবেষণালব্ধ জ্ঞান প্রয়োগে আলোড়ন ফেলেছেন ভারতের চিরাচরিত তারের যন্ত্র সেতার,
তানপুরা, সারেঙ্গী, গিটার, দিলরুবা, বীণায়। ভারতীয় ঘরানার প্রাচীনের সঙ্গে নতুন
প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটিয়ে তৈরি করেছেন জটিল এবং সূক্ষ্ম হাতে তৈরি যন্ত্র। নানা
ধরনের ঢোল, তবলা, হারমোনিয়ামও ওনার পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টা বিশ্বে এখন একনম্বরে। এই
কাজের জন্য তিনি দিনের পর দিন কাটিয়েছেন ভারতের নানান প্রান্তে। যোধপুর, উদয়পুর,
বেনারসের অলিতে গলিতে যারা তবলা বানায়-- কতদিন কাটিয়েছেন তাদের ডেরায়, ঘুরেছেন
তবলার প্রযুক্তিগত জ্ঞানলাভের জন্য। উলুবেড়িয়াতে প্রত্যন্ত এলাকায় দিনের পর দিন
ঘুরেছেন সেতার, এসরাজ, তানপুরা ইত্যাদি তারের যন্ত্রের কারিগরদের বাড়িতে সুরের
ঝংকারের ইতিকথা হাতে কলমে জানতে। হারমোনিয়ামের জন্য কখনো দিল্লী, সরস্বতী বীণা কোন
সুরে বাজে তা রপ্ত করতে কখনো যেতে হয়েছে তাঞ্জাভুর। ভারতীয় হারমোনিয়ামের রীডে
উন্নতমানের সুর লহরীর খোঁজে উনি পাড়ি দিয়েছেন ইতালি, চেক, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি,
অস্ট্রিয়াতে অগুন্তিবার। আবার কখনো
গুজরাটের পালিটানায় বা হাওড়ার উলুবেড়িয়াতে কাটিয়েছেন সেই সব মানুষের সঙ্গে, যারা
হারমোনিয়ামের রিড বানাতে পটু। যে বাদ্যযন্ত্রের জন্য যে ধরণের কাঠ লাগে তার খোঁজে
উনি কখনো ছুটেছেন কানাডা তো কখনো অন্য কোনো দেশে। একটা থিসিস জমা দেবার জন্য কেউ
সারা পৃথিবী জুড়ে ছুটোছুটি করে? কিন্তু দুর্ভাগ্য, ওনার থিসিস জমা দেবার আগেই সেই
প্রফেসর মারা যান। এবং ঐ বিষয়ে রিসার্চ করানোর মত উপযুক্ত গাইডের অভাব থাকায় পিএইচডি
ডিগ্রীটা ওনার আজও হয়নি। তবে খাতায় কলমে ডিগ্রী না থাকলে কি হবে, ওনার হাতে তৈরি
বাদ্যযন্ত্র পৃথিবীর বহু দেশে ছড়িয়ে আছে। দিল্লিতে আছে ওনার নিজস্ব প্রযুক্তিতে
তৈরি বাদ্যযন্ত্রের কারখানা যেখানে ভারতের
বিভিন্ন কোণ থেকে খুঁজে খুঁজে এনেছেন সুদক্ষ যন্ত্রীদের। বাদ্যযন্ত্রের দোকান ওনার
শুধু ভারত বা ইংল্যান্ডেই নেই, আছে আরও অনেক দেশে। বিভিন্ন বাজনার সুর, তাল ছন্দ
যেন গাঁথা আছে ওনার শরীরের তন্ত্রীতে, মজ্জায়, রক্তে আর মননের একাগ্রতায়,
ভালবাসায়। ইংল্যান্ডের ওনার দোকান ‘জ্যাস মিউজিক্যালস’ এ কত শিল্পীদের আনাগোনা, কত
শিল্পীমনের আদানপ্রদান, কত সুরবাহার। সে দোকান যেন এক সংগ্রহশালা। সেখানে একশ
বছরের পুরানো লন্ডনের বার্লিং এণ্ড বার্লিং কোম্পানির প্যাডেল হারমোনিয়াম যেমন আছে
তেমনি আছে ওনার হাতের তৈরি সর্বাধুনিক মানের হারমোনিয়ামও।
সেদিন সারাদিনের গাড়ি করে ঘোরা,
খাওয়া সবই হল হরজিৎ-এর আতিথেয়তায়। আমাদের কিছুই করতে দিলেন না। এমনকি রাতের ডিনারও
ওনার স্ত্রী জ্যাসমিত অসীম আন্তরিকতায় খাইয়ে তবে ছাড়লেন। ফেরার সময়ে বেশ রাত্রি
হল। ভদ্রলোক আমাদের হেইস এণ্ড হার্লিংটন স্টেশনে গাড়ি করে নামিয়ে দিয়ে গেলেন।
কিন্তু অত রাতে দেখি কাউন্টারে লোক নেই, অটোমেটিক মেশিনেও কেন জানি না কিছুতেই
টিকিট কাটা গেল না। কী করি? ওখানকার ট্রেনগুলোতে টি টি
ওঠে, তার কাছে টিকিট কেনা যায়। ভাবলাম ট্রেনে উঠেই
টিকিট কাটব। ট্রেনের এমাথা থেকে ওমাথা পর্যন্ত ঘুরে এলো গৌতম। কোনো টিটি সেদিন
রাতে চোখে পড়ল না। আমাদের বেশ চিন্তা হল, বিদেশে এসে কিনা শেষে বিনা টিকিটের জন্য ফাইন
হবে? প্যাডিংটন স্টেশনে গুটি গুটি সবাই এগোচ্ছি, দেখি বেরোনোর সব গেটগুলোই খোলা। ট্রেনে টিটি ছিল না বলে সব গেট খুলে রেখেছে।
দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
No comments:
Post a Comment