Saturday 13 January 2024

টাইরানোসোরাসের পালক

 

টাইরানোসোরাসের পালক

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়



এ কোথায় এলাম রে বাবা?

চোখ কচলে চারদিকে তাকালাম। কিছুই তো চিনতে পারছি না। একটা ছোটো মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছি, চারদিকে জনপ্রাণী নেই। মাঠ যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানেই ঘন জঙ্গল শুরু।

এটা কোন জায়গা? আমি এখানে এলামই বা কেমন করে? কিছুই তো মনে পড়ছে না।

ভালো করে তাকালাম। না জঙ্গলটা বোধহয় যতটা ঘন ভেবেছিলাম, ততটা নয়। একদিকে একটা বিরাট বাড়ি দেখা যাচ্ছে। যাই, ওখানেই যাই, নিশ্চয় কোনো মানুষের সঙ্গে দেখা হবে। তার কাছ থেকে বাড়ি ফেরার রান্তা জেনে নিতে হবে।

মাঠের পরেই একটা রাস্তা। মানে এক সময় বাঁধানো রাস্তা ছিল, এখন সেটার উপর দিয়ে জায়গায় জায়গায় ঘাস গজিয়েছে। গাছের পাতা পড়ে বাকিটাও প্রায় ঢেকে গেছে। রাস্তাটা চলে গেছে বাড়িটারই দিকে।

বাড়িটার কাছে গিয়ে দমে গেলাম। একেবারেই ভগ্নদশা। জানলা, দরজার পাল্লা ভেঙে ঝুলে পড়েছে। দেয়ালে জায়গায় জায়গায় গাছ গজিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে এখানে জনমানব থাকে না। তাহলে, এখন আমি কী করি?

একবার ভাবলাম বাড়িটার ভিতরে ঢুকব। দেখি যদি বুঝতে পারি এটা কোন জায়গা? কিন্তু তার পরেই মনে হল, যদি সাপখোপ থাকে? তার চেয়ে বরঞ্চ চারদিকটা আগে দেখে নেয়া যাক।


বাড়িটার পাশ দিয়ে হাঁটা লাগালাম। একটা মোড় নিয়েই দেখি সামনে একটা সাইনবোর্ড। লতাপাতায় ঢেকে গেছে, দূর থেকে পড়া যাচ্ছে না। ভাবলাম, দেখি ওটাতে কী লেখা আছে।

লতাপাতা সরিয়ে পড়ার চেষ্টা করলাম। একটু আবছা হয়ে গেছে। কষ্ট করে পড়তে হল। একটা গোল ডিজাইনের মধ্যে একটা ছবি আঁকা, তার তলায় লেখা “মেসোজোইক পার্ক"

মেসোজোইক শব্দটা আমার চেনা চেনা লাগল। ছবিটাও আবছা হয়ে এসেছে। তবু বোঝা যাচ্ছে সেটা একটা টাইরানোসোরাস রেক্সের ছবি। এরকমই একটা ডিজাইন দেখেছিলাম সেই বিখ্যাত সিনেমাটাতে। কিন্তু সেই নামটা তো ছিল জুরাসিক পার্ক! এটা তো আলাদা! যাই, আর একটু এগিয়ে দেখি।

আর একটা মোড় ঘুরতেই যেন ধড়ে প্রাণ এল। সামনে একটা পাথরের উপর একজন লোক। আমার দিকে পিঠ, মুখ দেখতে পাচ্ছি না। একজন মানুষ তো পেলাম, দেখি বাড়ি ফেরার রাস্তাটা জিজ্ঞাসা করি।

কাছে গিয়ে ডাকলাম, “এই যে শুনছেন? ভদ্রলোক মাথা ঘোরালেন। আরে, এ যে আমাদের স্কুলের বিজ্ঞানের মাস্টারমশাই, মল্লিকবাবু। “স্যার, আপনি?

ওহো; তুই? তুই এখানে কী করছিস?”

"স্যার, আমিও তো আপনাকে সেই কথাটাই জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলাম।”

জানি না। এটা কোন জায়গা? হঠাৎ দেখছি আমি এখানে। কেমন করে এখানে এলাম, কিছুই বুঝতে পারছি না"

স্যার, ওপাশে একটা বোর্ড আছে, তাতে লেখা মেসোজোয়িক পার্ক আর সঙ্গে একটা ডাইনোসরের ছবি আঁকা। ঠিক জুরাসিক পার্ক সিনেমাগুলোর মতো।"


স্যার বললেন, “চল দেখি? নিয়ে গেলাম ওনাকে বোর্ডের সামনে। দেখে বললেন, “যাক, একজন অন্তত যুগটার নাম ঠিক মতো লিখেছে।”

কিছুই বুঝতে পারলাম না। স্যারও কিছু ভাঙলেন না। বললেন, “চল, একটু চারদিকটা দেখে আসি।”

বাঁধানো রাস্তাটা বাড়ির কাছেই শেষ হয়ে গেছে। একটা পায়ে চলা রাস্তা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে গেছে। আমরা সেদিকেই পা বাড়ালাম। স্যার হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “দেখ, এখন তো সকাল। গত আধ ঘন্টায় সূর্যটা আর একটু উপরে উঠেছে। আমরা পূর্ব দিকে হাঁটছি। জঙ্গলে হাঁটতে গেলে এটা মনে রাখতে হবে।”

একটা বড়ো গাছের ছোটো একটা ডাল হাতের নাগালে ছিল। সেটা মুচড়ে ভেঙে বললেন, “মাঝে মাঝে চিহ্ন রাখতে হবে যাতে আবার এই রাস্তায় এসে পড়লে বুঝতে পারি।"

এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হাঁটছি, হঠাৎ ডান দিক থেকে গাছের ডাল ভাঙার আওয়াজ এল।

স্যা- - ?” আমি ফিস ফিস করে বলি।

কী হল?” বলে মল্লিকবাবু আমি যেদিকে তাকিয়ে আছি সেদিকে ঘুরলেন।

জঙ্গলের মধ্যে একটা খালি জায়গা, একটা ফুটবল মাঠের থেকে ছোটো। সেখানে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের গাছ থেকে পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে ...

জানি তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। বলবে গুল দিচ্ছি। তোমাদের জায়গায় আমি হলেও একই কথা বলতাম। তাই এখানেই যদি গল্প পড়া বন্ধ করে খেলতে চলে যাও আসি কিচ্ছু মনে করবো না। তবু আমি যা দেখলাম, সেই কথাটাই বলি।


সত্যি বলছি, দেখলাম পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে একটা ডাইনোসর। গাছের ডালও মাঝে মাঝে ভাঙছে - সেই আওয়াজই পেয়েছিলাম। এতই বড়ো যে স্বচ্ছন্দে উঁচু গাছের প্রায় মগভালের নাগাল পেয়ে গেছে। লম্বা গলা, লেজটা আরো ও লম্বা। সব মিলিয়ে মনে হয় পথ্গশ মিটার লম্বা। কোথায় লাগে তার কাছে হাতি!

মল্লিকবাবু মন্তব্য করলেন, “অ্যাম্ফিসিলিয়াস।”

কী বললেন?”

অ্যাম্ফিসিলিয়াস, ওটা এই ডাইনোসরটার নাম।"

নাম জেনে কী হবে? স্যার, এতো প্রায় একটা ট্রেনের মতো লম্বা। পালিয়ে চলুন, আসাদের দেখতে পেলে এখনি চিবিয়ে খাবে। ওর নাম জানি বলে কী আমাদের ছেড়ে দেবে?”

নাঃ, তোর বুদ্ধিসুদ্ধি আর হল না। ও তো গাছের পাতা খাচ্ছে। তার মানে মাংস খায় না। আর এত বড়ো জানোয়ার কথনো মাংস খেতে পারে? তাহলে তো গোটা বনের সব জন্তু সাবাড় হয়ে যাবে আর তারপর এরা না থেয়ে মরবে। অ্যাম্ফিসিলিয়াস সম্ভবত আমাদের জানা সবচেয়ে বড়ো ডাইনোসর, এক সময় আমরা যাকে ডিপ্লোডোকাস বলতাম, তারই একটা রকমফের মনে হয়।

স্যার, সত্যি সত্যি কী আমরা জুরাসিক পার্কের সেই দ্বীপগুলোর একটাতে এসে পড়েছি। কিন্তু নামটা তো অন্য লেখা ছিল?”

দেখ, সিনেমাগুলোর নাম জুরাসিক পার্ক কেন? নিশ্চয় বোঝাতে চেয়েছিলো যে জুরাসিক যুগে এই সব ডাইনোসররা ছিল। এটা ঠিক যে জুরাসিক যুগ ভাইনোসরদের সময়। কিন্তু সিনেমাটাতে যে সমস্ত ডাইনোসর দেখিয়েছিল, তারা অনেকেই জুরাসিক যুগের নয়। যেমন ধর, টাইরানোসোরাস রেক্স। জুরাসিক যুগ শুরু হয়েছিল আজ থেকে কুঁড়ি কোটি বছর আগে আর শেষ হয় সাড়ে চোদ্দ কোটি বছর আগে। তারপর শুরু হয় ক্রেটাসিয়াস যুগ যেটা শেষ হয় সাড়ে ছ' কোটি বছর আগে। টাইরানোসোরাস কিন্তু ক্রেটাসিয়াস যুগের প্রাণী। এদিকে ধর অন্য যে একটা ডাইনোসর যা দেখিয়েছিল; সেই স্টেগোসোরাসকে পাওয়া যেতো জুরাসিক যুগে। জুরাসিক, তার আগের ট্রায়াসিক আর ক্রেটাসিয়াস, এই তিনটে মিলিয়ে একসঙ্গে নাম হল মেসোজোয়িক। এই সময়টাকে ডাইনোসরদের বাড়বাড়ন্তের সময় বলা যেতে পারে। মেসোজোয়িক শুরু হয়েছিল মোটামুটি

পঁচিশ কোটি বছর আগে। তাই ডাইনোসরদের পার্ক বানাতে গেলে মোসোজোয়িক নামটাই বেছে নেওয়া ভালো। টাইরানোসোরাসের ছবি আঁকব আর একই সঙ্গে জুরাসিক যুগের নাম বলবো - তা আবার হয় নাকি?”

মাস্টারমশাইদের এই সমস্যা - এই বিপদে উদ্ধার পাই কেমন করে সে কথা ভাবতে হবে, তা না করে এখন কোনটা ঠিক কোনটা ভুল, তাই নিয়ে পড়লেন! আসলে পরীক্ষার খাতা বেশী দেখলে বোধহয় এরকমই হয়। সে না হয় হল, কিন্তু এখানে টাইরানোসোরাস আছে নাকি? তাহলে তো আর বেঁচে ফিরতে হবে না।

সিনেমার ছবিটা এখনো মনে ভাসছে। এ রকম বড়ো একটা প্রাণী, যার এক কামড়েই একটা মানুষকে প্রায় গিলে নিতে পারে।

স্যার বোধহয় আসার মনের কথা বুঝতে পারলেন, বললেন, “ভয় পেলি নাকি? চল চল, চারদিকটা দেখতে হবে তো।"

যাবো? কিন্তু যদি এখানে টাইরানোসোরাসের মতো কোনো শিকারী ডাইনোসর থাকে? তাহলে কী হবে?”

এখানে দাঁড়িয়েও তো কোনো কাজ হচ্ছে না। ধর না হয় শিকারী ডাইনোসর আছে। কতগুলো এরকম শিকার ধরা মাংসাশী ডাইনোসর এক জায়গায় থাকতে পারে? জানিস একটা বাঘের এলাকা কত বড়ো? তাকেও তো খেতে হবে। সে যে তৃণভোজী প্রাণীদের খায়, তারাও তো একটা এলাকার মধ্যে অনেক থাকতে

পারে না, তাহলে হয় না খেয়ে মরবে না হয় সবাই মিলে অন্য কোনো জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হবে। বাঘ যদি বেশী হয়ে যায়; তাহলে আবার তারা শিকার করে যাদের, সেই তৃণভোজীদের সংখ্যা কমে যাবে। তখন বাঘগুলোও না খেয়ে মরবে। ডাইনোসরদের জন্যও তো ব্যাপারটা সত্যি। তাদের সামনে আমরা এখুনি

পড়বো, তার সম্ভাবনা কতটুকু? এখানে দাঁড়িয়ে থেকেও তো কোনো কাজ হবে না। আরে বাবা, ভয় পেলে চলবে না।” স্যার হাঁটা লাগালেন।

ওরে বাবা, এখানে একা থাকতে হলে আমার হাত পা পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি করে স্যারের পিছন ধরলাম। অনেকদূর পর্যন্ত ডালপালা ভাঙার আওয়াজ পাচ্ছিলাম।

"কিন্তু স্যার”, আমি যেতে যেতে বলি, “যদি টাইরানোসোরাস তাড়া করে, তাহলে তো আর রক্ষে নেই।”

দৌড়োতে পারিস?

স্যার ভুলে গেছেন? আমি স্কুলের চ্যম্পিয়ন।”

তাহলে আর কী? দৌড়ে পালাবি।” স্যার নির্বিকার ভাবে উত্তর দেন। “এখন একটু চুপ কর দেখি। এত কথা বললেন তোর টাইরানোসোরাস ঘাড়ের উপর আসার আগে শুনতে পাবো না।

ওরে বাবা। ভয়ে চুপ করে গেলাম। মনে মনে ভাবলাম, সিনেমাটাতে তো দেখেছি, গাড়ি চালিয়েও টাইরানোসোরাসের থেকে পালাতে পারছিল না। আর স্যার বলেন কিনা দৌড়ে পালাবি! না, আজ আর কোনো রক্ষে নেই।

সামনে একটা উঁচু টিপি মতো; আশপাশের গাছগুলোর মাথা ছাড়িয়ে উঠেছে। তার উপরে বড়ো গাছের সংখ্যা কম, স্যার বললেন, “উপর থেকে চারদিকটা আরো ভালো দেখা যেতে পারে।"

টিপির উপর থেকেও চারদিকটা দেখা শক্ত, গাছে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছিল। স্যার বললেন, “গাছে উঠতে পারিস? নাকি ভয় পাস?”

আমার আত্মসম্মানে ঘা লাগল। পাড়ায় কেউ আমার চেয়ে তাড়াতাড়ি গাছে চড়তে পারে না। বললাম, “দেখবেন কত তাড়াতাড়ি উঠতে পারি?”

না, তাড়াতাড়ি করিস না। তবে সামনের এই বড়ো গাছটায় সাবধানে উঠে দেখ দেখি। চারদিকটা ভালো করে দেখ কিছু দেখতে পাস কিনা।

গাছটায় ওঠা সোজাই, একটুখানি উপর থেকেই মোটা মোটা ডাল চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। যতটা সম্ভব উঠলাম। তার উপরের ডালগুলো খুব সরু; মনে হল না আমার ওজন রাখতে পারবে। শক্ত দেখে একটা ডালে বসে দূরের দিকে তাকালাম। সত্যিই বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। দেখলাম, আমরা একটা দ্বীপে আছি। অধিকাংশটাই জঙ্গলে ঢাকা। তবে দ্বীপটা খুবই ছোটো, দূরে চারদিকে নীল জল দেখা যাচ্ছে। স্যারকে যা দেখছি বললাম।

স্যার নিচ থেকে টেচিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “সমুদ্রের ধারে জাহাজ বা এ রকম কিছু আছে নাকি? অন্য কোনো বাড়ি বা রাস্তা দেখতে পাচ্ছিস?”

জাহাজ নেই স্যার। তবে টিপির ওপাশেই একটা রাস্তা মতো আছে মনে হয়। সেটা সমুদ্রের দিকে চলে গেছে।”


"ঠিক আছে, নেমে আয়।” নামতে শুরু করেছি এমন সময় হঠাৎ স্যার আবার চিৎকার করে বললেন, “না, না, যেখানে আছিস সেখানেই থাক। শক্ত করে ধরে থাক।"

তোমরা নিশ্চয় জুরাসিক পার্ক সিনেমাটা দেখেছো। মনে আছে, প্রথম যে ডাইনোসরটাকে দেখিয়েছিল? সেটা ছিল একটা ব্রাকিয়োসোরাস। আ্যাম্ফিসিলিয়াস বলে যেটাকে একটু আগে দেখেছি, তার মতো বড়ো না হলেও ছোটো নয়। সেই রকমই একটা ব্রাকিয়োসোরাস আমি যে গাছে চড়েছি, তার থেকে একটু দুরে

দাঁড়িয়ে নিচের ডাল থেকে পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছে।

ভয়ের কিছু নেই, ওতো মাংসাশী নয়। সবে এই কথা নিজেকে বললাম, এমন সময় বুঝলাম ভয়ের যথেষ্ট কারণ আছে। যেভাবে ডালগুলোকে টানছে, আমি যেটার ওপর বসে আছি, সেটা টানলে তো নিচে পড়ে যাবো? দেখি আস্তে আস্তে উপরের দিকে মাথা তুলছে। গলাটা না হলেও মিটার দশেক লম্বা। একটু উপরের ডালে উঠে যাবো নাকি? কিন্তু উপরের ডালগুলো তো সরু, আমার ওজন রাখতে পারবে তো?

মাথাটা ফুটবলের মতো বড়ো, ক্রমশই উপরে তুলছে। নাঃ, আর উপায় নেই। সবে উপরের দিকে হাতটা বাড়ালাম, স্যার গাছের গুঁড়ির আড়ালে চলে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে চেঁচিয়ে বললেন, “ভয় নেই, ওই পর্যন্ত ও মাথা তুলতে পারবে না। আর উপরে যাওয়ার চেষ্টা করিস না।”

কেমন করে জানলেন স্যার? কিন্তু সত্যিই তো আর উপরে উঠতে গেলে ডাল ভেঙে পড়ে যাবো। কোনো উপায় নেই। তাই প্রাণপণে ডালটাকে আঁকড়ে ধরলাম। চোখ বুজে ফেলেছি, ডাল ভাঙার আওয়াজটা ক্রমশই কাছে আসছে।


কতক্ষণ পরে জানি না; আওয়াজটা বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখি সত্যিই ডাইনোসরটা মাথা নামিয়ে আবার আমরা যেদিক থেকে এই মাত্র এলাম, সেদিকে রওনা দিয়েছে। অনেকক্ষণ পর্যন্ত দূর থেকে ডালপালা ভাঙার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।

এবারে নেমে আয়, আপাতত কোনো ভয় নেই,” স্যার নিচ থেকে চেঁচিয়ে বললেন।

তাড়াতাড়ি করে নামলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, “কেমন করে জানলেন যে আর মাথা তুলবে না? গলা সোজা করলে তো গাছের মগডাল পর্যন্ত নাগাল পেয়ে যেতো। সিনেমাতে তো দেখেছিলাম যে মাথা সোজা করে, এমন কি সামনের পা মাটি থেকে তুলে গাছের ডাল চিবোচ্ছে।”

স্যার বললেন, “দেখ, গলাটা যা লম্বা, তাতে করে গলা উপরদিকে না তুললেও মাথা পযন্ত রক্ত পাঠাতে হৃংপিগুটাকে নিশ্চয় খুব খাটতে হয়। তাই মাথা যদি সোজা করে, তাহলে নিশ্চয় মাথায় আর রক্ত পৌছোতে পারবে না; একেবারে অজ্ঞান হয়ে যাবে। সামনের পা তোলার প্রশ্নই ওঠে না, যা ওজন জন্তুটার, তাতে করে পড়লে হাড়গোড় ভেঙে যাবে। তাই তোকে আর উঠতে বারণ করছিলাম, আরো উপরের ডাল হয়তো তোর ওজন রাখতে পারতো না। যাকগে, ওদিকে একটা রাস্তা আছে দেখতে পেয়েছিস। রাস্তা সাধারণত জঙ্গলের মধ্যে শেষ হয়না। চল ওটা ধরে এগোই। দেখা যাক কোথায় পৌঁছোই।”

রাস্তাটা খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। এটাও বাঁধানো ছিল এক সময়, এখন জায়গায় জায়গায় ভেঙে গেছে। “কোন দিকে যাবো স্যার?” জিজ্ঞাসা করি।

কোন দিকে বনটা একটু হালকা মনে হল?”

এই রে! সব তো গুলিয়ে গেছে। আমায় ইতস্তত করতে দেখে স্যার বললেন, "সমুদ্রটা কাছে পাব কোন দিকে গেলে?”

এইটা বলতে অসুবিধা হল না, আমি উত্তর দিকে হাত বাড়ালাম। স্যার বললেন, “চল, তাহলে সমুদ্রের দিকেই যাওয়ার চেষ্টা করি।”

ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকাচ্ছি। একটা মোটা মতো গাছের ডাল কুড়িয়ে নিলাম। আগে খেয়াল করিনি, জঙ্গলটা খুব নিঃশব্দ; শ্বাস ফেলতে ভয় করছিল। স্যারের অবশ্য ভয়ডর বলে কিছু নেই মনে হল। নিশ্চিন্ত মনে এগিয়ে যাচ্ছেন।

জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা খোলা জায়গা, একটা ফুটবল মাঠের থেকে বড়ো। তার মধ্যে দিয়ে রাস্তাটা চলে গেছে। মাঠটা পার হয়ে আবার জঙ্গলে ঢুকবো, হঠাৎ নিচু হয়ে মল্লিকবাবু একটা কী কুড়িয়ে নিলেন।

দেখি একটা পালক। বিরাট বড়ো, এত বড়ো পালক আগে কথনো দেখিনি।

কী পাখির পালক স্যার? উটপাখির?”

পাখির বলে মনে হচ্ছে না।” স্যার আমার দিকে পালকটা বাড়িয়ে দিলেন। হাতে নিয়ে দেখলাম, কিন্তু কিছু বুঝতে পারলাম না। “কেন, পাখির নয় কেন?”

আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারব না পাখির নয়। তবে পালকটা দেখ, একেবারেই শক্ত নয়। যে পাখি উড়তে পারে, তার পালক অনেক শক্ত হয়, কারণ হাওয়ার উপর চাপ দিতে হয়। এটা যেন উড়তে না পারা পাখির বাচ্চার পালকের মতো।”

পালকটা এক হাত লম্বা। “স্যার, একি রক পাখির বাচ্চা নাকি? এত বড়ো পালক যদি বাচ্চার হয়, তাহলে তার মায়ের পালক কতো বড়ো হবে? পাখিটা তো তাহলে হাতির চেয়ে অনেক বড়ো হতে হবে।”

বললাম তো পাখি নয়। আমার সন্দেহ হচ্ছে এটা ডাইনোসরের পালক। হয়তো টাইরানোসোরাসের পালক।"

কার পালক বললেন? টাইরানোসোরাসের? স্যার, এই বিপদের সময় আপনার মজা করতে ইচ্ছে করছে?” আমি বলি।

মজা করলাম কোথায়? টাইরানোসোরাসের সম্ভবত পালক ছিল। তার কাছের যে আত্মীয়, সেই ইউটাইরানাস হুয়ালি, তার পালক সমেত ফসিল পাওয়া গিয়েছে। এখন অধিকাংশ বিজ্ঞানীই মনে করেন টাইরানোসোরাসের পালক ছিল।”

পালক দিয়ে কী করতো? অত বড়ো প্রাণী তো আর উড়তে পারতো না?”

একটা কথা ভাব, ডানা আগে না পালক আগে? পালক প্রথম যখন বিবর্তনের ফলে এসেছিল, তখন নিশ্চয় সেটা ওড়ার জন্য ব্যবহার হতো না। এই নরম পালক দিয়ে ওড়াও যায় না। গত কুড়ি বছরে অনেক পালকওয়ালা ডাইনোসর আবিষ্কার হয়েছে, অধিকাংশই চীনে। সবগুলোই মূলত সেই সব অঞ্চলে যেখানে

ঠাণ্ডা বেশী। এবার বল দেখি পালক ওড়া ছাড়া কী কাজে লাগে?”

কিছুই আমার মাথায় আসছিল না। স্যার আবার বললেন, “পালকের লেপের কথা শুনেছিস?”

"হ্যাঁ স্যার।"

লেপের পালক তাপটাকে বেরোতে দেয় না। পাখির পালকও একই কাজ করে। পাখির বাচ্চা আর ডাইনোসরের নরম পালকও গরম থাকতে সাহায্য করে। তবে বড়ো টাইরানোসরাসের বোধহয় পালক থাকতো না, শুধু বাচ্চাদের থাকতো। বড়ো হলে হয়তো ঝরে পড়ে যেতো।”

কেন স্যার?”

টাইরানোসরাস রেক্স কতো বড়ো হতো জানিস? চল্লিশ ফুট লম্বা ফসিল পাওয়া গেছে যে প্রাণীটার ওজন হতো পাঁচ থেকে ছয় টন। জানিস তো যে প্রাণী যত বড়ো হয়, তার ওজনের তুলনায় তার দেহতলের ক্ষেত্রফল তত কমে যায়। এই দেহতল দিয়েই তো দেহের মধ্যে যে তাপ তৈরি হয় তা বেরিয়ে যায়। টাইরানোসরাস ছিল উষ্ণ রক্তের প্রাণী। কাজেই তার দেহে ভালোই তাপ তৈরী হতো। পালক থাকলে তাপটা বেরোতে পারতো না, তাহলে তো সেদ্ধ হয়েই মরে যেত।"

ভাইনোসররা শীতল রক্তের প্রাণী ছিল না? আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছিল। ডাইনোসররা তো সরীসৃপ শ্রেণির প্রাণী আর বইতে যে পড়েছি সরীসৃপদের রক্ত শীতল। তার উপর আবার ডাইনোসরের পালক। মল্লিকবাবুকে সেই কথা বললাম।

মল্লিকবাবু বললেন, “কেন, জুরাসিক পার্ক সিনেমাটাতেও তো বলেছিল ডাইনোসরদের রক্ত উষ্ণ। ভুলে গেছিস? ভেবে দেখ, পাখিরা তো উষ্ণ রক্তের প্রাণী, তাদের জন্ম তো ডাইনোসরদের থেকেই। তাছাড়া ডাইনোসরের ফসিল এমন সব ঠাণ্ডা জায়গায় পাওয়া গেছে যেখানে শীতল রক্তের প্রাণীদের পক্ষে বেঁচে থাকা বেশ কঠিন। এথন প্রায় সবাই মেনে নিয়েছে যে অধিকাংশ ডাইনোসরই ঠাণ্ডা রক্তের প্রাণী ছিল না।”

সে যাই হোক স্যার, ঠাণ্ডা কি গরম, এখানে এই পালক পাওয়ার মানে কাছাকাছি কোথাও টাইরানোসরাস থাকতে পারে। স্যার, কী করব?”

কেন, বললাম তো দৌড়ে পালাবি। চল দৌড়ো।"

কথাটা শেষ করার আগেই স্যার দৌড়োতে শুরু করেছেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি দেখে স্যার দাঁড়িয়ে পড়ে পিছন দিকে হাত বাড়িয়ে কী দেখালেন। ঘুরে প্রথমেই কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, তারপর স্যারের হাত অনুসরণ করে উপরের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখি ...

কথায় বোঝানো যাবে না কী দেখলাম। যারা জুরাসিক পার্ক সিনেমাগুলো দেখেছো তাদের বলতে হবে না। বাকিরাও পারলে সিনেমাতে দেখে নিও। আমাদের থেকে শ' খানেক মিটার পিছনে মাঠের ওপাশে একটা বড়ো গাছের আড়ালে প্রায় দোতলা বাড়ির থেকে উঁচুতে একটা মাথা দেখা যাচ্ছে। মাথাটাই আমার থেকে

বড়ো। আমাদের দেখতে পেয়েই বোধহয় হাঁ করল। এক একটা দাঁত কিছু না হলেও আধহাত লম্বা। তোমরা ঘোর দুঃস্বপ্নেও যে বিভীষিকা দেখোনি, সেই এবার আমাদের দিকে আসছে।

ডাইনোসরটা এক একটা পা ফেলছে আর মাটি কেঁপে উঠছে। কিন্তু মূর্তিমান মৃত্যুকে সামনে দেখেও আমি নড়তে পারছিলাম না, কে যেন স্ক্রু দিয়ে পা দুটো মাটির সঙ্গে আটকে দিয়েছে। মনে হল, আর কখনো মা বাবার সঙ্গে দেখা হবে না। তারা জানবেও না এই জুরাসিক, না না, মেসোজোইক পার্কে একটা টাইরানোসোরাস, যে এখনো খবর পায়নি যে সে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তার হাতে, না হাতে নয়, করাল গ্রাসে আমার মৃত্যু হল। ছোটোবেলা থেকে যত বদমায়েশি করেছি, সব একে একে মনে পড়ে গেল। টাইরানোসোরাসটাও বোধহয় বুঝতে পেরেছে যে তার কোনো তাড়া নেই। ধীরেসুস্থেই আসছে। তবে সিনেমাতে তো দেখেছি কতো জোরে দরকার পড়লে ও দৌড়োতে পারে? তাই পালাবার চেষ্টা করে আর কী হবে?

আমি প্রাণের আশা ছেড়েই দিয়েছি, কিন্তু হঠাৎই মল্লিকবাবু আসার সম্বিত ফিরিয়ে আনলেন। ফিরে এসে হাত ধরে টেনে বললেন “দৌড়োতে বললাম না?”

দৌড়ে কী হবে স্যার?”

যা বলছি কর। তবে জোরে দৌড়োবি না। জগিং করলেই চলবে। চল, যেতে যেতে বুঝিয়ে বলছি।”

স্যারের টানে বাধ্য হয়ে দৌড়োতে শুরু করলাম। স্যার পাশে পাশে যেতে যেতে বললেন, "টাইরানোসোরাসের চেহারা দেখেছিস? ও ঘন্টায় দশ কিলোমিটারও দৌড়োতে পারে কখনো? তুই তো বটেই এমনকি আমিও সহজেই দৌড়ে ওকে হারিয়ে দেবো। তবে বেশী জোরে পালানোরও দরকার নেই। টাইরানোসোরাস তো শিকারী নয়, শকুন আর হায়নার মতো মড়া খেয়ে বাঁচে। নেহাত আমরা ওর তুলনায় ছোটো, সামনে থাকলে এক কামড়ে শেষ করে দিতে পারে। তাই একটু দুরে চলে যাওয়া ভালো?

স্যারের একটা কথাও আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। টাইরানোসোরাস মড়াখেকো? টাইরানোসোরাস শিকারী নয়? টাইরানোসোরাস দৌড়োতে পারে না? তবে যে ওর নাম টাইরানোসোরাস রেক্স? বইতে পড়েছি রেক্স মানে রাজা আর টাইরানোসোরাস মানে অত্যাচারী ডাইনোসর। তাহলে?

কিন্তু সতিই টাইরানোসোরাসটা কখনোই গতি বাড়াল না। মাঠটার শেষ পর্যন্তও এল না, তার আগেই হাল ছেড়ে দিল। আবার পিছন ফিরে জঙ্গলে গিয়ে ঢুকল। স্যার বললেন, “ঠিক আছে, আর আপাতত ভয় নেই।"

স্যার, যা জানতাম সবই কী ভুল? আপনি কেমন করে জানলেন টাইরানোসোরাস দৌড়োতে পারে না? সব জায়গায় যে পড়েছি এই ডাইনোসরের মতো বড়ো শিকারী প্রাণী পৃথিবীতে জন্মায় নি!”

এই কথাটাও ভুল। সমুদ্রের আওয়াজ পাচ্ছি। চল সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসি _ তার পর আমি যা জানি বলছি। একটু দম নিতে হবে। এই বয়সে কী আর এত দৌড়োদৌড়ি পোষায়?”

স্যার বলাতে খেয়াল পড়ল আমিও ঢেউয়ের শব্দ পাচ্ছি। সত্যিই, একটু হাঁটতেই সমুদ্রের ধারে পৌছে গেলাম। বালি যেখানে শুরু হয়েছে, সেখানে একটা গাছের ছায়ায় মলিকবাবু বসলেন। গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বললেন, “বল; কী জানতে চাস।"

টাইরানোসোরাস," আমি এক কথায় বলি।

"প্রথমত, টাইরানোসোরাসের চেয়েও আয়তনে বড়ো শিকারী প্রাণী আমাদের সময়েই বেঁচে আছে। সে টাইরানোসোরাসের থেকে অনেক বেশী বুদ্ধিমানও বটে। তার নাম কী জানিস?”

কী আর বলবো? “জানি না স্যার।”

"খুনে তিমি। তার ওজন সবচেয়ে বড়ো টাইরানোসোরাসের থেকেও বেঁশী। কিন্তু সবচেয়ে বড়ো শিকারী ডাইনোসর হল স্পাইনোসোরাস। তার ওজন ছিল টাইরানোসোরাসের তিন গুণ। তবে সে বোধহয় মাছ খেয়ে বাঁচতো।

এটা ঠিক যে টাইরানোসোরাসকে প্রথমে শিকারী বলেই সবাই মনে করতো। কিন্তু ক'দিন আগে আমি একটা বই পড়েছি। সেটার লেখক দেখিয়েছেন যে শিকার ধরাতে টাইরানোসোরাস নেহাতই সুবিধা করতে পারবে না। প্রথমত যে সমস্ত প্রাণী জোরে দৌড়োতে পারে, ধর চিতা বা হরিণ, তাদের পায়ের গঠন

একেবারেই আলাদা । টাইরানোসোরাসের থাই পায়ের নিচের অংশের থেকে বড়ো। অনেকটা হাতির মতো। হাতি ঠিকঠাক দৌড়োতে পারেনা। দৌড় মানে হল কোনো না কোনো সময় সবকটা পা মাটি ছেড়ে উঠে থাকবে। এ রকম পায়ের গঠন নিয়ে সেটা সম্ভব নয়।

একবার ভাব, এ রকম বড়ো একটা প্রাণী যদি খুব জোরে দৌড়োয়, তাড়াতাড়ি ঘুরতে পারবে না। শিকার ধরবে কেমন করে - শিকার তো সব সময় একদিকে সরলরেখায় দৌড়োবে না, এদিক ওদিক পালানোর চেন্টা করবে। তার চেয়েও বড়ো সমস্যা হল হৌচট খাওয়া। চার পায়ে দৌড়োলে হোঁচট খেয়ে পড়ার সম্ভাবনা

কম থাকে। টাইরানোসোরাস বা মানুষের মতো দু পায়ে দৌড়োতে গেলে পড়ার সম্ভাবনা খুব বেশী। পাঁচ কি ছ'টনের একটা প্রাণী জোরে দৌড়োতে দৌড়োতে যদি হুমড়ি থেয়ে পড়ে, হাড়গোড় ভেঙে যাবেই যাবে। সামনের পা দুটো বা হাত দুটো যাই বল, কীরকম ছোটো দেখেছিস? ওই দুটো দিয়ে সামলাতে পারবে না। সত্যি কথা বলতে কি, ডাঙায় এতো বড়ো প্রাণীর পক্ষে শিকার ধরা সম্ভব কি না সন্দেহ। সাধারণত আমরা ডাঙার জন্য সত্যি বলে মনে হয় না। আমাদের সময়ের যে সমস্ত প্রাণী খুব তাড়াতাড়ি দৌড়োতে পারে, তারা কেউই খুব বড়ো নয়। স্পাইনোসরাস জলের মধ্যে শিকার ধরতো। খুনে তিমি তো সমুদ্রেই থাকে। জলের মধ্যে ওজন বেশী কমে কিছু আসে যায় না।?

তাহলে টাইরানোসোরাস খেতো কী?”

এ বইটাতেই বলেছে যে টাইরানোসোরাস মুলত মড়া খেয়ে বাঁচতো। তার কতগুলো যুক্তিও লেখক দেখিয়েছেন। প্রথমত মস্তিষ্কের যে অংশ ঘ্রাণ শক্তির নিয়ন্ত্রণ করে, টাইরানোসোরাসের সেই অংশটা অন্য যে কোনো ডাইনোসরের থেকে বেশী বড়ো। লেখকের মতে গন্ধ শুঁকে টাইরানোসোরাস মড়া খুঁজে বার করতো। আসাদের জানা প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ঘ্রাণশক্তি হল ভাল্লুকের। অনেক ভাল্লুকই বেশ বড়ো প্রাণী, কিন্তু তারা মুলত শিকারী নয়। ডাঙাতে থাকা সবচেয়ে বড়ো জীবিত শিকারী প্রাণী শ্বেত ভল্লুক, যাদের উত্তর মেরুতে পাওয়া যায়। শ্বেত ভল্লুক অবশ্য শিকারী, কিন্তু জলের মধ্যে শিকার ধরে। তার পরে যে প্রাণীটার নাম আসবে তা হল আলাস্কার কোডিয়াক ভাল্লুক, সে মাছ ধরে আর গন্ধ শুঁকে অনেক দূর থেকে মড়া জন্তুর দেহ খুঁজে বার করে খায়। চেহারায় বড়ো বলে মড়া থেকে অন্য জন্তদের হটিয়ে দিতে পরে। টাইরানোসোরাসও

হয়তো বড়ো চেহারার জোরে তাই করতো। বাঘ সিংহ তো ওজনে কোডিয়াক ভাল্লুকের অর্ধেকও হবে না। অন্য ভাল্লুকরাও তাড়া করে শিকার ধরে খুব কম ক্ষেত্রে। এই তুলনা থেকে এ বইটাতে টাইরানোসোরাসকে শিকারী না বলে মূলত মড়াখেকো বলা হয়েছে। লেখক আরো বলেছেন যে টাইরানোসোরাসের চোখ খুব ছোটো। অন্য কোনো শিকারী প্রাণীর দেহের তুলনায় এত ছোটো চোখ নেই। শিকার ধরতে হলে, বিশৈষ করে রাত্রিবেলা, বড়ো চোখ খুব কাজে লাগে।

চোখ বড়ো হলে বেশী আলো ঢোকে; তাহলে অন্ধকারে দেখতে সুবিধা হয়। এই সব পড়েই আমি তোকে বলেছিলাম টাইরানোসোরাস থেকে ভয়ের কোনো কারণ নেই।"

স্যার আরো কী সব বলছিলেন, কিন্তু আমার কানে আর ঢুকছিল না। ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল, চোখ বুজে এসেছিল। এমন সময় হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মল্লিকবাবু আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলছেন, “আর ঘুমোস না, বাড়ি যা।"

ঘুম জড়ানো চোখে জবাব দিলাম, “বাড়ি কেমন করে যাব স্যার?”

কেন, যেমন করে রোজ যাস। আজ আবার নতুন কী হল?”

ভালো করে চোখ খুলে দেখি স্কুলের লাইব্রেরিতে বসে আছি। সামনে একটা বই খোলা। ডাইনোসরদের নিয়ে লেখা এই বইটা পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তার মানে স্বপ্ন দেখছিলাম, কিন্তু স্বপ্ন কখনো এত বাস্তবের মতো হয়? চোখ বন্ধ করলেই টাইরানোসোরাসের হাঁ করা মুখটা দেখতে পাচ্ছি।

স্যার, একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। আপনিও ছিলেন তাতে। শুনবেন গল্পটা?”

বাইরে চল, লাইবেরি বন্ধ হয়ে যাবে। বাড়ি যেতে যেতে বলবি।”

সবটা বলে স্যারকে জিজ্ঞাসা করলাম, “স্যার, সত্যি কী টাইরানোসোরাস মড়া জন্ত থেয়ে বাঁচত? দৌড়োতে পারত না?”

এই সব নিয়ে বিজ্ঞানীরা এখনো তর্ক করছেন। কাজেই কোনটা সত্যি, কোনটা নয় বলা শক্ত। তবে স্বপ্নটা ভালো দেখেছিস। গল্পের মতো করে লিখে ফেল।"

সে আর বলতে স্যার।”


প্রকাশ: এ যুগের কিশোর বিজ্ঞানী, শারদ সংখ্যা ২০১৪