Wednesday 25 January 2023

ভারতে নিউক্লিয় বিজ্ঞানচর্চার প্রথম যুগ

 

ভারতে নিউক্লিয় বিজ্ঞানচর্চার প্রথম যুগ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


আমরা সবাই জানি পরমাণুর কেন্দ্রে আছে নিউক্লিয়াস, তার মধ্যেই আছে পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর। আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ১৯১১ সালে নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন, যদিও মূল পরীক্ষাটি হয়েছিল তার দু'বছর আগে ১৯০৯ সালে। সঠিকভাবে বলতে গেলে অবশ্য আঁরি বেকারেল ১৮৯৬ সালে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের সূত্রপাত হয়েছিল বলে ধরা যেতে পারে, কারণ নিউক্লিয়াসই হল তেজস্ক্রিয়তার উৎস। নিউক্লিয়াস প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে তৈরি। রাদারফোর্ডই প্রথম নিউট্রনের অস্তিত্বের কথা অনুমান করেছিলেন, ১৯৩২ সালে তাঁর ছাত্র জেমস চ্যাডউইক কণাটিকে আবিষ্কার করেন। ১৯৩৪ সালে আইরিন জোলিও কুরি ও ফ্রেডেরিক জোলিও কুরি কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেন। সেই বছরই নিউট্রন, বিশেষ করে ধীরগতির নিউট্রন ব্যবহার করে নিউক্লিয় বিক্রিয়া বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন এনরিকো ফের্মি। ১৯৩৯ সালে অটো হান ও ফ্রাঞ্জ স্ট্রাসমান আবিষ্কার করেন নিউক্লিয় বিভাজন বা ফিশন বিক্রিয়া, অবশ্য তার পিছনে লিজে মাইটনারের অবদানও ভোলার নয়। এই বিভাজন বিক্রিয়াই পরমাণু বোমা বা শক্তি উৎপাদনে ব্যবহার হয়। এই লেখাতে অবশ্য শক্তি উৎপাদন বা পরমাণু অস্ত্রের মতো নিউক্লিয় প্রযুক্তির দিকে না গিয়ে শুধুমাত্র মৌলিক গবেষণাতেই আমাদের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব।

ঘটনাচক্রে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের প্রথম যুগের সঙ্গে আমাদের দেশে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার সূচনাকালের কালপঞ্জীর বেশ কিছুটা মিল আছে। ১৮৯৪ সাল নাগাদ প্রেসিডেন্সি কলেজে জগদীশচন্দ্র নিজের পরীক্ষাগার তৈরি করে ভারতে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান গবেষণার সূত্রপাত করেন। মহেন্দ্রলাল সরকার অবশ্য ১৮৭৬ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি কাল্টিভেশন অফ সায়েন্স প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, কিন্তু ১৯০৭ সালে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন কাজ শুরু করার আগে সেখানে আধুনিক বিজ্ঞানে গবেষণা বিশেষ হত না। টাটা গোষ্ঠীর উদ্যোগে ১৯০৯ সালে বাঙ্গালোরে তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স, সেখানে মূলত রসায়ন বিষয়ে গবেষণা হত। ১৯৩৩ সালে রামন অধিকর্তা হিসাবে যোগ দেওয়ার পরে সেখানে পদার্থবিদ্যা বিভাগ তৈরি হয়েছিল। জগদীশচন্দ্র ১৯১৭ সালে তৈরি করেন বসু বিজ্ঞান মন্দির।

তবে নিউক্লিয়াস বিষয়ে গবেষণার প্রথম উদাহরণ এই সমস্ত প্রতিষ্ঠানে পাওয়া যাবে না। ১৯১৪ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে তৈরি হয় বিজ্ঞান কলেজ বা ইউনিভার্সিটি কলেজ অফ সায়েন্স; তার এক মূল অঙ্গ ছিল পদার্থবিদ্যা বিভাগ। সেখানে ১৯১৬ সাল থেকে ক্লাস ও গবেষণা শুরু হয়। গবেষকদের মধ্যে ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহা। মেঘনাদ সাহাই আমাদের দেশে প্রথম সুসম্বদ্ধভাবে নিউক্লিয় গবেষণার সূচনা করেছিলেন, সে কথাতে আমরা পরে আসব।

বিজ্ঞান কলেজের প্রথম দুই পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপকদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রমোহন বসু। তিনি জার্মানিতে গবেষণা করে ডক্টরেট করেছিলেন, সেখানে তিনি ক্লাউড চেম্বার বা মেঘকক্ষ নিয়ে কাজ করেছিলেন। তিনি ও তাঁর ছাত্র সুবোধ ঘোষ আমাদের দেশে প্রথম ক্লাউড চেম্বার তৈরি করে তা দিয়ে কসমিক রে বা মহাজাগতিক রশ্মি বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন। আধুনিক যুগের হিসাবে মহাজাগতিক রশ্মিকে কণা পদার্থবিদ্যা বা পার্টিকল ফিজিক্সের মধ্যে ফেলতে হবে। সেই যুগে অবশ্য এই ভাগ ছিল না, তা হলেও এই লেখাতে আমরা কণা পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়ে যাব না। তাঁরা মেঘকক্ষ দিয়ে বিভিন্ন গ্যাসের মধ্যে আলফা কণার শক্তিক্ষয় কেমনভাবে হয় তা পর্যবেক্ষণ করতেন। বিখ্যাত নেচার পত্রিকায় তাঁদের লেখা প্রকাশিত হয়েছিল, একেই আমরা আমাদের দেশে নিউক্লিয় বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম গবেষণা বলতে পারি। 

 

দেবেন্দ্রমোহন বসু

 

মেঘনাদ সাহা ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছিলেন, সেখানেই তাঁর তত্ত্বাবধানে ভারতবর্ষে প্রথম সুসম্বদ্ধ নিউক্লিয় গবেষণার সূচনা হয়। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে দু'জনের আলাদা করে নাম করতে হয়, দৌলত সিং কোঠারি ও বাসন্তীদুলাল নাগ চৌধুরি। দ্বিতীয়জনের কথা পরে আসবে, প্রথমেই বলি কোঠারির কথা।

রাদারফোর্ড দেখিয়েছিলেন যে অনেক তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে বিটা রশ্মি বেরোয়। বিটা রশ্মি হল ইলেকট্রন। তিনি আরো দেখান যে আলফা ও বিটা তেজস্ক্রিয়াতে এক পরমাণু অন্য পরমাণুতে পরিবর্তিত হয়ে যায়। কিন্তু নিউক্লিয়াসে যদি ইলেকট্রন না থাকে, তাহলে তা আসে কোথা থেকে? অপর এক সমস্যা ছিল বিটা ক্ষয়ে নির্গত ইলেকট্রনদের সবার গতিশক্তি কেন সমান নয় কোনো ভাবেই তার ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। বিজ্ঞানী নিলস বোর তো এক সময় ভেবেছিলেন বিটা ক্ষয় ভর–শক্তির সংরক্ষণ সূত্র মেনে চলে না।

১৯৩৩ সালে মেঘনাদ ও কোঠারি বিটা ক্ষয়ের এক নতুন তত্ত্ব দেন। তাঁরা বললেন যে প্রোটন কোনো মৌলিক কণা নয়, তাকে ভাঙ্গলে পাওয়া যায় নিউট্রন ও ইলেকট্রনের বিপরীত কণা বা অ্যান্টিপার্টিকল পজিট্রন। নিউক্লিয়াসের মধ্যে আলফা কণার চলাফেরার জন্য গামা রশ্মির ফোটন কণা তৈরি হয়, তার থেকে সৃষ্টি হয় ইলেকট্রন ও পজিট্রন। পজিট্রন ও নিউট্রন মিলে তৈরি করে প্রোটন, ইলেকট্রন বিটা কণা রূপে নিউক্লিয়াস থেকে বেরিয়ে আসে। এই ছিল সাহা–কোঠারির বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব।

এই তত্ত্বের আয়ু বেশিদিন ছিল না। ১৯৩০ সালেই উলফগ্যাং পাউলি বলেছিলেন যে নিউট্রন ভেঙে তৈরি হয় প্রোটন, ইলেকট্রন ও নিউট্রিনো নামের তড়িৎআধানহীন অতি ক্ষুদ্র ভরের এক কণা। এই নতুন কণাটা কিছুটা শক্তি নিয়ে চলে যায়, সেটা পরীক্ষাগারে ধরা পড়ে না বলে ভর-শক্তির সংরক্ষণ সূত্র মিলছে না। তবে মনে রাখতে হবে যে পাউলি এই প্রস্তাব কোনো গবেষণা পত্রিকাতে প্রকাশ করেননি, ইউরোপের এক সম্মেলনে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন। ভারতবর্ষের সঙ্গে ইউরোপের বিজ্ঞানীমহলের যোগাযোগ ছিল ক্ষীণ, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রের এলাহাবাদের অবস্থান ছিল কলকাতার তুলনায় আরো প্রান্তিক। মেঘনাদরা এলাহাবাদে বসে সম্ভবত পাউলির সেই চিঠির খবর পাননি। নিউট্রিনোকে হিসাবে রেখে বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব প্রকাশ করেন এনরিকো ফার্মি ১৯৩৩ সালে, নিউট্রিনো প্রথম আমাদের যন্ত্রে ধরা পড়ে ১৯৫৬ সালে। কাজেই সাহারা যখন গবেষণা করছিলেন, তখনও বিটা ক্ষয়ের তত্ত্ব নিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি। পরে দেখা গেছে যে প্রায় দশাদের প্রস্তাবের মতো ঘটনা নিউক্লিয়াসে ঘটে, সেখান থেকে নির্গত উচ্চ শক্তির গামা অনেক সময় ইলেকট্রন ও পজিট্রন রূপে পরিবর্তিত হয়।

এই গবেষণার কয়েকটা দিক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। প্রথমত সাহা ও কোঠারি বিজ্ঞানের প্রথম সারির এক সমস্যাতে হাত দিয়েছিলেন; সাধারণ গবেষণাতে তাঁরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। দ্বিতীয়ত তাঁরা সাহস করে বলেছিলেন প্রোটন মৌলিক কণা নয়, তাকেও ভাঙা সম্ভব। সম্ভবত তাঁরাই এই কথা প্রথম বলেছিলেন। পরে এক গবেষণাতে মেঘনাদ বলেছিলেন নিউট্রনও মৌলিক কণা নয়, তা দুই চৌম্বক একমেরু কণার সমষ্টি। তিন দশক পরে বোঝা যাবে প্রোটন ও নিউট্রন আসলে মৌলিক কণা নয়, তারা তিনটি করে কোয়ার্ক কণা দিয়ে তৈরি। তার সঙ্গে অবশ্য মেঘনাদদের তত্ত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। একমেরু কণার সন্ধানও এখনো পাওয়া যায়নি। 

দৌলত সিং কোঠারি

 

পরবর্তীকালে মেঘনাদ কোঠারিকে কেমব্রিজে রাদারফোর্ডের কাছে গবেষণা করতে পাঠান, তাঁর সঙ্গে কাজ করেই তিনি ডক্টরেট করেছিলেন। দেশে ফিরে তিনি দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন; স্বাধীন ভারতে তিনি প্রথমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের পরামর্শদাতা ও পরে বারো বছর বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের প্রধান হিসাবে কাজ করেছিলেন। আমাদের দেশ থেকে আরো দুই ছাত্র রাদারফোর্ডের কাছে গবেষণা করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে একজন হলেন নাজির আহমেদ যিনি পাকিস্তান পরমাণু আয়োগের প্রথম সভাপতি। অপরজন রফি আহমদ চৌধুরি পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র প্রকল্পে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

মেঘনাদ, তাঁর ছেলে অজিত কুমার সাহা এবং সমরেন্দ্রনাথ ঘোষাল নিউক্লিয়াসের ভর নির্ণয়ের একটি সূত্র তৈরি করেছিলেন। এই ধরনের সূত্র প্রথম দিয়েছিলেন হান্স বেথে ও কার্ল ওয়াইজ্যাকার। সাহারা এই সূত্রে একটি নতুন পদ যোগ করেছিলেন। এই পদটি নিউক্লিয়াসে স্পিন বা কৌণিক ভরবেগের সঙ্গে যুক্ত। বর্তমানে আমরা ভর নির্ণয়ের সূত্রে ওই বিশেষ পদটি ব্যবহার না করে কাছাকাছি একটি পদ প্রয়োগ করি যা প্রোটন ও নিউট্রনের সংখ্যা জোড় না বিজোড় তার উপর নির্ভর করে। ঘোষাল পরে স্মৃতিচারণ করেছেন যে বিশ্বযুদ্ধের সময় গবেষণা পত্রিকা ও বিজ্ঞানের খবর আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাতে তাঁদের বিশেষ অসুবিধায় পড়তে হয়েছিল। অজিত সাহা পরে সাহা ইনস্টিটিউটের অধিকরতার দায়িত্ব পালন করেন।

সমরেন্দ্রনাথ ঘোষালের একটি বিশেষ গবেষণার কথা এই প্রসঙ্গে বলতে হয় যা সারা পৃথিবীতে পদার্থবিদ্যার ছাত্রদের অবশ্যপাঠ্য। ঘোষালের পরীক্ষা নামে পরিচিত এই কাজটিতে তিনি নিউক্লিয় বিক্রিয়ার এক মৌলিক তত্ত্ব প্রমাণ করেছিলেন। দুটি নিউক্লিয়াসের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটিয়ে নতুন নিউক্লিয়াস তৈরি করা যায়। এই নিউক্লিয়াসগুলি সাধারণত উত্তেজিত অবস্থায় অর্থাৎ অত্যন্ত উচ্চ শক্তিসম্পন্ন হয়, এদের বলে যৌগ (compound) নিউক্লিয়াস। এর থেকে নিউট্রন, প্রোটন, গামা রশ্মি ইত্যাদি নির্গত হয়। বিখ্যাত বিজ্ঞানী নিল্‌স বোর বলেছিলেন যে এই ধরনের যৌগ নিউক্লিয়াস থেকে যে কণা বা গামা রশ্মির নির্গমন যৌগ নিউক্লিয়াস কিভাবে তৈরি হয়েছে তার উপর নির্ভর করে না। সমরেন্দ্রনাথ ১৯৫০ সালে দুই সম্পূর্ণ ভিন্ন বিক্রিয়াতে একই যৌগ নিউক্লিয়াস তৈরি করে বোরের প্রকল্পের সত্যতা পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণ করে দেখান। এই কাজটি অবশ্য তিনি দেশে নয়, আমেরিকার বার্কলেতে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে করেছিলেন। দেশে ফিরে তিনি প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাফল্যের সঙ্গে অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেছিলেন।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের সূচনা করেছিলেন শ্যামাদাস চ্যাটার্জি, ছাত্রাবস্থাতে নিউক্লিয় বিভাজন বিষয়ে গবেষণা শুরু করে তিনি এক নতুন আবিষ্কারের খুব কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন, কিন্তু ঘটনাচক্রে সেই কৃতিত্ব থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। শ্যামাদাস তখন বসু বিজ্ঞান মন্দিরে দেবেন্দ্রমোহন বসুর ছাত্র, জগদীশচন্দ্রের মৃত্যুর পরে তাঁর ভাগনে দেবেন্দ্রমোহন ১৯৩৮ সালে বসু বিজ্ঞান মন্দিরের অধিকর্তা হয়েছিলেন। ইউরেনিয়ামের বিভাজন নিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে করতে শ্যামাদাস দেখলেন যে নিউট্রন উৎস সরিয়ে নিলেও ফিশনের সঙ্কেত তাঁর ডিটেক্টরে ধরা পড়ছে। দেবেন্দ্রমোহন সেই সময় দার্জিলিঙে, কার সঙ্গে আলোচনা করবেন? সত্যেন্দ্রনাথ বসু তখন কলকাতায়, শ্যামাদাস তাঁর কাছে গিয়ে বিষয়টা খুলে বললেন। সত্যেন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করলেন মহাজাগতিক রশ্মির জন্য কি এটা হতে পারে? শ্যামাদাস ইউরেনিয়ামকে সিসের চাদর দিয়ে মুড়ে মহাজাগতিক রশ্মি কমানোর ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু সঙ্কেত আসা কমল না। সত্যেন্দ্রনাথ তখন অনুমান করলেন যে ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াস নিজে নিজেই ভেঙে যাচ্ছে। সে সময় নিউক্লিয় বিভাজন ব্যাখ্যা করার জন্য নিল্‌স বোর ও জন হুইলারের তত্ত্ব ব্যবহার করা হত, সেই অনুযায়ী এই ঘটনা অসম্ভব। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ চিরকালই পরীক্ষানিরীক্ষাকে তত্ত্বের থেকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন; তিনি শ্যামাদাসকে তাঁর গবেষণার কথা ছাপানোর পরামর্শ দেন। শ্যামাদাসও সেই মতো গবেষণাপত্রটি লিখে পাঠিয়ে দেন। কিন্তু দেবেন্দ্রমোহন কলকাতাতে ফিরে এসে শ্যামাদাসের পরীক্ষা দেখে সন্তুষ্ট হতে পারেননি; হয়তো তাঁর মনে হয়েছিল যে নিল্‌স বোরের তত্ত্বে ভুল থাকতে পারে না। তিনি শ্যামাদাসকে গবেষণাপত্র ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেন। ঠিক দু’মাস পরে দুই সোভিয়েত বিজ্ঞানী ফ্লেরভ ও পেত্রাক ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসের নিজে নিজে ভেঙে পড়ার কথা প্রকাশ করেন।

শ্যামাদাস চ্যাটার্জি

 

কণা পদার্থবিদ্যা, বিশেষ করে মহাজাগতিক রশ্মির গবেষণাতে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাভা ও পরে বিক্রম সরাভাই; স্বাধীন ভারতে তাঁরা দুজনে পরপর পরমাণু শক্তি আয়োগের প্রধান হয়েছিলেন। দেবেন্দ্রমোহন ও তাঁর ছাত্রী বিভা চৌধুরিও কণা পদার্থবিদ্যাতে এক অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য আবিষ্কারের কাছাকাছি পোঁঁছেছিলেন। আগেই বলেছি এই লেখাতে কণাপদার্থবিদ্যার আলোচনা থাকবে না। নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানের প্রথম যুগে সকলেই তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে নির্গত রশ্মি অথবা মহাজাগতিক রশ্মির সাহায্যে পরীক্ষানিরীক্ষা করতেন, ভারতীয় বিজ্ঞানীরাও সেই পথেই হেঁটেছিলেন। তেজস্ক্রিয়তাতে নির্গত কণাদের শক্তি খুব বেশি নয়, অন্যদিকে মহাজাগতিক রশ্মি কখন আসবে তা বিজ্ঞানীদের হাতে নেই, তার পরিমাণও কম। ফলে পরীক্ষার সুযোগ ছিল খুব সীমিত। পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটল ১৯২০-র দশকের একদম শেষে যখন কণাত্বরকের সাহায্যে প্রোটন বা আলফা কণাদের উচ্চ শক্তি দেওয়া সম্ভব হল। বিশেষ করে বলতে হয় আর্নেস্ট লরেন্স আবিষ্কৃত সাইক্লোট্রনের কথা। আধুনিক অধিকাংশ কণাত্বরকের উৎস হল এই যন্ত্র।

মেঘনাদ ১৯৩৮ সালে এলাহাবাদ থেকে আবার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। তিনি প্রথমেই নিউক্লিয় পদার্থবিদ্যার পাঠক্রম চালু করেন, সারা দেশের মধ্যে সেটিই প্রথম। তখনই তিনি একটি সাইক্লোট্রন স্থাপনের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে পড়েন। তাঁর সঙ্গী হয়েছিলেন বাসন্তীদুলাল নাগ চৌধুরি। বাসন্তীদুলালকে মেঘনাদ লরেন্সের ল্যাবরেটরিতে পাঠান, উদ্দেশ্য সাইক্লোট্রন যন্ত্র স্থাপন ও ব্যবহার সম্পর্কে তিনি সেখান থেকে শিখে আসবেন। বাসন্তীদুলাল সেখানে পরবর্তীকালের নোবেল জয়ী এমিলিও সেগ্রের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে ডক্টরেট করেন। বিষয় ছিল তিনটি নতুন কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় মৌল যেগুলি বার্কলের সাইক্লোট্রনের সাহায্যে বানানো সম্ভব হয়েছে। ইতিমধ্যে মেঘনাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, টাটা গোষ্ঠী, বিড়লা গোষ্ঠী ও কিছু সম্পদশালী ব্যক্তির থেকে সাইক্লোট্রনের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেন। বাসন্তীদুলাল আমেরিকা থেকে যন্ত্রাংশ সংগ্রহের ব্যবস্থা করে ১৯৪১ সালে দেশে ফিরে আসেন। কিন্তু তার পরেই আমেরিকা মিত্রপক্ষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদান করে, ফলে সেগুলির দেশে পৌঁছানোতে সমস্যা হয়। একটি জাহাজ তো জাপানিরা ডুবিয়েই দেয়। ফলে সাইক্লোট্রন তৈরিতে দেরি হয়; তার থেকে প্রথম কণার স্রোত পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালে। যন্ত্রটি পুরোপুরি কাজ শুরু করে ১৯৬৬ সালে, মেঘনাদ তার দশ বছর আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন।

মেঘনাদ ১৯৪৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরেই ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স তৈরি করেছিলেন, কিন্তু প্রথম থেকেই তার পরিচালনাতে অর্থসমস্যা দেখা দেয়। ভারতের স্বাধীনতা লাভের কয়েকবছর আগে থেকেই গবেষণা বিশেষত নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা বিষয়ে পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল। জওহরলাল নেহরুর ইচ্ছাতে সেই উদ্যোগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন হোমি জাহাঙ্গির ভাভা। সদ্যস্বাধীন দেশের অর্থবল ছিল কম, তাই ভাভা একমাত্র বোম্বাই, অর্থাৎ বর্তমানে মুম্বাইতে নিউক্লিয় গবেষণা কেন্দ্রীকরণের পক্ষপাতী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকেও গবেষণার জন্য বিশেষ অর্থবরাদ্দ করা সম্ভব হয় নি। শেষ পর্যন্ত সাহার ইন্সটিটিউট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, বর্তমানে তার নাম সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। মেঘনাদের মৃত্যুর পরে বাসন্তীদুলাল সাহা ইনস্টিটিউটের প্রধান হয়েছিলেন।

পরাধীন ভারতে কলকাতা বা এলাহাবাদে নিউক্লিয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা শুরু হয়েছি, স্বাধীনতার পরে তার মূল কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াল বোম্বাই। পরাধীন ভারতে নিউক্লিয় গবেষণার আরো এক কেন্দ্র তৈরির চেষ্টা হয়েছিল, বাঙ্গালোরের ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়ন্সে সেই প্রয়াস নিয়েছিলেন রামন। রামন তাঁর ছাত্র আর এস কৃষ্ণনকে কেমব্রিজে পাঠান। সেখানে তিনি বাসন্তীদুলালের মতোই সাইক্লোট্রন চালানোর ব্যাপারে জ্ঞান লাভ করে এবং কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা বিষয়ে গবেষণা করে ১৯৪১ সালে দেশে ফেরেন। কৃষ্ণন ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে নিউক্লিয় গবেষণাগার তৈরির চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে রামন ইন্সটিটিউটের অধিকর্তার পদ ছেড়েছেন, তবে নতুন অধিকর্তা জ্ঞানচন্দ্র ঘোষও কৃষ্ণনের প্রয়াসকে জোরদার সমর্থন করেন। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে নিউক্লিয় গবেষণা খুব ব্যয়বহুল, ফলে কৃষ্ণনকে অর্থের জন্য ইন্সটিটিউটের বাইরের উপর নির্ভর করতেই হচ্ছিল। কিন্তু সে সময় দেশের বিজ্ঞাননীতি নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল যে সমস্ত বিজ্ঞানীদের হাতে, সেই ভাভা, শান্তিস্বরূপ ভাটনগর বা মেঘনাদদের কেউই কৃষ্ণনের প্রস্তাব সমর্থন করেননি। ফলে ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্সে আর কখনোই নিউক্লিয় গবেষণা শুরু হয়নি।

১৯৪৫ সালের দুই পরমাণু বিস্ফোরণ নিউক্লিয় প্রযুক্তির অমিত সম্ভাবনা সম্পর্কে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানী ও দেশের নীতি নির্ধারকদের সচেতন করেছিল। রাষ্ট্রের উৎসাহের ফলে নিউক্লিয় গবেষণাতে অর্থবরাদ্দ বাড়ে, এবং নতুন এক যুগের সুচনা হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই অর্থবরাদ্দের সিংহভাগ নিউক্লিয় প্রযুক্তির উন্নতিতেই ব্যবহৃত হয়েছিল, তবে মৌল গবেষণাও তার ফলে উপকৃত হয়েছিল। সেই আলোচনা স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয়, তাই এই লেখা নিউক্লিয় গবেষণাতে প্রথম যুগেই সীমাবদ্ধ থাকল। 

 

প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান, জানুয়ারি ২০২৩   





Saturday 7 January 2023

কোথায় মোদের স্থান?

 

কোথায় মোদের স্থান?

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


পাঠকরা সবাই জানেন যে প্রাচীন কালে দু'একজন ছাড়া সব মানুষেরই বিশ্বাস ছিল যে পৃথিবী আছে ব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্রে, তাকে ঘিরেই সমস্ত কিছু আবর্তন করে। সেই ভূকেন্দ্রিক চিন্তা ভাবনার বিরোধিতার মাধ্যমেই আধুনিক বিজ্ঞানের জন্ম। কেন প্রায় সব প্রাচীন সভ্যতাই মনে করত যে পৃথিবী স্থির? কারণটা খুব সহজ, চোখে দেখা যেত যে সূর্য গ্রহ নক্ষত্ররা তাকে প্রদক্ষিণ করছে। জাড্য সম্পর্কে সঠিক ধারণার আগে পৃথিবী যে দ্রুতবেগে চলতে পারে তা বোঝা অসম্ভব ছিল। ব্যতিক্রম ছিলেন না তা নয়, যেমন গ্রিসে আরিস্টার্কাস (আনু 310–230 খ্রিপূ) বলেছিলেন সূর্যকেন্দ্রিক জগতের কথা। কিন্তু সেই সময়ের জ্ঞানের বিচারে বিচার করলে অ্যারিস্টার্কাসের মতকে সমর্থনের কোন কারণ ছিল না। প্রাচীন যুগে গ্রহদের চলাফেরার সব থেকে ভালো বর্ণনা দিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞানী ক্লডিয়াস টলেমি (100-170 খ্রি); এবং তা অ্যারিস্টার্কাসের থেকে অনেক ভালোভাবে পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম হয়েছিল।

টলেমির মডেলে পৃথিবী ছিল স্থির, তার চারদিকে সূর্য সহ অন্য নক্ষত্ররা প্রদক্ষিণ করছে। সেই প্রদক্ষিণের পথ ছিল অত্যন্ত জটিল, কারণ পৃথিবীর গতির জন্য আকাশে গ্রহদের বেগের পরিবর্তন হয়, কখনো কখনো কখনো তাদের উল্টোদিকে যেতে দেখা যায়। বিখ্যাত গ্রিক পণ্ডিত অ্যারিস্টটটলকে (384-322 খ্রি পূ) অনুসরণ করে টলেমি ধরে নিয়েছিলেন গ্রহদের কক্ষপথ বৃত্তকার এবং তাদের বেগ অপরিবর্তনীয়। অ্যারিস্টটল বলছিলেন বৃত্তই একমাত্র নিখুঁত এবং জ্যোতিষ্করা নিখুঁত ও অপরিবর্তনীয় কারণ তারা এই পরিবর্তনশীল পৃথিবীর ক্লেদের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। মূল বৃত্তটির পরিধির উপরে বৃত্ত (epicycle) বসিয়ে টলেমি গ্রহদের এই বিপরীতগতির ব্যাখ্যা করেছিলেন। ভূকেন্দ্রিক মডেল বলা হলেও কিন্তু গ্রহদের কক্ষপথের মূল বৃত্তটির কেন্দ্র পৃথিবী থেকে দূরে অবস্থান করত। নিচের ছবি থেকে হয়তো টলেমির মডেলটা কিছুটা পরিষ্কার হবে।



 

  এপিসাইকল তত্ত্ব


গ্রিক সভ্যতার পতনের পরে টলেমির তত্ত্ব আরব বিজ্ঞানীদের হাত ঘুরে আবার যখন ইউরোপে এসেছিল তখন তা দৃঢ়প্রতিষ্ঠ। টলেমির পরে প্রায় দেড় হাজার বছর পৃথিবীকেন্দ্রিক বিশ্বের সত্যতা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেন নি। বাইবেল থেকে তার পক্ষে যুক্তিও খুঁজে পেয়েছিলেন খ্রিস্টান দার্শনিকরা। চার্চ ছিল অ্যারিস্টটলের উৎসাহী সমর্থক। তাঁকে অনুসরণ করে চার্চ বলত আকাশের জ্যোতিষ্করা সবাই নিখুঁত ও অপরিবর্তনীয়। পৃথিবী অন্য সমস্ত জ্যোতিষ্কদের থেকে আলাদা, পাপ ও ক্লেদে ভরা পৃথিবীর কোনো আলো নেই। চাঁদ পৃথিবীর কাছে আছে, পৃথিবীর প্রভাব তার উপর পড়েছে। তাই তার নিজের আলো নেই। মাটির পৃথিবীই একমাত্র পরিবর্তনশীল; আকাশের জ্যোতিষ্করা অপরিবর্তনীয়, বিধাতার অমোঘ নিয়মে মেনে চলে। তাদের সকলের গতি বৃত্তাকার পথে, কারণ বৃত্ত হল একমাত্র নিখুঁত আকৃতি। পৃথিবী আছে বিশ্বের কেন্দ্রে, তার পরে চাঁদ, অন্যান্য গ্রহ এবং সবশেষে নক্ষত্রেরা। বিশ্বের এই মডেলে নক্ষত্রদের থেকে দূরে খ্রিস্টধর্মের কল্পিত স্বর্গ ও নরকের জন্য অনেকটা জায়গা পাওয়া যাচ্ছিল।

এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার করে বলা যাক, পৃথিবীর গতির কথা বলতে আমরা তার বার্ষিক গতি, অর্থাৎ সূর্যের চারদিকে তার আবর্তনের কথা বলছি। পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারদিকে আবর্তনের জন্য দিনরাত্রি হয়, তাকে বলে আহ্নিক গতি। আহ্নিক গতির কথা অনেকেই বলেছিলেন, প্রাচীন গ্রিসে অ্যানাক্সিমান্ডার (610-546 খ্রিপূ) , লিউচিপ্পাস (খ্রিপূ পঞ্চম শতাব্দী) বা ভারতে আর্যভট্ট (476-550) আহ্নিক গতির কথা বলেছিলেন।1 গ্রিসে অ্যারিস্টটলের তীব্র বিরোধিতার ফলে সেই ধারণা পরিত্যক্ত হয়। ভারতেও বরাহমিহির (আনু 505-587), ব্রহ্মগুপ্ত (আনু 598-668), এমনকি আর্যভট্টের অনুরাগী লল্লও (আনু 720-790) আর্যভট্টের এই মতের বিরোধিতা করেছিলেন। 

 কোথাও কোথাও শোনা যায় যে আর্যভট্ট বার্ষিক গতির কথা বলেছিলেন এবং তার সমর্থনে এই শ্লোকটি উদ্ধৃত হয়।

অনুলোমগতিনৌস্থঃ পশ্চাত্যচলং বিলোমগং যদবৎ

অচলানি ভানি তদবৎ সমপশ্চিমগানি লঙ্কায়াম্‌ ...

অর্থাৎ, যেমন গতিশীল নৌকার আরোহী তীরস্থিত অচল বৃক্ষদিগকে বিপরীতদিকে যেতে দেখে, তেমনি লঙ্কা থেকে (অর্থাৎ বিষুবরেখার উপর থেকে) স্থির নক্ষত্রদিগকে সমবেগে পশ্চিম দিকে যাইতে দেখা যায়। এখানে স্পষ্টতই পৃথিবীর নিজের অক্ষের চারদিকে আবর্তনের অর্থাৎ আহ্নিক গতির কথা বলা হয়েছে। সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণের জন্য নক্ষত্রদের অবস্থানের পরিবর্তন খালি চোখে দেখা সম্ভব নয়। তা মাপার মতো সূক্ষ্ম যন্ত্র ঊনবিংশ শতাব্দীর আগে আবিষ্কার হয়নি; এই লেখার শেষ অংশে সেই কাহিনি আছে।

স্থির পৃথিবী নিয়ে প্রশ্ন উঠল ষোড়শ শতকে। 1543 খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হল পোল্যান্ডের খ্রিস্টান যাজক নিকোলাস কোপার্নিকাসের (1473-1543) স্থির সূর্য ও চলমান পৃথিবীর তত্ত্ব নিয়ে সেই বিখ্যাত বই ডি রেভেলোউশনিবাস অরবিয়াম সেলেশ্চিয়াম। অবশ্য কোপার্নিকাস তার অনেক আগে থেকেই বন্ধুদের মধ্যে তাঁর মত তিনি প্রচার করেছিলেন। সেই যুগে অবশ্য বইটি বিশেষ সাড়া ফেলেনি, তার কিছু কারণও ছিল। কোপার্নিকাসও বৃত্তাকার পথের চিন্তা থেকে বেরোতে পারেননি, ফলে তাঁর মডেলেও এপিসাইকেল দরকার ছিল, যদিও সংখ্যায় তা টলেমির মডেলের থেকে অপেক্ষাকৃত কম। অপর এক কারণের কথায় আমরা পরে আসছি। বৈজ্ঞানিক যুক্তির বাইরের এক ঘটনাচক্রে বইটি বিজ্ঞানীমহলে বিশেষ সাড়া ফেলতে পারেনি। কোপার্নিকাস তাঁর মত বন্ধুদের চিঠিপত্র মারফত জানালেও বই আকারে প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন শেষ বয়সে। ছাপা যখন শুরু হয়েছে তখন কোপার্নিকাস খুবই অসুস্থ ছিলেন, দেখাশোনা করার দায়িত্ব তিনি দিয়েছিলেন আর এক খ্রিস্টান যাজক আন্দ্রিয়াস ওসিয়ান্দারকে (1498-1552)। ওসিয়ান্দার দেখলেন যে বইটি বাইবেলের ব্রহ্মাণ্ডতত্ত্বের বিরোধী, তিনি কোপার্নিকাসের অজ্ঞাতসারে বইতে এক ভূমিকা যোগ করেছিলেন। তাতে তিনি লিখেছিলেন যে সেই বইয়ের বর্ণিত জগৎ বাস্তব নয়, শুধুমাত্র অঙ্ক কষার সুবিধার জন্যই এই নতুন তত্ত্ব। কোপার্নিকাস মৃত্যুশয্যায় বইটির প্রথম কপি হাতে পেয়েছিলেন, তিনি সেই ভূমিকার কথা কোনোদিন জানতে পারেননি। এই ভূমিকাটির জন্য কোপার্নিকাসের সৌরজগতের মডেলকে অনেকেই উপেক্ষা করেছিলেন।

টলেমি ও কোপার্নিকাস ছাড়াও ব্রহ্মাণ্ডের আরো একটা মডেল ছিল। ড্যানিশ বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে (1546-1601) দূরবিন আবিষ্কারের আগের যুগে গ্রহ নক্ষত্রের গতিবিধি বিষয়ে সব থেকে নিখুঁত পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। তিনি কোপার্নিকাসের মতে বিশ্বাসী ছিলেন না, আবার পুরোপুরি টলেমির অনুগামীও ছিলেন না। তাঁর মডেলে পৃথিবী কেন্দ্রীয় অবস্থানে আছে। চন্দ্র, সূর্য ও দূরের নক্ষত্ররা পৃথিবীকে আবর্তন করছে। অন্য গ্রহগুলি আবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে।তবে টাইকোই প্রথম যে এই তত্ত্ব দিয়েছিলেন তা নয়। বিখ্যাত কেরালা গণিত সম্প্রদায়ের নীলকান্ত স্বামী (১৪৪৪-১৫৪৪) টাইকোর আগেই একই মডেল দিয়েছিলেন। তারও হাজার বছর আগে খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীতে মার্টিনিয়াস ক্যাপেলা বলেছিলেন যে বুধ ও শুক্র সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, এবং চন্দ্র সূর্য সহ অন্য সমস্ত গ্রহ ও নক্ষত্র পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। কোপার্নিকাসের বইতে তাঁর সপ্রশংস উল্লেখ আছে। পরবর্তীকালে দূরবিনের সাহায্যে পর্যবেক্ষণ থেকে টলেমির মডেল বাতিল হয়ে গেলেও কোপার্নিকাস ও টাইকোর মডেলের মধ্যে কোনটি ঠিক তার বিচার অত সহজ ছিল না। সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে টাইকোর মডেলে বিশেষ কেউ বিশ্বাস করত না, কিন্তু তা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না এমন পর্যবেক্ষণ পেতে 1838 সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

আগেই বলেছি কোপার্নিকাসের মত খুব একটা প্রভাব ফেলে নি। তার কারণ সাধারণ মানুষ সহজে বুঝবে এমন কোনো প্রমাণ কোপার্নিকাসের তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়নি। বরঞ্চ বিপক্ষের লোকরা অনেক কথাই বলতেন, যার কোনো উত্তর দেওয়া যেত না। একটা উদাহরণ দেখা যাক। গাড়িতে যাচ্ছি, সামনে আছে একটা গাছ আর পিছনে একটা পাহাড়। যত এগোচ্ছি, গাছ আর পাহাড়ের আপেক্ষিক জায়গা পরিবর্তন হচ্ছে। তেমনি পৃথিবী যদি চলমান হয় তাহলে ছ'মাস আগে পরে সে আলাদা জায়গায় আছে, সুতরাং তার সাপেক্ষে আকাশে নক্ষত্রদের মধ্যে আপেক্ষিক অবস্থানের পরিবর্তন হওয়া উচিত, এই পরিবর্তনের কৌণিক মাপকে বলে লম্বন। কেন লম্বন দেখা যাচ্ছে না তা কোপার্নিকাসপন্থীরা বলতে পারতেন না।

গ্যালিলিওর দূরবিন দিয়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করেন ১৬০৯ সালে। দূরবিন অনেক প্রশ্নের জবাব নিয়ে এল। গ্যালিলিও যখন রাতের আকাশে দুধ-সাদা আকাশগঙ্গার দিকে দূরবিন ফেরালেন, দেখলেন তা হল অসংখ্য নক্ষত্রের সমষ্টি। গ্যালিলিও প্রথম বুঝলেন যে আকাশগঙ্গার নক্ষত্ররা এত দূরে আছে যে খালি চোখে তাদের আলাদা করে চেনা যাচ্ছে না। দূরবিন দিয়ে দেখেও তাদের বিবর্ধিত করা যাচ্ছে না, অর্থাৎ দূরত্ব এতই বেশি যে দূরবিনেও তাদের বিন্দুর মতো লাগছে। এই একটি পর্যবেক্ষণই মহাবিশ্বের আয়তনকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দিল। গ্যালিলিও বললেন যে নক্ষত্রদের দূরত্ব এত বেশি যে তাদের লম্বন মাপ যায় না, যেমন অল্প পথ গেলে কিন্তু দূরের দুটো পাহাড়ের আপেক্ষিক স্থান পরিবর্তন বোঝা যায় না। এই বিরাট ব্রহ্মাণ্ডে তাহলে পৃথিবীর স্থান অতি নগণ্য, সে কি ব্রহ্মান্ডের কেন্দ্রে থাকতে পারে?

তাহলে কি কোপার্নিকাসই ঠিক বলেছেন, পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে? অ্যারিস্টটল আর টলেমি কি ভুল করতে পারেন? বাইবেলে কি ভুল লেখা আছে? আগে থেকেই কোপার্নিকাসের মতেই বিশ্বাস করতেন গ্যালিলিও, কিন্তু তার প্রচারে তিনি খুব উৎসাহী ছিলেন না। কেপলারকে 1597 সালে চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে লোকের ঠাট্টার ভয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোপার্নিকাসের মত সমর্থন করতে পারছেন না। সেই সুযোগ এলো 1610 সালের জানুয়ারি মাসের 7 তারিখ। সেই দিন বৃহস্পতিকে ভালো করে দেখতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন তার চারটি উপগ্রহ। বৃহস্পতিকে কেন্দ্র করে যদি উপগ্রহরা পাক খেতে পারে, তাহলে পৃথিবী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র না হতেও পারে। তিনি পরে দেখিয়েছিলেন যে পৃথিবীকে চলমান ধরে নিলেই এক মাত্র সহজে বৃহস্পতির চাঁদেদের গ্রহণের সময় বার করা যায়।

সূর্যকেন্দ্রিক জগৎ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে গ্যালিলিও বলবিদ্যাকে পাল্টে দিয়েছিলেন। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন পৃথিবী চলমান হলে কোনো বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে তা পিছিয়ে যাবে। একই কারণে চাঁদও গতিশীল পৃথিবীর সঙ্গে থাকতে পারবে না। গ্যালিলিও বললেন যে বৃহস্পতি যদি চারটি চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে, তাহলে পৃথিবী কেন পারবে না? তিনি উদাহরণ দিলেন যে চলমান জাহাজের মাস্তুল থেকে কোনো বস্তুকে নিচে ফেললে তা মাস্তুলের গোড়াতেই পড়ে, জাহাজের গতির জন্য পিছন দিকে চলে যায় না। তেমনি পৃথিবীতেও পতনশীল বস্তু সোজা নিচের দিকেই পড়ে, পিছিয়ে যায় না। তিনি দেখালেন যে বস্তুর গতিতে স্থিতাবস্থার আলাদা করে কোনো গুরুত্ব নেই। এখান থেকেই নিউটন জাড্য বিষয়ে তাঁর চিন্তাতে পৌঁছান। অসাধারণ কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে গ্যালিলিও দেখালেন ঘর্ষণ বা অন্য কোনো বল না থাকলে সচল বস্তু চিরকাল সচল থাকবে।

টাইকো ছিলেন Holy Roman Empire বা পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজদরবারের জ্যোতির্বিদ। জার্মান বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার (1571-1630 খ্রি) তখন ছিলেন টাইকোর সহকারী, টাইকোর মৃত্যুর পর তিনি তাঁর পদে বসেন। গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত তিনটি সূত্রের জন্য তিনি বিখ্যাত। গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত যে বিশাল তথ্যভাণ্ডার টাইকো সারাজীবন ধরে পর্যবেক্ষণ করে সঞ্চয় করেছিলেন, তার উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন কেপলার। কেপলার কোপার্নিকাসের তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন; বেশ কিছুদিন তিনি সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বে গ্রহদের বৃত্তাকার কক্ষপথ ধরে টাইকোর পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছিলেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি অন্য পথ খুঁজতে শুরু করেন। তাঁর আগে পর্যন্ত কেউ গ্রহনক্ষত্রদের কক্ষপথ যে বৃত্তাকার ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে সে কথা চিন্তাই করেননি। কেপলার দেখলেন যে বৃত্তাকার কক্ষপথ না ধরলে সমস্যার সমাধান অনেক সোজা হয়ে যায়, এপিসাইকেলের কোনো প্রয়োজন হয় না। তিনি আবিষ্কার করলেন যে গ্রহরা সুর্যের চারদিকে উপবৃত্ত (ellipse), এই আকারের কক্ষপথে চলে। বৃত্তের যেমন একটি কেন্দ্র থাকে, উপবৃত্তের আছে দুটি নাভি। তার মধ্যে এক নাভিতে থাকে সুর্য। এই হল কেপলারের প্রথম সূত্র। নিচের ছবিতে সুর্যের চারদিকে গ্রহের কক্ষপথ দেখানো হয়েছে, বোঝার সুবিধার জন্য বৃত্তাকার কক্ষপথের সঙ্গে পার্থক্যকে অনেকটা বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে।

 

কেপলার আরও দেখলেন যে কোনো গ্রহ আর সূর্যকে যদি এক কাল্পনিক রেখা দিয়ে যুক্ত করি, তাহলে তা সমান সময়ে কক্ষপথের সমান এলাকা অতিক্রম করবে। এটি হল তাঁর দ্বিতীয় সূত্র। এই দুটি সূত্র তিনি প্রকাশ করেন 1609 সালে, যে বছর গ্যালিলিও দূরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিলেন। এরপর কেপলার বিভিন্ন গ্রহের গতিবিধির মধ্যে সম্পর্ক খোঁজার কাজ শুরু করেন। এর ফলেই আবিষ্কার হয় তাঁর তৃতীয় সূত্র, সুর্যের চারপাশে কোনো গ্রহের আবর্তন কালের বর্গ সূর্য থেকে তার গড় দূরত্বের (আরো সঠিকভাবে বললে কক্ষপথের অর্ধ-পরাক্ষের) ঘনকের সমানুপাতী। এই সূত্রগুলি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আইজ্যাক নিউটন (1643-1727) তাঁর সার্বজনীন মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন।

কোপার্নিকাসের মডেলের সব থেকে বড় সমালোচনা ছিল নক্ষত্রদের লম্বনের অনুপস্থিতি, গ্যালিলিও তার একটা ব্যাখ্যা দেন, বলেন নক্ষত্ররা অনেক দূরে আছে; কিন্তু কত দূরে? লম্বন মাপা গেলে সহজ জ্যামিতির সাহায্যে নক্ষত্রদের দূরত্ব মাপা সম্ভবসহজ জ্যামিতি দেখায় যে কোনো নক্ষত্রের দূরত্ব = তার লম্বন কোণ (রেডিয়ান মাপে)/পৃথিবী ও সূর্যের গড় দূরত্ব। সরাসরি না হলেও দূরত্ব অন্য ভাবে মাপতে চেষ্টা করেছিলেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে নিউটনের হিসাবই খুব কাছে পৌঁছেছিল। তিনি ধরে নিয়েছিলেন যে লুব্ধক সূর্যের মতোই উজ্জ্বল। তিনি জানতেন যে শনি ও লুব্ধকের ঔজ্জ্বল্য প্রায় সমান। সূর্য থেকে কতটা আলো শনি পায় এবং কতটা প্রতিফলিত করতে পারে তা অনুমান করে তিনি নির্ণয় করেছিলেন লুব্ধকের দূরত্ব সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্বের আট লক্ষ গুণ। আধুনিক এককে নিউটনের নির্ণয় করা দূরত্ব হবে 12.6 আলোকবর্ষ। প্রকৃত মান হল 8.6 আলোকবর্ষ। হিসাবে অনেক অনুমান থাকলেও নিউটন অনেকটা কাছাকাছি গিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। বোঝা গিয়েছিল যে লম্বন দেখতে গেলে খুব সূক্ষ্ম যন্ত্রের প্রয়োজন হবে।

অন্যদিকে, কোপার্নিকাসের মৃত্যুর তিনশো বছর পরেও তাঁর ও টাইকোর সৌরজগতের মডেলের পার্থক্য করা সম্ভব ছিল শুধুমাত্র লম্বনের মাধ্যমে। টাইকোর মডেলে পৃথিবী স্থির, তাই টলেমির মডেলের মতোই সেখানে লম্বনের মান শূন্য হবে। যদিও নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের পর আর কেউ টাইকোর মডেলে বিশ্বাস করত না, তবু বিজ্ঞানে প্রমাণ জরুরি। সুতরাং বিজ্ঞানীরা লম্বন মাপার চেষ্টা করেই চলেছিলেন। সফল হলেন জার্মান বিজ্ঞানী ফ্রিয়েডরিশ উইলহেল্ম বেসেল (1784-1846)। প্রয়োজনীয় সূক্ষ্ম যন্ত্রটি বানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী ও সমকালের জ্যোতির্বিদ্যাতে শ্রেষ্ঠ যন্ত্রনির্মাতা জোসেফ ফন ফ্রনহফার (1787-1826)। বেসেল কোনিসবার্গ মানমন্দিরের জন্য সেই রকম যন্ত্র নির্মাণের দায়িত্ব দেন ফ্রনহফারকে। যন্ত্রটা শেষ করার আগেই ফ্রনহফারের মৃত্যু হয়, তবে অন্যরা সেটা সম্পূর্ণ করেছিল।

বেসেলই প্রথম নির্ভুলভাবে লম্বন মাপতে সফল হয়েছিলেন। 1838 সালে হংস (Cygnus) নক্ষত্রমণ্ডলের 61 Cygni নক্ষত্রের লম্বন মেপে তিনি পেলেন 0.31 সেকেন্ডএই সেকেন্ড হল কোণের মাপ। এক ডিগ্রিতে ষাট মিনিট, এক মিনিটে ষাট সেকেন্ড।  দূরত্ব ও লম্বনের সম্পর্ক থেকে দেখা যাচ্ছে ওই নক্ষত্রের দূরত্ব হয় 10.5 আলোকবর্ষ। এই প্রথম নক্ষত্রদের মধ্যের দূরত্ব মাপা সম্ভব হল। প্রায় একই সময়ে আরো দু'জন জ্যোতির্বিদ, অটো স্ট্রুভে (1819-1905) ও ও টমাস হেন্ডারসন (1798-1844) এই কাজে সফল হয়েছিলেন। দুজনেই বেসেলের আগেই লম্বনের পরিমাপ করেছিলেন, কিন্তু প্রকাশ করেছিলেন পরে। স্ট্রুভের মাপ অবশ্য অনেকটাই ভুল ছিল। বেসেলের মাপ আমাদের কাছে ব্রহ্মাণ্ডের বিশালতাকে প্রথম প্রতিষ্ঠা করল। অবশ্য তখন আমরা যা ভাবতাম, মহাবিশ্ব তার থেকে অনেক বড়। তবে অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কোপার্নিকাসের সময় থেকেই আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সূচনা হল ধরে নিতে পারি।

কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওর মত প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে বোঝা যায় যে আমাদের সূর্যের মতো বহু নক্ষত্র আছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে যে এই নক্ষত্ররা কি ব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে, নাকি অনন্ত শূন্যের মাঝে কিছুটা জায়গা অধিকার করে আছে? রেনে দেকার্তে (1596-1650) মনে করেছিলেন যে বস্তুর পরিমাণ সসীম, এবং বস্তুর সীমার বাইরে স্থানের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। তরুণ নিউটন কিন্তু ভেবেছিলেন যে বস্তুর পরিমাণ সসীম হলেও শূন্যস্থান অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত; নিউটনের ভাষায় সর্বশক্তিমান ঈশ্বর ইচ্ছা করলেই অসীম স্থান সৃষ্টি করতে পারেন। পরে এই প্রশ্ন নিউটনের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, কারণ মাধ্যাকর্ষণ আবিষ্কারের পরে প্রশ্ন আসে যে নক্ষত্ররা কেন পারষ্পরিক আকর্ষণে কাছে চলে আসছে না। তিনি অনুমান করেছিলেন যে অনন্ত পর্যন্ত নক্ষত্ররা একই ভাবে বিস্তৃত; তিনি ভেবেছিলেন যে সেই ক্ষেত্রে যে কোনো নক্ষত্রের উপরে সবদিকে টান সমান হবে, সুতরাং সে কোনোদিকেই যাবে না। কিন্তু তিনি পরে বোঝেন যে এই অবস্থা স্থায়ী হতে পারে না; যে কোনো দিকে নক্ষত্র একটু সরলেই সেই দিকের আকর্ষণ আরো বেশি হবে এবং সে সেদিকেই চলতে শুরু করবে। তখন তিনি এর জন্য ঐশ্বরিক হস্তক্ষেপের প্রয়োজন বোধ করেছিলেন।

পর্যবেক্ষণ থেকে এই প্রশ্নের প্রথম উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন টমাস রাইট (1711-1786)। পরিষ্কার রাতের আকাশের দিকে তাকালে দেখা যায় সাদা দুধের মতো আকাশগঙ্গা, গ্যালিলিওর দূরবিনে যা অজস্র নক্ষত্রের সমষ্টি হয়ে দেখা দিয়েছিল। রাইট অনুমান করেন যে নক্ষত্ররা একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, তার বাইরে শুধুই শূন্য। তা না হলে সারা আকাশই ওইরকম দুধের মতো হয়ে থাকত, কারণ যেদিকেই তাকাই, অসংখ্য নক্ষত্র দৃষ্টিগোচর হত। এই নক্ষত্রজগতেরই নাম ছায়াপথ, আকাশগঙ্গা বা Milky Way। স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন আসে এই নক্ষত্রজগতের আকার কেমন? রাইট সিদ্ধান্ত করেছিলেন এটা একটা লেন্সের মতো। লেন্সের দৈর্ঘ্য বরাবর দেখলে অসংখ্য নক্ষত্রকে আলোকিত এক মেঘ বা কুয়াশার মতো দেখাবে, কিন্তু বেধ বরাবর দেখলে অন্ধকার মহাকাশ চোখে পড়বে। রাইট মনে করেছিলেন এই নক্ষত্রমণ্ডলী অক্ষের চারপাশে ঘুরছে, যার জন্য নক্ষত্রগুলি কেন্দ্রের দিকে আকর্ষণ অগ্রাহ্য করতে পারছে।

দূরবিনের সাহায্যে আমাদের পর্যবেক্ষণকে সৌরজগতের বাইরে প্রসারিত করেন আঠারো শতকের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম হার্শেল (1738-1822)। তিনি দেখলেন যে আমাদের সৌরজগত হারকিউলিস নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে গতিশীল। হার্শেল আকাশে 685টি বিভিন্ন অঞ্চল বেছে নিয়ে সেগুলিতে তারার সংখ্যা গুনলেন, তার থেকে তিনি আমাদের এই নক্ষত্রজগতের আকার নির্ণয় করার চেষ্টা করলেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ রাইটকেই সমর্থন করলো, তিনি অনুমান করলেন যে লেন্সের দৈর্ঘ্য হবে দুটি তারার মধ্যের গড় দূরত্বের আটশো গুণ এবং বেধ হবে একশো পঞ্চাশ গুণ।4 হার্শেল তারাদের মধ্যেকার দূরত্বের অনুপাত সম্পর্কে কিছুটা জানলেও কোনো তারার সঠিক দূরত্ব জানতেন না, কারণ 1838 সালের আগে সূর্য ছাড়া অন্য কোনো নক্ষত্রের দূরত্ব মাপা সম্ভব হয়নি। প্রকৃত মাপ অবশ্যই এর থেকে অনেক বেশি, কিন্তু হার্শেল আমাদের ছায়াপথের আকার অনেকটাই সঠিক পেয়েছিলেন। হার্শেলের হিসাবে মোট নক্ষত্রের সংখ্যা হয় তিরিশ কোটি। দৈর্ঘ্য বরাবর আকাশগঙ্গার ঔজ্জ্বল্য প্রায় সমান, সেই কারণে হার্শেলের মনে হয় যে আমাদের সৌরজগৎ এই নক্ষত্রজগতের কেন্দ্রের খুব কাছে অবস্থান করে।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে হার্লো শেপলি (1885-1972) আমেরিকার মাউন্ট উইলসন মানমন্দির থেকে গ্লোবুলার ক্লাস্টার বা বর্তুলাকার তারাগুচ্ছ পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এদের প্রায় নব্বই শতাংশকেই আকাশে ধনু রাশিতে দেখতে পাওয়া যায়। শেপলি বিভিন্ন পদ্ধতিতে আমাদের থেকে এই বর্তুলাকার তারাগুচ্ছের দূরত্ব মাপছিলেন। তিনি দেখলেন যে এই বর্তুলাকার তারাগুচ্ছগুলি ছায়াপথের একটি বিন্দুকে কেন্দ্র করে মোটামুটি প্রতিসাম্য বজায় রেখে অবস্থান করছে। সেই বিন্দুটি আমাদের থেকে অনেক দূরে আকাশের ধনুরাশিতে অবস্থান করে, সে জন্য আমরা অধিকাংশ তারকাগুচ্ছকেই আকাশের ওই দিকে দেখতে পাই। এই তারকাগুচ্ছগুলি বিপুলাকার, এদের মধ্যে কয়েক হাজার থেকে কয়েক লক্ষ নক্ষত্র থাকে। তিনি সিদ্ধান্ত করলেন এই বিশালায়তন তারকাগুচ্ছরা নিশ্চয় ছায়াপথের কেন্দ্রকে ঘিরেই অবস্থান করে, অর্থাৎ সেটি আমাদের থেকে অনেক দূরে আছে। নব্য কোপার্নিকাসবাদ সৌরজগৎকেও ছায়াপথের বাইরের দিকে পাঠিয়ে দিল।

তাহলে হার্শেলের পর্যবেক্ষণের কী হবে? তিনি যে দেখেছিলেন আকাশগঙ্গা দৈর্ঘ্য বরাবর সব দিকে সমান উজ্জ্বল! হার্শেলই সেই সময় আরো একটা আবিষ্কার করেছিলেন যা এই সমস্যার সমাধান করবে। তিনি আমাদের ছায়াপথে অনেকগুলি অন্ধকার অঞ্চল খুঁজে পেয়েছিলেন, অর্থাৎ যেখানে কোনো নক্ষত্র দেখা যাচ্ছে না। এখন আমরা জানি এগুলি হল ধুলিকণা দিয়ে তৈরি মহাজাগতিক মেঘ, যা পিছনের আলোকে আটকে দেয়। ছায়াপথের মধ্যের তলে ধূলিকণার ঘনত্ব অনেক বেশি, তা দিয়ে তৈরি মেঘ কেন্দ্রকে আমাদের থেকে ঢেকে রেখেছে।

 আমাদের ছায়াপথ


শেপলির গবেষণা থেকে আমরা ছায়াপথের একটা মডেল পাই। একটা চাকতি যার মাঝখানটা ফুলে উঠে গোলকের আকার নিয়েছে। আধুনিক গবেষণা অনুসারে ওই চাকতির ব্যাস হল এক লক্ষ কুড়ি হাজার থেকে দুই লক্ষ আলোকবর্ষের মতো, মাঝের গোলকটার ব্যাস ষোল হাজার আলোকবর্ষ। সৌরজগত থেকে ছায়াপথের কেন্দ্র প্রায় সাতাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করে। বোঝা যাচ্ছে যে ছায়াপথে আমরা নেহাতই মফস্বলের বাসিন্দা। শেপলি অবশ্য ঠিক এই মাপগুলো পাননি, তাঁর হিসাবে ছায়াপথের ব্যাস হয় তিন লক্ষ আলোকবর্ষ। নক্ষত্রের দূরত্ব নির্ণয়ে তখনো অনেকটা ত্রুটি ছিল।

শেপলি মনে করতেন আমাদের নক্ষত্রজগৎ একক, অর্থাৎ যে সমস্ত জ্যোতিষ্ক দেখি সবই তার মধ্যে পড়ে। তার বাইরে অনন্ত শূন্যস্থান ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু ভিন্ন মতও ছিল। অনেক জ্যোতির্বিদ মনে করতেন যে আমাদের নক্ষত্রজগতের মতো আরো অনেক নক্ষত্রজগৎ আছে। আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাদেমি অফ সায়েন্স এই দুই পরস্পর বিরোধী তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কের জন্য সভার আয়োজন করেছিল, সেটি জ্যোতির্বিদ্যার মহাবিতর্ক বলে পরিচিত। শেপলি নিজে এসেছিলেন, তাঁর বিপক্ষের প্রতিনিধিত্ব করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হেবার কার্টিস (1872-1942)। দু'জনের বক্তব্যের কেন্দ্রে ছিল M31 নীহারিকা, যার অন্য নাম অ্যান্ড্রোমিডা। সেটি একটি সর্পিলাকার (spiral) নীহারিকা।

আকাশে কিছু বস্তুকে নীহারিকা বলে চিহ্নিত করা হত, দূরবিনে তাদের দেখতে হত উজ্জ্বল মেঘের মতো। খালি চোখেও কয়েকটি নীহারিকা দেখা যায়, টলেমি ও টাইকো ব্রাহে নীহারিকার উল্লেখ করেছেন। হার্শেল ঠিক করেছিলেন তিনি তাদের প্রকৃতি নির্ধারণ করবেন। তাঁর বানানো দূরবিন ছিল সে যুগের সব থেকে শক্তিশালী, তা দিয়ে তিনি আড়াই হাজার নীহারিকা পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি দেখলেন যে অনেকগুলি নীহারিকাই আসলে নক্ষত্রের সমষ্টি। কিছু নীহারিকা অবশ্য তাঁর কাছে মেঘের মতোই রয়ে গিয়েছিল। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন যে সব নীহারিকাই আসলে নক্ষত্রমণ্ডলী, অনেক দূরে আছে বলে তাদের তারাদের আলাদা করে দেখা যাচ্ছে না। সেই অনুমানই ঠিক ছিল কিন্তু পরে হার্শেল সেই মত থেকে সরে আসেন।

হার্শেলের দূরবিনকে ছাড়িয়ে যায় আয়ারল্যান্ডের রসে নামের জমিদারির আর্ল বা জমিদার উইলিয়াম পার্সন্সের (1800-1867) লেভিয়াথান, বাংলায় বলা যায় মহাকায়। অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকাকে খালি চোখেই দেখা যায়, হার্শেলের দূরবিন তাকে মেঘের মতো দেখিয়েছিল। 1850 সালে লেভিয়াথান দিয়ে দেখে পার্সন্স প্রথম বুঝতে পারেন যে তার আকার হল সর্পিলাকার। এর পরে অ্যান্ড্রোমিডার বর্ণালী বিশ্লেষণ করে বোঝা যায় যে সেটি হল নক্ষত্রপুঞ্জ, অর্থাৎ হার্শেলের প্রথম ধারণাই ঠিক ছিল। ক্রমে ক্রমে আরো অনেক সর্পিলাকার নীহারিকা আবিষ্কার হয়, তবে তাদের কেউই খালি চোখে দৃশ্যমান নয়।

অ্যান্ড্রোমিডা কি আমাদের নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে পড়ে এই ছিল কার্টিস ও শেপলির সেই মহাবিতর্কের মূল বিষয়। তবে এই নিয়ে তর্কের ইতিহাস আরো প্রাচীন। নিউটন বা দেকার্তের পরে এ বিষয়ে নাম করতে হয় পিয়ের লুই মোপারটুই-এর (1698-1759); তিনি 1745 সালেই বলেছিলেন যে অ্যান্ড্রোমিডা আমাদের ছায়াপথ থেকে দূরের এক নক্ষত্রপুঞ্জ। তিনি এর নাম দিয়েছিলেন দ্বীপ ব্রহ্মাণ্ড (Island Universe)। সেই নামটা বহুদিন পর্যন্ত ব্যবহার হয়েছিল, এখন আমরা তাকে বলি গ্যালাক্সি। দশ বছর পরে বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (1724-1804) বলেছিলেন আমাদের ছায়াপথের মতো অগুন্তি নক্ষত্রপুঞ্জ বা গ্যালাক্সি বিশ্বে ছড়িয়ে আছে।

মহাবিতর্কে প্রথম বলতে উঠেছিলেন শেপলি। আমাদের নক্ষত্রকুঞ্জের মাপ তিনি ধরেন তিন লক্ষ আলোকবর্ষ, কার্টিস এর দশ ভাগের এক ভাগ মানতে তৈরি ছিলেন। একই সঙ্গে কার্টিস অ্যান্ড্রোমিডা বা অন্য সর্পিল নীহারিকার দূরত্ব অন্তত পাঁচ থেকে দশ লক্ষ আলোকবর্ষ বলে অনুমান করেছেন। শেপলি বলেন যে আমাদের গ্যালাক্সির অনেক নক্ষত্রই আমাদের থেকে তিরিশ হাজার আলোকবর্ষের থেকে অনেক বেশি দূরত্বে আছে, এবং তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে এটা প্রতিষ্ঠিত যে সূর্য নিজেই গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে পঞ্চাশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে অবস্থান করছে। অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জে সম্প্রতি একটি নোভা বা হঠাৎ অতি উজ্জ্বল নতুন তারা পর্যবেক্ষণ করা গেছে।এই নোভাটি দেখা গিয়েছিল 1885 সালে, এটি এস অ্যান্ড্রোমিডা (S Andromeda) নোভা বলে পরিচিত। সেটি যদি আমাদের থেকে সত্যিই পাঁচ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে থাকে তাহলে তার ঔজ্জ্বল্য আমাদের নক্ষত্রজগতের পর্যবেক্ষণ করা অন্য সমস্ত নোভার থেকে অনেক লক্ষগুণ বেশি হবে। তিনি আরো বলেন যে কার্টিসের হিসাব ধরলে সর্পিল নীহারিকাদের দৈর্ঘ্য প্রস্থ বিশাল, আমাদের নক্ষত্রজগতের তুলনীয় বা তার থেকেও অনেক বড়। জ্যোতির্বিদ ভ্যান মানেন (1884-1946) তাদের ঘূর্ণন লক্ষ করেছেন। হিসাব করলে দেখা যাবে যে সেক্ষেত্রে বাইরের দিকের নক্ষত্রগুলির বেগ অত্যন্ত বেশি হতে হয়।

কার্টিস বলেন যে আমাদের সৌরজগৎ গ্যালাক্সির কেন্দ্রের কাছেই অবস্থান করছে, এ বিষয়ে অনেক বিজ্ঞানীই একমত। তাঁর হিসাবে আমাদের গ্যালাক্সির আয়তন ছিল অনেক ছোট, তা ব্যাস তিরিশ হাজার আলোকবর্ষের বেশি নয় বলেই তিনি বিশ্বাস করতেন। আমাদের ছায়াপথে অন্যান্য নোভার থেকে তাদের গড় ঔজ্জ্বল্য ছিল অনেকগুণ কম। তিনি অনুমান করেছিলেন যে নিশ্চয় সেগুলি অনেক দূরে আছে, সে জন্যই তাদের এত ম্লান দেখাচ্ছে। অ্যান্ড্রোমিডার দূরত্ব অন্তত পাঁচ লক্ষ আলোকবর্ষ ধরে নিলে গড় ঔজ্জ্বল্যের এই পার্থক্য আর থাকবে না। তাঁর দ্বিতীয় যুক্তি ছিল যে অ্যান্ড্রোমিডা যদি অনেক কাছে হয়, তাহলে তার আয়তন অনেক ছোট। গত কয়েকবছরের মধ্যে অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জে ষোলটি নোভা দেখা গেছে। অথচ তার আগের তিন শতাব্দীতে আমাদের ছায়াপথে মাত্র পঁয়তিরিশটি নোভা দেখা গেছে। ওই অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র নক্ষত্রপুঞ্জের মধ্যে অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলি নোভার সম্ভাবনা অত্যন্ত কম। তিনি বলেন যে আকাশে সর্পিল নীহারিকাদের বিন্যাসের সঙ্গে যে সমস্ত নক্ষত্র নিশ্চিত ভাবে আমাদের ছায়াপথের সদস্য তাদের বিন্যাসের কোনো মিল নেই; তাদের বেগও অন্যান্য নক্ষত্রের বেগের কয়েকগুণ; তারা নিশ্চয় ছায়াপথের বাইরের বস্তু। শেপলি নোভার অত্যন্ত বেশি ঔজ্জ্বল্যের কথা বলছেন, কিন্তু আমাদের কাছের নোভাদের ঔজ্জ্বল্যও অনেকরকম হয়; কাজেই সে বিষয়ে শেষ কথা বলার সময় এখনো আসেনি। ভ্যান মানেনের পর্যবেক্ষণ ঠিক হলে শেপলির মতই গ্রাহ্য হবে, কিন্তু সেই পর্যবেক্ষণেই গলদ আছে। ভ্যান মানেন বলেছিলেন যে অ্যান্ড্রোমিডার ঘূর্ণনকাল হল এক লক্ষ বছর। আধুনিক হিসাব বলছে যে সেটি হল পঁচিশ কোটি বছর। কীভাবে ভ্যান মানেন এতখানি ভুল করেছিলেন তা নিয়েও গবেষণা হয়েছে।

বিতর্কে সেই সময় কারো জয়পরাজয় হয়নি, কারণ সমস্যার মূলে ছিল অ্যান্ড্রোমিডা নক্ষত্রপুঞ্জের দূরত্ব যা সে সময় ছিল নিছকই অনুমান। কয়েক বছরের মধ্যে পর্যবেক্ষণ থেকে সেই দূরত্ব নির্ণয় করেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন হাবল। 1923 সালের অক্টোবর মাসের শুরুতে তিনি হুকার টেলিস্কোপ ব্যবহার করে অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকাতে এক নোভার সন্ধান পান ও ছবি তোলেন। 6 অক্টোবর তারিখের সেই ফটোর পিছনে লিখে দিলেন ‘N’ অর্থাৎ নোভা। পরের দিন তিনি পুরানো ফটোগ্রাফ থেকে ওই অঞ্চলের ছবি খুঁজে বার করলেন। তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে নক্ষত্রটি আদৌ নতুন তারা নয়, কারণ নোভারা কখনো দীর্ঘদিন দৃশ্যমান থাকে না। সেটি আসলে সেফিড ভেরিয়েবল নক্ষত্র। হেনরিয়েটা লেভিটের (1868-1921) উদ্ভাবিত পদ্ধতি অবলম্বন করে তিনি দেখলেন তার দূরত্ব হবে দশ লক্ষ আলোকবর্ষের মতো, অর্থাৎ কার্টিসের হিসাবেরও দু'গুণ। এত দূরের নক্ষত্র কখনোই শেপলির নির্ধারণ করা গ্যালাক্সির মধ্যে থাকতে পারে না। অর্থাৎ অ্যান্ড্রোমিডা নিঃসন্দেহে পৃথক এক গ্যালাক্সি। পেন বার করে তিনি ফটোর পিছনে নিজের হাতে লেখা ‘N’ কেটে ‘VAR!’ লিখে দিলেন। সেই H335H অর্থাৎ হুকার টেলিস্কোপে হাবলের তোলা 335 নম্বর ছবিটি হল মাউন্ট উইলসনের সব থেকে বিখ্যাত ফটোগ্রাফ। শেপলি ছিলেন হাবলের দূরত্ব নির্ণয় পদ্ধতির তীব্র সমালোচক, হাবল তাঁকে সমস্ত তথ্য এক করে এক চিঠি লেখেন। সেই চিঠি পড়ে শেপলি এক সহকর্মীকে বলেন, “এই সেই চিঠি যে আমার ব্রহ্মাণ্ডকে ধ্বংস করে দিল।” তিনি নিজের মত পরিবর্তন করে গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণে মন দেন এবং তাদের বিন্যাস সম্পর্কে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করেন।

শেপলি কার্টিস বিতর্কে অন্তিম জয় কার্টিসের হলেও শেপলিও কিছু বিষয়ে জিতেছেন। আমাদের গ্যালাক্সির আয়তন কার্টিসের অনুমানের থেকে অনেক বড়, তা প্রায় শেপলির মাপের কাছে। সূর্য সত্যিই গ্যালাক্সির কেন্দ্র থেকে অনেকটা দূরে আছে। সর্পিল নীহারিকাদের ঘূর্ণন বিষয়ে ভ্যান মানেনের পর্যবেক্ষণ স্পষ্টতই ভুল ছিল।6 প্রশ্ন ওঠে যে শেপলি যে বলেছিলেন অ্যান্ড্রোমিডা অনেক দূরে হলে নোভার ঔজ্জ্বল্য অনেক বেশি হতে হবে, তার ব্যাখ্যা কী? আমরা এখন জানি যে এস অ্যান্ড্রোমিডা ছিল সুপারনোভা, যা নোভার থেকে অনেক বেশি উজ্জ্বল। সুপারনোভা নিয়ে আলোচনা পরে আসবে। সুপারনোভা খুব বিরল ঘটনা, আমাদের ছায়াপথের যে সমস্ত সুপারনোভা আমরা দেখতে পেয়েছি, তাদের মধ্যে সর্ব শেষটি হয়েছিল দূরবিন আবিষ্কারেরও আগে 1604 সালে, কেপলার সেটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা লিকেহ্রেখেছিলেন বলে সেটি কেপলারের সুপারনোভা বলে পরিচিত। তাই শেপলি যখন অন্য গ্যালাক্সির নোভার ঔজ্জ্বল্য এত বেশি হতে পারেনা বলে যুক্তি দিয়েছিলেন, তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না। কেপলারের সুপারনোভা এতই উজ্জ্বল ছিল যে দিনের আলোতেও দেখা যেত।

অ্যান্ড্রোমিডার দূরত্ব কিন্তু আসলে হাবল যা মেপেছিলেন তারও অনেক বেশি। হাবল গ্যালাক্সিদের যে দূরত্ব নির্ণয় করেছিলেন, তা ব্যবহার করে দেখা যাচ্ছিল যে আমাদের ছায়াপথ বাকি সমস্ত গ্যালাক্সির থেকে অনেক বড়।আমরা দেখেছি কিভাবে কোপার্নিকাসের সময় থেকে শুরু করে মানুষ সৃষ্টির কেন্দ্রীয় অবস্থান থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তাই যে পর্যবেক্ষণ দেখায় সৃষ্টিতে আমাদের কোনো বিশেষ অবস্থান আছে বিজ্ঞানীরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখেন। 1940 1950-এর দশকে উনিশশো চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে বিজ্ঞানী ওয়াল্টার বাডে (1893-1960) দেখান যে গ্যালাক্সিদের দূরত্ব আসলে হাবলের মাপের তিনগুণ, যেমন অ্যান্ড্রোমিডার দূরত্ব হল মোটামুটি পঁচিশ লক্ষ আলোকবর্ষ। এই মাপের সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্ড্রোমিডা সহ সমস্ত গ্যালাক্সি দৈর্ঘ্য প্রস্থের মাপও তিনগুণ বেড়ে গেল। এখন আমরা জানি যে আকাশগঙ্গা হল এক মাঝারি মাপের গ্যালাক্সি। এডিংটনের অনুমান সত্যি প্রমাণিত হয়েছে।

আমাদের ছায়াপথের মডেল থেকে বোঝা গেছে যে সেটি একটি সর্পিলাকার গ্যালাক্সি, সে নিজের চারদিকে একবার পাক খেতে সময় নেয় একুশ কোটি বছরের মতো। গ্যালাক্সিরা সাধারণত দল বেঁধে থাকে, আমাদের গ্যালাক্সি যে দলের সদস্য তার নাম স্থানীয় গুচ্ছ বা লোকাল গ্রুপ। এই গ্রুপের সঠিক সদস্য সংখ্যা জানা নেই, কারণ ধূলিকণার জন্য আকাশগঙ্গার মাঝের তল বরাবর আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত হয় না; তবে তা আশির কম নয়। এই স্থানীয় গুচ্ছ আবার ভার্গো সুপারক্লাস্টার বা কন্যা মহাগুচ্ছের সদস্য, ওই মহাগুচ্ছে অন্তত এই রকম একশোটি গ্যালাক্সি গ্রুপ আছে। মহাবিশ্বে অন্তত এক কোটি মহাগুচ্ছ আছে। পাঁচশো বছর আগেও আমরা বিশ্বাস করতাম পৃথিবীর হল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কেন্দ্র, সেখান থেকে কতটা পথ আমরা অতিক্রম করেছি

 

প্রকাশঃ সন্ধিৎসা, নভেম্বর  ২০২২