Monday 31 October 2022

ফাইবার অপটিক্স

 

    এখন এমন এক প্রযুক্তির কথা বলি যেখানে লেজারের সাহায্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব হয়েছে, তা হল ফাইবার অপটিক্স। অপটিকাল ফাইবার বা আলোকতন্তুর ধারণাটা অতি সরল। এখানে আলোর একটা বিশেষ ধর্মকে কাজে লাগানো হয়। আমরা  স্নেলের সূত্রের কথা পড়েছি, তাকে লিখতে পারি sin i = m sin r। আলো যদি ঘন মাধ্যম থেকে লঘু মাধ্যমে যায়, যেমন কাচ থেকে বায়ুতে, তখন প্রতিসরাঙ্ক m-এর মান এক অপেক্ষা কম হয়। আপতন কোণ i-এর মান শূন্য থেকে নব্বই ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। এই মানের জন্য i যত বাড়ে, sin i তত বাড়ে। প্রতিসরাঙ্ক এক অপেক্ষা কম, সুতরাং উপরের সম্পর্ক থেকে দেখতে পাই যে sin r নিঃসন্দেহে sin i -এর থেকে বড়, অর্থাৎ প্রতিসরণ কোণ r আপতন কোণ i-এর থেকে বড়। তাহলে আপতন কোণ যখন শূন্য ডিগ্রি থেকে বাড়াতে থাকি, একটা সময় প্রতিসরণ কোণের মান নব্বই ডিগ্রি হয়ে যাবে, মানে আলোকরশ্মি একেবারে দুই মাধ্যমের বিভেদতল বরাবর যাবে। নিচের ছবি থেকে বিষয়টা স্পষ্ট হবে। আমরা জানি যে sin 90o=1, এবং কোনো কোণের সাইনের মান এর থেকে বেশি হতে পারে না। যে আপতন কোণের জন্য প্রতিসরণ কোণের মান নব্বই ডিগ্রি হয় তাকে বলে সঙ্কট কোণ (Critical angle)। ছবিতে ic দিয়ে সঙ্কট কোণ দেখানো হয়েছে। আপতন কোণ তার থেকেও যদি বাড়াই, তাহলে কী হবে?

 

আপতন কোণ সঙ্কট কোণের থেকে বড় হলে আর প্রতিসরণ হওয়া সম্ভব নয়, তখন আলোকরশ্মি আবার ঘন মাধ্যমে ফিরে আসবে এবং প্রতিফলনের সূত্র মেনে চলবে, অর্থাৎ আপতন কোণ ও প্রতিফলন কোণ সমান হবে। আগেও আলোর কিছুটা অংশ প্রতিফলিত হচ্ছিল কিন্তু এখন সম্পূর্ণ আলোটাই প্রতিফলিত হবে। একে বলে আভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন।

ফাইবার অপটিক্সে আলোর এই ধর্মকে কাজে লাগানো হয়। আমরা খুব জটিল আলোচনাতে না গিয়ে সহজে কেমন করে আলোকতন্তু কাজ করে দেখে নিই। এর চেহারা হল বেলনাকার। তার ভিতরের অংশকে বলে কোর, এর বাইরে থাকে ক্ল্যাডিং। ফাইবারের অনেক প্রকারভেদ আছে, আমরা একটির কথা বলি। ক্ল্যাডিং সিলিকা গ্লাস দিয়ে তৈরি, কোরও সিলিকা গ্লাস কিন্তু তার মধ্যে জার্মেনিয়াম মিশিয়ে প্রতিসরাঙ্ক একটু বাড়ানো হয়েছে। নিচের ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে আলোকরশ্মি যদি কোর ও ক্ল্যাডিঙের বিভেদতলে সঙ্কটকোণের থেকে বেশি কোণ করে পড়ে, তাহলে তা পূর্ণপ্রতিফলিত হয়। এবার প্রতিসাম্যের জন্যে প্রতিফলিত আলোকরশ্মি যখন আবার বিভেদতলে গিয়ে পড়বে, সে একই কোণ করবে। ফলে সে আবার পূর্ণ প্রতিফলিত হবে। আভাবে তাহলে আলোকরশ্মি বারবার প্রতিফলিত হয়ে তন্তু বরাবর যেতে থাকবে। এমনকি তন্তুকে বাঁকালেও অসুবিধা হবে না, কারণ কোর খুবই সরু, পঞ্চাশ মাইক্রনের কাছাকাছি। বাইরের ক্ল্যাডিং নিয়ে একক তন্তু কয়েকশো মাইক্রন চওড়া, মানুষের চুলের কাছাকাছি। এই রকম অনেকগুলি তন্তুকে নিয়ে একটি গুচ্ছ (Bundle) বানানো হয়। সমস্ত আলোকরশ্মিই পূর্ণপ্রতিফলিত হবে না, একমাত্র যেগুলি সঙ্কট কোণের থেকে বেশি কোণ করে পড়বে সেগুলিই তন্তু বরাবর যাবে।

আলোকতন্তুর মধ্যে আলোকরশ্মির পথ

তন্তুর মধ্যে অবশ্যই কিছুটা শোষণ হবে, তবে তার পরিমাণ খুব বেশি নয়। এভাবে দীর্ঘ পথ তন্তু মারফত আলো পাঠানো সম্ভব। বর্তমানে প্লাস্টিক দিয়ে আলোকতন্তু বানানো সম্ভব হয়েছে, তার ব্যাস অনেকটাই বড়, এক মিলিমিটারের কাছাকাছি হতে পারে। ফাইবার অপটিক্সকে সেন্সর তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। সঙ্কেত পাঠানোর ক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা হল যে মাঝপথে অন্য আলো বা তরঙ্গ এসে সঙ্কেতের গুণমান খারাপ করে দিতে পারে। আলোকতন্তুতে সেটা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা যায়।

ফাইবার অপটিক্সের আলোচনা করলে এক জন্মসূত্রে ভারতীয় বিজ্ঞানীর কথা বলতেই হয়। নরিন্দর সিং কাপানি (1926-2020)-কে প্রযুক্তির এই শাখার জনক মনে করা হয়। তিনিই এই বিষয়ে প্রথম বই লিখেছিলেন, ফাইবার অপটিক্স কথাটাও তাঁরই বানানো। কাপানির জন্ম পাঞ্জাবের মোগাতে। আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার পরে তিনি লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজে গবেষণার জন্য যান। পিএইচডি করার সময় তিনি ও তাঁর গাইড হ্যারল্ড হপকিন্স (1918-1994) প্রথম আলোক তন্তু দিয়ে গুচ্ছ বানিয়ে দেখিয়েছিলেন তার মধ্যে দিয়ে আলো পাঠিয়ে প্রতিবিম্ব গঠন সম্ভব। ক্ল্যাডিঙের ধারণাটা অবশ্য তাঁদের উদ্ভাবন নয়। 2009 সালে ফাইবার অপটিক্সে গবেষণার জন্য চার্লস কুয়েন কাও (1933-2018) পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তখন নরিন্দর সিং কাপানিকে বিবেচনা না করা নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল।

আমরা আগে যে আলোচনা করেছি, তা আলোকরশ্মির জন্য খাটে। ইন্টারনেট দাঁড়িয়ে আছে অপটিকাল ফাইবারের উপর। সমুদ্রের তলা দিয়ে বিশাল বিশাল কেবল পাতা হয়েছে, যার মধ্যে আছে আলোকতন্তু। তার কারণ হল আলোকতন্তুর সঙ্কেতবহন ক্ষমতা খুব বেশি। বিষয়টা বেশ জটিল, তাই তার ব্যাখ্যাতে না গিয়ে আমরা শুধুমাত্র আর ফলে কী হতে পারে দেখব। এক্ষেত্রে যে আলোকতন্তু ব্যবহার করা হয় তার কোর খুবই সরু, ব্যাস দশ মাইক্রনের কাছাকাছি। আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য তার কাছাকছি, তাই এত সরু তন্তুর জন্য আমরা আলোকরশ্মির সরলরেখাতে চলার কথা ধরতে পারি না। এখানে আলোকে তরঙ্গ হিসাবেই ধরতে হবে। তন্তুর একপ্রান্ত থেকে লেজারের সাহায্যে সঙ্কেত প্রেরণ করা হয়। এখানে একটা কথা আসে, ব্যান্ডউইথ (Bandwidth)। ব্যান্ডউইথ হল কতটা তথ্য প্রতি সেকেন্ডে পাঠানো যেতে পারে তার মাপ। বিশদ আলোচনাতে না গিয়ে শুধু এইটুকুই বলা যায় যে সঙ্কেত যে বাহক তরঙ্গের মাধ্যমে পাঠানো হয়, তার কম্পাঙ্ক যত বেশি হয়, তার ব্যান্ডউইথও তত বেশি। রেডিও তরঙ্গের কম্পাঙ্ক মেগাহার্জ থেকে শুরু করে কয়েক গিগাহার্জের মধ্যে থাকে। এখন যে ফাইভ জি তরঙ্গের কথা শুনি, তার কম্পাঙ্ক মোটামুটি চল্লিশ গিগাহার্জ। (হার্জ হল কম্পাঙ্কের একক, প্রতি সেকেন্ডে একবার যদি কম্পন ঘটে তাহলে তার কম্পাঙ্ককে বলি এক হার্জ। চল্লিশ গিগা হার্জ কম্পাঙ্ক মানে তার জন্য তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র এক সেকেন্ডে চারহাজার কোটিবার কম্পিত হয়।)

অন্যদিকে দৃশ্য আলোর কম্পাঙ্ক আর দশহাজার গুণেরও বেশি। ফলে ফাইভ জি তরঙ্গের মাধ্যমে প্রতি সেকেন্ডে মোটামুটি তিন থেকে চারশো মেগাবিট তথ্য আদান প্রদান করতে পারি। তামার তারের ব্যবহার করলে সেটা পঁচিশগুণ বেড়ে হয় দশ গিগাবিট। অপটিকাল ফাইবারের ক্ষেত্রে তাকে আরো কয়েকহাজার গুণ বাড়ানো সম্ভব। ই ধরনের কেবল দিয়েই সারা পৃথিবী ব্যপী ইন্টারনেট ব্যবস্থা চালু আছে। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভার্জিনিয়া বিচ ও স্পেনের বিলবাওয়ের মধ্যে সমুদ্রের তলা দিয়ে ছহাজার ছশো কিলোমিটার যে অপটিকাল ফাইবার কেবল পাতা হয়েছে তার তথ্য বিনিময় ক্ষমতা 224 টেরাবিট পার সেকেন্ড। (বাইনারি কোডে শুধু 0 1 ব্যবহার করে সমস্ত অক্ষর, সংখ্যা ও চিহ্নকে লেখা হয়। কম্পিউটার এই পদ্ধতিই ব্যবহার করে। যেমন A-কে লেখা হয় 01000001, B-কে 01000010, এইরকম। এই রকম 0 বা 1-কে বলায় হয় বিট(Bit), কয়েকটা বিট মিলে এক বাইট (Byte) । আধুনিক কালে এক বাইটে থাকে আটটা বিট, যে কারণে অক্ষরগুলো এই রকম রূপ নিয়েছে। আট বিটের সাহায্যে 28=256 সংখ্যক পৃথক চিহ্ন বোঝানো সম্ভব। এক মেগাবিট পার সেকেন্ড অর্থ প্রতি সেকেন্ডে দশ লক্ষ বিট তথ্য বিনিময়। গিগা অর্থ এক হাজার মেগা বা একশো কোটি, টেরা তারও হাজার গুণ।