Saturday 25 February 2023

পৃথিবীর বিখ্যাততম ঘড়ি

 

পৃথিবীর বিখ্যাততম ঘড়ি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

তোমাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত ঘড়ি কোনটি, কী উত্তর দেবে? অধিকাংশ লোকই বিগ বেনের নাম বলবে। কিন্তু যাঁরা ঘড়ির ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেছেন, তাঁরা বিগ বেনের থেকে তেরো কিলোমিটার দূরের গ্রিনউইচ মিউজিয়ামকে দেখাবেন। সেখানে রাখা আছে এমন ঘড়ি যা পৃথিবীর ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। তার নাম H-4। আজ আমরা সেই ঘড়ির গল্প শুনব।

আমাদের গল্প কিন্তু ঘড়ি দিয়ে শুরু হবে না। ঘড়ির ব্যাপারি হলেও আমরা প্রথমে জাহাজের খবর নেব। সমুদ্রে মাইলপোস্ট নেই, তাই মাঝ সমুদ্রে সবদিকই সমান। জাহাজ কোথায় আছে, কোনদিকে যেতে হবে জানে কেমন করে? এর জন্য জাহাজ যে পদ্ধতি অনুসরণ করে, তাকে বলে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম, সংক্ষেপে জিপিএস। তার জন্য চারটে কৃত্রিম উপগ্রহের থেকে সঙ্কেত প্রয়োজন হয়। এখন স্মার্ট ফোনও জিপিএস ব্যবহার করে এক মুহূর্তের মধ্যে যে কোনো জায়গার অবস্থান দেখিয়ে দেয়। কিন্তু কৃত্রিম উপগ্রহ তো এই সেদিনের ঘটনা, তার আগে মানুষ কী করত?

আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে সমুদ্রে জাহাজের পথ ছিল একেবারে অন্যরকম। খুব কম ক্যাপ্টেনই কলম্বাসের মতো মাঝসমুদ্রে যেতে সাহস করত, সবাই যেখান থেকে ডাঙা দেখা যায় তার কাছের পথ ধরে চলার চেষ্টা করত। ফলে জলদস্যুদের লুঠপাট করতে খুব সুবিধা হত। এক দেশের জাহাজ অন্য দেশের জাহাজকেও আক্রমণ করত। ১৫৯২ সালে পর্তুগালের এক জাহাজ ভারত থেকে ফিরছিল, আগে থেকে খবর পেয়ে ইংল্যান্ডের ছ'টা যুদ্ধজাহাজ অ্যাজোরেস দ্বীপপুঞ্জের কাছে ওঁত পেতে ছিল। ওই একটা জাহাজ থেকেই ইংল্যান্ড লুঠ করেছিল তখনকার হিসাবে পাঁচ লক্ষ পাউন্ড মূল্যের মশলা ও সোনাদানা, যা সে সময় ইংল্যান্ডের রাজকোষাগারের অর্ধেকের থেকেও বেশি।

সব সময় তীর কাছে থাকলেও রক্ষা পাওয়া যেত না। একটা ঘটনার কথা বলি। ১৭০৭ সালে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে এক নৌযুদ্ধে ইংল্যান্ড বিজয়ী হয়। ফেরার পথে কুয়াশাঢাকা সমুদ্রে জাহাজের অবস্থান বোঝা যাচ্ছিল না। সেই অবস্থান নির্ণয়ের দায়িত্বে যাঁরা থাকেন তাঁদের বলে নেভিগেটর। নৌবহরের প্রধান অ্যাডমিরাল সার ক্লাউডিসলির সঙ্গে ছিল পাঁচটি জাহাজ। ফেরার পথে বারো দিন ধরে কুয়াশা ছিল, তখন সার ক্লাউডিসলি সব ক'টি জাহাজের নেভিগেটরকে ডাকেন। তাঁরা একমত হন যে সামনে কোনো বিপদ নেই। এক নাবিক প্রতিবাদ করেছিল, বলেছিল যে সামনে ডুবোপাহাড় আছে; অ্যাডমিরালের আদেশে তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসি দেওয়া হয়। তার পরেই ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা লেগে পাঁচটা জাহাজের মধ্যে চারটে ডুবে যায়, দু' হাজার নাবিক প্রাণ হারায়। তখন ইংল্যান্ডের মূল ভূখণ্ড ছিল মাত্র কুড়ি মাইল দূরে। ফ্রান্সের নৌবাহিনী যা করতে পারেনি, প্রকৃতি কয়েক মিনিটের মধ্যে তাই করে দেখাল।

আরো একটা সমস্যা ছিল। ধরো ইংল্যান্ড থেকে ভারতে কোনো জাহাজ আসবে। তীর বরাবর আসতে যতটা পথ যেতে হবে, সাহস করে মাঝ সমুদ্র ধরলে পথ অনেক কম হবে। কিন্তু দ্রাঘিমা না জানা থাকলে জাহাজ চালানো কি সম্ভব? ফলে জাহাজযাত্রাতে সময় লাগত অনেক বেশি। দীর্ঘ পথে নাবিকদের ফল বা সজি জুটত না। সে যুগে ভিটামিনের কেউ নাম শোনেনি, ভিটামিন সি-এর অভাবে শরীরে হানা দিত স্কার্ভি রোগ। জাহাজডুবির থেকে অনেক বেশি লোক এই রোগে মারা যেত।

নৌপথই ছিল মূল বাণিজ্যের পথ, সে যুগে যে দেশের নৌবাহিনী যত ভালো সে ছিল তত শক্তিশালী। তাই ইংল্যান্ড, স্পেন, ইটালি, ফ্রান্স ইত্যাদি ইউরোপের সমস্ত দেশ সমুদ্রে কেমনভাবে জাহাজের অবস্থান বার করা যায় তাই নিয়ে আগ্রহী হয়ে পড়েছিল। একবার অবস্থান জানলে তারপর জাহাজ কোনদিকে চালাতে হবে ঠিক করা খুব সহজ। আমরা সেই গল্পে যাব, তার জন্য একটু ভূগোল পড়া ঝালিয়ে নিতে হবে।

তোমরা ভূগোলের ক্লাসে নিশ্চয় দ্রাঘিমাংশ অক্ষাংশ কথা দুটো শুনেছ। পৃথিবীর বুকে কোনো বিন্দুর অবস্থান জানার জন্য আমরা এই দুটোকে ব্যবহার করি। যেমন ধরো কলকাতার অক্ষাংশ হল ২২.৬ ডিগ্রি উত্তর, আর দ্রাঘিমাংশ হল ৮৮.৪ ডিগ্রি পূর্ব। এর মানে কী? পৃথিবীর উত্তর দক্ষিণ গোলার্ধকে নব্বই ডিগ্রি হিসাবে ভাগ করা হয়েছে, বিষুবরেখাকে বলা হয় শূন্য ডিগ্রি অক্ষাংশ, আর দুই মেরু বিন্দু হল নব্বই ডিগ্রি। কলকাতা বিষুবরেখার থেকে ২২.৬ ডিগ্রি উত্তরে অবস্থান করে। আবার উত্তর ও দক্ষিণ মেরু এবং ব্রিটেনের গ্রিনউইচকে যে রেখা যোগ করেছে, তার দ্রাঘিমা হল শূন্য ডিগ্রি। এবার তার পূর্ব ও পশ্চিম দু'দিকে একশো আশি ডিগ্রি হিসাবে আমরা দ্রাঘিমা মাপ করি। কলকাতা গ্রিনউইচ থেকে ৮৮.৪ ডিগ্রি পূর্বদিকে অবস্থান করে।

অক্ষাংশ বা দ্রাঘিমাংশ মাপি কেমন করে? অক্ষাংশ মাপা খুব সোজা ছিল, রাতের আকাশে নক্ষত্ররা উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটা সরলরেখার সঙ্গে যে কোণ বরাবর আছে তার থেকে তা বার করা যায়। যেমন কলকাতা থেকে ধ্রুবতারার কোণ মাপলে পাই ২২.৬ ডিগ্রি। দ্রাঘিমাংশও শক্ত নয়। ভূগোল বইতে লেখা আছে কোনো জায়গার স্থানীয় সময় গ্রিনউইচের থেকে যত মিনিট এগিয়ে বা পিছিয়ে আছে, তাকে চার দিয়ে ভাগ করলেই দ্রাঘিমাংশ পাওয়া যাবে। এগিয়ে থাকলে পূর্ব, আর পিছিয়ে থাকলে পশ্চিম। যেমন কলকাতা গ্রিনউইচের থেকে মোটামুটি পাঁচ ঘণ্টা সাড়ে তিপান্ন মিনিট এগিয়ে আছে।

এখানে একটা কথা আছে, স্থানীয় সময়। তার মানে কী? পৃথিবী নিজের অক্ষের চারপাশে পাক খাচ্ছে, তাই সূর্য তো সব জায়গায় একই সঙ্গে মাথার উপর থাকে না। তাই বিভিন্ন দ্রাঘিমাংশে সময় বিভিন্ন। ধরো আমরা যেখানে আছি, সেখানে যখন সূর্য আকাশে আমাদের মাথার উপর সব থেকে উপরে থাকে, সেই সময়কে বলি স্থানীয় সময় দুপুর বারোটা। তাহলে দ্রাঘিমাংশ বার করব কেমন করে? ঠিক সূর্য যখন মাথার উপরে আসে তখন গ্রিনউইচে কটা বাজে কোনোভাবে জেনে নেব। ব্যাস, কাজ শেষ! গ্রিনউইচের সময় না হলে অন্য কোনো একটা জায়গার স্থানীয় সময় জানলেও চলবে, শুধু সেই জায়গার দ্রাঘিমাংশটাও জানতে হবে।

বুঝতেই পারছ জাহাজের পক্ষে অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ জানাটা খুব দরকার। অক্ষাংশ রাতের আকাশের নক্ষত্র দেখে নির্ণয় করা যায়। যখন টেলিফোন, রেডিও এসব আবিষ্কার হয়নি, তখন সব জাহাজে একটা খুব নিখুঁত ঘড়ি থাকত, যার নাম ছিল মেরিন ক্রোনোমিটার। সে গ্রিনউইচ বা অন্য কোনো নির্দিষ্ট জায়গার সময় দেখাত। এবার ঠিক দুপুরবেলা ক্যাপ্টেন দেখতেন সেই ঘড়িটাতে ক'টা বাজে। তার থেকে দ্রাঘিমাংশ বার করে নিতেন।

কিন্তু এই ক্রোনোমিটার আবিষ্কারও ১৭৫৯ সালের ঘটনা, তার আগে দ্রাঘিমাংশ বার করা মোটেই সহজ ছিল না। তোমরা সবাই নিশ্চয় গ্যালিলিওর নাম শুনেছ, তিনি দূরবিন দিয়ে বৃহস্পতির চাঁদ আবিষ্কার করেছিল। সেই চাঁদরা যখন বৃহস্পতির পিছনে চলে যায় তখন তাদের গ্রহণ হয়। গ্যালিলিও বুঝলেন যে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখলে নিশ্চয় গ্রহণ বিভিন্ন সময়ে শুরু বা শেষ হবে, তার থেকে তিনি দ্রাঘিমাংশ বার করার একটা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিলেন। স্পেনের রাজা তৃতীয় ফিলিপ দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য একটা বিরাট পুরস্কার ঘোষণা করেছিলেন, গ্যালিলিও তাঁকে চিঠি লেখেন। কিন্তু রাজার পরামর্শদাতারা বলেন যে মাঝসমুদ্রে নাবিকদের পক্ষে বৃহস্পতির উপগ্রহ দেখা মোটেই সহজ হবে না। সেই পুরস্কার গ্যালিলিওর জোটেনি। আরো কয়েক দেশের সরকারের কাছে গ্যালিলিও তাঁর পদ্ধতির কথা জানিয়েছিলেন, শুধুমাত্র হল্যান্ড থেকে তিনি একটা সোনার হার চেষ্টার স্বীকৃতিতে পুরস্কার হিসাবে পেয়েছিলেন। পঞ্চাশ বছর পরে ডাঙাতে দ্রাঘিমাংশ নির্ণয়ের জন্য তাঁর পদ্ধতিই স্বীকৃত হয়েছিল। কিন্তু সন্দেহ নেই জাহাজ থেকে গ্যালিলিওর পদ্ধতিতে দ্রাঘিমা বার করার অনেক সমস্যা ছিল। দিনের বেলা কাজ করবে না, রাতের আকাশে বৃহস্পতিকে দেখা যেতে হবে, সেই সময় কোনো একটা চাঁদের গ্রহণ হতে হবে, কুয়াশা বা আকাশে মেঘ থাকলে চলবে না, জাহাজ খুব দুললেও অসুবিধা আছে। তাই সেই পদ্ধতি জাহাজে বিশেষ কাজে আসেনি।

ব্রিটেন হল দ্বীপ, তার বাণিজ্য ও সামরিক শক্তি ছিল নৌপথের উপর নির্ভরশীল। ১৭১৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দ্রাঘিমাংশ সঠিকভাবে নির্ণয়ের জন্য কুড়িহাজার পাউন্ড পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। আজকের দিনের হিসাবে তার পরিমাণ প্রায় তিরিশ লক্ষ পাউন্ড বা তিরিশ কোটি টাকা। সেই পুরস্কারের টাকা জিতেছিলেন এক পেশাদার ছুতোর মিস্ত্রি জন হ্যারিসন। তিনি প্রথম মেরিন ক্রোনোমিটার বানিয়েছিলেন। পুরস্কার যখন ঘোষণা হয় তখন হ্যারিসনের বয়স ছিল একুশ। তার পরে পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে চেষ্টা করে তিনি অবশেষে নিখুঁত ক্রোনোমিটার বানাতে সক্ষম হন। পুরস্কার দিতে সরকার টালবাহানা করেছিল, ফলে শেষ পর্যন্ত যখন তিনি পুরো অর্থটা পেয়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স আশি পেরিয়ে গেছে।

আগেই বলেছি ক্রোনোমিটার হল নিখুঁত ঘড়ি। তোমরা নিশ্চয় সূর্য ঘড়ি বা বালিঘড়ির কথা জানো, কিন্তু তা দিয়ে কখনোই খুব নিখুঁত ভাবে সময় মাপা সম্ভব নয়। সময়ের মাপে মাত্র চার মিনিট গণ্ডগোল হলেই দ্রাঘিমাতে এক ডিগ্রি ভুল হয়ে যাবে। তার মানে বিষুবরেখার কাছে জাহাজের অবস্থানে ভুল হবে একশো কিলোমিটারের বেশি! সেজন্য দরকার হয় যান্ত্রিক ঘড়ি। তোমাদের কতজন পেন্ডুলাম ঘড়ি দেখেছ জানি না, তবে ছবিতে নিশ্চয় দেখেছ। পেন্ডুলামের সূত্র বলে যে তার দোলনের সময়কাল শুধুমাত্র পেন্ডুলামের দৈর্ঘ্যের উপর নির্ভর করে। সেই সূত্র আবিষ্কার করেছিলেন গ্যালিলিও, আর তাকে ব্যবহার করে যান্ত্রিক ঘড়ি বানিয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ান হাইজেন্স। কিন্তু সেই ঘড়ির অনেক সমস্যা ছিল, জাহাজের দোলা, তাপমাত্রার বাড়া কমা, বাতাসে জলীয় বাষ্প – এই সব নানা কারণে দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রাতে সে কখনো ফাস্ট কখনো স্লো হয়ে যেত। ফলে তা কখনোই জাহাজ থেকে দ্রাঘিমা নির্ণয়ে কাজে লাগে নি।

জনের জন্ম ১৬৯৩ সালের ২৪ মার্চ। তাঁর বাবা হেনরি ছিলেন ছুতোর, জন তাঁর কাছে কাঠের কাজ শিখেছিলেন। স্কুলে পড়ার সুযোগ জনের হয়নি, নিজের চেষ্টাতে লিখতে পড়তে শেখেন। পড়াশোনাতে তাঁর উৎসাহ দেখে এক পাদ্রি তাঁকে একটা বিজ্ঞানের বই পড়তে দিয়েছিলেন। জন সেই বইয়ের প্রত্যেকটি শব্দ নিজের খাতায় আবার লিখেছিলেন, প্রত্যেক ছবি নতুন করে এঁকেছিলেন, এবং লেখার পাশে পাশে নিজের মতো করে ব্যাখ্যা লিখে রেখেছিলেন। কেউ জানে না তিনি হঠাৎ ঘড়ি তৈরিতে উৎসাহী হয়েছিলেন কেন, বা কোথা থেকে তিনি ঘড়ি বানানো শিখলেন; তাঁর কাছাকাছি কোনো ঘড়ি নির্মাতা ছিলেন না। শুধু নিজের চেষ্টাতে তিনি ১৭১৩ সালে একটা ঘড়ি বানিয়ে ফেলেন। সেই ঘড়ি এখনো লন্ডনের মিউজিয়ামে রাখা আছে। দেখলেই বোঝা যায় যে সেটি কোনো ছুতোর মিস্ত্রির তৈরি; পুরো ঘড়িটা, এমনকি ভিতরের সমস্ত কলকব্জাই কাঠের তৈরি। 

জন

 

ঘড়ি তৈরিতে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়েছিল। তোমরা হয়তো দেখেছ যে অনেক উঁচু টাওয়ার, গির্জা ইত্যাদি জায়গায় ঘড়ি থাকে, বিগ বেন যার সব থেকে বিখ্যাত উদাহরণ। সেইরকম একটা ঘড়ি তৈরির দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছিল। ১৭২২ সালে সেই ঘড়ি তৈরি করেন হ্যারিসন। আজ তিনশো বছর পরেও সেই ঘড়ি ঠিকঠাক সময় দিয়ে চলছে, শুধু ১৮৮৪ সালে একবার সামান্য মেরামতির জন্য তাকে থামাতে হয়েছিল। এই ঘড়িও কাঠের তৈরি। ঘড়ির কলকব্জাতে তেল দেওয়ার দরকার পড়ে না, হ্যারিসন এমন কাঠ ব্যবহার করেছিলেন যার থেকে রস বেরিয়ে তেলের কাজ করে।

জন এই সময় তাঁর ছোট ভাই জেমসের সঙ্গে কাজ করতে শুরু করেন। তাঁরা ঘড়িতে এমন অনেক যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন যা সম্পূর্ণ তাঁদের নিজের উদ্ভাবন। সে যুগের সেরা ঘড়িতেও দিনে এক মিনিটের গণ্ডগোল ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা, সেখানে হ্যারিসনদের ঘড়ি মাসে এক সেকেন্ডের বেশি স্লো বা ফাস্ট হত না। কেউ জানে না জন দ্রাঘিমা নির্ণয়ের পুরস্কারের কথা কোথায় শুনেছিলেন, সে যুগে রেডিও টিভি ইন্টারনেট ছিল না। যাই হোক ১৭২৬ থেকে ১৭৩০ চার বছর পরিশ্রম করে জন হ্যারিসন দ্রাঘিমা নির্ণয়ের উপযোগী ঘড়ির ডিজাইন তৈরি করেন। সেই নিয়ে হ্যারিসন লন্ডনে গেলেন।

ব্রিটিশ পার্লামেন্ট দ্রাঘিমার পুরস্কার বিষয়ে বিবেচনার জন্য একটা কমিটি বানিয়েছিলেন, তার নাম ছিল দ্রাঘিমা বোর্ড। হ্যারিসন লন্ডনে গিয়ে জানতে পারলেন যে সেই বোর্ডের সভা কোনোদিন বসেনি, কারণ কোনো প্রস্তাবই পুরস্কারের যোগ্য হওয়ার ধারেকাছেও পৌঁছায়নি। জন বোর্ডের একজন সদস্যের কথা জানতেন, তোমরা সবাই তাঁর নাম শুনেছ। তিনি এডমন্ড হ্যালি, যাঁর নামে হ্যালির ধূমকেতু। হ্যালি তখন রাজকীয় জ্যোতির্বিদ, তাঁর অফিস গ্রিনউইচ মানমন্দিরে। তিনি হ্যারিসনের প্রস্তাব বিবেচনা করে তাঁকে ইংল্যান্ডের বিখ্যাততম ঘড়ি নির্মাতা জর্জ গ্রাহামের কাছে পাঠান।

হ্যারিসনের আশঙ্কা ছিল গ্রাহাম তাঁর ডিজাইন চুরি করে নিতে পারেন, তবু উপায় না দেখে তিনি তাঁর কাছেই গীলনে। গ্রাহাম প্রথমে লন্ডনের বাইরে থেকে আসা এক অখ্যাত ঘড়িনির্মাতাকে পাত্তা দিতে চাননি, কিন্তু হ্যারিসনের ডিজাইন দেখে তিনি মত পাল্টান। সকাল দশটার সময় হ্যারিসন গ্রাহামের ওয়ার্কশপে গিয়েছিলেন, সন্ধে আটটার সময় তিনি যখন সেখান থেকে বেরোলেন তখন তাঁর সঙ্গে ছিল বেশ কিছু অর্থ। ক্রোনোমিটার তৈরির জন্য গ্রাহাম তাঁকে বিনা সুদে ধার দিয়েছেন, সুবিধামতো ফিরত দিলেই চলবে।

পাঁচ বছর চেষ্টা করে হ্যারিসন তাঁর প্রথম ক্রোনোমিটার বানালেন, সেটিকে এখন H-1 বলা হয়। কাঠ ও পিতল দিয়ে বানানো সেই ঘড়িতেও তেল দিতে হয় না। তিরিশ কিলোগ্রাম ওজনের সেই ঘড়ি এখন গ্রিনউইচ মিউজিয়ামে রাখা আছে, এবং এখনও নিখুঁত সময় দিচ্ছে। হ্যারিসন সেই ঘড়ি নিয়ে গেলেন গ্রাহামের কাছে, গ্রাহাম সেটা রয়্যাল সোসাইটিতে দেখিয়েছিলেন। সোসাইটির সদস্যরা ঘড়ির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

পুরস্কারের শর্ত অনুযায়ী ক্রোনোমিটারকে পাঠানোর কথা ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজে, সেই যাত্রাপথে সে কতটা ভালো দ্রাঘিমার হিসাব দিতে পারবে সেই অনুযায়ী পুরস্কার ঠিক হবে। কিন্তু তাকে পর্তুগালের লিসবনগামী জাহাজে তোলা হল। হ্যারিসন নিজেই তার সঙ্গী হলেন। লিসবন পৌঁছানোর চারদিন পরেই জাহাজ আবার লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। সমুদ্রে ঘড়ি যেমনই চলুক, হ্যারিসন সারা পথটাই সী-সিক ছিলেন। ফেরার সময় যখন ব্রিটেনের মূল ভূখণ্ড চোখে পড়ল, তখন হ্যারিসনের ঘড়ি আর জাহাজে ক্যাপ্টেনের হিসাবে জাহাজের অবস্থানে ষাট মাইলের তফাত হয়েছিল। দেখা গেল ঘড়িই ঠিক বলছে।

১৭৩৭ সালের ৩০ জুন হ্যারিসনের ঘড়ি নিয়ে বিবেচনার জন্য দ্রাঘিমা বোর্ডের প্রথম সভা বসে। সভাতে সবাই হ্যারিসনের দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, তাঁর ঘড়ির কোনো সমালোচনা তাঁরা করেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন হ্যারিসন, তিনি নিজেই H-1-এর দোষত্রুটির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন যে দু'বছর সময় এবং কিছু অর্থ সাহায্য পেলে তিনি আরো ভালো ঘড়ি বানাতে পারবেন। স্বাভাবিকভাবেই বোর্ডের সদস্যরা সেই প্রস্তাবে সম্মত হন।

প্রতিশ্রুতি মতো দু'বছরের মধ্যে নতুন ক্রোনোমিটার বানিয়ে ফেলেন হ্যারিসন, ১৭৪১ সালের জানুয়ারি মাসে বোর্ডের সামনে H-2-কে পেশ করেন। নানা পরীক্ষা করে দেখা গেল তাপমাত্রার বাড়াকমা, ঝাঁকুনি ইত্যাদিতে তার সময়ের কোনো পরিবর্তন হয়নি। রয়্যাল সোসাইটি ঘড়ির প্রশংসা করে বলে হ্যারিসন পুরস্কারের যোগ্য, এবার ঘড়িটাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে পাঠানো উচিত। কিন্তু আবারও হ্যারিসনের নিজেরই সেই মডেল পছন্দ হয় নি, তাই তাকে কখনো জাহাজে তোলা হয়নি। সুতরাং তিনি আবার নিজের ওয়ার্কশপে ঢুকলেন। ১৭৫৯ সালে তিনি পেশ করলেন H-3 এবং তার পরেই H-4। কেন তাঁর এতদিন লেগেছিল আমরা জানি না। এই সময় থেকে তাঁর ছেলে উইলিয়ামও তাঁকে সাহায্য করা শুরু করেন।

কিন্তু ইতিমধ্যে হ্যালির মৃত্যু হয়েছে, তাঁর পরের রাজকীয় জ্যোতির্বিদরা হ্যারিসনের ঘড়ির থেকে চাঁদ পর্যবেক্ষণের সাহায্যে দ্রাঘিমা নির্ণয়ের উপরেই বেশি জোর দিয়েছিলেন। এই বিষয়টা অল্প কথায় বলি। ধরো একটা গাড়িতে যাচ্ছ, সামনে কাছে আছে একটা গাছ, আর দূরে পাহাড়। দেখবে পাহাড় আর গাছের নিজেদের মধ্যে অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে। চাঁদ পৃথিবীর অনেক কাছে আছে, তাই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গা থেকে দেখলে দূরের নক্ষত্রদের সাপেক্ষে তার জায়গা পাল্টে যায়। সেই অবস্থান নির্ণয়ের উপযোগী যন্ত্র বানিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে জন হ্যাডলি এবং আমেরিকাতে টমাস গডফ্রে। নিউটনের মৃত্যুর অনেক পরে তাঁর কাগজপত্র থেকে দেখা যায় তিনিও প্রায় একইরকম যন্ত্রের ডিজাইন করেছিলেন। সেই যন্ত্র হয়ে দাঁড়াল হ্যারিসনের প্রতিযোগী।

সত্যি কথা বলতে কি, প্রতিযোগিতা ছিল নিতান্তই অসম। কারণ এই নতুন পদ্ধতিতেও রাতের আকাশ পরিষ্কার থাকতে হত, এবং অনেকবার পর্যবেক্ষণের পরে প্রায় ঘণ্টা চারেক সময় লেগে যেত হিসাব করতে। তাছাড়া মাসের মধ্যে ছ'দিন চাঁদ সূর্য এত কাছে থাকে যে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু বোর্ডের জ্যোতির্বিদরা স্বাভাবিকভাবেই তার সমর্থনে ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধানরাও। রয়্যাল সোসাইটি ছিলে হ্যারিসনের সমর্থক, তাঁকে সোসাইটির কোপলি মেডেল দিয়ে সম্মানিত করে হয়। বিংশ শতাব্দীতে এই পদক পেয়েছিলেন দুই বিখ্যাত বিজ্ঞানী, আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ও আলবার্ট আইনস্টাইন। রয়্যাল সোসাইটির ফেলো হওয়ার প্রস্তাব জন ফিরিয়ে দিয়েছিলে, অনুরোধ করেছিলেন তাঁর ছেলেকে ফেলো করতে। স্বাভাবিকভাবেই সোসাইটি তা মেনে নেয়নি। কিন্তু কয়েক বছর পরে উইলিয়াম নিজের যোগ্যতাতেই রয়্যাল সোসাইটির সদস্য হয়েছিলেন।

হ্যারিসনের চতুর্থ ঘড়িটা ছিল আগের সব মডেলের থেকে আলাদা, তার ওজন ছিলে দেড় কিলোগ্রামেরও কম। গ্রিনউইচের মিউজিয়ামে হ্যারিসনের চারটে ঘড়িই রাখা আছে। প্রথম তিনটে এখনো নিখুঁত সময় দিয়ে চলেছে, কিন্তু চার নম্বর ঘড়ি বন্ধ, তাতে আর দম দেওয়া হয় না। কারণ মিউজিয়াম পৃথিবীর বিখ্যাততম ঘড়ির কোনো ক্ষতি করতে চায় না। অসাধারণ সমস্ত যন্ত্র হ্যারিসন তাঁর ঘড়ির জন্য উদ্ভাবন করেছিলেন, কোথা থেকে তাঁর মাথায় সেই সব চিন্তা এসেছিল আমরা জানি না। চার নম্বর ঘড়িতে পেন্ডুলামের জায়গা নিয়েছিল ব্যালেন্স হুইল। কিন্তু ঠাণ্ডা গরমে সেও ছোট বড় হয়, ফলে ঘড়ি ফাস্ট বা স্লো চলে। সেই সমস্যা এড়াতে হ্যারিসন দুটি বিভিন্ন ধাতু দিয়ে ব্যালেন্স হুইল তৈরি করেছিলেন। তাঁর আবিষ্কৃত সেই প্রযুক্তি আজও আমরা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য থার্মোস্ট্যাটে ব্যবহার করি। অনেক টালবাহানার পরে সেই ঘড়িকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জামাইকা পাঠানো হয়, সঙ্গী হন উইলিয়াম। একাশি দিন যাত্রাপথে ঘড়ি মাত্র পাঁচ সেকেন্ড স্লো হয়েছিল, পুরস্কার জেতার জন্য যথেষ্ট। তা সত্ত্বেও বোর্ড হ্যারিসনকে মাত্র দেড় হাজার পাউন্ড দেয়। ঘড়িটাকে আবার পরীক্ষার জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাঠানো হয়, এবার বার্বাডোজ। এবারও সাফল্যের পরেও দ্রাঘিমা বোর্ড পুরস্কারের অর্ধেক মঞ্জুর করে।

জনের ছেলে উইলিয়াম এবার ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় জর্জকে চিঠি লেখেন। রাজা উইলিয়ামকে ডেকে পাঠান। জন ইতিমধ্যে আরো একটি ক্রোনোমিটার বানিয়েছেন, সেই H-5 রাজা নিজের কাছে রেখে পরীক্ষা করবেন ঠিক করেন। প্রথম কদিন ঘড়ি উল্টোপাল্টা সময় দিচ্ছিল; রাজার মনে পড়ল কাছের এক আলমারিতে তিনি কয়েকটা চুম্বক রেখেছেন। সেই চুম্বক সরানোর পরে ঘড়ি নিখুঁত সময় দিতে শুরু করে। দশ মাস পর্যবেক্ষণের পরে রাজা প্রধানমন্ত্রী লর্ড নর্থকে হ্যারিসনের দাবি বিবেচনা করতে বলেন। পার্লামেন্টে আলোচনার পরে হ্যারিসনকে আরো ৮৭৫০ পাউন্ড দেওয়া হয়। দ্রাঘিমার পুরস্কার ঘোষণা কখনোই করা হয় নি, কিন্তু পুরস্কারের অর্থ শেষ পর্যন্ত হ্যারিসন পেলেন। তখন তাঁর বয়স আশি, তার চোদ্দ বছর আগে তিনি H-4 তৈরি করেছিলেন। তিন বছর পরে ১৭৭৬ সালে নিজের চুরাশিতম জন্মদিনের দিন হ্যারিসন মারা যান।

কেন এই H-4 ঘড়িকে সব থেকে বিখ্যাত বলা হয়? কারণ সমুদ্রপথে নৌচালনার ইতিহাসকে সে পাল্টে দিয়েছিল। ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধে ইউরোপীয়রা নানা দেশ দখল করে ও উপনিবেশ স্থাপন করে সারা পৃথিবীতে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। তখন তারা সমুদ্রপথই অবলম্বন করেছিল, এবং হ্যারিসনের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ছাড়া তা কখনোই সম্ভব ছিল না। ইউরোপের সেই আধিপত্য আমাদের মতো দেশের পক্ষে ভালো হয়নি তা বলা বাহুল্য, কিন্তু তা বলে ইতিহাসকে তো আর ভুলে যাওয়া যায় না। যে কোনো নতুন উদ্ভাবনকেই ভালো এবং খারাপ দুই উদ্দেশ্যেই ব্যবহার করা যায়, কিন্তু খারাপ উদ্দেশ্যে ব্যবহারের দায় সাধারণত উদ্ভাবকের উপর বর্তায় না। তাই ঘড়ির ইতিহাসে জন হ্যারিসনের নাম ভোলার নয়। 

 

প্রকাশ - ছোটদের পত্রিকা মুক্তদল প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যা (ফেব্রুয়ারি ২০২৩)