Saturday 28 October 2023

প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বিকাশ চন্দ্র সিংহ

 প্রয়াত হলেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বিকাশ চন্দ্র সিংহ

 

গত ১১ আগস্ট, ২০২৩ প্রয়াত হলেন বিজ্ঞানী বিকাশ চন্দ্র সিংহ। বিজ্ঞানী ও বিশেষত বিজ্ঞান প্রশাসক হিসাবে তিনি ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার জগতে বিরাট অবদান রেখে গেছেন সন্দেহ নেই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্তরের পরীক্ষাতে ভারতের অংশগ্রহণের সূচনা তাঁর নেতৃত্বে ও উৎসাহেই সম্ভব হয়েছিল।

 

বিকাশ সিংহ (চিত্রঋণ বিশ্বরূপ গাঙ্গুলী)

 

বিকাশ সিংহের জন্ম মুর্শিদাবাদে কান্দির পুরানো রাজপরিবারে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুন। তাঁদের বাড়িতে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর যাতায়াত ছিল। পরিণত বয়সে বিকাশ সিংহের স্মৃতিচারণাতে সেই কথা অনেকবার এসেছে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে ১৯৬৪ সালে স্নাতক হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে অমলকুমার রায়চৌধুরি, সমরেন্দ্রনাথ ঘোষাল ও শ্যামল সেনগুপ্তের নাম কলকাতার পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে প্রবাদপ্রতিম হয়ে গিয়েছে। ঘটনাচক্রে এই বছর এই তিনজনের শতবর্ষ।

এর পর বিকাশ সিংহ ইংল্যান্ডে পড়তে যান। তিনি কেমব্রিজের কিংস কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে বিএ এবং ১৯৬৮ সালে এমএ-তে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ১৯৭০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৬ তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে গবেষণা করেছিলেন। তারপর রাজা রামান্নার আহ্বানে তিনি দেশে ফিরে মুম্বাইয়ের ভাভা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারে যোগ দেন।

১৯৮৪ সালে তিনি কলকাতার ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার বা ভিইসিসির একটি বিভাগের প্রধান হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ভিইসিসির অধিকর্তার দায়িত্ব পান। এত অল্প বয়সে দেশের কোনো মুখ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। ১৯৯২ সালে তিনি কলকাতার সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অধিকর্তার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত একই সঙ্গে দুটি বড় প্রতিষ্ঠান চালনার দায়িত্ব শুধু যে তিনি সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন তা নয়, দুটিকেই তিনি অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তাঁর সময়েই এই দুই প্রতিষ্ঠানে বহু নতুন বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়। নিজে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ হলেও পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়ার বিষয়ে তাঁর কুণ্ঠা ছিল না। তাঁর উদ্যোগে ভিইসিসি-তে মেডিক্যাল সাইক্লোট্রনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই সাইক্লোট্রনে যে সমস্ত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তৈরি হয় তারা ক্যান্সার সহ বহু রোগের নিরাময় বা নির্ধারণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সেই মেডিক্যাল সাইক্লোট্রন এখন কলকাতার উপকণ্ঠে কাজ শুরু করেছে এবং অনেক কম খরচে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করছে। ততিনি অধিকর্তা থাকার সময় সাহা ইন্সটিটিউটে বায়োফিজিক্স, সারফেস ফিজিক্স জাতীয় আধুনিক বিষয়ে গবেষণা সামনের সারিতে আসে। ভিইসিসি-র সুপারকন্ডাক্টিং সাইক্লোট্রন, রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়ন বিম প্রকল্প, সাহা ইন্সটিটিউটের অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল অ্যাকসিলারেটর ফ্রেনা - এই সমস্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে দুই ইনস্টিটিউটে গবেষণাতে নতুন জোয়ার আসে। কিছুদিন তিনি একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। কনিষ্ঠ বিজ্ঞানী ও ছাত্ররা যাতে ঠিক মতো কাজ করতে পারে, তাদের কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে নজর রাখতেন বিকাশ সিংহ।

বিকাশ সিংহ নিউক্লিয় বিক্রিয়া বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। এক বিশেষ তত্ত্ব যার নাম অপটিকাল মডেল, সেখানে তাঁর দখল ছিল প্রশ্নাতীত। লন্ডনের কিংস কলেজে ছ' বছরে প্রকাশিত কুড়িটি গবেষণাপত্র পদার্থবিজ্ঞানে তাঁর কৃতিত্বের সাক্ষ্য দেয়। এরপরে তিনি কোয়ার্ক গ্লুয়ন প্লাজমা বা কিউজিপি বিষয়ে মন দেন। এই বিষয়ে তিনি পৃথিবীর পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম; চল্লিশ বছর আগে ১৯৮৩ সালে এই বিষয়ে তাঁর প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই সমস্ত গবেষণাতে তাঁর অনেক সঙ্গীর মধ্যে তিনজনের নাম আলাদা করে বলতে হয়, তাঁরা হলেন দীনেশ কুমার শ্রীবাস্তব, শিবাজি রাহা ও প্রয়াত ভাস্কর দত্ত। বিকাশ সিংহের পরে ভিইসিসির অধিকর্তা হন শ্রীবাস্তব। শিবাজি রাহা দীর্ঘদিন বোস ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা ছিলেন।

কিউজিপি নিয়ে কিছু কথা এখানে বলা প্রয়োজন। প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে আছে কোয়ার্ক কণা। কোয়ার্ক কণাদের মধ্যে গ্লুয়ন কণা বিনিময়ের সাহায্যে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া হয়। সাধারণভাবে কোয়ার্ক কণারা প্রোটন নিউট্রন ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু সৃষ্টির আদিতে বিগব্যাঙের সময় মহাবিশ্ব ছিল অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও উত্তপ্ত। তখন সেই প্রচন্ড ঘনত্বে কোয়ার্করা খুব কাছাকাছি ছিল, ফলে আলাদা করে প্রোটন নিউট্রন মেসন ইত্যাদি কণার কথা বলা যেত না। এই অবস্থা বা দশাকে বলা হয় কিউজিপি। ব্রহ্মাণ্ড যত প্রসারিত হয়েছে, তার ঘনত্ব ও তাপমাত্রা হ্রাস পেয়েছে, এক সময় কোয়ার্করা প্রোটন ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ল। এই ঘটনাকে এক প্রকার দশা পরিবর্তন বলতে পারি। পৃথিবীর পরীক্ষাগারে দুটি ভারি নিউক্লিয়াসের মধ্যে উচ্চশক্তির সংঘর্ষ ঘটিয়ে সেই আদি অবস্থাকে পুনরায় সৃষ্টি করা সম্ভব। সেই অবস্থাকে দেখা যায় নানা ভাবে, বিকাশ সিংহ জোর দিয়েছিলেন তার থেকে বেরিয়ে আসা ফোটন, ও ইলেকট্রন ও মিউয়ন কণা পর্যবেক্ষণের উপরে।

বিকাশ সিংহকে কেন্দ্র করে কিউজিপি নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণার একটি দল দেশে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তাতেই তিনি সন্তুষ্ট হননি। তিনি জোর দিলেন পরীক্ষা করে দেখার উপর। এবং এখানেই বিজ্ঞান প্রশাসক হিসাবে আমরা তাঁর অন্য একটি রূপ দেখতে পাই। এই ধরনের পরীক্ষা করে দেখার মতো যন্ত্র আমাদের দেশে নেই। পৃথিবীর দুটি পরীক্ষাগার কিউজিপি বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাতে নেতৃত্ব দিয়েছে, একটি হল আমেরিকার ব্রুকহাভেনের রিলেটিভিস্টিক হেভি আয়ন কোলাইডার, অন্যটি হল সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডার। বিকাশ সিংহের চেষ্টাতে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এই পরীক্ষাগারের গবেষণাতে অংশ নেন। তাঁর দূরদৃষ্টি থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভারতকে যদি মর্যাদার সঙ্গে এই সমস্ত জায়গাতে কাজ করতে হয়, তাহলে শুধুমাত্র পরীক্ষার সময়ে অংশ নেওয়া বা তার তথ্য বিশ্লেষণ করলে চলবে না। তাঁর চেষ্টাতেই ভারতীয় বিজ্ঞানীরা নিজেরা যন্ত্র বানিয়ে পরীক্ষাতে ব্যবহার করেছেন; তাঁদের তৈরি ফোটন মাল্টিপ্লিসিটি ডিটেক্টর এবং মিউয়ন চেম্বার এখন এই সমস্ত পরীক্ষাগারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে কাজ করে চলেছে। এই জন্য দেশেই তৈরি হয়েছে মানস নামের সেমিকন্ডাক্টর চিপ, এই প্রযুক্তি যে ভারতে সম্ভব তা কেউ কল্পনাই করতে পারত না। ভারতে একের পর এক আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র আয়োজন করে সেখানে সারা পৃথিবীর প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের তিনি নিয়ে এসেছিলেন।

একজন বা দুজন ভারতীয় ব্যক্তিগতভাবে কী করল, তার থেকে বিকাশ সিংহের কাছে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে দেশ হিসাবে ভারত কী কাজ করছে। ভারত এখন সার্নের সহযোগী সদস্য, তার পিছনে তাঁর প্রচেষ্টার কথা বলতেই হবে। জার্মানিতে তৈরি হচ্ছে আর সর্বাধুনিক নতুন পরীক্ষাগার ফেসিলিটি ফর অ্যান্টিপ্রোটন এন্ড আয়ন রিসার্চ, সংক্ষেপে ফেয়ার। বিকাশ সিংহ পরিকল্পনা স্তর থেকেই ভারত যেন তাতে অংশ নেয় তার চেষ্টা করেছিলেন। অংশীদারত্বের হিসাবে ভারত এখন সেই প্রকল্পে তৃতীয়।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সবাইকে নিয়ে চলার জন্য বিকাশ সিংহ চেষ্টা করে গেছেন। শুরুতে ভারত থেকে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান এই ধরনের আন্তর্জাতিক পরীক্ষাতে অংশ নিচ্ছিল। এখন শুধুমাত্র কলকাতা থেকেই ভিইসিসি ছাড়াও সাহা ইনস্টিটিউট, বোস ইন্সটিটিউট, কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এই সমস্ত প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। সারা ভারতের মোট পঁচিশটি গবেষণা কেন্দ্র ও পনেরটি শিল্প প্রতিষ্ঠান এখন ফেয়ার-এ কাজের অংশীদার। শিল্প প্রতিষ্ঠানের কথা আলাদা করে বলতেই হয়, কারণ আন্তর্জাতিকমানের যন্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রযুক্তির উন্নতি করতে পারছে এবং ব্যবসার পরিমাণ বাড়াতে পারছে। তিনি ফেয়ার-এর পরিচালনা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।

অবসর নেওয়ার পরেও কাজ থামাননি বিকাশ সিংহ। পঁচাত্তর বছর বয়সেও পৃথিবীর প্রথম সারির গবেষণা পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একক গবেষণা। বিজ্ঞান প্রসারে ও প্রচারেও সক্রিয় ছিলেন, নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকাতে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখি করতেন। 'সৃষ্টি এবং কৃষ্টি: বন্ধনহীন গ্রন্থি' এবং 'স্থান, কাল ও বিশ্বলোক', এই দুই বইতে তাঁর রচনাগুলি গ্রন্থিত হয়েছে। মৃত্যু বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর ও পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের কাউন্সিল সদস্য ছিলেন তিনি। সাহিত্য বা ইতিহাসেও তাঁর উৎসাহ ছিল। রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী বিকাশ সিংহের উৎসাহেই নিউটাউনে তৈরি হয়েছে টেগোর সেন্টার ফর সায়েন্স এন্ড ফিলোজফি। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার, পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ সম্মান, রবীন্দ্র পুরস্কার, সত্যেন্দ্রনাথ বসু জন্মশতবার্ষিকী পুরস্কার, মেঘনাদ সাহা পুরস্কার, ইত্যাদি।

এখন যখন বিজ্ঞানের নামে অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের চর্চা প্রাধান্য পাচ্ছে, সেই সময় নিজে যা বিশ্বাস করেন তা সোজাসুজি বলা প্রয়োজন তা তিনি বুঝেছিলেন। ২০২০ সালে কলকাতার টেলিগ্রাফ পত্রিকাতে এক সাক্ষাৎকারে বিকাশ সিংহ বলেন সমস্ত পশ্চিমী চিন্তাভাবনার মূল ভারতীয় চিন্তাতে পাওয়া যাবে, এটা একেবারেই ভুল ধারণা এবং তা হয় একান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত বা তার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে। ভারতীয় দর্শনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও তিনি বলেছিলেন পাশ্চাত্যের অনেক চিন্তাই সেখানে পাওয়া যাবে না। তিনি সাক্ষাৎকারে চারটি উদাহরণের কথা বলেছিলেন। আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, রেনে দেকার্তের দর্শনের পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেছিলেন মার্ক্স ও এঙ্গেলসের শ্রেণি ও শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বের কথা। কখনো কোনো বামপন্থী দলের সদস্য না হয়েও মার্ক্স-এঙ্গেলসের তত্ত্বের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। তাঁর প্রয়াণে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণাতে এক বিরাট শূন্যস্থানের সৃষ্টি হল। 

 

প্রকাশঃ দেশহিতৈষী,  ১৮ আগস্ট, ২০২৩

ক্যালেন্ডারের গল্প

 

ক্যালেন্ডারের গল্প

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


আজকে তোমাদের ক্যালেন্ডারের গল্প শোনাব। ভাবছ ক্যালেন্ডারের মধ্যে আবার নতুন কী আছে? ওই প্রতিবছর হয় পয়লা জানুয়ারি নয়তো পয়লা বৈশাখ নতুন ক্যালেন্ডার আসে, কোনোটা দেয়ালে টাঙানো হয়, কোনোটা টেবিলে বা পকেটে রাখি। সেগুলোও নিশ্চয় ক্যালেন্ডার, কিন্তু আমাদের গল্পগুলো তার থেকে পুরোনো। এতই পুরোনো যে অনেক গল্পের শুরু কবে সবাই ভুলে গেছে। প্রাচীন রোমানরা মাসের প্রথম দিনটাকে বলত ক্যালেন্ডস, সেই থেকে ক্যালেন্ডার শব্দটা এসেছে। আমাদের দেশে আমরা বলি পঞ্জিকা বা পাঁজি। আয়ারল্যান্ডে এমন কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে যার ভিতরে একটি সমাধি আছে। একমাত্র একুশে ডিসেম্বর, অর্থাৎ মকর সংক্রান্তির দিনে সূর্যোদয়ের সময় সেই সমাধি সূর্যের আলোতে কয়েক মিনিটের জন্য সরাসরি আলোকিত হয়। এইরকম স্থাপত্য আমাদের দেশেও আছে। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষের দিকে কেরালাতে তৈরি শ্রীপদ্মনাভস্বামীর মন্দিরে গোপুরমের পাঁচটি স্তরের জানালা ভেদ করে সূর্যাস্তের সময় সূর্যের আলো ঢুকতে পারে মহাবিষুব ও জলবিষুবের দিনে, ঐ দু’দিন সূর্য বিষুবরেখার উপর লম্বভাবে কিরণ দেয় ইংল্যান্ডের বিখ্যাত স্টোনহেঞ্জও বছরের হিসাব রাখার জন্য তৈরি হয়েছিল। এদের ক্যালেন্ডার বলবে কিনা তা তোমরাই ঠিক করো।

পয়লা জানুয়ারি, কি পয়লা বৈশাখ, কি মহরম মাসের এক তারিখ, যেদিনই বছরটা শুরু হোক না কেন, ক্যালেন্ডার বানাতে হলে দুটো জিনিস জানতে হয়। এক হল বছরটা কত লম্বা? মানে কত দিন পরে আবার নতুন বছর আসবে। আর দু’নম্বরটা হল ঠিক কোন দিনে বছর শুরু হবে। এখন এই দ্বিতীয়টা নানা কারণে আলাদা আলাদা, তার কয়েকটা উদাহরণ আমরা দেখব। কিন্তু প্রথমটাতেও যে সবাই একমত, তা কিন্তু নয়। এক বছরে কত দিন? তোমরা বলবে ৩৬৫ দিন, আর লিপ ইয়ার হলে ৩৬৬। ঠিক, কিন্তু এটাই একমাত্র উত্তর নয়। যেমন ইসলামিক ক্যালেন্ডারে এক বছরে ৩৫৪ কিংবা ৩৫৫ দিন। সেটার কারণ আমরা জানি, একটু পরেই সেখানে আসব। কিন্তু মধ্য আমেরিকার মায়া সভ্যতা দু’রকম ক্যালেন্ডার ব্যবহার করত, তার একটাতে ছিল ২৬০ দিন। মায়া সভ্যতা স্পেনের আক্রমণে ধ্বংস হয়ে গেছে, তাই কেন তারা বছরে ২৬০ দিন রেখেছিল, তা জানার আর উপায় নেই।

আচ্ছা ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিন কোথা থেকে এলো? এখন আমরা জানি যে পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একপাক ঘুরতে সময় নেয় ৩৬৫ দিনের একটু বেশি, ঠিকঠাক মাপটায় আমরা পরে আসছি। তার ফলে গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত সব ঠিক এক বছর পরে ঘুরে আসে। নিশ্চয় জানো যে পৃথিবী ঠিক সোজা দাঁড়িয়ে সূর্যের চারদিকে ঘোরে না, একটু হেলে আছে। কোনো এক সময় সূর্য উত্তর গোলার্ধের উপরে বেশি লম্বভাবে কিরণ দেয়, তখন সেখানে গ্রীষ্মকাল। আবার ছ’ মাস পরে সূর্য উত্তর গোলার্ধের উপর তেরচা ভাবে কিরণ দেয়, তখন সেখানে শীতকাল। কিন্তু প্রাচীন যুগের মানুষ তো এসব জানত না, তাহলে তারা বছর গুনত কেমন করে?

অনেক রকম পদ্ধতি তারা নিয়েছিল। প্রথম ক্যালেন্ডার তৈরি হয়েছিল মিশরে। ভূগোল বইতে পড়েছ মিশরের সভ্যতা হল নীলনদের দান। মরুভূমির মধ্যে দিয়ে নদী বয়ে চলেছে, বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় সেখানে বন্যা আসত। কূল ছাপিয়ে নদী তীরকে প্লাবিত করত, রেখে যেত জল আর উর্বর পলিমাটি। সেইখানে সারা বছরের জন্য ফসল চাষ হত। কবে নাগাদ বন্যা আসবে আগে জানা গেলে তৈরি থাকা যায়, জল নামার সঙ্গে সঙ্গে বীজ বোনা যায়। মিশরিয়রা দেখল যখন সূর্য ওঠার ঠিক আগে পূর্ব আকাশে আকাশের সব থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র লুব্ধকের উদয় হয়, তার কয়েকদিনের মধ্যেই নীলনদে বন্যা আসে। তারা গুনে দেখল দু’বার এই ঘটনার মধ্যে মোটামুটি ৩৬৫ দিনের তফাত। তার থেকেই তারা বছর মেপে ফেলল। আসলে হিসেবটা ৩৬৫ দিনের থেকে একটু বেশি, মোটামুটি এক দিনের চার ভাগের এক ভাগ। তাহলে প্রতি চারবছরে এক দিন বেশি হয়। মিশরিয়রা সেটা বুঝতে পেরেছিল, কিন্তু সেটাকে হিসেবে আনার প্রয়োজন মনে করেনি। সেজন্য প্রতি চার বছরে এক দিনের গোলমাল হত। কবে থেকে তারা বছর গুনতে শুরু করেছিলে, তাই নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে তর্ক আছে, তার মধ্যে আমরা যাব না। কিন্তু খ্রিস্ট জন্মের তিন হাজার বছর আগে যে তারা এভাবে বছর গুনতে শুরু করেছিল তাই নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রতি চার বছরে একদিনের গণ্ডগোল মানে ১৪৬০ বছরে এক বছরের গণ্ডগোল। বুঝতেই পারছ গোনা শুরুর কয়েকশো বছর পরেই লুব্ধকের উদয়ের সঙ্গে বন্যার আর কোনো সম্পর্ক রইল না। তৃতীয় টলেমি যখন ২৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মিশরের সম্রাট হলেন, তখন তিনি বলেছিলেন যে প্রতি চার বছরে এক দিন যোগ করা হোক, এখন আমরা যাকে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ বলি। কিন্তু টলেমি ছিলেন গ্রিক, আলেকজান্ডার মিশর দখল করে নিয়েছিলেন, তাঁর মৃত্যুর পরে সেখানে গ্রিকরাই সম্রাট বা ফারাও হয়ে শাসন করতে শুরু করেন। বছরের হিসেব রাখত পুরোহিতরা, তারা গ্রিক সম্রাটের আদেশকে গুরুত্ব দেয়নি। সে যাই হোক, মিশরিয়রাই প্রথম ৩৬৫ দিনে বছর গুনেছিল।

অন্যভাবেও কিন্তু এই হিসেবটা করা যায়। প্রতিদিন যদি সূর্য একই জায়গায় উদয় হয় বা অস্ত যায় না। একুশে জুন কর্কটসংক্রান্তির দিনে সূর্য সব থেকে উত্তর দিকে উদয় হয়, তারপর সে দক্ষিণদিকে চলতে শুরু করে। বাইশে ডিসেম্বর দক্ষিণতম বিন্দুতে যায়, আবার তারপর উত্তর দিকে রওনা দেয়। সেই দেখেই বছরের হিসাব করা যায়। ঠিক তেমনি ঠিক দুপুর বেলা একটা খাড়া ভাবে রাখা লাঠির ছায়া কোনদিকে পড়ে আর কত বড় হয়, তাই দেখেও বছর মাপা যায়। ধরো, বেশ কয়েকবছর ধরে কর্কটক্রান্তি রেখার উপরে কোনদিন দুপুরবেলা লাঠির ছায়া থাকে না, তার থেকে হিসেব করলে দেখা যাবে বছর ৩৬৫ দিনের থেকে ছ’ ঘণ্টা বেশি। ভারত, মেসোপটেমিয়া, চিন, এই সমস্ত দেশে এভাবেই হয়তো বছরের হিসেব করা হয়েছিল। কিন্তু নীল নদের বন্যার সঙ্গে যোগ রেখে লুব্ধক উদয়ের সঙ্গে নতুন বছর শুরু করার হিসাব মিশরিয়রা করেছিল, অন্যদের বছরের শুরুটা সেই দিনে পড়ার কোনো কারণ নেই। যেমন আমাদের যে বঙ্গাব্দ, তার পয়লা বৈশাখ ছিল মার্চ মাসের একুশ তারিখ অর্থাৎ মহাবিষুব, সেই দিন সূর্য বিষুবরেখার উপর লম্বভাবে কিরণ দেয়।

আমি জানি তোমরা এক্ষুনি বলবে যে পয়লা বৈশাখের ছুটি তো ১৫ এপ্রিল পাই। আসলে সূর্য দেখে আর নক্ষত্র দেখে বছরের হিসেব করলে একটু তফাত হয়, তার কারণ পৃথিবীর অয়নচলন। এটা একটু জটিল, আসলে পৃথিবীর অক্ষ মোটামুটি ছাব্বিশ হাজার বছরে কক্ষতলের সঙ্গে লম্বের সাপেক্ষে একপাক ঘুরে আসে। কিন্তু আমাদের বঙ্গাব্দের পঞ্জিকায় সেটাকে হিসাবে রাখা হয়নি। ফলে ২০২৩ সালে মে মাসের গরমে রবীন্দ্রজয়ন্তী হল, আর ১৫০২৩ সালে সোয়েটার গায়ে দিয়ে পঁচিশে বৈশাখ পালন হবে। বঙ্গাব্দ কে কবে শুরু করেছিলেন তাই নিয়ে তর্ক আছে, তার মধ্যে না ঢুকে একটা কথা বলতেই পারি। বঙ্গাব্দ শুরুর হিসাবের পরে চোদ্দশো তিরিশ বছরে পয়লা বৈশাখ পিছিয়ে পিছিয়ে পনেরই এপ্রিলে চলে গেছে। এই অয়নচলন বিষয়টা আবিষ্কার করেছিলেন গ্রিক বিজ্ঞানী হিপ্পারকস খ্রিস্ট জন্মের একশো বছর আগে। কিন্তু আমাদের পঞ্জিকায় সেটা আর কেউ ঢোকায় নি। জ্যোতিষীরা জন্মের সময় কোন রাশি ছিল জানতে চায়। রাশি আর কিছু নয়, আকাশে সূর্যের গতিপথে বারোটা নক্ষত্রমণ্ডলের কল্পনা করা হয়েছে, তাদের বলে রাশি। কিন্তু বছর পিছিয়ে যাওয়ার ফলে রাশির হিসেবেও গণ্ডগোল হয়ে গেছে। অবশ্য রাশি ঠিক থাকলেও জ্যোতিষীদের ভবিষ্যৎবাণী মেলার কোনো কারণ নেই, সূর্য আকাশে কোথায় আছে তার সঙ্গে মানুষের ভবিষ্যতের কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। জ্যোতিষীরা যা বলে সবই ভুলভাল, কিন্তু তাদের হিসেবের গোড়াতেও ভুল আছে।

সূর্যকে ধরে বছর হিসেব করার কারণ আছে। কবে ফসল রোপণ করতে হবে, শীত শুরুর আগে কবে পশুপালকরা পাহাড় থেকে তাদের ভেড়ার পাল নিয়ে নেমে আসবেন, বর্ষার শেষে রাজা কবে যুদ্ধযাত্রা করবেন বা শিকার করতে বেরোবেন, এ সমস্তই ঋতুর উপর নির্ভর করত। আগেই বলেছি পৃথিবী ও সূর্যের আপেক্ষিক অবস্থানের জন্যই ঋতু পরিবর্তন হয়। মানুষের জীবনের জন্য এই বছরটাই হল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ, একে বলে ক্রান্তীয় বা সৌর বছর। কিন্তু অন্য এক ধরনের বছরও আছে।

আকাশে সব থেকে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক নিশ্চয় সূর্য, কিন্তু রাতের আকাশের চাঁদও মানুষের মন কেড়ে নিয়েছিল। চান্দ্র বছরের হিসাব সৌর বছরের থেকে বেশি পুরানো, চাঁদকে দেখে ক্যালেন্ডার বানানোর সব থেকে বড় সুবিধা হল চাঁদের কলা। পূর্ণিমার দিনের থালার মতো চাঁদ ক্ষয় পেতে পেতে অমাবস্যাতে অদৃশ্য হয়ে যায়, তারপর আবার বাড়তে বাড়তে পূর্ণিমাতে ফিরে আসে। এই বিষয়টা বোঝা খুব সোজা। এক অমাবস্যা থেকে আরেক অমাবস্যা বা এক পূর্ণিমা থেকে আরেক পূর্ণিমার মধ্যে মোটামুটি সাড়ে ঊনত্রিশ দিনের তফাত থাকে। একে বলে এক চান্দ্র মাস। যদি বারোটা চান্দ্র মাসের হিসেব করি, তাহলে হয় ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনের মাঝামাঝি। এই সংখ্যাটা ৩৬৫ দিনের সৌর বছরের কাছাকাছি, তাই বারো চান্দ্র মাসে এক বছর গোনা শুরু হয়েছিল। ইসলামিক হিজরি ক্যালেন্ডার চান্দ্র মাস মেনে চলে, তাই প্রতিবছর ইদ মহরম ইত্যাদি সৌর বছর বা বঙ্গাব্দের হিসাবে দশ থেকে এগারো দিনে আগে পড়ে। একে বলে চান্দ্র ক্যালেন্ডার। হজরত মহম্মদ যে বছর তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে নিয়ে মক্কা থেকে মদিনা গিয়েছিলেন, সেই বছর থেকে হিজরি সাল গোনা শুরু হয়।

বছরকে বারো মাসে ভাগ করার ধারণাটা এসেছিল চান্দ্র মাস থেকে, কিন্তু পরে অনেক সময় তাকে চাঁদের কলার থেকে আলাদা করা হয়। মিশরিয়রা ধরেছিল তিরিশ দিনে এক মাস, তার সঙ্গে চাঁদের কলার কোনো সম্পর্ক নেই। বারো মাসে ৩৬০ দিন, শেষ পাঁচ দিনকে তারা কোনো মাসের মধ্যে ফেলে নি। চাঁদের সঙ্গে বঙ্গাব্দের মাসেরও কোনো সম্পর্ক নেই। তাই বঙ্গাব্দ হল বিশুদ্ধ সৌর ক্যালেন্ডার। বুঝতেই পারো চাঁদের কলার সম্পর্ক আছে তিথির সঙ্গে। ইদের মতোই দুর্গাপুজোও এগোতে থাকে, কিন্তু তার একটা সীমা আছে। মহালয়া হল এমন অমাবস্যা তিথি যাকে আশ্বিন মাসে পড়তেই হবে। তার পরের পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ, দুর্গাপুজো সেই সময় হয়। এক মহালয়ার পরে আবার তেরো নম্বর অমাবস্যাই মহালয়া, কিন্তু এগোতে এগোতে যখন সেই অমাবস্যাটা ভাদ্র মাসে চলে যায়, তখন তার পরের অমাবস্যাতে মহালয়া পালন করা হয়। এভাবে চান্দ্র ক্যালেন্ডারকে যদি সৌর ক্যালেন্ডারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়, তখন তাকে বলে চান্দ্রসৌর ক্যালেন্ডার। দুই ক্যালেন্ডারের মধ্যে বছরে দশ বা এগারো দিনের তফাত হয়, সেই কারণে ভারতীয় পাঁজিতে তিন বছর অন্তর একটি অতিরিক্ত মাস যোগ করা হয় যাকে বলে মলমাস। অনেক ক্যলেন্ডারেই এই রকম ব্যবস্থা আছে।

এখানে একটা কথা বলে রাখি, সাধারণভাবে দিন কত লম্বা তা মাপা হয় এক মধ্যাহ্ন থেকে পরের মধ্যাহ্নের মধ্যের সময় দিয়ে। রাত বারোটা থেকে দিনের শুরু হয়েছে অনেক পরে। বঙ্গাব্দে দিন শুরু হয় সূর্যোদয় থেকে। হিজরি ক্যালেন্ডার চাঁদ মেনে চলে, তার দিনের শুরু সূর্যাস্ত থেকে। হিন্দুরা যে তিথি গণনা করেন, তা কিন্তু সৌর দিনের মাপের থেকে আলাদা; সেটা চান্দ্রমাসের হিসাবেই হয়। দিনেরও অনেক গল্প আছে, সে সব পরে কখনো বলা যাবে।

প্রতি চারবছরে একটা অধিবর্ষের নিয়ম চালু করেছিলেন রোমের শাসক জুলিয়াস সিজার। তাঁর পরে রোমের সম্রাট হন অগাস্টাস। জুলিয়াস মিশর দখল করেছিলেন, অগাস্টাস সেখানে অধিবর্ষ চালু করেন। জুলিয়াসের আগে রোমে বছর গোনা হত ৩৫৫ দিনে অর্থাৎ মোটামুটি বারোটি চান্দ্র মাস। দু’বছর অন্তর তার সঙ্গে বাইশ বা তেইশ দিন যোগ করা হত, কিন্তু তার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল না। ফলে জুলিয়াস সিজারের সময় দু’মাসের বেশি ফারাক হয়ে যাচ্ছিল। সিজার মিশরের থেকে ৩৬৫ দিনের সৌর বছরটিকে নিলেন, আর খ্রিস্টপূর্ব ৪৬ সালকে বাড়িয়ে করলেন ৪৪৫ দিনের। তিনি মাসের সঙ্গে চাঁদের কোনো সম্পর্ক রাখলেন না, এবং অধিবর্ষের নিয়ম চালু করলেন। একে বলা হয় জুলিয়াসের ক্যালেন্ডার।

কিন্তু বছরের আসল দৈর্ঘ্য হল ৩৬৫.২৪২২ দিন, অধিবর্ষের নিয়মে প্রতি চার বছরে ০.০৩১২ দিন বেশি যোগ হয়ে যাচ্ছিল। ১৫৮২ সালে পোপ দ্বাদশ গ্রেগরির আগ্রহে আবার ক্যালেন্ডার সংশোধন করা হয়। সমস্যাটা ছিল মূলত ধর্মীয়, যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ও পুনরুত্থানের যে উৎসব সেই ইস্টারের তারিখ নিয়ে গণ্ডগোল দেখা দিয়েছিল। তাই গ্রেগরি নিয়ম করলেন শতাব্দীর ক্ষেত্রে অধিবর্ষ তখনই প্রযোজ্য হবে যদি তা চারশো দ্বারা বিভাজ্য হয়। অর্থাৎ ১৯০০ সাল অধিবর্ষ ছিল না, ২১০০ সালও অধিবর্ষ হবে না, কিন্তু ২০০০ সাল ছিল অধিবর্ষ। এর ফলে সমস্যাটা পুরোপুরি চলে যায় নি, তবে তিন হাজার বছর না পেরোলে একদিনের নড়চড় হবে না। জুলিয়াস সিজার ও দ্বাদশ গ্রেগরির যুগের মধ্যে এগারো দিন গণ্ডগোল হয়েছিল, তাই তিনি নির্দেশ দেন যে ১৫৮২ সালের ৪ অক্টোবর বৃহস্পতিবারের পরের দিন হবে ১৫ অক্টোবর শুক্রবার। আস্তে আস্তে সব দেশই এই নিয়ম মেনে নিয়েছে, এই ক্যালেন্ডার গ্রেগরির ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। রাশিয়া ১৯১৭ সালের বিপ্লবের আগে পর্যন্ত জুলিয়াস সিজারের ক্যালেন্ডার মেনে চলত, বিপ্লবের পরে গ্রেগরির ক্যালেন্ডার অবলম্বন করে। আগের ক্যালেন্ডারে বিপ্লব হয়েছিল অক্টোবর মাসে, পরের হিসাবে সেটা ছিল নভেম্বর মাস। তাই পুরানো বইতে রুশ বিপ্লবকে অক্টোবর বিপ্লব বলা হত।

সেপ্টেম্বর, অক্টোবর, নভেম্বর, ডিসেম্বর, এদের মানে হল সপ্তম, অষ্টম, নবম, ও দশম মাস। কিন্তু ক্যালেন্ডারে তো তা নয়। আসলে রোমে বছর শুরু হত পয়লা মার্চ থেকে, সেই জন্যই এই নাম। খ্রিস্টজন্মের সাড়ে চারশ বছর আগে রোমে জানুয়ারি থেকে নতুন বছর গোনা শুরু হয়। তখন ছিল চান্দ্র মাস, তাতে থাকত আটাশ বা ঊনত্রিশ দিন। তার চারশো বছর পরে জুলিয়াস সিজার সব মাসগুলোকে হয় তিরিশ না হয় একতিরিশ দিনে চালু করেছিলেন। খালি ফেব্রুয়ারি মাসে আছে আটাশ দিন, অধিবর্ষে সেটা হয় ঊনত্রিশ দিন। জুলিয়াস ও অগাস্টাসের শাসনকে স্মরণীয় করে রাখতে বছরের সপ্তম ও অষ্টম মাসের নাম রাখা হয় জুলাই ও আগস্ট। কোথাও কোথাও গল্প শুনবে যে অগাস্টাস নিজের নামের মাস যাতে ছোট না হয় তার জন্য ফেব্রুয়ারি থেকে একদিন নিয়ে নিয়েছিলেন। ওটা গল্পই, অগাস্টাস সম্রাট হওয়ার আগেই অষ্টম মাসে একত্রিশ দিন ছিল।

একটা কথা বলে রাখি, পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব সব সময় সমান নয়, আমাদের যখন গ্রীষ্মকাল, তখন আমরা সূর্যের থেকে একটু বেশি দূরে থাকি। গ্রীষ্মকালের সঙ্গে সূর্য পৃথিবীর দূরত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার দেখিয়েছিলেন যে গ্রহ যখন সূর্যের থেকে বেশি দূরে থাকে তখন তার বেগ কমে যায়। সেই কারণে উত্তর গোলার্ধে গ্রীষ্মকাল বেশি লম্বা। এই কারণেই আমাদের বঙ্গাব্দের হিসাবে গ্রীষ্মকালের মাসগুলি অপেক্ষাকৃত বড় রাখা হয়। যেমন ১৪৩০ বঙ্গাব্দে বৈশাখ, আষাঢ়, ভাদ্র ও চৈত্র মাসে আছে একত্রিশ দিন করে, জ্যৈষ্ঠ ও শ্রাবণ মাসে বত্রিশ দিন, আবার পৌষ ও মাঘ মাসে উনতিরিশ দিন। পৃথিবীর গতির কথা জানা না থাকলেও উদয় বা অস্তের সময় সূর্যের অবস্থান পর্যবেক্ষণ থেকেই প্রাচীন পঞ্জিকাকাররাই এই ধরনের হিসাবে পৌঁছেছিলেন।

আমার কথা শেষ করার সময় এসেছে। আরো অনেক রকম ক্যালেন্ডার আছে, তাদের প্রত্যেকের অনেক গল্প আছে। ইচ্ছা করলে তোমরাও বই বা ইন্টারনেট ঘেঁটে তাদের সম্পর্কে জানতে পারো। দুটো খুব ভালো বইয়ের কথা বলি, পলাশ বরন পালের লেখা 'সাল তারিখের ইতিহাস' ও প্রদীপ্ত সেনের 'সন-তারিখের পাঁচালি'; উপরের অনেকগুলো কথাই এদের থেকে নেওয়া। 

খুশির হাওয়া পত্রিকার শারদীয় ১৪৩০ সংখ্যায় প্রকাশিত


 

Image by Freepik

Thursday 26 October 2023

বার বার আক্রান্ত বিবর্তনবাদ

 

বার বার আক্রান্ত বিবর্তনবাদ 

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায় 


শুরু করা যাক একটা পুরানো গল্প দিয়ে। গল্পটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, তবে যে কোনো দেশের হতেই পারত, এখনো হয়তো পারে। ১৯২৫ সালে টেনেসি প্রদেশের ডেইটন শহরের এক স্কুলশিক্ষক জন স্কোপ্‌সকে আইনভঙ্গের দায়ে আদালতে হাজির হতে হয়। কোন আইন তিনি ভেঙেছিলেন? অল্পদিন আগেই টেনেসির আইনসভা বিপুল গরিষ্ঠতাতে এক আইন পাস করেছিল; বাইবেলে লেখা আছে ইশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন, তার বিরোধী কোনো তত্ত্ব স্কুলে পড়ানোকে অপরাধ বলে গণ্য করা হবে। স্পষ্টতই লক্ষ্য ছিল ডারউইনের বিবর্তনবাদ। তবে সকলেই যে মুখ বুজে এই আইন মানতে তৈরি ছিলেন তা নয়, কারণ তাঁরা বুঝেছিলেন যে শুধু বিবর্তনবাদ নয়, এ হল আধুনিক বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তি ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপরে আক্রমণ। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন শিক্ষকদের কাছে আহ্বান জানায় আইন ভাঙার জন্য, তার জন্য আদালতে প্রয়োজনীয় আইনগত সহায়তা তারা দেবে। স্কোপ্‌স রাজি হন, তিনি স্কুলে বিবর্তনের ক্লাস নেন। আইন ভাঙার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হয়।

স্কোপ্‌সের পক্ষে দাঁড়ান আমেরিকার সব থেকে বিখ্যাত উকিলদের একজন, ক্ল্যারেন্স ড্যারো। ড্যারো ব্যক্তিগতভাবে ছিলেন প্রগতিশীল, তিনি সানন্দে এই দায়িত্ব নিয়েছিলেন। টেনেসির আইনের পিছনে ছিলেন রাজনীতিবিদ উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ান। তিনি সরকারপক্ষের উকিলদের সঙ্গে যোগ দেন। স্কোপ্‌স যে আইন ভেঙেছিলেন তা তিনি অস্বীকার করেননি, কাজেই সেদিক দিয়ে বিচারের বিশেষ কিছু ছিল না। আসলে ড্যারোরা আদালত নয়, মানুষের কাছে নিজেদের যুক্তি নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সরকার পক্ষ ড্যারোকে সেই সুযোগ দিচ্ছিলেন না। ড্যারো তখন এক অভাবনীয় কাজ করেছিলেন, তিনি বিপক্ষের উকিল ব্রায়ানকে বাইবেল বিশেষজ্ঞ হিসাবে সাক্ষ্য দিতে ডেকেছিলেন, এবং বাইবেল থেকে নানা উদাহরণ দেখিয়ে বলতে বাধ্য করেছিলেন যে বাইবেলে যা লেখা আছে তার সবটাই আক্ষরিক সত্যি নয়, কিছু কথা রূপক বলে ধরতে হবে। ড্যারোর এক বিখ্যাত প্রশ্ন ছিল, বাইবেলে লেখা আছে সৃষ্টির চতুর্থ দিনে ঈশ্বর সূর্য চন্দ্র সৃষ্টি করেছিলেন, তাহলে তার আগের তিন দিন রাত কেমন করে হয়েছিল? বিচারে স্কোপ্‌সের অবশ্যই শাস্তি হয়েছিল, তবে পরে টেনেসি সুপ্রিম কোর্ট একটা নিয়মগত ভুল দেখিয়ে তা বাতিল করে দেয়। 

উইলিয়াম জেনিংস ব্রায়ানকে (বাঁদিকে বসে) জেরা করছেন ক্ল্যারেন্স ড্যারো, (দাঁড়িয়ে)।  বিচারের সপ্তম দিনে প্রচণ্ড গরমের জন্য কোর্টের বাইরে বিচার চলেছিল।

 

আমেরিকাতে বিবর্তনবাদ প্রচারের কাজ করেছিল এই বিচার যা ইতিহাসে স্কোপ্‌স মাঙ্কি ট্রায়াল নামে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে। ডারউইনের মতবাদের বিরোধিতাতে বাঁদরের কথা আসা নতুন কিছু নয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে সব থেকে বিখ্যাত বিতর্ক হয়েছিল ১৮৬০ সালে অক্সফোর্ডে। তার একদিকে ছিলেন এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী, অন্যদিকে এক ধর্মযাজক। বিষয় ছিল ডারউইনের বিবর্তনবাদ। ঠিক আগের বছর ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে চার্লস ডারউইনের সেই কালজয়ী গ্রন্থ যাকে 'অরিজিন অফ স্পিসিস' (পুরো নাম হল On the Origin of Species by Means of Natural Selection, or the Preservation of Favoured Races in the Struggle for Life) এই সংক্ষিপ্ত নামে আমরা সবাই চিনি। আলোচনাতে অনেকে অংশ নিলেও মূল তর্ক হয়েছিল দুজনের মধ্যে। একদিকে ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত বক্তা বিবর্তনবাদের তীব্র বিরোধী বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্স; অন্যদিকে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী টমাস হাক্সলি যিনি নিজেকে বলতেন ডারউইনের বুলডগ। তর্কটা বেঁধেছিল বিবর্তনবাদের পক্ষে যুক্তি ও প্রমাণ নিয়ে, কিন্তু উইলবারফোর্স যুক্তির পরিবর্তে কথার কারিকুরিতে হাক্সলিকে পরাজিত করার চেষ্টা করছিলেন। একসময় হাক্সলিকে ব্যাঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করেন তাঁর ঠাকুর্দা না ঠাকুমা, কে বাঁদর ছিলেন। হাক্সলি উত্তরে বলেন যে পূর্বপুরুষ বাঁদর বলে তাঁর কোনো লজ্জা নেই, তিনি লজ্জিত হতেন যদি তিনি জানতেন যে তাঁর পূর্বপুরুষ সত্যকে সুবিধামতো বিকৃত করেছিলেন। স্পষ্টতই ইঙ্গিতের লক্ষ্য ছিলেন উইলবারফোর্স। কয়েকবছর আগে আমাদের দেশের সেই সময়ের কেন্দ্রীয় উচ্চশিক্ষামন্ত্রী সত্যপাল সিং মশাইও বলেছিলেন যে কেউ তো বাঁদর থেকে মানুষ হতে দেখেনি, সুতরাং বিবর্তন তত্ত্বটাই ভুল; জানি না হাক্সলির যুক্তির কী উত্তর তিনি দেবেন।

এখানে বলে রাখি যে ডারউইন ও আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেস আলাদা আলাদা ভাবে একই সময়ে বলেছিলেন যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তন হয়, সঠিক অর্থে তাই এটি দুজনেরই তত্ত্ব। এমন নয় যে বিবর্তনের কথা আগে কেউ বলেন নি, লামার্কের বিবর্তন তত্ত্বের কথা আমরা সবাই জানি। ডারউইনের ঠাকুর্দা ইরাসমাস ডারউইনও ছিলেন বিজ্ঞানী, তিনিও বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন। কিন্তু বিবর্তন কেন হবে সে কথা ডারউইন ও ওয়ালেসের আগে কেউ বুঝতে পারেননি। তবে ডারউইন বিবর্তনবাদের সমর্থনে বিপুল পরিমাণ তথ্য জোগাড় করেছিলেন, এবং ওয়ালেস কখনো কখনো তাঁর নিজের তত্ত্বের বৈপ্লবিক তাৎপর্য থেকে পিছিয়ে এসেছিলেন। তাই অনেক সময়েই বিবর্তনতত্ত্বকে ডারউইনবাদও বলা হয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মতো পরিচিত বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার প্রয়োজন এই লেখাতে নেই। সংক্ষেপে বলা যায় যে যে কোনো প্রজাতির জীবদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে নতুন চরিত্রের প্রকাশ ঘটে। জীবজগতে যে নতুন চরিত্রগুলি পরিবেশে ঐ জীবের বংশবৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে কোনো সুবিধা দেয়, সেগুলি স্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে যেগুলি বংশবৃদ্ধিতে জীবকে অসুবিধাজনক অবস্থানে ফেলে, সেই পরিব্যক্তিগুলি লুপ্ত হয়ে যায়। এই পদ্ধতিকে বলে অভিযোজন; এর মাধ্যমে নতুন চরিত্র পুঞ্জীভূত হতে হতে শেষ পর্যন্ত নতুন প্রজাতির জন্ম হয়। একেই বলে প্রাকৃতিক নির্বাচন। প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব আমাদের পৃথিবীর এই বৈচিত্রময় জীবজগৎ কেমনভাবে সৃষ্টি হয়েছে তা বুঝতে সাহায্য করেছে।

জীববিজ্ঞানের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ এই বিবর্তনবাদ, তাকে পাঠ্যসূচী থেকে বাদ দেওয়ার কাহিনির পুনরাবৃত্তি হচ্ছে আমাদের দেশে। ভারতের ইতিহাসের উপর আক্রমণ আমাদের দেশে বহুদিনই শুরু হয়েছে। পুরাণকথা আর ইতিহাসকে সচেতনভাবে গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অযোধ্যার রামমন্দির তার একটা ফলশ্রুতি। বোঝা কমানোর নামে ইতিহাসের পাঠক্রমে রদবদল করা হচ্ছে, মাধ্যমিক স্তর থেকে বিবর্তনবাদকে এই সুযোগে ছেঁটে ফেলা হল। রসায়নে পর্যায়সারণী বা পদার্থবিদ্যাতে তড়িৎচৌম্বক আবেশ বা শক্তির উৎসের মতো বিষয়ও বাদ দেওয়া হচ্ছে, তবে তারা সম্ভবত যুদ্ধক্ষেত্রের রিপোর্টের ভাষায় কোল্যাটারাল ড্যামেজ। শুধু ইতিহাস বা জীববিজ্ঞান পাঠক্রমের বোঝা হালকা করলে অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য সহজেই বোঝা যাবে, তাই অন্য বিজ্ঞানেও হাত পড়েছে। পর্যায়সারণী না পড়িয়ে রসায়ন শেখানো যায় সে কথা যাঁরা ভাবতে পেরেছেন, তাঁদের চিন্তাপদ্ধতি আমার বুদ্ধির অগম্য। কিন্তু রসায়নে পর্যায় সারণীর যেখানে স্থান, জীববিজ্ঞানে বিবর্তন তত্ত্ব তার থেকে অনেক বেশি কেন্দ্রীয় অবস্থানে আছে। আমাদের চারদিকের জীবজগতের বৈচিত্রকে বোঝার অন্য কোনো উপায় নেই। মনোবিদ্যা, ভাষাতত্ত্ব, এমনকি পদার্থবিজ্ঞানেও বিবর্তনবাদ নতুন পথ দেখাচ্ছে। পরিবেশ, অতিমারী, ওষুধ ও তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি মৌলিক সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে বিবর্তনবাদের মধ্যে। তাই দেশের আঠারোশোর বেশি বিজ্ঞানী এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, তবে তাতে বড়কর্তাদের মত পাল্টায়নি।

তবে একটা কথা পাঠক্রম রচয়িতাদের সমর্থনে বলতেই হবে, তাঁরা অন্তত বিবর্তনবাদকে ভুল বলেননি, উঁচু ক্লাসের পাঠক্রমে রেখে দিয়েছেন। পুরোটাই বাদ দিয়ে দিতে পারতেন; উচ্চশিক্ষা দপ্তরের মন্ত্রী সত্যপাল সিং তো সেই দাবীই তুলেছিলেন। তাঁর হাস্যকর যুক্তি নিয়ে আলোচনা করে পাঠকের সময় নষ্ট করতে চাই না, কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়; বিজ্ঞানে এত নানা বিষয় থাকা সত্ত্বেও কেন ডারউইনের তত্ত্বই বারবার আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে?

উইলিয়াম ব্রায়ান কেন বিবর্তনবাদের বিরোধিতা করেছিলেন? বাইবেলে লেখা আছে ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন, তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশাল অংশের মানুষ বিবর্তন তত্ত্বে বিশ্বাস করেন না। ব্রায়ানের  মনে হয়েছিল যে সেই তত্ত্ব স্কুলে পড়লে বাইবেল ও খ্রিস্টধর্ম থেকে ছাত্রছাত্রীদের বিশ্বাস চলে যাবে। বিদ্যালয়ের পাঠক্রম থেকে যাঁরা ডারউইনবাদকে বাদ দিচ্ছেন, তাঁদের আশঙ্কার কারণ বুঝতে আগের বাক্যটাতে খ্রিস্টধর্মের জায়গায় যে কোনো ধর্ম এবং বাইবেলের জায়গায় তার ধর্মগ্রন্থের কথা বসিয়ে নিতে পারেন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশের এক স্কুলে ডারউইনের তত্ত্বের কথা বলাতে এক শিক্ষকের হেনস্থার খবর এখনো পুরানো হয়নি। আমাদের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার তাদের বুদ্ধিমতো ধর্মের ভিত্তিতে দেশ চালাতে চায়, তার জন্য দেশ মধ্যযুগে ফিরে গেলেও তাদের কিছু আসে যায় না। চাইলেই তো আর অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না, একবিংশ শতাব্দীর সমস্যার সমাধান হাজার হাজার বছরের পুরানো বইতে পাওয়া যাবে না। তবে সে কথা আমাদের নীতি নির্ধারকদের কে বোঝাবে, তাঁরা তো মেঘনাদ সাহার ভাষায় 'সবই ব্যাদে আছে', সেই কথাতে বিশ্বাসী!

কোনো ধর্মগ্রন্থই যুক্তিপ্রমাণের ধার ধারে না, সেখানে আপ্তবাক্যই যথেষ্ট। প্রাচীন ও মধ্যযুগে তাকে কেউ প্রশ্ন করার কথা ভাবতে পারত না। কিন্তু আধুনিক জগৎ অনেকটা এগিয়ে গেছে, বিজ্ঞান হল এই যুগের মন্ত্র। তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মও এখন অনেক সময়েই নিজেকে বিজ্ঞানসম্মত প্রমাণ করতে চায়। প্রায়ই নানা ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতির সমর্থনে বিজ্ঞান থেকে যুক্তি খোঁজা হয়, যদিও প্রায় সব ক্ষেত্রেই তা অপযুক্তি। তাই বিজ্ঞানের অন্য শাখার উপর মৌলবাদীদের বিদ্বেষ খুব প্রবল নয়। কিন্তু বিবর্তনবাদ সম্পর্কে তারা সবাই খড়্গহস্ত, কারণ সেখানে ঈশ্বরের কোনো স্থান নেই। বিবর্তনবাদ পুরোপুরি বস্তুবাদসম্মত যুক্তিতে জীবজগতের উদ্ভবের ব্যাখ্যা দেয়। এবং সেই কারণেই বিবর্তনবাদ সকলের অবশ্যপাঠ্য। আমরা যে সায়েন্টিফিক টেম্পার বা বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির কথা বলি, এমন তো নয় যে একমাত্র বিজ্ঞানী বা বিজ্ঞানের ছাত্রদের জন্যই তা প্রযোজ্য; আধুনিক সমাজে সকলেরই সেই মনোবৃত্তি থাকা উচিত। বিবর্তনবাদ তা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। তাই দশম শ্রেণির পরে যারা ইতিহাস বা শিক্ষাবিজ্ঞান নিয়ে পড়বে, বা পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে, তাদেরও বিবর্তনবাদ শেখাটা জরুরি।

ডারউইনের বিরোধিতার নানা রূপ আছে। একটা হল যা আমাদের মন্ত্রীমশাই বলতে চেয়েছিলেন, অর্থাৎ বিবর্তন তত্ত্বের পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই। আধুনিক বই পড়তে হবে না, একটু কষ্ট করে তিনি যদি 'অরিজিন অফ স্পিসিস' বইটা পড়ে নিতেন, তাহলে তাঁর হয়তো এই কথাটা বলার সাহস হতো না। ইংরাজিতে বাক্যবন্ধটা হল থিওরি অফ ইভলিউশন, তাই এমন কথা শোনার দুর্ভাগ্য হয়েছে, ও তো থিওরি, প্রমাণিত সত্য নয়। বিজ্ঞানে ব্যবহৃত শব্দগুলি প্রতিদিনের ভাষা থেকেই নেওয়া, তার ফলে এই ধরনের সমস্যার সৃষ্টি। সাধারণ ভাষাতে আমরা অনেক সময় বলেই থাকি, ‘এটা তোমার থিওরি,’ অর্থাৎ তোমার বিশ্বাস, কিন্তু তা সত্যি নাও হতে পারে। বিজ্ঞানে ব্যাপারটা অনেকটা আলাদা। প্রথম যখন ডারউইন ও ওয়ালেস বিবর্তনের কথা বলেন, তখন স্বাভাবিকভাবেই তার নাম দেয়া হয়েছিল তত্ত্ব বা থিওরি। তারপরে গত দেড় শতাব্দীতে তার পক্ষে এত প্রমাণ জড়ো হয়েছে যে কোনো বিজ্ঞানীর আর তা নিয়ে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও তার নামটা থিওরিই রয়ে গেছে, যেমন ভৌতবিজ্ঞানে কোয়ান্টাম তত্ত্ব বা আইস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের পক্ষে অসংখ্য প্রমাণ সত্ত্বেও তাদের আমরা থিওরিই বলে থাকি।

তার মানে এই নয় যে বিজ্ঞানের এই সব তত্ত্বে কখনো কোনো সামান্য পরিবর্তন হবে না, কিন্তু মোটের উপর কাঠামো যে এক থাকবে তা নিশ্চিত ভাবেই বলা যায়। বিজ্ঞান কি পাল্টায় না? আজ যা গল্প, কাল তা সত্যি প্রমাণিত হতেও তো পারে। একথা ঠিক বিজ্ঞানের একটা বড় বৈশিষ্ট্য হল যে সে শেষ কথা বলতে পারে না। প্রতিনিয়ত নতুন উদ্ভাবন নতুন পর্যবেক্ষণ নতুন দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হচ্ছে, বিজ্ঞান নিজেকে পরিবর্তন করছে। এই আত্মসংশোধন ও আত্মোন্নতি একান্তভাবেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অঙ্গ। তার অর্থ কিন্তু এই নয় যে আজ যা জানি তা কাল একেবারে ভুল প্রমাণিত হবেই। একেবারে যে তা হয় না এমন নয়, কিন্তু সেই উদাহরণ খুবই কম; এবং বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে তা আরও দ্রুত কমে আসছে।

বিজ্ঞানের পোশাক পরা অবিজ্ঞানের থেকে দ্বিতীয় ধরনের বিরোধিতা আসে। অনেক বছর আগে কলকাতার এক বিখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান একটি বক্তৃতা আয়োজন করেছিল, বিষয় ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন। ঈশ্বর প্রাণ বা মানুষের সৃষ্টি করেছেন, এই ধারণার পোশাকি নাম ছিল ক্রিয়েশনিজম। এখন সেটা বিজ্ঞানী মহলে উপহাসের পাত্র, তাই তার নতুন নাম হয়েছে ইন্টালিজেন্ট ডিজাইন, কিন্তু সেটা একই রকম অবিজ্ঞান। ফেসবুকের বিজ্ঞানীরা যেমন ম্যাক্রোইভোলিউশন আর মাইক্রোইভোলিউশন নিয়ে ভারি ভারি পোস্ট করেন (আজকের যুগের ভাষায় হ্যাজ নামান), ইন্টালিজেন্ট ডিজাইনের প্রবক্তাদের বক্তব্যও তার থেকে উন্নত কিছু নয়। তাঁরা ফিরে যেতে চান যেই যুগে, যখন ঈশ্বরের ইচ্ছায় জগৎ চলত। বিবর্তন তত্ত্ব প্রকাশের পরে তা আর হওয়ার নয়, তাই ডারউইনের উপরে রাগ স্বাভাবিক।

তৃতীয় এক পক্ষ আছেন যাঁরা ডারউইনের তত্ত্বকে পুরাণের মধ্যে খুঁজে পান, যেমন আজকাল সব নতুন আবিষ্কার ও উদ্ভাবনকেই ধর্মগ্রন্থে বা পুরাণে পাওয়া যায়। অবশ্য কেন জানি না বিজ্ঞানীরা আবিষ্কারটি করার আগে ধর্মগ্রন্থে তার উল্লেখ সবসময়েই তাঁদের সকলের চোখ এড়িয়ে যায়। তবে বিবর্তনবাদের উপর সাম্প্রতিকতম আক্রমণের সঙ্গে তার খুব একটা সম্পর্ক নেই, তাই সেই আলোচনাতে গেলাম না। আগ্রহীরা মেঘনাদ সাহা ও অনিলবরণ রায়ের মধ্যে যে বিতর্ক হয়েছিল, সেই প্রবন্ধগুলি পড়ে নিতে পারেন।

ইতিহাস না পড়ালে ইতিহাস পাল্টে যাবে না, তেমনি বিবর্তনতত্ত্ব না পড়ালে তা মিথ্যা হয়ে যাবে না। কিন্তু ক্ষতি হবে আমাদের সমাজের, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের। প্রকৃতিকে চেনার সব থেকে বড় হাতিয়ার হল বিবর্তন তত্ত্ব, তা না জানলে মানুষ অন্ধ থেকে যাবে। তাতে কিছু সুবিধাভোগী মানুষের লাভ নিশ্চয়, দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁরাই এখন আমাদের নীতিনিয়ন্তা। তাই প্রয়োজন আরো ব্যাপক মাত্রায় প্রতিবাদের, কারণ অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকবে না। পৃথিবী যখন এগিয়ে চলেছে, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে 'ভ্রান্তিবিলাস সাজে না দুর্বিপাকে।'


 

 

পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘ মহেশতলা আঞ্চলিক কমিটির পত্রিকা 'জীবনের সপক্ষে' আশ্বিন ১৪৩০ সংখ্যায় প্রকাশিত।