Saturday 15 July 2017

জল সংরক্ষণ



 আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
শম্পা গাঙ্গুলী

      টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন একসময় চোখে পড়ত- একটি লোক ছাতা উল্টে বৃষ্টির জল ধরে আনছে। বিজ্ঞাপনটির অর্থ পরিষ্কার- বৃষ্টির জল সঞ্চয়।একটু গভীর করে ভাবলে এর দুটো মানে দাঁড়ায়। অন্যান্য জলসম্ভার খরচে যতটা সম্ভব মিতব্যয়ী হয়ে তাকে রোজকার নানা কাজে ব্যবহার করা।অন্যদিকে, এই জলকে শোধন করে ভূগর্ভে ফিরিয়ে দিয়ে মাটির তলায় জলসম্ভারের পুনঃসঞ্চার(Recharge) ঘটানো।পরিভাষায় একেই  Rain Water Harvesting বলে।
      পৃথিবীর অস্তিত্ব যতদিন আছে, বৃষ্টিপাত ও জলের জোগান ততদিন অক্ষুণ্ণ থাকবে। অফুরন্ত এই সম্পদ।তবে কেন এই সঞ্চয়ের দরকার? আবার পৃথিবীর তিনভাগই তো জল। কিন্তু যে বিপুল জলরাশি পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে তার বেশিটাই যে নোনা সমুদ্র। সেই জল পানের বা অন্যান্য কাজের উপযুক্ত নয়। আমরা যে জল নানা কাজে ব্যবহার করি তার সবটাই আসে বৃষ্টি বা তুষারপাত থেকে। সমুদ্র থেকে বাষ্পীভূত হয়ে পুনরায় ঘনীভবনের মাধ্যমে বৃষ্টির জল সৃষ্টি হয় বলে তা বিশুদ্ধ ধরে নেওয়া হয়। তাই এই জল সঞ্চয় করা দরকার। বৃষ্টির খানিকটা মাটির ওপর দিয়ে বয়ে যায়, কিছুটা নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।প্রবল বর্ষণে অনেক সময় মাটির ওপরের আস্তরণ ধুয়ে গিয়ে নদীতে পড়ে। ফলে একদিকে ক্ষয়ের ফলে মাটি অনুর্বর হয়ে চাষবাসের ক্ষতি করে বা পাহাড়ি অঞ্চলে ধস-ভূমিকম্প ঘটায়; আবার অন্যদিকে নদীকে অগভীর করে তুলে বন্যা বাড়ায়। তাই অঝোর এই বৃষ্টিপাতের সুনিয়ন্ত্রিত ও সুষম বণ্টন প্রয়োজন। মাটির ওপর দিয়ে যাবার সময় বৃষ্টির জলের বাকি অংশটুকু চলে যায় মাটির নিচে। মাটির ঠিক নিচেই যে অসম্পৃক্ত স্তর আছে তা জলকে ধরে রাখতে পারে না।ফলে জল আরও নিচে নেমে যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে কিছুটা জল সেখানে থাকে। তাকে সবিরাম সম্পৃক্ত স্তর বলে।
      তার তলায় আছে স্থায়ী সম্পৃক্ত স্তর। এখানেই স্থায়ী ভৌমজল(Ground Water) থাকে। সাধারণত ২৩০০ ফুট নিচে এই জলতলের সন্ধান মেলে। এর তলার শিলায় কাদার ভাগ এত বেশি যে জল আর নিচে নামতে পারে না। আমরা জলসেচ, গৃহস্থালিতে, কলকারখানায়, বাড়ি তৈরির কাজে সবচেয়ে বেশি এই মাটির নিচের জলকেই গভীর ও অগভীর নলকূপ, পাতকুয়োর মাধ্যমে তুলে প্রয়োজন মেটাই। মনে হতে পারে- আবার বৃষ্টি হলেই তো খরচ হওয়া জলের পরিপূরণ ঘটবে। কিছুটা হয়ও তাই। কিন্তু তবুও আজ আমরা সবাই সুপেয় জল নিয়ে চিন্তিত। তার কারণ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে মাটির নিচের জলকে টেনে তোলার ফলে অমৃত সমান এই জল ক্রমেই নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে ও গরল উঠে আসছে। ফলস্বরূপ ঘটছে জলদূষণ। শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যেমন ক্যাডমিয়াম, সিসা, পারদ ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ নদীতে ও সমুদ্রে মিশছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ, তা ভূগর্ভে বা সমুদ্রগর্ভে যেখানেই হোক না কেন, সেখানকার জলকে দূষিত করে তার গুণগত মানের অবনতি ঘটাচ্ছে। জলবাহী বিষাক্ত পদার্থগুলো ঢুকছে প্রাণীদেহে ও মানুষের শরীরে। এর মারাত্মক প্রভাবে পরিবেশ দিনে দিনে তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। যত্রতত্র কূপ, নলকূপ খুঁড়ে পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। দুরারোগ্য রোগের কারণ ঘটাচ্ছে। ভারতের মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গে নানা জেলায় ও বাংলাদেশের অনেক জায়গায় আর্সেনিক সমস্যা আজ এক ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।
      এই ভৌমজল আহরণে আরও কিছু অসুবিধা আছে। ভৌমজলের প্রধান উৎস বৃষ্টির জল। সুতরাং ভৌমজলের সম্ভার নির্ভর করে বৃষ্টির স্থায়িত্ব, পরিমাণ, শিলার প্রবেশ্যতা, ভূমির ঢাল ও প্রবেশ্য শিলার তলায় অপ্রবেশ্য শিলার উপস্থিতির ওপর। পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমির ঢাল বেশি বলে বৃষ্টির জল বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না, ফলে ভূগর্ভে খুব কম জল প্রবেশ করে। জম্বু-কাশ্মীরে মাটির নিচের জলতল বছরে ২০ সে মি করে নেমে যাচ্ছে। মরু অঞ্চলে শিলার প্রবেশ্যতা খুব বেশি বলে গরমকালে, বিশেষত গ্রামগুলির চিত্র করুণ। বহুদূরের কোনো গভীর কূপ বা জলাধার থেকে মেয়েদের মাথায় আট-দশটা ঘড়া করে পরিবারের এক সপ্তাহের জল বয়ে আনতে হয়। শহরেও, গভীর নলকূপে মোটর চালিত পাম্প লাগিয়ে বিদ্যুতের অনেক দাম মিটিয়ে তবে জল মেলে। দিল্লী, জয়সলমীর, জয়পুর, জলন্ধরে গরমকালে এ ছবি আমরা পাই। বর্ষার চিত্রটাও আমাদের অপরিচিত নয়। আধঘণ্টা ভারি বর্ষণেই কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লি -- এমনকি খরাপ্রবণ রাজস্থানের শহরও হাঁটু জলে ডুবে যায়। কারণ চারদিকের ইট-কাঠ-কংক্রিটের বাঁধুনি, দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রবল জোয়ার  ভাসায় শহরতলিকে। সুতরাং মাটির নিচে জলের নামার পথে no entry থাকায় ভূগর্ভের জলসম্ভার বিশেষ লাভবান হয় না। ঘাটতি পূরণ হয় সামান্য -- লাভবান হয় জমা জলে মশার বংশধরেরা।
      বস্তুতপক্ষে সমস্যা আরও অনেক। ভারতের মতো মৌসুমি জলবায়ুর দেশে আঞ্চলিক বৃষ্টির তারতম্যে বছরে কোথাও ১২০০ সেমি আবার কোথাও ২৫ সেমি বৃষ্টি হয়। তাই অতিবর্ষণযুক্ত অঞ্চলকে বন্যা আর মরু অঞ্চলকে খরার হাত থেকে বাঁচাতে হলে কোথাও অবাধ বারিধারাকে আবার কোথাও কয়েক ফোঁটা জলকে ধরে রাখতে হবে। অনিয়মিত বর্ষা এবং অত্যধিক জনসংখ্যাবৃদ্ধি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় যতই জলসংকট তৈরি করতে চাক না কেন, সঞ্চিত জলসম্ভার দিয়ে বছরে একাধিকবার অনেক খাদ্যশস্য ফলিয়ে সবাই অন্তত খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে। এছাড়া এত সব সমস্যার সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো পরিবেশ দূষণ পৃথিবীকে গরম করে তুলছে। বৃষ্টির পরিমাণ অনেক জায়গায় কমছে, তার আগমন ও স্থায়িত্বকালও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। পর্বতচূড়ার বরফ গলে কমে যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন নদীতে জলস্ফীতি ঘটছে তেমন অন্যদিকে নিত্যবহ নদীগুলোতে ক্রমে উৎস-জলের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, বরাক ইত্যাদি বরফগলা জলে পুষ্ট নদীগুলো অনিত্যবহ হয়ে পড়ছে।
      নদীর জলবন্টন নিয়ে আন্তঃরাজ্য সমস্যা (কাবেরীর জল নিয়ে কর্ণাটক ও তামিলনাডুর মধ্যে), আন্তঃদেশীয় সমস্যা (গঙ্গা ও তিস্তা নিয়ে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে) আজ পৃথিবীর অনেক দেশের এক কঠিন সমস্যা। আমাদের দেশে জনপ্রতি জলের ব্যবহার আগে ছিল বছরে ৫০০০ ঘনমিটার, যা এখন জলসংকটের ফলে নেমে এসেছে ২২০০ ঘনমিটার। সারা পৃথিবীর গড় পরিসংখ্যানটি হল ৮৫০০ ঘনমিটার। সবথেকে বড়ো কথা হল মাটির নিচ বা নদী, হ্রদ- যেখান থেকেই জল সংগ্রহ করি না কেন, তা কমবেশি ব্যয়সাপেক্ষ। পাম্প, নলকূপ, কূপ, জলাধার, খাল ইত্যাদি তৈরির প্রাথমিক ও পৌনঃপুনিক খরচও যথেষ্ট। আবার সেই জল কমবেশি দূষিত তো বটেই। তাই বৃষ্টির জল ভূগর্ভে যাবার বা নদীনালায় নামার আগেই তাকে যদি আমরা প্রতিটি বাড়িতে বিভিন্ন উপায়ে সরাসরি সঞ্চয় করে রাখতে পারি তাহলে অনেক সমস্যা তৈরি হওয়ার আগেই তার সমাধান হয়ে যায়। বিশাল ও দীর্ঘকালীন পঞ্চবার্ষিকী নদী পরিকল্পনা করে সরকারের কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয়ও হয় না, আর আমরাও বিষপান করে তিলে তিলে মরি না। অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকার একটা কোম্পানি বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য ভারতের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের জলসম্ভারকে কাজে লাগিয়ে এক বিশাল জলপ্রকল্প রূপায়ণের অনুমোদন পেতে চলেছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের জলকেই বিদেশি লগ্নিকারীদের মাধ্যমে বোতলবন্দি করে চড়া দামে আবার আমাদের বিক্রি করা হবে। বুঝুন অবস্থাটা!
      অমূল্য এই বৃষ্টির জল ধরে রাখার নানান উপায় মানুষ প্রাচীন কাল থেকেই উদ্ভাবন করে এসেছে। আজ থেকে প্রায় দু হাজার বছর আগে ইজরায়েলের নেজেভ মরুভূমিতে, মালয়েশিয়া, থাইল্যাণ্ড ও চিনের লোয়েস মালভূমিতে মানুষ বড়ো বড়ো জালায় বৃষ্টির জল সঞ্চয় করতে শিখেছিল। প্রাচীন রোম শহর এমন সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে সঞ্চিত বৃষ্টির জল দিয়ে তারা পানীয় জলের চাহিদা মেটাত ও ঘরবাড়ি ঠাণ্ডা রাখতে পারত। আন্দিজ পর্বতের বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলে, আলাস্কা ও হাওয়াই দ্বীপে একই পদ্ধতিতে বৃষ্টির সুব্যবহার মানুষ করেছে। ১৯২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামগুলোতে ও ৬৫ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশে চ্যাপ্টা বড়ো বড়ো গ্যালভানাইজড লোহার পাত কাঠের কাঠামোতে লাগিয়ে বৃষ্টির জল ধরে রাখার কথা জানা যায়।
      তবে বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে বৃষ্টির জল সঞ্চয় ও শোধন পদ্ধতি। এই সমস্যা নিয়ে সচেতনতা যত বাড়ছে সমাধান করতে দিনে দিনে তত বেশি সংখ্যক মানুষ আগ্রহী হচ্ছে। কতকগুলো সহজ উপকরণের সাহায্যে সহজ পদ্ধতিতে নিজ নিজ সাধ্যের মধ্যেই বাড়ির আশপাশের বৃষ্টির জল ধরে রাখা যায়। যথেষ্ট স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিবারের জলসংকট এতে মেটানো সম্ভব। প্রধানত তিনটে উপকরণ এক্ষেত্রে দরকার। সেগুলো হল- জল সংগ্রহের ক্ষেত্র(Catchment Area), সংগ্রহের আধার (Collecting Device) এবং পরিবহন বা সংবহনের পদ্ধতি(Conveyance System)।
      জলসংগ্রহের ক্ষেত্র হিসেবে বাড়ির ছাদকে (অন্তত ২০ বর্গমিটার) সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে পারি। কী পরিমাণ ও কতটা বিশুদ্ধ জল পাওয়া যাবে সেটা নির্ভর করে ছাদটা কত বড়ো ও ছাদ তৈরির পদ্ধতির ওপর। ছাদ কংক্রিট সিমেন্ট, টিন, এলুমিনিয়াম সিট, এসবেস্টস, টালি বা বাঁশের তৈরি হতে পারে। যত বেশি ঢাল হবে তত দ্রুত প্রবাহ হবে। তবে ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে। ছাদ ছাড়া বৃষ্টির জল সংগ্রহের ক্ষেত্র হিসাবে বাড়ির চারপাশের জমিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। আশপাশের অসংখ্য ফাটল ও অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে প্রচুর জল মাটির নিচে চলে যায়। গাছপালা ও মাটির আবরণ থাকলে জমির ওপরের জলপ্রবাহ কমে যায়।এজন্য বাড়ির চারপাশের এলাকা যেমন রাস্তা, বাগান, চাতাল ইত্যাদিকে কংক্রিটে ঢালাই করে একদিকে ঢালযুক্ত শক্ত কঠিন আবরণে পরিণত করে তোলা যায়। মৃত্তিকার স্তরে বৃষ্টির জলের প্রবেশ্যতা রোধ করতে রোলার ব্যবহার মাটিকে সুদৃঢ় ও আঁটোসাঁটো করতে পারি। এছাড়া রাসায়নিক ভাবে সোডিয়াম বা সিলিকন যৌগের দ্রবণ ব্যবহার করা যেতে পারে বা প্লাস্টিকের সিট, এসফল্ট বা টালি দিয়ে আশপাশ আবৃত করা যায়। কৃত্রিম পদ্ধতিতে বাষ্পীভবন কমিয়ে ও মৃত্তিকাক্ষয় রোধ করে অনেক বেশি পরিমাণ পরিষ্কার জলসংগ্রহের ক্ষেত্র গড়ে তোলা যায়।
      জল সংগ্রহের আধার বা জলাধার হিসেবে বড়ো বড়ো ট্যাঙ্ক মাটির নিচে বা ওপরে তৈরি করা যায়। তবে মানুষ, পশুপাখি বা পরিবেশের বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ যাতে জলাধারে না যায় তার জন্য ভালো আঁটযুক্ত ঢাকনা ব্যবহার করতে হবে। এতে জমা পরিষ্কার জলে মশা বা শ্যাওলা জন্মানো রোধ করা যাবে। বড়ো বড়ো ঢালাই করা সিমেন্টের জলাধার হলে ভালো। জলাধারের আয়তন নির্ভর করবে শুষ্ক ঋতুর দৈর্ঘ্য, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং জনপ্রতি জলের চাহিদার ওপরে। এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে বেশ কয়েকমাস শুষ্ক ঋতু থাকে, বৃষ্টি তিন চারমাস হয়। এক্ষেত্রে এক একটি জলাধারের ক্ষমতা এমন হওয়া উচিৎ যাতে অন্তত দু-তিন সপ্তাহের জল মজুত থাকে। ধরা যাক তিনজনের পরিবারে ন্যূনতম ৩(জন)X৯০(লি)X২০(দিন)=৫৪০০লিটার জল সঞ্চয় করা প্রয়োজন। পাইপ দিয়ে পরস্পর যুক্ত একাধিক পলিথিনের জলাধার (ধারণ ক্ষমতা কমপক্ষে ১০০০-২০০০ লিটার) ব্যবহারও সুবিধাজনক। থাইল্যান্ডে ১৯৮০-এর দশকে দশ লক্ষের বেশি ২০০০ লিটারের জার ও ১৯৯১-৯৩ সালের মধ্যে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার আরও বড়ো জলাধার তৈরি করা হয়।
      জলসংবহন পদ্ধতি বলতে জলসংগ্রহের ক্ষেত্র থেকে বৃষ্টির জলকে জলাধারে পাঠানোর পর্যায়টিকে বোঝায়। বৃষ্টি পড়ার প্রথম কিছুক্ষণ পর্যন্ত নোংরা ও বালি-কাঁকড় যুক্ত বৃষ্টির জল যাতে বেরিয়ে যায় সেই ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জলাধারের সঙ্গে ছাদ বা অন্যান্য জলসঞ্চয়ের ক্ষেত্র হিসাবে যে পাইপ দিয়ে যুক্ত থাকে সেখানে একটা কল লাগানো থাকবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময় কলটি বন্ধ থাকলে নোংরা জল জলাধারে ঢুকবে না, কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লে কলটা খুলে দিলে জলাধারের ভেতরে পরিষ্কার জলসঞ্চয় ঘটবে।এছাড়া আরও অন্য পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়। ছাদের সঙ্গে জলাধার সংযোগকারী মোটা মোটা PVC পাইপগুলোর মধ্যে বড়োমুখওয়ালা ফানেল আটকে দিতে হবে এমনভাবে যে প্রথম বৃষ্টির জল ধীরে ধীরে পাইপের গা বেয়ে ফানেল ও পাইপের মধ্যের ফাঁক দিয়ে নেমে বেরিয়ে যাবে। পরে প্রবল বর্ষণের সময় পরিষ্কার জল ফানেলের মধ্য দিয়ে জলাধারে প্রবেশ করবে। এই ফানেল লাগানো পাইপটির মুখ জলাধারের সংযোগকারী পাইপের মুখ অপেক্ষা বড়ো হবে যাতে জলাধার ভর্তি হয়ে গেলে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যেতে পারে। সংবহনের সময় PVC পাইপগুলোর মধ্যেই জলশোধন বিভিন্ন ভাবে করা যেতে পারে। পাইপের একটা অংশে জলাধারে জলপ্রবেশের আগে এই শোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সবচেয়ে উপরে থাকবে মোটা দানার বালির স্তর(৫-১০মিমি পুরু), তার তলায় ছোটো নুড়ি ও তার তলায় বড়ো নুড়ি পাথরের স্তর(৫-২৫ সেমি পুরু), এটাতে খরচ খুবই কম। বালির বদলে কাঠকয়লা দিয়েও জলশোধন করে নেওয়া যায়। এইভাবে জলের ঘোলাটে ভাব, নোংরা ও জীবাণু ইত্যাদি রোধ করা যায়। তবে জলকে পুরোপুরি বিশুদ্ধ করতে গেলে বিদেশি কোম্পানির তৈরি RPC(Rain Purification Centre) কিনতে হবে যা খরচ সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে Multi Staged Water Treatment Method-এ আয়ন বিনিময় প্রক্রিয়ার দ্বারা বৃষ্টির জলকে পুরোপুরি বিশুদ্ধ জলে পরিণত করা যায়।RPC ব্যবহার করে ১০০০ লিটার পানীয় জল পরিশুদ্ধ করতে খরচ পড়ে ১০০-১৫০ টাকা। সাধারণভাবে ব্যবহারের জন্য এরূপ জল পরিশোধনের দেশীয় ফিল্টারের দাম ২২০০টাকা। এছাড়া আরও একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হল অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে জীবাণুমুক্ত করে সক্রিয় চারকোল দ্বারা শোধন।
      বৃষ্টির জল সরাসরি ব্যবহার ছাড়াও Rain Water Harvesting-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মাটির তলার জলসম্ভারের পুনঃসঞ্চার। প্রাকৃতিক নানা কারণে এবং অপরিকল্পিতভাবে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে সর্বত্র ভৌমজলস্তর নেমে যাচ্ছে ও দূষিত হচ্ছে, একথা আগেই আলোচিত হয়েছে। বৃষ্টির জলের দ্বারা পুনঃসঞ্চার করে এই ঘাটতি পূরণ না করতে পারলে হয়তো ভৌমজল একদিন নিঃশেষিত হয়ে যাবে। তাই গর্ত, কুয়ো, সোকপিট, টিউবওয়েল ইত্যাদির সাহায্যে মাটির নিচে বিভিন্ন গভীরতায় খুব সহজে পরিষ্কার বৃষ্টির জল পাঠিয়ে পুনঃসঞ্চার করা যায়। এগুলি অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় ভূগর্ভের জলকে পুনরায় সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে একটা ফিল্টার ব্যবহার করলে ভালো। দেশীয় এরকম ফিল্টারের দাম ৬০০ টাকা। এইরকম গর্ত (recharge pit) খুঁড়তে ২৫০০-৫০০০ টাকা, সুড়ঙ্গ (recharge trench) তৈরি করতে ৫০০০-১০০০০ টাকা, টিউবওয়েল তৈরি করতে ১৫০০-২৫০০ টাকা, কুয়ো (recharge through dug well) ৫০০০-৮০০০ টাকা ও গভীর নলকূপ (recharge well) তৈরিতে ৫০০০০-৮০০০০ টাকা আনুমানিক ব্যয় হয়।
নিচের ছবিতে জলসঞ্চয়ের একটি ক্ষেত্র- বাড়ির ছাদ, জল সংবহন পদ্ধতি, মাটির ওপর ও নিচের জলাধার এবং পুনঃসঞ্চার কূপের মাধ্যমে গভীর ভৌমজলের পুনঃসঞ্চারণ প্রক্রিয়াটি বোঝানো হয়েছে।
জলসম্পদ সংরক্ষণের জন্য ভারত সরকার জলকে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং এর জন্য ‘জলসম্পদ মন্ত্রক’ গঠন করেছে। ১৯৮৭ সালে ‘জাতীয় জলনীতি’ গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আইন প্রণয়ন করে বৃষ্টির জলসংরক্ষণের পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০০১ সালে জুন মাসে নগরোন্নয়ন মন্ত্রক দিল্লিতে এই আইনটি বলবৎ করে। সেখানে বলা হয়েছে ১০০ বর্গমিটারের চেয়ে বড়ো ছাদযুক্ত নতুন বাড়িতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর, উওরপ্রদেশের কানপুর, অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দ্রাবাদে, হরিয়ানা, রাজস্থানের সব শহরে ও মুম্বাইতে ‘রেন ওয়াটার হার্ভেস্টিং’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। খুব সম্প্রতি তামিলনাডুতে মিউনিসিপ্যাল আইন অনুসারে (জুলাই ১৯, ২০০৩) সরকারি, বেসরকারি সমস্ত নতুন নির্মাণের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
      বৃষ্টির জল সঞ্চয় প্রকল্প রূপায়ণ আমাদের প্রত্যেকের কাছে অত্যাবশ্যক। আশা করা যায় এর মাধ্যমে অদূর ও সুদূর ভবিষ্যতে জলসংকট মিটবে, মাটির নিচের জলতল উঠে আসবে। পানীয় জলের চাহিদা মিটবে, গুণগত মানও বাড়বে। মৃত্তিকা ক্ষয়, আবদ্ধ জলের সমস্যা মিটবে। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে খরাক্লিষ্ট ও মরু অঞ্চলের মানুষ। তবে এই প্রকল্প রূপায়ণে কতকগুলি সীমাবদ্ধতা আছে। অঞ্চলটিতে বৃষ্টির প্রকৃতি ও স্থায়িত্বের ওপর সঞ্চয় ও পুনঃসঞ্চার নির্ভর করে। অঞ্চলটির প্রাপ্ত জলসম্ভার, মৃত্তিকার আস্তরণ, প্রবেশ্যতা, ভূমির ঢাল ও ভৌমজলের গভীরতা ও তার গুণগত মান সম্পর্কে একটা সমীক্ষার প্রয়োজন। স্থানটিতে কতটা পরিমাণ জলপ্রবাহ ঘটে, জমিটিতে কী পরিমাণ শিল্প, বসতি ও জনসংখ্যা বা সবুজ উদ্ভিদের আবরণ আছে তা দেখা দরকার। এসবের জন্য অবশ্য একান্ত জরুরি সাধারণ মানুষের মধ্যে বৃষ্টির জল সঞ্চয় সম্বন্ধে সচেতনতা তৈরি করা। যার জন্য সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য শুধু সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজনে বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংস্থার সক্রিয় অংশগ্রহণ আর গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা। তবেই আমরা বৃষ্টির জলের সঠিক ব্যবহার করে দেশের জল-সমস্যার সমাধান করতে পারব।

('এখন পর্যাবরণ' পত্রিকার ২০০৩ সালের উৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত)


     
                 

  




      
                    

  


1 comment:

  1. নদী ও খালের জলের অতিরিক্ত ব্যবহার সংরক্ষণের-এর উপর অসাধারণ একটি পোস্ট। তবে আর একটু বিস্তারিত হলে শিক্ষার্থরা বেশি উপকৃত হতো।

    ReplyDelete