Saturday 31 August 2019

রিপোর্টঃ চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে চন্দ্রযান-২


চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে চন্দ্রযান-২


গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

        গত ২২ জুলাই বাহুবলী অর্থাৎ জিএসএলভি মার্ক-৩ রকেট শ্রীহরিকোটার সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে উৎক্ষিপ্ত হয়েছে, সে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে দ্বিতীয় চন্দ্রযানকে। চন্দ্রলোকে ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশন সংক্ষেপে ইসরোর এটি দ্বিতীয় অভিযান। এর আগে ২০০৮ সালে প্রথম চন্দ্রযানকে চাঁদের চারদিকে কক্ষপথে স্থাপন করেছিল ইসরো। এবারের অভিযানের লক্ষ্য আরো সুদূরপ্রসারী। এই দ্বিতীয় চন্দ্রযানে আছে অরবিটার যা মাত্র একশো কিলোমিটার উপর থেকে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করবে। চাঁদের বুকে নামবে অবতরণ যান বা ল্যান্ডার। এই বছর ভারতীয় মহাকাশ গবেষণার জনক বিক্রম সরাভাইয়ের জন্মশতবর্ষ, সেই কথা মনে রেখে ল্যান্ডারটির নাম দেওয়া হয়েছে বিক্রম। চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণের পরে চারপাশে ঘুরে তথ্য সংগ্রহের জন্য আছে সৌরশক্তিচালিত রোভার প্রজ্ঞান। 
        শুরুতে উৎক্ষেপণের দিন ঠিক করা হয়েছিল ১৪ জুলাই, কিন্তু কিছু ত্রুটি ধরা পরার জন্য তা শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে দেওয়া হয়। এখনো পর্যন্ত চন্দ্রযান পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করছে। সব ঠিকঠাক চললে আগামী ২০ আগস্ট তাকে চাঁদের চারপাশের কক্ষপথে স্থাপন করা হবে, আর তারপরে ৭ সেপ্টেম্বর বিক্রম চাঁদের মাটি স্পর্শ করবে। ভারতের আগে কেবলমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন চাঁদের বুকে মহাকাশযান নামাতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র কয়েকমাস আগে ইজরায়েলের অবতরণ যান চাঁদে নামার সময় দুর্ঘটনাতে পড়েছিল।
         ঠিক পঞ্চাশ বছর আগে অ্যাপোলো -১১ চন্দ্রপৃষ্ঠে অবতরণ করেছিল, নিল আর্মস্ট্রং হয়েছিলেন প্রথম মানুষ যিনি পৃথিবীর বাইরে অন্য কোথাও পা রেখেছিলেন। পঞ্চাশ বছর পরেও কিন্তু চাঁদ সম্পর্কে অনেক কিছুই আমাদের অজানা। চাঁদের সৃষ্টি কেমনভাবে হল সে বিষয়েও আমরা নিশ্চিত নই। চাঁদে যদি দীর্ঘসময় বাস করতে হয়, তাহলে সেখানকার জল ব্যবহার করতেই হবে। সেই জলের সন্ধান করবে প্রজ্ঞান। চাঁদের বুকে জল তরল অবস্থায় থাকা সম্ভব নয়, সেখানে বরফের সন্ধান দিয়েছিল চন্দ্রযান-১।  ইসরোর বিজ্ঞানীরা চাঁদের দক্ষিণ মেরুকে অবতরণের জন্য বেছে নিয়েছেন। তার কারণ সেখানে অনেকটা জায়গায় সূর্যালোক কখনো পড়ে না। তাই সেখানে তাঁরা জল খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।  
        পৃথিবীতে অনেক সমস্যা, চাঁদে অভিযানের জন্য এত খরচ করে লাভ কী? বিজ্ঞানের দিক থেকে অনেক লাভই সম্ভব। চাঁদের উল্টোদিকের পিঠে যদি দূরবিন বা রেডিও টেলিস্কোপ বসাতে পারি, তাহলে তা পৃথিবীর যে কোনো টেলিস্কোপের থেকে শক্তিশালী হবে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল অনেক তরঙ্গকে শোষণ করে নেয়, বায়ুতে প্রতিসরণের জন্য অসুবিধা হয়। তাছাড়া শহরের আলো, মোবাইল টিভি রেডিওর সিগন্যাল এগুলো না আটকাতে পারলে টেলিস্কোপের পক্ষে কাজ করা শক্ত। চাঁদে বায়ুমণ্ডল নেই, উল্টো দিকে পৃথিবী থেকে কোনো সিগন্যাল পৌঁছবে না। অভিকর্ষ কম বলে অনেক বড় টেলিস্কোপ  বানানো যাবে। চাঁদের বায়ুচাপ প্রায় শূন্য, পৃথিবীতে আমরা অনেক খরচ করে ঐরকম অত্যুচ্চ ভ্যাকুয়াম বানাতে পারি। সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডারের মতো বড় কণাত্বরক বা অ্যাকসিলারেটর চাঁদে বানানো খুব সহজ, বায়ুশূন্য স্থান আলাদা করে বানাতে হবে না, সুপারকন্ডাক্টর তারকে ঠাণ্ডা করার ঝামেলা অনেক কম।
        তবে যে সমস্ত কারণে ভবিষ্যতে চাঁদে বসবাসের খরচা উঠে যেতে পারে তার একটা হল ইলেকট্রনিক্স শিল্পের মতো যে সমস্ত শিল্পে বায়ুশূন্য স্থান লাগে, সেগুলো সহজে চাঁদে স্থাপন করা সম্ভব। অপর একটা লাভ হতে পারে শক্তি উৎপাদনে।  হিলিয়ামের এক আইসোটোপ আছে হিলিয়াম-৩ যা পৃথিবীতে নেই বললেই চলে। সূর্যে নিউক্লিয় সংযোজন বা ফিউশন প্রক্রিয়াতে শক্তি তৈরি হয়। আমরা হাইড্রোজেন বোমাতে সেই প্রক্রিয়াকে কাজে লাগিয়েছি, কিন্তু এখনো তাকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে উঠতে পারিনি। তা করতে পারলে অনেক সুবিধা হবে, গ্রিন হাউস গ্যাসের সমস্যা নেই, তেজস্ক্রিয়তার ভয় নেই। ফ্রান্সে এক আন্তর্জাতিক প্রয়াসে ফিউশন রিঅ্যাক্টর বানানো হচ্ছে, আমাদের দেশও তার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। পৃথিবীতে হিলিয়াম-৩ পাওয়া গেলে রিঅ্যাক্টর বানানো অনেক সহজ হতোসূর্য থেকে হিলিয়াম-৩ সৌর বায়ুর সঙ্গে বেরিয়ে আসে, কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল তাকে আটকে দেয়। চাঁদের মাটিতে কোটি কোটি বছর ধরে হিলিয়াম-৩ জমা পড়েছে, তাকে তুলে পৃথিবীতে পাঠাতে পারলে খরচ উঠে আসতে পারে। মানুষ শেষ চাঁদে নেমেছিল ১৯৭২ সালে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা আবার ২০২৪ সালে চাঁদে মানুষ পাঠাতে এবং ২০২৮ সাল থেকে চাঁদে স্থায়ী বেস বানাতে চাইছে। চীন চাঁদের হিলিয়াম-৩ উত্তোলনের পরিকল্পনা করছে। জাপান ২০৩০ সাল থেকে স্থায়ী ভাবে চাঁদে অভিযাত্রীদল রাখার ব্যাপারে চিন্তা করছে। চন্দ্রযান-২ আমাদের সেই ক্লাবের সদস্য করার দিকে একধাপ এগিয়ে দেবে।

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, আগস্ট ২০১৯