Tuesday 9 May 2017

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান ভাবনা




রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানভাবনা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

(প্রথমেই একটা স্বীকারোক্তি করে নেয়া ভালো । আমি সাহিত্যের বিশেষজ্ঞ নই, বিজ্ঞানের ছাত্র। রবীন্দ্রনাথ শেষ বিচারে লেখক। তাঁর অনুরাগী পাঠক হলেও লেখার সাহিত্য বিচার আমার পক্ষে ধৃষ্টতা। তাই তাঁর যে সমস্ত গল্পের পটভূমি বিজ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত, যেমন “তিনসঙ্গী” বা  “ল্যাবরেটরি”, তাদের বিশ্লেষণ এই লেখাতে নেই। অন্যদিকে আমি সমাজবিজ্ঞানীও নই, তাই রবীন্দ্রনাথের লেখার সমাজবিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণও আমার পক্ষে অনধিকারচর্চা। কিন্তু সমাজ-বিচ্ছিন্ন ভাবে বিশেষত প্রযুক্তি বিষয়ে আলোচনার চিন্তাও করা যায় না। তাই এই প্রবন্ধকে বিজ্ঞানের এক ছাত্রের ব্যক্তিগত মত হিসেবেই ধরে নিতে পাঠককে অনুরোধ জানাই )

(১)

সময়টা বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক। সে সময় ভারত থেকে যাঁরা বিদেশে পড়তে যেতেন, তাঁরা প্রায় সবাই আইন পড়ে ব্যারিস্টার বা জজ হওয়ার ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন। কয়েকজন হয়তো ডাক্তারি শেখার জন্য সাগর পাড়ি দিতেন। জগদীশচন্দ্র বা প্রফুল্লচন্দ্র দু দশক আগে মৌলিক বিজ্ঞানে পড়াশোনা করে দেশে ফিরে এসে গবেষণা করছেন। কিন্তু তাদের ব্যতিক্রম হিসাবেই দেখতে হবে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ তাঁর বড়ো ছেলে রথীন্দ্রনাথ ও তাঁর এক বন্ধুর ছেলে সন্তোষ মজুমদারকে আমেরিকাতে কৃষিবিজ্ঞান শেখার জন্য পাঠান। তাঁরা দুজনেই ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। পরবর্তী কালে তাঁর ছোটো জামাই নগেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলীকেও একই লক্ষ্যে সেখানেই পাঠিয়েছিলেন। কবির উদ্দেশ্য ছিল অত্যন্ত গদ্যময়: দেশে কৃষির উন্নতির মাধ্যমে খাদ্যসংকট দূর করা, বা সোজা কথায় বললে দেশের না খেতে পাওয়া মানুষের পেটে দুবেলা খাবার জোগানো। তিনি জানতেন তার জন্য প্রয়োজন আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি; সেটা করায়ত্ত করার জন্যই এঁদের বিদেশযাত্রাতে তাঁর উৎসাহ।
একথা অস্বীকার করা যায় না যে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক, অন্তত প্রথম দৃষ্টিতে, মিশ্র। তাঁর একটি বহুপঠিত কবিতা, “দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর”। অথচ এই একই রবীন্দ্রনাথ অন্য কথাও বলেছেন। বিদেশে দেওয়া “সাধনা” বক্তৃতামালাতে তিনি বলেছিলেন, “Steam andelectricity shall be our nerve and muscle”, অর্থাৎ বাষ্পশক্তি ও বিদ্যুৎ হবে আমাদের স্নায়ু ও পেশী। সভ্যতার চালিকাশক্তিটিকে চিহ্নিত করতে তিনি কোনো ভুল করেননি বা কবিসুলভ ভাবালুতায় আচ্ছন্ন হয়ে প্রাচীন কালে ফিরে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন নি। অন্য এক সময় আইনস্টাইন সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন যে তিনি ও আইনস্টাইন দুজনেই নিশ্চিত যে আধুনিক শিল্পের উন্নতি মানুষের অগ্রগতির জন্য জরুরি। “সভ্যতার সংকট” প্রবন্ধে ইংরাজ শাসনের প্রতি তীব্র ধিক্কার বর্ষণের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ সেই শাসনের স্থায়িত্ব যে প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে আছে, সে কথা ভোলেন নি। “যে যন্ত্রশক্তির সাহায্যে ইংরেজ আপনার বিশ্বকর্তৃত্ব রক্ষা করে এসেছে তার যথোচিত চর্চা থেকে এই নিঃসহায় দেশ বঞ্চিত।” ভারতের অবস্থার বিপরীতে কবি জাপান ও রাশিয়াতে যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছিল, তার তুলনাও করেছেন।
তাহলে পরিণত বয়সে লেখা “মুক্তধারা” বা “রক্তকরবী'-র মতো নাটকে আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার উপর রবীন্দ্রনাথ যে আক্রমণ শানিয়েছেন, তাকে আমরা কোন চোখে দেখব? মুক্তধারা নাটকে যন্ত্ররাজ বিভূতির বিরুদ্ধে ধনঞ্জয়ের লড়াই কিন্তু স্পষ্টতই প্রযুক্তিসভ্যতার বিশু যখন বলে, “ওদের কাছে আমরা মানুষ নয়, কেবল সংখ্যা”, যখন মানুষের নাম হয় ৪৭ফ কিংবা ৬৯ঙ, তখন কি চার্লি চ্যাপলিনের “মডার্ন টাইমস” মনে পড়ে না?
আজীবন সুন্দরের পূজারী কবির এই ক্ষোভ একদিকে নগরসভ্যতার কুশ্রীতার বিরুদ্ধে। বিখ্যাত বিজ্ঞান ঐতিহাসিক জে ডি বার্নাল তাঁর ‘সায়েন্স ইন হিস্ট্রি” বইতে লিখেছেন, “Wealth had never been accumulated so easily; misery had never been so widespread and unmitigated by social defences. With all the new triumphs of engineering went a smoky dirtiness, drabness, and ugliness which no previous civilization could have produced. It was in this environment that science approached its present scale of activity and importance.” শিল্পবিপ্লবের  ফলে শহরগুলির এই ক্লেদাক্ত রূপ নিয়ে মার্কসও চিন্তা করেছিলেন। ভেবেছিলেন রবীন্দ্রনাথও। রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় মার্কসবাদী নন। কিন্তু যে আধুনিক প্রযুক্তিসভ্যতা মানুষকে শুধু উৎপাদনের যন্ত্র হিসাবে দেখে, তার অন্য সমস্ত পরিচয় যার কাছে গৌণ, যা প্রতিটি মানুষকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে পরিণত করে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ তাঁকে করতেই হয়েছে। আমার কাছে অন্তত সে প্রতিবাদ প্রযুক্তি নয়, ধনতান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে। শেষ কথাটা যদি মনে হয় বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে, খুলুন “রক্তকরবী”-র প্রস্তাবনা । সেখানে সরাসরি রাজাকে কবি বলেছেন,“সোনার খনির মালিক”। ধনতন্ত্রকে এর চেয়ে সহজ করে আর কীই বা বলতে পারতেন? তাও পাছে আমরা ভুল করি, পরের অনুচ্ছেদে গ্রামের কৃষকদের টিটাগড়ের চটকলে মরতে আসার কথা বলেছেন। আর কতো স্পষ্ট করে কবি লিখবেন? উপরের উদ্ধৃতিটির শেষে বার্নাল আধুনিক বিজ্ঞানের বিকাশের যে পটভূমি এঁকেছেন, শিল্পবিপ্লব সৃষ্ট নগরসভ্যতার সেই ক্লেদের বিরুদ্ধে কবি সোচ্চার তিনি সংবেদনশীল, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানী নন, তাই কখনো কখনো হয়তো তাঁর প্রতিবাদ পুঁজিবাদী শোষণের সঙ্গে সঙ্গে প্রযুক্তির বিরুদ্ধেও গেছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ এমন একজন মানুষ যিনি সারা জীবন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিনিয়ত নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। তাই প্রথম যৌবনের অরণ্যকে ফিরে পাওয়ার আকুতি পরবর্তীকালে অনুপস্থিত।
বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মত কী? এমন অনেকে আছেন যাঁরা বিশ্বাস করেন যে বিজ্ঞানীর কোনো সামাজিক দায় নেই। বিজ্ঞান গবেষণা করতে হবে শুধু বিজ্ঞানের জন্য: তার সামাজিক প্রয়োগ আছে কি না দেখার দায়িত্ব বিজ্ঞানের নয়। রবীন্দ্রনাথ এই মতের শরিক নন। ১৯২৫ সালে লেখা “চরকা” প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, “য়ুরোপীয় সভ্যতায় বিজ্ঞানচর্চার সামনে যদি কোনো বড়ো নৈতিক সাধনা থাকে সে হচ্ছে বাহ্যপ্রকৃতির হাতের সব রকম মার থেকে মানুষকে বাঁচানো, আর হচ্ছে মানুষের মনটাকে যন্ত্রে না বেঁধে প্রাকৃতিক শক্তিকেই যন্ত্রে বেধে সমাজের কাজ আদায় করা।“
প্রথম যৌবনের উচ্ছ্বাসের পরে রবীন্দ্রনাথ যে সরল জীবনে ফিরে যাওয়াতে আর বিশ্বাসী ছিলেন না, তার সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হল গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর চরকা নিয়ে মনান্তর। দুজনের প্রতি দুজনের শ্রদ্ধা ছিল অপরিসীম। কিন্তু গান্ধীজী যখন চরকাকে তাঁর পথের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করলেন; তখন তিনি কুটিরশিল্পকেই আধুনিক ভারত গড়ার চাবিকাঠি হিসেবে ধরে নেন। এই প্রচেষ্টার তীব্র প্রতিবাদ করেন রবীন্দ্রনাথ। তিনি “চরকা” প্রবন্ধেই লিখছেন, “বিজ্ঞানকে এক পাশে ঠেলে রেখে কেবল হাত চালিয়ে দেশের বিপুল দারিদ্র্য কিছুতে দূর হতে পারবে না। মানুষের জানা এগিয়ে চলবে না, কেবল তার করাই চলতে থাকবে, মানুষের পক্ষে এতো বড়ো কুলিগিরির সাধনা আর কিছুই নেই।” তাঁর স্পষ্ট মত: চরকা যে শুধু স্বরাজ আনার কঠোর সাধনাকে লঘু করে দিচ্ছে তা নয়, আধুনিক ভারত গড়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অন্যত্রও তিনি একই কথা লিখেছেন।
তবে একথা ভাবার কোনো কারণ নেই যে মৌল বিজ্ঞান, অর্থাৎ যা সরাসরি প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত নয়, তাকে তিনি অবহেলা করতেন। বিমূর্ত বা মৌল বিজ্ঞানের সঙ্গে তার যোগাযোগ নিয়ে নিবন্ধের শেষ ভাগে আলোচনা করা যাবে। নানাভাবে রবীন্দ্রনাথের কাছে বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞাননির্ভর গল্পের লেখকদের মধ্যে এইচ জি ওয়েলস যে সর্বকালের শ্রেষ্ঠদের মধ্যে জায়গা করে নেবেন, সে নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর লেখা ওয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ডস, ইনভিজিবল ম্যান বা টাইম মেশিন এখন চিরায়ত সাহিত্যের অঙ্গ । বিজ্ঞানের পথ আগামী দিনে কোনদিকে হবে সে বিষয়ে তাঁর  ভবিষ্যৎবাণী আশ্চর্যরকম মিলে যায়। সেই ওয়েলসের সঙ্গে ১৯৩০ সালে জেনেভাতে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে বলেছিলেন, “Physical science of the nineteenth century probably has created the spirit of race superiority in the West. When the East assimilate the physical science, the tide may turn and take a normal course.” এখানেও তিনি স্পষ্টতই দেশের মানুষের কথা চিন্তা করছেন। দেশবাসীরা ভৌত বিজ্ঞান আত্মস্থ করতে পারলেই পশ্চিমের লোক তাদের নিচু নজরে দেখবে না, এই মত একটু অতি সরলীকৃত হতে পারে, কিন্তু দেশের প্রতি রবীন্দ্রনাথের ভালোবাসা এখানে স্পষ্ট। এর সঙ্গে তাঁর ছেলে বা জামাইকে বিদেশে কৃষিবিজ্ঞান শিখতে পাঠানোর কারণের যোগও আমরা খুঁজে পাই। শুধু দেশবাসীর জীবন জীবিকার উন্নতি নয়, তাদের জগৎসভায় মাথা তুলে দাঁড়ানোর জন্যও বিজ্ঞানশিক্ষা জরুরি ।
রবীন্দ্রনাথের জীবনকালের মধ্যেই ভারতীয় বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ অতিবাহিত হয়েছে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা বা সত্যেন্দ্রনাথ বোসের সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট যোগাযোগ ছিল। কলকাতাতে কাজ করলেও সি ভি রমনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কোনো সাক্ষাতের খবর আমার জানা নেই। কিন্তু জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে তার দীর্ঘ এবং গভীর বন্ধুত্বের কথা সকলেই জানেন। তার একটা কারণ যেমন ছিল জগদীশচন্দ্রের দেশপ্রেম, তেমনি রবীন্দ্রনাথের কাছে তাঁর গবেষণা জাতীয় প্রগতির প্রতীক হয়ে দেখা দিয়েছিল। অনেক আর্থিক অসুবিধার মধ্যেও অকাতরে তাঁর গবেষণার জন্য অর্থের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এজন্য ভিক্ষাপাত্র হাতে নিয়ে ত্রিপুরার মহারাজা রাধাকিশোর মাণিক্যের সাহায্যপ্রার্থী হতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন নি। মহারাজকে লেখা তীর চিঠির একটি অংশ “জগদীশবাবুর জন্য আমি প্রত্যক্ষভাবে মহারাজের নিকট দরবার করিতে ইচ্ছুক - এজন্য আমি আগরতলা যাইতে প্রস্তুত।“ পরের মাসে সত্যিই তাকে আগরতলা যেতে হয়। মহারাজা যথাসাধ্য সাহায্য করেন।
জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার সম্পর্কে ১৯০১ সালে “জড় কি সজীব, নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ। তা পড়ে স্বয়ং বিজ্ঞানীর প্রতিক্রিয়া, “তুমি যে গত মাসে আমার কার্যের আভাস বঙ্গদর্শনে লিখিয়াছিলে তাহা অতি সুন্দর হইয়াছে। তুমি যে এত সহজে ও বৈজ্ঞানিক সত্য স্থির রাখিয়া এরূপ সুন্দর লিখিতে পার, ইহাতে আমি আশ্চর্য হইয়াছি।” কবি যে সহজেই জটিল বিজ্ঞানের মূল তত্ত্ব আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে এর চেয়ে বড়ো সাক্ষ্য আর কী হতে পারে?

(২)
তবে এটিই রবীন্দ্রনাথের প্রথম বিজ্ঞান বিষয়ক নিবন্ধ নয়। ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গদ্য রচনাই ছিল বিজ্ঞান বিষয়ে। বারো বছর বয়সে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে লেখা এই প্রবন্ধের নাম “গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি”। এখানে কিশোর লেখক অন্যান্য গ্রহে প্রাণীদের থাকার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেন। এর পরের কুড়ি বছরে বিভিন্ন পত্রিকাতে তিনি অন্তত আরো কুড়িটি বিজ্ঞান বিষয়ক লেখা ছাপান। এর পূর্ণাঙ্গ তালিকা অধ্যাপক দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান বইটিতে আছে।  রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ে উৎসাহে তাঁর পারিবারিক ও সামাজিক পরিমণ্ডলের ভূমিকা নিয়ে আলোচনার সুযোগ এখানে নেই। কিন্তু যে সময় প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞানশিক্ষা প্রায় অনুপস্থিত, বিজ্ঞান সংস্কৃতিও গড়ে ওঠেনি, সে সময় এই রচনাগুলি যে বিজ্ঞানে তাঁর উৎসাহের স্বাক্ষর দেয়, সে নিয়ে সন্দেহ নেই।
রবীন্দ্রনাথের একটি বইয়ের কথা আলাদা করে বলতেই হয়, তা হল “বিশ্বপরিচয়”। পরিণত বয়সে লেখা তাঁর এই বই আজও সম্ভবত সাধারণের জন্য বাংলা ভাষায় লেখা বিজ্ঞান গ্রন্থদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ জায়গা অধিকার করবে। রবীন্দ্রনাথ প্রমথনাথ সেনগুপ্তকে এই বইটি লেখার জন্য বলেছিলেন। তাঁর লেখা মনোমত না হওয়াতে নিজেই নতুন করে বইটি লেখেন। বইটি তিনি উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে। ভূমিকাতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিজ্ঞানে আগ্রহের ইতিহাস ও কারণ সম্পর্কে অনেক কথা লিখেছেন, আগ্রহী পাঠককে তা পড়ে নিতে অনুরোধ করি। আমরা লক্ষ্য করি যে বিজ্ঞানের সে সময়ের অতি আধুনিক আবিষ্কারও বইটিতে জায়গা করে নিয়েছে।
সেই সময় অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে অর্ধেক ইউরোপ ফ্যাসিবাদের কাছে নতজানু হয়ে শান্তি খুঁজছে। চারিদিকে বেজে উঠেছে আসন্ন যুদ্ধের দামামা। রবীন্দ্রনাথ অপর কয়েকজন মনীষীর সঙ্গে পৃথিবীর বিবেক হিসেবে পরিচিত। সেই সময়ের যন্ত্রণা ও জটিলতা তার সাহিত্যে প্রতিফলিত। সময়টাকে বুঝতে গেলে, বিশ্ব পরিস্থিতিকে উপলব্ধি করতে গেলে যে বিজ্ঞানকে বুঝতে হবে: সেই বোধ থেকেই আমাদের দেশের মানুষের কথা ভেবে তাঁর “বিশ্বপরিচয়” রচনা। দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় তাঁর পূর্বোল্লিখিত বইতে এই বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন।
আমাদের অনেকের কাছে রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের ভক্ত। তাঁকে আমরা গুরুদেব বলে ডেকে হয়তো নিজেদের অগোচরেই তাঁর লেখায় ধর্মের দিকটাতে বেশী গুরুত্ব আরোপ করি (যদিও তাঁর পরবর্তীকালের লেখায়, বিশেষত “নবজাতক'-এ অস্তিবাদের সঙ্কট সুস্পষ্ট) ৷ কিন্তু “বিশ্বপরিচয়”-এ গীতাঞ্জলির জীবনদেবতাকে তিনি স্থান দেননি । দেখা যাক জীবনের উৎস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ কী বলছেন। “বিশ্বরচনার মূলতম উপকরণ পরমাণু: সেই পরমাণুগুলি অচিন্তনীয় বিশেষ নিয়মে অতি সূক্ষ্ম জীবকোষরূপে সংহত হল। ... (কোষের) প্রত্যেকের নিজের ভিতরেই একটা আশ্চর্য শক্তি আছে যাতে করে বাইরে থেকে খাদ্য নিয়ে নিজেকে পুষ্ট, অনাবশ্যককে ত্যাগ ও নিজেকে বহুগুণিত করতে পারে। এই বহুগুণিত করার শক্তি দ্বারা ক্ষয়ের ভিতর দিয়ে মৃত্যু ভিতর দিয়ে প্রাণের ধারা প্রবাহিত হয়ে চলে।” স্রষ্টা এখানে অনুপস্থিত; প্রাণ এখানে বিজ্ঞানের নিয়মে তৈরি। তাঁর সময়ের  থেকে আমরা এখন এ বিষয়ে অনেক বেশী জানি। কিন্তু সেই সময়েও রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত যে জীবনের উৎসের সন্ধান শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানই দেবে।
অপর একটি বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ নজর দিয়েছিলেন যা বাংলায় বিজ্ঞানচর্চার জন্য অপরিহার্য -- তা হল বিজ্ঞানের পরিভাষা । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুরোধে তিনি এই বিষয়ক কমিটিতে যোগদান করেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সেই পরিভাষা যে সব সময় জনপ্রিয় হয়েছে তা নয়, কিন্তু উৎসুক পাঠক পরিভাষাগুলি বিবেচনা করলে দেখবেন যে সেগুলি তৈরি করতে রবীন্দ্রনাথ যথেষ্ট চিন্তাভাবনা করেছেন। আবারও “রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান থেকে একটা উদাহরণ নেয়া যাক। আমরা ইংরাজি solid শব্দের বাংলা করি কঠিন। কিন্তু কঠিন শব্দের সঙ্গে কাঠিন্য গুণটি যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাতে কঠিন বস্তু বলতে আমরা ময়দার তালকে বুঝব না। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের বিচারে ময়দার তালও solid, তাই “বিশ্বপরিচয়”-এ রবীন্দ্রনাথ ব্যবহার করেছিলেন নিরেট। দেখতে পেলাম যে পরিভাষা তৈরি করতে তৎসম অর্থাৎ সংস্কৃত শব্দই ব্যবহার করতে কবে এমন কোনো ছুঁৎমার্গ তার ছিল না। সাধারণ মানুষের জন্য পরিভাষা তৈরি করতে দুরূহ শব্দ ব্যবহার না করাই ভালো, একথা আমরা কবে শিখব কে জানে ?
রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। “বিশ্বপরিচয়” এর ভূমিকাতে তিনি লিখছেন, “ক্রমাগত পড়তে পড়তে মনের মধ্যে বৈজ্ঞানিক একটা মেজাজ স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। অন্ধ বিশ্বাসের মূঢ়তার প্রতি অশ্রদ্ধা আমাকে বুদ্ধির উচ্ছৃঙ্খলতা থেকে আশা করি অনেক  পরিমাণে রক্ষা করেছে।” শুধু বিজ্ঞানের তত্ত্ব বা তথ্য নয়, বিজ্ঞান যে একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবনবোধ দেয়, সেদিকেই কবির নির্দেশ । বিহারে ১৯৩৪ সালে ভূমিকম্পের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরে গান্ধীজী তাকে অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে ভগবানের শাস্তি হিসেবে বর্ণনা করেন। রবীন্দ্রনাথও অস্পৃশ্যতার তীব্র বিরোধী ছিলেন, কিন্তু বিজ্ঞানপ্রসূত জীবনবোধ থেকেই তিনি গান্ধীজীর এই উক্তির কঠোর সমালোচনা করেন।
তাঁর জীবন ও রচনাতে পাওয়া যাবে। বিশেষ করে “বনবাণী” কাব্যগ্রন্থটিতে পরিবেশ বিষয়ে তার যে দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আছে, তার আলাদা উল্লেখ করা প্রয়োজন। বিশ্বভারতীতে যে পদ্ধতিতে তিনি বিজ্ঞান শিক্ষা চালু করার চেষ্টা করেছিলেন, তা নিশ্চয় যারা শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা করেন, তাঁদের আলোচনার বিষয়। প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে একটা কথাই বলতে পারি - রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান বিষয়ক সমস্ত চিন্তাধারার ঘুলে ছিল মানুষ, বিশেষ করে আমাদের দেশের সেই সব মানুষ যারা জীবনে পিছিয়ে পড়েছে।
(৩)
কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে আমাকে ব্যক্তিগত ভাবে যা নাড়া দেয়, তা হল মৌলিক বিজ্ঞান বিশেষত পদার্থবিজ্ঞান প্রসঙ্গে তাঁর স্বজ্ঞা বা intuition| প্রথাগত বিজ্ঞানশিক্ষা তাঁর ছিল না। আমরা সবাই জানি যে কলেজ দূরে থাক, স্কুলের পড়াও তিনি শেষ করেন নি। আধুনিক পদার্থবিদ্যা মূলত গণিতাশ্রয়ী। ঠাকুরবাড়িতে দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ অঙ্ক নামক বিষয়টিতে পণ্ডিত হলেও ভাইটি ওদিকটা এড়িয়েই চলতেন। তাই পদার্থবিদ্যা বিষয়ে তাঁর জ্ঞান সীমাবদ্ধ হতে বাধ্য। অসামান্য স্বজ্ঞা দিয়ে তিনি সেই সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছিলেন।
জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল এবং বহু বই তিনি পড়েছেন। জীববিদ্যাতে আলফ্রেড ওয়ালেসের বিবর্তন সংক্রান্ত লেখা একসময় নিজে অনুবাদ করবেন ভেবেছিলেন। পাঠকদের মনে করিয়ে দিই, প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তনের তত্ত্ব ওয়ালেস সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে আবিষ্কার করেন এবং তাঁর এ বিষয়ে লেখা ডারউইনের প্রবন্ধের সঙ্গে একই সময়ে প্রকাশিত হয়। বিবর্তন তত্ত্বের বৈপ্লবিক তাৎপর্য রবীন্দ্রনাথ কতোটা বুঝতে পেরেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ আমার জানা নেহ। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে জটিল সমস্যা, আজ পর্যন্ত যার সর্বজনগ্রাহ্য কোনো সমাধান পাওয়া যায়নি, তার বিষয়ে কবি সচেতন ছিলেন। সেই পরিচয় আমরা পাই রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইনের মধ্যে সুপরিচিত এক কথোপকথনে।

দুজনের মধ্যে কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তার একটি ঘটেছিল ১৯৩০ সালের ১৪ই জুলাই তারিখে আইনস্টাইনের বাড়িতে। আইনস্টাইনের সৎ মেয়ে মার্গটের হবু স্বামী দিমিত্রি মারিয়ানফ তার একটি বিবরণ নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকাতে প্রকাশ করেন। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় অমিয় চক্রবর্তীর নেওয়া নোট থেকে রবীন্দ্রনাথ অনুমোদিত বিবরণটি ছাপা হয়। দুটি বিবরণের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য আছে, তবে আমরা তার মধ্যে যাব না। বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বোস “সত্যের স্বরূপ” নাম দিয়ে তার অনুবাদ করেছিলেন, তার থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করে আমরা আলোচনা করব। দৈর্ঘ্যের কারণে সাক্ষাৎকারটি সংক্ষেপিত করতে হয়েছে, তবে আশা করি তাতে আমাদের পরবর্তী আলোচনাতে কোনো বিভ্রান্তি আসবে না।
আ: সত্য ও সুন্দর, এই দুই’ই তবে মানব নিরপেক্ষ নয়?
র: না!
আ: মানুষ যদি না থাকে, তো বেলভিডিয়ারের আপোলোও সুন্দর থাকিবে না?
র: না!
আ: সুন্দরের বিষয়ে আমি আপনার সহিত একমত, কিন্তু সত্যের বিষয়ে নয়।
র: কেন? সত্যকে তো মানুষই উপলব্ধি করিতেছে?
আ: আমার মত যে অভ্রান্ত, তার প্রমাণ দিতে পারি না, কিন্তু এই বিশ্বাসই আমার ধর্ম।
র: সুন্দর, সে তো বিশ্বমানবের নিখুঁত আদর্শের মধ্যে; সত্য, সেও বিশ্বচেতনার অভ্রান্ত উপলব্ধিতে প্রকাশিত। ভুলভ্রান্তির মধ্য দিয়া আমরা প্রত্যেকে সেই উপলব্ধিতে পৌঁছিতে চাই, আমাদের পুঞ্জীভূত অভিজ্ঞতার মধ্যে আমাদের উদ্ভাসিত চেতনার মধ্যে তাহাকেই খুঁজি, তা ছাড়া অন্যভাবে কি করে সত্যকে জানিব?
আ: সত্য যে মানুষের অস্তিত্বের অপেক্ষা না রাখিয়াও সত্য ইহা আমি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে প্রমাণ করিতে পারিব না, তবু তাই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। ...
র: ... অন্ততঃ যাহাকে বিজ্ঞানে সত্য বলিয়া বর্ণনা করি, বিচার মাগেই তো তাহার সাক্ষাৎ ঘটে। অর্থাৎ মানুষের মনরূপ ইন্দ্রিয়ের সাহায্যেই তাহার জ্ঞান সম্ভব। ...
আ: আমাদের চেতনার অতীত সত্যের অস্তিত্ব আছে কি না, বস্তুতঃ সেইখানেই সমস্যার আরম্ভ।
আরো কিছুক্ষণ পরে রবীন্দ্রনাথ বলেন, “মানুষের সহিত সম্পর্করহিত কোন সত্য থাকিলেও, তাহা মানুষের পক্ষে না থাকার সামিল। ... মানুষের অনুভূতি কিংবা যুক্তির সহিত সম্পর্কমাত্র রহিত সত্যের অস্তিত্ব থাকিলেও, যতদিন আমরা মানুষধর্মী ততদিন তাহা আমাদের কাছে নাস্তির পর্যায়েই থাকিবে।”
এই কথোপকথন সম্পর্কে বিজ্ঞানী ইলিয়া প্রিগোজিনের একটা মন্তব্য শুনে নেব। “The question of the meaning of reality was the central subject of a fascinating dialogue between Einstein and tagore. Einstein emphasized that science had to be independent of the existence of any observer ... On the contrary, Tagore maintained that even if absolute truth could exist, it would be inaccessible to the human mind. Curiously enough, the present evolution of science is running in the direction stated by the great Indian poet.” সহজ কথায়, আইনস্টাইন দর্শক নিরপেক্ষ সত্য বা বাস্তবতাতে বিশ্বাস করেন, আর রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন যে সেরকম কোনো পরম সত্য থাকলেও তা মানবমনের গোচর হয় না। প্রিগোজিন মন্তব্য করছেন যে বিজ্ঞানের বর্তমান ধারা কবিকেই সমর্থন করছে।
প্রিগোজিনের একটু পরিচয় দেয়া হয়তো প্রয়োজন। ১৯৭৭ সালে রসায়নে তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। তিনি একালের একজন সেরা চিন্তানায়কও বটে। (সচেতন ভাবেই বুদ্ধিজীবি শব্দটি ব্যবহার করলাম না, কারণ আমাদের দেশে বিজ্ঞানীকে বুদ্ধিজীবি মনে করা হয় না।) নৈরাজ্য তত্ত্ব বা chaos theory-র মাধ্যমে তিনি বিজ্ঞানে আমাদের বহু সযত্ন লালিত প্রাচীন ধারণাকে পাল্টে দিয়েছেন। এমন একজন মানুষ যখন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেন, তা আমাদের ভাবায় বৈকি। আর এক নোবেলজয়ী পদার্থবিদ ব্রায়ান জোসেফসনও রবীন্দ্রনাথকেই সমর্থন করেছেন।
এখন দেখা যাক এই আলোচনার বৈজ্ঞানিক পরিপ্রেক্ষিত কী ছিল। আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জন্ম হয়েছিল ১৯২০-র দশকের মাঝামাঝি। ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গার তার জন্মদাতা, নিলস বোর তার পালক পিতা। এই  তত্ত্বের সবচেয়ে পরিচিত ব্যাখ্যা অনুসারে পর্যবেক্ষক নিরপেক্ষ সত্য বা বাস্তবের কোনো অস্তিত্ব নেই। কথাটা একটু দর্শনের মতো শোনালেও তা পরীক্ষাগারে প্রমাণিত। ধরা যাক একটা পর্দার উপর একটা একটা করে ইলেকট্রন ছোঁড়া হচ্ছে।পর্দার মধ্যে দুটো গর্ত আছে। সাধারণ বুদ্ধি বলে যে একটা ইলেকট্রন একই সময়ে একটা গর্তের মধ্যে দিয়ে যাবে। কিন্তু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে যে যতক্ষণ আমরা ইলেকট্রনটা কোথা দিয়ে যাচ্ছে দেখার চেষ্টা না করব, ততক্ষণ সেটা এক সঙ্গে দুটো গর্তের মধ্যে দিয়েই যাবে। পরীক্ষাও তাকে সমর্থন করে ! অর্থাৎ আমরা যতক্ষণ দেখতে চাইব না, ততক্ষণ ইলেকট্রনের কোনো নিদিষ্ট অবস্থান নেই। শুধু ইলেকট্রন নয়, অণু পরমাণু সমস্ত মৌলিক কণা, সকলের জন্যই এটা সত্য। আমরা দেখতে চাইলে তখন ইলেকট্রন কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় আমাদের কাছে ধরা দেবে, নচেৎ নয়। কোথায় তাকে আমরা পাব, তা আগে জানার কোনো উপায় নেই কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় তাকে পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা, সেটা বলা সম্ভব। শুধু অবস্থান নয়; বেগ, ঘূর্ণন ইত্যাদি সমস্ত ধর্মের জন্য এটা সত্য। যেমন না মাপা পর্যন্ত কণার কোনো নিদিষ্ট বেগ থাকে না, মাপার ফলেই তার নির্দিষ্ট মান প্রকাশ পায়।
পর্যবেক্ষণ না করা পর্যন্ত কণার কোনো নির্দিষ্ট অবস্থান নেই, অর্থাৎ পর্যবেক্ষকের উপর বাস্তবতা নির্ভর করছে। শ্রয়ডিঙ্গার এই প্রসঙ্গে ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন এই বিশ্ব আমাদের অনুভূতি ও স্মৃতির সৃষ্টি। এর নিজস্ব অস্তিত্ব আছে বলে ধরলে আমাদের সুবিধা হয়, কিন্তু শুধুমাত্র অস্তিত্বের মাধ্যমেই এর প্রকাশ ঘটে না। কোয়ান্টাম তত্ত্বের অন্যতম জন্মদাতা হয়েও আইনস্টাইন বলবিদ্যার এই অনির্দিষ্টতাকে কখনো মেনে নিতে পারেননি । চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সমস্ত ধ্যানধারণার বিরোধী এই কোয়ান্টাম বাস্তবতা প্রসঙ্গেই আলোচনা করছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও আইনস্টাইন ।
একথা ভেবে আশ্চর্য লাগে যে অনেক বিজ্ঞানী যখন এই নতুন বাস্তবতাকে মেনে নিতে পারেন নি, তখন রবীন্দ্রনাথ কেমন করে তার মুল ভাবনা উপলব্ধি করেছেন এবং আইনস্টাইনের মতো বিজ্ঞানীর সামনে তা দৃঢ়ভাবে প্রকাশ করছেন। একই চিন্তাভাবনা আছে ছ'বছর পরে লেখা “শ্যামলী” কাব্যগ্রন্থের বিখ্যাত “আমি” কবিতাটিতে।
আমারি চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, 
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম, সুন্দর,
সুন্দর হল সে।
দর্শক না থাকলে পান্না চুনির রঙ নেই, নেই আলো। পরের পংক্তিগুলিতে কবি বলেই দিচ্ছেন যে তিনি বিজ্ঞানের সত্যকেই প্রকাশ করছেন।
তুমি বলবে, এ যে তত্ত্বকথা,
এ কবির বাণী নয়।
আমি বলব, এ সত্য;
তাই এ কাব্য ।

প্রসঙ্গত বলে রাখা যাক যে এই অনির্দিষ্টতা কিন্তু ভাববাদকে প্রতিষ্ঠা করে না। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার বস্তুবাদী ব্যাখ্যা সম্ভব। ডেভিড বোহ্‌ম তা করে দেখিয়েছেন -- কিন্তু তা অনেক পরের ঘটনা ।
শুধু আইনস্টাইন নন; কোয়ান্টাম বলবিদ্যার অন্যতম স্রষ্টা হাইজেনবার্গ ও অপর এক বিশেষজ্ঞ আর্নল্ড সমারফেল্ড ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভারতে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাদের মধ্যে কী কথা হয়েছিল জানা যায় নি। ফ্রিজফ কাপরা একজন পদার্থবিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের দার্শনিক। তাঁর “Uncommon Wisdom” বইতে তিনি লিখেছেন যে হাইজেনবার্গ তাঁকে এই সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে জানান, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর বিজ্ঞান ও ভারতীয় দর্শন নিয়ে আলোচনা হয়। হাইজেনবার্গ মন্তব্য করেন, “After these conversations with Tagore some of the iodeas that seemed so crazy suddenly made much more sense. That was a great help to me.” দুঃখের বিষয় যে এই আলোচনা চিরকাল আমাদের অজানাই থেকে যাবে। আমরা কখনোই আর জানতে পারব না কোন ধারণাই বা বিজ্ঞানীর কাছে পাগলামি মনে হচ্ছিল, আর কবিই বা তাঁকে কেমন করে তার সারবত্তা বোঝান। মৌল বিজ্ঞান বা তার দর্শন প্রসঙ্গে কবির এই দখল এককথায় তাঁর স্বজ্ঞার প্রকাশ।
তথ্যসূত্র:
রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিগুলি পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত রচনাবলী থেকে সংকলিত । আইনস্টাইন ও রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারের সত্যেন্দ্রনাথ কৃত অনুবাদটি বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ প্রকাশিত “সত্যেন্দ্রনাথ বসু রচনা সংকলন” থেকে গৃহীত। অন্যান্য বহু তথ্য ও আলোচনার জন্য আমি আনন্দ প্রকাশিত দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায়ের “রবীন্দ্রনাথ ও বিজ্ঞান” বইটির কাছে ঋণী।

(প্রকাশ: নিশিত সাহিত্যপত্রিকা, ডিসেম্বর, ২০১০, পরিমার্জিত)
























1 comment:

  1. বস্তুর অবস্থান ভালো করে মাপতে গেলে তার ভরবেগ সম্পর্কে জানা মুশকিল হয়ে যায়; আবার ভরবেগ ভালো করে জানলে তার অবস্থান সম্পর্কে ধারনাটা খুব ঘোলাটে হয়ে যায়। এটাই হলো হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা সূত্র।
    আইনস্টাইন বললেন, আচ্ছা, না হয় মেনেই নেওয়া গেলো কোনো একটা মুহূর্তে বস্তুর অবস্থান এবং ভরবেগের নিঁখুত পরিমাপ করা সম্ভব নয়। তা থেকে কি বলার কারন আছে যে তাহলে যে কোনো মুহূর্তে তার সুনির্দিষ্ট অবস্থান ও গতিবেগের অস্তিত্বই নেই ?
    নীলস বোরের নেতৃত্বে অনেক বিজ্ঞানী বললেন: আমরা যখন মাপতে পারছি না কোনোমতেই, তা হলে জিনিসটা আছে বলা উচিৎ নয়। এই বিজ্ঞানীরা অনেকই বোরের গবেষনা প্রতিষ্ঠান - কোপেনহেগেন-এ কাজ করতেন। তাই এই ব্যাখ্যাটাকে বলা হয়ে থাকে 'কোপেনহেগেনীয় ব্যাখ্যা'।
    এ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হননি আইনস্টাইন। ১৯৩০ সাল নাগাদ রবীন্দ্রনাথের সাথে তার দেখা হয়। তখন তিনি বলেছিলেন: "ধরুন একদিন যদি কোনো মানুষ আর অবশিষ্ট না থাকে, তাহলে কি অ্যাপোলোর মূর্তি আর সুন্দর থাকবে না?" রবীন্দ্রনাথ তার উত্তরে বলেছিলেন, "না।"
    নতুন কোয়ান্টাম তত্ত্বের দর্শন মেনে নিতে রবীন্দ্রনাথের অসুবিধা হয় নি।

    Courtesy: Albert Einstein (Selection from and on Einstein)

    ReplyDelete