Friday, 19 September 2025

মহাবিশ্বে প্রাণের সন্ধান

 

মহাবিশ্বে প্রাণের সন্ধান 

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়  


আমাদের সৌরজগতে পৃথিবী ছাড়া উন্নত সভ্যতা কোথাও নেই, কিন্তু অন্য কোথাও কি প্রাণের সন্ধান পাওয়া যাবে? কারোর মতে প্রাণ এতই বিরল ঘটনা যে আমাদের ছায়াপথ কেন, সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডেই আমরা ছাড়া অন্য কোনো উন্নত সভ্যতাই নেই। আবার কারো মতে প্রাণের অনুকূল পরিবেশ থাকলেই প্রাণের জন্ম হবে। সমস্যা হল যে আমাদের কাছে মাত্র একটাই উদাহরণ আছে। তাই আমরা আমাদের সৌরজগতে প্রাণের সন্ধান করছি। যদি আমরা সফল হই, তাহলে দ্বিতীয় দলের যুক্তি অনেক জোরদার হবে সন্দেহ নেই।

প্রাণের জন্য তরল জল প্রয়োজন বলেই আমাদের অনুমান। সৌরজগতে আটটি গ্রহ আছে, তার মধ্যে তরল জল আছে বা কখনো ছিল এমন গ্রহ হল পৃথিবী ও মঙ্গল। তাই মঙ্গলই আমাদের প্রথম লক্ষ্য। মঙ্গলের সঙ্গে পৃথিবীর অনেক মিল। মঙ্গলের ব্যাস পৃথিবীর অর্ধেক। মঙ্গলের দিন পৃথিবীর দিনের থেকে মাত্র ঊনচল্লিশ মিনিট বড়। মঙ্গলও তার কক্ষপথের সঙ্গে প্রায় পৃথিবীর মতোই কোণ করে আছে; ফলে সেখানেও ঋতু পরিবর্তন হয়। মঙ্গলের দুই মেরুতে বরফ দেখা যায়। তাই মঙ্গলে প্রাণ থাকার সম্ভাবনা নিয়ে অনেকেই চিন্তা করেছিলেন। ১৮৭৭ সালে ইতালির জ্যোতির্বিজ্ঞানী জিওভান্নি শিপারেল্লি ঘোষণা করেন যে তিনি দূরবীন দিয়ে মঙ্গলগ্রহে canali দেখেছেন ইতালিয় ভাষায় তার মানে হল channel অর্থাৎ খাত, ইংরাজি অনুবাদে ভুল করে হয়ে গেল canal অর্থাৎ খাল পার্সিভাল লাওয়েল নামের এক বিজ্ঞানী 1892 সালে ঘোষণা করলেন খালগুলো কৃত্রিম। লাওয়েল যথেষ্ট খ্যাতনামা বিজ্ঞানী, কাজেই অনেকেরই ধারণা হয়েছিল যে মঙ্গলে নিশ্চয় বুদ্ধিমান প্রাণী আছে। মঙ্গলের অধিকাংশই বর্তমানে মরুভূমি, তাই তারা দুই মেরু থেকে খাল কেটে জল এনে কৃষিকাজ চালায়। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞানকার এইচ জি ওয়েলস ওয়ার অফ দি ওয়ার্ল্ডস উপন্যাসে মঙ্গলবাসীদের পৃথিবী আক্রমণের কাহিনি লিখলেন। সেই গল্প এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়েছিলে যে একবার রেডিওতে তার নাট্যরূপ প্রচারের সময় বহু লোক সেটাকে সত্যি ভেবে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে মঙ্গল গ্রহে সভ্যতার অস্তিত্ব তখন সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল। বাংলাতেও হেমেন্দ্রকুমার রায়ের 'মেঘদূতের মর্তে আগমন' বা প্রেমেন্দ্র মিত্রের 'মঙ্গলগ্রহে ঘনাদা' অনেকেই হয়তো পড়েছেন।

মাঙ্গলিক ও মঙ্গলের খাল (চ্যাট জিপিটির সাহায্যে আঁকা) 

অবশ্য এই ধারণা বেশিদিন টিকল না। শিগগিরি বোঝা গেল যে মঙ্গলগ্রহের বায়ুর চাপ পৃথিবীতে সমুদ্রতলে বায়ুচাপের একশো ভাগের এক ভাগের থেকেও কম, সেখানে জল তরল অবস্থায় খোলা জায়গায় থাকাই সম্ভব নয় -- বাষ্প হয়ে উবে যাবে তা একমাত্র বরফ অবস্থাতেই থাকতে পারে। কাজেই খাল সেখানে কোনো কাজে লাগবে না।

তবে মঙ্গলে এই অবস্থা চিরকাল ছিল না। মঙ্গলের উদ্দেশ্যে অনেক অভিযান পাঠানো হয়েছে। মহাকাশ থেকে ছবি তোলা হয়েছে, গ্রহের মাটিতেও ল্যান্ডার বা রোভার নামানো হয়েছে। তাই আমরা এখন জানি যে একসময় মঙ্গলের বুকে সত্যিই তরল জল ছিল; তখন বায়ুচাপ ছিল বেশি। মঙ্গলের বুকে শুকনো নদীখাত পাওয়া গেছে, প্রাচীন সমুদ্রের সম্ভাবনাও পাওয়া গেছে। তাই একসময় প্রাণের অনুকূল পরিবেশ মঙ্গলে একসময় ছিল। তারপর কোনো এক বিপর্যয়ে মঙ্গল এক শীতল মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। প্রশ্ন হল একসময় যদি প্রাণের জন্ম হয়ে থাকে, তার পক্ষে কি বর্তমান অবস্থায় টিকে থাকা সম্ভব?

ঙ্গলের বুকে জলের প্রবাহের চিহ্ন- সাদা দাগগুলো হল জলে থাকা নুন (ছবি- NASA/JPL-Caltech/MSSS)

 

এখানে একটা ঘরের কাছের গল্প বলি। ১৯৬৭ সালে চাঁদে নেমেছিল রোবট যান সার্ভেয়র-৩। দু’ বছর পরে অ্যাপোলো-১২ অভিযান যখন চাঁদে নামে, মহাকাশচারীরা সার্ভেয়রের ক্যামেরাটিকে পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনেন। উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের এককোশী জীবের সন্ধান, হয়ত মাঝের দু’ বছরে সার্ভেয়রে তারা কোনোভাবে চলে আসতে পারে। পৃথিবীতে এনে সন্ধান পাওয়া গেল নেহাতই পার্থিব ব্যাকটেরিয়া স্ট্রেপ্‌টোকক্কাসের স্পোরের। দেখা গেল তারা তখনো জীবিত, সুযোগ পাওয়া মাত্র তারা বংশবৃদ্ধি করতে শুরু করল। কাজেই মঙ্গলে এককোশী প্রাণের টিকে থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই বেশ কিছু অভিযান মঙ্গলে চালানো হয়েছে। ফলাফল কী?

এখনো পর্যন্ত মঙ্গলে নিশ্চিতভাবে প্রাণের চিহ্ন পাওয়া যায় নি। জৈব যোগের সন্ধান পাওয়া গেছে। কাজেই তরল জল ও জৈব যৌগ, অর্থাৎ প্রাণের সব উপাদান একসময় মজুত ছিল। মঙ্গলের মাটির তলায় এবং দুই মেরুতে এখনো জলের বরফ আছে তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গেছে। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডলে সব থেকে বেশি কৌতূহলের বিষয় হল ঋতুপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মিথেনের পরিমাণ বাড়ে কমে। বায়ুমণ্ডলের মিথেন গ্যাস অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে ভেজগে যায়,। তারপর সেই টুকরোগুলো হাইড্রোকার্বন অর্থাৎ জৈবযৌগ তৈরি করে। কিন্তু এভাবে চললে বায়ুমণ্ডল থেকে মিথেন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। বৃহস্পতির মতো দানব গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ভিতরের স্তরে হাইড্রোকার্বন ভেঙে আবার মিথেন তৈরি হয়। কিন্তু পৃথিবীর মতো ছোট গ্রহে তার অনুকূল পরিবেশ নেই। আমাদের বায়ুমণ্ডলে মিথেনের উৎস হল জীবজগৎ। মঙ্গলে মিথেন কোথা থেকে আসে? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর এখনো আমরা জানি না। পৃথিবীতে ব্যাকটেরিয়া মিথেন তৈরি করে, মঙ্গলে কি একই ঘটনা ঘটছে? পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোও হয়েছে, কিন্তু নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যায়নি। পাঁচ বছর আগে পার্সিভিয়ারেন্স রোভারকে পাঠানোই হয়েছিল বিশেষ করে প্রাচীন প্রাণের চিহ্ন খুঁজতে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত আমরা জানি না, সত্যিই কোনোদিন মঙ্গলে প্রাণ ছিল কিনা।


পার্সিভিয়ারেন্সের সেল্‌ফি (ছবি নাসা)

মঙ্গলের থেকেও আমাদের কাছের গ্রহ হল শুক্র, শুক্রের আয়তন এবং ঘনত্বও পৃথিবীর কাছাকাছি। শুক্ৰে প্ৰাণ আছে কি? শুক্রপৃষ্ঠে প্রাণ থাকা সম্ভব নয়। সেখানে তাপমাত্রা সাড়ে চারশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, বায়ুর চাপ পৃথিবীর নবই গুণ, আকাশ থেকে যেখানে হয়তো ঝরে পড়তে পারে ঘন সালফিউরিক অ্যাসিডের বৃষ্টি, জল বা অক্সিজেন নেই বললেই চলে। শুক্রপৃষ্ঠে নয়, বিজ্ঞানীরা প্ৰাণের অস্তিত্ব খুঁজছেন বায়ুমণ্ডলে। বায়ুমণ্ডলের উপরদিকে চাপ তাপমাত্রা অনেক কম, প্রায় পৃথিবীরই কাছাকাছি। সেখানে হয়তো এককোশী জীবের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। বায়ুমণ্ডলে ফসজিন গ্যাসের চিহ্ন পাওয়া গেছে, মিথেনের মতো পৃথিবীর প্রাকৃতিক ফসজিনের উৎসও জীবজগৎ। আবার একটা পর্যবেক্ষণ দেখায় মাটি থেকে আশি কিলোমিটার উঁচুতে সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি শোষিত হয়ে যাচ্ছে। কোন পদ্ধতিতে এই শোষণ ঘটে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা এখনই সম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করছেন যে এর জন্য দায়ী কোনো নতুন ধরনের জীবাণু।

দূরের গ্রহে প্রাণের নিশ্চিত চিহ্ন কী? কোন সঙ্কেত দেখলে বুঝব প্রাণ আছে? পৃথিবী হল আমাদের জানা একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণ আছে। তাই শুক্র অভিযানে পাঠানো ভেনাস এক্সপ্রেস পৃথিবীতে প্রাণের সন্ধান করেছে। তার ক্যামেরা পৃথিবীর ছবি তুলেছে। বিজ্ঞানীরা সেই ছবি থেকে পৃথিবীতে প্রাণের চিহ্ন সন্ধানের চেষ্টা করছেন । যদি এমন কিছু দেখা যায় যাকে নিশ্চিতভাবে জীবনের সঙ্কেত বলে চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য গ্রহের ছবিতে সেই চিহ্নকে খোঁজা হবে।

সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহে প্রাণ খুঁজে পাওয়ার আশা আমরা করি না। বুধের তাপমাত্রা খুব বেশি ওঠানামা করে, ৪৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থেকে -১৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত। সেখানে জল নেই, নেই বায়ুমণ্ডল। বৃহস্পতি, শনির মতো গ্যাসদানব গ্রহে কোনো স্থলভাগ নেই, নেই অক্সিজেন। যদিও কল্পবিজ্ঞানকাররা অবশ্য বৃহস্পতির বায়ুতে ভেসে থাকা বিরাট প্রাণের কল্পনা করেছেন, তবে তার সম্ভাবনা বিশেষ নেই।

সৌরজগতে আরো অন্তত দুটি জায়গা আছে যেখানে প্রাণ থাকতেও পারে। কিছু বিশেষ পরিস্থিতি সেখানে প্রাণের অনুকূল কিছু পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এবার আর গ্রহ নয়, প্রাণের সন্ধানে যাব উপগ্রহে। বৃহস্পতির উপগ্রহ ইউরোপা ও শনির উপগ্রহ টাইটান -- এই দুই জায়গা নিয়ে বিজ্ঞানীরা চিন্তা করেছেন। প্রথমে আসি ইউরোপার কথায়। ইউরোপা গ্যালিলিওর আবিষ্কৃত বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহের মধ্যে সব থেকে ছোট, আবার বৃহস্পতির থেকে সব থেকে দূরেও বটে। ইউরোপা আমাদের চাঁদের মতোই বড়। তার উপরটা বরফে ঢাকা। গ্যালিলিও মহাকাশযান দীর্ঘদিন বৃহস্পতির চারদিক পর্যবেক্ষণ করেছে, তার পাঠানো ছবি থেকে দেখা গেছে পৃথিবীর উত্তর মেরুতে যেমন ফাটল দেখা যায় ইউরোপার উপরিতল একেবারেই সেই রকম ফাটলে ভর্তি। উত্তর মেরুতে এর কারণ হল বরফের তলাতে আছে তরল জল, সমুদ্রস্রোতের প্রভাবে উপরের বরফে ফাটল ধরে। ইউরোপা গোল্ডিলক্‌স অঞ্চলের অনেক বাইরে, সেখানে উপরের তাপমাত্রা হল -২০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, সেখানে তরল জল আসবে কোথা থেকে?

অনেকদিন আগে থেকেই মনে করা হচ্ছিল ইউরোপাতে জল আছে। ইউরোপার বায়ুমণ্ডল নেই, কাজেই উপরে তরল জল থাকার উপায় নেই। তাই মহাসমুদ্রের উপরটা জমে গেছে। কিন্তু বৃহস্পতির টানে যে জোয়ারভাঁটা হয়, তা সেই বরফের স্তরের তলার জলকে জমতে দেয়নি। গ্যালিলিও দেখিয়েছে ইউরোপার একটা দুর্বল চৌম্বক ক্ষেত্র আছে। এর একমাত্র ব্যাখ্যা হল ইউরোপার ভিতরে এমন কোনো তরল আছে যা তড়িৎ পরিবহন করতে পারে। ইউরোপা এতই ছোট যে তার অভ্যন্তর বহুদিন শীতল হয়ে গেছে, কাজেই পৃথিবীর মতো তরল লোহার স্রোতের সাহাযযে তার চৌম্বক ক্ষেত্রের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব নয়। এর সব থেকে সহজ ব্যাখ্যা হল জল; নোনা জল তড়িৎ পরিবহন করতে পারে। দু একটা ছোটখাটো পুকুর নয়, ইউরোপাতে আছে এক উপগ্রহব্যাপী মহাসমুদ্র। হাবল টেলিস্কোপের সাম্প্রতিক ছবি থেকে মনে হয় সেই জল মাঝে মাঝে পিচকারির মতো বাইরে বেরিয়ে আসে। তা যদি সত্য হয়, তাহলে প্রায় দু’শো কিলোমিটার উঁচু জলের ফোয়ারার সন্ধান পাওয়া গেছে।

গ্যালিলিওর চোখে ইউরোপা (NASA/JPL-Caltech/SETI Institute


বৃহস্পতির এক শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র আছে, সে তার উপগ্রহগুলিকে মহাজাগতিক রশ্মির আঘাত থেকে রক্ষা করে। তাই তরল জল এবং মহাজাগতিক রশ্মির বর্ম, প্রাণের এই দুই শর্ত ইউরোপা পূরণ করে। কিন্তু সেখানে অক্সিজেন থাকার কোনো সুযোগ নেই, সূর্যের আলোও খুবই দুর্বল। তাহলে প্রাণ থাকলে কেমন হবে তার সম্ভাবনা তা জানতে ইউরোপা থেকে ফিরে আসতে হবে পৃথিবীতে।

কয়েক দশক আগে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের এক প্রাণের সন্ধান পৃথিবীতে পাওয়া গেছে। গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জের কথা আমরা সবাই শুনেছি, সেখানকার পাণীজগতের বৈচিত্রই ডারউইনকে তাঁর বিখ্যাত প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের পথ দেখিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে সেই দ্বীপপুঞ্জের কাছে সমুদ্রের নিচে এক সম্পূর্ণ নতুন ধরনের জীবমণ্ডল আবিষ্কার হয় যার জন্য গোল্ডিলক্‌স অঞ্চলের তত্ত্ব পুরোপুরি খাটবে না। সমুদ্রের গভীরে অনেক জায়গা আছে যেখানে ফাটল থেকে গরম জল বেরিয়ে আসে। এগুলিকে বলে জলতাপীয় রন্ধ্র (Hydrothermal vent)। এগুলি সাধারণত দুটি মহাদেশীয় পাতের সযোগস্থলে বা আগ্নেয়গিরির কাছে হয়। এই সব গঠনে যে ফাঁক থাকে তা দিয়ে সমুদ্রের জল ভূঅভ্যন্তরে প্রবেশ করে গরম হয় ও অন্য ফাটল দিয়ে বেরিয়ে আসে। সেই জলের সঙ্গে বেরিয়ে আসে। তার সঙ্গে বেরিয়ে আসে নানা রাসায়নিক পদার্থ। এই রাসায়নিক পদার্থের উপর নির্ভর করে জলতাপীয় রন্ধ্রদের আশেপাশে সম্পূর্ণ নতুন এক জীবজগৎ গড়ে উঠেছে; সূর্যের আলো বা মুক্ত অক্সিজেনের উপর তা একেবারেই নির্ভর করে না। এখন শুধু গ্যালাপাগোস নয়, আরো অনেক জায়গায় এমন জীবজগতের সন্ধান পাওয়া গেছে। বৃহস্পতির টানে ইউরোপাতে শুধু তরল জল নয়, সমুদ্রের তলাতে আগ্নেয়গিরিও থাকা সম্ভব। তাহলে সহজেই জলের ফোয়ারার ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব। সেক্ষেত্রে কি আমরা ইউরোপার অভ্যন্তরে প্রাণের আশা করতে পারি? নাসার ইউরোপা ক্লিপার মহাকাশযান ২০২৪ সালের ১৪ অক্টোবর যারা করেছে, ২০৩০ সাল নাগাদ সে ইউরোপা পৌঁছে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করবে। অবশ্য সমুদ্রের অভ্যন্তরে সন্ধান এখনো আমাদের ক্ষমতার বাইরে।

অপর এক সম্ভাব্য জায়গা হল আমাদের সৌরজগতের সবই থেকে বড় উপগ্রহ টাইটান। শনির এই উপগ্রহটা প্রায় মঙ্গলের মতোই বড়। তার একটা বায়ুমণ্ডল আছে যার মুখ্য উপাদান হল নাইট্রোজেন, আর্গন ও মিথেন। আগেই দেখেছি যে মিথেন সাধারণভাবে ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। মঙ্গলের ক্ষেত্রে আমরা জৈব উৎস্বের কথা বলেছিলাম, কিন্তু টাইটানের ক্ষেত্রে মিথেনের পরিমাণ এতই বেশি যে তা কোনভাবেই জৈব হতে পারে না। শনিতে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছিল ক্যাসিনি মহাকাশযান, সেই সময় তা মিথেনের রহস্য উদ্ধারে টাইটানে হাইজেন্স নামের একটি অনুসন্ধানী যন্ত্র নামিয়েছিল।

হাইজেন্সের ছবি দেখাচ্ছে পৃথিবীর সঙ্গে টাইটানের ভূপ্রকৃতির অনেক মিল আছে। টাইটানে আছে নদী, সম্ভবত সেখান দিয়ে তরল মিথেন প্রবাহিত হয়। জল বরফ রূপেই আছে, কারণ টাইটানের তাপমাত্রা -১৮০ ডিগ্রি। হাইজেন্স নেমেছিল কাদার মধ্যে, সেই কাদাতে জল নয়, আছে মিথেন। সম্ভবত টাইটানের ভিতরের মিথেন আগ্নেয়গিরির থেকে বেরিয়ে আসে।

হাইজেন্সের ক্যামেরাতে টাইটান 

মিথেনের উৎস জৈব না হলে বিজ্ঞানীদের টাইটান নিয়ে আগ্রহের কারণ কী? আমরা পরে দেখব পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সময় কোন ধরনের বায়ুমণ্ডল ছিল বলে মনে করা হয়। টাইটানের সঙ্গে তার অনেক মিল আছে। কাজেই টাইটানে কি আদি প্রাণের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে?

সৌরজগৎ নিয়ে আলোচনা শেষ করার আগে আরেকটা কথা বলে নেওয়া যাক। যদি সত্যিই মঙ্গল বা সৌরজগতে অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়া যায়, কিন্তু দেখা যায় তার সঙ্গে পৃথিবীর প্রাণের মিল অনেক, তাহলে আমাদের সিদ্ধান্ত করতে হয় যে তাদের উৎস এক। সেটা খুব অসম্ভব নয়। গ্রহ বা উপগ্রহদের সঙ্গে গ্রহাণু বা ধূমকেতুদের সংঘর্ষে অনেক সময়ই কিছু পাথরের টুকরো মহাকাশে উৎক্ষিপ্ত হয়। তার স্নগে ব্যাকটেরিয়ার মতো এককোশী জীব চলে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক, আমরা চাঁদের ক্ষেত্রে দেখেছি যে ব্যাকটেরিয়ার স্পোর বায়ুশূন্য অবস্থায় জীবিত থাকতে পারে, সুযোগ পেলে সে আবার বংশবিস্তার করে। এভাবে সৌরজগতের এক জায়গা থেকে অন্য জায়গাতে প্রাণের চলাচলের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অবশ্য অন্য কোথাও প্রাণের সন্ধান পাওয়ার আগে পর্যন্ত এই মতের সত্যমিথ্যা নির্ণয় করা সম্ভব নয়।

সৌরজগতের বাইরে প্রাণের সন্ধান কেমনভাবে করা যাবে? গ্রহের বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি জানতে পারলে তার মধ্যে প্রাণের সম্ভাবনা বোঝা যায়। যেমন কোনো গ্রহের বায়ুমণ্ডলে যদি অক্সিজেন গ্যাস থাকে, তাহলে সেখানে প্রাণ আছে আমরা ধরে নিতেই পারি। অক্সিজেন সাধারণত অন্য সব মৌলের সঙ্গে বিক্রিয়া করে, তাই তাকে স্বাভাবিকভাবে মুক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় না। আমাদের পৃথিবীতে অক্সিজেনের উৎস উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ।

গ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপাদান কেমনভাবে জানা যাবে? মহাকাশের দুই টেলিস্কোপ হাবল ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ এ ক্ষেত্রে খুব কাজে লাগছে। নক্ষত্রের আলো যখন বায়ুমণ্ডলের ভিতর দিয়ে আসে, তখন সেখানকার অণুপরমাণুরা কিছু কম্পাঙ্কের আলো শোষণ করে। সেই আলোর বর্ণালীবিশ্লেষণ করে কোন কোন কম্পাঙ্ক শোষণ করেছে জানলে বায়ুমণ্ডল কী দিয়ে তৈরি জানা যায়। ২০২৫ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যলয়ের গবেষকরা জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ ব্যবহার করে কে২-১৮ বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলে মিথেন ও ডাইমিথাইল সালফাইড ও ডাইমিথাইল ডাইসালফাইডের সন্ধান পেয়েছেন।

কে২-১৮ বি গ্রহের বায়ুমণ্ডলের উপাদান এই বর্ণালী থেকে পাওয়া গেছে। কার্বন ডাই অক্সাইডের সঙ্গে ডাইমিথাইল সালফাইড (DMS) ও মিথেনের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। (সৌজন্যে নাসা, ইএসএ, সি এস এ, র‍্যালফ ক্রফোর্ড ও জোসেফ অমস্টেড)

কে২-১৮ বি গ্রহটা পৃথিবীর থেকে বড় কিন্তু নেপচুনের থেকে ছোট। মূল তারা কে-২ আমাদের থেকে একশো কুড়ি আলোকবর্ষ দূরে আছে, তারাটা সূর্যের থেকে ছোট ও শীতল। আগেই বলেছি মিথেনের সম্ভাব্য উৎস হল প্রাণ। বাকি দুটি যৌগকে প্রাণের আরো নিশ্চিত সঙ্কেত মনে করা হয়। তাই পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সম্ভাবনা আরো বেড়েছে। অবশ্য প্রাণ থাকলেই যে উন্নত সভ্যতা থাকবে এমন কথা বলা যায় না, কে২-১৮ বি-তে তার সম্ভাবনা নেই, কারণ বায়ুমণ্ডলে মুক্ত অক্সিজেন নেই। কিন্তু আর একটা গ্রহে যদি নিশ্চিত ভাবে প্রাণের খোঁজ পাওয়া যায়, তাহলে ছায়াপথের অন্যত্র উন্নত সভ্যতা থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। 

 

(প্রকাশঃ বিজ্ঞান অন্বেষক, সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ২০২৫)  

No comments:

Post a Comment