শম্পা গাঙ্গুলী
(প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।)
টাওয়ার অফ লন্ডন |
পরের দিন
প্রথমেই গেলাম টেমস নদীর উত্তর পাড়ে ঐতিহাসিক রাজপ্রাসাদ ও দুর্গ টাওয়ার অফ লন্ডনে।
এখানেও ‘টু ফর ওয়ান’-এর সুযোগ পাওয়ায় অনেকটা সুবিধা হল, কারণ এক একজনের টিকিটের দাম
ছাব্বিশ পাউণ্ড। ১০৬৬ সালে হেস্টিংসের যুদ্ধে নরম্যান্ডির ডিউক উইলিয়াম দি
কনকোয়ারার রাজা হ্যারল্ডকে পরাজিত করেন ও দুর্গটি দখল করে ইংল্যান্ডের রাজা হন।
১২৪০ সালে রাজা তৃতীয় হেনরি এখানে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি টাওয়ারের সম্প্রসারণ
করেন ও একটা অংশ সাদা রং করান। সেই থেকে সেটার নাম হোয়াইট টাওয়ার; যার একটা অংশ
১১০০ থেকে ১৯৫২ সাল অবধি কারাগার রূপে
ব্যবহার হয়ে এসেছে। রাজা অষ্টম হেনরির প্রচুর কীর্তি এই টাওয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
১৫০৯ সালে তিনি রাজা হন। তিনি অত্যন্ত পারদর্শী ও জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু যা চান সেটা না পেলে ভয়ানক নির্দয় হতে পারতেন।
কথায় কথায় তিনি তাঁর কর্মচারীদের শিরশ্ছেদ করতেন। পুত্র সন্তান লাভের আশায় তিনি
বারংবার বিয়ে করেছেন। প্রথম স্ত্রী ক্যাথরিন ছিলেন হেনরির ভাইয়ের স্ত্রী। ভাইয়ের মৃত্যুর পর হেনরি তাঁকে
বিয়ে করতে চান। কিন্তু রোমের পোপ প্রথমে এই বিয়েতে মত দেননি। পরে বিশেষ অনুমতি
নিয়ে বিয়ে হয়। কিন্তু কোনো সন্তান না হওয়াতে তার সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে চান
হেনরি। ততদিনে এ্যানি বোলিনকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন রাজা। কিন্তু
রোমের ক্যাথলিক চার্চ তাঁর প্রথম বিয়ে নাকচ করতে রাজি না হওয়ায় তিনি ইংল্যাণ্ডের
ধর্মই পাল্টে ফেলেন। ক্যাথলিক ছেড়ে বেরিয়ে এসে তিনি ইংল্যাণ্ডে প্রোটেস্টান্ট ধর্মের ধারক ও বাহক হন।
ক্যান্টরবেরীর আর্চবিশপ এবার তাঁর সঙ্গে এ্যানে বোলিনের বিয়েকে বৈধ বলে ঘোষণা
করেন। কিন্তু এ্যানে এক কন্যা সন্তানের জন্ম দেন। তখন রাজা ব্যাভিচার, অনাচার, বিশ্বাসঘাতকতার অপবাদ দিয়ে তাঁর শিরশ্ছেদ করেন।
এরপরও তিনি আরও চারটে বিয়ে করেন যেগুলোর কোনটাই টেকেনি। তাঁর স্ত্রীদের ভাগ্যের
স্মৃতিচারণ নিয়ে একটা প্রচলিত লাইন হল-
তাঁর বারবার স্ত্রী
পরিবর্তন নিয়ে তখনকার দিনেও লোকের মুখে মুখে ছড়া ঘুরত-
‘Boleyn and Howard lost their heads,
Anne of Cleaves he would not bed
Anne of Cleaves he would not bed
Jane Seymour gave him a son-
But died before the week was done
Aragon he did divorce
Which just left Catherine Parr, of course.’
লন্ডন টাওয়ারের বিখ্যাত দাঁড়কাক |
একটা ঘরে ছিল শুধু পুরানো মুকুট যেগুলো
আগের রাজা বা রাণীরা ব্যবহার করতেন। পরের রাজা রাণীদের অভিষেকে অনেক সময়
মূল্যবান পাথর পুরানো মুকুট থেকে খুলে নতুন মুকুটে লাগানো হত। রাজ অলংকারের জন্য
আলাদা একটা ঘর ছিল যেখানে ২৩৫৭৮টা মণিমানিক্য আছে। ভারতীয়দের জন্য অবশ্যই সবচেয়ে
আকর্ষণীয় হল কোহিনুর হিরে, যা ইংল্যাণ্ডের এক রাজমুকুটে শোভা পায়। মনে হল সেটা
দেখার জন্য ওয়াক-ওয়েতে বেশিটাই ভারতীয়দের ভিড়।
টাওয়ারের প্রাচীরের উপরে অর্পিতাদির সঙ্গে |
পৃথিবীর
সবচেয়ে বড় হিরে, স্টার অফ আফ্রিকা বা কালিনান। তাকে কেটে দুটো বড় টুকরো বেরিয়েছিল।
সবচেয়ে বড় টুকরো কালিনান-১ আছে ব্রিটিশ রাজদণ্ডে। অন্যটা আছে রাজমুকুটে। দক্ষিণ
আফ্রিকা থেকে এই কালিনান আনার গল্পটা বেশ মজার।
আনার সময়ে অনেক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। লন্ডন থেকে একদল ডিটেকটিভকে হিরেটা
আনার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা পাঠানো হয়। জাহাজের ক্যাপ্টেনের সিন্দুকে হিরেটা রেখে
তারা দিনরাত তার উপর নজর রেখেছিল। সঙ্গে ছিল আরও অনেক অস্ত্রধারী প্রহরী। জাহাজে করে অত তোড়জোড় করে যেটা
আনা হল, সেটা ছিল একটা নকল হিরে। আসল কালিনান কি তবে সকলের চোখ এড়িয়ে চুরি গেল?
কদিন পর আসল হিরেটা একই জায়গা থেকে এল। সাধারণ ডাকে, রেজিস্ট্রি পোস্টে। হিরে
চোররা হয়তো খবরটা পেয়ে নিজেদের হাত কামড়েছিল। এখন একটা বিখ্যাত হিরে কোম্পানি এই
টাওয়ারের ক্রাউন জুয়েল প্রদর্শনীর সব খরচ যোগায়।
টাওয়ার মিউজিয়ামে বাংলা ভাষার খোঁজে শুভদা |
হোয়াইট
টাওয়ারের মাটির তলার একটা ঘরে বন্দীদের নানাভাবে অত্যাচারের জন্য বীভৎস সব
যন্ত্রপাতি ছিল। সেই টর্চার রুমের বর্ণনায় আর গেলাম না। বাইরের গেটের কাছে দেখি
টেমস নদী থেকে একটা খাল খুঁড়ে রাখা আছে দুর্গের ভিতর পর্যন্ত, যাতে সহজেই দুর্গের
ভিতর নৌপথে ঢুকে পড়া যায়। বোঝাই যায়, একসময়ে এটা খুবই ব্যবহৃত হত।
টাওয়ার গার্ডের সঙ্গে |
টাওয়ার অফ
লন্ডন থেকে বেরিয়ে টেমসের ধারে বসে খানিক জিরিয়ে নিলাম। সামনেই টাওয়ার ব্রিজ। হাতে সময় কম থাকায় সেটা আমরা সামনে থেকেই
দেখলাম, ব্রিজে আর উঠিনি।
টেমসের ধার দিয়ে হেঁটে গিয়ে লন্ডন ব্রিজে উঠলাম। দেখলাম ওটার ওপর দিয়ে আমাদের মতনই অনেকেই হাঁটছে। টেমস নদীর ওপর এটাই প্রথম ব্রিজ। তৈরি হয়েছিল জুলিয়াস সিজারের ইংল্যাণ্ড দখলের পর খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে। রোমানরা এই শহরের নাম দিয়েছিল লন্ডনাম। মাটি আর কাঠ দিয়ে তৈরি এই ব্রিজ তখন প্রায়ই ভেঙে পড়ত। এই নিয়ে ছোটো বেলায় একটা ইংরাজি রাইম আমাদের অনেকেরই জানা -- ‘লন্ডন ব্রিজ ইস ফলিং ডাউন, ফলিং ডাউন’। আমাদের নিয়ে ব্রিজটা অবশ্য ভেঙে পড়েনি। কিন্ত কে জানত যে তার কদিন পরই ঐ ব্রিজের ওপর সন্ত্রাসবাদী হামলা কিছু নিরীহ প্রাণকে কেড়ে নেবে। আগেই লিখেছি যখন এই ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল আমরা তখন বেলজিয়ামে।
টাওয়ার ব্রিজ |
টেমসের ধার দিয়ে হেঁটে গিয়ে লন্ডন ব্রিজে উঠলাম। দেখলাম ওটার ওপর দিয়ে আমাদের মতনই অনেকেই হাঁটছে। টেমস নদীর ওপর এটাই প্রথম ব্রিজ। তৈরি হয়েছিল জুলিয়াস সিজারের ইংল্যাণ্ড দখলের পর খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে। রোমানরা এই শহরের নাম দিয়েছিল লন্ডনাম। মাটি আর কাঠ দিয়ে তৈরি এই ব্রিজ তখন প্রায়ই ভেঙে পড়ত। এই নিয়ে ছোটো বেলায় একটা ইংরাজি রাইম আমাদের অনেকেরই জানা -- ‘লন্ডন ব্রিজ ইস ফলিং ডাউন, ফলিং ডাউন’। আমাদের নিয়ে ব্রিজটা অবশ্য ভেঙে পড়েনি। কিন্ত কে জানত যে তার কদিন পরই ঐ ব্রিজের ওপর সন্ত্রাসবাদী হামলা কিছু নিরীহ প্রাণকে কেড়ে নেবে। আগেই লিখেছি যখন এই ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছিল আমরা তখন বেলজিয়ামে।
লন্ডন ব্রিজের উপর |
ব্রিজ
থেকে নেমে দুপুরের খাবারের জন্য খানিক ঘোরাঘুরি করে অবশেষে আমরা ব্রিজের নিচেই
সিলকা নামে এক বাংলাদেশী রেস্তঁরায় ঢুকলাম। সেখানে সবাই বাঙালি। একটি অল্পবয়সী
ছেলে, যে আমাদের খাবার দাবার পরিবেশন করছিল, চুপি চুপি আমাদের বিরিয়ানিতে বেশি
বেশি মাংস দিয়ে যাচ্ছিল। এত অপূর্ব বিরিয়ানি খেয়ে প্রধান রাঁধুনির সঙ্গে আলাপ
জমালাম। কী ভাবে রান্না করেছেন জানতে চাই। ওনার রেসিপিটা মোবাইলে রেকর্ডিং করেও রাখলাম। রেস্তঁরাগুলো
দুপুরে ভিড় কম থাকে, সন্ধের সময়ে বাড়ে। তাই ফাঁকা থাকায় মালিক ও কর্মচারীরা এসে আমাদের
সাথে দফায় দফায় আড্ডা দিয়ে গেল। বিল হাতে নিয়ে দেখলাম মালিকও ভারত-বাংলাদেশের এই
মৈত্রী বন্ধনে বাঁধা পড়েছেন। অসম্ভব রকমের দাম কম নিয়েছেন।
ওয়েস্টমিনস্টার
এ্যাবেতে প্রথম দিন ঢোকা হয়নি। এদিকে সাড়ে তিনটের পর আর ঢুকতে দেয় না। হাতে সময় কম, তাড়াহুড়ো করে টিউব
ধরে পৌঁছলাম। এখানেও টু
ফর ওয়ানের সুযোগ আছে। অসংখ্য মনীষী, রাজারাণী, কবি, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিকের সমাধি
বা ফলক আছে এই অ্যাবেতে। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী নেভিল চেম্বারলেনের সমাধি দেখলাম।
ক্লেমেন্ট এ্যাটলি যিনি ভারতের স্বাধীনতার সময়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন
তাঁর সমাধিও আছে।
চার্চিল সহ
উল্লেখযোগ্য আরো অনেকের কবর অন্যত্র হলেও এখানে তাঁদের স্মৃতিস্তম্ভ আছে। ডারউইন আর নিউটনের সমাধির সামনে
গিয়ে গৌতম যেন মগ্ন হয়ে গিয়েছিল। ওখান থেকে ওকে প্রায় ঠেলে সরাতে হল। কবি সাহিত্যিকদের জন্য
আলাদা করে আছে পোয়েটস কর্ণার। সেখানে এসে শুভদা খুব আগ্রহ নিয়ে সমাধিগুলো দেখতে
লাগলেন। ইংরাজি সাহিত্যের অনেক পরিচিত নামই দেখতে পেলাম। চসার, রবার্ট ব্রাউনিং,
চার্লস ডিকেন্স, টমাস হার্ডি, কিপলিং, জেন অস্টেন, বায়রন, এলিয়ট, শেক্সপিয়র, কিটস,
মিলটন – কার নাম নেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত কবিদের জন্য আলাদা একটা ফলক আছে।
তাদের মধ্যে চোখে পড়ে উইলফ্রেড আওয়েনের নাম। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সী কবি যুদ্ধে
যাবার আগে ইংরাজি গীতাঞ্জলি থেকে একটি কবিতা বলে মায়ের কাছ থেকে শেষ বিদায়
নিয়েছিলেন। যুদ্ধে মৃত্যুর পর তাঁর পিঠের ব্যাগ থেকে পাওয়া যায় গীতাঞ্জলি,
যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর সবসময়ের সঙ্গী।
ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে |
ওখান থেকে
বেরিয়ে হাইড পার্ক যাব ঠিক আছে। কিন্ত তার আগে শুভদার এক পুরানো ছাত্র সন্দীপন তার
স্যারের সাথে দেখা করতে চায়। মুম্বাই আইআইটি থেকে ডক্টরেট করার পর গবেষণা করতে সে গিয়েছিল
কেম্ব্রিজ বিশ্ববদ্যালয়ে। এখন সেন্ট্রাল লন্ডনে ফ্রান্সিস ক্রিক ইনস্টিটিউটে পোস্টডক্টরেট করছে। পার্লামেন্ট স্কোয়ারে তার সাথে দেখা হলে
আমরা সবাই মিলে ট্রেনে করে গেলাম হাইড পার্ক সংলগ্ন একটা কাফেতে। ওখানে বিকেলের
আড্ডাটা ভালোই জমল। পরদিনে আমরা স্কটল্যাণ্ডের দিকে রওনা দেব। তাই হাইড পার্ক হয়ে
আমি আর গৌতম বাসায় ফিরব ঠিক করলাম। অর্পিতাদি কিছু কেনাকাটা করতে চায়। তাই
অক্সফোর্ড স্ট্রিটে ওদের নিয়ে গেল শুভদার ছাত্র।
হাইড পার্কের হাঁসেরা |
হেনরি মুরের ভাস্কর্য |
পরদিন সকাল সাড়ে-সাতটায় কিংস ক্রস থেকে ট্রেন ধরে স্কটল্যাণ্ডের এডিনবার শহরে যেতে হবে। সকাল সাড়ে ছটায় একটা ক্যাব আগের দিন রাতেই বুক করা হয়েছিল। সেটা আমাদের স্টেশনে পৌঁছে দেবেদেবে। লাগেজ গুছিয়ে আমরা অপেক্ষা করছি ক্যাবের জন্য। ঠিক সাড়ে ছটায় মেসেজ ঢুকল আমার ফোনে, আমাদের ক্যাব বুকিংটা বাতিল হয়েছে। তাড়াহুড়ো করে আমরা কোনো বাসের দিকে না গিয়ে সোজা হাঁটা লাগালাম প্যাডিংটন স্টেশনের দিকে। এমনিতে মিনিট পনেরোর হাঁটা। কিন্তু লাগেজ সমেত যেতে সময় তো লাগবেই। স্টেশনের কাছে একটা ট্যাক্সি পেয়ে যাওয়ায় সেটা করেই সোজা কিংসক্রস স্টেশন। সেখানে ঢুকে এদিক ওদিক খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। হঠাৎ দেখি গৌতম দূরে দেওয়ালের ধারে কিছু একটা করছে। দূর থেকে বোঝাও যাচ্ছে না। হাতে সময় আছে। তাই আমিও এগোলাম। গিয়ে দেখি সেখানে একটা লাগেজ ট্রলির অর্ধেকটা দেওয়ালে এমনভাবে লাগানো আছে যেন মনে হচ্ছে দেওয়ালের এপাশ থেকে ট্রলির দুটো হ্যাণ্ডেল ধরে কেউ দেওয়ালের মধ্যে ট্রলিটাকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছে। আন্দাজ করতে পারছেন নিশ্চই। হ্যাঁ, জে কে রাউলিঙের হ্যারি পটার গল্পের কিংসক্রস স্টেশনের সেই বিখ্যাত 9 3/4 প্ল্যাটফর্ম। বাস্তবে সেটা হঠাৎ দেখতে পাওয়ার চমক ছিল তো বটেই। পরের ঘটনা নিশ্চই অনুমেয়। সবাই একে একে দেওয়ালে ঠেকানো ট্রলির হ্যাণ্ডেল ধরে ছবি তুললাম সাধ মিটিয়ে। গৌতম সবার আগে ফেসবুকে সেই ছবি পোস্ট করে ঘন ঘন দেখতে লাগল, কটা লাইক পড়ল।
ট্রেনে এডিনবার সাড়ে চার ঘন্টা। লন্ডন থেকে স্কটল্যাণ্ডের
রাস্তার শোভা এক কথায় অসাধারণ। উত্তরদিকে ট্রেন যতই ছুটেছে ততই উঁচু নিচু ঢেউ
খেলানো ভূমি আর উত্তর সাগরকে ঘন ঘন চোখে
পড়েছে।
ট্রেনে মাঝে মধ্যেই শুভায়ুর ফোন আসছিল। আমরা এডিনবার থেকে বাসে ডাণ্ডি
পৌঁছলে সেখান থেকে ও আমাদের বাড়ি নিয়ে যাবে।
আমরা এডিনবার পৌঁছলাম সকাল সাড়ে এগারোটার পর। স্টেশনটার পুরো নাম
এডিনবার-ওয়েভার্লি। ওয়েভার্লি হল কবি ওয়াল্টার স্কটের একটা বিখ্যাত উপন্যাস। পরে
শুভায়ুর কাছে শুনেছিলাম স্কটল্যাণ্ডের সরকারি রেলদপ্তর দাবি করে কোনো বইয়ের নামে
একটা স্টেশনের নাম – এরকম নাকি পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই। শুভায়ু তাদের চিঠি
লিখেছিল যে কলকাতায় রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করে গীতাঞ্জলি নামে একটা মেট্রো স্টেশন
আছে। স্কটিশ সরকার শুভায়ুর চিঠির কোনো সাড়া করেনি আজও।
ট্রেন থেকে উত্তরসাগর |
ওয়াল্টার স্কট মনুমেন্ট |
ডাণ্ডির
রাস্তাটাও দারুণ সুন্দর। বিপত্তির মধ্যে আমাদের বাসটা রাস্তায় মাঝে খারাপ হয়ে
গিয়েছিল। কিন্তু সেটা বুঝলাম তখনই যখন অন্য একটা মেগাবাস আমাদের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই
লাগেজ সহ তুলে নিয়ে গেল। ডাণ্ডি বাস স্ট্যাণ্ডে আমাদের পৌঁছনোর খানিক পরেই শুভায়ু
গাড়ি নিয়ে এল। আমাদের সকলের চেয়ে বয়সে কিছু ছোটো মধ্য চল্লিশের হাসিখুসি টাক
মাথাওয়ালা এই ছেলেটা। প্রথম আলাপেই ও আর ওর স্ত্রী প্রণীতা নানান হাসি, গল্পে
একেবারে জমিয়ে দিল। শুভায়ুদের বাড়িটাও ছবির মত। বসার ঘরের সামনের দিকটা পুরোটা
কাঁচের। সেখানে বসলে বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট বাগান চোখে পড়ে, নানান ফুল আর
পাতাবাহার গাছে ভরা। আমাদের থাকার জন্য দোতলায় নিজেদের শোবার ঘর সহ মোট দুটো ঘর
ওরা ছেড়ে দিয়েছে। মানুষ কতটা অতিথিপরায়ণ হলে এমনটা করে!
আমরা একটু
জিরিয়ে নিয়ে মিনিট কুড়ি পরে নিচে নামলাম। দেখি বাড়ির পিছনের বাগান থেকে শুভায়ুর ঘন
ঘন ডাক পড়ছে। ডিনারের জন্য। সবে তো বিকেল সাড়ে পাঁচটা। বাইরে খটখটে রোদ। এত
তাড়াতাড়ি ডিনার? পিছনে আরও একটা বাগান আছে নাকি? গিয়ে দেখি সাজো সাজো রব। বাড়ির
সামনের বাগানের শোভা দেখার জন্য যেমন একটা ঘর আছে ; তেমনি পেছনের বাগানের শোভা
বাড়ির ভিতর থেকে দেখার জন্য বাড়ির পেছনের দিকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা আরও একটা সুসজ্জিত
ঘর। সেদিকের বাগানও বিভিন্ন গাছগাছালিতে ভরা, আবার তারই মাঝে একটা ছোট্ট লিলি-পন্ডলিলি-পন্ড। তার
চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কিছু বসার চেয়ার। অতিথি আপ্যায়নের ভারি তোড়জোড়। শুভায়ু অ্যাপ্রন
পরে একধারে বারবিকিউইয়ের তোফা আয়োজন করেছে। চিকেন, পর্ক, ল্যাম্বের ঝলসানো মাংসের সুগন্ধ। প্রণীতা
ব্যস্ত বিভিন্ন স্কচ, নানান স্যালাড, রকমারি ব্রেড সাজাতে। ছোট ছেলে আরিহান, বছর
বারো বয়স। স্পেশাল চাইল্ড। সেও প্রস্তুত অতিথি আপ্যায়নে।
যদিও
আমাদের খুব খিদে পেয়েছে, তবু এত তাড়াতাড়ি ডিনার আর এত আয়োজনে আমরা একটু কিন্তু
কিন্তু করছিলাম। শুভায়ু জানাল ওদেশে দিনের বেলা রোদ ওঠা মানে সেদিনটাকে সেলিব্রেট
করতে ঘরে ঘরে খোলা বাগানে বারবিকিউ, রোদটা এতই বিরল। সারা বছরভোর তো ঠাণ্ডা,
স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। আর রোদ চলে গেলেই আবার ঠাণ্ডা নামবে। তখন আর বাইরে থাকা
যাবে না। যদিও মে মাসের গ্রীষ্মে সূর্যের আলো রাত নটা অবধি থাকে। কিন্তু সারাবছর
এমনিতেও ডিনার ওদেশের লোক ছটা-সাতটার মধ্যে শেষ করে। গত কয়েকদিন বৃষ্টিভেজা
স্যাঁতস্যাতে আবহাওয়ার পর আজ রোদ্দুর। সুতরাং
বলাই বাহুল্য পরের দেড় ঘণ্টা সুস্বাদু খাবারের আঘ্রাণ, জমাট আড্ডা আর নানা স্কচ ও অন্যান্য পানীয়ের মৌতাতে মেতে
উঠল। ষোলো বছরের অগ্নিজ, শুভায়ু-প্রণীতার বড় ছেলে, একটু মুখচোরা। অংকে তার বিরাট
প্রতিভা সকলকে তাক লাগিয়েছে। গত আট বছর ধরে স্কটল্যাণ্ডে অংকে সেরা ছাত্রের
স্বর্ণপদকটা অগ্নিজই পেয়ে আসছে। হবে নাই বা কেন। শুভায়ুর টাইমলাইনে ঢুকে দেখলাম
২০১৩ সালের ৮ মার্চ আনন্দবাজারে অগ্নিজকে নিয়ে একটা লেখা বেরিয়েছিল। হেডিংটা ছিল
এরকম, ‘আইনস্টাইন, হকিংকে পিছনে ফেলেছে খুদে বাঙালি’। তাতে ওর সম্পর্কে বেরিয়েছিল,
‘‘ছোটোবেলায় দু বছর বয়স থেকে সে যখন কান্নাকাটি করত তাকে নামতা শোনালে বা অঙ্ক
কষতে দিলে সে শান্ত হত। তখনই এই বাঙালি দম্পতি টের পেয়েছিল, ছেলেটি তাদের
‘জিনিয়াস’। কিন্তু আইনস্টাইনের থেকেও বুদ্ধি বেশি! স্টিফেন হকিংও আইকিউতে তার থেকে
পিছিয়ে। ব্রিটিশ মেনসা আইকিউ পরীক্ষায় সর্বোচ্চ রেকর্ড গড়েছে সে। আট বছর বয়সেই সে
গড়গড় করে মুখস্থ বলতে পারত পর্যায় সারণী।”
শুভায়ু প্রণীতা ও ওদের ছেলেদের সঙ্গে |
এহেন বিষ্ময় বালক মাত্র, হ্যাঁ মাত্র
পনের বছর বয়সে অঙ্কের ওপর বই লিখতে শুরু করে ষোলো বছরে তা লেখা শেষ করে ফেলেছে, যা
‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড’ নামে একটা বিখ্যাত প্রকাশক ইংরাজিতে ১০০০০ কপি ছাপবে। এবং চিনা ও
রাশিয়ান ভাষায় তার অনুবাদ হবার কথা। ভাবা যায়!! অংকে বিশ্বজয় করা এই ছেলে ভয় পায়
খালি মাছিতে। ঘরে, বাইরে ওর ধারে কাছে একটা সাধারণ মাছির উপস্থিতি ওকে ভয়ে কুঁকড়ে
দেয়, অস্থির করে তোলে। বুঝতেই পারছেন, একমাত্র মাছির প্রসঙ্গ ছাড়া এহেন দিকপাল
ছেলের সাথে কী নিয়েই বা আমরা কথা বলতে পারি। বেড়াতে বেড়িয়ে বা খাবার টেবিলে আমরা
তাই খালি গৌতমকেই এগিয়ে দিতাম ওর সাথে কথা বলার জন্য। আমাদের সকলের মধ্যে ওই
একমাত্র বিজ্ঞানের লোক।
পরদিন
সকালে আমরা শুভায়ুর গাড়িতে রওনা দিলাম আরও উত্তরে, যেখানে আছে স্কটিশ হাইল্যাণ্ড।
শুভদার ইচ্ছে ছিল আরও উত্তরে ইনভার্নেস যাওয়ার, সেটা মনে হয় না কেবল তার
সৌন্দর্যের জন্য, ম্যাকবেথের জন্যও নিশ্চয়। ইনভার্নেস হল ম্যাকবেথের দুর্গ। আমাদেরও ইচ্ছা ছিল, কিন্তু অন্য কারণে।
ইনভার্নেসের পাশেই আছে লক নেস। সেখানেই থাকে নেসি। ওহো, নেসি কে জানেন না বুঝি?
ভ্রমণপিপাসুদের কাছে স্কটল্যাণ্ডের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হল ‘নেসি’। ‘নেসি’ হচ্ছে লক
নেসের তলায় থাকা এক জলদানব, যে গত দেড়হাজার বছর ধরে মানুষের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে।
তিনহাজার বারেরও বেশি সে নাকি দেখা দিয়েছে। কিন্তু ভীষণ লাজুক। ক্যামেরার সামনেও
আসে না আর দুটো বৈজ্ঞানিক অভিযানেও সে দেখা দেয়নি। গৌতম অবশ্য তাকে মেইল করেছিল
অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়ে, কিন্তু নেসি উত্তর দেয়নি। যা হোক, ইনভার্নেস পর্যন্ত যাওয়ার
সময় হাতে ছিল না।
বিরনামের জঙ্গলের সামনে শুভদা |
Macbeth
shall never vanquished be, untill
Great
Birnam Wood to high Dunsinane Hill
Shall come
against him.
কেমনভাবে
ডাইনির এই ভবিষ্যৎ বাণী মিলেছিল সে গল্প আমাদের সকলের জানা। শত্রুসৈন্য বিরনাম
জঙ্গলের ডাল কেটে এমনভাবে তার আড়াল থেকে ম্যাকবেথকে আক্রমণ করতে এগিয়ে এসেছিল যেন
মনে হয়েছিল পুরো জঙ্গলটাই উঠে আসছে। সেই জঙ্গল অতিক্রম করার সময়ে আমরা কিছুক্ষণের
জন্য গাড়ি দাঁড় করালাম। শুভদা দেখি নিমেষের মধ্যে হন হন করে জঙ্গল পানে যাচ্ছে। মনে মনে শেক্সপিয়র আওড়াতে আওড়াতে শুভদা কি ঐ ঘন
জঙ্গলে ঢুকবে নাকি? অর্পিতাদিও নামল পিছু পিছু। তারপর দেখি বিরনামকে সাক্ষী রেখে
শুভদা নানা পোজে নিজের ছবি তুলছে, সৌজন্যে অর্পিতাদি।
এবার আমরা
চলেছি উত্তরে। উদ্দেশ্য ক্রেগভিনিয়ান অরণ্যের ‘হার্মিটেজ’। টে নদীর ছোট্ট উপনদী
ব্রানের তীরে তেত্রিশ একর এলাকা নিয়ে দুশো বছরের পুরানো স্কটল্যাণ্ডের এক সংরক্ষিত
এলাকা। কবি
ওয়ার্ডসওয়ার্থ ও অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের পদচিহ্ন অনুসরণ করে আমরাও ঢুকে পড়লাম।
ইংল্যাণ্ডের সবচেয়ে পুরানো ও উঁচু গাছের প্রজাতি ডগলাস ফার, স্কটল্যাণ্ডের এই
অঞ্চলে আছে। তবে সবচেয়ে উঁচু গাছটা গত
জানুয়ারি মাসে ঝড়ে পড়ে গেছে। গাছগাছালির ভেতর দিয়ে আমরা খানিক হেঁটে পৌছে গেলাম
ব্রানের ওপর একটা খরস্রোতের কাছে, ব্ল্যাক লাইন ফল।
সেখানে সামনের জায়গাটায় স্কটল্যাণ্ডের
উপকথার এক অন্ধ চারণ কবি ওসিয়ান–এর নামে ‘ওসিয়ান হল’। সেই হলঘরের দেওয়ালগুলোতে
কাঁচের আয়না লাগানো। পাশের ব্রান নদীর জলোচ্ছ্বাস ঘরটাকে মুখরিত করে রাখে। বয়ে
যাওয়া নদীর প্রতিচ্ছবি এমনভাবে আয়নাগুলোতে এসে পড়ে যেন মনে হয় নদীটা কলকলোচ্ছ্বাসে
চারদিকের দেওয়াল দিয়ে বয়ে চলেছে। কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ এই ঘরটায় বসে ‘ওয়ার্ল্ড অফ ওয়ান্ডার্স’
কবিতাটা লিখেছিলেন। হার্মিটেজে নাকি অনেক লাল কাঠবিড়ালির ডেরা। যদিও তাদের চোখে
পড়েনি, কিন্তু চারিদিকের অপার নিস্তব্ধতার মধ্যে ঝোপের আড়ালে মনে হয় তাদের খুনসুটি
শুনেছি।
হারমিটেজঃ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলেছে ব্রান নদী |
শুভায়ুর সঙ্গে ব্ল্যাক লাইন ফলের সামনে |
ওসিয়ান হল |
আবার যাত্রা। এবার দেখতে গেলাম লক লাগান। ‘লক’ শব্দটা আগেও ব্যবহার করেছি, এর মানে পাহাড় দিয়ে ঘেরা মিষ্টিজলের প্রাকৃতিক জলাশয়। স্কটল্যাণ্ডে এরকম প্রায় তিরিশ হাজার লক আছে যার মধ্যে পাঁচটা বেশ বড়।
এগুলো দশ-বারো হাজার বছর আগে শেষ হিমযুগের সময় মহাদেশীয় হিমবাহ ক্ষয় বা সঞ্চয় কাজের ফলে তৈরি। লক লাগানের ধারে বসে অনেক ছবি তুললাম। পাহাড় দিয়ে ঘেরা ভারি সুন্দর জায়গাটা। জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এই লেকটার একপাশে বাঁধ দেওয়া আছে।
সেদিন
হাতে যা সময় ছিল তাতে শুভায়ু আমাদের পছন্দ করতে বলেছিল -- হয় আমরা বেন নেভিসের
চূড়ায় উঠতে পারি; নয়তো লক লিনহেতে বোটিং করতে পারি -- যেটা খুশি। দুটোর কোনোটাই তখনো দেখা হয় নি। অজানা দেশে এরকম পছন্দ করা ভারি মুশকিল। ‘On the Bonnie Bonnie banks O’ Loch Lomond’ স্কটল্যাণ্ডের
সেই বিখ্যাত ফোক সঙ্গীত আগে শুনেছি। সেই লক লোমণ্ড হলে আলাদা কথা ছিল। ওটা
স্কটল্যাণ্ডের সবচেয়ে বড় লক। একটা লক আগেই দেখে ফেলেছি, তাই আমিই প্রস্তাব দিলাম
বেন নেভিসের চূড়ায় উঠব। অন্যরাও সহমত।
পাহাড় আমাকে বরাবরই একটু বেশি টানে। কলেজ জীবনে ১৯৮৮ সালে গঙ্গোত্রী থেকে
চড়াই উৎরাই সামলে পায়ে হেঁটে গোমুখ উঠেছিলাম, চারহাজার মিটারেরও বেশি উঁচুতে।
এছাড়াও হিমালয়ের অনেক চড়াইতে এক সময়ে উঠেছি।
সারা
ব্রিটেনের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এই বেন নেভিস। মৃত আগ্নেয় পর্বত। তাই মনে মনে প্রস্তুত হলাম,
বিদেশের মাটিতে পর্বত আরোহণের জন্য। গিয়ে দেখি বেশ ভিড়। বাবা! এখানকার পাহাড় চূড়ায়
ওঠার জন্য দেশি-বিদেশি লোকের বুঝি এত আগ্রহ! গাড়ি থেকে নেমেই শুভায়ু ছুটল টিকিট কাটতে। পাহাড়ে চড়তে আবার
কিসের টিকিট? হায়! রোপওয়েতে করে উঠতে হবে। তারই এত ভিড়। ওঠার সময় মনে মনে আরও হতাশ
হলাম চূড়া দেখে। এতো দেখি
অযোধ্যা পাহাড়ের চেয়ে সামান্য বেশি উঁচু। উচ্চতা মাত্র ১৩৪৫ মিটার। তাও সেটা অনেক
নিচের সমুদ্রপৃষ্ঠের সাপেক্ষে।
যাহোক যেখানে নামাল আমাদের সেখান থেকে চ্যাপ্টা
চূড়াটা খুবই কাছে, একেবারে মৃদু ঢালে উঠে গেছে। বৃষ্টি বাদ সাধল। তাই আর বিদেশের
মাটিতে শৃঙ্গারোহণ হল না। যেটা হল সেটা ওখানকার কাঁচঘেরা ক্যাফেটেরিয়াতে বসে জমিয়ে
কফি খাওয়া আর হতাশ ভাবে বেন নেভিসের চ্যাপ্টা চূড়াটা দেখতে দেখতে কৌশানি, চৌকরি বা
ছিটকুল থেকে আমার দেখা সেরা পর্বতচূড়াগুলোর কথা ভাবা। বেন নেভিস থেকে নেমে এসে লক
লিনহের ধারে গেলাম। তাতে বোটিং করলে বোধহয় বেন নেভিসে চড়ার থেকে ভাল লাগত।
বেন নেভিসের ঊপরে কফি পান |
লক লিনহে |
পরের দিন
আমরা সবাই মিলে সেন্ট এন্ড্রুস শহরের বিশ্ববিদ্যালয়, চার্চ এসব দেখলাম। সেন্ট
এন্ড্রুস বিশ্ববিদ্যালয়টা বহু পুরানো, ১৪১০ সালে তৈরি। আমাদের দেশের মোগল
সাম্রাজ্যের তখন গোড়া পত্তনই হয়নি। পাশেই চার্চটা।
সেটা আরও আগের, ১১৫৮
সালের। একসময়ে এটা স্কটল্যাণ্ডের সবচেয়ে
উঁচু রোমান ক্যাথলিক চার্চ ছিল। এখন শুধুই ধ্বংসাবশেষ। চার্চ থেকে বেরিয়ে দেখি
অপূর্ব দৃশ্য আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে। পুব দিকে সামনেই উন্মুক্ত উত্তর সাগর। উঁচু
বাঁধানো পাড়, তার পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম কিনেস বার্ণ জলধারার শুকিয়ে
যাওয়া কর্দমাক্ত খাঁড়িতে। আরিহানের জন্য প্রণীতা
এরপর ফিরে গেলো। অর্পিতাদিও সঙ্গী হল ওর। আমরা বাকিরা গ্ল্যামিস ক্যাসেলের দিকে রওনা দিলাম।
সেন্ট এন্ড্রুসের চার্চের ভগ্নাবশেষ |
এই সেই
ক্যাসেল যার কথা আমরা ম্যাকবেথ নাটকে পেয়েছি। ক্যাসেলের সামনে নাটকের সেই তিন ডাইনির মূর্তি দেখলাম। রাজা রবার্ট
ব্রুসের আমলে ১৩৭৬ সালে স্কটল্যান্ডের ডান্ডির কাছে গ্ল্যামিস দুর্গের কথা প্রথম শোনা
যায়। তার আগে গ্ল্যামিসে ছিল রাজাদের ‘হান্টিং লজ’। ১০৩৪ সালে রাজা দ্বিতীয় ম্যালকম
সেখানে খুন হন। রবার্ট ব্রুসের আমল থেকে স্কটল্যান্ডের অনেক রাজারাণী এখানে
থেকেছেন। এমনকি ব্রিটেনের এখনকার রাণী এলিজাবেথের ছেলেবেলাও কেটেছে এই ক্যাসেলে। দুর্গ দেখতে গেলে গাইডের সাহায্য
নিতেই হয়। রাজপরিবারের লোকেদের ব্যবহৃত আসবাবপত্র, পোশাক, সাজগোজের সামগ্রী,
শিকারের জিনিস, শখ-শৌখিনতার দ্রব্য সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। যে কোনো প্রাচীন
দুর্গের মত এর সঙ্গেও জড়িয়ে আছে কিছু অলৌকিক গল্প। যেমন ১৫৩৭ সালে রাজা পঞ্চম জেমস,
গ্ল্যামিস দুর্গ দখল করার জন্য তাঁর বৈমাত্রেয় পিসি জ্যানেট ডগলাসকে ডাইনি অপবাদ
দিয়ে পুড়িয়ে মারেন। কথিত আছে এই দুর্গে এখনও ঘুরে বেড়ায় তাঁর প্রেতাত্মা। কানে
কানে ফিস ফিস করে নাকি কথাও বলে। চ্যাপেল অর্থাৎ প্রার্থনা ঘরে গাইড আমাদের সবাইকে বসতে
বলেছিলেন -- খালি পেছনের একটা বড় চেয়ার ছেড়ে দিয়ে। সেখানে নাকি জ্যানেটের
প্রেতাত্মা প্রার্থনার জন্য আজও এসে বসে।
পঞ্চদশ
শতক থেকে আরো একটা গল্প চালু হয়েছে। কোনো এক জমিদার তাস খেলতে খেলতে এত মজে
গিয়েছিল যে সঙ্গী খুঁজে না পেয়ে বলেছিল দরকার হলে সে শয়তানের সাথেও খেলতে রাজি ঠিক মধয়রাতে শয়তান নাকি এসেছিল। গাইড আমাদের দুর্গের একটা ঘরের কথা বললেন -- সেই ঘরটা দুর্গের ভিতর
দিয়ে গেলে কোথাও নাকি খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু দুর্গের বাইরে দিয়ে ঘরের জানলাটা
দেখা যায়। শোনা যায় সেই জমিদার নাকি আজও সেই ঘরে তাস খেলে যাচ্ছে।
গ্ল্যামিস দুর্গ |
শেক্সপিয়র
তাঁর নাটকে গ্ল্যামিস দুর্গের গল্প ঢুকিয়েছেন, তবে সেটা কাল্পনিক। শেক্সপিয়রের
ম্যাকবেথ ছিলেন গ্ল্যামিসের জমিদার, তিনি রাজা হবার জন্য রাজা ডানকানকে খুন
করেছিলেন। পরে এই দুর্গের একটা ঘরের নামও
দেওয়া হয়েছে ‘ডানকান হল’। এটা নিশ্চয় দর্শক টানার জন্য। কিন্তু তার
সঙ্গে ইতিহাসের রাজা ডানকানের কোনো সম্পর্ক নেই, এমনকি শেক্সপিয়রের ম্যাকবেথেরও
নয়। নাটকের ম্যাকবেথ রাজা হবার জন্য ডানকানকে খুন করেছিল ইনভার্নেসে। ইতিহাসে আছে
ম্যাকবেথ ডানকানকে মেরেছিল যুদ্ধক্ষেত্রে। সে যুদ্ধ হয়েছিল গ্ল্যামিস দুর্গ তৈরি হওয়ার তিন শতাব্দী আগে। ক্যাসেল থেকে বেরিয়ে একপাশে শেক্সপিয়রের মূর্তি দেখলাম।
স্কটিশ
মেডোজ আর হাইল্যাণ্ড আমরা ইংরাজি সাহিত্যে পড়েছি। সেদিন চাক্ষুস করে জীবন সার্থক
হল।
রাস্তার দুপাশেই রোলিং ল্যাণ্ডস। তাতে কৃষি খামারগুলোতে
জ্যামিতিক নিয়ম মেনে কেউ যেন সোজা সরল রেখা টেনে বিভিন্ন রঙের চতুর্ভুজ এঁকে
দিয়েছে। রঙীন খোপ কাটা সেই জমিতে নানান সবজি চাষ। মনুষ্য বসতি বিরল। দিগন্ত বিস্তৃত
ঢেউ খেলানো মেডোজ। দূরের আকাশের সীমারেখায় পাহাড়ের সারি কখনো অবাক ভাবে তাকিয়ে দেখে ধরিত্রীর
তৃণতটিনীর অবিরাম হিল্লোল, আবার কখনো দেখে মাথার ওপরের মেঘের খেলা। সূর্য
যখন মেঘের আড়ালে, আকাশের গাঢ় ছায়া মেডোজের বুক ঢাকে ঘন সবুজ শ্যাওলায়। আবার যেখানে সূর্য মাতোয়ারা করে আকাশকে, ঝলমলে রোদ নিচের
তৃণভূমিতে হেসে বালিকার মতো লুটোপুটি খায়
কচি কলাপাতা সবুজে। দূরে সাদা ভেড়ার পাল।
স্কটিশ মেডোজ |
জুনিপার ঝোপ |
উদ্ধত যত শাখার শিখরে রডোডেনড্রনগুচ্ছ |
এই সব মন
ভরে দেখতে দেখতে চলে এলাম টে নদীর মোহনায় আরব্রোথ স্বাভাবিক পোতাশ্রয়ে। ডান্ডির থেকে প্রায় সতেরো মাইল
উত্তর পূর্বে টে নদীর ফানেল আকারের খাঁড়িটা অনেক চওড়া, উন্মুক্ত। নর্থ সির হিমেল
হাওয়া হু হু করে বইছে সেখানে। প্রচণ্ড ঝোড়ো ঠাণ্ডা হাওয়া। বেড়াতে যাবার আগে
স্কটল্যাণ্ডের ঠাণ্ডা মোকাবিলার জন্য অনেক গরম পোশাক নিয়ে গিয়েছিলাম। তিন দিনই
আমরা রোদঝলমলে আবহাওয়া পেয়েছি, তাই সেগুলো রাত্রিবেলা ছাড়া বিশেষ কাজে দেয়নি। টে
নদীর মোহনায় সেদিন প্রথম ঠাণ্ডা হাওয়ায় ফোয়ারার মত সমুদ্রজলে গা ভেজালাম। সঙ্গের গরম পোশাকটা সেইসময়ে কাজে
দিল। অনেকক্ষণ ঐ কুয়াশাচ্ছন্ন শান্ত গম্ভীর ঝাপসা সমুদ্রের দিকে আমরা তাকিয়ে
রইলাম।
উত্তর সাগরতীরে |
‘’ Her cheek was wet with North Sea Spray
We walked where tide and shingle meet,
The long waves rolled from far away
To purr in ripples at our feet ….
Out seaward hung the brooding mist
We saw it rolling, fold on fold
And marked the great Sun alchemist
Turn all its leaden edge to gold.’’
সেদিন
সন্ধ্যাবেলায় ফিরে শুভায়ুর লাইব্রেরিতে গৌতম আর শুভায়ু অনেকটা সময় কাটাল। আমিও
একবার উঁকি দিলাম। দেখলাম হাতে গ্লাভস পড়ে দুজন বইপড়ুয়া গভীর আলোচনায় মগ্ন। গ্লাভস
ছাড়া শুভায়ু কাউকে সংগ্রহের বই ঘাঁটতে দেয় না। ওর আছে পৃথিবীর দিকপাল লেখকদের
বিখ্যাত বইয়ের লেখকের সই করা প্রথম সংস্করণ। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোয়েজ, উইলিয়াম গোল্ডিং, ওরহান পামুক,
এ্যালিস মুনরো, অমর্ত্য সেন, হোসে স্যারামাগোর মতো নোবেল জয়ীদের সই করা বই তো
আছেই; তাছাড়াও সালমান রুশদি, বেন ওকরি, টনি মরিসন, নাদিন গর্ডিমারের মতো বেশ কিছু
বিখ্যাত সাহিত্যিকের বইও আছে শুভায়ুর সংগ্রহে। কাজুয়ো ইশিগুরোর সই করা বই ওর
কাছে দেখেছিলাম, পরে তাঁর নাম নোবেল পুরস্কারে দেখে শিহরিত হয়েছি। বই পড়া বা বই
কেনা অনেকেরই হবি কিন্তু এ যেন নেশার মত। গৌতমেরও ওই একই নেশা। বেড়াতে যাবার আগে বেশ কয়েকবার বলেছি, ‘শুভায়ুর
বইয়ের কালেকশনটা কবে যে দেখতে পাব!’ বেড়ানোর আনন্দের থেকেও ওটা যেন আরও বড় আকর্ষণ।
শুভায়ুর লাইব্রেরিতে দুই বইপড়ুয়া বেশ কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গিয়েছিল। তিনদিন সব জায়গায় নিজের গাড়ি করে ঘোরানো, টিকিট
কাটা খাওয়া সবকিছুই শুভায়ু করেছে। আমাদের এক পয়সাও খরচ করতে দেয়নি। ওদের বাড়িতেও
খাওয়া দাওয়ার তোফা ব্যবস্থা রেখেছিল প্রণীতা। অগ্নিজ বিশেষ মিশুকে না হলেও ছোট
ছেলে আরিহান আমাদের সবাইকে খুব মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে ফেলেছিল। বাড়িতে সারাক্ষণ আমার বা
অর্পিতাদির কোলের কাছে বা গলা জড়িয়ে বসে থাকত আদর খাবার জন্য। গান শুনতে ও খুব ভালোবাসে।
পরদিন
আমাদের ফেরার পালা। মন খারাপ করছিল। বিশেষত আরিহানের জন্য, সকালে আমরা যখন বেরিয়ে
আসি ও তখন ঘুমোচ্ছে। শুভায়ু আমাদের গাড়ি করে এডিনবার এয়ারপোর্ট পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে
গেল। ওখান থেকে আমাদের যাত্রাপথ ভাগ হয়ে যাবার কথা। শুভদারা ওখান থেকে মুম্বাই হয়ে
কলকাতা। আমরা হিথরো হয়ে যাব প্যরিসের ওরলি বিমানবন্দরে। শুভদারা চেক ইন করতে চোখের আড়াল হতে না হতেই আমরা ডিসপ্লে বোর্ডে লক্ষ্য করলাম আমাদের ফ্লাইট
বাতিল। হিথরোতে আগের দিন সফটওয়্যার ক্র্যাশ করার জন্য পরদিন সকাল এগারোটায় ফ্লাইট।
তার মানে আমাদের প্যারিস যাত্রাও একদিন পিছিয়ে গেল। এরোপ্লেন কোম্পানি আমাদের থাকা
ও খাওয়ার জন্য একটা হোটেলে পাঠাল। ট্যাক্সি নিয়ে গিয়ে দেখি সেটা এডিনবার শহরের
একটা ফাইভ স্টার হোটেল। আমাদের মন খারাপ, প্যারিস যাওয়া একদিন পিছিয়ে যাওয়া মানে সব
পরিকল্পনা উধাও। লাগেজ রেখে বেরিয়ে পড়লাম। মধ্যযুগীয় ইতিহাসের শেকড়ের ওপর
নব্যধ্রুপদীয় ছন্দে গাঁথা হয়েছে স্কটল্যান্ডের এই রাজধানী শহর। দুজনের হপ-অন-হপ-অফ বাসের সারাদিনের জন্য টিকিট
কেটে উঠে পড়া। প্রথমেই পড়ল স্কটল্যান্ডের জাতীয় কবি রবার্ট বার্নেসের স্মৃতিসৌধ।
অষ্টাদশ
শতকের প্রথম দিককার রোম্যান্টিক আন্দোলনের
সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখা বিখ্যাত কবিতা ‘Auld Lang Syne’ এর
সাথে আমাদের সকলের পরিচয় আছে। কিভাবে? রবীন্দ্রনাথের একটি অতি পরিচিত গানের শিকড়
লুকিয়ে আছে এতে। এই কবিতাটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বিখ্যাত ‘পুরানো সেই দিনের
কথা’ গানটা লিখেছিলেন।
রবার্ট বার্নেসের স্মৃতিসৌধ |
স্কটল্যান্ডের পার্লামেন্ট ভবনের
ডিজাইনটার অভিনবত্ব ভাল লেগেছিল। অনেকের মতে এটা নাকি গত একশো বছরে ব্রিটিশ
স্থাপত্যের সেরা নিদর্শন। সিকিউরিটির কড়াকড়ি বিশেষ নেই।
ডিবেট হল বাদ দিয়ে সবটাই ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অনেকটা সময় ধরে ওখানকার একটা কফি শপে বসে কফি খেলাম। সেটার পাশেই ছিল ‘ডাইনামিক আর্থ’ নামে মিউজিয়াম। তাতে দেখি ছোটদের বিজ্ঞানের নানান মজার মজার হাতে কলমে খেলার সম্ভার। টিকিটের দাম শুনে পালিয়ে এলাম।
ডিবেট হল বাদ দিয়ে সবটাই ঘুরে ঘুরে দেখলাম। অনেকটা সময় ধরে ওখানকার একটা কফি শপে বসে কফি খেলাম। সেটার পাশেই ছিল ‘ডাইনামিক আর্থ’ নামে মিউজিয়াম। তাতে দেখি ছোটদের বিজ্ঞানের নানান মজার মজার হাতে কলমে খেলার সম্ভার। টিকিটের দাম শুনে পালিয়ে এলাম।
বাস
আমাদের হলিরুড প্রাসাদের সামনে নামাল। ব্রিটেনের রাজা রাণীর স্কটল্যান্ডের
বাসস্থান। গেটের বাইরে থেকেই দেখলাম। এরপর যা দেখে মুগ্ধ হলাম এডিনবারের জাতীয় মিউজিয়াম। সারা
পৃথিবীর সংস্কৃতির গ্যালারি, প্রাচীন মিশর ও পূর্ব এশীয় সংস্কৃতি, স্কটল্যান্ডের
ইতিহাসে অতীত থেকে বর্তমানে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, প্রাকৃতিক বিস্ময়
টিরানোসরাস রেক্স সবই রাখা আছে একই ছাদের তলায়। একতলায় ঢুকেই মাঝের বিশাল গ্র্যান্ড গ্যালারিটায় দাঁড়ালে চার
তলা উঁচু এত বড় বাড়িটা দেখলে বলতেই হয় আমরা বিশ্বের বৃহত্তম একক মিউজিয়ামে ঢুকে
পড়েছি। কি অফুরন্ত এর সম্ভার! একদিনে কয়েক ঘণ্টায় তার কতটুকু দেখা সম্ভব। মনে পড়ছে
সাড়ে ছ কোটি বছর আগেকার ডাইনোসর যুগের ডাঙার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রাণী টিরানোসেরাস
রেক্সের কঙ্কালটার কথা।
ছয় মিটার উঁচু, বারো মিটার লম্বা। আরেকটা মনে রাখার মত
জিনিসের কথা বলি। মিলেনিয়াম ঘড়ি। মধ্যযুগীয় ক্যাথিড্রাল আকৃতির দশ মিটার উঁচু
ঘড়িটা ভাস্কর্য, প্রযুক্তি, কারিগরি বিদ্যা আর অভিনবত্বের মিশেল। এটির চারটি অংশে
ফুটে উঠেছে সময়ের ধারা। বিংশ শতাব্দীর সর্বোত্তম ও নিকৃষ্টতম ঘটনার সারাংশ তাতে।
কাঁচের বড়
শোকেসে দাঁড়িয়ে আছে ডলি। ডলির কথা আমরা অনেকেই
শুনেছি, যাঁরা শোনেননি তাঁদের জন্য বলি। ডলি হল একটি স্ত্রী ভেড়া। ৫ই জুলাই ১৯৯৬ সালে এডিনবারের
রসলিন ইন্সটিটিউটে সোম্যাটিক সেল নিউক্লিয়ার ট্রান্সফার প্রক্রিয়ায় ক্লোন করা
প্রথম স্তন্যপায়ী প্রাণী ডলির জন্ম। এর জন্মদাত্রী মা তিন
ভেড়া।
প্রথম
ভেড়ার ডিম্বাশয় থেকে ডিম্বাণু নিয়ে তার নিউক্লিয়াস সরিয়ে নেওয়া হয়। দ্বিতীয়ের প্রাপ্তবয়স্ক কোষ থেকে নিউক্লিয়াস সেই
ডিম্বাণুতে প্রতিস্থাপিত করা হয়। আর তৃতীয় প্রাণীটি এভাবে পাওয়া ভ্রূণটিকে গর্ভে
ধারণ করেছিল। সঙ্গীত শিল্পী ডলি পার্টনের নাম অনুসারে তার নামকরণ করা হয়। বেশ
কয়েকটি সন্তানের জন্ম দিয়ে সাড়ে ছয় বছর বয়সে ফুসফুসের জটিল রোগে মারা যায়। এইভাবে
ডলি কেবল একটি ভেড়া নয়, ডলি হল একটি ইতিহাস, বিজ্ঞানের অভিনব জয়যাত্রার
সংক্ষিপ্তসার। এর পরে বিজ্ঞানীরা অন্যান্য প্রাণী যেমন শুয়োর, হরিণ, ষাঁড় প্রভৃতির
ক্লোনিং শুরু করেন।
গৌতম ও ভেড়া ডলি (ডলি শোকেসের ভিতর) |
‘আর্থার
সিট কফিন’ হল এখানকার আর একটি আকর্ষণ। এডিনবার দুর্গের এক মাইল পূর্বে উত্তর সাগর
পাড়ে আর্থার সিট হল মৃত আগ্নেয় পাহাড়। কার্বোনিফেরাস যুগের। পরে কোয়াটার্নারি
হিমযুগে মহাদেশীয় হিমবাহ পশ্চিম থেকে পুবে উত্তর সাগরের দিকে যাওয়ার সময়ে ক্ষয়ের
ফলে ‘ক্রাগ ও পুচ্ছ’ ভূমিরূপ তৈরি করে। মানে উঁচু ঢিপি ও তারপর পুবদিকে সমুদ্র
অবধি নরম শিলা চেপ্টে আছে লেজের মত। সেখানে গুহার ভিতর, ১৮৩৬ সালে কয়েকটা অল্পবয়সী
ছেলে খরগোশ শিকার করতে গিয়ে সতেরোটা ক্ষুদ্র কফিন আবিষ্কার করে ফেলে যার ভিতর ছোটো
কাঠের মানবদেহ প্রথাগত পোশাক পড়িয়ে রাখা আছে। এইরকম কফিন খুঁজে পাওয়াকে কেউ কেউ
বলে জাদুবিদ্যা, কেউ মনে করান ব্রুক আর হেয়ারের পরপর ষোলোটা খুনের কুখ্যাত ঘটনার কথা,
আবার কেউ বা কল্পলোকের রাজা আর্থারের গল্প খুঁজে পান। এইরকম আটটা কফিন এই
মিউজিয়ামে রাখা আছে।
যাঁরা
নোবেল প্রাইজ পান তাঁরা তাঁদের নোবেল মেডেলের তিন কপি গিল্টি করা ডুপ্লিকেট অর্ডার
করতে পারেন। ২০১৩ সালে পিটার হিগস পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ পান। বিখ্যাত হিগস
বোসনের জন্য পাওয়া মেডেলের ব্রোঞ্জের গিল্টি করা একটা প্রতিরূপ এই মিউজিয়ামকে দিয়েছেন।
নোবেল মেডেল কেমন দেখতে হয় খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের সেদিন হল। এই মিউজিয়ামের আর একটা মূল্যবান সংগ্রহের কথা বলে শেষ করব। সেটা হল মবি, পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাণী স্পার্ম মানে দাঁতাল তিমির একটা উদাহরণ, চল্লিশ ফিট বড়। সেটি ফোর্থ নদীর মোহনায় এসে মারা যায়। দেড় টনের ওজনের তার মাথার খুলিটা এখানে রাখা আছে।
নোবেল মেডেল কেমন দেখতে হয় খুব কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের সেদিন হল। এই মিউজিয়ামের আর একটা মূল্যবান সংগ্রহের কথা বলে শেষ করব। সেটা হল মবি, পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাণী স্পার্ম মানে দাঁতাল তিমির একটা উদাহরণ, চল্লিশ ফিট বড়। সেটি ফোর্থ নদীর মোহনায় এসে মারা যায়। দেড় টনের ওজনের তার মাথার খুলিটা এখানে রাখা আছে।
মুখোমুখি নয়, মু্খোশের আড়ালে |
সারাদিন
ঘুরে ক্লান্ত হয়ে হোটেলে ফিরে স্নান সেরে নিচে ডাইনিং হলে ঢুকে দেখি এলাহি
ব্যবস্থা। যত খুশি খাও। পরদিন সকালের ব্রেকফাস্ট করে আমাদের প্লেন ধরার জন্য হোটেল
থেকে বেরিয়ে পড়তে হবে। সেই খাওয়ার ও দারুণ ব্যবস্থা। বেড়ানোর মাঝে প্লেন বাতিলের
জন্য প্যারিস ভ্রমণ একদিন কম হওয়ায় প্রথমে মন খারাপ হলেও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ তা
পুষিয়ে দিয়েছে। বিনা পয়সায় থাকা খাওয়ার উত্তম ব্যবস্থাই শুধু করেনি, ক্লেম করা
কম্পেনসেশনটাও পরে মিটিয়ে দিয়েছে। বিদেশ ভ্রমণের মাঝে এই রকম মাঝে মধ্যে প্লেন
বাতিল হলে তাহলে একেবারে মন্দ হয় না!
(প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, জুলাই ২০১৮, পরিমার্জিত)
(প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, জুলাই ২০১৮, পরিমার্জিত)
শেষ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
Bhari sundar hoeche... porte bhalo lage... janao galo anek kichu, bisheshato aakti jaega gore othar bhougalik byakhya guli sacharachar bhraman kahini te thake na... segulo choto, kintu tahya samridhdha haoar jonne galpo bala ta ke aro samridhdha koreche
ReplyDelete