শেক্সপিয়র থেকে বিটোভেনের দেশে (তৃতীয় ও শেষ পর্ব)
স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ থেকে লন্ডনের
হিথরো হয়ে আমাদের প্যারী যেতে হয়েছিল। প্যারীর ওরলি এয়ারপোর্টে নেমে প্রথম কাজ হল
আটচল্লিশ ইউরো দিয়ে এক এক জনের আটচল্লিশ ঘণ্টার প্যারী পাস কেনা। প্যারীর সমস্ত
মিউজিয়ামে এটা ব্যবহার করা যায়, আর সবচেয়ে বড় কথা হলো লাইন দিতে হয় না। এরপর বাস আর তার পরে মেট্রো ধরলাম। মেট্রোতে একগোছা টিকিট কিনলে অল ডে পাসের থেকেও সস্তা পড়ে।
থাকার জায়গাটা খুঁজে পেতে বেশ কিছুটা
সমস্যা হল। এখানকার বাসিন্দারা ফরাসির বাইরে কোন ভাষাই বোঝে না। ফলে জিপিএস দেখে
সঠিক ঠিকানা খুঁজে পেতে সময় লাগল। ঘর দেখে মুষড়ে পড়লাম। ইংল্যান্ডের থাকার
বাসাটা যতটা বড় আর সাজানো ছিল, এটা তার তুলনায় অনেক ছোট আর অগোছালো। মালিক অল্প
বয়সী একটি ইন্দোনেশিয়ার ছেলে। তার জামাকাপড় আর অন্তত তিরিশ জোড়া জুতোতেই ঘরের
আলমারি আর বারান্দা ঠাসা। ছোটবেলায় বাবা আমাদের হোল্ডল ঘাড়ে করে বেড়াতে নিয়ে যেত। কষ্ট করে ঘুরেও কত বেশি জায়গা দেখলাম –-- সেটাই ছিল
আসল ব্যাপার। কলেজ জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে যখন
শিক্ষামূলক ভ্রমণে যেতাম, তখন সব কিছু ঠিকঠাক না হয়ে বরঞ্চ থাকা, খাওয়া ঘোরা নিয়ে
নানান বিভ্রাট হলেই যেন অ্যাডভেঞ্চারের ছোঁয়াতে বেড়ানোটা আরও বেশিদিন স্মৃতিপটে
ধরা থাকত। কিন্তু এই বয়সে আরাম করে থাকা খাওয়া না হলে বেড়ানোর আনন্দই বুঝি মাটি।
ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ডে থাকার
ব্যবস্থা অতটা ভাল হওয়ার পর এই জায়গাটা বড়ই ছোটো লাগল। রান্নার সুবিধা সবই আছে,
বাসনও প্রচুর, ছোটো ফ্রিজও আছে, কিন্তু তা ছেলেটির খাবারদাবারে ঠাসা। বুঝলাম
ছেলেটির নিজের থাকার জায়গা এটাই। ভাড়া পেলে কদিনের জন্য অন্যত্র থাকে। গৌতম আমায়
একটা গল্প বলল। সাহা ইন্সটিটিউটের প্রফেসর সুদেব ভট্টাচার্য একবার রোমে গিয়ে একটা
ঘর দেখতে গিয়েছিলেন। ঘরটা একটা খাটের মাপের, দরজা খুলেই সোজা খাটে উঠতে হবে।
কিন্তু বাথরুমটা কোথায়? ঘরে ঢোকার মুখে একটা বোতাম, পা দিয়ে টিপতেই খাটটা সোজা
নব্বই ডিগ্রী কোণে উঠে গেল। দেখলেন খাটের তলায় একটা কমোড। ভাবুন একবার! আমাদের
কামরাটা তো সে তুলনায় অনেক ভালো।
প্যারী শহরের প্রায় মাঝামাঝি সেইন
নদীর উপরে দুটি ছোট দ্বীপ আছে। তার একটির নাম শহর দ্বীপ (Ile de la Cite) আর
অন্যটা সন্ত লুই দ্বীপ (Ile St. Louis)।
খ্রিস্টজন্মের
প্রায় তিনশো বছর আগে থেকে পারিসি নামে এক উপজাতি এখানে বসবাস করত। খ্রিস্টপূর্ব ৫২ অব্দে রোমের জুলিয়াস সিজার এই দেশ
জয় করেন। তখন ফ্রান্সকে বলা হত গল আর তার অধিবাসীদের বলা হত গলোয়া বা পারিসি।
রোমানরা সেইন নদীর ধারে এক নতুন শহর পত্তন করে তার নাম দিল লুতেশিয়া। এই লুতেশিয়া
পারিসিদের নাম নিয়ে হয়ে গেছে প্যারী।
পরের দিন সকালে আমরা গেলাম নোতর দাম
গির্জা দেখতে, প্যারীর সব থেকে প্রসিদ্ধ ও গুরুত্বপূর্ণ গির্জা। ১১৬৩ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় আর শেষ হয় চতুর্দশ
শতাব্দীতে। তারপর বিভিন্ন সময়ে প্রচুর
সংস্কার করা হয়েছে। নেপোলিয়নের অভিষেক এখানেই হয়েছিল। ১৮৩১ সালে ভিক্টর হুগো গথিক
শৈলীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে এই গির্জার পটভূমিতে একটি উপন্যাস রচনা করেন।
১৮৩৩ সালে ফ্রেডরিক শোবেরিক তার ইংরাজিতে অনুবাদ করে নাম দেন ‘Hunchback Of Notre Dame’। আর সঙ্গে সঙ্গে উপন্যাসটি পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে পড়ে,
একই সঙ্গে গির্জাটিও। সেই সময়ে গথিক শিল্পকলার প্রতি অবজ্ঞাকে হুগো ফুটিয়ে
তুলেছেন। গির্জার ঘষা রঙিন কাঁচের ওপর শিল্পকর্ম দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। হুগো
দেখিয়েছিলেন যে গির্জার ভিতর আলো বাড়ানোর জন্য সেই কাঁচের প্যানেলগুলোর বদলে সাদা
কাঁচ বসিয়ে ঐতিহ্যবাহী নিদর্শনগুলোকে নষ্ট করা হচ্ছিল নির্মমভাবে। তাঁর লেখনীর মাধ্যমে গির্জাটি পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে পড়ে
ও মানুষের কাছে এর নান্দনিকতার দিকটি গুরুত্ব লাভ করে।
নোতর দাম গির্জা |
রোজ উইন্ডো |
মনে পড়ে, ছোটবেলায় মেলায় গিয়ে অবশ্যই ক্যালিডোস্কোপে চোখ রাখতাম -- একটা লম্বা নলের ভেতরে ভেসে উঠত ভাঙা রঙিন চুড়ির নতুন নতুন কারুকার্য। নতর দাম ক্যাথিড্রালে সকালের সূর্যের আলো রোজ উইন্ডোগুলোর মধ্যে দিয়ে বিচ্ছুরিত হয়ে ভেতরটায় অদ্ভুত এক আলোছায়ার ম্যাজিক তৈরি করেছিল। বিশ্বাস করুন, মনে হচ্ছিল সূর্যের আলোর সাত রঙের গহন রহস্য বুঝি ওই গথিক জানলায় নিহিত আছে। বৃত্তের কেন্দ্রের গোলাকার কাঁচ -- মনে করা হয় যেন বর্তমান মুহূর্তের প্রতীক। আর চারদিকের অবয়ব, গোলাপের পাপড়ির মত ছড়ানো স্থাপত্য -- যেন সময়ের অসীমতা। ইউরোপের ইতিহাসের নানা ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক টানাপড়েন সহ্য করেও ভঙ্গুর কাঁচগুলো সময়কে অতিক্রম করে আজও বেঁচে আছে। ব্রোঞ্জ আর পাথরের দারুণ সব মূর্তি ভেতরে এক মোহময় পরিবেশ তৈরি করেছে। দেওয়ালের জায়গায় জায়গায় বা দরজা-জানলার গথিক খিলানের খাঁজে খাঁজে আছে কাঠের নিপুণ খোদাই কারুকার্য যাতে গাঁথা আছে বাইবেলের গল্প বা ইউরোপের ইতিহাস। ঘষা কাঁচের প্যানেলে রং তুলির টান ফুটিয়ে তুলেছে কত রাজপরিবারের ইতিকথা।
গির্জার ভিতরে বেদীর পেছনে জোয়ান অফ
আর্কের স্ট্যাচু দেখলাম। এই মহীয়সী বীরকন্যা ফ্রান্সের এক করুণ ইতিহাসের সাক্ষী।
ইংরেজদের সঙ্গে শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধে (১৩৩৭-১৪৫৩) এক সময় তিনি ফ্রান্সের
সৈন্যবাহিনীকে নেতৃত্ব দেন। মিউজ নদীর তীরে দঁরেমি গ্রামে এক সাধারণ কৃষক পরিবারে
১৪১২ সালে তাঁর জন্ম। ফ্রান্স তখন ইংরেজদের শাসনাধীন। ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম হেনরির পুত্র ষষ্ঠ হেনরি
(১৪২১-১৪৭১) ফ্রান্সের সিংহাসনে আরোহণ করলে ফ্রান্সের রাজা সপ্তম চার্লস পালিয়ে
যান। জোয়ান লেখাপড়া জানতেন না। কথিত আছে, মাত্র তেরো বছর বয়সে মাঠে ভেড়ার পাল
চড়ানোর সময়ে দৈববাণী শুনতে পান যে তাঁকেই মাতৃভূমির স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে
ফ্রান্সের রাজাকে ফেরাতে হবে। এই দৈববাণী তাঁর জীবনকে আমূল পাল্টে দেয়।
জোয়ান অনেক চেষ্টা করে পলাতক রাজার সঙ্গে যোগাযোগ করেন ও সৈন্য সংগ্রহ করেন। এর পরের ইতিহাস আমাদের অজানা নয়। জোয়ান সাদা পোশাক পরে সাদা ঘোড়ায় চেপে পঞ্চক্রুশধারী তরবারি হাতে ৪০০০ সৈন্য নিয়ে ১৪২৯ সালের ২৮ এপ্রিল অবরুদ্ধ নগরী অরলেয়াঁয় প্রবেশ করেন ও জয়লাভ করেন। একের পর এক শহর ইংরেজদের হাত থেকে উদ্ধার করেন। ১৬ জুলাই সপ্তম চার্লস আবার ফ্রান্সের রাজা হন। এর পরের করুণ ইতিহাস কে না জানে! ইংরেজরা জোয়ানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে একদল বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক কর্মী, বার্গেন্ডিদের সাহায্যে তাঁকে আটক করে, ইংরেজ পাদ্রির অধীনে তাঁর বিচার হয়। ডাইনি অপবাদ দিয়ে ১৪৩১ সালে তাঁকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর জোয়ান অফ আর্ক হয়ে ওঠেন ফরাসিদের কাছে এক প্রেরণার উৎস। অবশেষে ১৪৫৩ সালে ফরাসিরা তাদের দেশ থেকে ইংরেজদের চিরতরে তাড়াতে সক্ষম হয়।
কঁসিয়ার্জেরি |
১৭৯৯ সালে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট
ক্ষমতায় এলেন। কিছুদিন পর তিনি রাজনৈতিক চাল চেলে নিজেকে ফ্রান্সের সম্রাট ঘোষণা
করলেন। জনসাধারণও চাইছিল একজন শক্তিশালী নেতা। ফরাসি বিপ্লবের নিট ফল হল যে রাজাকে
সরিয়ে এক সম্রাটকে সিংহাসনে বসানো হল। তবে সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা আর
প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন ফ্রান্স তো বটেই, ততদিনে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল।
সেইন নদীর তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে
পৌঁছলাম আর্ট গ্যালারী মুজে দর্সেতে (Musée d'Orsay)। চিত্রকলার ইতিহাসে উনিশ শতকের
গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ইম্প্রেশনিজম। আধুনিক বিমূর্ত শিল্পের উত্থানে এর গুরুত্ব
অসীম। ১৮৭৪ সালে প্যারীতে অনুষ্ঠিত হয় ইম্প্রেশনিস্টদের
প্রথম চিত্র প্রদর্শনী। এখানে শিল্পী ক্লদ মনের একটি ছবি ‘ইম্প্রেশন সানরাইজ’
দর্শকদের বিদ্রূপ কুড়িয়েছিল। লুই লেভয় নামে এক শিল্প
সমালোচক ছবি আঁকার এই ঢংটিকে ব্যঙ্গ করে নাম দিলেন ইম্প্রেশন। শিল্প আন্দোলনের
নতুন মোড় সেই ইম্প্রেশনিজমের বিরাট সংগ্রহশালা হল মুজে দর্সে। সেইন নদীর পাড়ে
বিশাল এলাকা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা পথ হেঁটে আসায় বেজায় খিদে পেয়েছে। সকালে
অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বানিয়ে আনা চিকেন পাস্তাটার সদ্ব্যবহার করে তবেই গেটের দিকে
এগোলাম। এটা আগে গ্যারে দর্সে নামে একটা পুরানো রেল স্টেশন ছিল। এতটা বিশাল চত্বর
কোনো মিউজিয়ামের বাইরে আগে কখনো দেখিনি। ঢোকার আগে বিশাল চাতালে খোলা আকাশের তলায়
দেখি ছটা অসাধারণ মূর্তি ফুটিয়ে তুলেছে ছটা মহাদেশকে।
মুজে দর্সের বাইরের মূর্তি |
উনিশ শতকের শেষ দিকে ক্লদ মনে, এদগার
দেগা, পিসারো, রেনোয়া এবং এদের সমসাময়িক কয়েকজন ফরাসি চিত্রশিল্পী গতানুগতিক
সর্বজনস্বীকৃত রীতি থেকে সরে এসে নতুনভাবে ছবি আঁকতে শুরু করেন। স্টুডিওর বাইরে
খোলা আকাশের নিচে ছবি আঁকতে তাঁরা বেশি আগ্রহী। রচনা-মুহূর্তে শিল্পীর অনুভূতিকে
গুরুত্ব দিয়ে বর্ণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার আলোকে রামধনুর সাতটি রঙকে ব্যবহার করে
ব্রাশের স্ট্রোকে গতি এনেছেন তাঁরা। আলোর প্রতিফলনের
পরিবর্তনের সঙ্গে গতিময় বিষয়বস্তু যেমন -- ছুটন্ত ঘোড়া, ব্যালে ড্যান্স,
কুয়াশাচ্ছন্ন আকাশ ইত্যাদির আকার, আকৃতি ও গড়নের পরিবর্তন ফুটিয়ে তোলাই ছিল এইসব
ইম্প্রেশনিস্টদের লক্ষ্য।
ইমপ্রেশনিস্টদের প্রথম প্রদর্শনীতে ক্লদ মনে ‘পপি
ফিল্ড’ নামে যে ছবিটি দিয়েছিলেন সেটা দেখলাম। এক গ্রীষ্মের দিনে তাঁর স্ত্রী
ক্যামিল ও ছেলে জাঁ আফিমের খেত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অসাধারণ। এছাড়া ওনার আঁকা--
‘গিভার্নি ব্রিজ’, ‘ম্যাগপি’, ‘ব্লু ওয়াটার লিলি’ ছবিগুলো বিশেষ উল্লেখযোগ্য। ভ্যান
গগের আত্মপ্রতিকৃতি এবং লিলিফুল দেখলাম। ১৮৮৮ সালে তাঁর আঁকা ‘স্টারি নাইট ওভার দ্যা রোন’ খুব
বিখ্যাত। শান্ত, পরিষ্কার তারা ভরা আকাশে প্রত্যেকটা তারা যেন এক একটা জ্বলন্ত
আগুনের গোলা। এছাড়া আরও অনেক পৃথিবী বিখ্যাত ছবির মধ্যে আছে গঁগার আঁকা ‘তাহিতিয়ান
ওম্যান’, সেজানের আঁকা ‘বেদার্স’; ইনগ্রেসের ‘স্প্রিং’ বা ‘বসন্ত’; রেনোয়ার ‘ডান্স
ইন দ্যা কান্ট্রি’। আরও কত অসংখ্য ছবি মন টেনেছে সেই
সময়, সব এখন মনেও নেই।
ক্লদ মনের আঁকা গিভার্নি ব্রিজ ও ভ্যান গগের আঁকা লিলিফুল (ডা্নদিকে) |
অগুস্ত রঁদার ‘গেটস অফ হেল’ |
‘উগোলিনো এন্ড হিজ সনস’ |
পম্পন ছিলেন রঁদার সহকারী। পরে শুধু তিনি পশুর মূর্তি বানিয়েছিলেন, তাদের ভেতরের
রূপ ফুটিয়ে তাদের জীবন্ত করতে চেষ্টা করতেন। তাঁর তৈরি ‘পোলার বিয়ার’ ভাস্কর্য খুব
ভাল লাগল। ‘স্মল ডান্সার্স-এজেড ফোর্টিন’-- দেগাস এর এই ভাস্কর্যটি খুবই বিতর্কিত।
নাচের পোশাকে চোদ্দ বছরের মোমের এই মূর্তিটিতে দেগাস মেয়েটির মুখটিকে বানরের মতো
বানিয়ে পাশবিকতা ফুটিয়ে তুলেছিলেন ও ১৮৮০ সালের ইম্প্রেশনিস্টদের প্রদর্শনীতে
বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। তিনি একজন অতি-বাস্তবতার ও প্রকৃতি বৈজ্ঞানিকের আঙ্গিকে
নৃতত্ত্ববিদের মতো মেয়েটির মুখের মধ্যে দিয়ে তখনকার সমাজের পাপময় জগতের পঙ্কিল
প্রতিশ্রুতিগুলির প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। কোনরকম ভণ্ডামি না করে তিনি সমাজের মুখোশ
খুলে দিতে দ্বিধা করেননি। এই বিতর্কিত মূর্তিটি প্রদর্শনের পর আর কোনো মূর্তি তিনি
প্রকাশ্যে আনেননি। ১৯১৭ সালে তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্টুডিও থেকে দেড়শোটি মোমের বা
মাটির মূর্তি পাওয়া যায়।
মিউজিয়াম
থেকে বেরিয়ে আমরা সেইন নদীর ধারে আবার এলাম। সঙ্গের প্যারীর ম্যাপ দেখাচ্ছে যে
এরপর আমরা টুইলারিস বাগান হয়ে লো-অরেঞ্জেরি মিউজিয়ামে যাব। একটা কথা বলে রাখি,
ফরাসি নাম উচ্চারণ বাঙালীর কাছে বড়োই গোলমেলে ঠেকে, জিভের কোন অংশ কোনদিকে ওল্টাব
বুঝতে পারি না। সেজন্য ভুল হলে ক্ষমা করবেন। এবার আমাদের সেইন নদীটা টপকাতে হবে।
সামনেই ব্রিজ পেলাম। নদীর শোভা দেখতে দেখতে ব্রিজ দিয়ে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ দেখি ব্রিজের ধারে রেলিঙের গায়ে তারের জাল আর
তাতে অসংখ্য তালা ঝোলানো আছে। ব্যাপারটা প্রথমে বুঝতে পারিনি। তারপর বুঝলাম।
ছোটবেলায় ‘ববি’ নামে একটা হিন্দি সিনেমা খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তাতে একটা গান খুব
হিট করেছিল। প্রেমিক প্রেমিকা ঋষি কাপুর আর ডিম্পল কাপাডিয়া দুজনে মিলে গেয়েছিল,
‘হাম তুম এক কামরে মেঁ বন্ধ হো অর চাবি খো যায়’। এখানেও প্রায় সেই রকমই ব্যাপার।
প্রেমিক প্রেমিকারা তাদের প্রেমের শিকলে চিরকাল বাঁধা পড়তে তালা লাগিয়ে চাবিটা
হারিয়ে ফেলতে চায়, আর তাই সেই চাবি সেইন নদীর জলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। তাদের অটুট
বন্ধনের সাক্ষী থাকে স্বপ্ননগরী প্যারীর বুকে সেইন নদীর ওই ব্রিজের গায়ে ঝোলানো
তালাগুলো।
টুইলারিস গার্ডেন |
মুজে দর্সেতে ওনার আঁকা একটি ব্রিজের
ছবি দেখেছিলাম যেটা লিলিফুলে ভরা একটা জলাশয়ের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালের রূপ ফুটিয়ে
তুলেছিল। কিন্তু এই গ্যালারির একতলার দুটো
হলঘরে ঢুকে মনে হল লিলিফুলে ভরা নীল দিঘিতে ভেসে বেড়াচ্ছি বা বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছি। দুটো ডিম্বাকৃতি বিশাল হলঘরে দেওয়ালের এক প্রান্ত
থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত কেবলই অসাধারণ লিলিফুলের শোভা। ঘরদুটোর নাম দেওয়া হয়েছে
‘নিম্ফিয়াস’, - ওয়াটার লিলির বৈজ্ঞানিক নাম। দুটো ঘরে সব মিলিয়ে মনেটের আটটা
তৈলচিত্র আছে। চওড়ায় সবকটা চিত্রের মাপ দু’মিটার। লম্বায় সবচেয়ে বড় ছবি ‘মর্নিং
উইথ টু উইলোস’-এর মাপ সতেরো মিটার। আর সবচেয়ে ছোটটার মাপ ছয় মিটার। বিভিন্ন রঙের ওয়াটার
লিলি বিভিন্ন রূপে উদ্ভাসিত।
ভোরের আলোয় শিশির সিক্ত
আধফোটা লিলি, দুপাশের দুটো উইলো গাছের মাঝে কুয়াশায় ঢাকা দিঘিতে লিলি, বসন্তের
দুপুরের হাওয়ায় দোল খাওয়া আগাছা আর জলজ গুল্ম ভরা জলে লিলি, গাছের পাতার আড়াল দিয়ে
আসা তির্যক রবিকিরণে রামধনু রঙের ঢেউয়ের দোলায় সাঁঝের দোদুল্যমান লিলিদল, উইলো
ঝোপের ছায়ায় রাতের কাজল কালো জলের গাঢ় ধূসর
নীল লিলি, ভেসে যাওয়া সাদা মেঘের প্রতিচ্ছবিতে উদ্ভাসিত হাস্যময়ী প্রশান্তিভরা
সকালের সাদা লিলি – অভূতপূর্ব। কেবল দিনের সব মুহূর্তই ধরা নেই এই নানা রঙের লিলিতে -- জলের প্রতিচ্ছবির ব্যাপ্তিতে
যেন ধরা আছে সারা বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড।
ক্লদ মনের ওয়াটার লিলি |
মনে থেকে ঘোর যেন কাটছিলই না। ঐ
মিউজিয়ামে আরও কিছু বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবি দেখলাম। পল সেজানে, আঁরি মাতিস,
পাবলো পিকাসো, অগুস্ত রেনোয়া প্রমুখ। ইম্প্রেশনিস্ট আমল চলেছিল ১৮৬০ থেকে ১৮৯০
অবধি, কিন্তু এই তিরিশ বছরেই তা তিনশো বছরের ফরাসি চিত্রশিল্পের ধারা পালটিয়ে দেয়।
তবে জনসাধারণ তা বুঝতে অনেক সময় নিয়েছিল। আগে সরকারি সালোঁ অর্থাৎ প্রদর্শনী ছাড়া কোথাও ছবি দেখানো যেত না আর ধনী না
হলে ছবিও কেনা যেত না। ইম্প্রেশনিস্ট আমল থেকে অনেক ছবির গ্যালারি ও দোকান চালু
হয়।
এরপর আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটা
বিশাল খোলা চারকোণা চক এর সামনে এলাম। সাড়ে আট হেক্টরের বেশি এলাকা নিয়ে প্লেস ডি
লা কনকর্ড (Place
de la Concorde) ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় চক। তবে এই চক অনেক করুণ ইতিহাসের সাক্ষী। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের
শুরুতে এখানের পঞ্চদশ লুইয়ের একটি স্ট্যাচু ভেঙে ফেলা হয়। এই চত্বরটার নাম পাল্টে
রাখা হয় প্লেস ডি লা রেভোলিউশন। নতুন বিপ্লবী সরকার এখানে একটি গিলোটিন স্থাপন
করে। ১৭৯২ সালে প্যারীতে প্রথম মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের জন্য এখানে গিলোটিন ব্যবহার
করা শুরু হল। গিলোটিন আমরা সবাই জানি, হাড়িকাঠে গলা ঢুকিয়ে খাঁড়া দিয়ে বলি দেবার
যান্ত্রিক সংস্করণ। রাজা ষোড়শ লুই ছিলেন ফ্রান্সের বংশ পরম্পরার শেষ রাজা। লোক
হিসাবে তিনি খুব খারাপ ছিলেন না। কিন্তু রাজাই সর্বেসর্বা এই মনোভাব তাঁর ছিল এবং
সেটাই তাঁর পতনের কারণ। রাজ্যের শাসনব্যবস্থায় তিনি বেশ কিছু ভাল সংস্কার করতে
চেয়েছিলেন, যেমন সকলের কাছ থেকে আয়কর নিয়ে সর্বসাধারণের করভার লাঘব করা। কিন্তু
অভিজাত শ্রেণি আর উচ্চপদস্থ ধর্মযাজকরা যারা কর দিত না তারা বাধা দেয়। রাজার নিজের
লোকেরাও তাই। রাজা তখন এমন একটা কাজ করলেন যা তার আগে একশো পঁচাত্তর বছরে কোনও
রাজা করেননি। তিনি একটা সভা ডাকলেন যার নাম এত্তা জেনেরো, মানে সাধারণ রাষ্ট্র। এই
সভায় তিন রকমের সদস্য থাকত। অভিজাত শ্রেণি, উচ্চপদস্থ ধর্মযাজক আর সাধারণ শহরবাসী
লোকের নির্বাচিত প্রতিনিধি যাঁরা একটা বিশেষ অঙ্কের বেশি কর দিতে পারতেন অর্থাৎ
যাদের বুর্জোয়া বলা হত।
প্লেস ডি লা কনকর্ড |
রাজা এই এত্তা জেনেরো ডাকলেন এই মনে
করে যে সাধারণ লোকের প্রতিনিধিরা অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে গিয়ে তাঁর সকলের উপর
চাপানো কর নীতি সমর্থন করবে। তৃতীয় দলের লোকরা জানাল যে তারা রাজাকে সমর্থন করবে
কিন্তু তার আগে ফরাসি দেশের একটা লিখিত সংবিধান তৈরি করতে হবে। রাজা তাতে রাজি নন
কারণ তাঁকেও তবে সেই সংবিধান মেনে চলতে হবে আর ওনার সর্বেসর্বা নীতি তখন খাটবে না।
কিন্তু বুর্জোয়ারা নাছোড়বান্দা। রাজা তখন বাধ্য হলেন মেনে নিতে। সাময়িকভাবে
বিক্ষোভ কিছুটা কমলেও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ষোড়শ লুই এর সময়ে সাংঘাতিক খারাপ হতে
শুরু করল। গরিবদের প্রধান খাদ্য গমের রুটি। গমের দাম অসম্ভব বেড়ে গেল। দেখা দিল
প্রচণ্ড অরাজকতা, লুঠতরাজ, খুনোখুনি, দুর্গ দখল, অস্ত্রাগার লুণ্ঠন প্রভৃতি।
‘সাম্য মৈত্রী আর স্বাধীনতা’, বিপ্লবের এই বাণী নিয়ে শোষিত জনগণ ঝাঁপিয়ে পড়ল
অভিজাত শ্রেণির ওপর। তাদের প্রধান দাবি ছিল পেট ভরে খাবার।
৫ অক্টোবর ১৭৮৯ অনেক লোক, বিশেষত মহিলারা রাজা
ষোড়শ লুই এর বাসস্থান, প্যারীর দক্ষিণে ভার্সাই প্রাসাদের সামনে সমবেত হয়েছিল
খাদ্যের দাবি নিয়ে। প্রবাদ আছে যে লোকদের ‘রুটি চাই’ চিৎকার শুনে তাঁর স্ত্রী রানি
মারি আন্তোয়ানেৎ নাকি বলেছিলেন যে রুটি না থাকলে কেক খায় না কেন?
বিক্ষোভের ভয় দেখিয়ে রাজাকে
বাধ্য করা হল জমিদারি প্রথা আর অভিজাত শ্রেণির বিশেষ সুবিধা তুলে দেবার জন্য আইন
চালু করতে। রাজা বাধ্য হলেন প্যারী এসে থাকতে। নতুন সংবিধানে রাজার ক্ষমতা অনেক
কমিয়ে দেওয়া হল। রাজ্য চালাতে লাগল বিপ্লবী সংগঠন। এই অবস্থায় রাজা সপরিবারে
পালাতে গিয়ে ধরা পড়লেন। বন্দি করে রাখা হল তাঁদের। শুরু হল বিপ্লবের বীভৎসতা।
রবেস্পিয়েরের মূর্তি, কঁসিয়ার্জেরি |
ওবেলিস্ক |
এরপর আমরা এসে পড়লাম পৃথিবী বিখ্যাত প্রশস্ত
রাজপথ শ্যঁজেলিজেতে। প্লেস ডি লা কনকর্ড থেকে আর্ক দ্য ট্রয়ম্ফ পর্যন্ত প্রায় দু’কিলোমিটার লম্বা সত্তর
মিটার চওড়া সুসজ্জিত রাস্তা। এর ধারে ধারে সাজানো ফুলের বাগান, দামি দামি সুসজ্জিত
সব মণিহারী দোকান, দারুণ দারুণ বুটিক, আধুনিকতম ডিজাইনের বাড়ি, হোটেল, নাইটক্লাব
ইত্যাদি। আমাদের মত শয়ে শয়ে দেশী বিদেশী পথচারী ওই পথের ধারের বুলেভার্ড দিয়ে
হেঁটে চলেছে সারাদিন রাত বিরামহীনভাবে।
আর্ক দ্য ট্রয়ম্ফ |
আর্ক দ্য ট্রয়ম্ফের উপর থেকে নিচের রাস্তা |
বাড়ি ফেরার সময় আমরা অ্যাপার্টমেন্টের
কাছের সুপার মার্কেট থেকে রাতে রান্নার আর পরের দিন সকালের ব্রেকফাস্টের খাবার
কিনে আনলাম। পরের দিন সকালে জগৎবিখ্যাত ল্যুভের মিউজিয়ামের দিকে রওনা দিলাম।
প্যারীর টিউব রেল পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম
শ্রেষ্ঠ। শহরের যে কোন জায়গার থেকে মিনিট
দশেকের হাঁটা পথে কোনো না কোনো মেট্রো স্টেশন আছে। মাটির তলায় অন্তত চারটে লেভেলে
ট্রেন চলছে এবং একবার টিকিট কেটে ঢুকে পড়তে পারলে যে কোনো লেভেলে যতবার খুশি গিয়ে
যে কোনো স্টেশনে পৌঁছতে পারি। আমরা প্যারী পাসের সঙ্গে দেওয়া ম্যাপের সাহায্যে আর
মোবাইলের জিপিএস-কে ভর করে নিজেরাই স্বচ্ছন্দে সব জায়গায় ভাল ভাবেই ঘুরেছি। খালি
সুড়ঙ্গের মধ্যে জিপিএস ভাল কাজ করে না বলে আমরা আগেই যেখানে যাব তার লোকেশন দেখে
ঠিক করে নিতাম কটা লেভেল অতিক্রম করতে হবে আর কোন লেভেলে কোথায় নামতে হবে। যাহোক আমরা সেদিন ল্যুভের যাবার জন্য একনম্বর লেভেল
থেকে মেট্রো ধরে সবে তিন নম্বর লেভেলের জন্য সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি, সেই সময়ে দেখি লোকজনের ছুটোছুটি। রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। জানলাম তিন
নম্বর লেভেলে সন্দেহজনক কিছু পাওয়া গেছে। তখন সকালবেলা, কাজের দিন। বুঝতেই পারছেন অবস্থাটা। সব অফিসযাত্রীদের সাথে
আমাদেরও হুড়োহুড়ি লেগে গেল সুড়ঙ্গের বাইরে বের হবার জন্য। শেষে বিদেশে এসে প্রাণটা
যাবে নাকি! ওপরে উঠে সোজা জিপিএস দেখে হাঁটা লাগলাম ল্যুভেরের দিকে।
সেইন নদীর ডান তীরে ল্যুভের হল পৃথিবীর
বৃহত্তম মিউজিয়ামের একটা। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে একবিংশ শতক
পর্যন্ত মূল্যবান আটত্রিশ হাজার নিদর্শন এখানে রাখা আছে। মিউজিয়ামটি ল্যুভের
প্রাসাদের মধ্যে যেটি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে রাজা ফিলিপের সময় পর্যন্ত দুর্গ হিসাবে
ব্যবহার করা হত। এক তলায় ঘুরে দেখলে সেই
দুর্গের অংশ এখনো চোখে পড়ে। এই মিউজিয়াম সম্পর্কে এত মানুষের এত লেখা আছে যে আমি
আর বিশদ বিবরণে যাচ্ছি না। অল্প কয়েকটা সংগ্রহের কথা বলব।
কাঁচের উল্টো পিরামিড, ল্যুভের |
স্ফিংস |
মিশরীয় লিপিকার |
আর্টেমিস (উপরে) উইংড ভিকট্রি (নিচে |
'ফোর ক্যাপটিভস'-এর দুটি |
প্রাচীন গ্রিক মূর্তির ভিতর আর্টিমিসের
মূর্তিটির কথা মনে আছে। আর্টিমিস ছিল
গ্রিক দেবরাজ জিউসের অবৈধ কন্যা। কুমারীত্ব, শিকার, চাষবাস, পশুদের দেবী। আর্টিমিসের
রোমান রূপ হল ডায়না। মার্বেল পাথরের মাথাবিহীন
‘উইঙ্গড ভিকট্রির’ স্টাচু একটা ভাঙা জাহাজের অংশের মধ্যে দণ্ডায়মান। এরপর যে
মূর্তিটির কথা বলব সেটার ছবি বহু শিল্পীর তুলিতে ফুটে উঠেছে বা মূর্তি বহু দেশে
দেখা যায়। অনেকের লেখাতে আমরা তার কথা পাই। সেই হাত কাটা অর্ধ নগ্ন মহিলাটি হল
দেবী ভেনাস। তবে এই সৌন্দর্যের দেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে আমার আগে রোমের
ক্যাপিটোলাইন মিউজিয়ামে। আর এবার দেখলাম ‘ভেনাস ডি মিলো’। এটা ১৮২০ সালে গ্রিসের খুব কাছে মিলোস দ্বীপে পাওয়া গিয়েছিল। দ্বীপের নাম
অনুসারে নাম। সৌন্দর্যের জন্য এই দুটো ভেনাসই খুব বিখ্যাত। এক জায়গায় ব্রোঞ্জের
‘ফোর ক্যাপটিভস’ মূর্তিগুলিদারুণ লাগল। ফ্রান্সের রাজা চতুর্দশ লুইয়ের সময়ে ডাচদের সঙ্গে দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর জয়লাভ করে ফ্রান্স ১৬৭৯ সালে। সেই বিজয়কে তুলে ধরতে চতুর্দশ লুইয়ের চারদিকে চারজন বন্দীর মূর্তি ফুটিয়ে তুলেছে চারটে পরাজিত দেশ স্পেন, ব্র্যান্ডেনবুর্গ, হল্যান্ড, এবং হোলি রোমান সাম্রাজ্যকে। তাদের মধ্যে চার রকম ভাব ফুটে উঠেছে- বিদ্রোহ, আশা, নৈরাশ্য ও দুঃখ।
ভেনাস ডি মিলো |
ল্যুভেরের নীচেই মেট্রো স্টেশন। আমরা
সোজা চলে গেলাম আইফেল টাওয়ার। ১৮৮৯ সালে প্যারীতে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকী
উপলক্ষে এক বিশ্বমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে একটি উঁচু মিনার তৈরি করার
পরিকল্পনা হয় এবং এর জন্য একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। সেখানে একশোরও বেশি নক্সা জমা পড়ে। গুস্তাভ আইফেল নামে একজন ইঞ্জিনিয়ারের
নক্সাটি বাস্তবায়িত করার অনুমোদন পায়। কিন্তু কাজ শুরু হবার সময় অনেক শিল্পী
সাহিত্যিক এই স্তম্ভ তৈরির বিপক্ষে আন্দোলন করেছিলেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল যে প্যারীর সৌন্দর্য সৌধমালায়, সেখানে লোহালক্কড় দিয়ে
বানানো একটা খাঁচার মতো মিনার অত্যন্ত বেমানান। এছাড়াও অত বিশাল উঁচু স্তম্ভটি
মাটির তলায় বসে যেতে পারে বা যে কোনো দিন ভেঙে পড়তে পারে বলে প্রচার করা হল খবরের
কাগজগুলোতে।
কিন্তু ১৮৮৯ সালে এই ৩১৩ মিটার
স্তম্ভটি যখন চালু হল তখন সেটা ভীষণ জনপ্রিয়তা পেল। গোড়ায় যাঁরা আপত্তি করেছিলেন
তাঁরা অনেকেই মত বদলালেন। নাট্যকার আলেকজান্ডার দুমার ছেলে সংগীতকার শার্ল গুনো,
যিনি প্রথমে প্রবল আপত্তি করেছিলেন তাঁকে একদিন একটা পিয়ানোসমেত উপরে উঠিয়ে বাজাতে নিয়ে গেলেন আইফেল। আপোলিনেয়ার ওই স্তম্ভ নিয়ে একটা কবিতা লিখলেন।
অনেক শিল্পী ছবি আঁকলেন। মপাঁসা স্তম্ভের একটা রেস্তোরাঁয় মাঝে মাঝে খেতে যেতেন। তাঁকে যখন তাঁর বিরুদ্ধতার কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হল তিনি নাকি বলেছিলেন যে ওখানে তাঁর খেতে আসার কারণ হচ্ছে যে ওইটাই হচ্ছে প্যারীর একমাত্র জায়গা যেখান থেকে ওই বিশ্রী জিনিসটা চোখে পড়ে না। সত্যি কথা বলতে কি আমাদেরও যে দারুণ লেগেছিল তা নয়। তবে ওই টাওয়ারে না উঠলে প্যারী দেখা অসম্পূর্ণ থেকে যেত। ওঠার আগে বিশাল লাইন দেখে আমরা লাঞ্চ সেরে নেব স্থির করলাম। লিফটে করে দুবার উঠলে তবে একদম টপে পৌঁছানো।
ওপরে উঠে প্যারী শহরের দৃশ্য অসাধারণ। কোন দিকে কোন দেশের অবস্থান সেটা চার্ট করে দেখানো আছে। অন্যদের মত আমরাও টাওয়ারের কোন দিকটায় ভারত খুঁজে নিলাম। ওপরে গুস্তাভ আইফেল ও তার মেয়ের মোমের মূর্তি আছে। নামার সময় মাঝপথে যেখানে লিফট পরিবর্তন করতে হয় সেখানে একটা কাঁচের প্লাটফর্ম আছে। সেখানে অনেকেই নেমে পড়ে। সেখানে কাঁচের ভেতর দিয়ে নিচটা দেখা যায়। আমাদেরও তাই ইচ্ছে ছিল। ভেবেছিলাম বাকি পথটা হেঁটে ফিরব। কিন্তু সময় কম থাকায় দুটো ধাপেই লিফটে করেই নামলাম। নামার সময় দেখলাম কিছু কিছু লোক টাওয়ারের মাঝখানের ঐ ঘসা কাঁচের ওপর শুয়ে পড়ে নিচটা দেখছে।
আইফেল টাওয়ারের ঊপর থেকে তোলা নানা ছবি |
ওপরে উঠে প্যারী শহরের দৃশ্য অসাধারণ। কোন দিকে কোন দেশের অবস্থান সেটা চার্ট করে দেখানো আছে। অন্যদের মত আমরাও টাওয়ারের কোন দিকটায় ভারত খুঁজে নিলাম। ওপরে গুস্তাভ আইফেল ও তার মেয়ের মোমের মূর্তি আছে। নামার সময় মাঝপথে যেখানে লিফট পরিবর্তন করতে হয় সেখানে একটা কাঁচের প্লাটফর্ম আছে। সেখানে অনেকেই নেমে পড়ে। সেখানে কাঁচের ভেতর দিয়ে নিচটা দেখা যায়। আমাদেরও তাই ইচ্ছে ছিল। ভেবেছিলাম বাকি পথটা হেঁটে ফিরব। কিন্তু সময় কম থাকায় দুটো ধাপেই লিফটে করেই নামলাম। নামার সময় দেখলাম কিছু কিছু লোক টাওয়ারের মাঝখানের ঐ ঘসা কাঁচের ওপর শুয়ে পড়ে নিচটা দেখছে।
ব্রাসেলসে |
ওখান থেকে বেরিয়ে মেরি কুরির সমাধি
যেখানে আছে সেই প্যান্থিয়নে যাবার ইচ্ছে গৌতমের ছিল। কিন্তু আমি খুব ক্লান্ত থাকায়
তা আর হল না। পরের দিন আমাদের ব্রাসেলসের বাসযাত্রা। বিদায় প্যারী। ভার্সাই প্রাসাদ আমাদের আর যাওয়া
হল না এ যাত্রায়। প্লেনের গণ্ডগোলে এডিনবার্গে একদিন বেশি থেকে যেতে হয়েছিল বলে প্যারী
ট্রিপ তিনদিনের বদলে দুদিন। আমরা এই দুদিন সারাক্ষণ ঘুরে ঘুরে যতটা দেখেছি এর চেয়ে
বেশি সম্ভবও হত না। ইউরোপ ভ্রমণের বাকি কটা দিন আমাদের ছেলে পাপান আমাদের সফর
সঙ্গী ছিল। এবারের ইউরোপ ভ্রমণে প্রথম বারোদিন এত দ্রুত ঝাঁপতাল লয়ে কেটেছে যে
বলতে পারি বেলজিয়ামের ব্রাসেলস হয়ে ছেলের কাছে জার্মানির বন শহর -- ওই নদিন
কাটিয়েছি অত্যন্ত ধীর একতালের গতিতে, গড়িয়ে গড়িয়ে। সে বর্ণনায় যাব না। পৃথিবীশ্রেষ্ঠ
ব্রাসেলসের কমিক মিউজিয়াম দেখার আর ওখানকার বিখ্যাত চকলেট খাবার সৌভাগ্য আমাদের
হয়েছিল। ব্রাসেলসের মানুষের রসবোধের পরিচায়ক ব্রোঞ্জের ম্যানেকেন পিস মূর্তিও
দেখেছি।
মানেকিন পিস |
কমিক মিউজিয়ামের নানা ছবি |
ছোট্ট বন শহরটা খুব আয়েশ করে ঘুরেছি।
আমরা পাপানের বাড়ির কাছাকাছি একটা অ্যাপার্টমেন্টে সাতদিন ছিলাম। সারাদিন নিজেদের
মত করে ঘুরতাম। আমাদের সঙ্গী ছিলেন সুস্মিতাদি। পাপানের পরিচিত একটি বাঙালি
পরিবারের গৃহিণী। উনিও সানন্দে আপন দেশের লোককে পেয়ে
আমাদের একদিন নেমন্তন্ন করে খাওয়ালেন আর শহরের দ্রষ্টব্যগুলো দেখালেন। প্রতিদিন
ঘুরে আমরা বিকেলের দিকে পাপানের কাছে চলে যেতাম। রাইন নদী ওর বাসার থেকে দু
মিনিটের পথ। আমরা নদীর ধারের অপরূপ প্রকৃতির কাছাকাছি অনেকটা সময় থাকতাম। তারপর
ছেলের সঙ্গে গল্পগুজব করতে করতে তার হাতের রান্না করা খাবার খেয়ে অনেক রাতে হেঁটে
নিজেদের ডেরায় ফিরতাম।
বিটোভেন |
বিটোভেনের জন্মস্থান |
বাড়িটাতে রয়েছে বিটোভেনের মূর্তি,
চিত্র, তাঁর ব্যবহার করা যন্ত্র, সঙ্গীতের পাণ্ডুলিপি। যে ঘরটায় এই অমর সুরস্রষ্টার জন্ম, সেখানে
অবশ্য প্রবেশাধিকার নেই, বাইরে থেকে দেখতে হল। পাশ্চাত্য সঙ্গীতপ্রেমীদের
তীর্থক্ষেত্র এই বাড়ি দেখে মনটা কিন্তু বিষাদে ভরে গেল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে
বিশ্বের শত কোটি মানুষকে সুরমুর্ছনার ইন্দ্রজালে যিনি আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, খুব
অল্প বয়সে শ্রবণ যন্ত্রের জটিল রোগে সম্পূর্ণ বধির হয়ে গিয়ে সেই সুরকারই কিনা তাঁর
নিজের অনেক অমর সৃষ্টি কোনদিনই নিজের কানে শুনতে পাননি। ছোটবেলা থেকে বারবার শোনা
তাঁর মন্ত্রমুগ্ধ করা সিম্ফনিগুলো যেন সেইদিন সন্ধ্যাবেলা রাইনের ধারে ঘুরে ঘুরে
বাজছিল।
এরপর ঘরে ফেরার পালা। ফ্রাঙ্কফুর্ট
এয়ারপোর্ট থেকে প্লেন ধরব। রাস্তায় রাইনের
সঙ্গে লুকোচুরি খেলল ট্রেন। স্টেশনটা এয়ারপোর্টের মধ্যেই। যাওয়ার সময় মুম্বাই হয়ে
গিয়েছিলাম, ফিরলাম আবু ধাবি হয়ে। আবার প্রতিদিনের কাজের চাপ, তার মধ্যে মনে পড়ে
যায় পশ্চিম ইউরোপের সেই কটা দিন। পেয়েছি নতুন বন্ধু, দেখেছি অনেক কিছু, জেনেছি
অনেক। (সমাপ্ত)
No comments:
Post a Comment