Friday 21 September 2018

শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ সামির আমিন


সামির আমিন (৩ সেপ্টেম্বর ১৯৩১ - ১২ আগস্ট, ২০১৮)

          চলে গেলেন ইউরোসেন্ট্রিজম অর্থাৎ ইউরোকেন্দ্রিকতা শব্দের নির্মাতা সামির আমিন। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ সামির আমিন ছিলেন আধুনিক মার্কসীয় তাত্ত্বিকদের মধ্যে অন্যতম। রাজনৈতিক অর্থনীতিতে মার্কসীয় তত্ত্বের প্রয়োগে তাঁর স্থান প্রথম সারিতে
        সামির আমিনের জন্ম মিশরে। তাঁর বাবা ছিলেন মিশরীয়, মা ফরাসি – দুজনেই ছিলেন ডাক্তার। তাঁর ছোটবেলার পড়াশোনা মিশরের পোর্ট সইদে। ১৯৪৭ সালে তিনি পড়াশোনার জন্য ফ্রান্সে যান। প্যারিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতি এবং পরিসংখ্যানবিদ্যা বিষয়ে পড়াশোনা করে ১৯৫৭ সালে পিএইচডি করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল অনুন্নয়নের উৎস, তাঁর পরবর্তী বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অ্যাকুমুলেশন অন এ ওয়ার্ল্ড স্কেল’-এ তিনি এ বিষয়ে তাঁর ধারণাকে আরো বিকশিত করেছিলেন।
        তাঁর নিজের কথাতেই, ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার জন্য পড়াশোনাতে ব্যাঘাত ঘটেছিল। তখনই ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হয়েছিলেন, কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে অচিরেই তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬০ সাল তিনি মিশরে ফিরে পরিকল্পনা বিষয়ক সরকারি দপ্তরে কাজ করেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি গামাল আব্দুল নাসেরের দেশের মধ্যে কমিউনিস্ট বিরোধিতার জন্য তিন বছরের মধ্যেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ ছিলেন সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্র মালিতে পরিকল্পনা বিষয়ে উপদেষ্টা, তারপর ১৯৬৩ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত  সেনেগালের ডাকারে রাষ্ট্রসংঘের  আফ্রিকান ইন্সটিটিউট অফ ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্ল্যানিং-এ কাজ করেছেন, তার মধ্যে শেষ দশ বছর ছিলেন ইন্সটিটিউটের ডাইরেক্টরএকই সঙ্গে প্যারি ও ডাকারে অধ্যাপনা করেছেন১৯৮০ সালে থার্ড ওয়ার্ল্ড ফোরামের আফ্রিকা দপ্তরের ডাইরেক্টর হন। তাঁর উৎসাহেই প্রতিষ্ঠিত হয় আফ্রিকার অগ্রগণ্য সমাজ বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্সিল ফর দি ডেভেলপমেন্ট অফ সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ ইন আফ্রিকা।
        প্যান-আফ্রিকানিজম বা সার্বিক-আফ্রিকানবাদের প্রতি তাঁর পক্ষপাত তাঁর জীবন থেকেই স্পষ্ট, কিন্তু তাঁর কাছে আফ্রিকান সংস্কৃতির কোনো অভিন্ন সাধারণ রূপ ছিল না।  তাঁর প্যান-আফ্রিকানিজম ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও তার মুৎসুদ্দিদের বিরুদ্ধে আফ্রিকার অত্যাচারিত জনগণের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ। আমিন বিশ্বাস করতেন যে প্রকৃত মার্কসবাদী মাত্রেই কেবলমাত্র বুদ্ধিজীবী নয়, একই সঙ্গে রাজনৈতিক কর্মী ভবিষ্যৎ কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা ছিল। সমাজতন্ত্রই ছিল তাঁর আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য  এবং তিনি জানতেন যে তার জন্য প্রয়োজন সাম্রাজ্যবাদ ও ধনতন্ত্রের পরাজয়। সেই উদ্দেশ্যে আন্দোলন সংগঠন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম প্রধান কাজ।
        আমিন বিশ্বাস করতেন যে মার্কসবাদের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ও সামাজিক-ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাকে  পৃথক করার দৃষ্টিভঙ্গি পুরোপুরি সঠিক নয়। তাঁর মতে ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির নিয়মগুলি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের অধীনসে জন্য সাম্রাজ্যবাদের উত্থানকে নিছক ধনতন্ত্রের নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তিনি মনে করতেন যে মূল ধারার অর্থনীতির লক্ষ্য হল ধনতান্ত্রিক শোষণকে বৈধতা দানের প্রয়াস। অর্থনীতিকে বিশুদ্ধ বিজ্ঞান হিসাবে প্রকাশের যে কোনো প্রচেষ্টা তাঁর কাছে ছিল হাস্যকর উল্লেখ করতে হয় তাঁর ডিপেন্ডেন্সি বা নির্ভরতা তত্ত্ব বিষয়ে তাঁর কাজ। উন্নত ও অনুন্নত দুনিয়ার মধ্যে অসম বিনিময় কেমনভাবে অনুন্নত দুনিয়াকে শোষণ করেছে এবং বিশ্ব ধনতন্ত্র একচেটিয়া অধিকারের মাধ্যমে সেই অসাম্যকে পুষ্ট করছে, তা তিনি ‘অ্যাকুমুলেশন অন এ ওয়ার্ল্ড স্কেল’, ‘ইউরোসেন্ট্রিজম’, ‘ইমপিরিয়ালিজন এন্ড আনইকোয়াল ডেভেলপমেন্ট’ এবং ‘ক্যাপিটালিজম ইন দি এজ অফ গ্লোবালাইজেশন’ এই সমস্ত বইতে আলোচনা করেছেন। অসম বিনিময়ের তত্ত্ব আলোচনাতে তিনি দেখিয়েছিলেন যে উন্নত দেশের সাধারণ শ্রমের মূল্য অনুন্নত দেশের থেকে বেশি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অনুন্নত দেশের শ্রমিককে এই শোষণ সাম্রাজ্যবাদের এক মূল স্তম্ভ।  এই সমস্ত কারণেই তাঁকে দক্ষিণের অর্থাৎ অনুন্নত দেশের অর্থনীতিবিদ বলা হত।
ইউরোসেন্ট্রিজম আধুনিক সমাজবিদ্যার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। সমাজ বিবর্তনকে কেমন ভাবে সচেতন বা অচেতন ভাবে পশ্চিমী দুনিয়াকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয়, তা প্রতিষ্ঠা করেছে। ধনতান্ত্রিক শোষণের ইতিহাসকে লুকিয়ে রেখে অনুন্নয়নের দায় অনুন্নত দেশের উপরে চাপিয়ে দেওয়াকে প্রকাশ্যে এনেছে ইউরোসেন্ট্রিজম তত্ত্ব।
        এই একচেটিয়া ধনতন্ত্রের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি এনেছেন ‘ডিলিঙ্কিং’ অর্থাৎ বিযুক্তির ধারণা। তাঁর মতে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের অন্ধ অনুকরণ শেষ পর্যন্ত নয়া উপনিবেশবাদকেই শক্তিশালী করে। তাই  শুধু যে উন্নত দেশ কর্তৃক চাপিয়ে দেওয়া অর্থনৈতিক নীতির বিরোধিতা প্রয়োজন তা নয়,  অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিমণ্ডল গঠন করে যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, তাকেও অস্বীকার করতে হবে। একমাত্র সাহসী ও ব্যাপক গণভিত্তিসম্পন্ন সরকারের পক্ষেই এই নীতি গ্রহণ করা সম্ভব। এছাড়াও প্রয়োজন অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলির মধ্যে সংহতি। সে কারণেই তিনি বহুকেন্দ্রিক বিশ্বের সমর্থক ছিলেন। তিনি এও আশা রাখতেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশের শ্রমিকশ্রেণি ধনতন্ত্রেরই বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে।
        তা বলে তিনি বহুকেন্দ্রিকতা যে সাধারণভাবে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধী এমন কোনো সরল ধারণায় বিশ্বাসী ছিলেন না। সেই কারণেই তিনি ধর্মীয় মৌলবাদের বিরোধিতা করেছিলেন। মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের তিনি তীব্র বিরোধী ছিলেন। তার কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে তারা শেষ পর্যন্ত নয়া উদারনীতিবাদের নীতিগুলিই প্রয়োগ করবে। মোরসির মুসলিম ব্রাদারহুডের নির্বাচিত সরকারের বিরোধিতা এবং সেই সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পক্ষে আমিনের সমর্থন তাঁর অনেক সমর্থককেও  বিচলিত করেছিল। কিন্তু আমিন ছিলেন নিজের বিশ্বাসে অবিচল। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর মত প্রকাশে কুণ্ঠা বোধ করেন নি।
 গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, সেপ্টেম্বর ২০১৮

No comments:

Post a Comment