Monday 30 November 2020

দারুচিনির দ্বীপ পর্ব ৪- ক্যান্ডি ও নুয়ারা এলিয়া



 দারুচিনির দ্বীপ

পর্ব ৪- ক্যান্ডি ও নুয়ারা এলিয়া

                                 শম্পা গাঙ্গুলী

প্রথম পর্বঃ সিগিরিয়া

দ্বিতীয় পর্বঃ পোলোন্নারুয়া ও মিনেরিয়া

তৃতীয় পর্বঃ অনুরাধাপুরা ও ডাম্বুলা


        শ্রীলঙ্কায় প্রথম প্রাগৈতিহাসিক মানুষের আগমন ঘটেছিল অবশ্য দক্ষিণের রত্নপুরা জেলার বালাঙ্গোদায়। আজ থেকে চৌত্রিশ হাজার বছর আগে, মেসোলিথিক যুগে। পরবর্তীকালে অনেক রাজা এখানে ছোটো ছোটো রাজ্য শাসন করেছেন পরে ভারতের চোল রাজত্বের অধীনে আসে এই দেশ  চোল রাজারা সব ছোটো রাজ্যগুলোকে একসঙ্গে একছাতার তলায় এনে ৯৯৩-১০৭৭ সাল, এই সময়কালে রাজত্ব  চালায়। ষোড়শ শতক নাগাদ উপকূল এলাকায় পর্তুগিজদের কলোনি গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে ডাচ, ব্রিটিশরা ঢুকে পড়ে এই দেশে বাণিজ্য করতে। ১৮০৩ সালে ব্রিটিশরা প্রথম ক্যাণ্ডি যুদ্ধের পর অনায়াসে ক্যাণ্ডি রাজ্য দখল করে নেয়। ১৮১৫ সালে দ্বিতীয় ক্যাণ্ডি যুদ্ধের পর পরাক্রমশালী ব্রিটিশদের হাতে শ্রীলঙ্কার স্বাধীনতার সূর্য হয় অস্তমিত ব্রিটিশরা এদেশে চা, কফি, রাবার এইসব চাষের জন্য পাহাড়ের ঢালগুলোয় উত্তম অনুকূল পরিবেশ পেল। ফলে ভারতের মতোই এদেশেও বাগিচা ফসল ফলিয়ে সারা পৃথিবীতে একচেটিয়া ভাবে বাণিজ্য করে মুনাফা লুঠতে লাগল। প্রচুর শ্রমিক আনল ভারতের তামিল রাজ্য থেকে। তারপর চলল শোষণ আর নিপীড়নের রাজনীতি। এ ইতিহাস আমাদের মত ভুক্তভোগীদের অজানা থাকার কথা নয়। তখন এ দেশের জনসংখ্যার দশ শতাংশই ভারত থেকে আনা শ্রমিক যা হোক সিংহলের স্বাধীনতার আন্দোলনের কথায় আমি যাচ্ছি না, তাহলে এ লেখা শেষ হবে না। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি এদেশ স্বাধীন হয়।   
আমরা চলেছি ডাম্বুলা ছেড়ে আরও দক্ষিণে ক্যাণ্ডির পথে। পোলোন্নারুয়া বা অনুরাধাপুরার মত অত প্রাচীনত্বের ছোঁয়া না থাকলেও ব্রিটিশরা দেশটা দখল করার আগে ক্যাণ্ডি ছিল এদেশের শেষ স্বাধীন রাজধানী। আমাদের যাবার পথটাও বেশ সুন্দর। কিন্তু দারুণ গরম। এসি গাড়িতে বসেও সকলের কেন জানি না খুব হাঁস-ফাঁস অবস্থা। একটা মশলা বাগানে ঢুকেছিলাম। দেশটার নাম তো দারুচিনির দ্বীপ, তাই মশলা কিনব ভাবলাম সবাই। একজন গাইড ঘুরে ঘুরে আমাদের সব ভেষজ উদ্ভিদ আর মশলার গাছগুলো চেনাচ্ছিল, আর   বার করছে আর টপাটপ কত সব ভেষজ গুণে ভরা জড়িবুটি কিনছে। গাইড আমাদেরও অনেক উৎসাহিত করল কিছু কেনার জন্য। টাকে চুল গজানো থেকে শুরু করে শরীরের যে কোন অংশে লোম তোলা, যাবতীয় রোগ নিরাময় করা, বার্ধক্য রোধ করা--- সব ঔষধই মজুত ছিল সে বাগানে। গৌতমের হাতের একটা অংশে ভেষজ তেল একফোটা লাগিয়ে, লোম তুলে দিয়ে, হাতেনাতে প্রমাণও দিল। গৌতম টাকে চুল গজানোর বিষয়ে সম্ভবত আগ্রহী ছিল, কিন্তু যা সব দাম শুনলাম তাতে মাথার ফাঁক ঢাকতে গিয়ে পকেট ফাঁকা হবার যোগাড়। বাগানের ছোটো ছো্টো ছাউনির ভেতর দেখি বিদেশীরা ঐ সব দুর্মুল্য তেল দিয়ে সারা শরীর মালিশ করাচ্ছে। নেংটি পরিয়ে, সাদা চামড়াগুলোর পিঠে চটাস চটাস থাপ্পড় কষিয়ে ভালই ব্যাবসা চলছে। একজন পঞ্চাশোর্ধ সাহেব আর তার তরুণী সঙ্গিনীর ওপর দেখি একটা ছাউনিতে চলছে এরকমই পরীক্ষা নিরীক্ষা। মনে মনে ভাবলাম এই বয়সে সাহেব হয়ত মালিশ করে বয়সটাকে কিছুদিন আটকাবে; কিন্তু তার সঙ্গিনী!  অল্পবয়সীদের চামড়ায় ভেষজ বেশি তাড়াতাড়ি কাজ করবে। তখন তাকে যদি বায়ো কি তেয়ো মনে হয়? তবে যে সাহেবের পার্শ্ববর্তিনীটি নাতনি-সম ঠেকবে!
আবার যাত্রা শুরু হল। বাইরের তাপমাত্রা প্রচণ্ড বেশি হলেও বাগানে এতক্ষণ  ছায়াতে তবু ভালো ছিলাম। কিন্তু এসি গাড়িতে উঠেই ফের সকলের গরম লাগতে শুরু করল। কিছুতেই বুঝতে পারছি না কারণটা। রাস্তায় সবাই ডাব খেলাম। অনেকটা পথ তখনও বাকি। ড্রাইভার দুবার গাড়ি দাঁড় করিয়ে চেক করল ভালভাবে। বাইরে প্রায় চল্লিশ ডিগ্রীর বেশি তাপমাত্রা। সেজন্যই তো এসি গাড়ি। কিন্তু ভেতরে আমরা ঘামছি। দুপুরে রাস্তায় লাঞ্চ করে গাড়িতে উঠে গরমের জন্য আমি আর আহেল মিলে এসির ঠাণ্ডাটা ড্রাইভারের অগোচরে বাড়াতে চেয়েছিলাম খালি। তাতে কি করে উল্টো ফল হবে? পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে ক্যাণ্ডি শহরের কাছাকাছি এসে গেছি।  গৌতম সেদিন খুব গরম ছিল বলে চটি পরে গাড়িতে উঠেছিল। ঐ গরমেও পিছনের সিট ফাঁকা পেয়ে পা তুলে শুয়ে অনেকক্ষণ নাক ডাকাচ্ছিল। ক্যাণ্ডি শহরে গাড়ি ঢুকতেই তড়াক করে উঠে, খালি পা সিটের তলায় ফেলে বসেই বলল, পায়ের তলায় গরম হাওয়া বইছে কেন? গরম হাওয়া শুনেই ড্রাইভার সঙ্গে সঙ্গে পিছনে তাকিয়ে দেখে বলল, হিটারের সুইচটা কেউ অন করে দিয়েছিল। ওটা শীতকালের জন্য। সবাই মুখচাওয়া-চাওয়ি করছে, একমাত্র আমি আর আহেল ব্যাপারটা ধরতে পারলাম। চুপিচুপি এসির ঠাণ্ডা বাড়াতে গিয়ে এই কাণ্ড করেছি। দোষটা স্বীকার করলাম। সবাই মিলে গালাগাল দিল, আর ফাইন হল, খাওয়াতে হবে।   

রাজপ্রাসাদ, ক্যান্ডি

বিকেল গড়িয়ে ক্যাণ্ডি পৌঁছোলাম। এবার গন্তব্য ক্যাণ্ডির বিখ্যাত রাজপ্রাসাদ। ভিতরে আছে একটি স্বর্ণ-মন্দির, নাম শ্রী দালাদা মালিগাওয়া, যেখানে বুদ্ধের দাঁত সংরক্ষিত আছে।

ক্যাণ্ডির রাজপ্রাসাদের শিল্পকলা কোনোভাবেই প্রাচীনত্বের দিক থেকে পোলোন্নারুয়া বা অনুরাধাপুরার সঙ্গে  তুলনীয় নয়, কিন্তু তাও অনুপম
। প্রধানত কাঠ, পাথর, আর কাদামাটি দিয়ে প্রাসাদটা তৈরি। বড় বড় কাঠের ঘরগুলোর বিশাল বিশাল কাঠের দরজায় এত সূক্ষ্ম হাতির দাঁতের কারুকাজ খুব কমই দেখেছি। ঘরগুলোর ভেতরে বৌদ্ধ ও হিন্দুদের উপাসনার নানান মূর্তি রাখা আছে। সেগুলো প্রধানত মাটি, কাঠ প্রভৃতি সাধারণ সামগ্রী দিয়ে তৈরি। কিন্তু মূর্তিশিল্পের অলঙ্করণ অসাধারণ। উজ্জ্বল রঙের প্রলেপ, সোনা-রূপা-তামা ইত্যাদি নানান ধাতব পাতের ব্যবহার, হাতির দাঁতের কারুকার্য, আর সর্বোপরি নানান দামি দামি পাথরের ব্যবহার সংগ্রহশালার ঘরগুলোকে একটা নান্দনিক ছোঁয়া দিয়েছে। মূর্তি ছাড়াও ঘরগুলোতে সংরক্ষিত আছে প্রাচীন পালি ও সিংহলী ভাষার শিলালিপি, পুঁথি ইতাদি নানা সামগ্রী।



ওপরের ছাদ ও দেওয়ালে সোনার পাতের ওপর সূক্ষ্ম কাজ ও মণিমুক্তা খচিত দারুণ সুসজ্জিত সুপ্রশস্ত সুড়ঙ্গ, তার মধ্যে দিয়ে আমরা গেলাম প্রাসাদের অন্দর-মহলে।

শ্রী দালাদা মালিগাওয়া বৌদ্ধদের সেই পবিত্র মন্দির যেখানে বুদ্ধের স্মরণিকা রাখা আছে। সেই মন্দির, যা দেখার জন্য দেশ বিদেশের লোক ছুটে আসে। সেই মন্দির, যেখানে ২৫ জানুয়ারি, ১৯৯৮ এই দেশের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে তিনজন আত্মঘাতী এল টি টি ই জঙ্গি রাজপ্রাসাদের প্রবেশ পথ দিয়ে অতর্কিতে একটি ট্রাক নিয়ে ঢুকে পড়ে বোমা ছুঁড়ে পাথরের তৈরি মন্দিরের ঢোকার মুখের সবচেয়ে নিচের চাতালটি এক্কেবারে নষ্ট করে দেয়। পরে সেটিকে আবার নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। সেখানে দেখলাম একদল ড্রাম-বাদক দুপাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে সুরের তালে তালে ড্রাম বাজাচ্ছে। চাতালের দ্বিতীয় ধাপে একপাশে সিংহাসনে উপবিষ্ট ব্রোঞ্জের বুদ্ধ মূর্তি চারিদিক আলোকিত করে আছেন। একটু দূরে ধ্যানমগ্ন নিরাভরণ শ্বেতপাথরের বুদ্ধ বসে আছেন অপর একটি সিংহাসনে। দেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। বুদ্ধের এই দ্বৈত মূর্তির মাঝে চাতালের সবচেয়ে ওপরের ধাপে রাখা আছে আরেকটি সুসজ্জিত সিংহাসন। তার ওপরে  সোনার চাদরের চাঁদোয়া। সিংহাসনটির চারপাশটা সোনার তারের সূক্ষ্ম জাল দিয়ে ঘেরা। সেখানে হাতির দাঁতের কারুকার্যে ভরা একটা বিশাল গম্বুজাকৃতির সিন্দুক। তার ভিতর  আছে পরপর আরও সাতটি সিন্দুক। সবচেয়ে ভিতরের সোনার সিন্দুকটাতে রাখা আছে বুদ্ধের দাঁতের সেই অমূল্য স্মৃতি-স্মারক। এই সিংহাসনটির শোভা একশো গুণ বাড়িয়েছে দুপাশে ঝুলে থাকা দুটি বিশাল গজদন্ত। দেয়ালে ত্রিপিটকের লিপি সমন্বিত প্রাচীন তালপাতা মন্দিরটার ঐতিহ্যকে ফুটিয়ে তুলেছে।

শ্রী দালাদা মালিগাওয়া, ক্যান্ডি

     বুদ্ধের পরিনির্বাণ লাভের পর তাঁর দাঁতের স্মরণিকা নিয়ে একটা ইতিহাস আছে। তিনি খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫৪৩ সালে দেহত্যাগ করেন। বর্তমান বিহার রাজ্যের অন্তর্গত কুশিনগরে তাঁকে দাহ করা হয়। তাঁর শিষ্যা খেমা চিতা-ভস্ম থেকে তাঁর বাঁদিকের মাড়ির আক্কেল দাঁত সংগ্রহ করেন। তিনি এই স্মরণিকাটির যথাযথ সম্মান প্রদানের জন্য শ্রদ্ধাপূর্বক রাজা ব্রহ্মদত্তকে নিবেদন করেন। রাজা এটিকে দন্তপুরীর (বর্তমানে উড়িষ্যার পুরী) মন্দিরে সংরক্ষিত রাখেন। ধীরে ধীরে একটা ধারণা জন্মায়, যে এই স্মরণিকার অধিকারী হবে  সে-ই রাজ্য শাসনের ঐশ্বরিক ক্ষমতা অর্জন করবে। বুদ্ধের মৃত্যুর আটশো বছর পর কলিঙ্গের রাজা গুহশিব  এবং ক্ষত্রিয় পাণ্ডুর মধ্যে এই স্মারণিকাটির অধিকার নিয়ে যুদ্ধ বাধে। দাতাবংশ থেকে তা জানা যায়। শোনা যায় গুহশিবের কন্যা হেমমালা ও তার স্বামী এই স্মরণিকাটি রক্ষা করার জন্য শ্রীলঙ্কায় নিয়ে আসেন কীর্তি শ্রী মেঘাবন্নের রাজত্বকালে (৩০১-৩২৮ খ্রিস্টাব্দ)। ক্রমান্বয়ে বছরের পর বছর এই স্মরণিকাটি করায়ত্ত করার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজার মধ্যে চলেছে রাজনৈতিক লড়াই। বুদ্ধের পবিত্র দাঁতের পরিক্রমণের সে ইতিহাস আজ নাই বা বিবৃত করলাম; কিন্তু এটুকু জানিয়ে রাখি, যিনি যখনই এই স্মরণিকাটি অর্জন করতে পেরেছেন, তিনি তখনই সেটার ওপর অভিভাবকত্ব দেখিয়েছেন, আধিপত্য করেছেন এবং সেটা সযত্নে সসম্মানে রেখেছেন। এটির জন্য মন্দির তৈরি হয়েছে বিশেষ পরিকল্পনায়। শ্রীলঙ্কাতে প্রথমে তা ছিল অনুরাধাপুরার ইসুরুমুনিয়াতে যার কথা আগে লিখেছি। পোলোন্নারুয়া ও অনুরাধাপুরার আরো একাধিক চৈত্যে তা রক্ষিত ছিল, তাদের ভগ্নাবশেষ আমরা দেখেছি বিখ্যাত বৌদ্ধ তীর্থযাত্রী ফাহিয়েন ও হিউ এন সাঙ অনুরাধাপুরাতে এই পবিত্র স্মরণিকা দেখেছিলেন ও সে সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা লিখে গেছেন।


বর্তমানে ক্যাণ্ডির এই প্রাসাদ-মন্দিরে মালওয়াত্তে ও অসগিরিয়া এই দুই মহাবিহারের দু দল বৌদ্ধ ভিক্ষু দিনে তিনবার অর্থাৎ সকালে, দুপুরে ও সন্ধ্যায় এই পবিত্র স্মৃতি চিহ্নটির পূজার্চনা করেন মন্দিরের অন্দর কক্ষে। প্রতি বুধবার স্নান করান সুগন্ধি জলে ভেষজ মিশিয়ে। তারপর সেই জল বিতরণ করা হয় উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে। বছরে একবার জুলাই মাসে এই স্মরণিকা নিয়ে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা হয় ও তাতে বহু বিদেশীসহ অনেক সাধারণ মানুষ  যোগদান করেন।


এখান থেকে আমরা গেলাম কাউন্সিল অফ চেম্বার বা রাজার মন্ত্রণালয় দেখতে যেখানে ক্যাণ্ডির রাজা মন্ত্রীদের নিয়ে সভা করতেন। তারপর একটা বিশাল লেকের ধার দিয়ে গিয়ে পাহাড়ের উপর অনেকটা উঠে আমাদের হোটেলটা পেলাম। প্রাকৃতিকভাবে শহরটা খুব সুন্দর। জায়গাটা তিনদিক পর্বত দিয়ে ঘেরা একটা উপত্যকায়। অতীতে চারদিকের ঘন বনভূমি আর পর্বত স্থানটাকে শত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত রাখত। শহরের উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ দিক দিয়ে বয়ে গেছে দেশটির দীর্ঘতম নদী মহাবলি। ভৌগোলিক দিক দিয়ে তাই শহরটার চারপাশের সীমানায় প্রাকৃতিক বাধা বা দুর্গ অনেকগুলো, যেমন- গিরিদুর্গ, বনদুর্গ, জলদুর্গ ও পঙ্কদুর্গ। প্রথম তিনটে দুর্গের কথা একটু আগেই লিখেছি। খালি পঙ্কদুর্গটা বলা বাকি। এখানে শহরটার চারদিকের বিশাল বিশাল জলাভূমির কথা বলা হয়েছে। ক্যাণ্ডির শেষ স্বাধীন রাজা বিক্রমরাজা সিংহের ইচ্ছা অনুযায়ী, এই রাজধানী শহরটাকে স্বর্গতুল্য করতে গিয়ে প্রাসাদের সামনের বিস্তীর্ণ কৃষিজমিকে এক বিশাল দিঘিতে পরিণত করা হয়। তাঁরই ইচ্ছা অনুযায়ী প্রাসাদের সামনের সেই দিঘিতে নীল আকাশের মেঘেদের ছায়া, আর চারপাশের গিরিশ্রেণি, বনরাজি--- সত্যিই শহরটাকে একদিন নৈসর্গিক শোভা দিয়েছিল। এখন এই ছোট্ট শহরটা হোটেল আর মনিহারী দোকান-বাজারে ভর্তি। প্রচুর বিদেশীদেরও ভিড় এখানে। সেদিন সবাই কিছুকিছু কেনাকাটা করলাম উঁচু পাঁচিলে ঘেরা দিঘিটার ধারে আমি আর গৌতম খানিক হাঁটলাম পরে একটা বড় হোটেলে জমিয়ে গল্পগুজব করতে করতে রাতের খাওয়া সারলাম।

 

পরদিন রওনা দিলাম নুয়ারা এলিয়া অর্থাৎ আলোর শহরের দিকে, আরও দক্ষিণে পার্বত্য প্রদেশে। এই পাহাড়ি অঞ্চলটি চা চাষের জন্য সবচেয়ে অনুকূল। আমরা পথে এখানকার সবচেয়ে বড় টি এস্টেটগুলোর একটাতে ঢুকেছিলাম। সুন্দর সুন্দর মোড়কে চা রাখা বিদেশে রপ্তানির জন্য। আমরা সবাই চা কিনলামও। ক্যাণ্ডি এবং নুয়ারা এলিয়া, দুটোই পাহাড়ি এলাকায় বলে আবহাওয়াটা মনোরম। এই জায়গাটাকে বলে লিটল ইংল্যান্ড। সেখানে পাহাড়ের ঢালে সুন্দর একটা লেকের ধারে আমরা বেশ অনেকক্ষণ কাটালাম। লেকটার নাম লেক গ্রেগরি, জলে অনেক পর্যটক বোটিং, ওয়াটার স্কুটারিং করছে। লেকের সামনের  সাজানো বাগানে বসে ওগুলো দেখে সময় কাটছিল ভালই। হঠাৎ দেখি  অনির্বাণ আর ঝুলনের মধ্যে কী নিয়ে যেন তর্কাতর্কি হচ্ছে। ঝুলন চাইছে ওয়াটার স্কুটারে চড়তে, আর অনির্বাণ একেবারেই নারাজ। বলছে, এই বয়সে বউ হারাতে ও কোনমতেই রাজি নয়।
লেক গ্রেগরি, নুয়ারা এলিয়া

ওখান থেকে বেরিয়ে আমরা আরও দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তের দিকে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য হিক্কাদুয়ার সমুদ্র-সৈকত। পথে একটা দারুণ ঝর্ণা পড়ল। একটানা অনেকটা পথ বলে ড্রাইভার দুবার গাড়ি দাঁড় করাল। একবার হাইওয়ের ওপর একটা পেট্রল-পাম্পের কাছে যখন দাঁড়াল, পাশেই এয়ার কন্ডিশানড সুপার মার্কেটে দেখলাম অসাধারণ সব খোদাই করা কাঠের ঘর সাজানোর জিনিসপত্র। অন্তত একটা কারুকার্য করা কাঠের হাতি ওদেশ থেকে আনার বড়ই শখ ছিল। কিন্তু অস্বাভাবিক দাম, তাই আর কেনা হয়নি।


(সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকার ১৪২৪ সালের উৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত)












Saturday 28 November 2020

আশি বছর আগের এক প্রবন্ধগুচ্ছঃ প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা

 

আশি বছর আগের এক প্রবন্ধগুচ্ছঃ প্রেক্ষাপট ও প্রাসঙ্গিকতা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

       দু’বছর আগে চলে গেল মেঘনাদ সাহার জন্মের একশো পঁচিশ বছর। এবছর আমরা তাঁর নামাঙ্কিত সমীকরণের শতবর্ষ পালন করছি। মেঘনাদ সাহা শুধু বিরাট বিজ্ঞানী ছিলেন না, দেশ ও সমাজ নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছিলেন এবং দেশের ও মানুষের উন্নতিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি ১৯৩৯-৪০ সালে একগুচ্ছ প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন, যেগুলি আজও প্রাসঙ্গিক। ভারতবর্ষ পত্রিকাতে প্রকাশিত এই প্রবন্ধগুলিতে মেঘনাদ প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতি বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। এই লেখাতে আমরা সেগুলির দিকে ফিরে তাকাব।



এই রচনাগুলির একটা প্রেক্ষাপট আছে। সুভাষচন্দ্র ও নেহরুর সঙ্গে দেশের উন্নতি বিষয়ে কাজের জন্য মেঘনাদের যোগাযোগ হয়েছিল। স্বাধীনতার সময় অবশ্য দেশের বিজ্ঞানের পথ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে জহরলালের মতের মিল হয়নি। প্রধানমন্ত্রী নেহরু হোমি জাহাঙ্গির ভাবার কথায় প্রভাবান্বিত হয়ে কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ার উপর জোর দিয়েছিলেন; তাঁর সেই বিখ্যাত Temples of Modern India-র মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানগুলিও পড়বে। মেঘনাদের মত ছিল গবেষণার মূল কেন্দ্র হওয়া উচিত বিশ্ববিদ্যালয়। সারা পৃথিবীতেই বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণার মূল কেন্দ্র; অনেকেই মনে করেন নেহরুর নীতি অনুসরণের ফলে আমাদের দেশে বিজ্ঞান প্রযুক্তির বিকাশ ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু সে অনেক পরের কথা।

অনেক আগে থেকেই দেশের ভবিষ্যৎ বিকাশ বিষয়ে কংগ্রেসের মূল অংশের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে মেঘনাদের তীব্র আপত্তি ছিল। গান্ধীজীর চিন্তাধারা অনুসরণ করে কংগ্রেস মনে করত চরকা ও কুটিরশিল্পই দেশের বিকাশের একমাত্র পথ। মেঘনাদের মত ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার চোখ-ধাঁধানো সাফল্য সেই মুহূর্তে অন্যান্য পিছিয়ে পড়া দেশকে এগোনোর পথের দিশা দেখাচ্ছে। সোভিয়েত মডেলের একটা মূল কথা ছিল বিজ্ঞানের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে পরিকল্পনামাফিক ব্যাপক অংশের জনগণের উন্নয়ন; শুধু মেঘনাদ নয়, সারা পৃথিবীতে অনেক চিন্তাবিদই তাতে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

মেঘনাদের শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন যে একটা দেশ কত এগিয়ে, তা তার সালফিউরিক অ্যাসিড ও ইস্পাত তৈরির পরিমাণ থেকে বোঝা যায় প্রফুল্লচন্দ্র নিজে রসায়ন শিল্পের উন্নতিকল্পে বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেছেন। পক্ষান্তরে যুক্তপ্রদেশের কংগ্রেসি মন্ত্রীসভার শিল্পমন্ত্রী কৈলাসনাথ কাটজু একটা দেশলাই বানানোর কারখানার উদ্বোধন করে দেশ শিল্পের পথে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে বলে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন, এ কথা জেনে মেঘনাদের মনে হল দেশের বিশাল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের জীবনযাত্রার মানের উন্নতির জন্য ভারি শিল্পের প্রয়োজনীয়তা কংগ্রেসকে বোঝাতে হবে।

 ১৯৩৮ সালে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন সুভাষচন্দ্র, তাঁর সঙ্গে মেঘনাদের ভালোই যোগাযোগ ছিল। ১৯২২ সালে অবিভক্ত বাংলাতে যে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল, মেঘনা ছিলেন তার ত্রাণ কমিটি সম্পাদক সুভাষচন্দ্র কমিটির পক্ষ থেকে ত্রাণ নিয়ে গিয়েছিলেন উত্তরবঙ্গে। সে বছরই সুভাষচন্দ্রের আমন্ত্রণে মেঘনাদ বঙ্গীয় যুবক সম্মেলনে সভাপতি য়েছিলেন। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরেই মেঘনাদ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন, তাঁরই পরামর্শে সোভিয়েত মডেলের অনুসরণে সুভাষচন্দ্র তৈরি করলেন জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি।

একটা কথা বলে রাখা ভালো, মেঘনাদ যে রাশিয়ার পদ্ধতি হুবহু ভারতে চালাতে চেয়েছিলেন, তা নয়। শান্তিনিকেতনে এক বক্তৃতার কথায় আমরা এখনি আসব, সেখানে জাতীয় পরিকল্পনা প্রসঙ্গে মেঘনাদ বলেছিলেন, ‘এই প্রকার দেশব্যাপী শিল্পপরিকল্পনা রুশিয়ার পরিকল্পনা নহে। যদি কোনো আদর্শকে ফলবান করিতে হয়, তাহা হইলে উহাকে কেবল বস্তুবাদের উপর প্রতিষ্ঠা করাই যথেষ্ট নয়। রুশিয়ার বর্তমান জাতীয় জীবন খানিকটা অপূর্ণ, কারণ এখানে আদর্শে ও কার্যের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সম্পূর্ণ অভাব। যদি আমরা আমাদের সভ্যতার উৎসকে পুনরুজ্জীবিত করিতে চাই, তাহা হইলে আমাদের জীবনাদর্শকে সামাজিক মৈত্রী, সার্বজনীন প্রীতি ও নৈতিকতার উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে।’

দিল্লিতে কংগ্রেস কমিটির মিটিঙে একদিন পরে পৌঁছেছিলেন মেঘনাদ; আগের দিনই জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হ বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার বিশ্বেশ্বরাইয়া। কিন্তু মেঘনাদ তাতে সন্তুষ্ট হতে পারলেন না, তাঁর মনে হল কমিটির শীর্ষে কোনো প্রধান রাজনৈতিক নেতা না থাকলে তার সুপারিশের কোনো মূল্য থাকবে না। তাঁর অনুরোধে বিশ্বেশ্বরাইয়া জহরলাল নেহরুর সমর্থনে সভাপতি পদ থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি হলেন।

       প্ল্যানিং কমিটির সভাপতি হওয়ার জন্য জহরলাল নেহরুকে অনুরোধ করলেন মেঘনাদ। তিনি রাজি হলেও সাহার সন্দেহ গেল না,  নেহরুর পক্ষে বাস্তবে গান্ধীজীর প্রভাবকে অগ্রাহ্য করা কঠিন। তাই এমন একজনের শরণাপন্ন হলেন যাঁর কথা গান্ধী বা নেহরু কেউই সহজে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। ১৯২১ সালে জার্মানিতে তাঁর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হয়েছিল, কবি তাঁকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সতের বছর পরে সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করার সময় হল। রবীন্দ্রনাথও দেশের উন্নয়ন বিষয়ে তাঁর বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হলেন, জহরলালকে চিঠি দিলেন।

       এই বক্তৃতাটি ‘একটি নতুন জীবন দর্শন এই শিরোনামে ভারতবর্ষ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। মেঘনাদ বলেছিলেন, ‘এই জীবন সমস্যা সমাধানের জন্য অনেকে বলেন যে আমাদিগকে শহর হইতে গ্রামে প্রত্যাবর্তন করিয়া কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করিতে হইবে একটু ভাবিয়া দেখিলে এই সমস্ত যুক্তির অসাতা বুঝা যায়।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমাদিগকে ইউরোপ ও আমেরিকার মতো যান্ত্রিক সভ্যতায় শ্রেষ্টত্বলাভ করিতে হইবে। ভারতের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, তাঁহারা বলেন যে ভারতবর্ষের পক্ষে চিরকাল কৃষিপ্রধান হইয়া থাকা উচিত। এই মত অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক বলিয়া মনে করি। যদি আমরা সকলেই গ্রাম্য জীবনে ফিরিয়া যাই, তাহা হইলে মুষ্টিমেয় পুঁজিবাদীদের পক্ষে শোষণ করা সহজসাধ্য হইয়া পড়ে।’ নাম না করে গান্ধীজীর সমালোচনা এখানে স্পষ্ট। অনেক পরে ১৯৫১ সালে তিনি যখন লোকসভা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ভাবেন, তখন তিনি তাঁর সঙ্গে যে দলের বহুদিনের যোগ সেই কংগ্রেসের কাছেই প্রথম গিয়েছিলেন। কংগ্রেস শর্ত দেয় যে গান্ধীজীর চরকা ও কুটির শিল্পনীতিকে তিনি বিজ্ঞানবিরোধী ও পশ্চাৎমুখী বলেছেন, সেই কথা তাঁকে প্রত্যাহার করতে হবে। সে কথা মেনে না নিয়ে তিনি বামপন্থীদের সমর্থনে প্রথম লোকসভাতে উত্তর কলকাতা কেন্দ্র থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

       লেখা প্রকাশের পরে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হল তার থেকেই আমাদের আলোচ্য প্রবন্ধগুচ্ছের জন্ম; শান্তিনিকেতনের বক্তৃতাটিকে সেগুলির প্রাক-কথন বলা যেতে পারে। পুরো প্রবন্ধটি পড়লে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে এটি গান্ধীজীর নীতির সমালোচনা। কিন্তু গান্ধীবাদীদের নয়, হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসীদের আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন মেঘনাদ। কেন এই লেখা তাঁদের গাত্রদাহের কারণ হয়েছিল?

       ১৯৩৭ সালে এক প্রবন্ধে মেঘনাদ লিখেছিলেন, ‘পশ্চিমা জাতিগুলি চিরকাল বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছে যে কদাচিৎ কখনও দুর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধ প্রভৃতি বিপর্যয় ঘটিলেও পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান অগ্রগতি অক্ষুণ্ণই আছে। এই বিশ্বাসই চিন্তা ও কর্মের ক্ষেত্রে তাহাদের অত্যাশ্চর্য সাফল্যের মূলে।’ এখানে মেঘনাদ একটু অত্যুক্তি করেছিলেন সন্দেহ নেই, পাশ্চাত্যের জাতিরাও চিরকাল প্রগতির ধারণাতে বিশ্বাসী ছিল না। মধ্যযুগে তারাও বিশ্বাস করত যে নতুন কিছু জানার নেই, সবই প্রাচীন পণ্ডিতরা বলে গেছেন। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কার তাই মানুষের চিন্তার ইতিহাসেও এক যুগান্তকারী ঘটনা, প্রাচীন গ্রিক বা রোমানদের লেখায় সেই নতুন মহাদেশের কথা ছিল না। ইউরোপীয় ভাষাসমূহে ‘ডিসকভারি’ বা সমার্থক শব্দগুলির ইতিহাস সেই পরিবর্তনের সাক্ষী।

      প্রগতির ধারণার সূত্র ধরেই মেঘনাদ শান্তিনিকেতনে বলেছিলেন, ‘আদর্শই সভ্যতার গতি নির্ণয় করে এবং প্রথম হইতেই আদর্শের প্রকৃত মূল্য নির্ধারণ করিতে পারিলে অনেক ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়ে ... প্রত্যেক সভ্যতার আদর্শের ভুল ত্রুটি আছে এবং বর্তমানে সমস্ত প্রাচীন ধর্মাত্মক আদর্শই অসম্পূর্ণ বলিয়া প্রতিপন্ন হইয়াছে। কারণ এই সমস্ত ধর্ম তথা আদর্শ বিশ্বজগতের যে ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত সেই ধারণা নিছক কল্পনামূলক। প্রায় সকল প্রাচীন ধর্মেই কল্পিত হইয়াছে যে, পূর্বে এক সত্যযুগ ছিল, তখন মানুষ পরস্পর সম্প্রীতি-সূত্রে বাস করিত। এবং তাহাদিগকে দুর্ভিক্ষ ও মহামারীতে ভুগিতে হইত না। এখন আমরা জানি যে, এইরূপ সত্যযুগের ছবি ভ্রমাত্মক।’ তার আগে বলেছিলেন, ‘হিন্দুর সৃষ্টিকর্তা একজন দার্শনিক তিনি ধ্যানে বসিয়া প্রত্যক্ষ জগত, স্থাবর ও জঙ্গ, জীব এবং ধর্মশাস্ত্রাদি সমস্তই সৃষ্টি করিয়াছেন সেইজন্য যাঁহারা মাথা খাটায়, অলস দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনায় সময় নষ্ট করে এবং নানারূপ রহস্যের কুহেলিকা সৃষ্টি করে, হিন্দু সমাজে তাহাদিগকে খুব বড়ো স্থান দেওয়া হইয়াছে শিল্পী, কারিগর ও স্থপতির স্থান এই সমাজের অতি নিম্নস্তরে এবং হিন্দু সমাজে হস্ত ও মস্তিষ্কের পরস্পর কোনো যোগাযোগ নাই তাহার ফল হইয়াছে এই যে সহস্র বছর ধরিয়া হিন্দুগণ শিল্প ও দ্রব্যোৎপাদনের একই ধারা অনুসরণ করিয়া আসিয়াছে এবং তজ্জন্য বহুবার যান্ত্রিক বিজ্ঞানে উন্নততর বৈদেশিকের পদানত হইয়াছে।’

       মেঘনাদের লেখার উপরে এখানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের ‘A History of Hindu Chemsitry’-এর প্রভাব স্পষ্ট। প্রফুল্লচন্দ্র লিখেছিলেন, ‘In ancient India the useful arts and sciences, as distinguished from mere handicrafts, were cultivated by the higher classes.... unfortunately a knowledge of these perished with the institution of the caste system in its most rigid form.’ পরে মেঘনাদ তাঁর বক্তব্যকে আরও বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, সে কথায় আমরা ফিরে আসব।

       স্বাভাবিক ভাবেই মেঘনাদের এই প্রবন্ধের বহু সমালোচনা হয়েছিল, তার মধ্যে প্রধান ছিল পন্ডিচেরির অরবিন্দ আশ্রমের অনিলবরণ রায়ের লেখাটি। সেটিও ভারতবর্ষ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল। অনিলবরণ অভিযোগ করেছিলেন মেঘনাদ হিন্দুর দর্শন, ধর্ম ও ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য জানার কোনো চেষ্টা না করে পাশ্চাত্য সমালোচকদের মামুলি কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। ঋগ্বেদের পুরুষসূক্ত উল্লেখ করতে অনিলবরণ বোঝাতে চান যে ভগবান একাধারে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র; চার বর্ণের মধ্যে প্রাচীন সমাজে কেউই ন্যূন ছিল না।  ভারতের প্রাচীন শাস্ত্র জগৎ সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে, আধুনিকতম বৈজ্ঞানিক গবেষণা তাকেই সমর্থন করে। ‘বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম বৈজ্ঞানিকেরা বলিতেছেন যে এই বিশ্ব জগতের পশ্চাতে একটা বিরাট চৈতন্য রহিয়াছে, মেঘনাদ এ বিষয়ে গত শতাব্দীতে পড়ে আছেন। বিবর্তন, সূর্যকেন্দ্রিক জগৎ ইত্যাদি আধুনিক মত প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে পাওয়া যায়। শেষে তিনি লেখেন “ডক্টর মেঘনাদ সাহা যদি বিজ্ঞানের আধুনিকতম জ্ঞান লইয়া দেখাইয়া দিতে চেষ্টা করেন যে উহার সহিত হিন্দুর প্রকৃত আধ্যাত্মিকতার কোনই বিরোধ নাই, তাহা হইলেই তাহার ন্যায় প্রতিভাশালী ব্যক্তির উপযুক্ত কর্ম করা হইবে এবং তিনি দেশের এবং জগতের অশেষ কল্যাণসাধন করিতে পারিবেন।

       অসুস্থতার কারণে এই লেখাটি কিছুদিন মেঘনাদের চোখে পড়েনি। তিনি ছোটবেলা থেকে জাতিভেদ প্রথা ও দারিদ্রের শিকার। কলকাতার নাগরিক সমাজেও পূর্ববঙ্গ থেকে আগত তরুণ মেঘনাদ নানা সময়ে ব্যঙ্গের শিকার হয়েছেন। নিজের কৃতিত্বে তিনি বিশ্বের দরবারে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বিদেশী বিজ্ঞানীদের মুরুব্বিয়ানার মনোভাবও তাঁকে আহত করত। শৈশব-কৈশোর-প্রথম যৌবনের সেই অবহেলা ও অপমান তাঁর মনে স্থায়ী দাগ কেটে গিয়েছিল। সমসাময়িকদের সাক্ষ্য থেকে তাঁর মেজাজের পরিচয় পাওয়া যায়।  অনিলবরণ রায়ের  উপদেশ দানের ভঙ্গি এবং জাতিভেদ প্রথার প্রতি সমর্থন তাঁর পছন্দ হয়নি। ভারতবর্ষ পত্রিকাতে তিনি পরপর কয়েকটি প্রবন্ধ লিখে সেই সমালোচনাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছিলেন। মোহিনীমোহন দত্ত ভারতবর্ষে একটি প্রবন্ধে মেঘনাদের কথার দুর্বলভাবে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন, অপর একটি প্রবন্ধে মেঘনাদ তাঁকে তাচ্ছিল্যভরে উড়িয়ে দেন। মেঘনাদের এই প্রবন্ধগুলিই আমরা সংক্ষেপে ফিরে দেখব।

       প্রবন্ধগুলির বিষয়বস্তুতে ঢোকার  আগে বলতে হয় তাদের খরশান ব্যঙ্গের কথা। স্থানাভাবে একটিই উদাহরণ দেখা যাক। সাহা লিখেছেন, জনৈক পরিচিত ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন তিনি কী বৈজ্ঞানিক কাজ করেছেন। মেঘনাদের কথা শুনে তিনি বলেন যে ‘সবই ব্যাদে আছে।’ বেদের কোথায় আছে, সেই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বললেন যে বেদ তাঁর পড়া হয়নি বটে, কিন্তু তাঁর বিশ্বাস সবই সেখানে পাওয়া যাবে। প্রাচীন শাস্ত্র থেকে যাঁরা আধুনিক বিজ্ঞানের তত্ত্ব খুঁজে বার করেন, তাঁদের সম্পর্কে মেঘনাদের এই ‘সবই ব্যাদে আছে  ব্যঙ্গোক্তি আজ প্রবাদে পরিণত।

       মেঘনাদ লিখলেন সমালোচক তাঁর প্রবন্ধের উদ্দেশ্যই বুঝতে পারেননি। তিনি দেখাতে চেয়েছিলেন যে আদর্শ যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়, ভগবানের ধারণাও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রাচীনকালের ভারতীয় সভ্যতা অন্যদের থেকে এগিয়ে ছিল কিনা তা আলোচনা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না; সেই সময়ে তা শ্রেষ্ঠ ছিল বলে আধুনিক যুগেও তা শ্রেষ্ঠ, এ কুযুক্তি। তা যে মধ্যযুগ বা আধুনিক যুগের উপযোগী নয়, ইতিহাস পাঠ করলেই তা বোঝা যায়। অনিলবরণ লিখেছিলেন হিন্দুধর্ম ও দর্শনের মূল হল বেদ। সাহা দেখান যে বৈদিক ধারার বাইরেও হিন্দু ধর্মের মধ্যে একটি বিরাট ও সুপ্রাচীন ধারা বহমান।

অনিলবরণের জাতিভেদ প্রথার সমর্থন স্বভাবতই তাঁর সমালোচনার শিকার হয়েছে। পুরুষসূক্তের আলোচনা প্রসঙ্গে মেঘনাদ মনে করিয়ে দেন যে সমস্ত বিশেষজ্ঞের মতেই সেটি পরবর্তীকালে রচিত, জাতিভেদ প্রথার সমর্থনে বেদের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঋক বেদে অন্য কোথাও ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্র এই চার জাতির উল্লেখ নেই। জাতিভেদ প্রথার দার্শনিক ব্যাখ্যা তাঁর প্রবন্ধের আলোচনাতে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক, দেখতে হবে সমাজ সেই প্রথাকে কেমনভাবে নিয়েছে। এই প্রথার থেকেই অস্পৃশ্যতা, বর্ণসঙ্করবাদ ইত্যাদি কুপ্রথার উদ্ভব। তার থেকেও বড় কথা হল যে জাতিভেদ প্রথা হাত ও মাথার মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন করে দিয়েছে, ফলে নতুন প্রকৌশল সৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। ‘ফলে বৈদিক যুগ হইতে এতাবৎকাল পর্যন্ত আমরা একই প্রাগ্বৈদিক চরকাতেই সুতা কাটিতেছি, কাঠের তাঁতে বস্ত্রবয়ন করিতেছি এবং আধুনিককালেও মহাত্মা গান্ধী আমাদিগকে পুনরায়, “বৈদিক অসভ্যতায়” ফিরিয়া যাইতে বলিতেছেন।’ মেঘনাদ আরও বলেন যে প্রতিভা থাকলে ইউরোপে কসাইয়ের ছেলে শেক্সপিয়ার হতে পারত, আমাদের প্রাচীন সভ্যতায় সে সেইরকম চেষ্টা করলে তার মাথা কেটে নেওয়ার বিধান আছে।

       প্রবন্ধগুলিতে মেঘনাদ নানা বিষয় আলোচনাতে এনেছেন। বিভিন্ন ঐতিহাসিকের মত উদ্ধৃত করে এবং জ্যোতির্বিদ্যার সাক্ষ্য থেকে ঋক বেদ রচনার কাল নির্ণয়ের চেষ্টা করেছেন। প্রাক-বৈদিক সভ্যতার দেবদেবীরা কেমনভাবে হিন্দু ধর্মের মধ্যে স্থান পেয়েছে তা দেখিয়েছেন। জাতীয় পরিকল্পনার উদ্দেশ্য এবং দেশের উন্নয়নে বিজ্ঞান প্রযুক্তির ভূমিকা তিনি এই লেখাতে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি কেমনভাবে ঘটে, বিজ্ঞানের যুক্তি বলতে কী বোঝায় – এই সমস্ত নিয়ে একজন প্রথম শ্রেণির বিজ্ঞানীর মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। প্রাচীন ভারতীয় পঞ্জিকাতে ভুল থাকার ফলে কেমনভাবে আমাদের বছর গোনাতে ভুল রয়ে গেছে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন; স্মরণীয় যে পরে তিনি স্বাধীন ভারতে পঞ্জিকা সংস্কারের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। ভারতীয় শাস্ত্রের ধারণার প্রতি বিদেশী বিজ্ঞানীদের বা আধুনিক বিজ্ঞানের তথাকথিত সমর্থন প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে মেঘনাদ দেখান যে তাঁর সমালোচকরা বিজ্ঞান আদৌ বোঝেননি বা ভুল ব্যাখ্যা করছেন। দীর্ঘ প্রবন্ধগুলির সমস্ত দিক আলোচনা করা এই নিবন্ধের পরিসরে সম্ভব নয়। এই লেখার অবশিষ্ট অংশে  আমরা শুধু সংক্ষেপে প্রাচীন শাস্ত্রের ভিতর বিজ্ঞানের আধুনিক আবিষ্কারের সন্ধান বিষয়ে তাঁর বক্তব্য দেখার চেষ্টা করব। বর্তমানে যখন পুরাণ বা মহাকাব্যের মধ্যে বিজ্ঞান খোঁজার চেষ্টা চলছে, পুষ্পক রথের মধ্যে প্রাচীন বিমানের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, তখন এক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বিষয়টাকে কেমনভাবে দেখেছিলেন সেই আলোচনা হয়তো অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

       মেঘনাদ প্রাচীন ভারতে বিজ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে খুবই সচেতন ছিলেন, কিন্তু অযৌক্তিকভাবে ইতিহাসের সাক্ষ্য উপেক্ষা করে তার শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণাতে তাঁর আপত্তি ছিল। তিনি প্রথমেই লেখেন, ‘বর্তমান সমালোচকের মত অনেক সমালোচকই বোধহয় কল্পনা করিয়াছেন যে আমি হিন্দু ধর্মের ও দর্শনের কোন মৌলিক গ্রন্থ পড়ি নাই। এরূপ ধারণা করিবার পূর্বে একটু অনুসন্ধান করিয়া লইলে বুদ্ধিমানের কার্য হইত। যাহা হউক, আশা করি এই প্রত্যুত্তর পাঠে তাঁহার ভ্রান্তির নিরসন হইবে।’ এরপরে তিনি বেদ, উপনিষদ, মহাভারত ও পুরাণ থেকে নানা উদাহরণ তুলে দেখান যে কীভাবে সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা করে প্রাচীন শাস্ত্রের মধ্যে আধুনিক বিজ্ঞানের সন্ধান করা হচ্ছে।

       মেঘনাদ লিখলেন, ‘এক শ্রেণীর লোক বলেন যে, বিজ্ঞান আর নূতন কি করিয়াছে? বিজ্ঞান বর্তমানে যাহা করিয়াছেন তাহা কোন প্রাচীন ঋষি, বেদ পুরাণ বা অন্য কোথাও না কোথাও বীজাকারে বলিয়া গিয়াছেন।’ অনিলবরণ রায় লিখেছিলেন জন্মান্তরবাদ ও অবতারতত্ত্বই প্রমাণ করে যে হিন্দুরা বিবর্তনবাদ জানত। মেঘনাদ প্রশ্ন করেন, জন্মান্তরবাদ বলে মানুষ পাপ করলে মনুষ্যেতর জীব হিসাবে জন্ম হয়, তার সঙ্গে বিবর্তনের সম্পর্ক কোথায়? অবতারবাদ প্রসঙ্গে তিনি দেখান যে মহাভারত, পুরাণের মধ্যে অবতারের তালিকার অনেক পার্থক্য আছে। অবতারবাদের মধ্যে অনেক স্ববিরোধিতার দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। অবতারবাদ থেকে অনিলবরণ যে অর্ধপশু-অর্ধমানুষ বা বামন মানুষের কথা বলেছেন, তারা কোনোদিন পৃথিবীতে ছিল না। বিবর্তনবাদের সঙ্গে সভ্যতার বিকাশকে সমালোচক গুলিয়ে ফেলে সত্যযুগ কলিযুগ ইত্যাদির কথা বলেছেন। বাস্তব পৃথিবীতে কখনো সত্যযুগ ছিল না, তা একান্তই প্রাচীন পুরাণকারের কল্পনা। 

       অনিলবরণ লিখেছিলেন পৃথিবী যে গোল, সূর্য যে সৌরজগতের কেন্দ্র ও পৃথিবী যে চলমান তা কোপার্নিকাস বা গ্যালিলিওর অনেক আগেই ভারতবর্ষে জানা ছিল। মেঘনাদ মনে করিয়ে দেন যে গ্যালিলিও বা কোপার্নিকাসের অনেক আগে থেকেই পাশ্চাত্য বিজ্ঞানে এই সমস্ত ধারণা ছিল। পৃথিবী যে চলমান সে কথা এই দুজনের কেউ প্রথম বলেননি। খ্রিস্ট জন্মের সাড়ে পাঁচশো বছর আগে গ্রিসে অ্যানাক্সিম্যান্ডার পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথা বলে গিয়েছিলেন। পৃথিবীর বার্ষিক গতির কথা বলেছিলেন খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীতে গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টার্কাস। ওই শতাব্দীতেই আলেকজান্দ্রিয়ার বিজ্ঞানী এরাটোস্থিনিস প্রথম পৃথিবীর ব্যাস মেপেছিলেন। পৃথিবী যে গোল তা তার অনেক আগে থেকেই নিশ্চয় গ্রিকদের জানা ছিল, তা না হলে তার ব্যাস মাপার প্রশ্ন ওঠে না।

       মহাভারতের সাক্ষ্য থেকে মেঘনাদ পাশ্চাত্য জ্যোতিষ ভারতবর্ষে আসার কালনির্ণয়ের চেষ্টা করেন। তিনি দেখান যে মহাভারতে বার, রাশিচক্র, পৃথিবীর আহ্নিক বা বার্ষিক গতির উল্লেখ নেই। মহাভারতের মতে পৃথিবী সমতল, সুমেরু তার কেন্দ্রে অবস্থিত, সূর্য তাকে প্রদক্ষিণ করে। এ থেকে বোঝা যায় যে মহাভারত সংকলনের সময় পৃথিবীর আকার, আবর্তন ইত্যাদি বিষয়ে ভারতবর্ষে জানা ছিল না। ভারতবর্ষে খ্রিস্টিয় দ্বিতীয় শতাব্দীতেই পাশ্চাত্য জ্যোতিষ প্রচলিত হয়, এবং ভারতীয় জ্যোতিষীরা সেই অনুযায়ী পঞ্জিকা রচনা শুরু করেন। মেঘনাদ ভারতীয় জ্যোতিষ সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা করেন। সূর্যসিদ্ধান্ত ও বরাহমিহিরের পঞ্চসিদ্ধান্তিকা উদ্ধৃত করে তিনি দেখান যে খ্রিস্টিয় পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে ভারতীয় জ্যোতির্বিদরাই প্রাচীন ভারতীয় পঞ্জিকাকে অশুদ্ধ বলে ইউরোপ থেকে আগত পঞ্জিকা ব্যবহারের পক্ষে মত দিয়েছেন।  মেঘনাদ বলেন যে স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেওয়া যায় পৃথিবী সম্পর্কে গ্রিক মতও তাঁদের কাছে পৌঁছেছিল। সূর্য যে সৌরজগতের কেন্দ্র, সে বিষয়ে যে শ্লোকটি অনিলবরণ উদ্ধৃত করেছিলেন, মেঘনাদ দেখান যে তাতে পৃথিবী যে গ্রহ সে কথা বলা নেই। সেই শ্লোকে সূর্য যে সৌরজগতের কেন্দ্র বলা হয়েছে, তা মেনে নিতে গেল কল্পনাকে অনেকদূর বাড়াতে হয়; এর সরল অর্থ হল সমস্ত গ্রহের মধ্যে সূর্য সবচেয়ে উজ্জ্বল।  

        মেঘনাদের কালেও বলা হত, আজও হয়, যে আর্যভট্ট পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিণের কথা প্রথম বলেছিলেন। আর্যভট্টের যে শ্লোকটি তার সমর্থনে উদ্ধৃত করা হয়, তার থেকে স্পষ্টতই দেখা যায় আর্যভট্ট আহ্নিক গতির কথাই বলেছেন। মেঘনাদ লিখেছেন যে বার্ষিক গতির কথা কোনো ভারতীয় প্রাচীন জ্যোতিষী বলেছেন জানা নেই, আর্যভট্ট নিজে পৃথিবীকে সৌরজগতের কেন্দ্র ধরে নিয়ে গ্রহদের গতি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।

       একই রকমভাবে একটি কথা এখনও শোনা যায়, ভাস্করাচার্য মাধ্যাকর্ষণের কথা বলেছিলেন, সুতরাং ‘নিউটন আর নূতন কি করিয়াছে?’ সমস্যা হল যে যাঁরা বলেন তাঁরা মাধ্যাকর্ষণ সূত্রটিও ভালো করে পড়েন নি। নিউটন শুধুমাত্র পৃথিবীর আকর্ষণের কথা বলেন নি, সমস্ত বস্তু অন্য বস্তুকে যে বলে আকর্ষণ করে তার গাণিতিক রূপ দিয়েছিলেন এবং তার সাহায্যে পৃথিবী ও অন্য গ্রহদের কক্ষপথ নিরূপণ করেছিলেন। মেঘনাদের মতে, দেশে এমন অপবিজ্ঞান প্রচারকের অভাব নেই যাঁরা সত্যের নামে এমন নির্জলা মিথ্যার প্রচার করছেন।

       এই প্রবন্ধগুলি রচনার পরে আশি বছর কেটে গেছে। ভাবলে দুঃখ হয় যে প্রবন্ধগুলি আজও প্রাসঙ্গিক; অপবিজ্ঞান প্রচারকরা এখনও কুযুক্তির আশ্রয় নিয়ে চলেছেন। বেদ না পড়েই তাঁরা বেদের মধ্যে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির সমস্ত আধুনিক আবিষ্কারকে খুঁজে পান, মহাকাব্য ও পুরাণের গল্পের মধ্যে শল্যচিকিৎসাকে সন্ধান করেন। বিজ্ঞান মানসিকতার দিক থেকেও আমরা এখনো খুব বেশি এগোতে পারিনি। মেঘনাদ লিখেছিলেন ‘আমাদের দেশে শতকরা ৯৯ জন পুরুষ, এবং ১০০ জন স্ত্রীলোক ফলিত জ্যোতিষে বিশ্বাস করেন। … পঞ্জিকায় অন্ধবিশ্বাস জাতীয় জীবনের দৌর্বল্যের দ্যোতক।’ সেই মাপকাঠিতে আমাদের জাতীয় জীবন এখনও দুর্বল।

       মেঘনাদের ভাষা জায়গায় জায়গায় বেশ কঠোর, কিন্তু তার কারণও ছিল। সেই কথা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু। বলেছিলেন, ‘আমি সনাতনীদের এই কথাটি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, আমার বন্ধু যেমন বলতেন ঠাট্টা করে, সবই “ব্যাদে আছে”, “বেদে আছে” এই মনোভাবটা অনেক সময়ে যদি নিদান করতে হয় তাহলে মাঝে মাঝে শক্ত কথাই বলতে হয়।’ মেঘনাদ লিখেছিলেন, ‘বর্তমান লেখক বৈজ্ঞানিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হিন্দুর বেদ ও অপরাপর ধর্মের মূলতত্ত্ব বুঝিতে চেষ্টা করিয়াছেন। ইহাতে অবজ্ঞা বা অবহেলার কোন কথা উঠিতে পারে না।’ এই বৈজ্ঞানিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টির অভাবই আমরা বোধ করছি। স্থানাভাবে মেঘনাদের লেখাগুলির অনেক দিকই অনালোচিত থেকে গেল, পাঠককে মূল প্রবন্ধগুলি পড়তে অনুরোধ করি।

(মেঘনাদ সাহা ও অনিলবরণ রায়ের রচনার উদ্ধৃতিগুলি ও সত্যেন্দ্রনাথের উদ্ধৃতিটি শ্যামল চক্রবর্তী সম্পাদিত ‘বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা রচনা সংকলন’ থেকে নেওয়া হয়েছে।)

প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, শারদীয় ২০২০


Friday 20 November 2020

শতবর্ষে আইজ্যাক আসিমভ

 

শতবর্ষে আইজ্যাক আসিমভ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

    কল্পবিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশনের স্বর্ণযুগ ধরা হয় গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের শেষ থেকে পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত সময়কালকে। তিরিশের দশকে কল্পবিজ্ঞান ছিল মূলত রূপকথার আধুনিক সংস্করণ; স্বর্ণযুগের লেখকরা কাহিনির বিজ্ঞানকে বাস্তবোচিত করে তোলেন। সমাজ ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক তাঁদের লেখায় ধরা দেয়। সেই সময়ের সব থেকে বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখকদের মধ্যে পড়বেন রে ব্র্যাডবুরি, আর্থার সি ক্লার্ক, রবার্ট হেইনলেইন, ফ্রেডরিক পোল ও আইজ্যাক আসিমভ। এঁদের মধ্যে আসিমভ বয়সে ছোটদের দলে পড়লেও লেখা শুরু করেছেন অনেকেরই আগে। তিনি যখন প্রথম গল্প প্রকাশ করেছিলেন, তখন তাঁর বয়স উনিশ। জন ক্যাম্পবেল সম্পাদিত Astounding Science Fiction পত্রিকার জুলাই ১৯৩৯ সংখ্যাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কল্পবিজ্ঞানে স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। ঘটনাচক্রে সেই সংখ্যাতে আসিমভের গল্প প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল। 

       কোনো একটি বিশেষ গল্প বা উপন্যাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগে এই নিবন্ধে নেই, তবে প্রথম প্রকাশিত সেই Trends গল্পটিতেই আমরা আসিমভের পরবর্তী অনেক রচনার মূল সূত্র খুঁজে পাই। গল্প লেখার কয়েক মাস পরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, গল্পে সেই ভবিষ্যৎবাণীও ছিল। তবে সেই সময়ে অধিকাংশ মানুষই যুদ্ধ যে আসন্ন সে কথা অনুমান করেছিলেন, তাতে আসিমভের আলাদা করে কোনো কৃতিত্ব নেই। মহাকাশ অভিযানের সামাজিক বিরোধিতা ছিল এই গল্পের উপজীব্য, সেখানে এসেছে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির প্রতি বৃহত্তর সমাজের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কথা। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের বিরোধিতা সমাজে আরো অনেক বিস্তার লাভ করেছে সন্দেহ নেই, সেই দিক থেকে আসিমভকে আমরা ভবিষ্যৎবক্তার দলে ফেলতে পারি। 

       আসিমভের জন্মের দিন সঠিক জানা নেই, তিনি নিজে লিখতেন ১৯২০ সালের ২ জানুয়ারি। সেই হিসাব ধরলে আমরা তাঁর জন্ম শতবর্ষ পেরিয়ে এলাম। বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়াতে তাঁর জন্ম, তাঁর তিন বছর বয়সে তাঁর বাবা মা গৃহযুদ্ধবিদীর্ণ রাশিয়া ছেড়ে আমেরিকাতে চলে আসেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন নিয়ে মাস্টার্স পাস করেন ১৯৪১ সালে, এর পর ১৯৪৮ সালে সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই রসায়নে ডক্টরেট করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য গবেষণাতে ছেদ পড়েছিল। ১৯৪৯ সালে তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনে জৈবরসায়ন পড়ানো শুরু করছিলেন। লেখালেখির জন্য গবেষণা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পড়ানো তিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে তিনি প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৯২ সালের ৬ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৮৩ সালে এক অস্ত্রোপচারের সময় তাঁকে যে রক্ত দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে তাঁর এইচআইভি সংক্রমণ ঘটেছিল, কিন্তু ডাক্তাররা  সেই কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরে তাঁর স্ত্রী আত্মজীবনীতে সেই কথা লিখেছিলেন।

       ব্যক্তি আসিমভ বেশ বিতর্কিত চরিত্র। গবেষণা না করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একসময় তাঁকে বরখাস্ত করেছিলেন, দু’বছর লড়াই করে তিনি চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন। মহিলাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার কখনো কখনো ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইকিউ নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা হয়; আসিমভ ছিলেন উচ্চ আইকিউসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংস্থা মেনসার মার্কিন শাখার সহসভাপতি। তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে মেনসার অনেক সদস্য অতিরিক্ত আগ্রাসী ব্যবহার করে, অথচ মেনসার সদস্যপদ নিয়ে তাঁর বেশ অহঙ্কার ছিল। নিজের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে তাঁর ধারনা বেশ উঁচু ছিল সন্দেহ নেই, তিনি মনে করতেন জীবনে তাঁর থেকে বুদ্ধিমান দুজনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল, জ্যোতির্বিদ কার্ল সাগান এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী মার্ভিন মিনস্কি।

       বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন আসিমভ, সেই বিষয়ে তাঁর লিখিত বইয়ের সংখ্যা একশো কুড়ি। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিদ্যা – নানা বিষয়ে তিনি বই লিখেছিলেন, প্রায় সবগুলিই বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সাধারণের জন্য বিজ্ঞান লিখতে গিয়ে বিজ্ঞানকে অতিসরলীকরণের পথে হাঁটেননি আসিমভ। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করাতে তাঁর অসাধারণ দক্ষতার জন্য শুধু সাধারণ মানুষ নয়, তাঁর বইগুলি সেই বিষয়ে গবেষকদেরও উপকারে লেগেছিল। লিখেছেন জৈবসসায়নের পাঠ্য পুস্তক। বিশ্বউষ্ণায়ন, বায়ুদূষণ ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন সত্তরের দশকেই; এই সমস্ত পরিবেশগত সমস্যার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে তাঁর বিশেষ ভূমিকা আছে।  

       লেখালেখির বাইরেও বিজ্ঞান চেতনা প্রসারের জন্যও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তথাকথিত অলৌকিক ঘটনার পিছনে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছিল একটি সংস্থা, কমিটি ফর দি সায়েন্টিফিক ইনভেস্টিগেশন অফ দি ক্লেমস অফ দি প্যারানর্মাল, পরবর্তীকালে যা নাম পালটে হয়েছে কমিটি ফর স্কেপটিকাল এনকোয়ারি। আসিমভ ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, তাঁর খ্যাতির সুবাদেই এই সংস্থা সাধারণের মধ্যে পরিচিতি লাভ করেছিল। তিনি ছিলেন স্বঘোষিত নাস্তিক, গত শতাব্দীর মধ্যভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন ইহুদির পক্ষে এই স্বীকারোক্তি খুব সহজ কথা ছিল না।

       আসিমভের সমস্ত রচনা নিয়ে আলোচনা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, আমরা শুধু তাঁর কল্পবিজ্ঞান রচনার দিকেই চোখ রাখব।। কল্পবিজ্ঞানের বাইরে বেশ কয়েকটি রহস্য কাহিনি তিনি লিখেছিলেন, কিন্তু সেগুলি আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে। কল্পবিজ্ঞানেও মাত্র কয়েকটি গল্প বা উপন্যাসের মধ্যেই এই প্রবন্ধ সীমাবদ্ধ থাকবে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তিগত পছন্দই প্রাধান্য পেয়েছে, তাই সেই বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

       আসিমভ লিখতে ভালবাসতেন, সমস্ত লেখা মিলিয়ে মোট ছাপা শব্দের পরিমাণ দু কোটি ছাপিয়ে যাবে। তাঁর লেখালেখির জীবনকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। কল্পবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগের শুরুতেই প্রথম গল্প প্রকাশ করলেও তিনি তখনই বিশেষ পরিচিতি লাভ করেননি, তবে কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে জায়গা করে নেন। উনিশশো পঞ্চাশের দশকের শেষে স্বর্ণযুগের অবসান হয়। এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ এই লেখাতে নেই, তবে একথা বলা যেতেই পারে যে স্বর্ণযুগের সমাপ্তিতে কল্পবিজ্ঞানের ধারা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কল্পবিজ্ঞানের উপর অনেক বেশি পড়তে শুরু করেছিল। আসিমভ এই সময় কল্পবিজ্ঞান লেখা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে বিজ্ঞানের বই লেখা শুরু করেন। তাঁর সব সেরা লেখাগুলি সেই স্বর্ণযুগের দুই দশকের মধ্যের রচনা। প্রায় দেড় দশক পরে তিনি আবার কল্পবিজ্ঞানের জগতে ফিরে আসেন। কিন্তু একমাত্র The Gods Themselves উপন্যাস ছাড়া এই সময়ের অন্য লেখাগুলির মধ্যে আমি পুরানো আসিমভকে খুঁজে পাই না। প্রথম যুগে লেখা বেশ কয়েকটি অসাধারণ গল্পকে তিনি এই সময় উপন্যাসের রূপ দিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলি আমার খুবই সাধারণ মানের মনে হয়। এই সময় তাঁর বিখ্যাত Foundation সিরিজে তিনি আরও কয়েকটি উপন্যাস যোগ করেছিলেন, কিন্তু তার জন্য মাঝে মাঝেই গল্পের মধ্যে স্ববিরোধিতা এসেছে, গল্পের রসও ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তাই আমি আলোচনার জন্য তাঁর প্রথম যুগের কয়েকটি লেখাই বেছে নিয়েছি।

       সমসাময়িক বিখ্যাত লেখক আর্থার সি ক্লার্কের সঙ্গে আসিমভের তুলনা করলে আমরা তাঁর লেখার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করতে পারি। লেখালেখির ক্ষেত্রে সম্পাদক জন ক্যাম্পবেল ছিলেন আসিমভের পিতৃপ্রতিম, অথচ সচেতনভাবেই ক্যাম্পবেলের জাতিবাদী ও ফ্যাসিবাদী চিন্তাভাবনাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ক্লার্কের লেখাও জাতিধর্মবর্ণ বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছে। ক্লার্কের রচনাতে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা খুব কম। নিজে বিজ্ঞানের ডক্টরেট ও শিক্ষক, জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই লিখেছেন; কিন্তু কাহিনি রচনাতে আসিমভের কল্পনার উড়ান অনেক বেশি। তাঁর রচনা আমাদের নিয়ে যায় দূর ভবিষ্যতে, যেখানে গোটা ছায়াপথই হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবসভ্যতার ক্রীড়াভূমি।

       ক্লার্কের মতোই আসিমভও ছিলেন অপরিমেয় আশাবাদী, অথচ তাঁর কাহিনিতে দেখি বিজ্ঞানের প্রগতি  সমাজের বিকাশকে বিশেষ পরিবর্তন করতে পারেনি। প্রায়শই তা বন্দী হয়ে গেছে প্রাচীনযুগের পুরোহিততন্ত্র ও মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের ঘেরাটোপে। এ কিন্তু কোনো সমালোচনা নয়, সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি আসিমভের ভবিষ্যতের কাহিনি লেখার প্রধান শক্তি। ক্লার্কের লেখাতে পাত্রপাত্রীরা ভবিষ্যৎ সমাজের অংশ। আসিমভের ভবিষ্যত সমাজ আমাদের বর্তমানের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা  বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রগতির পথ সন্ধান করেছে। তাঁর End of Eternity উপন্যাস সচেতনভাবেই ইতিহাসের পৌনঃপুনিকতার শিকল ভাঙতে চেয়েছে।

       তাঁর সব থেকে বিখ্যাত লেখাগুলির মধ্যে পড়বে Foundation সিরিজের কাহিনিগুলি, আসিমভ সেখানে সচেতনভাবেই গিবনের বিখ্যাত ইতিহাস The Decline and fall of Roman Empire-কে অনুসরণ করেছেন। অতিরিক্ত কেন্দ্রিকতা, হাতে কলমে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পরিবর্তে অতীতের পণ্ডিতদের লিখিত বইয়ের সাক্ষ্যের উপর গুরুত্ব দান, সামরিক শক্তির উপর অতিনির্ভরতা – নানা কারণে রোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছিল। প্রথম বইয়ের সূচনাতে ছায়াপথব্যাপী সাম্রাজ্য একই কারণে ধ্বংস হচ্ছে, (যদিও প্রথম বইয়ের সূচনাটা আসিমভ লিখেছিলেন কয়েকটি গল্প প্রকাশের পরে, সেগুলিকে একসঙ্গে করে উপন্যাস হিসাবে প্রকাশের সময়)। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে ইউরোপে নেমে এসেছিল অন্ধকার যুগ, পুরোহিততন্ত্রের রমরমার সময়। ইউরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয়েছিল ফ্লোরেন্স ও ভেনিসের বণিকদের হাত ধরে। তারপরে আসে শিল্পবিপ্লব ও গণতন্ত্রের যুগ। আসিমভের গল্পও একই ধারা অনুসরণ করেছে, কিন্তু তা কখনোই ঐতিহাসিক কাহিনি নয়। এই পরিবর্তন ইতিহাসের অমোঘ কিন্তু উদ্দেশ্যহীন পরিবর্তন নয়, তা সচেতন হস্তক্ষেপের ফল। এখানেই প্রকাশ পেয়েছে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর অপরিমেয় আশাবাদ। সেই আশাবাদের প্রতিফলন দেখতে পাই Nemesis উপন্যাসে, যেখানে মানুষ সৌরজগতের সঙ্গে সংঘর্ষে উদ্যত এক নক্ষত্রকে তার প্রযুক্তির সাহায্যে সরিয়ে দিয়েছে।

       এই গল্পগুলিতেই আসিমভ এনেছেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কল্পনাটিকে, সাইকোহিস্ট্রি। আসিমভ যে কটি শব্দ ইংরাজি অভিধানে যুক্ত করেছেন, তার মধ্যে এটি অন্যতম। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, মনোবিদ্যা ও পরিসংখ্যানবিদ্যার মিলিত রূপ সাইকোহিস্ট্রি মানবসভ্যতা কোন পথে এগোবে তা নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে। সিরিজের পরের গল্পগুলিতে অবশ্য আসিমভ এই ধারা থেকে সরে এসেছিলেন, ফলে সাইকোহিস্ট্রি প্রায় পুরোপুরি মনোবিদ্যার পথ ধরেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য সাইকোহিস্ট্রির এই ধারণার মূল লুকিয়েছিল আসিমভের প্রথম দিকের Homo Sol ইত্যাদি কয়েকটি গল্পে, যদিও সেগুলি তখন বিশেষ পরিচিত হয়নি। একই সঙ্গে আসিমভ দেখিয়েছিলেন সমাজের অবক্ষয়ের যুগে যে কোনো রকমের জ্ঞানচর্চাকেই সন্দেহের চোখে দেখা হতে পারে, তার নানা উদাহরণ আমরা এখন আমাদের সমাজে দেখতে পাচ্ছি।

       ইংরাজি অভিধানে আরও দুটি শব্দ আমরা আসিমভের কল্যাণে পেয়েছি, রোবোটিক্স ও পজিট্রনিক। আসিমভের যন্ত্রমানবরা রোবোটিক্সের তিনটি নিয়ম মেনে চলে, অনেক গল্পকার এই নিয়মগুলি তাঁদের কাহিনিতে ব্যবহার করেছেন। তাঁর রোবটদের মস্তিষ্ক পজিট্রন নিয়ন্ত্রিত, তা সে বাস্তবে যতই অসম্ভব হোক না কেন। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রোবটদের মধ্যে মানবিক গুণ সঞ্চারিত হয়েছে, এক সময় মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো প্রভেদ করাই সম্ভব নয়।

       রোবটের কাহিনিকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে আসিমভের ইতিহাস চেতনা । প্রাচীন গ্রিস ও রোম পশ্চিমে সভ্যতার আলো দেখিয়েছিল, কিন্তু তাদের ভিত্তি ছিল দাসদের শ্রম। নানা সময় ক্রীতদাসদের বিদ্রোহ সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আসিমভের রোবটদের পক্ষে বিদ্রোহ করার কোনো উপায় নেই, তিন নিয়মের শৃঙ্খলে তারা বন্দী। তাহলে কি এভাবে দাসের পরিবর্তে রোবট শ্রমের ভিত্তিতে প্লেটোর আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে পারে?  আসিমভের উত্তর হল, না। তাঁর কাহিনিতে পৃথিবী থেকে প্রথম যে মানুষরা ছায়াপথের অন্য গ্রহ জয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল, তাদের বলা হয় স্পেসার। তাদের সহায় হয়েছিল রোবট। পৃথিবীর সমাজে রোবট প্রযুক্তি সহ বিজ্ঞান প্রযুক্তির যে কোনো অগ্রগতিকেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়, অর্থনৈতিকভাবে ক্রমশই পৃথিবী পিছিয়ে পড়ে। কিন্তু রোবটের উপর অতিনির্ভরতা শেষ পর্যন্ত স্পেসার সমাজদেরও ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়। পৃথিবী থেকে আবার মানুষ ছায়াপথের নানা গ্রহে বসতি স্থাপন করে, কিন্তু রোবট শ্রমের উপর তারা নির্ভর করেনি। রোবটের উপরে অনেকগুলি ছোট বড় গল্প ছাড়াও Caves of Steel, Naked Sun, Robots of Dawn উপন্যাসগুলিতে আসিমভ প্রযুক্তির অন্ধ বিরোধিত ও তার উপর অতিনির্ভরতা, এই দুয়ের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন।

      এই তিনটি উপন্যাস ও Foundation-এর মধ্যের সময়কালে ছায়াপথব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছে।  তিনটি উপন্যাসের মাধ্যমে তার ইতিহাস লিখেছেন আসিমভ, Pebble in the Sky, The Stars Like Dust ও The Currents of Space। দুই মহাযুদ্ধের মধ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মহাশক্তি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশের ছায়া তাঁর লেখাতে পড়েছিল।  বিখ্যাত ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়নবির মতে সভ্যতার ইতিহাস চক্রাকার -- যে কোনো সভ্যতাই এক সময় মধ্যগগনে পৌঁছয়, তারপর তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। আসিমভ তাঁর উপন্যাসগুলির সূত্রকে টয়নবির এই মতের সাহায্যে বেঁধেছেন, কিন্তু তাঁর আশাবাদ তাঁকে সেই চক্রাকার পরিবর্তনের থেকে বেরোনোর গল্পও লিখতেও প্রেরণা জুগিয়েছে। জন্মমৃত্যুর কাহিনি লিখলেও ছায়াপথ সাম্রাজ্য যখন তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়, সেই সময়ের কোনো উল্লেখযোগ্য কাহিনি তাঁর লেখাতে আসেনি। এই কাহিনিগুলিতে রোবটদের কোনো ভূমিকা নেই। সেটা স্বাভাবিক, তার কারণ এগুলি তাঁর রোবটের কাহিনি প্রকাশের আগে লেখা। বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত রোবটদের কাহিনি, ছায়াপথ সাম্রাজ্য এবং Foundation সিরিজ এক বিন্দুতে পৌঁছেছে, কিন্তু সেগুলির অধিকাংশই তাঁর পরবর্তীকালের রচনা, এবং কাহিনি হিসাবে বেশ দুর্বল।

       বেশ কয়েকটি অসাধারণ ছোট গল্প লিখেছেন আসিমভ। তাঁর Nightfall গল্পটি বহুবার পাঠকদের বিচারে কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গল্প নির্বাচিত হয়েছে, আমাদের আলোচনা তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি। গল্পটির শুরু হয়েছে কবি ও দার্শনিক র‍্যালফ এমারসনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। এমারসন বলেছিলেন যে যদি এক হাজার বছরে একবার মাত্র যদি আকাশের নক্ষত্ররা আমাদের দৃষ্টিগোচর হত, মানবজাতি তাহলে জন্ম জন্ম ধরে তাকে স্বর্গের আবির্ভাব ভেবে পূজা করত। আসিমভ গেলেন এমারসনের বিপরীত দিকে। একটি গ্রহের আকাশে ছটি সূর্যের মতো তারা আছে, ফলে সেখানে রাত্রি প্রায় নামেই না। দু’হাজার পঞ্চাশ বছর পরপর গ্রহ নক্ষত্রের এমন অবস্থান হয় যে গ্রহণের ফলে সেই গ্রহে রাত্রি আসে।  আকাশে দেখা দেয় তিরিশ হাজার নক্ষত্র, যাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা ছিল না। বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় মানবজীবনের ক্ষুদ্রতার বোধ মানুষকে উন্মাদ করে দেয়, সভ্যতার পতন ঘটে।

       কল্পবিজ্ঞানের জন্য যে কটি পুরস্কার দেওয়া হয় সবকটি পেয়েছেন আসিমভ, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাধিকবার। Foundation-এর গল্পগুলি কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সিরিজ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। তিনি মনে করতেন যে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো দেওয়াল নেই, নিজের লেখাতে বার বার সে কথা তিনি প্রমাণ করেছেন। তিনি সেই যুগের লেখক যে যুগ বিশ্বাস করত যে বিজ্ঞানপ্রযুক্তি আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারবে। ষাটের দশকে সেই বিশ্বাসের অবসান ঘটেছিল, আসিমভও কল্পবিজ্ঞান লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে্র লেখায় আর প্রথম যুগের আসিমভকে আমরা পাই না। জর্জ অরওয়েলের 1984, অলডাস হাক্সলির Brave New world বা মার্গারেট অ্যাটউডের The Handmaid’s Tale যে ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যতের কথা বলে, আসিমভের আশাবাদ তার সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি আঁকে। তাই হয়তো মৃত্যুর তিন দশক পরেও তাঁর লেখা পাঠকের মন জয় করে নেয়, চলচ্চিত্রায়িত হয়, আধুনিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়।


প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার শারদীয় ২০২০