দারুচিনির দ্বীপ
পর্ব ১- সিগিরিয়া
শম্পা গাঙ্গুলী
অবশেষে
চলে এল শ্রীলঙ্কা যাত্রার দিন। অভিজিত আর কাবেরী গৌতমের সহকর্মী, কলেজ জীবন থেকে
আমাদের বন্ধুও বটে। অনির্বাণও তাই। কাবেরীদের ছেলে আহেল, অনির্বাণের স্ত্রী ঝুলন
আর ওদের ছেলে মৈত্রেয় --- সব মিলিয়ে আমরা আটজন। প্লেনের সময়টা পালটে হয়েছে রাত দুটো। তার অনেক আগেই
এয়ারপোর্টে পৌঁছোতে হল, কারণ পুজোর
সময় ষষ্ঠীর দিনে গাড়ি পাওয়া শক্ত, রাস্তাতেও ভিড় কম হয় না।
বিমানযাত্রা
নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই, খালি প্লেনের ডিনার কারোরই পছন্দ হল না। ঘুমানোর চেষ্টা
করেও লাভ হলো না। শ্রীলঙ্কাতে ভিসা আগে করাতে হয় না। আগে থেকে ইন্টারনেটে ইলেকট্রনিক ট্রাভেল অথরাইজেশন করে রাখা ছিল,
কলম্বো এয়ারপোর্টে সেটা দেখিয়ে পাসপোর্টে ছাপ মারিয়ে নিলাম। তারপরেই অভিজিত আর
অনির্বাণ গিয়ে ডলার ভাঙিয়ে শ্রীলঙ্কার টাকা কিনে আনল। ভারতে বসে শ্রীলঙ্কার টাকা
কিনতে পারিনি, তাই আমরা আমেরিকান ডলার কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম। আমেরিকান টুরিস্টদের
কল্যাণে ওটাই সবচেয়ে সুবিধার কারেন্সি। আমাদের এক টাকায় শ্রীলঙ্কার দুটাকার একটু
বেশি পাওয়া যায়।
গাড়ি
আগে থেকে বুক করা ছিল। ফোরটিন সিটার গাড়ি, ড্রাইভারের নাম পালিথা জয়রত্নে। অনর্গল
ইংরাজি বলেন --– অবশ্য সেটাই ছিল আমাদের চাহিদা। ভদ্রলোকের থেকে পরে নানা সময় অনেক
সাহায্য পেয়েছি।
পালিথার সঙ্গে আমরা |
আমাদের
প্রথম গন্তব্যস্থান সাংস্কৃতিক ত্রিভুজ। অনুরাধাপুরা-সিগিরিয়া-পোলোন্নারুয়া, এই
তিন প্রাচীন রাজধানী নিয়ে এই ত্রিভুজ প্রাচীন শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধ সংস্কৃতির সবচেয়ে
বড়ো পরিচায়ক। আমরা চলেছি কলম্বো থেকে উত্তরপূর্বে হাবারানার দিকে। রাস্তাটা ভারি
সুন্দর। দুপাশে সবুজে ঢাকা। তবে শ্রীলঙ্কার এই অংশ বেশ শুকনো, বছরে মাত্র দু-তিন
মাস সামান্য বৃষ্টি হয়। রাস্তাঘাট বেশ পরিষ্কার। শ্রীলঙ্কাতে একটা কথা বারবার
বলতেই হয় --– পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে এখানকার মানুষজনের সবসময় নজর থাকে। গরম
যথেষ্ট, গাড়িটা এয়ার কন্ডিশনড, তাই রক্ষে।
অক্টোবর
মাস শ্রীলঙ্কায় টুরিস্ট সিজন নয়। তাই সব জায়গাতেই হোটেল বেশ ফাঁকা। আমরা আগে থেকেই
হাবারানার লে গ্রাঁ মোন ( উচ্চারণ যেমন খুশি করে নিন, বানানটা Le Grand Meaulnes) হোটেলে ঘর ঠিক করে রেখেছিলাম। ফরাসি সাহিত্যিক আঁরি
আলবান-ফুর্নিয়ের সাতাশ বছরের জীবনে একটিই উপন্যাস লিখেছিলেন, সেটিই ফরাসি সাহিত্যে
অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কীর্তি হিসাবে স্বীকৃত। সেই উপন্যাসের নামেই হোটেলের নাম।
হোটেলটা খুঁজে পেতে একটু সময় লেগেছিল, লোকবসতি থেকে সামান্য দূরে। গাছপালা ভর্তি
বাগানের মধ্যে কলোনিয়াল বাংলোর মতো বাড়ি। ঘরগুলোও খুবই সুন্দর, ঘরের ভিতরে ফুটবল
খেলা যায় বলে সত্যের অপলাপ করতে চাই না, কিন্তু বাস্কেটবল নিঃসন্দেহে সম্ভব।
দুপুরের খাওয়া সেদিন হোটেলেই সারলাম, ভাত আর নানা রকম প্রায়
সিদ্ধ তরকারি, মশলাপাতি বিশেষ নেই। সেকি, দারুচিনির দ্বীপে এসে মশলা ছাড়া খাবার
খেতে হবে, মনটা বিদ্রোহ করে উঠল। বাকিরা বলল, হবে হবে, সাত দিন তো থাকব। আমার
ভাগ্যবিধাতা নিশ্চয় মুচকি হেসেছিলেন, দেখতে পাইনি।
খেয়ে দেয়েই বেরিয়ে পড়া, গন্তব্য সিগিরিয়া রক। গৌতম লাফাতে শুরু
করেছে আর অনর্গল বকবক করছে। অনেক কষ্টে বুঝলাম বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি
ক্লার্কের ফাউন্টেনস অফ প্যারাডাইস উপন্যাসে সিগিরিয়ার কথা আছে, অবশ্য ক্লার্ক
এটাকে প্রায় ন’শো কিলোমিটার দক্ষিণে বিষুবরেখার একদম উপরে নিয়ে গিয়েছিলেন --–
গল্পকারদের পক্ষে সবই সম্ভব! টিকিট কাটতে হল, সার্কভুক্ত দেশের লোক বলে আমাদের
জন্য দাম অন্য বিদেশিদের তুলনায় অর্ধেক।
দেড় কিলোমিটার লম্বা, এক কিলোমিটার চওড়া আর দুশো মিটার উঁচু ওই গ্রানাইট
পাথরটা এক সমভূমির মাঝখানে একেবারে খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ দেখলে অবাক লাগবে। দু’শো
কোটি বছরের এক পুরোনো আগ্নেয়গিরি ক্ষয়ে গিয়ে এখন এইটুকুই অবশিষ্ট আছে। আজ থেকে
প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগে শ্রীলঙ্কার মেসোলিথিক যুগে আদিম মানুষের পা পড়ে ঘন
জঙ্গলাকীর্ণ দৈত্যাকার এই পাথরে। প্রাগৈতিহাসিক এই বিশাল শিলাস্তুপে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দি
থেকেই বৌদ্ধ সাধুসন্ন্যাসীদের আবাসস্থল ছিল। প্রাচীন সিংহলি পুঁথি কুলবংশ থেকে
জানা যায় খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতকে উপপত্নী গর্ভে রাজা ধাতুসেনের পুত্র কাশ্যপের জন্ম
হয়। বাবাকে হত্যা করে তিনি সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনিই ৪৯৫
খ্রিস্টাব্দ নাগাদ এই শিলাস্তুপের ওপর এক সুসজ্জিত ও সুরক্ষিত দুর্গপ্রাসাদ গড়ে
তোলেন। সেই রাজধানী থেকেই তাঁর শাসন চলত। বৈমাত্রেয় ভাই যুবরাজ মৌদগলায়ন (এখানকার
বানানে মৌজ্ঞল্লান) ভারতে পালিয়ে গিয়ে সৈন্য সংগ্রহ করেন। পাহাড়ের গা
কেটে বারোশো সিঁড়ি, মাঝে মধ্যে খুবই সরু প্রাকৃতিক খিলান। মৌদগলায়নের পক্ষে কাশ্যপকে আক্রমণ করা শক্ত ছিল সন্দেহ নেই, ধীরে
ধীরে উঠতে গিয়েই আমাদের পা ব্যথা হয়ে গিয়েছিল --- গৌতম আর আমি ছাড়া বাকি সবাই
মাঝপথে রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। কিন্তু কেন জানি না, রাজা কাশ্যপ সৎভাইয়ের সঙ্গে যুদ্ধ
করার সময় ওই পাথরের দুর্গের উপর থেকে নেমে এসেছিলেন। সেই যুদ্ধেই
তাঁর মৃত্যু হয়। সিগিরিয়ার গৌরবের দিনও শেষ হয়ে আসে।
সিগিরিয়াকে রাজা কাশ্যপ সাজিয়েছিলেন তাঁর কল্পনার স্বর্গের অনুকরণে।
পাথরের নিচে সমতলে ফোয়ারা আর পুকুর সমেত বাগান বানিয়েছিলেন, সেটা সেই সময়ে একটা
আশ্চর্য দ্রষ্টব্য হয়েছিল সন্দেহ নেই। বিশেষ করে ফোয়ারাগুলোর জন্য দেড় হাজার বছর
আগে পাইপ বসাতে হয়েছিল ভাবলেই কেমন লাগে। পাথরের উপর থেকে কিছু কিছু আরো প্রাচীন
বসতিও চোখে পড়ে।
প্রাচীন বসতি |
সিগিরিয়ার অপ্সরাদের সঙ্গে দেখা করার পথ |
কিছুটা উঠে তারপর একটা ঢাকা জায়গা। এই জায়গায় লোহার ঘোরানো সিঁড়ি
পেরিয়ে যেতে হয়। কষ্টেসৃষ্টে উঠে হঠাৎ হতচকিত হয়ে গেলাম। এ তো অজন্তার ছবির মতোই
--- সেই ফ্রেস্কো, সেই অপ্সরা। আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে কাশ্যপ এখানে পাথরের দেয়ালে
স্বর্গের অপ্সরাদের ছবি আঁকিয়েছিলেন। কালের নিয়মে রোদ বৃষ্টিতে তার প্রায় পুরোটাই
আজ বিলুপ্ত, শুধু একটা ছোট জায়গায় পাথরটা ছাদের মতো কিছুটা এগিয়ে থাকায় সামান্য
কয়েকটা দেয়াল চিত্র বেঁচে গেছে।
সিগিরিয়া
দেয়ালচিত্র
আবার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলাম। একটু উপরের দিকে এগিয়েই বিখ্যাত
মিরর ওয়াল। কাশ্যপের আদেশে সেকালের ইঞ্জিনিয়াররা এত মসৃণ দেওয়াল বানিয়েছিল যে শোনা
যায় তাতে ফ্রেস্কোর অপ্সরাদের প্রতিচ্ছবি দেখা যেত। একজন কর্মচারী দেখালেন কেমন
ভাবে সেই দেয়াল আজও আলো প্রতিফলন করছে। গৌতম পিছন থেকে বাংলায় বলল, ‘ওই অ্যাঙ্গেলে
আলো ফেললে আমাদের বাড়ির দেয়ালও আয়নার মতো দেখাবে।’ আসলে এর ওপরেও পড়েছে মহাকালের
ছাপ, সেই মসৃণত্ব এখন শুধুই গল্পকথা।
পরবর্তীকালের দর্শকদের পক্ষে ঐ মসৃণ দেয়ালের উপর লেখার লোভ
সম্বরণ করা সম্ভব হয়নি। রাজা কাশ্যপের মৃত্যুর পরে সিগিরিয়াতে ছিল এক বৌদ্ধ বিহার।
খ্রিস্টিয় ষষ্ঠ শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত সেই বিহারে যে তীর্থ যাত্রীরা আসত, তাদের অনেকেই
ওই দেওয়ালের উপর তাদের কথা তামিল, সিংহলি বা সংস্কৃত ভাষায় লিখে যেত। সিগিরিয়া
গ্রাফিটির উপর মোটা মোটা বই লেখা হয়েছে। আজ থেকে হাজার বছর পরে কি তাজমহলের দেয়ালে
যারা তাদের নাম লিখে গেছে তাদের কথা ইতিহাস বইতে থাকবে? তবে আজকের দিনে ঐতিহাসিক
সৌধের উপর দাগ কাটাটা নিশ্চয় অপরাধ। ওই দেয়াল লিখন থেকেই জানা যায় একসময় এখানে
পাঁচশো অপ্সরার ছবি ছিল। এখনো পর্যন্ত ছশো পঁচাশি জনের লেখা উদ্ধার করা গেছে। যেমন
বীর-বিদুর লিখেছেন কবিতা,
শীতল শিশিরবিন্দুসিক্ত
পুষ্পগন্ধবাহ
মৃদুমন্দ পবনে যূথী পদ্ম
বসন্তরৌদ্রে নৃত্যরত।
সুবর্ণবর্ণী অপ্সরাদের কটাক্ষপাতে আমার চিত্ত চঞ্চল।
আমার হৃদয় স্বর্গচিন্তা ধারণেও অক্ষম,
তাকে হরণ করেছে এক নারী
এই পাঁচশত অপ্সরামধ্যে সে একক। (ইংরাজি তর্জমা থেকে
অক্ষমের আক্ষরিক অনুবাদ)
আরো একটু এগোলাম, তারপরেই বিখ্যাত সিংহসোপান। দুর্গের প্রবেশ
পথ। মূল প্রাসাদের গেটহাউসে একসময় ছিল ষাট ফুট উঁচু এক সিংহমূর্তি। এখন অবশিষ্ট
আছে শুধু পাথরে খোদাই করা বিশাল থাবা, তবে সে দুটোও সত্যিই দেখার মত। এই Lion’s Paw-এর
ভেতর দিয়ে গেছে বিখ্যাত Lion
Staircase, যেখান দিয়ে হাঁটার সময়ে আমার মনে
হচ্ছিল যেন স্বর্গে উঠছি। এই মূর্তির জন্যই এই
পাথরের নাম হয়েছিল সিংহগিরি, আজ যা সিগিরিয়া। সিংহসোপান বেয়ে উপরে উঠে প্রাসাদ, আজ
আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই, শুধু ভিতটা পড়ে আছে। একসময়ে রকের ওপরের প্রাসাদটা ছিল
অনেকটা মৌচাকের মত --- প্রায় দেড় হেক্টর এলাকা জুড়ে ধাপে ধাপে উঠে যাওয়া মালভূমির মত
চ্যাপ্টা অংশে বানিয়ে ছিলেন রাজা কাশ্যপ।
নামতে শুরু করলাম। সূর্য ঢলে পড়েছে। পুবদিকে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি
সিগিরিয়া রকের বিপুলাকার ছায়া পাশের বনে ঢাকা সমতল ভূমির ওপর দিয়ে দৌড়োতে শুরু
করেছে। মনে হচ্ছে যেন ছায়াটাকে সত্যিই সরে যেতে দেখছি। মালভূমির ওপরটা
তখন প্রায় ফাঁকা। মালভূমির পশ্চিমপ্রান্ত একেবারে সরলরেখা বলেই এমন দৃশ্য।
বিষুবরেখার কাছে সূর্য খুব দ্রুত ডোবে, তাই পূর্ব প্রান্তে সিগিরিয়ার ছায়াটা অত
তাড়াতাড়ি সরছিল। মন ক্যামেরায় অনেকদিন ধরা থাকবে ওই ছায়ার সরণ। আমাদের সঙ্গে নামছে
শুধু একপাল বাঁদর। অত্যন্ত সভ্যভব্য, এমনকি দাঁতও খিঁচোয় না। এরা নিশ্চয়
শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে এসেছিল তারপর আর ফিরে যায়নি, এখানে সেটল করে গেছে। অন্ধকারে বার দুয়েক
রাস্তা হারিয়ে অবশেষে খুঁজে পেলাম কার পার্ক যেখানে বাকিরা আমাদের জন্য বহুক্ষণ অপেক্ষা
করছিল।
সিগিরিয়া
রকের ছায়া
রাত্রে হোটেলের বাইরে শহরের রেস্তরাঁতে খেতে যাব। ভেবেছিলাম
হেঁটেই চলে যাব, কিন্তু পালিথা বাদ সাধলেন। রাতে সামনের রাস্তায় হাতি বেরোয়, এখানে
কয়েকদিন আগেই একজন হাতির আক্রমণে মারা গেছে। আমাদের হোটেল চত্বরেও নাকি বাগানের
গাছের ফল খেতে আসে। তাই বাইরের মেন গেটটা শুনলাম কখনোই বন্ধ করা হয় না। বন্ধ করলে
গেটের দামটাই যাবে, হাতিকে তো আর আটকানো যাবে না। গেট রাখার দরকার কী কে জানে। কালকে হাতি
দেখতে আমাদের মিনেরিয়া ন্যাশনাল পার্ক যাওয়ার কথা, তার আগেই গজরাজরা আমাদের দেখতে
আসবেন নাকি?
অগত্যা গাড়িতেই বেরোনো হল। স্থানীয় খাবার খাব, তাই জুটল চিকেন
কোট্টু। রুটি আর মশলাদার মুরগির মাংস একসঙ্গে মিশিয়ে টুকরো টুকরো করে কাটা,
শ্রীলঙ্কার রোড সাইড খাবারের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়। স্বাদের চেয়েও ইন্টারেস্টিং
সেটাকে টুকরো করাটা, বোর্ডের ওপরে চপারটা দ্রুত তালে প্রায় বাজনার মতো আওয়াজ তোলে। (ক্রমশ)
No comments:
Post a Comment