Saturday, 28 November 2020

দারুচিনির দ্বীপ পর্ব ২- পোলোন্নারুয়া ও মিনেরিয়া


দারুচিনির দ্বীপ

পর্ব ২- পোলোন্নারুয়া ও মিনেরিয়া

                        শম্পা গাঙ্গুলী

    পরের দিন ব্রেকফাস্টে একটা নতুন জিনিস খেলাম, নারকেল আর আটা দিয়ে তৈরি রুটি। সকলের অবশ্য ভালো লাগেনি, তবে অন্য খাবারও ছিল। তারপরেই আবার বেরিয়ে পড়লাম, গন্তব্য পোলোন্নারুয়া। চোলরাজা রাজরাজ চোল ৯৯৩ সালে শ্রীলঙ্কার রাজধানী অনুরাধাপুরা দখল করেছিলেন, সে সময় তিনি পোলোন্নারুয়াতে তাঁর অধীনস্থ প্রদেশের নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। শ্রীলঙ্কার রাজা বিজয়বাহু আবার পরে স্বাধীন রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। ১০৫৫ সাল থেকে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত পোলোন্নারুয়া ছিল শ্রীলঙ্কার রাজধানী। তারপরে অবশ্য আর এক ভারতীয় রাজা কলিঙ্গ মঘা শহরটা দখল করে প্রায় পুরোপুরি ধ্বংস করেন। যেটুকু বাকি ছিল, তা শেষ করে পর্তুগিজরা। বহু বছর পরে ১৮২০ সালে ব্রিটিশ শাসনের সময় জঙ্গলের মধ্যে থেকে শহরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়। পোলোন্নারুয়া যাওয়ার পথেই পড়ল পরাক্রমসমুদ্র। এই অঞ্চলে বৃষ্টি কম হয় বলে রাজা পরাক্রমবাহু (১১৬৩-১১৮৬) সেচের জন্য এই বিরাট জলাশয়টি খনন করান। এর বর্তমান আয়তন ২৫ বর্গ কিলোমিটার। যাওয়ার পথে পরাক্রমসমুদ্রের তীরে দেখলাম এক বিশাল বুদ্ধ মূর্তি। শ্রীলঙ্কাতে অনেক জায়গাতেই বিরাট বিরাট বুদ্ধের মূর্তি কোনো রকম মন্দির বা ছাউনি ছাড়াই রাস্তার ধারে দেখেছি।


পোলোন্নারুয়াতে পরাক্রমবাহুর প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ।

        প্রথমে গেলাম পরাক্রমসমুদ্রের তীরের মিউজিয়ামে। মিউজিয়ামটা ছোটো হলেও শ্রীলঙ্কার ইতিহাস বেশ চমৎকারভাবে বর্ণনা করা আছে। তারপর পরাক্রমবাহুর প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ। এখানে অন্তত দেওয়ালগুলো দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে স্নানাগার, সভাগৃহ ইত্যাদি। এই জায়গাটা ছিল নগরের একেবারের ভিতরের অংশ অর্থাৎ সিটাডেল বা নগরদুর্গ। একটু বাইরে গেলেই একটা বিরাট চত্বর। সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে স্তুপ ও চৈত্য অর্থাৎ বৌদ্ধ মন্দির – অধিকাংশই ভগ্নপ্রায়। এদের মধ্যে কয়েকটি শ্রীলঙ্কার বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বুদ্ধের পবিত্র এক স্মৃতিচিহ্ণ বিভিন্ন সময় পোলোন্নারুয়াতে ছিল, সেগুলোর কথায় আমরা পরে আসব। পোলোন্নারুয়ার সবচেয়ে প্রাচীন প্রতিমা মন্দিরটি প্রায় অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। আশেপাশে কয়েকটি হিন্দু মন্দিরও রয়েছে, চোল রাজাদের সময় থেকেই এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষজন বাস করত।





পোলোন্নারুয়া
        এরপর আমরা গেলাম গল বিহার, পোলোন্নারুয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত দ্রষ্টব্য স্থান। সিংহলি ভাষায় গল  শব্দের অর্থ পাথর। রাজা পরাক্রমবাহুর আনুকূল্যে দ্বাদশ শতকে এখানে একটা বিরাট পাথর কেটে তৈরি হয়েছিল কিছু মূর্তি --- সেগুলি কালের গ্রাস থেকে কোনোভাবে রক্ষা পেয়েছে। এর অন্য নাম উত্তরারাম অর্থাৎ  উত্তরের মঠ। এখানে প্রথমেই চোখে পড়ে পনেরো ফুট উঁচু ধ্যানমগ্ন বুদ্ধের একটি মূর্তি। তারপাশেই এক কৃত্রিম গুহা, ভিতরে ঐ একইরকম কিন্তু অনেক ছোটো একটি মূর্তি। বাইরে তেইশ ফুট উঁচু দণ্ডায়মান একটি মূর্তি, সেটি বুদ্ধের না তাঁর শিষ্য আনন্দের তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এক্কেবারে ডানদিকে ছেচল্লিশ ফুট লম্বা শায়িত বুদ্ধমূর্তি, সম্ভবত পরিনির্বাণ। সবগুলিই এককথায় অসাধারণ। কিন্তু সমস্যা হল যে গলবিহার খোলা জায়গায়, সামনের জমিটা বালি ভর্তি। খুব কাছে যেতে গেলে জুতো খুলে রোদে তেতে ওঠা বালির উপর দিয়ে খালি পায়ে হাঁটতে হবে। আমাদের মধ্যে কাবেরী, ঝুলন আর গৌতম সাহস করে পা বাড়াল। তারপরেই লাফাতে লাফাতে গিয়ে একটুখানি ছায়ামতো জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। ব্যাস, আর কেউ ফিরতে রাজি নয়। তিনজনেরই এক বক্তব্য --- পায়ে ফোস্কা পড়তে পড়তে বেঁচে গেছে, সূর্য না ডুবলে আর বালিতে পা দেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং ওদের জন্য আমাদের বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন বাজে দুপুর বারোটা! ওদের অনেক বুঝিয়ে, বিশেষ করে গৌতমকে লাঞ্চের লোভ দেখিয়ে, গল বিহার থেকে বার করতে হল। তারপর আরো কিছু ভাঙা চৈত্য ও একটা সুন্দর ভাবে রক্ষিত স্তুপ দেখে পোলোন্নারুয়া থেকে বিদায় নিলাম।





গলবিহারে বুদ্ধমূর্তি (শেষেরটি বুদ্ধের শিষ্য আনন্দের মূর্তি)
        শ্রীলঙ্কার নিজস্ব খাবার খেতে ইচ্ছে হলেও আমাদের হোটেলে তা জুটছে না। ড্রাইভারকে সেকথা জানাতেই ভারি সুন্দর ছিমছাম একটা রেস্তরাঁতে আমাদের নিয়ে গেলেন। তার বাইরে আবার সুইমিং পুল। চিকেন মিল এল, থালাভর্তি ভাত, শাকভাজা, তরকারি, মাংস, সঙ্গে একটা বিরাট শুকনো লঙ্কা। আমরা সবাই শুকনো লঙ্কাগুলো সরিয়ে রাখলাম। তারপর শাকভাজা ভাতে মেখে মুখে দিলাম।
        এর পরের পনেরো মিনিট যা হল তা কহতব্য নয় –-- একেবারে লঙ্কাকাণ্ড --- সবাই হাপুস নয়নে কাঁদতে বসে গেলাম। জীবনে এত ঝাল আমরা কেউ খাইনি, এমনকি পালিথাও নয়। অথচ আমাদের পাশের টেবিলের লোকজন দেখি ঐ শুকনো লঙ্কাটাও ভাতে মেখে নিচ্ছে। মনে হচ্ছিল পাশের সুইমিং পুলে ঝাঁপ দিই। অভিজিতকে ধন্যবাদ, ও তাড়াতাড়ি গিয়ে কয়েকটা দই কিনে আনল। নাহলে এই ভ্রমণ কাহিনি লেখার সৌভাগ্য হত কি না সন্দেহ।
        কাঁদতে কাঁদতেই কোনো রকমে শুকনো ভাত খেয়ে পেট ভরালাম। এবার হাতিদের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট। মিনেরিয়া ন্যাশনাল পার্কটা খুব বড়ো নয়, মোটামুটি নব্বই বর্গ কিলোমিটার। আমাদের আরও একটা জঙ্গলে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল, ইয়ালা ন্যাশনাল পার্ক। সেখানে হাতি তো আছেই, তার সঙ্গে ভাগ্য ভালো থাকলে লেপার্ডও দেখা যায়। কিন্তু এই সময় ইয়ালা বন্ধ।  
        মিনেরিয়াতে আমাদের গাড়ি ঢুকবে না। আলাদা করে জিপ ভাড়া করতে হল। তারপর জঙ্গলে। শ্রীলঙ্কার এই পার্কটা উত্তর মধ্যভাগের শুষ্ক সমভূমিতে। আহেল আর মৈত্রেয় তো জঙ্গলে ঢুকবো শুনে লাফাতে শুরু করল। চারিদিক খোলা জিপে করে জঙ্গলে ভ্রমণ কারো কারো কাছে প্রথম বার হলেও, আমার আর গৌতমের কাছে তা নয়। সারাণ্ডার জঙ্গলে বা উত্তরাখণ্ডের জিম করবেট ন্যাশনাল পার্কে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের আছে। জঙ্গলটা একটু ঘন হতেই জিপে সকলের মধ্যেই দেখলাম একটা টানটান ভাব। নিরক্ষরেখার  ছয় ডিগ্রী উত্তরে জলবিষুব অতিক্রম করে আসা দুপুর তিনটের জ্বলন্ত সূর্যটা মাথার ওপর। অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় আমাদের এই আট অভিযাত্রীর হাতে বন্দুক না থাকলেও আছে বাইনোকুলার। সানগ্লাস চোখে থাকলেও আমাদের দৃষ্টি সজাগ টুপি মাথায় জিপে চড়ে আমরা যেন স্পিলবার্গের জুরাসিক পার্কের অভিযাত্রী দল।  এখনো কল্পনায় আসছে না বুঝি? তাহলে বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড় উপন্যাসে আমাদের বসিয়ে দেখুন না কেমন হয়? না, সেখানে মহানায়কের উপস্থিতি ভুলেও ভাববেন না। তাহলে কিন্তু পুরো কল্পনাটাই গুবলেট হয়ে যাবে। বনের মধ্যে একটু সড়সড় শব্দ হলেই সবাই ভাবছি ভাল্লুক বা সিংহ মামা।
        না, তেমন কিছুই ঘটল না। গাছের ওপর থেকে চিতাও লাফালো না বা হাতির দল পথও আটকালো না। খালি কতগুলো উইয়ের ঢিবি, বুনো শুয়োর আর ময়ূরের পেখম তুলে নাচ। বুনো হাতির ডাক শুনে সারাণ্ডার জঙ্গলের কথা মনে পড়ছিল। ১৯৯৬ সালে আমি আর গৌতম বন্ধুদের সাথে ছয় রাত ওখানকার মেঘাতুবুরু খনি অঞ্চলে জঙ্গলের ভিতর পাহাড়ের উপর একটা ফরেস্ট বাংলোয় ছিলাম। সেখানেও আমরা দলে আটজন ছিলাম। চাঁদনি রাত। বাংলোর লাগোয়া খোলা চাতালে বসে অনেক রাত অবধি কবিতা,গল্প, গান চলত। পাহাড়ের অনেকটা উঁচুতে বাংলোটা ছিল বলে দূরের পাহাড়গুলো খুব ভালো ভাবে দেখা যেত। দূরের পাহাড়গুলো থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ঘন ঘন ভেসে আসত হায়না, চিতা বা বুনো হাতির ডাক সেটা মনে করলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়।
         যাক সে অভিজ্ঞতা অন্য কোনো সময়ে লিখব। শ্রীলঙ্কার জঙ্গলে ফিরে আসি। জিপ অনেকটা ভেতরে যাবার পর ঘন ঘন হাতির ডাক শুনে বুঝলাম আমরা হাতি-কলোনির খুব কাছাকাছি এসে পড়েছি। একটু এগোতেই দেখি পর পর বেশ কয়েকটা জিপ দাঁড়িয়ে। সামনেই হাত কয়েকের মধ্যে বিশালাকার অনেকগুলো হাতি। এত কাছ থেকে এতগুলো বুনো হাতি আমরা কেউ কখনো দেখিনি। ফলে দাঁতাল হাতির শুঁড় দোলানো, একে অপরকে কাদা ছেটানো, শুঁড় তুলে গাছের পাতা খাওয়া, বাচ্চা হাতিকে মা হাতির খাইয়ে দেওয়া বা আদর করা, এমনকি তাদের পটি করাও --- সবই গোগ্রাসে গিলছিলাম আর ক্যামেরা বন্দী করছিলাম। তাদের  নিজস্ব এলাকায় অনধিকার প্রবেশ করে আমরা যতই আহ্লাদে আটখানা হই না কেন, বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে তারা নিজেদের দৈনন্দিন কাজে লিপ্ত থেকে আমাদের মোক্ষম জবাব দিল।  
   
        সেখান থেকে আমরা আরও এগোলাম ভেতরের দিকে। দেখি পটভূমি পাল্টে গেছে, বন বদলে গিয়ে এবার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি। যেন রূপকথার দেশ। আফ্রিকার সাভানায় এসে পড়লাম না কি? যেন তেপান্তরের মাঠ। দেখি সেখানে শয়ে শয়ে হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঠের পরে প্রান্তদেশ বরাবর বিশাল দীঘি। মেঘহীন, দূষণহীন উদার আকাশ তার সেরা নীল রঙ ঢেলে দিয়েছে ঐ জলে। দীঘির ওপারে রূপকথার রাজ্যের শেষ সীমানা টেনে দিয়েছে সারি সারি আবছা ধূসর পাহাড়। চারদিকে শুধু হাতি হাতি আর হাতি। পুরো একান্নবর্তী পরিবারের মত তারা দলে দলে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নদীর ধারে বাচ্চা হাতিকে মা আর বাবা হাতি দুজনে মিলে স্নান করাচ্ছে শুঁড়ের ফোয়ারা দিয়ে। এ দৃশ্য কি ভোলার? বহুক্ষণ আমরা হাতিদের রাজ্যে ছিলাম। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এলাম। অপরাহ্ণের স্তিমিত আলো দীঘিটাকে মোহময় করে তুলেছে। তার প্রান্ত বরাবর সারিবদ্ধ ভাবে হাতির দলগুলো হেঁটে চলেছে। বয়ঃজ্যেষ্ঠ দাঁতাল আধিপত্যের জেরে আলাদা সম্ভ্রম আদায় করে হাঁটছে দলের সামনে দলপতি হয়ে। সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রথম ঐরাবত যেমন গজেন্দ্র গমনে হেঁটে চলত। (ক্রমশ)











মিনেরিয়াতে হাতির দল
প্রকাশঃ সৃষ্টির একুশ শতক, উৎসব সংখ্যা ১৪২৪       

No comments:

Post a Comment