Friday 20 November 2020

শতবর্ষে আইজ্যাক আসিমভ

 

শতবর্ষে আইজ্যাক আসিমভ

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

    কল্পবিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশনের স্বর্ণযুগ ধরা হয় গত শতাব্দীর তিরিশের দশকের শেষ থেকে পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত সময়কালকে। তিরিশের দশকে কল্পবিজ্ঞান ছিল মূলত রূপকথার আধুনিক সংস্করণ; স্বর্ণযুগের লেখকরা কাহিনির বিজ্ঞানকে বাস্তবোচিত করে তোলেন। সমাজ ও বিজ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক তাঁদের লেখায় ধরা দেয়। সেই সময়ের সব থেকে বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখকদের মধ্যে পড়বেন রে ব্র্যাডবুরি, আর্থার সি ক্লার্ক, রবার্ট হেইনলেইন, ফ্রেডরিক পোল ও আইজ্যাক আসিমভ। এঁদের মধ্যে আসিমভ বয়সে ছোটদের দলে পড়লেও লেখা শুরু করেছেন অনেকেরই আগে। তিনি যখন প্রথম গল্প প্রকাশ করেছিলেন, তখন তাঁর বয়স উনিশ। জন ক্যাম্পবেল সম্পাদিত Astounding Science Fiction পত্রিকার জুলাই ১৯৩৯ সংখ্যাটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই কল্পবিজ্ঞানে স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন। ঘটনাচক্রে সেই সংখ্যাতে আসিমভের গল্প প্রথম ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়েছিল। 

       কোনো একটি বিশেষ গল্প বা উপন্যাস নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগে এই নিবন্ধে নেই, তবে প্রথম প্রকাশিত সেই Trends গল্পটিতেই আমরা আসিমভের পরবর্তী অনেক রচনার মূল সূত্র খুঁজে পাই। গল্প লেখার কয়েক মাস পরেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল, গল্পে সেই ভবিষ্যৎবাণীও ছিল। তবে সেই সময়ে অধিকাংশ মানুষই যুদ্ধ যে আসন্ন সে কথা অনুমান করেছিলেন, তাতে আসিমভের আলাদা করে কোনো কৃতিত্ব নেই। মহাকাশ অভিযানের সামাজিক বিরোধিতা ছিল এই গল্পের উপজীব্য, সেখানে এসেছে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির প্রতি বৃহত্তর সমাজের সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কথা। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের বিরোধিতা সমাজে আরো অনেক বিস্তার লাভ করেছে সন্দেহ নেই, সেই দিক থেকে আসিমভকে আমরা ভবিষ্যৎবক্তার দলে ফেলতে পারি। 

       আসিমভের জন্মের দিন সঠিক জানা নেই, তিনি নিজে লিখতেন ১৯২০ সালের ২ জানুয়ারি। সেই হিসাব ধরলে আমরা তাঁর জন্ম শতবর্ষ পেরিয়ে এলাম। বিপ্লব পরবর্তী সোভিয়েত রাশিয়াতে তাঁর জন্ম, তাঁর তিন বছর বয়সে তাঁর বাবা মা গৃহযুদ্ধবিদীর্ণ রাশিয়া ছেড়ে আমেরিকাতে চলে আসেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন নিয়ে মাস্টার্স পাস করেন ১৯৪১ সালে, এর পর ১৯৪৮ সালে সেই প্রতিষ্ঠান থেকেই রসায়নে ডক্টরেট করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য গবেষণাতে ছেদ পড়েছিল। ১৯৪৯ সালে তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনে জৈবরসায়ন পড়ানো শুরু করছিলেন। লেখালেখির জন্য গবেষণা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পড়ানো তিনি চালিয়ে গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৭৯ সালে তিনি প্রফেসর পদে উন্নীত হন। ১৯৯২ সালের ৬ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু হয়। ১৯৮৩ সালে এক অস্ত্রোপচারের সময় তাঁকে যে রক্ত দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে তাঁর এইচআইভি সংক্রমণ ঘটেছিল, কিন্তু ডাক্তাররা  সেই কথা প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর দশ বছর পরে তাঁর স্ত্রী আত্মজীবনীতে সেই কথা লিখেছিলেন।

       ব্যক্তি আসিমভ বেশ বিতর্কিত চরিত্র। গবেষণা না করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একসময় তাঁকে বরখাস্ত করেছিলেন, দু’বছর লড়াই করে তিনি চাকরি ফিরে পেয়েছিলেন। মহিলাদের সঙ্গে তাঁর ব্যবহার কখনো কখনো ভদ্রতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইকিউ নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা হয়; আসিমভ ছিলেন উচ্চ আইকিউসম্পন্ন ব্যক্তিদের সংস্থা মেনসার মার্কিন শাখার সহসভাপতি। তিনি নিজেই স্বীকার করেছিলেন যে মেনসার অনেক সদস্য অতিরিক্ত আগ্রাসী ব্যবহার করে, অথচ মেনসার সদস্যপদ নিয়ে তাঁর বেশ অহঙ্কার ছিল। নিজের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে তাঁর ধারনা বেশ উঁচু ছিল সন্দেহ নেই, তিনি মনে করতেন জীবনে তাঁর থেকে বুদ্ধিমান দুজনের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল, জ্যোতির্বিদ কার্ল সাগান এবং কম্পিউটার বিজ্ঞানী মার্ভিন মিনস্কি।

       বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন আসিমভ, সেই বিষয়ে তাঁর লিখিত বইয়ের সংখ্যা একশো কুড়ি। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিদ্যা – নানা বিষয়ে তিনি বই লিখেছিলেন, প্রায় সবগুলিই বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সাধারণের জন্য বিজ্ঞান লিখতে গিয়ে বিজ্ঞানকে অতিসরলীকরণের পথে হাঁটেননি আসিমভ। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করাতে তাঁর অসাধারণ দক্ষতার জন্য শুধু সাধারণ মানুষ নয়, তাঁর বইগুলি সেই বিষয়ে গবেষকদেরও উপকারে লেগেছিল। লিখেছেন জৈবসসায়নের পাঠ্য পুস্তক। বিশ্বউষ্ণায়ন, বায়ুদূষণ ইত্যাদি বিষয়ে লিখেছেন সত্তরের দশকেই; এই সমস্ত পরিবেশগত সমস্যার প্রতি মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে তাঁর বিশেষ ভূমিকা আছে।  

       লেখালেখির বাইরেও বিজ্ঞান চেতনা প্রসারের জন্যও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। তথাকথিত অলৌকিক ঘটনার পিছনে সত্য উদ্ঘাটনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গড়ে উঠেছিল একটি সংস্থা, কমিটি ফর দি সায়েন্টিফিক ইনভেস্টিগেশন অফ দি ক্লেমস অফ দি প্যারানর্মাল, পরবর্তীকালে যা নাম পালটে হয়েছে কমিটি ফর স্কেপটিকাল এনকোয়ারি। আসিমভ ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, তাঁর খ্যাতির সুবাদেই এই সংস্থা সাধারণের মধ্যে পরিচিতি লাভ করেছিল। তিনি ছিলেন স্বঘোষিত নাস্তিক, গত শতাব্দীর মধ্যভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজন ইহুদির পক্ষে এই স্বীকারোক্তি খুব সহজ কথা ছিল না।

       আসিমভের সমস্ত রচনা নিয়ে আলোচনা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়, আমরা শুধু তাঁর কল্পবিজ্ঞান রচনার দিকেই চোখ রাখব।। কল্পবিজ্ঞানের বাইরে বেশ কয়েকটি রহস্য কাহিনি তিনি লিখেছিলেন, কিন্তু সেগুলি আমাদের আলোচনার পরিধির বাইরে। কল্পবিজ্ঞানেও মাত্র কয়েকটি গল্প বা উপন্যাসের মধ্যেই এই প্রবন্ধ সীমাবদ্ধ থাকবে। নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তিগত পছন্দই প্রাধান্য পেয়েছে, তাই সেই বিষয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।

       আসিমভ লিখতে ভালবাসতেন, সমস্ত লেখা মিলিয়ে মোট ছাপা শব্দের পরিমাণ দু কোটি ছাপিয়ে যাবে। তাঁর লেখালেখির জীবনকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। কল্পবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগের শুরুতেই প্রথম গল্প প্রকাশ করলেও তিনি তখনই বিশেষ পরিচিতি লাভ করেননি, তবে কয়েক বছরের মধ্যেই তিনি সবচেয়ে বিখ্যাত লেখকদের মধ্যে জায়গা করে নেন। উনিশশো পঞ্চাশের দশকের শেষে স্বর্ণযুগের অবসান হয়। এ বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ এই লেখাতে নেই, তবে একথা বলা যেতেই পারে যে স্বর্ণযুগের সমাপ্তিতে কল্পবিজ্ঞানের ধারা পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব কল্পবিজ্ঞানের উপর অনেক বেশি পড়তে শুরু করেছিল। আসিমভ এই সময় কল্পবিজ্ঞান লেখা পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে বিজ্ঞানের বই লেখা শুরু করেন। তাঁর সব সেরা লেখাগুলি সেই স্বর্ণযুগের দুই দশকের মধ্যের রচনা। প্রায় দেড় দশক পরে তিনি আবার কল্পবিজ্ঞানের জগতে ফিরে আসেন। কিন্তু একমাত্র The Gods Themselves উপন্যাস ছাড়া এই সময়ের অন্য লেখাগুলির মধ্যে আমি পুরানো আসিমভকে খুঁজে পাই না। প্রথম যুগে লেখা বেশ কয়েকটি অসাধারণ গল্পকে তিনি এই সময় উপন্যাসের রূপ দিয়েছিলেন, কিন্তু সেগুলি আমার খুবই সাধারণ মানের মনে হয়। এই সময় তাঁর বিখ্যাত Foundation সিরিজে তিনি আরও কয়েকটি উপন্যাস যোগ করেছিলেন, কিন্তু তার জন্য মাঝে মাঝেই গল্পের মধ্যে স্ববিরোধিতা এসেছে, গল্পের রসও ক্ষুণ্ণ হয়েছে। তাই আমি আলোচনার জন্য তাঁর প্রথম যুগের কয়েকটি লেখাই বেছে নিয়েছি।

       সমসাময়িক বিখ্যাত লেখক আর্থার সি ক্লার্কের সঙ্গে আসিমভের তুলনা করলে আমরা তাঁর লেখার মূল বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করতে পারি। লেখালেখির ক্ষেত্রে সম্পাদক জন ক্যাম্পবেল ছিলেন আসিমভের পিতৃপ্রতিম, অথচ সচেতনভাবেই ক্যাম্পবেলের জাতিবাদী ও ফ্যাসিবাদী চিন্তাভাবনাকে তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ক্লার্কের লেখাও জাতিধর্মবর্ণ বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে মানবতাবাদের জয়গান গেয়েছে। ক্লার্কের রচনাতে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা খুব কম। নিজে বিজ্ঞানের ডক্টরেট ও শিক্ষক, জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বই লিখেছেন; কিন্তু কাহিনি রচনাতে আসিমভের কল্পনার উড়ান অনেক বেশি। তাঁর রচনা আমাদের নিয়ে যায় দূর ভবিষ্যতে, যেখানে গোটা ছায়াপথই হয়ে দাঁড়িয়েছে মানবসভ্যতার ক্রীড়াভূমি।

       ক্লার্কের মতোই আসিমভও ছিলেন অপরিমেয় আশাবাদী, অথচ তাঁর কাহিনিতে দেখি বিজ্ঞানের প্রগতি  সমাজের বিকাশকে বিশেষ পরিবর্তন করতে পারেনি। প্রায়শই তা বন্দী হয়ে গেছে প্রাচীনযুগের পুরোহিততন্ত্র ও মধ্যযুগীয় সামন্ততন্ত্রের ঘেরাটোপে। এ কিন্তু কোনো সমালোচনা নয়, সমাজ ও ইতিহাস বিষয়ে অন্তর্দৃষ্টি আসিমভের ভবিষ্যতের কাহিনি লেখার প্রধান শক্তি। ক্লার্কের লেখাতে পাত্রপাত্রীরা ভবিষ্যৎ সমাজের অংশ। আসিমভের ভবিষ্যত সমাজ আমাদের বর্তমানের প্রতিচ্ছবি, কিন্তু তাঁর সৃষ্ট চরিত্ররা  বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রগতির পথ সন্ধান করেছে। তাঁর End of Eternity উপন্যাস সচেতনভাবেই ইতিহাসের পৌনঃপুনিকতার শিকল ভাঙতে চেয়েছে।

       তাঁর সব থেকে বিখ্যাত লেখাগুলির মধ্যে পড়বে Foundation সিরিজের কাহিনিগুলি, আসিমভ সেখানে সচেতনভাবেই গিবনের বিখ্যাত ইতিহাস The Decline and fall of Roman Empire-কে অনুসরণ করেছেন। অতিরিক্ত কেন্দ্রিকতা, হাতে কলমে জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার পরিবর্তে অতীতের পণ্ডিতদের লিখিত বইয়ের সাক্ষ্যের উপর গুরুত্ব দান, সামরিক শক্তির উপর অতিনির্ভরতা – নানা কারণে রোমান সাম্রাজ্য ভেঙে পড়েছিল। প্রথম বইয়ের সূচনাতে ছায়াপথব্যাপী সাম্রাজ্য একই কারণে ধ্বংস হচ্ছে, (যদিও প্রথম বইয়ের সূচনাটা আসিমভ লিখেছিলেন কয়েকটি গল্প প্রকাশের পরে, সেগুলিকে একসঙ্গে করে উপন্যাস হিসাবে প্রকাশের সময়)। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে ইউরোপে নেমে এসেছিল অন্ধকার যুগ, পুরোহিততন্ত্রের রমরমার সময়। ইউরোপে রেনেসাঁ বা নবজাগরণ শুরু হয়েছিল ফ্লোরেন্স ও ভেনিসের বণিকদের হাত ধরে। তারপরে আসে শিল্পবিপ্লব ও গণতন্ত্রের যুগ। আসিমভের গল্পও একই ধারা অনুসরণ করেছে, কিন্তু তা কখনোই ঐতিহাসিক কাহিনি নয়। এই পরিবর্তন ইতিহাসের অমোঘ কিন্তু উদ্দেশ্যহীন পরিবর্তন নয়, তা সচেতন হস্তক্ষেপের ফল। এখানেই প্রকাশ পেয়েছে মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর অপরিমেয় আশাবাদ। সেই আশাবাদের প্রতিফলন দেখতে পাই Nemesis উপন্যাসে, যেখানে মানুষ সৌরজগতের সঙ্গে সংঘর্ষে উদ্যত এক নক্ষত্রকে তার প্রযুক্তির সাহায্যে সরিয়ে দিয়েছে।

       এই গল্পগুলিতেই আসিমভ এনেছেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কল্পনাটিকে, সাইকোহিস্ট্রি। আসিমভ যে কটি শব্দ ইংরাজি অভিধানে যুক্ত করেছেন, তার মধ্যে এটি অন্যতম। ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, মনোবিদ্যা ও পরিসংখ্যানবিদ্যার মিলিত রূপ সাইকোহিস্ট্রি মানবসভ্যতা কোন পথে এগোবে তা নিয়ে ভবিষ্যৎবাণী করতে পারে। সিরিজের পরের গল্পগুলিতে অবশ্য আসিমভ এই ধারা থেকে সরে এসেছিলেন, ফলে সাইকোহিস্ট্রি প্রায় পুরোপুরি মনোবিদ্যার পথ ধরেছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য সাইকোহিস্ট্রির এই ধারণার মূল লুকিয়েছিল আসিমভের প্রথম দিকের Homo Sol ইত্যাদি কয়েকটি গল্পে, যদিও সেগুলি তখন বিশেষ পরিচিত হয়নি। একই সঙ্গে আসিমভ দেখিয়েছিলেন সমাজের অবক্ষয়ের যুগে যে কোনো রকমের জ্ঞানচর্চাকেই সন্দেহের চোখে দেখা হতে পারে, তার নানা উদাহরণ আমরা এখন আমাদের সমাজে দেখতে পাচ্ছি।

       ইংরাজি অভিধানে আরও দুটি শব্দ আমরা আসিমভের কল্যাণে পেয়েছি, রোবোটিক্স ও পজিট্রনিক। আসিমভের যন্ত্রমানবরা রোবোটিক্সের তিনটি নিয়ম মেনে চলে, অনেক গল্পকার এই নিয়মগুলি তাঁদের কাহিনিতে ব্যবহার করেছেন। তাঁর রোবটদের মস্তিষ্ক পজিট্রন নিয়ন্ত্রিত, তা সে বাস্তবে যতই অসম্ভব হোক না কেন। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে রোবটদের মধ্যে মানবিক গুণ সঞ্চারিত হয়েছে, এক সময় মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো প্রভেদ করাই সম্ভব নয়।

       রোবটের কাহিনিকেও নিয়ন্ত্রণ করেছে আসিমভের ইতিহাস চেতনা । প্রাচীন গ্রিস ও রোম পশ্চিমে সভ্যতার আলো দেখিয়েছিল, কিন্তু তাদের ভিত্তি ছিল দাসদের শ্রম। নানা সময় ক্রীতদাসদের বিদ্রোহ সাম্রাজ্যকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আসিমভের রোবটদের পক্ষে বিদ্রোহ করার কোনো উপায় নেই, তিন নিয়মের শৃঙ্খলে তারা বন্দী। তাহলে কি এভাবে দাসের পরিবর্তে রোবট শ্রমের ভিত্তিতে প্লেটোর আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা হতে পারে?  আসিমভের উত্তর হল, না। তাঁর কাহিনিতে পৃথিবী থেকে প্রথম যে মানুষরা ছায়াপথের অন্য গ্রহ জয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছিল, তাদের বলা হয় স্পেসার। তাদের সহায় হয়েছিল রোবট। পৃথিবীর সমাজে রোবট প্রযুক্তি সহ বিজ্ঞান প্রযুক্তির যে কোনো অগ্রগতিকেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়, অর্থনৈতিকভাবে ক্রমশই পৃথিবী পিছিয়ে পড়ে। কিন্তু রোবটের উপর অতিনির্ভরতা শেষ পর্যন্ত স্পেসার সমাজদেরও ধ্বংসের পথেই নিয়ে যায়। পৃথিবী থেকে আবার মানুষ ছায়াপথের নানা গ্রহে বসতি স্থাপন করে, কিন্তু রোবট শ্রমের উপর তারা নির্ভর করেনি। রোবটের উপরে অনেকগুলি ছোট বড় গল্প ছাড়াও Caves of Steel, Naked Sun, Robots of Dawn উপন্যাসগুলিতে আসিমভ প্রযুক্তির অন্ধ বিরোধিত ও তার উপর অতিনির্ভরতা, এই দুয়ের দ্বন্দ্বকে তুলে ধরেছেন।

      এই তিনটি উপন্যাস ও Foundation-এর মধ্যের সময়কালে ছায়াপথব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপিত হয়েছে।  তিনটি উপন্যাসের মাধ্যমে তার ইতিহাস লিখেছেন আসিমভ, Pebble in the Sky, The Stars Like Dust ও The Currents of Space। দুই মহাযুদ্ধের মধ্যের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে মহাশক্তি হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশের ছায়া তাঁর লেখাতে পড়েছিল।  বিখ্যাত ঐতিহাসিক আর্নল্ড টয়নবির মতে সভ্যতার ইতিহাস চক্রাকার -- যে কোনো সভ্যতাই এক সময় মধ্যগগনে পৌঁছয়, তারপর তার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। আসিমভ তাঁর উপন্যাসগুলির সূত্রকে টয়নবির এই মতের সাহায্যে বেঁধেছেন, কিন্তু তাঁর আশাবাদ তাঁকে সেই চক্রাকার পরিবর্তনের থেকে বেরোনোর গল্পও লিখতেও প্রেরণা জুগিয়েছে। জন্মমৃত্যুর কাহিনি লিখলেও ছায়াপথ সাম্রাজ্য যখন তার সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়, সেই সময়ের কোনো উল্লেখযোগ্য কাহিনি তাঁর লেখাতে আসেনি। এই কাহিনিগুলিতে রোবটদের কোনো ভূমিকা নেই। সেটা স্বাভাবিক, তার কারণ এগুলি তাঁর রোবটের কাহিনি প্রকাশের আগে লেখা। বেশ কয়েকটি গল্প ও উপন্যাসের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত রোবটদের কাহিনি, ছায়াপথ সাম্রাজ্য এবং Foundation সিরিজ এক বিন্দুতে পৌঁছেছে, কিন্তু সেগুলির অধিকাংশই তাঁর পরবর্তীকালের রচনা, এবং কাহিনি হিসাবে বেশ দুর্বল।

       বেশ কয়েকটি অসাধারণ ছোট গল্প লিখেছেন আসিমভ। তাঁর Nightfall গল্পটি বহুবার পাঠকদের বিচারে কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ গল্প নির্বাচিত হয়েছে, আমাদের আলোচনা তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখি। গল্পটির শুরু হয়েছে কবি ও দার্শনিক র‍্যালফ এমারসনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। এমারসন বলেছিলেন যে যদি এক হাজার বছরে একবার মাত্র যদি আকাশের নক্ষত্ররা আমাদের দৃষ্টিগোচর হত, মানবজাতি তাহলে জন্ম জন্ম ধরে তাকে স্বর্গের আবির্ভাব ভেবে পূজা করত। আসিমভ গেলেন এমারসনের বিপরীত দিকে। একটি গ্রহের আকাশে ছটি সূর্যের মতো তারা আছে, ফলে সেখানে রাত্রি প্রায় নামেই না। দু’হাজার পঞ্চাশ বছর পরপর গ্রহ নক্ষত্রের এমন অবস্থান হয় যে গ্রহণের ফলে সেই গ্রহে রাত্রি আসে।  আকাশে দেখা দেয় তিরিশ হাজার নক্ষত্র, যাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে মানুষের কোনো ধারণা ছিল না। বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তুলনায় মানবজীবনের ক্ষুদ্রতার বোধ মানুষকে উন্মাদ করে দেয়, সভ্যতার পতন ঘটে।

       কল্পবিজ্ঞানের জন্য যে কটি পুরস্কার দেওয়া হয় সবকটি পেয়েছেন আসিমভ, এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে একাধিকবার। Foundation-এর গল্পগুলি কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সিরিজ হিসাবে নির্বাচিত হয়েছে। তিনি মনে করতেন যে বিজ্ঞান ও শিল্পকলার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে কোনো দেওয়াল নেই, নিজের লেখাতে বার বার সে কথা তিনি প্রমাণ করেছেন। তিনি সেই যুগের লেখক যে যুগ বিশ্বাস করত যে বিজ্ঞানপ্রযুক্তি আমাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান করতে পারবে। ষাটের দশকে সেই বিশ্বাসের অবসান ঘটেছিল, আসিমভও কল্পবিজ্ঞান লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পরে্র লেখায় আর প্রথম যুগের আসিমভকে আমরা পাই না। জর্জ অরওয়েলের 1984, অলডাস হাক্সলির Brave New world বা মার্গারেট অ্যাটউডের The Handmaid’s Tale যে ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যতের কথা বলে, আসিমভের আশাবাদ তার সম্পূর্ণ বিপরীত ছবি আঁকে। তাই হয়তো মৃত্যুর তিন দশক পরেও তাঁর লেখা পাঠকের মন জয় করে নেয়, চলচ্চিত্রায়িত হয়, আধুনিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়।


প্রকাশঃ জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার শারদীয় ২০২০

      

No comments:

Post a Comment