Sunday, 1 December 2024

পরিবর্জন নীতির শতবর্ষে বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি

 

পরিবর্জন নীতির শতবর্ষে বিজ্ঞানী উলফগ্যাং পাউলি

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


 

()

কোয়ান্টাম তত্ত্বের জন্ম ১৯০০ সালে; তাকে কোয়ান্টাম বলবিদ্যাতে পরিবর্তিত করতে চিরায়ত পদার্থবিদ্যার ধ্যানধারণাকে বিসর্জন দেওয়ার প্রয়োজন ছিল। মাক্স প্লাঙ্ক, আলবার্ট আইনস্টাইন, নিলস বোর, আর্নল্ড সমারফেল্ড প্রমুখের গবেষণা চিরায়ত বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা দেখাচ্ছিল, পরের প্রজন্মের পদার্থবিদরা সেই সীমাবদ্ধতাকে স্মরণে রেখেই বিজ্ঞানের জগতে পা রেখেছিলেন। তাই হয়তো তাঁদের পক্ষে চিরায়ত বিজ্ঞানের সঙ্গে বিচ্ছেদ সহজতর হয়েছিল। এই তরুণদের মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য ছিলেন উলফগ্যাং পাউলি, ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ এবং পল ডিরাক। পঁচিশ বছর বয়সের আগেই তাঁরা তাঁদের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজগুলি করেছিলেন। এঁদের মধ্যে সব থেকে বড় ছিলেন পাউলি, আবার এঁদের মধ্যে কোয়ান্টাম তত্ত্বে তিনিই প্রথম অবদান রেখেছিলেন। তা৬র এক বিশেষ আবিষ্কারের শতবর্ষে আমরা প্রবেশ করেছি। এই লেখাতে আমরা তাঁর সম্পর্কে শুনব।

পাউলির জন্ম ভিয়েনাতে ১৯০০ সালের ২৫ এপ্রিল। তাঁর বাবার নামও উলফগ্যাং, তিনি ছিলেন ডাক্তার, কিন্তু চিকিৎসা পেশা ত্যাগ করে গবেষণাতে যোগ দিয়েছিলেন, এবং ভিয়েনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইন্সটিটিউটের অধিকর্তা হয়েছিলেন। মা বার্থা ছিলেন সুপরিচিত লেখিকা ও সাংবাদিক। ছোটবেলা থেকেই সবাই বিশ্বাস করতেন পাউলি এক বিরল প্রতিভা, পাউলির নিজেরও তাই নিয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। গল্প আছে মাত্র বারো বছর বয়সে পাউলি সমারফেল্ডের বক্তৃতা শুনতে গিয়েছিলেন, ছোট্ট পাউলিকে সমারফেল্ড জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সব বুঝতে পারছ? পাউলি বললেন, “হ্যাঁ, খালি বোর্ডের ওই উপরের ডানদিকের সমীকরণটা ছাড়া।“ সমারফেল্ড ঘুরে দেখে বললেন, “ওহো, ওটা ভুল লিখেছি।“ এটা খুব সম্ভবত গল্পই, কিন্তু তা হলেও পাউলিকে বুঝতে কাজে লাগে।

১৯১৮ সালে পাউলি মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন, আকর্ষণ সেই সমারফেল্ড। সমারফেল্ড বুঝলেন পদার্থবিদ্যা ও গণিতের প্রায় সব কিছু জেনেই পাউলি মিউনিখে এসেছেন। সঙ্গে করে এনেছিলেন সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে একটা গবেষণাপত্র। আঠারো বছর বয়সী পাউলির গবেষণাপত্রটির প্রশংসা করেন সেই তত্ত্বের স্রষ্টা আইনস্টাইন স্বয়ং। ১৯১৯ সালে পাউলি সেই বিষয়ে তিনটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সমারফেল্ডের উপর সাধারণ আপেক্ষিকতা নিয়ে একটি বিস্তারিত প্রবন্ধ লেখার দায়িত্ব পড়ে, সমারফেল্ড পাউলিকে বলেন তাঁরা দু’জনে মিলে সেটি লিখবেন। কিন্তু পাউলির প্রথম ড্রাফ্‌টই এত ভালো হয় যে সমারফেল্ড তাতে হাত না দিয়ে পাউলির নামেই সেটি ছাপতে পাঠিয়ে দেন। দু’শো সাঁইত্রিশ পাতার সেই প্রবন্ধটি সমারফেল্ড ছাড়াও মাক্স বর্ন ও এরউইন শ্রয়ডিঙ্গারের মতো প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীর সমীহ আদায় করে নিয়েছিল। আইনস্টাইন ছাপার অক্ষরে পাউলির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

এর পরেই পাউলি সাধারণ আপেক্ষিকতাকে সাময়িকভাবে ত্যাগ করে পরমাণু ও কোয়ান্টাম তত্ত্বের দিকে মন দেন। সমারফেল্ডের সঙ্গে কাজ করে তিনি একুশ বছর বয়সে এই বিষয়ে ডক্টরেট করলেন। এর পর পাউলি গটিনগেনে মাক্স বর্নের সহকারী হিসাবে যোগ দেন। এক বছর তিনি সেখানে ছিলেন, বর্নের সঙ্গে মিলে তিনি হিলিয়াম পরমাণুর ক্ষেত্রে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগের এক নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন। এর পর হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক মাস কাটানোর পরে বোরের আমন্ত্রণে কোপেনহাগেন যান। বোরের আমন্ত্রণের উত্তর পাউলি যে ভাষায় দিয়েছিলেন, তাও তাঁকে বুঝতে আমাদের সাহায্য করে; “কোপেনহাগেনে বিজ্ঞান বিষয়ে আপনার চাহিদা পূরণের বিষয়ে আমি কোনো সমস্যার আশঙ্কা করছি না, কিন্তু ড্যানিশের মতো বিদেশী ভাষা শেখাটা আমার কাছে সত্যিই সমস্যা হবে।“ পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন যে দুই ক্ষেত্রেই তাঁর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। কোপেনাহাগেনে এক বছর কাটিয়েছিলেন, তার মধ্যেই তিনি বোরের মনে যে দাগ কেটেছিলেন তা অভূতপূর্ব। এরপর তিনি ১৯২৩ থেকে ১৯২৮ পর্যন্ত হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান।

হামবুর্গে থাকাকালীন ১৯২৫ সালে পাউলি তাঁর জীবনের সব থেকে বিখ্যাত কাজটা করেছিলেন, যা তাঁকে কুড়ি বছর পরে নোবেল পুরস্কার এনে দেবে। আমরা মেন্দেলিয়েভের পর্যায় সারণীর কথা জানি, সেখানে মৌলিক পদার্থগুলি তাদের ধর্ম অনুসারে সাজানো থাকে। নিচে আধুনিক পর্যায় সারণির একটি রূপ দেখানো হল।


পর্যায় সারণী
    দেখা যাচ্ছে যে প্রথম সারিতে দু’টি মৌল জায়গা পেয়েছে, দ্বিতীয় সারিতে আটটি, তৃতীয় সারিতে আটটি, চতুর্থ সারিতে আঠারোটি, এভাবে মৌলিক পদার্থগুলি সাজানো থাকে। সারির একেবারে শেষে আছে নিষ্ক্রিয় গ্যাসেরা, তাদের পরমাণু ক্রমাঙ্ক বা পরমাণুর ইলেকট্রনের সংখ্যা হল যথাক্রমে 2, 10, 18, 36, 54 86। এই সংখ্যাগুলোর থেকে একটা ইলেকট্রন বেশি হলেই আমরা পাই লিথিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি ক্ষার ধাতু; আবার একটা ইলেকট্রন কম হলেই পাই হয় হাইড্রোজেন, নয়তো ফ্লোরিন, ক্লোরিন, ব্রোমিন ইত্যাদি হ্যালোজেন মৌল। এরা সবাই রাসয়ানিক বিক্রিয়াতে অত্যন্ত সক্রিয়, অথচ নিষ্ক্রিয় গ্যাসরা বিক্রিয়া করতেই চায় না।

বোর ১৯২২ সালে তাঁর পরমাণুর মডেল থেকে পর্যায় সারণীর ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। বোরের মডেলে ইলেকট্রনেরা কতগুলো কক্ষপথে অবস্থান করে। বোর বললেন যে পরমাণুর বাইরের কক্ষপথ যদি পুরোপুরি ভর্তি হয়, তাহলে সে খুব সুস্থিত, ফলে বিক্রিয়াতে অংশ নিতে চায় না। এর পরে একটা ইলেকট্রন যোগ করলে সে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিতে বাঁধা পড়ে, তাই পরমাণু চট করে তাকে ছেড়ে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের মতো হতে চায়। আবার একটা ইলেকট্রন কম থাকলে অন্য মৌলের পরমাণু থেকে ইলেকট্রন ছিনিয়ে নিয়ে নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রন বিন্যাস নেয়। ফলে ক্ষার ধাতু বা হ্যালোজেনরা অত্যন্ত সক্রিয়। কিন্তু নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ইলেকট্রনের সংখ্যা কেন 2, 10 ইত্যাদি হবে তার ব্যাখ্যা বোর দেননি।

এডমন্ড স্টোনার বেশি বয়সে কেমব্রিজে ডক্টরেট করছিলেন। ১৯২৪ সালে তিনি প্রস্তাব করেন যে পর্যায় সারণীতে যতগুলি ঘর থাকে, ইলেকট্রনরা ততগুলি শক্তিস্তরেই থাকতে পারে। সেখানে বোর-সমারফেল্ড মডেল তিনি কাজে লাগান। ধরা যাক মুখ্য কোয়ান্টাম সংখ্যা হল n, সেক্ষেত্রে l-এর মান হয় 0, 1, 2... (n-1); আবার প্রতিটি l–এর জন্য (2l+1) সংখ্যক m কোয়ান্টাম সংখ্যা হতে পারে। সুতরাং কোনো বিশেষ n-এর জন্য মোট শক্তিস্তরের সংখ্যা পাওয়ার জন্য যতগুলি l আছে, তাদের প্রত্যেকের জন্য (2l+1) –কে যোগ করতে হবে। যোগফলটা খুব সোজা, তার মান n2। এখান n–এর জায়গায় 1 বসালে পাব 1, আবার 2 বসালে পাব 4, তেমনি 3 বসালে পাব 9। পর্যায় সারণীতে প্রথম সারিতে 2–টি, দ্বিতীয় সারিতে 8–টি, চতুর্থ সারিতে 18-টি মৌল আছে। (তৃতীয় সারিতে কেন 18 নয় তার আলোচনা এখানে সম্ভব নয়, তখন তা বোঝাও যায়নি।) দেখা যাচ্ছে শক্তিস্তরের সংখ্যাকে দুই দিয়ে গুণ করলে বিভিন্ন সারিতে মৌলের সংখ্যার সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।

পাউলি এই ধারণাটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি বললেন যে ইলেকট্রনরা ত্রিমাত্রিক কক্ষপথে থাকে, সেজন্য তাদের সম্পর্কে জানতে তিনটি কোয়ান্টাম সংখ্যা n, l m প্রয়োজন। কিন্তু প্রত্যেক ইলেকট্রনের আরো একটি কোয়ান্টাম সংখ্যা আছে যার দু’টি মান হতে পারে। সেই কারনেই দুই দিয়ে গুণ করতে হচ্ছে। এই নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যার তিনি নাম দিলেন Zweideutigkeit, জার্মান শব্দটার মানে হল দুই রকম মান। সেজন্য ইলেকট্রনের বর্ণনা দিতে চারটি কোয়ান্টাম সংখ্যা লাগবে, এবং পরমাণুতে কোনো দু’টি ইলেকট্রনের ক্ষেত্রে এই চারটি সংখ্যাই অবিকল এক হতে পারবে না। একে বলে পাউলির পরিবর্জন নীতি। ১৯২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাইটশক্রিপ্ট ফার ফিজিক গবেষণাপত্রিকাতে তিনি এটি প্রকাশ করেন।

পাউলির ব্যাখ্যা একসঙ্গে অনেকগুলি সমস্যার সমাধান করল। প্রথম থেকেই একটা প্রশ্ন ছিল, পরমাণুর সব ইলেকট্রন কেন নিচের স্তরে চলে যায় না। পরিবর্জন নীতি অনুযায়ী তার সুযোগ নেই, কারণ সেখানে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার থেকে বেশি ইলেকট্রন থাকতে পারে না। মুখ্য কোয়ান্টাম সংখ্যা n-এর জন্য কক্ষপথে 2n2-এর থেকে বেশি ইলেকট্রন থাকা সম্ভব নয়।

পাউলির পরিবর্জন নীতির একটা বড় সাফল্য ছিল সোডিয়ামের বর্ণালীর ব্যাখ্যা। সোডিয়ামকে উত্তপ্ত করলে তার থেকে হলুদ আলো বেরোয়। ভালো করে বিশ্লেষণ করে দেখা গেল এই হলুদ আলোতে একটা নয়, দুটো খুব কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো আছে। আধুনিক ভাষায় বললে দু’টি ফোটন আছে যাদের শক্তি খুব কাছাকাছি। আমরা দেখেছি যে বোরের মডেলে এই আলোর উৎস হল উপরের কক্ষপথ থেকে নিচের কক্ষপথে ইলেকট্রনের ঝাঁপ। কিন্তু এত কাছাকাছি আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য তখনই সম্ভব যদি উপরে খুব কাছাকাছি শক্তির একটি নয়, দু’টি স্তর থাকে। বোরের মডেলে তা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পাউলির এই নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যা খুব সহজেই সমস্যাটার সমাধান করে দিল। ওই দু’টি শক্তিস্তরের (n,l,m) কোয়ান্টাম সংখ্যাগুলি সমান, কেবল চতুর্থ কোয়ান্টাম সংখ্যাতে তারা আলাদা। সেজন্য তাদের শক্তির মান খুব কাছাকাছি হয়। আরো বেশ কিছু ঘটনার ব্যাখ্যা এই নীতি দিয়েছিল, তার মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হল ব্যতিক্রান্ত জিমান ক্রিয়া। তিরিশ বছর আগেই পিটার জিম্যান দেখিয়েছিলেন যে পরমাণুর উপরে চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করলে তার থেকে নির্গত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কয়েকটি কাছাকাছি তরঙ্গদৈর্ঘ্যে ভেঙে যায়। এই নতুন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের মধ্যে পার্থক্যটা চৌম্বকক্ষেত্রের মানের সমানুপাতী। চিরায়ত পদার্থবিদ্যা কয়েকক্ষেত্রে ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা ব্যর্থ হয়। যেমন সোডিয়ামের একটি রেখা চারটি ও অন্য রেখাটি ছয়টি ভাগে ভাঙে — এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। পাউলির নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যা এই সমস্যার সমাধান করল। এই পরিবর্জন নীতির জন্য ১৯৪৫ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার জিতবেন।

()

পাউলির সম্পর্কে সে সময় একটা গল্প চালু ছিল। মৃত্যুর পরে পাউলি স্বর্গ গেছেন, ভগবান তাঁকে বললেন পাউলি তোমার উপরে আমি সন্তুষ্ট, তুমি কী চাও বলো। পাউলি কোয়ান্টাম বলবিদ্যার এক বিশেষ বিষয় বুঝতে চাইলেন। ভগবান একটা ক্লাসরুম সৃষ্টি করে পাউলিকে বসতে বললেন, বোর্ডে গিয়ে বোঝানো শুরু করলেন। পাউলির মতো খুশি সেই মুহূর্তে সৃষ্টিতে আর কেউ ছিলেন না। কিন্তু দু’ মিনিট পরেই তাঁর মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আরো দু’ মিনিট পরে পাউলি আর থাকতে পারলেন না, লাফিয়ে উঠে বললেন, ভগবান, আপনি সবই ভুল করছেন।

গল্পটা মজার, কিন্তু পরের ঘটনাটা বুঝতে আমাদের সাহায্য করবে। পাউলি সমালোচনাতে কাউকেই রেয়াত করতেন না বলে তাঁর নাম হয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানের বিবেক, কেউ কেউ বলত পোপ। কলেজে পড়াকালীন জীবনে প্রথমবার আইনস্টাইনের বক্তৃতার পরে তাঁর মন্তব্য ছিল, প্রফেসর আইনস্টাইন যা বলছেন সবটাই বোকা বোকা নয়। কোনো গবেষণা পছন্দ না হলে মন্তব্য আসত, এমন কি ভুলও নয়! এমনকি তিনি নিজেই ছিলেন নিজের সব থেকে বড় সমালোচক। অনেক বছর পরে পাউলি ও হাইজেনবার্গ এক তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন, হাইজেনবার্গ এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে তাঁদের গবেষণা প্রায় সম্পূর্ণ, ছোটখাটো কয়েকটা জিনিস বাকি আছে। সেটা শুনে পাউলি তাঁকে একটা খালি পোস্টকার্ড পাঠান, নিচে খালি লেখা ছিল, ‘আমি টিশিয়ানের মতো আঁকতে পারি, ছোটখাটো কয়েকটা জিনিস বাকি আছে।’

পাউলি এই নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যা বাস্তবে ইলেকট্রনের সঙ্গে কেমন ভাবে সংশ্লিষ্ট তা নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি ছিলেন না। তবে স্বাভাবিক ভাবেই অন্যরা তাই নিয়ে ভাবছিলেন। তরুণ র‍্যালফ ক্রনিগ পাউলিকে বলেন ইলেকট্রন যদি পৃথিবীর মতো নিজের অক্ষের চারপাশে পাক খায়, তাহলে হয়তো এই নতুন কোয়ান্টাম সংখ্যার ব্যাখ্যা সম্ভব। পাউলি তাঁকে এমন ভাষাতে উড়িয়ে দেন যে ক্রনিগ বিষয়টা নিয়ে আর এগোননি। তিনি পরে কোপেনহাগেনে বোরকে অবশ্য বলেছিলেন, কিন্তু বোরও বিশেষ উৎসাহ দেখাননি।

সকলেই পাউলির মতো কড়া ছিলেন না। এক বছর পরে হল্যান্ডের লেইডেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পল এহরেনফেস্টের দুই ছাত্র জর্জ উহ্‌লেনবেক ও স্যামুয়েল গৌডস্মিট প্রায় একই কথা তাঁদের শিক্ষককে বলেন। এহ্‌রেনফেস্ট তাঁদের দু’জনকে সোডিয়ামের মতো ক্ষার ধাতুর বর্ণালী নিয়ে কাজ করতে বলেছিলেন। আমরা দেখেছি পাউলি সোডিয়ামের বর্ণালীর জন্য তাঁর চতুর্থ কোয়ান্টাম সংখ্যার প্রস্তাব করবেন। ক্ষার ধাতুর বর্ণালী প্রসঙ্গেই উহ্‌লেনবেকরা ইলেকট্রনের ঘূর্ণির ধারণাতে আসবেন। তাঁরা তার নাম দিলেন স্পিন। এহ্‌রেনফেস্ট তাঁদের তত্ত্বকে প্রবন্ধের আকারে লিখে তাঁকে জমা দিতে বলেন। হল্যান্ডের দিকপাল পদার্থবিজ্ঞানী হেন্‌ড্রিক লরেঞ্জ চিরায়ত পদার্থবিদ্যাতে ইলেকট্রন তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত ছিলেন, এহ্‌রেনফেস্ট দুই ছাত্রকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। লরেঞ্জ তখনো লেইডেনে সপ্তাহে একদিন ক্লাস নেন, ক্লাসের পরে উহ্‌লেনবেক ও গৌডস্মিট তাঁকে তাঁদের তত্ত্বের কথা বলেন। লরেঞ্জ বলেন তিনি ভেবে দেখবেন।

পরের সপ্তাহে আবার তাঁরা লরেঞ্জের কাছে যান। লরেঞ্জ তাঁদের একতাড়া অঙ্ক দেখান, বলেন যে ইলেকট্রনের ঘূর্ণি থেকে যদি পাউলির কোয়ান্টাম সংখ্যা ব্যাখ্যা করতে হয়, তাহলে ইলেকট্রনের বাইরের তলের বেগ আলোর থেকে অনেক বেশি হতে হবে। হতাশ হয়ে দুই ছাত্র শিক্ষকের কাছে গিয়ে বলেন যে লরেঞ্জ তাঁদের তত্ত্ব যে ভুল তা দেখিয়ে দিয়েছেন, কারণ বিশেষ আপেক্ষিকতা অনুসারে আলোর বেগের থেকে বেশী বেগ সম্ভব নয়। এহ্‌রেনফেস্ট বলেন যে তিনি সেই গবেষণাপত্র আগেই ছাপতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। ‘তোমরা দু’জনেই তরুণ, একটা বোকামি তোমরা করতেই পারো।‘ পাউলির মতোই এহ্‌রেনফেস্টও প্রথমেই এই সমস্যাটা বুঝেছিলেন, কিন্তু তিনি আরো বুঝেছিলেন যে যখন প্রকৃত তত্ত্ব আসবে, তখন এই সমস্যা থাকবে না। লরেঞ্জ চিরায়ত পদার্থবিদ্যা থেকে বেরোতে পারেননি। বাস্তবে ঘটবেও তাই। আমরা এখন জানি যে স্পিন ইলেকট্রনের মূলগত ধর্ম, তার সঙ্গে ইলেকট্রনের ঘূর্ণির কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের সাধারণ জগতের কোনো ছবি দিয়ে তাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। তখন অবশ্য সে কথা বোঝা সম্ভব ছিল না।

উহ্‌লেনবেকদের গবেষণাপত্রটি বিজ্ঞানীমহলে বেশ আলোড়ন তুলেছিল। নিলস্‌ বোর আবারও একেবারেই স্পিনের ধারণার সঙ্গে সহমত হতে পারেননি। পরের মাসে তিনি লেইডেনে এক সম্মেলনে যোগ দিতে ট্রেনে করে যাচ্ছিলেন। হামবুর্গ স্টেশনে পাউলি ও অটো স্টার্ন তাঁর সঙ্গে দেখা করে স্পিন সম্পর্কে তাঁর মত জানতে চান। বোর বলেন পরমাণুর মধ্যে স্পিনের প্রভাব দেখতে হলে চৌম্বক ক্ষেত্র দরকার, সেটা কোথা থেকে আসবে? কাজেই উহ্‌লেনবেকদের তত্ত্ব ভুল। লেইডেন স্টেশনে আইনস্টাইন ও এহ্‌রেনফেস্ট তাঁর সঙ্গে দেখা করে স্পিন সম্পর্কে তাঁর মত জানতে চান। বোর তাঁর আপত্তির কথা জানান। এহ্‌রেনফেস্ট বলেন আইনস্টাইন সমস্যাটার সমাধান করেছেন। ইলেকট্রনের কাছে মনে হবে ধনাত্মক আধানের নিউক্লিয়াসটা তার চারপাশে ঘুরছে, সেটাও একটা তড়িৎপ্রবাহ, সেই তড়িৎপ্রবাহ চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্ম দিচ্ছে। বোরের মত সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়, তিনি স্পিনের উৎসাহী সমর্থক হয়ে দাঁড়ান। কোপেনহাগেন ফেরার সময় গটিনগেন স্টেশনে হাইজেনবার্গ ও পাস্কাল জর্ডান তাঁর সঙ্গে দেখা করে স্পিন সম্পর্কে তাঁর মত জানতে চান। বোর আইনস্টাইনের মত তাঁদের বলেন, এবং যোগ করেন যে এটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। বার্লিন স্টেশনে আবার পাউলি তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি শুধু স্পিন সম্পর্কে বোরের মত পরিবর্তন হয়েছে কিনা জানতেই হামবুর্গ থেকে এসেছেন। বোরের উৎসাহ দেখে পাউলি মন্তব্য করেন, কোপেনহাগেনের নতুন ধর্মদ্রোহিতা (heresy)। ফিরে গিয়ে বোর এহ্‌রেনফেস্টকে চিঠিতে লেখেন যে তিনি এখন ইলেকট্রন চুম্বক বিষয়ক দৈববাণীর প্রচারক। এহ্‌রেনফেস্টদের গণনার থেকে পরীক্ষার ফল দু’’গুণ কম হচ্ছিল, যে কারণে পাউলি বিষয়টাকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। বোর নিশ্চিত ছিলেন যে পরে তার কারণ বোঝা যাবে। পরের বছর লেওয়েলিন টমাস দেখান যে আপেক্ষিকতাকে হিসাবে নিলে এই সমস্যা আর থাকে না। পাউলি এবার পুরোপুরি সন্তুষ্ট হলেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসু ১৯২৪ সালের তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্রে ফোটনের স্পিনের কথা বলেছিলেন, কিন্তু আইনসস্টাইন অনুবাদের সময় সেটি বাদ দিয়ে দেন। নোবেলজয়ী আর্থার কম্পটনও ১৯২৪ সালে ইলেকট্রনের স্পিনের কথা বলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবিষ্কর্তা হিসেবে উহ্‌লেনবেক ও গৌডস্মিটের নামই ইতিহাসে লেখা রইল। ক্রনিগ বোরের সহকারী হেনড্রিক ক্রেমার্সকে এক চিঠিতে নিজের রাগের কথা লিখেছিলেন। ক্রেমার্স সেটি বোরকে দেখান। বোর এক চিঠিতে ক্রনিগের কাছে ঘটনাক্রমের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। ক্রনিগ উত্তরে লেখেন যে এই কথা যেন উহ্‌লেনবেক ও গৌডস্মিটের কানে না যায়, কারণ তাঁরা নিজেরাই বিষয়টা আবিষ্কার করেছেন। ক্রনিগ না চাইলেও অবশ্য বিষয়টা ছড়িয়ে পড়েছিল, উহ্‌লেনবেক প্রকাশ্যেই বলেন যে তাঁদের আগেই ক্রনিগ স্পিনের ধারণাতে পৌঁছেছিলেন। এই সমস্ত কারণেই হয়তো স্পিনের মতো পদার্থের মৌলিক ধর্ম আবিষ্কার কখনো নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়নি।

পাউলির অন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল নিউট্রিনোর তত্ত্ব, কিন্তু সেই নিয়ে আলোচনার সুযোগ এই লেখাতে নেই। আরো অনেক মৌলিক অবদান তিনি রেখেছিলেন। হিটলার ক্ষমতায় আসার পরে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া এক হয়ে যায়, ফলে পাউলিও জার্মান নাগরিকে পরিণত হন। ইহুদি পাউলি সুইস নাগরিকত্ব নেওয়ার চেষ্টা করে বিফল হন। বাধ্য হয়ে ১৯৪০ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পরে ১৯৪৬ সালে তিনি মার্কিন নাগরিকত্ব পেয়েছিলেন। আবার তিনি সুইজারল্যান্ডে ফিরে এসে পড়ানো শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে তিনি সুইস নাগরিকত্ব পান। ১৯৫৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।

পাউলি পরিবর্জন নীতির কথা আমরা শুনেছি, শেষ করার আগে পাউলি ক্রিয়ার গল্প শুনে নিই। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী পাউলি পরীক্ষানিরীক্ষাতে একেবারেই পারদর্শী ছিলেন না, ল্যাবরেটরিতে জিনিসপত্র ভাঙতে বা যন্ত্র খারাপ করতে তাঁর জুড়ি ছিল না। তাই বন্ধুরা বলতেন পাউলি পরীক্ষাগারে এলেই যন্ত্র খারাপ হয়ে যায়, তার নাম তাঁরা দিয়েছিলেন পাউলি ক্রিয়া। পাউলি নিজেও বিষয়টাতে মজা পেতেন। একবার গটিনগেনের পরীক্ষাগারের একটা যন্ত্র হঠাৎ কাজ করা বন্ধ করে দেয়, কেন তা কেউ বুঝতে পারছিলেন না। পরীক্ষাগারের অধিকর্তা জেমস ফ্রাঙ্ক পাউলিকে এক চিঠি লিখছিলেন, তিনি সেখানে মজা করে লিখে পাঠান যে এর জন্য অন্তত পাউলিকে দায়ী করা যাচ্ছে না। পাউলি উত্তরে আরো মজা করে লেখেন যে ঐ দিন ঐ সময়ে তিনি গটিনগেন স্টেশনে ট্রেন পরিবর্তন করছিলেন।

 

প্রকাশিত জ্ঞান ও বিজ্ঞান, শারদীয় ২০২৪ 

No comments:

Post a Comment