Monday 11 June 2018

বিজ্ঞানীর বিবেক

আমার প্রথম দিকের লেখা। বিষয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পরমাণু বোমা সংক্রান্ত গবেষণা।  বেশ বড় বলে দুই কিস্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল  'এখন পর্যাবরণ' পত্রিকার ডিসেম্বর ২০০৩ ও জানুয়ারি ২০০৪ সংখ্যায়। 
 

বিজ্ঞানীর বিবেক

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে ভারতের দ্বিতীয় পরমাণু বোমা পরীক্ষার পর সারা দেশে বহু লোক এর পক্ষে বা বিপক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের যাঁরা পরিচালক তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শ সাধারণভাবে সকলেরই পরিচিত। পরমাণু অস্ত্র বিষয়ে তাঁদের সমর্থন থাকাই স্বাভাবিক। দেশের বিজ্ঞানীদের এ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কী অনে তাকেরই অজানা। দেশের বিজ্ঞানচর্চার মূল কেন্দ্রগুলির মধ্যে যেগুলি সরাসরি সরকারের অধীন নয় তার প্রায় প্রত্যেকটিতে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তবে দেশব্যাপী যে সমর্থন ও উচ্ছ্বাসের জোয়ার দেখা গিয়েছিল তার তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল প্রতিবাদের কণ্ঠ। কিন্তু একথাও মনে রাখতে হবে যে বহু বিজ্ঞানী প্রতিবাদে যোগ দেননি অথবা সরকারের পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন। পরমাণু বোমা প্রকল্পে অনেক বিজ্ঞানী কাজ করেছেন বা এখনও করছেন। এই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পরমাণু বোমা প্রকল্পের সূচনাপর্বে এবং অব্যবহিত পরে প্রকল্পে যুক্ত বিজ্ঞানীদের ভূমিকা আলোচনা হয়তো বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে এই নিবন্ধ পরমাণু বোমা তৈরির বিজ্ঞান বিষয়ে নয়। বিজ্ঞানীরাও মানুষ, গবেষণাগারের বাইরে। তারা আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতোই । তাঁদের রুজিরোজগার, সংসার ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। তাঁরাও ভুল করেন, আবার তা সংশোধনের চেষ্টা করেন। সেই মানুষগুলিকে নিয়েই এই প্রবন্ধ।

বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলি বিমূর্ত ও নৈর্ব্যাক্তিক। সমাজের উপর তা নির্ভর করে না। কিন্তু গবেষণা ও বিজ্ঞানের প্রয়োগ একান্তভাবেই সমাজনির্ভর। গ্যালিলিওর সময়ে যেআধু নিক বিজ্ঞানের জন্ম তার উত্তরাধিকার নিহিত আছে বিজ্ঞানীর সত্যের প্রতি ভালবাসার মধ্যে, প্রকৃতিকে বোঝার প্রচেষ্টার মধ্যে। বিংশ শতাব্দিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত গবেষণাগারের বাইরে তাঁর কাজের প্রয়োগ নিয়ে তিনি ছিলেন উদাসীন। বিজ্ঞানের গজদন্ত-মিনারের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাই তাঁর কাছে ছিল শ্রেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যে সিদ্ধান্তের ভার আরোপিত হয়েছিল তা বহনের প্রস্তুতি তাঁর ছিল না। এ বিষয়ে বিখ্যাত পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যানের একটি মন্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। সফল পরমাণু বোমা পরীক্ষার পর মানসিক অবস্থা বোঝাতে তিনি লিখেছেন, ‘... আমরা একটা ভাল উদ্দেশ্যে কাজ শুরু করেছিলাম। উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পরিশ্রম করা আনন্দ ও উত্তেজনার বিষয় চিন্তা করা তখন একেবারে বন্ধ।' এই সমাজবিমুখীনতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে হয়ে দাঁড়িয়েছে এমন এক বিলাস যা গবেষকের পক্ষে আর উপভোগ করা সম্ভব নয়। অথচ চারশ বছরের বিজ্ঞানচর্চার উত্তরাধিকার অস্বীকার করাও তার পক্ষে সহজ নয়। এই দুয়ের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় বিজ্ঞানীর বিবেক। পরমাণু বোমা প্রকল্পে যুক্ত বিজ্ঞানী জেমস্ ফ্রাঙ্ক Emergency Committee of the Atom Scien tists -এর সামনে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে বলেছিলেন 'আমাদের নৈর্ব্যক্তিকতাই রাজ নৈতিক বিবাদে কোনো পক্ষ নিতে বাধা দেয়, কারণ ন্যায় সেখানে কখনই একপক্ষীয় নয়। তাই আমরা সহজ পথ বাছি এবং আশ্রয় খুঁজি আমাদের গজদন্ত মিনারে। আমরা মনে করেছিলাম যে আমাদের গবেষণার ভালো বা খারাপ কোনো প্রয়োগই আমাদের দায়িত্ব নয়।' বিশ্ববিশ্রুত গবেষকের এই স্বীকারোত্তির প্রতিধ্বনি শোনা যায় সংশ্লিষ্ট আরও অনেকের কণ্ঠে।

পরমাণু বোমা সৃষ্টির কথা বলতে গেলে প্রথমেই আলোচনা করতে হয় তার পট ভূমিকা। বিজ্ঞানী রাদারফোর্ড পরমাণুর কেন্দ্রীণ বা নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের জন্ম। নিউক্লিয়াসের মধ্যে যে অমিত শক্তি নিহিত আছে তা মুক্তির জন্য কয়েকজন বিজ্ঞানী কাজ করে চলেছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অটো হান, হান্স বেথে, এনরিকো ফার্মি, লিও জিলার্ড, লিজে মিটনার, আইরিন জোলিও কুরি প্রমুখ। ১৯৩০-এর দশকে ধীরে ধীরে তাঁদের গবেষণার তাৎপর্য পরিষ্কার হয়ে আসে গবেষক মহলে। পরীক্ষাগারের বাইরে তখন চলছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন। ইউরোপের বিজ্ঞান গবেষণার পীঠস্থান ছিল জার্মানি। ১৯৩৩ সালে হিটলারের নেতৃত্বে নাৎসিরা ক্ষমতায় আসে। নাৎসি মতবাদের এক মূল স্তম্ভ ছিল অন্ধ ইহুদিবিদ্বেষ এবং পরমত অসহিষ্ণুতা। নাৎসিদের হাতে পরবর্তী বারো বছরে খুন হয় ষাট লক্ষ ইহুদি। বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতে ইহুদি চিন্তাবিদ এবং যাঁরাই নাৎসি দর্শনের বিরোধী তাদের ওপর নেমে আসে অত্যাচার। শুধুমাত্র নাৎসি জার্মানি বা তার সহযোগী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ইতালি নয়, ইউ রোপের বহু বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নাৎসি ছাত্ররা তাদের বিরোধীদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে অনেক বিজ্ঞানী দেশত্যাগ করতে বাধ্য হন। 'নতুন দুনিয়া" মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁদের সাদরে গ্রহণ করে। এঁদের মধ্যে আইনস্টাইনের নাম সকলেরই জানা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনার পর জার্মানির অধিকৃত দেশগুলি থেকেও অনেক বিজ্ঞানী আমেরিকায় চলে যান। এই সময় থেকেই বিজ্ঞান গবেষণার শীর্ষস্থান আমেরিকার দখলে যায়। দেশত্যাগী বিজ্ঞানীদের মধ্যে অনেকেই পরমাণু বোমা তৈরিতে সাহায্য করেন। নাৎসিদের মতবাদের ভয়াবহতার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তাঁরা হিটলারের হাতে পরমাণু বোমার সম্ভাবনাতে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। মানবজাতির ভবিষ্যৎ বিষয়ে দুশ্চিন্তা তাঁদের বাধ্য করে জার্মানির বিরোধী পক্ষকে পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা দিতে। অনেকেই জানেন যে আইনস্টাইন তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি এফ. ডি. রুজভেল্টকে পর মাণু গবেষণার গুরুত্ব বোঝাতে একটি চিঠি লেখেন। এই চিঠি লিখতে তাঁকে উৎসাহিত করেছিলেন লিও জিলার্ড, ইউজিন উইগনার এবং এডওয়ার্ড টেলার। এঁরা সবাই নাৎসি দের অত্যাচারে ইউরোপ ত্যাগ করতে বাধ্য হন।

প্রায় একই সঙ্গে গবেষণাক্ষেত্রে ঘটেছিল। আর একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন যার প্রভাব তখনই বোঝা যায় নি। বিজ্ঞান গবেষণা চিরকালই ছিল খরচসাপেক্ষ। বিজ্ঞানীরা এতদিন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি সামান্য অনুদান এবং ব্যক্তিগত সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ১৯৩০-এর দশক থেকেই রাষ্ট্র গবেষণাতে অর্থসাহায্য করতে শুরু করে যা বিজ্ঞানীরা সাদরে গ্রহণ করেন। রাষ্ট্রের অনুদানের ক্ষমতা অনেক বেশি তাই নতুন ও উন্নতমানের যন্ত্রপাতিতে গবেষণাগারগুলি আধুনিক হয়ে ওঠে। কিন্তু অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন সেই ইংরাজি প্রবাদবাক্য 'He who pays the piper calls the tune'। গবেষণার দিকনির্দেশ অনেক সময়েই চলে যায় রাষ্ট্রশক্তির হাতে। রাষ্ট্র যখন গবেষণাকে মারণাস্ত্র তৈরির কাজে লাগায়, তখন অনেকের পক্ষে তাকে আর অস্বীকার করার কোনো পথ থাকে না।

আবার আগের কথায় ফিরে আসি। যদিও অধিকাংশ বিজ্ঞানী পরমাণু গবেষণার সামাজিক ও রাজনৈতিক তাৎপর্য বিষয়ে অচেতন ছিলেন কিছু ত্রিশের দশকের মধ্যভাগ থেকেই আস্তে আস্তে এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। ১৯৩৫ সালে লিও জিলার্ড বিজ্ঞানীদের কাছে আবেদন জানান স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে গবেষণার ফল প্রকাশ বন্ধ রাখতে। কিন্তু তাঁর অনুরোধ সাধারণভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়। যুদ্ধ শুরুর পর আইনস্টাইনের চিঠি আগেই উল্লেখিত হয়েছে। আইনস্টাইন ও অন্যান্যদের উদ্বেগের মূল কারণ ছিল ১৯৩৮ সালের বার্লিনের কাইজার উইলহেল্‌ম ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের পরমাণু বিভাজনে সাফল্যলাভ। এরপরই বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গ ঐ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা হন। মার্কিন পদার্থবিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে জার্মানিতে তখনও যে বিজ্ঞানীরা আছেন, তাঁদের মধ্যে একমাত্র হাইজেনবার্গের পক্ষেই পরমাণু বোমা নির্মাণ সম্ভব। মিত্রপক্ষের বিজ্ঞানীরা এই সময় থেকেই দুটি কারণে জার্মানিতে তাঁদের সহকর্মীদের সঙ্গে যোগা যোগ বন্ধ করে দেন। প্রথমত নাৎসিরা জোর করে বা ভয় দেখিয়ে জার্মান বিজ্ঞানীদের থেকে কাজ আদায় করে নিতে পারে। দ্বিতীয় কারণ একটু জটিল। লেনার্ড ও স্টার্ক এই দুই নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী নাৎসিদের পক্ষ সমর্থন করেছিলেন। মার্কিন মহলে তখন জার্মানির রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত যে কোন বিজ্ঞানীর ভূমিকা সন্দেহ জনক মনে হয়। ইহুদিদের উপর নাৎসিদের অত্যাচারের সময় চুপ করে থাকাও তখন এক ধরনের অপরাধ বলে তাঁরা মনে করেছিলেন। তাঁদের পক্ষে তখন জানা সম্ভব ছিল না হাইজেনবার্গ ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে দেশত্যাগ করতে মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু অশীতিপর বিজ্ঞানী কোয়ান্টাম বলবিদ্যার জনক ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক তাঁকে নিবৃত্ত করেন। প্ল্যাঙ্ক তাঁকে বোঝান যে, যাঁরা সরাসরি অত্যাচারিত নয় তাঁরা বিদেশে চাকরি নিলে যাঁদের অনেক বেশি প্রয়োজন তাঁরা বর্ণিত হবেন। ব্যক্তিগত মতামতও অনেক সময় গুরুত্ব পায়। এডওয়ার্ড টেলার জানতেন যে তাঁর প্রাক্তন বন্ধু কার্ল ফ্রেডরিক ভন ওয়াইজেকার নাৎসিদের মতবাদের সমর্থক। তাই তিনি যখন জার্মানির ইউরেনিয়াম প্রকল্পের ভারপ্রাপ্ত হন তখন টেলার মার্কিন সামরিক মহলকে পরমাণু বোমা তৈরির জন্যে চাপ দিতে শুরু করেন। এর মধ্যে যে ওয়াইজেকারের মনের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে তা তাঁর অজানা ছিল। জার্মান বিজ্ঞানীদের ভূমিকা যথাস্থানে আলোচনা করব। যুদ্ধ শুরুর পর ব্রিটেনে রুডলফ ই পিয়ের্লস ও অটো রবার্ট ফ্রিশ সরকারের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। তাঁরা দেখান যে পরমাণু বোমা একটি সম্ভবপর প্রকল্প। এরপর ব্রিটিশ সরকারের উদ্যোগে গবেষণা শুরু হয়।

জাপানের পার্ল হারবার আক্রমণের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও পরমাণু বোমা গবেষণা শুরু হয়। রুজভেল্ট এ বিষয়ে সংগঠনের দায়িত্ব দেন মেজর জেনারেল লেসলি গ্রোভকে। প্রকল্পের নাম হয় ম্যানহাটান প্রকল্প। বিজ্ঞানী জে. রবার্ট ওপেনহাইমার হলেন প্রকল্পের অধিকর্তা। নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে লস এলামসে মূল গবেষণাগার স্থাপিত হয়। এছাড়াও ওক রিজ ও শিকাগোতেও প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। ব্রিটেনের পরমাণু প্রকল্পে কর্মরত বিজ্ঞানীরাও এখানে যোগ দেন। বস্তুতপক্ষে এই প্রকল্পে যে রকম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের সমাবেশ ঘটেছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে আগে বা পরে কখনও হয় নি। বহু বিজ্ঞানীর অনলস প্রচেষ্টাতে প্রথম পরমাণু বোমা পরীক্ষা হয় ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ জুলাই নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে। বোমা বিস্ফোরণের জ্যোতি ওপেনহাইমারের মনে এনে দেয় ভগবদ্গীতার বিশ্বরূপ দর্শন।

দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা ।

যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ভাস্তস্য মহাত্মনঃ ।।

( যদি যুগপৎ সহস্র সূর্য উত্থিত হয়, তা সেই পরমাত্মার জ্যোতির সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে)। কিন্তু এ তো ভগবানের বিশ্বরূপ নয় — এ নটরাজের কালরূপ-মৃত্যুর দ্যোতক। তাই আবার তিনি আশ্রয় খুঁজলেন গীতার মধ্যে।


কালেহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধো লোকান্ সমাহর্তুমিহঃ প্রবৃত্তঃ।

ঋতহপি ত্বাং ন ভবিষ্যন্তি সর্বে যেহবস্থিতা প্রত্যনীকেষু যোধাঃ।।


( আমি লোকক্ষয়কারী কাল – বর্তমানে সংহারে প্রবৃত্ত। তুমি যুদ্ধ না করলেও বিপ ক্ষের যোদ্ধাগণ জীবিত থাকবেন না)। অর্থাৎ এই মারণ অস্ত্র তৈরিতে ওপেনহাইমার নিমিত্ত মাত্র।

ওপেনহাইমারের দর্শন সকলের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। তার মূল কারণ ছিল জার্মানদের বোমা বানানোর অক্ষমতা সম্বন্ধে মিত্রপক্ষের বিজ্ঞানীরা এর আগেই নিশ্চিত ছিলেন। ব্রিটেনে বিজ্ঞানীরা জানতেন যে জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপকরা তখনও নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন। এর সঙ্গে তুলনা করতে হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেখানে গোটা দেশের প্রায় সমস্ত প্রথমশ্রেণীর পদার্থবিদরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অদৃশ্য থেকে হয়ে গেছেন এবং তাদের কারও সঙ্গে সেই মুহূর্তে যোগাযোগ করা অসাধ্য প্রায়। কী ঘটেছিল জার্মানির বোমা তৈরির প্রকল্পে?

বস্তুতপক্ষে জার্মানির পরমাণু অস্ত্র বানানোর প্রচেষ্টা সম্পর্কে আজও বিশেষজ্ঞরা একমত নন। তার একটা কারণ অবশ্যই। ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থাতে সর্বময় সন্দেহের বাতাবরণ। ফলে বিভিন্ন দপ্তরের মধ্যে যোগাযোগ প্রায় অদৃশ্য হয়ে পড়েছিল। ফ্রিজ হাউটারম্যান জার্মান ডাক বিভাগের হয়ে পরমাণু গবেষণা করতেন এবং প্রায় কোনো তথ্যই প্রকাশ করতেন না। Federation of American Scientists (এই সংস্থার কথা পরে আসবে)-এর মুখপত্রে সংস্থার সভাপতি জে.এফ. স্টোন ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে লিখেছেন যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনাকাল থেকেই জার্মান বিজ্ঞানীরা পরমাণু বোমার সম্ভাবনাকে কমিয়ে দেখানোর জন্য এক নীরব সহমত গঠন করেন। তাঁরা হিটলারের হাতে এই অস্ত্র তুলে দিতে চান নি। তারা সরকারের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে মানবজাতির সেবা করেছিলেন। যুদ্ধোত্তর কালে হাইজেনবার্গ লিখেছেন তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল জার্মানির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে জার্মানিতে পদার্থবিদ্যার গবেষণার যাতে মৃত্যু না হয় তা নিশ্চিত করা। এজন্য তিনি তরুণ বিজ্ঞানীদের সৈন্যদল থেকে এনেছিলেন বোমা গবেষণার নাম করে তাঁদের প্রাণ রক্ষা করতে। ২০০০ সালে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে হাল বেথে এবং রবার্ট ইয়ুঙ্ক তাঁর গ্রন্থ 'Brighter Than a Thousand Suns'-এ এই মত সমর্থন করেন। ওয়াইজেকারের কথা আগেই বলেছি। অর্থাৎ জার্মান বিজ্ঞানীরা সচেতনভাবে বোমা বানানো থেকে বিরত ছিলেন। হাইজেনবার্গের একদা সহকর্মী রুডলফ পিয়ের্লসের মতে হাইজেনবার্গ ও অন্যান্য জার্মান বিজ্ঞানীরা পরমাণু বোমা বানানোর প্রযুক্তিগত বাধাগুলিকে অনেক বড়ো ভেবেছিলেন। তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন যে বোমা বানানো সম্ভব নয়, সুতরাং কোনো নৈতিক দ্বিধাদ্বন্দ্বের সম্মুখীন তাঁদের হতে হয় নি।

এটা নিশ্চিত যে হাইজেনবার্গ মিত্রপক্ষের বিজ্ঞানীদের কাছে সঙ্কেত পাঠাতে চেয়ে ছিলেন। জার্মানি ডেনমার্ক অধিকারের পর হাইজেনবার্গ তাঁর শিক্ষক স্থানীয় প্রবাদপ্রতিম ডেনিশ পদার্থবিদ নিলস বোর-এর সঙ্গে দেখা করেন। বোরের মৃত্যুর পর পাওয়া হাইজেনবার্গকে লেখা ডাকে না দেওয়া এক চিঠি থেকে জানা যায় যে হাইজেনবার্গ তাকে পরমাণু বোমার সম্ভাবনা সম্পর্কে জানিয়েছিলেন। তা মিত্রপক্ষকে সতর্ক করার জন্য না কি মৌন সম্মতির মাধ্যমে উভয়পক্ষকেই গবেষণা থেকে বিরত হওয়ার অনুরোধ করতে অথবা ভয় দেখিয়ে বা জোর করে বোরকে জার্মান পক্ষে আনার জন্যে- - তা আজ আর জানার কোনো উপায় নেই। হাইজেনবার্গের সমালোচকরা তৃতীয় বিকল্পটিকে বেছে নিয়েছেন। তবে ইহুদি বিজ্ঞানীদের হিটলারের কবল থেকে উদ্ধার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানোর কাজে বোরের সক্রিয়তার কথা হাইজেনবার্গের অজানা থাকার কথা নয় তাই সেটি সম্ভবপর বলে মনে হয় না। যুদ্ধোত্তর কালে জার্মান পরমাণু বিজ্ঞানীরা একবাক্যে বলেছেন যে তাদের লক্ষ্য ছিল রিঅ্যাক্টর তৈরি, বোমা নয়। যদি একথা মেনে নেওয়া হয় যে প্রযুক্তিগত বাধাগুলিকে অনেক বড়ো মনে করার জন্যই তাঁরা বোমা বানানোর পথে যান নি - সেক্ষেত্রে অবচেতন মনে বোমা সম্পর্কে বিতৃষ্ণার থেকে প্রকৃত গবেষণাতে অনীহার কথা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যাই হোক না কেন - ইতিহাসের পরিহাসে টোটালিটারিয়ান রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা ফ্যাসিবাদী শক্তির হাতে ভয় করতম অস্ত্র তুলে দেন নি অথচ গণতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত বিজ্ঞানীরা সেই অস্ত্রই তুলে দেন রাষ্ট্রের হাতে। রাষ্ট্রশক্তির সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান কতটা সীমিত ছিল তা বোঝার জন্য একটি ঘটনার উল্লেখই যথেষ্ট। জার্মানির ইউরেনিয়াম প্রকল্পের অগ্রগতি বোঝার জন্য মার্কিন সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে বিজ্ঞানী স্যামুয়েল গোডস্মিটের নেতৃত্বে এক অনুসন্ধানকারী দল পাঠানো হয়। অনুসন্ধানের ফলে জার্মান পরমাণু বোমার অস্তিত্ব নেই বুঝতে পেরে গোডস্মিট সহযোগী এক মেজরকে বলেন যে মার্কিন পক্ষের আর পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না। মেজর উত্তর দেন যে অস্ত্র যদি আমেরিকানদের হাতে থাকে তারা তা ব্যবহার করবেই। ইতিহাস প্রমাণ করে দিয়েছে বিজ্ঞানীর সমাজ বিষয়ে অনভিজ্ঞতা।


বিপক্ষের হাতে পরমাণু বোমা নেই তা বোঝার পর কী করেছিলেন বিজ্ঞানীরা? পূর্বোল্লিখিত প্রবন্ধে জে. এফ. স্টোন লিখেছেন ১৯৪৩ সালের গ্রীষ্মকালেই বোঝা গিয়েছিল জার্মানরা বোমা বানাতে পারবে না। কিন্তু ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরা তা জানা সত্ত্বেও মানহাটান প্রকল্পে কর্মরত বিজ্ঞানীদের জানানোর সক্রিয় প্রচেষ্টা করেন নি এবং যখন তাঁরা তা করলেন তখন তাঁদের মত রাজ নৈতিক মহলে গ্রাহ্য হয় নি। যদিও সমস্ত বিজ্ঞানী যে একরকম পথ নিয়েছেন তা নয়। জার্মানির পরমাণু বোমা নেই জানার পর জোসেফ রটব্ল্যাট মানহাটান প্রকল্প থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪৪-এর শেষভাগ থেকেই অনেক বিজ্ঞানী বোমা প্রয়োগের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করতে থাকেন। বিজ্ঞানী নিলস্ বোর যিনি ইতিমধ্যে আমেরিকা পালিয়ে এসে মানহাটান প্রকল্পে সহায়তা করেছেন তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্টও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের সঙ্গে দেখা করে পরমাণু অস্ত্রের আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলেন। তাঁর প্রস্তাব কোনো গুরুত্ব পায় নি।

এরপরই রুজভেল্টের মৃত্যু হয় এবং তীব্র কমিউনিস্ট বিরোধী ট্রুম্যান রাষ্ট্রপতির ভার গ্রহণ করেন। জেমস্ ফ্র্যাঙ্ক, লিও জিলার্ড এবং ইউজিন রাবিনোভিচের নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী একটি রিপোর্ট তৈরি করেন এবং ১৯৪৫ সালের জুন মাসে তদানীন্তন মার্কিন সমর-সচিব হেনরি স্টিমসনের কাছে পেশ করেন। বিজ্ঞানীদের আবিষ্কারের ফলে তাঁদের নিজেদের উপর যে অপরিসীম নৈতিক ও রাজনৈতিক চাপ পড়েছিল এই রিপোর্ট হল তাঁদেরই পক্ষ থেকে এবিষয়ে প্রকাশিত প্রথম যৌথ প্রয়াস। এতে পরমাণু শক্তির উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয় এবং পরবর্তীকালে মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতা সম্বন্ধে নিখুঁত ভবিষ্যদ্বাণী করা হয় ৷

শিকাগোতে জিলার্ড বিশেষ সক্রিয় ছিলেন। ৩ জুলাই তিনি মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছে এক আবেদনে নৈতিক কারণে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগে বিরত থাকতে বলেন। একই সঙ্গে এই আবেদন পত্রটি তিনি সহকর্মীদের মধ্যে স্বাক্ষরের জন্য পাঠান। সহকর্মীদের উদ্দেশ্যে এক চিঠিতে তিনি লেখেন যে সাধারণ জার্মানরা নাৎসিদের অনৈতিক কার্যকলাপের বিরোধিতা না করার জন্য সমালোচনার পাত্র। মানহাটান প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বাস করেও যদি পরমাণু বোমার বিরোধিতা করা থেকে বিরত থাকেন তবে তাঁদের কোনো অজুহাতই থাকবে না। ওক রিজের বিজ্ঞানীরা রাষ্ট্রপতির কাছে দুটি পৃথক আবেদন পাঠান। প্রথমটিতে আঠার জন ও দ্বিতীয়টিতে সাতযট্টি জন স্বাক্ষর করেন। তাঁরা আবেদন জানান যুদ্ধক্ষেত্রে প্রয়োগের আগে যেন এই নতুন অস্ত্রের ক্ষমতা শত্রুপক্ষকে জানানো ও দেখানো হয়। তাঁরা মনে করেন যে এই পথ ভবিষ্যতে যুদ্ধ বন্ধ করতে ফলপ্রসূ হবে। ১৭ জুলাই রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে জিলার্ড আরও একটি আবেদন পাঠান। শিকাগোতে কর্মরত ঊনসত্তর জন বিজ্ঞানী এতে স্বাক্ষর করেন। তাঁরা জাপানের বিরুদ্ধে প্রয়োগের আগে আলোচনা ও অস্ত্রের শক্তি প্রদর্শনের অনুরোধ করেন। তাঁরা পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের পর এমন এক পরিস্থিতির ভবিষ্যদ্বাবাণী করেন যেখানে বিবদমান দুপক্ষের নগরগুলি সর্বদা ধ্বংসের আশঙ্কায় থাকবে।

এই আবেদন নিবেদনে কোনো ফল হল না। কারণ ইঙ্গ-মার্কিন শক্তি তখন তাদের শত্রু পরিবর্তন করে ফেলেছে। জার্মানি বা জাপান নয়, যুদ্ধোত্তর সোভিয়েত ইউনিয়নই তখন নতুন প্রতিপক্ষ। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সামরিক মহল এই আবেদন প্রথমে রাষ্ট্রপতির কাছে পৌঁছতে বাধা দিয়েছে এবং এমন সময়ে পৌঁছে দিয়েছে যখন সমস্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়ে গেছে। শেষ যে আবেদন পত্রটির কথা পূর্ব অনুচ্ছেদে বলেছি সেটি যখন প্রকাশ পায় তখন দেখা গেছে আবেদনকারীদের অনেকের স্বাক্ষরের নামের পাশেই তাঁদের প্রকল্প থেকে কর্মবিচ্যুতির তারিখ লেখা রয়েছে। অনুমান করা অসঙ্গত নয় আবেদন কারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হিসেবেই তাঁদের বরখাস্ত করা হয়। এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে ততদিনে দুশ কোটি ডলার খরচ হয়ে গেছে বোমা তৈরিতে। কাজেই সামরিক কর্তৃপক্ষের উপরও যুদ্ধে তা কত কার্যকরী তা দেখানোর চাপ ছিল।

প্রশ্ন উঠতে পারে এমন পরিস্থিতিতেও কেন বিজ্ঞানীরা বোমা বানানোর কাজ করেছিলেন। জোসেফ রটব্ল্যাটের মতে এটা হল যা চলছে তাকে চলতে দেওয়ার মনোবৃত্তি। লস এলামসে কর্মরত বৈজ্ঞানিকদের মানসিকতার প্রতিভূ হিসাবে রুডলফ্ পিয়ে লসের মতামত দেখা যাক।

পিয়ের্লসের মতো বিজ্ঞানীরা আশা করে ছিলেন যে পরমাণু অস্ত্র মিত্রপক্ষকে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখবে। কিন্তু ইঙ্গ-মার্কিন সরকার একমাত্র খুব বিশেষ ক্ষেত্রেই এর ব্যবহার করবেন। কোনো নগরের উপর, কোনো বিপদসঙ্কেত ছাড়াই এটা প্রয়োগ হবে তা তাঁরা কল্পনাও করতে পারেন নি। পিয়ের্লস লিখেছেন কোনো জনবিরল জায়গায় প্রয়োগ করে বোমার কার্য ক্ষমতা দেখানোই যেত, আর নাগাসাকিতে বোমা ফেলার কোনো কারণই ছিল না। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, অপর এক বিজ্ঞানী ব্রায়ান ফিল্ড লিখেছেন যে হিরোসিমাতে বোমা ফেলার পর তিনি উল্লাস ই করলেও দ্বিতীয় বোমা ফেলার সংবাদে বিরক্ত হয়ে পড়েন। অস্ত্রপ্রয়োগের আগে বিবেচনার জন্য বিজ্ঞানীরা ভরসা করেছিলেন নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানীদের উপর যাঁরা সামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবেন। ওপেনহাইমার, ফার্মি ছাড়াও এই নেতৃস্থানীয় বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে ছিলেন আর্নেস্টো লরেন্স এবং আর্থার কম্পটন। কিন্তু সে আশা তাঁদের পূরণ হয় নি। উপরোক্ত চারজনকে নিয়ে গঠিত কমিটি নৈতিক প্রশ্ন এবং বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ বিষয়ে আলোচনাই করেন নি। তাঁরা সুপারিশ করেন যে জাপান যুদ্ধে আমেরিকানদের জীবন বাঁচানো তাঁদের দায়িত্ব এবং সরাসরি সামরিক ক্ষেত্রে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা ছাড়া তা সম্ভব নয়। এঁরা চারজনই বিজ্ঞানী হিসেবে সমস্ত সহকর্মীর শ্রদ্ধার পাত্র এবং মানবিক দিক থেকেও সংবেদনশীল। কিন্তু প্রয়োজনের সময় তাঁরা তাঁদের কর্তব্যপালনে ব্যর্থ হলেন।

টুম্যান তাঁর ডায়েরিতে বলেছেন যে তিনি সম্পূর্ণ সামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর বোমা ফেলতে নির্দেশ দেন যাতে মহিলা ও শিশুদের প্রাণহানি না ঘটে। প্রকৃত সামরিক দলিলে এই চিন্তাভাবনার কোন নজির নেই। লক্ষ্যবস্তু হিসেবে প্রথমে চারটি শহরকে বাছা হয়েছিল যেগুলির কোনোটিরই বিশেষ সামরিক গুরুত্ব ছিল না। ইঙ্গ-মার্কিন রাজ নৈতিক ও সামরিক মহল যুদ্ধের পর বলেন যে পরমাণু বোমাতে যত লোক মারা গেছে, জাপান আক্রমণ ও অধিকার করতে গেলে জাপানিদেরই প্রাণহানি হত তার চেয়ে বেশি। অনেক বিজ্ঞানীও তাই মনে করতেন। কিন্তু বিজ্ঞানীদের জানা ছিল না যে জাপান তখন আত্মসমর্পনের জন্য প্রস্তুত এবং ইঙ্গ-মার্কিন নেতৃত্ব তা জানতেন। এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এমন একটা মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। যে অসামরিক লক্ষ্যবস্তুর উপর আক্রমণ স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে পড়েছিল। ফলে শহরের উপর বোমা নিক্ষেপের বিষয়ে নৈতিক আপত্তি ওঠে নি। কিন্তু যে অস্ত্রে কার্যত নিজেদের কোনো ঝুঁকি ছাড়াই শত্রুদেশের একটি বিরাট শহরকে এক মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা যায় তাকে অন্য অস্ত্রের থেকে পৃথকভাবে দেখা প্রয়োজন।

হিরোসিমা ও নাগাসাকিতে বোমা বিস্ফোরণে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তা অনেকেরই জানা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মারা যায় দুই লক্ষাধিক ব্যক্তি। দীর্ঘকাল যন্ত্রণা ভোগের পর মৃত্যুর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি। বোমার ভয়াবহতা তার নির্মাতাদের অধিকাংশকেই বিষণ্ণ করে তোলে। রাজ নীতিবিদরা যখন বোমার গুণগানে ব্যস্ত তখনই উইলি হিগিনবোথামের নেতৃত্বে Association of Atom Scientists গঠিত হয় জনগণকে এর ভয়াবহতা সম্বন্ধে সচেতন করার জন্য। ১১ অগস্ট নাগাসা কিতে বোমা পড়ার দুদিন পরই, নিলস বোর লন্ডনের 'দি টাইমস' পত্রিকায় লেখেন যে সভ্যতা এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর পূর্ণ অধিকার এবং আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান ছাড়া পরমাণু অস্ত্রের উপর কোনো নিয়ন্ত্রণই ফলপ্রসূ হওয়া সম্ভব নয়। তিনি পরবর্তীকালে এই প্রস্তাব রাষ্ট্রসঙ্ঘের কাছে এক খোলা চিঠির মাধ্যমেও দিয়েছিলেন। পরমাণু গবেষণা সামরিক নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য মার্কিন সেনেটে একটি বিল আসে। নবগঠিত Federation of Atom Scientists (পরে যার নাম হয় Federation of American Scientists বা FAS)-এর চেষ্টাতে এই বিল পাস হতে পারে নি। FAS প্রথম থেকেই পরমাণু অস্ত্রের উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের দাবি রাখে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে মার্কিন পরমাণু বোমা পরীক্ষার তীব্র সমালোচনা করে FAST বিজ্ঞানীদের অনেকেরই মনে হয় যে সমসাময়িক রাজনৈতিক চিন্তাধারা পরিস্থি তির মোকাবিলায় অক্ষম। আইনস্টাইন বলেছিলেন যে প্রথম পরমাণু বোমা কেবল হিরোসিমা শহর নয়, উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত প্রাচীন রাজনৈতিক মতাদর্শকেও ধ্বংস করেছে। তিনি এক আন্তর্জাতিক সরকারের কথা বলেন রাষ্ট্রসমূহ যার নিয়ম মানতে বাধ্য থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে তিনি কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘের কথা বলেন নি। আইনস্টাইন ও জিলার্ডের চেষ্টায় তৈরি হয় Emergency Committee of Atom Scientists। প্রথম সভাপতি হন আইনস্টাইন।

সোভিয়েত ইউনিয়নও এরপর পরমাণু অস্ত্র বিস্ফোরণ ঘটায়। এর পরই ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে ট্রুম্যান হাইড্রোজেন বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। মার্কিন জনগণের মধ্যে তীব্র প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়। আইনস্টাইন,জিলার্ড, কম্পটন, বেথে, ফার্সি ও রাবি প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেন। গণিতবিদ নর্মান উইনার লেখেন যে বিজ্ঞানীর এই গবেষণা তাদের হাতেই ক্ষমতা তুলে দেয় যাদের সে বিশ্বাস করে না। থিওডোর হাউস্কা লেখেন যে বিজ্ঞানীদের খ্যাতি হয়েছে মৃত্যুর দৌতা করার জন্য।

একথা ভাবলে ভুল হবে যে সমস্ত বিজ্ঞানী বিরোধিতার দলে যোগ দিয়েছিলেন। এডওয়ার্ড টেলার বা জন ভন নয়ম্যানের মতো বিজ্ঞানীদের উৎসাহেই হাইড্রোজেন বোমা তৈরির কাজ শুরু হয়। টেলার যে মতে বিশ্বাস করতেন তা পরমাণু অস্ত্রধর রাষ্ট্রের কর্ণধারদের মুখে আজও শোনা যায় -- শান্তির জন্য অস্ত্র। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ভন নয়ম্যানের তীব্র কম্যুনিস্ট বিদ্বেষ। অপর এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিজ্ঞানীদের উপর চাপ। আগেই বলেছি, রাষ্ট্রশক্তি পিছনের দরজা দিয়ে গবেষণার উপর নিয়ন্ত্রণ চালু করেছিল। এসময় মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সর্ববৃহৎ সাহায্যকারী ছিল সামরিক কর্তৃপক্ষ। জীবিকার প্রয়োজনে অনেক বিজ্ঞানীকেই সামরিক কাজে সহায়তা করতে হয় । জেনারেল গ্রোভস এটা আগেই অনুমান করেছিলেন। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে অধিকাংশ বিজ্ঞানী যারা পরমাণু বোমা বানানোর বিরোধিতা করছেন তাঁরা আবার ফিরে আসবেন। অনেকক্ষেত্রেই তা ঘটেছিল। এমন কি হান্স বেথের মতো বিজ্ঞানীও হাইড্রোজেন বোমা বানানোর কাজে যোগ দিয়েছিলেন যদিও তিনি নিজে বলেছেন যে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন হাইড্রোজেন বোমা বানানো অসম্ভব। ব্রিটেনে পরমাণু অস্ত্র তৈরির বিরোধিতা করার জন্য Atomic Scientists' Association গঠিত হয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। অথচ ব্রিটেন যখন পরমাণু বোমা বানানো শুরু করে তখন সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরাই তাকে সমর্থন করেন। অবশেষে ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে সংগঠন বন্ধই হয়ে যায়। টেলারের কার্যকলাপ বিশেষভাবে নিন্দার্হ। জে.এফ.স্টোন লিখেছেন মানবজাতি যে ভয়ঙ্কর বিপদের সম্মুখীন তাতে বিজ্ঞানী হিসেবে সবচেয়ে বেশি দায় টেলারের। মারণাস্ত্র প্রতিযোগিতাতে টেলারের দায়িত্ব অপরিসীম। পরমাণু বোমা যেমন গবেষণা থেকে স্বাভাবিক ভাবে উঠে এসেছিল হাইড্রোজেন বোমা কিন্তু তা নয়। হাইড্রোজেন বোমা তৈরির সেই মুহূর্তে কোনো কারণ ছিল না। টেলার যদি রাজনৈতিক ও সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে হাইড্রোজেন বোমার বিষয়ে ব্যাখ্যা না করতেন, তাহলে হয়ত তা বানানো পেছিয়ে যেত। পরবর্তীকালেও রোনাল্ড রেগানের ব্যর্থ ‘তারকা যুদ্ধ' বা Star Wars-এর উৎসাহদাতা হিসেবে টেলারের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বিজ্ঞান জগতের এক দুর্বলতা হল যে সর্বব্যাপী ভীতির সময় কোনো রাজনীতি মনস্ক ও দৃঢ়চেতা বিজ্ঞানী যদি তাঁর সহকর্মীদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে রাজি থাকেন তবে তিনি মানবতা বিরোধী কাজেও বিজ্ঞানকে নিয়োজিত করতে পারেন।

বিজ্ঞানীদের প্রতিবাদ প্রতিরোধ কিন্তু শেষ হয়ে যায় নি। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে ব্রিটিশ দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ও আইনস্টাইন বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণের কাছে এক যৌথ বিবৃতিতে বিরোধ বিদীর্ণ বিশ্বে হাইড্রোজেন বোমার বিভীষিকা সম্পর্কে সচেতন হতে আহ্বান জানান। বিজ্ঞানীদের কাছে তাঁদের আবেদন ছিল এই বিপদ হ্রাসের জন্য পদক্ষেপের। এটি আইনস্টাইনের শেষ বিবৃতি, স্বাক্ষরদানের দুদিন পরেই তাঁর মৃত্যু হয়। অন্যান্য স্বাক্ষরদাতারা ছিলেন ম্যাক্স বর্ন, পার্সি ব্রিজম্যান, লিওপোল্ড ইনফেল্ড, ফ্রেডরিক জোলিও কুরি, হেরম্যান মুলার, লিনাস পাউলিং, সিসিল পাওয়েল, হিদেকি ইউকাওয়া এবং জোসেফ রটব্ল্যাট। রাসেলের চেষ্টায় ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে লন্ডনে বিজ্ঞানীদের এক সম্মেলন হয় । এখানে পরমাণু অস্ত্রের ধ্বংস ক্ষমতা, অসামরিক পারমাণবিক গবেষণার ঝুঁকি, নিরস্ত্রীকরণের প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা ও বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব বিষয়ে আলোচনা হয়।

১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে কানাডার নোভা স্কটিয়াতে হয় প্রথম পাগওয়াশ সম্মেলন। যুদ্ধ ও শান্তিতে পরমাণু শক্তির বিপদ, পরমাণু শক্তির উপর আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণের সমস্যা ও আন্তর্জাতিক স্তরে বিজ্ঞানীদের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনার জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন সহ ১০টি দেশের ২২ জন বিজ্ঞানী মিলিত হন। এর থেকেই সূচনা হয় এক স্থায়ী সংগঠনের The Pugwash Conferences on Science and World Affairs। দীর্ঘদিন পরে এই সংস্থা ও এর কর্ণধার জোসেফ রটব্ল্যাট যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পান।

এই নিবন্ধে দেখানোর চেষ্টা করেছি অধিকাংশ বিজ্ঞানী কিভাবে পরবর্তীকালে পরমাণু অস্ত্রের বিরোধিতা করেছেন। প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা করা সকলের পক্ষে সম্ভব হয় নি - তাই অনেকের প্রতিবাদ প্রকাশ্যে আসে নি। আবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এসে ক্ষমতার স্বাদও অনেককে প্রলুব্ধ করেছিল অস্ত্র তৈরিতে সহায়তা করতে। বোমা বিস্ফোরণের পর বিজ্ঞানীদের সামাজিক সম্মান অনেক বেড়ে যায়। এমন অনেক বিষয়ে তাঁদের মতামত চাওয়া হয় যা তাঁদের জ্ঞানের বাইরে। যেমন ভিয়েতনাম যুদ্ধ বিষয়ে মার্কিন প্রশাসন বিশেষজ্ঞের মত চেয়েছিল পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে। এর ফলে বিজ্ঞানীদের উপর চাপ বেড়ে যায়। পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে বিজ্ঞানীদের ভূমিকার নিন্দা করার আগে একটা কথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই। বিজ্ঞানীরা এই বাড়তি সম্মানকে তাঁদের প্রাপ্য বলে মেনে নিয়ে চুপ করে যেতে পারতেন। তা না করে তাঁরা রাজনৈতিক ও সামরিক মহলের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে দেশব্যাপী জনমতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমাজকে সচেতন করতে চেয়েছেন সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে। রাজনীতিবিদদের উপর তাঁদের আস্থা আমাদের কাছে বোকামি মনে হতে পারে। এ বিষয়ে রুডলফ পিয়ের্লসের একটি মন্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করব, ‘Perhaps the Scientist who is used to rational arguments makes the mistake of expecting politicians to act ra tionally'


প্রকাশঃ এখন পর্যাবরণ, ডিসেম্বর ২০০৩ ও জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ২০০৪

 















Friday 1 June 2018

কলকাতাতে ছাত্র-গবেষক সত্যেন্দ্রনাথঃ কিছু প্রাসঙ্গিক কথা


কলকাতাতে ছাত্র-গবেষক সত্যেন্দ্রনাথঃ কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়

আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু সম্পর্কে জ্ঞান বিজ্ঞানের পাঠকদের আলাদা ভাবে কিছু বলার প্রয়োজন নেই, এই সংখ্যাতে তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা ও জীবন নিয়ে আরো অনেক লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সত্যেন্দ্রনাথ  ১৯০৯ সালে  হিন্দু স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পঞ্চম হয়ে পাস করেন এর পর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সায়েন্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসে বিজ্ঞানে তাঁর বিষয় ছিল গণিত, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও শরীরবিজ্ঞান। ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার পরে ১৯১১ সালে তিনি গণিতে অনার্স এবং পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে পাস নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯১৩ সালে স্নাতক অর্থাৎ বিএসসি পাস করার পরে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজেই মিশ্র গণিতে এমএসসি কোর্সে ভর্তি হয়েছিলেন। ১৯১৫ সালে তিনি স্নাতকোত্তর পাঠক্রম সম্পূর্ণ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা শুরু  করেছিলেন। ১৯২১ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে রিডার পদে যোগ দিয়েছিলেন। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে আমরা ১৯০৯ থেকে ১৯২১, এই বারো বছর সময়ে তাঁর শিক্ষকবৃন্দ, পড়াশোনা, গবেষণা ও শিক্ষকতার বিষয়ে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য দেখব। এর জন্য আমি যে সমস্ত সূত্রের উপর নির্ভর করেছি তাদের মধ্যে Presidency College Centenary Volume, 1955 এবং প্রেসিডেন্সি কলেজ পত্রিকা শতবার্ষিকী স্মারক সংখ্যা, ১৯৫৬, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের কার্যবিবরণী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বছরের ক্যালেন্ডার উল্লেখযোগ্য এই শেষোক্তগুলি হল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক রিপোর্ট

       আমরা দেখতে চাই প্রেসিডেন্সি কলেজে যখন পড়ছেন সত্যেন্দ্রনাথ, তখন তাঁর শিক্ষক কারা ছিলেন? তাঁকে কী কী  বিষয় পড়তে হয়েছিল? তার সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যৎ গবেষণার কোনো সূত্র থাকার সম্ভাবনা আছে কি? পরিশিষ্টে কলকাতা তখন গণিত অনার্স, মিশ্র গণিতে এমএসসি এবং পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নে পাস পাঠক্রমে বিষয় ও বইয়ের তালিকা দেয়া আছে। তিনি কলেজে কোন কোন বিষয়ে শিক্ষালাভ করেছিলেন, তা ঐ তালিকা থেকে বোঝা যায়।
সত্যেন্দ্রনাথ যে সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে ছিলেন, তার মাঝের এক বছর বাদ দিলে তাঁর প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার প্রায় পুরো সময়টাই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন হেনরি রশার জেমস (১৯০৯-১১, ১৯১২-১৬) [শিক্ষকদের নামের পাশে বন্ধনীর মধ্যে প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁদের কার্যকাল দেয়া আছে।] তিনি ১৯০০ থেকে ১৯০১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজে ইংরাজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন তাঁর সম্বন্ধে পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া যায়। প্রেসিডেন্সি কলেজ পত্রিকার শতবার্ষিকী সংখ্যায় প্রেসিডেন্সি কলেজের ইংরাজি সাহিত্যের অধ্যাপক স্যার যদুনাথ সরকার এবং শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর উপরে লেখা দুটি প্রবন্ধে তাঁর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। তবে ঐ দুটি প্রবন্ধে বিজ্ঞানশিক্ষা সম্পর্কে আলাদা করে তাঁর কোনো উৎসাহের কথা নেই। পরে সুভাষচন্দ্র-ওটেন ঘটনার সময়ে তিনি কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং সুভাষচন্দ্রকে বহিষ্কার করেছিলেন।
হেনরি রশার জেমস
       আমরা জানি সত্যেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজের গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা বিভাগে মিশ্র গণিতে এমএসসি পড়েছিলেন। বিভাগের অধ্যাপকদের মধ্যে ছিলেন প্রফেসর ডক্টর কাথবার্ট এডমান্ড কালিস (১৯০২-০৩, ১৯০৪-০৬, ১৯০৮-১৭)কালিস ছিলেন ক্যালকাটা ম্যাথামেটিকাল সোসাইটির সহ-সভাপতি, স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। কালিস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েকটি বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেগুলি পরে Matrices and Determinoids, Vol I নামের একটি বইতে সংকলিত হয়েছিল, প্রকাশক ছিল কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। কালিস কেম্ব্রিজের ক্যাইয়াস কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন, পরে জার্মানির জেনার ফ্রিডরিশ-শিলার ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট করেছিলেন। তিনি বার্লিনেও গবেষণা করেছিলেন ও সেই সময় বিখ্যাত গণিতজ্ঞ ফ্রবেনিয়াসের সংস্পর্শে আসেন। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে ১৯১৭-২২ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশুদ্ধ গণিত বিভাগে হার্ডিঞ্জ অধ্যাপক পদে যোগ দিয়েছিলেন।
       বিভাগের অন্যান্য বিশিষ্ট অধ্যাপকদের মধ্যে ছিলেন ডক্টর দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক (১৯০৮-১৯২১) দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক গবেষণাতে যুক্ত ছিলেন, ফিলসফিকাল ম্যাগাজিনে তাঁর বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের পত্রিকাতেও ফার্মাটের সূত্র বিষয়ে তাঁর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।  তিনি কেম্ব্রিজে পড়াশোনা করেছিলেন, তারপর ডাবলিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিএসসি করেন। তিনি ছিলেন রয়াল সোসাইটি অফ এডিনবারের ফেলো তিনি আপেক্ষিকতাবাদ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ছিলেন। ১৯১৯ সালের মে মাসে সূর্যগ্রহণের সময় আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদের পরীক্ষামূলক প্রমাণ দিয়েছিলেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী আর্থার এডিংটন, তারপরে আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে উৎসাহ জাগে। ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত কনকোয়েস্ট ম্যাগাজিনে ১৯২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাধারণ পাঠকদের জন্য Relativity of Time and Space শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। সত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর কলেজের বাইরেও যোগাযোগ ছিল। কলেজে পড়াকালীন সত্যেন্দ্রনাথ ওয়ার্কিং মেনস ইন্সটিটিউট নামে মাণিকতলার একটি নাইট স্কুলে পড়াতেন, সেখানে দরিদ্র শ্রমজীবী পরিবারের শিশুরা পড়ত। দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন স্কুলটির প্রধান।
       শ্যামাদাস মুখোপাধ্যায় (১৯০৪-০৮, ১৯৯-১২) ছিলেন অপর এক বিখ্যাত অধ্যাপক। প্রেসিডেন্সি কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র শ্যামাদাস কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন। জ্যামিতিতে তাঁর গবেষণা দেশে বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছিল। ১৯০৯ সালে তিনি ডিফারেনশিয়াল জ্যামিতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপপাদ্য ‘Four Vortex Theorem’ প্রথম প্রমাণ করেছিলেনসত্যেন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল খুব ঘনিষ্ঠ  মিহিজামে শ্যামাদাসের একটি বাড়ি ছিল, দীর্ঘ ছুটির সময় সেখানে তিনি ছাত্রদের নিয়ে যেতেনসত্যেন্দ্রনাথও অনেক শনিবার সেখানে যেতেন এবং তাঁর ছাত্রদের পড়াশোনাতে সাহায্য করতেন। (এই তথ্যের জন্য আমি শ্যামাদাস মুখোপাধ্যায়ের প্রপৌত্র অধ্যাপক সব্যসাচী ভট্টাচার্যের কাছে ঋণী।) সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বের জন্য ডিফারেনশিয়াল জ্যামিতির প্রয়োজন হয়, সত্যেন্দ্রনাথ যে ভবিষ্যতে আপেক্ষিকতা নিয়ে পড়ানো ও গবেষণা শুরু করবেন, তার উৎস হয়তো দেবেন্দ্রনাথ মল্লিক ও শ্যামাদাস মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ।
  শ্যামাদাস মুখোপাধ্যায়
  গণিতে অন্যান্য যে অধ্যাপকদের নাম পাওয়া যায় তাঁরা হলেন সারদাপ্রসন্ন দাস (১৯০০-১৯১১, ১৯১৫-১৯৩০), হেমচন্দ্র সেনগুপ্ত (১৯১১-১৫, ১৯১৬-২৯), করুণাময় খাস্তগীর (১৯১৩-২৩, ১৯৩৪-৩৫) এবং জীবনমোহন বসু (১৯১৪-১৫, ১৯১৭-২৬)শেষোক্ত জন এডিনবার থেকে বিএসসি পাস করেছিলেন। বিভূতিভূষণ ব্যানার্জির নাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যালেন্ডারে থাকলেও প্রেসিডেন্সি কলেজের শতবার্ষিকী পত্রিকায় পাওয়া যায় নি। জ্যোতির্বিদ্যাতে ডেমনোস্ট্রেটর ছিলেন রাখালদাস চক্রবর্তী (১৯০৪-১৯১৯) জ্যোতির্বিদ্যা শিক্ষার জন্য যে মানমন্দির ছিল, সেখানে ছাত্র সহকারী ছিলেন হরিগতি দত্ত, প্রাণকৃষ্ণ পারিয়া ও বিভূতিভূষণ দত্ত।
       স্নাতক স্তরে তাঁকে পাসের বিষয় হিসাবে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন পড়তে হত। পদার্থবিদ্যা বিভাগে ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৮৫-১৯১৫)তাঁর পৃথকভাবে পরিচিতি দেওয়া অনাবশ্যক। সি ডব্লিউ পিক (১৮৯৫-১৮৯৭, ১৮৯৯-১৯০০ গণিত, ১৯০৬-১৯১৮ পদার্থবিদ্যা) পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন, তার আগে তিনি ছিলেন তিনি গণিত বিভাগে তাঁর নামে প্রেসিডেন্সি কলেজের বিজ্ঞান গ্রন্থাগারের নাম দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে পরিসংখ্যান বিষয়ে উৎসাহিত রেছিলেন এবং বায়োমেট্রি টেবিলের প্রতি তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। ১৯১২ সালে হেনরি জেমসের অনুপস্থিতিতে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব সামলান। অপর এক অধ্যাপক ই পি হ্যারিসন (১৯০৮-১৫, ১৯২০-২২) ছিলেন জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি। বিখ্যাত নেচার পত্রিকাতে তিনি গবেষণা প্রবন্ধ ছাপিয়েছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথের প্রেসিডেন্সির সহপাঠী বন্ধু এবং পরবর্তীকালে স্বল্পসময়ের সহকর্মী শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি করার সময় তাঁর সঙ্গে কাজ করে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন। হ্যারিসন ছিলেন রয়াল সোসাইটি অফ এডিনবারের সদস্য। রসায়ন পড়াতেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৮৯-১৯১৬) এবং জ্যোতিভূষণ ভাদুড়ি (১৯০৯-১৯২৫)।  প্রফুল্লচন্দ্র সম্পর্কে এই প্রবন্ধে আলাদা করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। ভাদুড়ি প্রেসিডেন্সি কলেজের দ্বিতীয় ডিন, ১৯১৯ সালে তিনি শারীরবিদ্যার অধ্যাপক সুবোধচন্দ্র মহলানবীশের পরে ডিন হয়েছিলেন। শরীরবিজ্ঞানে অধ্যাপক ছিলেন সুবোধচন্দ্র মহলানবীশ (১৯০০-১৯২৭) এবং নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৯০৪-১৯৩৯)। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, শরীরবিজ্ঞানে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষাতে সত্যেন্দ্রনাথ একশোতে একশো পেয়েছিলেন।
       ইংরাজি বিভাগে শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন হিউ মেলভিল পার্সিভাল (১৮৮০-১৯১১), মনমোহন ঘোষ (১৮৯৬-৯৭, ১৯০৩-২৪) এবং প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ (১৯০৪, ১৯০৬-১৯০৭, ১৯০৮-১৯৩৯) এঁরা সে সময়ে শিক্ষক হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পার্সিভাল সত্যেন্দ্রনাথের খাতা দেখার পরে যা নাম্বার পেয়েছিলেন, তার সঙ্গে আরো অতিরিক্ত দশ নম্বর যোগ করে লিখে দিয়েছিলেন, “This Boy has originality.”
       পদার্থবিদ্যা বিভাগে দ্বিজেন্দ্রকুমার মজুমদার (১৯০২-১৯৩৯), চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য (১৯০৬-১৯৪১), অবনীমোহন দাস (১৯১১-১৯১৬), নরেন্দ্রনাথ নিয়োগী (১৯১১-১৯১৬, ১৯২৪-১৯৪২), মণীন্দ্রনাথ মৈত্র (১৯১১-১৯৩৫), কৈলাসচন্দ্র চক্রবর্তী (১৯১১-১৯৪৬) এবং সুশীলকুমার আচার্য (১৯১২-১৯১৪) নাম প্রেসিডেন্সি কলেজের শতবার্ষিকী পত্রিকায় আছে। এঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের নাম আমাদের বিশেষ পরিচিত, পরবর্তীকালে তাঁরা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যার ক্লাসও নিয়েছেন। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯১৪ সালের ক্যালেন্ডারে এঁদের নাম আছে অধ্যাপকের সহকারী হিসাবে। রসায়নে অধ্যাপকদের সহকারীরা ছিলেন সতীশচন্দ্র মুখার্জী (১৯০৭-১৯২১), শৈলেন্দ্রনাথ মিত্র (১৯০৮-১৯৩২, ১৯৩৫) এবং গঙ্গাগোবিন্দ বসাক (১৯১১-১৯১৯)।
       সত্যেন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে গণিতে অনার্স সহ বিএসসি পাস করেন। তিনি গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন, সে বছর প্রথম বিভাগে পাস করেছিলেন আরও চার জন ছাত্র, যথাক্রমে মেঘনাদ সাহা, নিখিলরঞ্জন সেন, অপর্ণাচরণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং সুধাংশুবদন পাণ্ডা। এঁদের মধ্যে অপর্ণাচরণ ছিলেন স্কটিশ চার্চ কলেজের ছাত্র, বাকিরা প্রেসিডেন্সি কলেজে সত্যেন্দ্রনাথের সহপাঠী প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আরো চারজন গণিতে সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করেছিলেন।
       ১৯১৫ সালে মিশ্র গণিতে সত্যেন্দ্রনাথ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তখন এই বিষয়টা কেবল প্রেসিডেন্সি কলেজেই পড়ানো হত। তিনি ছাড়া প্রথম শ্রেণিতে পাস করেছিলেন যথাক্রমে মেঘনাদ সাহা, সুরেন্দ্রকুমার রায় এবং দেবেন্দ্রচন্দ্র দত্ত। বিনয়কৃষ্ণ সিংহ দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং হরিপদ নাগ এবং পূর্ণচন্দ্র চন্দ্র তৃতীয় শ্রেণিতে পাস করেছিলেন। এঁদের মধ্যে দেবেন্দ্রচন্দ্র ছিলেন ননকলেজিয়েট ছাত্র। নিখিলরঞ্জন সেন সে বছর পরীক্ষা দেন নি।
       কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজের কান্ডারী আশুতোষ অবিলম্বেই কয়েকজন সদ্য পাস করা ছাত্রকে গবেষণার জন্য নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। ১৯১৫-১৬ সালে স্যার তারকনাথ পালিত রিসার্চ স্কলারশিপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা গবেষণা শুরু করেছিলেন, তাঁরা হলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, মেঘনাদ সাহা, শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষ, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং অবিনাশচন্দ্র সাহা। তারকনাথ পালিত ট্রাস্টের গভর্নিং বডি ১৯১৫ সালের  ৮ই ডিসেম্বর সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে আপেক্ষিকতাবাদ, মেঘনাদ সাহার ক্ষেত্রে বিকিরণ তত্ত্ব এবং শৈলেন্দ্রনাথ ঘোষকে ধাতুর পাউডারের তড়িৎ পরিবাহিতা বিষয়ে গবেষণার জন্য মাসিক ১৫০ টাকা করে স্কলারশিপ অনুমোদন করে। দশদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট প্রথম দুজনের প্রয়োজনীয় বই কেনার জন্য ৫০০ টাকা এবং শৈলেন্দ্রনাথের গবেষণার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ২০০০ টাকা অনুমোদন করে। সাহা এবং বোস, দুজনেই স্বাধীনভাবে গবেষণা শুরু করেন। শৈলেন্দ্রনাথ অবশ্য বিপ্লবীদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার জন্য পুলিসের নজরে পড়েন এবং অল্পদিনের মধ্যেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
       এঁদের দ্রুত নিয়োগের পিছনে আশুতোষের উদ্দেশ্য ছিল অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজে  এমএসসি ক্লাস চালু করা। ১৯১৬ সালের ১লা জুলাই থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে এম এস সি ক্লাস শুরু হয়। আমরা সকলেই জানি আশুতোষেরই উৎসাহে মূলত স্যার তারকনাথ পালিত ও স্যার রাসবিহারী ঘোষের দানের উপর ভিত্তি করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান কলেজ তৈরি হয়েছিল। ১১ই মে, ১৯১৬ অনুষ্ঠিত পালিত ট্রাস্ট ও ঘোষ এন্ডওমেন্টের গভর্নিং বডির মিলিত সভায় ১লা জুলাই ১৯১৬ থেকে দুই বছরের জন্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও মেঘনাদ সাহাকে পালিত রিসার্চ স্কলারশিপের সঙ্গে সঙ্গে পদার্থবিদ্যা বিভাগে  পালিত অধ্যাপকের সহকারী হিসাবে নিয়োগ করা হয়। প্রসঙ্গত সি ভি রমন ১৯১৪ সালে পালিত অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হলেও তিনি পদে যোগদান করেন ১৯১৭ সালের ২ জুলাইসভা মনে করেছিল যে এঁদের দুজনের মিশ্র গণিতে ডিগ্রি হলেও তাঁরা পদার্থবিজ্ঞান পড়াতে সক্ষম, কারণ তাঁদের বিএসসিতে তা পাস বিষয় হিসাবে ছিল। একই সঙ্গে তাঁরা ফলিত গণিত বিভাগেও কাজ করতে পারবেন। সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদকে ম্যাথামেটিকাল ফিজিক্স পড়ানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এজন্য তাদের স্কলারশিপের পরিমাণ বাড়িয়ে করা  হয় ২০০ টাকা। সেই সভাতে উপস্থিত ছিলেন স্যার আশুতোষ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মহেন্দ্রনাথ রায়, রসায়ন বিভাগের দুই অধ্যাপক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও প্রফুল্লচন্দ্র মিত্র এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার পি ব্রুল। বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট ১৯শে মে তাঁদের এই প্রস্তাব অনুমোদন করে। পরবর্তীকালে অবশ্য ফলিত গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক গণেশ প্রসাদের সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে দুজনেই পুরোপুরি পদার্থবিদ্যা বিভাগে চলে আসেন।
       পদার্থবিদ্যা বিভাগে এই সময় সত্যেন্দ্রনাথ যে সমস্ত শিক্ষকের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের মধ্যে সি ভি রমন, ফণীন্দ্রনাথ ঘোষ, যোগেশচন্দ্র মুখার্জি, দেবেন্দ্রমোহন বোস এবং ব্রজেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর  নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া যে সমস্ত রিসার্চ স্কলার বা অধ্যাপকের সহকারীরা ক্লাস নিতেন তাঁরা হলেন সুশীলকুমার আচার্য, সুধাংশুকুমার ব্যানার্জি, শিশিরকুমার মিত্র, অবিনাশচন্দ্র সাহা, মেঘনাদ সাহা, ও বিধুভূষণ রায় এঁদের সকলেই পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত অধ্যাপক হিসাবে যোগ দেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একসঙ্গে ক্লাস শুরু হয় ১৯১৭ সাল থেকেপ্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে চারুচন্দ্র ভট্টাচার্য, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ, দ্বিজেন্দ্রকুমার মজুমদার এবং ডি বি মিক ক্লাস নিতেন। সত্যেন্দ্রনাথের উপর পড়েছিল আপেক্ষিকতাবাদ পড়ানোর ভার, তাছাড়াও তিনি জেনারেল প্রপার্টিস ল্যাবরেটরিতে ছাত্রদের প্র্যাকটিকাল করাতেন। এই লেখার শেষে ১৯১৮ সালে সত্যেন্দ্রনাথের তৈরি করা পদার্থবিদ্যার প্রশ্নপত্রের প্রথম পাতার ছবি দেওয়া আছে, সঙ্গী ছিলেন ফলিত গণিত বিভাগের অধ্যাপক সুধাংশু কুমার ব্যানার্জি। তখন প্রশ্নকর্তাদের নাম ছাপানো হত।
       এমএসসিতে বিশ্ববিদ্যালয় কোনো বই সুপারিশ করেনি, ছাত্ররা শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে কী পড়তে হবে তা ঠিক করত। ধরেই নেওয়া হয়েছিল যে তারা মৌলিক গবেষণাপত্র থেকে বিভিন্ন বিষয় পড়বে। সময়টা হল পদার্থবিজ্ঞানে কোয়ান্টম বিপ্লবের যুগ, কয়েকবছরের মধ্যে সত্যেন্দ্রনাথ নিজেও সেই বিপ্লবের  এক কারিগর হবেন।  সে সময় আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের বই বিশেষ ছিল না, যে কটি ছিল তাদের অধিকাংশই জার্মান ভাষায় লেখা। মৌলিক গবেষণাপত্রের একটা বিরাট সংখ্যা তখন জার্মান ভাষায় লেখা হত।  সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ, দুজনের কারোরই পদার্থবিজ্ঞানে ক্লাস করার অভিজ্ঞতা ছিল না। পরিশিষ্টের তালিকা থেকে বোঝা যায় যে পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর গবেষণা করার মতো বিশেষ কোনো বই তাঁদের পাঠক্রমে ছিল না।  এই পরিস্থিতিতে দুজনেই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্মান ভাষা শেখার ক্লাসে ভর্তি হন, মেঘনাদ অবশ্য ভাষাটা কিছুটা জানতেন। সেই ক্লাসে তাঁদের সহপাঠী ছিলেন ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সাহা ও বোস মিলে আপেক্ষিকতাবাদ সংক্রান্ত আইনস্টাইন ও হেরম্যান মিনকাওস্কির আপেক্ষিকতা সংক্রান্ত গবেষণাপত্রগুলি ইংরাজিতে অনুবাদ করেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৯ সালে তা প্রকাশিত হয়। সত্যেন্দ্রনাথ  ১৯১৬ সালে অ্যানালেন ডার ফিজিক পত্রিকায় প্রকাশিত আইনস্টাইনের The Foundation of the Generalized Theory of Relativity প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছিলেনবইটির ভূমিকা লিখেছিলেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ। এটিই আইনস্টাইনের গবেষণাপত্রগুলির প্রথম প্রকাশিত ইংরাজি অনুবাদ।
       সত্যেন্দ্রনাথের যে কাজের জন্য তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতি, তা আপেক্ষিকতাবাদ নয়, তাপগতিতত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত। আরো নির্দিষ্টভাবে বললে তাঁর গবেষণা কোয়ান্টম স্ট্যাটিসটিকসের জন্ম দেয় যা ১৯০০ সালে আবিষ্কৃত ম্যাক্স প্লাঙ্কের কৃষ্ণ বস্তুর বিকিরণ সংক্রান্ত কোয়ান্টম তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। অধ্যাপক দেবেন্দ্রমোহন বসু ১৯১৪ সালে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ঘোষ অধ্যাপক পদে যোগদান করে উচ্চতর গবেষণা করতে দুই বছরের জন্য জার্মানি গিয়েছিলেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়াতে তিনি ১৯১৯ সালের আগে ভারতে ফিরতে পারেননি। ফেরার সময় তিনি কয়েকটি নতুন প্রকাশিত জার্মান বই নিয়ে আসেন, তার মধ্য থেকে প্লাঙ্কের লেখা থার্মোডায়নামিক্স বা তাপগতিতত্ত্ব বইটি তিনি সত্যেন্দ্রনাথকে দিয়েছিলেন। এটি সত্যেন্দ্রনাথের ভবিষ্যৎ গবেষণার দিক নির্ণয়ে সাহায্য  করেছিল।
       সত্যেন্দ্রনাথের কলকাতাবাসের প্রথম পর্বের সমাপ্তি ঘটে ১৯২১ সালে যখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রিডার পদে যোগ দেন। এই পর্বে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পাঁচটি গবেষণা পত্র প্রকাশ করেছিলেন, তার মধ্যে গ্যাসের অবস্থার সমীকরণ সংক্রান্ত দুটি গবেষণা পত্র মেঘনাদ সাহার সঙ্গে যৌথভাবে লেখা। অপরটি ছিল পরমাণুর শক্তি স্তর বিষয়ে কোয়ান্টম তত্ত্বের প্রয়োগ, ১৯১৩ সালে নিলস বোর এ বিষয়ে তাঁর গবেষণাটি প্রকাশ করেছিলেন। এই তিনটি গবেষণাপত্র ব্রিটেন থেকে প্রকাশিত ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে ও অপর দুটি বুলেটিন অফ দি ক্যালকাটা ম্যাথামেটিকাল সোসাইটিতে প্রকাশিত হয়েছিল। সাহার সঙ্গে করা গবেষণা তাপগতিবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত। তাপগতিবিদ্যার আণুবীক্ষণিক ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করে স্ট্যাটিসটিকাল মেকানিকস। সাহা সমীকরণ ও বোস-আইনস্টাইন সংখ্যায়ন দুইই স্ট্যাটিসটিকাল মেকানিকসের মধ্যে পড়ে, তাই সেই যৌথ গবেষণাকে তাঁদের ভবিষ্যৎ পথে প্রথম পদক্ষেপ মনে করা যেতে পারে। এই সময়কালে প্রকাশিত সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণাপত্রের তালিকা পরিশিষ্টে পাওয়া যাবে।
       কলকাতা ছাড়ার পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি, তিনি দীর্ঘদিন কলকাতায় তাঁর পুরানো বিভাগে পরীক্ষক ছিলেন। অবশেষে ১৯৪৫ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ঢাকায় থাকাকালীন ১৯২৪ সালে তিনি তাঁর যুগান্তকারী গবেষণাটি করেছিলেন, এই প্রবন্ধে অবশ্য তা নিয়ে কোনো আলোচনা করা হল না। 
      

তথ্যসূত্র
১। Presidency College Centenary Volume, 1955
২। প্রেসিডেন্সি কলেজ পত্রিকা শতবার্ষিকী স্মারক সংখ্যা, ১৯৫৬
৩। Minutes of the Calcutta University Syndicate for Various Years
Calcutta University Calendar for Various Years
‘Satyendranath Bose’, Santimay Chatterjee and Enakshi Chatterjee


(সংযোজনঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান কলেজে পদার্থবিদ্যা বিভাগ শুরুর কথা অপেক্ষাকৃত বিস্তৃতভাবে ছোটদের পত্রিকা জয়ঢাকে এখানে লিখেছিলাম। বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আরো কিছু কথা সৃষ্টির একুশ শতক পত্রিকায় প্রকাশিত এই লেখায় আছে। ) 

পরিশিষ্ট

বিএসসি পাঠক্রমে অঙ্ক অনার্স পাঠক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশ করা বইয়ের তালিকা
1. Higher Algebra
Hall and Knight (Higher Algebra)
C. Smith (A Treatise on Algebra)
2. Elementary Theory of Equations
Cajori (Introduction to Theory of Equations, Chapter I-VII)
3. Higher Plane Trigonometry
Todhunter (Trigonometry, edited by Hogg)
4. Plane Analytical Geometry
Loney (Elements of Co-ordinate Geometry)
C. Smith (Elementary Treatise on Conic Sections)
Salmon (Conic Sections)
5. Elementary Solid Geometry
C. Smith (Elementary Treatis on Solid Geometry)
Bell (Analytical Geometry of Three Dimensions)
6. Elementary Principles of Vectors
Kelland and Tait (Introduction to Quaternions, 3rd Edition, edited by Knott)
Henrici and Turner (Vectors and Rotors)
7. Differential Calculus
Williamson (Differential Calculus)
8. Integral Calculus and Differential Equations
Williamson (Integral Calculus)
Murray (Introductory Course in Differential Equations)
9. Statics
Minchin  (Statics)
Jeans (Theoretical Mechanics)
10. Dynamics of a Particle
Loney (Dynamics of a Particle)
Jeans (Theoretical Mechanics), Cox (Mechanics)
11. Hydrostatics
Besant (Elementary Hydrostatics)
Loney (Elements of Hydrostatics)
12. Astronomy
Parker (Elements of Astronomy)
Young (Manual of Astronomy) 

পদার্থ বিজ্ঞান বিএসসি পাস পাঠক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশ করা বইয়ের তালিকা
Deschanel and Everett (Treatise on Natural Philosophy, Parts I,II and IV), Hadley (Magnetism and Electricity for Students), Schuster and Lees (Advanced Exercises in Practical Physics), Harrison (A Course of Practical Physics)

রসায়ন বিএসসি পাস পাঠক্রমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশ করা বইয়ের তালিকা
Van Deventer (Physical Chemistry for Beginners), Newth (Inorganic Chemistry), Holleman (Organic Chemistry), Ire Remsen (Organic Chemistry), Francis Jones (Practical Chemistry), Alexander Smith (General Inorganic Chemistry), F. Mollow Perkin (Qualitative Chemical Analysis – Organic and Inorganic), Clows and Coleman (Quantitative Analysis), J.B. Cohen (Theoretical Organic Chemistry)


মিশ্র গণিত বিষয়ে এমএসসি পাঠক্রমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুপারিশ করা বইয়ের তালিকা
1. Advanced Statics, including Theory of Potential
Minchin (Statics)
Routh (Statics)
2. Dynamics of a Particle
Routh (Dynamics of a Particle)
3. Rigid Dynamics
Routh (Elementary Rigid Dynamics)
4. Hydrostatics, including Capillarity
Besant and Ramsay (Hydrodynamics Part I: Hydrostatics)
5. Hydrodynamics
Lamb (Hydrodynamics)
6. Spherical Astronomy
Ball (Spherical Astronomy)
7A. Theory of Elasticity
Love (Theory of Elasticity, 2nd Edition), Todhunter and Pearson (History of Theory of Elasticity, recommended reference)
7B Advanced Dynamics
Whittaker (Analytical Dynamics)
A.C. Webster (Dynamics)
Routh (Advanced Rigid Dynamics)
Hertz (Principles of Mechanics)
7C Higher Parts of Spherical Astronomy
Chauvenet (Spherical Astronomy)
Newcomb (Spherical Astronomy)
7D Lunar and Planetray Theories
Adams (Lectures on Lunar Theory)
Airy (Mathematical Tracts)
Brown (Lunar Theory)
Cheyne (Planetary Theory)
Moulton (Celestial Mechanics)
7E Figure of the Planets
Todhunter (History of the Theory of Attraction and the Figure of the Earth)
Thomson and Tait (Natural Philosopohy)
Airy (Mathematical Tracts; Figure of the Earth Enc. Metr.)
Clark and Radau (Figure of the Earth: Enc. Britt. Vols.VII and XXVII)
Pratt (Figure of the Earth)
7F Theory of Tides
Bassett (Hydrodynamics)
Darwin (Tides and Kindred Phenomena, Murray, 1898; Tides: Enc. Britt. Vols. XXIII and XXXIII; Scientific Papers, Vol I, Pt I)
 
১৯১৭ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত সময়কালে সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণাপত্রের তালিকা 
 1. Megh Nad Saha, Satyendra Nath Basu, On the influence of the finite
volume of molecules on the equation of state, Phil. Mag. 36, 199-203,
1917.
2. Satyendranath Basu, The stress-equations of equilibrium, Bull. Cal. Math.
Soc. 10, 117-121, 1919.
3. Satyendranath Basu, On the Horpolhode, Bull. Cal. Math. Soc. 11, 21-22,
1919.
4. Megh Nad Saha, Satyendra Nath Basu, On the equation of state, Phil.
Mag. 39, 456, 1920.
5. Satyendra Nath Basu, On the deduction of Rydberg’s law from the
quantum theory of spectral emission, Phil. Mag. 40, 619-627, 1920.




প্রকাশঃ জ্ঞান ও বিজ্ঞান মে ২০১৮।