Monday 31 July 2017

জ্যোতিষ কেন বিজ্ঞান নয়











Saturday 29 July 2017

বিজ্ঞান ও অবিজ্ঞান





ইউ এফ ও থেকে সেতুসদ্রম – বিজ্ঞানের মোড়কে অবিজ্ঞান
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
       মনে পড়ে এই কয়েকদিন আগে কোনো এক বিশেষ টেলিভিশন চ্যানেলে সন্ধ্যাবেলা আকাশে উড়ন্ত এক অচেনা আলোর ছবি দেখিয়ে হুলুস্থুলু ফেলে দিয়েছিল? দিনটা ছিল অক্টোবর মাসের ২৯ তারিখ। বড়বড় করে লেখা হল কলকাতার আকাশে ইউ এফ ও? অন্য অনেকের মতো আমিও জনৈক ব্যক্তির হ্যান্ডিক্যামে তোলা ছবি দেখেছিলাম। তার সঙ্গে ছিল আগে কবে কোথায় ইউ এফ ও দেখা গেছে তার ফর্দ। ছবি দেখে অবশ্য সেটা কোন বস্তুর তা বোঝার কোনো উপায় ছিল না। দু এক দিন পরে জানা গেল ওটা আসলে শুক্র গ্রহের ছবি।
       খবরের কাগজে ব্যাখ্যাটা পড়ে একটু অবাকই হয়েছিলাম, কারণ আমার ধারণা ছিল শুক্ৰ সবাই চেনেন। সূর্য আর চাঁদ ছাড়া আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হল শুক্ৰ— তাকে ইউ এফ ও বলে ভুল করাটা একটু অস্বাভাবিকই মনে হয়েছিল আমার। পরে জানলাম। এই প্রথম নয়, আগেও অনেকেই এই একই ভুলের শিকার হয়েছেন। ১৯৭৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ার গভর্নর জিমি কার্টার, যিনি পরবর্তীকালে সে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন, একই ভুল করেন। এমনকি ১৯৬৬ সালে পেনসিলভানিয়ার পুলিশের একবার ঘণ্টায় একশ মাইল বেগে গাড়িতে করে শুক্রগ্রহকে তাড়া করারও রেকর্ড আছে। হ্যান্ডিক্যামে তোলা শুক্রের ছবিকে আগেও ইউ এফ ও বলে ভুল হয়েছে। কলকাতায় ইউ এফ ও-র আপাতত এখানেই ইতি। তবে সেই চ্যানেলে ভাষ্যকারের গভীর গলায় ইউ এফ ও-র তালিকা আবৃত্তি শুনে এ বিষয়ে কিছু লেখার লোভ সামলাতে পারছি না।
       ইউ এফ ও অর্থাৎ (Unidentified Flying Object) বা অজানা উড়ন্ত বস্তু। তবে Flying Saucer বা উড়ন্ত চাকি নামটাই বোধহয় বেশি চলে। এখানে একটা পার্থক্য আছে – ইউ এফ ও নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে তারা অজানা, কিন্তু উড়ন্ত চাকি কৃত্রিম ছাড়া হওয়া সম্ভব নয়। সাধারণভাবে উড়ন্ত চাকি বলতে অন্য গ্রহের মহাকাশযানই মনে করা হয়। তবে এমন মতও পড়েছি যেখানে বলা হয়েছে পৃথিবীটা আসলে ফাঁপা, তার ভিতরে আর এক সভ্যতা অবস্থান করছে। ইউ এফ ও-গুলোকে তারাই পাঠায়। টিভিতে শুনলাম অ্যারিস্টটল নাকি ইউ এফ ও দেখেছিলেন – হবেও বা। তবে অনেক কিছুকেই মানুষ ইউ এফ ও বলে ভুল করে – তার মধ্যে শুক্র বা বৃহস্পতি গ্ৰহ, ধূমকেতু, উল্কা ইত্যাদি যেমন আছে, তেমনি আছে ঘুড়ি, বেলুন, কৃত্রিম উপগ্রহ, এরোপ্লেন, অরোরা বোরিয়ালিস বা মেরু জ্যোতি, এমন আরো অনেক কিছু। মাটির সার্চলাইটের আলো মেঘে পড়ে উড়ন্ত চাকি বলে ভুল হওয়ার নজির আছে। প্লেনের জানলায় রোদ পড়ে ইউ এফ ও মনে হয়েছে। পাখির ডানায় অস্তগামী সূর্যের আলো পড়ে বিভ্রমের সৃষ্টি হয়েছে।
       একথা মনেও করবেন না যে অ্যারিস্টটলই প্রথম ইউ এফ ও দেখেছিলেন। পঞ্চাশ হাজার আগের বছরের গুহাচিত্রে উড়ন্ত চাকি খুঁজে পেয়েছেন অনেকে। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, তখন এরিক ফন দানিকেন বলে এক ভদ্রলোকের লেখা কয়েকটি বই নিয়ে বেশ হইচই পড়েছিল। তাতে দানিকেন দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন যে কয়েক হাজার বছর আগে গ্রহান্তরের প্রাণীরা পৃথিবীতে এসেছিল। আর আমাদের পূর্বপুরুষদের উন্নত প্ৰযুক্তি দিয়ে সাহায্য করেছিল। তাদের দেখেই মানুষ দেবতার কল্পনা করেছে। প্রমাণ ? আমার সামনে দানিকেনের লেখা একটা বই খোলা আছে, তাতে দেখছি প্রাচীন ব্যাবিলনের এক মূর্তির ছবি। সে যে চাপা প্যান্টটি পড়ে আছে, তার সঙ্গে আজকের সাঁতারের পোশাকের সাদৃশ্য আছে – অতএব…  স্বীকার করছি যে বইটিতে এটিই একমাত্র প্রমাণ তা নয়, কিন্তু এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার। দানিকেন বা তাঁর মতাবলম্বীরা কেন জানিনা বিশ্বাস করেন যে পাঁচ হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা আমাদের থেকে অনেক কম বুদ্ধিমান ছিল, তারা কখনো সাঁতারের পোশাক বানাতে পারে ? সুতরাং ভিন গ্রহের প্রাণীরা নিশ্চয় চাপা প্যান্ট পরে মানুষের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। (আমি কিন্তু সেই প্ৰাণীদের পোশাকের ফ্যাশন বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।) তাই দেখে সে সময়ের শিল্পী ধারণাটা পেয়েছিলেন।
       এই মতে যাঁরা বিশ্বাস করেন, বিবর্তন সম্পর্কে যে আসলে কোনো ধারণাই নেই, তা বোঝা শক্ত নয়। প্ৰজাতির উন্নয়ন ঘটে ডারউইনের পথে হাজার হাজার প্রজন্ম ধরে, তাতে সময় লাগে লক্ষ কোটি বছর। কিন্তু প্ৰযুক্তির বিকাশ ঘটে লামার্কের পদ্ধতিতে, একটি মাত্র প্রজন্মে। বিষয়টা আর একটু স্পষ্ট করে দেখা যাক। মিউটেশন বা পরিব্যক্তির মাধ্যমে জীবের নতুন বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি হয়, কিন্তু তা কখনোই নির্দিষ্ট দিকে হয় না, পুরোপুরি র‍্যানডম। যেমন, জলচর মেরুদণ্ডী প্রাণীর স্থলচর হওয়ার জন্য ফুলকার জায়গায় প্রয়োজন হয়েছিল ফুসফুসের। কিন্তু তার জন্য লেগেছিল বহু সময়। কারণ যে পরিব্যক্তি ফুলকাকে ফুসফুসে রূপান্তরিত হতে সাহায্য করে তার সম্ভাবনা যতটা, তার ঠিক উল্টো পরিব্যক্তিরও সম্ভাবনা প্রায় ততটাই। তাহলে ফুসফুস সৃষ্টি হয়েছিল কেমন করে ? হয়েছিল, কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচন বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে প্ৰথম ধরনের পরিব্যক্তিকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু তার জন্য বহু প্ৰজন্ম অতিবাহিত হতে হয়েছিল। বিবর্তনের ইতিহাস সেই সাক্ষ্য বহন করে।
       অন্যদিকে প্রযুক্তির বিবর্তন কখনোই র‍্যানডম নয়। প্রথম এরোপ্লেন বানাতে অনেক সময় লেগেছিল, কিন্তু একবার বানানোর পর দ্বিতীয়বার আর আগের ভুলগুলির মধ্যে দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি। তাই প্রযুক্তির বিবর্তন অনেক গুণ বেশি দ্রুত। গত পাঁচ হাজার বছরে মানুষের মস্তিষ্কের বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয় নি। ব্যাবিলনের সময়কার আমার পূর্বপুরুষ আমার মতোই বা আমার থেকেও বেশি বুদ্ধি রাখতেন। হাজার হাজার বছর ধরে যা হয়েছে তা হল বিজ্ঞান ও সেই সঙ্গে প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নতি। এরোপ্লেন বা কম্পিউটার আমরা বানাতে পারি। কারণ গত কয়েক হাজার বছরের পুঞ্জিত জ্ঞান আমাদের নাগালের মধ্যে। সাঁতারের পোশাক বানানোর জন্য তার প্রয়োজন হয় না।
       এমন আরো অনেক ‘প্ৰমাণ’ বইটার পাতায় পাতায় ছড়ানো। মানুষের দেহে পোকার মাথা, ডানাওয়ালা সিংহ, তারকাখচিত পোশাক, এসব মূর্তিই নাকি ভিনগ্রহের প্রাণীর পৃথিবীতে আসার অভ্রান্ত নিদর্শন। মানতে হবে আমাদের পূর্বপুরুষদের কল্পনাশক্তি ছিল এতই কম যে সিংহের দেহে ডানা লাগানোর আগেও তাদের ডানাওয়ালা সিংহ দেখতেই হত। ঐ বইয়ের একটা ছবির ক্যাপশন হুবহু তুলে দিই। চার নম্বর ছবির পাশে লেখা আছে ‘মহান সাইরাস (৬০০ খৃঃ পূঃ) এর আদেশে নির্মিত চার ডানাওয়ালা মূর্তি। এ চিত্রে উড্ডয়ন ক্ষমতা আরোপ করা হয়েছে রাজাকে, কিন্তু সে কালের কেউ তো উড্ডীন জীব দেখে নি।” একথা সত্যি বলে বিশ্বাস করতে গেলে মেনে নিতে হবে যে পাখি, বাদুড়, ফড়িং সবই গৌতম বুদ্ধের পরে পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে। সন্দিহান পাঠক মিলিয়ে নেবেন, বইটির নাম “আমার পৃথিবী – প্রাচীন দেবতার অন্বেষণে’। অনুবাদক অজিত দত্ত, প্রকাশক লোকায়ত প্রকাশন, দ্বিতীয় সংস্করণ, প্রকাশকাল ১৯৭৭ ৷ প্ৰসঙ্গত বলে রাখি দানিকেন অনেক জায়গায় প্রমাণ জাল করেছেন বলেও ধরা পড়েছেন। তবে বই বিক্রি তাতে আটকায় নি।
       ফিরে আসি আধুনিক কালে। উড়ন্ত চাকির রূপকথার আধুনিক যুগের সূচনা হিসাবে ১৯৪৭ সালকে চিহ্নিত করা যায়। এক মার্কিন বিমান থেকে নটি থালার মতো বস্তু উড়তে দেখার ঘটনা চারিদিকে আলোড়ন ফেলেছিল। তার পর বহু লোক উড়ন্ত চাকি দেখেছেন বলে রিপোর্ট করেন, কেউ কেউ এমনকি তার আরোহীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাদের চাকিতে উঠে মঙ্গল বা শুক্র গ্রহে ঘুরে আসারও খবর আছে। তবে যখন জানা গেল যে মঙ্গল এক অতি শুষ্ক শীতল মরুভূমি আর শুক্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রায় সিসা গলে যাবে, তখন ভিনগ্রহে মধুচন্দ্রিমা যাপনের বা ছুটি কাটানোর উৎসাহে একটু ভাঁটা পড়ে।
       কেন যুক্তিবাদীরা উড়ন্ত চাকির অস্তিত্বে সন্দিহান? একটা মাত্র কারণ দেখা যাক। উড়ন্ত চাকি সংক্রান্ত প্ৰায় সব কটি ঘটনায় যে সাধারণ বর্ণনাগুলি পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল তাদের অতি দ্রুত বেগ, হঠাৎ দিক পরিবর্তন এবং নিঃশব্দ চলাফেরার ক্ষমতা। এখানেই খটকা লাগে। যেরকম জোরে চাকিরা ব্রেক করে ও দিক পাল্টায় তাতে যে কোনো বস্তু, তা যতই শক্তিশালী হোক না কেন, ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া উচিত। তকের খাতিরে যদি ধরে নিই যে উন্নততর সভ্যতার পক্ষে অত্যন্ত শক্তিশালী যান বানানো সম্ভব কিংবা তারা নিউটনের গতিসূত্রগুলিকে অগ্রাহ্য করার কায়দা জানে, তাতেও সমস্যাটার সমাধান হয়না। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে প্ৰায় সব সময়েই শোনা যায় কেমন অসাধারণ নিঃশব্দে চাকিগুলি চলাফেরা করে। আসলে আমরা সবাই জানি যে গাড়ি আওয়াজ করে না, তারা লড়ঝড়ে বিকট শব্দ করা গাড়ির থেকে অনেক ভালো। তার থেকে সহজেই মনে হয় আমাদের কান ফাটানো আওয়াজের প্লেন, হেলিকপ্টার বা রকেট থেকে নিঃশব্দ চাকি অনেকগুণ উন্নত। চাকির গতিবেগ অনেকেই বলেছেন ঘণ্টায় বারোশো কিলোমিটার থেকে তিরিশ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি (যদিও কিভাবে বেগ মাপা গেলো তা কখনোই পরিষ্কার নয়)। যদি সবচেয়ে কম বেগও ধরি, তাহলেও এত দ্রুত কোনো বস্তু বাতাসের মধ্যে দিয়ে গেলে হাওয়ার সঙ্গে ধাক্কায় যে শকওয়েভ অর্থাৎ প্রচণ্ড আলোড়ন ও শব্দ সৃষ্টি করবে: তাতে কয়েকশো গজের মধ্যে মানুষের দাঁড়িয়ে থাকা তো দূরের কথা, বাড়ি ঘর ভেঙে পড়ে যাওয়া একেবারে নিশ্চিত। এর সঙ্গে ইঞ্জিনের আওয়াজের কোনো সম্পর্ক নেই। এরকম আরো সমস্যা প্ৰায় সব প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণেই আছে। তাছাড়াও এই মহাবিশ্বের বিশালত্বকে মাথায় রাখলে পৃথিবীর মতো ছায়াপথের বাইরের দিকের কোনো গ্রহে এই অল্প সময়ের মধ্যে এত ভিনগ্রহের আগন্তুকের আনাগোনা অবাস্তব মনে হওয়া স্বাভাবিক।
       ১৯৫০ সাল নাগাদ উড়ন্ত চাকি নিয়ে উন্মাদনা শিখরে উঠেছিল। আমেরিকাসহ কয়েকটি দেশের সরকার বিজ্ঞানী ও সামরিক বাহিনীর অফিসারদের নিয়ে এবিষয়ে খতিয়ে দেখার জন্য অনুসন্ধান কমিটিও গঠন করেছিল, তাদের কোনো রিপোর্টেই ভিনগ্রহের প্রাণীদের কথা পাওয়া যায় নি। বিশ্বাসীরা অবশ্য অন্য কথা বলেন। তাদের দুরকম মত আছে। একদল বলেন যে সরকার ষড়যন্ত্র করে সব তথ্যপ্রমাণ গোপন করেছে। সমস্ত সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত। তাঁদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই যা আপনি বিবেচনা করতে পারবেন – সবই তো সরকার চেপে রেখেছে। বিজ্ঞানের যুক্তি তাঁরা শুনতে নারাজ, কাজেই সে নিয়ে আলোচনা দীর্ঘায়িত করে কোনো লাভ নেই।
       অন্য এক দল মানুষ আছেন যাঁরা শুরু করেন এই সমস্ত রিপোর্ট থেকেই। এ কথা সত্যি বিভিন্ন সময়ে যে হাজারেরও বেশি ঘটনা বিষয়ে অনুসন্ধান করা হয়েছে, তাদের মধ্যে সবগুলির ব্যাখ্যা সঠিক ভাবে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ভুল করা, দৃষ্টিবিভ্রম, অলীকদর্শন বা জালিয়াতি, এসব বাদ দিলেও শতকরা দুভাগ ঘটনা থাকে যাদের কারণ আমাদের জানা নেই। বিশ্বাসীরা বলেন যে ঐ ঘটনাগুলির একমাত্র ব্যাখ্যা হওয়া সম্ভব ভিন গ্রহের আগন্তুক। তাঁরা প্রায়ই বলেন যে অমুক বৈজ্ঞানিক বা তমুক তদন্তকারী সংস্থা এই ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন নি, সুতরাং এর পিছনে কোনো সাধারণ কারণ থাকতেই পারে না।
       আমি একথা বলছি না যে তাঁদের বক্তব্য নিঃসন্দেহে ভুল। এমন হতেও পারে যে সত্যিই কোনো একটা বিশেষ ঘটনার জন্য হয়তো ভিনগ্রহের আগন্তুকরাই দায়ী। সমস্যা হল যে এদের মধ্যে কোনো ঘটনারই পরম্পর নিরপেক্ষ কোনো প্ৰত্যক্ষদর্শী নেই। ফলে সত্যতা যাচাই করা শক্ত। কিন্তু এই প্রসঙ্গে বিজ্ঞানের একটা দিক মনে রাখতেই হবে, তা হল যুক্তিগ্রাহ্য সংশয় বা Logical Skepticism। ঘটনার কোনো সাধারণ ব্যাখ্যা এই মুহূর্তে দেয়া যাচ্ছে না বলে যে সেরকম কোনো ব্যাখ্যা হতেই পারেনা, তা নয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনেক সময়ই এত ভাসাভাসা হয় যে তার থেকে সমস্ত প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না। তাই অসাধারণ নতুন কোনো ব্যাখ্যার আগে ভাবতে হবে যে অপর কোনো অতি সাধারণ কারণ থাকতে পারে কি না। বিশ্বাসীরা প্রায়ই বলেন যে প্রমাণ করা যাবে। না যে ইউ এফ ও-টি মহাকাশযান নয়। এই ধরনের কুযুক্তিকে তৰ্কশাস্ত্ৰে বলে argumentum ad ignorantiam। কোন দাবী, এক মাত্র তা মিথ্যা প্রমাণ করা যাচ্ছে না, এই কারণেই সত্য হতে পারে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না ভিন গ্রহের প্রাণী ইউ এফ ও-র কারণ বলে প্রমাণিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত এটা মেনে নেওয়াই বাস্তবসম্মত যে তার কোনো সাধারণ ব্যাখ্যা আছে; আমরা ব্যাপারটা সম্পর্কে সমস্ত তথ্য জানিনা বলে আমরা এখনি সেটা খুঁজে পাচ্ছি না।
       এই দলের মানুষদের নিয়ে সমস্যাটা হল যে এঁরা ইউ এফ ওটি যে মহাকাশযান নয় তা প্রমাণের ভার আপনার উপরই ছেড়ে দেবেন। কিন্তু আপনি যে যুক্তিকে প্রামাণ্য মনে করবেন, তাঁরা তাকে স্বীকার করবেন না। একটা উদাহরণ নেয়া যাক। কলকাতার ইউ এফ ওটিকে আপনার প্রতিবেশী দেখেছেন। আপনি তার কাছে জেনে নিলেন। সেটি আকাশের কোন দিকে কোন কোণে কতক্ষণ ছিল । তারপর বার করে নিলেন যে সেদিন আকাশে ঐ দিকে ঐ সময়ের জন্য কোন জ্যোতিষ্ক অবস্থান করছিল। আপনি দেখলেন যে শুক্রগ্রহের সঙ্গে তা পুরোপুরি মিলে যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই আপনার মনে হল যে শুক্রকেই ইউ এফ ও বলে ভুল হয়েছে। বিশ্বাসী কিন্তু বলবেন যে, ওটি যে মহাকাশযান নয়। তার কোনো প্ৰমাণ কোথায় – সেদিন উড়ন্ত চাকি আর শুক্রগ্রহ হয়তো আপনার প্রতিবেশীর কাছে একই সরলরেখায় অবস্থান করছিল বটে, কিন্তু তিনি শুক্রকে দেখতে পান নি, উড়ন্ত চাকিই দেখেছেন। আপনি বলার চেষ্টা করলেন যে একই কোণের ব্যাপারটা অন্য জায়গা থেকে দেখলে তো সত্যি হবে না। তাহলে আর কেউ চাকিকে দেখতে পায়নি কেন ? তাদের তো আর শুক্র আর চাকিটাকে গুলিয়ে ফেলার সম্ভাবনা ছিল না । (শুক্র অনেক দূরে, আপনার শহরের সকলের কাছেই একই সময়ে সে একই কোণ উৎপন্ন করে। কিন্তু কাছের বস্তু, যেমন প্লেন বা চাকি, তার জন্য একথাটা খাটবে না।) বিশ্বাসীর বিজয়গর্বে উত্তর, কিন্তু আর কেউ তো ইউ এফ ও-টির দিকে তাকায়নি – তাকালেই তারা দেখতে পেত। কাজেই বিশ্বাসীকে মানানোর মতো প্রমাণ জোগাড় করা আপনার সাধ্যের বাইরে।
       এই দুই দলের লোকই বিজ্ঞান নয়, মূলত অবিজ্ঞান নিয়ে বেশি। উৎসাহী। বৈজ্ঞানিকের যুক্তি তাঁরা মানতে নারাজ। অপর কেউ কেউ আছেন যাঁরা এই দলদুটির কোনোটাতেই পড়ে না। অথচ উড়ন্ত চাকি নিয়ে মাতামাতিতে অগ্রগণ্য। একটু ভাল ভাবে দেখলেই বোঝা যায় তাদের স্বার্থ। উড়ন্ত চাকি, বারমুডা ট্র্যাঙ্গলের তথাকথিত রহস্য বা হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিস নিয়ে বই বাজারে চলে ভালো, তার সুযোগ তাঁরা নিতে চান। The Flying Saucers Have Landed নামের একটি বই একসময় খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর লেখকদ্বয় তো চাঁদের পিছন দিকে, যে দিকটা আমরা দেখতে পাইনা সেদিকে, বিরাট শহর দেখেছিলেন; শুক্র গ্রহের অধিবাসীর সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। (তখনো পর্যন্ত আমাদের জানা ছিল না যে শুক্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্ৰায় পাঁচশো ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড)। বিশ্বাসীরা সেই ধরনের বই লক্ষ লক্ষ কিনেছেন। একা দানিকেনেরই বই বিক্রি হয়েছে সাড়ে তিন কোটির বেশি। লাভ করা হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
       কেন এত মানুষ ভিনগ্রহের প্রাণীর পৃথিবীতে আসার কথায় বিশ্বাস করতে চান ? আকাশে ইউ এফ ও দেখলে দৈনন্দিন জীবনে কি সুবিধা হবে যার জন্য সাধারণ অফিসের বা দোকানের কর্মচারী থেকে কখনো কখনো বিশিষ্ট বিজ্ঞানী পর্যন্ত এই চাকি-ম্যানিয়াতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন ? মনস্তত্ত্ববিদ মাইকেল শেরামার একটা ভারি উল্লেখযোগ্য কথা বলেছেন। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের আয়তন এত বিশাল যে কল্পনা করা যায় না। আমাদের তৈরি মহাকাশযান ভয়েজার ঘণ্টায় ষাট হাজার কিলোমিটার বেগে যাচ্ছে। সবচেয়ে কাছের তারা প্রক্সিমা সেন্টরাই-এর সমান দূরত্ব অতিক্রম করতে তার সময় লাগবে পঁচাত্তর হাজার বছরেরও বেশি। সবচেয়ে কাছের তারায় যেতে যদি এত সময় লাগে, তাহলে তারাদের মধ্যে সশরীরে যোগাযোগ করা কত কঠিন বুঝতেই পারছেন। মনে রাখতে হবে যে সব তারার গ্রহ আছে এমন নয়। আবার গ্রহ থাকলেই প্ৰাণ তৈরি হবে কি না। আমরা জানি না, উন্নত সভ্যতার কথা ছেড়ে দিন। বস্তুত পৃথিবীর বাইরে প্রাণ আছে কিনা সে বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। খুব উন্নত সভ্যতা ছাড়া এই বিশাল বিশাল দূরত্ব অতিক্রম করে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। তাই যে প্রাণীরা আমাদের পৃথিবীতে এসে যোগাযোগ করবে তারা আমাদের থেকে হয়তো লক্ষ বছর এগিয়ে থাকবে। আগেই বলেছি বিজ্ঞান প্রযুক্তি লামর্কের পথ অনুসরণ করে অর্থাৎ তার অগ্রগতির হার ক্রমশই বেড়ে চলে। সেকারণে গরুর গাড়ি থেকে এরোপ্লেন বানাতে সময় লেগেছে দশ হাজার বছর আর সেখান থেকে মানুষ চাঁদে পৌঁছেছে মাত্র ছেষট্টি বছরে। তাই লক্ষ বছর পরে বিজ্ঞান প্রযুক্তি কোথায় পেঁৗছোবে কল্পনা করাও সম্ভব নয়। দেবতাদের আমরা সাধারণত সর্বজ্ঞ বা সর্বশক্তিমান ভাবতে অভ্যস্ত। সেই উন্নত সভ্যতার প্রাণীরা আমাদের কাছে কিন্তু দেবতাদের মতোই মনে হবে।
       ১৯৫০ এর দশকে দুই মহাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন আরো বড় নিউক্লিয়ার বোমা বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু করেছিল। তখন সাধারণ মানুষের মনে হত যে অল্প দিনের মধ্যেই যুদ্ধ বাঁধবে। আর তাতে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। এরকম বিপদ থেকে বাঁচতে আগে মানুষ দেবতার শরণাপন্ন হত। কিন্তু পশ্চিম দেশে বিজ্ঞানপ্রযুক্তির চমকপ্ৰদ অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম মানুষের মন থেকে পিছু হটেছে। তাই অনেকের কাছে আধুনিক যুগের নতুন দেবতার স্থান নিয়েছিল অন্য গ্রহের উন্নত প্ৰাণী যে প্রাচীন কল্পনার দেবতার মতই শক্তিশালী। সে জন্যই ১৯৫০-এর দশকে উড়ন্ত চাকি নিয়ে মাতামাতি হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি। এখনো কিন্তু দূষণ বা বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিপদ থেকে বাঁচতে কিছু মানুষ ইউ এফ ও-র দিকে তাকিয়ে আছে।
       আমাদের দেশে কিন্তু চাকি-ম্যানিয়া কখনোই বিদেশের, বিশেষ করে আমেরিকার পর্যায়ে পৌছোয়নি। আমার মনে হয় তার একটা হল এশিয়ার প্রাচ্য দেশগুলি আধুনিক বিজ্ঞানপ্ৰযুক্তির জগতে অনেকটাই পিছিয়ে। আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের দেশে আমদানি করা বস্তু, তার জন্ম এদেশে হয়নি। তাই বিজ্ঞান পড়লেও আমাদের মানসিকতা এখনো তাকে আত্মস্থ করতে পারেনি, বরঞ্চ অনেক সময়েই হয়েছে বদহজম। তাই পশ্চিমের দেশগুলির মতো ধর্ম এখানে অতটা পিছিয়ে যায় নি, কখনো কখনো সে অনেক আক্রমণাত্মক । তাই আমরা এখনো আমাদের বহুদিনের পরিচিত দেবদেবী, গুরুফকিরদের উপরই ভরসা করি, মঙ্গলগ্রহ বা সিরিয়াস নক্ষত্রের সর্বশক্তিমান সবুজ মানুষদের প্রয়োজন আমরা এখনো অনুভব করিনি।
       তা বলে কিন্তু গণ-হিস্টেরিয়াতে আমরাও কম যাই না। মনে পড়ে সারা দেশে গণেশের মূর্তির দুধ খাওয়ার কথা ? সেখানেও কিন্তু বিজ্ঞানী থেকে সাধারণ মানুষ অনেকেই ঘটনার পরে পত্রপত্রিকায় বা টিভি চ্যানেলে পদার্থবিদ্যার নিয়ম দিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা করেছিলেন। কিন্তু তার কয়েক বছরের মধ্যেই আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। বোঝা গেল বিজ্ঞান আমাদের কাছে বইয়ে পড়ার জিনিস, জীবনে প্রয়োগের নয়। আমরা যে বিজ্ঞান গবেষণাতে পৃথিবীতে ক্রমশই পিছিয়ে যাচ্ছি তাতে আর আশ্চর্য কি ?
       ঠিক যেমন চাকি-ম্যানিয়াকে পুঁজি করে বিদেশে বহু লোক অর্থ উপার্জন করে, আমাদের দেশেও সে রকম লোকের অভাব নেই। প্রয়োজনে তারা বিজ্ঞানকে বিকৃত করতেও পিছপা হয় না। একটা সাম্প্রতিক ঘটনার কথা মনে পড়ছে। ২০০২ সালের অক্টোবর মাসে কয়েকটি আগ্রাসী হিন্দুত্ব প্রচারক সংবাদমাধ্যম ও এন আর আই ওয়েব সাইটে হঠাৎ বলা হল যে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা (NASA) মহাকাশ থেকে করা সার্ভেতে ভারত ও শ্ৰীলঙ্কার মধ্যের পক প্রণালীতে সমুদ্রের তলায় এক প্রাচীন সেতুর চিহ্ন খুঁজে পেয়েছে। তার বয়স নাকি কার্বন ডেটিং করে পাওয়া গেছে সতের লক্ষ বছর। নাসা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই এরকম কোনো খবরকে অস্বীকার করে। কিন্তু তাতে কী ? মৌলবাদী হিন্দু সংগঠনগুলি একেই রামায়ণে লেখা শ্ৰীীরামচন্দ্র নির্মিত লঙ্কা ও ভারতের মধ্যে সেতু বলে চিহ্নিত করে ও শ্রীরামচন্দ্রের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে প্রচার করতে শুরু করে।
       ২০০২ সালে কেন্দ্রে ছিল ভারতীয় জনতা পাটি নেতৃত্বাধীন এন ডি এ সরকার। তারাই শুরু করেছিল সেতুসমুদ্রম প্রকল্প যেখানে পক প্রণালীতে জাহাজ চলাচলের জন্য সমুদ্রে একটি চ্যানেল খোঁড়ার পরিকল্পনা ছিল। এপর্যন্ত কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ কেন্দ্ৰে ছিল হিন্দুত্ববাদী দল নিয়ন্ত্রিত সরকার। কিন্তু ২০০৪ সালে সরকার পরিবর্তন হয়। এর পর রাষ্ট্ৰীয় স্বয়ংসেবক সংঘের মতো হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির ঘুম ভাঙে। ২০০৭ সালে তারা হঠাৎ আবিষ্কার করে যে সেতুসমুদ্রম প্রকল্পে রামচন্দ্র নির্মিত সেতু ভেঙে ফেলা হবে।
       ভারতের প্রাচীন ঐতিহ্যের উপর এ এক চরম আঘাত। শুরু হয়ে গেল আন্দোলন। যোগ দিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের অনেকে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ডঃ পুনীশ তানেজা নামের এক বিজ্ঞানীকে হাজির করল। যিনি বললেন যে তাঁর গবেষণাতে প্ৰমাণ হয়ে গেছে। যে ঐ সেতু আসলে মানুষের তৈরি এবং তার বয়স সতের লক্ষ পঞ্চাশ হাজার বছর। পরে জানা গেল। ঐ তথাকথিত বিজ্ঞানী আসলে এক জালিয়াত। তারপরে সুপ্রিম কোর্টেও এই প্রকল্প নিয়ে মামলা হয়। বাকি ইতিহাস হয়তো সকলের জানা, এই লেখাতে তার আর প্ৰয়োজন নেই।
       কিভাবে নিজেদের স্বাৰ্থ চরিতার্থ করতে বিজ্ঞানকে বিকৃত করা হয়। তার আদর্শ উদাহরণ হতে পারে এই ঘটনাক্ৰম। মার্কিন মহাকাশ সংস্থার নাম দেওয়া হল যাতে বিশ্বাসযোগ্যভাবে হিন্দুধর্মের মহিমা প্রচার করা সম্ভব হয়। পুরো প্রচারটার মধ্যে জালিয়াতি লক্ষ্য করার মতো। কোনো ঐতিহাসিকই ভারতে আর্য সভ্যতাকে সিন্ধু সভ্যতার থেকে প্রাচীন বলে মনে করেন না। সিন্ধু সভ্যতার বয়স ছ হাজার বছর। রামায়ণের ঘটনার সময়কালতো তার থেকে পুরোনো হতে পারে না। তাহলে সতের লক্ষ বছরের কথা আসছে। কোথা থেকে ? আসলে রামচন্দ্রের যুগ হল পৌরাণিক ত্রেতা যুগ। পুরাণের হিসাবে ধরলে সেটা ঐ সময়ই দাঁড়ায়। রামায়ণের ঘটনায় কিছুটা ঐতিহাসিক উপাদান নিশ্চয় আছে, তবে সে জন্য তাকে ইতিহাস ভেবে নিলে মুশকিল। কিন্তু কোনো মৌলবাদী সংগঠন তো আর ধর্মগ্রন্থের সত্যাসত্য বিচার করতে পারে না, তার কাছে প্রতিটি লাইনই একেবারে ধ্রুব সত্য। তাই ভুলে যান যে ভারতে কেন, সারা পৃথিবীতে পনের থেকে কুড়ি হাজার বছরের চেয়ে পুরোনো কোনো বড় জনবসতির নিদর্শন পাওয়া যায় নি। মনেও রাখবেন না যে ঐ সময় নাগাদ তুষার যুগ শেষ হয় ও কৃষিকাজ আবিষ্কার হয়, আর কৃষির আগে কোনো ভাবেই নগরপত্তন সম্ভব নয়। মেনে নিন ধর্মগ্রন্থে যা লেখা আছে তা অক্ষরে অক্ষরে সঠিক।
       এখানেই শেষ নয়। কার্বন ডেটিং করে বয়স পাওয়া গেছে বললে বক্তব্যটা বেশ শক্তিশালী হয়। দেখা যাক এখানে জালিয়াতিটা কি রকম। কোনো প্ৰাণী বা উদ্ভিদ মারা যাওয়ার পর তার দেহাবশেষের কার্বন ডেটিং করা সম্ভব, অজৈব পদার্থের নয়। পাথর সাধারণভাবে অজৈব। পাথর তৈরির সময় তাতে কোনো জৈব পদার্থ মিশে গিয়ে থাকলে তবেই তার বয়স বার করে পাথরের বয়স নির্ণয় সম্ভব। রামায়ণের গল্প অনুযায়ী অন্য জায়গা থেকে পাথর এনে সেতু বানানো হয়েছিল। সেতুর বয়স পাওয়া যাবে কোথা থেকে ? তাছাড়া এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে বেশি বয়স মাপা যায় বড়জোর পঞ্চাশ থেকে ষাট হাজার বছর, তার বেশি হলে এই পদ্ধতি কাজ করে না। সবচেয়ে বড় কথা কার্বন ডেটিং-এর জন্য পদার্থ থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তা মাপতে হয় বা তার ভরের বর্ণালী বিশ্লেষণ (mass spectroscopy) করতে হয়, মহাকাশ থেকে যা কখনোই সম্ভব নয়।
       এই কথাগুলো আজকাল অনেক সময় বিদ্যালয় স্তরের বইতে পাওয়া যায়, তাই একথা ভাবা শক্ত যে আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের কেউ একথা জানতেন না। আসলে তাদের প্রয়োজন কোনো একটা ইস্যু যা মানুষকে নাড়া দেবে। তা করতে গিয়ে যদি আধুনিক বিজ্ঞানের অপপ্রয়োগ হয়, তাতে অসুবিধা নেই। রাজনৈতিক স্বার্থে এমন উদাহরণ যে আমাদের দেশে সীমাবদ্ধ তা নয়। জার্মানিতে হিটলারের আমলে বিজ্ঞানসম্মত ভাবে প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল যে ইহুদিরা আর্যদের থেকে পৃথক ও অনুন্নত প্ৰজাতি। আমেরিকাতে দাস প্রথাকে একই ভাবে সমর্থন করার চেষ্টা করা হয়েছিল।
       উড়ন্ত চাকি হল আধুনিক যুগের কুসংস্কার – অবিজ্ঞান সেখানে বিজ্ঞানের পোশাকে উপস্থিত। গণেশের দুধ খাওয়ার সঙ্গে তার মূলগত কোনো পার্থক্য নেই। অপর দিকে আধুনিক বিজ্ঞানের যে সম্মান প্রতিপত্তি তাকে ব্যবহার করে বিজ্ঞানের নামে এক অবৈজ্ঞানিক তত্ত্বকে হাজির করার উদাহরণ হল ঐ রাম সেতু নিয়ে আন্দোলন। একটা কথা বলে নেয়া ভাল। সেতুসমুদ্রম প্রকল্প নিয়ে অনেক পরিবেশবাদীর আপত্তি আছে – সে বিষয়ে কোনো আলোচনা বর্তমান নিবন্ধে করা হয়নি। সে দিকে অবশ্যই দৃষ্টিপাত করা উচিত। কিন্তু তার সঙ্গে পৌরাণিক যুগকে যুক্ত করার কোনো ভিত্তি নেই। প্রয়োজন বৈজ্ঞানিক মানসিকতা, যুক্তি দিয়ে বিচার করার ক্ষমতা।

(এখন পর্যাবরণ: পঞ্চম বর্ষ ২য় সংখ্যা, ২০০৮, পরিমাৰ্জিত)














Thursday 27 July 2017

আইনস্টাইনের দর্শনচিন্তা






























Friday 21 July 2017

বিজ্ঞান, ইতিহাস ও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র




























Saturday 15 July 2017

জল সংরক্ষণ



 আয় বৃষ্টি ঝেঁপে
শম্পা গাঙ্গুলী

      টিভিতে একটা বিজ্ঞাপন একসময় চোখে পড়ত- একটি লোক ছাতা উল্টে বৃষ্টির জল ধরে আনছে। বিজ্ঞাপনটির অর্থ পরিষ্কার- বৃষ্টির জল সঞ্চয়।একটু গভীর করে ভাবলে এর দুটো মানে দাঁড়ায়। অন্যান্য জলসম্ভার খরচে যতটা সম্ভব মিতব্যয়ী হয়ে তাকে রোজকার নানা কাজে ব্যবহার করা।অন্যদিকে, এই জলকে শোধন করে ভূগর্ভে ফিরিয়ে দিয়ে মাটির তলায় জলসম্ভারের পুনঃসঞ্চার(Recharge) ঘটানো।পরিভাষায় একেই  Rain Water Harvesting বলে।
      পৃথিবীর অস্তিত্ব যতদিন আছে, বৃষ্টিপাত ও জলের জোগান ততদিন অক্ষুণ্ণ থাকবে। অফুরন্ত এই সম্পদ।তবে কেন এই সঞ্চয়ের দরকার? আবার পৃথিবীর তিনভাগই তো জল। কিন্তু যে বিপুল জলরাশি পৃথিবীকে ঘিরে রেখেছে তার বেশিটাই যে নোনা সমুদ্র। সেই জল পানের বা অন্যান্য কাজের উপযুক্ত নয়। আমরা যে জল নানা কাজে ব্যবহার করি তার সবটাই আসে বৃষ্টি বা তুষারপাত থেকে। সমুদ্র থেকে বাষ্পীভূত হয়ে পুনরায় ঘনীভবনের মাধ্যমে বৃষ্টির জল সৃষ্টি হয় বলে তা বিশুদ্ধ ধরে নেওয়া হয়। তাই এই জল সঞ্চয় করা দরকার। বৃষ্টির খানিকটা মাটির ওপর দিয়ে বয়ে যায়, কিছুটা নদীর মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।প্রবল বর্ষণে অনেক সময় মাটির ওপরের আস্তরণ ধুয়ে গিয়ে নদীতে পড়ে। ফলে একদিকে ক্ষয়ের ফলে মাটি অনুর্বর হয়ে চাষবাসের ক্ষতি করে বা পাহাড়ি অঞ্চলে ধস-ভূমিকম্প ঘটায়; আবার অন্যদিকে নদীকে অগভীর করে তুলে বন্যা বাড়ায়। তাই অঝোর এই বৃষ্টিপাতের সুনিয়ন্ত্রিত ও সুষম বণ্টন প্রয়োজন। মাটির ওপর দিয়ে যাবার সময় বৃষ্টির জলের বাকি অংশটুকু চলে যায় মাটির নিচে। মাটির ঠিক নিচেই যে অসম্পৃক্ত স্তর আছে তা জলকে ধরে রাখতে পারে না।ফলে জল আরও নিচে নেমে যায়। অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে কিছুটা জল সেখানে থাকে। তাকে সবিরাম সম্পৃক্ত স্তর বলে।
      তার তলায় আছে স্থায়ী সম্পৃক্ত স্তর। এখানেই স্থায়ী ভৌমজল(Ground Water) থাকে। সাধারণত ২৩০০ ফুট নিচে এই জলতলের সন্ধান মেলে। এর তলার শিলায় কাদার ভাগ এত বেশি যে জল আর নিচে নামতে পারে না। আমরা জলসেচ, গৃহস্থালিতে, কলকারখানায়, বাড়ি তৈরির কাজে সবচেয়ে বেশি এই মাটির নিচের জলকেই গভীর ও অগভীর নলকূপ, পাতকুয়োর মাধ্যমে তুলে প্রয়োজন মেটাই। মনে হতে পারে- আবার বৃষ্টি হলেই তো খরচ হওয়া জলের পরিপূরণ ঘটবে। কিছুটা হয়ও তাই। কিন্তু তবুও আজ আমরা সবাই সুপেয় জল নিয়ে চিন্তিত। তার কারণ মাত্রাতিরিক্ত ভাবে মাটির নিচের জলকে টেনে তোলার ফলে অমৃত সমান এই জল ক্রমেই নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে ও গরল উঠে আসছে। ফলস্বরূপ ঘটছে জলদূষণ। শিল্প-কলকারখানার বর্জ্য বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ যেমন ক্যাডমিয়াম, সিসা, পারদ ও তেজস্ক্রিয় বর্জ্য পদার্থ নদীতে ও সমুদ্রে মিশছে। পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ, তা ভূগর্ভে বা সমুদ্রগর্ভে যেখানেই হোক না কেন, সেখানকার জলকে দূষিত করে তার গুণগত মানের অবনতি ঘটাচ্ছে। জলবাহী বিষাক্ত পদার্থগুলো ঢুকছে প্রাণীদেহে ও মানুষের শরীরে। এর মারাত্মক প্রভাবে পরিবেশ দিনে দিনে তার ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে। যত্রতত্র কূপ, নলকূপ খুঁড়ে পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। দুরারোগ্য রোগের কারণ ঘটাচ্ছে। ভারতের মধ্যপ্রদেশ, বিহার, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গে নানা জেলায় ও বাংলাদেশের অনেক জায়গায় আর্সেনিক সমস্যা আজ এক ভয়াবহ আকার নিচ্ছে।
      এই ভৌমজল আহরণে আরও কিছু অসুবিধা আছে। ভৌমজলের প্রধান উৎস বৃষ্টির জল। সুতরাং ভৌমজলের সম্ভার নির্ভর করে বৃষ্টির স্থায়িত্ব, পরিমাণ, শিলার প্রবেশ্যতা, ভূমির ঢাল ও প্রবেশ্য শিলার তলায় অপ্রবেশ্য শিলার উপস্থিতির ওপর। পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমির ঢাল বেশি বলে বৃষ্টির জল বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারে না, ফলে ভূগর্ভে খুব কম জল প্রবেশ করে। জম্বু-কাশ্মীরে মাটির নিচের জলতল বছরে ২০ সে মি করে নেমে যাচ্ছে। মরু অঞ্চলে শিলার প্রবেশ্যতা খুব বেশি বলে গরমকালে, বিশেষত গ্রামগুলির চিত্র করুণ। বহুদূরের কোনো গভীর কূপ বা জলাধার থেকে মেয়েদের মাথায় আট-দশটা ঘড়া করে পরিবারের এক সপ্তাহের জল বয়ে আনতে হয়। শহরেও, গভীর নলকূপে মোটর চালিত পাম্প লাগিয়ে বিদ্যুতের অনেক দাম মিটিয়ে তবে জল মেলে। দিল্লী, জয়সলমীর, জয়পুর, জলন্ধরে গরমকালে এ ছবি আমরা পাই। বর্ষার চিত্রটাও আমাদের অপরিচিত নয়। আধঘণ্টা ভারি বর্ষণেই কলকাতা, মুম্বাই, দিল্লি -- এমনকি খরাপ্রবণ রাজস্থানের শহরও হাঁটু জলে ডুবে যায়। কারণ চারদিকের ইট-কাঠ-কংক্রিটের বাঁধুনি, দ্রুত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের প্রবল জোয়ার  ভাসায় শহরতলিকে। সুতরাং মাটির নিচে জলের নামার পথে no entry থাকায় ভূগর্ভের জলসম্ভার বিশেষ লাভবান হয় না। ঘাটতি পূরণ হয় সামান্য -- লাভবান হয় জমা জলে মশার বংশধরেরা।
      বস্তুতপক্ষে সমস্যা আরও অনেক। ভারতের মতো মৌসুমি জলবায়ুর দেশে আঞ্চলিক বৃষ্টির তারতম্যে বছরে কোথাও ১২০০ সেমি আবার কোথাও ২৫ সেমি বৃষ্টি হয়। তাই অতিবর্ষণযুক্ত অঞ্চলকে বন্যা আর মরু অঞ্চলকে খরার হাত থেকে বাঁচাতে হলে কোথাও অবাধ বারিধারাকে আবার কোথাও কয়েক ফোঁটা জলকে ধরে রাখতে হবে। অনিয়মিত বর্ষা এবং অত্যধিক জনসংখ্যাবৃদ্ধি তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় যতই জলসংকট তৈরি করতে চাক না কেন, সঞ্চিত জলসম্ভার দিয়ে বছরে একাধিকবার অনেক খাদ্যশস্য ফলিয়ে সবাই অন্তত খেয়ে পরে বাঁচতে পারবে। এছাড়া এত সব সমস্যার সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো পরিবেশ দূষণ পৃথিবীকে গরম করে তুলছে। বৃষ্টির পরিমাণ অনেক জায়গায় কমছে, তার আগমন ও স্থায়িত্বকালও অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। পর্বতচূড়ার বরফ গলে কমে যাচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন নদীতে জলস্ফীতি ঘটছে তেমন অন্যদিকে নিত্যবহ নদীগুলোতে ক্রমে উৎস-জলের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, বরাক ইত্যাদি বরফগলা জলে পুষ্ট নদীগুলো অনিত্যবহ হয়ে পড়ছে।
      নদীর জলবন্টন নিয়ে আন্তঃরাজ্য সমস্যা (কাবেরীর জল নিয়ে কর্ণাটক ও তামিলনাডুর মধ্যে), আন্তঃদেশীয় সমস্যা (গঙ্গা ও তিস্তা নিয়ে ভারত বাংলাদেশের মধ্যে) আজ পৃথিবীর অনেক দেশের এক কঠিন সমস্যা। আমাদের দেশে জনপ্রতি জলের ব্যবহার আগে ছিল বছরে ৫০০০ ঘনমিটার, যা এখন জলসংকটের ফলে নেমে এসেছে ২২০০ ঘনমিটার। সারা পৃথিবীর গড় পরিসংখ্যানটি হল ৮৫০০ ঘনমিটার। সবথেকে বড়ো কথা হল মাটির নিচ বা নদী, হ্রদ- যেখান থেকেই জল সংগ্রহ করি না কেন, তা কমবেশি ব্যয়সাপেক্ষ। পাম্প, নলকূপ, কূপ, জলাধার, খাল ইত্যাদি তৈরির প্রাথমিক ও পৌনঃপুনিক খরচও যথেষ্ট। আবার সেই জল কমবেশি দূষিত তো বটেই। তাই বৃষ্টির জল ভূগর্ভে যাবার বা নদীনালায় নামার আগেই তাকে যদি আমরা প্রতিটি বাড়িতে বিভিন্ন উপায়ে সরাসরি সঞ্চয় করে রাখতে পারি তাহলে অনেক সমস্যা তৈরি হওয়ার আগেই তার সমাধান হয়ে যায়। বিশাল ও দীর্ঘকালীন পঞ্চবার্ষিকী নদী পরিকল্পনা করে সরকারের কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয়ও হয় না, আর আমরাও বিষপান করে তিলে তিলে মরি না। অদূর ভবিষ্যতে আমেরিকার একটা কোম্পানি বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য ভারতের মধ্য পশ্চিমাঞ্চলের জলসম্ভারকে কাজে লাগিয়ে এক বিশাল জলপ্রকল্প রূপায়ণের অনুমোদন পেতে চলেছে। অর্থাৎ আমাদের দেশের জলকেই বিদেশি লগ্নিকারীদের মাধ্যমে বোতলবন্দি করে চড়া দামে আবার আমাদের বিক্রি করা হবে। বুঝুন অবস্থাটা!
      অমূল্য এই বৃষ্টির জল ধরে রাখার নানান উপায় মানুষ প্রাচীন কাল থেকেই উদ্ভাবন করে এসেছে। আজ থেকে প্রায় দু হাজার বছর আগে ইজরায়েলের নেজেভ মরুভূমিতে, মালয়েশিয়া, থাইল্যাণ্ড ও চিনের লোয়েস মালভূমিতে মানুষ বড়ো বড়ো জালায় বৃষ্টির জল সঞ্চয় করতে শিখেছিল। প্রাচীন রোম শহর এমন সুপরিকল্পিত ভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে সঞ্চিত বৃষ্টির জল দিয়ে তারা পানীয় জলের চাহিদা মেটাত ও ঘরবাড়ি ঠাণ্ডা রাখতে পারত। আন্দিজ পর্বতের বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চলে, আলাস্কা ও হাওয়াই দ্বীপে একই পদ্ধতিতে বৃষ্টির সুব্যবহার মানুষ করেছে। ১৯২০ সাল পর্যন্ত আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের গ্রামগুলোতে ও ৬৫ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়া প্রদেশে চ্যাপ্টা বড়ো বড়ো গ্যালভানাইজড লোহার পাত কাঠের কাঠামোতে লাগিয়ে বৃষ্টির জল ধরে রাখার কথা জানা যায়।
      তবে বিজ্ঞানের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে বৃষ্টির জল সঞ্চয় ও শোধন পদ্ধতি। এই সমস্যা নিয়ে সচেতনতা যত বাড়ছে সমাধান করতে দিনে দিনে তত বেশি সংখ্যক মানুষ আগ্রহী হচ্ছে। কতকগুলো সহজ উপকরণের সাহায্যে সহজ পদ্ধতিতে নিজ নিজ সাধ্যের মধ্যেই বাড়ির আশপাশের বৃষ্টির জল ধরে রাখা যায়। যথেষ্ট স্বাস্থ্যসম্মতভাবে পরিবারের জলসংকট এতে মেটানো সম্ভব। প্রধানত তিনটে উপকরণ এক্ষেত্রে দরকার। সেগুলো হল- জল সংগ্রহের ক্ষেত্র(Catchment Area), সংগ্রহের আধার (Collecting Device) এবং পরিবহন বা সংবহনের পদ্ধতি(Conveyance System)।
      জলসংগ্রহের ক্ষেত্র হিসেবে বাড়ির ছাদকে (অন্তত ২০ বর্গমিটার) সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করতে পারি। কী পরিমাণ ও কতটা বিশুদ্ধ জল পাওয়া যাবে সেটা নির্ভর করে ছাদটা কত বড়ো ও ছাদ তৈরির পদ্ধতির ওপর। ছাদ কংক্রিট সিমেন্ট, টিন, এলুমিনিয়াম সিট, এসবেস্টস, টালি বা বাঁশের তৈরি হতে পারে। যত বেশি ঢাল হবে তত দ্রুত প্রবাহ হবে। তবে ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে। ছাদ ছাড়া বৃষ্টির জল সংগ্রহের ক্ষেত্র হিসাবে বাড়ির চারপাশের জমিকে ব্যবহার করা যেতে পারে। আশপাশের অসংখ্য ফাটল ও অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে প্রচুর জল মাটির নিচে চলে যায়। গাছপালা ও মাটির আবরণ থাকলে জমির ওপরের জলপ্রবাহ কমে যায়।এজন্য বাড়ির চারপাশের এলাকা যেমন রাস্তা, বাগান, চাতাল ইত্যাদিকে কংক্রিটে ঢালাই করে একদিকে ঢালযুক্ত শক্ত কঠিন আবরণে পরিণত করে তোলা যায়। মৃত্তিকার স্তরে বৃষ্টির জলের প্রবেশ্যতা রোধ করতে রোলার ব্যবহার মাটিকে সুদৃঢ় ও আঁটোসাঁটো করতে পারি। এছাড়া রাসায়নিক ভাবে সোডিয়াম বা সিলিকন যৌগের দ্রবণ ব্যবহার করা যেতে পারে বা প্লাস্টিকের সিট, এসফল্ট বা টালি দিয়ে আশপাশ আবৃত করা যায়। কৃত্রিম পদ্ধতিতে বাষ্পীভবন কমিয়ে ও মৃত্তিকাক্ষয় রোধ করে অনেক বেশি পরিমাণ পরিষ্কার জলসংগ্রহের ক্ষেত্র গড়ে তোলা যায়।
      জল সংগ্রহের আধার বা জলাধার হিসেবে বড়ো বড়ো ট্যাঙ্ক মাটির নিচে বা ওপরে তৈরি করা যায়। তবে মানুষ, পশুপাখি বা পরিবেশের বিভিন্ন বর্জ্য পদার্থ যাতে জলাধারে না যায় তার জন্য ভালো আঁটযুক্ত ঢাকনা ব্যবহার করতে হবে। এতে জমা পরিষ্কার জলে মশা বা শ্যাওলা জন্মানো রোধ করা যাবে। বড়ো বড়ো ঢালাই করা সিমেন্টের জলাধার হলে ভালো। জলাধারের আয়তন নির্ভর করবে শুষ্ক ঋতুর দৈর্ঘ্য, বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং জনপ্রতি জলের চাহিদার ওপরে। এশিয়ার বেশিরভাগ দেশে বেশ কয়েকমাস শুষ্ক ঋতু থাকে, বৃষ্টি তিন চারমাস হয়। এক্ষেত্রে এক একটি জলাধারের ক্ষমতা এমন হওয়া উচিৎ যাতে অন্তত দু-তিন সপ্তাহের জল মজুত থাকে। ধরা যাক তিনজনের পরিবারে ন্যূনতম ৩(জন)X৯০(লি)X২০(দিন)=৫৪০০লিটার জল সঞ্চয় করা প্রয়োজন। পাইপ দিয়ে পরস্পর যুক্ত একাধিক পলিথিনের জলাধার (ধারণ ক্ষমতা কমপক্ষে ১০০০-২০০০ লিটার) ব্যবহারও সুবিধাজনক। থাইল্যান্ডে ১৯৮০-এর দশকে দশ লক্ষের বেশি ২০০০ লিটারের জার ও ১৯৯১-৯৩ সালের মধ্যে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার আরও বড়ো জলাধার তৈরি করা হয়।
      জলসংবহন পদ্ধতি বলতে জলসংগ্রহের ক্ষেত্র থেকে বৃষ্টির জলকে জলাধারে পাঠানোর পর্যায়টিকে বোঝায়। বৃষ্টি পড়ার প্রথম কিছুক্ষণ পর্যন্ত নোংরা ও বালি-কাঁকড় যুক্ত বৃষ্টির জল যাতে বেরিয়ে যায় সেই ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। জলাধারের সঙ্গে ছাদ বা অন্যান্য জলসঞ্চয়ের ক্ষেত্র হিসাবে যে পাইপ দিয়ে যুক্ত থাকে সেখানে একটা কল লাগানো থাকবে। বৃষ্টি শুরু হওয়ার সময় কলটি বন্ধ থাকলে নোংরা জল জলাধারে ঢুকবে না, কিছুক্ষণ পরে বৃষ্টির পরিমাণ বাড়লে কলটা খুলে দিলে জলাধারের ভেতরে পরিষ্কার জলসঞ্চয় ঘটবে।এছাড়া আরও অন্য পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়। ছাদের সঙ্গে জলাধার সংযোগকারী মোটা মোটা PVC পাইপগুলোর মধ্যে বড়োমুখওয়ালা ফানেল আটকে দিতে হবে এমনভাবে যে প্রথম বৃষ্টির জল ধীরে ধীরে পাইপের গা বেয়ে ফানেল ও পাইপের মধ্যের ফাঁক দিয়ে নেমে বেরিয়ে যাবে। পরে প্রবল বর্ষণের সময় পরিষ্কার জল ফানেলের মধ্য দিয়ে জলাধারে প্রবেশ করবে। এই ফানেল লাগানো পাইপটির মুখ জলাধারের সংযোগকারী পাইপের মুখ অপেক্ষা বড়ো হবে যাতে জলাধার ভর্তি হয়ে গেলে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যেতে পারে। সংবহনের সময় PVC পাইপগুলোর মধ্যেই জলশোধন বিভিন্ন ভাবে করা যেতে পারে। পাইপের একটা অংশে জলাধারে জলপ্রবেশের আগে এই শোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সবচেয়ে উপরে থাকবে মোটা দানার বালির স্তর(৫-১০মিমি পুরু), তার তলায় ছোটো নুড়ি ও তার তলায় বড়ো নুড়ি পাথরের স্তর(৫-২৫ সেমি পুরু), এটাতে খরচ খুবই কম। বালির বদলে কাঠকয়লা দিয়েও জলশোধন করে নেওয়া যায়। এইভাবে জলের ঘোলাটে ভাব, নোংরা ও জীবাণু ইত্যাদি রোধ করা যায়। তবে জলকে পুরোপুরি বিশুদ্ধ করতে গেলে বিদেশি কোম্পানির তৈরি RPC(Rain Purification Centre) কিনতে হবে যা খরচ সাপেক্ষ। এক্ষেত্রে Multi Staged Water Treatment Method-এ আয়ন বিনিময় প্রক্রিয়ার দ্বারা বৃষ্টির জলকে পুরোপুরি বিশুদ্ধ জলে পরিণত করা যায়।RPC ব্যবহার করে ১০০০ লিটার পানীয় জল পরিশুদ্ধ করতে খরচ পড়ে ১০০-১৫০ টাকা। সাধারণভাবে ব্যবহারের জন্য এরূপ জল পরিশোধনের দেশীয় ফিল্টারের দাম ২২০০টাকা। এছাড়া আরও একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি হল অতিবেগুনি রশ্মির সাহায্যে জীবাণুমুক্ত করে সক্রিয় চারকোল দ্বারা শোধন।
      বৃষ্টির জল সরাসরি ব্যবহার ছাড়াও Rain Water Harvesting-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল মাটির তলার জলসম্ভারের পুনঃসঞ্চার। প্রাকৃতিক নানা কারণে এবং অপরিকল্পিতভাবে যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে সর্বত্র ভৌমজলস্তর নেমে যাচ্ছে ও দূষিত হচ্ছে, একথা আগেই আলোচিত হয়েছে। বৃষ্টির জলের দ্বারা পুনঃসঞ্চার করে এই ঘাটতি পূরণ না করতে পারলে হয়তো ভৌমজল একদিন নিঃশেষিত হয়ে যাবে। তাই গর্ত, কুয়ো, সোকপিট, টিউবওয়েল ইত্যাদির সাহায্যে মাটির নিচে বিভিন্ন গভীরতায় খুব সহজে পরিষ্কার বৃষ্টির জল পাঠিয়ে পুনঃসঞ্চার করা যায়। এগুলি অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত হওয়ায় ভূগর্ভের জলকে পুনরায় সমৃদ্ধ করে তুলতে পারে। এক্ষেত্রে একটা ফিল্টার ব্যবহার করলে ভালো। দেশীয় এরকম ফিল্টারের দাম ৬০০ টাকা। এইরকম গর্ত (recharge pit) খুঁড়তে ২৫০০-৫০০০ টাকা, সুড়ঙ্গ (recharge trench) তৈরি করতে ৫০০০-১০০০০ টাকা, টিউবওয়েল তৈরি করতে ১৫০০-২৫০০ টাকা, কুয়ো (recharge through dug well) ৫০০০-৮০০০ টাকা ও গভীর নলকূপ (recharge well) তৈরিতে ৫০০০০-৮০০০০ টাকা আনুমানিক ব্যয় হয়।
নিচের ছবিতে জলসঞ্চয়ের একটি ক্ষেত্র- বাড়ির ছাদ, জল সংবহন পদ্ধতি, মাটির ওপর ও নিচের জলাধার এবং পুনঃসঞ্চার কূপের মাধ্যমে গভীর ভৌমজলের পুনঃসঞ্চারণ প্রক্রিয়াটি বোঝানো হয়েছে।
জলসম্পদ সংরক্ষণের জন্য ভারত সরকার জলকে ‘জাতীয় সম্পদ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে এবং এর জন্য ‘জলসম্পদ মন্ত্রক’ গঠন করেছে। ১৯৮৭ সালে ‘জাতীয় জলনীতি’ গ্রহণ করা হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আইন প্রণয়ন করে বৃষ্টির জলসংরক্ষণের পদ্ধতি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ২০০১ সালে জুন মাসে নগরোন্নয়ন মন্ত্রক দিল্লিতে এই আইনটি বলবৎ করে। সেখানে বলা হয়েছে ১০০ বর্গমিটারের চেয়ে বড়ো ছাদযুক্ত নতুন বাড়িতে বৃষ্টির জল সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর, উওরপ্রদেশের কানপুর, অন্ধ্রপ্রদেশের হায়দ্রাবাদে, হরিয়ানা, রাজস্থানের সব শহরে ও মুম্বাইতে ‘রেন ওয়াটার হার্ভেস্টিং’ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। খুব সম্প্রতি তামিলনাডুতে মিউনিসিপ্যাল আইন অনুসারে (জুলাই ১৯, ২০০৩) সরকারি, বেসরকারি সমস্ত নতুন নির্মাণের ক্ষেত্রে এই আইন প্রযোজ্য বলে ঘোষণা করা হয়েছে।
      বৃষ্টির জল সঞ্চয় প্রকল্প রূপায়ণ আমাদের প্রত্যেকের কাছে অত্যাবশ্যক। আশা করা যায় এর মাধ্যমে অদূর ও সুদূর ভবিষ্যতে জলসংকট মিটবে, মাটির নিচের জলতল উঠে আসবে। পানীয় জলের চাহিদা মিটবে, গুণগত মানও বাড়বে। মৃত্তিকা ক্ষয়, আবদ্ধ জলের সমস্যা মিটবে। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে খরাক্লিষ্ট ও মরু অঞ্চলের মানুষ। তবে এই প্রকল্প রূপায়ণে কতকগুলি সীমাবদ্ধতা আছে। অঞ্চলটিতে বৃষ্টির প্রকৃতি ও স্থায়িত্বের ওপর সঞ্চয় ও পুনঃসঞ্চার নির্ভর করে। অঞ্চলটির প্রাপ্ত জলসম্ভার, মৃত্তিকার আস্তরণ, প্রবেশ্যতা, ভূমির ঢাল ও ভৌমজলের গভীরতা ও তার গুণগত মান সম্পর্কে একটা সমীক্ষার প্রয়োজন। স্থানটিতে কতটা পরিমাণ জলপ্রবাহ ঘটে, জমিটিতে কী পরিমাণ শিল্প, বসতি ও জনসংখ্যা বা সবুজ উদ্ভিদের আবরণ আছে তা দেখা দরকার। এসবের জন্য অবশ্য একান্ত জরুরি সাধারণ মানুষের মধ্যে বৃষ্টির জল সঞ্চয় সম্বন্ধে সচেতনতা তৈরি করা। যার জন্য সাধারণ মানুষকে প্রশিক্ষণ দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এর জন্য শুধু সরকারি উদ্যোগই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজনে বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংস্থার সক্রিয় অংশগ্রহণ আর গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা। তবেই আমরা বৃষ্টির জলের সঠিক ব্যবহার করে দেশের জল-সমস্যার সমাধান করতে পারব।

('এখন পর্যাবরণ' পত্রিকার ২০০৩ সালের উৎসব সংখ্যায় প্রকাশিত)


     
                 

  




      
                    

  


শুক্রগ্রহ




এবার লক্ষ্য শুক্রগ্রহ
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
     

সৌন্দর্যের প্রতীক ভেনাস ডি মিলো, লুভর মিউজিয়াম, প্যারিস
      সফলভাবে চাঁদে ও মঙ্গলে অভিযানের পরে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো শুক্র অভিযানের পরিকল্পনা করছে। প্রকৃতির কোন রহস্য সন্ধানে এই প্রচেষ্টা সে সম্পর্কে কিছু বলার আগে শুক্রগ্রহ সম্পর্কে আমাদের আজ পর্যন্ত কী জানা আছে দেখে নেওয়া যাক। আকাশে সূর্য ও চাঁদের পরেই সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু হল শুক্র ভোরবেলা বা সন্ধ্যা বেলা দেখা যায় বলে আমরা একে অনেক সময় শুকতারা বা সন্ধ্যা তারা বলে চিনি আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনীয়রা শুক্রগ্রহ পর্যবেক্ষণ করেছিল। প্ৰাচীনকালে ইউরোপে শুক্র ছিলেন সৌন্দর্যের দেবী। আমাদের দেশেও প্রাচীন পুরাণে শুক্রগ্রহের কথা পাওয়া যায়। দেবতাদের গুরু ছিলেন বৃহস্পতি, দানবদের গুরু ছিলেন শুক্র। দূরবিন আবিষ্কারের পর গ্যালিলিও দেখান যে চাঁদের মতো শুক্রেরও কলা দেখা যায়। তার পর থেকেই অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী দূরবিন দিয়ে এই গ্রহ পর্যবেক্ষণ করেছেন।
      শুক্রের ব্যাস মোটামুটি ১২১০০ কিলোমিটার অর্থাৎ পৃথিবীর ৯৫ শতাংশ। ওজন পৃথিবীর ৮২ শতাংশ। এ দুই গ্রহের গড় ঘনত্বও প্রায় সমান। এজন্য শুক্রকে পৃথিবীর যমজ গ্রহ বলা হয়। সূর্য থেকে শুক্রের গড় দূরত্ব ১০ কোটি ৮০ লক্ষ কিলোমিটার। সমস্ত গ্রহের মধ্যে শুক্রের কক্ষপথ বৃত্তের সবচেয়ে কাছাকাছি। শুক্রের এক বছর হয় আমাদের ২২৫ দিনে এই সমস্ত খবরই উনবিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি জানা ছিল।
      দূরবিন দিয়ে শুক্রের কোনো পরিবর্তন দেখা যেত না, শুক্রপৃষ্ঠের কোনো বৈশিষ্ট্যই বোঝা যেত না। তাই বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র চোখে দেখা আলোর উপর ভরসা না করে অন্য ধরনের পর্যবেক্ষণের উপর জোর দেন। ১৯২৭-২৮ সালে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম রাইট ও ফ্রাঙ্ক রস অতিবেগুনী রশ্মিতে ফটো তুলে দেখান যে শুক্রের মুখ সবসময়ই মেঘে ঢাকাএত যেখানে মেঘ, স্বাভাবিক ভাবেই মনে হল সেখানে জল আছে পৃথিবীর চেয়ে অনেক বেশি। শুধু তাই নয়, এও জানা গেল যে ঐ মেঘ সূর্যের আলোর বেশি অংশকেই প্রতিফলন করে দেয়। তাই মনে করা হয়েছিল যে শুক্র সূর্যের বেশি কাছে থাকলেও তার তাপমাত্রা হয়তো পৃথিবীরই মতো। তাই এর পরই কল্পবিজ্ঞানকাররা শুক্রগ্রহে মহাসাগরের এবং জলাভূমির কল্পনা করে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। শুক্রকে তাঁদের অনেকে করে তোলেন বিশাল বিশাল ডাইনোসর জাতীয় প্রাণী ও মানুষের যুদ্ধক্ষেত্র। এঁদের মধ্যে টারজানের স্রষ্টা এডগার রাইস বারোজ ও আইজ্যাক আসিমভের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পরবর্তীকালে যে সমস্ত খবর পাওয়া গেল তার থেকে দেখা গেল যে প্ৰাণের পক্ষে শুক্রের মতো প্রতিকূল জায়গা খুব কমই আছে। শুক্র থেকে পাওয়া অবলোহিত রশ্মি বিশ্লেষণ করে ১৯৩২ সালে অপর দুই মার্কিন বিজ্ঞানী ওয়াল্টার অ্যাডামস ও থিয়োডোর ডানহ্যাম দেখান যে আবহমণ্ডলে আছে মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড। বায়ুমণ্ডলের শতকরা ৯৬ ভাগই এই গ্যাস উনিশশো পঞ্চাশের দশকের শেষে শুক্র থেকে আসা অবলোহিত রশ্মি এবং মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ বিশ্লেষণ করে জানা যায় শুক্রের তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশি। সেখানে জলের পক্ষে তরল অবস্থায় থাকাই সম্ভব নয়। সেখানে নেই আসিমভের কল্পনার গ্রহব্যাপী মহাসাগর। আমরা এখন জানি যে শুক্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ৪৬০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। তাই শুক্র নিয়ে লেখা সায়েন্স ফিকশনের গল্পগুলো সত্যি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা এখনই নেই। ভবিষ্যতে কী সত্যি হতে পারে? এই লেখার শেষে আমরা দেখব।
মেঘে ঢাকা শুক্র (ছবি: NASA/JPL)
      শুক্রের মুখ সবসময়েই মেঘে ঢাকাতাই ১৯৬০-এর দশকের গোড়া থেকে শুরু হল রাডার দিয়ে পর্যবেক্ষণ। রেডিয়ো তরঙ্গ মেঘে আটকায় না। পৃথিবী থেকে রেডিয়ো তরঙ্গ পাঠিয়ে শুক্রের পিঠ থেকে প্রতিফলন করে সেই প্ৰতিফলিত তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে অনেক তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে প্রথম হল শুক্রের দিন কত বড় সে খবর। সেখানে দিন হল আমাদের পৃথিবীর ২৪৩ দিনের সমান। তাই শুক্রগ্রহে এক দিন এক বছরের থেকে বেশি লম্বা। শুধু তাই নয়, সমস্ত গ্রহের মধ্যে শুক্রই এক মাত্র পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে ঘোরে।
      শুক্রগ্রহে বেশ কয়েকটি মানুষবিহীন অভিযান চালানো হয়েছে। ১৯৬২, ১৯৬৭ ও ১৯৭৪ সালে পাঠানো মেরিনার-, ৫ ও ১০ মহাকাশযান শুক্রের পাশ দিয়ে যায় ১৯৬৭ সালে সোভিয়েত মহাকাশযান ভেনেরা-৪ শুক্রের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বায়ুমণ্ডলে একটি সন্ধানী যন্ত্র নামায় ১৯৭০ সালে ভেনেরা-৭ শুক্রের মাটিতে একটি যান নামাতে সক্ষম হয় ১৯৭৫ সালে ভেনেরা-৯ ও ১০ অভিযানে শুক্রের মাটি থেকে ক্যামেরাতে তোলা ছবি পৃথিবীতে পাঠায়। শুধু তাই নয় এই দুটি যানকেই শুক্রের চারপাশে কক্ষপথে স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে মার্কিন মহাকাশযান পায়োনিয়ার কক্ষপথে স্থাপিত হয়ে চারটি সন্ধানী যন্ত্র বায়ুমণ্ডলে পাঠায়। ১৯৮৩ সালে আবার সোভিয়েত অভিযান ভেনেরা-১৫ ও ১৬ এবং ১৯৯০ সালে মার্কিন মহাকাশযান ম্যাগেলান শুক্রের কক্ষপথ থেকে অনেক তথ্য পাঠিয়েছে। ১৯৭৮ সাল থেকেই অভিযানগুলি মূলত রাডারের উপর নির্ভর করেছে। গ্রহের পৃষ্ঠও রাডার দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে।
      এতদিন পর্যবেক্ষণের পরেও শুক্র নিয়ে আমাদের আগ্রহ কমে নি। এই শতাব্দীর দুটি অভিযান নিয়ে একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক। ২০০৫ সালের ৯ই নভেম্বর কাজাকিস্তানের মরুভূমি থেকে সোয়ুজ-ফ্লেগটি রকেটের পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু করেছিল ভেনাস এক্সপ্রেস ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে শুক্রে পৌঁছয় ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির এই মহাকাশযান। শুক্রের রহস্য অনুসন্ধানের জন্য ভেনাস এক্সপ্রেসে ছিল দৃশ্য ও অবলোহিত বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র। ছিল রেডিয়ো তরঙ্গ বিশ্লেষণ যন্ত্র, অণুকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার যন্ত্র ও ছবি তোলার জন্য ক্যামেরা। এছাড়া ছিল চৌম্বক ক্ষেত্র মাপার যন্ত্র। শুক্রের কোনো চৌম্বক ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা সবাই জানি পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্য চুম্বক উত্তর দক্ষিণ বরাবর থাকে। শুক্রের চৌম্বক ক্ষেত্র থাকলেও তা খুব দুর্বল। অত্যন্ত সূক্ষ্ম যন্ত্র ছাড়া তা ধরার কোনো উপায় নেই। চৌম্বক ক্ষেত্র সূর্য থেকে আসা অতি শক্তিসম্পন্ন কণাসমূহ, যাদের বলে সৌর বায়ু, তাদের ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। বায়ুমণ্ডলের উপর এর প্রভাব পড়ে।
      ২০০৬ সালের ১১ এপ্রিল ভেনাস এক্সপ্রেস শুক্রের চারদিকে কক্ষপথে স্থাপিত হয়প্রথমে যে কক্ষপথ ছিল সে তাতে শুক্রের মেরুদের উপর দিয়ে ন’দিনে একবার প্ৰদক্ষিণ করছিল। তাতে কখনো সে শুক্রের মাত্র চারশো কিলোমিটার উপরে আসছিল, আবার  কখনো  তিন লক্ষ তিরিশ হাজার কিলোমিটার দূরে চলে যাচ্ছিল।  এর পর ৭ মে তাকে স্থাপন করা হয় স্থায়ী কক্ষপথে। চব্বিশ ঘণ্টায় শুক্রকে সে এক বার পাক খাচ্ছে, সবচেয়ে কম দূরত্ব হল আড়াইশো কিলোমিটার ও সবচেয়ে বেশি ছেষট্টি হাজার কিলোমিটার। আট বছর পর্যবেক্ষণের পরে ভেনাস এক্সপ্রেসকে শুক্রের বায়ুমণ্ডলে নামানো হয়। ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়, এত দীর্ঘ সময়কাল শুক্রকে কোনো অভিযান পর্যবেক্ষণ করে নি। তার এক মাস পর থেকে কোনো সঙ্কেত ভেনাস এক্সপ্রেস থেকে পাওয়া যায়নি।
শিল্পীর চোখে শুক্র প্রদক্ষিণরত ভেনাস এক্সপ্রেস (ছবি: NASA)
      ২০১০ সালের ২০ মে জাপান পাঠিয়েছিল অ্যাকাৎসুকি বা ভেনাস ক্লাইমেট অরবিটার। কিন্তু তাকে তখন রকেটের সমস্যার জন্য শুক্রের কক্ষপথে স্থাপন করা যায়নি। পাঁচবছর সূর্য প্রদক্ষিণের পরে ইঞ্জিনিয়াররা তাকে ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর শুক্রের কক্ষপথে স্থাপন করতে পেরেছেন। ন’দিনে সে শুক্রকে প্রদক্ষিণ করছে। শুক্রে সবচেয়ে কাছে যখন আসে তখন শুক্রপৃষ্ঠ থেকে তার দূরত্ব চারশো কিলোমিটার। সবচেয়ে দূরে যখন থাকে, তখন তার দূরত্ব চার লক্ষ চল্লিশ হাজার কিলোমিটার। অন্যান্য যন্ত্রপাতির সঙ্গে এতে আছে অবলোহিত থেকে অতিবেগুনি পর্যন্ত নানা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর জন্য পাঁচটা ক্যামেরা। এখনো কাজ করে চলেছে অ্যাকাৎসুকি। শুক্রের বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে নানা তথ্য পাঠিয়েছে সে, তবে তা বুঝতে আমাদের সময় লাগছে। এছাড়া শুক্রের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকটি মহাকাশযান তাকে পর্যবেক্ষণ করেছে বা এখনও করছে। ভারতের প্রস্তাবিত শুক্রযানও শুক্রের বায়ুমণ্ডলকেই পর্যবেক্ষণ করার কথা।
      কেন আমরা শুক্র নিয়ে এত আগ্রহী? কোন রহস্য লুকিয়ে আছে শুক্রের মেঘের আড়ালে? দেখে নিই এখনো পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা শুক্র সম্পর্কে কী জানতে পেরেছেন। একটা সবচেয়ে বড় সমস্যা অবশ্যই হল শুক্রের ঘূর্ণন কেন শুক্র উল্টো দিকে ঘোরে, কেনই বা তার নিজের চারদিকে ঘূর্ণন বেগ এত কম? বৰ্তমানে বিজ্ঞানীরা মনে করেন শুক্র আগে অন্যান্য গ্রহদের মতো পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকেই ঘুরত। ঘন বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ঘূর্ণন বেগ কমে একসময় স্থির হয়ে যায়। এর পর তা খুব আস্তে আস্তে উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু করেছে। শুক্রের বায়ুমণ্ডলের কম্পিউটার মডেল আমাদের সেই কথাই জানাচ্ছে।  কারো মতে আবার শুক্রের ঘূর্ণন কমানোর জন্য পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণেরও ভূমিকা আছে। পৃথিবীর টান শুক্রের ঘূর্ণন বেগ কমিয়ে দিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর টানে চাঁদের ক্ষেত্রে ও সূর্যের টানে বুধের ক্ষেত্রে হয়েছে। তবে শুক্রের টানে আমাদের সমুদ্রের জোয়ারভাটা হয়না বলেই চলে, তাই পৃথিবীর টান শুক্রের উপর এতটা প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকেই স্বীকার করেন না। মনে রাখতে হবে দুটি বস্তুর উপর মাধ্যাকর্ষণের জন্য উভয়েই উভয়কে সমান বলে টানে। ভেনাস এক্সপ্রেসের পাঠানো তথ্য অনুসারে শুক্রের ঘূর্ণনের বেগ ক্রমশ কমছে, কেন তা আমাদের অজানা।
      শুক্রগ্রহের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এর বায়ুমণ্ডল। পৃথিবী বা তার চেয়ে ছোটো গ্রহদের মধ্যে সবচেয়ে ঘন বায়ুমণ্ডল এখানেই পাওয়া যাবে। শুক্রপৃষ্ঠে বায়ুর চাপ পৃথিবীর ৯০ গুণ। আমাদের গ্রহে ঐ চাপ পাওয়া যায় সমুদ্রের এক কিলোমিটার নিচে। মূল মেঘের স্তর প্রায় ২৫ কিলোমিটার পুরু। সূর্যের আলোর ৮৫ শতাংশ প্রতিফলিত করে এই মেঘের স্তর। মেঘ মূলত অত্যন্ত ঘন সালফিউরিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। এছাড়া আছে গন্ধক ও নাইট্রোসালফিউরিক অ্যাসিড। শুক্রে বৃষ্টি হয় কী না নিশ্চিত নয়, তবে হলে সে বৃষ্টি পাথর গলিয়ে দিতে পারবে। তাই শুক্ৰে এডগার রাইস বারোজের কল্পনার কয়েক মাইল উঁচু গাছ আর তার উপর হাল্কা জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ানো মানুষের খোঁজ পাওয়া যাবে না। বায়ুমণ্ডলের উপরিতলে বায়ুর বেগ এত বেশি যে তা চার দিনে শুক্রকে এক বার পাক খেয়ে আসে। ঘন এবং কার্বন ডাই অক্সাইড দিয়ে গঠিত বায়ুমণ্ডল গ্রহের পিঠ থেকে তাপকে মহাশূন্যে ফিরে যেতে দেয় না। তাই শুক্রের তাপমাত্রা এত বেশি। তোমরা নিশ্চয় জানো যে এই ভাবে তাপ ধরে রাখাকে বলে গ্রিন হাউস এফেক্ট, তার সব সেরা উদাহরণ হল শুক্রের বায়ুমণ্ডল।
      এত ঘন বায়ুমণ্ডল হল কেমন করে? সাধারণত কোনো গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ঘনত্ব তার মাধ্যাকর্ষণ ও তাপমাত্রার উপর নির্ভর করেঅপেক্ষাকৃত ছোটো গ্রহের মাধ্যাকর্ষণ বল কম, তাই তার বায়ুমণ্ডলকে ধরে রাখার ক্ষমতা কম। যেমন চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ছ’ভাগের এক ভাগ, তাই চাঁদে কোনো বায়ু মণ্ডল নেই। মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ, তাই সেখানে বায়ুমণ্ডল খুব পাতলা। আবার তাপমাত্রা বেশি হলে বায়ুর অণুগুলোর বেগ বেশি হয়, তখন তারা সহজে গ্রহের আকর্ষণ ছেড়ে পাড়ি জমাতে পারে। প্লুটোর আকর্ষণ চাঁদের থেকে অনেক কম, কিন্তু সূর্যের থেকে অনেক দূরে আছে বলে তার তাপমাত্রাও কম। তাই পাতলা হলেও তার এক বায়ুমণ্ডল আছে।
      শুক্রের আকর্ষণ পৃথিবীর থেকেও কম, অন্যদিকে তার তাপমাত্রা পৃথিবীর থেকে বেশি। সেখানে এই ঘন বায়ুমণ্ডল এক বিরাট প্ৰহেলিকা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে শুক্র ও পৃথিবী, দুই গ্রহেই মোট কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় সমান। পৃথিবীতে এই গ্যাস শিলার মধ্যে কার্বনেট যৌগ হিসাবে অবস্থান করছে। শুক্রের তাপমাত্ৰা প্রথমেই পৃথিবীর চেয়ে বেশি ছিল কারণ তা সূর্যের বেশি কাছে, তাই শিলা থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড মুক্ত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে গিয়ে ঘটিয়েছে গ্রিন হাউস এফেক্ট। তার ফলে তাপমাত্ৰা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে ও আরো বেশি গ্যাস শিলাস্তর থেকে মুক্ত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফল হল কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি যা আবার তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এধরনের পজিটিভ ফিডব্যাককে নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। আমরা প্রায় সবাই জানি যে আমাদের গ্রহের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভয় হয় এখনি ব্যবস্থা না নিলে এক সময় আমাদের সবুজ গ্রহও না শুক্রের মতো অবস্থায় পৌঁছে যায়।
      আরো এক সমস্যা হল বায়ুমণ্ডলের অস্বাভাবিক ঘূর্ণন। আগেই বলেছি। উপরের অংশ চার দিনে এক বার গ্রহকে পাক খেয়ে আসে। তার মানে মাটি থেকে সত্তর কিলোমিটার উপরে ঘণ্টায় তিন থেকে চারশো কিলোমিটার বেগে ঝড় বয়ে যায়। আমরা জানি না এর কারণ কি। ভেনাস এক্সপ্রেস দেখেছে এই বাতাসের বেগ ক্রমশ বাড়ছে।  শুক্রের যে দিকে রাত্রি, সেখানে বায়ুমণ্ডল আরো বেশি বিশৃঙ্খল।  বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন শুক্রের বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে তার ভূমিরূপের সম্পর্ক আছে।
      ভেনাস এক্সপ্রেস জানিয়েছে শুক্রের একটা তড়িৎক্ষেত্র আছে যার মান দশ ভোল্টের কাছাকাছি। পৃথিবী বা মঙ্গলের তড়িৎক্ষেত্র আছে কিনা মাপা সম্ভব হয় নি, থাকলেও তা দু’ভোল্টের কম। শুক্র সূর্যের বেশি কাছ থাকার জন্য অতিবেগুনি রশ্মির তীব্রতা সেখানে বেশি। তার প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের পরমাণুগুলি আয়নিত হয় বেশি। এর জন্য সেখানে তড়িৎক্ষেত্রের মান পৃথিবীর থেকে বেশি, অনেকে এমনই মনে করছেন। এর কি কোনো প্রভাব বায়ুমণ্ডলের উপর পড়ছে? ভেনাস এক্সপ্রেসকে শেষ পর্যন্ত শুক্রের বায়ুমণ্ডলে নামানো হয়। তার থেকে জানা গেছে যে মেরুর উপর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা এবং ঘনত্ব, দুইই আমাদের ধারণার থেকে অনেক কম। আবার শুক্রের বায়ুমণ্ডলের এমন শীতল অঞ্চলের খোঁজ পাওয়া গেছে যেখানে কার্বন ডাই অক্সাইড বরফ হিসাবে পাওয়া যেতে পারে। শুক্রের বায়ুমণ্ডলকে বুঝতে গেলে ভেনাস এক্সপ্রেস পাঠানো এই সমস্ত নতুন তথ্যকে মাথায় রাখা প্রয়োজন।
অবলোহিত আলোতে তোলা শুক্রগ্রহের মেরুর উপর বাতাসের ঘূর্ণি (চিত্র: ভেনাস এক্সপ্রেস, ESA/VIRTIS/INAF-IASF/Obs. de Paris-LESIA/Univ. Oxford)
      শুক্রের অপর এক বড় ধাঁধা হল তার ভূমিরূপ। কেউ কেউ মনে করেন যে বায়ুমণ্ডল থেকে যে অংশ হারিয়ে যায়, হয়তো আগ্নেয়গিরি থেকে বেরোনো কার্বনডাই অক্সাইড তা পুষিয়ে দেয়। শুক্র পৃষ্ঠে অনেক আগ্নেয়গিরির খোঁজ দিয়েছিল ম্যাগেলান, কিন্তু আমরা জানি না তার কোনোটা এখনো জীবন্ত কি না। ভেনাস এক্সপ্রেসের পাঠানো খবর থেকে জানা গেছে বাতাসে ২০০৬ সালে সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল, তার পর আবার কমে গেছে। অনুমান করা হয় এ কোনো জীবন্ত আগ্নেয়গিরির কীর্তি। সম্পূর্ণ গ্রহপৃষ্ঠ নিরবচ্ছিন্ন না পৃথিবীর মত কয়েকটি মহাদেশীয় প্লেট দিয়ে তৈরি যারা গলিত স্তরের উপর ভাসছে, তাও আমাদের অজানা। শুক্রপৃষ্ঠের সবচেয়ে বড় রহস্য হল তার বয়স। আমরা জানি শুক্রগ্রহের বয়স চারশো থেকে সাড়ে চারশো কোটি বছরের মধ্যে। কিন্তু শুক্রগ্রহের কোনো ভূমিরূপেরই বয়স ৫০ কোটি বছরের বেশি নয়। পৃথিবীতে অগ্ন্যুৎপাত ও ভূমিকম্পের মাধ্যমে অভ্যন্তরে সঞ্চিত তাপ বেরিয়ে যায়। এমন হতে পারে যে শুক্রে ভূমিকম্প হয় না বা আগ্নেয়গিরি নেই। তাই সমস্ত তাপ জমা হয়ে হঠাৎ একসঙ্গে সারা গ্ৰহতেই এক বিরাট বিস্ফোরণ ঘটায় ও গ্রহের গোটা ভূমি নতুন করে তৈরি করে।
      এই গ্রহে জলের অনুপস্থিতিও আর এক রহস্য। বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবী ও শুক্র একই সময় একই ভাবে তৈরি হয়েছিল। আমাদের গ্রহে এত জল, কিন্তু শুক্রে নেই কেন? তাপমাত্রা বাড়ার জন্য জল তরল অবস্থায় থাকবে না, কিন্তু তা তো ফুটে বাষ্প হবে। বায়ু মণ্ডলেও জলীয় বাপের পরিমাণ খুব কম। অনেকে মনে করেন উচ্চ তাপমাত্রায় জল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে ভেঙে গেছে। হাইড্রোজেন হালকা বলে শুক্রের মাধ্যাকর্ষণ তাকে ধরে রাখতে পারে নি, তা মহাকাশে মিলিয়ে গেছে। অক্সিজেন পাথরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন অক্সাইড গঠন করেছে। তা হলেও কিন্তু সমস্যা থেকে গেল গ্রহ সৃষ্টির সময় তো পৃথিবীর তাপমাত্ৰাও যথেষ্ট বেশি ছিল। আমাদের অনুমান যে পৃথিবীতে জল বয়ে নিয়ে এসেছে ধূমকেতু। এই বইয়ের ধূমকেতুর সওয়ার লেখাটাতে এই বিষয়ে আরো খোঁজখবর পাবে।  ভেনাস এক্সপ্রেসের পাঠানো খবর থেকে মনে হচ্ছে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বায়ুমণ্ডলের উপরের অংশের জলের অণুদের ভেঙে ফেলছে। শুক্রের তড়িৎক্ষেত্রেরও কোনো ভূমিকা থাকতে পারে।
      শুক্ৰে প্ৰাণ আছে কি? তোমাদের মনে হতেই পারে, মাটি যেখানে গলানো সিসার চেয়ে গরম, বায়ুর চাপ যেখানে প্রচণ্ড বেশি, আকাশ থেকে যেখানে ঝরে পড়তে পারে ঘন সালফিউরিক অ্যাসিড, জল বা অক্সিজেন যেখানে নেই বললেই চলে, সেখানে প্ৰাণের অস্তিত্ব কষ্টকল্পনা কিন্তু আমরা দেখেছি যে প্ৰাণের অভিযোজন ক্ষমতা খুব বেশি। পৃথিবীতে এমন অনেক ব্যাকটেরিয়া আছে অক্সিজেন যাদের কাছে বিষ। তবে শুক্রপৃষ্ঠে নয়, এখন বিজ্ঞানীরা প্ৰাণের অস্তিত্ব খুঁজছেন বায়ুমণ্ডলে। মাটি থেকে আশি কিলোমিটার উঁচুতে সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি শোষিত হয়ে যাচ্ছে। কোন পদ্ধতিতে এই শোষণ ঘটছে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা এখনই সম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করছেন যে এর জন্য দায়ী কোনো নতুন ধরনের জীবাণু।
      ভেনাস এক্সপ্রেস পৃথিবীতে প্রাণের সন্ধান করেছে। আশ্চর্য লাগছে? আসলে ভেনাস এক্সপ্রেসের ক্যামেরা পৃথিবীর ছবি তুলেছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন অত দূর থেকে তোলা ঐ ছবি থেকে পৃথিবীতে প্রাণের চিহ্ন সন্ধানের। যদি এমন কিছু দেখা যায় যাকে নিশ্চিতভাবে জীবনের সঙ্কেত বলে চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য গ্রহের ছবিতে সেই চিহ্নকে খোঁজা হবে। তবে এ বিষয়ে এখনো সবাই একমত হতে পারেননি।
       মনে একটা প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক। শুক্রের রহস্য সন্ধান করে আমাদের কী কোনো লাভ আছে? এর উত্তরটা তিনভাবে দেওয়া সম্ভব। প্রথমত বিজ্ঞান অধিকাংশ সময় লাভ লোকসান হিসাব করে কাজ করে নি। একথা নিশ্চয় ঠিক যে বর্তমানে বহু গবেষণা লাভের দিক বিবেচনা করেই এগোয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত যে সমস্ত আবিষ্কার মানুষের কল্যাণে সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে, তাদের অধিকাংশেরই উৎস কিন্তু শুধুমাত্র মানুষের কৌতূহল। গবেষণার সময় ভবিষ্যতে তা আমাদের কোনো উপকারে লাগবে বলেই একমাত্র বিজ্ঞানী গবেষণা করেন তা কিন্তু নয়। তাই শুক্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ মানুষের জানার ইচ্ছা থেকেই প্রথমত আসে। দ্বিতীয় কারণটাও প্রথমটির সঙ্গে যুক্ত। গবেষণা কিন্তু অনেক সময়ই কেবল কৌতূহল থেকে শুরু হলেও তা শেষে মানুষের অনেক উপকারে আসে। প্রথম দিকে যাঁরা বিদ্যুৎ বিষয়ে গবেষণা করতেন, তাঁরা কল্পনাতেও আনতে পারতেন না যে বর্তমানে তাদের গবেষণা কত কাজে লেগেছে। তেমনি শুক্র সম্পর্কে গবেষণা আমাদের পৃথিবী সম্পর্কে কী শেখাবে তা আগে থেকে সমস্ত বলে দেওয়া সম্ভব নয়। এ কথা নিশ্চিত যে এর থেকে আমরা সৌরজগতের গঠন সম্পর্কে জানতে পারব তেমনি আবহমণ্ডল সম্পর্কে গবেষণা আমাদের গ্রিনহাউস এফেক্ট সম্পর্কে শেখাবে। আমরা সবাই জানি যে পৃথিবীতে এই গ্রিনহাউস এফেক্ট ও তার জন্য তাপমাত্রার বৃদ্ধি এক বিরাট সমস্যা। তাই শুক্র সম্বন্ধীয় গবেষণা যে মানুষের কাজে আসবে তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের এবিষয়ে উৎসাহের আরো একটা দিক অবশ্য আছে। শেষ করার আগে সেই কথাটাই আলোচনা করতে চাই ।
      শুনলে আশ্চর্য লাগতে পারে, কিন্তু অন্য কোনো গ্রহকে পৃথিবীর মতো করার জন্যও অনেক বিজ্ঞানী চিন্তাভাবনা করেন। তাঁদের আশা আজ না হলেও একদিন তাঁদের গবেষণা কাজে লাগবেই। এই ধরণের কাজকে বলে Terraforming বা Planetary Engineering বাংলায় বলা যাক পার্থিবীকরণ । ঐ বিজ্ঞানীদের নজর সবচেয়ে বেশি পড়েছে মঙ্গল আর শুক্রের দিকে। শুক্র এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমাদের খুব কাছের গ্রহ, যার আয়তন ও অভিকর্ষ প্রায় আমাদের পৃথিবীরই মতো কিন্তু তা বর্তমানে আমাদের বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। দেখা যাক বিজ্ঞানীরা কী ভেবেছেন তাকে নিয়ে।
      ১৯৬১ সালে বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী কাল সাগান বিজ্ঞানের একেবারে প্রথম সারির পত্রিকা Science-এ একটি প্রবন্ধ প্ৰকাশ করেছিলেন। তিনি প্রস্তাব দেন যে শুক্রের বায়ুমণ্ডলে শৈবাল মানে শ্যাওলা চাষ করা যেতে পারে। শ্যাওলা কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে অক্সিজেন তৈরি করবে। তার ফলে গ্রিনহাউজ এফেক্টের মাত্রা কমে তাপমাত্রা কমবে। পরে অবশ্য যখন আরো খবর শুক্র সম্পর্কে পাওয়া গেল, তখন বোঝা গেল যে শুক্রে বায়ুমণ্ডলের পরিমাণ এত বেশি যে এই পদ্ধতি কাজ করবে না। শুধু তাপমাত্রা কমালে চলবে না, বায়ুমণ্ডলের পরিমাণও কমাতে হবে।
      তাপমাত্রা কমানোর এক অত্যন্ত আকৰ্ষণীয় উপায় হল পুরো গ্রহকেই ছায়া আনা যাতে সূর্যের আলো গ্রহে পৌঁছতে না পারে। এর জন্য গ্রহ আর সূর্যের মাঝখানে রাখতে হবে এক বিরাট পাতলা প্রতিফলক যাকে আবার সৌর শক্তি তৈরিতেও ব্যবহার করা যাবে। একে করতে হবে অত্যন্ত পাতলা, তা না হলে কয়েক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড় প্রতিফলক বানাতে যে পরিমাণ কাঁচামাল লাগবে তা যোগাড় করা যাবে না। গবেষণা যদিও চলছে, কিন্তু ঐরকম প্রতিফলক এখনো সায়েন্স ফিকশনের বাইরে পাওয়া যাবে না। তার উপর যতই পাতলা হোক না কেন, শুধুমাত্র আয়তনের কথা চিন্তা করলে বোঝা যায় যে পৃথিবী থেকে এই পরিমাণ উপকরণ শুক্রে নিয়ে যেতে খরচা পোষাবে না। তাই উৎস হিসাবে কাছাকাছির ধূমকেতুদের ব্যবহার করা যেতে পারে। তা না হলে গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে কোনো গ্রহাণু ধরে আনা যেতে পারে। শুনে হয়তো মনে হচ্ছে, গ্রহাণুপুঞ্জ তো পৃথিবীর থেকেও অনেক বেশি দূরে, তা হলে সেখান থেকে আনতে খরচ কম পড়বে কেন? আসলে খরচের অধিকাংশটাই পড়ে মাধ্যাকর্ষণ বল কাটিয়ে উঠতে। পৃথিবী থেকে ভরকে মহাকাশে তুলতেই খরচ সবচেয়ে বেশি। এই উপায়ে সে সমস্যা নেই। বর্তমান প্রযুক্তির কথা চিন্তা করলে বায়ুমণ্ডলে বিরাট সংখ্যায় প্রতিফলক বেলুন ব্যবহার করা যেতে পারে।
      বায়ুমণ্ডলের পরিমাণ কমানোর কোনো উপায় আছে কি? বুধ বা কোনো গ্রহাণু থেকে ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেসিয়াম বায়ুমণ্ডলে ফেলে ঐ মৌলের কার্বনেট যৌগ গঠন করা সম্ভব। এগুলি কঠিন পদার্থ, তাই এরা মাটিতে পড়ে যাবে ও বায়ুর পরিমাণ কমবে। আর এক উপায় হল হাইড্রোজেনের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইডের বিক্রিয়া করে জল বানানো। হাইড্রোজেন পাওয়া যেতে পারে বৃহস্পতির মতো গ্যাস দানব গ্রহদের থেকে। কার্বন মৌল রূপে মুক্ত হবে। এর ফলে গ্রহের আশি শতাংশ অঞ্চল অগভীর সমুদ্রের তলায় চলে যাবে। সত্যি হবে আসিমভের ওসেনস অফ ভেনাসের গল্পটা। তবে সমস্যা হল ঐ বিশাল পরিমাণ কার্বনকে কী করা হবে? মুক্ত কার্বন অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ। সে বিষয়েও চিন্তা চলছে।
      সম্পূর্ণ অন্য এক কথাও বিজ্ঞানীরা ভেবেছেন। শুক্রের মাটিকে মানুষের বাসযোগ্য করা শেষ পর্যন্ত খরচের দিক থেকে লাভজনক নাও হতে পারে। জিওফ্রে লান্ডিস নামে এক বিজ্ঞানী প্ৰস্তাব দেন হাওয়াতে ভাসমান শহরের শুনে আশ্চর্য লাগছে? তিনি দেখান যে আমাদের পৃথিবীর যে বায়ু, তা শুক্রের বায়ুর চেয়ে অনেক হালকা। তাই ঠিক যেমন হালকা গ্যাস ভর্তি বেলুন হাওয়ায় ভেসে থাকে, তেমনি যদি চারদিক থেকে বন্ধ বড় বাসস্থান বানিয়ে যদি পৃথিবীর মত বায়ু দিয়ে ভর্তি করা যায়, তা শুক্রের বায়ুতে ভেসে থাকবে। মাটি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার উপরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা শূন্য থেকে পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। সেখানে শুক্রের বায়ুচাপও পৃথিবীর মাটিতে চাপের সঙ্গে সমান। তাই বাসস্থানে কোনো ফুটো হলেও ভিতরের হাওয়া খুব আস্তে আস্তে বেরোবে। সুতরাং মেরামত করার সময় পাওয়া যাবে। এধরনের বাসস্থান যেখানে বদ্ধ স্থানে মানুষের থাকার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে তাদের বলে হ্যাবিট্যাটযদি ক্রমশ বেশি বেশি সংখ্যায় এমন বাসস্থান তৈরি হয়, তারাও আস্তে আস্তে শুক্রকে পরিবর্তন করতে পারবে।
শিল্পীর কল্পনায় শুক্রের আকাশে ভাসমান শহর (চিত্র: NASA)
      শুক্রকে বাসোপযোগী করা এক সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ সৌরজগতে অন্য যে গ্রহ নিয়ে এত চিন্তাভাবনা হয়েছে, তা হল মঙ্গল। সেখানে কিন্তু তুলনায় সমস্যাটা অনেক সোজা। আমাদের বর্তমানে জানা প্রযুক্তি ব্যবহার করেই মঙ্গলের পার্থিবীকরণ সম্ভব। সমস্যাটা শুধুমাত্ৰ কত বড় আকারে তার প্রয়োগ করা যাবে। সেই কথা ‘মঙ্গলগ্রহে মানুষ (এখনও) থাকে না’ লেখাটায় পাবে। শুক্রে কিন্তু প্রযুক্তিও এখনো আমাদের নাগালের প্রায় বাইরে। তার জন্য অবশ্য আলোচনা থেমে নেই। অনেক বিজ্ঞানীর মতে পার্থিবীকরণের চেষ্টা অনৈতিক আমরা ভবিষ্যতে অন্য ধরনের প্রাণের সম্ভাবনা নষ্ট করে দেব। আবার এক দল বিজ্ঞানীর মতে সৌরজগতের এই মাঝবয়সেও যখন পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও উন্নত প্রাণের উদ্ভব হয়নি, তখন আর তা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এদিকে পৃথিবী মানুষের একমাত্র বাসস্থান হলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে। পরমাণু যুদ্ধ বাঁধলে বা যদি কোনো বড় গ্রহাণু বা ধূমকেতু পৃথিবীকে ধাক্কা মারলে মানুষ লোপ পেয়ে যেতে পারে। অনেকদিন আগে এরকমই এক গ্রহাণুর সঙ্গে পৃথিবীর সংঘাতে পৃথিবীর আবহাওয়ার যে পরিবর্তন ঘটেছিল, তা ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল বলে অধিকাংশ বিজ্ঞানী মনে করেন। পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো বাসস্থান সেরকম কোনো ঘটনাতে মানুষজাতিকে অন্তত সম্পূর্ণ লুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে ।

      তবে শুক্রকে বাসযোগ্য করা দীর্ঘসময়ের পরিকল্পনা এই মুহূর্তে তা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। কিন্তু শুক্রের বহু রহস্যের উদঘাটন হয়তো অল্পদিনের মধ্যেই করা সম্ভব। ছোটরা, যারা এই লেখা পড়ছ, তোমরা যখন বড় হবে, কয়েকজন নিশ্চয় গ্রহনক্ষত্র এই সমস্ত বিষয়ে গবেষণা করবে। ভেনাস এক্সপ্রেসের মতো অভিযান ভবিষ্যতে আরো হবে। মঙ্গল বা প্লুটোতে অভিযানের কথা এখানে পড়তে পার। এরকম অনেক খবর সারা সৌরজগতের থেকে আসবে আগামী দিনে তোমাদের কেউ নিশ্চয় তখন আমাদের প্রতিবেশী এই গ্রহদের রহস্য সমাধানে মানুষকে সাহায্য করবে।

প্রথম প্রকাশঃ এখন পর্যাবরণ ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পুনর্লিখিত জুন ২০১৯