এবার লক্ষ্য শুক্রগ্রহ
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
সৌন্দর্যের প্রতীক ভেনাস ডি মিলো, লুভর মিউজিয়াম, প্যারিস
|
সফলভাবে চাঁদে ও মঙ্গলে অভিযানের পরে ভারতীয় মহাকাশ
গবেষণা সংস্থা ইসরো শুক্র অভিযানের পরিকল্পনা করছে। প্রকৃতির কোন রহস্য সন্ধানে এই
প্রচেষ্টা সে সম্পর্কে কিছু বলার আগে শুক্রগ্রহ সম্পর্কে আমাদের আজ পর্যন্ত কী
জানা আছে দেখে নেওয়া যাক। আকাশে সূর্য ও চাঁদের পরেই সবচেয়ে উজ্জ্বল বস্তু হল
শুক্র। ভোরবেলা বা সন্ধ্যা বেলা দেখা যায় বলে আমরা একে অনেক সময়
শুকতারা বা সন্ধ্যা তারা বলে চিনি। আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনীয়রা শুক্রগ্রহ
পর্যবেক্ষণ করেছিল। প্ৰাচীনকালে ইউরোপে শুক্র ছিলেন সৌন্দর্যের দেবী। আমাদের দেশেও
প্রাচীন পুরাণে শুক্রগ্রহের কথা পাওয়া যায়। দেবতাদের গুরু ছিলেন বৃহস্পতি, দানবদের গুরু
ছিলেন শুক্র। দূরবিন আবিষ্কারের পর গ্যালিলিও দেখান যে চাঁদের মতো শুক্রেরও কলা
দেখা যায়। তার পর থেকেই অনেক জ্যোতির্বিজ্ঞানী দূরবিন দিয়ে এই গ্রহ পর্যবেক্ষণ
করেছেন।
শুক্রের ব্যাস মোটামুটি ১২১০০ কিলোমিটার অর্থাৎ পৃথিবীর ৯৫ শতাংশ।
ওজন পৃথিবীর ৮২ শতাংশ। এ দুই গ্রহের গড় ঘনত্বও প্রায় সমান। এজন্য শুক্রকে
পৃথিবীর যমজ গ্রহ বলা হয়। সূর্য থেকে শুক্রের গড় দূরত্ব ১০ কোটি ৮০ লক্ষ কিলোমিটার। সমস্ত গ্রহের
মধ্যে শুক্রের কক্ষপথ বৃত্তের সবচেয়ে কাছাকাছি। শুক্রের এক বছর হয় আমাদের ২২৫
দিনে। এই সমস্ত খবরই উনবিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি জানা ছিল।
দূরবিন দিয়ে শুক্রের কোনো পরিবর্তন দেখা যেত না, শুক্রপৃষ্ঠের
কোনো বৈশিষ্ট্যই বোঝা যেত না। তাই বিজ্ঞানীরা শুধুমাত্র চোখে দেখা আলোর উপর ভরসা
না করে অন্য ধরনের পর্যবেক্ষণের উপর জোর দেন। ১৯২৭-২৮ সালে মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী
উইলিয়াম রাইট ও ফ্রাঙ্ক রস অতিবেগুনী রশ্মিতে ফটো তুলে দেখান যে শুক্রের মুখ
সবসময়ই মেঘে ঢাকা। এত যেখানে মেঘ, স্বাভাবিক ভাবেই মনে হল সেখানে জল আছে পৃথিবীর চেয়ে অনেক
বেশি। শুধু তাই নয়, এও জানা গেল
যে ঐ মেঘ সূর্যের আলোর বেশি অংশকেই প্রতিফলন করে দেয়। তাই মনে করা হয়েছিল যে
শুক্র সূর্যের বেশি কাছে থাকলেও তার তাপমাত্রা হয়তো পৃথিবীরই মতো। তাই এর পরই কল্পবিজ্ঞানকাররা
শুক্রগ্রহে মহাসাগরের এবং জলাভূমির কল্পনা করে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন। শুক্রকে
তাঁদের অনেকে করে তোলেন বিশাল বিশাল ডাইনোসর জাতীয় প্রাণী ও মানুষের
যুদ্ধক্ষেত্র। এঁদের মধ্যে টারজানের স্রষ্টা এডগার রাইস বারোজ ও আইজ্যাক আসিমভের
নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পরবর্তীকালে যে সমস্ত খবর পাওয়া গেল তার থেকে
দেখা গেল যে প্ৰাণের পক্ষে শুক্রের মতো প্রতিকূল জায়গা খুব কমই আছে। শুক্র থেকে
পাওয়া অবলোহিত রশ্মি বিশ্লেষণ করে ১৯৩২ সালে অপর দুই মার্কিন বিজ্ঞানী ওয়াল্টার
অ্যাডামস ও থিয়োডোর ডানহ্যাম দেখান যে আবহমণ্ডলে আছে মূলত কার্বন ডাই অক্সাইড।
বায়ুমণ্ডলের শতকরা ৯৬ ভাগই এই গ্যাস। উনিশশো পঞ্চাশের দশকের শেষে শুক্র থেকে আসা অবলোহিত রশ্মি
এবং মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ বিশ্লেষণ করে জানা যায় শুক্রের তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশি।
সেখানে জলের পক্ষে তরল অবস্থায় থাকাই সম্ভব নয়। সেখানে নেই আসিমভের কল্পনার
গ্রহব্যাপী মহাসাগর। আমরা এখন জানি যে শুক্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা ৪৬০ ডিগ্রি
সেন্টিগ্রেড। তাই শুক্র নিয়ে লেখা সায়েন্স ফিকশনের গল্পগুলো সত্যি হওয়ার কোনো
সম্ভাবনা এখনই নেই। ভবিষ্যতে কী সত্যি হতে পারে? এই লেখার শেষে আমরা দেখব।
মেঘে
ঢাকা শুক্র (ছবি: NASA/JPL)
শুক্রের মুখ সবসময়েই মেঘে ঢাকা। তাই ১৯৬০-এর দশকের গোড়া থেকে শুরু হল রাডার দিয়ে পর্যবেক্ষণ।
রেডিয়ো তরঙ্গ মেঘে আটকায় না। পৃথিবী থেকে রেডিয়ো তরঙ্গ পাঠিয়ে শুক্রের পিঠ থেকে
প্রতিফলন করে সেই প্ৰতিফলিত তরঙ্গ বিশ্লেষণ করে অনেক তথ্য জানা গেছে। এর মধ্যে
প্রথম হল শুক্রের দিন কত বড় সে খবর। সেখানে দিন হল আমাদের পৃথিবীর ২৪৩ দিনের
সমান। তাই শুক্রগ্রহে এক দিন এক বছরের থেকে বেশি লম্বা। শুধু তাই নয়, সমস্ত গ্রহের মধ্যে শুক্রই এক মাত্র পূর্ব থেকে
পশ্চিম দিকে ঘোরে।
শুক্রগ্রহে বেশ কয়েকটি মানুষবিহীন অভিযান চালানো হয়েছে। ১৯৬২, ১৯৬৭ ও ১৯৭৪ সালে পাঠানো মেরিনার-২,
৫ ও ১০ মহাকাশযান
শুক্রের পাশ দিয়ে যায়।
১৯৬৭ সালে
সোভিয়েত মহাকাশযান ভেনেরা-৪ শুক্রের
পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বায়ুমণ্ডলে একটি সন্ধানী যন্ত্র নামায়। ১৯৭০ সালে ভেনেরা-৭ শুক্রের মাটিতে একটি যান নামাতে সক্ষম হয়। ১৯৭৫ সালে ভেনেরা-৯ ও ১০
অভিযানে শুক্রের মাটি থেকে ক্যামেরাতে তোলা ছবি পৃথিবীতে পাঠায়। শুধু তাই নয় এই
দুটি যানকেই শুক্রের চারপাশে কক্ষপথে স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে মার্কিন
মহাকাশযান পায়োনিয়ার কক্ষপথে স্থাপিত হয়ে চারটি সন্ধানী যন্ত্র বায়ুমণ্ডলে
পাঠায়। ১৯৮৩ সালে আবার সোভিয়েত অভিযান ভেনেরা-১৫ ও ১৬ এবং ১৯৯০ সালে মার্কিন মহাকাশযান ম্যাগেলান
শুক্রের কক্ষপথ থেকে অনেক তথ্য পাঠিয়েছে। ১৯৭৮ সাল থেকেই অভিযানগুলি মূলত রাডারের
উপর নির্ভর করেছে। গ্রহের পৃষ্ঠও রাডার দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে।
এতদিন পর্যবেক্ষণের পরেও শুক্র নিয়ে আমাদের আগ্রহ কমে নি। এই
শতাব্দীর দুটি অভিযান নিয়ে একটু আলোচনা করে নেওয়া যাক। ২০০৫ সালের ৯ই নভেম্বর
কাজাকিস্তানের মরুভূমি থেকে সোয়ুজ-ফ্লেগটি রকেটের পিঠে চড়ে যাত্রা শুরু করেছিল ভেনাস
এক্সপ্রেস। ২০০৬ সালের এপ্রিল মাসে শুক্রে পৌঁছয় ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির এই
মহাকাশযান। শুক্রের রহস্য অনুসন্ধানের জন্য ভেনাস এক্সপ্রেসে ছিল দৃশ্য ও অবলোহিত
বর্ণালীবীক্ষণ যন্ত্র। ছিল রেডিয়ো তরঙ্গ বিশ্লেষণ যন্ত্র, অণুকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করার যন্ত্র ও ছবি তোলার জন্য
ক্যামেরা। এছাড়া ছিল চৌম্বক ক্ষেত্র মাপার যন্ত্র।
শুক্রের কোনো চৌম্বক ক্ষেত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। আমরা সবাই জানি পৃথিবীর
চৌম্বক ক্ষেত্রের জন্য চুম্বক উত্তর দক্ষিণ বরাবর থাকে। শুক্রের চৌম্বক ক্ষেত্র
থাকলেও তা খুব দুর্বল। অত্যন্ত সূক্ষ্ম যন্ত্র ছাড়া তা ধরার কোনো উপায় নেই।
চৌম্বক ক্ষেত্র সূর্য থেকে আসা অতি শক্তিসম্পন্ন কণাসমূহ, যাদের বলে সৌর বায়ু, তাদের ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম। বায়ুমণ্ডলের উপর এর
প্রভাব পড়ে।
২০০৬ সালের ১১ এপ্রিল ভেনাস এক্সপ্রেস শুক্রের চারদিকে কক্ষপথে
স্থাপিত হয়। প্রথমে যে কক্ষপথ ছিল সে তাতে শুক্রের মেরুদের উপর
দিয়ে ন’দিনে একবার প্ৰদক্ষিণ করছিল। তাতে কখনো সে শুক্রের মাত্র চারশো কিলোমিটার উপরে আসছিল, আবার কখনো তিন লক্ষ তিরিশ হাজার কিলোমিটার দূরে চলে যাচ্ছিল। এর পর ৭ মে তাকে স্থাপন করা হয় স্থায়ী কক্ষপথে।
চব্বিশ ঘণ্টায়
শুক্রকে সে এক বার পাক খাচ্ছে, সবচেয়ে কম দূরত্ব হল আড়াইশো কিলোমিটার ও সবচেয়ে বেশি ছেষট্টি হাজার কিলোমিটার। আট বছর পর্যবেক্ষণের
পরে ভেনাস এক্সপ্রেসকে শুক্রের বায়ুমণ্ডলে নামানো হয়। ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর অভিযানের
সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়, এত দীর্ঘ সময়কাল শুক্রকে কোনো অভিযান পর্যবেক্ষণ করে নি। তার
এক মাস পর থেকে কোনো সঙ্কেত ভেনাস এক্সপ্রেস থেকে পাওয়া যায়নি।
শিল্পীর
চোখে শুক্র প্রদক্ষিণরত ভেনাস এক্সপ্রেস (ছবি: NASA)
২০১০ সালের ২০ মে জাপান পাঠিয়েছিল অ্যাকাৎসুকি বা ভেনাস ক্লাইমেট
অরবিটার। কিন্তু তাকে তখন রকেটের সমস্যার জন্য শুক্রের কক্ষপথে স্থাপন করা যায়নি।
পাঁচবছর সূর্য প্রদক্ষিণের পরে ইঞ্জিনিয়াররা তাকে ২০১৫ সালের ৭ ডিসেম্বর শুক্রের কক্ষপথে
স্থাপন করতে পেরেছেন। ন’দিনে সে শুক্রকে প্রদক্ষিণ করছে। শুক্রে সবচেয়ে কাছে যখন
আসে তখন শুক্রপৃষ্ঠ থেকে তার দূরত্ব চারশো কিলোমিটার। সবচেয়ে দূরে যখন থাকে, তখন
তার দূরত্ব চার লক্ষ চল্লিশ হাজার কিলোমিটার। অন্যান্য যন্ত্রপাতির সঙ্গে এতে আছে
অবলোহিত থেকে অতিবেগুনি পর্যন্ত নানা তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর জন্য পাঁচটা ক্যামেরা। এখনো
কাজ করে চলেছে অ্যাকাৎসুকি। শুক্রের বায়ুমণ্ডল সম্পর্কে নানা তথ্য পাঠিয়েছে সে,
তবে তা বুঝতে আমাদের সময় লাগছে। এছাড়া শুক্রের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকটি
মহাকাশযান তাকে পর্যবেক্ষণ করেছে বা এখনও করছে। ভারতের প্রস্তাবিত শুক্রযানও
শুক্রের বায়ুমণ্ডলকেই পর্যবেক্ষণ করার কথা।
কেন আমরা শুক্র নিয়ে এত আগ্রহী? কোন রহস্য লুকিয়ে আছে শুক্রের মেঘের
আড়ালে? দেখে নিই এখনো পর্যন্ত
বিজ্ঞানীরা শুক্র সম্পর্কে কী জানতে পেরেছেন। একটা সবচেয়ে বড় সমস্যা অবশ্যই হল
শুক্রের ঘূর্ণন। কেন শুক্র উল্টো দিকে ঘোরে, কেনই বা তার নিজের চারদিকে ঘূর্ণন বেগ এত কম? বৰ্তমানে বিজ্ঞানীরা মনে করেন শুক্র আগে অন্যান্য
গ্রহদের মতো পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকেই ঘুরত। ঘন বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ঘূর্ণন
বেগ কমে একসময় স্থির হয়ে যায়। এর পর তা খুব আস্তে আস্তে উল্টোদিকে ঘুরতে শুরু
করেছে। শুক্রের বায়ুমণ্ডলের কম্পিউটার মডেল আমাদের সেই কথাই জানাচ্ছে। কারো মতে আবার শুক্রের ঘূর্ণন কমানোর জন্য
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণেরও ভূমিকা আছে। পৃথিবীর টান শুক্রের ঘূর্ণন বেগ কমিয়ে
দিয়েছে। এ ধরনের ঘটনা পৃথিবীর টানে চাঁদের ক্ষেত্রে ও সূর্যের টানে বুধের
ক্ষেত্রে হয়েছে। তবে শুক্রের টানে আমাদের সমুদ্রের জোয়ারভাটা
হয়না বলেই চলে, তাই পৃথিবীর টান শুক্রের উপর এতটা প্রভাব ফেলতে পারে বলে অনেকেই
স্বীকার করেন না। মনে রাখতে হবে দুটি বস্তুর উপর মাধ্যাকর্ষণের জন্য উভয়েই উভয়কে
সমান বলে টানে। ভেনাস এক্সপ্রেসের পাঠানো তথ্য অনুসারে শুক্রের ঘূর্ণনের বেগ ক্রমশ
কমছে, কেন তা আমাদের অজানা।
শুক্রগ্রহের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এর বায়ুমণ্ডল। পৃথিবী
বা তার চেয়ে ছোটো গ্রহদের মধ্যে সবচেয়ে ঘন বায়ুমণ্ডল এখানেই পাওয়া যাবে।
শুক্রপৃষ্ঠে বায়ুর চাপ পৃথিবীর ৯০ গুণ। আমাদের গ্রহে ঐ চাপ পাওয়া যায় সমুদ্রের
এক কিলোমিটার নিচে। মূল মেঘের স্তর প্রায় ২৫ কিলোমিটার পুরু। সূর্যের আলোর ৮৫ শতাংশ প্রতিফলিত করে এই মেঘের
স্তর। মেঘ মূলত অত্যন্ত ঘন সালফিউরিক অ্যাসিড দিয়ে তৈরি। এছাড়া আছে গন্ধক ও
নাইট্রোসালফিউরিক অ্যাসিড। শুক্রে বৃষ্টি হয় কী না নিশ্চিত নয়, তবে হলে সে বৃষ্টি পাথর গলিয়ে দিতে পারবে। তাই
শুক্ৰে এডগার রাইস বারোজের কল্পনার কয়েক মাইল উঁচু গাছ আর তার উপর হাল্কা
জামাকাপড় পরে ঘুরে বেড়ানো মানুষের খোঁজ পাওয়া যাবে না। বায়ুমণ্ডলের উপরিতলে
বায়ুর বেগ এত বেশি যে তা চার দিনে শুক্রকে এক বার পাক খেয়ে আসে। ঘন এবং কার্বন
ডাই অক্সাইড দিয়ে গঠিত বায়ুমণ্ডল গ্রহের পিঠ থেকে তাপকে মহাশূন্যে ফিরে যেতে
দেয় না। তাই শুক্রের তাপমাত্রা এত বেশি। তোমরা নিশ্চয় জানো যে এই ভাবে তাপ ধরে
রাখাকে বলে গ্রিন হাউস এফেক্ট, তার সব সেরা উদাহরণ হল শুক্রের বায়ুমণ্ডল।
এত ঘন বায়ুমণ্ডল হল কেমন করে? সাধারণত কোনো গ্রহের বায়ুমণ্ডলের
ঘনত্ব তার মাধ্যাকর্ষণ ও তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে। অপেক্ষাকৃত ছোটো গ্রহের
মাধ্যাকর্ষণ বল কম, তাই তার
বায়ুমণ্ডলকে ধরে রাখার ক্ষমতা কম। যেমন চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর ছ’ভাগের এক
ভাগ, তাই চাঁদে কোনো বায়ু মণ্ডল
নেই। মঙ্গলের মাধ্যাকর্ষণ পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ,
তাই সেখানে
বায়ুমণ্ডল খুব পাতলা। আবার তাপমাত্রা বেশি হলে বায়ুর অণুগুলোর বেগ বেশি হয়, তখন
তারা সহজে গ্রহের আকর্ষণ ছেড়ে পাড়ি জমাতে পারে। প্লুটোর আকর্ষণ চাঁদের থেকে অনেক
কম, কিন্তু সূর্যের থেকে অনেক দূরে আছে বলে তার তাপমাত্রাও কম। তাই পাতলা হলেও তার
এক বায়ুমণ্ডল আছে।
শুক্রের আকর্ষণ পৃথিবীর থেকেও কম, অন্যদিকে তার তাপমাত্রা পৃথিবীর
থেকে বেশি। সেখানে এই ঘন বায়ুমণ্ডল এক বিরাট প্ৰহেলিকা। বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে
শুক্র ও পৃথিবী, দুই গ্রহেই
মোট কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ প্রায় সমান। পৃথিবীতে এই গ্যাস শিলার মধ্যে
কার্বনেট যৌগ হিসাবে অবস্থান করছে। শুক্রের তাপমাত্ৰা প্রথমেই পৃথিবীর চেয়ে বেশি
ছিল কারণ তা সূর্যের বেশি কাছে,
তাই শিলা
থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড মুক্ত হয়ে বায়ুমণ্ডলে মিশে গিয়ে ঘটিয়েছে গ্রিন হাউস
এফেক্ট। তার ফলে তাপমাত্ৰা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে ও আরো বেশি গ্যাস শিলাস্তর থেকে
মুক্ত হয়েছে। দেখা যাচ্ছে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফল হল কার্বন ডাই অক্সাইডের
বৃদ্ধি যা আবার তাপমাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। এধরনের পজিটিভ ফিডব্যাককে
নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন। আমরা প্রায় সবাই জানি যে আমাদের গ্রহের তাপমাত্রা
বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভয় হয় এখনি ব্যবস্থা না নিলে এক সময় আমাদের সবুজ গ্রহও না
শুক্রের মতো অবস্থায় পৌঁছে যায়।
আরো এক সমস্যা হল বায়ুমণ্ডলের অস্বাভাবিক ঘূর্ণন। আগেই বলেছি।
উপরের অংশ চার দিনে এক বার গ্রহকে পাক খেয়ে আসে। তার মানে মাটি থেকে সত্তর কিলোমিটার উপরে ঘণ্টায় তিন থেকে
চারশো কিলোমিটার
বেগে ঝড় বয়ে যায়। আমরা জানি না এর কারণ কি। ভেনাস এক্সপ্রেস দেখেছে এই বাতাসের
বেগ ক্রমশ বাড়ছে। শুক্রের যে দিকে রাত্রি,
সেখানে বায়ুমণ্ডল আরো বেশি বিশৃঙ্খল। বিজ্ঞানীরা
অনুমান করছেন শুক্রের বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে তার ভূমিরূপের সম্পর্ক আছে।
ভেনাস এক্সপ্রেস জানিয়েছে শুক্রের একটা তড়িৎক্ষেত্র আছে যার মান
দশ ভোল্টের কাছাকাছি। পৃথিবী বা মঙ্গলের তড়িৎক্ষেত্র আছে কিনা মাপা সম্ভব হয় নি,
থাকলেও তা দু’ভোল্টের কম। শুক্র সূর্যের বেশি কাছ থাকার জন্য অতিবেগুনি রশ্মির
তীব্রতা সেখানে বেশি। তার প্রভাবে বায়ুমণ্ডলের পরমাণুগুলি আয়নিত হয় বেশি। এর জন্য
সেখানে তড়িৎক্ষেত্রের মান পৃথিবীর থেকে বেশি, অনেকে এমনই মনে করছেন। এর কি কোনো
প্রভাব বায়ুমণ্ডলের উপর পড়ছে? ভেনাস এক্সপ্রেসকে শেষ পর্যন্ত শুক্রের বায়ুমণ্ডলে
নামানো হয়। তার থেকে জানা গেছে যে মেরুর উপর বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা এবং ঘনত্ব,
দুইই আমাদের ধারণার থেকে অনেক কম। আবার শুক্রের বায়ুমণ্ডলের এমন শীতল অঞ্চলের খোঁজ
পাওয়া গেছে যেখানে কার্বন ডাই অক্সাইড বরফ হিসাবে পাওয়া যেতে পারে। শুক্রের
বায়ুমণ্ডলকে বুঝতে গেলে ভেনাস এক্সপ্রেস পাঠানো এই সমস্ত নতুন তথ্যকে মাথায় রাখা
প্রয়োজন।
অবলোহিত
আলোতে তোলা শুক্রগ্রহের মেরুর উপর বাতাসের ঘূর্ণি (চিত্র: ভেনাস এক্সপ্রেস, ESA/VIRTIS/INAF-IASF/Obs. de Paris-LESIA/Univ. Oxford)
শুক্রের অপর এক বড় ধাঁধা হল তার ভূমিরূপ। কেউ কেউ মনে করেন যে
বায়ুমণ্ডল থেকে যে অংশ হারিয়ে যায়, হয়তো আগ্নেয়গিরি থেকে বেরোনো কার্বনডাই অক্সাইড
তা পুষিয়ে দেয়। শুক্র পৃষ্ঠে অনেক আগ্নেয়গিরির খোঁজ দিয়েছিল ম্যাগেলান, কিন্তু আমরা
জানি না তার কোনোটা এখনো জীবন্ত কি না। ভেনাস এক্সপ্রেসের পাঠানো খবর থেকে জানা
গেছে বাতাসে ২০০৬ সালে সালফার ডাই অক্সাইডের পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে গিয়েছিল, তার পর
আবার কমে গেছে। অনুমান করা হয় এ কোনো জীবন্ত আগ্নেয়গিরির কীর্তি। সম্পূর্ণ
গ্রহপৃষ্ঠ নিরবচ্ছিন্ন না পৃথিবীর মত কয়েকটি মহাদেশীয় প্লেট দিয়ে তৈরি যারা
গলিত স্তরের উপর ভাসছে, তাও আমাদের
অজানা। শুক্রপৃষ্ঠের সবচেয়ে বড় রহস্য হল তার বয়স। আমরা জানি শুক্রগ্রহের বয়স
চারশো থেকে সাড়ে চারশো কোটি বছরের মধ্যে। কিন্তু শুক্রগ্রহের কোনো ভূমিরূপেরই বয়স
৫০ কোটি বছরের বেশি নয়। পৃথিবীতে অগ্ন্যুৎপাত ও ভূমিকম্পের মাধ্যমে অভ্যন্তরে
সঞ্চিত তাপ বেরিয়ে যায়। এমন হতে পারে যে শুক্রে ভূমিকম্প হয় না বা আগ্নেয়গিরি
নেই। তাই সমস্ত তাপ জমা হয়ে হঠাৎ একসঙ্গে সারা গ্ৰহতেই এক বিরাট বিস্ফোরণ ঘটায় ও
গ্রহের গোটা ভূমি নতুন করে তৈরি করে।
এই গ্রহে জলের অনুপস্থিতিও আর এক রহস্য। বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবী ও
শুক্র একই সময় একই ভাবে তৈরি হয়েছিল। আমাদের গ্রহে এত জল, কিন্তু শুক্রে নেই কেন? তাপমাত্রা বাড়ার জন্য জল তরল অবস্থায় থাকবে না, কিন্তু তা তো ফুটে বাষ্প হবে। বায়ু মণ্ডলেও জলীয়
বাপের পরিমাণ খুব কম। অনেকে মনে করেন উচ্চ তাপমাত্রায় জল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনে
ভেঙে গেছে। হাইড্রোজেন হালকা বলে শুক্রের মাধ্যাকর্ষণ তাকে ধরে রাখতে পারে নি, তা মহাকাশে মিলিয়ে গেছে। অক্সিজেন পাথরের সঙ্গে
যুক্ত হয়ে বিভিন্ন অক্সাইড গঠন করেছে। তা হলেও কিন্তু সমস্যা থেকে গেল – গ্রহ সৃষ্টির সময় তো পৃথিবীর তাপমাত্ৰাও যথেষ্ট বেশি
ছিল। আমাদের অনুমান যে পৃথিবীতে জল বয়ে নিয়ে এসেছে ধূমকেতু। এই বইয়ের ধূমকেতুর সওয়ার লেখাটাতে এই বিষয়ে আরো খোঁজখবর পাবে। ভেনাস এক্সপ্রেসের পাঠানো খবর থেকে মনে হচ্ছে
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি বায়ুমণ্ডলের উপরের অংশের জলের অণুদের ভেঙে ফেলছে। শুক্রের
তড়িৎক্ষেত্রেরও কোনো ভূমিকা থাকতে পারে।
শুক্ৰে প্ৰাণ আছে কি? তোমাদের মনে হতেই পারে, মাটি যেখানে গলানো সিসার চেয়ে গরম, বায়ুর চাপ যেখানে প্রচণ্ড বেশি, আকাশ থেকে যেখানে ঝরে পড়তে পারে ঘন সালফিউরিক
অ্যাসিড, জল বা অক্সিজেন যেখানে নেই
বললেই চলে, সেখানে প্ৰাণের অস্তিত্ব
কষ্টকল্পনা। কিন্তু আমরা দেখেছি যে প্ৰাণের অভিযোজন ক্ষমতা খুব বেশি।
পৃথিবীতে এমন অনেক ব্যাকটেরিয়া আছে অক্সিজেন যাদের কাছে বিষ। তবে শুক্রপৃষ্ঠে নয়, এখন বিজ্ঞানীরা প্ৰাণের অস্তিত্ব খুঁজছেন
বায়ুমণ্ডলে। মাটি থেকে আশি কিলোমিটার উঁচুতে সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি
শোষিত হয়ে যাচ্ছে। কোন পদ্ধতিতে এই শোষণ ঘটছে, তা নিশ্চিত ভাবে বলা এখনই সম্ভব নয়। কেউ কেউ মনে করছেন যে
এর জন্য দায়ী কোনো নতুন ধরনের জীবাণু।
ভেনাস এক্সপ্রেস পৃথিবীতে প্রাণের সন্ধান করেছে। আশ্চর্য লাগছে?
আসলে ভেনাস এক্সপ্রেসের ক্যামেরা পৃথিবীর ছবি তুলেছে। বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করছেন অত
দূর থেকে তোলা ঐ ছবি থেকে পৃথিবীতে প্রাণের চিহ্ন সন্ধানের। যদি এমন কিছু দেখা যায়
যাকে নিশ্চিতভাবে জীবনের সঙ্কেত বলে চিহ্নিত করতে পারি, তাহলে ভবিষ্যতে অন্য
গ্রহের ছবিতে সেই চিহ্নকে খোঁজা হবে। তবে এ বিষয়ে এখনো সবাই একমত হতে পারেননি।
মনে একটা প্রশ্ন আসা
স্বাভাবিক। শুক্রের রহস্য সন্ধান করে আমাদের কী কোনো লাভ আছে? এর উত্তরটা তিনভাবে দেওয়া সম্ভব। প্রথমত বিজ্ঞান
অধিকাংশ সময় লাভ লোকসান হিসাব করে কাজ করে নি। একথা নিশ্চয় ঠিক যে বর্তমানে বহু
গবেষণা লাভের দিক বিবেচনা করেই এগোয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত যে সমস্ত আবিষ্কার
মানুষের কল্যাণে সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে, তাদের অধিকাংশেরই উৎস কিন্তু শুধুমাত্র মানুষের কৌতূহল।
গবেষণার সময় ভবিষ্যতে তা আমাদের কোনো উপকারে লাগবে বলেই একমাত্র বিজ্ঞানী গবেষণা
করেন তা কিন্তু নয়। তাই শুক্র সম্পর্কে জ্ঞানলাভ মানুষের জানার ইচ্ছা থেকেই
প্রথমত আসে। দ্বিতীয় কারণটাও প্রথমটির সঙ্গে যুক্ত। গবেষণা কিন্তু অনেক সময়ই
কেবল কৌতূহল থেকে শুরু হলেও তা শেষে মানুষের অনেক উপকারে আসে। প্রথম দিকে যাঁরা
বিদ্যুৎ বিষয়ে গবেষণা করতেন,
তাঁরা
কল্পনাতেও আনতে পারতেন না যে বর্তমানে তাদের গবেষণা কত কাজে লেগেছে। তেমনি শুক্র
সম্পর্কে গবেষণা আমাদের পৃথিবী সম্পর্কে কী শেখাবে তা আগে থেকে সমস্ত বলে দেওয়া
সম্ভব নয়। এ কথা নিশ্চিত যে এর থেকে আমরা সৌরজগতের গঠন সম্পর্কে জানতে পারব। তেমনি আবহমণ্ডল সম্পর্কে গবেষণা
আমাদের গ্রিনহাউস এফেক্ট সম্পর্কে শেখাবে। আমরা সবাই জানি যে পৃথিবীতে এই গ্রিনহাউস
এফেক্ট ও তার জন্য তাপমাত্রার বৃদ্ধি এক বিরাট সমস্যা। তাই শুক্র সম্বন্ধীয়
গবেষণা যে মানুষের কাজে আসবে তাতে সন্দেহ নেই। আমাদের এবিষয়ে উৎসাহের আরো একটা
দিক অবশ্য আছে। শেষ করার আগে সেই কথাটাই আলোচনা করতে চাই ।
শুনলে আশ্চর্য লাগতে পারে, কিন্তু অন্য কোনো গ্রহকে পৃথিবীর মতো করার জন্যও অনেক
বিজ্ঞানী চিন্তাভাবনা করেন। তাঁদের আশা আজ না হলেও একদিন তাঁদের গবেষণা কাজে
লাগবেই। এই ধরণের কাজকে বলে Terraforming
বা Planetary Engineering। বাংলায় বলা যাক পার্থিবীকরণ । ঐ বিজ্ঞানীদের নজর
সবচেয়ে বেশি পড়েছে মঙ্গল আর শুক্রের দিকে। শুক্র এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমাদের খুব কাছের গ্রহ, যার আয়তন ও অভিকর্ষ প্রায় আমাদের পৃথিবীরই মতো
কিন্তু তা বর্তমানে আমাদের বসবাসের সম্পূর্ণ অনুপযোগী। দেখা যাক বিজ্ঞানীরা কী
ভেবেছেন তাকে নিয়ে।
১৯৬১
সালে বিশিষ্ট
জ্যোতির্বিজ্ঞানী কাল সাগান বিজ্ঞানের একেবারে প্রথম সারির পত্রিকা Science-এ একটি প্রবন্ধ প্ৰকাশ করেছিলেন। তিনি প্রস্তাব দেন
যে শুক্রের বায়ুমণ্ডলে শৈবাল মানে শ্যাওলা চাষ করা যেতে পারে। শ্যাওলা কার্বন ডাই
অক্সাইড থেকে অক্সিজেন তৈরি করবে। তার ফলে গ্রিনহাউজ এফেক্টের মাত্রা কমে
তাপমাত্রা কমবে। পরে অবশ্য যখন আরো খবর শুক্র সম্পর্কে পাওয়া গেল, তখন বোঝা গেল যে শুক্রে বায়ুমণ্ডলের পরিমাণ এত বেশি
যে এই পদ্ধতি কাজ করবে না। শুধু তাপমাত্রা কমালে চলবে না, বায়ুমণ্ডলের পরিমাণও কমাতে হবে।
তাপমাত্রা কমানোর এক অত্যন্ত আকৰ্ষণীয় উপায় হল পুরো গ্রহকেই
ছায়া আনা যাতে সূর্যের আলো গ্রহে পৌঁছতে না পারে। এর জন্য গ্রহ আর সূর্যের
মাঝখানে রাখতে হবে এক বিরাট পাতলা প্রতিফলক যাকে আবার সৌর শক্তি তৈরিতেও ব্যবহার
করা যাবে। একে করতে হবে অত্যন্ত পাতলা, তা না হলে কয়েক লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড় প্রতিফলক বানাতে
যে পরিমাণ কাঁচামাল লাগবে তা যোগাড় করা যাবে না। গবেষণা যদিও চলছে, কিন্তু ঐরকম প্রতিফলক এখনো সায়েন্স ফিকশনের বাইরে
পাওয়া যাবে না। তার উপর যতই পাতলা হোক না কেন, শুধুমাত্র আয়তনের কথা চিন্তা করলে বোঝা যায় যে পৃথিবী
থেকে এই পরিমাণ উপকরণ শুক্রে নিয়ে যেতে খরচা পোষাবে না। তাই উৎস হিসাবে কাছাকাছির
ধূমকেতুদের ব্যবহার করা যেতে পারে। তা না হলে গ্রহাণুপুঞ্জ থেকে কোনো গ্রহাণু ধরে
আনা যেতে পারে। শুনে হয়তো মনে হচ্ছে, গ্রহাণুপুঞ্জ তো পৃথিবীর থেকেও অনেক বেশি দূরে, তা হলে সেখান থেকে আনতে খরচ কম পড়বে কেন? আসলে খরচের অধিকাংশটাই পড়ে মাধ্যাকর্ষণ বল কাটিয়ে
উঠতে। পৃথিবী থেকে ভরকে মহাকাশে তুলতেই খরচ সবচেয়ে বেশি। এই উপায়ে সে সমস্যা নেই।
বর্তমান প্রযুক্তির কথা চিন্তা করলে বায়ুমণ্ডলে বিরাট সংখ্যায় প্রতিফলক বেলুন
ব্যবহার করা যেতে পারে।
বায়ুমণ্ডলের পরিমাণ কমানোর কোনো উপায় আছে কি? বুধ বা কোনো গ্রহাণু থেকে ক্যালসিয়াম বা
ম্যাগনেসিয়াম বায়ুমণ্ডলে ফেলে ঐ মৌলের কার্বনেট যৌগ গঠন করা সম্ভব। এগুলি কঠিন
পদার্থ, তাই এরা মাটিতে পড়ে যাবে ও
বায়ুর পরিমাণ কমবে। আর এক উপায় হল হাইড্রোজেনের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইডের
বিক্রিয়া করে জল বানানো। হাইড্রোজেন পাওয়া যেতে পারে বৃহস্পতির মতো গ্যাস দানব
গ্রহদের থেকে। কার্বন মৌল রূপে মুক্ত হবে। এর ফলে গ্রহের আশি শতাংশ অঞ্চল অগভীর সমুদ্রের তলায় চলে
যাবে। সত্যি হবে আসিমভের ওসেনস অফ ভেনাসের গল্পটা। তবে সমস্যা হল ঐ বিশাল পরিমাণ
কার্বনকে কী করা হবে? মুক্ত কার্বন
অত্যন্ত দাহ্য পদার্থ। সে বিষয়েও চিন্তা চলছে।
সম্পূর্ণ অন্য এক কথাও বিজ্ঞানীরা ভেবেছেন। শুক্রের মাটিকে
মানুষের বাসযোগ্য করা শেষ পর্যন্ত খরচের দিক থেকে লাভজনক নাও হতে পারে। জিওফ্রে লান্ডিস
নামে এক বিজ্ঞানী প্ৰস্তাব দেন হাওয়াতে ভাসমান শহরের। শুনে আশ্চর্য লাগছে? তিনি দেখান যে আমাদের পৃথিবীর যে বায়ু, তা শুক্রের বায়ুর চেয়ে অনেক হালকা। তাই ঠিক যেমন
হালকা গ্যাস ভর্তি বেলুন হাওয়ায় ভেসে থাকে, তেমনি যদি চারদিক থেকে বন্ধ বড় বাসস্থান বানিয়ে যদি পৃথিবীর
মত বায়ু দিয়ে ভর্তি করা যায়,
তা শুক্রের
বায়ুতে ভেসে থাকবে। মাটি থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার উপরে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা
শূন্য থেকে পঞ্চাশ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। সেখানে শুক্রের বায়ুচাপও
পৃথিবীর মাটিতে চাপের সঙ্গে সমান। তাই বাসস্থানে কোনো ফুটো হলেও ভিতরের হাওয়া খুব
আস্তে আস্তে বেরোবে। সুতরাং মেরামত করার সময় পাওয়া যাবে। এধরনের বাসস্থান যেখানে
বদ্ধ স্থানে মানুষের থাকার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হবে তাদের বলে হ্যাবিট্যাট। যদি ক্রমশ
বেশি বেশি সংখ্যায় এমন বাসস্থান তৈরি হয়, তারাও আস্তে আস্তে শুক্রকে পরিবর্তন করতে পারবে।
শিল্পীর
কল্পনায় শুক্রের আকাশে ভাসমান শহর (চিত্র: NASA)
শুক্রকে বাসোপযোগী করা এক সত্যিকারের চ্যালেঞ্জ। সৌরজগতে অন্য যে গ্রহ নিয়ে এত চিন্তাভাবনা হয়েছে, তা হল মঙ্গল। সেখানে কিন্তু তুলনায় সমস্যাটা অনেক
সোজা। আমাদের বর্তমানে জানা প্রযুক্তি ব্যবহার করেই মঙ্গলের পার্থিবীকরণ সম্ভব।
সমস্যাটা শুধুমাত্ৰ কত বড় আকারে তার প্রয়োগ করা যাবে। সেই কথা ‘মঙ্গলগ্রহে মানুষ (এখনও) থাকে না’ লেখাটায় পাবে। শুক্রে কিন্তু প্রযুক্তিও
এখনো আমাদের নাগালের প্রায় বাইরে। তার জন্য অবশ্য আলোচনা থেমে নেই। অনেক
বিজ্ঞানীর মতে পার্থিবীকরণের চেষ্টা অনৈতিক। আমরা ভবিষ্যতে অন্য ধরনের প্রাণের সম্ভাবনা নষ্ট করে
দেব। আবার এক দল বিজ্ঞানীর মতে সৌরজগতের এই মাঝবয়সেও যখন পৃথিবী ছাড়া অন্য কোথাও
উন্নত প্রাণের উদ্ভব হয়নি, তখন আর তা
হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এদিকে পৃথিবী মানুষের একমাত্র বাসস্থান হলে ভবিষ্যতে
সমস্যা হতে পারে। পরমাণু যুদ্ধ বাঁধলে বা যদি কোনো বড় গ্রহাণু বা ধূমকেতু
পৃথিবীকে ধাক্কা মারলে মানুষ লোপ পেয়ে যেতে পারে। অনেকদিন আগে এরকমই এক গ্রহাণুর
সঙ্গে পৃথিবীর সংঘাতে পৃথিবীর আবহাওয়ার যে পরিবর্তন ঘটেছিল, তা ডাইনোসরদের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল বলে অধিকাংশ
বিজ্ঞানী মনে করেন। পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনো বাসস্থান সেরকম কোনো ঘটনাতে
মানুষজাতিকে অন্তত সম্পূর্ণ লুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করবে ।
তবে শুক্রকে বাসযোগ্য করা দীর্ঘসময়ের পরিকল্পনা – এই মুহূর্তে তা নিয়ে না ভাবলেও চলবে। কিন্তু শুক্রের
বহু রহস্যের উদঘাটন হয়তো অল্পদিনের মধ্যেই করা সম্ভব। ছোটরা, যারা এই লেখা পড়ছ, তোমরা যখন বড় হবে, কয়েকজন নিশ্চয় গ্রহনক্ষত্র এই সমস্ত বিষয়ে গবেষণা
করবে। ভেনাস এক্সপ্রেসের মতো অভিযান ভবিষ্যতে আরো হবে। মঙ্গল বা প্লুটোতে
অভিযানের কথা এখানে পড়তে পার। এরকম অনেক খবর সারা সৌরজগতের থেকে আসবে আগামী
দিনে।
তোমাদের কেউ
নিশ্চয় তখন আমাদের প্রতিবেশী এই গ্রহদের রহস্য সমাধানে মানুষকে সাহায্য করবে।
প্রথম প্রকাশঃ এখন পর্যাবরণ ফেব্রুয়ারি ২০০৬, পুনর্লিখিত জুন ২০১৯
No comments:
Post a Comment