গ্যালিলিও ও আধুনিক যুগ
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
পৃথিবীর
ইতিহাসে ২০০৯ সাল বহু স্মরণীয় ঘটনার জয়ন্তী হিসাবে চিহ্নিত। চারশো বছর আগে বিজ্ঞানী
জোহানেস কেপলার প্রকাশ করেন গ্রহদের গতিবিধি সংক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত দুটি সূত্র। এই
নিয়মগুলি জানা না থাকলে নিউটনের পক্ষে মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার করা কঠিন হতো। দুশো
বছর আগে ১৮০৯ সালে চার্লস ডারউইন জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে প্রকাশিত
হয়েছিল বিবর্তন তত্ত্ব সংক্রান্ত তাঁর সেই চিরস্মরণীয় গ্রন্থ যার সংক্ষিপ্ত নাম অরিজিন
অফ স্পিসিস। মানুষের চিন্তার ইতিহাসে এই বইয়ের প্রভাব যে কতখানি, তা আজ আর কাউকে বলার
দরকার নেই। ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞানী হোমি ভাবারও জন্মশতবার্ষিকী এ বছর পালিত হচ্ছে।
ডারউইনের
বিবর্তনতত্ত্বের মতোই আরেক এক যুগান্তকারী ঘটনার জয়ন্তী পালিত হচ্ছে এই বছর। ঠিক চারশ
বছর আগে ইতালির এক বিজ্ঞানী খবর পেয়েছিলেন যে, হল্যান্ডে লিপার্শে নামের এক চশমার
দোকানদার দুটি লেন্স ব্যাবহার করে দূরের জিনিসকে বড় করে দেখার এক যন্ত্র বানিয়েছেন।
সেই বিজ্ঞানী তখন পদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। শোনা মাত্র তিনি ঠিক করলেন যে তিনি
ঐরকম এক যন্ত্র বানাবেন। বানিয়েও ফেললেন, আর তারপর তার মুখ আকাশের দিকে ফেরালেন। যন্ত্রে
চোখ রাখার সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর আধুনিক যুগের সূচনা ঘটল। সেই বিজ্ঞানীর নাম গ্যালিলিও
গ্যালিলি, আর তাঁর যন্ত্রের নাম দূরবিন।
জাস্টাস সুস্টেরমানস অঙ্কিত গ্যালিলিওর প্রতিকৃতি
|
গ্যালিলিওর জন্ম হয় ১৫৬৪ সালের
১৫ই ফেব্রুয়ারি, ইতালির পিসাতে। তাঁর বাবা ভিনসেঞ্জো গ্যালিলি ছিলেন এক সঙ্গীতজ্ঞ।
গ্যালিলিও যেমন বিজ্ঞানের আধুনিক যুগের সূচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয়, তেমনি ইউরোপের
সঙ্গীতের মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে আনার ব্যাপারে ভিনসেঞ্জোর ভূমিকাও কম নয়। গ্যালিলিওর
প্রথম পড়াশোনা হয় ফ্লোরেন্সের কাছে ভ্যালেমব্রোসার কাছে এক খ্রিস্টান মঠের স্কুলে।
তখন গোটা ইউরোপেই পড়াশোনা এই রকম স্কুলেই হতো। একটু বড়ো হলে ১৫৮১ সালে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে
ডাক্তারি পড়তে ভর্তি হলেন গ্যালিলিও। ডাক্তারি কেন? কারণ তখন পেশার মধ্যে শুধু ডাক্তারিতেই
উপাৰ্জন একটু ভালো ছিল।
কিন্তু ডাক্তার হওয়া গ্যালিলিওর হলো না। একবার বিজ্ঞান এবং অঙ্ক পড়া শুরু করার পরে তাঁর মনে হলো যে এ দুটি বিষয় নিয়েই তিনি জীবন কাটাবেন। ১৫৮৫ সালে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেন, কোনো ডিগ্রিই তাঁর নামের পাশে লেখা ছিল না। ডিগ্রি না। থাকলে কি হবে, তরল ব্যবহার করে ওজন মাপার এক নতুন যন্ত্র এবং সরল দোলক বা পেন্ডুলামের সূত্র আবিষ্কার করার জন্য তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপই তো জীবনে শেষ কথা নয়, আমাদের রবীন্দ্রনাথেরও তো কোনো প্রথাগত ডিগ্রি ছিল না, কিন্তু তাঁর মতো পণ্ডিত দেশে কজন ছিলেন?
কিন্তু ডাক্তার হওয়া গ্যালিলিওর হলো না। একবার বিজ্ঞান এবং অঙ্ক পড়া শুরু করার পরে তাঁর মনে হলো যে এ দুটি বিষয় নিয়েই তিনি জীবন কাটাবেন। ১৫৮৫ সালে তিনি যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়লেন, কোনো ডিগ্রিই তাঁর নামের পাশে লেখা ছিল না। ডিগ্রি না। থাকলে কি হবে, তরল ব্যবহার করে ওজন মাপার এক নতুন যন্ত্র এবং সরল দোলক বা পেন্ডুলামের সূত্র আবিষ্কার করার জন্য তাঁর খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপই তো জীবনে শেষ কথা নয়, আমাদের রবীন্দ্রনাথেরও তো কোনো প্রথাগত ডিগ্রি ছিল না, কিন্তু তাঁর মতো পণ্ডিত দেশে কজন ছিলেন?
পেন্ডুলামের
ঐ সূত্র কিন্তু গ্যালিলিও ল্যাবরেটরিতে বসে আবিষ্কার করেন নি। ১৫৮৩ সালে উনিশ বছর বয়সী
গ্যালিলিও পিসার ক্যাথিড্রালে প্রার্থনা করতে গেছেন। একটা ঝুলন্ত বাতিতে তখন সবে আগুন
দেয়া হয়েছে। গ্যালিলিও দেখলেন যে বাতিটা প্ৰথমে জোরে দুলছিল, আস্তে আস্তে তা থেমে
যাচ্ছে। কিন্তু জোরে বা আস্তে যেমনই দুলুক না কেন, একবার দুলতে একই সময় লাগছে। কেমন
করে মাপবেন? নিজের নাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে নিঃসন্দেহ হলেন। তাঁর তখন মনে হলে – ব্যাপারটা
কি শুধু ঐ বাতিটার জন্যই সত্যি? পরীক্ষা করে দেখলেন যে নিয়মটা সবরকম দোলকের জন্যই
খাটে। এই তাঁর প্রথম সূত্র – সরল দোলকের দোলনকাল তার বিস্তারের উপর নির্ভর করে না,
দোলকটি বেশি বা কম জোরে দুলুক না কেন, একটি পূর্ণ দোলনের জন্য একই সময় লাগে। পরে তিনি
দোলনের আরো দুটি সূত্র আবিষ্কার করেন। পরবর্তীকালে গ্যালিলিওর আবিষ্কারের ও মতামতের
উপর ভিত্তি করে যান্ত্রিক ঘড়ি তৈরি করেন হল্যান্ডের বিখ্যাত বিজ্ঞানী হাইজেন্স। আগেকার
সূর্যঘড়ি, বালিঘড়ি, এসবের থেকে এই নতুন ঘড়ি ছিল অনেক উন্নত – একে ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞানের
এগিয়ে চলা সম্ভব হত না।
কিছুদিন
বাড়িতে ছাত্রদের পড়িয়ে চালালেন, তারপর ১৫৮৯ সালে পিসাতে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ
দেন গ্যালিলিও। তবে চাকরি তাঁর বেশিদিন টেকে নি। প্রাচীন গ্রিসের বিখ্যাত বিজ্ঞানী
ও দার্শনিক অ্যারিস্টটল তখন ছিলেন বিজ্ঞানের শেষ কথা। তাঁর মতের বিরোধিতা করার জন্য
১৫৯২ সালে গ্যালিলিওর চাকরি যায়। কী বলেছিলেন গ্যালিলিও? সে কথায় আমরা পরে আসছি।
পিসাতে জায়গা
না হলেও গ্যালিলিওর কোনো সমস্যা হলো না। ইতালির পদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক পড়ানোর
কাজ তিনি ১৫৯২ সালেই পেলেন। ১৬১০ সাল পর্যন্ত তিনি পদুয়াতে ছিলেন। এই সময় তিনি দোলকের
বাকি সূত্রগুলি আবিষ্কার করেন। কোনো বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে তার বেগ কেমন ভাবে
পাল্টাবে, কত উপর থেকে পড়তে সময় কত লাগবে – এই সংক্রান্ত নিয়মগুলিও তিনি এই সময়ই
প্রতিষ্ঠা করেন। সে সময় একটা সমস্যা নিয়ে অনেক বিজ্ঞানী মাথা ঘামাচ্ছিলেন। কোনো বস্তুকে
উপর দিকে কোণ করে ছুড়ে দিলে সে কোন পথ ধরে যাবে? কামান কোন দিকে তাক করতে হবে, সেটা
জানার জন্য এই অঙ্কটা করা দরকার ছিল। গ্যালিলিও দেখালেন যে বায়ুর ঘর্ষণকে উপেক্ষা
করলে পথটা জ্যামিতির একটা নির্দিষ্ট আকার মেনে চলবে যার নাম অধিবৃত্ত বা parabola।
শুনতে খুব সহজ লাগিলেও সে সময় এই কাজ করা ছিল অত্যন্ত কঠিন। গ্যালিলিওই প্রথম বললেন
যে ঐ বস্তুটার গতি এমন ভাবে দুভাগে ভাগ করে নেয়া যায় যে একটা ভাগের উপর অন্য ভাগের
কোনো প্রভাব থাকে না। এভাবে উপর নিচের গতির ও অনুভূমিক গতিকে আলাদা করার পদ্ধতি তাঁরই
আবিষ্কার। তিনিই প্রথম যিনি বুঝেছিলেন যে পদার্থবিদ্যার সমস্যা সমাধান করতে গেলে অঙ্ক
ছাড়া চলবে না। পদুয়ার পর ফ্লোরেন্স, ১৬১০ সালে সেখানকার শাসনকর্তা মেদিচিদের দরবারে
তিনি গণিতজ্ঞ হিসেবে নিযুক্ত হন।
১৫৪২ সালে কোপার্নিকাস বলেছিলেন
যে সূর্য স্থির, পৃথিবী সহ সমস্ত গ্রহ তাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। কজন তাতে বিশ্বাস করতো?
প্রাচীন কালের বিরাট পণ্ডিত অ্যারিস্টটল বলেছেন। পৃথিবী স্থির, আর এক প্ৰাচীন বিজ্ঞানী
টলেমি তার উপর ভিত্তি করে সৌরজগতের মডেল বানিয়েছেন, তাঁরা কি ভুল করতে পারেন? বিশ্বাস
করতেন গ্যালিলিও, কিন্তু তার প্রচারে তিনি খুব উৎসাহী ছিলেন না। কেপলারকে ১৫৯৭ সালে
একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন যে লোকের ঠাট্টার ভয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোপার্নিকাসের মত
সমর্থন করতে পারছেন না। এমন কোনো উপায় কি নেই যাতে সহজেই সকলের কাছে প্রমাণ করা যায়
কোপার্নিকাসই ঠিক? সুযোগ এলো ১৬০৯ সালে। দূরবিন দিয়ে আকাশের দিকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে এক নতুন
জগৎ যেন তাঁর সামনে খুলে গেলো।
কী দেখেছিলেন গ্যালিলিও? চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন পাহাড় আর গহ্বর। দেখলেন চাঁদের বুকে পড়েছে পৃথিবী থেকে প্রতিফলিত হওয়া সূর্যের আলো। শুক্র গ্রহের দিকে তাকালেন। আমরা পূর্ণিমা ছাড়া অন্যসময় চাঁদকে পুরোপুরি দেখতে পাইনা, শুধু যে অংশে সূর্যের আলো পড়ে সেটুকু দেখি। একে বলে চাঁদের কলা। গ্যালিলিও অবাক হয়ে দেখলেন শুক্রগ্রহেরও কলা আছে। সূর্যের দিকে দূরবিন ঘুরিয়ে চোখে পড়ল কালো কালো দাগ যাদের আমরা এখন বলি সৌরকলঙ্ক। দেখলেন অগুন্তি নতুন তারা যাদের খালি চোখে দেখা যেত না। আকাশগঙ্গা তাঁর কাছে আসল রূপে ধরা দিল, দেখলেন যে সাদা ঐ পথ আসলে অগুন্তি তারার সমষ্টি। গ্যালিলিওর জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের উপহার নিয়ে এল। বৃহস্পতি গ্ৰহ। দেখলেন তার চারদিকে চারটি চাঁদ যারা বৃহস্পতিকে প্ৰদক্ষিণ করছে। চোখের সামনে দেখতে পেলেন কোপার্নিকাসের সৌরজগত।
তোমাদের মনে হতেই পারে এ আর নতুন কথা কী? কোপার্নিকাস। তো কবেই বলে গেছেন যে সূর্য স্থির, পৃথিবী তাকে প্ৰদক্ষিণ করে। কিন্তু আগেই বলেছি কোপার্নিকাসের মত খুব একটা প্রভাব ফেলে নি। তার কারণ সাধারণ মানুষ সহজে বুঝবে এমন কোনো প্রমাণ কোপার্নিকাসের তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়নি। বরঞ্চ বিপক্ষের লোকরা অনেক কথাই বলতেন, যার কোনো উত্তর দেয়া যেত না। এবার গ্যালিলিও অনেক প্রশ্নের জবাব নিয়ে এলেন। বিরুদ্ধবাদী পণ্ডিতরা বলতেন যে পৃথিবী অন্য গ্রহদের থেকে আলাদা, কারণ তাদের আলো আছে, পৃথিবীর নেই। গ্যালিলিও দেখলেন পৃথিবীও নিশ্চয় আলো দেয়, যা চাঁদের উপর পড়ে। কিন্তু আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি পৃথিবীর আলো নেই। গ্যালিলিও বুঝলেন কোনো গ্রহেরই নিজের আলো নেই, সূর্যের আলো যেখানে পড়ে না সেই জায়গা অন্ধকার থাকে। তাই তো আমরা শুক্রের চাঁদের মতো কলা দেখতে পাই। তাই পৃথিবী ও অন্য গ্রহদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, সূর্যের আলোর প্রতিফলনেই তাদের সকলের ঔজ্জ্বল্য। শুধু তাই নয়, তিনি দেখান যে শুক্রের কলার যে বাড়া কমা দেখা যায়, তা টলেমির সৌরজগতের মডেলে ব্যাখ্যা করতে পারে না। তিনি এও দেখালেন যে পৃথিবীকে চলমান ধরে নিলেই এক মাত্র সহজে বৃহস্পতির চাঁদদের গ্রহণের সময় বার করা যায়।
কী দেখেছিলেন গ্যালিলিও? চাঁদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন পাহাড় আর গহ্বর। দেখলেন চাঁদের বুকে পড়েছে পৃথিবী থেকে প্রতিফলিত হওয়া সূর্যের আলো। শুক্র গ্রহের দিকে তাকালেন। আমরা পূর্ণিমা ছাড়া অন্যসময় চাঁদকে পুরোপুরি দেখতে পাইনা, শুধু যে অংশে সূর্যের আলো পড়ে সেটুকু দেখি। একে বলে চাঁদের কলা। গ্যালিলিও অবাক হয়ে দেখলেন শুক্রগ্রহেরও কলা আছে। সূর্যের দিকে দূরবিন ঘুরিয়ে চোখে পড়ল কালো কালো দাগ যাদের আমরা এখন বলি সৌরকলঙ্ক। দেখলেন অগুন্তি নতুন তারা যাদের খালি চোখে দেখা যেত না। আকাশগঙ্গা তাঁর কাছে আসল রূপে ধরা দিল, দেখলেন যে সাদা ঐ পথ আসলে অগুন্তি তারার সমষ্টি। গ্যালিলিওর জন্য সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের উপহার নিয়ে এল। বৃহস্পতি গ্ৰহ। দেখলেন তার চারদিকে চারটি চাঁদ যারা বৃহস্পতিকে প্ৰদক্ষিণ করছে। চোখের সামনে দেখতে পেলেন কোপার্নিকাসের সৌরজগত।
তোমাদের মনে হতেই পারে এ আর নতুন কথা কী? কোপার্নিকাস। তো কবেই বলে গেছেন যে সূর্য স্থির, পৃথিবী তাকে প্ৰদক্ষিণ করে। কিন্তু আগেই বলেছি কোপার্নিকাসের মত খুব একটা প্রভাব ফেলে নি। তার কারণ সাধারণ মানুষ সহজে বুঝবে এমন কোনো প্রমাণ কোপার্নিকাসের তত্ত্ব থেকে পাওয়া যায়নি। বরঞ্চ বিপক্ষের লোকরা অনেক কথাই বলতেন, যার কোনো উত্তর দেয়া যেত না। এবার গ্যালিলিও অনেক প্রশ্নের জবাব নিয়ে এলেন। বিরুদ্ধবাদী পণ্ডিতরা বলতেন যে পৃথিবী অন্য গ্রহদের থেকে আলাদা, কারণ তাদের আলো আছে, পৃথিবীর নেই। গ্যালিলিও দেখলেন পৃথিবীও নিশ্চয় আলো দেয়, যা চাঁদের উপর পড়ে। কিন্তু আমরা তো দেখতেই পাচ্ছি পৃথিবীর আলো নেই। গ্যালিলিও বুঝলেন কোনো গ্রহেরই নিজের আলো নেই, সূর্যের আলো যেখানে পড়ে না সেই জায়গা অন্ধকার থাকে। তাই তো আমরা শুক্রের চাঁদের মতো কলা দেখতে পাই। তাই পৃথিবী ও অন্য গ্রহদের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই, সূর্যের আলোর প্রতিফলনেই তাদের সকলের ঔজ্জ্বল্য। শুধু তাই নয়, তিনি দেখান যে শুক্রের কলার যে বাড়া কমা দেখা যায়, তা টলেমির সৌরজগতের মডেলে ব্যাখ্যা করতে পারে না। তিনি এও দেখালেন যে পৃথিবীকে চলমান ধরে নিলেই এক মাত্র সহজে বৃহস্পতির চাঁদদের গ্রহণের সময় বার করা যায়।
অ্যারিস্টটলের
মত খণ্ডন করতে গিয়ে গ্যালিলিও বলবিদ্যার জগতে যুগান্তর নিয়ে আসেন। অ্যারিস্টটলপন্থীরা
প্রশ্ন করতেন যে পৃথিবী যদি চলমান হয়, তাহলে কোনো বস্তুকে উপর থেকে ছেড়ে দিলে তা
ঠিক নিচে পড়বে কেন, তার তো পিছিয়ে যাওয়া উচিত। তাঁরা জানতে চাইলেন, পৃথিবী যদি গতিশীল
হয়, তাহলে চাঁদ কেমন করে পৃথিবীর সঙ্গে সবসময় থাকে? গ্যালিলিও তাদের বললেন, যে বৃহস্পতি
যদি চারটি চাঁদকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারে, তাহলে পৃথিবী কেন পারবে না? তিনি উদাহরণ দিলেন
যে চলমান জাহাজের মাস্তুল থেকে কোনো বস্তুকে নিচে ফেললে তা মাস্তুলের গোড়াতেই পড়ে,
জাহাজের গতির জন্য পিছন দিকে চলে যায় না। তেমনি পৃথিবীতে পতনশীল বস্তু সোজা নিচের
দিকেই পড়ে, পিছিয়ে যায় না। পরীক্ষার মাধ্যমে সবাইকে তিনি দেখিয়ে দিলেন, তিনিই ঠিক
বলছেন।
গ্যালিলিওর
দূরবিন চিন্তার জগতে বিপ্লব এনে দিল। যদি বৃহস্পতির চারদিকে প্ৰদক্ষিণ করতে পারে কোনো
চাঁদ, তাহলে পৃথিবীই কেন্দ্রে আর সমস্ত কিছুই পৃথিবীকে প্ৰদক্ষিণ করে, একথা আর বলা
যাবে না। দূরবিন দিয়ে আকাশের দিকে তাকানোর পরে তাঁর মনে হলো যে কোপার্নিকাসের মতের
পক্ষে প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখন তাঁর নাগালের মধ্যে। সবাইকে তা জানানোর জন্য তাই ১৬১০ সালে
বেরোল তাঁর বই, 'তারকাজগতের দূত'। বই ছাপার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচুর বিক্রি হতে
লাগল। চারদিকে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল, আর সাধারণ মানুষের কাছেও পৌঁছে গেল বিশ্ব
ব্ৰহ্মাণ্ডের এই নতুন চিত্র।
গ্যালিলিও
চিন্তার জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন বললে একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না। বিশ্ব ব্ৰহ্মাণ্ড
সম্পর্কে মূলত অ্যারিস্টটলের মতকেই মেনে নিত এত দিন মানুষ। প্লেটো, অ্যারিস্টটল বা
পরবর্তী কালে খ্রিস্টান দার্শনিকদের মতে আকাশে যা দেখা যাচ্ছে, তা হল স্বর্গের অংশ।
সেই কারণেই তারা ত্রুটিহীন, নিখুঁত। তার কোনো পরিবর্তন হবে না, কারণ তার কোনো উন্নতি
করা সম্ভব নয়। সেজন্য নক্ষত্রের জন্ম মৃত্যু হয় না, তাদের নিজেদের মধ্যে আপেক্ষিক
অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়না। কেমন করে জানব যে তারা স্বর্গের অংশ? অ্যারিস্টটল
বলেছিলেন যে কোনো চলমান বস্তুর উপর বল প্রয়োগ না করলেও সে নিজে থেকেই থেমে যাবে। কারণ
স্থিতাবস্থা হল পৃথিবীর কোনো বস্তুর স্বাভাবিক অবস্থা। গ্ৰহ নক্ষত্ররা চিরকাল
চলমান, কারণ তারা পৃথিবীর নিয়ম নীতির ঊর্ধ্বে। বুঝতেই পারো যারা চায় না যে সমাজে
কোনো পরিবর্তন হোক, রাজা, জমিদার বা যাজকের মতো সমাজের মাথারা, তারা এই স্থিতাবস্থার
ধারণাকে খুব পছন্দ করবে।
শুধু কোপার্নিকাসকে সমর্থন
করেই থামলেন না গ্যালিলিও। তিনি দেখালেন যে বস্তুর গতিতে স্থিতাবস্থার আলাদা করে কোনো
গুরুত্ব নেই। অসাধারণ কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে তিনি দেখালেন যে ঘর্ষণ বা অন্য কোনো
বল না থাকলে সচল বস্তু চিরকাল সচল থাকবে। তাই আকাশের গ্রহ তারার মধ্যে আলাদা করে কোনো
বৈশিষ্ট্য নেই। একই নিয়মে সমস্ত কিছু চালিত হয়। এমন ভাবে কোপার্নিকাস ও গ্যালিলিওর
মত প্রচারের সঙ্গে সঙ্গেই দুহাজার বছরের এই পুরনো সমাজব্যবস্থায় ফাটল ধরল।
গ্রহ নক্ষত্রদের আর স্বর্গের অংশ বলা যাচ্ছে না। তারা নিখুঁত নয় – গ্যালিলিও দূরবিন দিয়ে চাঁদের পাহাড় আর গহ্বর, সূর্যের কলঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছেন। তাহলে আর স্বর্গ এই মাটির পৃথিবীর থেকে আলাদা কোথায়? গ্যালিলিও আগেই দেখিয়েছিলেন যে আকাশের নক্ষত্ররা চিরকাল একই রকম থাকে না। ১৬০৪ সালে এক নতুন তারা আকাশে দেখা যায়। আজ আমরা জানি, যে তা ছিল এক তারকার মৃত্যু বা নোভা বিস্ফোরণের চিহ্ন। অ্যরিস্টটলপন্থীরা বললেন যে নতুন তারাটা নিশ্চয় পৃথিবীর খুব কাছে, কারণ তাদের মতে স্বর্গের তো কোনো পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। গ্যালিলিও দূরত্ব হিসেব করে বললেন সেটি গ্রহদের থেকে অনেক দূরে আছে, তাকে কোনোভাবেই আমাদের সৌরজগতের অংশ হিসেবে ভাবা যাবে না। তাই স্বৰ্গও অপরিবর্তনীয় বা চিরস্থায়ী নয়। স্বর্গে যদি পরিবর্তন হতে পারে, তাহলে পৃথিবীতে এক দলের লোকই চিরকাল রাজত্ব করবে। কেন? স্বর্গীয় নিয়মের দোহাই দিয়ে যে ধর্মযাজকরা বা রাজারাজড়ারা সমাজে কর্তৃত্ব করছেন, তাদের পক্ষে এতো মহা সর্বনাশের কথা! তাই সমাজপতিরা গ্যালিলিওর বিচার করে তাঁকে শাস্তি দিয়েছিলেন। সে কথা পরে বলছি।
গ্রহ নক্ষত্রদের আর স্বর্গের অংশ বলা যাচ্ছে না। তারা নিখুঁত নয় – গ্যালিলিও দূরবিন দিয়ে চাঁদের পাহাড় আর গহ্বর, সূর্যের কলঙ্ক দেখিয়ে দিচ্ছেন। তাহলে আর স্বর্গ এই মাটির পৃথিবীর থেকে আলাদা কোথায়? গ্যালিলিও আগেই দেখিয়েছিলেন যে আকাশের নক্ষত্ররা চিরকাল একই রকম থাকে না। ১৬০৪ সালে এক নতুন তারা আকাশে দেখা যায়। আজ আমরা জানি, যে তা ছিল এক তারকার মৃত্যু বা নোভা বিস্ফোরণের চিহ্ন। অ্যরিস্টটলপন্থীরা বললেন যে নতুন তারাটা নিশ্চয় পৃথিবীর খুব কাছে, কারণ তাদের মতে স্বর্গের তো কোনো পরিবর্তন হওয়া সম্ভব নয়। গ্যালিলিও দূরত্ব হিসেব করে বললেন সেটি গ্রহদের থেকে অনেক দূরে আছে, তাকে কোনোভাবেই আমাদের সৌরজগতের অংশ হিসেবে ভাবা যাবে না। তাই স্বৰ্গও অপরিবর্তনীয় বা চিরস্থায়ী নয়। স্বর্গে যদি পরিবর্তন হতে পারে, তাহলে পৃথিবীতে এক দলের লোকই চিরকাল রাজত্ব করবে। কেন? স্বর্গীয় নিয়মের দোহাই দিয়ে যে ধর্মযাজকরা বা রাজারাজড়ারা সমাজে কর্তৃত্ব করছেন, তাদের পক্ষে এতো মহা সর্বনাশের কথা! তাই সমাজপতিরা গ্যালিলিওর বিচার করে তাঁকে শাস্তি দিয়েছিলেন। সে কথা পরে বলছি।
গ্যালিলিও
শুধুমাত্র আকাশের জ্যোতিষ্কদের উপর গবেষণাতেই সন্তুষ্ট রইলেন না। পরীক্ষানিরীক্ষার
মাধ্যমে বিভিন্ন পার্থিব ঘটনার সম্পর্কে অনুসন্ধান করলেন গ্যালিলিও। এও আর এক নতুন
চিন্তাধারা। পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়েই বিশ্বজগত সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে
হবে, প্রাচীন দর্শনের বই পড়ে তা সম্ভব নয় – গ্যালিলিওর এই মত স্থিতাবস্থার দর্শনের
একেবারে মূলেই কুঠারাঘাত করল। অ্যারিস্টটল বলেছিলেন যে দুটি পতনশীল বস্তুর মধ্যে ভারী
বস্তুটি আগে মাটিতে পড়বে। তার পর প্রায় দু হাজার বছর পণ্ডিতরা প্ৰায় কেউই এর বিরোধিতা
করেননি। এগিয়ে এলেন গ্যালিলিও। তিনি বললেন যে বাতাসের ঘর্ষণকে উপেক্ষা করলে দুটি বস্তুই
একই সঙ্গে নীচে পড়বে। তাঁর আগে যে এ বিষয়ে অ্যারিস্টটলের মতের সমালোচনা কেউ করেন
নি তা নয়, কিন্তু গ্যালিলিও প্রথম প্রকাশ্যে পরীক্ষাটা করেও দেখালেন। তোমরা সবাই নিশ্চয়
পিসার হেলানো মিনারের উপর থেকে দুটি বল ফেলে করা তাঁর পরীক্ষার গল্প শুনেছ। যদিও সত্যিই
গ্যালিলিও ঐ মিনারেই পরীক্ষাটা করেছিলেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে, তবে আমরা জানি
যে তিনি বিভিন্ন টাওয়ারের উপর থেকে দুরকম ওজনের বল ফেলে তাঁর ছাত্রদের দেখাতেন।
ঠিক কোন সময় থেকে গ্যালিলিও প্রকাশ্যে অ্যারিস্টটলের বিরোধিতা শুরু করেন বলা কঠিন,
তবে অনেকেই মনে করেন যে এই কারণেই পিসার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্যালিলিওর চাকরি গিয়েছিল।
পতনশীল বস্তুর
গতি সংক্রান্ত মাপজোক করা সে সময় নির্ভুল ভাবে সরাসরি করা ছিল কঠিন, তাই গ্যালিলিওকে
পরোক্ষ পদ্ধতির সাহায্য নিতে হয়েছিল। তিনি একটি মসৃণ নততলে একটি বল গড়িয়ে পরীক্ষা
করেন। তখন গতিবিদ্যার শৈশব অবস্থা, তাই গ্যালিলিওর পক্ষে জানা সম্ভব হয় নি যে তাঁর
পরীক্ষাতে বলের ঘূর্ণনের হিসাব ধরতে হবে। তাই গ্যালিলিওর মাপে অনেক ভুল ছিল, কিন্তু
তার জন্য তাঁর কৃতিত্বকে বিন্দুমাত্র ছোটো করা যাবে না। প্রকল্প বা হাইপোথিসিস উত্থাপন
ও পরীক্ষার মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই করার যে পদ্ধতি গ্যালিলিও শুরু করেছিলেন, তা আধুনিক
বিজ্ঞানের এক মূল স্তম্ভ।
গ্যালিলিওর
মতে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রমাণ ছাড়া কোনো কিছুই স্বীকার করা যাবে না। তাঁর সময়ের
দর্শনের পণ্ডিতরা দূরবিন দিয়ে তাকাতেই রাজি হলেন না। কারণ তাঁরা তো চিন্তাভাবনা করেই
ব্ৰহ্মাণ্ডটা কেমন তা জেনে গেছেন, সেখানে প্রত্যক্ষ প্রমাণের কোনো প্রয়োজন নেই। পক্ষান্তরে
পতনশীল বস্তুর গতি সম্পর্কে গ্যালিলিওর নিজের প্রথমে যে মত ছিল, পরীক্ষার ফল দেখে তার
পরিবর্তন করতে হয়। অর্থাৎ চিন্তা করে বিশ্ব সম্পর্কে জানা যাবে না, বাস্তবে যেটা দেখা
যাচ্ছে সেটাকেই ঠিক বলে মেনে নিতে হবে। এই মত ছড়িয়ে পড়লে কি লোকে আর ধর্মগ্রন্থ
বা প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থাকে বিনা প্রশ্নে মেনে নেবে?
তাই সহজে
সমাজ গ্যালিলিওকে মেনে নেয় নি। শুধু তো অ্যারিস্টটলের বিরোধিতা নয়, তিনি তো সমস্ত
প্রতিষ্ঠিত চিন্তাভাবনাকেই অস্বীকার করছেন। তার উপর গ্যালিলিও আবার তাঁর মত ১৬৩২
সালে ইতালিয়ান ভাষাতে প্রকাশ করলেন, সেকালের পণ্ডিতদের মতো সাধারণের অবোধ্য ল্যাটিন ভাষাতে নয়। সাধারণ মানুষের তাই সত্যি কথাটা জানতে কোনো অসুবিধা হলো না। গ্যালিলিও
নিজে কিন্তু খ্রিস্টধর্মে গভীর বিশ্বাস রাখতেন। তিনি শুধু চেয়েছিলেন যে ধর্ম তার নিজের
জায়গায় থাকুক, তা যেন বাস্তব জগতে হস্তক্ষেপ না করে। বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের বর্ণনা কোপার্নিকাস
আর টলেমির মধ্যে কে ঠিকঠাক করেছেন, তা বাইবেল ঠিক করে দেবে না। কিন্তু সে সময়ের সমাজের
যাঁরা মাথা, তাঁরা গ্যালিলিওর লেখা পড়ে প্ৰমাদ গুনলেন। ধর্ম তাদের কাছে প্রচলিত ব্যবস্থাকে
বজায় রাখার হাতিয়ার, তাকে বাস্তব জগত থেকে বিচ্ছিন্ন করলে তাঁদের সেই অস্ত্রটাই অকেজো
হয়ে যাবে।
তাই রোমান ক্যাথলিক চাৰ্চ শুরু করল গ্যালিলিও বিচার। প্ৰায় সত্তর বছরের বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে রোমে ডেকে পাঠানো হলো। বিচারে পরে তাঁকে বাকী জীবন বন্দী থাকার শাস্তি দেওয়া হলো। শুধুমাত্র সমকালীন বিজ্ঞানী মহলে তাঁর প্রভাবের জন্যই তাঁকে ব্রুনোর মতো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। তাঁকে দিয়ে জোর করে বলিয়ে নেয়া হলো যে তিনি ভুল বলেছিলেন। তাঁকে ফ্লোরেন্সে গৃহ বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর মতকে ভুল বলে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন যে গ্যালিলিওকে শাস্তি দেওয়ার জন্য জাল নথিপত্র পেশ করা হয়েছিলো।
তাই রোমান ক্যাথলিক চাৰ্চ শুরু করল গ্যালিলিও বিচার। প্ৰায় সত্তর বছরের বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে রোমে ডেকে পাঠানো হলো। বিচারে পরে তাঁকে বাকী জীবন বন্দী থাকার শাস্তি দেওয়া হলো। শুধুমাত্র সমকালীন বিজ্ঞানী মহলে তাঁর প্রভাবের জন্যই তাঁকে ব্রুনোর মতো মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়নি। তাঁকে দিয়ে জোর করে বলিয়ে নেয়া হলো যে তিনি ভুল বলেছিলেন। তাঁকে ফ্লোরেন্সে গৃহ বন্দী করে রাখা হয় এবং তাঁর মতকে ভুল বলে ঘোষণা করা হয়। পরবর্তী ঐতিহাসিকরা দেখিয়েছেন যে গ্যালিলিওকে শাস্তি দেওয়ার জন্য জাল নথিপত্র পেশ করা হয়েছিলো।
১৬৩৩ সালের সেই বিচার আজ ইতিহাস,
১৯৯২ সালে রোমান ক্যাথলিক চার্চ ঘোষণা করেছে যে গ্যালিলিওর বিচার আসলে দু পক্ষের ভুল
বোঝাবুঝির ফল। বুঝতে অসুবিধা নেই যে গ্যালিলিও চার্চকে ভুল বোঝেন নি, প্রতিষ্ঠিত ধর্ম
গ্যালিলিওর মতো লোকদের বুঝতে চিরকালই অক্ষম। তবে সত্যকে অস্বীকার করলেই তো আর তা মিথ্যা
হয়ে যাবে না। তাই পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের যে ভিত্তি স্থাপন গ্যালিলিও করলেন, তার উপরই
আধুনিক বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে। গ্যালিলিওকে শাস্তি দেবার ফলে সমাজপতিরা যা চেয়েছিলেন,
হলো ঠিক তার উল্টো। সমকালীন বিজ্ঞানী মহলে তাঁর খ্যাতি ও প্রভাব ছিল সবার উপরে। তাঁর
পরিণতি দেখে বিজ্ঞানীরা ধর্মের কর্তৃত্ব সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লেন। তাই বিজ্ঞানের
উপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মের প্রভাব হ্রাসের সূচনা হিসাবে ১৬০৯ সালকে চিহ্নিত করা যেতে পারে।
শেষ জীবনে
অর্থাৎ ১৬৩৭ সালে গ্যালিলিও অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। গৃহবন্দী অন্ধ বিজ্ঞানীর গবেষণাতে
বিন্দুমাত্র ভাঁটা পড়েনি, ইউরোপের অন্য বিজ্ঞানীদের সঙ্গে চিঠি মারফত মত বিনিময় করেছেন।
১৬৩৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গতিবিদ্যা সংক্রান্ত নতুন বই। তিনি যে পর্যন্ত অগ্রসর
হয়েছিলেন, পরবর্তীকালে নিউটন সেখান থেকেই গবেষণা শুরু করেন। ১৬৪২ সালের ৮ই জানুয়ারি
গ্যালিলিওর মৃত্যু হয়।
বিজ্ঞানের
ইতিহাসে গ্যালিলিওর সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব কী? তিনি জ্যোতির্বিদ্যাতে নতুন দিগন্ত খুলে
দিয়েছিলেন। গণিত ও পদার্থবিদ্যার মেল বন্ধন ঘটিয়ে আধুনিক পদার্থবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন
করেছিলেন। গতিবিদ্যার সূত্র প্রয়োগ করে জোয়ার ভাটার ব্যাখ্যা দেন ও ভাসমান বস্তুর
উপর গবেষণা করেন। শব্দবিজ্ঞানের সূচনা তাঁর হাতে, তিনি সে বিষয়ে বহু সূত্র আবিষ্কার
করেন এবং তাদের ব্যাখ্যা দেন। তারের বাদ্যযন্ত্র সংক্রান্ত তাঁর গবেষণা আধুনিক যুগকে
মনে করিয়ে দেয়। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের প্রভূত উন্নতিসাধন করেন গ্যালিলিও। এত সত্ত্বেও
তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান সম্ভবত আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ভিত্তি স্থাপন। তিনি কোনো
সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর জন্য পরীক্ষার উপর জোর দেন। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা যে আগের
প্রায় সমস্ত বিজ্ঞানী (আর্কিমিডিস এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম) পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেও তা
অধিকাংশ সময় ছিল দেখানোর জন্য, কোনো কিছু মাপার জন্য নয়। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে
আছে পরীক্ষা নিরীক্ষা ও নিখুঁত পরিমাপের উপর। গ্যালিলিওই এই পদ্ধতির সূচনা করেছিলেন।
বস্তুর গতি বর্ণনা করতে গিয়ে প্রাচীন দার্শনিকরা তার নিজস্ব প্রকৃতির কথা বলতেন, গ্যালিলিও
তার জায়গায় যে ধর্ম দেখা যায়, মাপা যায়, তার উপর জোর দিলেন। তোমরা যারা বড়ো হয়ে
বিজ্ঞান করবে, তারা দেখবে যে এই পদ্ধতি কতখানি আধুনিক। সরল দোলকের দোলনকাল মাপার কথা
আগেই বলেছি। ঠিক তেমনি, চাঁদে পাহাড় দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার উচ্চতা মাপার কাজটাও তিনি
করেন। আকাশে নতুন তারা দেখার সঙ্গে সঙ্গে তার দূরত্ব মাপার চেষ্টা করেন। দুটি বস্তু
একসঙ্গে ফেললে মাটিতে পড়ার সময় তাদের মধ্যে কতখানি ব্যবধান থাকবে সেটা নির্ণয়ের
চেষ্টা করেন। তিনিই প্ৰথম বলেন যে বাতাসের বাধার জন্যই যে তারা একসঙ্গে পড়তে পারছে
না। সৌর কলঙ্ক পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সঙ্গে তার থেকে সূর্যের নিজের চারপাশে ঘুরতে কতো
সময় লাগে সেটা বার করেন। দূরত্ব মেপে দেখান যে সৌরকলঙ্করা সূর্যেরই অংশ। তিনিই প্ৰথম
আলোর বেগ মাপার চেষ্টা করেন যদিও একাজে তিনি সফল হননি। প্ৰথম থার্মোমিটারও তিনি তৈরি
করেন। তাঁর পরামর্শেই তাঁর ছাত্র টরিশেলি বায়ুচাপ মাপার যন্ত্র ব্যারোমিটার তৈরি করেন।
কিন্তু বিজ্ঞানের
বাইরেও যে বিরাট সমাজ আছে, গ্যালিলিও সেখানে মানুষের চিরন্তন প্রচলিত ব্যবস্থার শৃঙ্খল
ভাঙা মুক্ত জিজ্ঞাসার প্রতীক। প্রত্যক্ষ পরীক্ষার উপর নির্ভর করা, প্রাচীন দর্শনকে
প্রমাণ হিসেবে গণ্য না করা, বাস্তব জগত থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করতে চাওয়া, এসমস্ত
চিন্তাধারা নিয়ে গ্যালিলিও প্রথম আধুনিক মানুষ। ১৬০৯ সালে যখন তিনি প্রথম তাঁর নিজের
তৈরি দূরবিনে চোখ রেখেছিলেন, শুধু বিজ্ঞানে নয়, সমাজেও আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছিল
বললে অত্যুক্তি হবে না।
(কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞন
পত্রিকার শারদ ২০০৯ সংখ্যায় প্রকাশিত, পরিমার্জিত)
".......প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে Dialogue অ্যারিস্টটলপন্থীদের দৃষ্টি আকর্ষন করিল।...এই গ্রন্থের প্রধান উদ্দেশ্য যে...কোপার্নিকাসের সূর্যকেন্দ্রীয় জ্যোতিষিয় মতবাদ সমর্থন করা, ইহা কারোও দৃষ্টি এড়াইল না।......অবিলম্বে রোমের ইনকুইজিশন হইতে তলব আসিল। তাঁহার ...বিচার আরম্ভ হয়......এই বিচারে গ্যালিলিও সম্পূর্নরূপে আত্মসমর্পন করেন। দৈহিক নির্যাতন ও ব্রুনোর ভাগ্য চিন্তা করিয়া ৭০ বয়স্ক বৃদ্ধের পক্ষে সম্ভবতঃ আর শহীদ হইবার সাহসে কুলায় নাই..............................শপথ সমাপান্তে উঠিয়া দাঁড়াইবার সময় গ্যালিলিও নাকি বিড় বিড় করিয়া বলিয়াছিলেন, 'E pur si mouve' (তবু ইহা ঘুরিতেছে)..............."
ReplyDelete--------------------------------------------
বিজ্ঞানের ইতিহাস
সমরেন্দ্রনাথ সেন
ঠিক। ধন্যবাদ।
DeleteBhalo jhojhore bangla Biplab
ReplyDelete