রেডিওথেরাপি, রেডিওডায়াগনসিস ও নিউক্লিয় বিজ্ঞান
গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়
রেডিওথেরাপি কথাটার সঙ্গে আমরা সবাই কম বেশি পরিচিত। রেডিয়েশন অর্থাৎ বিকিরণের সাহায্যে দেহের অভ্যন্তরে ক্যান্সার বা ম্যালিগন্যান্ট টিউমারের কোষকে ধ্বংস করাকে বলে রেডিওথেরাপি। রেডিওডায়াগনসিস কথাটা অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত হলেও তার মানে বুঝতে অসুবিধা হয় না -- বিকিরণের সাহায্যে রোগনির্ণয়। এই লেখাতে আমরা রেডিওথেরাপি ও রেডিওডায়াগনসিসে নিউক্লিয় বিজ্ঞানের প্রয়োগ সম্পর্কে আলোচনা করব।
এই দুই ক্ষেত্রে ব্যবহৃত বিকিরণ নানা রকম হতে পারে। ক্যান্সারের রেডিওথেরাপিতে এক্স রশ্মির ব্যবহারের কথা অনেকেই জানি। অন্য ধরনের বিকিরণের মধ্যে পড়বে বিটা ও গামা রশ্মি, নিউট্রন, উচ্চশক্তির প্রোটন, ইত্যাদি। এদের সাধারণ একটা ধর্ম আছে যা রেডিওথেরাপিতে কাজে লাগানো হয়। কোনো পদার্থের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বিকিরণ সেই পদার্থকে আয়নিত করে। দেহের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় বিকিরণ যে আয়ন সৃষ্টি করে, তা কোশের ডিএনএ-কে ধ্বংস করে কোশের মৃত্যু ঘটায়।
১৯১১ সালে ম্যানচেস্টারে বিজ্ঞানী আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউক্লিয়াস আবিষ্কার করেন। নিউক্লিয়াস আবিষ্কারের আগেই কিন্তু নিউক্লিয় প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছিল। তেজস্ক্রিয়তার উৎস হল পরমাণুর নিউক্লিয়াস। ১৮৯৬ সালে তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার হওয়ার কিছু দিন পর থেকেই বোঝা গিয়েছিল যে ক্যান্সারের চিকিৎসাতে তাকে কাজে লাগানো যায়। ১৯০৩ সালের নোবেল পুরস্কারের জন্য প্রথমে তেজস্ক্রিয়তার আবিষ্কারের জন্য আঁরি বেকেরেল ও সেই বিষয়ে গবেষণার জন্য পিয়ের কুরিকে মনোনীত করা হয়। পিয়ের নোবেল কমিটিকে লিখে পাঠিয়েছিলেন যে তাঁর স্ত্রী মেরি ও তিনি একসঙ্গে সমস্ত কাজ করেছেন, তাই মেরির নামও থাকা উচিত। কমিটি তখন বাকি দুজনের সঙ্গে মেরির নামে জমা পড়া এক মনোনয়ন ব্যবহার করে মেরির নাম তালিকাতে ঢুকিয়েছিলেন। সেই মনোনয়ন দিয়েছিলেন শার্ল বৌশার্ড নামের এক ডাক্তার; চিকিৎসাতে রেডিয়ামের প্রয়োগের জন্যই তাঁর মাথায় পিয়ের ও মেরির কথা মনে এসেছিল।
রেডিওথেরাপিতে নানা পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। অনেক সময়েই ক্যান্সারগ্রস্ত টিউমারের কাছে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ রেখে তাকে ধ্বংস করা হয়। সাধারণভাবে তিন রকমের তেজস্ক্রিয়তা হয়। আলফা তেজস্ক্রিয়তাতে নিউক্লিয়াস থেকে আলফা কণা অর্থাৎ হিলিয়ামের নিউক্লিয়াস বেরিয়ে আসে। বিটা কণা হল ইলেকট্রন বা পজিট্রন। গামা তেজস্ক্রিয়তাতে নিউক্লিয়াস থেকে উচ্চশক্তির ফোটন কণা নির্গত হয়। তেজস্ক্রিয়াতে নির্গত আলফা কণার ভেদনক্ষমতা খুব কম, চামড়ার বাইরের মৃত কোশের স্তরই তাকে আটকে দেয়। তেজস্ক্রিয় পদার্থের প্রয়োগের ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপিতে কার্যকর বিকিরণটি হল মূলত বিটা রশ্মি।
বিটা রশ্মির ভেদনক্ষমতা আলফা রশ্মির থেকে বেশি হলেও খুব বেশি নয়, অর্থাৎ তা দেহের মধ্যে বেশিদূর যেতে পারে না। ফলে শুধুমাত্র টিউমার বা তার আশপাশের কোশগুলিই ধ্বংস হয়। সুতরাং বিটা তেজস্ক্রিয় পদার্থকে টিউমারের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তার জন্য নানা পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। উদাহরণ হিসাবে ধরা যাক থাইরয়েডের ক্যান্সারের কথা। দেহের অধিকাংশ আয়োডিন থাইরয়েড গ্রন্থিতে শোষিত হয় ও জমা থাকে। আয়োডিনের একটি তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ হল I-131। এই 131 হল ওই আয়োডিন আইসোটোপের ভরসংখ্যা অর্থাৎ নিউট্রন ও প্রোটনের মোট সংখ্যা। কোনো নির্দিষ্ট মৌলের নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সংখ্যা নির্দিষ্ট, কিন্তু নিউট্রন সংখ্যার হেরফের হতে পারে। পরিবেশে সাধারণ যে আয়োডিন পাওয়া যায়, তা হল I-127, তার নিউক্লিয়াসে আছে 53টা প্রোটন ও 74টা নিউট্রন। অন্যদিকে I-131-এর মধ্যে আছে 78টা নিউট্রন। একটা ক্যাপসুলের মাধ্যমে সোডিয়াম আয়োডাইড লবণ রোগীকে খাওয়ানো হয়, তার আয়োডিনটা হল I-131আইসোটোপ, এর থেকে বিটা কণা বেরোয়। আয়োডিন রক্তের মাধ্যমে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাইরয়েডে গিয়ে জমা হয় এবং তার থেকে নির্গত বিটা বিকিরণ সেখানকার ক্যান্সার কোশদের ধ্বংস করে।
প্রকৃতিতে এই I-131 পাওয়া যায় না; কেমন ভাবে তা তৈরি করা হয়? নিউক্লিয় রিঅ্যাক্টরে তৈরি হয় প্রচুর নিউট্রন। সেই নিউট্রন দিয়ে ইউরেনিয়ামের আইসোটোপ U-235-এর নিউক্লিয়াসকে আঘাত করলে তা ভেঙে যায়, একে বলে ফিশন বা বিভাজন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়াতে আরো অনেক নতুন মৌলের সঙ্গে I-131 তৈরি হয়; তাকে রাসয়ানিক পদ্ধতিতে আলাদা করা হয়। অন্য এক উপায়ে রিঅ্যাক্টরের নিউট্রন দিয়ে টেলুরিয়ামের আইসোটোপ Te-130-কে ধাক্কা দিলে সে নিউট্রনকে ধরে নিয়ে হয় Te-131। এটি ক্ষণস্থায়ী আইসোটোপ, বিটা ক্ষয়ের মাধ্যমে তা I-131-এ রূপান্তরিত হয়।
আধিকাংশ সময় এত সহজে একটা নির্দিষ্ট অঙ্গ বা গ্রন্থিকে নিশানা করা যায় না, তার জন্য অন্য পদ্ধতি আছে। যকৃতের টিউমারের ক্ষেত্রে ইট্রিয়াম বা হোলমিয়ামের তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ Y-90 বা Ho-166 কে কাচের তৈরি অতি ক্ষুদ্র গোলকের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। গোলকগুলির ব্যাস তিরিশ মাইক্রনের কাছাকাছি, মোটামুটি চারটে লোহিত রক্তকণিকার কোশের মতো। সেগুলিকে সরাসরি ইঞ্জেকশনের সাহায্যে যকৃতের ধমনীতে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। গোলকগুলি যকৃতের গিয়ে জমা হয় ও তার থেকে নির্গত বিকিরণ মাধ্যমে সেখানকার টিউমারের কোশগুলিকে অনেকটা মারতে সক্ষম হয়। সাধারণত টিউমারের আয়তন কমাতে এর ব্যবহার হয়, এর পরে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে টিউমারটিকে সরানো হয়। ইট্রিয়াম বা হোলমিয়ামের এই তেজস্ক্রিয় আইসোটোপদেরও রিঅ্যাক্টরে নিউট্রন বিক্রিয়ার সাহায্যে তৈরি করা হয়।
রেডিওথেরাপির এই পদ্ধতির পোশাকি নাম Selective Internal Radiation Therapy (SIRT)। এর সব থেকে বড় সুবিধা হল যে বিকিরণ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে, অন্য অঙ্গের ক্ষতি করে না। আরো একটা বড় সুবিধা হল যে কোনো দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থাকে না। ধরা যাক I-131-এর কথা। এর অর্ধায়ু কাল হল আট দিন, অর্থাৎ আট দিন পরে তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা কমে অর্ধেক হয়। তার অর্থ ওই আইসোটোপ থেকে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের মাত্রা মাসখানেকের মধ্যে কমে দশ শতাংশে পৌঁছে যায়। ইট্রিয়াম বা হোলমিয়েমের অর্ধায়ু কাল আরো কম, ফলে দীর্ঘস্থায়ী কোনো প্রভাব থাকে না। সেই কারণে বিকিরণের মাত্রা বা ডোজ অনেকটা বাড়ানো যায়।
এইরকম বহু তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ চিকিৎসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়। এই সমস্ত আইসোটোপের অধিকাংশই হল কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ, প্রকৃতিতে তাদের পাওয়া যায় না। নিউক্লিয় গবেষণা ছাড়া এই সমস্ত আইসোটোপ পাওয়া যেত না। কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা আবিষ্কার করেছিলেন মাদাম কুরির মেয়ে আইরিন জোলিও-কুরি ও তাঁর স্বামী ফ্রেডরিক জোলিও-কুরি। এ জন্য তাঁরা ১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
রোগ নির্ণয়ে তেজস্ক্রিয়তা ব্যবহারের উদাহরণ হল পেট (PET) স্ক্যান, পুরো কথাটা হল পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি। সাধারণ এক্স-রশ্মির বড়ো সমস্যা হল যে তা দিয়ে হাড়ের ছবি ভালো উঠলেও নরম কলা বা পেশী ইত্যাদির ছবি ভালো ওঠে না। কোনো কোনো কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়াতে পজিট্রন তৈরি হয়। পজিট্রন হল ইলেকট্রনের বিপরীত কণা, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই দুটি বিপরীত কণা একে অপরকে ধ্বংস করে দেয় ও দুটি 511 keV (কিলো ইলেকট্রনভোল্ট) গামা রশ্মি পরস্পর বিপরীতদিকে বেরোয়। এই গামারশ্মিগুলিকে ধরে কোন জায়গায় তারা সৃষ্টি হয়েছে জানা সম্ভব। সঙ্গের ছবিটাতে বিষয়টি সহজ করে দেখানো হয়েছে।
পজিট্রন এমিশন টোমোগ্রাফি
কোনো যৌগের পরমাণুতে সাধারণ আইসোটোপের বদলে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ব্যবহার করলে তাকে বলে ট্রেসার। এভাবে সাধারণ অণুর মধ্যে ট্রেসার ব্যবহার করাকে বলে ট্যাগিং। এখন ট্রেসার ব্যবহারের সঙ্গে সিটি (CT) স্ক্যানের সংযোগ ঘটিয়ে চালু হয়েছে স্পেক্ট (SPECT: Single Photon Emission Computed Tomography)। এই পদ্ধতিতে শিরা ও ধমনীর মধ্যে দিয়ে বিভিন্ন অঙ্গে রক্তের প্রবাহকে পর্যবেক্ষণ করা যায়। এখানেও গামা ক্যামেরার সাহায্যে আইসোটোপ থেকে বেরোনো গামা রশ্মিকে ধরা সম্ভব হয়। গামা ক্যামেরার কথা আগেও এসেছে। এতে থাকে একটি প্রতিপ্রভ পদার্থ, সাধারণত সোডিয়াম আয়োডাইড। গামা রশ্মি এসে সোডিয়াম আয়োডাইডে পড়লে তার থেকে আলোর ঝলক বেরোয়, সেই ঝলক পরে রাখা ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব নামের যন্ত্রে ধরা পড়ে। এভাবে একটি গামা ফোটনকেও (Single Photon) ধরা সম্ভব, তাই এই পদ্ধতির সুবেদিতা খুব বেশি। এই পদ্ধতিতে কিছু কিছু ক্যান্সার অন্য স্ক্যানের থেকে আগে ধরা পড়ে।
রিঅ্যাক্টর ছাড়াও নিউক্লিয়ার অ্যাক্সিলারেটরে বা কণাত্বরকে নিউক্লিয় বিক্রিয়ার মাধ্যমে এখন চিকিৎসাতে ব্যবহৃত আইসোটোপ তৈরি হয়। ১৯৪০-এর দশকে ভারতের প্রথম সাইক্লোট্রন অ্যাক্সিলারেটর তৈরির উদ্যোগ নিয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা, তাঁর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তৈরি করা। সেই সাইক্লোট্রনের জন্য প্রথম অর্থসাহায্য করেছিল টাটা চ্যারিটিজ ট্রাস্ট যারা তখন বম্বেতে ক্যান্সার হাসপাতাল বানাচ্ছিল। সেই পুরানো সাইক্লোট্রন অবশ্য বহুদিন বাতিল হয়ে গেছে, কিন্তু আধুনিক চিকিৎসার চাহিদা মেটাতে কলকাতার কাছেই নিউ গড়িয়াতে বসেছে এক নতুন সাইক্লোট্রন। ভারতের অন্য কণাত্বরকরা কখনো কখনো এইসব আইসোটোপ বানায়, কিন্তু এই নতুন সাইক্লোট্রনের প্রধান উদ্দেশ্যই হল তাই।
দেখা যাক কোন ধরনের আইসোটোপ এই সাইক্লোট্রনে তৈরি হয়। অক্সিজেনের একটা আইসোটোপ হল O-18। এটি তেজস্ক্রিয় নয়, সাধারণ অক্সিজেনের প্রতি পাঁচশো পরমাণুর মধ্যে একটি O-18-এর পরমাণু পাওয়া যায়।এই সাইক্লোট্রনে লক্ষ্যবস্তু হিসাবে যে জল ব্যবহার করা হয়, তাতে অবশ্য O-18 কিছু বেশি থাকে, যে পদ্ধতিতে তা করা হয় তাকে বলে এনরিচমেন্ট। সাইক্লোট্রন থেকে উচ্চশক্তি সম্পন্ন প্রোটন দিয়ে এই অক্সিজেনের সঙ্গে বিক্রিয়াতে তৈরি হয় পেট স্ক্যানে ব্যবহৃত F-18। এছাড়াও অন্য নানা পদ্ধতিতে তৈরি হচ্ছে Ge-68, I-123, Tl-201 এই সমস্ত আইসোটোপ। এদের থেকে গামা রশ্মি বেরোয়। স্পেক্ট-এ Ge-68, I-123 এই আইসোটোপদের ব্যবহার করা হয়। থ্যালিয়ামের আইসোটোপ Tl-201 হৃৎযন্ত্রের অবস্থা নির্ণয়ে ব্যবহার হয়।
স্পেক্ট-এ গ্যালিয়ামের আইসোটোপ, Ga-68 ব্যবহার হয়। কিন্তু তার অর্ধায়ু কাল খুব কম, মাত্র আটষট্টি মিনিট। তাই অন্যত্র তৈরি করে এনে রোগীর দেহে ব্যবহার সম্ভব নয়, তার আগেই সমস্ত পরমাণুর ক্ষয় হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে জার্মেনিয়ামের আইসোটোপ Ge-68-কে উৎস বা জেনারেটর হিসাবে ব্যবহার করা হয়। জার্মেনিয়ামের এই আইসোটোপটির অর্ধায়ু হল 271 দিন, ফলে একবার তৈরি করলে অনেক দিন চলে। জার্মেনিয়ামের বিটাক্ষয় থেকে গ্যালিয়াম তৈরি হয়, স্পেক্ট-এ ব্যবহারের সময় জেনারেটর থেকে গ্যালিয়ামকে বার করে নিয়ে কাজে লাগানো হয়।
যে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপটি চিকিৎসাক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ব্যবহার হয়, তা হল টেকনিশিয়ামের আইসোটোপ, Tc-99। টেকনিশিয়ামের সমস্ত আইসোটোপই তেজস্ক্রিয়, পৃথিবীতে তাদের পাওয়া যায় না। টেকনিশিয়ামের এই আইসোটোপের অর্ধায়ু কাল ছ' ঘণ্টা, ফলে প্রয়োগের এক দিনের মধ্যেই তার সমস্ত পরমাণু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। সেকারণে দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয়তার সমস্যা নেই। এর থেকে যে গামা রশ্মিটি বেরোয় তার শক্তি 140 keV। এই শক্তির গামা রশ্মি ক্যামেরাতে সহজেই ধরা পড়ে। প্রতি বছর কোটি কোটি রোগীর দেহে স্পেক্ট, বোন স্ক্যান সহ নানা রকম পদ্ধতিতে রোগনির্ণয়ে ট্রেসার হিসাবে ব্যবহার হয় এই আইসোটোপ।
এবার আমরা ক্যান্সারের চিকিৎসাতে একটা অপেক্ষাকৃত আধুনিক পদ্ধতির কথা বলব। শরীরের ভিতরে কোনো অংশের ক্যান্সারের চিকিৎসা করা বেশ শক্ত। রেডিওথেরাপিতে এর জন্য নানারকম পদ্ধতি নেওয়া হয়, থাইরয়েডের ক্যান্সারের কথা যেমন আগে বলেছি। অস্ত্রোপচার না করে বাইরে থেকে বিকিরণ দিয়ে ক্যান্সার ধ্বংসের জন্য সাধারণত এক্স রশ্মি ব্যবহার করা হয়। এর প্রধান সমস্যা হল যে এক্স রশ্মি যে শুধু ক্যান্সারের টিউমারের কোশগুলিকেই মারবে এমন নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তার আগে ও পরে শরীরের যে অঙ্গের মধ্যে দিয়ে যাবে সেখানকার কোশগুলিও ধ্বংস হবে। তার পরিবর্তে প্রোটন বা কার্বনথেরাপি ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর পোশাকি নাম পার্টিকলথেরাপি বা হ্যাড্রনথেরাপি। প্রোটন, নিউট্রন বা তাদের দিয়ে তৈরি নিউক্লিয়াস, এরা হল হ্যাড্রন। ইলেকট্রন কিন্তু হ্যাড্রন নয়। তাই হ্যাড্রনথেরাপি শব্দটাই সঠিকতর, তবে পার্টিকলথেরাপিই বেশি চালু।
দেহের কলার মধ্যে বিভিন্ন বিকিরণের শক্তি ক্ষয় |
দেহের অভ্যন্তরে কতদূরে টিউমারটি আছে, তা বিচার করে কণার গতিশক্তি ঠিক করা হয়। যেমন পঁচিশ সেন্টিমিটার ভিতরে টিউমার থাকলে প্রোটনের গতিশক্তি হতে হবে 200 MeV (মেগা ইলেকট্রনভোল্ট), কার্বনের জন্য প্রয়োজন 4500 MeV। কার্বন নিউক্লিয়াসের আধান প্রোটনের ছয় গুণ, তাই একই গভীরতাতে যেতে অনেক বেশি শক্তি প্রয়োজন হয়। সেই কারণে প্রোটনের থেকে কার্বন নিউক্লিয়াস টিউমারের মধ্যে বহু গুণ বেশি শক্তি জমা করে, ফলে কোশের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
প্রোটনথেরাপিতে প্রোটন কণা অর্থাৎ হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে অ্যাক্সিলারেটরের সাহায্যে নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তি দেওয়া হয়। কার্বন থেরাপিতে প্রোটনের জায়গা নেয় কার্বনের নিউক্লিয়াস। কোন গতিশক্তির প্রোটন বা কার্বন নিউক্লিয়াস মানবদেহের ভিতরে কতদূরে প্রবেশ করতে পারে, তা খুব নির্দিষ্ট। শুধু তাই নয়, প্রোটন বা কার্বনের নিউক্লিয়াসের আধান আছে, ফলে তড়িৎচৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করে খুব সরু রশ্মি (চালু কথায় পেনসিলের) আকারে পাঠানো সম্ভব; এক্স রশ্মি অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে টিউমারকে লক্ষ্য করে প্রোটন বা কার্বনকে পাঠানো যায়, অন্য কোনো অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। কণাগুলি পথে খুব একটা বেশি শক্তি খরচ করে না, যাত্রাপথের শেষে গিয়ে প্রায় সমস্ত শক্তিটা একবারে ছেড়ে দেয়। তার ফলে টিউমারের আগে বা পরে কণাদের পথে যে সমস্ত কোশ পড়ে তাদের ক্ষতি হয় অনেক কম। সেই কারণে চিকিৎসার সময় বিকিরণের মাত্রা অনেক বেশি করা সম্ভব। ফলে চিকিৎসার সময়ও কমানো যায়। কার্বনথেরাপিতে প্রোটনের থেকেও আরো সঠিকভাবে নির্দিষ্ট করে শুধুমাত্র টিউমারকে ধ্বংস করা সম্ভব। যে সব ক্ষেত্রে টিউমারটি মস্তিষ্কের মতো খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গের কাছে অবস্থিত, সেখানে পার্টিকল থেরাপি খুব কার্যকর হয়। প্রোটন বা কার্বনথেরাপিতে আরো একটা সুবিধা হল যে এর ফলে দেহের মধ্যে জমা হয় হাইড্রোজেন বা কার্বন। এই দুটি মৌল শরীরের মুখ্য উপাদানের মধ্যে পড়ে ও তারা আদৌ তেজস্ক্রিয় নয়। ফলে তেজস্ক্রিয়তার বিপদ নেই।
প্রোটনথেরাপির কথা প্রথম বলেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লরেন্স বার্কলে ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী রবার্ট উইলসন ১৯৪৬ সালে, কিন্তু তা পরীক্ষামূলকভাবে চালু হতে আট বছর পেরিয়ে যায়। হাসপাতালে প্রোটনথেরাপি প্রথম শুরু হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৯০ সালে। এখন পৃথিবীতে প্রায় দেড়শো প্রোটনথেরাপি কেন্দ্র আছে। আমাদের দেশে মুম্বাই-এর টাটা মেডিক্যাল সেন্টার ও চেন্নাই-এর অ্যাপোলো হসপিতালে এই ব্যবস্থা আছে। কার্বন থেরাপি শুরু হয় ১৯৯৪ সালে জাপানে। পার্টিকলথেরাপি কো-অপারেটিভ গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে পৃথিবীতে মোট পনেরটি কার্বনথেরাপি সেন্টার চালু আছে, তার মধ্যে সাতটিই জাপানে। বছরে পনের থেকে কুড়িহাজার রোগীর প্রোটন ও পাঁচ হাজার রোগীকে কার্বন থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা হয়।
হ্যাড্রনথেরাপি শুরু হয়েছিল দ্রুতগতির নিউট্রন দিয়ে ১৯৩৮ সালে, কিন্তু তা চিকিৎসার পক্ষে সুবিধাজনক ছিল না। আবার ১৯৬০-এর দশকে নতুন ভাবে অনেক জায়গায় শুরু হলেও বিরূপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার জন্য একটি কেন্দ্র ছাড়া বাকি সব গুলি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে নতুন এক পদ্ধতি পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। একে বলে বোরন নিউট্রন ক্যাপচার থেরাপি (BCNT)। এই পদ্ধতিতে টিউমারটিতে প্রথমে বোরনের আইসোটোপ B-10 প্রবেশ করানো হয়। এটি তেজষ্ক্রিয় নয়, তাই নিজে থেকে কোশের কোনো ক্ষতি করে না। এর পরে রিঅ্যাক্টর থেকে ধীরগতির নিউট্রন দেহের সেই অংশে ফেলা হয়। টিউমারের মধ্যের বোরন নিউট্রনের সঙ্গে বিক্রিয়াতে লিথিয়াম (Li-7) ও হিলিয়াম (He-4) নিউক্লিয়াস তৈরি করে। এই দুই নিউক্লিয়াসই খুব অল্প দূরত্ব গিয়েই থেমে যায়, ফলে তাদের পুরো গতিশক্তিটাই কোশের মধ্যে জমা পড়ে এবং টিউমারের কোশের মৃত্যু ঘটে।
তেজস্ক্রিয় নয় এমন নিউক্লিয়াসের ধর্মকেও রোগনির্ণয়ে ব্যবহার করা হয়, তার উল্লেখ করে শেষ করি। আমরা সবাই এমআরআই কথাটা শুনেছি। পুরো কথাটা হল নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং, কিন্তু নিউক্লিয়াস শুনলেই অনেকে ভয় পান বলে প্রথম শব্দটা আর ব্যবহার হয় না। বিজ্ঞানের পরীক্ষাগারে কিন্তু পুরো নামটাই চালু। অনেক নিউক্লিয়াসের চৌম্বক ভ্রামক (Magnetic moment) আছে, অর্থাৎ তারা শক্তিশালী চৌম্বকক্ষত্রের সঙ্গে ক্রিয়া করে। এই ধর্মকে কাজে লাগিয়ে দেহের ভিতরের বিভিন্ন অঙ্গের ছবি তোলা সম্ভব, সেটাই হল ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং। এই পদ্ধতি সব থেকে বড় সুবিধা হল যে এতে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। এক্স-রে দেহের ক্ষতি করে, এমনকি বেশি এক্স-রে থেকে ক্যান্সারও হতে পারে। এমআরআই-তে সেই সম্ভাবনা নেই। এমআরআই-এর সাহায্য টিউমারটিকে চিহ্নিত করা সম্ভব হলে তাকে ধ্বংস করার জন্য পার্টিকলথেরাপিতে কত শক্তি হওয়া প্রয়োজন তা নির্ণয় করা খুব সহজ। নিউক্লিয় ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স পদ্ধতি আবিষ্কার ও তার উন্নতির জন্য ১৯৪৪ সালে ইসিডোর রাবি এবং ১৯৫২ সালে ফেলিক্স ব্লখ ও এডওয়ার্ড মিলস পার্সেল পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।
বিজ্ঞানের অগ্রগতি যে এই একটি ক্ষেত্রে অন্তত মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হচ্ছে সন্দেহ নেই। মনে রাখতে হবে যে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কার্যকরী প্রমাণিত হয়েছে; অন্য সমস্ত পদ্ধতিরও প্রয়োজন আছে। ক্যান্সারের চিকিৎসায় পার্টিকলথেরাপির ব্যবহার ক্রমশই বাড়ছে। তবে সাধারণ চিকিৎসার থেকে পার্টিকলথেরাপির খরচ অনেক বেশি, তার কারণ যন্ত্রপাতির দাম। সেই কারণেও রোগীদের খুব কম অংশই এর সুযোগ নিতে পারে। এমন কি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো ধনী দেশেও কোনো কার্বনথেরাপি কেন্দ্র এখনো চালু হয়নি। আশা করা যাক ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি একে সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে আনবে।
আরো জানতে হলে
Scientific and technological development of hadrontherapy, Saverio Braccin, Astroparticle, Particle and Space Physics, Detectors and Medical Physics Applications. World Scientific (2010)
Particle Therapy Cooperative Group (PTCOG) website https://www.ptcog.site/
VECC Medical Cyclotron Facility website https://www.vecc.gov.in/r-d-activities/742
প্রকাশ - জনবিজ্ঞানের ইস্তাহার, শারদ ২০২৪
No comments:
Post a Comment